ভালোবাসা রয়ে যায়

অর্পিতা সরকার

ভালোবাসা রয়ে যায়

‘কীগো, তুমি কি তাহলে এমন হাত-পা গুটিয়ে নেবে? এমন নির্লিপ্ত থাকো কী করে বলো তো? অভি আর নিশা ডিসিশন নিয়ে নিয়েছে ওরা ডিভোর্স নেবে। বাবা হয়ে তোমার কি একবারও ওদের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়? সেরকম বড় কোনো ইস্যু নিশ্চয়ই নয়। ঝগড়া তো হয়নি এ ক’দিনে। তোমাকে তো দুজনেই মানে-টানে, একটু দেখো না শেষ চেষ্টা করে।’

চিরন্তন দত্ত ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে স্থিরভাবে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। বরাবরের নির্ঝঞ্ঝাট নির্বিবাদী মানুষ। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। আর হয়তো বছরখানেক চাকরি আছে। তারপর রিটায়ার করবেন। তনুশ্রীকে বিয়ে করেছেন সেই চব্বিশ বছর বয়সে। আজ অবধি পাড়ার লোক কেউ চিরন্তনের গলার চিৎকার কেমন হয় শুনতে পায়নি। তনুশ্রী একাই চেঁচিয়ে ঝগড়া করেছেন কখনও সখনও, কিন্তু চিরন্তন চিরকালের শান্ত, ধীর-স্থির মানুষ। কিন্তু তাই বলে বোরিং নন মোটেই। খুবই হুল্লোড়ে। পাড়ার ক্লাবের সভাপতি উনি। পাড়ার ছেলেরা চিরুজেঠু বলতে অজ্ঞান। ক্লাবের সরস্বতী পুজো থেকে দুর্গা পুজোর নতুন নতুন প্ল্যান সব এই চিরুজেঠুর মাথা থেকেই আসে। তাই পাড়ায় খুব পপুলার। কিন্তু আজ অবধি কারোর সঙ্গে জোর গলায় কথা বলেননি। যাকে যা বলার শান্ত মেজাজে বলেছেন। তাতে কাজও হয়েছে।

একমাত্র ছেলে অভিরূপ আবার বাবার ঠিক উল্টো। অভিরূপ ফিন্যান্সে খুব ভালো চাকরি করে। ব্যবহারও খুব ভালো। কিন্তু রাগলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায় সেই ছোট থেকে। তনুশ্রী চাইল্ড সাইকিয়াট্রিস্ট দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তেমন কাজ হয়নি। মেধাবী, নম্র ভদ্র ছেলেটা রাগলে যেন সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়ে যায়। তখন মা হয়ে নিজের সন্তানকেই চিনতে পারেন না তনুশ্রী।

চিরন্তন শান্ত গলায় বলেছেন, ‘তনু, সব মানুষকে একই সরলরেখায় ফেলে দাগ টানলে তোমার দাগটা হয়তো সোজা সরল হবে ঠিকই, কিন্তু যাদের দিয়ে তুমি দাগটা কাটলে তারা কিছুদিনের মধ্যেই ওই দাগ থেকে বেরিয়ে যাবে। তখন তোমার ওই সরলরেখা বেঁকেচুরে যাবে। তার থেকে যাদের মেলাতে পারছ না তাদের একই দলে ফেলো না। পরে তুমিই মুশকিলে পড়বে। তার থেকে বরং হিসেব না মেলা অঙ্কগুলোর জন্য আলাদা পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারো। অভি ঠিক তেমনই হিসেব না মেলা অঙ্ক। তাই ও যাতে না রাগে সেটা খেয়াল রেখো। আর কেন অভি রেগে যাচ্ছে তার কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে আমাদেরই।’

অভির সঙ্গে নিশার প্রেমটা সেই স্কুল লাইফ থেকে। তিনদিন অন্তর ব্রেকআপ হয়েছে। আবার দুজনে দুজনকে মিস করেছে, আবার প্যাচআপ হয়েছে। ওদের সম্পর্কের যা বয়েস তাতে বোধহয় তিন দিয়ে গুন করলে ব্রেকআপ কতবার হয়েছে সেই সংখ্যাটা পাওয়া যাবে। কোনও সম্পর্কে যে এতবার ব্রেকআপ হতে পারে সেটা বোধহয় কল্পনাতীত। তার থেকেও আশ্চর্যজনক হল, এরা আবার নিজেদের ইগো ছেড়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে। এমনকী বিয়ে অবধি গড়িয়েছে ওদের সম্পর্কটা। মাত্র এক বছর হল বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে মাঝে-মাঝেই বেশ ঝাঁঝালো ঝগড়া শোনা যায় এদের। তখন তনুশ্রীই গিয়ে মধ্যস্থতা করে ঝামেলা মেটান। কিন্তু এবারের ঝামেলাটা যে ঠিক কী, বুঝতে পারেনি তনুশ্রী। কোনো ঝগড়া নেই, মান-অভিমান নেই, নালিশ, অভিযোগ কিছু নেই। হঠাৎই দুজনে অফিস থেকে ফিরে ড্রয়িংরুমে বোমাটা ফাটাল, ‘আমরা ডিভোর্স চাই। এটা আমরা দুজনে খুব ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমরা এর মধ্যে একেবারেই ইন্টারফেয়ার করবে না। শুধু একই ছাদের নীচে থাকি বলে জানিয়ে দিলাম। নিশা ডিভোর্স ফাইল করেই বাপের বাড়ি চলে যাবে।’

এই কথাটা শোনার পরে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে গিয়েছিলেন চিরন্তনবাবু। তনুশ্রী তো রীতিমতো ফুঁপিয়ে কান্নাকাটি করতে শুরু করেছিলেন।

নিশা এবং অভি দুজনেই চলে গিয়েছিল। এই ক’দিন অভি গেস্টরুমে থাকছে। এই ফ্ল্যাটে তিনটে বেডরুম। একটা আত্মীয়স্বজন না এলে একেবারেই ব্যবহার হয় না। তনুশ্রী দেখলেন, নিশাই পরিষ্কার চাদর নিয়ে গিয়ে ওই ঘরের ডিভানে পেতে দিল। জলের বোতল ভরে ওই ঘরে রেখে এল। এমনকী অভির কিছু পোশাকও ওই ঘরের আলমারিতে গুছিয়ে দিয়ে এল। সবই চোখের সামনে দেখলেন তনুশ্রী, কিন্তু ঠিক কী কারণে ওরা ডিভোর্স চাইছে, সেটা জানা গেল না। নিশাকে তনুশ্রী আজ থেকে চেনেন না। সেই স্কুলের সময় থেকে অভির সঙ্গে এই বাড়িতে আসছে। মেয়ের থেকে কিছু কম নয় ও। ওরা মুখ খুলছে না দেখে বাধ্য হয়েই রাত্রে নিশার ঘরে গিয়েছিলেন তনুশ্রী। দেখলেন নিশা নিজের সব জিনিস আলমারির একটা লম্বা তাকে গোছনোর চেষ্টা করছে। যাতে চট করে ট্রলিতে প্যাক করে নেওয়া যায়।

তনুশ্রী নিশার পাশে বসে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আমাকেও বলবি না ঠিক কী হয়েছে?’

নিশা হালকা করে তনুশ্রীর কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘ডিভোর্সটা তোমার ছেলের সঙ্গে হবে মামনি, তোমার বা বাবাইয়ের সঙ্গে নয়। তোমাদের কাছে আমি আসব মাঝে-মাঝেই।’

তনুশ্রী বলল, ‘কারণটা জানতে চাইছি। অভির রাগের সঙ্গে তো তুই ক্লাস নাইন থেকে পরিচিত। তাই শুধু ওর রাগটা যে কারণ নয় সেটুকু আমি বুঝেছি। আসল কারণটা আমায় বলবি? তোদের ঝগড়ার সময় আমি তো সবসময় অভিকে বকেছি। তোকে তো কোনোদিন বকিনি বল। কারণ আমি জানতাম মাথা গরম অভিই করে, তুই নিজেকে সামলাস। আজকেও আমায় বল মা, ঠিক কী হয়েছে?’

নিশা বলল, ‘এটা জানতে চেয়ো না মামনি। নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাব। আর তো মাত্র সাতদিন আছি এ বাড়িতে, এ ক’দিন এসব থাক।’

তনুশ্রী বলল, ‘তোর বাবা-মা জানেন? হ্যাঁ রে, আমি কী উত্তর দেব জয়িতাকে? তোর বাবা যখন জিজ্ঞেস করবে, তনুশ্রীদি ঠিক কী হয়েছিল ওদের মধ্যে যে আপনারা মেটাতে পারলেন না, তখনই বা কী বলব?’

নিশা বলল, ‘কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবে না তোমায়। নিশ্চিন্তে থাকো।’

নিশা আর কথা বাড়াতে চায়নি। তনুশ্রীও প্রশ্ন খুঁজে না পেয়ে নিরুপায় হয়ে অভির ঘরে গেছেন।

অভি ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে, হাতও কি-প্যাডে, কিন্তু অন্যমনস্ক।

তনুশ্রী ছেলের এলোমেলো চুলে আঙুল ডুবিয়ে বলেছেন, ‘হ্যাঁ রে অভি, তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস না? আগে তো মাকে কোনো কথা না বললে তোর ঘুমই আসত না। আর এখন মাকে কিছু বলতেই চাস না।’

অভি একটু সতর্ক হয়ে বলেছে, ‘এখনও তো সব বলি মা। তোমাকে তো বললাম, একটা নতুন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। আর প্রজেক্ট ম্যানেজারও আমিই। তাই কাজের খুব প্রেশার থাকবে সামনের পাঁচ মাস।’

তনুশ্রী নিরুপায় হয়ে বললেন, ‘নিশার সঙ্গে ডিভোর্স কেন দরকার হল?’

অভি বলল, ‘সেটা তুমি নিশাকে জিজ্ঞাসা করে দেখো। আমার তো ডিভোর্সের দরকার ছিল না। নিশাই জানিয়েছে সে আর থাকতে চায় না।’

তনুশ্রী অবাক হয়ে বলেছেন, ‘কিন্তু কেন বলেছে নিশা এ কথা। কী করেছিস তুই?’

অভি বলল, ‘ওটা বরং তুমি নিশার কাছ থেকেই জেনে নিও।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেমে এসেছেন তনুশ্রী। তারপরেই চিরন্তনের দ্বারস্থ হয়েছেন। আজ অবধি তনুশ্রীর কোনো আবদার চিরন্তন রাখেননি, এমন হয়নি। আজ প্রথম কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে আছেন।

তনুশ্রী আবারও বললেন, ‘কী গো, তুমি ওদের একবার ডেকে কথাও বলবে না? আর কারণটা ঠিক কী সেটা তো জানবে নাকি? বাবা হয়ে কিছু কর্তব্য তো করো।’

চিরন্তন বললেন, ‘আজ নয় কাল কথা বলব। যদিও ওদের দুজনের সিদ্ধান্তের ওপর আমার কিছু বলাটা একেবারেই উচিত নয়, তবুও একটু কথা তো বলতেই হবে। আসলে কী জানো তনু, ঝগড়া হলে ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিত না। ক্ষতটা বোধহয় গভীরে। তাই এত বড় সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হল না। ঝগড়া তো ওদের আজ থেকে হচ্ছে না। এটা বিষয় নয়।’

নিশা আজ ওদের বেডরুমে একা শুয়ে আছে। অভির ল্যাপটপের আলো চোখে লাগছে না। অভির সিগারেটের উৎকট গন্ধ এসে নাকে লাগছে না। অভির ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢালার আওয়াজ নেই। নিস্তব্ধ, নিশ্চিন্ত রাত্রি। তবুও ঘুম আসছে না নিশার। চোখ বন্ধ করলেই অভির ক্লাস ইলেভেনের মুখটা মনে পড়ছে। ক্লাস নাইনে ওরা একই টিউশনে পড়তে ঢুকেছিল। টিউশনের সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বললেও নিশার সঙ্গে কথা বলত না অভি। কারণটা অবশ্য নিশা কোনোদিন জানতে চায়নি। এমনিতেই ছোট থেকে ও কম কথা বলা মানুষ। অভি ছিল ওদের ব্যাচের সব থেকে হই-হুল্লোড়ে ছেলে। ও না এলে মধুসূদন স্যার বলতেন, ‘আজ ব্যাচটা বড্ড ফাঁকা লাগছে বুঝলি। বিচ্ছুটা আজ আসেনি না।’

তবে অভির রাগ ছিল মারাত্মক। একবার ব্যাচের কোনো একটা ছেলে ওর ফ্যামিলিকে অপমান করে গালাগাল দিয়েছিল। অভি ছেলেটাকে মেরে ওর নাক ফাটিয়ে দিয়েছিল। এমন রগচটা মুডি টাইপ ছেলে নিশার পছন্দের তালিকায় কোনোদিনই ছিল না। ও বরাবরই শান্ত নদীর মতো। গতিহীন নয়, বর্ষার দামালপনা নেই ওর মধ্যে। নিজেকে জাহির করার ইচ্ছেও ওর কোনোদিনই ছিল না। অভির ঠিক কী কারণে ওর ওপরে রাগ সেটা অবশ্য ও জানত না। অভি পড়াশোনাতেও ভালো ছিল। বয়েস স্কুলের ফার্স্ট সেকেন্ড হত। নিশা ওদের গার্লস স্কুলে দশের মধ্যে অবশ্যই থাকত। তাই অভির কথা বলার যোগ্য নয় এমনটাও নয়। তবুও অভি নিশাকে দেখলেই বিরক্ত হত। নিশা এর কারণ জানার চেষ্টাও করেনি।

একদিন অভি টিউশনে আসেনি। সেদিন মধুসূদন স্যার গল্পের ছলে বলে ফেলেছিলেন, ‘আজ ভাগ্যিস অভি আসেনি, না হলে নিশার প্রথম অঙ্ক করে ফেলায় যথেষ্ট রাগ করত।’

বন্ধুরা হেসে বলেছিল, ‘হ্যাঁ স্যার, অভির ধারণা মেয়েরা অঙ্ক পারে না। মেয়েরা আর্টস পড়বে। সায়েন্স ওদের বশের নয়। নিশা অঙ্কে ভালো বলেই অভির রাগ।’

রাগের কারণটা শুনে আরও বিরক্ত হয়েছিল নিশা। কোন মধ্যযুগে বাস করে এই ছেলে যে, মেয়েরা আর্টস পড়বে ভাবনা নিয়ে বসে আছে? মাদাম কুরি কি ছেলে নাকি?

অভির ব্যাপারে এত দিন নিস্পৃহতা ছিল। এবারে রীতিমতো রাগ আর বিরক্তি মিশে অদ্ভুত একটা অনুভূতি জন্ম নিল।

অঙ্কের ব্যাচে মধুসূদন স্যার এক্সাম নিলেন একদিন। অভি আর নিশা একই নম্বর পেল। নিশা নিরুত্তাপ। কিন্তু অভি যে বেশ অখুশি সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। এভাবে একই ব্যাচে একই টাইমে পড়াশোনা করেও ওদের মধ্যে সামান্যতম কোনো কথা হল না কোনোদিন। ওরা মাধ্যমিক পাস করে গেল। ইলেভেনে একই স্কুলে ভর্তি হল। নিশা সায়েন্স নিয়েই ভর্তি হল। অভি স্কুলেও নিশাকে চিনেও চেনে না ভান করে থাকে। নিশারও কোনো সদিচ্ছা নেই ওর সঙ্গে ভাব করার। এরকম অবস্থায় একদিন একটা ঘটনা ঘটে গেল স্কুলে।

স্যার অভিকে বোর্ডে ডেকেছিলেন অঙ্ক কষতে। অভি কোনো কারণে ভুল পদ্ধতিতে অঙ্কটা এগোচ্ছিল তাই অনেক চেষ্টা করেও মেলাতে পারল না। স্যার এরপরে নিশাকে ডাকলেন বোর্ডে। নিশা অঙ্কের একেবারে শেষ ধাপে এসে চকটা টেবিলে রেখে দিয়ে বলল, ‘স্যার পারছি না।’

ঠিক সেইসময় অভি বলল, ‘আমি কমপ্লিট করে দিচ্ছি।’

নিশার করা অঙ্কটা জাস্ট আরেকটা স্টেপ করতেই উত্তর মিলে গেল। মোটামুটি ক্লাসের সবাই সেদিন বুঝতে পেরেছিল নিশা ইচ্ছে করেই আগের স্টেপে অঙ্কটা ছেড়ে দিয়েছিল।

স্কুল ছুটির পরে চৌমাথায় আইসক্রিমের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অভি। নিশাকে দেখেই বলল, ‘আমি কি জিততে চেয়েছিলাম তোর কাছে?’

নিশা একটু থেমে বলল, ‘আমি হারলে কেউ যদি আনন্দ পায়, পাক না। তাছাড়া কেউ কেউ মেয়েদের কাছে হেরে গেলে জীবন বৃথা মনে করে। আমি মনে করি তাদের জিতিয়ে দেওয়া উচিত।’

অভি হেসে বলেছিল, ‘আমার সম্পর্কে হোমওয়ার্ক কমপ্লিট দেখছি। আর কী কী জানিস আমার সম্পর্কে?’

নিশা বলেছিল, ‘আগে আইসক্রিম খাওয়া, তারপর বলব।’

দুজনে আইসক্রিম খেতে খেতে হাঁটছিল। এতদিনের পরিচিত হয়েও কথা না বলার বাঁধন সেদিন আলগা হয়ে গিয়েছিল।

নিশা বলেছিল, ‘কারোর একজনের ধারণা যে মেয়েরা অঙ্ক পারে না, তাদের সায়েন্স নিয়ে পড়ার অধিকার নেই। কেউ একজন রেগে গেলে মারমুখী হয়। আর দীপান্বিতা একজনকে প্রপোজ করেছিল, তাকে সে বলেছে তার নাকি অঙ্ক পারে না এমন মেয়ে পছন্দ নয়। আগে যেন নিশার কাছে গিয়ে ভালো করে অঙ্ক শিখে আসে।’

অভি লজ্জা পেয়ে বলল, ‘এটা তো চকলেট বলে দিল, কুলফির টেস্ট পাচ্ছি কেন বল তো?’

নিশা বলল, ‘ওই যেমন অঙ্ক করতে পারে এমন মেয়ে তুই সহ্য করতে পারিস না, আবার অঙ্ক পারে না এমন মেয়ের প্রেমে পড়বি না। এমনই অদ্ভুত কম্বিনেশন আছে এই আইসক্রিমে। চকলেট আর কুলফির মিশ্রণ।’

অভি হেসে বলেছিল, ‘তোকে এতদিন খুব শান্ত মেয়ে মনে হত। এখন তো দেখছি, বিছুটি।’

নিশা ওর দিকে অপলক তাকিয়ে বলেছিল, ‘তোকেও তো মনে করতাম তুই খুব অহংকারী। এখন দেখলাম, জিতিয়ে দিলে তুই মিশতেও পারিস।’

নিশার বাড়ির কাছাকাছি এসে অভি বলেছিল, ‘আমার জন্য অমন লাস্ট স্টেপে গিয়ে অঙ্ক ছেড়ে দিবি না। তুই পারলে আমারও কেমন একটা গর্ব হয় রাগের সঙ্গে সঙ্গে।’

নিশা মুচকি হেসে বলেছিল, ‘ঠিক চকলেট আর কুলফির রেয়ার কম্বিনেশন।’

এরপর থেকে অভি নিশাকে দেখলে কেমন একটা লজ্জা পেত। বলতে চাইত অনেক কিছু কিন্তু নিশা সামনে দাঁড়ালে সব গুলিয়ে যেত। ‘কী রে কেমন আছিস? খুব পড়াশোনা করছিস?’ এর বাইরে আর কিছু বলা হয়ে উঠত না।

উচ্চমাধ্যমিকের ঠিক আগে আগেই টিউশন থেকে ফিরছিল নিশা। হঠাৎই অভি ওর সামনে সাইকেল থামিয়ে দাঁড়ায়। অভি কিছু জিজ্ঞাসা না করা সত্ত্বেও নিশা হেসে বলেছিল, ‘ভালো আছি রে। এক্সামের প্রিপারেশন মোটামুটি ভালোই।’

অভি তখন বলেছিল, ‘না, আজ এসব কথা জিগ্যেস করতে দাঁড়াইনি। অন্য একটা কথা বলার ছিল।’

নিশা উৎসুক হয়ে বলেছে, ‘বল কী বলবি?’

অভি অন্যদিকে তাকিয়ে বলেছে, ‘সব যে আমাকেই বলতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? তুইও তো বলতে পারিস। বুঝিস না যে তা তো নয়।’

নিশা হাসি চেপে বলেছিল, ‘কী বুঝি রে? তুই আমাকে দেখলে কথা হারিয়ে ফেলিস এটা আমি বুঝি। কিন্তু তার কারণটা কী সেটা বুঝি না।’

অভি বলেছিল, ‘কারণটা আর কী? যে কারণে তুই বোর্ডে অঙ্ক করতে করতে থেমে গিয়ে হেরে যাস, সেটাই ধরে নে।’

নিশা শান্ত স্বরে বলেছিল, ‘আমি তোকে সর্বত্র জয়ী দেখতে চাই। কিন্তু তোর কথা আটকে যাওয়ার কারণটা আমি কী করে জানব বল?’

অভি বলেছিল, ‘দ্যাখ বস, ওই হাঁটু গেড়ে প্রোপোজ করা আমার দ্বারা হবে না। তবে তুই জেনে রাখ, অনেক কিছু বলতে গিয়েও থমকে যাই।’

নিশা বলেছিল, ‘তুই যতদিন থমকে আছিস ততদিন আমার মনের মধ্যে বিনা রঙে একটা ছবি আঁকা হয়ে চলেছে। ভয় করে তোকে কোনোদিন অন্য কারোর হাত ধরে দেখব না তো। তার থেকে তোর চুপ করে থাকা ঢের ভালো। আমার মনে আঁকা হয়ে যাক ওই ছবির শেষাংশ।’

অভি বলল, ‘আর যদি দেখিস ছবি শেষ হওয়ার পরে আমি অন্য কারোর হয়ে গেলাম, তখন?’

নিশা হেসে বলেছিল, ‘তখন ওই ছবিটাকে খুব বকব, খুব কাঁদব।’

অভি বলেছিল, ‘বুঝেছি। তোকে আর কাঁদতেও হবে না, বকতেও হবে না।’

নিশা তবুও না বোঝার ভান করে বলেছিল, ‘কেন রে?’

অভি চোখটা বন্ধ করে বলেছিল, ‘আমার অঙ্ক জানা মেয়েটাকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে তাই।’

এই বলে আর দাঁড়ায়নি অভি। ঝড়ের বেগে সাইকেল চালিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। নিশা সেদিন একা বসে ছিল মদনমোহন দীঘির পাড়ে। গাছ থেকে গুলঞ্চ পড়ে দীঘির পাড়টা সাদা আর হলুদে মাখামাখি হয়েছিল। সেদিকে আনমনে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল নিশার। বারবার অভির লজ্জা পাওয়া মুখটা মনে পড়ে হাসি পাচ্ছিল। অত রাগী দাপুটে ছেলেও তাহলে লজ্জা পায়! নিশার ইচ্ছে করছিল গাছের প্রতিটা পাতায় অভির নাম লিখতে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি। এর আদৌ কোনো নাম আছে কিনা জানা নেই নিশার। দু’বছর আগেও যে ছেলেটা ওকে দেখলে এড়িয়ে যেত, রেগে যেত, সে আজ ওকেই চায়। এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ভাবনার জগতে ডুবে গিয়েছিল নিশা।

চুপিচুপি পা টিপে টিপে নিশার দরজায় চোখ রাখল অভি। নিশার ঘরের লাইট নেভানো। তার মানে, ঘুমিয়ে পড়েছে নিশা। আজ হয়তো বেশ শান্তিতেই ঘুমাচ্ছে মহারানি। অন্যদিন তো ওর ল্যাপটপের আওয়াজ, ওর সিগারেটের গন্ধে নিশার বিরক্তি উৎপাদন হয়। আজ একলা ঘরে বেশ ভালোই আছে। দু’দিনের মধ্যে তো নিজের বাড়িতে চলে যাবে নিশা। বাড়িতে যাবে নাকি কোথাও ফ্ল্যাট ভাড়া করবে সেটা অবশ্য জানে না অভি। তবে ডিভোর্স ফাইল করলে সেপারেশনে থাকতে হবে এটা বেশ জানে। ওর মতো অপদার্থের সঙ্গে আর কাটাতে হবে না নিশাকে, এটাই তো অনেক। এই বাড়ি থেকে চলে গেলেই শান্তি পাবে। অভি কী করবে না করবে ভাবার তো দরকার নেই ওর। অভি একাই অহেতুক কষ্ট পাচ্ছে। আজ নিশ্চিন্তে মুভি বা ওয়েব সিরিজ দেখতেই পারত। ল্যাপটপে আলো জ্বলছে বলে কেউ বিরক্ত করার নেই। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছে না এসবে। এত সহজে এত বড় একটা কথা বলে দিল নিশা! একেবারে ডিভোর্স চায়। ওকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে না নিশার?

না, হবে না বোধহয়। কিন্তু আগে হত। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে অভির ম্যালেরিয়া হয়েছিল, প্রায় মাসখানেক অসুস্থ ছিল। তখন নিশার কষ্ট হত। তাই রোজ চিঠি লিখে পাঠাত পবিত্রকে দিয়ে। প্রতিটা চিঠি আজও যত্ন করে জমিয়ে রেখেছে অভি।

বেডরুম ছাড়ার সময় নিজের ওই টুকরো স্মৃতি জমা রাখার বক্সটাও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে এই রুমে।

বক্সটা খুলতেই কত কিছু চোখের সামনে ভেসে উঠল। নিশার দেওয়া কুমার শানুর সিডি, পেন সেট, হাত ঘড়ি। ঘড়িটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তবুও ফেলেনি অভি।

হালকা সবুজ খামে ভরে চিঠি পাঠাত নিশা যেহেতু অভির প্রিয় রং সবুজ।

একটা চিঠি খুলল অভি। তাতে লেখা আছে,

‘ফোন করেছিলাম তোমায়। আন্টি বললেন, তুমি ঘুমাচ্ছ। তোমার ঘুমন্ত মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল আমার। রাগি রাগি অভি ঘুমালে কেমন লাগে দেখার লোভ হচ্ছিল। আর কতদিন পরে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হবে বলো তো? তুমি অসুখকে বলো, কেউ একজন তোমায় দীর্ঘদিন না দেখে অসুস্থ হয়ে পড়ছে তো। এক কাজ করো। তোমার অসুখকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও। তখন তুমি সুস্থ আর আমি অসুস্থ। দেখবে কেমন লাগে! মনে হবে এই কলেজ ক্যাম্পাস, এই ক্যান্টিন, ওই টিউশন সব সব শূন্য। বুঝবে মিস করা কাকে বলে। ওহ, তুমি তো সব সময় জিতবে তাই না। তাই এক্ষেত্রেও তোমাকে আমিই মিস করছি। বুঝতে পারছি তোমায় ছেড়ে থাকা কতটা কঠিন।

অভি তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি সাত দিন তিন ঘণ্টা পনেরো মিনিট। প্রতিটা মুহূর্তে আমি অনুভব করেছি, তোমার অনুপস্থিতির কষ্ট। এভাবে আর কতদিন?

জানো অভি, আজ ছাদে উঠেছিলাম। দেখলাম, শরতের মেঘ আঁকিবুকি কাটছে আকাশে। ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম, ওই ছোপ ছোপ মেঘগুলোতে তোমার ছবি ফুটে উঠেছে। তোমার চোখ, তোমার নাক, তোমার ঠোঁট…একটা গোটা অভি আমার বিকেলের আকাশ জুড়ে।’

চিঠিতে বা আদর করে ওরা একে অপরকে ‘তুমি’ বলত তখন। তুই-তুমি ওদের সম্পর্কে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল। কখনও প্রেমিক সত্ত্বায় তুমি এসে জুড়ে বসত, কখনও বন্ধু সত্ত্বায় তুইয়ের অধিকারবোধ।

তখন নিশা ওকে মিস করত।

এখন আর করে না। এর মধ্যে অবশ্য ওদের ব্রেকআপ হয়েছে বারবার।

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের থার্ড ইয়ারে নিশার বন্ধু সৌতিককে নিয়ে খুব ঝামেলা করেছিল অভি। অভি বলেছিল, সৌতিক নিশার প্রতি দুর্বল হয়তো নিশা সেটা বুঝেও বোঝে না। নিশা কিছুতেই মানতে চায়নি অভির কথা। ও বলেছিল, সৌতিক ওর ভালো বন্ধু মাত্র। সৌতিক ওদের দুজনের সম্পর্কের কথা জানে তারপর হঠাৎ দুর্বলতা কেন দেখাতে যাবে। কিন্তু নিশার ব্যাপারে চূড়ান্ত পজেসিভ অভির চোখে ধরা পড়েছিল সৌতিকের নিশার প্রতি আগ্রহ। এই নিয়ে সমস্যা থেকেই ব্রেকআপ করেছিল নিশা। বলেছিল এমন সন্দেহবাতিক মানুষের সঙ্গে নাকি ও থাকতে পারবে না।

প্রায় মাস দুয়েক কথা বলেনি নিশা অভির সঙ্গে।

বহুবার ক্ষমা চাওয়া সত্ত্বেও জেদ ধরে বসেছিল। শেষে অভি মনখারাপ করে প্রায় দিনসাতেক কলেজ যায়নি। তখনই নিশা ফোন করে বলেছিল, ‘ন্যাকামি না করে কলেজ আয়। তোর মতো হাড়বজ্জাত ছেলে আমি জীবনে দেখিনি। অসভ্য আর হিংসুটে তুই।’

নিশার মুখে এসব শুনলে অভি বুঝতে পারত বরফ গলেছে। আবার ওদের ভাব হত। এভাবে কত তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে নিশা ব্রেকআপ করত অভির সঙ্গে।

অভি হাজার ঝগড়া করলেও কখনও ব্রেকআপ করেনি। কিন্তু নিশা বলত, এরকম বদরাগি, মুডি ছেলের সঙ্গে নাকি জীবন কাটানো সম্ভব নয়। তারপরেও ওরা ছাদনা তলায় বসেছে। নিশার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়েছে। সাতপাকে ঘুরেছে। অভি ভেবেছিল, আর কোনোদিন ঝগড়া হলেও নিশা ওকে ছেড়ে যেতে পারবে না। কিন্তু আজ যেটা হল সেটা অভির কল্পনার বাইরে ছিল। একেবারে বাবা-মার সামনে দাঁড়িয়ে ডিভোর্সের কথা বলে দিল নিশা। এই ভাবতে ভাবতে আরো একটা চিঠি খুলল অভি।

এটা সম্ভবত নিশার সঙ্গে ঝগড়া হওয়ার পরে ও লিখেছে।

‘অভি,

তুই হয়তো ভাবছিস গতকাল তুই এসে সরি বললি আর আমায় করা সব অপমানগুলো মুহূর্তে বাতাসে মিলিয়ে গেল। না রে, মানুষের মনটা এতটাও সরল পথে চলে না। আমি হাজার চেষ্টা করলেও কিছুতেই তোর বলা ওই কথাগুলো ভুলতে পারছি না। চেষ্টা করছি আমিও। কারণ তোকে ভালোবাসি। তোকে মিস করি। তোকে ছেড়ে থাকাটা কষ্টকর। কিন্তু তোর বলা কথাগুলো তোর বলা সরির মতো অতটা হালকা নয় বলেই হয়তো বেশ জমিয়ে বসেছে আমার মনের মধ্যে।

কী অবলীলায় বলে দিলি—এত সেজেগুজে মুভি দেখতে এসেছিস কেন? আমার সঙ্গে সঙ্গে অন্যরাও তোকে দেখবে বলে? কেন রে আমি একা দেখলে বুঝি তোর ভালো লাগে না?

কে জানে কথাগুলোতে তোর পজেসিভনেস, ভালোবাসা এসবকে ছাপিয়ে গিয়ে তীব্র অপমানটুকুই আমার গায়ে এসে লাগল। তোর জন্য করা সাজগোজ, মুভি, তোর আনা পপকর্ন—সব মূল্যহীন হয়ে গেল মুহূর্তে। তবুও সিন ক্রিয়েট করতে ইচ্ছে করেনি। অভি, আমায় একটু সময় দে। সরি বলে তুই সব মিটিয়ে দিতে চাস, আমিও চাই। কিন্তু আমার মনের ক্ষতটার একটু সময় লাগবে প্রলেপ লাগাতে। সেটুকু সময় আমাকে দে প্লিস।’

অভির মনে পড়ে গেল, তখন বেশ কিছুদিন নিশা কথা বলেনি ওর সঙ্গে। কোনো রাগ অভিমান নয়, শুধু চুপ করে ছিল। একটা ঠান্ডা ব্যবহার করে যাচ্ছিল অভির সঙ্গে। অসহ্য হয়ে উঠেছিল অভির জীবনটা। নিশা ঝগড়া করছে না, রাগ নয় শুধুই শীতলতা। যে শীতলতার প্রতিটা বরফের টুকরো এসে সজোরে তিরের মতো বিঁধেছিল অভির গায়ে।

এখনও ঠিক একই পরিস্থিতি। নিশা ভীষণ রকমের শান্ত। কোনো কথা নেই। ওকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কোন ঘরে থাকবে এই তিনদিন? বেডরুমে নাকি গেস্টরুমে?’

অভি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি কোথায় থাকতে চাও?’

নিশা শান্ত গলায় বলল, ‘যেটায় তুমি থাকবে না সেটায়।’

তারপর অভিই বলেছে, ও গেস্টরুমে থাকবে। তাই অভির যাবতীয় জিনিসপত্র এনে গেস্টরুমে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়ে গেছে নিশা। কোনো অবহেলা নয়, কোনো বিরক্তি নয়, নিখুঁত ভাবে সব করে দিয়েছে ও।

অভি অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। কেমন যেন অসহায় লাগছিল ওর। নিশার এমন ঠান্ডা ব্যবহারের সামনে ও ঠিক কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না।

ওকে পায়চারি করতে দেখেই বোধহয় বাবা উঠে এসেছে। ওর পিঠে আলতো করে হাত রেখে বলল, ‘ঘরে চল।’

ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে মধ্যরাত অতিক্রম করেছে প্রায় ঘন্টাখানেক আগেই। চারিদিক নিস্তব্ধ। কয়েকটা রাত চরা পাখি আর রাত জাগা কুকুরের হঠাৎ বিকট আওয়াজে ডেকে ওঠা ছাড়া এ তিলোত্তমা এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

অভির জীবনে এর আগেও যত সমস্যা এসেছে বাবাকে ও পাশে পেয়েছে। মা একটু স্পর্শকাতর। কেঁদে ফেলে কথায় কথায়। কিন্তু বাবা অত্যন্ত বাস্তববাদী বলেই বাবার সঙ্গে সব বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়।

চিরন্তনবাবু অভির দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করলেন, ‘যাকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবলে তোমার কষ্ট হচ্ছে তাকে তুমি মন থেকে দূরে সরাতে পারোনি এটুকু নিশ্চিত। কখন মানুষ ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নেয় জানো? যখন তার ছায়াটাও অসহ্য লাগে কোনো কারণে। যখন সম্পর্কের অবনতি ঘটতে ঘটতে সেটা পলকা হয়ে যায় তখন কোনো আঘাত ছাড়াই সেটা ভেঙে পড়তে চায়। সেইসময় মানুষ বোঝে এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গেলে শুধুই তিক্ততা আসবে। আর তাই দুজনে সিদ্ধান্ত নেয় ডিভোর্সের। কিন্তু অভি তুমি তো কষ্ট পাচ্ছ, নিশাকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছ। তাহলে তোমাদের সম্পর্কের সুতোটা তো এখনও পলকা হয়নি, ছিঁড়েও যায়নি। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণটা কী? নিশাকে আমি সেই স্কুলবেলা থেকে দেখছি। তোর জন্মদিনের পার্টিতে আসত মিষ্টি, শান্ত একটা মেয়ে। অন্যদের মতো হুল্লোড়ে নয় কিন্তু বেশ মিশুকে। তাছাড়া নিশা খুব ধীর-স্থির। এতদিনের চেনা যদি ভুল না হয়ে যায় তাহলে এটুকু নিশ্চিন্তে বলতে পারি ও ভাঙতে আসেনি এবাড়িতে, বরং ও গড়তেই এসেছে। এমন একটা মেয়ে আচমকা এরকম একটা কঠিন ডিসিশন কেন নিল অভি?’

অভি চুপ করে জানলার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্ধকার আকাশের চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারছে ও। লজ্জা করছে না। অন্ধকারের এই এক সুবিধে, আলোর মতো প্রকট নয় বলে অপরাধগুলোকে এক নিমেষে চিহ্নিত করে দিতে পারে না। আপাতত অন্ধকারকে বড্ড আপন মনে হচ্ছে অভির। বাবার করা প্রশ্নগুলো সূর্যের তীব্র আলোর মতো। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে গলাটা কেঁপে গেল অভির। অভি সামলে নিয়ে বলল, ‘তোমরা তো চিরটাকাল আমার দোষ দেখে গেলে। নিশাকে গিয়ে কেউ প্রশ্ন করেছ কেন সে ডিভোর্স চায়? নাকি এই সম্পর্কের সব দায়িত্ব শুধুই আমার?’

চিরন্তনবাবু ছেলের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। অভির অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাবা যেন সবটা পড়ে নিচ্ছে। অভির যে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে সেটা বুঝতে পেরেই চিরন্তন বললেন, ‘বেশ বলো না তবে। যদিও কারোর পার্সোনাল বিষয়ে ইন্টারফেয়ার করা আমি একেবারেই পছন্দ করি না, করতামও না। তোমাদের সিদ্ধান্তকেই গুরুত্ব সহকারে মেনেও নিতাম। কিন্তু ওই একটা মানুষের কাছে আমি একটু দায়বদ্ধ, সেটা হল তোমার মা। তোমার মাকে যেদিন বিয়ে করে এনেছিলাম, সেদিন কথা দিয়েছিলাম আমার সাধ্যমতো তার সব কথা আমি রাখার চেষ্টা করব। এতদিন সেই চেষ্টা করেওছি। তনুশ্রী এতটাই ইমোশনাল তোমাদের ব্যাপারে যে, তার ধারণা কথা বললেই বিষয়টা মিটে যাবে। আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম তনুকে যে, এটা শুধু রাগ বা ঝগড়া নয় তাহলে মিটে যেত হয়তো। কোনো কারণে নিশা খুব গভীরে আঘাত পেয়েছে। তাই অত শান্ত মেয়েটা এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। কিন্তু তোমার মাকে তো তুমি চেনো, তার অভিমান তো সহজে কমে না। তাই শুধু তোমার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলতে এসেছিলাম আমি। এটা অত্যন্ত অন্যায় বুঝেও এসেছিলাম। আসলে তনু কাঁদছে এটা মেনে নেওয়া আমার জন্য আবার বড্ড অসহায়তার। যাই হোক অভি, রাত অনেক হল। ঘুমিয়ে পড়লেই ভালো হয়, কাল তো অফিস আছে সকলেরই।’

বাবা যেমনভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেল।

অভি বলতে চেয়েছিল সবটুকুই, কিন্তু বলা হল না কিছুই। বাবা বারংবার নিশার সাইড নিচ্ছিল বলেই বলতে ইচ্ছে করল না। নিশা যেন কোনো দোষ করতেই পারে না এমন ধারণা নিয়েই বসে আছে সবাই। এদের বলবেই বা কী!

লাইট অফ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল অভি। স্বপ্ন দেখল না সত্যিই নিশা এসেছিল ওর ঘরে, ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারল না। তবে উত্তরের জানালাটা ভোরে উঠে দেখল বন্ধ আর ওর গায়ে একটা পাতলা ঢাকা দেওয়া।

অভির ঠান্ডা লাগার ধাত বলে নিশা বরাবরই একটু সচেতন থাকে। বর্ষাকালের জোলো হাওয়া যাতে না লাগে সেজন্যই কি ও এসে বন্ধ করে দিয়ে গেছে জানালাটা? নাকি মা এসেছিল? অভি যে বন্ধ করেনি সেটা ওর স্পষ্ট মনে আছে।

অন্যদিন চায়ের কাপ দুটো নিশাই নিয়ে আসে। চা খেতে খেতে টুকিটাকি কথা হয়। আজ মা এসে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে গেল বিশেষ কথা না বলে। বাড়ির আবহাওয়ায় গুমোট ভাব। বর্ষার মেঘের মতো গুমরে যাচ্ছে যেন। বৃষ্টি নামলেও গুমোট কাটছে না। নিশা এল না আজ চা নিয়ে। অভির জীবনের পরিবর্তন শুরু হল আজ সকাল থেকে। অভ্যস্ত জিনিসগুলো থেকে বেরোতে হবে ওকে। নিশা আর ওর শার্ট-প্যান্ট-টাই, ওয়ালেট-ঘড়ি রেডি করে রাখবে না। একসঙ্গে একই গাড়িতে অফিসও হয়তো যাবে না। অভির কেমন বিস্বাদ ঠেকল চা-টা। ঠিক সেই কলেজের দিনগুলোয় যখন নিশার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়েছিল, বা কোনো কারণে কথা বন্ধ হত তখন নিকোটিনের স্বাদটাও ওর বিশ্রী লাগত। অভ্যাসবশে খেত হয়তো কিন্তু আনন্দের বদলে বিরক্তি উৎপাদন হত। আজও অভির অনুভূতিগুলো একই আছে একটুও বদলায়নি নিশার ব্যাপারে। শুধু নিশার অনুভূতিগুলোই বদলে গেছে ওর ব্যাপারে। তাই এত সহজে একটা ছোট্ট ব্যাপারে বলে দিত পারল, ‘আমাদের ডিভোর্স দরকার অভি। এভাবে হয় না।’

আজকের সকালটা অন্যদিনের থেকে বড্ড আলাদা। অদ্ভুত একটা একাকীত্ব যেন ঘিরে ধরছে ওকে। জোর করে উঠে দাঁড়াল অভি। ওদের বেডরুমের দিকে তাকিয়ে দেখল নিশা রেডি হচ্ছে অফিসের জন্য।

ড্রয়িংরুমে রোজকার দৃশ্য। মায়ের ছোটাছুটি বাবাকে অফিস পাঠানোর আগে। যত্ন করে টিফিনবক্স ভরে দিচ্ছে, বাবার হাতে ঘড়িটা অবধি দিয়ে দিচ্ছে। ছোট্ট থেকে এই দৃশ্য দেখে আসছে অভি। এদের অনেক ঝগড়া হয়েছে, অভিমান হয়েছে তবুও সব ভুলে কী সুন্দর দুজনে দুজনকে বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। যদিও বাবা বলে বাবার কাছে নাকি সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মায়ের অভিমান। অভির বুকটা ভারী হয়ে এল। ওদের সম্পর্কটা কেন বিয়ের পরে দীর্ঘস্থায়ী হল না? প্রেম যখন করেছে তখন তো ওর কত দোষ ক্ষমা করে দিয়েছে নিশা, তাহলে আজ কেন এভাবে নিষ্ঠুর হল ও। এখন অভি কী করবে!

নিশার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও তো পারবে না। কারণ গতকাল যখন নিশা বলেছিল, আমার ডিভোর্স চাই, তখন অভিও রাগ দেখিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, আমারও মনে হয় এটাই সঠিক পন্থা।’

নিশা একটু যেন চুপ করে গিয়েছিল। অভি তখন আরও জোর দিয়ে বলেছিল, ‘এভাবে কথায় কথায় ঝগড়া আমারও একঘেয়ে হয়ে গেছে। আমিও মুক্তি চাই।’

কী অদ্ভুত তাই না! চেনা গলির মোড়, চেনা চায়ের দোকান, চেনা নিজের ঘরের অন্ধকার কোণ, চেনা গানের সুর, ভীষণ চেনা মানুষটাকে রোজ দেখতে দেখতে বড্ড একঘেয়ে হয়ে যায় মন। খুব ইচ্ছে করে স্বাদ বদল হোক। কিন্তু দু’দিন এই পরিচিত সবকিছু ছেড়ে পাহাড়ে বেড়াতে গেলেই মনে হয়, অনেক হল অপরিচিতর সঙ্গে ভাব করা, এবার ফিরতে হবে। বড্ড মনকেমন করে সেই চির চেনা একঘেয়ে জিনিসগুলোর জন্য। আসলে অভ্যস্ত চোখ বেশি দিন অন্যকিছু সহ্য করতে পারে না। অভিরও একই অনুভূতি হচ্ছে এখন। মনে হচ্ছে ও যেন পাহাড়ের কোনো অচেনা বাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে নিশা নেই। অভির মনকেমন করে উঠল, ভিতর থেকে কেউ যেন বলে উঠল ফিরে চল তোর বড্ড চেনা মানুষটার কাছে।

ঠিক তখনই ঝেঁপে বৃষ্টি নামল।

কোনোমতে ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়ির চাবিটা হাতে নিয়ে বেরোতেই দেখল নিশা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইলে উবের ট্র্যাক করছে। বাবা বৃষ্টির আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল। উবের ক্যানসেল করে দিচ্ছে বৃষ্টির জন্য।

অভি খুব সাবধানে বলল, ‘গাড়ি বের করছি এসো। না হলে অফিস পৌঁছাতে দেরি হবে।’

কথা না বলে গাড়িতে উঠে বসল নিশা। না রোজ যেখানে বসে সেই সিটে নয়। আজ পিছনে বসেছে ও। দূরত্ব বেড়েছে ওদের সম্পর্কের সেটাই যেন বেশি করে প্রকট হচ্ছে নিশার এই পিছনের সিটে বসা দেখে।

প্রতিদিনের মতোই এফএম-টা অন করল অভি।

কেউ একজন কবিতা বলছে ভরাট গলায়…

“ঠিক সময়ে অফিসে যায়?
ঠিক মতো খায় সকালবেলা?
টিফিনবাক্স সঙ্গে নেয় কি?
না ক্যান্টিনেই টিফিন করে?
জামাকাপড় কে কেচে দেয়?
চা করে কে আগের মতো?
দুগগার মা ক’টায় আসে?
আমায় ভোরে উঠতে হত
সেই শার্টটা পরে এখন?
ক্যাটকেটে সেই নীল রঙটা?
নিজের তো সব ওই পছন্দ
আমি অলিভ দিয়েছিলাম
কোন রাস্তায় বাড়ি ফেরে?”

সম্ভবত এটি জয় গোস্বামীর কবিতা। বাইরে বৃষ্টির আওয়াজ। গাড়ির মধ্যে ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতায় কবিতার লাইনগুলো যেন আরও বেশি অস্বস্তি দিচ্ছিল অভিকে। তাড়াতাড়ি পাল্টে দিল চ্যানেল।

নিশা বলল, ‘অভি ভালো থাকিস। তোর কোনো দোষ নেই। আমি তো জানতাম তুই এরকমই। কিন্তু ইদানীং আমারই বয়েস বেড়েছে তাই কিছু জিনিস আর আগের মতো মেনে নিতে পারি না রে, সরি। তাই ডিভোর্সের ডিসিশন নিলাম। চিন্তা করিস না, কোনো খোরপোষ তোকে দিতে হবে না। আমি এমনই মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স নেব। আমরা দুজনেই চাকরি করি তাই তোর কাছ থেকে শুধু মেয়ে হওয়ার সুবিধা নেব, এমন নয়।

শোন না, তোর সব দরকারি ফাইল আমাদের আলমারির ডান দিকের লকারে গুছিয়ে রেখেছি। আর তোর মোজা, রুমাল এগুলো নীচের তাকে থাকল।’

অভির কান্না পাচ্ছিল। বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘প্লিস নিশা, ওই ভুল আর কখনও করব না। আমায় ছেড়ে যাস না প্লিস। তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না।’ কিন্তু বলতে গিয়েও বলা হল না। শুধু বলল, ‘বেশ।’

নিশা বলল, ‘বাপির সঙ্গে কথা হয়েছে ফোনে। পরশু ফিরে যাব ওই বাড়িতে। তাহলে আগামীকাল চল কোর্টে গিয়ে ফাইলটা করে আসি।’

অভি ঘাড় নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ চল।’

অভি আচমকাই বলল, ‘আরেকবার ভেবে দেখা উচিত আমাদের দুজনেরই।’

নিশা একটু থমকে গিয়ে বলল, ‘সম্পর্কটা কিন্তু কম দিনের নয় অভি। এরপরেও যদি তুই আমায় বিশ্বাস না করতে পারিস, তাহলে সেই সম্পর্কটার গভীরতা যে এক চুল বাড়েনি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিন্ত। অফিসে থাকাকালীন আমিও তোকে বহুবার ফোন করে পাইনি, কই আমি তো তোকে কোনোদিন বলিনি যে তুই কোনো মহিলা কলিগের সঙ্গে কফি খেতে গেছিস। আর যদি গিয়েও থাকিস তাতেই বা কী? অথচ আমি অফিসে মিটিংয়ে থাকলে, কোনো কারণে তোর ফোন রিসিভ না করতে পারলেই তুই বলতে শুরু করিস, ‘বসের রুমে ছিলিস? প্রাইভেট কথা হচ্ছিল বুঝি? ফোন রিসিভ করলি না কেন?’ এগুলো কী অভি? দয়া করে স্কুলের মতো এগুলোকে পজেসিভনেস বলে হালকা করার চেষ্টা করিস না। এই বয়েসে এসে এগুলো মানায় না বুঝলি!’

অভি বলল, ‘পজেসিভনেসের কোনো বয়েস হয় না। তাছাড়া তুই সুন্দরী। আর তোর বসকে আমার মোটেই পছন্দ নয়। তাই জিজ্ঞাসা করেছি। এতে এত রিয়্যাক্ট করার কী আছে বলবি? আরে তুইও তো আমার প্রতি একটু পজেসিভ হতে পারতিস? আমি কি বলেছি, আমায় তুই এতটাও বিশ্বাস করে ছেড়ে দে?’

নিশার জাস্ট বিরক্ত লাগছিল। এই বয়েসে এসে এমন স্কুল-কলেজের প্রেম মোটেই পোষাচ্ছে না নিশার। একটু তো ম্যাচিওরিটি দরকার অভির। সবকিছুর একটা বয়েস আছে। পজেসিভনেস নয় এটা, এটাকে সন্দেহবাতিক বলে। অনেক সহ্য করেছে অভির এসব রাগ-অভিমান, আর নয়। এবার বুঝুক অভি ওকে ছাড়া।

নিশা নেমে গেল অফিসে। অভি চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘ফেরার সময় নিয়ে যাব।’

নিশা বলল, ‘আমি উবের করে নেব। তোকে আসতে হবে না।’

অফিস থেকে বাড়ি ঢুকেই অভি দেখল নিশা বসে আছে ড্রয়িংরুমে। ওর চোখে জল। মা রীতিমতো কাঁদছে। বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে বই হাতে। অভি কিছু বোঝার আগেই নিশা বলল, ‘মা চলে যাচ্ছে। এই বাড়িতে বাবার সঙ্গে আর থাকতে চায় না।’

অভি আরেকটু হলেই সোফার পায়ায় হোঁচট খেত। মা দু-একবার ঝগড়া করে একদিন কথা বন্ধ রেখেছে বাবার সঙ্গে, সেই অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু একেবারে ছেড়ে চলে যাবে মানেটা কী?

মায়ের সামনে একটা ট্রলি ব্যাগ রাখা। নিশা মাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছে কোনো একটা ব্যাপারে। কিন্তু মা কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। মায়ের একটাই কথা, ‘তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে এখনও এত সন্দেহবাতিক পুরুষ হয় কী করে? আমি আর ওর সঙ্গে ঘর করতে পারব না নিশা। তুই আমায় দিয়ে আসবি চল।’

অভি বাবার সামনে বসে বলল, ‘কী হয়েছে? কী করেছ তুমি মায়ের সঙ্গে?’

চিরন্তনবাবু রেগে বললেন, ‘তোমার এটা কেন মনে হল যে, আমিই দোষী তোমার মা নয়? জিজ্ঞাসা করো তোমার মাকে সে কী করেছে!’

অভি বলল, ‘এ তো মহা মুশকিল! এই বয়েসে এসে কীসের এত ইগো গো? বলো কী হয়েছে?’

নিশা মাকে বোঝাচ্ছে, ‘শোনো রাগ করো না। বাবা তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে— এটা তো তুমি মানবে। তাই হয়তো মজা করেই বলেছে।’

তনুশ্রী বললেন, ‘কীসের মজা রে নিশা! অরবিন্দদা আজ এত বছর এই ক্লাবের সেক্রেটারি। প্রতিবছর আসেন বাড়িতে চাঁদা নিতে। এসেই বলেন, এক কাপ কড়া করে চা খাব তনুশ্রীর হাতের। এতে দোষ কোথায়? আরে, বলতে পারেন না? তোর বাবা বলে, সবার নাকি বাড়িতে গিয়ে চাঁদা তোলে না অরবিন্দ। সব জায়গায় ক্লাবের ছেলেদের পাঠায়। একমাত্র আমাদের বাড়িতেই নাকি আমার হাতের চা খেতে আসে। আর আমি নাকি এটা প্রশ্রয় দিই। এলেই গদগদ হয়ে হেসে চায়ের সঙ্গে টা দিই। তুই বল নিশা, এই অপবাদ কেন সহ্য করব আমি? আমি ডিভোর্স নেব।’

অভি আর নিশা চুপচাপ চোখ চাওয়া-চাওয়ি করল। নিশার ঠোঁটে অস্বস্তি। অভির চোখে কৌতুক। নিশা বলেছিল না বয়েস হলে পজেসিভনেস কমে যায়! আর ভালোবাসা থাকলে এই হিংসুটেপনাও থাকবে। বাবার উনষাট বছরেও আছে।

অভি বিচারকের ভূমিকায় বসে বলল, ‘দেখো এসব করে লোক হাসিও না। ডিভোর্সের ইস্যু এটা হতে পারে না।’

চিরন্তনবাবু বললেন, ‘তোকে আমি জিজ্ঞাসা করেছি তোদের ডিভোর্সের ইস্যু কী? তাহলে তুই এত বড় বড় কথা বলছিস কেন? তোরা নিজের ঘরে যা।’

তনুশ্রী বাড়ির দরকারি চাবি নিশার হাতে দিতেই নিশা জড়িয়ে ধরল মাকে। বলল, ‘শোনো মা, তোমায় একটা কথা বলি, ছোট্ট কারণে আমরা কেউই ডিভোর্স নেব না, বরং ওই অরবিন্দকাকুকে ডেকে তুমি ডিনার করিয়ে ছাড়বে এবার থেকে। যাদের সমস্যা হবে তারা বুঝে নেবে। আসলে যত বয়সই হোক পুরুষমানুষ বদলায় না।’

অভি বলল, ‘একদম ঠিক। আমরা উজাড় করে ভালোবাসতে পারি। তাই লক্ষ রাখতে হয় অনেক বেশি।’

নিশা কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। অভিও পিছন পিছন গিয়ে বলল, ‘এই যে মহারানি, তাহলে বুঝলে তো ভালোবাসা, পজেসিভনেস এসবের কোনো বয়েস হয় না। এটাকে সন্দেহবাতিক বলে না। নিজের জিনিস আগলে রাখা বলে।’

নিশা বিরক্ত মুখে বলল, ‘আসলে ভুলটা তো আজ করিনি রে। ওই মধুসূদন স্যারের টিউশনে ঢুকেই মস্ত বড় ভুল করেছিলাম। আজীবন এই ভুলের বোঝা আমাকে এভাবেই বয়ে বেড়াতে হবে। অসহ্য রকমের বিরক্তিকর একটা মানুষ।’

অভি আচমকা ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘প্লিস সহ্য করে নে। তুই ছাড়া আমার সব কিছু বর্ষার মেঘের মতো থমথমে হয়ে যায়।’

চিরন্তনবাবু বললেন, ‘বেশ কড়া করে চা করো দেখি এককাপ। যেমন অরবিন্দর জন্য করলে।’

তনুশ্রী হেসে বললেন, ‘এই জন্যই তোমায় পাড়ার সবাই ডাকে তাদের সমস্যার সমাধানের জন্য। তুমি কী করে জানলে যে ওদের এটাই প্রবলেম?’

চিরন্তনবাবু বললেন, ‘দোষটা যে অভির সেটা আগেই বুঝেছিলাম। আজ সকালে নিশাকে ফোনে বলতে শুনলাম, ‘আরে ওই আধবুড়ো বসের কাছেও ঘেঁষতে দেবে না অভি। এমন হলে চলে বল? সেই স্কুল থেকে একটুও বদলালো না। তখনই বুঝলাম সমস্যাটা আসলে কোথায়? নিশাকে এসব বলার জন্যই মেয়েটা অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছে। অভির যে কবে বুদ্ধি হবে কে জানে!

তবে একটা কথা কিন্তু সত্যি, তোমাকে অরবিন্দ খুব মন দিয়ে দেখে, বুঝলে।’ তনুশ্রী ফিক করে হেসে বললেন, ‘বেশ, তাহলে ওকে একদিন ডিনারে নিমন্ত্রণ করি।’

চিরন্তনবাবু বললেন, ‘আসলে এরা এখনও জানে না যে একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। এদের সম্পর্কের সুতোটা বড্ড মজবুত করে বাঁধা। এমন বন্ধনে ডিভোর্স হয় না। ডিভোর্স কেন, বিরহও সহ্য হয় না। ভাবছি কাল থেকে অভিকে একটু বউয়ের মন ভোলানোর উপায় শেখাব।’

তনুশ্রী চায়ের কাপটা নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওহ এতদিনে বুঝলাম এসব তাহলে আমাকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা মাত্র!’

চিরন্তনবাবু হেসে বললেন, ‘পারলে এ গিঁট খোলো দেখি।’

নিশা-অভির ঘরে গান বাজছে…

‘আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।’

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন