ঈশ্বর ভালো নেই – ৪

দমদম এয়ারপোর্টের সামনে যখন গাড়ি থামল, হাতঘড়িতে তখন ৫ টা ২৫। ঠিক সময়েই পৌঁছে গিয়েছে ওরা। লাগেজ যথাস্থানে রেখে ওরা ওয়েটিং লাউঞ্জে এল। কলকাতা থেকে সন্ধে ছটা নাগাদ গো এয়ার ফ্লাইট ছাড়বে। টিকিট আগে থেকেই বুক করা। সন্ধের আলতো প্রলেপ নেমে এসেছে শহর কলকাতার বুকে। পাতলা একটা হাওয়ার চাদর গায়ে জড়িয়ে রেখেছে মহানগরী। সূর্যাস্তের এই মুহূর্তটা বেশ মনোরম। পাখিগুলো দলবেঁধে ফিরে আসছে ওদের বাসায়। এক-এক করে জ্বলে ওঠা রঙিন আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে আচমকা। নৈসর্গিক এক রূপে সেজে উঠছে সন্ধের শহর। এয়ারপোর্টে মানুষের ভিড় একটু একটু করে বাড়ছে। সেই ভিড়ের মধ্যেই অসাবধানতাবশত কারোর সঙ্গে ধাক্কাও লেগে গিয়েছে ওদের। লাউঞ্জটা বেশ বড়োসড়ো। সামনের তিনটে সীটে বসে পড়ল ওরা। মৈত্রেয়ী মাঝেমাঝে ফোনে কারোর সঙ্গে কিছু কথা সেরে নিচ্ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে ওরা ফ্লাইটে উঠল। পাশাপাশি তিনটে বুক করা সিটে নম্বর মিলিয়ে বসার পর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ওরা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রা শুরু হবে। তারপর চোখের সামনে সেই মরুভূমির দেশ… সত্যজিতের চোখে দেখা সেই সোনার কেল্লা… চোখ বন্ধ করলেই টুকরো টুকরো স্মৃতি যেন মনের কোণে এসে ভিড় করতে থাকে। মৈত্রেয়ী উইন্ডোসীট বেশি পছন্দ করে। কিন্তু আজ ও মিমের দিকে তাকিয়ে বলল, “যা, জানলার সামনে গিয়ে বস।”

মিম এই প্রথমবার ফ্লাইটে চড়ছে। বাচ্চাটার চোখেমুখে অদ্ভুত এক উত্তেজনা আর আনন্দ মিশে রয়েছে। অনির্বাণের দিকে তাকাতেই অনির্বাণ হাসিমুখে বলল, “বোস… মাম্মাম তো বলল।”

“বাবাই, তুমি তাহলে আমার পাশে বসো”, হাত দিয়ে পাশের সীটে মিম বসতে বলে অনির্বাণকে।

“বেশ, আজ আমরা দু’জনে মিলে জানলা দিয়ে অনেক কিছু দেখতে দেখতে যাব”, অনির্বাণ বসে পড়ে মিমের পাশের সীটে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রীদের সবাইকে সীটবেল্ট বেঁধে নিতে বলা হয়। অনির্বাণের মনেও আজ অদ্ভুত এক খুশির ছোঁয়া লেগেছে। ও মনে মনে গুনতে থাকে, তিন, দুই, এক…

ফ্লাইটটা একটু একটু করে সামনের দিকে এগোতে থাকে। তারপর তার চাকা মাটি ছেড়ে বাতাসে ভর করে। মিম অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে জানলার বাইরে। তার চোখের সামনে অত বড়ো জায়গাটা একটু একটু করে ছোটো হয়ে যাচ্ছে। অনির্বাণ ওকে বলল, “দেখেছিস, আমাদের কলকাতা শহরটা কত ছোটো?”

— পিঁপড়ের মতো দেখাচ্ছে সব কিছু, বাবাই।

— একদম, আমরা এখন আকাশে অর্থাৎ যে আকাশের বুকে এতদিন ধরে কেবল পাখিদের উড়তে দেখেছিস, ঘুড়ি কেটে যাওয়ার পর যেখানে নির্নিমেষ ভেসে যেতে দেখেছিস, আজ সেই আকাশের বুকেই আমরা রয়েছি।

“আমরা পড়ে যাব না তো বাবাই?” মিম বড়ো বড়ো চোখে বলে ওঠে।

— না না, পড়ব কেন? এখানে এতগুলো মানুষ রয়েছে, এত সাবধানতা, তাহলে পড়ব কীভাবে?

— ওটা মেঘ বাবাই!

— কই দেখি… হুমম, ওই যে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যাচ্ছে আকাশের বুকে।

— আমি হাত বাড়িয়ে মেঘগুলো ছুঁতে পারব?

— এই জানলাগুলো আঠা দিয়ে আটকে দেওয়া, আমরা চাইলেও খুলতে পারব না।

— যাহ্, তাহলে কী হবে?

— আমরা এত ওপর থেকে নীচের জায়গাগুলো দেখব… দেখছিস, সবকিছু কত ছোটো হয়ে যাচ্ছে!

— আমরাও এত ছোটো?

— হুমমম… ওই দেখ ওটা হচ্ছে ভিক্টোরিয়া।

“কই”, একরাশ উৎসাহ নিয়ে জানালায় চোখ রাখে মিম।

খুব বেশিক্ষণের জার্নি নয় এটা। দু’ঘণ্টা দশ মিনিটের মধ্যে ওদের ফ্লাইট পৌঁছে যাবে জয়পুর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। মৈত্রেয়ী একটা ইংরেজি ম্যাগাজিন নিয়ে সেটার পাতা ওলটাচ্ছে। অনির্বাণ আর মিম জানলার বাইরের দৃশ্য উপভোগ করছে। ওদের আশেপাশে আরও কিছু প্যাসেঞ্জার। মিমের কাছে এসব নতুন। ও বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে লক্ষ করছে সবকিছু।

 বিজনেস ক্লাসে ওদের সিট, তাই খুব বেশি ভিড় নেই এই কম্পার্টমেন্টে। প্রত্যেকেই নিজের মতো ব্যস্ত। মিম এখন চুপচাপ চেয়ে রয়েছে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে। ওর কল্পনাপ্রবণ মন ইতিমধ্যেই নানারকম কল্পনার জাল বুনতে শুরু করে দিয়েছে। অনির্বাণ চুপচাপ লক্ষ করে যাচ্ছে মিমকে। এই বাচ্চারা অদ্ভুত এক সৃষ্টি। নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকেও একটা বাচ্চাকে সহজে বোঝা যায় না। সে যে কী কল্পনা করে, কী বলতে চায়— তা কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব না। মিম অনির্বাণের একটা দুর্বল জায়গা। তাই ওকে ভীষণ আগলে রাখে ও। মৈত্রেয়ী যতই বলুক যে, মিম এসেছে বলেই হয়তো ওদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে গেছে, কিন্তু অনির্বাণ এসব কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। সত্যিই! জন্ম দিলেই সবাই ‘মা’ হতে পারে না। অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে। চোখ বুজিয়ে নিজের কল্পনায় বহু বছর আগের মৈত্রেয়ীকে ও খুঁজে পেতে চায়। সেই ছটফটে মেয়েটা— যে মেয়েটার প্রেমে একসময় অনির্বাণ নিজেও ডুবেছিল। তখন অনির্বাণের বেশিরভাগ লেখায় মিশে থাকত শুধু মৈত্রেয়ী। প্রেমে পড়লে মানুষ সত্যিই বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। সে যে কী করে আর কী বলে, সেটা বোঝা মুশকিল। অনির্বাণের কল্পনায় মৈত্রেয়ী অনির্বাণের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসে। কখনও নিজের ব্যস্ততা দেখিয়ে অনির্বাণকে একলা করে দেয় না। ওদের মন খারাপের মুহূর্তগুলো কাটে গঙ্গার পাড়ে কিংবা কফি হাউসের সেই চিরপরিচিত টেবিলের দু’পাশে। অনির্বাণ এজন্যেই কল্পনা করতে এতটা ভালোবাসে, কারণ সেখানে বাস্তবের মতো এত জটিলতা থাকে না। ভালোবাসার মানুষগুলোকে অতি সহজেই আগলে নিয়ে তাদের জড়িয়ে ধরে একটা পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেলা যায়। কল্পনায় সেই মানুষগুলো কখনও মুখ ভার করে না। ওরা বোঝে, ওরা আগলে নেয়, ওরা ভালোবাসে। একটু একটু করে অনির্বাণের কল্পনায় মৈত্রেয়ী মিশে যেতে থাকে।

 সঠিক সময়ে গো এয়ার জয়পুর এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে। এতক্ষণ হয়তো বোঝা যায়নি, কিন্তু প্লেন থেকে নামার পর গা-টা বেশ শিরশির করতে লাগল। ওদের সঙ্গে জ্যাকেট ছিল, তাই আর দেরি না করে নিজেদের শরীরে বেশকিছু শীতবস্ত্র চাপিয়ে নিল ওরা। নিজেদের লাগেজ সংগ্রহ করে নিয়ে ওরা লাউঞ্জ ছেড়ে বাইরে বেরোল। সন্ধের অন্ধকার আরও একটু গাঢ় হয়েছে। তবে চারপাশে আলোর রোশনাই যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এয়ারপোর্টের বাইরে একটা রাস্তার দু’পাশে সারে সারে জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে। ওদের দেখে বেশ কয়েকজন ড্রাইভার এগিয়ে এল। ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে প্রত্যেকেই নিজেদের গাড়িতে ওদের শহর ঘোরানোর কথা জানাতে লাগলো। কিন্তু আগে থেকেই ওদের জন্য একটা গাড়ি এখানে বুক করে রাখা হয়েছিল। একটা প্ল্যাকার্ডে ওদের নাম লিখে সেই ড্রাইভার বেশ কিছুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল। ওরা খুঁজে নিয়ে সেই গাড়িতে উঠে বসে। ড্রাইভার ওদের লাগেজগুলো গাড়ির ডিকিতে তুলে নেয়। তারপর সীটে বসে ইঞ্জিনে স্টার্ট দেয়।

হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোতে থাকে গাড়ি। আগেরবার ওরা যখন এখানে এসেছিল, তখনকার তুলনায় বর্তমানে জায়গাটা বেশ কিছুটা আপডেটেড লাগল। নিখাদ চওড়া রাস্তার বুকে ওদের গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে চলেছে। শহরের বুকে তখন পাতলা কুয়াশার চাদর ছড়িয়ে পড়ছে একটু একটু করে। মিম এতক্ষণে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল, ওকে হালকা ঝিমোতে দেখে অনির্বাণ বুকে জড়িয়ে নেয় মিমকে। অনির্বাণের নরম বুকে মিম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘণ্টাখানেক পর ওদের গাড়ি এসে থামল জয়পুরের বিসাউ প্যালেস হোটেলের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের মেইন গেটে দাঁড়িয়ে ওরা দু’চোখ ভরে দেখতে লাগল জায়গাটা। পুরোনো আমলের এক বিখ্যাত রাজবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। কী অপূর্ব লাগছে হোটেলের পরিবেশটা। দোতলা হোটেল আর চারপাশে একটা মনোরম বাগান। চারদিকে দামি আলোর ঝালরে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সামনে পায়ে চলা পথের দু’পাশে বিভিন্ন রকম ফুলের গাছ লাগানো। বাগানের চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এত অপূর্ব কারুকার্য ছড়িয়ে রয়েছে এই জায়গায় যে, চোখ ফেরানো যায় না। ওরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই একজন পরিচারক বেরিয়ে আসে হোটেলের ভেতর থেকে। ওদের লাগেজগুলো তুলে নিয়ে ভেতরে চলে যায় সেই পরিচারক। অনির্বাণ আর মৈত্রেয়ী মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে চারপাশ। খুব মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে এখানকার বাতাসে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় ওরা।‌ এক-পা এক-পা করে ওরা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। সামনের প্রধান চত্বরটা কাঠের তৈরি। দেওয়ালে দামি ঝাড়লণ্ঠন। প্রত্যেকটা দরজার সামনে রেশমি পর্দা ঝুলছে। ওরা প্রথমে চেক-ইন করে নেয়। কামরা আগে থেকে বুক করা ছিল। ম্যানেজার একজন পরিচারকের হাতে চাবি দিয়ে হাসিমুখে ওদের বিদায় জানান। দু’পাশ দিয়ে সিঁড়ি বেঁকে উঠে গিয়েছে ওপরের দিকে। সামনের লাউঞ্জটা পেরিয়ে আসার পর এখানকার মেঝেটা ঠিক যেন চেকারবোর্ড ধাঁচের। ভেতরের অংশটা বিশাল চওড়া। সত্যিই, এই হল রাজপ্রাসাদ! মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পরিচারকের পিছনে পিছনে ওরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে যায়।

 রুমটা আরও সুন্দর। রুমের বাইরের দেওয়ালে রয়েছে রাজা-রাজড়ার আমলের বিভিন্ন ধরনের তরবারী। রুমের ভেতরটা অতি তৎপরতার সঙ্গে সাজানো গোছানো। দেওয়ালের গায়ে রকমারি সব চিত্রকলা। দামি কাঠের টেবিলের ওপর নানারকম আসবাবপত্র। কাঠের বিছানায় তুলোর গদির ওপর ধবধবে সাদা চাদর পাতা। মিমকে বিছানায় শুইয়ে দেয় অনির্বাণ। তারপর দুজনে মিলে ওদের রুমটা ঘুরেফিরে দেখতে থাকে। বেড রুমের পাশের ঘরটা একটা ছোটোখাটো লাইব্রেরি রুম। দেওয়ালের বুকে কাচের পাল্লা ঘেরা অংশে থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বই। শুধু বই রয়েছে বললে ভুল হবে, পাশের দু-একটা শোকেসে নানা রকমের অলঙ্কার, এমনকি বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্রও রয়েছে। কি অপূর্ব কারুকার্য সেসবের! একটা শোকেসের ভেতরে হাতির খুলি-ও রাখা রয়েছে। দেওয়ালের গায়ে নানা রকমের চিত্রকলা। রাজার আমলের নানারকম ঘটনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এইসব চিত্রে। রুমটা ঘুরে দেখতে দেখতে অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় মন। সিলিংয়ের রাজকীয় ঝাড়লণ্ঠন কেমন যেন অন্যরকম অনুভূতি জাগায়। দেওয়ালের গায়ে হাত বুলোতে থাকে মৈত্রেয়ী। তার দু’চোখের তারায় না-বলা প্রশ্নেরা ভিড় করে রয়েছে। অনির্বাণ মৈত্রেয়ীর কোমরটা ধরে ওকে নিজের কাছাকাছি নিয়ে আসে। দুজনে এখন মুখোমুখি। অনির্বাণের নরম আঙুল খেলা করছে মৈত্রেয়ীর সারা মুখে। চোখ বুঝে যায় মৈত্রেয়ীর। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ও। অনির্বাণ ফিসফিসিয়ে বলে, “আমরা অবশেষে বালির রাজ্যে, তাই তো!”

— হুমমম।

“তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে আজ, জানো মিতু”, গভীর স্বরে বলে ওঠে অনির্বাণ।

“তাই-ই!” মৈত্রেয়ীর স্বরে মাদকতা।

অনির্বাণের গরম নিঃশ্বাস পড়ছে মৈত্রেয়ীর কপালে। অদ্ভুত একটা ছটফটানি চলছে ওদের শরীর আর মন জুড়ে। মুহূর্ত কেটে যায়, ওরা একে-অপরের হাতের বাঁধনে আটকা পড়েছে। দু’জোড়া চোখ যেন একে অপরকে প্রাণ ভরে দেখছে। চারপাশ একটু একটু করে অস্পষ্ট হতে শুরু করেছে। অনির্বাণের ঠোঁটদুটো মৈত্রেয়ীর ঠোঁটের দখল নেওয়ার আগেই মৈত্রেয়ী থামিয়ে দিল ওকে।

“কী হল?” প্রশ্ন করে অনির্বাণ।

“এখন না… এই সময়ে আমি শাওয়ার নেব।” ফিসফিস করে জানায় মৈত্রেয়ী।

— এখনই?

— হুমম… এখনই।

“আচ্ছা যাও।” ছোটোখাটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনির্বাণ।

— আমি চেঞ্জ করে আসি, তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও।

— বেশ।

অনির্বাণ প্রথমে বাথরুমে ঢোকে। বাথরুমটা বিশাল। মেঝের সাদা পাথরে যেন আলো পিছলে যাচ্ছে। একপাশে শাওয়ার আর তার উলটো দিকে বাথটব। বেসিনের সামনে বেশ বড়ো আকৃতির একখানা আয়না। চোখেমুখে, শরীরে জলের ছিটে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করতে থাকে অনির্বাণ। ওর কলার-বোন, পুরুষালী বুকের ভাঁজ, হালকা অ্যাবস আর নাভির গভীরে কে জানে কত রহস্য লুকিয়ে রয়েছে! জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে ওর বুক আর পিঠ বেয়ে। বুকের লোমের আড়ালে জমে রয়েছে ঘামের ফোঁটা। ওর দাঁড়ি-গোঁফের আড়ালে পুরু ঠোঁট দুটো যেন কত জন্মের তেষ্টা নিজের গভীরে লুকিয়ে রেখেছে। আচ্ছা, ওর চোখ দুটো কি ভীষণ মায়া জড়ানো! ওর চওড়া কপাল, টিকালো নাক, পাতলা কোমর, মেদহীন শরীর— এসব কি আদৌ কোনো মেয়ের মনে লোভ জাগাতে পারে! হঠাৎ ঘোর কাটে অনির্বাণের। ছিঃ ছিঃ! এসব কী ভাবছে ও? আজকাল এত অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসে… নিজের ওপরেই বিরক্ত হয় অনির্বাণ। এমন সময় মৈত্রেয়ী দরজায় হালকা নক করে, “অনি… হল?”

— হুমম, আসছি।

“তোমায় আসতে হবে না”, বলতে বলতেই ভেজানো দরজা খুলে বাথরুমে ঢুকে পড়ে মৈত্রেয়ী। ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় অনির্বাণ। মৈত্রেয়ীর শরীরে এখন কেবল একটা পাতলা তোয়ালে জড়ানো। তাতে ওর বুকের ভাঁজ থেকে শুরু করে শরীরের কোমলতা স্পষ্ট। নিয়মিত ওয়াক্স করায় ওর শরীরে লোমের লেশমাত্র নেই। বাথরুমের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয় মৈত্রেয়ী। ওর দু’চোখে একটা দুষ্টুমি ঝিলিক মারছে। অনির্বাণের দিকে এগিয়ে আসে ও। হাত বাড়িয়ে শাওয়ার চালিয়ে দেয়। গরম জলের ধারা লাফিয়ে নামে ওদের ওপর। হাত বাড়িয়ে অনির্বাণকে নিজের কাছে টেনে নেয় মৈত্রেয়ী। অনির্বাণ মৃদু আপত্তি করতে যেতেই দু’হাত দিয়ে ওর মাথাটা সামনে টেনে মৈত্রেয়ী ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। একটু একটু করে সেই মাদকতায় মিশে যেতে থাকে অনির্বাণ। দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ও মৈত্রেয়ীকে। জলের ধারায় একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছে দুটো মানব শরীর। অনির্বাণ পাগলের মতো চুমু খেতে থাকে মৈত্রেয়ীর গালে, ঘাড়ে, বুকের ভাঁজে, পিঠে। মৈত্রেয়ী আঁকড়ে ধরে ওকে। শাওয়ারের জলের আড়ালে একটু একটু করে ঝাপসা হতে থাকে সুতোবিহীন শরীর দুটো।

.

রাতে বেশ এলাহী খাবার-দাবারের ব্যবস্থা ছিল। হোটেলে মোট তিনখানা রেস্তরাঁ। রেস্তরাঁগুলো এক-একটা বড়োসড়ো জায়গা নিয়ে বানানো। ওদের মতোই আরও বেশ কতগুলো পরিবার একসাথে ডিনার করেছে। সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিল যে, ডিনারের সময় সামনের ছোটো মঞ্চ মতো একটা অংশে রাজস্থানী নৃত্য পরিবেশন করেছে স্থানীয় কয়েকজন। মিম তো খুবই উপভোগ করেছে এগুলো। ওর চোখে-মুখে আনন্দের রেশ ছড়িয়ে পড়তে দেখে অনির্বাণ মনে মনে ভীষণ তৃপ্তি পেয়েছিল। হাততালি দিয়ে, মাথা নেড়ে নেড়ে একটু একটু করে মিম বুঝতে চেষ্টা করেছে বিষয়গুলো। তা ছাড়া খাবার ভীষণ সুস্বাদু লেগেছে ওদের সবার। মোট মিলিয়ে খুব সুন্দর সময় কাটিয়েছে ওরা। রাতে বিছানায় শুয়ে সারাদিনের ঘটনাগুলো এক-এক করে সাজাচ্ছিল অনির্বাণ। মিম ওর পাশে গভীর ঘুমে মগ্ন। মৈত্রেয়ী বারান্দায় দাঁড়িয়ে শহরের সৌন্দর্য দেখছে। ওর পরনে বেগুনি রঙের ফিনফিনে হাউসকোট। হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। রাত যত গভীর হয়, জয়পুরের সৌন্দর্য হয়তো ঠিক ততটাই বাড়ে। মাথার ওপর কালচে নীল রঙের আকাশের বুকে একটা দুটো করে তারা ফুটে উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আনমনা হয়ে যায় মৈত্রেয়ী। এমন সময় পিছন থেকে ওর কাঁধে হাত রাখে অনির্বাণ। একটু চমকে যায় ও, “উফ্… ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে তো!”

— এত সিগারেট কি না খেলেই নয়, মিতু? শরীরটা খারাপ করবে যে!

— তুমি তো জানো অনির্বাণ, আমি টেনশনে থাকলে সিগারেট ছাড়া কোনো উপায় নেই।

— কিন্তু এখন তুমি কীসের টেনশনে রয়েছ?

— ও তুমি বুঝবে না, আমাদের ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার।

— যে কটা দিন আমরা ঘুরতে এসেছি, সে কটা দিন এতটা চিন্তা না করলেই কি নয়?

— আচ্ছা বেশ… তারপর বলো, ডিনারটা কেমন লাগল?

— আমার তো ব্যাপক লেগেছে… আর কী যেন একটা পদ… আমার ঠিক নামটা মনে পড়ছে না… ওই যে কী যেন… চুড়মুর সামথিং…

— দাল বাটি চুর্মা?

— হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটাই… ওটা বেশ ভালোই লাগল।

— কাল থেকে আমরা এই শহরটা ঘুরে দেখব… আমাদের গাইড মিঃ শীর্ষেন্দু বণিক দশটার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিয়ো।

— হুমম, সে তো ঠিক আছে… তবে ম্যাডাম, আপনি সবসময় এত চাপ একলা নিলে আমারও যে ভালো লাগে না… আমাকেও আপনার চাপের ভাগীদার করুন একটু।

— সবকিছু সবার জন্য নয় অনির্বাণ… বললাম তো, আমি এখন কাজ নিয়ে কিছু ভাবছি না। কাল থেকে আমাদের একটা নতুন যাত্রা শুরু হবে, সে নিয়েই না হয় ভাবনাচিন্তা করা যাক।

— আচ্ছা বেশ, ঘুমাবে তো নাকি? কাল তো আবার সকাল সকাল উঠতে হবে।

“হুমম চলো।” সিগারেটের বাকি অংশটা ফেলে দেয় মৈত্রেয়ী।

নাইট ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে ঘরের মেইন লাইট অফ করে দেয় ওরা। ঘরের মধ্যে এখন একটা নরম নীলচে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। খুব দূর থেকে একটা রাজস্থানী গানের সুর ভেসে আসছে। সেই সুর যেন একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে সারা শহর। রাতের গভীরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সেই সুরের ভঙ্গিমা ক্রমশ পালটাতে থাকে।

.

ঘড়ির কাটায় দশটা বাজার কিছুক্ষণ আগেই ওদের গাইড মিঃ বণিক পৌঁছে গিয়েছেন। ওঁর জিপেই আপাতত পনেরোটা দিন পুরো রাজস্থান ঘুরে দেখবে ওরা। শীর্ষেন্দুবাবু মাটির মানুষ। ওদের দেখে মিষ্টি হেসে নমস্কার জানালেন প্রথমে, “আসুন ম্যাডাম, আসুন স্যার, এই গরিবের জিপে আপনাদের পদধূলি দিন।”

“আপনি পারেন বটে”, মৈত্রেয়ী হেসে ফেলে, “তাও ভাগ্যিস আপনি ছিলেন, নাহলে আমাদের কী যে হতো! আর সত্যি বলতে এখানকার রাজস্থানী কিংবা হিন্দি ভাষায় ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে সবকিছু বোঝানো… ওহ মাই গড, ভয়ঙ্কর ব্যাপার।”

— এত বছর ধরে এখানে আছি আমি, এখানকার সব ভাষাতেই অভ্যস্ত বলতে পারেন।

— সেদিক দিয়ে তো আমাদের ভালোই হল, কোনো অসুবিধে হলে আপনি ম্যানেজ করে দিতে পারবেন।

— একদম।

ওরা তিনজন শীর্ষেন্দুর জিপে উঠে বসে। দিনের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। পিচের রাস্তা দিয়ে ওদের গাড়ি দুরন্ত গতিতে ছুটে চলে। যেতে যেতে শীর্ষেন্দু ওদের সঙ্গে বেশ কিছু পুরোনো ইতিহাস নিয়ে আলোচনায় মেতে ওঠেন, “আপনারা যে হোটেলে উঠেছেন, সেই হোটেলের পুরোনো ইতিহাস জানেন?”

— না তো… এটা পুরোনো আমলের রাজার রাজবাড়ি ছিল সেটা জানি, কিন্তু এটা বাদে আর কোনো ইতিহাস জানা নেই।

— মহারাজা সওয়াই জগৎ সিংয়ের আমলে ১৯ শতকে বানানো হয় এই প্যালেস। বাইরের অংশটা মূলত রাজা রঘুবীর সিংজির প্যালেস ছিল। ১৯৭৭ সালে প্যালেসটাকে হোটেলে পরিণত করা হয়। এ এক ঐতিহাসিক হোটেল। এই হোটেলের বিভিন্ন জায়গায় যেসব অস্ত্রশস্ত্র আছে, তা দিয়ে কিন্তু একসময় রাজা মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। আমি আমার পূর্বপুরুষদের মুখে এসব রাজা-রাজড়াদের লড়াইয়ের গল্প প্রচুর শুনেছি… মেবারের রানী পদ্মাবতীর মতো এখানকার এক রানী ছিলেন ইন্দুবালা, রাজা চন্দ্রদ্বীপ সিংয়ের স্ত্রী। শুনেছিলাম রানী যতটা না রূপসী ছিলেন, তার থেকেও বেশি গুণবতী ছিলেন। ওঁর শ্যামলা রং তাবড় তাবড় সুন্দরীদের ঈর্ষার কারণ ছিল। তবে রানীর পছন্দের একটা কাজ ছিল সেতার বাজানো। উনি যখন গান ধরতেন, তখন সারা রাজবাড়ি বিমোহিত হয়ে সেই গান শুনত। এই খবর গিয়ে পৌঁছেছিল মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছে। তিনি তখন রানীকে নিজের চোখে দেখার জন্য যাত্রা করেন এখানকার উদ্দেশ্যে। এখানকার মানুষজন ছেড়ে দেবে নাকি! তারা কিছুতেই মুঘলদের রাজপুত নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করতে দেবে না। ব্যস! শুরু হল এক ভয়ানক যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে কত মানুষ যে প্রাণ হারাল, তার ইয়ত্তা নেই। রানী ইন্দুবালা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন তার প্রজাদের এই অবস্থা দেখে। শোনা যায় তিনি নাকি এমনই একদিন নিজের ঘরে সেতার নিয়ে বসে দরজা বন্ধ করে দেন ভেতর থেকে। সারারাত ধরে রাজ্যের সকল মানুষ শুনেছিল রাজবাড়ি থেকে সেতারের সুর ভেসে আসছে। তবে সেই সুর যেন ভীষণ করুণ! যেন কোনো অবলা অসহায়া কাকুতি-মিনতি করছে ভগবানের কাছে। মোঘল সেনারাও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই সুর শুনে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার এটাই যে, সেই দিনের পর থেকে রানীকে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বন্ধ দরজার ওপাশে সারা ঘর ফাঁকা পড়েছিল। কিন্তু রানীর চিহ্নমাত্র ছিল না সেই ঘরে। সারা রাজ্য তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইন্দুবালাকে আর কেউ কোনোদিন দেখতে পায়নি। রাজা-রানীর একমাত্র সন্তান বিম্বাইয়া, রাজার মৃত্যুর পর রাজ্যের হাল ধরে। তারপর এক এক করে নানারকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে এই বিসাউ প্যালেস। সব ঘটনা হয়তো সবাই জানে না, আবার অনেকেই আছে বলতে চায় না। কারণ ওরা চায় না ওদের এই সংস্কৃতি, ওদের ঐতিহ্য— এসব বাইরের মানুষের কাছে কেবল একটা গল্প হয়ে যাক।

 ওরা তিনজনেই মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনছিল। গল্প শেষ হতেই অনির্বাণ বলে ওঠে, “অপূর্ব… এই রাজস্থান সত্যিই ভীষণ ইন্টারেস্টিং একটা জায়গা… এর প্রাচীরে প্রাচীরে লুকিয়ে রয়েছে রাজা-মহারাজাদের কখনও প্রকাশ না পাওয়া অনেক সত্য… গুগলে আমরা কতটাই বা জানতে পারি! আসল ঘটনা তো জমে রয়েছে এখানকার মানুষদের স্মৃতিতে।”

“এখানকার প্রত্যেকটা জায়গার আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য আর ইতিহাস রয়েছে”, শীর্ষেন্দু জবাব দেয়, “আমরা কতটাই বা জানি… তবে বেশিরভাগটাই নির্ভর করছে যাত্রীদের আগ্রহের ওপর… যারা ইন্টারেস্টেড থাকে, তাদের কিছু কিছু গল্প বলি আমরা। আর যারা কেবল ঘুরতে আর ছবি তুলতে আসে, তাদের গল্প শোনার ধৈর্য্য থাকে না।”

— জয়পুরকে ‘পিঙ্ক সিটি’ কেন বলা হয়, তার কারণ তো আমরা জানি। কিন্তু এখানকার অন্য কোনো ইতিহাস আছে নাকি?

— ইতিহাসই তো এখানকার একমাত্র সম্বল… ১৭২৭ সালে আমের রাজ দ্বিতীয় জয় সিংয়ের আমলে এই শহরের গোড়াপত্তন হয়। বর্ধিত জনগোষ্ঠী আর পানীয় জলের সহজলভ্যতার সুবিধার্থে রাজার নির্দেশে বিদ্যাধর ভট্টাচার্য শহরের স্থাপত্যনকশা করেন। জয়পুরের রাজপরিবারের শেষ রাজা ছিলেন ভবানী সিং। রাজার কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। তাই নিজের মেয়ের সন্তান, মানে নাতিকেই তিনি সেই পরিবারের রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনিই এখন উদয়পুরের মহারাজ পদ্মনাভ সিং। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে এই রাজপরিবারের।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন