কথা বলতে বলতেই গাড়ি পৌঁছে গেল যন্তর-মন্তরের সামনে। সে যুগের অদ্ভুত এক স্থাপত্য এই যন্তর-মন্তর। বিশাল এক জায়গা জুড়ে তৈরি এই যন্তর-মন্তর আসলে একটা মানমন্দির। গাড়ি থেকে নেমে ওরা অবাক হয়ে সবকিছু দেখতে দেখতে নির্দিষ্ট পথ ধরে এগোতে থাকে। চারপাশে গোলকধাঁধার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে স্থাপত্যগুলো। যন্তর-মন্তর মানমন্দিরে পাথরের তৈরি চারটি যন্ত্র দেখা গেল।
“রাজপুত রাজা দ্বিতীয় সওয়াই জয় সিং পাঁচটি মানমন্দির বানিয়েছিলেন। তিনি এই ধরনের পাঁচটা স্থাপত্য, পাঁচটা আলাদা আলাদা জায়গায় নিৰ্মাণ করেছিলেন। তার মধ্যে দুটো দিল্লি এবং জয়পুরে অবস্থিত। জয়পুরের এই মানমন্দিরটা বৃহত্তম এবং এখানে তিনি মোট ২০টা স্থায়ী যন্ত্ৰ স্থাপন করেছিলেন। পাঁচটি মানমন্দিরের মধ্যে তিনটিই শুধুমাত্র ‘যন্তর-মন্তর’ নামে পরিচিত। সবাই যাতে সহজে মনে রাখতে পারে আর মানমন্দিরটা দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে— সেজন্য ছন্দ মিলিয়ে মানমন্দিরের নাম রাখা হয় ‘যন্তর-মন্তর’। রাজপুত রাজা জয় সিং এমন এক যুগে বাস করতেন, যেখানে ধর্মীয় কুসংস্কার আর গোঁড়ামি মানুষের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। সমাজের যাবতীয় অন্ধবিশ্বাসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি নির্মাণ করেন এই যন্তর-মন্তর”, শীর্ষেন্দু বলতে শুরু করে, “এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ২৪ ঘণ্টায় বিভক্ত সূর্যঘড়ি, যেটাকে ‘সম্রাট ইয়ন্ত্র’ বা সর্বোচ্চ যন্ত্র বলা হয়। জয় সিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি হিসেবে সমাদৃত হয় এটি।”
পাথরের তৈরি এক বিশাল ত্রিভুজ রয়েছে একপাশে। সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল অনির্বাণ, “এটা কী?”
“এই ত্রিভুজের ৩৯ মিটার লম্বা অতিভুজ পৃথিবীর অক্ষের সমান্তরালে আর উত্তর মেরুর দিকে মুখ করে আছে। ত্রিভুজের দু’দিকেই ঘণ্টা, মিনিট ও সেকেন্ড নির্দেশ করার চিহ্নসহ কৌণিক উচ্চতামাপক নির্দেশক রয়েছে। যদিও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাধারণ সূর্যঘড়ির অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু জয় সিং সময় পরিমাপ করার এই মৌলিক যন্ত্রটিকে বিষুবাংশ এবং গ্রহ-নক্ষত্রের সম্পর্কযুক্ত স্থানাঙ্ক পরিমাপ করার এক নিখুঁত যন্ত্রে পরিণত করেছিলেন। এখানেই তিনি আর সবার চেয়ে আলাদা আর নির্মিত মানমন্দিরগুলো সবার জন্য বিস্ময়কর হয়ে রয়েছে”, শীর্ষেন্দু উত্তর দেয়।
বিশাল সেই মানমন্দির ঘুরেফিরে দেখতে থাকে ওরা। আর ওদের গাইড শীর্ষেন্দু একের পর এক অজানা তথ্য জানাতে থাকে ওদের। মানমন্দিরের দেওয়ালে হাত রাখে মৈত্রেয়ী। যেন অনুভব করতে চাইছে এর পিছনে ঘটে চলা ইতিহাস। মিম অনির্বাণের আঙুল ধরে এগোতে থাকে পাশের দিকে। ওর শিশুমনে প্রচুর প্রশ্ন ভিড় করছে। ওদের মতোই আরও অনেক টুরিস্ট রয়েছে এই মান মন্দিরে। অনেকেই নিজেদের ডিএসএলআর-এ ছবি তুলছে চারপাশের। কেউ কেউ ফোনে ভিডিও বানাচ্ছে। এখানে প্রবেশের আগে অনির্বাণদের অবশ্য কাউন্টারে টিকিট কেটে আসতে হয়েছে। কারণ টিকিট কাটলে তবে ডিএসএলআর বা ফোনে ছবি তোলার অনুমতি পাওয়া যাবে। অনির্বাণ ওর গলায় ঝোলানো ডিএসএলআর-এ বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি বন্দি করে নিতে থাকে। ওরা সামনের চত্বরটা পেরিয়ে বাঁদিকে বাঁক নেয়। এখানে আরও তিনখানা ঘড়ি দেখতে পায় ওরা। সেদিকে নির্দেশ করে শীর্ষেন্দু বলে, “এই তিনটে হচ্ছে যথাক্রমে রাম, জয়প্রকাশ এবং মিশ্রা ইয়ন্ত্র। এই যন্ত্রগুলো সূর্য ও বিভিন্ন নক্ষত্রের বিষুবাংশ, কৌণিক দূরত্ব এবং দিগংশ পরিমাপ করার জন্য খুব সূক্ষ্মভাবে তৈরি করা হয়েছে। মিশ্রা নামক যন্ত্রের সাহায্যে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে কখন দুপুর হয়েছে, তা-ও জানা সম্ভব। মিশ্রা ইয়ন্ত্র ছাড়া উল্লেখিত সব যন্ত্র জয় সিং নিজে উদ্ভাবন করেছিলেন, যার মধ্যে অন্যতম একটির নাম চক্র ইয়ন্ত্র।”
যন্তর-মন্তর দেখে ওরা যখন বেরোলো, তখন সূর্য মাথার ওপরে। আবহাওয়া এতটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যে, চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়েও শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর ক্ষিদেটাও বেশ বেগেই পাচ্ছে। শীর্ষেন্দু ব্যাপারটা বুঝে ওদের বলল, “এখানকার রাস্তার ধারের ধাবাগুলোয় খুব সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায়… আমার পরিচিত একটা ধাবা আছে, ওখানেই তাহলে আগে যাওয়া হোক… খেয়ে দেয়ে তারপর না হয় বেরোনো যাবে আবার।”
অনির্বাণ কিংবা মৈত্রেয়ী কেউই দ্বিমত পোষণ করল না। প্রায় মিনিট কুড়ি পর ওদের গাড়ি এসে থামল একটা ধাবার সামনে। খুব বেশি বড়ো না হলেও বেশ পরিষ্কার জায়গাটা। সামনের টেবিলে বেশ কয়েকজন খাবার খাচ্ছে বসে। শীর্ষেন্দু ওদের বলল, “আপনারা ভেতরে গিয়ে বসুন, আমি এখানকার স্পেশাল মেনু অর্ডার করে আসছি।”
একটা ফাঁকা টেবিলে বসল ওরা। এরকম জায়গা থেকে খাবার খুব একটা খায় না মৈত্রেয়ী। তবে রাজস্থানে ঘুরতে এসে ধাবায় না খেলে ট্রিপটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। তাই কোনো আপত্তি জানায়নি ও। বেশ কিছুক্ষণ পর ওদের সামনে টেবিলের ওপর গরম গরম খাবারের প্লেট চলে এল। তবে খাবারটা যে কী, সেটা ওরা ঠিক বুঝতে পারল না। কীরকম যেন চপের মতো দেখতে। আর এটা কি সন্দেশ! শীর্ষেন্দু হেসে বলল, “এগুলো হচ্ছে এখানকার স্পেশাল ডিশ… মাওয়া কাচুরি, পেঁয়াজ কাচুরি আর কালাকান্দ। একবার যে খাবে, সে জীবনে স্বাদ ভুলবে না। আমি এর ব্যাপারে আর বেশি কিছু বলব না, খেয়ে দেখুন… তারপর নিজেরাই বুঝে যাবেন।”
ওরা আর দ্বিরুক্তি না করে প্লেট সামনে টেনে পেঁয়াজ কাচুরি কিছুটা ভেঙে মুখে দিল। আর তারপরেই অদ্ভুত এক তৃপ্তিতে ওদের চোখ বন্ধ হয়ে এল। এ যেন পুরো স্বর্গীয় এক স্বাদ! মুখে দেওয়া মাত্রই মিলিয়ে যাচ্ছে মুখের ভেতর। মিমেরও বোধহয় ভালো লেগেছে, ও কোনো কথা না বলে চুপচাপ খেয়ে চলেছে। কালাকান্দ ভেঙে মুখে দিতেই সমস্ত ধকল যেন দূর হয়ে গেল ওদের। এত মিষ্টি খেয়েছে ওরা, কিন্তু এটার স্বাদ যেন সেই সবকিছুকেই হার মানিয়ে দেয়। খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন ওরা উঠল, তখন ওদের প্লেটে একফোঁটা খাবারও অবশিষ্ট নেই। তৃপ্ত হয়ে দাম মিটিয়ে ওরা বাইরে এসে দাঁড়াল। সত্যিই, এটাকেই হয়তো বলে রাজস্থানী রোদ। যত বেলা বাড়ছে, তত যেন প্রবল আক্রোশে তাপ বাড়ছে। ঝটপট সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি ছুটিয়ে দিল শীর্ষেন্দু। ওদের পরবর্তী গন্তব্য সিটি প্যালেস।
সিটি প্যালেস বাইরে থেকে দেখেই সত্যি চোখ জুড়িয়ে গেল। রাজা-রাজড়াদের তৈরি এমন স্থাপত্য স্বাভাবিকভাবে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নেয়। জয়পুরের একদম কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই সিটি প্যালেস। ঢোকার আগে এখানেও আর একবার টিকিট কেটে নিতে হল ওদের। সামনের চত্বর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে ওরা আরও অবাক হয়ে গেল। ঘরের সিলিং অনেক উঁচুতে। দেওয়ালের গায়ে নানা ধরনের কারুকার্য করা। সিলিং থেকে ঝুলছে ঝাড়লণ্ঠন। এত বিশাল একটা জায়গা জুড়ে অতীতের ঐতিহ্য বহন করে চলা এই সিটি প্যালেস না দেখলে হয়তো ওদের রাজস্থান ভ্রমণ অসম্পূর্ণ রয়ে যেত। প্যালেসের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যেতে যেতে শীর্ষেন্দু বলল, “সিটি প্যালেস চত্বরে কয়েক বছর আগে আগুন লেগেছিল একবার। বহু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, ছবি আর গ্রন্থাগারের বইপত্র— যেগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম… সব পুড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।”
“হ্যাঁ, খবরের কাগজে বেরিয়েছিল সেটা”, অনির্বাণ বলে।
— আগুন লেগেছিল এই প্যালেসের দোতলার এক অফিসঘরে। ঘটনার সময় অফিস বন্ধ ছিল। আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল একতলার ‘ফ্রেন্ডস অফ দ্য মিউজিয়ম’ গ্যালারিতেও। আর্ট গ্যালারির বেশ কিছুটা অংশ পুড়ে গিয়েছিল তাতে।
— এসব ঐতিহাসিক স্থাপত্যে এরকম দুর্ঘটনা… ভীষণ খারাপ লেগেছিল দেখে।
এগোতে এগোতেই প্যালেসের বিভিন্ন জায়গার ছবি ক্যামেরাবন্দি করে যাচ্ছিল অনির্বাণ। মৈত্রেয়ী আর মিম একটু আগে আগে এগিয়ে চলেছে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে বারান্দায় এল ওরা। বারান্দা থেকে জয়পুর শহরটা আরও বেশি মনোরম লাগছে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এভাবেই মন কাড়ে।
— এই জায়গাটা দেখে মনে হচ্ছে তো এখানকার ইতিহাস অন্যান্য জায়গার থেকে আরও বেশি ইন্টারেস্টিং… এমন কোনো ঘটনা আছে এখানকার?
“ইতিহাস কথা বলে এখানে”, শীর্ষেন্দু জবাব দেয়, “১৭৪৪ সালে জয় সিংহের মৃত্যুর পরে এই অঞ্চলের রাজপুত রাজাদের মধ্যে আন্তঃ যুদ্ধ হয়ে যায়। তবে ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে তাদের সুন্দর সম্পর্ক ছিল। এখানকার সিপাহী বিদ্রোহের সময় মহারাজা রাম সিংহ ব্রিটিশদের পক্ষে ছিলেন এবং সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। এটি তাঁর কৃতিত্বের যে, জয়পুর শহরটার সমস্ত স্মৃতিসৌধ সহ ‘গোলাপী’ রঙের করে দেন, তখন থেকেই এই শহরটাকে ‘গোলাপী শহর’ বলা হয়। এই যে রঙের স্কিম পরিবর্তন, এটা ছিল অতিথি আপ্যায়নের সম্মান যা প্রিন্স অফ ওয়েলসের পরিদর্শনে প্রসারিত হয়েছিল। এই রঙিন স্কিমটা তখন থেকে জয়পুর শহরের ট্রেডমার্কে পরিণত হয়েছে। এবার আসল কথায় আসি, দ্বিতীয় মহারাজা মাধো সিংহের দত্তক পুত্র মন সিংহ ছিলেন জয়পুরের শেষ মহারাজা। এই রাজবাড়ি রাজপরিবারের আবাস হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত। এরপর জয়পুর ভারতের রাজস্থান রাজ্যের রাজধানী হয়ে ওঠে এবং দ্বিতীয় মন সিং কিছু সময়ের জন্য রাজপ্রমুখ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।”
“অপূর্ব”, মৈত্রেয়ী আপন মনে বলে ওঠে।
— এই প্যালেস কিন্তু রাজপুত, মোঘল আর ইউরোপীয় স্থাপত্য-শৈলীর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলক… এখানকার বিখ্যাত কয়েকটা ফটক হচ্ছে উদাই পোল, জালেব চৌক, ত্রিপোলিয়া গেট, বীরেন্দ্র পোল ইত্যাদি। এর সঙ্গে সঙ্গে এখানে চন্দ্রমহল মোবারক মহল, দিওয়ান ই খাস, গোবিন্দ দেবজির মন্দির রয়েছে।
সামনে চত্বর পেরিয়ে আর একটু ভেতরের দিকে যেতেই এখানকার দেওয়াল আর দরজাগুলোয় মোগল স্টাইলের ডিজাইন দেখা গেল। সত্যি! তিনটে সভ্যতার স্থাপত্যের মেলবন্ধন এই সিটি প্যালেস। ওরা যত দেখছে, তত অবাক হচ্ছে। সেই সঙ্গে সঙ্গে শীর্ষেন্দু জানাচ্ছে এখানকার ইতিহাস। সব মিলিয়ে পুরো জায়গাটা ঘুরে ওরা অভিভূত হয়ে গেল।
.
প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ওরা বেরিয়ে আসে প্যালেস থেকে। সারাটা দিন যথেষ্ট হাঁটাহাঁটি হওয়ায় ওরা তিনজনেই বেশ ক্লান্ত। গাড়িতে বসে জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নেয় অনির্বাণ। এখানকার আবহাওয়া সত্যিই অদ্ভুত। দিনের বেলায় যতটা গরম লাগে, রাতের বেলায় ঠিক ততটাই ঠান্ডা। মিমকে একটা সোয়েটার পরিয়ে দেয় ও। মৈত্রেয়ী একখানা শাল জড়িয়ে নিয়েছে গায়ে। গাড়ি চালাতে চালাতেই শীর্ষেন্দু বলে ওঠে, “কেমন দেখলেন বলুন আমাদের জয়পুরের ঐতিহ্য?”
“আমার তো ব্যাপক লেগেছে”, মৈত্রেয়ী উত্তর দেয়।
— আজ এইগুলো দেখালাম, এখনও তো হাওয়া মহল, বিড়লা মন্দির আরও কত কী দেখা বাকি আছে… একে একে সব ঘুরিয়ে দেখাব।
“আপনি না থাকলে এত সুন্দর করে ইতিহাস কেউ বলে দিত না”, অনির্বাণ বলে ওঠে।
— ওই যে বলেছিলাম, মানুষের ইন্টারেস্ট দেখে তবে আমরা বলি… তা ছাড়া আজকের দিনটা আমার নিজেরও বেশ ভালোই কেটেছে। কালকে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব আমি।
আটটা নাগাদ হোটেলে পৌঁছে যায় ওরা। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে তিনজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। একটু পরেই ডিনার সার্ভ হয়ে যাবে। তাই ফ্রেশ হওয়ার জন্য একে একে মৈত্রেয়ী আর অনির্বাণ বাথরুমে ঢুকল।
.
পরদিন সকালে শীর্ষেন্দুর গাড়িতে ওরা বেরিয়ে পড়ে বিড়লা মন্দির, অম্বর ফোর্ট, হাওয়া মহলের উদ্দেশে। জয়পুর শহরের মধ্যিখানে একটা উঁচু টিলার ওপর তৈরি শ্বেতপাথরের বিড়লা মন্দির। চারপাশের পরিবেশ অসাধারণ। পায়ে পায়ে ওরা মন্দিরের ভেতর প্রবেশ করল। শ্বেত পাথরের মন্দিরের ভেতরের কারুকার্য আরও বেশি চোখ টানে। রাজস্থানী ঘরানার স্থাপত্যে বানানো মন্দিরের দেওয়ালের ধাঁচ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল ওরা। রাধাকৃষ্ণের প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ রয়েছে সামনে। ওদের মতোই বেশকিছু দর্শনার্থী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন মন্দিরের ভেতরে। স্নিগ্ধ মনে মন্দিরটা খুঁটিয়ে দেখে ওরা বেরিয়ে এল বাইরে। সেখান থেকে ডানপাশে তাকাতেই ওদের চোখে পড়ল অতি প্রাচীন এক কেল্লা। শীর্ষেন্দু বলল, “ওখানে প্রতিষ্ঠিত দেবাদিদেব মহাদেব রয়েছেন।”
“তাহলে দেখে আসি আমরা”, মৈত্রেয়ী বলে উঠল।
— নাহ্, যে-কোনো সময় সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। বছরের একটা বিশেষ তিথিতে ওই কেল্লায় মেলার আয়োজন হয়, তখন জনসাধারণ সেখানে যাওয়ার সুযোগ পায়।
— যাহ্… আমার তো স্বচক্ষে কেল্লার ভেতরটা দেখার ভীষণ ইচ্ছে ছিল।
— আমি আপনাদের জানিয়ে দেব’খন… সেই সময় এলে দেখতে পাবেন মহাদেবকে মাত্র একটিবার দেখার জন্য ভক্তদের কত আকুলি-বিকুলি… তবে চিন্তা নেই, আপনাদের আর-একটা ভালো মন্দিরে নিয়ে যাই, চলুন।
— কার মন্দির?
— গণপতি বাবার মন্দির… জয়পুরের ভীষণ জাগ্রত বাবা উনি।
গণপতি বাবার মন্দির দূর থেকে দেখেই ওরা হাতজোড় করে প্রণাম করল। ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে মন্দিরের ভিতরের দিকে। দু’পাশে সবুজের সমারোহ, নিপুণ হাতে সাজানো ফুলের চারা। একটা বেদীর ওপর বসে রয়েছেন গণপতি। তার চারপাশে ফুল আর লাড্ডুর স্তূপ। ধুপ ধুনোর গন্ধে চারিদিক ভরপুর। পুজো হচ্ছে মন্দিরে। ভক্তেরা ডালায় করে ফল মিষ্টি নিয়ে আসছে আরাধ্য দেবতার জন্য। অদ্ভুত একটা শান্তি ছেয়ে গেল তাদের সবার মনে।
গণপতির মন্দির দেখে বেরিয়ে শীর্ষেন্দু গাড়ির ইঞ্জিন অন করে বলল, “এবার আপনাদের নিয়ে যাব অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে… এই মিউজিয়ামে পুরোনো আমলের বিখ্যাত সব চিত্রকলা, মহারাজাদের তৈলচিত্র, রাজস্থানী গয়না, বিশ্বের প্রাচীনতম কার্পেট, হাতির দাঁতের নানা শিল্প, অমূল্য সব পাথর, এমনকি ধাতব ও ভাস্কর্যের কৃত্রিম নিদর্শন রয়েছে… তবে যেটা সবথেকে প্রধান আকর্ষণের বিষয়, সেটা হচ্ছে প্রায় ১৩০ বছরের পুরোনো এক মিশরীয় মমি।”
“ওয়াও… কোয়াইট ইন্টারেস্টিং”, স্বগতোক্তি করে অনির্বাণ।
“মমি কী বাবাই?” এতক্ষণ পরে প্রশ্ন করে মিম।
“তোমার কাছে যেমন প্রচুর খেলনা রয়েছে, ঠিক সেইরকম ভাবেই আগেকার দিনে মিশরে মানুষ পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়লে তার শরীরে এমন একটা ওষুধ দেওয়া হতো, যাতে তার শরীর পুরো খেলনার মতো শক্ত হয়ে যায়। মানুষ থেকে এই কাঠের পুতুল হয়ে যাওয়া বস্তুটাকে আমরা মমি বলি”, অনির্বাণ খুব সহজভাবে বুঝিয়ে দেয় মিমকে।
“তাহলে আমরা ঘুমিয়ে পড়লে আমরাও মমি হয়ে যাব?” মিমের চোখে একরাশ জিজ্ঞাসা।
“না না”, অনির্বাণ হাসে, “আমাদের এখানে ওইসব পুতুল বানানো হয় না… এগুলো তো সব মিশরে হয়।”
— আমরা তাহলে মিশরে যাব বাবাই… তুমি আর আমি মিলে অনেকগুলো মমি কিনব… যাবে তো?
— আচ্ছা বেশ, তুমি বড়ো হলে আমরা মিশরে ঘুরতে যাব।
হালকা কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই ওদের গাড়ি এসে পৌঁছয় অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের সামনে। তবে এটাকে মিউজিয়াম না বলে ভয়ঙ্কর সুন্দর একটা দুর্গ বলাই ভালো। মৈত্রেয়ী গাড়ি থেকে নেমেই প্রশ্ন করে, “এটা কি আগে কোনো রাজার প্রাসাদ ছিল?”
.
“খুব একটা ভুল বলেননি ম্যাডাম”, শীর্ষেন্দু জবাব দেয়, “আসল ঘটনা হল ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অ্যালবার্টের জয়পুর ভ্রমণকে বরণীয় করে তুলতে ব্রিটিশ স্থপতি স্যার স্যামুয়েল জ্যাকবের হাত ধরেই ১৮৬৭ সাল নাগাদ ইন্দো-সেরাসেনিক শৈলীতে নির্মাণ শুরু হয় এই মিউজিয়ামের। তবে মহারাজ রাম সিং প্রথমে চেয়েছিলেন এই বিল্ডিংটাকে টাউন হল বানিয়ে তুলতে, কিন্তু তার উত্তরসূরি দ্বিতীয় মাধো সিংহ নিজ পরিকল্পনা অনুযায়ী এটাকে জয়পুরের এক বিখ্যাত সংগ্ৰহশালা বানিয়ে তুলেছিলেন।”
মিউজিয়ামের ভেতরে ঢুকে আরও বৈচিত্র্য চোখে পড়ে ওদের। মিউজিয়ামের ছাদ, গম্বুজ আর অলিন্দে কলাকুশলীরা নিজেদের অনবদ্য ছাপ রেখে গিয়েছেন। দেওয়ালের গায়ে হাত রাখে মৈত্রেয়ী। যেন উপলব্ধি করতে চায় কত বছর আগের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। রাজাদের শিল্পকর্ম, প্রাচীন জিনিসপত্র— সত্যিই স্তব্ধ করে দেয় চিন্তাভাবনা। মমি দেখার আগ্রহটা অন্যান্য সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল, বিশেষত মিমের। কাচ দিয়ে ঘেরা স্বচ্ছ পর্দার ওপাশে সেই মিশরীয় মমি। যেন খুব নিপুণ হাতে অল্প অল্প করে ধৈর্য্য মিশিয়ে বানিয়ে তোলা হয়েছে মূর্তিটা। শীর্ষেন্দু বলে ওঠে, “প্রায় ১৩০ বছর আগে মিশরের কায়রো থেকে আনা হয়েছিল তুতুর এই মমি। তুতু ছিলেন মিশরের প্রাচীন পোনোপোলিস শহরের বাসিন্দা। এই মমি এখনও মানুষকে আশ্চর্য করে। প্রায় ১৩০ বছর ধরে বাক্স বন্দি রয়েছে মমিখানা।”
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে অনির্বাণ বলল, “বেড়ানো তো অনেক হল, কিছু খেয়ে নেওয়া যাক? আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।”
— অবশ্যই… হাওয়া মহলের কাছাকাছি একটা ভালো হোটেল আছে। খুব সুন্দর খাবার সেখানকার… ওখান থেকে বেরিয়ে হাওয়া মহল আর তারপর অম্বর ফোর্টটা ঘুরে নেবেন না হয়!
.
হোটেলের নাম রয়েল সেরাটন। হোটেলের চারতলায় রুফটপে রেস্টুরেন্ট। এর চারপাশের পরিবেশ আরও বেশি মন কাড়ে। খাবার অর্ডার দিয়ে ওরা প্রথমে ছাদে গেল। ছাদ থেকে সামনের দৃশ্য আরও বেশি অপূর্ব দেখাচ্ছে। চারদিক পাহাড়ে ঘেরা আর একটু দূরেই অম্বর ফোর্ট। এত সুন্দর একটা দৃশ্য যে, অনির্বাণ নিজেকে সামলাতে পারল না। ওর ডিএসএলআর-এ পটাপট ছবি তুলে নিতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পর ঘুরেফিরে চোখ আর মন দুটোই তৃপ্ত করে ওরা টেবিলের সামনে বসল। প্লেটে রাখা গরম গরম খাবার নিজেদের গন্ধে জানান দিতে লাগল যে, এবার জিভটাকেও তৃপ্ত করা দরকার!
এরপরের কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু চামচ আর প্লেটের ঠুংঠাং শব্দ মিশে গেল বাতাসে।
সারাদিন ঘুরে ফিরে সন্ধে নাগাদ হোটেলে ফেরে ওরা। ডিনারের সময় রাজস্থানী শিল্পীদের নাচ-গান বেশ উপভোগ করল সবাই। খেয়েদেয়ে অনির্বাণ শুয়ে পড়েছিল, চাদরের গরমে আরামে চোখ বুজে আসে তার। মৈত্রেয়ী তখনও ল্যাপটপে খুটখাট করে যাচ্ছে। অনির্বাণ বলল, “এখানে এসেও তুমি কাজ নিয়ে পড়েছ!”
— অনি… কিছু ইম্পর্টেন্ট ডকুমেন্টস সাবমিট করতে হবে আমায়… তুমি ঘুমিয়ে পড়ো, আমি একটু পরে শুচ্ছি।
— আচ্ছা, এই দুদিন যে ঘুরলাম, তোমার কেমন লাগল বললে না তো?
— এত সুন্দর জায়গা, অবশ্যই ভালো লেগেছে।
— আর এখানকার খাবারের মধ্যে বেশি ভালো কোন্টা লেগেছে?
“উফ্ অনি”, ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ তোলে মৈত্রেয়ী, “এসব কথা এখন বোলো না… আমি একটা কাজ করছি তো!”
— সেটাই… আপনি সবসময় কাজই করে যান।
— কাল সকালে কিন্তু উঠতে হবে, তাই আর রাত না জেগে ঘুমিয়ে পড়ো।
— এমন করে বলছ যেন ঘুরতে আমি একা যাচ্ছি, তুমি ঘুমাবে না!
— আমি কাজটা কমপ্লিট করে ঘুমাই।
— কিন্তু… আচ্ছা বেশ, আমিও তাহলে জেগে থাকি।
“কোনো দরকার নেই”, মৈত্রেয়ী ল্যাপটপটা টেবিলে রাখে, তারপর অনির্বাণের দিকে সরে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখে। নরম আঙ্গুলে অনির্বাণের মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলে, “নাও, এবার চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো।”
— তুমি যখন আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করো, আমার খুব ভালো লাগে… জানো!
— জানি তো।
— মাঝে মাঝে তোমায় যেন চিনতে পারি না আমি।
— এত চিনে কী হবে অনির্বাণ বাবু? কিছু কিছু মানুষ অচেনা থাকাই ভালো।
— সে না হয় ঠিক আছে, তবে…
“ব্যস, আর একটাও কথা নয়”, মৈত্রেয়ী নরম স্বরে ধমক দেয়, “এবার চুপচাপ চোখ বন্ধ করো।”
— আচ্ছা বেশ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন