আটটা নাগাদ মৈত্রেয়ী বাড়ি ফেরে। ওর ঘামে ভেজা ক্লান্ত মুখখানা খুশিতে চকচক করছে। সাইড ব্যাগটা নামিয়ে রেখে হাতের বড়ো প্লাস্টিকটা ডাইনিং টেবিলে রেখে অনির্বাণকে ডাকে মৈত্রেয়ী, “অনির্বাণ… এদিকে এসো।”
এই সময়ে কলকাতায় ইতিমধ্যে বেশ গরম পড়ে গিয়েছে। সেজন্যই শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিল বলে অনির্বাণ বাথরুমে ঢুকে আরও একবার স্নান সেরে নিচ্ছিল। মৈত্রেয়ীর গলা শুনে মাথা মুছতে মুছতে যখন ও বেরোল, তখন দেখতে পেল টেবিলের ওপর দুটো প্লেটে চিকেন বার্গার, ভেজ স্যান্ডুইচ আর একটা রয়্যাল পিৎজার প্যাকেট। ও কিছুটা অবাক হয়ে মৈত্রেয়ীর দিকে তাকাতেই মৈত্রেয়ী হাসতে হাসতে বলে ওঠে, “এতে অবাক হওয়ার কী আছে? সকালে তো বলেইছিলাম তোমায়… তা ছাড়া আমার প্রমোশনের পিন লেভেল অ্যাচিভ করার আনন্দেই বলতে পারো আজকের এই খাওয়া-দাওয়া।”
“আচ্ছা, আমি জামা পরে আসছি, তুমি ততক্ষণ ফ্রেশ হয়ে নাও।” অনির্বাণ ঘরের দিকে এগোতে যেতেই মৈত্রেয়ী ওর সামনে চলে আসে।
“অনি…” আদুরে গলায় ডেকে ওঠে মৈত্রেয়ী। ওর চোখে এই মুহূর্তে একটা দুষ্টুমি খেলা করছে। অনির্বাণকে অবাক করে দিয়ে আচমকা ওকে জড়িয়ে ধরে মৈত্রেয়ী। তারপর অনির্বাণের ভিজে শরীরে ক্রমশ ঘন হয়ে যেতে যেতে ওর চোখে চোখ রাখে। ফিসফিস করে বলে, “তোমার কি মনে হয় না যে, আমাদের নিজেদের একটা আলাদা টাইম স্পেন্ড করা উচিত?”
— সে তো মনে হয় কিন্তু…
“চুপ”, অনির্বাণকে মাঝপথেই থামিয়ে দেয় মৈত্রেয়ী, “আজ আমি বলব তুমি শুনবে… আমাদের মধ্যে অনেক কিছু পালটে গেছে, তাই না অনি? যত দিন যাচ্ছে, তত একে অপরের থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি আমরা… তুমি আমায় আগের মতো একটুও ভালোবাসো না আর… কত দিন ভালো করে আদর করোনি বলো তো… আমারও তো ইচ্ছে হয় একটা গোটা দিন শুধু তুমি আর আমি দুজন দুজনকে পাগলের মতো ভালবাসব… কতদিন অফিস থেকে ফিরে তোমাকে জড়িয়ে ধরিনি… তুমি শেষ কবে আমায় আচমকা চুমু খেয়েছিলে, মনে পড়ে? কেন এতটা পালটে যাচ্ছে সবকিছু! অনি… অনি… আই স্টিল লাভ ইউ… আমাদের মধ্যে তৃতীয় কেউ চলে এসেছে, তাই তো! তাই হয়তো আগের গুরুত্বটা আমি আর পাই না।”
— মিতু তুমি…
— শশশশ… কোনো কথা বোলো না অনির্বাণ দেশমুখ… আমায় অন্তত আজকে বলতে দাও… আমরা শেষ কবে একসঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম অনি? একসঙ্গে অনেকটা সময় শেষ কবে কাটিয়েছিলাম বলতে পারো? আমরা কি একে অপরের কাছে এতটাই পুরোনো হয়ে গিয়েছি! আমার ভীষণ ইচ্ছে হয় আমাকে কেউ পাগলের মতো ভালোবাসুক, কেয়ার করুক… আমায় ভালোবাসো না অনি?
“বাসি তো… আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি মিতু।” অনির্বাণের গরম নিঃশ্বাস পড়ছে মৈত্রেয়ীর কপালে, “তুমি হয়তো সেটা বুঝতে পারো না।”
“আমায় কতটা ভালোবাসো অনির্বাণ?” বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করে মৈত্রেয়ী।
— যতটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।
— আমায় একটু আদর করবে অনির্বাণ, পাগলের মতো… আমায় এমনভাবে ভালোবাসো, যাতে এরপরে আমাদের ভালোবাসা নিয়ে আমার মনে আর কোনো ক্ষোভ না থাকে।
মুখটা এগিয়ে অনির্বাণের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় মৈত্রেয়ী। অদ্ভুত এক তৃপ্তিতে অনির্বাণ চোখ বন্ধ করে নেয়। চারপাশ ক্রমশ মুছে যেতে থাকে। কেবল ঘড়ির টিকটিক শব্দটা নিজের প্রভাব বিস্তার করছে। কতক্ষণ যে কাটল এভাবে, সেটা কারোরই মনে নেই। কিছুক্ষণ পর ঠোঁটের কোণে আলগা হাসি নিয়ে অনির্বাণ ঘরে ঢুকে গেল জামা পালটানোর জন্য। অন্যদিকে মৈত্রেয়ী নিজের মনে একটা সুর গুনগুন করতে করতে প্লেটে খাবার সাজাতে লাগল। মানুষের জীবনে এমন একটা মুহূর্ত ভীষণ মূল্যবান হয়। কিছু কিছু মুহূর্ত আসা দরকার, যেখানে ভেতরে জমে থাকা রাগ-অভিমান গলিয়ে ফেলা যায় নিঃসংকোচে। একটা চুমু কিংবা জড়িয়ে ধরার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অদ্ভুত এক প্রশান্তি। প্রতিদিনের নিয়মমাফিক জীবনের ফাঁকে নিজের মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে জানান দিতে হয় যে, আমি আছি। তাহলে হয়তো সম্পর্কগুলোয় সজীবতা বজায় থাকে।
.
মিমকে কোলে নিয়ে অনির্বাণ ডাইনিং টেবিলের সামনে আসে। মৈত্রেয়ী তিনটে প্লেটে খাবার ভাগ করে রেখেছে। খেতে খেতে মৈত্রেয়ী বলে ওঠে, “অনেকদিন আমরা মুভি দেখতে যাইনি সেইভাবে… ইউটিউব, নেটফ্লিক্স দেখে দেখে চোখ পচে গেল… ৯:৩০ থেকে একটা ভালো মুভি আছে, আমি আইনক্সের দুটো সিট বুক করে রেখেছি… তাড়াতাড়ি খাওয়া কমপ্লিট করো, আজ বেরোব।”
“বাহ্, ভালো করেছ।” অনির্বাণ বলে ওঠে, “আজ না হয় মুভি দেখে একটু ঘুরে আসব… তা ছাড়া অনেকদিন হল রাতের কলকাতা ঘুরে দেখা হয়নি আমার, তোমার সঙ্গে… আজকে তাহলে সেই কথাই থাক।”
“বাবাই!” মিম ডেকে ওঠে।
— বলো।
— আমার জন্যে একটা আইসক্রিম আনবে?
“হমম, বেশ।” অনির্বাণ হাসি মুখে বলতেই যাচ্ছিল ; মৈত্রেয়ী কড়া গলায় বলে ওঠে, “একদম না, এই মুহূর্তে আইসক্রিম খাওয়ার কোনো দরকার নেই… তোমার ঠান্ডার ধাত রয়েছে, আইসক্রিম অ্যাভয়েড করা ভালো।”
— মিতু, ছাড়ো না… অসুবিধা কী? একটাই তো…
— না অনি… আমি জানি তুমি ওকে ভীষণ প্রশ্রয় দাও, কিন্তু ওর শরীর খারাপ হলে ভুগতে তো দুজনকেই হবে, তাই না! সেজন্য ‘নো আইসক্রিম।’
মৈত্রেয়ীর কথা শুনে আর কোনো বায়না করে না মিম। চুপচাপ নিজের প্লেটের খাবার খেয়ে বেসিনে হাত ধুতে চলে যায়। মিম চলে যাওয়ার পর অনির্বাণ বাঁ হাত বাড়িয়ে মৈত্রেয়ীর ডান হাতের কব্জিতে হালকা চাপ দেয়, “এভাবে ওকে কেন বললে মিতু? বাচ্চাটা একটা আবদার করে ফেলেছে, সেজন্য…”
— আমাকে তুমি ভীষণ খারাপ মনে করো, তাই না? কিন্তু কী বলো তো, আমি তো মা… নিজের সন্তানের খারাপ কিছু হলে আমার নিজেরও কষ্ট হবে, সেজন্যেই বারণ করলাম আমি।
— সেটা তো তুমি ভালোভাবেও বলতে পারতে।
— উফ… তুমি প্লিজ এখন আর এসব নিয়ে পোড়ো না… লেট্স এনজয় আওয়ার টাইম।
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনির্বাণ অল্প হাসে, “আচ্ছা বেশ।”
.
মুভির নাম ‘ট্যাঙরা হিল্স্’… প্রথমে যদিও নামটা দেখে খুব একটা ইন্টারেস্ট পায়নি ওরা কেউই। ভেবেছিল বেশ কিছুটা সময় একসঙ্গে কাটাতে পারবে সিনেমাহলের অন্ধকারে, এটাই যথেষ্ট। প্রথম ১০ মিনিট ওরা একে অপরকে নিয়েই মজে ছিল। অনির্বাণের বুকে মাথা রেখে বসেছে মৈত্রেয়ী। অনির্বাণ বাঁ হাত দিয়ে আগলে রেখেছে ওকে। মৈত্রেয়ী অনির্বাণের গালে ওর ঠোঁট ছোঁয়ায়। এই সময় খুব একটা বেশি ভিড় নেই এখানে। ওদের মতোই বেশ কিছু কাপল ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে চারপাশে। এসি চলছে, তাই আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। অনির্বাণ মৈত্রেয়ীর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে। মৈত্রেয়ী অনির্বাণের হাতের মুঠোয় চুমু খায়। তারপর ওর কানের পাশে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে বলে, “আচ্ছা অনির্বাণ, আমরা শেষ যেবার একসঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, সেদিন কিন্তু আমাদের মধ্যে তৃতীয় কেউ ছিল না, আজকেও আমরা দুজন একলা… আমি তোমাকে প্রত্যেকটা বার আলাদা করে পেতে চেয়েছি… আমি কি খুব বেশি কিছু চেয়ে ফেলেছি?”
— মিতু, তুমি সত্যিই বাচ্চা আছো… আমার কাছে তুমি কী, সেটা তুমি নিজেও জানো না। আমি আজও তোমার ফিরতে লেট হলে আগের মতোই টেনশন করি। তুমি যখন আমার সঙ্গে ঝগড়া করে রাগ দেখিয়ে না খেয়ে অফিসে বেরিয়ে যাও, আমি নিজেও ঠিকঠাকভাবে খাওয়া-দাওয়া করতে পারি না… তুমি যতবার নিজের ভুল বুঝতে পারো, ততবার আমি নতুন করে আমার মৈত্রেয়ীকে ভালোবাসি।
— আমার কেন জানি ভয় হয়, জানো!
— কীসের ভয়?
— জানি না, খালি মনে হয় আমরা দুজন হয়তো একে অপরের থেকে অনেকটা দূরে সরে যাচ্ছি।
— এটা সম্পূর্ণ তোমার ভুল ধারণা… আমরা যেমন ছিলাম, তেমনই আছি।
— একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
— বলো।
— তুমি সত্যিই একজন প্রকৃত বাবা হয়ে উঠতে পেরেছ, কিন্তু আমি একজন ভালো মা হতে পারিনি, তাই না?
— আমি জানি তুমি মিমকে ভালোবাসো, কিন্তু সেটা কখনও প্রকাশ করো না… তবে জানো তো মৈত্রেয়ী, মানুষকে ভালোবাসলে সেটা প্রকাশ করতে হয়… জানি তুমি এখন নিজের কাজ নিয়ে অনেকটা ব্যস্ত, কিন্তু নিজেকে এতটাও ব্যস্ত রেখো না যে, ভবিষ্যতে এর জন্য তোমায় ফল ভোগ করতে হয়।
“আমি ওসব কিছু জানি না।” মৈত্রেয়ী অনির্বাণের জামা চেপে ধরে, “কথা দাও তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না কোনোদিন।”
“আমি কখনও ভুল বুঝি না মিতু।” মৈত্রেয়ীর কপালে চুমু খায় অনির্বাণ, “সেজন্যই তো কলেজ লাইফের সেই পাগল মেয়েটাকে আমি আজও ভালোবাসি।”
— অ্যাই অ্যাই… পাগল মানে? আমি পাগল!
— অবশ্যই, কারণ পাগলি মেয়েরাই এতটা গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে।
“মরণ দশা”, মুখ ভেঙচায় মৈত্রেয়ী।
অনির্বাণ হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই তার চোখ পড়ে স্ক্রিনে। সেখানে তখন বেশ কয়েকটা ছোট ছোট বাচ্চার একটা ব্যান্ডে গান গাওয়ার সিন চলছে। গানের লিরিক্সগুলো বেশ কানে লাগার মতো। সেদিকে মৈত্রেয়ীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনির্বাণ, “গানটা শোনো মিতু।”
একে একে দুজনেই ডুবে যায় সামনের পর্দায় চলতে থাকার ঘটনাগুলোয়। ঘড়ির কাঁটা যত এগোচ্ছে, ততই যেন সিনেমাটা একটা অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। দুজনেই সিনেমার মানুষগুলোর জীবনযাত্রার সঙ্গে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের মিল খুঁজে পায়। স্ক্রিপ্ট রাইটার বেশ ভেবেচিন্তেই লেখাটা লিখেছেন তাহলে। ওই তো, কে যেন মেয়েটার পিছু নিয়েছে… এবার কী হবে! উত্তেজনায় মৈত্রেয়ী অনির্বাণের হাত চেপে ধরে।
সাড়ে এগারোটা নাগাদ ওরা যখন মেনরোডে এসে দাঁড়ায়, তখনও আশেপাশে গাড়ি-ঘোড়া, লোকজন যথেষ্ট। কলকাতার মানুষ এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যায় না। অনির্বাণ ফোন বের করে বলে, “তাহলে ক্যাব বুক করি?”
— নাহ্… ক্যাব, ওলা এসবে চড়তে চড়তে বোর হয়ে গিয়েছি, আজকে আমরা ট্যাক্সিতে উঠব।
— চলো, তোমার কথাই থাক।
হাত নেড়ে একটা ট্যাক্সি থামায় অনির্বাণ। তারপর দুজনে মিলে পিছনের দরজা খুলে উঠে বসে গাড়িতে। ট্যাক্সিওয়ালা বলল, “কোথায় যাবেন?”
“এই রাতের মহানগরী ঘুরব আমরা আজ, একটা গোটা ঘণ্টা দিলাম আপনাকে… তারপর রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে নামিয়ে দেবেন”, উত্তর দেয় মৈত্রেয়ী।
— আচ্ছা ম্যাডাম
.
ট্যাক্সি চলতে শুরু করে। পিছনের দরজার কাচ নামানোই ছিল। সেই জানলা দিয়ে দমকা হাওয়া এসে আছড়ে পড়ে দুজনের মুখে। হাওয়ার ধাক্কায় দুজনেরই চুল এলমেলো। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দুজনেই রাতের শহরের মাধুর্য্য অনুভব করতে ব্যস্ত। তাদের এই শহরটা যে এতটা সুন্দর, সেটা আগে ওরা কখনও এতটা খুঁটিয়ে দেখেনি। মৈত্রেয়ীর অবাধ্য কয়েক গাছা চুল চোখের সামনে পড়ছিল বারবার। অনির্বাণ হাত দিয়ে সেই চুলের গাছা ওর কানের পাশে দিয়ে দেয়। তারপর ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, “তুমি এই রাতের শহরের থেকেও বেশি সুন্দর।”
— আমাদের চোখের সামনেই কত কিছু রয়েছে… তাই না অনির্বাণ! অথচ আমরাই সময় পাই না সেসব দেখার।
— মাঝে মাঝে এরকম সময় বের করতে হয় মিতু, না হলে জীবনটা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
— আমরা তাহলে সপ্তাহে একদিন করে এভাবে ঘুরতে বেরোব?
— সে তো বের হওয়াই যায়, কিন্তু কাল তোমার অফিস যেতে লেট হয়ে যাবে না?
— মহামান্য হাঁদারাম, কাল রবিবার… আমার অফ ডে আছে কাল… সেজন্যই তো আজকে এতক্ষণ অব্দি তোমার সঙ্গে কাটাতে পারছি।
— আচ্ছা বুঝলাম, ম্যাডাম তাহলে সবকিছু রেডি করেই রেখেছেন!
— হুমম, মেয়েরা একটু বেশিই চটপটে এদিক দিয়ে।
— তাই নাকি… তা বেশ।
হাসতে থাকে দুজনে। ওদের দুজনের হাসির শব্দ ভেসে যায় দূরের বাতাসে। মাথার ওপর তারা ভরা আকাশ, ঘন নীল রঙের জামদানি শাড়িতে ঢেকে রেখেছে নিজেকে। একটু একটু করে রাত বাড়তে থাকে।
.
অনির্বাণ সকাল থেকে একটা লেখা নিয়ে বসেছে। প্রকাশক সুধীরদা ওকে ফোন করে করে প্রায় পাগল করে দিচ্ছেন। পরের দু-মাসের মধ্যে ফাইনাল কপি ওকে সাবমিট করতে হবে। সেটা নিয়ে একটু চাপেই রয়েছে ও। মৈত্রেয়ী সকাল সকাল বেরিয়ে গিয়েছে আজ। একগাদা পেপার আর বেশ কয়েকটা বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনির্বাণের টেবিলে। অনেকক্ষণ ধরে একনাগাড়ে বসে থাকার ফলে অনির্বাণের কোমর ব্যথা করছে। “একটু রেস্ট নেওয়া যাক”, এই ভেবে চেয়ার ছেড়ে উঠে আড়মোড়া ভাঙে অনির্বাণ। তারপর কফি বানানোর জন্য কিচেনে ঢোকে। কফি বানানো প্রায় হয়ে এসেছে, এমন সময় কলিংবেল বাজল।
এখন আবার কে! ভাবতে ভাবতেই দরজা খোলে অনির্বাণ। দরজা খুলতেই দেখে ওপাশে দাঁড়িয়ে আগের দিনের সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক। ওঁর হাতে একটা মিষ্টির হাঁড়ি। একগাল হেসে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেন, “কী হে, কী খবর?”
— ঠিকঠাক, আপনি কেমন আছেন?
— চলে যাচ্ছে… শরীরটা একটু খারাপ হয়েছিল, তাই সেভাবে আর খবর নেওয়া হয়নি এই ক’দিন।
— বুঝলাম, এখন কেমন আছেন? আসুন, ভিতরে আসুন।
“গতকাল থেকে খিদেটা বেশ আগের মতোই পাচ্ছে”, ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জবাব দেন, “খিদে পাচ্ছে মানে শরীর একদম ঠিক।”
— ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?
— ডাক্তারের সাধ্য কী এই রোগের চিকিৎসা করার!
— কেন? এমন কী রোগ হয়েছে আপনার?
“সে বাপু অনেক গল্প… সময়মতো বলা যাবে’খন, আগে এটা ধরো দিকি”, বলে হাতে ধরা মিষ্টির হাঁড়িটা এগিয়ে দেন তিনি, “কী আছে বলো দেখি এতে?”
— এসব আবার কেন আনতে গেলেন?
— শোনো বাপু, কেন করলাম এসবের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই… তা ছাড়া ভালোবেসে কোনো মানুষ কিছু দিলে সেটা নিতে হয়।
— আপনি শুধু শুধু এসব কিনতে গেলেন।
— স্পেশাল রাবড়ি আছে এতে, খেয়ে দেখো… তোমাদের বয়সে আমরা হাপুস-হুপুস করে খেতাম আর এখনকার দিনে… বাবাহ্! লজ্জায় মরে যায় সব।
“আপনিও পারেন বটে”, অনির্বাণ হেসে ফেলে।
বুড়ো ততক্ষণে সোফায় আরাম করে বসেছেন। ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন, “মিমবাবু কই?”
— স্কুলে গিয়েছে, একটু পরেই ছুটি হয়ে যাবে।
— বেশ বেশ… আজ মিম বাবুর সঙ্গে গল্প করে যাব।
— আপনি বসুন, আমি কফি বানিয়েছি।
— কফি আমি খাই না বাপু… চা হলে তবুও ঠিক আছে।
— আচ্ছা বেশ, আমি চা বানিয়ে আনছি।
.
অনির্বাণ রান্নাঘরে ঢুকে গ্যাসে চায়ের জল বসায়। কৌটো খুলে দুটো বিস্কুট বের করে প্লেটে রাখে। জলটা ফুটে উঠতেই তাতে চা পাতা, চিনি আর এক টুকরো আদা কুচি দিয়ে দেয়। অনির্বাণ মোটামুটি সব রান্নাই করতে পারে। তাই ‘রান্না করাটা মেয়েদের কাজ’ এই কথাটার মুখে চুনকালি লেপে দিতে পারে অনির্বাণের মতো ছেলেরাই। কিছুক্ষণ পর কফির কাপ আর চায়ের প্লেট হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে অনির্বাণ। টেবিলের ওপর চায়ের কাপটা রেখে ভদ্রলোকের মুখোমুখি বসে ও। ভদ্রলোক ততক্ষণে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে সেটার পাতা ওলটাচ্ছিলেন। অনির্বাণকে দেখে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা বাবা, দিনকয়েক আগে বোধহয় তোমরা কোথাও বেরিয়েছিলে… তবে মিম বাবু সঙ্গে ছিল না, বাচ্চাটাকে একা রেখে গিয়েছিলে, কোনো অসুবিধা হয়নি?”
“আরে না না”, অনির্বাণ মৃদু আপত্তি জানায়, “পাশের ফ্ল্যাটের মিসেস দত্ত আমাদের অনেকদিনের প্রতিবেশী… ওঁর কাছে এক্সট্রা চাবি দেওয়াই ছিল, আমরা যতক্ষণ ছিলাম না, ততক্ষণ তিনিই মিমের সঙ্গে ছিলেন… তা ছাড়া মিম ওঁকে বেশ পছন্দও করে, গল্প শোনে চুপচাপ… সে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না।”
— তা বেশ বেশ… আসলে আমি একটু অবাক হয়েছিলাম যে, অতটুকু একটা বাচ্চাকে রেখে তোমরা বেরিয়ে গেলে… তারপর কখন ফিরলে, সেটাও জানি না।
— মিমের ব্যাপারে আমি ভীষণ সিরিয়াস… ওর যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সেদিকে আমি সবসময় খেয়াল রাখি।
“খুব ভালো”, বৃদ্ধ চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, “চা টা তো বেশ হয়েছে… এক্কেবারে সুপারহিট।”
“তাই নাকি!” অনির্বাণ হাসল, “এই টুকিটাকি দু-একটা জিনিসই যা করতে পারি।”
— তাও ভালো, রান্না একদম করতে না পারার থেকে কিছুটা করতে পারা অনেক বেশি সম্মানের… আমি এই ম্যাগাজিনটা দেখছিলাম, দেখো দেখো… পেপারের টপিকটা ভীষণ অদ্ভুত… আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে— আচ্ছা তোমার কী মনে হয়… না মানে তুমি কি ভূতে বিশ্বাস করো?
— দেখুন, আমি মনে করি ভূত বলে সেরকম কিছু হয় না … তবে আত্মা অবিনশ্বর, তাকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। তা ছাড়া আমরা যারা কলম বেচে খাই, তাদের কাছে এই ভূতের অস্তিত্ব একটা বড়োসড়ো ব্যাপার ; কারণ তেনারা না থাকলে আমরা মানুষকে ভয় দেখাব কী করে বলুন তো!
— তার মানে তুমি মনে করো ভূত বলে সেরকম কিছু হয় না, তাই তো?
— আমি ভগবানকে কোনোদিনও চোখে দেখিনি, কিন্তু বিশ্বাস করি যে, একটা পজিটিভ এনার্জি আছে… ঠিক তেমনই আমি কোনোদিন ভূত-ও দেখিনি, তাই ভূত আছে কিনা সে নিয়ে তর্কে যাব না। কিন্তু পজিটিভ এনার্জি যখন আছে, তখন অবশ্যই নেগেটিভ এনার্জিও থাকবে… না হলে ব্যালেন্স হবে কী করে!
— ভালো যুক্তি, তবে আমার জীবনে এমন অনেক কিছু ঘটেছে, যেগুলোর ব্যাখ্যা আমি আজও পাইনি… তোমার যদি অসুবিধা না থাকে, তোমার সঙ্গে তেমনই কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চাই।
— কোনো অসুবিধা নেই, বরং এসব শুনলে হয়তো আমি নতুন লেখার আইডিয়া পাব।
“বেশ, তাহলে শুরু করা যাক”, চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে রাখেন ভদ্রলোক। গলাটা হালকা খাঁকড়িয়ে নেন। তারপর গল্প বলার ভঙ্গীতে শরীরটা একটু টানটান করে বসেন, “প্রথমে যে ঘটনার কথা বলতে চলেছি, সেটা সত্যিই ভীষণ অদ্ভুত… বলতে পারো এই পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যার সত্যি কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা বিশ্বাস করি যে, ঈশ্বর বা ভগবান বা আল্লাহ এমন একজন, যিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। আমরা ভালো মনে কিছু প্রার্থনা করলে তিনি সেটা পূরণ করেন, এটা একটা পজিটিভ শক্তি। তুমিও এটা বিশ্বাস করো যে, পজিটিভ শক্তি যেমন আছে পৃথিবীতে, তেমন পাশাপাশি নেগেটিভ শক্তিও রয়েছে। মনে করো, এই নেগেটিভ শক্তিটাই হল সেই দ্বিতীয় ঈশ্বর। এই দ্বিতীয় ঈশ্বর এমন একটা শক্তি, যেটা ভালোর একদম বিপরীত। অর্থাৎ এঁর কাছে যে শক্তি রয়েছে, সেটা মানুষের ভালোর থেকেও বেশি খারাপ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। আমরা এই দ্বিতীয় ঈশ্বরকে কিন্তু সরাসরি কোথাও পাই না। এঁর বাসস্থান মানুষের চোখের আড়ালে। তথাকথিত মন্দির কিংবা মসজিদে এঁর আরাধনা করা হয় না। আমাদের ঈশ্বর সন্তুষ্ট থাকেন মানুষের ভক্তি, শ্রদ্ধা আর মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যে। কিন্তু এই দ্বিতীয় ঈশ্বরের চাহিদা অনেক বেশি। তেনাকে সন্তুষ্ট করতে হয় একটা গোটা মানুষ দিয়ে। তুমি যেটা চাইবে, সেটা হয়তো তুমি পাবে… কিন্তু বিনিময়ে এমন কিছু তোমাকে দিতে হবে, যেটা তোমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। হতে পারে তুমি জীবনে এমন একটা বাধার সম্মুখীন হয়েছ, যেখান থেকে তুমি কোনোভাবেই বেরোতে পারছ না। খুব অদ্ভুতভাবে এই দ্বিতীয় ঈশ্বর তোমাকে সেই বাধা কাটিয়ে উঠতে সবরকম সাহায্য করবে, পরিবর্তে তোমার কাছ থেকে নিয়ে নেবে খুব কাছের একজন মানুষ।”
“ওহ মাই গড…সাউন্ডস ইন্টারেস্টিং”, অনির্বাণ বিড়বিড় করে বলে ওঠে।
— এই দ্বিতীয় ঈশ্বরের খোঁজ আমি পাই আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে। বয়স কম সে সময় ; অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখবার আগ্রহেই বেরিয়ে পড়ি গন্তব্যের পথে। সঙ্গী বলতে আমার আরও দুই বন্ধু। খোঁজ যিনি দিয়েছিলেন, তিনি আমার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়। শোনা যায়, সেই দ্বিতীয় ঈশ্বরকে সহজে কেউ দেখতে পায় না। কারণ উনি বিরাজ করেন লোকচক্ষুর আড়ালে। স্বার্থসিদ্ধি হয়ে যাওয়ার পরে উনি ওঁর সব হিসেব মিটিয়ে নেন, ফাঁকি দিতে পারে না কেউ। এসব কথা যতবার ভাবছিলাম, ততবার মনে হচ্ছিল যে, এমন একটা অদ্ভুত কিছু পৃথিবীতে রয়েছে— সেটা না দেখে যদি মরে যাই, তাহলে আক্ষেপ ছাড়া জীবনে আর কিছু থাকবে না। আমার ছেলে তখন অনেক ছোটো। গিন্নিকে বলে এসেছিলাম ভ্রমণে বের হচ্ছি, কারণ এসব জায়গায় যাচ্ছি জানতে পারলে তিনি কোনোদিনই আমায় আসতে দিতেন না। তিনজনে মিলে যেতে যেতে কত গল্প-আড্ডা, সেই সঙ্গে একটা অদ্ভুত উৎকণ্ঠা গ্ৰাস করে নিয়েছিল আমাদের। তা ছাড়া তখনকার দিনে তো আর এসব স্মার্ট ফোন ছিল না, তবে রিলের ক্যামেরা পাওয়া যেত। আমার কাছে একখানা সেরকম ক্যামেরা ছিল বটে, কিন্তু কোনোভাবে সেটার শাটার খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যাইহোক, নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছলাম সেই আত্মীয়ের বাড়ি। পৌঁছতে পৌঁছতে অনেক অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে, পরের দিন ভালো বার আছে। তাই যাওয়াটা পরের দিনের জন্য মুলতুবি রইল। রাতে তিন বন্ধু মিলে একটা ঘরে সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম, এমন সময় আমার আত্মীয় সেই ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। আমাদের সঙ্গে মেঝেতেই বসে পড়ে উনি বললেন অদ্ভুত এক গল্প।
“দেখো, জানি না আমার কথা তোমরা কতটা বিশ্বাস করবে কিংবা করবে কি না! কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, জীবনটা একটা বিশাল সমুদ্রের মতো আর এই সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে থাকে এমন অনেক অজানা বিষয় বস্তু, যা হয়তো তর্কের বাইরে। তোমরা যাকে দেখার জন্য এতদূর এসেছ, তাঁর দেখা কিন্তু সকলে পায় না। তবে তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়াটা এর চেয়েও বেশি ভয়ানক। একটা কথা মনে রেখো, আমি কিন্তু চাই না তোমাদের কারোর কোনো ক্ষতি হোক। তাই কিছু কথা তোমাদের আগেভাগেই জানিয়ে রাখতে চাই। ইনি হচ্ছেন এখানকার আদিবাসীদের অতি জাগ্রত এক ঈশ্বর। তবে এই ঈশ্বর নরখাদক। এঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রতি ছয় মাস অন্তর দুটো মানুষের বলি দেওয়া হয় আর সেটাও খুব গোপনে। এখানকার সরকার এ বিষয়ে জানলেও তিনি কিছু করতে পারেন না, কারণ ওই যে বলে… বিশ্বাস মানুষকে হিংস্র করে তোলে আর বিশ্বাসে আঘাত করলে এখানকার মানুষ কাউকে ছেড়ে দেবে না। তবে যাদের বলি দেওয়া হয়, তাদের খুব গোপনে দূরের কোনো গ্রাম থেকে তুলে আনা হয়। অনেক অদ্ভুত রীতি চালু আছে এখানকার আদিবাসীদের মধ্যে। পনেরো বছর বয়স হওয়া মাত্রই এখানকার মেয়েদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে উল্কি মতো কিছু এঁকে দেওয়া হয়। তবে ভীষণ কষ্টকর এই রীতি। কারণ এই উল্কি তাদের শরীরে সারাজীবনের জন্য যাতে থেকে যায়, সেজন্য চামড়া কেটে তার মধ্যে আগুনে গরম করা লোহার শিক দিয়ে নানা রকম কারুকার্য করে থাকে ওরা। এসবে নাকি ওদের দেবতা সন্তুষ্ট থাকে। শুধু তাই নয়, অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সন্তান জন্মদানের ঠিক এক ঘণ্টা আগে তাকে স্নান করিয়ে নগ্ন শরীরে এক যজ্ঞে বসানো হয়। যজ্ঞের আগুনের তাপে সেই মহিলার সারা শরীর ঘেমে ওঠে আর তার সামনে বসে মন্ত্র পড়তে থাকে দশাসই চেহারার এক পুরোহিত। এভাবেই ওরা বংশপরম্পরায় নিজেদের সন্তানদের ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করে থাকে, যাতে ঈশ্বরের আশীর্বাদ সবসময় ওদের সঙ্গে থাকে। পুরুষদের রীতিনীতি তো আরও একধাপ ওপরে। কুড়ি বছর হওয়া মাত্রই প্রত্যেক পুরুষকে বছরের একটা বিশেষ দিনে রক্তদান করতে হয়। মাটির একটা বড়ো ভাঁড় ভর্তি করে সেই রক্তে স্নান করানো হয় ওদের দেবতাকে। আরও অনেক নিয়ম কানুন মেনে ওরা ওদের দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখে।”
“কিন্তু এসব তো অন্ধবিশ্বাস”, আমি ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করি।
— অন্ধবিশ্বাস আছে বলেই আজও পৃথিবীর বুকে এমন দেবতারা বেঁচে থাকেন। কিন্তু এসব বোঝাতে যাবে কে? ওদের ধর্মের বিরুদ্ধে যেই গিয়েছে, তার লাশটাও কেউ খুঁজে পায়নি। এখানে কয়েকশো বছর ধরে চলমান এসব আচার-অনুষ্ঠানে বেঁচে থাকেন ওদের দেবতা। তবে ওদের দেবতাকে ওরা মানব সমাজের সামনে কখনওই প্রতিষ্ঠা করতে চায়নি। তাই ওদের দেবতা থাকেন মানুষের বসবাসের জায়গা থেকে অনেক দূরে। শোনা যায়, বেশ কয়েকবার নাকি দুঃসাহসী কয়েকজন মানুষ সেই দেবতার অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে ওঁর বাসস্থানে সত্যতা খুঁজতে গিয়েছিল। তবে সেইসব মানুষদের তারপর থেকে আর কোনোদিনই দেখা যায়নি। গল্প আছে যে, দেবতা নাকি নিজের শিকার নিজেই করে নেন। তবে কিছু খবর তো বাতাসেও ভাসে! কেউ কেউ মনে করে, এসব হয়তো সেই আদিবাসীদের কাজ। ওদের দেবতাকে নিয়ে যদি কেউ মশকরা করে, তাকে ওরা জীবিত ছাড়ে না।
“আপনি বিশ্বাস করেন নাকি এই দেবতার অস্তিত্বে?” প্রশ্নটা করেই ফেললাম।
— বিশ্বাস না করলেও পালাবার উপায় আছে কি? তাই অহেতুক যুক্তিতর্কের ঝামেলায় না গিয়ে এসব মেনে নেওয়াই ভালো। কারণ আমি তাকে দেখিনি বলে যে তিনি নেই, এটা ভাবা কিন্তু ভীষণ ভুল।
— তারপর বলুন।
— এই দেবতা যেখানে থাকেন, সেখানে একবার যদি কেউ প্রবেশ করে, তাকে একটা মূল্য দিতে হয়। আগেই বলেছি এই দেবতা নরখাদক। এই দেবতার কাছে কেউ যদি কোনো মানসিক করে, সেটা কোনো না কোনোভাবে ফলে যায়। কিন্তু এর পরিবর্তে ওঁকে কিছু দিতে হয়। আর এই দেবতার আরাধনা করার একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে।
“কী পদ্ধতি?” ফিসফিসিয়ে বলে উঠি আমি।
— আদিবাসীদের এই দেবতা হলেন ভাংড়ু। ভাংড়ুর আরাধনা করতে একটা বিশেষ তিথি লাগে। চাঁদ যখন হারিয়ে যায় অন্ধকারের বুকে, যখন সভ্য সমাজ তলিয়ে যায় ঘুমের অন্ধকারে, সেই মুহূর্তে জেগে ওঠেন ভাংড়ু। ভাংড়ুর মন্দিরে ঢোকার আগে সঙ্গে নিতে হয় বাজরার আটা, মধু আর…
— আর?
— একটা কালো বিড়াল।
“কিহ্?” কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠি আমি।
— হুমমম, ভাংড়ুর আরাধনা করতে হলে এগুলোই লাগে। অনেক নিয়ম মেনে ভাংড়ুর পুজো শুরু করতে হয়, আর তার জন্য একটা বিশেষ মন্ত্র আছে।
— কী সেই মন্ত্র?
— এই মুহূর্তে সেই মন্ত্র আমি উচ্চারণ করতে পারব না। বিশেষ তিথিতে সেই মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। তোমাদের যদি কোনোরকম কোনো বাসনা থাকে, সেটা তোমরা তার কাছে জানাতেই পারো। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, তোমাদের আর্জি হয়তো পূরণ হবে, কিন্তু তার বদলে একজনকে হারিয়ে ফেলবে তোমরা। এতকিছু জানার পরেও কি তোমরা সত্যিই যেতে চাও সেখানে?
“অবশ্যই”, আমার এক সঙ্গী বলে ওঠে, “এর জন্যই তো এতদূর থেকে ছুটে আসা। তা ছাড়া এসব আদিবাসীদের কুসংস্কার কিনা, সেটাও তো আমাদের দেখা দরকার। তাই না!”
— আমি কিন্তু তোমাদের আরও একবার ভেবে দেখতে বলব। হঠকারিতায় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ো না। ভাংড়ুকে আজ পর্যন্ত যারা কেবল একটা কল্পনা ভেবে এসেছে, তারা কেউই বেঁচে নেই আর। তোমাদের বয়স কম, সংসার রয়েছে— ফিরে যাও কিন্তু।
“ফিরে যাব বলে তো আসিনি”, আমি বলে উঠলাম, “তা ছাড়া দেখাই যাক না, এতগুলো বছর তো অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখে কাটালাম। এটাও যদি সেগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, ক্ষতি কী?”
“বেশ, তোমরা স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করতে চাইলে আমি বাধা দেওয়ার কে!” মৃদু হাসেন ভদ্রলোক, “কাল বিকেল পাঁচটার পরে তৈরি থেকো সকলে।”
— পুজোর সামগ্রীগুলো কোথায় পাব?
— আমি জোগাড় করে দেব, দামটা আমাকেই দিয়ে দিয়ো তোমরা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন