জয়সলমীর থেকে প্রায় ১৭-১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই কুলধারা। চারদিকে হলুদ পাথরের প্রাসাদ। বেলা প্রায় পড়ে আসছে। সোনার কণার মতো ধুলো উড়িয়ে ওদের গাড়ি ছুটে চলল হাইওয়ের দিকে। হলুদের মাঝে মরু অঞ্চলের সবুজের সমারোহ ওদের মন কেড়ে নেয়। হাইওয়ের দু’পাশে রাস্তার দু’ধারে মরুভূমির মাঝখানে উইন্ডমিল বসানো। বাতাসে পাখা ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ চলছে। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর চোখে পড়ল মরুভূমির শুষ্ক মাটিতে চাষাবাদের কাজ করছে বেশ কিছুজন।
— আমাদের জয়সলমীরে সরস্বতী নদীর গতিপথ আবিষ্কার হওয়ার পর থেকেই এই শুষ্ক মরু খাদে খোদাই করে জল তুলে আনা হচ্ছে… আর এটাকে কাজে লাগিয়ে চাষাবাদ করা হচ্ছে। বেশ কিছু বছর পর এখানেও সবুজের সমারোহ দেখে আপনাদের চোখ জুড়িয়ে যাবে।
“দারুণ ব্যাপার তো”, অনির্বাণ মৃদু প্রশংসা করে।
বর্ডার রোড বেশ ভালো হওয়ায় এতটা পথ যেতে ওদের খুব বেশি সময় লাগল না। আধঘণ্টার মধ্যে রাজস্থানী ভাস্কর্য খচিত এক বিশাল প্রবেশদ্বারের সামনে গাড়ি থামল। দরজার ওপরে লেখা আছে ‘কুলধারা’। বাইরের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে ওরা ভেতরে প্রবেশ করে। শীর্ষেন্দু প্রথমে ওদের নিয়ে যায় কেশবজীর মন্দিরের দিকে।
“অনেক গল্প প্রচলিত আছে এই কুলধারা গ্ৰামকে নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী সেলিম সিং ভীষণ অত্যাচারী ছিলেন। লোকটা যেমন শয়তান, তেমনই লোভী ছিল। এই গ্রামের প্রধানের মেয়ে ছিল যথেষ্ট সুন্দরী। সেলিম সিংয়ের নজর পড়ে মেয়েটির ওপর। তিনি দাবি করে বসেন যে, সেই মেয়েটিকে তিনি বিয়ে করবেন। এমন কথা শুনে গ্রামের মানুষজন ভীষণ আপত্তি জানায়। ব্রাহ্মণের মেয়েকে শেষে কিনা…! এ কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। তা ছাড়া মেয়েটা অন্য আর-একটা ছেলেকে ভালোবাসত। তবে সেই ছেলেটা নীচুজাতের হওয়ায় তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চায়নি গ্ৰামপ্রধান। শোনা যায় সেই ছেলেটাকে নাকি মেয়েটার চোখের সামনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এর ওপর এই সেলিম সিং, প্রধানের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে না দিলে অত্যধিক করের বোঝা চাপানোর হুমকি দেয়। এই ঘটনার দিন দুয়েকের মধ্যে খুব অদ্ভুতভাবে গ্রামের কোনো মানুষকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রায় চুরাশিটা গ্রামের মানুষ যেন রাতারাতি মিলিয়ে যায় বাতাসে। কেউ বলে যে, অত্যাচারী দেওয়ানের হাত থেকে বাঁচতে ওরা এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছিল। আবার নিন্দুকেরা বলে যে, সেলিম সিং নাকি গোপনে লোক লাগিয়ে গ্ৰামের মানুষগুলোকে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে দেয়। তবে এ ঘটনার সত্যতা জানা নেই। যদি ওরা পালিয়েও যায়, তাহলে কি পরবর্তীতে ওদের খুঁজে পাওয়া যেত না! শুধু গোটা গ্রাম ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল রাতারাতি। সেলিম সিং এরপর নতুন করে গ্রাম বসানোর চেষ্টা করেছিলেন, তবে সেই গ্রামে কেউ আর রাত কাটাতে পারত না। যারা যারা জেদের বশে এখানে রাত কাটাতে চেয়েছে, পরদিন সকালে তাদের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। এরপর থেকেই নানা রকম কাহিনী লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ মানুষ মনে করে কুলধারার গ্রামবাসীরা এই গ্রামকে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল। তাদের অভিশাপ ছড়িয়ে পড়েছিল নগরীর বাতাসে। সেই থেকে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে এই কুলধারা”, শীর্ষেন্দু কুলধারার ইতিহাসটা জানায়।
ওরা অবাক হয়ে ঘুরে দেখছিল সম্পূর্ণ গ্রামটা। এত বছর পরেও অবিকৃত থেকে গিয়েছে বাড়িগুলো। দু-একখানা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে তার ইঁট-কাঠ-পাথরে হাত রাখতে শরীর কেঁপে উঠল অনির্বাণের। মনে হচ্ছিল কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে কানের কাছে! এসব যদিও ওর মনগড়া কল্পনা।
— এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পরেও নতুন করে জনবসতি গড়ে ওঠেনি কুলধারায়। এখনও অব্দি কেউ পা রাখতে সাহস করে না এখানে। অন্তত রাতের বেলায় তো নয়ই। কুলধারায় যারা রাত কাটিয়েছে, কোনো না কোনো বিপদের মুখে পড়েছে তারা। তবে প্রথম দিকে এই কুলধারা গ্রামের সৌন্দর্য দেখার মতো ছিল। সোনালী বালির মাঝে মরুদ্যানের মতোই মাথা তুলে সগৌরবে বিরাজ করত কুলধারা। চুরাশিটা ছোটো ছোটো সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে বাস করত এই গ্রামে। ১২৯১ সাল নাগাদ পালিওয়াল ব্রাহ্মণরা এই গ্রামের পত্তন করেছিলেন। সেসময় প্রায় পনেরোশো মানুষ সমৃদ্ধ করে তুলেছিল এই গ্রামখানা। রাজস্থানের মতো মরু অঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও এখানকার আবহাওয়া যথেষ্ট ব্যতিক্রমী ছিল। তা ছাড়া ব্রাহ্মণেরা কৃষিকাজে দক্ষ হওয়ায় এই এলাকা কৃষি এবং ব্যাবসার জন্য বেশ বিখ্যাত ছিল। প্রাচীন মন্দির থেকে শুরু করে নিখুঁত নকশায় বানানো বিভিন্ন বাড়ি— কী ছিল না এই কুলধারায়! কিন্তু একটা ঘটনার পর থেকে এই নগরী জনমানবহীন হয়ে পড়ে। মাত্র দু’রাতের মধ্যেই গ্রামবাসীরা কোথায় গায়েব হয়ে যায়, সেটা আজও রহস্য।
শীর্ষেন্দু একের পর এক বলে চলেছিল গ্রামের ইতিহাস। গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে ওরা লক্ষ করেনি কখন আকাশে একটু একটু করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। গরমটা কমে এসেছে এই মুহূর্তে। তবে একটা ভ্যাপসা আবহাওয়া চারপাশে। সেদিকে তাকিয়ে শীর্ষেন্দু বলে, “আমাদের এবার বোধহয় ফেরা উচিত।”
“এত তাড়াতাড়ি?” অনির্বাণ প্রশ্ন করে।
— হ্যাঁ, তা ছাড়া বৃষ্টি নামবে মনে হয়।
— আমার তো এই গ্রামটা বেশ ভালো লাগছে ঘুরতে… একটা অদ্ভুত অনুভূতি যেন ঘিরে ধরেছে আমায়।
— অস্বাভাবিক কিছু নয়। ২০১৩ সাল নাগাদ দিল্লির প্যারানরমাল সোসাইটির বেশ কিছু সদস্য এখানে রাত কাটাতে এসেছিলেন। যতদূর জানি, তাদের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। তারা বলেছিলেন যে, তাদের চারপাশের আবহাওয়া নাকি ক্ষণে ক্ষণে পালটে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে আবার অদৃশ্য কেউ স্পর্শও করেছিল। তাদের মনে হয়েছিল যে, এখানে তাদের সঙ্গে আরও অনেকেই ছিল, যাদের তারা দেখতে পাননি। রাতের বেলা কান্নার আওয়াজ শুনেছিলেন ওরা। নিজেদের গাড়িতেই রাত কাটিয়েছিলেন, সকাল বেলায় বাইরে বেরিয়ে দেখতে পান গাড়ির কাচের ওপর ছোটো-বড়ো বেশ কতগুলো হাতের ছাপ। এরকম টুকিটাকি ভৌতিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন ওঁরা। অনেকেই এখানে এসে অনেক কিছু উপলব্ধি করে। একটু একটু করে হয়তো সময় এগোবে, কিন্তু এই কুলধারা গ্রাম তার অতীত বুকে নিয়ে ঠিক এমনই রয়ে যাবে। ভারত সরকার এটাকে হেরিটেজ নগরী হিসেবে ঘোষণাও করে দিয়েছেন।
— ভালোই লাগল শুনে… এখান থেকে যেন যেতে ইচ্ছে করছে না। আরও কিছুক্ষণ থাকতে পারলে ভালো লাগত, তবে এমন একটা জায়গায় রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা থাকলে মন্দ হতো না।
— সবকিছুকে এতটা মজা হিসেবে নেওয়া উচিত নয়। কারণ আমাদের চারপাশে এমন অনেক কিছুই থাকে, যা হয়তো আমরা দেখতে পাই না, শুনতে পাই না, কেবল অনুভব করতে পারি। আমাদেরও যেমন জগত আছে, ঠিক তেমনি ওদেরও একটা জগত থাকে। আমাদের কখনওই গা-জোয়ারী করে ওদের নিয়ে মজা করা উচিত নয়।
.
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে আসছে মরুভূমির বুকে। সেই সঙ্গে মেঘটা আগের তুলনায় বেশ ঘন হচ্ছে। সূর্যাস্তের মলিন আভা মৃদুভাবে স্পর্শ করে রয়েছে বালি। এক অদ্ভুত আলো-আঁধারির মাঝে অনির্বাণের চোখে ধরা পড়ছিল দেওয়ালের গায়ে কিছু প্রাচীন লুপ্তপ্রায় বর্ণমালা, যার মাঝে হয়তো লুকিয়ে ছিল রহস্য সমাধানের রাস্তা। শীর্ষেন্দুর কথায় হুঁশ ফেরে ওর, “আসুন স্যার, বৃষ্টি নামলে যেতে সমস্যা হবে।”
— চলুন তাহলে… আর কী বলব… মিম এসো।
ওরা বসতেই শীর্ষেন্দু গাড়ির বেগ বাড়িয়ে দেয়। হু হু করে গাড়ি ছুটে চলেছে হাইওয়ে ধরে। আকাশের মুখ ভার। এই হয়তো বৃষ্টি নামবে। তবে শীর্ষেন্দুর মুখে কেমন যেন একটা মৃদু চিন্তার ছাপ। কিছু অসুবিধা হয়েছে কি! অনির্বাণ নিজে থেকেই একটা প্রসঙ্গ তুলল, “আমাদের তো তাহলে হয়েই গেল রাজস্থান ঘোরা। এতগুলো দিন আপনি যেভাবে আমাদের সঙ্গে থেকে গাইড করেছেন, তার জন্য আমরা ভীষণ কৃতজ্ঞ।”
— কী যে বলেন স্যার, এটাই তো আমার কাজ।
— আর তো মাত্র কয়েকঘণ্টা। তারপরেই রাজস্থানের বালি ছেড়ে আমরা উড়ে যাব কলকাতার দিকে। সত্যি বলতে ভীষণ মিস করব এতদিনের এই ট্রিপটা। এই ক’দিনে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলাম এখানকার মানুষের মতো। তা ছাড়া এত সুস্বাদু খাবারদাবার— এসব কি আর সহজে ভোলা যায়!
— সমস্যা কীসের? আবার আসবেন। আমাদের রাজস্থানে সবসময় আপনাদের স্বাগত। আসার আগে একটা জাস্ট ফোন করে নেবেন… বান্দা হাজির হয়ে যাবে।
— একদম, আবার যদি আসি, তখন আপনাকেই গাইড হিসেবে রাখব। এর আগের বারে আমরা যখন এসেছিলাম, তখন এতকিছু এত সুন্দর ভাবে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ হয়নি।
— সঠিক গাইডের দরকার পড়ে স্যার এসব জায়গায়।
— সে তো ঠিকই… আচ্ছা শীর্ষেন্দুদা, একটা কথা বলি?
— বলুন।
— এতদিন ধরে আপনাকে দেখছি, এর থেকেও বেশ দেরি করেই আমরা হোটেলে ফিরেছি। কিন্তু তখনও আপনাকে এতটা চিন্তিত মনে হয়নি আজকের মতো, কিছু কি হয়েছে?
— না না, কী আর হবে! তেমন কিছু না, তবে…
— তবে…?
— আজকে আসলে তিথিটা ভালো না।
— তিথি! কেন?
— আপনারা মানবেন না, কিন্তু আমরা এখানকার স্থানীয় মানুষ। তাই কিছু কিছু রীতিনীতি আমরাও মেনে থাকি। আজকের তিথিটাকে আদিবাসীদের ভাষায় বলা হয় ওমেগা। অমাবস্যার এমন একটা লগ্ন পড়তে চলেছে, যে লগ্নে নেগেটিভ শক্তিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আপনারা বলতেই পারেন এটা কুসংস্কার, কিন্তু সবকিছু কি আর বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়!
— ওমেগা?
— এখানে বিভিন্ন তিথির নামকরণ করা হয় তার গুণাগুণ বিশেষে। তবে এই ওমেগা তিথির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা পাঁচ বছরে একবার মাত্র আসে। আর এই তিথিতে খুব সহজেই অন্য জগতের সঙ্গে আমাদের জগতের একটা সংযোগ স্থাপন হয়।
— আপনি এসবে বিশ্বাস করেন?
— ওই যে বললাম, বিশ্বাস করা-না করাটা প্রত্যেকটা মানুষের ওপর। আমরা জানি, তাই মানি। এজন্যেই স্যার আপনাদের পৌঁছে দিয়ে আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চাইছি। এই তিথিতে সন্ধের পর বাইরে থাকা উচিত নয়। আপনারা দেখতে পাবেন আজকে রাস্তায় লোক চলাচল কতটা কমে এসেছে।
— বুঝলাম।
.
শীর্ষেন্দু একফোঁটাও বাড়িয়ে বলেনি। অন্যান্য দিন রাস্তার দু’ধারে যেভাবে খদ্দের, বিক্রেতা, সাধারণ মানুষের ভিড় লেগে থাকে, আজ যেন সেটা এক চতুর্থাংশ হয়ে গিয়েছে। সত্যিই কি তাই? নাকি বৃষ্টি নামবে বলেই ওরা ঘরের মধ্যে রয়েছে? কে জানে! দোকানের ঝাঁপগুলো বেশিরভাগ বন্ধ হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। শীর্ষেন্দুর কথা শুনে অনির্বাণের মাথার মধ্যে আবার বেশ কতগুলো চিন্তা ঘোরাফেরা করতে লাগল।
হোটেলের সামনে গাড়িটা থামতেই ওরা নেমে এল গাড়ি থেকে। শীর্ষেন্দু বলল, “চলি তাহলে, সাবধানে থাকুন আপনারা… কাল আবার দেখা হচ্ছে… শুভ রাত্রি।”
হোটেলে পৌঁছানোর আধঘণ্টার মধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ধীরে ধীরে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দূরে কোথাও বাজ পড়ল কয়েকবার। এমন আবহাওয়া অনির্বাণের বেশ লাগে। ফ্রেশ হয়ে কফি অর্ডার দিয়েছিল ও। ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় অনির্বাণ। অল্প অল্প চুমুক দিয়ে উপভোগ করতে থাকে বাইরের প্রকৃতি। সারা শহরে যেন নিমেষে লোডশেডিং হয়ে গিয়েছে। অক্লান্ত বৃষ্টির ধারায় ভিজে যাচ্ছে জয়সলমীর। জানালার কার্নিশ থেকে শুরু করে বাড়ি ছাদ যেন শুষে নিতে চাইছে সেই জলধারা। এতক্ষণ যে ভ্যাপসা গরম ভাবটা লাগছিল, সেটা নিমেষেই দূর হয়ে যায়। আশেপাশে তেমন মানুষজন নেই বললেই চলে। শুধু ওদের হোটেলের উলটোদিকের রাস্তায় শেডের নীচে বেশ কতগুলো ভাড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই ওয়েদারে কোনো যাত্রী আসবে বলেও তো মনে হয় না! আবার একবার মেঘের গর্জন শোনা গেল। পরশু ওদের ফ্লাইটের টিকিট কাটা। আর মাত্র একটা দিন ওরা এখানে রয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে। এই তো কয়েকদিন আগে রাজস্থানের মাটি স্পর্শ করল ওরা। দেখতে দেখতে দিনগুলো যেন নিমেষে কেটে গেল। রাজস্থান সত্যিই ভীষণ মনোরম একটা জায়গা। এখানকার মরুভূমি, মানুষজন, জীবজন্তু— সবকিছুতে একটা আলাদা সারল্য লেগে রয়েছে। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পরেও এখানকার স্মৃতি মনে থেকে যাবে ওর। অন্তত মৈত্রেয়ী ওর ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে এই কয়েকটা দিন তো একসঙ্গে কাটাল। অনেক বছর বাদে অনির্বাণ আবার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে নরম চাঁদের আলোয় একসময়ের প্রেমিকার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখটা দেখেছে। ওর মনে হয়েছে, জীবনটা সত্যিই হয়তো ভীষণ সুন্দর! শুধু ওরাই এই সৌন্দর্যটা উপভোগ করতে ভুলে গেছে। এ-কথা সে-কথা ভাবছিল অনির্বাণ। এমন সময় পিছন থেকে মৈত্রেয়ী এসে ওর কাঁধে হাত রাখে।
— অ্যাইই… কী ভাবছ একা দাঁড়িয়ে?
— ভাবছি আমাদের জীবনটা যদি সবসময়ের জন্য এরকম হতো, তাহলে কত ভালো হতো, তাই না?
— কীরকম হতো?
— এই তুমি ঠিক এভাবেই আমার সঙ্গে এতটা সময় কাটাতে।
— সেইই… আর আমার কাজগুলো কে করে দিত?
— তার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতাম।
— ওরম মনে হয় অনির্বাণ বাবু।
— বাই দ্য ওয়ে, তুমি বললে না তো— কাল তোমার ফিরতে এতটা দেরি হল কেন?
— আরে বললাম তো, ওখানে ভিড় ছিল দোকানটায়… তাই আমি ভাবলাম শুধু শুধু আগ বাড়িয়ে গিয়ে ঝামেলা বাঁধিয়ে তো লাভ নেই… ওরা চলে যাওয়ার পর আমি ধীরেসুস্থে কিনলাম।
— তা বলে এতটা সময় লাগল!
— উফফ… তুমি পারোও বটে… আমার ঘাট হয়েছে বাবা, আর কখনও যদি গিয়েছি।
“আরে না না… পাগলি আমি মজা করছিলাম… পছন্দ হয়েছে তোমার ওগুলো?” হাত বাড়িয়ে মৈত্রেয়ীকে বুকে টেনে নেয় অনির্বাণ।
“পছন্দ হয়েছে বলেই তো কিনলাম”, আদুরে গলায় জবাব দেয় মৈত্রেয়ী।
— এরপর তাহলে আমরা আবার কবে ঘুরতে যাচ্ছি?
“আবার… দেখা যাক”, আলতো হাসে মৈত্রেয়ী, “আমার ভীষণ খিদে পাচ্ছে, একটু পরে গিয়ে খেয়ে আসি বরং… কী বলো! আজকে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে, কাল আবার গোছগাছ করে নিতে হবে যে।”
— হুমম, তুমি দেখেছ মিম এই ক’দিন কীরকম স্বাভাবিক ব্যবহার করছিল! আমি তোমায় বলেইছিলাম, আমরা একসঙ্গে ওকে সময় দিলে ও একাকীত্বটা ভুলে ভালোভাবে মিশতে পারবে… আমরা যতটা আনন্দ করেছি, তার থেকেও বেশি বোধহয় ও করেছে।
— আমি বুঝি সব, কিন্তু কাজের চাপে আমি নিজেও খিটখিটে হয়ে যাই… তুমি বুঝতে পারো তো!
— আমি বুঝি মিতু, তাই কখনও কিছু বলতে দেখেছ আমায় এ নিয়ে?
“উমমম… জানি… আর তাই তো তোমায়…” বলে থেমে যায় মৈত্রেয়ী।
— তাই তো আমায়…?
— তাই তো তোমায় অ্যাত্তোটা ভালোবাসি।
“আমিও”, একটু ঝুঁকে স্ত্রীর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় অনির্বাণ।
.
রাত তখন ক’টা ঠিক খেয়াল নেই। ঘরের মধ্যে অস্পষ্ট একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় অনির্বাণের। সারা ঘরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। ওরা যখন ঘুমাচ্ছিল, তখন একটা নীলচে আলো জ্বলছিল না! তাহলে কি লোডশেডিং হয়ে গেল? আবার শব্দটা পায় অনির্বাণ। কেউ যেন আলতো পায়ে হাঁটাহাঁটি করছে ঘরের মধ্যে। খুব সতর্ক তার পদক্ষেপ। কে ঢুকল ঘরে! চোর নয় তো? গা-টা কেমন যেন ছমছম করে ওঠে ওর। মনে পড়ে যায় শীর্ষেন্দুদার বলা সেই কথাগুলো। আজকের তিথিটা নাকি ভালো নয়! ওদের ঘরের মধ্যে যে ঢুকেছে, সে কি মানুষ নাকি…! অন্ধকারে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাকে অনির্বাণ। বুঝে নিতে চায় ঘরে যে ঢুকেছে, তার আসল উদ্দেশ্যটা কী? কিন্তু দরজা তো ভালোভাবেই বন্ধ করেছিল ও। আর জানলা বেয়ে নিশ্চয়ই কেউ ঘরে ঢুকবে না! তাহলে ঘরের মধ্যে এখন যার উপস্থিতি টের পাচ্ছে অনির্বাণ, সে কীভাবে এল? বুকের মধ্যে শিলপেটার আওয়াজ বাড়ছে। কান দুটো কেমন যেন ভোঁ ভোঁ করছে ওর। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে বোধহয়। সেই ব্যক্তির হাতে যদি কোনো অস্ত্র থাকে তাহলে! না না… তাকে বুঝতে দেওয়া চলবে না যে অনির্বাণ জেগে গিয়েছে। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে সে। সেই ব্যক্তি অন্ধকারের ভিতর এসে দাঁড়াল অনির্বাণের ঠিক উলটোদিকে। কী করতে চাইছে ও? একটু ঝুঁকে কিছু একটা বুঝে নিতে চাইল সেই ব্যক্তি। তারপর বিছানার ওপাশে চলে গেল। নিঃশ্বাসটাও যেন পড়তে চাইছে না অনির্বাণের। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে ওর। কী করতে চাইছে আগন্তুক! হঠাৎ কিছু একটা তুলতে গিয়ে আচম্বিতে একটু লেগে যায় আগন্তুকের।
“উফ্!”
অতি মৃদু একটা আওয়াজ অনির্বাণের কানে আসে। আর সঙ্গে সঙ্গেই ওর ভ্রূ কুঁচকে যায়। মৈত্রেয়ীর গলা! কিন্তু এত রাতে ও কী করছে এইভাবে? কেমন যেন একটা সন্দেহ হয় অনির্বাণের। ও যেমনভাবে বিছানায় পড়েছিল, তেমনিই পড়ে থাকে। মৈত্রেয়ী নিঃশব্দে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। ল্যাচটা ঘুরিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আবার বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। অনির্বাণের মাথার মধ্যে সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। রাতের বেলা কোথায় গেল মৈত্রেয়ী! বাথরুম তো ওদের রুমের ভেতরে, তাহলে? তবুও বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকার পর যখন ও বুঝল যে, মৈত্রেয়ী এখন আর ফিরে আসবে না, তখন ও উঠে বসে বিছানায়। পাশে তাকিয়ে দেখে মৈত্রেয়ী আর মিম কেউই নেই। এত রাত্রে মিমকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে মৈত্রেয়ী? বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। অনির্বাণ খুব সাবধানে দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামে। একতলায় একটাই আলো জ্বলছে, তাও ভীষণ নিবুনিবু হয়ে। মেইন গেট তো বন্ধ… তাহলে! এত বৃষ্টিতে বাইরে নিশ্চয়ই কেউ নেই। তাহলে মৈত্রেয়ী কোন্ দিকে গেল? এদিক ওদিক তাকাতে ওর মনে পড়ল হোটেলের পিছন দিকে আর একটা সাইড গেট আছে। কালকেই চোখে পড়েছিল অনির্বাণের। পা টিপে টিপে ও এগিয়ে যায় পিছনের দরজার দিকে। যা ভেবেছে, ঠিক তাই। দরজাটা আলতো করে ভেজানো ছিল। হোটেলের পিছন দিকে হওয়ায় এদিকে খুব একটা আসে না কেউ। দরজা খুলে বাইরে মাথাটা অল্প গলাল অনির্বাণ। বৃষ্টিটা আগের তুলনায় একটু ধরেছে। হোটেলের সামনে যে রাস্তাটা, তার উলটোদিকে কিছুটা এগোলেই অটোস্ট্যান্ড। একটা হলুদ বাল্ব টিমটিম করে জ্বলছে অটোস্ট্যান্ডের এক সাইডে। সেই আলো আঁধারিতে অনির্বাণ দেখতে পেল মৈত্রেয়ী মিমকে কোলে নিয়ে একটা অটোয় উঠল। অটোর সামনের হেডলাইটা নরম আলো ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। এত রাতে মৈত্রেয়ী কোথায় যাচ্ছে? মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যায় অনির্বাণের। ও কোনোমতে মাথায় হাত চাপা দিয়ে বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে করতে অটো স্ট্যান্ডে পৌঁছায়। এইরকম একটা ওয়েদারে বেশিরভাগ অটো চালকই গায়ে চাদর জড়িয়ে শুয়ে রয়েছে একপাশে। অনির্বাণকে আসতে দেখে ওদের মধ্যে একজন চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল। তারপর ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে প্রশ্ন করল, “ক্যায়া চাহিয়ে?”
— আভি কিসিনে ইয়াহা সে অটো কিরায়ে পার লিয়া হ্যায়, কেয়া আপ উসে জানতে হে?
— হা, রামেশ্বরম কা অটো থা উয়ো, কিউ?
— মে আভি মুশকিল মে হু, মুঝে কাহি যানা হ্যায়, আপ লে যায়েঙ্গে? প্লিজ…!
“আব ইস মওসাম মে… কিধার যানা হ্যায় আপকো?” কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় অল্প বিরক্ত হয় অটোচালক।
“মে দুগনা কিরায়া দুঙ্গা… উস অটোকো ফলো ক্যরনা হোগা… চ্যলিয়ে প্লিজ”, কাতরভাবে বলে অনির্বাণ। ওর পরনের জামাটা একটু ভিজে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। অনির্বাণের কাতর আবেদনে অটোচালক কী ভাবল, কে জানে। তারপর উঠে একটা আড়মোড়া ভেঙে বলল, “ঠিক হ্যায়… চলিয়ে…”
— শুকরিয়া।
অনির্বাণ গাড়িতে বসলেই গাড়ি ছেড়ে দিল অটোচালক। বৃষ্টি অনবরত পড়েই চলেছে। তার মধ্যে দিয়েই এগোতে লাগল গাড়ি। অনির্বাণের শরীরটা থরথর করে কাঁপছে এই মুহূর্তে। মনে হচ্ছে চিন্তায় ওর মাথা যেন ফেটে যাবে। ও বারবার বলতে লাগল, “থোড়া জলদি কিজিয়ে।”
— আরে বাবুজি… ইস মওসাম মে জলদবাজি ক্যরনা আচ্ছা নেহি হোগা… উয়ো ইস সড়ক পার গ্যয়ে হে।
অনির্বাণ ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকে। ওর মধ্যে এই মুহূর্তে কী চলছে, সেটা ও ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারবে না। অটো ঠিকঠাকই এগোচ্ছে। আরও বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর প্রথম অটোটাকে ধরে ফেলল ওরা। সামনের অটোটা দেখতে পেয়ে অনির্বাণ চালককে বলল, “উন লোগোকো ইয়ে নেহি পাতা হোনা চাহিয়ে কি হাম উসকে পিছে হ্যায়।”
— আপ ক্যরনা কা চাহতে হো?
— বাদ মে বোলেঙ্গে স্যব… আপ প্লিজ স্যড়ক পার ধেয়ান দে।
আর কিছু না বলে একটু দূরত্ব বজায় রেখে গাড়ি চালিয়ে সামনের অটোটাকে ফলো করতে লাগল চালক। যেদিক দিয়ে ওরা যাচ্ছে, সেই রাস্তার দু’পাশে একটু একটু করে লোকালয় কমে আসছে। বরং এইদিকে জঙ্গল একটু একটু করে ঘন হচ্ছে। আরও কিছুদূর এগোনোর পর সামনের অটোটা হঠাৎ থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অনির্বাণ বলে উঠল, “ইয়াহা রুকিয়ে।”
গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মেটানোর পর অটোচালক বলল, “হাম চ্যলে যায়ে?”
— হা হা যাইয়ে… আপকা বহোত বহোত শুকরিয়া।
— পার ইয়াহা ক্যায়া করেঙ্গে আপ?
— কুছ কাম হে মেরেকো… আতা হু মে।
অটোচালক আর কিছু না বলে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অনির্বাণ অন্ধকার ঘেঁষে এগোতে থাকে সামনের দিকে। তাড়াহুড়োয় ছাতা নেওয়ার কথা ওর মনে নেই। তাই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই এগোতে লাগল ও। সামনের অটোটা এবার ফিরে আসছে। নিজেকে অন্ধকারে আড়াল করে নেওয়ায় ওকে দেখতে পায়নি চালক। এবার তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা সূক্ষ্ম আলো চোখে পড়ে অনির্বাণের। সেইদিক বরাবর এগিয়ে গিয়ে ও দেখতে পেল, মৈত্রেয়ী খুব সাবধানে মিমকে কোলে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কোথাও যাচ্ছে। এক হাতে ছাতা আর টর্চ খুব সাবধানে ধরে রেখেছে ও। অনির্বাণ চুপচাপ ফলো করতে থাকে ওকে। যে রাস্তা ধরে মৈত্রেয়ী এগোচ্ছে, সেই রাস্তার দু’পাশে জঙ্গল বেশ ঘন। বৃষ্টির জলে চুপসে গিয়েছে অনির্বাণ। হাত দিয়ে কোনোমতে চোখটাকে আড়াল করে হাঁটছে ও। টর্চের আলোয় চারপাশ খুব একটা স্পষ্ট নয়। এমন সময় কোথায় যেন বাজ পড়ল আবার। চারদিক কেঁপে উঠল সেই শব্দে। অনির্বাণ পুরোপুরি নিশ্চিত নয় কিন্তু একটা সন্দেহ পাক খেয়ে উঠছে ওর মনের মধ্যে। যদি সে ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে…! বেশ কিছুদূর এগোনোর পর অবশেষে মৈত্রেয়ী থামল। ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘের বুকে বাজের ঝিলিক দেখা গেল। ক্ষণিকের সেই ঝলকানিতে অনির্বাণ দেখতে পেল ওদের সামনে বহু বছরের পুরোনো একটা মন্দির। চুন পলেস্তারা খসে পড়া বীভৎস সেই মন্দির চোখের সামনে দেখে বুক কেঁপে ওঠে অনির্বাণের। এই মুহূর্তে ও বুঝতে পেরেছে যে, ওরা কোথায় রয়েছে। এই তাহলে সেই দ্বিতীয় ঈশ্বরের মন্দির! মৈত্রেয়ী কোনোদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে গেল পাশের বেদীর দিকে। অনির্বাণ ততক্ষণে মোটা একটা গাছের পিছনে আত্মগোপন করেছে। সেইখান থেকে লক্ষ করে ও বুঝতে পারল, বেদীর ঢাকনাটা আগে থেকেই খোলা ছিল। সেই বেদীর মধ্যে একটু একটু করে হারিয়ে গেল টর্চের সাদা আলো।
বৃষ্টির বেগ এই মুহূর্তে আগের তুলনায় আরও বেড়েছে। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে অনির্বাণের। এখানে লুকিয়ে আসার একটাই মানে হতে পারে, কিন্তু কেন? কী আছে মৈত্রেয়ীর মনে! না না… বেশি দেরি করা উচিত নয়। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোনোমতে হালকা হোঁচট খেতে খেতে ও এগোতে লাগল সেই বেদীর দিকে। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে ভেতরের দিকে। অন্ধকারে খুব সাবধানে সেই সিঁড়িতে পা রাখল অনির্বাণ। একটা ঠান্ডা হাওয়া কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় ওর শরীরে। ভিজে জামা-কাপড়ে হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে আস্তে আস্তে নীচে নামতে থাকে সে। সিঁড়িটা প্যাঁচালো। নামতে নামতে একটা সময় পর সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রাখে অনির্বাণ। মাটির নীচের একটা গোপন সুড়ঙ্গে এসে থেমেছে এই সিঁড়ি। অন্ধকারে আরও বীভৎস লাগছে চারপাশ। খুব হালকা একটা আলোর ছিটে এসে পড়েছে এদিকে। সেই আলোয় কোনোরকমে সামনের সরু প্যাসেজটা পার হয় সে। এবার যে ঘরে সে ঢোকে, সেটা বেশ বড়োসড়ো। তবে ঘরের মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুত গন্ধ। গা-টা গুলিয়ে ওঠে অনির্বাণের। যেন বহু বছর ধরে জমে থাকা পচা গলা মাংসের গন্ধ! বৃষ্টির শব্দটা কেমন যেন গমগম করছে মাটির নীচের এই সুড়ঙ্গে। সুড়ঙ্গের দেওয়ালে দেওয়ালে যেন মাথা কুটছে চাপা শব্দেরা। বুকের ঢিপঢিপানি বাড়ছে ক্রমশ। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ওর। এই ঘরটা পেরোতেই সামনে একটা সরু পায়ে-হাঁটা জায়গা। তার ওপাশের ঘরটা মোমবাতির আলোয় ভরে গিয়েছে। খুব সাবধানে সেই ঘরে উঁকি মারে অনির্বাণ। এটাকে ঠিক যেন ঘর বলা চলে না। একপাশে ধ্বসে পড়া দেওয়াল। ও পাশে কী আছে কে জানে! অনির্বাণের চোখ পড়ল সেই গাছটার দিকে। ঘরের মাঝখান দিয়ে একটা গাছ ছাদ ফুঁড়ে সোজা ওপরে উঠে গেছে। এই সেই গাছ, যেটার কথা গল্পের ছলে বলেছিলেন সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক। একইরকমভাবে গাছের চারপাশে একটা বেড়া দেওয়া আছে। ঘরের চারধারে একটা করে বড়ো মোমবাতি জ্বলছে। সেই আলোয় ঘরটা বেশ উজ্জ্বল। মাঝখানে মেঝের ওপর পাঁচকোণা আকৃতির একটা তারা। সেই তারার পাঁচটা কোণে পাঁচটা প্রদীপ জ্বলছে। মৈত্রেয়ী মিমকে শুইয়ে রেখেছে মেঝের একপাশে। কেমন যেন গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে রয়েছে মিম। মৈত্রেয়ী সেই বেড়ার সামনে বসে একমনে কিছু একটা করছে। হঠাৎ একটা ছুরি চকচক করে ওঠে ওর হাতে। বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছে ও। কেমন যেন গোঙানির মতো লাগছে ওর গলার স্বর। অনির্বাণের নিঃশ্বাস যেন থমকে পড়েছে। ছুরি দিয়ে কী করবে ও? হঠাৎ এক হাতে সেই ছুরির ধারালো মুখটা চেপে ধরে মৈত্রেয়ী। মোমবাতির আলোয় অনির্বাণ দেখতে পায়, মৈত্রেয়ীর হাতের চামড়া কেটে টাটকা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কী ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য! মৈত্রেয়ীর মন্ত্রোচ্চারণ অস্পষ্ট হতে হতে ঘরের বদ্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। কেমন যেন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ অনেকক্ষণ থেকেই পাচ্ছে অনির্বাণ। গা-টা আবার গুলিয়ে ওঠে ওর। যতদূর মনে আছে এই দেবতার পুজো দিতে গেলে একটা কালো বিড়াল দরকার। কোথায় সেই বিড়াল? পরিবেশটা কেমন যেন আধিভৌতিক হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। ওর মনে হচ্ছে এই ঘরের মধ্যে যেন কয়েকশো বন্দি আত্মারা একসঙ্গে আর্তনাদ করছে। গলা শুকিয়ে গিয়েছে ওর। ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছে ওর আশেপাশে অসংখ্য অশরীরীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবার মৈত্রেয়ী মন্ত্র পড়া থামাল। তারপর এগিয়ে এল সেই পাঁচকোণা তারার সামনে। লাল রঙের সেই তারা জ্বলজ্বল করছে। মৈত্রেয়ী এক হাতে ছুরি ধরে অন্য হাতটা এগিয়ে দেয় ঠিক সেই তারার ওপর। তারপর বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে নিমেষে ছুরি টেনে দেয় তার নরম হাতের কব্জিতে। অনির্বাণ আর সহ্য করতে পারে না। ঘটনার আচম্বিতে ওর গলা থেকে অস্ফুটে একটা শব্দ বেরিয়ে আসে, “অ্যাঁ!”
আর সেই শব্দে চমকে সেদিকে তাকায় মৈত্রেয়ী। অনির্বাণের সঙ্গে চোখাচোখি হয় ওর। মৈত্রেয়ীর কোমল মুখে একটা হিংস্র ভাব খেলা করে যায়। চকিতে উঠে দাঁড়ায় ও। তারপর নরম সুরে ডাকে, “অনির্বাণ… তুমি?”
অনির্বাণ কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে আসে ওর দিকে। সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ তাকিয়ে থাকে সে। তারপর অল্প ঢোঁক গিলে বলে, “এসব… এসব কী করছ মিতু?”
— তুমি এখানে কী করে এলে অনির্বাণ… ফলো করেছ আমায়?
— আগে আমায় বলো এসব কী হচ্ছে এখানে?
“জানি না আমি”, মৈত্রেয়ীর গলা কেঁপে ওঠে। তারপর হঠাৎ কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠে দাঁড়ায় ও। হাতের ছুরিটা ফেলে দেয় সে। ওর দু’চোখ ইতিমধ্যে জলে ভরে গেছে। চোখের কোল বেয়ে কান্না গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদতে কাঁদতেই মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে মৈত্রেয়ী, “আমি জানি না এসব আমার সঙ্গে কী হচ্ছে… আমি… আমি একজনের মায়াজালে ফেঁসে গিয়েছি অনি… প্লিজ হেল্প মি… প্লিজ।” কাঁদতে কাঁদতে অসহায়ের মতো ঝুপ করে মেঝেয় পড়ে যায় মৈত্রেয়ী। অনির্বাণ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বসানোর চেষ্টা করে। মৈত্রেয়ী ঢলে পড়ে অনির্বাণের বুকে। অনির্বাণ ওর হুঁশ ফেরানোর চেষ্টা করতে থাকে। জল দরকার এখন ওর… কিন্তু জল কোথায় পাবে! মেঝের এককোণে একটা কলসি টাইপ কিছু বসানো। সেদিকে এগিয়ে গিয়ে কলসিটা টেনে তার ভেতরে উঁকি মারে অনির্বাণ। ঠিক সেই মুহূর্তে ওর মাথার পেছন দিকে খুব জোরে আঘাত করে কেউ। চোখের সামনেটা কেমন যেন অন্ধকার হয়ে আসে। ঘাড় ঘোরানোর বৃথা চেষ্টা করে মেঝেয় মুখ থুবড়ে পড়ে অনির্বাণ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন