শিবব্রত বর্মন
‘ওরা যখন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনল যে আমি আরবান গেরিলাদের মদদ দিচ্ছি, তখন প্রথমেই আমার মনে হলো : তাই তো, আমি কেন দিচ্ছি না।’ ফিরোজকে বলেন আফসান চৌধুরী। ‘ইন ফ্যাক্ট গেরিলা স্ট্র্যাটেজি আমার চেয়ে ভালো কে শেখাতে পারবে আর এ দেশে?’
তাঁরা দুজন মুখোমুখি বসা। মাইকের ঘোষণা অনুযায়ী, এটা ইস্ট পাকিস্তান ন্যাশনাল চেস টুর্নামেন্টের ফাইনালের আসর। তবে মাইকের অডিওতে কোনো সমস্যা হওয়ায় প্রতি তৃতীয় শব্দে ‘ক্যা…’ করে বিকট তীক্ষ্ণ আওয়াজ উঠছে। যে লোকটা ঘোষণা দিচ্ছেন, তিনি অপেক্ষা করছেন শব্দটা চলে যাওয়ার জন্য। এ কারণে ‘ইস্ট পাকিস্তান ন্যাশনাল’ বলার পর তীক্ষ্ণ আওয়াজ শেষ হলে তিনি বলছেন ‘দাবা টুর্নামেন্ট’। ‘ফিরোজ’ বলার এত পরে ‘আহসান বেগ’ বলছেন, মনে হচ্ছে দুজন আলাদা লোকের নাম বলা হচ্ছে।
টুর্নামেন্টের সব গেম পল্টনে ইস্ট পাকিস্তান ক্রীড়া পরিষদে হলেও ফাইনালের গালা আসর বসানো হয়েছে হোটেল পূর্বাণীর প্রশস্ত হলরুমে। এক পাশে নিচু মঞ্চ করে তাতে একটা টেবিলে দাবার বোর্ড পাতা হয়েছে। এক পাশে একটা ঢাউস ডিসপ্লে চেস বোর্ড, যেটায় চালগুলো ম্যানুয়ালি রেপ্লিকেট করা হবে কার্ডবোর্ডের ঘুঁটি দিয়ে।
সামনে দর্শকদের জন্য আসন পাতা হয়েছে তিন কলামে। প্রথম তিন রো সোফা। তারপর একটু ফাঁকা রেখে টানা চেয়ার।
সোফায় দর্শকের আসনে সেনাবাহিনীর অনেক হর্তাকর্তা বসে আছেন। তাঁদের মধ্যে কর্নেল নাদিম ও মেজর শাকিলকে দেখা গেল।
দুই রো পেছনে বসেছে রওশন আরা। সে এসেছে তার ব্যবসায়ী বরকে নিয়ে। দিন পনেরো হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। রওশন ও মিস্টার ইসলাম দুজনে ফিরোজের বাসায় গিয়ে মা ও ছেলেকে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে এসেছিল। যাওয়ার সময় রওশন ফিরোজকে বলেছিল, সালমা বেগকে যেন অবশ্যই বিয়ের অনুষ্ঠানে আনা হয়, কেননা যে হোটেলে ওয়েডিং সেরিমনির আয়োজন করা হয়েছে, তারা নিশ্চিত করেছে সেখানে বিশেষ র্যাম্প আছে।
ফিরোজের হাতে রওশন আরার দেওয়া টাইমেক্স। প্রতিবার চাল দেওয়ার সময় সেটার ডায়াল ঝিলিক দিয়ে উঠছে।
ফিরোজ আজ ভেন্যুতে পৌঁছাতে সেদিনের মতো কৌশলগত বিলম্ব করেনি। আধা ঘণ্টা আগেই পৌঁছে যায় সে। আজ সে হালকা ছাইরঙা একটা হাই-নেক কটি পরেছে। সঙ্গে একটা কালচে প্যান্টালুন।
আফসানও আজ সেজে এসেছেন এবং তিনিও কটি পরেছেন। তাঁর কটির রং কালচে খয়েরি। মিরা আর জাহানারা নিউমার্কেট থেকে কিনে এনেছে।
শুরুতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দর্শকসারির সোফায় বসে ছিলেন। নাম ঘোষণা করা হলে তুমুল করতালির মধ্যে তাঁরা মঞ্চে ওঠেন। নিজ নিজ আসনে বসার আগে তাঁরা হ্যান্ডশেক করেন।
আজকের ম্যাচের রেফারি এসেছেন বেলুচিস্তান থেকে। তিনি গেমের কিছু বিশেষ নিয়মকানুন বলে দিয়ে টস করলেন।
কালো দিয়ে শুরু হলো আফসান চৌধুরীর গেম
ফিরোজ প্রথম চাল দিয়ে চেস ক্লকের বাটনে চাপ দিল। টাইমারে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আওয়াজ শুরু হলো। আফসান চাল দিয়ে তাঁর চেস ক্লক চালু করেন। ফিরোজ চাল দেয় দ্রুত। চাল অনুযায়ী ডিসপ্লে বোর্ডে দ্রুত ঘুঁটি সরাচ্ছে ভলান্টিয়ার।
ফিরোজ মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে আফসানের দিকে। আফসানের চোখ দাবার বোর্ডে নিবদ্ধ।
চাল দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আফসান ও ফিরোজের মধ্যে কথা হয়।
ফিরোজ চাপা স্বরে বলে, ‘প্লে ইয়োর ন্যাচারাল গেম, স্যার। বেশি সহজ করে ফেলবেন না।’
আফসান ফিরোজের দিকে তাকিয়ে আবার চাল দেন।
ফিরোজ আবার বলে, ‘রিমেম্বার দ্য ডিল, স্যার।’
আফসান তার মন্ত্রীকে স্টেকে ফেলেন। দর্শকসারিতে একটা গুঞ্জন ওঠে।
ফিরোজ সন্দিহান হয়। ‘ফাঁদ না তো?’
আফসান বলেন, ‘দাবার বোর্ডে না। নিশ্চিন্তে খেতে পারো।’
ফিরোজ আফসানের মন্ত্রী খায়। দর্শকসারিতে একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। সবাই বিস্মিত।
একজন উৎসাহী দর্শকের মন্তব্য কানে আসে, ‘স্টুপিড নাকি!’
আরেকজন বলে, ‘বুড়া মাথার বুদ্ধি। ধার কইমা যাইতেছে।
ফিরোজ ও আফসানের ফিসফিস বন্ধ হয় না। বালুচ রেফারি বিরক্ত হন। তিনি তাঁদের সতর্ক করেন। কিন্তু দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা বন্ধ হয় না। দর্শকসারি থেকেও বোঝা যায়, খেলোয়াড়েরা দৃষ্টিকটুভাবে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে।
ফিরোজ বলে, ‘নিজেকে অ্যামেচারদের লেভেলে নামাচ্ছেন কেন?’
আফসান বলেন, ‘তুমি জিততে পারবা?’
‘মাথায় রাখবেন আমি কিন্তু অ্যামেচার নই।’
চেস ক্লকটা টিকটিক করে এগোচ্ছে। কিন্তু সেটা ছাপিয়ে আফসানের কানে একটু একটু করে বাড়ছে আরেকটা ঘড়ির আওয়াজ। হলরুমে দেয়ালে রাখা বিশাল দেয়ালঘড়িটা যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে টক্ টক্ করছে। ওই আওয়াজই এখন আফসানের কানজুড়ে।
আফসান নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকেন।
সেকেন্ডের কাঁটাটা ঘুরে ৬০ সেকেন্ডের ঘর পূর্ণ করে। বিকেল ঠিক পাঁচটা পঞ্চান্ন।
আফসান আবার বড় ঘড়িটার দিকে তাকান। সেখানে সেকেন্ডের কাঁটাটা আরও তিন সেকেন্ড পরে ৬০ সেকেন্ড পূর্ণ করল।
আফসান এবার দাবার বোর্ড থেকে মুখ তুলে সরাসরি ফিরোজের দিকে তাকান। নিচু স্বরে কিন্তু প্রায় শ্রুতিগ্রাহ্যভাবে বলেন, ‘ফিরোজ, তোমাকে বলেছি, খেলাটাকে দাবার বোর্ডের বাইরে নিয়ো না। তুমি শোনোনি।’
‘হোয়াট!’
পাশে দাঁড়ানো রেফারি আবার বিরক্তি প্রকাশ করেন।
আফসান বলেন, ‘তুমি চাল দিয়েছ। নিখুঁত চাল। কিন্তু বোর্ডের বাইরে। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। লেক সার্কাস রোডের বাসায় ট্রেনিং আস্তানার গল্প ভালো সাজিয়েছ, তারপর লায়ন সিনেমা হলের টিকিট—ব্রিলিয়ান্ট! এখন তোমার চাল আমি তোমাকে ফিরায়ে দিব, ফিরোজ।’
ফিরোজ ভয় পাওয়া চোখে তাকায়।
আফসান বলেন, ‘খেলাটা আমিও বোর্ডের বাইরে নিয়ে গেছি। মিথ্যাগুলোকে আমি সত্য বানিয়েছি। যা যা অভিযোগ তুমি সাজিয়েছ, তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে উপায় নেই, কিন্তু সেগুলো আর বানানো অভিযোগ নয়, ফিরোজ। তোমার দেওয়া বুদ্ধিই আমি কাজে লাগিয়েছি।’
‘আর ইউ নাটস, প্রফেসর।’
‘দাবায় মন দাও। তোমার মন্ত্রীটা এবার আমাকে দিতে হবে। আফসান সাদা ঘরের হাতি দিয়ে ফিরোজের মন্ত্রীকে ধরে। ফিরোজ অবাক হয়ে যায়।
দর্শকসারিতেও একটা বিস্ময়ের ঢেউ। কেউ অনুমান করেনি।
‘যে ফাঁদ তুমি আমার জন্য পেতেছ, সেই ফাঁদ আমি তোমার জন্য সাজিয়েছি। চাল দাও। আর সাত মিনিটের মধ্যে গেমটা শেষ করতে হবে। ওরা এসে পড়ছে।’
‘কারা?’
‘যাদের আমি খুঁজে বের করেছি। ট্রেইন-আপ করেছি। দে আর মাই বয়েজ নাও। চাল দাও। এটাই তোমার শেষ খেলা। তুমি আর দাবা খেলার সুযোগ পাবে না।’
ফিরোজ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে আতঙ্ক।
বাইরে দূরে কোথাও একটা বিস্ফোরণের শব্দ হয়।
অভ্যাগতদের মধ্যে একটা গুঞ্জন ওঠে।
এরপর আরেকটু কাছে আরেকটা বিস্ফোরণ।
এরপর আরেকটু কাছে।
প্রতিবার বিস্ফোরণে সামনে রাখা দাবার বোর্ড কেঁপে কেঁপে উঠছে।
ঘুঁটিগুলো নড়ে যাচ্ছে।
একটা বিশাল দৈত্য যেন পা ফেলে ফেলে এগিয়ে আসছে।
***
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন