ঈশ্বর ভালো নেই – ৯

খুব দূর থেকে অস্পষ্ট একটা শব্দ কানে আসছে। চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে রয়েছে এই মুহূর্তে। সারা শরীর যেন ভীষণ ক্লান্ত, অবসন্ন। মাথার পিছনে ভীষণ ব্যথা। কোনোমতে জড়ানো চোখের পাতা দুটো খোলে অনির্বাণ। দৃষ্টি ঝাপসা। বেশ কয়েকবার ভালো করে তাকানোর পর অবশেষে সবকিছু পরিষ্কার হয় তার চোখের সামনে। মেঝের একপাশে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে ওকে। মোমবাতিগুলো তখনও জ্বলছে। একটা থমথমে ভাব ঘরের চারপাশে। ওকে চোখ খুলতে দেখে মৈত্রেয়ী এগিয়ে আসে ওর দিকে। হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে ওর সামনে। তারপর ওর মাথার চুলে নরম আঙুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলে, “কী হল অনির্বাণ… খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি… আহা রে, কী করবে বলো তো… এত পাকামো করে আমায় ফলো নাই বা করতে পারতে… কী লাভ হল বলো?”

“এখানে… এখানে…”, অনির্বাণ কোনোমতে শব্দগুলো উচ্চারণ করার চেষ্টা করে।

“কী এখানে? ভালো করে বলো অনি”, খিলখিল করে হেসে ওঠে মৈত্রেয়ী, “এখানে আমি কী করছি, এটা জানতে চাইছ? অনির্বাণ দেশমুখ, এত জানার আগ্রহ কীসের… বেশি জানার চেষ্টা করতে নেই, জানো তো… না হলে কে জানে কখন কী থেকে কী হয়ে যায়।”

“কী করতে চাইছ তুমি?” থেমে থেমে কথাগুলো বলে অনির্বাণ।

“আমি… আমি তো অনেক কিছু করতে চাই… শুনবে তুমি…”, মৈত্রেয়ী ঠোঁট নামিয়ে আনে অনির্বাণের কানের কাছে, “তাহলে তোমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে দিই, কী বলো?”

ফের হেসে ওঠে মৈত্রেয়ী। ওর হাসির শব্দ ধাক্কা খাচ্ছে ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ চুপ করে যায় সে। গলার স্বরটা ভীষণ সিরিয়াস হয়ে যায় তার, “অনির্বাণ দেশমুখ… সারাটা জীবন শুধু বইয়ে মুখ গুঁজেই কাটিয়ে দিলেন, এর বেশি না তো কিছু হিসেব করেছেন, না তো কখনও বোঝার চেষ্টা। আমি মৈত্রেয়ী সেনগুপ্ত… আমার চাহিদাগুলোকে আপনার মতো এত সহজে বাঁধতে পারিনি। জীবনে ভালোভাবে বাঁচতে গেলে ক্ষমতার প্রয়োজন… বিশ্বাস করো, আমি শুধু সেই ক্ষমতা দখল করতে চাই মাত্র… এর বেশি কিচ্ছু না, আমার প্রমোশন, এই ট্রিপ— সবকিছু কি আর এমনি এমনি হয়, অনির্বাণ বাবু! তার জন্য স্যাক্রিফাইস করতে হয়। আর আমি সেটাই করছি, কারণ জীবনে এখনও আমার অনেক কিছু হাসিল করা বাকি… সেজন্য একটা ছোট্ট প্ল্যান ছিল এটা… আপনি যদি আজ আমাকে ফলো না করতেন, তাহলে হয়তো এভাবে মরতে হতো না আপনাকে। কিন্তু ওই যে বলে, ভাগ্যে মৃত্যু লেখা থাকলে কে আর বাঁচতে পারে বলুন… তবে এটা বলব, এখানে এসে ভালো কাজ করেননি… এটা কার মন্দির জানেন, ভাংড়ুর… জানি কখনও নাম শোনেননি, তাই বলছি, এখানে ঢুকতে গেলে মূল্য দিতে হয়, আর সেই মূল্য হিসেবে এখন আপনার প্রাণ চলে যাবে, ব্যস… কী করবেন এবার!”

— তুমি সেই মৈত্রেয়ী নও, যাকে আমি ভালোবেসেছিলাম… কে তুমি?

— এসব পাতি ভালোবাসায় কিচ্ছু হয় না, ক্ষমতাই আসল… তা ছাড়া একটু একটু করে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে সময় লাগে, সেজন্যই তোমায় বেছে নিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম কাজ মিটে গেলে সরে পড়ব এভাবেই, কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না, বুঝতে পারবে না, কিন্তু মাঝখান থেকে তুমি সব বিগড়ে দিলে… ডিসগাস্টিং।

— মিম কোথায়?

“অন্যের বাচ্চার ওপর এত কীসের দরদ অনির্বাণ বাবু?” ব্যঙ্গ করে বলে মৈত্রেয়ী।

— কী বলতে চাইছ তুমি?

— যাকে তুমি এতটা ভালোবাসো, যার জন্য নিজের প্রাণ বাজি রেখে এখানে এসেছ, সেটা তো তোমার সন্তান নয়… তাহলে আর খোঁজ নিয়ে কী হবে!

— মিম… মিম আমার সন্তান নয়?

— নাহ্, তুমি ওর বাবা নও… জানতে চাও ওর বাবা কে?

অনির্বাণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মৈত্রেয়ীর দিকে। মৈত্রেয়ী মুচকি হাসে, “তোমার মনে আছে এর আগেরবার আমরা যখন রাজস্থান ঘুরতে এসেছিলাম, তখন আমাদের সঙ্গে আরও একজন ছিল। নাহ্, তুমি তাকে চিনতে না। ও ছিল আমার প্রাক্তন প্রেমিক। সেই আমাকে এখানকার এই মন্দিরের সম্পর্কে জানিয়েছিল। ওর কাছ থেকে আমি ধীরে ধীরে সবকিছু জেনে নিই। এখানকার দেবতা কে, সেই দেবতাকে কীভাবে তুষ্ট করতে হয়, সবথেকে বড়ো বিষয়… এমন কিছু বিশেষ তিথি, যে তিথিতে দেবতা জেগে ওঠেন আর সেই দেবতাকে দিতে হয় মহাভোগ। আর এই মহাভোগ যে দেয়, সে এক প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়। মনে আছে, আমাদের গাইড কী বলেছিল? আজ সেই ওমেগা তিথি… এই তিথিতে জেগে ওঠেন দেবতা… আজকের দিনে দেবতার কাছে যা চাইব, আমি সেটাই পাব… এই সবকিছু আমি জেনেছিলাম দেবরূপের থেকে। তুমি তো সবসময়ের হাঁদাক্যাবলা একটা মানুষ… তাই আশেপাশে কী হচ্ছে, সেদিকে তুমি কখনওই খেয়াল করোনি… তোমার চোখের আড়ালে আমরা ঘুরতে গেছি, একসাথে সময় কাটিয়েছি, এমনকি ও আমাকে শারীরিক তৃপ্তিও দিয়েছে… মিম তোমার নয়, দেবরূপের সন্তান। আমি তো জন্ম দিতে চাইনি অনির্বাণ, তুমি জোর করেছিলে। আমার মনে হয়েছিল যে, বাচ্চাটাকে নিয়ে তুমি ভুলে থাকবে আর সেই সুযোগে আমি আমার আখের গুছিয়ে নিতে পারব… তোমার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স থেকে শুরু করে প্রপার্টি পেপার— সব আমার কাছে। এছাড়া তোমার বিধবা স্ত্রী… মানে আমি সেই সমস্ত লাইফ ইন্সুরেন্স পেয়ে যাব, যেগুলো তুমি করে রেখেছ। আমাদের ডিভোর্স হলে কম্পেন্সেশন হিসেবে এত কিছুও হয়তো পেতাম না আমি… এখান থেকে আমি সোজা চলে যাব ব্যাংকক… ওখান থেকে ফ্লাইট ধরে দেশের বাইরে। আমাকে এখন আর কেউ ছুঁতে পারবে না অনির্বাণ… আমি এখন সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে।”

— এত কিছু করেছ শুধু আমার প্রপার্টির জন্যে?

— উহু… সেটা তো উপরিপাওনা। আমি যে সেক্টরে আছি, সেখানকার মেন লিড আমার হাতে চলে আসবে, পুরো কোম্পানির ওপর ছড়ি ঘোরাব আমি… ক্যান ইউ ইম্যাজিন… অনির্বাণ দেশমুখ!

— কতদিনের পরিচয় তোমাদের?

— খুব বেশি না… সাত-আট বছর ধরে নাও। ও আমার জীবনে না এলে তো আমি জানতেই পারতাম না যে, আমাদের বিশ্বাসের আড়ালেও অনেক কিছু গোপন রয়ে যায়।

— সে এখন কোথায়?

— জানি না, তবে এটুকু জানি এখনও সে আমায় ফলো করছে… ও জানে আমি কখন, কোথায়, কীভাবে আছি… আমাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল, তারপরেও আমার পিছু ছাড়েনি, আমাকে মাঝেমাঝেই চিঠি পাঠিয়ে ও জানান দিত যে, আমার ওপর ওর নজর আছে… এখান থেকে বেরিয়ে ওর নাগালের বাইরে চলে যাব আমি।

— এত সহজ? হোটেলের সিসিটিভি ক্যামেরায় সব রেকর্ড থাকবে নিশ্চয়ই।

— বোকা অনির্বাণ… তোমার কী মনে হয়, আমি খোঁজ না নিয়ে এতকিছু করেছি? হোটেলের কাউকে হাত করে সিসিটিভি ক্যামেরা খারাপ করে রাখার আইডিয়া অনেক আগেই আমার মাথায় চলে এসেছিল… এটা নিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

— আর সেই অটোচালক … ওরা তো আছে, ওরা সব বলবে।

— ওই যে তোমাকে বললাম, টাকার থেকে বড়ো পৃথিবীতে আর কিছু হয় না… টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করা যায়… কুল বেবি… আর-একটা কথা বলি তোমায়, কালকে আমি কোনো দোকানে কোনোরকম গয়না কিনতে যাইনি, কাল আমি এখানে পুজোর দ্রব্যাদি কিনে এনে সবকিছু গুছিয়ে রাখতে এসেছিলাম, তাই তো অতটা দেরি হল… আচ্ছা ছাড়ো, আমার এবার সময় হয়ে এল।

— কীসের?

— দেবতাকে মহাভোগ দেওয়ার।

— বাচ্চাটাকে ছেড়ে দাও… প্লিজ।

— পাগল নাকি! ভাংড়ুর পুজো কখনও অসমাপ্ত রাখতে নেই… দেবতা নিজেই নিজের প্রসাদ গ্রহণ করে নেন… তা ছাড়া আজকে দেবতা বেশি খুশি হবেন, একটা নয়… দু’খানা বলি পেয়ে।

— এসব একটা কুসংস্কার… প্লিজ মিতু, এসব কোরো না।

— সবকিছু কুসংস্কার হয় না অনির্বাণ, কিছু কিছু জিনিস থাকে সাধারণ মানুষের ভাবনার বাইরে।

— তুমি মিমের সঙ্গে কী করেছ?

— কিছুই না, ঘুমের ওষুধের এফেক্টে ঘুমাচ্ছে ও… একটু পরেই তো চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়বে, তাই ওকে আর জ্বালাতন না করাই ভালো।

— তুমি… তুমি এটা করতে পারো না মিতু।

— আমি অনেক কিছু করতে পারি অনির্বাণ… শুধু দেখে যাও তুমি… আর কিছুক্ষণ পরেই অশুভ লগ্ন পড়তে চলেছে… থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ফর এভরিথিঙ্‌ অনির্বাণ।

“মিতু… মিতু প্লিজ… এমন কোরো না মিতু”, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে অনির্বাণের।

অনির্বাণের কাতর আবেদনকে উপেক্ষা করে উঠে যায় মৈত্রেয়ী। ভেতরের গুমোট ভাবটা একটু একটু করে বাড়ছে। সেই মাংস পচা গন্ধটা ইতিমধ্যে বেশি করে নাকে ধাক্কা মারছে। মৈত্রেয়ী এবার বাচ্চাটাকে নিয়ে আসে বেড়ার সামনে। প্রথমে নিবেদন করে রক্তমাখা সেই ভোগ। তারপর ছুরিখানা তুলে ধরে এক কোপে বাচ্চাটার গলার নলি কেটে দেওয়ার জন্য। মোমবাতির আলোয় ছুরির ধারালো ফলাটা চকচক করে ওঠে। অনির্বাণ শেষবারের মতো একটা চিৎকার করে ওঠে। ঠিক সেই মুহূর্তে খুব কাছে কোথাও বাজ পড়ে।

“আহ্!”

মৈত্রেয়ীর গলা দিয়ে একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে আসে। এই বীভৎস দৃশ্য দেখার মতো অনির্বাণের সাহস ছিল না। ও চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। মৈত্রেয়ীর চিৎকারে ও তাকিয়ে দেখল, ছুরি ফেলে মৈত্রেয়ী ঘাড় ধরে মেঝেতে বসে পড়েছে। ঠিক সেই সময় আর-একটা কণ্ঠস্বর কানে আসে অনির্বাণের।

“ঠিক আছো?”

স্বরটা যেদিক থেকে এল, সেদিকে তাকিয়ে অনির্বাণ দেখতে পেল, আরেহ… এ তো সেই বুড়োটা, জয়সলমীরে আসার পথে যাদের গাড়ির সঙ্গে ওদের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। কিন্তু লোকটা এখানে কী করছে? বুড়ো তাড়াতাড়ি এসে অনির্বাণের হাত আর পায়ের বাঁধন খোলার চেষ্টা করেন। বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, “আমি জানতাম এমন কিছু একটা হবে… ইশশ, আমার আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।”

হঠাৎ একটা কথা বিদ্যুৎ চমকের মতো খেলে যায় অনির্বাণের মাথায়। বুড়ো তো রাজস্থানী, তাহলে বাংলা বলছে কীভাবে! এটা মৈত্রেয়ীর কোনো চক্রান্ত নয় তো? ওর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিয়ে ওকে ধরে-ধরে বসানোর চেষ্টা করেন বুড়ো। কোনোরকমে বসে অনির্বাণ। মাথার পিছনটা ভীষণ ভারী হয়ে রয়েছে। অনির্বাণ জিজ্ঞেস করে, “আপনি…?”

— সব বলব’খন… তুমি ঠিক আছো তো?

— হ্যাঁ… আছি।

— বেশ… তবে খুব সাবধান। এই মেয়েটা ভীষণ ডেঞ্জারাস।

— আপনি চেনেন ওকে?

বুড়ো মৃদু হাসেন। মৈত্রেয়ী ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে ফের উঠে দাঁড়িয়েছে। ও ফিরে তাকায় বুড়োর দিকে। দু’চোখ জ্বলজ্বল করছে মৈত্রেয়ীর, এক বীভৎস জিঘাংসা সেই দৃষ্টিতে। ও এবার ছুরিটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে ওদের দিকে।‌

“বাচ্চাটাকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারো এখান থেকে সরে যাও”, অনির্বাণের কানে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠেন বুড়ো। তারপর পকেট থেকে একটা সরু বাঁশি বের করেন। মৈত্রেয়ী ততক্ষণে ছুরি নিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে বুড়োর ওপর। বুড়ো চোখের পলকে সরে যান অন্যদিকে। ব্যর্থ হয়ে আরও ক্ষেপে ওঠে মেয়েটা। বুড়ো সেই বাঁশিটা মুখে নিয়ে খুব জোরে ফুঁ দেন। মৈত্রেয়ী বাঁহাত চেপে ধরে আর্তনাদ করে ওঠে। অনির্বাণ ততক্ষণে কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে মিমের কাছাকাছি এগিয়ে যায়। মাথায় এত জোরে লেগেছে যে, টাল সামলাতে পারছে না ও। মিমের কাছাকাছি গিয়ে ওকে বুকের মধ্যে তুলে নেয় অনির্বাণ। বাচ্চাটা তখনও ঘুমিয়ে কাদা। গাছের গোড়ায় চোখ পড়ে অনির্বাণের। প্রায় এক হাত লম্বা পাথরের একটা মূর্তি। এটাই কি ভাংড়ু? এমন কি অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে এই পাথর খণ্ডের? পাথরের গায়ে ছোপ ছোপ রক্ত। আজও তাহলে মানুষ কুসংস্কারের বশে এভাবে প্রাণ হত্যা করে থাকে! গাছের চারপাশে লোহার শিক গেঁথে বেড়া বানানো। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়, দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অনির্বাণের ভাবনায় ছেদ পড়ে। কারণ মৈত্রেয়ী ছুরি হাতে পাগলের মতো ছুটে আসে ওর দিকে। ওর লক্ষ্য মিম। ছুরিটা অতর্কিতে চালাতে গিয়ে অনির্বাণের কাঁধের পাশটা ফালা ফালা হয়ে যায়। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠে অনির্বাণ।

“আমার আজকের পুজো আমি কিছুতেই অসমাপ্ত হতে দেব না… লগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছে, আর দেরি করলে চলবে না”, হিসহিসিয়ে বলে ওঠে মৈত্রেয়ী।

ডান কাঁধ রক্তে ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু অনির্বাণ নাছোড়বান্দা। ও কিছুতেই মিমকে এই নৃশংসতার বলি হতে দেবে না। একহাতে মিমকে ধরে অন্যহাতে মৈত্রেয়ীকে ঠেলে সরিয়ে দেয় অনির্বাণ। অনির্বাণের ঠেলা খেয়ে মৈত্রেয়ীর পা পড়ে মেঝেতে পড়ে থাকা মোমবাতির ওপর। পা স্লিপ করে যায় ওর। তাল সামলাতে না পেরে ও চিত হয়ে পড়ে যায় সেই লোহার শিকের বেড়ার ওপর। সেই বেড়া এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয় মৈত্রেয়ীর নরম শরীর। ওর কিছুটা রক্ত ছিটকে পড়ে সেই মূর্তির গায়ে। মিশমিশে কালো মূর্তির গা বেয়ে টকটকে রক্তের ধারা নামতে থাকে। মৃত্যুমুখী মৈত্রেয়ীর কানফাটা আর্তনাদে চারপাশের নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে যায়। ছটফট করতে করতে ওর শরীরটা মুহূর্তের মধ্যে নিথর হয়ে যায়।

“ভাংড়ু নিজেই তার পূজার বলি গ্রহণ করেছেন”, বিড়বিড় করে বলে ওঠে সেই বুড়ো।

এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যাওয়া মৈত্রেয়ীর শরীরের দিকে তাকিয়ে থমকে গিয়েছিল অনির্বাণ। থরথর করে কাঁপতে থাকে সে। এটা কী হয়ে গেল! কিছুই যেন বুঝতে পারছে না ও। কাঁপতে কাঁপতে দেওয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে অনির্বাণ। বুড়ো এগিয়ে আসেন ওর দিকে। পিঠে হাত রেখে সস্নেহে বলে ওঠেন, “চলো অনির্বাণ, এখানে থাকা আর উচিত হবে না।”

ফ্যালফ্যাল করে বুড়োর মুখের দিকে তাকায় অনির্বাণ। কে এই বুড়ো? এটা আবার কি কোনো নতুন চক্রান্ত! বুড়ো বোধহয় ওর মনের কথা আঁচ করতে পারেন। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে একটানে নিজের মুখের দাড়ি গোঁফ টেনে খুলে ফেলেন। পরচুলা খুলে ফেলতেই অনির্বাণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। এটা তো বিনোদ ভটচাজ… ইনিই তো কলকাতায় ওদের ফ্ল্যাটে প্রতিবেশী হয়ে আলাপ করতে এসেছিলেন! লোকটা এখানে কী করছে?

“আমি জানি তোমার মনে এখন অনেক প্রশ্ন, অনির্বাণ… কিন্তু আমার মনে হয় এসব নিয়ে আর এখানে আলোচনা করে লাভ নেই… দেবতার পুজো কখনও অসমাপ্ত থাকে না অনির্বাণ, তোমায় এটা আমি আগেই বলেছিলাম, দেবতা নিজের ভোগ স্বীকার করেছেন… চলো অনির্বাণ, সব কথা কলকাতায় গিয়ে বলব… রাজস্থানকে বিদায় জানানোর সময় হয়ে এসেছে, এবারে আর প্লেনে নয়, আমরা তিনজনেই ট্রেনে করে ফিরব”, বুড়ো স্বগতোক্তি করেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন