মিনিট দশেক পর ক্লান্ত অনির্বাণ যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, মৈত্রেয়ী ওর ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। রাতের জয়পুর ভীষণ স্নিগ্ধ। এক এক করে জ্বলে ওঠা আলোয় নেশা ধরে যায় চোখে। এই সময়টায় ভীষণ ঠান্ডা লাগে। হাউসকোটের ওপর মোটা জ্যাকেট পড়েছে মৈত্রেয়ী। ফস করে একটা সিগারেট ধরায় ও। কয়েকটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কললিস্ট ঘেঁটে পরিচিত একটা নম্বরে ফোন করে ও। খুব দূর থেকে একটা রাতচরা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। সেই ডাককে অতিক্রম করে বাতাসের বুকে ভর করে এগিয়ে আসছে বেহাগের এক করুণ রাগ। যেন কোনো রাজস্থানী মহিলা নিজের অতৃপ্তি জানান দিচ্ছে এই রাগের মাধ্যমে। ফোনটা রিসিভ হতেই মৈত্রেয়ীর স্বর আরও হালকা হয়ে ওঠে, “অ্যাকাউন্ট ডিটেইলসটা চেক করা হয়েছে?”
সিগারেটের ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে ঠান্ডা বাতাসে। একটু একটু করে রাত বাড়তে থাকে শীতের শহরে।
.
রাজস্থান সত্যিই একটা অদ্ভুত জায়গা। মানুষকে এমনভাবে মোহাচ্ছন্ন করে রাখে যে, এক একটা দিন কীভাবে পেরিয়ে যায় সেটার হিসেব রাখা হয় না। তার ওপর এখানকার আবহাওয়াও ভীষণ অদ্ভুত। দিনের বেলা যতটা গরম, রাতের বেলা ঠিক ততটাই ঠান্ডা। এরপর আবার এখানকার বিখ্যাত কিছু খাবারদাবার খেয়ে মন ভরে গেছে ওদের। শীর্ষেন্দু সত্যিই খুব বিচক্ষণ গাইড। জায়গার ইতিহাস সম্বন্ধে জ্ঞান তো ওর রয়েছেই। তা ছাড়াও এমন এমন জায়গায় ও নিয়ে গিয়েছে, যেখানকার খাবার না খেলে হয়তো ওদের রাজস্থান ভ্রমণ কিছুটা হলেও অসম্পূর্ণ রয়ে যেত। রাবত মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের পিঁয়াজ আর ডালের কচুরি, এডির লাল মাস, পনির আফতাব আর সুলা বিরিয়ানি, তাপরি সেন্ট্রালের চীজ ফুচকা আর পেস্তো খাকরা পিৎজা, চৌকি ধানির খাঁটি ঘি দিয়ে বানানো ডাল বাটি চুর্মা, এমনকি স্পাইস কোর্টের জঙ্গলি মাস যদি ওরা খেয়ে না দেখত— তাহলে হয়তো খুব দামী কিছু মিস করে ফেলত। অনির্বাণ খেতে ভীষণ ভালোবাসে, বলা ভালো ও প্রায় কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছে। এখানকার মানুষজনের জীবনযাত্রা এত সাধারণ, অথচ অতিথি আপ্যায়নের কায়দা ঠিক ততটাই অসাধারণ। ওরা যত দেখছে, তত বেশি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষজন কী ভীষণ সরল এখানকার! আর শীর্ষেন্দুদা তো মাটির মানুষ। কোনো কিছুতেই বিরক্তি নেই ভদ্রলোকের। সব সময় একগাল হাসি। এই যে দিন পনেরো ধরে ওদের একটার পর একটা জায়গায় ঘুরতে নিয়ে গিয়েছেন, সেখানকার অজানা ইতিহাস জানিয়েছেন, এমনকি এসব সুস্বাদু খাবারের খোঁজ দিয়েছেন— তারপরেও ওদের ওপর ভদ্রলোকের আগ্রহ একবিন্দু কমেনি। রাজস্থান তো আর ছোটোখাটো জায়গা নয়। এর এক একটা কোণায় লুকিয়ে রয়েছে এক একটা মূল্যবান বস্তু। কুম্ভলগড় দুর্গ, মেহরানগড় দূর্গ, রানী সতী মন্দির, বিজয় স্তম্ভ থেকে শুরু করে পাটোয়া প্রাসাদ, পদ্মিনী প্রাসাদ, ব্রহ্মা মন্দির— কোথায় ঘোরেনি ওরা! এক একটা জায়গার ইতিহাস অন্য জায়গাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। লোকমুখে চলে আসা কাহিনী শুনতে শুনতে ওদের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গিয়েছে। এতকিছুর পর শীর্ষেন্দু ওদের নিয়ে গিয়েছে রাজস্থানের এমন কিছু জায়গায়, যেখানকার হস্তশিল্প ভীষণ বিখ্যাত। মূল্যবান পাথরের গয়না থেকে শুরু করে হ্যান্ডমেড জামাকাপড়, মাটি দিয়ে বানানো নানা রকম কারুকার্য— কী ছিল না সেখানে! মৈত্রেয়ী নিজের পছন্দমতো বেছে নিয়েছিল বেশকিছু পাথরের অলংকার। সেসবে তাকে মানিয়েছিল বেশ। ঘর সাজানোর জন্য সে কিনে নেয় বেশ কয়েকটা রাজস্থানী চিত্রাঙ্কন। সূক্ষ্ম রেখা আর উজ্জ্বল রঙের এক আকর্ষণীয় সংমিশ্রণে শিল্পী সাদা কাগজের বুকে ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণ কারুকার্য। মন ভরে যায় এসব দেখলে। এসব জায়গায় দরদাম অনির্বাণের খুব একটা বেশি পছন্দ নয়। গরিব মানুষগুলো সংসার চালানোর জন্য কিছুটা লাভ তো রাখবেই! তাই বিনা বাক্যব্যয়ে ওদের দাবি মেনে নিয়েছে সে। এত সুন্দর একটা জায়গায় যখন ঘুরতে এসেছে, তখন মনে কোনো খেদ না নিয়ে যাওয়াই ভালো। মিমের জন্য ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু জামাকাপড় কিনেছে ওরা। সেসব রাজস্থানী পোশাকে অপূর্ব মানিয়েছে মিমকে। সময় যেন এখানে মুহূর্তের মধ্যে পেরিয়ে যাচ্ছে। একে একে যে এতগুলো দিন কেটে গিয়েছে, সেটা ওদের মনেই হয়নি। বরং যত দিন কেটেছে, তত যেন এই রাজস্থানকে ওরা আরও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে। মরুভূমির ওপর দিয়ে যখন ওদের গাড়ি এগোচ্ছিল, তখন চারপাশের সেই অপরূপ শোভা অবর্ণনীয়। পথের দু’পাশে প্রচুর ময়ূর দেখেছে ওরা। ভারতের জাতীয় পাখি নির্দ্বিধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। মিম তো ওদের দেখে হাততালি দিয়ে উঠেছিল। ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূর যেন ওদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ভিড় করে রয়েছে! তার থেকেও বেশি ইন্টারেস্টিং ছিল বোধহয় ‘মরুভূমির জাহাজ’। এতদিন প্রাণীটাকে বইয়ের পাতায় দেখে এসেছে মিম। আজ চোখের সামনে দেখে যেন সহজে বিশ্বাস করতে চাইছিল না ও। এত লম্বা একটা প্রাণী নির্দ্বিধায় হেঁটে চলেছে বালির ওপর দিয়ে। তবে উটের পিঠে চড়ার সময় একটু সমস্যা হয়েছিল ওদের। মৈত্রেয়ী তো কিছুতেই চড়বে না, এদিকে অনির্বাণও ওকে ছাড়বে না। অবশেষে অনির্বাণের জোরাজুরিতে ভয়ে ভয়ে উটের পিঠে উঠল মৈত্রেয়ী। এমনভাবে বসেছিল যেন এই বুঝি পড়ে যাবে! ওর অবস্থা দেখে অনির্বাণ তো হেসে লুটোপুটি খেয়েছে। আরও একটা বিষয়কে ওরা প্রত্যক্ষ করেছে, সেটা হল মরীচিকা। সামনে এগোতে এগোতে ওদের মনে হয়েছে আর কিছুদূর গেলে একটা নদী আছে, তার আশেপাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ। কিন্তু কাছাকাছি এসে বুঝতে পেরেছে পুরোটাই আসলে ভ্রম ছিল। মরুভূমির মরীচিকা এটাকেই বলে। যত বেলা গড়িয়েছে, সূর্যের তেজ তত বেড়েছে। বিকেল নাগাদ সেই গরম কমতে শুরু করেছে একটু একটু করে। শীর্ষেন্দুকে মৈত্রেয়ী জিজ্ঞেস করেছিল, “মরুভূমিতে চোরাবালি নেই?”
— আছে তো, তবে যেসব জায়গা দিয়ে মানুষ চলাচল করে, সেদিকে নেই। এই মরুভূমি কি আর একটুখানি জায়গা! সুদূর বিস্তৃত এই মরুভুমির কোথায় যে কী লুকিয়ে রয়েছে, তার সবটা বোধহয় আমরাও জানি না। তবে টুরিস্টদের কাছে এই মরুভূমি একটা ব্ল্যাকহোলের মতো, কাউকে যদি মাঝামাঝি কোনো একটা জায়গায় ছেড়ে দেওয়া হয়, সে জীবনেও এখান থেকে বেরোতে পারবে না। প্রথমত এখানে যে পরিমাণে সূর্যের তেজ, তাতে বেচারা কতদিন টিকবে সেটা বলা যায় না। তার ওপর যদি চোরাবালিতে ডুবে যায়, তাহলে তো গল্পই শেষ।
— চোরাবালি আমি কখনও নিজের চোখে দেখিনি, তাই এটা নিয়ে প্রচ্ছন্ন একটা আগ্রহ তো আছেই।
— এসব চোরাবালিতে আগেকার দিনের রাজারা তাদের কত যে গোপনীয়তা লুকিয়ে রেখেছে, সেসবের হিসেব আর কেই বা রাখে! তবে এই চোরাবালি ভীষণ ভয়ানক, একটু একটু করে গ্রাস করে নেয় মানুষকে। সে ছটফট করতে করতে তলিয়ে যেতে থাকবে অতল বালির গহ্বরে, কিন্তু ওপাশের মানুষটার কোনো সাধ্য থাকবে না তাকে বাঁচানোর।
“হিলারিয়াস”, অনির্বাণ বিড়বিড় করে ওঠে।
“রাজস্থানের এমন বেশকিছু জায়গা রয়েছে, যেগুলো খুবই কুখ্যাত”, একটা কাঠি দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বলে ওঠেন শীর্ষেন্দু, “শোনা যায়, সেসব জায়গায় নাকি অনেকেই অলৌকিক কিছু দেখতে পেয়েছে।”
“অলৌকিক কিছু মানে? ভূত!” অনির্বাণ জানতে চায়।
— সেরকমই ধরে নিন।
— কই, এতদিন ধরে যেসব জায়গা ঘুরলাম, সেগুলোর কোনোটাকেই তো আমার ভৌতিক বলে মনে হয়নি।
— সব জায়গায় নিয়ে যাওয়ার অধিকার কি আমাদের আছে? ওসব জায়গা টুরিস্টদের জন্য নয়।
— তাও শুনি, কোন্ সব জায়গা? আর এমন কীই বা ঘটেছিল সেখানে?
শীর্ষেন্দু অনির্বাণের দিকে তাকায়, “আপনারা বিজ্ঞানমনস্ক, এগুলোকে মজা হিসেবে নেবেন, তা জানি। কিন্তু আমজনতা এগুলোকে বিশ্বাস করে ভীষণভাবে। প্রথমেই আসা যাক নাহারগড় কেল্লার কথায়। কেল্লার চারপাশে বড়োসড়ো দেওয়াল দিয়ে প্রায় একখানা দুর্গ বানিয়ে সেটাকে বাইরের জগত থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। আর সেই কেল্লার মধ্যেই ঘটে গেছে অদ্ভুত কিছু ঘটনা। যতবারই সেই কেল্লা সংস্করণের জন্য লোক নিযুক্ত করা হয়েছে, ততবারই কেউ না কেউ মারা গিয়েছে আর সংস্করণের কাজ অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। যারা সেখানে ছিল, তারা নাকি এমন অনেক কিছু শুনেছে, যেগুলো ওদের সেই কেল্লা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। কেল্লাটা রাজা সওয়াই জয় সিংয়ের, শোনা যায় সেই কেল্লার ভেতর আজও নাকি ওঁর অতৃপ্ত আত্মা ঘোরাফেরা করে।”
“না দেখেই এতকিছু বিশ্বাস করে নিয়েছে সবাই?” অনির্বাণের ভ্রূ কুঁচকে যায়।
— বিশ্বাস করতে হলেই যে সেটাকে নিজের চোখে দেখতে হবে, এমন কোনো কথা নেই… তা ছাড়া বিশ্বাস-অবিশ্বাস সবটাই নিজের নিজের কাছে।
— আচ্ছা বুঝলাম। তা আর কোন্ জায়গা?
“আছে আছে”, শীর্ষেন্দু দম নেয়, “আমাদের রাজস্থানের একটা হোটেল হচ্ছে ব্রিজ রাজভবন। এই হোটেলের একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহীরা এই হোটেলে বসবাসকারী মেজর বার্টন আর তার পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। মেজর ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী, তাই স্বাভাবিকভাবেই বিদ্রোহীদের রাগ গিয়ে পড়ে ওঁর ওপর। তারপর আর কী…! বর্তমানে যদিও এটা হোটেল হিসেবেই পরিচিত, তবুও এই হোটেলে যারা যারা এসেছেন, তারা প্রত্যেকেই একটা অদ্ভুত অনুভূতির শিকার হয়েছেন। একলা রুমে কখনও মনে হয়েছে পাশে কেউ আছে, কিংবা গভীর রাতে তাদের দরজার ওপাশ দিয়ে কারোর খুব সতর্কভাবে হেঁটে যাওয়া পদধ্বনি শুনেছে ওরা।”
— দারুণ ব্যাপার তো।
— ওরম মনে হয়… তবে রাজস্থানের সবথেকে ভয়ানক জায়গা বলা যেতে পারে ভানগড় দুর্গকে। ভোর পাঁচটার আগে আর বিকেল পাঁচটার পরে এখানে আসার অনুমতি নেই কারোর। সরকার থেকে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এর পেছনের গল্প অনেকেই জানে, তবে আসল ঘটনা একটু আলাদা। এই ভানগড়ের রাজকুমারী ছিলেন রত্নাবতী, ভীষণ অপরূপা ছিলেন তিনি। দূর দূর রাজ্য থেকে তার বিয়ের সম্বন্ধ আসত। রাজ্যের প্রজারা খুব সুখে শান্তিতেই ছিল। কিন্তু ওই যে বলে, এত সুখ ভগবানও সহ্য করতে পারেন না! তাই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো গ্রামে উপস্থিত হয়েছিল এক তান্ত্রিক। ভীষণ ভয়ঙ্কর কুৎসিত সেই তান্ত্রিক এমন অনেক যাদু-টোনা জানত, যা দিয়ে মানুষকে বশ করা যায়। সে রাজকুমারীর প্রেমে পড়ে যায় আর রাজকুমারীকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। রাজকুমারীর কানে কথাটা যেতেই তিনি তান্ত্রিককে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেন। কিন্তু তান্ত্রিক এত সহজে হাল ছাড়ে না। অতি গোপনে সে রাজপ্রাসাদে পৌঁছায় আর একটা মন্ত্রপূতঃ জড়িবুটি কোনোভাবে রাজকুমারীর চুলে বেঁধে দেয়। তারপরই রাজকুমারী একটু একটু করে অসুস্থ হয়ে পড়েন, তার রূপের জৌলুস কমতে থাকে। কিন্তু শোনা যায় রাজকুমারী নিজেও নাকি গোপনে তন্ত্র সাধনা করতেন। সেহেতু এসবের কারণ খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হয়নি তার। অনেক চেষ্টার পর তান্ত্রিক ধরা পড়ে আর প্রজাদের সামনে নির্মমভাবে তাকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানো হয়। মৃত্যুর আগে তান্ত্রিক সারা গ্রামকে অভিশাপ দিয়ে যায় যে, এই ভানগড়ে কোনো জীবিত মানুষ থাকবে না আর। তান্ত্রিকের মৃত্যুর পর থেকেই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে আর মানুষ মরতে মরতে একটা সময়ের পর পরিত্যক্ত হয়ে যায় এই জায়গা। তারপর অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে নতুন করে বসতি স্থাপন করার, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে যে-ই এখানে থাকতে এসেছে, পরের দিন তাকে আর জীবিত পাওয়া যায়নি। এভাবে চলতে চলতে একটা সময় পর সবাই হাল ছেড়ে দেয় আর তারপর থেকেই ভানগড় দুর্গ তার অতৃপ্তি আর একবুক ক্ষিদে নিয়ে ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে রয়েছে।
“আমি ভানগড় দুর্গ সম্পর্কে আগে যদিও গুগলে দেখেছি, কিন্তু সত্যি কথা বলতে আমার নিজেরও মাঝে মাঝে মনে হয় যে, আদৌ কি ভূত বলে কিছুর অস্তিত্ব আছে!” অনির্বাণ বলে ওঠে।
— সবই আছে, শুধু আমাদের চোখের আড়ালে রয়ে যায় সবকিছু। তাই হয়তো বুঝেও বুঝতে পারি না আমরা।
— জানি না… তবে নিজের চোখে যদি কোনোদিন কিছু দেখি, তাহলে হয়তো ধারণাটা আরও পোক্ত হবে।
— আমাদের রাজস্থানের আরও একটা অলৌকিক ঘটনাস্থল হচ্ছে রানা কুম্ভের রাজপ্রাসাদ। রানা কুম্ভের কথা বলতে গেলে সামনে চলে আসে চিতোর, সেখানকার সুন্দরী রানী পদ্মিনী আর দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির বহুল আলোচিত ঘটনা। এই খিলজি জোর করে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন রানী পদ্মিনীকে। নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে আরও সাতশো নারীকে সঙ্গে নিয়ে জহরব্রত পালন করে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন পদ্মিনী। অনেকেই নাকি এখানে মাঝে মাঝে এক মহিলাকে দেখতে পান, মহিলার পরনে রাজকীয় বেশ… তবে তার মুখের দিকে চোখ পড়লেই কেঁপে ওঠে বুক। দগদগে পোড়া মুখখানার দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে নিতে বাধ্য হয় সেই ব্যক্তি। এটা আমার চোখে দেখা নয়, তবে যারা যারা দেখেছেন, তাদের মুখ থেকে শোনা।
— হতেও পারে কী দেখতে কী দেখে ফেলে আর তারপর সেটা নিয়ে লোক জানায়… এসব কত বছর আগে ঘটে গেছে, এখনও কি ওদের আত্মার মুক্তি ঘটেনি?
— মুক্তি পাওয়া এতটাও সহজ নয়। মৃত্যুর ওপারের দুনিয়া ভীষণ ভয়ঙ্কর, সেখানে কোনো আলো নেই, চারদিকে শুধু অন্ধকার। জীবনে বেঁচে থাকতে সেই ব্যক্তি যত পাপ করেছে কিংবা যত কষ্ট পেয়ে সেই ব্যক্তি মরেছে, সেই সবকিছু নরকযন্ত্রণার মতো ভোগ করতে হয় মৃত্যুর পর। তাই এসব হয়তো আমাদের কাছে একটা গল্পকথা মাত্র, তবে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এতটাও গল্প বানিয়ে বলতে পারতেন না মনে হয়! ওঁদেরও নিশ্চয়ই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা ছিল।
“সে থাকতেই পারে, তবে বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের মধ্যিখানে একটা প্রশ্ন চিহ্ন তো থেকেই যায়”, কথাটা বলেই অনির্বাণ কোনো একটা চিন্তায় ডুবে যায়।
“সবকিছুকে তুমি এতটা স্বাভাবিকভাবে নিয়ো না অনি”, এতক্ষণ পর মৈত্রেয়ী মুখ খোলে, “দেয়ার আর মেনি থিঙ্গস ইউ ডোন্ট হ্যাভ এ বিট আইডিয়া অ্যাবাউট ইট… তাই এসবের মজা না ওড়ানোই ভালো।”
— কিন্তু…
“চুপ করো… আচ্ছা শীর্ষেন্দু দা”, মৈত্রেয়ী শীর্ষেন্দুর দিকে তাকায়, “আমি রাজস্থানের একটা ভৌতিক রোডের সম্বন্ধে কাগজে পড়েছিলাম… ঠিক মনে নেই আমার, বাট…”
“এন এইচ ৭৯”, শীর্ষেন্দুর গলা যেন খাদে নেমে যায়, “এটা যদিও রাজস্থানের একটা জাতীয় সড়ক, তবে এখানকার অলৌকিক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী অনেকেই আছেন। আসল ঘটনাটা যদিও বহুবছর আগেকার, যখন আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ চালু ছিল। শোনা যায় সেইসময় একটা পাঁচ বছরের বাচ্চার সঙ্গে ষাটোর্ধ্ব বুড়োর বিয়ে ঠিক করে বাচ্চার বাবা… বলা ভালো টাকার লোভে। মেয়ের মা অনেক অনুনয়-বিনয় করেও আটকাতে পারে না এই বিয়ে। বিয়ের আগের দিন রাতের বেলা মেয়েকে কোলে নিয়ে সবার চোখের আড়ালে গ্রাম ছাড়েন তিনি। আশ্রয় খুজঁতে খুজঁতে ক্লান্ত অবসন্ন মহিলা এই হাইরোড ধরেই এগোচ্ছিলেন। সেই সময় পিছন থেকে আসা একটা লরি মা আর মেয়েকে মাঝরাস্তায় পিষে দেয়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত অনেকেই রাত বাড়ার পর থেকেই এক মহিলাকে দেখতে পায়। মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে আলুথালু বেশে এক মহিলাকে উদভ্রান্তের মতো সাহায্য চাইতেও দেখেছে অনেকে। তবে ব্যাপারটা যেহেতু অনেকেই জানে, তাই কেউ গাড়ি থামায় না। কারণ এইসব রাস্তায় গাড়ি থামানো মানে মৃত্যুকে সাক্ষাৎ আহ্বান জানানো। ওই যে বললাম, মানুষ বেঁচে থেকে যতটা যন্ত্রণা ভোগ করে, তার কয়েকগুণ বেশি হয়তো মারা যাওয়ার পরে তাকে ভোগ করতে হয়।”
এত অব্দি বলে শীর্ষেন্দু থামে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে একটা আড়মোড়া ভাঙ্গে। বেলা বাড়ছে। রাস্তার ধারের এই ধাবায় পেট পুজো করতে এসেছিল ওরা। সিঙ্গারা খেতে খেতেই ওদের মধ্যে ভূত নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, আর তারপর শীর্ষেন্দু তার ঝুলি থেকে বের করে এসব চমকপ্রদ ঘটনা। তার গল্প বলার ভঙ্গিমায় এমন কিছু একটা ছিল যে, অনির্বাণ আর মৈত্রেয়ী অল্প হলেও থমকেছে। মিম অবশ্য এই আসরে ছিল না। দোকানদারের পোষা একটা কুকুরছানার সঙ্গে খেলতে ব্যস্ত ও। নাহলে এসব গল্প শুনলে ওর শিশুমনে আরও বেশি প্রভাব পড়ত। খেয়েদেয়ে দাম মিটিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে। এবার ওদের গন্তব্য জয়সলমীর। এই জয়সলমীরের ব্যাপারে টুকিটাকি অনেক কিছুই শুনেছে ওরা। এটাও শুনেছে যে, এখানকার অনেক জায়গায় নাকি গুপ্তধন লুকানো রয়েছে। সরকার থেকে অনেকবার তল্লাশি করা হয়েছে বটে, তবে সবকিছু একেবারে পাওয়া যায়নি। তাই মাঝেমাঝেই গুপ্তধনের খোঁজ করতে করতে অনেক টুরিস্ট এসে উপস্থিত হয় জয়সলমীরে। তবে ওরা কেবল জায়গাটা ঘুরে দেখতে চায় টুরিস্ট স্পট হিসেবে। রাজস্থানের আর-এক বিখ্যাত জায়গা এই জয়সলমীর। নরম হাওয়ায় নিজেদের মধ্যে টুকিটাকি কথাবার্তা বলতে বলতেই ওদের গাড়িটা হাইরোড দিয়ে এগোচ্ছিল। রাস্তায় খুব বেশি ভিড় নেই। রাস্তার দু’পাশে নানারকমের দোকান। ক্রেতা-বিক্রেতা দুজনেই ব্যস্ত নিজেদের চাহিদা পূরণে। এই রাস্তার ধারের দোকানগুলোয় কত রকমের নাম-না-জানা জিনিসপত্র চোখে পড়ল ওদের। খুব স্বাভাবিক গতিতেই এগোচ্ছিল ওদের গাড়িটা। এমন সময় বাঁদিক থেকে টার্ন-ইন করতে গিয়ে একটা জিপ এসে ধাক্কা মারে ওদের গাড়িকে। মুহূর্তের মধ্যে একটা বিপর্যয় ঘটে যায়। পেছনের সীটে বসা অনির্বাণের মাথা গিয়ে ঠোকে গাড়ির এক সাইডে। কপালের এক পাশ কেটে গিয়ে একটা রক্তের রেখা গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মিম ওর পাশেই বসেছিল। আচমকা ধাক্কায় বাচ্চাটা কিছুটা ছিটকে যায় সামনে। মৈত্রেয়ীর হাতে ধরা ফোনটা অতর্কিতে নীচে পড়ে গিয়ে বুকের ওপর একটা লম্বালম্বি স্ক্র্যাচ নিয়ে চুপচাপ চেয়ে থাকে। মৈত্রেয়ীর হাতের এক সাইড ঘষে গিয়েছে বেশ জোরেই।
“উফ্”, মৃদু আর্তনাদ বেরিয়ে আসে ওর মুখ দিয়ে। ঘষে যাওয়া হাতের চামড়াটা উঠে গিয়ে রক্তের দাগ ফুটে উঠেছে সেখানে। হাতটা যেন অবশ লাগে ওর। যন্ত্রণায় চোখমুখ কুঁচকে গিয়েছে মৈত্রেয়ীর। কোনোরকমে ছোটো ছোটো নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত রাখতে চায় ও। শীর্ষেন্দু সামনে বসেছিল। গাড়ির ধাক্কায় ও ছিটকে গিয়েছে এক পাশে। গালের একটা সাইড কেটে ঘন হয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। কোনোরকমে নিজেকে সামলে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসে ও। আশেপাশে তখন বেশ ছোটোখাটো একটা ভিড় জমে গিয়েছে। প্রকাশ্যে দিনের আলোয় এরকম একটা ঘটনা ঘটবে, এটা কেউই ভাবতে পারেনি। যে গাড়িটা শীর্ষেন্দুর গাড়িকে ধাক্কা মেরেছে, সেটার অবস্থাও তথৈবচ। সামনের বনেটটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে গাড়িটার। সেই গাড়িতে ড্রাইভার আর একজন যাত্রী ছিলেন। দুজনের কারোর সেভাবে তেমন ক্ষতি হয়নি, শুধু ড্রাইভারের শরীরের বেশকিছু জায়গা ছড়ে গিয়েছে মাত্র। শীর্ষেন্দু সেই গাড়ির সামনে গিয়ে ড্রাইভারের জামার কলার ধরে তাকে প্রায় টেনে নামাল। তারপর জনসম্মুখে ঠাস করে একটা চড় মারল তার গালে। সেই চড়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ল ড্রাইভার ছেলেটা। ততক্ষণে ডিউটিতে থাকা কনস্টেবল ছুটে এসেছে ঘটনাস্থলে। সে কোনোমতে ব্যাপারটাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। শীর্ষেন্দু কনস্টেবলকে এক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। শীর্ষেন্দুর এই রূপ অনির্বাণ মৈত্রেয়ীর কাছে অজানা। সেই শান্তশিষ্ট হাসিখুশি লোকটা যেন নিমেষেই পালটে গিয়েছে। এরকম তর্জন গর্জন করা, এলপাথাড়ি আক্রমণ চালানো লোকটাকে ওরা চেনেই না। এরপরের জিনিসটা দেখার জন্য ওরা কেউই প্রস্তুত ছিল না। শীর্ষেন্দু পকেট থেকে একটা কোল্ড ব্লাডেড রিভলবার বের করে রাস্তায় ছিটকে পড়া ড্রাইভার ছেলেটার বুকের ওপর চেপে ধরে। তারপর আর এক হাতে থাপ্পড়ের পর থাপ্পড় মারতে থাকে ছেলেটাকে। সেইসঙ্গে রাজস্থানী ভাষায় কী সব বলে যেতে থাকে তাকে। অনির্বাণেরা অবাক চোখে দেখে যাচ্ছে সবকিছু। সেই কনস্টেবল ধাক্কা খেয়ে কেমন যেন মিনমিন করতে থাকে। যেন শীর্ষেন্দুর প্রতিপত্তি তার চেয়েও বেশি। উলটোদিকের গাড়ি থেকে ততক্ষণে নেমে এসেছেন যাত্রী ভদ্রলোক। বয়স্ক ওই ভদ্রলোকের দাঁড়ি গোঁফের আড়ালে ওঁর মুখটা স্পষ্ট নয়। তিনি কোনোমতে কাকুতি-মিনতি করে শীর্ষেন্দুর হাত থেকে রক্ষা করেন ড্রাইভার ছেলেটাকে। তখনও তর্জন-গর্জন করছিল শীর্ষেন্দু। আরও কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থল মোটামুটি ফাঁকা হল। শীর্ষেন্দু গাড়িতে ফিরে আসে, সঙ্গে সেই ড্রাইভার ছেলেটা আর বৃদ্ধ ভদ্রলোক। এখানে ফিরে এসেই শীর্ষেন্দু আবার সেই আগের মতোই শান্তশিষ্ট, হাসিখুশি। ওদের অবস্থা দেখে ভীষণ চিন্তিত আর ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। ড্রাইভার ছেলেটা রাজস্থানী ভাষায় কীসব যেন বলল শীর্ষেন্দুকে। শীর্ষেন্দু সেটা শুনে অনির্বাণদের বলল, “এখানে কাছাকাছি তেমন কোনো হাসপাতাল নেই… উলটো পথে যেতে হবে আমাদের। এদিকে মেডিকেল শপ আছে বটে, তবে এঁদের বক্তব্য যেহেতু ক্ষতিটা ওদের অজান্তেই হয়েছে, তাই আজকের দিনটা ওঁদের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে”, বলে বুড়ো ভদ্রলোককে দেখিয়ে দেয় শীর্ষেন্দু, “আমি তাই ওদের নিয়ে এলাম আপনাদের কাছে। ওদের রাজস্থানী ভাষা আপনারা বুঝতে পারবেন না, তাই আপনাদের কী মত উনি সেটা জানতে চাইছেন।”
“আপাতত কাছাকাছি কোনো মেডিক্যাল স্টোরে চলুন”, মৈত্রেয়ী কোনোরকমে নিজেকে সামলে বলে ওঠে, “তা ছাড়া আমরা এখানে ঘুরতে এসেছি, তাই শুধু শুধু সময় নষ্ট করার মানে হয় না… আমাদের হাতে আর বেশিদিন নেই, যে কটা দিন আছি, আমরা রাজস্থানটা ঘুরে ফিরে দেখতে চাই।”
সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক মৃদু গতিতে এগিয়ে আসেন ওদের দিকে। একটু ঝুঁকে রাজস্থানী ভাষায় কীসব যেন বলতে থাকেন ওদের। শীর্ষেন্দু বুঝিয়ে দেয়, “বুড়োর বাড়ি এখান থেকে কিছুটা দূরেই… তাই বুড়ো অনুরোধ জানাচ্ছে যদি আজকের দিনটা ওর বাড়িতে আমরা অতিথি হই।”
“এমনটা হলে খুব একটা মন্দ হয় না তাহলে, কী বলো…”, কথাটা বলেই মৈত্রেয়ীর দিকে তাকিয়ে থমকে যায় অনির্বাণ। বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে মৈত্রেয়ী চেয়ে রয়েছে ওর দিকে, “এত ইডিয়েট কেন তুমি? চিনি না, জানি না— হুট করে একজনের বাড়িতে চলে যাব আমরা? তা ছাড়া ওসব যা-তা জায়গায় আমি থাকতে পারব না”, তারপর শীর্ষেন্দুর দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি ওঁদের বলুন আমাদের অলরেডি হোটেল বুক করা আছে, তাই এত চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।”
“আচ্ছা ম্যাডাম”, শীর্ষেন্দু ওদের দুজনকে একটু সাইডে নিয়ে গিয়ে ওদের ভাষায় কিছু বুঝিয়ে দেয়। মিনিট পাঁচেক পর গাড়িতে বসে ইঞ্জিন অন করে সে বলে, “বুড়ো হেব্বি নাছোড়বান্দা মাল… ফালতু ভাটিয়েই যাচ্ছে… ক্যাজরা আর কাকে বলে! আমরা এখান থেকে প্রথমে একটা মেডিকেল স্টোরে যাচ্ছি তাহলে, বেশি দূরে নয়, এই কাছেই।”
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন