শিবব্রত বর্মন
দুপুরের আগে আগে বৃষ্টি নামল। ইলশেগুঁড়ি। রান্নার আয়োজনের এ সময়টা আফসান চৌধুরীর বাসা সবচেয়ে কর্মব্যস্ত থাকে। জাহানারা একটু আগে নিউমার্কেট কাঁচাবাজার থেকে ফিরেছেন মেজাজ খারাপ করে। সবকিছুর দাম দুই থেকে তিন গুণ বেড়ে গেছে। বাইরের লোকের ঢাকায় ঢোকা কঠিন করে দেওয়া হয়েছে। বাজারে সরবরাহ নেই। এর মধ্যে আতঙ্কে মানুষ মজুত করা শুরু করেছে। যে সামান্য তরিতরকারি আর মাছ পাওয়া গেছে, তাই কুটাবাছা চলছে শেফালিকে সঙ্গে নিয়ে। আলী বারান্দার টবগুলোয় নতুন মাটি দিচ্ছে। আকাশবাণীতে জগন্ময় গাইছেন, ‘আমি ভুলে গেছি তব পরিচয়/ তবু তোমারে তো আজও ভুলি নাই।’
হাবিবুল্লাহকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে নিয়াজ বেশির ভাগ সময় এ বাড়িতেই থাকছে। এ মুহূর্তে সে বসার ঘরে আফসান চৌধুরীর কাছ ঘেঁষে মেঝেতে কার্পেটের ওপরে দাবার বোর্ড সাজিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে চাল দিচ্ছে। খেলা চলছে আফসান চৌধুরীর সঙ্গে ফিরোজের। টেলিফোনে। আফসানের মুখ থেকে শুনে সেই চালগুলোই দিচ্ছে নিয়াজ। সে চালের নোটেশন শিখেছে নতুন নতুন। ফলে মহা উৎসাহ।
সকাল থেকে শুরু হয়েছে খেলা। একটা গেমই চলছে আড়াই ঘণ্টা ধরে। ফিরোজ আজ একেবারে ভিন্ন কৌশলে খেলছে। আফসান তাঁর অভিপ্রায় ধরতে পারছেন না। ফলে চাল দিতে তাঁর দেরি হচ্ছে। ফিরোজও অস্বাভাবিক বেশি সময় নিয়ে চাল দিচ্ছে।
খেলাটা যখন মিডগেমে, তখন দরজায় কলিং বেল বাজে। মাত্র একবার বাজলেও এর পেছনে একটা অস্থির আঙুলের উপস্থিতি বাসার কারও নজর এড়ায় না।
টবে মাটি দেওয়া শেষ হয়েছে বলে আলী হোসেন দরজা খুলে দিতে যায়। তার কণ্ঠে কারা আপনেরা’ শব্দটা ছিল ওই দিন বাসায় ধ্বনিত সবচেয়ে কম কর্কশ শব্দ।
আধা ঘণ্টা পরে গ্রিল দেওয়া বারান্দা থেকে নিচে বয়রাগাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকা জিপগাড়িটার দিকে তাকিয়ে দোতলার ফিজিকসের শ্যামলবাবু তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘কিন্তু ওনাকে কেন?’
তাঁর স্ত্রী ইশারায় তাকে চুপ করে থাকতে বলেছিলেন।
.
প্রকাণ্ড লোহার গেট খোলার শব্দে আফসান চৌধুরীর পক্ষে অনুমান করা সম্ভব ছিল না তিনি এখন সেই দুর্গের মতো ভবনটাতেই ঢুকছেন, মাসখানেক আগে যেটা তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল বলে তাঁর মনে হয়েছিল। তাঁর চোখে একটা পট্টি বাঁধা। হাতও পিঠমোড়া করে বাঁধা। একটা হুডলাগানো জিপগাড়ির পেছনে বেঞ্চ মতন আসনে তিনি বসা। নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে বলে তাঁর মনে হয়। কেননা কেউ একজন তাঁর নাকে কিছুক্ষণ একটা রুমাল চেপে ধরে রেখেছিল। রুমালটা তত পরিষ্কার ছিল না। সেটায় জর্দার গন্ধ ছিল, সে গন্ধ এখনো তাঁর নাকে লেগে আছে।
জিপটা অনেকক্ষণ চলেছে। সবাই দুলেছে, আর সে কারণে তিনি অনুভব করেছেন তাঁর দুপাশে দুজন লোক বসা। ডান পাশের লোকটার নিশ্বাস থেকে কড়া তামাকের গন্ধ পেয়েছিলেন তিনি।
দুপুরবেলার রাস্তা থেকে নানা রকম যানবাহনের আওয়াজ এসেছে। একাধিক বাস ছুটে গেছে পাশ দিয়ে। রিকশা ও সাইকেলের টুংটাং বেজেছে। আফসান চৌধুরীর সন্দেহ জাগে, জিপটা শহরজুড়ে এলোপাতাড়ি ঘুরেছে, কিছু ক্ষেত্রে একই পথ দিয়ে গেছে একাধিকবার। কারণ, কিছু এলাকাগত আওয়াজ এবং গন্ধের পুনরাবৃত্তি তিনি লক্ষ করেছেন।
তারপর সেই গেটের সামনে এসে থেমেছে গাড়িটা। গেট ধাতব জন্তুর মতো আওয়াজ তুলে খুলে গেলে ভেতরে কোনো খোলা উঠানে জিপটা পূৰ্ণ বৃত্ত রচনা করে একবার ঘুরেছে। তারপর চূড়ান্তভাবে থেমেছে। স্টার্ট বন্ধ করা হয়েছে গাড়িটার। কিছু লোক সেনা নির্দেশনা বিনিময় করেছে। তাদের একজনের কণ্ঠস্বর আফসানের চেনা। বাসায় যারা ঢুকেছিল, তাদের মধ্যে এই লোকটা তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। নিজেকে তিনি লেফটেন্যান্ট শাকিল বলে পরিচয় দিয়েছিলেন।
লেফটেন্যান্ট শাকিল বলেন, ‘নামিয়ে, প্রফেসারজি। হামলোগ আ গ্যায়ে।’
আফসান ভেবেছিলেন, এবার বোধ হয় চোখের পট্টি খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু তা করা হলো না। ফলে জিপ থেকে নামতে তাঁর ভারসাম্যের সমস্যা হলো। একটা টানা বারান্দা দিয়ে তাঁকে যখন হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো, পায়ের আওয়াজের প্রতিধ্বনি থেকে তিনি বুঝতে পারলেন, বারান্দার এক পাশটা খোলা। আরেক পাশে একটার পর একটা ঘর।
একটা দরজার সামনে তাঁকে থামানো হলো। তালা খোলার শব্দের পর ঠেলে দেওয়া হলো একটা ঘরে। কয়েক কদম ঢোকার পর খুলে দেওয়া হলো চোখের পট্টি। ঘণ্টা দুয়েক পর আফসান চৌধুরীর চোখে আলো প্রবেশ করল। তবে তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে গেল না ঘরটা প্রায় অন্ধকার বলে। দুটি জানালা থাকলেও সেগুলো সিল করা। এ মুহূর্তে কোনো বাতি জ্বলছে না। দরজা দিয়ে আসা আলোর বাইরে এক পাশে একটা ঘুলঘুলি থেকে কিছু আলো আসছে। তাতে একটা প্রশস্ত ঘরের ভেতরকার মানচিত্র আবছা ভেসে ওঠে।
এক কোনায় একটা খাট। লোহার। হাসপাতালের বেডের মতো। তার পাশে একটা টুল। একটা আলনা আছে। দেয়াল আলমারি একটা। আলমারির পাশে একটা টেবিল আর চেয়ার। এক পাশে ছোট একটা দরজা থেকে অনুমান করা যায়, অ্যাটাচড বাথরুম আছে।
চোখ খোলামাত্ৰ এত কিছু একবারে দেখেননি আফসান চৌধুরী। ধীরে ধীরে এগুলো নজরে এসেছে তাঁর। সে মুহূর্তে তিনি কিছুই দেখছিলেন না। তাঁর মাথার ভেতরে একটাই প্রশ্ন তখন বেজে চলেছে : এরা কী চায় তাঁর কাছে?
আফসান চৌধুরী বলেন, ‘এটা কোথায়?’
পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন লেফটেন্যান্ট শাকিল। তিনি বলেন, ‘নোহয়্যারল্যান্ড। আপ কুছ দিন ইয়াহা রেহেঙ্গে।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন