ঈশ্বর ভালো নেই – ৩

ভদ্রলোক চলে গেলেন। বাকি রাতটুকু আমরা অদ্ভুত একটা ছটফটানি মনের মধ্যে নিয়ে কাটালাম। কারণ বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যে সবসময়ই একটা দ্বন্দ্ব মানুষের মনের মধ্যে চলে। কখনো কখনো আমরা বিশ্বাসের কাছে মাথা নত করি। আবার কখনও ঠিক এর উলটোটা হয়। আমাদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টাই কার্যকরী হয়েছিল। পরের দিনটা আমরা যে কীভাবে কাটিয়েছি, সেটা আমরাই জানি। খালি মনে হচ্ছিল সময় যেন কাটছেই না। অদ্ভুত একটা অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে সময় কাটানোর পর যখন সূর্য প্রায় ডোবার মুখে, সেইসময় ভদ্রলোক আমাদের ডাকলেন। বললেন, “সবকিছু জোগাড় করে ফেলেছি, আর তার মূল্য বাবদ তোমরা আমায় দেড়শোটা টাকা দেবে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা বেরোব, তোমাদের যা কিছু নেওয়ার, সঙ্গে নিয়ে নিয়ো।”

জিনিসপত্র যদিও গোছানোই ছিল, তবুও আর-একবার দেখে নিলাম সকলে। আমরা যখন বের হলাম, তখন সূর্যাস্তের পর অন্ধকারটা হালকা হয়ে ছড়িয়েছে। তখনকার দিনে তো আর এত গাড়ি ঘোড়া ছিল না, তাই পায়ে হেঁটেই এগোতে লাগলাম আমরা। সবার আগে আগে হাঁটছিলেন সেই ভদ্রলোক। আমরা ওঁকে ফলো করছিলাম। ওঁর হাতে একখানা বেশ বড়ো মাপের পুঁটুলি, তার মধ্যে থেকে মাঝেমাঝেই একটা বিড়ালের ‍‘মিঁয়াও মিঁয়াও’ শব্দ ভেসে আসছে। বুঝতে পারলাম এই হল সেই কালো বিড়াল। যদিও ভদ্রলোক পুঁটুলিটা বেশ চেপেচুপে নিয়েছেন, তবে প্রাণীটা যথেষ্ট ছটফট করছে। তার ডাকটা মাঝেমাঝেই গর্জনে বদলে যাচ্ছে। বেশ অনেকটা পথ হেঁটে আসার পর লোকালয় কমতে শুরু করল। এবার যে জায়গাটার মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম, তার আশেপাশে গাছ গাছালি ভর্তি। বেশ কয়েকটা নাম না জানা পাখির ডাক শুনতে পেলাম। ভদ্রলোকের হাতে একখানা হ্যারিকেন, সেই আলোয় চারপাশটা কেমন যেন অদ্ভুত থমথমে লাগছে। তার ওপর জঙ্গল ক্রমশ ঘন হতে শুরু করেছে এদিকে। হ্যারিকেনের আলোয় আমাদের ছায়াগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমরা একা নই, আমাদের সঙ্গে আরও কেউ রয়েছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। যেন সবাই অপেক্ষা করে রয়েছে অদ্ভুত কোনো কিছুর সাক্ষী হওয়ার। আরও কিছুদূর এগিয়েছি, এমন সময় পাশের একটা ঝোপ নড়ে উঠল। যত বড়ো দুঃসাহসীই হোক না কেন, এমন একটা মুহূর্তে গা ছমছম করাটা স্বাভাবিক। ভদ্রলোক সেদিকে তাকিয়ে বললেন, “চিন্তা কোরো না, খটাস বা সেরকম কোনো প্রাণী হবে। বনে বাঁদাড়ে এসব প্রাণী হামেশাই থাকে।” এরপর আর কোনো কথা হল না। চুপচাপ এগোতে লাগলাম সকলে। একটা সময় পর যখন থামলাম, বুঝতে পারলাম জায়গাটা লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে। ভদ্রলোক হারিকেনের আলোটা একটু উস্কে দিলেন। সেই আলোয় দেখতে পেলাম আমাদের সামনে একখানা অতি পুরোনো দিনের মন্দির। তার গা থেকে চুন পলেস্তারা খসে পড়েছে। শ্যাওলাধরা ইঁটগুলো যেন দাঁত বের করে সভ্য সমাজকে ব্যঙ্গ করছে। মন্দিরের চারদিকে আগাছা, ঝোপঝাড়ের স্তূপ। দেখে বোঝাই যাচ্ছে বহু বছরের স্মৃতি বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই প্রাচীন মন্দিরখানা। হ্যারিকেনের আলোয় ততটা স্পষ্ট না হলেও বোঝা যাচ্ছিল মন্দিরটাকে। দিনের বেলায় এমন জায়গায় এলে হয়তো এতটাও অস্বস্তি লাগত না। মনটা যেন কেমন কেমন করতে লাগল। ভদ্রলোক কেমন যেন ফ্যাসফেসে স্বরে বললেন, “ভাংড়ু দেবতার মন্দির… এখানেই থাকেন তিনি… সাবধানে এসো আমার সঙ্গে।”

 কথাটা বলেই ভদ্রলোক মন্দিরের দিকে না এগিয়ে পাশের একটা বেদীর দিকে এগিয়ে গেলেন। পুঁটুলিটা কোনোভাবে বগলদাবা করে হ্যারিকেনটা নামিয়ে রাখলেন সেই বেদীর পাশে। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন, “এসো, হাত লাগাও।”

 আমি ওঁর কথাটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে, ওখানে কী হবে! যাইহোক, তিনজনে মিলে যখন সেই বেদীর কাছে পৌঁছলাম, দেখলাম সেই বেদীর ওপরের অংশটা ধরে হালকা টানাটানি করছেন ভদ্রলোক। বললেন, “এটাকে সরাতে হবে… এসো।” চারজনের মিলিত চেষ্টায় একটা সময় পর বেদীর ওপরের অংশটা সরে গেল। যতটা বুঝতে পারছি, ভেতরে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। অদ্ভুত… ভীষণ অদ্ভুত! এবার হ্যারিকেনটা নিয়ে ভদ্রলোক সবার প্রথমে প্রবেশ করলেন ভেতরে। সিঁড়িতে পা দিয়ে বললেন, “খুব সাবধানে আসো।” আশেপাশের জঙ্গল থেকে কেমন যেন একটা অদ্ভুত হিসহিসানির শব্দ ভেসে আসছে কানে। দেরি না করে এক এক করে তিনজনেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম। বেদীর মধ্যে যে এমন একটা গুপ্ত সুড়ঙ্গ থাকবে, সেটা হয়তো আমরা কেউই কল্পনা করতে পারিনি। সিঁড়িটা প্যাঁচালো ধরনের, বেশ কিছুটা পথ ঘুরে এসে মিশেছে মাটির বুকে। একটা সময় পর যখন আমাদের পা মাটি স্পর্শ করল, বুঝতে পারলাম আমরা অনেকটা গভীরে নেমে এসেছি। এখানে যদি কোনোভাবে আমরা চাপা পড়ে যাই, শত ডাকাডাকিতেও কেউ রক্ষা করতে আসবে না আমাদের। নিজেদের নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসছে আমাদের। জায়গাটা বেশ ভেবেচিন্তেই বানানো হয়েছিল। সামনের ঘ্যাষঘেষে অংশটা পার হয়ে যাওয়ার পর আমরা যে ঘরে এসে দাঁড়ালাম, সেটা বেশ বড়োসড়ো। তবে ঘরের চারদিকে কেমন যেন একটা পোড়া পোড়া ছোপ। হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন অতর্কিতে ঘরটায় আগুন ধরে গিয়েছিল কোনো এক সময়ে। এমন সময় ওপরে কেমন যেন একটা শব্দ হল। খুব জোরে কোথাও কি বাজ পড়ল! সেই শব্দ যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে নামছে মাটির নীচের এই ঘরে। এরকম অবস্থায় এর আগে কখনও পড়িনি আমরা। তিনজনেই কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। ভদ্রলোক ততক্ষণে এগিয়ে গিয়েছেন সামনের দিকে। ওঁর কাঁপতে থাকা ছায়ার দিকে তাকিয়ে আমি নিজের মনেই বলে উঠলাম, “ভাংড়ু বুঝি এখানেই থাকেন!”

 অবাক দৃষ্টিতে চারপাশটা লক্ষ করতে থাকলাম আমি। বহু বছর ধরে এই জায়গাটা যে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে, সেটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হল না। সভ্য সমাজ জানে না যে, তাদের চোখের আড়ালে পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে চলেছে। তবে মানুষ যে এখানে আসে, সেটা আমি বুঝতে পারলাম মেঝের একপাশে পড়ে থাকা একটা পরিত্যক্ত চাদর দেখে। হয়তো এর আগে যারা এসেছিল, তারা মনের ভুলে ফেলে গিয়েছে এটা। বাইরে বোধহয় ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির বেগ যত বাড়ছে, ঘরের ভেতরে তার একটা অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। একপা একপা করে এগোচ্ছি আমরা। সামনের ঘরটা পেরিয়ে একটা সরু পায়ে-হাঁটা জায়গা। সেটা পেরোতেই আমরা এসে পড়লাম তিনদিক ঘেরা এমন একটা জায়গায়, যেটাকে ঠিক ঘর বলা চলে না। এক পাশের দেওয়াল হয়তো কোনোভাবে ধ্বসে পড়েছে। একটা ঠান্ডা হাওয়ার রেশ রয়েছে এখানে। অবাক হলাম একটু ; মাটির নিচে হাওয়া ঠান্ডা থাকার তো কথা নয়! তাহলে? পুঁটুলির মধ্যে থাকা বিড়ালটা ততক্ষণে আবার ডাকতে শুরু করেছে। ঘরের ভেতর ওর আওয়াজটা কেমন যেন কান্নার মতো শোনাচ্ছে। সেই কান্নার সুর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে। কেমন যেন একটা খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে এসব কিছু। চোখ পড়ল ঘরের মাঝখান দিয়ে একটা গাছ যেন ছাদ ফুঁড়ে ওপরে উঠে গেছে। তার চারপাশের বেশ কিছুটা অংশ বেড়া দেওয়া। তার সামনে বসে পড়ে ভদ্রলোক আমাদের ডাকলেন। সেদিকে গিয়ে দেখলাম সেই বেড়ার ভেতর গাছের গোড়ায় প্রায় এক হাত লম্বা পাথরের একটা মূর্তি রাখা। মূর্তির গায়ে আলকাতরা কিংবা কিছু দিয়ে ছোপ দিয়েছে কেউ। কালচে রঙের তরল পদার্থ একপাশে জমে রয়েছে মূর্তিটার। তবে কেউ যেন খুব যত্নে বেড়ার মধ্যেকার জায়গাটা পরিষ্কার করে দিয়েছে। না হলে এখানেও আগাছা জন্মে যাওয়ার কথা। বাইরের ঝড়-বৃষ্টি এতক্ষণে আরও বেড়েছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিড়ালটার কান্না। আমাদের সব উৎসাহে যেন ভাটা পড়ছে। এসব করা কি ঠিক হচ্ছে! ভদ্রলোক প্রথমে একটা খবরের কাগজ বের করে তার ওপর বাজরার আটা আর মধু মেশাতে লাগলেন। তারপর আমাদের দিকে ঘুরে বললেন, “এমন কোনো ইচ্ছে যেটা তোমরা ভগবানকে জানাতে চাও, সেটা মনে মনে চিন্তা করে নাও, তারপর…”, ব্যাগ থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করে এগিয়ে দিলেন আমাদের দিকে, “নিজের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুলের মাথা চিরে কয়েক ফোঁটা রক্ত ফেলো এই মন্ডটায়।”

 খবরের কাগজের ওপর ততক্ষণে একখানা গোলগাল মন্ড তৈরি করে ফেলেছেন ভদ্রলোক। এক এক করে আমরা তিনজনেই নিজেদের আঙুল চিরে কয়েক ফোঁটা করে রক্ত ফেলি কাগজের ওপর। বানিয়ে রাখা মন্ডের সঙ্গে সেই রক্ত মিশিয়ে নিতে নিতে ভদ্রলোক বললেন, “আমাদের সামনে যিনি রয়েছেন, তিনিই হলেন ভাংড়ু। এখানে দেবতাকে উৎসর্গ করার জন্য বানালাম ওঁর পছন্দের পদ। তোমাদের রক্ত তোমরা দিয়েছ দেবতাকে, দেবতা সন্তুষ্ট হবেন। এবার আর একখানা কাজ বাকি, তারপর আমি একটা মন্ত্র পড়ব, তোমরা সবাই সেটা উচ্চারণ করবে আমার বলার সঙ্গে সঙ্গে। দেখো, মন্ত্রোচ্চারণে যেন কোনো ভুল না হয়।” আমরা ঘাড় নাড়লাম। এরপর উনি রক্তমাখা ওই মন্ড একপাশে রেখে পুঁটুলির মধ্যে থেকে বার করে আনলেন সেই অবলা জীবটাকে। জীবটা ছটফট করছে ভীষণভাবে। তার চোখের তারায় একটা ভয় মিশে রয়েছে। কুচকুচে কালো রঙের প্রাণীটা ভদ্রলোকের হাত থেকে পালানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। উনি বিড়ালটাকে আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “চেপে ধরে রাখো একে, মন্ত্র শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক কোপে এর গলা কেটে ফেলতে হবে… এই নাও ছুরি”, বলে সেই ধারালো ছুরিটা এগিয়ে দিলেন আমাদের দিকে। এতক্ষণ পর্যন্ত ঠিকঠাক ছিল সব। কিন্তু এবারে আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। বলে ফেললাম, “বন্ধ করুন এসব… কি ভয়ানক! আমি এভাবে কোনো জীবিত প্রাণীকে মারতে পারব না।”

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, “ভাংড়ুর পুজো এভাবে মাঝপথে কখনও বন্ধ হতে নেই… তাহলে তার ফল হয় ভয়ানক। পুজোর যেটা নিয়ম, সেটা তো সবাইকেই মানতে হবে। তা না হলে তোমাদের পরিবারও বাঁচবে না।”

 আমার বাকি দুই সঙ্গী ততক্ষণে বেড়ালটাকে চেপে ধরেছে। আমি ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে রাজি হলাম। এবার ভদ্রলোক বললেন, “নাও, আমার সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করো… জা মে ভাংড়ুদ্দিপে মে হি তো বজ তান্যতে ঈশামে দিব্যং হিতো সন্তামে পাতম বোংগিলা… ঈর্শে কালম আজ্জুমে তম হে দারম কালে…”

আমরা মন্ত্রোচ্চারণ করে চললাম। আমাদের হাতের বাঁধনে আটকে পড়া সেই বিড়ালটা অসহায়ের মতো শেষ একবার ডেকে উঠল। সেই মূহূর্তে কোথাও বাজ পড়ার শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ। মন্ত্র পাঠ শেষ করে তিনি বললেন, “ওর মুন্ডুটা একটু উঁচু করো… ব্যস, মারো এবার।”

 বুঝলাম নিষ্ঠুরের মতো অসহায় জীবটাকে হত্যা করতে হবে আমাদের। কিন্তু এখন যে না করে উপায় নেই। বাকি দুই সঙ্গী চেপে ধরল বিড়ালটাকে আর আমি এক কোপে ধারালো ছুরি চালিয়ে দিলাম তার গলার নলি লক্ষ করে। একটা গরম রক্ত ছিটকে পড়ল সেই পাথরের মূর্তির গায়ে। ছুরি ধরা হাতটা আমার কাঁপতে লাগল প্রবলভাবে। চোখ বন্ধ করেই রেখেছিলাম, খুলতে পারছিলাম না। বুকের মধ্যে কেমন যেন হাতুড়ি পেটার আওয়াজ হচ্ছে। আমি কি উচিত কাজ করলাম! জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলাম আমি। তারপর আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। দেখি ভদ্রলোক বিড়ালের কাটা মাথাটা নিয়ে সেই পাথরের মূর্তির সামনে রেখে দিলেন। টাটকা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে পাথরের মূর্তির গা বেয়ে। এবার বুঝলাম মূর্তির পাশের সেই থকথকে তরলটা কি! গা-টা গুলিয়ে উঠল আমার। প্রাণীটার অবশিষ্ট শরীরটা উনি এক পাশে ফেলে দিলেন। তারপর বানিয়ে রাখা মন্ডটা হাতে তুলে এগিয়ে দিলেন বেড়ার ভেতর থাকা সেই মূর্তির সামনে। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “পুজো শেষ হয়েছে, এবার তোমরা দেবতার কাছ থেকে আশীর্বাদস্বরূপ কিছু চেয়ে নিতে পারো… তবে মনে রেখো, একবারই চাইতে পারবে তোমরা। বেশি কিছু চেয়ে বোসো না যেন ভুল করে, কারণ লোভী মানুষদের দেবতা একেবারেই পছন্দ করেন না।”

আমরা তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। আমার সেই মুহূর্তে টাকার ভীষণ দরকার ছিল। কিন্তু কীভাবে কী বলব, সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভগবানের কাছে আমরা যেভাবে প্রার্থনা করি, সেভাবে হাতজোড় করে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বললাম, “আমি জানি না কীভাবে চাইব তোমার কাছ থেকে, তবে আমার টাকার প্রয়োজন আছে… কোনোভাবে… কোনোভাবে আমাকে বেশ খানিকটা টাকা পাইয়ে দাও… আমি সারাজীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব‍।”

আমার বাকি দুই বন্ধু কী চেয়েছিল, আমি জানি না। তবে নিজের প্রার্থনাটুকু সেরে নিয়ে আমি চোখ খুলে ফেললাম। এবার সেই ভদ্রলোক বললেন, “ভাংড়ু তোমাদের প্রার্থনা শুনেছেন। চিন্তা কোরো না, সেটা খুব তাড়াতাড়ি পূরণ হবে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, তোমাদের তিনজনের মধ্যে একজনের জীবনে নেমে আসতে চলেছে একটা ঘোর বিপর্যয়… তৈরি থেকো।” সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়েও আমার মাথায় কেবল একটা কথাই ঘুরছিল যে, আদৌ কি এসব সত্যি? নাকি কেবল একটা কুসংস্কার! চারপাশের পরিবেশ কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। কিছু ভালো লাগছিল না আর। তারপর আর কি! সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছিলাম মাটির ওপরে। বেদীর মুখে পাথরটা চাপা দিতে দিতে ভদ্রলোক বলেছিলেন, “যাই হয়ে যাক না কেন, এসব কথা তোমরা আর কাউকে কখনও বোলো না। কারণ আমি চাই না আবার কেউ ভাংড়ুর কোপে পড়ুক। খবরদার, লোভে পড়ে কেউ কোনোদিন একা এই জায়গায় আসার চেষ্টা কোরো না, তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হতে পারে।”

মনের মধ্যে অদ্ভুত এক দোটানা নিয়ে সেদিন রাতে ফিরে এসেছিলাম ভদ্রলোকের বাড়িতে। সেদিন ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রকৃতি যেন ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে দিচ্ছিল সবকিছু। মাঝেমাঝেই বাজের আওয়াজে কেঁপে উঠছিল চারপাশ। যেন সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে মুহূর্তে! রাতটা ওঁর বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন আমরা তিনজন নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। পথে আসতে আসতে আমাদের মধ্যে অনেক কথা হয়েছিল। আমার বাকি সঙ্গীরা তো বিশ্বাসই করেনি সেই ভদ্রলোকের সাবধান বাণী। ওরা বলেছিল, ‘দেখ ভাই, এসব এক-একটা অন্ধ বিশ্বাস। তা ছাড়া তোর সঙ্গে আসার একটা কারণ এটাই যে, অনেকদিন ভালো করে কোথাও ঘোরা হয়নি। তাই ভাবলাম রথ দেখা, কলা বেচা দুটোই যদি হয়ে যায়, ক্ষতি কী! আর এসব ভাংড়ু-ফাংড়ু কোনো দেবতা নয়, এসবই মানুষের মনগড়া একটা চিন্তাভাবনা… শুধু শুধু একটা অবলা জীব মরল… পারেও বটে এরা।’ তথাকথিত সেই দেবতাকে ব্যঙ্গ করে ওরা হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে গড়িয়ে পড়ছিল। আমি সেভাবে যুক্তি-তর্ক দিয়ে ওদের কিছু বোঝাতে যাইনি আর। কারণ আমি নিজেও বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে, আদৌ কি এসব সত্যি! বাড়ি ফিরে আসার পর প্রথম কয়েকটা দিন অদ্ভুত একটু উৎকণ্ঠার মধ্যে কেটেছিল। তারপর মনে হল, সত্যি হয়তো ওসব মানুষের মনগড়া একটা কুসংস্কার মাত্র। কিন্তু আসল চমকের তখনও অনেক বাকি ছিল। আরও দিন দুয়েক বাদে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ পড়ছিলাম, এমন সময় পিওন চিঠি নিয়ে আসে। চিঠিটা নিয়ে রেখে দিয়েছিলাম টেবিলে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর কী মনে হতে চিঠিটা খুললাম। আর তারপর চিঠির বিষয়বস্তু দেখে আমার গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে গেল। আমার এক কাকা ছিল, নিঃসন্তান কিন্তু বুড়োর প্রচুর টাকা ছিল। যদিও বুড়োর কাছ থেকে কখনও সেভাবে কিছু পাইনি, কারণ বুড়ো সবকিছু যকের ধনের মতো আগলাত। সেই বুড়ো নাকি কয়েকদিন আগে বুকের যন্ত্রনায় হঠাৎ মারা যায়, মৃত্যুর আগে উইলে তার সম্পত্তির একমাত্র অংশীদার করে গিয়েছে আমায়। সত্যি কথা বলতে, বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলাম না। এটা কী করে হতে পারে! এসব কি সত্যি সেদিনের সেই দৈবের প্রভাব? নাকি অতি স্বাভাবিক এক ঘটনা! খুব অদ্ভুতভাবে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হলাম রাতারাতি। আমার স্ত্রীর সেই মুহূর্তে একটা অপারেশনের জন্যে প্রচুর টাকার দরকার ছিল। ঈশ্বরের আশীর্বাদে কিংবা বলা যেতে পারে ভাংড়ুর অনুগ্রহে, সে নিয়ে আমার আর কোনো সমস্যা রইল না। আমার বাকি দুই বন্ধু ঠিক কি চেয়েছিল, সেটা আমি জানি না। আর একটা ব্যাপার নিয়ে একটু ভয়ে ভয়ে থাকতাম যে, যদি এই সবকিছু সেদিনের সেই অখ্যাত গ্রামের এক গোপন ঈশ্বরের আশীর্বাদে হয়ে থাকে, তাহলে সাবধানবাণী অনুযায়ী আমাদের তিনজনের মধ্যে একজন মারা যাবে। তাহলে মৃত্যু তার থাবা সবার প্রথমে কার ওপরে বসাবে? চিন্তায় চিন্তায় আমার রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল। এমনও হয়েছিল আমি সন্ধের পর বাড়ি থেকে বেরোতাম না আর। খালি মনে হতো রাতের অন্ধকারে যদি মৃত্যুর নির্মম থাবা আমার ওপর নেমে আসে, তাহলে? আমার সেই পাগলামো দেখে আমার স্ত্রী অনেকবার জানতে চেয়েছিল যে, কী হয়েছে? কিন্তু আমি চেয়েও সত্যিটা জানাতে পারিনি ওকে। এভাবেই দিন কাটতে লাগল। এক মাসের মাথায় খবর পেলাম আমাদের তিন বন্ধুর মধ্যে একজন দুর্ঘটনায় মারা গেছে। মৃত্যুটা নাকি খুবই অদ্ভুতভাবে হয়েছিল তার। বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে একখানা বড়োসড়ো পুকুর ছিল ওদের। প্রতিনিয়ত সে পুকুরেই স্নান করত। সেদিনও নাকি দুপুর বেলা বাড়িতে বলে যায় যে, স্নান করে এসে ভাত খাবে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন সে ফেরে না, তখন তার বাড়ির লোকজন খোঁজ করতে গিয়ে দেখে সে পুকুরে নেই। চারপাশে খোঁজাখুঁজি চলে, কিন্তু সে যে পুকুরে ডুবে যাবে— এমনটা আশা করেনি কেউই। তার লাশ ভেসে উঠেছিল পরদিন সকালবেলা। যে মানুষটা এত বছর ধরে সাঁতার কেটে এসেছে, সে এভাবে জলে ডুবে মারা যাবে— এটা কল্পনার বাইরে। তার ফুলে ফেঁপে ওঠা লাশের গলায় বাঁধা ছিল পরনের ধুতিখানা। কীভাবে যে এটা হল, সেটা রহস্য রয়ে গিয়েছে আজও। সেই বন্ধুর মৃত্যুটা আকস্মিক ছিল নাকি সেই দৈববাণীর ফল— সেটা নিয়েও একটা সন্দেহ রয়ে গিয়েছে আমার মনে। তবে মাথার ওপর থেকে মৃত্যুভয়টা যদিও সরে গিয়েছিল, কিন্তু তার বদলে আরও একখানা উপসর্গ দেখা দিল আমার। ঘুমের ঘোরে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখা। কখনও কখনও দেখতাম আমি একা একা সেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছি মাটির গভীরে। আমার ঠিক সামনে এগিয়ে চলেছে একটা ছায়ামূর্তি। যে এগিয়ে চলেছে, তার মুখ দেখতে পাচ্ছি না। যতবার তাকে ধরার চেষ্টা করছি, ততবার সে আমার নাগালের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় পর দেখতাম আমি একটা খাদের ধারে দাঁড়িয়ে, আর আমার সামনে একরাশ কালো বিড়াল আমায় ঘিরে ধরেছে। তাদের প্রত্যেকের চোখেই নির্মম এক হিংস্রতা। একটু একটু করে ওরা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি সরতে সরতে একেবারে কিনারায় গিয়ে পৌঁছেছি। আর কয়েকটা পা পিছোলেই আমি অতল গভীরে পড়ে যাব। ঠিক সেই মুহূর্তে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আমার পা ধরে কেউ টেনে নেয়, আর আমি আর্তনাদ করে পড়তে থাকি সেই অতল গভীরতায়। এসব দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসি বিছানায়। অনেক চেষ্টা করেও তারপরে ঘুমাতে পারি না আর। ডাক্তার দেখিয়েছিলাম কিন্তু ডাক্তার বলেছে যে, এসব নাকি আমার মনের ভুল। সবাইকে তো আর সত্যিটা বলা যায় না। তাই না!”

গল্প বলা শেষ করে বুড়ো একদৃষ্টে তাকালেন অনির্বাণের দিকে। গল্প শুনতে শুনতে অনির্বাণের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল। গল্পটা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও হয়তো তার রেশ রয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ। বুড়ো একটু হেসে বললেন, “কী হে, গল্প শুনে মনে হচ্ছে তুমি ভয় পেয়ে গেলে?”

“আপনি এতক্ষণ ধরে যেগুলো বললেন, সেগুলো সত্যিই আপনার জীবনে ঘটেছে?” অনির্বাণের গলাটা ভীষণ শুকনো লাগে এই মুহূর্তে।

— না হলে আর বলছি কী! আমার জীবনে না ঘটলে আমি এসব জানতে পারতাম কীভাবে বলো তো? দেখেছ কাণ্ড, এত বড়ো গল্প… এক ঘণ্টা প্রায় হতে যায়। এসব গল্প একবার শুরু হলে আর শেষ হওয়ার নয় সহজে।

— আপনি যে দ্বিতীয় ঈশ্বরের কথা বললেন, তাঁর দেখা কোথায় পেয়েছিলেন আপনারা?

— দেখা পাইনি সেইভাবে, তবে তিনি থাকেন রাজস্থানের খুবই অখ্যাত একটা গ্রামে… লোকালয় থেকে বহুদূরে।

আর শুনতে চায়নি অনির্বাণ। ওর মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে যেন ওর মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। দু’হাতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরে সে। বুড়ো ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আরে আরে… কী হল তোমার?”

— তেমন কিছু না, শরীরটা একটু খারাপ লাগছে।

— এ বাবা… তুমি ঠিক আছো তো? হঠাৎ কী হল, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

— আমি ঠিক আছি… শুধু একটু রেস্ট নিতে হবে আমায়।

— বেশ বেশ, তুমি এখন একটু বিশ্রাম নাও। কিন্তু ওদিকে তো বোধহয় মিমবাবুর ফেরার সময় হয়ে গেল।

— হুমম, সেটা আমি বুঝতে পারছি, তবে…

— যদি কিছু মনে না করো, একখানা কথা বলি? এমনিতেই আমি একলা মানুষ, আপত্তি না থাকলে মিম বাবুকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি আমি! ছেলেটা আজ বিয়ে-থা করলে হয়তো ওর বয়সী আমার একখানা নাতি-নাতনি থাকত… তুমি বরং একটু বিশ্রাম নাও বুঝলে।

অনির্বাণ আপত্তি করতেই যাচ্ছিল, এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। দরজা খুলতেই মিম ঘরে ঢুকে আসে। পিছনে ওদের ফ্ল্যাটের মিসেস দস্তিদার। হেসে বললেন, “শরীর ভালো আছে অনির্বাণ বাবু?”

— হুমম, আপনি কেমন আছেন?

— এইই চলে যাচ্ছে … সারাদিন বাচ্চাগুলোকে সামলাতে সামলাতে আমার আর সময় কই নিজের জন্য… আচ্ছা, আসি তাহলে।

মিসেস দস্তিদার চলে যান। মিম স্কুলবাসে করে ফেরার পর উনি মাঝে মাঝে এগিয়ে দেন ওকে। একই ফ্ল্যাটে থাকে ওরা, তাই আর কি! অন্যান্য দিন অনির্বাণ মিমকে রিসিভ করতে মেন-গেটেই ওয়েট করে। কিন্তু আজ গল্পটা শুনতে শুনতে সে যেন নিজের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। মিম ঘরে ঢুকেই নিজের রুমে চলে গেল। অনির্বাণ দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে সোফায় বসে পড়ল। ওর ভেতরকার অস্বস্তিটা একটু একটু করে বাড়ছে। বারবার মনে হচ্ছে যে, ছন্দটা ঠিক মিলছে না। ওকে চুপ দেখে বুড়ো জিজ্ঞেস করলেন, “ডাক্তার ডাকব… কীহে?”

— না না, আমি একটু রেস্ট নেব এখন।

— আমি তাহলে মিম বাবুকে…

“নাহ্”, বুড়োকে কথা শেষ করতে দেয় না অনির্বাণ, “ও বাড়িতেই থাক এখন। তা ছাড়া স্কুলে কী করালো, কালকের হোমওয়ার্ক কী কী দিল— সেই সবকিছু আমাকেই দেখতে হয়… তাই পরে কোনো একদিন না হয় বেরোনো যাবে।”

বুড়ো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেন, তারপর মুখ খুললেন, “আচ্ছা বেশ, শরীরের খেয়াল রাখো। আমি আবার পরে আসব’খন।”

বুড়ো চলে যাওয়ার পর অনির্বাণ বাথরুমে ঢোকে। বেসিনের কলটা চালিয়ে দিয়ে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিতে থাকে অনবরত। যেন শরীরের সমস্ত অস্বস্তি নিমেষে দূর হয়ে যাবে এতে। ও আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখল, নিজেকে কেমন যেন বিধ্বস্ত লাগছে। এটা কী করে হতে পারে! এত মিল কীভাবে সম্ভব? কেমন যেন জটিল হয়ে যাচ্ছে ঘটনাগুলো। মনে হচ্ছে মাথাটা ফেটে যাবে চিন্তার ভারে। হাত বাড়িয়ে শাওয়ারটা চালিয়ে দেয় অনির্বাণ। একরাশ জলের ফোঁটা তীক্ষ্ণবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর। ঠান্ডা জলের ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর শুকনো পোশাক। একটু একটু করে ছটফটানি ভাবটা কমতে থাকে অনির্বাণের মনের ভেতর। জোরে জোরে বেশ কয়েকটা নিঃশ্বাস নেয় সে। এই মুহূর্তে ভীষণ ক্লান্ত লাগে ওর নিজেকে। শাওয়ারের জলে ভিজে যেতে যেতে ও ধপ করে বসে পড়ে বাথরুমের মেঝেতে।

.

মৈত্রেয়ী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেকআপ সেরে নিচ্ছিল। ফাউন্ডেশনটা লাগাতে লাগাতেই গলাটা একটু উঁচু করে ও বলল, “অনি… প্যাকেজিংটা আর একবার চেক করে নাও প্লিজ… কোনোকিছু বাদ পড়ে যায়নি তো লিস্ট থেকে আমাদের?”

অনির্বাণ পাশের ঘরে লাগেজ চেক করছিল। ওদের তিনজনের প্রয়োজনীয় জামাকাপড়, টুকিটাকি জিনিসপত্র আর ওর কিছু দরকারি ফাইলস সেট করে গুছিয়ে রেখেছে ও। মৈত্রেয়ীর কথা শুনে ও বলল, “আমি সবকিছু চেক করে নিচ্ছি, তুমি চিন্তা কোরো না।”

— ওলা বুক করে রেখেছ তো তুমি?

— হুমম, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসবে।

— গুড… বাই দ্য ওয়ে, আমার স্যালাডের প্লেটটা একটু এনে দাও না। প্রপার টাইম মেনটেন না করলে কোনো ফল পাওয়া যাবে না।

অনির্বাণ ছোটোখাটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর কিচেনে চলে যায়। মৈত্রেয়ীর চেহারার বাঁধুনি‌ বেশ ভালোই। কিন্তু তাও ও নিজেকে নিয়ে ভীষণ খুঁতখুঁত করে। ডায়েটিং, স্কিন কেয়ার, জিম— এসব কিছুর ফাঁকে কোথাও গিয়ে যেন অনির্বাণকে সময় দিতে ভুলে যায় ও। অনির্বাণের খারাপ লাগে, কিন্তু তাও কিছু বলে না ও। কী দরকার শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে! যে বুঝতে চায় না, তাকে জোর করে বোঝানো যায় না কখনও। অনির্বাণ প্লেটে স্যালাড কুচি নিয়ে এসে রাখে ড্রেসিং টেবিলের ওপর। মৈত্রেয়ী প্লেট থেকে এক টুকরো শসা মুখে দিয়ে বলে, “আমার প্রজেক্ট ডকুমেন্টসগুলো আমি একটা ফাইলে রেখেছিলাম, ওটা আমার ব্যাগে রেখেছ তো?”

— হমমম

— মনে রেখো ছটায় ফ্লাইট, আধঘণ্টা আগে কিন্তু আমাদের পৌঁছতে হবে।

— আমরা তৈরি, তুমি রেডি হয়ে নাও, দেন গাড়ি এলেই … যেতে আর কতক্ষণ লাগবে!

— সেইই… এখান থেকে দমদম যেতে একদম সময় লাগবে না, তাই না? তুমি এতটা ক্যাজুয়ালি সবকিছু কীভাবে নাও, আমি বুঝি না… টাইম কটায় দিয়েছ ড্রাইভারকে?

— বললাম তো, আর কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। তুমি রেডি হয়ে নাও।

মৈত্রেয়ী আর কিছু না বলে আইলাইনারের কৌটো থেকে তুলিটা বের করে নেয়।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন