শোধ – ১৩

শিবব্রত বর্মন

এক মাসে একটা লোক কতটা শুকিয়ে যেতে পারে? লোকটার চামড়া আর হাড়ের মাঝখানে যেন কোনো মাংস নেই। সেই হাড়ও পাথর হয়ে গেছে। মগ দিয়ে যখন মাথায় পানি ঢালা হচ্ছিল, পাথরের মতো বসে ছিলেন আফসান চৌধুরী। বাথরুমে একটা কাঠের চেয়ার বসিয়ে তাতে বসানো হয় তাকে। মিরা ও জাহানারা তাঁর গায়ে পানি ঢালছিলেন। পেছনে উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আলী ও শেফালি।

কত সহস্র বছর পর যেন গোসল করছে লোকটা। চোখ বন্ধ করে পানির স্পর্শ অনুভব করছে। একটা চোখ ফুলে এমনিতেই বন্ধ হয়ে আছে। কালশিটে পড়ে আছে সেই চোখের পাতায়।

আফসান চৌধুরীকে চেনা যায় না। বিকেলে যখন বাসার সামনে অটোরিকশা থেকে নামছিলেন, ফিরোজ তাঁকে নামাচ্ছিল, জাহানারা সিঁড়ির গোড়ায় কথা বলছিলেন মোজাম্মিল সাহেবের সঙ্গে, তখন আফসান চৌধুরীকে চিনতে পারেননি তিনি। সেটা শুধু তাঁর হাড্ডিসার তোবড়ানো চোয়ালে এক মাসের অকর্তিত দাড়ি-গোঁফের কারণে বা তাঁর বিসদৃশ ঢোলা জামাকাপড়ের কারণে নয়, লোকটার অবয়ব পুরোপুরি বদলে গেছে। এমনকি ফিরোজের কাঁধে ভর দিয়ে আফসান যখন তাকালেন জাহানারার দিকে, তাঁর মনে হলো এ রকম শূন্য, ফাঁপা দৃষ্টি তিনি কোনোকালে কোথাও দেখেননি। একটা লোক যেন তার সবকিছুকে পেছনে ফেলে এসেছে।

মিরা গা মুছিয়ে বারান্দায় শেষ বিকেলের রোদে বসাল আফসানকে। আলমারি থেকে বের করে পুরোনো একটা সাদা ফতুয়া পরানোয় সেটা এমনভাবে ঝুলে থাকল, মনে হলো একটা চাদর পরানো হয়েছে তাঁকে।

টবের গাছগুলোয় তেমন যত্ন পড়েনি। পুরো বাড়িটাই ছন্নছাড়া হয়ে আছে। একটা শুকিয়ে যাওয়া হলুদ জবাগাছের দিকে তাকিয়ে থেকে আফসান প্রায় বিড়বিড় করে প্রথম যে কথাটা বলেন, সেটা যে মিরাকে উদ্দেশ করে, বুঝতে সময় লাগে। ‘রাজিব নামে একটা ছেলে এসেছিল আমাদের বাসায়।’

মিরা অবাক হয়ে বলে, ‘হ্যাঁ। মামুন আর সৌগতের বন্ধু। কেন?’

‘ও কি সীমান্তের ওপার থেকে এসেছে?

‘শুনেছি। কিন্তু কেন?’

‘যোগাযোগ আছে তোর সঙ্গে?’

.

একটা গন্ধের হাত থেকে কিছুতেই মুক্তি পাওয়া গেল না। একটা সূক্ষ্ম কিন্তু বিটকেল গন্ধ কিছুতেই পিছু ছাড়ল না আফসানের। স্মৃতি আর মাঝরাতে হাঁসফাঁস করে ওঠা দুঃস্বপ্নের পাশাপাশি বন্দিশালা থেকে আর যে একটা বাড়তি জিনিস তিনি বয়ে আনলেন, তা এই গন্ধ। বারবার সাবান দিয়ে ডলে, গায়ে ট্যালকম পাউডার আর পারফিউমের শিশি ঢেলেও সেটা দূর হলো না। বন্দিশালার লোহার খাটের তোশক থেকে গন্ধটা তাঁর গায়ে লেপ্টে গেছে। স্থায়ীভাবে।

আর ক্লান্তি। রাজ্যের ক্লান্তি ভর করল তাঁর ওপর। চোখের পাতা মেলতেও যেন ক্লান্তি লাগে।

জাহানারার মনে হলো ওরা যেন ষড়যন্ত্র করে গোপনে অন্য একটা লোককে পাঠিয়ে দিয়েছে। লোকটা দেখতেও তো আফসানের মতো নয়।

‘সব ঠিক হয়ে যাবে,’ মিরা জাহানারাকে বলল।

এক সপ্তাহে আফসানের স্বাস্থ্যের বেশ খানিকটা উন্নতি হলো। আর তখন তারা জানতে পারল, লোকটা এবার দাবার একটা প্রতিযোগিতার আসরে অংশ নিচ্ছে। ভোররাতে ঘুম ভেঙে জাহানারা দেখেন, গায়ে চাদর পেঁচিয়ে আফসান বসার ঘরের মৃদু আলোয় একটা দাবার বোর্ড সাজিয়ে বসে আছেন। লোকটা রাতে ঘুমাননি। আর তখনই প্রথম টুর্নামেন্টে যোগ দেওয়ার তথ্য জানতে পারেন জাহানারা।

‘তুমি! হয়েছে কী তোমার?’ পরদিন মিরা বলেছিল বাবাকে। ‘তোমার মাথা ঠিক আছে? যে লোক কারও সঙ্গে চ্যালেঞ্জ গেম খেলে না, কোনোকালে খেলেনি, সে খেলবে টুর্নামেন্ট!’

কিছুতেই নিরস্ত করা গেল না তাঁকে। মা ও মেয়ের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল : একটু হাঁটতে পারার মতো অবস্থায় আসতেই লোকটা বাসা থেকে হুটহাট করে বেরিয়ে যেতে শুরু করল। দীর্ঘ সময়ের জন্য। জেদ করে বের হচ্ছে। কারও কথা শুনছে না। কাউকে সঙ্গে যেতেও দিচ্ছে না। এ কি নতুন পাগলামি? জাহানারা গোপনে আলীকে পেছনে পেছনে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আলী বকা খেয়ে ফিরে এসেছে।

.

শাহীন খুব অবাক হয়ে গেল।

‘ভাই, আপনি? এই শরীরে?’

তিনতলা সিঁড়ি বেয়ে উঠে আফসান হাঁপাচ্ছিলেন। শাহীন তড়িঘড়ি তাঁকে সোফায় বসায়। তাঁর মেয়ে নিরঞ্জনা এক গ্লাস শরবত এনে দেয়।

শাহীন এর মধ্যে একদিন ও-বাড়িতে গিয়ে দেখে এসেছে আফসানকে।

‘আমরা একই বিল্ডিংয়ে ছিলাম, কিন্তু কোনো দিন দেখা হয় নাই, ‘ আফসান বললেন। সে ঠিক বুঝতে পারছিল না, কী বলে সান্ত্বনা দেবে।

‘এসব কথা থাক আফসান ভাই। কী হবে আর এগুলো নিয়ে কথা বলে। আপনি ফিরে এসেছেন, এটাই অনেক বড় কথা।’

আফসান কিছুক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদুস্বরে বলেন, ‘আমার খুব জানা দরকার, হাবিবুল্লাহর বিরুদ্ধে ওদের অভিযোগটা কী ছিল?’

‘আমি জানি না।’

‘হাবিবুল্লাহকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ওরা কি বাসায় তল্লাশি চালিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। দুজন এসেছিল।’

‘আর্মির পোশাকে?’

‘না। সিভিল পোশাকে। কিন্তু আর্মির লোক। বোঝা যায়।’

‘কী কী জিনিস নিয়ে গেছে ওরা?’

‘আমি জানি না। দেখায় নাই।’

‘আমি যে তোমার এখানে এসেছি, এটা জাহানারা আর মিরাকে বলবা না। ঠিক আছে?’

শাহীন মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

‘এখন আমি তোমার কাছে একটা জিনিস জানতে চাইব, শাহীন। ভেবেচিন্তে জবাব দিবা।’

‘ঠিক আছে, ভাই।’

‘ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে, হাবিবুল্লাহ কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছিল?’

‘মানে?’

‘বাসায় কি কোনো অচেনা লোকজনের আসা-যাওয়া শুরু হয়েছিল?’

শাহীন চুপ করে থাকে।

‘পরে কি তাঁরা এসেছে আর? হাবিবুল্লাহকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরে?’

‘না।’

‘ওই লোকগুলার সঙ্গে এখন যোগাযোগ আছে তোমার?’

‘না। নাই।’

‘ভয় পেয়ো না। সত্যি কথা বলো। আমার কাছ থেকে তোমার কোনো ভয় নাই।’

‘না। কোনো যোগাযোগ নাই।’

‘তাদের কারও ঠিকানা বা টেলিফোন নাম্বার?’

‘না।’

‘একটা কাজ করতে পারবা? হাবিবুল্লাহর ডায়েরি বা নোটবুক যা আছে, আমারে দিয়ে দিতে পারবা? দেখি সেইখানে কিছু টুকে রেখেছে কি না।’

.

লেক সার্কাস রোডে ফিফটিন-বি বাড়িটা দোতলা। লাল ইটের। সামনে একটা বাগানবিলাসের ঝাড়ে লাল-সাদা ফুল ফুটে থিকথিক করছে। গাছটা লতিয়ে দোতলার গ্রিল বেয়ে উঠে যেতে চাইছে।

রিকশা থেকে নেমে কলিং বেল টিপতেই সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। বোঝা গেল ভেতর থেকে কেউ কোনো জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিল। দরজা খুলল এক লুঙ্গি পরা লোক। গায়ে ফতুয়া। গালে আধা পাকা দাড়ি। বয়স পঞ্চাশের ওপরে। লোকটা বলল, ‘কবে ছাড়ল ওরা আপনাকে, আফসান ভাই?’

‘ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনেছিস তুই?’

‘শুনেছি। ধরে কেন নিয়ে গিয়েছিল, বলেন তো?’

‘তোদের এখানে তল্লাশি চালিয়েছে?’

‘হ্যাঁ। জিপ নিয়ে এসে সারা বাড়ি সে কী লন্ডভন্ড অবস্থা করল। কী যে খুঁজল, ওরাই জানে।’

‘আমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল?’

‘হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়? বললাম, কাজিন। জানতে চাইল, শেষ কবে দেখা হয়েছে, এই বাসায় নিয়মিত আসত কি না, শেষ কবে এসেছে, ইত্যাদি। কিন্তু বিষয়টা কী বলেন তো?

আফসান বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। তারপর বলেন, ‘একবার যে জায়গায় তল্লাশি হয়েছে, সেখানে দ্বিতীয়বার হবে না। সাজ্জাদ, তোর বাসাটা আমার লাগবে।’

.

ছবির নাম দুনিয়া না মানে।

বিশাল হোর্ডিং জুড়ে জেবা আর মোহম্মদ আলীর ছবি। জেবার অপরূপ হাসি ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর লালচে গোলাপি গালে। মোহম্মদ আলী জেবার দিকে তাকিয়ে আছেন। তবে দেখছেন না। কেননা তাঁরা দুটি ভিন্ন দৃশ্যের কোলাজ।

যুদ্ধের মধ্যেও সিনেমা হলে দর্শকের কমতি নেই।

হোর্ডিংয়ের তলায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আফসান চৌধুরী চারপাশটা ভালো করে দেখে নিলেন। চেনা কাউকে চোখে পড়ল না।

ঢোকার মুখে ডানে টিকিট বুথ।

‘একটা রিয়ার স্টল,’ গ্রিলের ফাঁকে হাত গলিয়ে টাকা দিয়ে বললেন আফসান। তারপর যোগ করলেন, ‘আমাকে এফ-১৮ সিটটা দেবেন।’

কাউন্টারের লোকটার ভুরু কুঁচকে গেল। ‘এভাবে তো টিকিট দেওয়া হয় না। ভাগে যেটা পড়বে, বসতে হবে।

‘আমার এফ-১৮ই লাগবে। টাকা বেশি দিচ্ছি।’

‘আচ্ছা, দেখতেছি।’

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে তক্ষুনি হলে ঢুকে গেলেন না আফসান। দেয়ালে ‘চলিতেছে’ লেখা বোর্ডে টাঙানো দুনিয়া না মানের কিছু দৃশ্যের ফটোগ্রাফ দেখলেন। রোমান্টিক ছবি। পাশেই ‘আসিতেছে’ লেখা বোর্ডের নিচে দো বাঘি ছবির পোস্টার জানাচ্ছে, রোমান্সের পরেই আসছে যুদ্ধের মুভি।

সিনেমা শুরুর বেল বাজলে হলে ঢুকে নিজ আসনে বসেন আফসান। পাশের এফ-১৭ আসনটা ফাঁকা থাকল। অন্য সিটগুলো সবই ভরা। মিনিট পাঁচেক পর পাশের সিটে একজন দর্শক এসে বসল। খুব আলতো করে। খুব মনোযোগ দিয়ে লোকটা সিনেমা দেখছে। অন্ধকারে শুরুতে তাকে সেভাবে দেখা গেল না। পর্দার প্রতিফলিত আলোয় ধীরে ধীরে তার অবয়ব বোঝা গেল। আফসান আড়চোখে দেখে বুঝলেন ছোটখাটো শরীরের লোকটার বয়স ত্রিশের ঘরে। তবে এই বয়সেও তার মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে।

ছবিতে একটা আবেগঘন মুহূর্তে লোকটা আফসানের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, ‘আপনি আমাকে খুঁজছেন কেন?’

.

‘রাত তিনটা বাজে, বাবা। এখানে কী করছ?’ বারান্দায় আফসানকে আবিষ্কার করে মিরা বলে।

‘ঘুম আসছে না।’

মিরা বাবার পাশে চেয়ার টেনে বসে। ‘তোমার কী হয়েছে? তুমি কী কী করে বেড়াচ্ছ, বলো তো?’

‘কী করছি?’

‘কোথায় যাচ্ছ, কাউকে জানিয়ে যাচ্ছ না। আমাদের কথাটা তো একবার ভাববা।’

‘ভাবতে হবে না। আমার শেষ হয়েছে।’

‘কী শেষ হয়েছে?’

আফসান কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। তারপর বলেন, ‘কাল ফাইনাল।’

‘কিসের?’

‘দাবা।’

‘ও, তাই নাকি? আমি আর মা-ও যাচ্ছি তাহলে।’

‘তোরা আসছিস না।’

‘কেন?’

‘আমি বলছি, তাই। তোরা কেউ আসছিস না।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন