গাড়ি চলতে শুরু করেছিল। অনির্বাণ মিমকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে যে, ওর কোথাও আঘাত লেগেছে কিনা! মিমের তেমন কোনো অভিব্যক্তি নেই। যেন কিছুই হয়নি, এমন একটা মুখ করে ও বসে রয়েছে চুপচাপ। পকেট থেকে রুমাল বের করে সেটা একটু ভিজিয়ে নিয়ে কপালের রক্তটা মুছে নেয় অনির্বাণ। তারপর একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “শীর্ষেন্দু বাবু, আপনি তখন রিভলবার বের করেছিলেন পকেট থেকে?”
“কী মনে হয়?” গাড়ি চালাতে চালাতে মুচকি হাসে শীর্ষেন্দু।
— না মানে… আপনার কাছে লাইসেন্স আছে?
— দেখুন স্যার, এগুলো এখানকার প্রাইভেট ব্যাপার। না জানাই ভালো, তবে জিজ্ঞেস যখন করলেন তখন এটা জেনে রাখুন, এখানকার মানুষজনের কাছে এরকম আগ্নেয়াস্ত্র হামেশাই থাকে। কখন কী হয়, বলা তো যায় না!
— নিমেষে আপনি এতটা পালটে গেলেন… আমরা জাস্ট অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
— আমরা মানুষগুলো অনেকটা নারকোলের মতন। ভিতরে একরকম, বাইরে আর একরকম। টুরিস্টদের কাছে আমাদের কোনো ব্যাড ইম্প্রেশন ফেলি না আমরা। তবে এটা রাজস্থান, এর এক-একটা কোণায় প্রচুর রহস্য লুকিয়ে আছে। সবকিছু ওভাবে জানানো যায় না।
“সেটাই তো দেখছি”, অনির্বাণ জানলা দিয়ে গাড়ির বাইরে তাকায়।
মিনিট দশেকের মধ্যে একটা মেডিকেল স্টোরের সামনে গাড়ি থামায় শীর্ষেন্দু। অনির্বাণ, মৈত্রেয়ী আর মিমকে ভেতরে নিয়ে যায় সে। তারপর দোকানদারের সঙ্গে খুচখাচ কিছু কথা বলে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্রুত হাতে ওদের ক্ষতস্থানে মলম দিয়ে পট্টি বেঁধে দেন ভদ্রলোক। হিসেব মিটিয়ে গাড়িতে বসে ওরা।
“আর কোনো সমস্যা নেই তো?” শীর্ষেন্দু প্রশ্ন করে।
“না না, আপনি চলুন”, মৈত্রেয়ী জবাব দেয়।
রাস্তার দু’পাশের ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলে গাড়ি।
.
জয়সলমীর শহরটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর। চারদিকে হলুদ পাথরের প্রাসাদ। সোনার কণার মতো ধুলো উড়িয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে হাইরোড দিয়ে। হলুদের মধ্যিখানে মরু অঞ্চলের সবুজ গাছপালা ওদের মন কেড়ে নিল। দু’চোখ ভরে ওরা তাকিয়ে দেখছে চারপাশ। এ-গলি সে-গলি করে অবশেষে ওদের গাড়ি থামল হেরিটেজ হাউসের সামনে। এই হোটেলটাও অদ্ভুত রকমের সুন্দর। হলুদ রঙের মার্বেল পাথরের দোতলা হোটেল। ব্যস্ত জনজীবনের থেকে একটু দূরত্বে হোটেলটা, তাই আশেপাশের পরিবেশ বেশ শান্ত। ওরা ভিতরে গিয়ে চেক ইন করে নেয়। তারপর চাবি নিয়ে রুমে ঢুকে বিছানায় বসে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অনির্বাণ বিছানার ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়েছিল, মিম ওর পাশেই। মৈত্রেয়ী প্রথমে ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকল। এই হোটেলের বাথরুমটা বিউস প্যালেসের মতো অতটা চওড়া না হলেও বেশ নিখুঁতভাবেই বানানো। শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে সারাদিনের সমস্ত ধকল ঝেড়ে ফেলতে থাকে মৈত্রেয়ী। হাতের ব্যান্ডেজ বাঁধা অংশে যাতে জল না লাগে, তাই হাতটা নিরাপদ দূরত্বে রাখে ও। চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৈত্রেয়ী। মনের ভিতরে একটা অস্বস্তি বারবার জট পাকাচ্ছে। দুর্ঘটনাটা ঘটার পর থেকেই মেজাজটাই খিঁচড়ে রয়েছে। আহম্মকের মতো কেউ গাড়ি চালায় এমন… বিরক্তিকর!
শাওয়ারের জলের ধারায় একটু একটু করে শরীর আর্দ্র হচ্ছে, সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওর বিরক্তির ভাব কমছে। আজ একটু বেশিক্ষণ সময় নিয়ে স্নান সারল সে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে আস্তে আস্তে শরীরে লেগে থাকা জলের শেষ বিন্দুটা অব্দি মুছে নিল। তারপর মাথা মুছে ওয়ান পিস পড়ে বেরিয়ে এল বাইরে। স্নান করে শরীরটা বেশ ফ্রেশ লাগছে। ঘরের জানলা দিয়ে নরম রোদ ভেতরে এসে পড়েছে। সেই রোদটা শরীরে মেখে নিতে নিতে ও নরম গলায় বলল, “অনি… যাও স্নান সেরে এসো… কিছুক্ষণ পরেই শীর্ষেন্দু দা চলে আসবেন, বেরোতে হবে তো নাকি!”
“স্নান সেরে বেরোনোর পর তোমাকে এতটা স্নিগ্ধ লাগে যে, মনে হয় যেন সারাক্ষণ তাকিয়েই থাকি”, ভাবুক দৃষ্টিতে মৈত্রেয়ীর দিকে তাকিয়ে জবাব দেয় অনির্বাণ।
“তাই নাকি”, হেসে ফেলে মৈত্রেয়ী, “আর ঢং করতে হবে না, তাড়াতাড়ি যাও।”
— তুমি হাসলে এতটা সুন্দর লাগে, অথচ সবসময় মুখ গোমড়া করে থাকো কেন বলো তো?
— অত উত্তর আমি দিতে পারছি না। তুমি তাড়াতাড়ি যাও… খেয়েদেয়ে বেরোতে হবে আমাদের। বাই দ্য ওয়ে, তোমার সঙ্গে মিমকেও স্নান করিয়ে দাও একেবারে।
“যো হুকুম ম্যাডাম”, বলে অনির্বাণ শুয়ে থাকা মিমের পেটে কাতুকুতু দেয়। খিলখিল করে হেসে ওঠে মিম। অনির্বাণ “চলুন মিম বাবু, স্নান সেরে আসি”, বলে মিমকে কোলে তুলে নেয়।
বাথটবে বসে স্নান করতে করতে মিম হঠাৎ বলে, “আমরা এখন কোথায় আছি বাবাই?”
“আমরা আছি জয়সলমীরে”, কথাটা বলেই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায় অনির্বাণ। ওর মনে পড়ে যায় বহুদিন আগে মিমের বলা সেই কথাগুলো। এমনই কোনো অ্যাক্সিডেন্টের কথা বলেছিল না ও!? আচ্ছা… এটা কি জাস্ট একটা কো-ইনসিডেন্ট? নাহলে…! চিন্তায় ডুবে যায় অনির্বাণ।
— কী ভাবছ বাবাই?
“হ্যাঁ… নাহ্ কিছু না”, অনির্বাণ প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করে।
— জানো বাবাই, আমি ওকে দেখেছি।
— কাকে?
— জানি না, কিন্তু মনে হল আমি ওকে দেখেছি।
— কী দেখেছ মিম… বলো আমায়।
— সেই চোখ দুটো।
“কার চোখ! কীসের চোখ?” অধৈর্য্য হয়ে ওঠে অনির্বাণ।
— এখানে সেই ঈশ্বর থাকেন… তোমায় বলেছিলাম, মনে আছে!
— কোথায়?
— আমি জানি না, কিন্তু ও জানে… বাবাই, তুমি আর আমি দুজনে মিলে সেই ঈশ্বরের খোঁজে বেরোব… যাবে তো বাবাই?
এই দিনের বেলাতেও গা-টা কেমন যেন ছমছম করে ওঠে অনির্বাণের। মিমের কথাবার্তা আজকাল বুঝতে পারে না ও। কেমন যেন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলছে মিম। কাকে দেখেছে ও? কীসের চোখের কথাই বা বলছে? কী রহস্য আছে এর পেছনে!
বেশিকিছু চিন্তা করতে পারে না অনির্বাণ। তার আগেই দরজায় নক করে মৈত্রেয়ী, “কীগো হল? এতক্ষণ ধরে কী করছ দুজনে!”
— হুমম, আসছি।
খাওয়া-দাওয়া সেরে শীর্ষেন্দুর গাড়িতে জয়সলমীর ঘুরতে বেরোল ওরা। শীর্ষেন্দুকে দেখলে মনেই হবে না সকালবেলা ওর চেহারা মুহূর্তে বদলে গিয়েছিল। সেই আগের মতোই শান্তশিষ্ট হাসিখুশি এক গাইড। যতক্ষণ ওদের সঙ্গে থাকে— নানারকম মস্করা, হাসি ঠাট্টা করতে থাকে। দেখলে একবারও মনে হবে না যে, এই লোকটাই পকেটে রিভলবার ক্যারি করছে। যেন হাসতে হাসতেই মানুষ খুন করে দিতে পারে ও! মৈত্রেয়ী স্বাভাবিকভাবেই হেসে হেসে কথা বলে চলেছে শীর্ষেন্দুর সঙ্গে। কিন্তু অনির্বাণ যেন ভিতরে ভিতরে ভীষণ অশান্ত হয়ে উঠছে। এখানে আসার আগে পর্যন্ত এসব চিন্তা ওর মাথায় আসেনি। সত্যিই তো! এই জয়সলমীরের কোনো একটা জায়গায় সেই দ্বিতীয় ঈশ্বর থাকেন। কিন্তু কোন্ জায়গায়? ভুল করে সেরকম কোনো জায়গায় নিয়ে যাবে না তো শীর্ষেন্দু! কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে ওর। আচ্ছা অনির্বাণ কি একটু বেশিই ভাবছে! তা ছাড়া একটা বাচ্চার মনগড়া কিছু বিষয়কে ও কি বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলছে? কিন্তু ওদের ফ্ল্যাটের সেই বৃদ্ধ প্রতিবেশী! উনিও তো এমন কিছুই…
আর ভাবতে পারে না অনির্বাণ। তার আগেই শীর্ষেন্দুর গলা শোনা যায়, “এই হচ্ছে সেই জয়সলমীর ফোর্ট।”
দিনের আলোয় জ্বলজ্বল করছে জয়সলমীর দূর্গ। এটাকে সত্যিই ‘সোনার কেল্লা’ না বলে উপায় নেই। সত্যজিতের সেই সোনার কেল্লা! কত রহস্য জমে রয়েছে এই কেল্লার বুকের প্রত্যেকটা পাথরে। যেন কেল্লার গায়ে কান পাতলেই শোনা যাবে সেসব! চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে ওরা কেল্লার মধ্যে প্রবেশ করে।
শীর্ষেন্দু বলতে থাকে, “এই জয়সলমীর কিন্তু ভাট্টি রাজাদের রাজ্য… ওঁরা যাদব বংশের লোক। রাজা জয়সল সিং তেজস্বী এক সাধুর আদেশে ওঁর রাজ্য পুনঃস্থাপিত করেন এই শহরে। ত্রিকূট পর্বতের ওপর বানানো এই কেল্লার প্রচুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তা ছাড়া শহরের নামকরণের পিছনেও রাজা জয়সল আর এই পর্বতের ভূমিকা কম নয়।”
“কীভাবে?” প্রশ্ন করে মৈত্রেয়ী।
— রাজার নাম থেকে জয়সল আর মেরু ( পাহাড় ) থেকে মীর… জয়সলমীর।
— বাহ্!
তিনকোণা আকৃতির কেল্লার প্রবেশপথে চারটে গেট। শীর্ষেন্দু চিনিয়ে দেয় কোন্টা অক্ষয় পোল, সুরাজ পোল, গণেশ পোল আর হাওয়া পোল। একে একে ওরা প্রবেশ করে দশেরা চকে। এখানে দু’দিকে দুটো মহল— একটা রাজার মহল আর অন্যটা রানীর মহল। দুই মহলের জালির কাজ আলাদা ধরনের। রাজার মহলটা বেশ খোলামেলা ধরনের। ওপরে সিলিং থেকে শুরু করে ঘরের মেঝে পর্যন্ত নানা ধরনের কারুকার্য। রাজার মহল থেকে বেরিয়ে ওরা গেল রানীর মহলে। এই মহলে বেশ সূক্ষ্ম জালির কাজ রয়েছে। ঘরের পর্দা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর— সবেতেই একটা কমনীয়তা রয়েছে। তবে অতীত বেশ ভালোভাবেই থাবা বসিয়েছে মহলগুলোতে, শুধু ধ্বসে পড়াটাই বাকি।
“এখানকার আর-একটা স্পেশালিটি হচ্ছে জয়সলমীর ফোর্ট মিউজিয়াম”, শীর্ষেন্দুর কথায় ঘোর কাটে ওদের।
“কোথায় সেই মিউজিয়াম?” অনির্বাণের প্রশ্ন।
— আসুন… দেখতেই পাবেন।
মিউজিয়াম মাঝারি আকৃতির। এখানে রাজা-রানীর ব্যবহার করা নানা ধরনের আসবাবপত্র, বেশকিছু পাথরের মূর্তি আর প্যানেল রয়েছে। রাজার বিছানা আর খাবার পাত্র রূপো বাঁধানো। তবে যেটাকে রাজার বিছানা বলে উল্লেখ করল শীর্ষেন্দু, সেটা দেখে কেমন যেন হাসি পেল অনির্বাণের।
— রাজার বিছানা তো আর যে সে বিছানা নয়… কিন্তু এরকম নীচু আর ছোটো বিছানায় রাজা ঘুমাতেন, বিশ্বাস হয় না।
— কারণ আছে অবশ্যই।
— কী সেই কারণ?
— রাজার তো আর শত্রুর অভাব থাকে না। তাই ঘুমের মধ্যে শত্রুরা রাজাকে বিছানার সঙ্গে বেঁধে ফেললেও তিনি যাতে মাটিতে পা দিয়ে দাঁড়াতে পারেন, সেজন্যই বিছানাটা ওঁর হাইটের থেকে ছোটো বানানো হতো। তা ছাড়া বিছানা নীচু হওয়ায় এর নীচে কেউ লুকিয়ে থাকতেও পারত না। এসব বিবেচনা করেই রাজার বিছানা বানানো হতো।
— আরিব্বাস… দারুণ তো! কিন্তু রাজা যে পাত্রে খাবার খেতেন, সেটা সোনা বাঁধানো হলে বেটার হতো না কি?
— সে তো একশোবার, কিন্তু রূপার পাত্রের গুণ হচ্ছে এটাই যে, খাবারে যদি একফোঁটাও বিষ মেশানো থাকে, তাহলে মূহূর্তে রূপার পাত্রের রঙ বদলে যায়। লাইফ সিকিউরিটি তো মাস্ট, তাই না!
“সেটাই তো দেখছি… আচ্ছা এটা কার মূর্তি”, একপাশে রাখা একটা মূর্তির দিকে আঙুল দিয়ে দেখায় অনির্বাণ।
— এটা রামচন্দ্র।
— বলেন কী! রামচন্দ্রের কবে আবার এমন দাঁড়ি আর নাথুলালজি মার্কা গোঁফ গজালো?
— যে যেভাবে ভগবানকে দেখে, সেভাবেই তো বানাবে… সিম্পল।
— হুমম, তবে সোনার কেল্লা বলতে আমি যেটা আশা করেছিলাম, কিছুটা হলেও সেই আশা ভেঙেছে। রানীর মহল বা অন্যান্য যে মহলগুলো, সেগুলো তো প্রায় নষ্টই হয়ে গিয়েছে।
— আর যে ক’টা বছর এসবের আয়ু রয়েছে, ততদিন মানুষ আসবে, দেখবে ব্যস…
“আচ্ছা, ওটা সেই মুকুলের বাড়ি, তাই না?” দূরের একটা ধ্বংসস্তূপের দিকে দৃষ্টি ফেরায় মৈত্রেয়ী। সত্যজিতের সিনেমায় এই ঘরখানাকেই দেখানো হয়েছিল, ওর মনে আছে। কিন্তু সেই ঘরখানাও আজ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
— হ্যাঁ ম্যাডাম।
.
কেল্লা থেকে বেরোতেই ওদের চোখে পড়ল দেওয়াল ঘেঁষে একপাশে বসে রয়েছেন এক বৃদ্ধ। ওঁর হাতে একটা বাদ্যযন্ত্র— কামিচা। একমনে নিবিষ্ট হয়ে কামিচায় সুর তুলেছেন সেই বৃদ্ধ, ‘পাধারো মারে দেশ, কেশরিয়া বালম…’ আহা, কান জুড়িয়ে গেল ওদের! বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেই সুর উপভোগ করে ওরা। অনির্বাণ স্মৃতি হিসেবে ওর ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তুলে নেয় ভদ্রলোকের।
সেখান থেকে বেরিয়ে ওরা গেল গাদিসার লেকে। অপূর্ব সুন্দর সেই লেক আর তার পাশের মহলটা। ওরা ঘুরেফিরে দেখতে লাগল জায়গাটা।
— এখানকার নাম এমন হওয়ার কারণ কী?
— রাজা রাওয়াল জয়সল এই মহল তৈরি করেন… পরবর্তীতে গাডসি সিং নামক ব্যক্তি এই পুরো জায়গাটা নতুনভাবে সংস্করণ করান। সেই থেকে এই লেক গাদিসার নামেই পরিচিত… তবে এই লেক কিন্তু কৃত্রিমভাবে বানানো।
গাদিসার লেক দেখার পর ওরা যায় কোঠারির পাটোয়া হাভেলিতে। এটা যদিও একটা মিউজিয়াম। মিউজিয়ামের ভেতরটা রাজস্থানী কারুকার্যের এক অবর্ণনীয় সমাহার। সিলিং থেকে শুরু করে মেঝে— সবেতেই রাজস্থানী ঐতিহ্য ফুটে উঠেছে। ওরা যত দেখে, তত অবাক হয়। যত অবাক হয়, আরও বেশি দেখে। সেখান থেকে বেরিয়ে শীর্ষেন্দু বলে, “এবার মোতিমহল দেখে আজকের মতো শেষ করব… তা ছাড়া সন্ধে হয়ে আসছে, আকাশে আবার চাঁদ ওঠেনি… অমাবস্ কি সাম হ্যায়।”
“বেশ তাই হোক”, ওর কথায় সায় দেয় অনির্বাণ।
সেলিম সিংয়ের মোতিমহল দেখে হোটেলে ফিরতে বেশ সময় লাগল ওদের। সারা শহর ততক্ষণে ঝলমলে আলোয় নতুন রূপে সেজে উঠেছে। দূর থেকে জয়সলমীর দুর্গটা দেখে আরও একবার চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওদের।
“সোনার কেল্লা”, অস্ফুটে বলে ওঠে অনির্বাণ।
ওদের হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় শীর্ষেন্দু। ভেতরে ঢোকার সময় হঠাৎ মৈত্রেয়ী বলে ওঠে, “যাহ্… ভুলে গেলাম।”
— কী ভুললে?
— এখানকার ওই বাজারে বেশ কতগুলো রাজস্থানী গয়না আমি দেখেছিলাম… ভেবেছিলাম কিনব, কিন্তু তারপর একথা সেকথায় ভুলেই গিয়েছি।
— কী আর হবে! কালকে বেরিয়ে কিনে নিয়ো।
— কালকে তো আবার অনেকগুলো জায়গায় ঘুরতে যাব। যদি ভুলে যাই, কেনাই হবে না আমার।
— তাহলে কী করবে? এখন আবার বেরোব তাহলে!
— পাগল! ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে তিনজনে বেরিয়ে পড়ব… মিমের এমনিতেই ঠান্ডার ধাত, কী করে ভাবো তুমি এসব?
— সেটাই তো জিজ্ঞেস করছি। তাহলে কি আমি গিয়ে কিনে আনব? কীরকম কী লাগবে একটু বলে দাও, আমি…
— সেই-ই, জীবনে সংসারের ক’টা জিনিস তুমি কিনেছ বলতে পারো? আর আজ নাকি কিনবে আমার পছন্দের গয়না! দরদাম কী করে করতে হয় জানো? শোনো, তুমি ওকে নিয়ে ভিতরে যাও। আমি কিনে নিয়ে আসছি।
— এই সন্ধেয় একা একা…
— হ্যাঁ, তো? গাড়ি করে যাচ্ছি, গাড়িতে ফিরে আসব। এখানে রাস্তার ধারে ওই তো গাড়ির স্ট্যান্ড… তা ছাড়া আমি বাচ্চা মেয়ে নই। অদ্ভুত! উফ্… তুমি চিন্তা কোরো না… আমি কিনে নিয়ে ফিরে আসব।
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় অনির্বাণ। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে দু’হাতে মৈত্রেয়ীর মুখটা ধরে ওর কপালে চুমু খায়। তারপর বলে, “আচ্ছা বেশ, সাবধানে ফিরো।”
“হুমম”, রাস্তার উলটো দিকে গিয়ে গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে কিছু একটা বোঝায় মৈত্রেয়ী। তারপর অনির্বাণের দিকে ফিরে হাত নাড়ে। গাড়ি চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইল অনির্বাণ। সন্ধের শহরে একটু একটু করে ঠান্ডা বাড়ছে। বাইরে থাকা আর উচিত হবে না ভেবেই মিমকে নিয়ে হোটেলে ঢোকে অনির্বাণ।
.
“এই হল ব্যাস ছত্রী”, হলুদ মার্বেলের স্থাপত্যের দিকে নির্দেশ করে শীর্ষেন্দু। এখানে ঢোকার আগে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে নিয়েছে ওরা। অপূর্ব কারুকার্য করা গম্বুজগুলো দিনের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্যটকও এসেছেন এখানে। ওরা একটু একটু করে ভেতরে প্রবেশ করল।
— মহাভারতের ব্যাসদেবকে তো আমরা সবাই চিনি। এখানে বসেই ব্যাসদেব রচনা করেছিলেন মহাভারত। চারপাশে তাকালেই দেখতে পাবেন বালিপাথরের প্রচুর নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে এখানকার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে সানসেট পয়েন্ট। এখন অতটাও বোঝা যাবে না, তবে সূর্যাস্তের সময় অপরূপ সুন্দর লাগে চারপাশ। মনে হয় গম্বুজের ওইপাশে সূর্য একটু একটু করে মুখ লুকাচ্ছে।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হোঁচট খেল অনির্বাণ। শীর্ষেন্দু কোনোমতে ওকে ধরে ফেলে, “এত এক্সাইটেড হবেন না স্যার, ভালোভাবে ঘুরেফিরে জায়গাটা দেখুন… তাড়াহুড়োর কিছু নেই।”
.
“আমি আসলে খেয়াল করিনি পায়ের সামনে একটা পাথর ছিল”, একটু অপ্রস্তুত হয় অনির্বাণ।
ব্যাস ছত্রী দেখে ওরা বেরিয়ে পড়ে ওদের পরবর্তী গন্তব্যে।
“ ‘নাথমল কি হাভেলি’ জয়সলমীরের একটা বিখ্যাত স্থাপত্য। এটা বানিয়েছিলেন দুই মুসলিম স্থপতি। এই হাভেলি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সহকারে বানানো হয়েছিল। একমাত্র এখানেই মুসলিম এবং রাজপুতানা সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে”, শীর্ষেন্দু জানায়।
হাভেলির প্রত্যেকটা ঘরে নানা রকমের চিত্রকলা। বিশেষত হলুদ বালিপাথরের ওপর বানানো হাতির মূর্তি বিশেষ আকর্ষণ করল ওদের। গম্বুজের মাথায় বিশাল এক হাতি যেন স্বাগতম জানাচ্ছে ওদের সবাইকে।
এরপর ওরা গেল বড়ো বাগে। জয়সলমীর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার উত্তরে এই বড়ো বাগ। এটা সম্পূর্ণটা একটা বাগান বিশেষ। মহারাজা জয়সিংহের বংশধর দ্বিতীয় জয় সিংহ তাঁর রাজত্বকালে জলাশয় বানানোর জন্য একটা বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন। ওঁর মৃত্যুর পর পুত্র লুনকরণ বাকি কাজ সমাপ্ত করেন। জলাশয়ের পাশাপাশি এত সুন্দর একটা প্রাকৃতিক পরিবেশ ওদের মন ভরিয়ে দেয়। সত্যি! বালির শহরেও সবুজের ঘনঘটা কম নয়।
শীর্ষেন্দু আজ বারবার ঘড়ি দেখছে। সেদিকে তাকিয়ে অনির্বাণ বলল, “কোনো সমস্যা হয়েছে শীর্ষেন্দু বাবু?”
— অ্যাঁ… না না সমস্যা নয়… তা ছাড়া আজকের আবহাওয়াটা ভালো লাগছে না, যখন-তখন নামতে পারে… ভীষণ গুমোট ভাব।
— হ্যাঁ, আজকে গরম খুব একটা লাগছে না অন্যান্য দিনের মতো।
— এক কাজ করি। এখান থেকে আগে কিছু খেয়ে নিই আমরা, তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে তাজিয়া টাওয়ার আর কুলধারাটা দেখে আসা যাবে।
— সেই-ই ভালো।
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার পাশের একটা সরাইখানায় ওরা খাবার খেয়ে নিল। শেষপাতে মিষ্টি হিসেবে জিলাবি এল। বেশ ভালোই লাগল খেতে। এসব গ্রাম্য এলাকার মানুষের হাতের রান্নায় অদ্ভুত এক জাদু থাকে। খাবারের স্বাদ থেকে শুরু করে পরিবেশন— সবেতেই একটা কমনীয়তার ছোঁয়া লেগে রয়েছে। খেয়েদেয়ে শীর্ষেন্দু গাড়ি চালিয়ে দেয় তাজিয়ার দিকে।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত তাজিয়া টাওয়ার। রাজপুতানা ও মুসলিম সংস্কৃতির আরও এক মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। তাজিয়ার ব্যালকনি, বারান্দা আর দেওয়ালে খোদাই করা নকশা— এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
“এর প্রতিটা তলায় যে বারান্দা”, শীর্ষেন্দু বলে, “সেখানে ইসলামিক মাজারের সংস্করণ রয়েছে… একদম ওপরের বারান্দা থেকে দেখলে শহরটাকে ব্যাপক লাগে। মহারাজ বরিশাল সিংহ উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন এটা। শোনা যায় ওঁর সুন্দরী স্ত্রী এই টাওয়ার থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। কেন আত্মহত্যা করেছিলেন, তার কারণ অজানা। তবে অনেকে বলে থাকেন যে, রাজপরিবারের কোনো এক সদস্যের সঙ্গে রানীর অবৈধ সম্পর্কের কথা জানতে পেরে রাজা নিজেই স্ত্রীকে খুন করে ছিলেন। তবে এসব বহু বছর আগেকার কথা… তাই কোন্টা ঠিক, কোন্টা ভুল— সে নিয়ে আজও প্রচুর বিতর্ক রয়েছে।”
— রাজাদের কুকীর্তি ওঁরা নিজেরাই ঢেকে দিতেন, তাই হয়তো ইতিহাসের পাতায় ওঁদের ভালো দিকটাই কেবল প্রকাশ পায়। বাকিটা হারিয়ে যায় অতীতের গহ্বরে।
— কত শত ঘটনা যে লোকানো থাকে, তার খবর আমরা কেউই রাখি না। আসলে কী বলুন তো, সবকিছুই একটা রাজনীতি— আর এই রাজনীতিতে যে যত বেশি লুকাতে পারে, সে তত বেশি নাম কামায়।
— হুমম, তাই-ই তো দেখছি।
— আবার আমাদের এখানে এমন অনেক সিক্রেট আছে, যেগুলো হয়তো টুরিস্টদের আমরা বলতে পারি না। কারণ এসব জানলে হয়তো অনেককিছু ওলট-পালট হয়ে যাবে।
— এমন কী জিনিস, যা জানলে…
— ওই যে বললাম, সবকিছু বলা যায় না। যাইহোক… এবার আপনাদের যেখানে নিয়ে যাব, সেটা ভূতুড়ে গ্রাম নামেই বেশি পরিচিত।
— কুলধারা!
— হুমমম… আর সেখানকার ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন