শিবব্রত বর্মন
রাতে বাসায় ফিরে ফিরোজ বেগ পোশাক না পাল্টে সোজা তার শোবার ঘরে চলে যায়। একটা ছোট দাবার বোর্ড নামিয়ে আনে শেলফ থেকে। ম্যাগটেনিক বোর্ড। ছোট ছোট ঘুঁটি।
পুরো গেম মুখস্থ ফিরোজের। সে ঘুঁটি সাজিয়ে আবার সেটা খেলতে থাকে। মাঝামাঝি গিয়ে একটা চালে সে থেমে থাকে। পাথরের মূর্তির মতো। ক্রমে রাত বাড়ে।
‘স্যার এখন খাবেন, না ফ্রিজে তুলে রাখব?’
নীলরঙা শাড়ি পরা একটা ২২-২৩ বছর বয়সী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। ফিরোজের খানিকটা সময় লাগে মেয়েটার পরিচয় শনাক্ত করতে। নার্স সুমি। মায়ের দেখাশোনার জন্য রাখা হয়েছে। বাড়ির ফুটফরমাশও খাটে কিছু কিছু।
সুমি আবার বলে, ‘স্যার যাব তো, সেই জন্য।
ফিরোজ ঘোরলাগা চোখে সুমির দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো কথা আসলে তার কানে ঢুকছে না।
সুমি আরেকটু এগিয়ে আসে। ‘আমি এখন যাব। অনেক দূরে থাকি। নদীর ওই পার। কেরানীগঞ্জ।’
তাঁর নিজের ঘর থেকে সালমা উঁচু স্বরে ডেকে ওঠেন, ‘সুমি! তোর ওই ঘরে কী?’
সালমা কান পেতে থাকেন। তাঁর সারাক্ষণের উদ্বেগ এই অল্পবয়সী নার্স তাঁর ছেলের রুমে ঢুকে পড়ছে কি না। ছেলেটা ভীষণ জেদি আর মাথা গরম। বাস্তব বুদ্ধি কম। ফিরোজকে তিনি বিভিন্ন সময় ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কানে তুলছে না দেখে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘মেয়েটার চলনে-বলনে ছোঁক ছোঁক ভাব আছে। সাবধান।’
এখন বুড়ির গলা শুনে সুমি বিরক্ত মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে সালমার ঘরে ঢোকে। সালমা তখনো গজগজ করছেন, ‘টেবিলে খাবার বেড়ে চলে যাবি। এত জিজ্ঞাসার কী আছে?’
সুমি যন্ত্রচালিতের মতো ড্রয়ারের ওপর থেকে দুটো ট্যাবলেট খুলে গ্লাস হাতে এগিয়ে দেয় সালমার দিকে। সালমা ওষুধ নিয়ে খান। ঢোক গেলার জন্য একটু থেমেছিলেন। তারপর আবার শুরু করেন, ‘বারবার বলি কম বয়সী নার্স না পাঠাতে। মনসুর কি শুনবে আমার কথা!’
সুমি জানে একটা বয়সের পর মানুষের কথা ধরতে নেই। তার নিজের বাড়িতেও এ রকম একটা আছে। তবু মেজাজ ঠিক রাখা তার পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। সে ঠক করে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে যায়। বাড়িটা নিস্তব্ধ। সালমা কান পেতে শোনার চেষ্টা করেন, কিন্তু সুমির চলে যাওয়ার কোনো আওয়াজ তাঁর কানে আসে না। চোখ ও কান তীক্ষ্ণ করে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। বোঝার চেষ্টা করেন সুমি আবার ফিরোজের রুমে ঢুকেছে কি না।
কোনো আওয়াজ নেই। কোথাও একটা ক্যাঁচ করে দরজা লাগানোর শব্দ হয়। রান্নাঘরে কারও উপস্থিতির আওয়াজ আসে একটা-দুটো। ইঁদুর নয়। আরও ভারী কিছু। সালমা ডাকেন, ‘সুমি! আছিস?’
কোনো আওয়াজ নেই। সালমা এবার আরও গলা চড়ান, ‘সুমি!’
ফিরোজ এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে। তার হাতে দাবার বোর্ড। তাতে একটা আধখেলা গেমের ঘুঁটি সাজানো। সে বলে, ‘সুমি চলে গেছে, মা।’
ফিরোজ সাজানো বোর্ডটা নিয়ে বিছানার সামনে আসে। আধশোয়া মায়ের পাশে বিছানায় রাখে সে বোর্ডটা। সালমা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন সেটার দিকে। তারপর যখন কথা বলেন, তাঁর গলার কোমল স্বরে একটু আগের কর্কশতার লেশমাত্র নেই। সালমা বলেন, ‘সো, ইউ লস্ট টু অ্যান আননোন অ্যামেচার?’
সালমা শুনেছেন সন্ধ্যার ঘটনাটা। ইউনিভার্সিটির দুজন সিনিয়র শিক্ষক ফোন করে তাঁকে দিয়েছেন খবরটা।
ফিরোজ বসে বিছানায়। একটা বাধ্য অভিমানী ছেলের মতো তার চলাফেরা। সে বলে, ‘মিডগেমে লোকটা জিনিয়াস, মা।’
হেড স্ট্যান্ডে পিঠ ঠেস দিয়ে ছিলেন সালমা। এবার তিনি সোজা হয়ে বসেন। ছেলের মাথায় বিলি কাটেন। বলেন, ‘আবার সাজা তো দেখি। শুরু থেকে।’
ফিরোজ আবার গেমটা সাজায়। দুঃস্বপ্নের সেই গেমটার চালগুলো দিতে থাকে।
সালমা বলেন, ‘লোকটা তো ওপেনিং কম্বিনেশনে তেমন এক্সপার্ট না।’ ফিরোজ তাকায় মায়ের দিকে। বলে, ‘আরেকটু আগাই, বুঝবা।’
ফিরোজ খুব বিদঘুটে একটা চাল দেয় আফসান চৌধুরীর। দিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। সালমার চোখে বিস্ময়।
ফিরোজ বলে, কিছু বুঝলা, মা?’
সালমা বলেন, ‘হুম।
‘কী বুঝলা?’
সালমা বলেন, ‘তুই হেরেছিস লোকটার আনঅর্থডক্স চালের কারণে। বলেই হেসে ওঠেন তিনি
ফিরোজও হাসে। মায়ের কোলে মাথা রাখে সে। সালমা তাঁর চুলে বিলি কেটে দেন।
ফিরোজ কেমন শিশুর মতো হাসতে থাকে। বলে, ‘ইয়েস। ভ্যাবাচেকা খেয়েছি। নেক্সট টাইম এটা হবে না।’
একটু পর উঠে বসে ফিরোজ দাবার ঘুঁটিগুলা এলোমেলো করে দেয়। তারপর অকস্মাৎ উঠে চলে যায়।
.
কার্ল ভন ক্লজেভিটসের অন ওয়ার বইটা তুলে ধরে আফসান চৌধুরী বলেন, ‘এটা হলো ওয়ার স্ট্র্যাটেজির বাইবেল, বুঝলি? বাইবেল।’
শান্তিনগরে ফুটপাতের একটা দোকান থেকে কেনা সেকেন্ডহ্যান্ড বইটার প্রচ্ছদ মলিন হয়ে গেছে। পৃষ্ঠা অবিন্যস্ত। একটু আগে সেটা অনেক খোঁজাখুঁজি করে বুকশেলফের পেছনের সারি থেকে উদ্ধার করেছেন আফসান চৌধুরী।
‘দুনিয়ায় যে এত বড় বড় যুদ্ধ হয়েছে,’ আফসান চৌধুরী বলেন, ‘সব যুদ্ধের মূল এসেন্সটা কি জানিস মিরা, এসেন্সটা হলো আনসারটেইনটি। যুদ্ধের ময়দানে নেমেছিস কি, তুই জানিস না প্রতিপক্ষ কোন দিকে এগোবে, কোন পথে আক্রমণ করবে, তারা কোন বুদ্ধি পাকাচ্ছে। যুদ্ধের পরিণতি কেউ জানে না। যদি জানত, তাহলে সেটা কোনো যুদ্ধ থাকত না।’
হাবিবুল্লাহ তাঁর স্ত্রী শাহীনকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। সঙ্গে নিয়াজকেও আনা হয়েছে। সে এ মুহূর্তে ড্রয়িংরুমের কার্পেটে শুয়ে লেগো দিয়ে একটা দুর্গ বানাচ্ছে। কাছেই লং প্লেতে বাজছে :
লেট মি টেক ইউ ডাউন
’কস আয়ম গোইং টু স্ট্রবেরি ফিল্ডস
নাথিং ইজ রিয়েল
অ্যান্ড নাথিং টু গেট হাং অ্যাবাউট
স্ট্রবেরি ফিল্ডস ফরএভার।
‘লোকটা জিনিয়াস,’ আফসান চৌধুরী আবার বলেন। ক্লজেভিটস নিয়ে তাঁর বক্তৃতা থামছে না। তিনি বলেন, ‘নেপোলিয়নিক যুদ্ধের কথা লিখেছে। কিন্তু সব যুদ্ধ একই। মানে দুনিয়াজুড়ে একটাই যুদ্ধ নানান ফর্মে লড়া হয়েছে, হচ্ছে।’
মিরা ও হাবিবুল্লাহ এ মুহূর্তে ক্লজেভিটস নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী নয়। দেশে দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি রেখে কে এখন আড়াই বছর আগের যুদ্ধ নিয়ে কথা বলবে?
আর তখন আফসান চৌধুরী বলেন, ‘তোমাদের ওই অক্সফোর্ড-ফেরত ব্যারিস্টারটা, কী যেন নাম…’
মিরা বলে, ‘কোনটা? জুলফি ভুট্টো?’
ইয়েস। মুজিব ইলেকশনে জিতলে সে কি মানবে? ছয় দফা মানবে? দ্যাটস দ্য রিলম অব আনসারটেইনটি। ক্লজেভিটস।
হাবিবুল্লাহ হেসে ফেলেন, ‘আপনি রাজনীতির খোঁজখবরও রাখেন তাহলে?’
মিরা বলে, ‘তার মানে তুমি বলতে চাও, এটা অলরেডি একটা ওয়ার?’ আফসান চৌধুরী সোফায় বসে বইটার কয়েকটা পাতা ওলটান। কথাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেন। ‘যুদ্ধ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রের জিনিস না। ইলেকশন ক্যাম্পেইনের দিকে তাকা। দেখবি, কীভাবে স্ট্র্যাটেজিক অ্যাডভান্টেজ তৈরির খেলা চলছে। পলিটিশিয়ানরা ভালো করবে, যদি তারা এই লোকটাকে পড়ে। দিস প্রুশান জেনারেল, কার্ল ভন ক্লজেভিটস।’
মিরা বিটলস থামিয়ে অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায় চালিয়ে দিয়ে আসে।
হাবিবুল্লাহ ডিনারের অগ্রগতি জানতে চান।
সারা বাড়িতে একটা খোশবু ছড়িয়ে রান্নাঘরে জাহানারা বিরিয়ানি বানাচ্ছেন অতিথিদের জন্য। হাবিবুল্লাহর স্ত্রী শাহীন পাশে দাঁড়িয়ে সালাদ বানাচ্ছেন। কাজের মেয়ে শেফালি এগিয়ে দিচ্ছে এটা-সেটা। দুজনের আলোচনার বিষয় করাচি থেকে রিতা আসলামের প্রত্যাবর্তন। ব্যারিস্টার জামালের বোন হিসেবে রিতার মধ্যে একটা উন্নাসিক ভাব আছে বলে শাহীন মনে করেন। ফিল্মে অভিনয়ের চেষ্টায় করাচি গিয়ে সুবিধা করতে না পেরে ফিরে এসে রিতা এখন রেডিওতে সন্ধ্যার খবর পড়ে।
জাহানারা বলেন, ‘ইশ্, শাহীন, তুমি না হিংসুটে একটা। তোমার ক্লাসমেটকে তুমি দেখতে পারো না।’
খেতে বসে হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘কাল ক্লাবে একটা দুর্দান্ত ঘটনা ঘটেছে ভাবি, জানেন?’
‘কী সেটা?’
‘ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন ফিরোজ বেগ হেরে গেছে আফসান ভাইয়ের কাছে।’
আফসান চৌধুরী বলেন, ‘ক্লাবের একটা খেলা নিয়ে এত মাতামাতি করার কী আছে? বাদ দাও।’
হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘এটা কি হুট করে হেরে গেছে বলছেন?’
‘হুট করে হেরেছে। ও আমাকে আন্ডারএস্টিমেট করেছিল। বুঝতে পারে নাই। আর প্রফেশনাল দাবাড়ুরা একটা-দুটো গেম হেরে যেতেই পারে। নরমাল ব্যাপার।’
হাবিবুল্লাহ খাওয়া থামায়। ‘আফসান ভাই—স্যার, গত সতেরো বছরে আমি দাবায় আপনাকে হারতে দেখি নাই কারও কাছে।’
‘হয়েছে। তাতে কী?’
‘ও আবার খেলুক। আবার হারবে।’
মিরা হেসে বলে ওঠে, ‘বাবা, হাবিব আঙ্কেল ঠিক কথা বলেছেন। তুমি দাবার কার্ল ভন…’
নিয়াজ বলে ওঠে, ‘স্প্যাসকি।’
আফসান গম্ভীর হয়ে যান। বলেন, ‘আমি আর খেলব না ওর সঙ্গে।’
‘কেন? কী সমস্যা?’
‘হি টেকস দাবা টু সিরিয়াসলি। আমি আনন্দের জন্য খেলি। কম্পিটিশন করা আমার কাজ নয়। আমার সাজে না।’
হাবিবুল্লাহ জোর দিয়ে বলেন, ‘আলবত খেলবেন, স্যার। শুধু ফিরোজ বেগের সঙ্গে না, আপনি খেলবেন গোটা পাকিস্তানের দাবাড়ুদের সঙ্গে। আপনি নেক্সট ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন।’
নিয়াজ হাততালি দিয়ে ওঠে। সেটা দেখে মিরাও হাততালি দেয়।
আফসান বলেন, ‘না। সেটা হচ্ছে না।’
‘সমস্যা কোথায়?’
আফসান বলেন, ‘মাথা ঠান্ডা করে বিরিয়ানি খাও হাবিব। মিরেরসরাই ঘরানার বিরিয়ানি। দোতলার স্ট্যাটিসটিকসের সোহরাব সাহেবের স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া রেসিপি। উনি মিরেরসরাইয়ের লোক।’
হাবিবুল্লাহ নাছোড়বান্দা। চ্যাম্পিয়নশিপে পার্টিসিপেট করতে কী সমস্যা আপনার?’
তখন জাহানারা বলেন, ‘আমি বলি। আমাদের অধ্যাপক দাবাকে কখনো প্রতিযোগিতা হিসেবে দেখেন না।’
‘দাবা প্রতিযোগিতা না তো কী?’
মিরা বলে, ‘অ্যাকর্ডিং টু আফসান চৌধুরী, দাবা কোনো স্পোর্ট না। দাবা একটা আর্ট।’
‘কিসের আর্ট, শুনি?’
মিরা কিছুক্ষণ ভাবে। ‘উমম…আর্ট অব সাইলেন্স, মে বি। অথবা কনফিউশন, না না-আনসার্টেইনটি।’
আফসান চৌধুরী বলেন, ‘আর্ট অব কনভারসেশন।’
‘কাদের মধ্যে?’
‘দুটি ইতিহাসের মধ্যে।’
.
গভীর রাতে সালমা এহতেশামের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি জোরে জোরে ডাকেন, ‘ফিরোজ! ফিরোজ!’
ফিরোজ এসে দরজায় দাঁড়ায়। তার নির্ঘুম চোখ টকটকে লাল।
সালমা বলেন, ‘ডোন্ট টেক হিম ঠু সিরিয়াসলি, মাই বয়। দেয়ার উইল বি নো নেক্সট টাইম। তুই লোকটার সঙ্গে আর খেলবি না।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন