শোধ – ১০

শিবব্রত বর্মন

কর্নেল নাদিমের অফিস দেখতে একটা স্কুলের হেডমাস্টারের কক্ষের মতো। এমপি হোস্টেলের প্রশাসনিক অফিসকে তাঁরা অস্থায়ী অফিস বানিয়ে নিয়েছেন। ফলে একটা লম্বা কাঠের টেবিল, দেয়ালজোড়া স্টিলের আলমারি আর টেবিলজুড়ে নানান নথিপত্র, ফাইল, যার অনেকগুলো পূর্বতন অফিসের।

কর্নেল নাদিম ও মেজর সামির পাশাপাশি বসা।

সামরিক উর্দি পরা হলেও কর্নেল নাদিমকে দেখায় একজন আমলার মতো। গড় সেনা অফিসারদের চেয়ে তিনি কিছুটা পৃথুলদেহী, মেদময়। চোয়ালের রেখা গলার সঙ্গে মিশে গেছে। মাথার চুলের রেখা ক্ষীণ। চিকন রিডিং চশমা চোখে নিচু হয়ে তিনি ফাইল পড়ছেন, কলম চালাচ্ছেন। গরমে তাঁর ফরসা গাল লাল হয়ে আছে।

মাথার ওপরে ঘুরতে থাকা একটা পুরোনো ফ্যানের শব্দ ছাড়া কক্ষে পিনপতন নীরবতা। এক কোনায় একটা টেবিল ফ্যান চলছে প্রায় নিঃশব্দে। সেটার বাতাসে হাতে ঠেসে ধরা ফাইলের কাগজ উল্টে আসতে চায়।

দুজন সেনাসদস্য এক পাশে ফাইলপত্র নিয়ে অপেক্ষমাণ

কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে ফাইলে মুখ গুঁজে থাকার পর কর্নেল নাদিম আড়চোখে টেবিলের উল্টো দিকে বসে থাকা আফসান চৌধুরীর দিকে তাকান। তারপর ফাইল থেকে মুখ তোলেন, যেন এতক্ষণে মনে পড়েছে তাঁর সামনে একজন লোক বসা। কলম নামিয়ে চশমা খুলে সামনে ফাইলের ওপর রাখেন তিনি।

কর্নেল নাদিম বলেন, ‘আমরা এখানে যেটা করি, প্রফেসর, সেটাকে বলে কো-অর্ডিনেশন। বাংলায় আপনারা যেটাকে বলেন… কী যেন বলেন…কঠিন একটা শব্দ—সমন্বয়। বাই দ্য ওয়ে, আমার বাংলা শুনে কনফিউজড হবেন না। আমি বাঙালি না। বাবা শিয়ালকোটের লোক ছিলেন। মামাবাড়ি নওয়াবশাহ, মানে সিন্ধ। বাবা এখানে আদমজী জুট মিলে ওভারসিয়ার ছিলেন। ফলে নারায়ণগঞ্জে আমরা বহুদিন থেকেছি। ওখানে স্কুলে পড়েছি। নারিন্দাতেও ছিলাম। সেন্ট গ্রেগরিস। একটু অ্যাকসেন্ট আছে, কিন্তু আমার বাংলা খারাপ না, কী বলেন?

আফসান চৌধুরী চুপ করে থাকেন।

‘আপনি কম কথা বলা টাইপ। আই লাইক ইট। তো হোয়াট আই ওয়াজ টেলিং, যে বাইরে নানা কথা শুনবেন। এটা নাকি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, টর্চার সেল। বোগাস! আমরা এখানে যা করি, উই অ্যাক্ট লাইক সর্ট অব আ ব্রিজ। বিটুইন হোয়াট?’

শেষ প্রশ্নটা তিনি পাশে বসা মেজর সামিরের উদ্দেশে করেন।

শুকনোদেহী মেজর সামিরের গায়ের রং দুধে-আলতা। মুখটা লম্বাটে। তাকে দেখলে টেনিস তারকা রড লেভারের কথা মনে পড়ে।

মেজর সামির মন্ত্রোচ্চারণের মতো জবাব দিল, ‘বিটুইন সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড আর্মি, স্যার।’

কর্নেল নাদিম মুচকি হাসেন, ‘উঁহু। রঙ অ্যাগেইন। বিটুইন সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড দ্য রিয়াল প্যাট্রিয়টিক গাইজ। এক দল জানে কী করতে হবে, কোনটা আচ্ছা, কোনটা বুরা…আরেক দল জানে কীভাবে করতে হবে। অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে আমরা হেল্প করি। আর সেটা করতে হলে যা সবচেয়ে বেশি দরকারি, সেই জিনিসটা আমরা সরবরাহ করি। সেটা কী? ইন্টেলিজেন্স। উই গ্যাদার ইন্টেলিজেন্স। হিউজ অ্যামাউন্ট অব। এই পুরো বিল্ডিংটাকে আপনি একটা ইনফরমেশন হাব বলতে পারেন। কাইন্ডা আলোকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি। ইনফরমেশনের কোনো বিকল্প নাই। ইনফরমেশন ইজ এভরিথিং। আমরা আপনাকে নিয়ে এসেছি, আমাদের হাতে কিছু ইনফরমেশন…’

মাঝপথে থেমে যান কর্নেল নাদিম। কথা বললেও এতক্ষণ তাঁর মনোযোগ ছিল মূলত কাগজপত্রের দিকে। সামনে তাকাচ্ছিলেন, কিন্তু কিছু দেখছিলেন না আসলে। এবার আফসান চৌধুরীকে ভালো করে লক্ষ করে তিনি বলে ওঠেন, ‘গুডনেস মি! আপনাকে এভাবে ট্রিট করা হয়েছে? হু ডিড দিস? আই ওয়ানা নো, হু ডিড দিস!’

মেজর সামির বিব্রত ভাব লুকানোর চেষ্টা করে, ‘স্যার, হি ওয়াজ নট কো-অপারেটিং।’

কর্নেল নাদিম গর্জে ওঠেন, ‘তাই বলে কি এতটা ব্রুটাল হতে হবে? জাস্ট সি হোয়াট ইউ ডিড। হি ইজ আ প্রফেসর, মেজর! ইউ নো হোয়াট আ প্রফেসর মিনস টু আ নেশন? তোমরা ফার্স্ট এইড দিয়েছ? দাওনি? একটা লোক ব্লিডিং, তোমরা তাকে ফার্স্ট এইড দাওনি? ওয়ান্ডার হোয়াট কাইন্ড অব স্যাভেজেজ আই অ্যাম ওয়ার্কিং উইথ!’

মেজর সামির উঠে দাঁড়ায়, ‘স্যার, এখন ব্যবস্থা করি?’

‘লিভ ইট। আমি কয়েকটা কথা সেরে নিই। হার্ডলি মিনিট দশেক। তারপর ইউ টেক হিম স্ট্রেট টু আওয়ার মেডিকেল সেন্টার। দেন টেক হিম ব্যাক টু হিজ হাউস। হিজ ফ্যামিলি মাইট বি ইগারলি ওয়েটিং। প্রফেসর আফসান, ইউ জাস্ট ফরগিভ দিজ রাউডি বয়েজ। বয়স কম, বাড়াবাড়ি করে ফেলে। তো যেটা বলছিলাম, আমাদের হাতে কিছু ইনফরমেশন এসেছে। আমরা সেগুলো ক্রস চেক করব। দেখব এগুলো ঠিক আছে কি না। আপনি যদি কিছু বাড়তি ইনফরমেশন ভলান্টিয়ার করেন, অ্যাপ্রেশিয়েট করব। দেন, ইউ আর ফ্রি। ওকে? জেন্টেলম্যানস ডিল?’

আফসান মাথা নাড়েন। তবে চুপ করে থাকেন।

‘ভেরি গুড।’

এবার একটা ফাইল খুঁজে বের করেন কর্নেল। চশমাটা আবার চোখে এঁটে কিছুক্ষণ পড়েন। তারপর চশমা খুলে রেখে তাকান আফসানের দিকে চেয়ার থেকে উঠে আসেন। তখন বোঝা যায়, তাঁর উচ্চতায় কিছু ঘাটতি আছে। টেবিলের এপারে এসে একটি নিতম্ব টেবিলে ঠেস দিয়ে আধবসা হয়ে দাঁড়ান তিনি। মেজর সামিরও উঠে দাঁড়ায়। তবে তার দাঁড়ানোর জায়গা কোথায় হলে নিয়মমাফিক হয়, সেটা সে নির্ধারণ করতে পারে না।

কর্নেল নাদিম বলেন, ‘আপনি সিনেমা পছন্দ করেন, প্রফেসর?’

আফসান কথাটার অর্থ ঠিকমতো ঠাহর করতে পারেন না। বলেন, ‘খুব একটা না।’

‘একেবারেই না? মাঝেমধ্যে? অকেশনালি?’

‘রেয়ারলি।’

‘লাস্ট কবে হলে গিয়ে ছবি দেখেছেন?’

আফসান চৌধুরী চুপ করে থাকেন।

‘মনে করার চেষ্টা করুন। শেষ কবে ছবি দেখেছেন, হলে গিয়ে?’

‘ইজ ইট ইমপর্ট্যান্ট?’

‘ইয়েস ইট ইজ। এক্সট্রিমলি।’

‘মনে পড়ছে না।’

‘আপনার কোনো প্রিয় অভিনেতা আছে? অভিনেত্রী? উত্তম-সুচিত্রার বাইরে বা গ্রেগরি পেক, লিজ টেলরের বাইরে…দেশি?’

‘নেই।’

‘ধরুন, ওয়াহিদ মুরাদ? বা রানী কি আপনার প্রিয় নায়িকা?’

‘তাদের ছবি দেখেছি। আলাদাভাবে প্রিয় নয় কেউ।’

কর্নেল ভালো করে দেখে নেন আফসান চৌধুরীকে। টেবিল থেকে নিতম্ব সরিয়ে এনে সোজা হন। একটা চেয়ার খোঁজেন। মেজর সামির নিজের চেয়ারটা এগিয়ে দেয়। নিজে অন্য একটা চেয়ার টেনে আগের জায়গায়, অর্থাৎ টেবিলের ওপারে বসে। সামিরের দেওয়া চেয়ারে আফসান চৌধুরীর এক পাশে বসেন কর্নেল। তারপর আবার শুরু করেন, ‘আনজুমান ছবিটা দেখেছেন আপনি?’

‘মনে হয় না।’

‘এগজ্যাক্টলি। আপনার রুচির লোকেদের আনজুমান দেখার কথা নয়। ড্র্যাব। সিনেমাটার কাহিনি কি আপনি জানেন?’

‘না।’

‘খুব স্বাভাবিক। না দেখে থাকলে জানবেন কীভাবে। আমি কি আপনাকে কাহিনিটা সংক্ষেপে একটু বলব?’

‘এটা কি রেলেভেন্ট?’

‘খুব। লেট মি পুট ইট দিস ওয়ে—এভরিথিং ইন দিস ইউনিভার্স ইজ কানেকটেড টু এভরিথিং এলস। আমাদের ইন্টেলিজেন্স বিজনেসের এইটাই মূলমন্ত্র। সিনেমার কাহিনিটা বলি।’

কর্নেল ইশারা করলে ফাইল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা সোলজাররা কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়। এখন কক্ষে তারা তিনজন।

কর্নেল বলেন, ‘মেজর সামির! নোটস!’

মেজর সামির একটা নোটবই বের করে খাতা-কলম নিয়ে বসে।

কর্নেল হাতের ইশারা করে বলেন, ‘রেকর্ড।’

মেজর সামির আবার উঠে পাশে রাখা একটা বাক্সের মতো ম্যাগটেনিক টেপের অডিও রেকর্ডার অন করার চেষ্টা করে। কয়েকবারের চেষ্টায় সেটা অন হয়ে ঘুরতে থাকে।

এতক্ষণ সবকিছুর মধ্যে একটা ক্যাজুয়াল ভাব ছিল। মুহূর্তে পরিবেশটা সিরিয়াস হয়ে ওঠে। আফসান বাতাসে কিছু একটার গন্ধ পান।

মেজর সামির বলে, ‘ওকে, স্যার।’

‘ভেরি গুড,’ কর্নেল এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে হাঁটুতে হাতের তালু রেখে একটা আয়েশি ভঙ্গি নেন। ‘দিস ইজ জাস্ট ফর কিপিং রেকর্ডস। আমার নিজের স্মৃতিশক্তি খুব ভালো। কিন্তু হোয়াট ইজ আ ডকুমেন্ট উইদাউট রেকর্ডস? ওকে। গুড। নাও, কী বলছিলাম? ও, আনজুমান ছবির কাহিনি। ছবির কাহিনি এক তাওয়াইফ বা কোর্টিজানকে নিয়ে, বাংলায় কী বলে ওদেরকে—বাইজি। হ্যাঁ, বাইজির নাম আনজুমান। রানী অভিনয় করেছে এই ভূমিকায়। রানী আমার সবচেয়ে প্রিয় নায়িকা। আপনাদের মতো বিদেশি জিনিসে রুচি আমার নাই। দেশি মাল, সরি…তো এই আনজুমান করে কী, প্রেমের জালে ফাঁসানোর চেষ্টা করে নবাব ওয়াহাহাত আলী নামের এক উচ্চবংশীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিকে। আনজুমানের মিথ্যা প্রেমের জালে ফেঁসে সংসার উচ্ছন্নে যাওয়ার জোগাড় ওয়াহাহাতের। তখন তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে তাঁর ছোট ভাই নবাব আসিফ আলী, মানে ওয়াহিদ মুরাদ। বাই দ্য ওয়ে, বড় ভাই ওয়াহাহাত আলীর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সন্তোষ কুমার। চেনেন তো তাঁকে? ষাটের দশকে বড় নায়ক ছিলেন। হিন্দু না। মুসলিম। লাহোরে জন্ম। আসল নাম সাঈদ মুসা আব্বাস রেজা। গেটিং বোরড, প্রফেসর?

‘না।’

‘আই নো ইউ আর। কিন্তু হয়েছে কী, আমি এত ইনফরমেশনের সাগরে ডুবে থাকি, অ্যান্ড আই লাইক ইনফরমেশন সো মাচ, যেকোনো কিছু বলতে গেলে একসময় খেই হারিয়ে ফেলি। হেল্প মি ইফ আই গেট ঠু মাচ ডাইগ্রেসড।’

‘ঠিক আছে।’

‘তো আনজুমান ছবির কাহিনি। ভাইকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে আসিফ মানে ওয়াহিদ মুরাদ। কীভাবে বাঁচাবে? সে ঠিক করল, সে পাল্টা প্রেমের জালে ফাঁসাবে আনজুমানকে। তাতে করে যদি আনজুমানকে সরিয়ে আনা যায়। আসিফের সেই কনফিডেন্স আছে। তার যে চেহারা, যে ব্যক্তিত্ব, একটা কোর্টিজানকে প্রেমে ফাঁসানো তার জন্য কোনো ব্যাপার নয়। ফলে আনজুমানের কোঠায় যাতায়াত শুরু করে আসিফ। আনজুমান প্রেমে পড়ে আসিফের। এইটা সত্যিকারের প্রেম। উথাল-পাতাল প্রেম। কিন্তু আসিফ তো আসলে প্রেমে পড়েনি আনজুমানের। সে প্রেম করে আরেক মেয়ের সঙ্গে। তার নাম নুদরাত। মানে আমাদের দিবা। ইনফরমেশন অ্যাগেইন। তাহলে এক অদ্ভুত ট্রায়ো। ত্রিভুজ প্রেম। শেষটা খুবই ট্র্যাজিক। খুব করুণ ছবি। আমার খুব প্রিয় ছবি। রুনা লায়লার অসাধারণ গান। আমি কয়েকবার দেখেছি ছবিটা। হলে গিয়ে। এখানে না। লাহোরে। বছর দুয়েক আগে মুক্তি পাওয়া ছবি। সারা পাকিস্তানে সুপারহিট। কিন্তু ছবিটা এখানে সুবিধা করতে পারেনি। কেন, জানেন? কারণ, যখন এটা মুক্তি পায়, সিক্সটি নাইনে, তখন ইস্ট পাকিস্তানে চরম নৈরাজ্য চলছে। আওয়ামী লীগ তাদের নেতার মুক্তির জন্য কেয়স তৈরি করতে শুরু করেছে। ছবিটা হলে ঠিকমতো চলতেই পারল না। কী স্যাড, দেখুন। ফলে এখন এই পিসফুল টাইমে, নাউ দ্যাট এভরিথিং হ্যাজ বিন পুট ব্যাক টু ইটস নরমাল কোর্স, ছবিটা এখন আবার মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তিন সপ্তাহ ধরে ছবিটা চলছে ঢাকার কয়েকটা হলে। ভালো দর্শক টানছে। নাউ প্রফেসর আফসান, আই হ্যাভ আ কুইজ ফর ইউ। ছবিটা ট্র্যাজিক। ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি। একজন কাউকে মারা যেতে হবে। কে মারা যায়?’

‘সরি?’

‘কে মারা যায় ছবিতে?’

‘আমি ছবিটা দেখিনি।’

‘তাহলে হলে গিয়েছিলেন কেন?’

শেষ কথাটা বলার সময় কর্নেল নাদিমের স্বর বদলে যায়। একটু যেন কড়া তাঁর গলা। তিনি পায়ের ওপর থেকে পা নামান।

আফসান বলেন, ‘কিসের হল?’

‘আপনি সিনেমা হলে গিয়েছিলেন কেন? আমার নথি বলছে, গত জুলাই মাসের ২৬ তারিখে আপনি লায়ন সিনেমা হলে ছবিটা দেখতে গিয়েছিলেন। ম্যাটিনি শো।’

‘আমার ঠিক মনে পড়ছে না। হতে পারে।’

‘মাত্র তো মাসখানেক আগের কথা। আপনার মেমোরি এত দুর্বল?’

আফসান অসহায় গলায় বলেন, ‘এটা কি খুব জরুরি?’

‘জরুরি। কারণ আপনার আচরণ আমাদের কাছে স্বাভাবিক লাগেনি।’

‘একটা সিনেমা, পপুলার, সেটা দেখতে যাওয়া কি অস্বাভাবিক আচরণ?’

‘তা হয়তো নয়। কিন্তু আপনার ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি গুলিস্তান সিনেমা হল বা মানসীতে না গিয়ে আপনি ইসলামপুরের পুরোনো ভাঙাচোরা হল লায়নে গেলেন কেন?’

‘হতে পারে ওই হলটাই আমার পছন্দের।’

‘মানলাম। ওকে। কিন্তু তিন দিন পর ২৯ জুলাই দ্বিতীয়বার আবার সিনেমাটা দেখতে গেলেন কেন আপনি? ওই একই হলে? একই শোতে? তার দুদিন পরে আবার গেছেন। ৩১ জুলাই।’

আফসান কোনো জবাব না দিয়ে তাকিয়ে থাকেন কর্নেল নাদিমের দিকে।

‘এর ব্যাখ্যা একটাই হতে পারত, সিনেমাটা আপনাকে মুগ্ধ করেছে। এত মুগ্ধ যে আপনি নিজেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেননি। অথচ আমরা দেখছি, সিনেমাটা আপনি দেখনইনি। এর কাহিনি আপনার জানা নেই। তাহলে আপনি ওখানে সিনেমা দেখতে জাননি। জানতে পারি কি কিসের জন্য গিয়েছিলেন? তিনবার?’

‘আমার মেমোরিতে নেই। একবার যাওয়ার মেমোরিই নেই।

‘নাইস। ওকে। আপনার স্মৃতিশক্তিকে হেল্প করি। আপনি ওখানে গিয়ে তিনবারই একই আসনে বসেছেন। রিয়ার স্টলে এফ-১৮ সিট। তিনবারই একই টিকিট। কীভাবে একই আসন পাওয়া সম্ভব?’

‘কীভাবে সম্ভব?’

‘সম্ভব কেবল তখনই, যখন টিকিট আপনি কাটেননি। আপনাকে কেটে দেওয়া হয়েছে। কেউ একজন টিকিটটা আপনাকে দিয়েছে। আর তিনবারই আপনার এই এফ-১৮ আসনের পাশের সিট এফ-১৭-তে বসেছে একজন ব্যক্তি। একই ব্যক্তি। আপনার এই সহ-দর্শকের বয়স হবে ত্রিশের মতো। কিন্তু এই বয়সেই তার মাথায় টাক পড়েছে। আপনি সিনেমার পুরো সময়জুড়ে এই লোকটার সঙ্গে মৃদু স্বরে কথা বলেছেন। আলাপ করেছেন। সিনেমা আপনি দেখেননি।

আফসান বলেন, ‘এগুলো একটা কথাও সত্যি না।’ তবে তাঁর গলা খুব ক্লান্ত শোনায়।

‘সব মিথ্যা? সব ভিত্তিহীন? তাহলে এইগুলো কী বলুন তো।’

কর্নেল নাদিম একটু আগে ইশারা করেছিলেন, তখন তাঁর হাতে একটু আগের ফাইলটা গছিয়ে দিয়েছে মেজর সামির। কর্নেল ফাইল থেকে তিন টুকরো কাগজ বের করে আফসানের হাতে দেন। ‘দেখুন তো, প্রফেসর, এগুলো চিনতে পারেন কি না।’

আফসান চৌধুরী কাগজের টুকরো তিনটি নেন। সিনেমা হলের টিকিট।

কর্নেল বলেন, ‘লায়ন হল। ম্যাটিনি শো। এফ-১৮। এগুলো পাওয়া গেছে আপনার মানিব্যাগে। আপনার বাসা থেকে মানিব্যাগটা উদ্ধার করা হয়েছে আপনাকে আটকের দিনই। উই আর সরি টু ইনভেড ইয়োর প্রাইভেসি। আমাদের করতে হয়েছে, ফর দ্য গ্রেটার ইন্টারেস্ট অব দ্য নেশন।’

আফসান চৌধুরী চুপ করে তাকিয়ে থাকেন।

‘চুপ করে থাকবেন না, প্রফেসর। আই নিড ইনফরমেশন। দ্যাটস হোয়াট আই লিভ অন। ইনফরমেশন আমার ব্রেড অ্যান্ড বাটার। ইনফরমেশন ইজ মাই অর্গাজম। স্পিক আউট। এগুলো আপনার মানিব্যাগে এল কী করে?’

‘নো আইডিয়া।’

‘প্রফেসর আফসান, প্লিজ স্পিক আউট। স্পিল অল দ্য বিনস। আমার ধৈর্যের একটা সীমা আছে।’

‘আমি কিছু জানি না।’

‘ওয়েল অ্যান্ড গুড।’

কর্নেল নাদিম উঠে দাঁড়ান। ফাইলটা টেবিলে একপ্রকার ছুড়ে দিয়ে রেকর্ডারের কাছে গিয়ে সুইচ বন্ধ করে দেন। তারপর আবার এসে আফসানের সামনে দাঁড়ান।

‘দিস ওয়াজ সো ফার অফিশিয়াল। নাও লেট মি কাম টু দ্য আনঅফিশিয়াল পার্ট,’ কর্নেল বলেন। তাঁর কণ্ঠস্বর এখন একবারে বদলে যাওয়া। একটা নিষ্ঠুর তীক্ষ্ণতা তাঁর গলায়, যেন কথাগুলো এই মুহূর্তের তাজা নয়, যেন আগে রেকর্ড করা কথা তাঁর মুখ থেকে বের হচ্ছে। শুনুন মনোযোগ দিয়ে। ভেবেছিলাম, আপনি নিজে থেকে ভলান্টিয়ার করবেন। আমার রিডিং বলছিল আপনি টাইপ-এ ক্যারেক্টারের লোক। সেটা হলেই ভালো হতো। কিন্তু আপনি দেখছি টাইপ-বি ক্যারেক্টারের। সো, ইনফরমেশন এক্সট্রাক্ট করতে এখন আমাদের টাইপ-বি মেথডে যেতে হবে। সেটা একটু লেংদি। আর সেটা আপনার জন্য সুখকর হবে না। আই অ্যাম ফিলিং সরি। সরি ফর ইউ। আমি এখন বের হয়ে যাব। পরের মেথডটা আই অ্যাম লিভিং ফর মেজর সামির। হি ইজ অ্যান এক্সপার্ট অন ইট। মেজর, ইউ প্রসিড নাও।’

মেজর সামির যেন এ জন্য অপেক্ষা করে ছিল। তার দেহে একটা উৎসাহী তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ে।

‘ওকে, স্যার।’

কর্নেল নাদিম ফাইল গুটিয়ে হাতে নিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যান।

ঘরে এখন মেজর সামির ও আফসান। সামির কোনো দিকে না তাকিয়ে খানিকক্ষণ পায়চারি করেন। টেবিল ফ্যানটা বন্ধ করে দেন।

মিনিট দুয়েক পর দুজন সেনাসদস্য অদ্ভুত ধরনের কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে ঢোকে। কয়েকটা দেখতে দাঁত তোলার যন্ত্রের মতো। কয়েকটা লোহার আঁকশি। ফাইলপত্র এক পাশে সরিয়ে যন্ত্রগুলো টেবিলের ওপর রাখা হয়।

মেজর সামির তার ফুল স্লিভ শার্টের বোতাম খুলে কবজি পর্যন্ত হাতা গোটায়। তারপর পেশাদারদের মতো যন্ত্রপাতিগুলো গোছাতে থাকে। একবারও তাকায় না আফসান চৌধুরীর দিকে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন