শিবব্রত বর্মন
নির্বাচনের পাঁচ দিন আগে একটা দাবা খেলাকে ঘিরে ইউনিভার্সিটি ক্লাবের হলরুমে এত লোক উপস্থিত হবে কেউ আশা করেনি।
বিকেল চারটায় টেবিলে বোর্ড সাজানো হলে দেখা যায় চাদর মুড়ি দিয়ে বোর্ডের সামনে শুধু আফসান চৌধুরী বসে আছেন। তার উল্টো দিকের চেয়ার ফাঁকা। ফিরোজ এখনো আসেনি।
আফসান চৌধুরীর জন্য সবই নতুন। সবচেয়ে বড় নতুন জিনিস হলো দাবার বোর্ডের ডান পাশে একটা হলুদরঙা চেস ক্লক। একটা বক্সের মধ্যেই পাশাপাশি দুটি ডায়াল ঘড়ি। দুটি ঘড়ির ওপরে দুটি কালো বাটন। ঘড়িটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। সোভিয়েত ইউনিয়নে বানানো ঘড়ি। কোম্পানির নাম জ্যান্টার।
দাবা ফেডারেশন থেকে একজন আম্পায়ার এসেছেন। তিনি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।
বোর্ডের দিকে না তাকিয়েও খেলাটা যাতে সবাই দেখতে পায়, সে জন্য বড় একটা ডিসপ্লে বোর্ডে দাবার রেপ্লিকা বসানো। তাতে কার্ডবোর্ডের বড় বড় ঘুঁটি। এই রেপ্লিকার সামনে একটা লোক দাঁড়ানো। মূল দাবা বোর্ডে কোনো চাল দেওয়া হলে লোকটা রেপ্লিকার ঘুঁটিও সেভাবে সরাবে। তাতে সবাই চেয়ারে বসেই গেমটা দেখতে পাবে।
সবার শেষে আফসান তাকান টেবিলের ওপর রাখা দাবার বোর্ডটার দিকে। এ মুহূর্তে ঘুঁটিগুলো সাজানো। একেবারে নিখুঁতভাবে সারি করা। একটা ঘুঁটিও এক সেন্টিমিটার ডানে বা বাঁয়ে সরে নেই। তাঁর ধারণা ছিল এ রকম আনুষ্ঠানিক কম্পিটিশনে দাবার বোর্ড বাহারি হয়। কিন্তু এ চামড়ার বোর্ড এবং মেহগনি কাঠের ঘুঁটিগুলোর তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। প্ৰায় এ রকম বোর্ডেই তাঁরা সচরাচর খেলে থাকেন। আফসান বুঝলেন, একটা স্ট্যান্ডার্ড দাবার বোর্ড এ রকমই হয়। যত বিখ্যাত টুর্নামেন্টই হোক না কেন, হেরফের হবে না। আফসান পরে খোঁজখবর করে জেনেছেন, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় একটা প্রমাণ দাবার বোর্ডের দৈর্ঘ্য হয় ২১ ইঞ্চি। প্রতিটি বর্গের দৈর্ঘ্য সোয়া দুই ইঞ্চি এবং রাজার উচ্চতা পৌনে চার থেকে চার ইঞ্চি।
অতিথিরা চেয়ার পেতে বসেছেন। জনা পঞ্চাশেক হবে সব মিলিয়ে। বেশির ভাগই দাবা-অন্তপ্রাণ। কেউ খেলোয়াড়, কেউ সংগঠক, কেউ ভক্ত। আফসান দেখলেন দর্শকদের মধ্যে হাবিবুল্লাহ এবং নিয়াজ এসেছে। মিরা এসেছে তার বন্ধুদের নিয়ে। গিটার বাজানো ছেলেটাকে দেখা গেল না।
একেবারে সামনের সারিতে বসা দুজন অতিথিকে দেখে আফসান বিব্রত হলেন। দুজনই দাবার কিংবদন্তি। একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও পরিসংখ্যানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কাজী মোতাহার হোসেন। তাঁর পাশে ততোধিক শীর্ণকায় আরেক প্রৌঢ় শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বুদ্ধিদীপ্ত চালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাম্পাসে। আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে খেলেছেন আফসান। বেশির ভাগ গেমে তাঁকে হারিয়েছেন। লোকটা দুই ঘোড়া নিয়ে যেভাবে আক্রমণ করে, তাক লেগে যেতে হয়।
এই দুই অতিথি নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিলেন আর চাপা হাসি হাসছিলেন।
মোতাহার হোসেন বললেন, ‘ফিশারের দিকে চোখ রাখবেন, রাজ্জাক। ‘ববি ফিশার?’
আরেকটা নীল আর্মস্ট্রং কেস হতে যাচ্ছে।’
‘হ। নিউইয়র্কার-এ দেখলাম, স্যার। কাভার স্টোরি করছে।’
‘এইবারের ইন্টারজোনালে তো মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। টানা বিশ গেম। পুঁচকা একটা পোলা। কেউ হারাতে পারে না।’
‘আমি দুইটা গেম দেখছি। এ এক আজিব চিজ। স্প্যাসকির খবর আছে।’
দুজনে খিকখিক করে হেসে নেন, যেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্প্যাসকির দুর্দশা কল্পনা করে তাঁরা আমোদ পাচ্ছেন।
কাজী মোতাহার বলেন, ‘দাবা ইজ কোল্ড ওয়ার, ইউ লাইক ইট অর নট।’
‘লাইক না করার কী আছে। তয়, একটা আমেরিকান চেস চ্যাম্পিয়ন দরকার আছে। দাবার স্বার্থেই দরকার।’
‘কেন?’
‘রাশানরা খেলাটারে যান্ত্রিক কইরা ফেলছে। আমাদের দরকার আলাদা আলাদা থিংকিং প্যাটার্ন। আলাদা এথনিক কালচারাল অ্যাপ্রোচ। তাইলে না দাবা।’
হঠাৎ গুঞ্জন থেমে যায়। ফিরোজ এসে দাঁড়ায় টেবিলের সামনে। অতিথিরা করতালি দিয়ে ওঠে। আফসান বোঝেন, মিনিট পাঁচেকের এ সামান্য বিলম্ব ইচ্ছাকৃত, যাতে মনোযোগের আলো পড়ে তাঁর দিকে।
আজ অত্যন্ত পরিপাটি পোশাক পরে এসেছে ফিরোজ। একটা ধূসর স্যুট আর নেভি ব্লু জ্যাকেট। টাই না পরে আজও একটা নেকারচিফ পরেছে সে। সেটা খুবই যত্ন করে প্যাঁচানো। একটা অচেনা কিন্তু খুব আরামদায়ক মৃদু পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে তার গা থেকে। আফসান আজ ফিরোজকে দেখে মুগ্ধই হয়ে গেলেন।
ফিরোজ নিজের চেয়ার বরাবর দাঁড়িয়ে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। আফসান উঠে দাঁড়িয়ে হাত মেলাতে গিয়ে লক্ষ করেন ফিরোজ তাঁর চোখে চোখ রাখছে না। এক কি দুই ডিগ্রি নিচে তাকাচ্ছে সে। ফিরোজের চোখ লাল। রাতে ঘুমায়নি।
টস হয় সেই পুরোনো নিয়মে। প্রথম গেম ফিরোজ কালো নিয়ে খেলে। তাকে আজ খুব আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। আফসানের রাজার সামনের বড়ের দুই ঘর চালের বিপরীতে সে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক চালটাই চালে-সিসিলিয়ান ডিফেন্স। মন্ত্রীর দিককার হাতির সামনের বড়ে দুই ঘর। এরপর আফসান রাজার দিককার ঘোড়া বের করলে ফিরোজ তার মন্ত্রীর দিককার ঘোড়া এনে রাখে সি-সিক্স ঘরে।
পরবর্তী দুই-তিন চালে আফসান টের পান ফিরোজ অস্বাভাবিক খেলা খেলছে। সে দ্রুত বোর্ড ফাঁকা করে মিডগেমের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে। সুযোগ পেলেই সে ঘুঁটি স্যাক্রিফাইস করছে।
অতিথিদের মধ্যে কাজী মোতাহারের ভুরু কুঁচকে যায়। আব্দুর রাজ্জাক তাঁর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, ‘কী করবার চায় পোলাডা?’
আফসান সাবধান হয়ে যান। তিনি আড়চোখে তাকান ফিরোজের দিকে। খুবই আবছা একটা হাসির রেখা খেলে যায় তাঁর চোখে।
খেলাটা এন্ডগেমে গড়ায় না। মিডগেমের শেষের দিকে দুজনই ড্র ঘোষণা করে।
দ্বিতীয় গেমে আফসান চৌধুরী স্যাক্রিফাইস এড়িয়ে চলেন। ফলে খেলাটা খুবই জটিল হয়ে উঠতে থাকে। বোর্ডের দিকে তাকালে একটা গোলকধাঁধাময় জঙ্গল মনে হয়।
দুঘণ্টা চলার পর দ্বিতীয় গেমও ড্র।
তৃতীয় গেমের জন্য বোর্ডে শায়িত ঘুঁটিগুলো তুলে তাদের জায়গায় বসাতে বসাতে ফিরোজ প্রথমবারের মতো তাকায় দর্শকসারিতে। এতক্ষণ সে একবারের জন্যও বোর্ড থেকে চোখ সরায়নি। ফিরোজের একবার মনে হয় একেবারে পেছনের সারিতে ভিড়ের মধ্যে সে একটা পরিচিত মুখ দেখল যেন। লোকটা কর্নেল মঈনুদ্দিন কি? ফিরোজ একবার মাথা ঝাঁকিয়ে মগজ পরিষ্কার করার চেষ্টা করে।
তৃতীয় গেমে ফিরোজকে অস্থির দেখায়। সে প্রথম চালে রাজার দিককার ঘোড়া বের করে। স্পষ্টত বুদাপেস্ট গ্যামবিট। ঘোড়া আরও নিচে নেমে এলে আফসান মন্ত্রীর দিককার বড়ে এক ঘর বাড়িয়ে দিয়ে কালো হাতি নেমে আসা প্রতিরোধ করেন।
খেলা ২০তম চালে যাওয়ার আগেই ফিরোজ দুবার উঠে পায়চারি করে আসে। দুবার পানি খায়। আম্পায়ারের সঙ্গে একবার তার ধাক্কা লাগে।
ফিরোজের হিসাব ভুল ছিল। আফসান চৌধুরী এন্ডগেমে দুর্বল নন।
ফিরোজ হেরে যায়।
হাবিবুল্লাহ ওই রাতে জাহানারাকে উত্তেজিতভাবে বর্ণনা করেন কীভাবে আফসানের সাদা হাতি কালো রাজাকে চেক দেওয়ামাত্র ফিরোজ দাবা বোর্ড উল্টে দিয়ে গেম রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল এবং তার এ আচরণে কীভাবে হলভর্তি লোকের মুখ হাঁ হয়ে গেছে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন