অর্পিতা সরকার
‘মিন তিমাসি তুমি বাবাকে নিয়ম করে ওষুধগুলো দাও তো? বাবার এই ভুলভাল বকার রোগটা দেখছি কিছুতেই সারছে না। মা মারা যাওয়ার পরে সাময়িক ট্রমা মনে করেছিলাম। দেখতে দেখতে প্রায় একবছর হয়ে গেল, এখনও বাবা সবসময় চন্দনা বলেই ডাকছে কেন তোমায়? তুমি কিছু মনে করো না মিনতিমাসি, আসলে মায়ের মৃত্যুটা বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। মা অসুস্থ ছিল ঠিকই, কিন্তু এভাবে চলে যাবে বোধহয় ভাবতে পারেনি। ডক্টরও বলেছিলেন, কেমো কমপ্লিট হলেই মা সুস্থ হয়ে যাবে। আমরাও সেটাই বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু মা যে লাস্ট কেমো নিতে গিয়ে হার্ট ফেল করবে কে জানত বলো তো? মা’র ওইভাবে মারা যাওয়াটা কিছুতেই নিতে পারছে না বাবা। তাই তোমাকে সবসময় চন্দনা বলে ডেকে চলেছে। তুমি রাগ করো না মিনতিমাসি।’
বছর পঞ্চাশের মিনতি শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজে বলল, ‘ও তুমি কিছু মনে করো না টুয়াদিদি। আমি সামলে নেব দাদাবাবুকে।’
টুয়া নিজের ল্যাপটপ খুলে বসল। নামেই উইকেন্ড। অফিসের ফোন কলের কোনো শেষ নেই এই দিনগুলোতেও। সত্যি বলতে কী এই মুহূর্তে চেন্নাই থেকে ট্রান্সফার নেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই বাবাকে রেগুলার দেখাশোনা করাও সম্ভব নয়। বাবাকে নিয়ে চেন্নাই শিফট করবে ভেবেছিল, কিন্তু যা কাজের চাপ তাতে ওখানে নিয়ে গিয়ে বাবার যত্ন করার সময় পাবে না। তার থেকে বরং এখানে কাছেই পিসিমনিরা থাকে, তারাও মাঝে মাঝেই আসতে পারবে। তাছাড়া মিনতিমাসি তো এবাড়িতেই থাকে সর্বক্ষণ, তাই বাবার অসুবিধা হবে না। তাছাড়া অপরিচিত পরিবেশে গিয়ে বাবা যদি আরও বিরক্ত হয়, তখন তো মুশকিল হবে। ও অফিস সামলাবে না বাবাকে! ডক্টর বারবার বলেছিলেন, ‘কোনো কিছু নিয়ে ওঁনাকে জোর করবেন না। হিতে বিপরীত হতে পারে।’
তাই মাসে দু’দিনের জন্য ট্রাভেল করে টুয়া। বাবাকে নিয়ে চেকআপে যায়, সব ওষুধপত্র মিনতিমাসিকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে যায়। মা মারা যাওয়ার পরে পিসিমনি মিনতিমাসিকে এনে দিয়েছে ওদের বাড়িতে। পিসিমনির জায়ের বাড়িতে কাজ করত দীর্ঘদিন। জা মেয়ের বাড়ি পার্মানেন্টলি থাকবে বলেই মিনতিমাসি কাজের সন্ধান করছিল। তখনই পিসিমনির মনে হয়েছে, দাদার যা মানসিক অবস্থা সেখানে সবসময় একটা লোকের দরকার। টুয়ার দ্বারা যে সেটা সম্ভব নয় বুঝেই পিসিমনি একাজ করেছে। পিসিমনি বলেছিল, ‘এত বিশ্বাসী মানুষ তুই আর দ্বিতীয় পাবি না। নিজের বাড়ি মনে করে আগলে রাখবে।’ সত্যিই তাই। গত একবছরে ওদের বাড়ির ভোল পাল্টে দিয়েছে। মা দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার কারণে বাড়িঘর যথেষ্ট নোংরা হয়েছিল। টুয়ার মা ছিল ভীষণ গোছানো মহিলা, বাবা আবার ততটাই এলোমেলো। মা দিনরাত বাবাকে বকাবকি করত আর ঘরদোর গুছিয়ে যেত। টুয়ার বন্ধুরা এসে বলত, ‘তোদের বাড়িটা ইন্দ্রপুরী সিনেমার সেটের মতো গোছানো।’
সেই বাড়িই এলোমেলো হয়ে গেল একটা ঝড়ে। মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ল। অসুস্থ হয়ে পড়ল মা। নিজের রোগের কষ্ট সামলে বাড়িঘর গোছানোর সুযোগ পেত না। এদিকে ওদের পরিচারিকা রীতাদি ওইসময় যত ইচ্ছে ফাঁকি দিতে শুরু করল। মায়ের পছন্দের শো-পিসগুলোতে ধুলো জমল। মা বেঁচে থাকার দিন গুনতে লাগল। সাজানো ঘর-সংসারের প্রতি মোহ কমতে শুরু করল। ধীরে ধীরে মা বড্ড বেশি উদাসীন হয়ে গেল। হয়তো উপলব্ধি করেছিল, আর ক’দিন এসব আগলে রাখতে পারবে? বরং মায়া ত্যাগ করাই শ্রেয়। টুয়াদের পাশের বাড়ির নীলিমাকাকিমা ছিল মায়ের প্রাণের বন্ধু। অঞ্জনকাকু আর বাবার একসঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। দুজনে নাকি একই সঙ্গে বউ নিয়ে পাড়ায় ঢুকেছিল। কালীমন্দিরে প্রণাম করতে ঢুকেই মা প্রথম দেখেছিল নীলিমাকাকিমাকে। সেই শুরু বন্ধুত্বের। তারপর কত ঝড়ঝাপটা গেছে জীবনে, কোনোদিন ওদের বন্ধুত্বে টোল পড়েনি। টুয়া আর মিষ্টি একসঙ্গে বড় হয়েছে। মা বা নীলিমাকাকিমা আমাদের দুজনকেই নিজের সন্তানের মতো যত্নে বড় করছে।
মায়ের শরীর খারাপের সময় নীলিমাকাকিমা রোজ সন্ধেবেলা এসে বসে থাকত বন্ধুর কাছে। আর বলত, ‘এ কী চন্দনা, তুমি তোমার সাধের ঘরদোর অবধি পরিষ্কার করাচ্ছ না? আর ওই ফাঁকিবাজ রীতাটাও হয়েছে তেমনই।’
মা হেসে বলেছিল, ‘আর ক’দিনই বা আছি এবাড়িতে। অনেক তো পরিষ্কার করলাম। এবারে নতুন বাড়িতে গিয়ে আবার ঝাঁটা-ন্যাতা নেব।’
নীলিমা বিরক্ত হয়ে বলত, ‘ওহ, তুমি বুঝি ডাক্তারিটাও পড়েছিলে? একেবারে জেনে গেলে তুমি বাঁচবে না? এদিকে মিষ্টির বাবা, কাকু দুজনেই বলল তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে।’
মিষ্টি টুয়ার বাবা দিবাকরকে কাকু বলে ডাকত। দিবাকর নাকি অঞ্জনের থেকে মাস পাঁচেকের ছোট ছিল বয়েসে। তাই এই কাকু-জেঠুর গল্প। টুয়া দেখেছিল, মা একটু একটু করে সবকিছুর থেকেই নিজের মনকে গুটিয়ে নিচ্ছে। মা চলে যাওয়ার পরে বাবা একেবারে গভীর জলে পড়েছিল। সেই অবস্থায় মিনতিমাসিই ওদের উদ্ধারকর্ত্রী হিসাবে এসেছিল এবাড়িতে। নীলিমাকাকিমা ক’দিন এসে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সব। তারপর আর কাউকে তাকাতে হয়নি। একা হাতে সব সামলে নিয়েছে মাসি। ঘর-দোর আগের মতো ঝকঝকে করে ফেলেছে। বাবার ঘরের বিছানার চাদর অবধি টানটান করে রাখে মাসি। মা মারা যাওয়ার মাত্র তিনমাসের মধ্যেই টুয়াকে একটা প্রোজেক্টের কাজে কোম্পানি চেন্নাই পাঠিয়ে দেয়। টুয়া আটকানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু টুয়ার বস শুভাশিস তরফদার বলেছিলেন, ‘আমাদের জীবনে প্রবলেম কোনোদিন শেষ হয় না চন্দ্রানী। আমরা একটা সমস্যার সমাধান করে মনে করি, আপাতত নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু ওই ভাবনার পথ ধরেই আরেকটা সমস্যা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। তখন আমরা আবার নতুন উদ্যমে সেটাকে সলভ করতে লেগে পড়ি। এটাই লাইফ। সমস্যাবিহীন কোনো জীবন হয় না। ঢেউ বিহীন যেমন সমুদ্র হয় না তেমনই। তাই তুমি যদি মনে করে থাকো, চেন্নাই না গিয়ে তুমি বাড়ির সব সমস্যা মিটিয়ে ফেলবে, তাহলে ভুল করছ। সমস্যা মেটে না। তাই কোম্পানির জন্য আর নিজের কেরিয়ারের জন্য বছরখানেক চেন্নাই থেকে ঘুরে এসো।’
টুয়া বোঝাতে পারেনি, মা মারা যাওয়ার পরে বাবা অদ্ভুত একটা ভাবনার জগতে চলে গেছে। সেখানে শুধুই চন্দনার অবাধ প্রবেশ। আর কারোর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তাই এই ক্রাইসিস টাইমে টুয়াকে বাবার দরকার ছিল। কিন্তু চাকরিটা ছেড়ে দিলে মুশকিল। প্রাইভেট কোম্পানি, তাই দিনরাত এক করে খাটতে হয়। বাবার পেনশনের টাকার ওপরে নিজের ভবিষ্যৎকে ছেড়ে দিতে পারেনি টুয়া। অনেকে হয়তো আড়ালে টুয়াকে স্বার্থপর বলে, অনেকে ভাবে বাবার খেয়াল রাখল না। কিন্তু টুয়া নিরুপায়।
দীঘলের মেসেজ ঢুকল। ‘কবে ব্যাক করছ? আচমকা কলকাতায় চলে গেলে, এনি প্রবলেম? আঙ্কেলের শরীর ঠিক আছে?’
টুয়া মেসেজগুলোর দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। দীঘল চেন্নাইয়ে ওর প্রজেক্টেই কাজ করছে। ব্রাইট ছেলে। বাঙালি। শুধু বাঙালি নয়, বাংলার প্রতি বেশ ইন্টারেস্ট আছে। টুকিটাকি নাকি লেখালিখির শখও আছে। আইটি’তে লেবার দিয়ে যে ছেলে কবিতা লেখে তাকে টুয়া একটু সম্মানের চোখেই দেখে। কারণ ও একটা ওয়েব সিরিজ শেষ করতে মিনিমাম কুড়িদিন লাগায়। এতটাই ক্লান্ত থাকে যে, চালানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।
টুয়া একদিন দীঘলকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এনার্জি ট্যাবলেট খাও নাকি? এত হাসিখুশি থাকো কী করে?’
দীঘল মুচকি হেসে বলেছিল, ‘কাজটাকেই ভালোবাসি আমি। আর জীবনটাকে বড্ড বেশি ভালোবাসি। তাই সময়গুলো কৃপণের মতো খরচ করি। সময় খুব মূল্যবান আমার কাছে।’
দীঘল ইদানীং একটু বেশিই খোঁজ নিচ্ছে টুয়ার। শুধু একই প্রজেক্টে একই টিমে কাজ করছে বলে নয়। তার থেকেও একটু যেন বেশিই খোঁজ নিচ্ছে।
মন্দ লাগে না অবশ্য। মনে হয়, কেউ তো একজন আছে যে ওর অনুপস্থিতিতে ওকে সামান্য হলেও মিস করছে।
দীঘল জানে, টুয়ার বাবার একটা শারীরিক সমস্যা আছে। সমস্যাটা ঠিক কী সেটা নিয়ে ডিটেলসে আলোচনা করেনি টুয়া অফিসের কারোর সঙ্গেই। ছোট থেকেই ওর সব থেকে অপছন্দের জিনিস হল সিমপ্যাথি। এই একটা জিনিস ও কারোর কাছ থেকে নিতে পছন্দ করে না। আর অদ্ভুত বিষয় হল, এটাই সবাই ঢালাও দিতে পছন্দ করে। তাই ওর মা মারা গেছে, বাবার মেন্টাল ট্রমা চলছে—এসব কথা খুব কাছের মানুষ ছাড়া কাউকেই তেমন বলেনি।
দীঘল একদিন কফি খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি একটাই সন্তান? বাবা কী করেন?’
তখন টুয়া জানিয়েছিল, ওর মা রিসেন্ট মারা গেছে। আর বাবারও একটু শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই ও প্রতি মাসে কলকাতা ট্রাভেল করে।
দীঘল বলেছিল, ‘আমার মা-ও অসুস্থ। ডায়াবেটিক পেশেন্ট। তবুও কলকাতা যাওয়া হয়ে ওঠে না। বাবা একাই সামলায় সব। আর দিদি আসে মাঝে মাঝে। দিদির কলকাতাতেই বিয়ে হয়েছে।’
টুয়া আর বেশি ঘনিষ্ঠ হতে চায়নি। তাই পারিবারিক কথার মাঝপথেই ওকে থামিয়ে দিয়ে অফিসের আলোচনায় ফিরে এসেছিল। তবুও দীঘল মাঝেমাঝেই জিজ্ঞাসা করে, ‘আঙ্কেল এখন কেমন আছেন?’
টুয়া প্রতিবারই ‘একটু বেটার’ বলে এড়িয়ে গেছে। আরও দশটা ডক্টরের অ্যাড্রেস, আমার অমুকেরও সেম হয়েছিল— এসব বাক্যবাণে জর্জরিত হওয়ার থেকে, এড়িয়ে যাওয়া ঢের ভালো। মা বলত, টুয়া যে কী করে ছোট থেকে এত ম্যাচিওর হল কে জানে! টুয়া নাকি ছোট থেকে বড্ড বেশি বুঝদার। কখনও সেভাবে বায়না অবধি করেনি কোনো জিনিসের জন্য। বাবা, মা-ই একমাত্র সন্তানকে সবটুকু দিয়ে মানুষ করেছে। কিন্তু টুয়া চিরকালই একটু গম্ভীর, ভাবে বেশি বলে কম। বাবা বলত, ‘আমার গিন্নি মেয়ে।’ মা বলত, ‘ধুর, ছেলেমেয়ে দুষ্টুমি করবে তবেই না।’
টুয়া যেন বলার আগেই সব বুঝে যেত। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিজ্ঞতা বেড়েছে বৈ কমেনি। তাই টুয়া জানে, বাবার অসুস্থতার কথা শুনলেই সবাই আচমকা ডক্টর হয়ে যাবে। ও নিজে জানে, বাবাকে ও বেস্ট নিউরোলজিস্ট, বেস্ট সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাচ্ছে। তাই অযথা কারোর পরামর্শের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া লোকজনের কথায় ও বিশেষ পাত্তা দেয় না। মায়ের অসুস্থতার সময় দেখেছে, আত্মীয় থেকে পরিচিত সকলেই নিজের নিজের মতো জ্ঞান দিয়ে গেছে বাবাকে। শেষ দিকে বাবার মনে হতে শুরু করেছিল, অমুক জায়গায় নিয়ে গেলেই ভালো হত। অমুকের কথা শুনলেই মা হয়তো বেঁচে যেত। তাই বাবার ব্যাপারে ডক্টরদের ওপরেই বিশ্বাস রেখেছে টুয়া।
দীঘল আবার মেসেজ করল, ‘এনি প্রবলেম? একা সামলাতে অসুবিধা হলে নির্দ্বিধায় ডেকো।’
টুয়া লিখল, ‘নো প্ৰবলেম। এভরিথিং ইস্ ফাইন।’
দীঘল লিখল, ‘ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে? কলকাতার বৃষ্টি ভীষণ রোম্যান্টিক তাই না? শহর জুড়ে ভিজে চুপচুপে।’
টুয়া দুটো স্মাইলি পাঠিয়ে লিখল, ‘আজও কি কবিতা লিখছ? হঠাৎ বৃষ্টির খোঁজ কেন?’
দীঘল লিখল, ‘লিখেছি দু’লাইন। পাঠক নেই আমার।’
কী মনে হতে টুয়া বলল, ‘আমি অজ্ঞ পাঠক হতে পারি। যদিও কবিতার তেমন কিছুই বুঝি না।’
‘এক পশলা বৃষ্টি এলেই ছুটে গিয়ে তোমায় আমি ছুঁয়ে দেব।
এক পশলা বৃষ্টি এলেই তোমার ভেজা চুলের গন্ধ নেব।
ভিজে ঠোঁটের সবটুকু জল চুঁইয়ে তবে বৃষ্টি নামুক।
আমার দু’চোখে বৃষ্টি নেমেছে তোমার চোখও ভিজে উঠুক।
মেঘলা মনের আঙিনাতে রিম ঝিম ঝিম বৃষ্টি নামুক।’
কবিতা পাঠিয়ে দীঘল বলল, ‘এরপরের লাইনটা কী লিখব বুঝতে পারছি না।’
টুয়া লিখল,
‘এক পশলা বৃষ্টি এলেই তোমার সঙ্গে ভিজব আমি,
সব দ্বিধা ঘুচিয়ে দিয়ে বর্ষার মতো কাঁদব আমি।’
দীঘল লিখল, ‘সত্যি ভিজবে?’
ইস্, সত্যি কলকাতা বড্ড রোম্যান্টিক। না হলে টুয়ার মতো মেয়েও দু’লাইন কবিতা লিখে ফেলল!
টুয়া লিখল, ‘জানি না। বাই। পরশু অফিস যাচ্ছি।’
দীঘল কিছু একটা টাইপ করছিল, সেটা আর পাঠাল না।
টুয়া ল্যাপটপে তাকিয়ে কাজে মন দিল। খেয়াল করেনি কখন মিনতিমাসি এসেছে। টেবিলে কফির কাপটা রেখে বলল, ‘রাতের খাবার কখন খাবে? এত কাজের চাপ তোমার, ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করো তো? শরীর টিকিয়ে রাখতে হবে তো?’
টুয়া চোখ তুলে তাকাল মিনতিমাসির দিকে। ছোটখাটো মজবুত গড়ন। গায়ের রং বেশ কালো, সামনের দাঁতগুলো অনেকটা উঁচু। কপালটাও চওড়া। সত্যি বলতে কী, এক কথায় মিনতিমাসিকে দেখতে একেবারেই ভালো নয়।
টুয়া কফিতে চুমুক দিতেই মনটা ভরে গেল। মা মারা যাওয়ার পরে এই প্রথম এত ভালো কফি খেল ও। বহুদিন মনের মতো কফি পায় না। এমনিতেই ও চা আর কফির ব্যাপারে একটু খুঁতখুঁতে। মায়ের হাতের কফিটা ছিল বেস্ট। মিনতিমাসির বানানো কফিটাও চমৎকার।
টুয়া বলল, ‘আগের বার যে কফিটা খাইয়েছিলে এটা তাকেও ছাড়িয়ে গেছে, বুঝলে? আচ্ছা মাসি, তুমি বিয়ে করোনি কেন?’
মাসির চোখে একটু অবসাদের ছায়া ঘনিয়ে এল যেন মুহূর্তের জন্য। তারপরেই স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘করিনি নয় গো, হয়নি। বাবা অনেক চেষ্টা করেছিল। মা মরা মেয়ে, ছোট থেকেই সংসারের সব দায়িত্ব পালন করেছি। একা হাতে দুই বোন, একভাইকে মানুষ করেছি। দাঁড়িয়ে থেকে তাদের বিয়ে দিয়েছি।’
টুয়া বলল, ‘তাহলে তুমি কেন বিয়ে করলে না?’
মাসি হেসে বলল, ‘পাত্রপক্ষ এল আর গেল। মাঝখান থেকে নারান ময়রার মিষ্টির দোকানের লাভ হল কিছু। মিষ্টি-সিঙ্গাড়া খেয়ে দেয়ে মুখ ধুতে ধুতে সবাই বলত, ‘মাধববাবু, মেয়েটা আপনার খুবই লক্ষ্মীমন্ত। কিন্তু গায়ের রংটা বড্ড চাপা, আর দাঁতটাও উঁচু। ভাগ্না আমার সুপুরুষ, তাই এমন মেয়েকে সে বিয়ে করতে রাজি হবে না।’ কারোর ভাগ্না, কারোর ভাইপো, কারোর ছেলে, তো কারোর বোনপোর আমায় পছন্দ হল না। তাই বিয়েটাও হল না। আমিও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বহুবার দেখেছি, এত খারাপ দেখতে মানুষকে কেউ বউ করে নিয়ে যায়! তারপর বোনেদের বিয়ের বয়স হল। তারা আমার মায়ের মতো রূপ পেয়েছিল। তাই বিয়ে হয়ে গেল ভালো বাড়িতে। ভাইয়েরও বউ আনলাম। বাবা আমার বিয়ে দিতে পারল না বলে মনে দুঃখ নিয়েই চোখ বুজল। তারপর শুরু হল আসল সমস্যা।
ভাই আর ভাইয়ের বৌ দুজনেরই আমায় নিয়ে সমস্যা তৈরি হল। পরের বাড়ির মেয়ের দোষ কেন দেব দিদিমনি? আমার ভাইও চাইছিল না আরেকটা পেট চালাতে। প্রায়ই বলত, ‘তুই শুধু ঘরের কাজ না করে বাইরে কাজে যা। বাইরে কাজ করলে তবুও তো দুটো পয়সা আয় হয়। এখন তো সংসারে খরচ বেড়েছে। এরপরে আমার ছেলে-মেয়ে হবে, খরচ বাড়বে। একা আর কত টানব?’
আমি বুঝলাম, আমার জন্য খরচ করতেই গায়ে লাগছে ভাইয়ের। তাই পাড়ার দুটো বাড়িতে রান্নার কাজ নিলাম। সে রোজগারের টাকাও ভাইয়ের হাতে তুলে দিলাম। তাতেও দেখলাম মন ভরল না ওদের। ভাই প্রায়ই বলছিল, ‘এই টাকায় কী হয় বল?’ বাধ্য হয়ে দত্তগিন্নিকে ধরলাম। ওখানেই আমায় থাকতে দিতে হবে। আমি রান্না ছাড়াও সব কাজ করব। দত্তগিন্নি না করল না। যে দু’খানা কাপড় ছিল নিয়ে চলে এলাম। ভাইয়ের সংসারের খরচ কমল। আমারও খাবার হজম হতে লাগল। ওরা আমায় বাড়ির লোক করে রেখেছিল। কিন্তু কর্তাবাবু আর মা দুজনে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ছেলে-মেয়ে বাইরে নিয়ে চলে গেল। আমার আবার আশ্রয় গেল। তখনই তোমার পিসি বলল, তোমাদের বাড়িতে থাকতে পারব। এই তো এইটুকুই আমার জীবন। এমন বিশ্রী দেখতে যে আয়নাও লজ্জা পায় দিদিমনি। আমায় আর কে বিয়ে করবে, বলো দেখি?’
টুয়া অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিল, ‘যারা শুধু বাইরের রূপটুকু দেখে মানুষ বিচার করে তাদের ভাবনা ভেবে লাভ নেই। তোমার যে এত গুণ, তা কি সকলের আছে? যারা তোমায় বিয়ে না করে ফিরে গেল, তারা ভীষণ ঠকল। বুঝলে?’
মিনতিমাসি উদাস গলায় বলল, ‘হয়তো তারাই জিতল। যাক গে, এখন বলো রাতে কী খাবে? চিকেন আছে, বানাব?’
টুয়া হেসে বলল, ‘যা ইচ্ছে। আমি সর্বভুক। বাবা কী করছে? বই পড়ছে?’
মাসি ঘাড় নেড়ে বলল, ‘এখন পড়ছে। পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে। ডেকে খাওয়াতে বসাতে হয় রোজ।’
টুয়া বলল, ‘হুঁ। ডক্টর বলেছিলেন, নার্ভের ওষুধ আছে তো, ঘুমাবে একটু বেশি।’ মাসি আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল।
টুয়া ভাবনার জগতে ডুবে গেল। সামনে ল্যাপটপ খোলা। তবুও ও ছুটে গেল সেই স্কুলবেলার বাবার কাছে। সেই সাড়ে ন’টা বাজলেই ওর আর বাবার হুড়োহুড়ি। কে আগে স্নান সেরে খাবার টেবিলে বসতে পারে তার কম্পিটিশন। দুজনে দুটো বাথরুমে ঢুকে পড়ত ওরা। বেশিরভাগ দিন টুয়া ফার্স্ট হত। বাবার মুখে হেরে যাওয়ার কষ্ট, আর টুয়ার জিতে যাওয়ার আনন্দ। আচ্ছা বাবা কি ইচ্ছে করেই টুয়াকে জিতিয়ে দিতে চাইত? যাতে টুয়া দেরি না করে স্কুলবাসে ওঠে, তাই? নাকি সত্যিই হেরে যেত! ইস্, এই কথাটা তো কোনোদিন ভাবেনি টুয়া!
আজ মনে হচ্ছে, বাবা বোধহয় চাইত টুয়া জিতে যাক।
ওই জন্যই খাবার টেবিলে মা টুয়ার পাতে বড় মাছের পিসটা দিয়ে মুচকি হেসে বলত, ‘আজকেও তো তোমার মেয়ে বড় মাছের পিসটা পেয়ে গেল। তুমি তো আজও হেরে গেলে।’
খুব মনে করার চেষ্টা করল টুয়া, বাবার গোঁফের ফাঁকেও কি হাসি থাকত তখন? তবে টুয়ার পাতে বড় মাছের পিস পড়ায় বাবার মুখে তৃপ্তির হাসিটুকু মনে পড়ে গেল ওর। ওর বাবার গোটা জগৎ জুড়ে ছিল মা আর টুয়া। অফিস আর বাড়ির বাইরে লোকটা আজীবন কোনো আড্ডায় গেল না। অবসর কাটাত খবরের কাগজ আর বই পড়ে। অথবা টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখে। মায়ের হাতের চা খেতে খেতে খেলা দেখার নাকি মজাই আলাদা, এই কথাটা বারবার বলত বাবা। কথায় কথায় বিভিন্ন ব্যাপারে মায়ের প্রশংসা করাটা যেন বাবার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
বাবা অবশ্য কারোরই নিন্দে করত না। টুয়া একটা বাঁকাচোরা আঁকা নিয়ে এসে সামনে ধরলেও বাবা উৎসাহিত হয়ে বলত, ‘ওহ, দারুণ এঁকেছিস তো।’
মা এসে বকুনির সুরে বলত, ‘সবেতে প্রশংসা করো না তো। মেয়েটার ভুলগুলো ওকে দেখিয়ে দাও। যাতে ও বুঝতে পারে।’
বাবা হেসে বলত, ‘আরেকটু বড় হোক, ঠিক বুঝবে। এই তো বেশ এঁকেছে।’
বাবার চোখে কারোর কোনো কিছুই খারাপ নয়। সবাই ভালো, সব ভালো। মায়ের রান্না নুন কম তরকারি অম্লানবদনে খেয়ে প্রশংসা করতে করতে আঙুল চাটত বাবা। মা নিজে মুখে দিয়ে রেগে গিয়ে বলত, ‘এই মানুষটা কি কোনোদিন ভুল ধরে দিতে শিখল না!’
টুয়ার সবটা জুড়ে ছিল বাবা। স্কুলে বন্ধুরা কী করেছে, টিচাররা কী বলেছে, কলেজে কোন প্রফেসরের ওপরে ক্রাশ খেয়েছে, রাস্তায় কোন ছেলে ওকে প্রোপোজ করেছে, সব প্রাণখুলে গল্প করার জায়গা ছিল বাবা। সেই বাবাই যখন এমন চুপ করে গেল, তখন ভিতরে ভিতরে টুয়ার যে কতটা ক্ষরণ হয় সেটা কাকে বোঝাবে ও!
টুয়ার চাকরি পাওয়া, বাবার উল্লাস, টুয়ার প্রথম প্রেমে পড়া বাবার ছেলেটা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া আড়ালে, এমন কত কত কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে ছিল বাবা। টুয়ার গোটাটা জুড়ে ছিল বাবা। ব্রেকআপের পরে বাঁধভাঙা কান্না বাবার বুকে মাথা রেখে কেঁদেছিল। বাবা শুধু শান্ত গলায় বলেছিল, ‘টুয়া জীবনটা এরকমই। আমি খবর নিয়েছিলাম, ছেলেটা খুব একটা ভালো না। কিন্তু তবুও তোকে কিছু বলিনি। সবে কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়িস তুই। গোটা জীবনটা পড়ে আছে তোর। ভালো-খারাপ, ম্যাচ-মিসম্যাচ এগুলো তোকেই বুঝতে হবে। হোঁচট খাবি, আবার উঠে দাঁড়াবি, এভাবেই চলতে শিখে যাবি। শুধু হাঁটতে শেখা মানেই চলতে শেখা নয়। সমস্ত আঘাতকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর নাম জীবন। এই যে রাতুলের সঙ্গে তোর মতের মিল হচ্ছিল না। রাতুল তোকে যাচ্ছেতাই কথা বলে অপমান করল, তাতে তোর মনে হল এই মানুষটাকে এতদিন আমি ভালোবাসলাম? কেন বাসলাম? কিন্তু টুয়া, ভালো না বাসলে তুই বুঝতিস কী করে রাতুল এমন ছেলে! দূর থেকে বা একদিনের পরিচয়ে তো কাউকে বোঝা সম্ভব নয়। মিশলে তারপর তো ভুল-ঠিক বুঝবি।’
টুয়া বলেছিল, ‘কিন্তু রাতুলকে ছেড়ে থাকতে আমার কষ্ট হচ্ছে তো বাবা।’
বাবা শান্ত স্বরে বলেছিল, ‘হবে তো। ওই কষ্টটাই তোর শক্তি হবে। একটু সময় দিতে হবে সময়কে। সে-ই সব ভুলিয়ে দেবে। চিন্তা করিস না। মানুষের মন সবেতে অভ্যস্ত হতে পারে। তুইও একটু কষ্ট পাবি, মন খারাপ করবে, রক্তক্ষরণ হবে মনে, তারপর দেখবি সময় ঠিক ধীরে ধীরে প্রলেপ লাগিয়ে দিল ক্ষততে। চিন্তা করিস না। এটাই জীবন। দুঃখ না পেলে সুখ কোনটা চিনতেই তো পারবি না।’
বাবার বলা কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে মন দিয়ে শুনেছিল টুয়া। সেদিন যে খুব বিশ্বাস হয়েছিল এমন নয়। বরং মনে হয়েছিল রাতুলকে ছাড়া চলবে কী করে। ওর দিনরাতের ভাবনায় তো রাতুল জুড়ে ছিল। কিন্তু ফাইনাল ইয়ারে গিয়ে বুঝেছিল, বাবাই ঠিক। সময় ধীরে ধীরে ভুলিয়ে দিয়েছে অনেক কিছু।
আজ খুব ইচ্ছে করছে বাবাকে গিয়ে বলতে, ‘বাবা দীঘল হয়তো খুব তাড়াতাড়ি প্রোপোজ করবে আমায়। আমার ঠিক কী করা উচিত? যদি আবার রাতুলের মতো হয়, তাহলে?’
কিন্তু বাবা তো এখন বড্ড চুপচাপ। কালবৈশাখী হওয়ার আগের মুহূর্তের আকাশের মতো থমথমে। তাকে বলা, না-বলা দুই-ই সমান। মায়ের সঙ্গে কোনোদিনই এসব গল্প করত না টুয়া। মা টুয়ার পড়াশোনা থেকে খাওয়াদাওয়া সব খেয়াল রাখলেও মনের খবর তেমন রাখত না। বরং বকাঝকা করত বেশি। কিন্তু বাবা ছিল ওর সবকিছুর সঙ্গী। বড্ড অসহায় লাগে আজকাল। টুয়া কোনো বন্ধুর কাছেই নিজেকে উজাড় করে বলতে পারে না, এটা হয়তো ওর নিজেরই দোষ। সবকিছু নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে রেখে এটাই এখন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বুকের ভিতরটা শূন্যতা গ্রাস করেছে। দীর্ঘশ্বাসগুলো ভারী আর দীর্ঘমেয়াদি হয়েছে। টুয়া অবশ্য এর নাম দিয়েছে পরিণত।
কাজে মন নেই ওর। গুটিগুটি পায়ে বাবার ঘরের সামনে দাঁড়াল টুয়া। মিনতিমাসি বাবাকে খেতে দিয়ে সামনে বসে আছে। বাবা এক মনে খাচ্ছে।
মাসি জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন লাগল চিকেন?’
বাবা একগাল হেসে বলল, ‘খুব ভালো হয়েছে। চন্দনার রান্না খারাপ হবে কেন? খুব ভালো হয়েছে।’
মাসি আরেক পিস চিকেন পাতে দিয়ে বলল, ‘যাক, আপনার পছন্দ হয়েছে।’
বাবা ঘাড় নেড়ে জানাল, ভালো হয়েছে। বাবার একটা স্বভাব আগের মতোই রয়ে গেছে—সবকিছুর প্রশংসা করা। এই স্বভাবটার জন্য মায়ের সঙ্গে খুব ঝগড়া হত বাবার। মা বলত, ‘যে যা দেবে সব ভালো তোমার কাছে? যে মানুষ আসল ভালো-মন্দর বিচার বোঝে না, তার প্রশংসায় অন্য কেউ গলে গেলেও আমি যাই না। কারণ আমি জানি যে, প্রশংসা অন্তরের নয়, মৌখিক। এই যে গতকাল রুমকির জন্মদিনে খেতে গিয়েছিলাম। যতজন নিমন্ত্রিত ছিল সবাই বলছিল, মাংসটা অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে ফেলেছে রাঁধুনি। একমাত্র উনি বললেন, খুব ভালো রান্না হয়েছে। বেশ ঝাল ঝাল। মুখ ছেড়ে গেল।
বিশ্বাস করো, তোমার এই সবেতে ঘাড় নাড়ার স্বভাবটা একেবারে নিতে পারি না আমি।’
টুয়া দেখত, মা অত্যন্ত বিরক্ত হত বাবার প্রশংসা শুনে। মায়ের বক্তব্য ছিল ঠিককে ঠিক আর ভুলকে ভুল বলতে শেখা উচিত মানুষের। কিন্তু মা চেঁচিয়ে, ঝগড়া করেও বাবার এই স্বভাব যে বদলাতে পারেনি কোনোদিন, সেটা টুয়া জানত। আজকেও দেখল বাবা, চিকেনের প্রশংসা করে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে।
টুয়া সামনে গিয়ে বলল, ‘বাবা আমি কাল চলে যাব। অফিসের কাজ আছে। আবার পরের মাসে আসব।’
বাবা খুব শান্ত স্বরে বলল, ‘সাবধানে যাবি। মন দিয়ে কাজ করবি।’
বাবা হয়তো বিশাল কিছু ভেবে কথাগুলো বলেনি, কিন্তু টুয়ার মনে হল বাবার বলা দুটো বাক্য যেন ওর কাছে আশীর্বাদ। বাবার গায়ে হাত বুলিয়ে টুয়া বলল, ‘করব বাবা।’
মাসি বাবাকে যে খুবই যত্নে রেখেছে সেটা দেখেই বোঝা যায়। বাবার শরীর-স্বাস্থ্য আগের থেকে অনেক ভালো হয়েছে। শুধু মানসিক প্রবলেমটা সারেনি। ওটা রয়েই গেছে। সেই চুপ করে এক মনে বসে থাকা, সেই সব কথায় কথায় চন্দনা চন্দনা বলা— এগুলো রয়েই গেছে। ডক্টর বলেছিলেন, ওষুধ খেলে এটাও ঠিক হয়ে যাবে। এতদিন হয়ে গেল, এখনও বাবা আগের অবস্থায় ফিরে এল না।
মিনতিমাসি টুয়াকে যত্ন করে খেতে দিয়ে বলল, ‘আমায় তোমরা তাড়িয়ে দেবে না তো?’
টুয়া খাওয়া থামিয়ে বলল, ‘ও মা, হঠাৎ তাড়াতে যাব কেন? তুমি এত গুছিয়ে আগলে রেখেছ সব, তোমায় তাড়ালে এসব সামলাবে কে? এসব ভেবে মনখারাপ করো না। আমি কাল ফিরে যাব, ভালো করে বাবার খেয়াল রেখো। সব ওষুধ ঠিক করে খাওয়াবে মনে করে।’
মিনতিমাসি বলল, ‘আর রুটি নেবে?’
টুয়া ঘাড় নেড়ে বলল, ‘তুমি কি আমায় একদিনে মোটা করে দেবে?’
মাসি হেসে বলল, ‘এমন প্যাংলাকাঠি কি ভালো নাকি? খাও না নাকি?’
টুয়া খেতে খেতেই বলল, ‘ডায়েট কন্ট্রোল করি মাসি। যত রাতই হোক জিমে ঢুঁ দিই।’
মাসির কথাগুলো ঠিক যেন মায়ের মতো। মা-ও বলত, ‘রোগা হয়ে কী বিচ্ছিরি হচ্ছিস তুই টুয়া। মডেলদের মতো হয়ে যাচ্ছিস। একটু বেশি করে মাখন দিয়ে ভাত খা।’
টুয়া ফিরে গেছে। যাওয়ার আগে বাবাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ধরে আদর করেছে। মিনতিমাসি লক্ষ করেছে টুয়ার চোখে জল। একবছর হয়ে গেছে ও এবাড়িতে আছে। টুয়া খুব ভরসা করে ওর বাবার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে যায় মিনতির ওপরে। যতবার বাড়ি আসে, ওর জন্য কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসেই। প্রতিমাসে মোটা টাকা মাইনে দেয়। মিনতির আর খরচ কী? সবটাই তো জমে। টুয়াই ব্যাঙ্কে একটা বই করে দিয়েছে। বলেছে, ‘এখানে সব টাকা ফেলে দিও। তোমার ভবিষ্যতের জন্য।’
শাড়ি কিনে দেয়, মুখে মাখার ক্রিম কিনে দেয়, মাথার শ্যাম্পু, সাবান সব দামি দামি প্রোডাক্ট কিনে দেয়। অনেক টাকা মাইনে পায় টুয়া। তাছাড়া দাদাবাবুর পেনশনের টাকাও অনেক। তবে শুধু টাকা থাকলেই হয় না, মেয়েটার মনটাও বড়। এবাড়িতে ঢোকার পর মিনতির কোনোদিন নিজেকে কাজের লোক বলে মনে হয়নি। মনে হয়েছে, ও-ই যেন এবাড়ির গিন্নি। সপ্তাহে দু’দিন সুধীর আসে। ওকে লিস্ট ধরিয়ে দেয় মিনতি, ও-ই সব বাজার হাট করে দেয়। টুয়া ওকেও একটা মাইনে দিয়ে দেয়। এছাড়াও মাঝে মাঝেই এটা ওটা বাড়িতে আসে অনলাইনে। ফোনে বলে, ‘মিনতিমাসি তোমার আর বাবার জন্য আজ গলদা চিংড়ি পাঠালাম। নিয়ে নিও।’
অত দূর থেকে কী করে পাঠায় প্রথমে বুঝতে পারেনি মিনতি। তারপর সুধীর বুঝিয়ে বলেছে। এত সুখ মিনতি ওর গোটা জীবনে পায়নি। কিন্তু টুয়ার চোখের জল এবারে মিনতিকে অস্থির করে তুলেছে। কিছুতেই যেন মন বসছে না। প্রিয় সিরিয়ালগুলো চালিয়েও মন দিতে পারছে না। বারংবার মনে হচ্ছে শুধু নিজের স্বার্থের জন্য ও টুয়াদের ঠকাচ্ছে। পাপ করছে ও, খুব বড় পাপ। হয়তো ওপরে গিয়ে জবাব দিতে হবে ওকে। কিন্তু এ লোভ যে ভয়ঙ্কর লোভ। এর থেকে মিনতি বেরোবে কী করে!
দিবাকর ভরাট গলায় ডাকল, ‘চন্দনা। এক কাপ চা দাও তো।’
মিনতি সোজা উঠে গিয়ে মৃত চন্দনার ঘরে দরজা বন্ধ করল। ঘরে বেশ বড় একটা চন্দনার ছবি বাঁধানো আছে। সেদিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে রোজ দাঁড়ায় মিনতি। ক্ষমা চায় রোজ। কিন্তু ও মনে মনে জানে, চন্দনা বৌদি কোনোদিন ক্ষমা করবে না ওকে। তবুও রোজ সন্ধেতে ধূপ জ্বেলে ক্ষমা চাওয়াটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে মিনতির। আলমারিটা খুলে হালকা গোলাপি শাড়িটা বের করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরে নিল মিনতি। তারপর ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে চা চাপাল। দিবাকরের পায়ের শব্দ ক্রমশ কাছে আসছে। বুকটা ধুকপুক করছে মিনতির। চায়ের জল ফুটছে সসপ্যানে। কাঁপা হাতে চা দিল মিনতি। দিবাকর এসে ঠিক পিছনে দাঁড়িয়েছে।
‘কী ব্যাপার, পিছনে দাঁড়িয়ে আছ কেন দীঘল? কিছু বলবে?’
দীঘলের ঠোঁটে লাজুক হাসি। একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আজ একটা মুভি দেখতে যাবে? খুব ইচ্ছে করছে মুভি দেখতে। কিন্তু সঙ্গী পাচ্ছি না। ভাবলাম তোমায় বলে দেখি।’
টুয়া হেসে বলল, ‘ওহ, তার মানে, আরও বেশ কয়েকজনকে অফার করেছ তুমি। তারা রাজি হয়নি। শেষে আমায় বলতে এসেছ?’
দীঘল অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘এ মা, তা কেন হবে? একসঙ্গে যাব ভাবলাম তাই বললাম।’
টুয়ার আজ জেদ চেপেছে যেন। মনে মনে চাইছিল, দীঘল আরও কিছু বলুক। বলুক, অন্য কেউ নয় তোমাকে নিয়েই যেতে চাই।
টুয়া বলল, ‘সে বুঝলাম। কিন্তু তুমি অফিসে অনেককেই তো সঙ্গী খুঁজছিলে, পাওনি তাই বল। আচ্ছা দীঘল, আমাদের সৌরীও যাবে না বলল? ও তো মুভি দেখতে পেলে খেতেও ভুলে যায়। সৌরীকে বোধহয় বলতে ভুলে গেছ তুমি। দাঁড়াও তোমার সঙ্গীর ব্যবস্থা আমি এখুনি করে দিচ্ছি। আরে চাপ নিচ্ছ কেন? স্কুলে আমায় সবাই প্রবলেম সলভ করতেই ডাকত। আমি সকলের সব প্রবলেম মিটিয়ে দিতাম এক মিনিটে। এ তো সামান্য! তোমায় মুভি দেখতে যাওয়ার পার্টনার জোগাড় করে দেওয়ার মতো সহজ কাজ আর হয় না।’
দীঘল গম্ভীর গলায় বলল, ‘চন্দ্রানী, আমার কোনো প্রবলেম নেই যে তোমায় সলভ করতে হবে। প্লিস সৌরী বা অফিসের অন্য কোনো মেয়েকে বলো না। আমি ওদের সঙ্গে যাব না। আমার বলার মধ্যে হয়তো ভুল ছিল বলে তোমার বুঝতে অসুবিধা হয়েছে, আমি শুধুমাত্র তোমাকেই চাই মুভি পার্টনার হিসাবে। তুমি যদি না যেতে পারো, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু প্লিস অন্য কাউকে বলো না।’
অন্য দিন চেন্নাইয়ের শুকনো গরমে বেশ হাঁসফাঁস করে টুয়া। আজ কেন কে জানে আচমকা বসন্তবাতাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল ওকে। মুহূর্তের মধ্যেই রাতুলের মুখটা মনে পড়ল। দীঘল আবার রাতুলের মতো নয় তো? পরক্ষণেই মনে পড়ল বাবার বলা কথাগুলো। বাবা বলেছিল, ‘মানুষ ঠকে, তাই বলে কি সময় থমকে যায়? মানুষ চিনতে গেলে মিশতে হবে। ভয় পেলে, দূরে সরিয়ে দিলে তো বন্ধুই হবে না কেউ কোনোদিন।’ দীঘল অপলক তাকিয়ে আছে টুয়ার দিকে। টুয়া সেটা অনুভব করছে বেশ কয়েক মাস ধরে। দীঘল যে টুয়ার ব্যাপারে বেশ কেয়ারিং সেটা ও বুঝেছে ওর আচরণে। আর এটাই হয়তো দীঘলকে ভালো লাগার একমাত্র কারণ।
দীঘল টুয়াকে মাপছে হয়তো।
টুয়া সুযোগ না দিয়েই বলল, ‘ওহ, আমি একা তোমার সঙ্গী হলেই চলবে? তাহলে যেতেই পারি।’
দীঘলের ঠোঁটে এক চিলতে হাসির রেখা।
গত এক সপ্তাহে দীঘলের সঙ্গে বন্ধুত্বটা অন্য মোড় নিয়েছে। কলিগ, বন্ধুত্ব এসবের বাইরে গিয়ে আরেকটু গভীরতা বেড়েছে ওদের সম্পর্কটার। টুয়া এতদিনে ওর সবটুকু উজাড় করে বলতে পেরেছে দীঘলকে। দীঘলও বলেছে ওর বাড়ির কথা। টুয়ার বাবার অসুস্থতার কথা শুনে দীঘল বলেছে, ‘নেক্সটবার আমি যাব তোমাদের বাড়ি। আঙ্কেলের সঙ্গে একটু কথা বলে আসব।’
ভালোবাসার প্রতি হারিয়ে ফেলা বিশ্বাসটাকে যেন একটু একটু করে ফিরিয়ে দিচ্ছে দীঘল। টুয়া আবার অনুভব করছে ভালোবাসা আর প্রবঞ্চনা সমার্থক শব্দ নয়।
দীঘল আজ অফিসে ঢুকেই বলল, ‘চন্দ্রানী, আজ আমার জন্মদিন। তাই যা বলার আজকেই বলে দিও।’
টুয়া হেসে বলেছিল, ‘আশীর্বাদ করি তুমি একশো বছর বেঁচে থাক। আর এই কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট হও। তখন আমায় একটু বেশি করে ছুটি দিও কিন্তু।’
দীঘল মুখ গোমড়া করে বলেছে, ‘আমি তোমার জন্য ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ হেলায় হারাতে রাজি। এরপরে তো বলো আর কী বলার আছে তোমার!’
টুয়া লজ্জা পেয়ে বলেছে, ‘শুভ জন্মদিন।’
দীঘল আরেক পা টুয়ার দিকে এগিয়ে এসে বলেছে, ‘দেখো লাস্ট সুযোগ দিলাম তোমায়। এ সুযোগ হাতছাড়া করো না কিন্তু।’
টুয়া আর ভণিতা না করেই বলে দিয়েছে, ‘এখন থেকে তোমার প্রতিটা জন্মদিনে তোমার পাশে থাকতে চাই।’
দীঘল হেসে বলেছে, ‘এটা কোনো প্রোপোজ হল চন্দ্রানী? এভাবে কেউ প্রোপোজ করে? আচ্ছা বেশ, এখন এটাকে নিয়েই এগিয়ে চলি। আজ আমি তোমায় প্রোপোজ করব না। আমি যেদিন তোমায় বোঝাতে পারব, ভালোবাসা আসলে কী, সেদিন হাঁটু গেড়ে প্রোপোজ করব তোমায়।’
বেশ কাটছিল চেন্নাইয়ের দিনগুলো। সারাদিনের অফিস-ক্লান্ত টুয়া সবসময় অনুভব করত, কেউ একজন আছে ওর পাশে। যে কোনো সমস্যায় হাতটা বাড়ালেই হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টানে ওকে তুলে দেবে ওই খাদ থেকে। মিনতিমাসিকে রোজই ফোন করে বাবার খোঁজ নেয়। বাবাও কথা বলে টুকটাক। সারাদিন আকাশে উষ্ণতা বেলানোর পরে অস্ত গেলেও যেমন সূর্যের অস্তিত্ব থেকেই যায় আকাশ জুড়ে, বাবাও ঠিক তেমনিভাবে রয়ে গেছে টুয়ার জীবনে। এখন হয়তো সুচিন্তিত পরামর্শ দিতে পারে না বাবা, কিন্তু বাবার বলা কথাগুলো থেকেই যেন জীবনটাকে চালাতে শিখেছে টুয়া। এখনও বাবা যখন ফোনে আনমনে বলে, ‘ভালো থাকতে হবে বুঝলি টুয়া, ভালো থাকতে হবে।’ তখন মনে হয়, সত্যিই তো ভালো তো থাকতেই হবে। বাবা বলে, ‘টুয়া লড়াইয়ের রাস্তাটা পাহাড়ের মতো খাড়া আর একমুখী। তুই যে শর্টকাটে পৌঁছে যাবি, তা হবে না। হয় তোকে ওই খাড়া একমুখী রাস্তা বেয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে, নয়তো ফেরত আসতে হবে।’
টুয়া জানে জীবনটা একটা লড়াই। সেখানে যদি একটা দুটো সহৃদয় বিশ্বস্ত যোদ্ধা পাওয়া যায়, তাহলে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে হয়। এই যেমন টুয়া এখন নিজেকে ভাগ্যবান ভাবছে। কারণ, দীঘল ওর পাশে আছে। শক্ত করে ওর হাতটা ধরে আছে। দীঘল সামনের সপ্তাহে কলকাতা যাবে, টুয়াও ওই সময়েই ফিরবে।
দীঘল বলেছে, ‘একই ফ্লাইট ধরি চলো।’
টুয়া হাসতে হাসতে বলেছে, ‘কেন, মধ্য আকাশে আমায় প্রোপোজ করবে বুঝি!’ দীঘল গম্ভীর স্বরে জানিয়েছে, ‘সেই মুহূর্ত ঠিক কখন আসবে আর কীভাবে আসবে আমি নিজেও জানি না চন্দ্রানী। তবে আমি বিশ্বাস করি, সেই মুহূর্ত আসবে।’
দীঘল আর টুয়া কলকাতা ফিরছে। এবারে টুয়া ইচ্ছে করেই বাড়িতে জানায়নি। দীঘলকে ওদের বাড়িতে সোজা নিয়ে যাবে। বাবার সামনে দাঁড় করিয়ে বলবে, ‘বলো মানুষ চিনতে কি এবারেও ভুল করলাম?’ চমকে দেবে বাবাকে। মিনতিমাসির সঙ্গে গতকাল রাতেও কথা হয়েছে, কিন্তু টুয়া জানায়নি আজ আসছে। হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন ছেলেমানুষিতে পেয়ে বসে ওকে। লুকোচুরি খেলার নেশাটা মাথাচাড়া দিয়ে বলে, বয়েস তো একটা সংখ্যা মাত্র।
দীঘল কানের কাছে মুখটা নামিয়ে এনে বলল, ‘চন্দ্রানী এই আকাশগঙ্গাকে সাক্ষী রেখে কথা দিলাম, যতদিন আমার শ্বাস পড়বে ততদিন সেই নিঃশ্বাসে তুমি মিশে থাকবে। কলেজের মতো রোম্যান্টিক প্রেমিক মনে হচ্ছে আমায়? হোক না, ক্ষতি কী? প্রেম কবেই খুব পরিণত ছিল! প্রেম তো চিরকাল আবেগী, অপরিণত, তাই না চন্দ্রাণী? তাই তো হিসেব নিকেশ করতেই ভুলে যায় অর্ধেক সময়।’
টুয়া শুনছিল দীঘলের কথাগুলো। সেই মা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে যেন একটা ওষুধ ওষুধ গন্ধ আর দুশ্চিন্তা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। কিছুতেই এর থেকে নিস্তার পাচ্ছিল না। আজ বহুদিন পরে নাকের ওই ওষুধ ওষুধ গন্ধটা সরে গিয়ে ল্যাভেন্ডারের গন্ধ পাচ্ছে। সম্ভবত দীঘলের পারফিউমের। প্রাণ ভরে গন্ধটা টেনে নিল টুয়া। দীঘলের কাঁধে মাথাটা হেলিয়ে বলল, ‘দমদম এয়ারপোর্ট আসতে আরও দেরি হোক। অনেক দেরি হোক।’
যেহেতু দু-তিনদিনের জন্য আসা, তাই লাগেজ একেবারেই বাড়ায়নি টুয়া। বাড়িতে জামার শেষ নেই। সর্বসময়ের সঙ্গী ল্যাপটপটা সঙ্গে নিয়ে চলে আসে।
মেন গেট খোলা দেখে একটু অবাক লাগল টুয়ার। দরজা তো বন্ধ থাকার কথা। দীঘল আর ও বাড়িতে ঢুকতেই সজোরে ধাক্কা লাগল মিনতিমাসির সঙ্গে। মাসির আঁচল থেকে পড়ে গেল কিছু ওষুধের স্ট্রিপ। ওষুধগুলো কি এক্সপায়ারি ডেটের? তাই মাসি ফেলে দিতে যাচ্ছে?
টুয়া একটা স্ট্রিপ তুলেই চমকে উঠল। এ তো সাইকিয়াট্রিস্টের দেওয়া ওষুধগুলো! ডেট তো রয়েছে।
মিনতিমাসির মুখ সাদা।
টুয়া বলল, ‘এগুলো কেন ফেলে দিতে যাচ্ছ মাসি?’
আমতা আমতা করে মিনতিমাসি বলল, ‘এগুলো খেতে চায় না, বলে তেতো।’
টুয়ার চোখে তীব্র সন্দেহের উঁকিঝুঁকি। দীঘলকে ইশারায় ভিতরে আসতে বলল টুয়া। দীঘল ওকে অনুসরণ করল। টুয়া বাবার ঘরে সোজা ঢুকে গেল। একটা বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাবা এই ওষুধটা খেয়ে নাও তো।’
বাবা বাধ্য ছেলের মতো ওষুধটা মুখে ঢোকাতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় আচমকা মাসি এসে প্রায় জোর করে ওষুধটা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘সব ওষুধ আমি খাওয়াব। কিন্তু এটা নয়। এটা কিছুতেই নয়। এটা খেলেই সব মনে পড়ে যাবে! আমাকে আর চন্দনা বলে কাছে বসাবে না। আমার থুতনিতে হাত দিয়ে আর বলবে না, ‘তুমি খুব সুন্দর। তোমার চোখ দুটো খুব সুন্দর।’ কেউ কোনোদিন আমায় সুন্দর বলেনি। গোটা পাড়ার লোক মুখের ওপর বলত, মিনতি সন্ধেবেলা পাড়ায় বেরোলে লোকে দাঁত উঁচু ভূত বলে ভয় পাবে। পাত্রপক্ষরা মিষ্টি খেয়ে বলে যেত, এই ভাতের হাঁড়িকে বউ করে নিয়ে গেলে লজ্জায় ডুবে মরবে আমার ছেলে। আমায় কেউ কোনোদিন সুন্দর বলে প্রশংসা করেনি দিদিমনি। আমি রোজ বৌদিমনির কাপড় পরে চন্দনা সাজি। ওই ব্যালকনিতে বসে আমরা কত গল্প করি। ওই ওষুধ তুমি খাইও না। সব মনে পড়ে যাবে ওর। আমাকে আর ভালোবাসবে না। আর আমার প্রশংসা করবে না কেউ।’
টুয়া স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ কী বলছে মাসি! এ কী অবাস্তব চাহিদা মাসির! বাবার চিরকালের সবকিছুতে প্রশংসা করার স্বভাব। মিনতিমাসিকেও সেভাবেই প্রশংসা করেছে। তাই বলে মাসি বাবাকে ওষুধগুলো খাওয়াবে না? বাবা মানসিকভাবে অসুস্থ থাকুক চায় মাসি! এ যে কল্পনার অতীত টুয়ার। এই জন্যই বাবার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলেও, মানসিক অবস্থার সেভাবে উন্নতি হয়নি। এখনও দিনরাত চন্দনা বলে ডেকে চলছে। আর মিনতিমাসি সেই ডাকে সাড়া দিয়ে মায়ের শাড়ি পরে বাবার সামনে বসে বিষয়টাকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছে বাবার কাছে। বাবারও কোথাও একটা বিশ্বাস রয়ে গেছে, মা বেঁচে আছে।
টুয়া ধিক্কার জানাল। দীঘল ওর মুখে আঙুল ঠেকিয়ে ইশারায় চুপ করতে বলল।
টুয়া দেখল, বাবা মিনতিমাসির হাতটা ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘দিনরাত এত কাজ কীসের চন্দনা? একটু বসো তো। আজকের খবরের কাগজের একটা খবর তোমায় পড়ে শোনাই।’
বাবার মুখে তৃপ্তির হাসি। মিনতিমাসির দুটো গাল ভেসে যাচ্ছে নোনতা জলে। বাবাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে চোখ দুটোতে অপরাধবোধ।
মিনতিমাসি বাবার হাতের ওপরে হাতটা রেখে বলল, ‘অসুস্থ রাখতে চাই না। শুধু হারিয়ে ফেলতে ভয় পাই। একজনের চোখে আমি সুন্দর— এই বিশ্বাস নিয়ে মরতে চাই। আমি চন্দনা হয়ে বাঁচতে চাই।’
বাবা হাত দিয়ে মাসির চোখের জলটা মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘আহা, কাঁদছ কেন চন্দনা? তোমার এই অভিমানী স্বভাবটা আর গেল না।’
দীঘল টুয়াকে টেনে বাইরে নিয়ে এল। হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে বলল, ‘বলেছিলাম না, যেদিন সত্যি তোমাকে বোঝাতে পারব ভালোবাসা আসলে কী, সেদিন তোমায় প্রোপোজ করব। আজ আশা করি বুঝতে পারছ, মিনতিমাসি নিজের সবটুকু উজাড় করে ভালোবাসে তোমার বাবাকে। এর থেকে পবিত্র ভালোবাসা হয় না চন্দ্রানী। তুমি এত নিষ্ঠুর হয়ে যেও না।’
মিনতিমাসি ব্যাঙ্কের বইটা টুয়ার সামনে ধরে বলল, ‘এই যে, এতে তুমি যা মাইনে দিতে সব আছে। একটা পয়সাও খরচ হয়নি। তুমি নিয়ে নাও। দোহাই দিদিমনি, আমাকে এবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিও না।’
দীঘল শান্ত গলায় বলল, ‘মাসি আঙ্কেলকে সুস্থ করে তুলতে হবে। আঙ্কেল আপনাকে ভালোবাসেন না, বাসেন চন্দনা আন্টিকে। কিন্তু আপনি যদি ধীরে ধীরে আঙ্কেলকে সুস্থ করে তোলেন ওষুধ খাইয়ে, তাহলে আপনার যত্নে, ভালোবাসায়, আঙ্কেল এই মিনতিকেই ভালোবাসবেন। ভালোবাসা তো শুধু ভালোবাসাকেই চেনে। ভয় নেই। সুস্থ হলেই আপনাকে ভুলে যাবেন এমন নয়।’
মিনতিমাসির চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অস্ফুটে বলে উঠল, ‘মিনতিকে ভালোবাসবে? তুমি সত্যি বলছ দাদাবাবু?’
দীঘল ঘাড় নেড়ে বলল, ‘সত্যি বলছি।’
মিনতি টুয়ার হাত থেকে ওষুধের স্ট্রিপটা নিয়ে দিবাকরের মুখে দিয়ে বলল, ‘তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাও। তোমায় মিনতি নামের একটা কুৎসিত মেয়ের গল্প বলব।’
দীঘল বলল, ‘চন্দ্রানী, বলেছিলাম না ভালোবাসা পরিণত হয় না। বয়সের বা পারিপার্শ্বিকতার হিসেব নিকেশ করে না। ভালোবাসা চিরকাল অবুঝ, অপরিণত, বড্ড অভিমানী হয়। থাকুক না এই সম্পর্কটা। দুজনে যদি ভালো থাকে অসুবিধা কী?’
টুয়া জড়িয়ে ধরল দীঘলকে। কানে কানে বলল, ‘ঠিক বলেছ, ভালোবাসা শুধু নিজেকেই চেনে।’
জানালায় চোখ রেখে দেখল টুয়া, বাবার মুখে হাসি। কোনো একটা খবর পড়ে শোনাচ্ছে মিনতিমাসিকে। মাসিও এক মনে শুনছে। দুজনকে এই মুহূর্তে দেখে মনে হচ্ছে এরাই বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ।
দীঘলের ফোনটা বাজছে…দীঘল বলল, ‘মা করছে। বিকেলে এসে তোমায় নিয়ে যাব আমাদের বাড়িতে।’
ফোনের রিংটোনটা বেজে চলেছে…
‘বড় ইচ্ছে করছে ডাকতে, তার গন্ধে মেখে থাকতে,
কেন সন্ধে সন্ধে নামলে সে পালায়,
তাকে আটকে রাখার চেষ্টা, আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তেষ্টা,
আমি দাঁড়িয়ে দেখছি শেষটা জানলায়।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন