অর্পিতা সরকার
‘এই চন্দ্রজা যা না, তিমিরকে ডেকে নিয়ে আয় না। তুই কেন বুঝতে পারছিস না এটা আমাদের সেকেন্ড ইয়ারের ম্যাটার অফ প্রেস্টিজ। এমনিতেই তো ফাইনাল ইয়ারের ওই সুবিনয়, তনয়া, জ্যোতিষ্ক এরা সব ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ালে জড়পদার্থও প্রাণ ফিরে পায়। দেখলি না গতকাল বর্ষা ম্যাডাম এসে বলে গেলেন, ‘এটাকে কম্পিটিশন হিসাবে নিও তোমরা। শুধু কলেজ ফেস্ট নয়। চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিও। আজ অবধি সেকেন্ড ইয়ার থার্ড ইয়ারের কাছে জিততে পারেনি কোনোদিন। তোমাদের মধ্যে একমাত্র তিমিরকেই একটু ভরসা করা যায়।’
অতনুর দিকে তাকিয়ে চন্দ্রজা বলল, ‘তোরা হঠাৎ আমাকে কেন ডাকতে পাঠাচ্ছিস? তোরা যে কেউ তো তিমিরকে ডাকতে পারিস। আমরা একই ইয়ারের একই বিষয়ের ছেলেমেয়ে, তাহলে তোরা ওকে ডাকতে পারবি না কেন?’
আর্ট কলেজের ক্যাম্পাসে আজ একটা বেশ চাপা উত্তেজনা শুরু হয়েছে। সিনিয়র ভার্সেস জুনিয়র আঁকার কম্পিটিশন। ছোটবেলার মতো বসে আঁকো প্রতিযোগিতা নয়। এ অনেক জটিল ব্যাপার। ওদের কলেজে দুটো ছাত্র পরিষদই বেশ স্ট্রং। মানে ভোটা-ভুটিতে ড্র হয়েছে গত বছর। সেকেন্ড ইয়ারের উৎসব ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে ভীষণ রকমের যুক্ত। তাই সেকেন্ড ইয়ার হেরে যাক এটা ও একেবারেই চায় না। সেইজন্যই উৎসব বেশ উঠে পড়ে লেগেছে।
উৎসব এবারে বলল, ‘চন্দ্রজা, ঢং পরে করলেও চলবে। সবেতে তোদের এই ন্যাকামিগুলো আর হজম হয় না মাইরি। আরে তিমির যে সকলের থেকে আলাদা সেটা আমরা সবাই জানি। ওকে আমরা জোর-জবরদস্তি ডাকলেও ও আসবে না।’
চন্দ্রজা নিজের নখের কপার রঙের নেলপলিশ খুঁটে তুলতে তুলতে বলল, ‘তাহলে জোর করছিস কেন? ওকে থাকতে দে না ওর মতো। আমরা সবাই মিলে ভেবেচিন্তে একটা প্রজেক্ট দাঁড় করাই। কেন তিমিরকে তোদের প্রয়োজন? এতদিন তো ওকে আমরা কেউ পাত্তাই দিইনি। এমনকি ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্টের পরেও না। তাহলে আজ হঠাৎ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ওকে ডাকতে পারব না।’ উৎসব বলল, ‘দেখ চন্দ্রজা, আচমকা শরৎচন্দ্রের নায়িকার মতো সৎ হয়ে যাস না। পাত্তা কি আমরা একা দিইনি? তুইও তো দিসনি। ছেলেটার তোর প্রতি আকর্ষণ আছে জেনেও দিসনি।’
চন্দ্রজা বলল, ‘কার কার আমার প্রতি আকর্ষণ আছে সেটা কি খুঁজে বেড়াতে হবে আমাকে? আমি জাস্ট পারব না।’
বিরক্ত হয়ে শ্রাবণী বলল, ‘ছাড় রে। আমি ডাকছি ওকে।’
শ্রাবণী এগিয়ে গেল নিজেদের ডিপার্টমেন্টের দিকে। তিমির আবার বাইরে তেমন বেরোয় না। ক্লাসরুমে বসে থাকতে পছন্দ করে।
শ্রাবণী রুমে ঢুকে দেখল খাতায় দুটো চোখ এঁকেছে তিমির। ওকে সামনে দেখেই চট করে খাতাটা বন্ধ করে দিল। শ্রাবণীরও আর্টিস্টের চোখ। ভুল ওরও হয়নি। চোখ দুটো কার বুঝতে দেরি হয়নি ওর। অন্য সময় হলে হয়তো একটু লেগপুল করত। কিন্তু আজ ওদের টিমের তিমিরকে প্রয়োজন। তাই বেশ সিরিয়াস মুখ করে শ্রাবণী বলল, ‘তিমির, আমাদের ডিপার্টমেন্টের সম্মান তোর হাতে। একমাত্র তোর তুলিতেই ইউনিক আইডিয়া আসে। থার্ড ইয়ারের সঙ্গে পাঙ্গা লড়ে বসে আছে উৎসব। এখন তুই আমাদের বাঁচা প্লিস।’
তিমির খাতায় লিখল, ‘প্লিস শ্রাবণী, আমায় এসবে জড়াস না। আমি কোনো প্রতিযোগিতা পছন্দ করি না।’
খাতাটা সামনে ধরল শ্রাবণীর। শ্রাবণী লেখাটা পড়েই বলল, ‘কিন্তু তিমির তুই আমাদের পাশে থাকবি না?’
তিমির আবার লিখল, ‘পাশে আছি। কিন্তু কোনো চ্যালেঞ্জে নেই।’
তিমির আর কিছু লিখবে কিনা সেটার আশায় ছিল শ্রাবণী। কিন্তু তিমির পেন বন্ধ করে দিল দেখেই বুঝল, এটা নিয়ে ও আর কোনো কথা বলতে চাইছে না।
তিমির বোবা, কালা নয়। কানে শুনতে পায়। কথা বলতেও পারে। কিন্তু কথাগুলো একটু অস্পষ্ট উচ্চারণ করে। ঠিক তোতলা বলা যায় না। সম্ভবত ওর উচ্চারণেই কোনো সমস্যা আছে। ক্লাসে এসে প্রথম দিন রবিনকে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করেছিল, গোটা ক্লাস হেসেছিল ওর অমন অস্পষ্ট আধো আধো উচ্চারণ শুনে। তারপর থেকেই ও আর কথাই বলে না কারোর সঙ্গে। যে যা বলে খাতায় লিখে উত্তর দেয়। ওর নিখুঁত হাতের লেখার প্রেমে পড়তে বাধ্য হয় সকলেই।
তবুও কলেজে যা হয়, ওকে ‘তোতলা’ নাম দেওয়া হয় গেছে। আড়ালে ওকে সবাই তোতলা বলেই ডাকে। তিমির নিজেও সেটা বুঝে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। এখন ও ওর বই আর আঁকার দুনিয়ায় থাকে। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার, তারপর থেকে ক্লাসের কেউ ওর গলা শুনতে পায়নি। অদ্ভুত জেদ ছেলেটার। প্রফেসররা এসে অনেক বুঝিয়েছেন। তবুও কথা বলেনি ছেলেটা। দু-চারটে যা কথা বলার প্রয়োজন হয় সেটা খাতায় লিখে লিখে সেরে নেয়। তাই ক্লাসের সবাই জানে তিমিরের জেদ মারাত্মক। ওকে এত সহজে যে রাজি করানো যাবে না সেটা উৎসব নিজেও জানে। তাই চন্দ্রজাকে পাঠাতে চাইছিল। ডিপার্টমেন্টের মোটামুটি সবাই বুঝতে পারে তিমিরের চন্দ্রজার প্রতি আকর্ষণ আছে। না, তিমির কখনও বলেনি ওকে। হয়তো বলবেও না। কিন্তু মাঝেমাঝেই তিমিরকে চন্দ্রজার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখেছে সবাই। চন্দ্রজা অবশ্য ব্যাপারটা মোটেই পাত্তা দেয়নি। হেসে বলেছে, ‘সাতবার তুতলে শেষে হয় তো বলবে বালোবাছি। রক্ষে করো মোরে। আমার কি ছেলের অভাব আছে?’
চন্দ্রজাকে দেখতে যে বিশাল সুন্দরী তা নয়। তবে ওর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। ওর ঠোঁটের কোণে সবসময় একটা অহংকারী হাসি বাধা পড়ে থাকে। আর হাঁটার ছন্দে পাতাবাহারি গাছের দোলন। ঠিক ভিড়ে মিশে যাওয়া চেহারা নয়। একটু স্বতন্ত্র। কিন্তু তাই বলে চন্দ্রজাকে সুন্দরী বলা মোটেই সমীচীন নয়। যদিও চন্দ্রজা এসব ভাবে না। সে নিজেকে নিয়েই মজে আছে। তিমিরকে নিয়ে চন্দ্রজাকে লেগপুল করলে ও খুব শান্ত গলায় বলে, ‘তোরা আনন্দ পাচ্ছিস এটাই তো যথেষ্ট। আজও যেমন উৎসবের মুখের ওপর বলে দিল, তোরা ডাক। এতদিন যখন উপযাচক হয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে যাইনি, তখন আজকেও যাব না।’ ডিপার্টমেন্টের সবার সঙ্গে কথা বললেও, তিমিরের সঙ্গে একটাও কথা বলে না ও। কারণটা ঠিক কী, সেটাও কোনোদিন বলেনি কাউকে।
শ্রাবণী ফিরে এসে বলল, ‘হল না বস। মহারাজ রাজি হলেন না।’
অতনু, সুপ্রভরা হেসে বলল, ‘সে কি রে, হল না? তোর এত সুন্দর কালার করা চুল, এমন নেল আর্ট দেখেও তিমির ভিজল না?’
বিরক্ত হয়ে শ্রাবণী বলল, ‘না, ভিজল না। ভিজবে কী করে, সে তো একজনের মধ্যেই জগৎ দর্শন করে। এখনও ডাকতে গিয়ে দেখলাম, তার চোখ আঁকছিল মন দিয়ে।’
চন্দ্রজার দিকে সব ক’টা চোখ একসঙ্গে হতেই বিরক্ত হয়ে নিজের নেলপলিশে মন দিল ও। উৎসব এবার গলাটা নামিয়ে বলল, ‘আরে চন্দ্রা, তুই সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন রে? আমাদের কাজ মিটে গেলেই কেল্লা ফতে। তারপর থোড়ি তোকে ওর সঙ্গে টাইম স্পেন্ড করতে হবে? আরে তিমিরকে দিয়ে কাজটা হবে বুঝলি। তারপর না মিশলেই মিটে গেল। অসম্ভব জেদি ছেলে রে, আমরা ডাকলে যে আসবে না, সেটা জানি। একমাত্র তোর প্রতি দুর্বলতা আছে। তাহলে সেটাকে কাজে লাগালে অন্যায় কেন হবে?’
সুপ্রভ বলল, ‘তুই তো এমন ভাব করছিস, যেন ওই তোতলাকে আমরা ছাদনা তলায় এনেছি। আর তোর মুখে পান চাপা। শুভদৃষ্টি হওয়ার আগের মুহূর্তে তুই বলছিস, না আমি বিয়ে করব না। আরে ইয়ার এটা জাস্ট একটা কম্পিটিশন। আমাদের টিমের ওকে দরকার। দ্যাটস এনাফ। তারপর ও যাবে ওর পথে, তুই তোর। নাথিং সিরিয়াস।’
চন্দ্রজা বলল, ‘আমি ডাকলেই যে আসবে এমন গ্যারেন্টি তোদের কে দিল? নাও তো আসতে পারে।’
অতনু বলল, ‘বেশ, তুই একবার ট্রাই তো কর।’
চন্দ্রজা একটু ভেবে বলল, ‘ঠিক আছে। আমি আজ নয় কাল কলেজে এসে ওকে ডাকব। আজকে ডাকলে ও বুঝতে পারবে আমরা প্ল্যান করছি। কারণ, দু’মিনিট আগেই শ্রাবণী ফিরে এসেছে।’
ওর কথায় সবাই সম্মতি দিয়ে বলল, ‘এটা ঠিক বলেছিস। কালকেই ডাকা হোক ওকে।’
চন্দ্রজা বাড়ি ফিরেই ফোন করল জিৎকে। জিৎ ফোনটা কেটে দিয়ে লিখল, ‘ব্যস্ত আছি। পরে করছি।’ চন্দ্রজা জানে এই ‘পরে’-র অর্থ আজ কখনোই নয়। এক সপ্তাহও হতে পারে। অথচ এর সঙ্গেই নাকি চন্দ্রজাকে গোটা জীবন কাটাতে হবে। চন্দ্রনাথ বসুর বন্ধুর ছেলে বলেই তাকে কেন বিয়ে করতে হবে—এটা অবশ্য চন্দ্রজা বোঝেনি। কিন্তু জিৎকে দেখার পরে ওর আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তাই বিয়ের কথাবার্তা টুকটাক এগোলেও আপত্তি করেনি চন্দ্রজা। কিন্তু মাস পাঁচেক ধরেই দেখেছে জিতের আচরণ কেমন বদলে গেছে। সবসময় ব্যস্ততা দেখায়। একটুও যেন সময় নেই ওর। এদিকে দুই বাড়ি থেকেই চায় ওরা একটু মেলামেশা করুক। সুপুরুষ, স্মার্ট, নামী কোম্পানিতে চাকুরীরত জিৎ যেন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আলাদা সময় নেই চন্দ্রজাকে দেওয়ার। মন হলে ফোনে দু’মিনিট কথা বলে, না হলে নয়। মুড ঠিক থাকলে চন্দ্রজাকে বলে, ‘মুভি যাবে? তাহলে চলে এসো।’
চন্দ্রজা ওর বলা নির্দিষ্ট জায়গায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে ফিরে আসে। কারণ সেই সময়টুকু জিতের ফোন সুইচড অফ থাকে। পরে ফোনে বলে, ‘ওহ আচমকা মিটিং এসে গিয়েছিল। পরে কোনো একদিন যাব।’
ভুলেও জিজ্ঞাসা করে না, কতক্ষণ ওয়েট করেছিলে ওখানে? বা ‘সরি’ বলে যে একটা শব্দ আছে ডিকশনারিতে, সেটাও সম্ভবত জানে না জিৎ। কারণ গত এক বছরে জিতের মুখে এর ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখেনি চন্দ্রজা। তবুও জিৎকে ওর ভালো লাগে। খুব ইচ্ছে করে জিৎও ওকে একটু মিস করুক, যেমন চন্দ্রজা করে। মা বলে, বিয়ে হলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আচমকা একটা মানুষের আজন্মলালিত স্বভাবের পরিবর্তন কীভাবে হবে, সেটাই ভেবে পায় না চন্দ্রজা। জিৎ অন্যরকম হবে কী করে? ওর মধ্যে যে খামতিগুলো আছে সেটা তো ও রিয়ালাইজও করে না। চন্দ্রজার স্কুল লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড সুলেখাকেও বলেছে জিতের কথা। সুলেখা অদ্ভুত একটা ভঙ্গিমা করে বলেছে, ‘ও বাবা, ভালো চাকরি, সুদর্শন, স্মার্ট, ভদ্র ফ্যামিলির সঙ্গে আবার ভালোবাসাও চাস নাকি তুই? শোন বস, ওসব ভালোবাসা বলে আদৌ কিছু হয় না। ওই প্রথম প্রথম ক’দিন তুমি আমার আমি তোমার হয়, তারপর সেসব কর্পূরের মতো উবে যায়। এই আমার বয়ফ্রেন্ডকে দেখ, চার বছর ধরে প্রেম করছি আমরা, কোনোদিন আমার জন্মদিনটুকু মনে রেখে উইশ করতে পারে না। আমার ফেসবুকে একটা ভুল বার্থ ডে দেওয়া হয়ে গিয়েছিল যখন অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ার নোটিফিকেশন পেয়ে যেমন অন্য স্বল্প পরিচিতরা আমায় বার্থ ডে উইশ করে আমার বয়ফ্রেন্ডও তাই করে।’
চন্দ্রজা বলল, ‘ভুল সংশোধন করে দিস না কেন?’
সুলেখার ঠোঁটে একটুকরো করুণ হাসি। বলল, ‘হয় রে? এভাবে হয়? জোর করে মনে করিয়ে কারোর থেকে শুভেচ্ছা নিয়ে সেই আনন্দটা পাওয়া যায়! এই যে প্রতিবার তুই রাত বারোটা বাজলেই আমায় উইশ করিস, এতে যে গুরুত্বটা পাই সেটা ওইভাবে আদায় করতে ইচ্ছে করে না। ও তো জানে আসল ডেটটা। আমি কিন্তু এই চার বছরে ওকে একবারও উইশ করতে ভুলিনি জানিস। আসলে ইচ্ছেটাও দরকার। সম্পর্কগুলো শুরু হয় বেশ কিছু না বলা শর্তাবলী, বেশ কিছু অলিখিত প্রতিশ্রুতি নিয়েই। তারপর একজন কবে থেকে যেন অলিখিত আর না বলার সুযোগ নিতে থাকে। কতবার মনে করাব? তাছাড়া ভালোবাসা ভিক্ষে করতে হলে বড্ড আত্মসম্মানে লাগে রে। তাই জিতের কাছ থেকে আর যাই পাস, ভালোবাসা বা গুরুত্ব এসব পাবি না জেনেই তোকে এগোতে হবে। আসলে কী জানিস, সম্পর্কটাকে যত্ন করতে কম মানুষই জানে। আরেকটা কথা, তোকে সে ভালোবাসছে কিনা এটা তুই ফিল করতে পারবি। ঠিক যেভাবে অবহেলাটা পারছিস, সেভাবে।’
সুলেখার মুখে এই সমস্ত কথা শুনে শুনে চন্দ্রজা বুঝে গেছে, ভালোবাসা বলে আদৌ কিছু নেই। কেউ ওর জন্য প্রতীক্ষা করে থাকবে না। যদিও কলেজের কেউ এখনও জিতের কথা জানে না। ইচ্ছে করেই বলেনি চন্দ্রজা। আগে জিৎকে চিনতে চায় ও। হঠাৎই যদি বাতিলের দলে ফেলে দেয় জিৎ, তাহলে অকারণে নিজের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে। তাই আগে দেখুক ওর প্রতি জিতের সামান্যতম ইন্টারেস্ট আছে কিনা, তারপর বলবে। দু’ঘন্টা হয়ে গেল, না জিতের কোনো ফোন না মেসেজ। এটাতেও অভ্যস্ত হয়ে গেছে চন্দ্রজা। ও জানে জিৎ ওকে রিং ব্যাক করবে না। বরং ও ন’টায় বাড়ি ফেরে, সেই হিসেব করে যদি চন্দ্রজা কল করে তাহলে হয়তো দু-একটা কথা হলেও হতে পারে। অথবা বলতে পারে, ‘আজ টায়ার্ড আছি, পরে কথা বলব।’ চন্দ্রজা জিজ্ঞাসা করেছিল জিৎকে, ‘তোমার কি আমায় পছন্দ নয়?’ জিৎ অবাক চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আমি তো এ প্রসঙ্গে তোমায় কোনো কথা বলিনি চন্দ্রজা। আমার চয়েস সম্পর্কে আমি তো কাউকেই কিছু বলিনি। তোমায় আমার পছন্দ না অপছন্দ এ নিয়ে তো কখনও আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি।’
চন্দ্রজা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘তাহলে আজ হোক। দুই বাড়ি থেকে আমাদের বিয়ের কথা বলছে। এর আগে আমায় তোমার পছন্দ কিনা সেটা তো জানা প্রয়োজন।’
জিৎ হালকা হেসে বলেছিল, ‘পছন্দ-অপছন্দের ওপরে বিয়ে নির্ভর করে না চন্দ্রজা। বিয়েটা একটা সোশ্যাল স্ট্যাটাস। সবাই করে, তাই আমরাও করব। দুই ফ্যামিলি পরিচিত তাই এই সম্বন্ধটা এসেছে, ব্যস। আর তো কিছু ভাবিনি এটা নিয়ে। ইনফ্যাক্ট এর থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আমার আছে। সো প্লিস, মনোটনাস জিনিস নিয়ে বেশি আলোচনা করতে আমি পছন্দ করি না।’
ঠিক কী বলা উচিত বুঝতে পারেনি চন্দ্রজা। কেমন যেন ঘেঁটে গিয়েছিল ওর চেনা জানা বিষয়গুলো। আজ যেমন আর কল করতে ইচ্ছে করছে না জিৎকে। এভাবে হয় না। দেখা যাক জিৎ আদৌ কবে কল করে ওকে। খেয়াল করেনি কখন যেন ওর দু’গাল বেয়ে নোনতা জলের ধারা নেমে এসেছে। খুব ভালো করে চিন্তা করল চন্দ্রজা। ও কি জিতের জন্য কাঁদছে? জিৎ ওকে ভালোবাসে না বুঝে কাঁদছে? নাকি আত্মসম্মানে আঘাত লাগেছে বলে কাঁদছে? অনেক খুঁজে প্রশ্নের উত্তরটা পেতেই গালটা মুছে নিল। না, জিৎ ভালোবাসে না বলে ও কাঁদছে না, ওর আত্মসম্মানে তীব্র আঘাত লাগছে বলেই কেঁদে ফেলছে। ঘরটা অন্ধকার করে অনেকক্ষণ বসে থাকল চন্দ্রজা। তারপর জিতের ফোন নম্বরটা ডিলিট করে দিল ফোন থেকে। আর হোয়াটসঅ্যাপেও ব্লক করে দিল। নিজের থেকে আর কোনো ফোন বা মেসেজ নয়। এখন শুধু ধৈর্যের পরীক্ষা চলুক। দেখা যাক কবে জিৎ ওকে কল করে। বা হোয়াটসঅ্যাপে ব্লকিংটা নোটিস করে কী না।
মনটা বড্ড খারাপ লাগছে। উঠে গিয়ে সাদা ক্যানভাসে আঁকতে শুরু করল। হোম থিয়েটারে গান বাজছে। ওর প্রিয় অরিজিৎ সিং।
বিশাল মনযোগ দিয়ে যে ও আঁকছে, তা নয়। কিছুটা আনমনেই। হঠাৎই খেয়াল হল ক্যানভাসে একটা স্টেশনের ছবি এঁকেছে। একটা ট্রেনের পিছনটুকু দেখা যাচ্ছে। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনে। ঠিক যেন লাস্ট ট্রেনটা বেরিয়ে যাওয়ার পরে মেয়েটা ভাবছে, এখন সে কীভাবে বাড়ি পৌঁছাবে! চন্দ্রজা ছবিটা ভালো করে দেখল। দূরে কোথাও কি কোনো রাস্তা এঁকেছে? যেটা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটা বাড়ি পৌঁছে যেতে পারে। এখনও আঁকা হয়নি দেখেই স্টেশনের পিছন দিকে একটা সরু রাস্তা এঁকে দিল। একটা পথ বন্ধ হয়ে গেলে আরেকটা পথ খুলে যায়, এই ভেবেই সেই রাস্তায় একটা বাস আঁকতে শুরু করল চন্দ্রজা।
মেয়েটার পরনে শেষ বসন্তের মতো ফিকে হলদে একটা শাড়ি।
‘কী রে আজ হঠাৎ শাড়ি পরে কলেজে এলি যে? আজ তো কোনো অকেশন নেই গুরু, তাহলে শাড়ি কেন? তাও আবার হলদে শাড়ি। এটা তো বসন্তকালও নয়।’
শ্রাবণী বলল, ‘তোকে আজ অন্যরকম লাগছে। মুখেচোখে একটা যন্ত্রণার চিহ্ন, অথচ তুই সেটাকে দমিয়ে রেখে জিততে চাইছিস হাসি দিয়ে।’
ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ঠোঁটটা সামান্য উল্টে চন্দ্রজা বলল, ‘এটা কাব্যিক কষ্ট নয় বস, এটা রিয়েল কষ্ট। এখুনি উৎসব আর অতনুরা এসে বলবে তিমিরকে রাজি করাতে। এখন থেকেই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, বিশ্বাস কর। শুধু প্রয়োজনের জন্য এভাবে কাউকে ব্যবহার করা আমার একেবারে অপছন্দের।’
শ্রাবণী বলল, ‘তুই একটু বেশি ভাবছিস। কেউ ওর কিডনি চাইছে না রে। ও দিনরাত আঁকছে, আমরাও ডিপার্টমেন্টের সম্মানের জন্য ওর একটা আঁকা চাইছি। ও অদ্ভুত টাইপের ছেলে তাই আসতে রাজি হল না।’
উৎসব ক্লাসে ঢুকেই বলল, ‘তিমির আসছে। সবাই ক্লাসের বাইরে চল এখুনি। একমাত্র চন্দ্রজা থাকুক।’
এবারে একটু ভয় ভয় করছে চন্দ্রজার। তিমির বেশ জেদি। ক্লাসে কারোর সঙ্গে কোনো কথা বলে না। বন্ধুরা বলে, ও নাকি তিমিরের ক্রাশ। দু-একবার ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা ছাড়া আর কোনো লক্ষণ দেখেনি ও তিমিরের মধ্যে। যদি বন্ধুরা ভুল হয়, যদি তিমির অকারণে অপমান করে! এমনিতেই মন ভালো নেই ওর। জিতের করা অকারণ অপমানের জ্বালাটা এখনও ক্ষত হয়ে ব্যথা দিচ্ছে। না, সকাল থেকে একবারও ফোন করেনি জিৎ। করবে না জানত অবশ্য চন্দ্রজা। তবুও বারবার সাইলেন্ট করা ফোনটা চেক করছিল আনমনে। এখন আবার যদি তিমির তেমন কিছু বলে দেয়, তাহলে…
ও কিছু বলার আগেই সবাই উৎসবের কথায় বেরিয়ে গেল ক্লাস থেকে। চন্দ্রজা একা বসে আছে রুমে। ঠিক দু’মিনিট পরে তিমির ঢুকল ক্লাসে। ঢুকেই এদিক-ওদিক তাকাল। ক্লাসরুম ফাঁকা কেন বোঝার চেষ্টা করছে বোধহয়। চন্দ্রজা খুব চাইছে ওকে জিজ্ঞাসা করুক তিমির। কিন্তু কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে রোজ ও যে বেঞ্চে বসে, সেই বেঞ্চে গিয়ে বসে পড়ল। অদ্ভুত ছেলে তো। ফাঁকা রুম দেখেও কোনো হেলদোল নেই। চুপচাপ বসে নিজের খাতা-পেন বের করে কিছু একটা লিখতে শুরু করল। চন্দ্রজা অপেক্ষা করছিল, হয়তো তিমির ওকে কিছু বলবে লিখে লিখে। কিন্তু পাঁচ মিনিট হয়ে গেল। কিছুই বলল না। মহাভারত রচনা নিশ্চয়ই করতে শুরু করেনি। বাধ্য হয়ে বন্ধুদের ভয়েই চন্দ্রজা উঠে গিয়ে তিমিরের ডেস্কের সামনে দাঁড়াল। তিমির একমনে খাতায় একটা স্কেচ করছে। স্কেচের মেয়েটার মুখটা ওর খুব চেনা। রোজ একে আয়নায় দেখে চন্দ্রজা। ওকে সামনে দেখে একটু যেন লজ্জা পেয়ে খাতাটা বন্ধ করে দিল তিমির। বড় বড় চোখে অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে তাকাল চন্দ্রজার দিকে। তিমিরের চোখদুটোতে যেন সমুদ্রের গভীরতা। মুখে কিছু না বলেও যেন অনেক কিছু বলে দিতে পারে তিমির ওই চোখদুটো দিয়ে। তিমিরের ঠোঁটের কোণে প্রশ্নের উঁকিঝুঁকি। যেন বলতে চাইছে, হঠাৎ ওর ডেস্কের সামনে, কিছু দরকার আছে?
চন্দ্রজা বলল, ‘একই ডিপার্টমেন্টে কাটিয়ে দিলাম এক বছরের একটু বেশি সময়, অথচ তোমার সঙ্গে আলাপ হয়নি এখনও সেভাবে, তাই আজ কথা বলতে এলাম।’
তিমির খাতায় লিখল, ‘আমি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই। আলাদা করে আলাপ করারও কিছু নেই। খুবই নগণ্য মানুষ।’
চন্দ্রজা বলল, ‘কথা বলতে পারো আমার সঙ্গে। তোমার উচ্চারণে সমস্যা থাকলেও আমি বুঝে নেব।’
একটু করুণভাবে হাসল তিমির। তারপর আবারও খাতায় লিখল, ‘করুণা আমার বড্ড অপছন্দের জিনিস। প্লিস ওটা বাদ দিয়ে কথা বলো।’
চন্দ্রজা অনেক চেষ্টা করেও তিমিরকে তুই বলে সম্বোধন করতে পারছে না। চন্দ্রজা বলল, ‘উৎসবরা আমায় পাঠাল তোমার কাছে। যদি তুমি এই কম্পিটিশনটাতে সহযোগিতা করো তাহলে সেকেন্ড ইয়ার জিতবে। তাই আমি তোমায় বলতে এলাম। তুমি রাজি না হতেই পারো। ওরা জোর করছিল বলে বাধ্য হয়েই আমি এলাম। তোমার ইচ্ছের ওপরে আমার জোর নেই।’
তিমির অপলক তাকিয়ে আছে চন্দ্রজার দিকে। কেমন একটা লজ্জা করছে চন্দ্রজার। ও মোটেই লাজুক স্বভাবের নয়। কিন্তু তিমিরের গভীর চাহনির সামনে কেমন একটা অজানা অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছে চন্দ্রজা।
চন্দ্রজা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘ওরা হয়তো তোমায় ইউজ করতে চাইছে। তোমার ট্যালেন্টকে কাজে লাগিয়ে ডিপার্টমেন্টকে জেতাতে চাইছে। কিন্তু আমি বলছি তিমির, তোমার নিজের যদি ইচ্ছা না থাকে তাহলে শুধু আমি বলতে এসেছি বলে তুমি রাজি হয়ে যেও না। নিজে ভেবে সিদ্ধান্ত নিও।’
তিমির খাতায় লিখল, ‘এতজন থাকতে তোমায় কেন ওরা এই দায়িত্ব দিয়েছে তুমি কি জানো?’
চন্দ্রজা যেন মরমে মরে গেল। ঘাড় নেড়ে বলল, ‘জানি না।’
তিমির লিখল, ‘বেশ, আমি রাজি ওদের বলে দিও। কোন বিষয়ে আঁকতে হবে আমায় জানাতে বলো, প্লিস।’
চন্দ্রজার খুশি হওয়ার কথা। খুব আনন্দ পাওয়ার কথা। কারণ তিমিরকে ও রাজি করিয়েছে। কিন্তু কেন কে জানে সেই আনন্দটা ওর হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে তিমিরের একতরফা পছন্দের সুযোগ নিচ্ছে। যেহেতু তিমির ওকে পছন্দ করে তাই ইমোশনালভাবে ওকে রাজি করাল।
তিমির খাতায় লিখল, ‘মনখারাপ করার কিছু হয়নি। তুমি বললে বলেই আমি রাজি হলাম। সেটাতেও তোমার কিছু দোষ নেই। এত হেজিটেট কেন করছ? কেন এটা ভাবছ যে, এর কারণে আমি পরে তোমার থেকে কিছু চাইব? না চাইতেই তুমি অনেক কিছু দিয়েছ আমায়। তোমার কাছে আমি কোনোদিনই কিছু চাইব না। নিশ্চিন্তে থাকো।’
চন্দ্রজা লেখাটা পড়ে বলল, ‘এই তুমি আমায় বুঝলে? তুমি কিছু চাইতে পারো ভেবে আমি হেজিটেট করছি না। বরং সুযোগ নেওয়া হল কিনা, তোমার অপছন্দ সত্ত্বেও তুমি রাজি হলে কিনা, এসব ভেবে মনখারাপ করছি।’
তিমির লিখল, ‘প্লিস আর মনখারাপ করো না। এমনিতেই তুমি মনখারাপ করে আছ কোনো কারণে। এবারে চোখের কোণের জল আর তোমার কথা শুনবে না।’
অবাক হয়ে গেল চন্দ্রজা। তিমির কী করে জানল ওর মনখারাপ হয়ে আছে আজকে?
চন্দ্রজা বলল, ‘কী করে বুঝলে আমার মনখারাপ হয়ে আছে?’
তিমির মুখটা নামিয়ে নিল। শুধু লিখল, ‘আমি বুঝতে পারি।’
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই সবাই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল ক্লাসে।
চন্দ্রজা বলল, ‘তিমির রাজি। ও আঁকবে আমাদের ডিপার্টমেন্টের হয়ে।’
উৎসব ছুটে গিয়ে তিমিরকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাঁচালি ভাই। ইজ্জত কা সওয়াল। তোর ওপরে আমাদের ভরসা আছে।’
তিমির মিটিমিটি হাসছিল।
চন্দ্রজা বলল, ‘কোনো বিশেষ বিষয়ের ওপর আঁকতে হবে, এমন কিছু বলেছে?
তিমির জানতে চাইছিল।’
উৎসব বলল, ‘ইউনিক কিছু এঁকে দে ভাই। সবার যেন চোখ ট্যারা হয়ে যায়। ক্লাসে বেশ একটা উত্তেজনা চলছে। তার মাঝেই বারকয়েক তিমিরের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল চন্দ্রজার। অন্যদিনও হয় হয়তো, কিন্তু সেভাবে খেয়াল করেনি কোনোদিন।
চন্দ্রজার ফোনে জিতের কোনো ফোন আসেনি গত তিন দিনে। ও জানে আসবেও না, তবুও একটা অভিমানভরা আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল। বাবংবার ফোন যে চন্দ্রজাই করত সেটা এই ক’দিনে আরও বেশি করে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। ওদিক থেকে সব চুপচাপ।
সুলেখার ফোন থেকে জিতের ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা দেখল আজ বিকেলে। যথারীতি বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে চিল আউটের ছবি আপলোড করেছে। অনেক খুঁজেও জিতের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে নিজেকে পেল না চন্দ্রজা।
কলেজে যেটুকু সময় ও থাকে, সেটুকু সময় বন্ধুদের সঙ্গে বেশ কেটে যায়। বাড়িতেও বাবা-মা রোজই কোনো না কোনো কারণে জিতের প্রসঙ্গ তোলে। বারণ করলেও ওদের ভ্রূক্ষেপ নেই। ওরা ধরেই নিয়েছে বিয়েটা হচ্ছেই।
ইদানীং জিতের প্রসঙ্গ উঠলেই নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে এ বাড়িতে। এমন কেউ নেই যার কাছে ও এগুলো শেয়ার করতে পারে। চূড়ান্ত বিরক্তিকর অবস্থা।
কলেজে ঢুকতেই শ্রাবণী বলল, ‘তোকে একবার তিমির ডেকেছে। মানে আমাকে ইশারায় জানতে চাইছিল তুই এসেছিস নাকি।’
চন্দ্রজা বলল, ‘তিমির কোথায়?’
শ্রাবণী ওর হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বলল, ‘এই নে।’
চিরকুটটা খুলতেই চন্দ্রজা দেখল, তিমির লিখেছে—আজ একবার আমার বাড়িতে আসতে হবে তোমায় কলেজ ছুটির পরে। খুব প্রয়োজন।
বিরক্তিতে ভ্রূটা কুঁচকে গেল চন্দ্রজার। শিল্পী, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, লুকিয়ে ওকে দেখা—এসব নাটকের যবনিকা পড়ে গেল এত সহজেই! একদিন একটু সহজ ব্যবহার করেছে বলে বাড়িতে ডাকতে সাহস পেয়ে গেল তিমির! হয়তো বাবা-মা থাকবে না, সেই সুযোগে ডাকছে ও। ভাবতেই গা’টা গুলিয়ে উঠল ওর। একটু শীতলতা তো দিতে পারত তিমির ওকে। বট না হোক কাঠচাঁপা গাছের ছায়াটুকুও যদি দিত হয়তো চন্দ্রজা নতুন করে ভাবতে শুরু করত। কিন্তু না, সবাই সেই একই ছাঁচে গড়া। জিতের সঙ্গে ওর ফাঁকা বাড়িতে যেতে চায়নি বলেই না জিতের আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই ওর প্রতি। তিমির হঠাৎ আলাদা হবে, এমন ধারণা হলই বা কোথা থেকে ওর! চিরকুটটা হাতের মধ্যে মুচড়ে ধরল চন্দ্রজা। তিমির ক্লাসে ঢুকছে দেখেই চন্দ্রজা বলল, ‘আজ কলেজ ছুটির পরে একসঙ্গেই তাহলে তোমার বাড়ি যাব।’
তিমিরের মুখে প্রাপ্তির হাসি।
চন্দ্রজা দেখতে চায় তিমির ঠিক কতটা নীচে নামতে পারে। এতদিন চোখের সামনে এক ধ্যানমগ্ন শিল্পীকে দেখে এসেছে। সাদা ক্যানভাস আর রং-তুলি যার একমাত্র সাধনা। তার মধ্যে কতটা পাশবিক প্রবৃত্তি লুকিয়ে আছে সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছে ও। ক্ষতি করবে চন্দ্রজার? করুক। একজন মনটাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে গেছে। আরেকজন না হয় শরীরটাকে দেবে। একটা অদ্ভুত বোকা বোকা জেদ মাথা চাড়া দিল ওর মধ্যে। অন্যমনস্কভাবে কেটে গেল সময়টা। প্রফেসরের লেকচারের সময়েও বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল তিমিরের দিকে। সে একমনে শুনছে লেকচার। মুখের কোনো রেখায় লোভ নেই। কী সুন্দর অভিনেতা। দক্ষ শিল্পীর সঙ্গে দক্ষ অভিনেতাও!
কলেজ থেকে বেরিয়েই দেখল তিমির দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে এগিয়ে এল বাইক নিয়ে। পিছনের সিটে হাত দিয়ে বসতে বলল।
চন্দ্রজার আজ আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। তিমির ওকে এই চোখে দেখত এতদিন! ফাঁকা বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইত! কষ্ট হচ্ছে ওর। বুকের বাঁ-দিকে চিনচিনে একটা অব্যক্ত কষ্ট। এর থেকে ভালো হত যদি কখনো তিমিরের সঙ্গে কথা না হত। ওই বন্ধুদের মাধ্যমে জানত, তিমির ওকে ভালোবাসে, তাহলেই বোধ হয় ভালো হত।
তিমির কোনো কথা না বলে বাইক চালাচ্ছে। চন্দ্রজা আকাশ-পাতাল ভাবছে। হঠাৎই ব্রেক কষে দাঁড়াতে সম্বিৎ ফিরল চন্দ্রজার। বেশ বড়সড় একটা তিনতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তিমির। তিমিরকে দেখে বা ওর হাবভাব দেখে বোঝা যায় ও ছা-পোষা মধ্যবিত্ত। এই বাড়িটা যে ওদের নয় বেশ বুঝতে পারছে চন্দ্রজা। বাড়ির সামনেই গ্যারেজে গাড়িও রয়েছে। তিমির ওকে নামতে নির্দেশ করল।
ওই গাড়ির পাশেই নিজের বাইকটা ঢুকিয়ে দিয়ে ইশারায় ভিতরে যেতে বলল। এতক্ষণে চন্দ্রজার ভয় করছে। এভাবে রিস্ক নেওয়া উচিত হয়নি ওর। রোজ খবরের কাগজ খুলেই দেখে গ্যাং রেপ থেকে শুরু করে আরও কত কী! চন্দ্রজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত ধরে টানল তিমির।
বাড়ির দরজা খুললেন একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। মহিলার চেহারায় বেশ সম্ভ্রান্ত ভাবভঙ্গি। বুকের মধ্যে শিরশিরে ভয়টা একটু যেন প্রশমিত হল মহিলাকে দেখে।
মহিলা হেসে চন্দ্রজার হাতটা ধরে বললেন, ‘তুমি চন্দ্রজা তাই না? তুতাইয়ের ব্যাচমেট। এসো, ভিতরে এসো।’
চন্দ্রজা কিছু বোঝার আগেই একটা বছর সতেরোর মেয়ে এসে চন্দ্রজাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, ‘তুমিই দাদার সব ছবির কমন ক্যারেক্টার? ছবিতে তোমায় রোজ দেখি। আজ সামনে দেখলাম।’
তিমির এতক্ষণ ইশারায় চালাচ্ছিল। এবারে বোনকে ধমকে উঠে বলল, ‘চুপ করবি? চন্দ্রজা আমার ফ্রেন্ড।’
চন্দ্রজা জানতই না তিমিররা এতটা ধনী। ওর ভাবভঙ্গিমায় এত কুণ্ঠা মিশে থাকে যে, মনে হয় নিতান্ত মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে ও। চন্দ্রজা তিমিরদের থেকে অনেকটাই বিলো স্ট্যান্ডার্ডে বিলং করে। যদিও ওর হাবে-ভাবে কখনও সেটা কাউকে বুঝতে দেয়নি।
তিমিরের উচ্চারণে সমস্যা হয় বলেই বোধহয় ও বাড়িতেও কম কথা বলে। তিমিরের বাবা নিউরোলজিস্ট। ওর মা ব্যাঙ্কে জব করেন। ওর মা চন্দ্রজার সামনে একটু আফসোস করেই বললেন, ‘ভগবান বোধহয় হিংসে করেই তুতাইয়ের কাছ থেকে ওর সাবলীল কথা বলার ক্ষমতাটা কেড়ে নিয়েছেন। আর কত দেবেন একটা ছেলেকে? আমার ছেলে বলে নয়, এত গুণ কোনো ছেলের মধ্যে থাকে না চন্দ্রজা।’
তিমিরের বোন ঠোঁট উল্টে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি তো বেগুন। দাদাই বেস্ট বয়।’
চন্দ্রজা তমালীকে পাশে বসিয়ে বলল, ‘আমার তো মনে হচ্ছে দাদার থেকেও দাদার বোন বেশি গুণের। দাদাটা তো মিশুকে নয় মোটেই। একগুঁয়ে আর জেদি। রাগ যেন নাকের ডগায়। শান্ত হলে কী হবে, ভিতরে রাগ গনগন করে।’
আড়চোখে দেখল তিমিরের ঠোঁটে হাসি।
চন্দ্রজার মনটা পাখির মতো ডানা মেলতে চাইছে অনেকদিন পরে। নিজের ভাবনাগুলো মিথ্যে হওয়ায় ও যে এতটা খুশি হবে, নিজেই ভাবতে পারেনি।
তমালী বলল, ‘ঠিক বলেছ দি। দাদা অমন শান্ত দেখতে হলে কী হবে, একবার যা বলে দেবে, সেটাই শেষ কথা। এই দেখো না, এত করে আমরা সবাই বললাম জন্মদিনে একটা পার্টি থ্রো করি। ওর কলেজের বন্ধুরা আসুক। আমার স্কুলের বন্ধুদের ডাকি আর বাবা-মায়ের কলিগরা আসুক। কিন্তু দাদার কড়া নির্দেশ ওর আজকে জন্মদিন, সেটা কাউকে বলাই যাবে না।’
চমকে উঠল চন্দ্রজা। আজ তিমিরের বার্থ ডে! অদ্ভুত ছেলে তো। সেসব না বলে ওকে কলেজ থেকে তুলে নিয়ে বাড়িতে চলে এল। চন্দ্রজা কোনো উপহারও আনেনি।
তমালী বলল, ‘তুমি দাদার একমাত্র বন্ধু যে দাদার জন্মদিনে এ বাড়িতে এলে। মায়ের লাডলা বলে মা অবশ্য ঘরোয়াভাবে সবটুকুই করে।’
তমালীর কথা শেষ হওয়ার আগেই তিমিরের মা বললেন, ‘চন্দ্রজাকে নিয়ে খাবার টেবিলে আয়।’
খাবার টেবিলে গিয়ে চমকে গেল চন্দ্রজা। বিশাল আয়োজন। পোলাও, চিংড়ি, মাংস, মাছ, পায়েস থেকে আইসক্রিম অবধি!
ওর মা বললেন, ‘তুমি আর তিমির খেয়ে নাও। কলেজে ছিলে, সেই কখন খেয়েছ।’
চন্দ্রজা দেখেই আঁতকে উঠে বলেছিল, ‘এত খাবার আমি খেতে পারব না আন্টি।’
তিমিরের মা বলেছিলেন, ‘খুব পারবে।’
তিমির চন্দ্রজার চেয়ার টেনে দিয়ে বলেছিল, ‘ওকে কিছু নিয়ে জোর করো না মা।’
চন্দ্রজা তিমিরের কানের কাছে এসে বলেছিল, ‘শুভ জন্মদিন। উপহারটা কালকে দেব।’
তিমির লাজুক মুখে খাবারের থালায় হাত দিয়েছিল।
চন্দ্রজা বলেছিল, ‘চিংড়ির মালাইকারি আমার খুব পছন্দের।’
তিমির নিজের বাটিও ওর দিকে এগিয়ে দিয়েছিল নীরবে। চোখের ইশারায় বলেছিল, এটাও তোমার। তিমিরের মা খুব যত্ন করে খাইয়েছিলেন ওদের।
তিমির নিজের খাওয়ার থেকে বেশি নজর রেখেছিল চন্দ্রজার প্রতি। ওর নিজেরই লজ্জা করছিল এত যত্ন দেখে। খাওয়ার পরে তিমির নিয়ে গেল ওর তিনতলার ঘরে। ওর বেডরুমের পাশেই একটা বিশাল রুম জুড়ে ওর স্টুডিও।
তিমির বলল, ‘এসো। তবে রাগ করো না প্লিস।’
চন্দ্রজা বলল, ‘উচ্চারণে প্রবলেম আছে বলে কথা বলাই বন্ধ করে দেওয়া কী উচিত ছিল তিমির? সকলের সবকিছু তো পারফেক্ট থাকে না তাই না? তোমার উচ্চারণ পারফেক্ট নয়, তবুও গোটা ডিপার্টমেন্টকে তোমার পায়ে ধরতে হল এই কম্পিটিশনটা জেতার জন্য। তার মানে, তোমার যথেষ্ট যোগ্যতা আছে তাই না তিমির? তাহলে অকারণে কথা না বলে এভাবে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না।’
তিমির এসব নিয়ে কথা না বাড়িয়ে একের পর এক ক্যানভাসে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। প্রত্যেকটাই চন্দ্রজার ছবি। ছবির চন্দ্রজা যেন বাস্তবের থেকেও বেশি সুন্দর। ঈশ্বর বোধহয় ওকে গড়ার সময় এতটা যত্ন করেননি যতটা যত্ন করে এঁকেছে তিমির। যে যে পোশাক পরে চন্দ্রজা কলেজে গেছে তার বোধহয় প্রতিটার ছবিই আছে ওর কাছে। চন্দ্রজার লজ্জা করছে। হাত-পা ঘামছে ওর। এভাবে কেউ ওকে নজরবন্দি করে রেখেছে ভেবেই লজ্জা আর সুখের আবেশে ছেয়ে যাচ্ছে ওর সমস্ত মন। কারোর কাছে ও এতটা গুরুত্বপূর্ণ, ভাবতেই পারছে না চন্দ্রজা।
তিমির লাজুক গলায় বলল, ‘এই একজন মডেলকে আমি সামনে না বসিয়েও চোখ বন্ধ করে আঁকতে পারব।’
কথাটা বলতে গিয়ে বার চারেক আটকাল বলে সংকুচিত হয়ে গেল তিমির।
চন্দ্রজা ওর হাতটা আলতো করে ধরে বলল, ‘আমি যে সুন্দরী আমি নিজেও তো জানতাম না। আয়নাও কখনও বলেনি আমায়। একমাত্র তোমার ছবিই প্রথম আমায় সুন্দরী বলল।’
তিমির থেমে থেমে বলল, ‘চন্দ্রজা এই প্রতিযোগিতার জন্য একটা ছবি আঁকতে শুরু করেছি। একটু দেখো, ভুল কিছু দেখলে সাজেস্ট করো।’
চন্দ্রজা তখনও ঘোরের মধ্যে আছে। চারিদিকে ওর ছবি। এই স্টুডিওর মালকিন যেন শুধুই ও। আর চিত্রকরের মনে যে ওর একাধিপত্য, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিমির একটা ক্যানভাসের ওপর থেকে স্বচ্ছ কাপড়টা সরিয়ে দিল।
স্তম্ভিত হয়ে দেখছে চন্দ্রজা।
একটা মাল্টিপ্লেক্সের সামনে জিৎ নামছে গাড়ি থেকে। অপেক্ষারত চন্দ্রজাকেই দেখা উচিত ছিল ওখানে। কিন্তু তিমির এঁকেছে গাড়ি থেকে নামছে জিৎ, ওর চোখ দুটো যেন কাউকে খুঁজছে। ওদিকে একটি মেয়ে মুখাবয়ব অনেকটা চন্দ্রজার মতো, হাতে একগুচ্ছ বেলুন নিয়ে বাচ্চাদের বিলি করেছে। মেয়েটির চোখ ভর্তি জল, মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। যেন কোনো পিছুটান নেই মেয়েটার। পৃথিবীতে কোথায় কী চলছে সেদিকে যেন ভ্রূক্ষেপ নেই। দূরে গাছতলায় দাঁড়িয়ে একজন চিত্রশিল্পী ক্যানভাসে কিছু এঁকে চলেছে।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে চন্দ্রজা। ফিসফিস করে বলল, ‘জিৎকে তুমি চিনলে কী করে?’
তিমির বলল, ‘ওই পথ দিয়েই আসছিলাম সেদিন। দেখলাম তুমি প্রায় ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করছিলে। আমিও দূরে দাঁড়িয়ে তোমায় দেখছিলাম। তারপর তোমার ভালোবাসার মানুষটি এল। ভেবেছিলাম তুমি রাগ করবে, চেঁচামেচি করবে। কিন্তু দেখলাম, ওই ছেলেটি দু’মিনিট তোমার সঙ্গে কথা বলে গাড়ি করে চলে গেল। তুমি একা দাঁড়িয়ে থাকলে। ওই অবস্থায় তোমায় দেখতে ভালো লাগছিল না। ছবির তুমি আমার কল্পনা। তুমি অন্য কোথাও আনন্দ খুঁজে নিতে পারো। জিতের ওপরে তুমি নির্ভরশীল নও। সেই ভাবনা থেকেই এঁকেছি ছবিটা।’
চন্দ্রজার কান্না পাচ্ছিল। জিতের অপমানটা তিমির দেখেছিল বলে, নাকি তিমির ওকে অন্যরূপে এঁকেছে বলে, সেটা ও নিজেও বুঝতে পারছে না।
তিমির তাড়াতাড়ি ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, ‘আমি তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি। প্লিস আমায় ক্ষমা করো। আমি তোমার ফিয়ঁন্সের নামেও কিছু বলতে চাইনি। তোমরা ভালো থেকো।’
তিমির চুপ করে গেল। চন্দ্রজাও চুপ। একমাত্র নীরবতা অনেক কথা বলে যাচ্ছে কানে কানে। চন্দ্রজার মনে হচ্ছে, তিমিরকে কি বলে দেওয়া উচিত, জিতের সঙ্গে ওর ওইটুকু অবহেলার সম্পর্কও আর অবশিষ্ট নেই? না থাক, তিমির যদি ভাবে চন্দ্রজার দোষ ছিল এই ভাঙনে।
তিমির বলল, ‘চন্দ্রজা, আমি জানি আমার কথা বুঝতে তোমার অসুবিধা হচ্ছে। তবুও আরেকটা কথা বলতে চাই, এই ছবিটাকে আরেকটু নিখুঁত করার জন্য তোমার হেল্প লাগবে। মাত্র আধঘন্টার জন্য আমার মডেল হবে?’
চন্দ্রজা সামনের চেয়ারে বসে পড়ল।
তিমির চন্দ্রজার জল টলটল চোখদুটো আর ঠোঁটের কোণের হাসিটাকে আরও নিখুঁত করে ফোটানোর চেষ্টা করছে ছবিতে। চন্দ্রজার থুতনির ভাঁজে এসে বেশ কিছুক্ষণ তুলি বোলাল।
চন্দ্রজা নিজেও চিত্রশিল্পী। কিন্তু এমন ধ্যানমগ্ন হতে পারেনি এখনও পর্যন্ত। তিমিরকে দেখে মনে হচ্ছে, ওর বাহ্যিক কোনো জ্ঞান নেই। মগ্ন হয়ে রয়েছে ওই ছবিতে। প্রতিটা বাচ্চার মুখে আলাদা আলাদা এক্সপ্রেশন। কেউ বেলুনের দিকে হাত বাড়িয়েছে, নেওয়ার ইচ্ছে ষোলো আনা, কিন্তু চোখে অনেকটা সংশয়।
একটি বাচ্চা মেয়ের চোখে রয়েছে বিস্ময়, কেন হঠাৎ বিনামূল্যে কেউ বেলুন দিচ্ছে ওদের সেটাই যেন ভাবছে। একজনের ঠোঁটে সব প্রাপ্তির হাসি। আরও দুজন দৌড়ে আসছে বেলুন শেষ না হয়ে যায় সেই আশঙ্কায়।
চন্দ্রজা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিমিরের আঁকার দিকে। এত নিখুঁত কেউ কীভাবে আঁকতে পারে!
তিমির আচমকা উঠে এসে চন্দ্রজার মুখটা একটু বাঁ দিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘আর দু’মিনিট এইভাবে থাকো।’
তিমিরের কাজ শেষ। ওর মা, বোনের সঙ্গে দেখা করে বাইরে এসে দাঁড়াল চন্দ্রজা। তিমির ওকে বাইকে চাপিয়ে বাড়ির কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘আজকের দিনটা আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ দিন।’
চন্দ্রজার বলা হল না, এটা ওরও জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। এত গুরুত্ব যে ওকে কেউ দিতে পারে, এই ধারণাই ছিল না ওর।
বাড়ির গেটের সামনে জিতের গাড়িটা রয়েছে দেখেই অবাক হল। হঠাৎ হল কী জিতের? ওদের বাড়িতে চলে এসেছে! চন্দ্রজার অভিমান কবেই বা ওর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল যে, একটাও ফোন না করে একেবারে বাড়িতে চলে এল রাগ ভাঙাতে!
বাড়িতে ঢুকেই দেখল চন্দ্রজার মা গদগদ হয়ে একজনকে খুব আদর আপ্যায়ন করছে।
চন্দ্রজা ঢুকতেই বলল, ‘কী রে, এত দেরি হল আজ? এক্সট্রা ক্লাস এতক্ষণ চলছিল? দেখ কে এসেছে। ইনি জিৎদের বাড়ির ড্রাইভার। জিৎ আরও একটা শো-রুম ওপেন করেছে। তাই মিষ্টি পাঠিয়েছেন ওর মা। বেশ কয়েক প্যাকেট মিষ্টি ছড়িয়ে রয়েছে ডাইনিং টেবিলে।’
ড্রাইভারকে দিয়ে মিষ্টি পাঠিয়ে ভদ্রতা দেখাতে চাইছে জিৎ? নাকি জিৎ জানেই না, ওর মা পাঠিয়েছে? সত্যি বলতে কী, আর কোনো আগ্রহ নেই চন্দ্রজার জিতের প্রতি। জিতের কিছু দেওয়ার নেই ওকে। টাকা ছাড়া আর জিতের আছেই বা কী?
না আছে মন, না আবেগ, না ভালোবাসা, কিছুই নেই জিতের। যান্ত্রিক জীবন ছাড়া আর কিছুই দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া চন্দ্রজার অপেক্ষারাও আজ ঘুমিয়ে গেছে। তারাও আর জিতের জন্য রাত জাগতে নারাজ।
নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল চন্দ্রজা। ঠিক তখনই জিতের ফোনটা এল।
অনাগ্রহে ফোনটা রিসিভ করতেই জিৎ বলল, ‘কী ব্যাপার, কল করোনি ক’দিন? ব্যস্ত আছ নাকি? তা ভালো। তুমি যত ব্যস্ত থাকবে তত আমায় বিরক্ত কম করবে। তত আমি মনযোগ দিয়ে কাজ করতে পারব। আর উন্নতি ততই বাড়বে। মিষ্টি খেয়েছ? রবীনকে দিয়ে মা পাঠিয়েছে তোমাদের বাড়ি। কলকাতার বেস্ট দোকানের মিষ্টি। সাধারণ মানুষের যেগুলো নাগালের বাইরে সেগুলোকে কব্জা করেই আমার শান্তি। আমি একটা শো-রুম ওপেন করলাম। জুয়েলারির শো-রুম। এসে দেখে যেও একদিন।’
চন্দ্রজার ক্লান্ত লাগছে। আর বারবার মনে হচ্ছে, টাকা ছাড়া এই লোকটার কি কিছুই নেই?
ফোনটা রেখে দিল চন্দ্রজা।
আজ শুধুই ভাবতে ইচ্ছে করছে ওর। স্বপ্ন স্বপ্ন একটা দিন শুধুই ওকে ঘিরে। কিন্তু চন্দ্রজা জানে, তিমিরকে নিয়ে ভবিষ্যতের পথে যখনই পাড়ি দিতে যাবে তখনই এই সুখস্বপ্নটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাবে। কারণ চন্দ্রজার বাবা কিছুতেই মেনে নেবে না তিমিরকে। তিমির তোতলা বলে নয়, তিমির জিতের মতো অহংকারী নয় বলে। বাবার বোধহয় জিতের ওই ডোন্ট কেয়ার ভাবটাই বেশি পছন্দের। দিনরাত নিজের স্ট্যাটাস নিয়ে অন্যকে ছোট করার মানসিকতাটাই বোধহয় বেশি পছন্দ ওর বাবার। শুধু বন্ধুপুত্র বলে এই আবেগ, নাকি, এভাবে নিজেকে আরেকটু ওপরে তোলার ইচ্ছে— সেটা অবশ্য বুঝতে পারেনি চন্দ্রজা।
অন্যমনস্কভাবেই তিমিরকে লিখল, ‘তোমাদের বাড়িতে কাটানো সময়টা ভুলব না আমি।’
তিমির হোয়াটসঅ্যাপে অন নেই। লিখেই ডিলিট করে দিতে ইচ্ছে হল। ঠিক তখনই তিমির লিখল, ‘তোমায় একটা জিনিস পাঠাচ্ছি দেখো।’
একটা ছবি এঁকেছে তিমির। চন্দ্রজা একমনে খাবার টেবিলে খাচ্ছিল যখন সেই মুহূর্তকেই তুলে ধরেছে তিমির।
চন্দ্রজা লিখল, ‘মডেল চেঞ্জ করো। না হলে একঘেয়ে হয়ে যাবে যে।’
তিমির লিখল, ‘মডেল আমি চেঞ্জ করব না, যদি তোমার উডবি এসে আমার নাক ফাটিয়েও দেয়, তবুও মডেল চেঞ্জ হবে না।’
চন্দ্রজা লিখল, ‘তিমির তোমার আঁকা সব ছবি নিয়ে, একটা আর্ট গ্যালারি ভাড়া করে এক্সিবিশন করতে পার।’
তিমির বলল, ‘উঁহু, এই ছবিগুলো বিক্রি নেই। অন্য কারোর দেখার অধিকারও নেই। শুধু তোমার জন্মদিনে তোমায় একটা গিফ্ট করতে পারি।’
‘শুভরাত্রি’ লিখে অফ হয়ে গেল তিমির। চন্দ্রজার ইচ্ছে করছিল সারারাত কথা বলে যেতে।
ধ্রুবতারাকে চিনতে না পারাটা একমাত্র নাবিকের ব্যর্থতা, এতে ধ্রুবতারার কিছু বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। তিমির হচ্ছে ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল। ওকে নিজের করে পাওয়ার যোগ্যতা চন্দ্রজার নেই। তাই তো ওর বাড়ির একতলায় এখন জোরকদমে জিতের বাড়ি থেকে পাঠানো নামি দোকানের মিষ্টি নিয়ে আহ্লাদিত হচ্ছে ওর বাবা-মা।
তিমিরের আঁকা ছবি ওদের কম্পিটিশনে ফার্স্ট হয়েছে। এই প্রথম সেকেন্ড ইয়ার জিতেছে থার্ড ইয়ারের কাছে। উৎসব আজ সবাইকে খাওয়াবে বলেছে চাঁদনী রেস্টুরেন্টে। কিন্তু গোটা কলেজ তিমিরের আঁকা ছবিতে বেলুন বেলানো মেয়েটাকে বেশ ভালোই চিনতে পেরেছে। অনেকে ঈর্ষা করেছে। এমন শিল্পীর ক্যানভাসে চন্দ্রজার মতো সাধারণ চেহারার মেয়ে স্থান পেয়েছে দেখে অনেকেই ফিসফিস করেছে। অনেকেই আঙুল দেখিয়ে বলেছে, ‘দেখ, ওই মেয়েটাই ছিল ছবিতে।’
চন্দ্রজা সেই মুহূর্তগুলো শুধুই উপভোগ করেছে। বারবার মনে হয়েছে, তিমিরের দেওয়া সম্মান, ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরা উচিত ওর। বাবা-মা, জিৎ, দুই ফ্যামিলি এসবকে তুচ্ছ করে শুধুই তিমিরের হাতটা শক্ত করে ধরা উচিত। এত সম্মান, এত ভালোবাসা ওকে আর কেউ কোনোদিন দিতে পারবে না।
চন্দ্রজার বাবা বলে দিয়েছে, আর মাত্র একটা বছরের অপেক্ষা। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলেই জিতের সঙ্গে ওর বিয়েটা দিয়ে দেবে। তারপর পড়াশোনা করুক, ও বাড়িতে কোনো আপত্তি নেই।
অন্যের ইচ্ছের ওপরে চলছে চন্দ্রজার প্রতিটা মুহূর্ত।
তিমিরকে ঘিরে আজ কলেজে উচ্ছ্বাস। শান্ত, নির্বিবাদী ছেলেটাকে ঘিরে সবাই মেতে আছে। তিমিরের চোখে খুশি উপচে পড়ছে।
চন্দ্রজা ব্যাগ থেকে বের করে একটা কফি মাগ ওর হাতে দিয়ে বলল, ‘আজকের জন্য আমার তরফ থেকে গিফ্ট।’
তিমির আড়ালে গিয়ে প্যাকিংটা খুলেই চমকে উঠে বলেছিল, ‘চন্দ্রজা আমি কীভাবে তোমার মডেল হলাম? এটা তো আমার হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি। কাপের গায়ে আমি নিজে? তুমি আমায় আঁকলে চন্দ্রজা? এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর তো কিছুই নেই আমার কাছে।’
চন্দ্রজা হেসে বলেছিল, ‘আমি তোমার মতো নিখুঁত শিল্পী নই। তাই যা যা ভুল চোখে পড়ছে সেগুলো জাস্ট হজম করে নিও।’
তিমিরের চোখে জল। ছোট্ট করে বলল, ‘কেউ কখনও আমায় আঁকেনি তুমি ছাড়া।’
তিমির জানত, চন্দ্রজার সঙ্গে জিতের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তাই বন্ধুত্বের থেকে বেশি কিছু দাবি করেনি কখনও। চন্দ্রজার সঙ্গে খুব শান্ত নির্মল বন্ধুত্ব রেখেছিল ও।
চন্দ্রজা জানত, তিমির শুধু ওকেই ভালোবাসে। ও নিজেও তিমিরকে ভালোবাসত কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি কখনও। শুধু জানত, কেউ একজন আছে এই পৃথিবীতে যে ওর জন্য অপেক্ষায় আছে। ওকে নীরবে ভালোবাসে। এই অনুভূতিটুকুই যেন চন্দ্রজার বেঁচে থাকার প্রেরণা ছিল। তিমিরের সবটুকুতে ও মিশে আছে এই উপলব্ধিটাই যেন পরম প্রাপ্তি ছিল।
থার্ড ইয়ারের শেষের দিকেই চন্দ্রজার বাড়িতে বিয়ের শপিং শুরু হয়ে গিয়েছিল। জিতের ব্যবহার আলাদা করে কিছুই বদলায়নি। চন্দ্রজার কোনো গুরুত্ব নেই ওর জীবনে। ও একেবারেই বাড়তি, না হলেও চলে। তবুও চন্দ্রজা জিতের সহধর্মিনী হতে চলেছে। নিজের সবটুকু আত্মসম্মান বলি দিয়ে ও জিতের জীবনসঙ্গিনী হতে চলেছে।
‘কী হল বৌদিমনি, এত ডাকছি শুনতে পাচ্ছ না? কাঁদছ কেন?’
বাহান্ন ইঞ্চি টিভির পর্দা জুড়ে তিমিরের মুখ। একটা সাক্ষাৎকার চলছে টিভিতে। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক আর্ট ফেস্টিভ্যালে বিচারক হিসাবে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন তিমির রায়। সেই অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইছে চ্যানেল।
প্রায় চারবছর পরে তিমিরকে টিভির পর্দায় দেখল চন্দ্রজা। ওর বিয়ের পরে তিমিরের সঙ্গে ইচ্ছে করেই আর যোগাযোগ রাখেনি চন্দ্রজা। অকারণে তিমিরের ক্ষতকে রক্তাক্ত করতে ইচ্ছে করেনি আর। তাই জিতের সঙ্গে নিজেকেও আস্তে আস্তে যন্ত্রমানবে পরিণত করে নিয়েছে। বেশ আছে বড়লোকের বউ হয়ে। আবেগহীন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
তিমিরও চেষ্টা করেনি যোগাযোগের। ধীরে ধীরে ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল।
সেই বিয়ের রাতেই যা তিমির এসেছিল চন্দ্রজার বাড়িতে। অন্য কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে। নিজের আঁকা একটা সুন্দর ছবি উপহার দিয়েছিল। সেই ছবিটা এখনও টাঙানো আছে চন্দ্রজার বেডরুমে। ওর হাতে জিতের হাত, একটা বৃষ্টিভেজা বিকেল, মেঘের আড়াল থেকে সূর্য উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেছিল চন্দ্রজা। খুঁজতে চেয়েছিল এই ছবি আঁকার সময় ক্যানভাসে তিমিরের চোখের জল পড়েছে কিনা। কিন্তু তিমির নিখুঁত শিল্পী, তাই খুঁজে পায়নি নোনতা জলের দাগ। পেলে হয়তো খুশি হত চন্দ্রজা। তিমির তো জোর করতে পারত, নিদেন একটা প্রোপোজ! প্রোপোজ করলেই কি চন্দ্রজা ওর পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারত? কেন যে কলেজের প্রতিযোগিতায় ওকেই ডাকতে পাঠানো হল তিমিরকে। কেন যে…
তিমিরের সেই উচ্চারণে সমস্যা এখনও আছে। একটু থেমে থেমেই কথা বলছে। সঞ্চালক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শিল্পীদের নাকি একাধিক প্রেম হয়। আপনার জীবনে তেমন কেউ আছেন নাকি?’
তিমির হেসে বলল, ‘আমার জীবনে প্রেম একটাই ছিল। এখন যার সঙ্গে জীবন কাটাব স্থির করেছি সেটা সমঝোতা। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে প্রেমের রূপ নিলে আমি খুশি হব।’
বহুদিন পরে আজ খুব খুশি হল চন্দ্রজা। একজনের জীবনে সে অন্তত একক রয়েছে এখনও। তিমির তো বলল, প্রেম একটাই হয়েছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অদ্ভুত একটা হিংসে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর একচ্ছত্র আসনটা কেউ একজন ভরাট করে দিতে এসে গেছে। হয়তো আস্তে আস্তে ভুলে যাবে তিমির ওকে। মনে মনে বলল, প্লিস তিমির আমায় ভুলে যেও না। তুমিও আমার মতোই মানিয়ে নিয়ে সংসার করো, তোমার ক্যানভাস জুড়ে আমিই থাকতে চাই আজীবন।
চন্দ্রজা তাকাতেই পদ্ম বলল, ‘বৌদিমনি, রাতে কী রান্না হবে জিজ্ঞাসা করছে বামুন।’
চন্দ্রজা নিজের গাল মুছে রান্নাঘরে গেল নির্দেশ দিতে।
আজ কতক্ষণ ধরে যে সেই ফেলে আসা পথে ও হেঁটে বেড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এমন মাঝে মাঝে পুরোনো পথে এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ালে মন্দ হয় না। জমাট বরফগুলোও মুক্তি পায় একটু।
দ্রুত পায়ে রান্না ঘরের দিকে এল চন্দ্রজা। কানের কাছে অনুরণন হয়ে চলেছে, ‘আমার জীবনে প্রেম একটাই ছিল। এখন যার সঙ্গে জীবন কাটাব স্থির করেছি সেটা সমঝোতা।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন