অর্পিতা সরকার
‘আহা দেবসেনা, এসব পাগলামি বাদ দাও তো। ওই অপরাধীর না আছে ছাড়া পাওয়ার ইচ্ছে, না আছে বাঁচার আবেগ। দিনরাত বসে বসে একটা খাতায় আঁকিবুকি করে যাচ্ছে। উনি নাকি উপন্যাস লিখছেন। সে উপন্যাস একেবারে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পেয়ে যাবে যেন। তুমি কয়েদিদের নিয়ে রিসার্চ পেপার রেডি করতে চাও খুব ভালো, তুমি মহিমের মেয়ে, সবরকম হেল্প আমি করব। মহিম ফোন করে বলল, দেবসেনা যাচ্ছে ওকে যেন হেল্প করি। কয়েদিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমি নিলাম। কিন্তু পাঁচজন কয়েদির সঙ্গে তোমায় আমি কথা বলার সুযোগটুকুও দিতে পারব না দেবসেনা। এই জনা পাঁচেক কয়েদি গত তিন-চার বছরে কারোর সঙ্গে কো-অপারেট অবধি করেনি। এদের আত্মীয়রা উকিল নিয়ে এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে, এরা মুখ দিয়ে টুঁ শব্দ বের করেনি। তাই এদের মধ্যে এখনও একটা করে ভয়ঙ্কর ক্রিমিনাল বাস করছে। তুমি আমার কাছের বন্ধু মহিমের মেয়ে। তোমার কোনো বিপদ হোক আমি চাইব না।’
দেবসেনা আদুরে গলায় বলল, ‘কিন্তু কাকু, আমি অর্জুন রায়ের কেস হিস্ট্রি পড়েছি। ইনফ্যাক্ট যে মিডিয়ায় যতটুকু খবর বেরিয়েছিল, সব পড়েছি। থানায় জমা পড়া ওর বয়ান অবধি আমি পড়েছি। তারপরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি অর্জুন রায়ের ওপরে গবেষণা করব। প্লিস কাকু, হেল্প মি। কেসটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং।’
একটু যেন অন্যমনস্ক হলেন জেল সুপার দেবদুলাল মিত্র। কেসটা যে ইন্টারেস্টিং সেটা দেবদুলাল নিজেও জানেন। প্রথম যেদিন অর্জুনকে দেখেছিলেন, সেদিন চমকে উঠেছিলেন তিনি। নিরীহ দুটো কবি কবি চোখ, পরনে একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি, ফেডেড জিন্স, চুলগুলো একটু উস্কোখুস্কো। তর্জনীতে একটা জায়গায় কড়া পড়ে গেছে। ওকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘তুমি খুন করার চেষ্টা করেছিলে ইন্দ্রাণী নামের মেয়েটাকে?’
অর্জুন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, ‘আমি আমার ভালোবাসাকে মরতে দেখলাম, বিশ্বাসকে ছিন্নভিন্ন হতে দেখলাম, মানুষ খুন কি তার থেকেও বেশি অপরাধ?’ তারপরেই নিজের এলোমেলো মাথার চুলগুলো খামচে ধরে বলেছিল, ‘ইন্দ্রাণী বেঁচে গেল আমার হাত থেকে। ওকে মেরে ফেলা দরকার ছিল। ভীষণ দরকার ছিল। আমাকে একঘণ্টা সময় দিন আমি ওকে নিজের হাতে শেষ করে আপনাদের কাছে এসে সারেন্ডার করছি।’
চমকে গিয়েছিল এসআই গৌরব মিত্র। দেবদুলালকে বলেছিল, ‘স্যার, এ তো নিজেই স্বীকার করেছে যে খুন করতে চায়। একবার সুযোগ পেলেই প্রেমিকাকে মেরে ফেলবে।’
আর কোনো কথা কোনোদিন বলেনি অর্জুন। শুধু বিজবিজ করে বলত, ‘ইউক্যালিপটাস গাছটা বাড়ির গেটের সামনে আমি বসিয়েছিলাম। গাছটা একটু বড় হতে তার নীচে একটা বেঞ্চ রাখব ভেবেছিলাম। কিংবা সিমেন্টের বাঁধানো বেদি। শুকনো পাতায় ছেয়ে থাকবে সেই বেদিটা। হল না, কিছু হল না।’
ওর বিরুদ্ধে ইন্দ্রাণী কেস এনেছিল—অ্যাটেম্পট টু মার্ডার।
এ কেস এতদিন চলে না। কবেই ছাড়া পেয়ে যেত অর্জুন। কিন্তু যতবারই ওর উকিল ওকে কোর্টে দাঁড় করিয়েছে, ততবারই ও একই কথা বলেছে, ‘একঘণ্টা সময় দিন আমি ইন্দ্রাণীকে শেষ করেই ফিরে আসছি।’
দেবসেনা বলল, ‘হ্যাঁ কাকু, এই কথাগুলো আমি পড়েছি। কিন্তু কেন খুন করতে গিয়েছিল, সেটা না অর্জুন বলেছে না ইন্দ্রাণীর কোনো বয়ানে আছে। ইন্দ্রাণী বলেছিল, ওর আর অর্জুনের নাকি দীর্ঘ পাঁচ বছরের লাভ রিলেশন ছিল। ওদের বন্ধুরা মিলে ফাল্গুন মাসে বিয়ের ডেট ফাইনাল করেছিল। সেই অবস্থায় যখন ওদের বিয়ের আর মাত্র তিনমাস বাকি তখন ওদের শপিংয়ে ব্যস্ত থাকার কথা, ঠিক সেইসময় আচমকাই অর্জুন মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আর হঠাৎই ওকে গলা টিপে খুন করতে চায়। ইন্দ্রাণী কোনোমতে ওর কাছ থেকে পালিয়ে বেঁচেছে। ইন্দ্রাণী নাকি অর্জুনকে অনেক জিজ্ঞাসাও করেছে ঠিক কী কারণে ও এমন করছে? কিন্তু অর্জুন চুপ ছিল, আক্রমণাত্মক ছিল। তাই বাধ্য হয়ে নিজেকে বাঁচাতে ইন্দ্রাণীকে অর্জুনের বিরুদ্ধে কেস করতে হয়েছে।’
দেবদুলালবাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, একদমই তাই। এর বেশি তথ্য কেউ দিতে পারেনি। অর্জুন তো কোনো কথাই বলে না দেবসেনা। আর এমন ধরনের চুপ করে থাকা মানুষগুলোর বুকের মধ্যে থাকা প্রতিশোধের আগুনটা কিন্তু কিছুতেই নিভে যায় না। ধিকধিক করে জ্বলে। কম কয়েদি তো জীবনে দেখলাম না! তাই এটুকু স্টাডি করতে পারি যে অর্জুন বাইরে থেকে ঠিক যতটা শান্ত, ভিতরে ঠিক ততটাই হিংস্র। এতকিছু জানার পরও আমি তোমাকে ওর কাছে যেতে দিতে পারি না, তুমি আমায় ক্ষমা করো। অর্জুনের মা দুবার দুটো উকিল নিয়োগ করেছিল, কারোর সঙ্গে কথা বলেনি ও। শেষে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে।’
দেবসেনা নাছোড়বান্দা। ও বলল, ‘প্লিস কাকু, একবার আমায় চেষ্টা করতে দিন। সাতদিন সময় নেব, যদি উনি কথা না বলেন তাহলে আর অনুরোধ করব না।’
দেবদুলালবাবু একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘বেশ, সুযোগ কিন্তু বারবার দেব না দেবসেনা। তুমি কাল সকাল এগারোটার পরে চলে যেও জেলে, আমি বলে রাখব।’
দেবসেনা টুপ করে একটা প্রণাম সেরে বেরিয়ে এল।
সমীররঞ্জন স্যারের বাড়ি একবার ঘুরে যাবে। স্যারের আন্ডারে পিএইচডি করবে কথা হয়েই আছে। কয়েদিদের জীবনদর্শন নিয়ে রিসার্চ পেপার্সগুলো রেডি করতে হবে। আনমনে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল দেবসেনা। যদি এই অর্জুন নামক ছেলেটি ওকে দেখেই পত্রপাঠ বিদায় করে দেয়, তাহলে ও কী করবে? অন্য কয়েদিদের সঙ্গে কথা বলে পেপার রেডি করাই যায়, কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভেঙে যাবে দেবসেনা। কে জানে কেন অর্জুন নামক ছেলেটির সব কথা শোনার পর ওর সম্পর্কে লেখার ইন্টারেস্টটা বেড়েই চলেছে।
ফোনটা ভাইব্রেট করছে জিন্সের পকেটে। বের করতেই স্ক্রিনে ফুটে উঠল শতরূপের নামটা। ইদানীং আর ভালো লাগে না শতরূপের সঙ্গে কথা বলতে। কেমন একটা গা গোলানো অনুভূতি কাজ করে দেবসেনার মধ্যে।
ফোনটা কেটে দিল ও। ইচ্ছে করছে না কথা বলতে। ট্যাক্সিতে উঠে বসতেই আবার ফোন। শতরূপ একবার ফোন করে কোনোদিন রেহাই দেয় না দেবসেনাকে। যতক্ষণ পর্যন্ত না দেবসেনা রিসিভ করছে এবং শতরূপের সমস্ত কথা বলা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ও কল করেই যাবে। দেবসেনা যেন ওর নিজস্ব সম্পত্তি। ঠিক যেন শতরূপের জমিদারির অংশে পানীয় পুকুর। সেখানে কে নামবে, আর কে নামবে না সেটা একমাত্র ওরই ঠিক করার অধিকার আছে।
দেবসেনা ফোনটা রিসিভ করে বলল, ‘ব্যস্ত আছি। অকারণে বিরক্ত কেন করছিস?’
শতরূপ ওর নিজস্ব স্টাইলে বলল, ‘আমার জন্য তুই সব সময় ফ্রি দেবী। নন্দনে চল আজ বিকালে। মুভি দেখব।’
দেবসেনা শীতল গলায় বলল, ‘আজ হবে না রে, সরি। আমি একটা কাজে ব্যস্ত আছি।’
শতরূপের গলার পারদ চড়ছে। দেবসেনার মুখ থেকে স্পষ্ট ‘না’ শুনতে ও অভ্যস্ত নয়। থমকে দাঁড়িয়ে গেছে শতরূপের স্বর। কিছুক্ষণের বিরতির পর বলল, ‘আমাকে অ্যাভয়েড করছিস তুই? তাহলে অকারণে আমাকে বাঁচিয়ে রাখলি কেন? সেদিনই তো নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম আমি। কেন বাঁচতে শেখালি আমাকে?’
দেবসেনা শান্ত গলায় বলল, ‘তোকে বাঁচতে শিখিয়েছি বলেই কি তুই আমাকে দমবন্ধ করে মেরে ফেলতে চাইছিস? আমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত কন্ট্রোল করতে চাইছিস তুই রূপ? এভাবে জোর করে কিছু পাওয়া যায়? বরং দূরত্ব বাড়ে।’
ফোনটা কেটে দিল শতরূপ। আগে হলে দুশ্চিন্তায় ব্যাকুল হত দেবসেনা। বারবার ফোন করত রূপকে। ওর ফোনে সুইচড অফ পেলে ওর বড়দিকে কল করে ফেলত উত্তেজনায়। এখন সেসব ভয় আর পায় না দেবসেনা। কী করবে শতরূপ? সুইসাইড করবে? সুইসাইড নোটে ওর নাম লিখে রেখে যাবে? যা ইচ্ছে করুক রূপ। এমন দমবন্ধ জীবন থেকে ও নিজেও মুক্তি চায়। বন্ধুত্বের মাশুল প্রতিমুহূর্তে গুনতে গুনতে ও এখন ভীষণ রকমের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। রূপের হুমকি তাই আর ওর ভিতরে প্রবেশ করে না কিছুতেই। রূপের ওই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার হুমকি বহুবার ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে।
কলেজের নবীন বরণের দিন ও প্রথম দেখেছিল শতরূপকে। না শতরূপ সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের ছাত্র নয়। ফিজিক্সের স্টুডেন্ট ছিল। একই দিনে দুটো ডিপার্টমেন্টেরই নবীন বরণ ছিল। নিজের ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে দেবসেনা একাই হাঁটছিল। কপালে এক বিন্দু চন্দনের টিপ, পরনে শরতের আকাশকে টেক্কা দেওয়ার মতো আকাশ নীল শাড়ি, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ, হাতে দুটো গোলাপ আর একটা পেন। গোলাপ আর পেনটা ফ্রেশারদের গিফট।
হঠাৎই চোখে পড়েছিল, একটা ছেলে গোলাপের পাপড়িগুলো নৃশংসভাবে ছিঁড়ে মাটিতে ফেলছে, তারপর অহেতুক রাগে জুতো দিয়ে পিষে চলছে। ছেলেটার কপালে চন্দনের টিপ দেখেই বুঝেছিল ফ্রেশার। একটু এগিয়ে গিয়ে দেবসেনা বলেছিল, ‘নিরীহদের ওপরে রাগ দেখিয়ে অনেককে বীরপুরুষ হতে দেখেছি।’
ছেলেটা সম্ভবত এমন আকস্মিক কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল, ‘নিরীহ! কে নিরীহ? ওই গোলাপগুলো? কিছুতেই ওরা নিরীহ নয়। বরং অনেকটা রক্ত জমাট বেঁধে রেখে দিয়েছে নিজেদের পাপড়িতে। ওরা যদি সাদা হত, তাহলে ব্লাড ক্রাইসিসে কেউ মারা যেত না।’
আর দাঁড়ায়নি ছেলেটা। হনহন করে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গিয়েছিল করিডোর পেরিয়ে। পিছনে বিমূঢ় হয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল দেবসেনা। গোলাপের লাল রঙের সঙ্গে রক্তের কী সম্পর্ক সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিল ও। দুটোর রং লাল ছাড়া আর তো কোনো সাদৃশ্য খুঁজে পায়নি ও। দুটোর প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণ আলাদা। ছেলেটাকে অদ্ভুত লেগেছিল ওর।
পরের দিনও কলেজে দেখেছিল ওই দলছুট ছেলেটাকে। ইউক্যালিপটাস গাছের নীচে বসে বেদনার লালচে দানাগুলোকে মাটিতে ফেলে পিষে চলছে।
দেবসেনা ধীর পায়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলেছিল, ‘কোন ডিপার্টমেন্ট তোমার?’
ছেলেটা বিরক্তির সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল, ‘ফিজিক্স। মানুষকে একটু একা থাকতে দেখলে তোমাদের বড্ড কষ্ট হয় তাই না? তাকে যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের হল্লাবাজির দলে না মিশিয়ে ফেলতে পারছ, ততক্ষণ পর্যন্ত অস্বস্তি হয় বুঝি?’
দেবসেনা নিজের হাতটা ওর দিকে বাড়িয়ে বলেছিল, ‘দেবসেনা মিত্র। সাইকোলজি, ফার্স্ট ইয়ার। আমিও ভীষণ একলা বাঁচা মানুষ। বলতে পারো নিতান্ত প্রাইভেট পার্সন। তাই একলা মানুষকে দেখলেই বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছে করে। মনে হয় আরেকজনকে পেলাম আমার দলে, যে নীরব থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু পাই কই তেমন কাউকে। সবাই তো দলে মিশে যেতেই পছন্দ করে।’
ছেলেটা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছিল, দেবসেনার কথা শুনে ওর বাড়ানো হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলেছিল, ‘শতরূপ ব্যানার্জী। ফার্স্ট ইয়ার ফিজিক্স। তুমিও কি হই হট্টগোল পছন্দ করো না?’
দেবসেনা ঘাড় নেড়ে বলেছিল, ‘আমি বন্ধুত্বে গভীরতা পছন্দ করি। শুধু একসঙ্গে সিনেমা দেখা, ঝালমুড়ি খাওয়া, অন্তক্ষরীর বেঞ্চ বাজানোর বাইরেও যে বন্ধুত্ব হয়, সেটা পছন্দ করি। এই যেমন চুপচাপ বসে সূর্যাস্ত দেখা, অথবা পাতা খসার আওয়াজ শোনা কান পেতে।’
শতরূপ একটু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আর বন্ধুর হাঁড়ির খবর নেওয়া? তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে কথা বলা—এগুলো কেমন লাগে তোমার?’
দেবসেনা হেসে বলেছিল, ‘যতটুকু সে বলতে চায় ততটুকুই আমি শুনতে চাই। প্রশ্নবাণে ব্যতিব্যস্ত করা আমার একেবারেই পছন্দ নয়।’
শতরূপ নিজের ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিল, ‘যেন আর কেউ না জানে আমার নম্বর।’
দেবসেনা দাঁড়িয়ে দেখেছিল শতরূপের চলে যাওয়া। আজকের হাঁটার মধ্যে সেই প্রথম দিনের আক্রোশ নেই, বরং পাগুলো যেন একটু এলোমেলো পড়ছে। অল্প অন্যমনস্ক ভাব রয়েছে হাঁটার ছন্দে। দেবসেনা মনে মনে খুশি হল, সাইকোলজির স্টুডেন্ট হিসাবে এটা ওর সাকসেস। একজন মানুষকে সামান্য হলেও ভাবাতে পেরেছে ওর কথা।
তবে শতরূপকে দেখে দেবসেনা সেদিনই বুঝতে পেরেছিল ওর মধ্যে মারাত্মক কোনো সমস্যা আছে। গভীর ক্ষত আছে। পড়াশোনাটা হয়তো করে নিচ্ছে মন দিয়েই, কিন্তু স্বাভাবিক জীবনযাপন যে ছেলেটা করে না সেটা ওর চোখের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিই প্রমাণ করে।
প্রায় রোজই ক্যান্টিনে শতরূপ আর দেবসেনা একসঙ্গে বসে টিফিন খেত। ধীরে ধীরে শতরূপের একমাত্র বন্ধু হয়ে উঠল দেবসেনা। শতরূপের মনের মধ্যে জমে থাকা কঠিন বরফটা একটু একটু করে গলতে শুরু করেছিল। কোনো কথায় আচমকা হেসে উঠছিল শতরূপ। হাসিবিহীন রাগী মুখের শিরা-উপশিরাগুলো আবারও ছন্দে ফিরছিল। দেবসেনা বলেছিল, ‘রূপ আমরা কিন্তু ভালো বন্ধু। প্রেমিক-প্রেমিকা নই। এই সম্পর্কে আমার দমবন্ধ লাগে। ওই একটার পর একটা কমিটমেন্ট, রাগ-অভিমান এসব ঠিক ভালো লাগে না। বরং মুক্ত আকাশে যে সম্পর্ক পাখির মতো ডানা মেলতে পারে সেই সম্পর্কটার নাম বন্ধুত্ব। আমাদের মধ্যে সেটাই থাকবে। তাছাড়া তোকে দেখে আমার অন্য কোনোরকম অনুভূতি অর্থাৎ প্রেম-ভালোবাসা আসে না। মনে হয় তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ব্যস।’
শতরূপ হেসে বলেছিল, ‘আমিও তোর বন্ধু হয়েই থাকতে চাই। প্রেমিক হওয়ার ইচ্ছে আমারও নেই বস।’
বেশ চলছিল ওদের বন্ধুত্বের দিনগুলি। সমস্যাটা তৈরি হল ওরা যখন থার্ড ইয়ারে উঠল। দেবসেনার ধারে কাছে আর কাউকে সহ্য করতে পারত না রূপ। এমনকী ওর ডিপার্টমেন্টের রচনা আর শান্তনু যারা সবসময় দেবসেনাকে সাহায্য করে তাদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করে এসেছিল শতরূপ। ওর একটাই বক্তব্য, ‘তোর কী লাগবে বল দেবী, আমি তোকে সব দেব।’
ততদিনে শতরূপের সবকিছু জেনে গেছে দেবসেনা। মাত্র বছর তিনেক আগে ওর মা মারা যান। বাথরুমে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এত ব্লিডিং হয়েছিল যে শরীর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও মায়ের ব্লাড গ্রুপের ব্লাড পায়নি ব্লাড ব্যাঙ্কে। মাকে হারিয়ে ওর সব রাগ পড়েছিল বাবার ওপরে। বাবার অবহেলার কারণেই নাকি ওর মা মারা গেছেন, এমন একটা দৃঢ় ধারণা ওর মাথায় বসে গিয়েছিল। মা ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করতেন না, তাই লো প্রেশার আর অ্যানিমিয়ায় ভুগছিলেন বহুদিন ধরে। মা তবুও নিজের অফিস আর বইপত্র নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। ওর দিদি ব্যাঙ্কে ভালো জব করে। আগে সম্পর্ক খারাপ ছিল না রূপের সঙ্গে। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পরে দিদিকেও ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে দিয়েছে ও। কারণ দিদি এখনও বাবাকে ভালোবাসে। রূপ বাড়ির কারোর সঙ্গেই ভালো ব্যবহার করে না, সেটা ওর দিদিও বলেছিল দেবসেনাকে।
রাতের পর রাত মায়ের ছবির সামনে চুপ করে বসে থাকে শতরূপ।
দেবসেনার ফোন বেজে উঠেছে রাত দুটোয়। চমকে উঠে ফোন রিসিভ করতেই একটা অতি পরিচিত গলার স্বর অপরিচিত ভঙ্গিমায় বলেছে, ‘দেবী আমি চললাম রে। নিজের খেয়াল রাখিস। আমায় একেবারে ভুলে যাস না প্লিস।’
ঘুমের ঘোরে চমকে উঠেছে দেবসেনা। ‘কোথায় যাচ্ছিস রূপ তুই? কী বলছিস এসব?’
রূপ খানিকক্ষণ ফোনটা কানে চেপে ডুকরে কেঁদে বলেছে, ‘মায়ের কাছে যাচ্ছি। মা ডাকছে আমায়। এ বাড়িতে আমার কেউ আপন নেই বিশ্বাস কর।’
দেবসেনা আরও শীতল গলায় বলেছে, ‘বেশ, তাহলে চলে যা তুই। আমি যখন তোর কেউ হই না, আমাদের বন্ধুত্ব যখন মিথ্যে, তখন চলে যা। এভাবে বন্ধুত্ব ভেঙে দেওয়ার ইচ্ছে যখন ছিল তখন দায়িত্ব নিয়েছিলিস কেন সম্পর্কের?’
শতরূপ বেশ কিছুক্ষণ শব্দ না করে ফোনটা ধরে রেখেছে, ওর সঙ্গে রাত জেগেছে দেবসেনা। তারপর আচমকাই রূপ বলেছে, ‘চল, কাল কলেজে দেখা হচ্ছে।’
রূপ বলে, ‘আমার বার তিনেক আত্মহত্যার পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়েছিস তুই দেবী।’
রূপ ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়েছে। পড়াশোনায় মনযোগী হয়েছে। দেবসেনা ওকে আগলে রেখেছিল ওর মায়ের মতো করে, কাছের বন্ধুর মতো করে। না, শতরূপের মধ্যে ও কোনোদিনই ওর প্রেমিককে খুঁজে পায়নি বরং মানসিকভাবে একটু দুর্বল একটা বন্ধুর প্রতিচ্ছবি দেখেছে বারংবার, যার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখার দায়িত্ব দেবসেনার। যার একাকিত্বের ভাগীদার হওয়ার দায়িত্বও দেবসেনার। দেবসেনা সে দায়িত্ব পালন করেছে খুব নিষ্ঠার সঙ্গেই। শতরূপ অনেক স্বাভাবিক হয়েছে। ওর নিজের ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়ের সঙ্গে পিকনিকে মাইথন গিয়েছিল। দেবসেনা শুনেছে ওখানে গিয়ে ও গান গেয়েছে সকলের সঙ্গে। লেগপুল করেছে বন্ধুদের। নিশ্চিন্ত হয়েছে দেবসেনা। যাক, শতরূপকে ও স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে।
যে যার নিজের নিজের মতো ব্যস্ত থেকেছে জীবনে। আর মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে রূপ বলে না, ‘ঘুমাতে পারছি না দেবী, প্লিস হেল্প মি।’ আর পাবলিক বাসের মধ্যে ওর হাত টেনে নিয়ে বলে না, ‘ছেড়ে যাবি না তো আমায়?’
দেবসেনা কানাঘুষো শুনেছে শতরূপ নাকি প্রেমে পড়েছে। থার্ড ইয়ারের বাংলা ডিপার্টমেন্টের অনুশ্রীর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন দেখতেও পেয়েছে ওকে দেবসেনা।
মনে মনে শুধু একটাই কষ্ট হয়েছে, কেন শতরূপ ওকে কিছু বলল না অনুশ্রীর ব্যাপারে! রূপকে ওই ঘন অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে এই আলো ঝলমলে পৃথিবীতে আনার জন্য কম পরিশ্রম তো করতে হয়নি দেবসেনাকে। তারপরেও বেস্ট ফ্রেন্ডের এমন ব্যবহার ওকে বেশ দুঃখই দিয়েছে। তবে রূপ আর ওর মধ্যে কোনো আড়াল নেই, থাকার কথাও নয়। তাই দেবসেনা নিজেই কলেজ থেকে বেরিয়ে রূপের হাত থেকে আইসক্রিমটা কেড়ে নিয়ে নিজে খেতে খেতে বলেছিল, ‘কী বস, প্রেমে পড়েছ, মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ আর অভিভাবকের পারমিশন নিলে না?’
রূপ হেসে বলেছিল, ‘অভিভাবকটা কে রে?’
দেবসেনা নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে গর্বিত গলায় বলেছিল, ‘এই যে আমি। তোর চিরকালীন অভিভাবক।’
রূপ হেসে বলেছিল, ‘ওহ্, মাদার ইন্ডিয়া সরি। বাট অনুশ্রী এখনও আমার প্রেমিকা কিনা সেটা বুঝতে পারিনি। দুজনে দুজনের পালস বোঝার পর্বে বিলং করছি।’
দেবসেনা কিছু শোনেনি। বলেছিল, ‘ওসব গুলগাপ্পা অন্য কাউকে দিস। আমার সঙ্গে বৌমার পরিচয় করিয়ে দে আগে।’
দেবসেনার জীবনের সবথেকে বড় ধাক্কাটা লেগেছিল সেদিন।
‘ম্যাডাম এই গলির মুখে নামিয়ে দিলে হবে?’
ট্যাক্সি ড্রাইভারের কথাতে সম্বিৎ ফিরল দেবসেনার। টাকা মিটিয়ে নেমে পড়ল। ওদের বাড়ির সামনের গলিটা একটু সরু তাই বাইরের গাড়ি ঢুকতে চায় না। তাতে অবশ্য পঞ্চানন গলির বাসিন্দারা তেমন ভাবিত নয়। মেইন রোড থেকে এই কয়েকপা তারা হেঁটেই মেরে দেয়। গলির দু’পাশের রাস্তায় বসা ছোট ছোট দোকানগুলোকে উঠিয়ে দেওয়ার কথা কখনই মনে হয়নি এই পঞ্চানন গলির বাসিন্দাদের।
নিজেদের পাড়াতে ঢুকতেই চোখে পড়ল সেই পরিচিত দৃশ্য, বেশ কয়েকজন হাফ প্যান্টের মস্তান ব্যাট-বল হাতে রাস্তাটাকেই বাইশ গজ বানিয়ে বল পেটাচ্ছে। আর পাড়ার নিয়ম অনুযায়ী শুভেন্দু জেঠুর বাড়ির দেওয়ালে বল লাগলেই আউট বলে চিৎকার করছে। চেনা মুখগুলো দেখে এতক্ষণ আটকে রাখা নিশ্বাসটা বেশ জোরেই ছাড়ল দেবসেনা। শতরূপ নামটা এখন তার কাছে একটা বিভীষিকার মতো। এই নামটা ফোনের স্ক্রিনে দেখলেই ওর হৃৎপিণ্ড দ্রুতগামী হয়, একটা চূড়ান্ত বিরক্তি আর ঘৃণা এসে জমা হয় বুক পকেটে।
কেউ একজন পিছন থেকে ডাক দিল, ‘দেবসেনা, কী রে, কদিন দেখতে পাইনি কেন রে মা?’
পিছন ঘুরে দেখল একতলার বারান্দায় মিনতিকাকিমা বসে বসে কাকুর ফেলে রাখা বাসি কাগজে চোখ বোলাচ্ছেন। একটা চোখ কাগজে তো আরেকটা রাস্তায়।
দেবসেনা একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম গো কাকিমা কয়েকদিন। তাই সকালে বেরিয়ে সন্ধেতে ফিরছিলাম। সেইজন্য হয়তো দেখতে পাওনি।’
কাকিমা গলা নামিয়ে বললেন, ‘ওই যে রে সেই ফর্সা মতো ছেলেটা, একটু আগেই বাইক হাঁকিয়ে পাড়া জানিয়ে বার দুয়েক ঘুরে গেছে পাড়ার মধ্যে দিয়ে।’
দেবসেনা একটু চমকে উঠেই জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন ছেলেটা কাকিমা?’
কাকিমা অবলীলায় বলল, ‘ওই যে রে, তোর বন্ধুটা। কী যেন নাম! যে তুই কলেজে পড়াকালীন আসত তোদের বাড়িতে, ওই ছেলেটা।’
দেবসেনা চমকে গেল। শতরূপ ওদের পাড়ায় এসে টহল দিয়ে গেছে? বাড়িতেও গিয়েছিল নাকি? তার মানে, ওকে যখন ফোন করছিল তখন হয়তো এই গলিতেই দাঁড়িয়েছিল শতরূপ। ছি, ভাবতেই আবারও গা’টা গুলিয়ে উঠল ওর। এতটা নীচে কী করে নেমে গেল রূপ! অবশ্য নেমে তো আজ যায়নি, গেছে বেশ কয়েক বছর আগেই। কাকিমাকে কিছু একটা বলতে হবে ভেবেই বলল, ‘ও আচ্ছা তাহলে হয়তো অন্য কোনো দরকারে এসেছিল। আমি তো বাড়িতে ছিলাম না।’
কাকিমাকে দ্বিতীয় প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই এগিয়ে এল বাড়ির দিকে।
গেট খুলে ঢুকতেই বাবার গম্ভীর মুখ। মা-ও বেশ বিরক্ত মুখেই বসে আছে ড্রয়িংরুমে। ওকে দেখে আর সময় নষ্ট না করেই বাবা বলল, ‘দেবী তুই কি আমাদের একদিনও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দিবি না? মানে আমাদের অপরাধটা কী যদি একটু বলিস?’
দেবসেনা একটু থমকে গিয়ে বলল, ‘কেন কী হয়েছে?’
বাবাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মা বলল, ‘আজ শতরূপ এসে বারচারেক বাইরের গেটের সামনে দিয়ে চক্কর কেটে গেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে গেটের সামনে হর্ন বাজাচ্ছিল। পাড়ার মোটামুটি অনেকেই জানে শতরূপ তোর বন্ধু ছিল। তারা উঁকিঝুকি দিচ্ছিল। লাস্টবার বাড়ির সামনে এসে যা চেঁচিয়েছিল তোর ওপরে, সেটাও কারোর জানতে বাকি নেই। মানসিক অসুস্থ ছেলেটাকে সুস্থ করার দায়িত্ব দিয়ে তো তোমায় কলেজে পাঠাইনি মা। তাকে তুমি সুস্থ করে তুললে, সে এখন আমাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে।’
বাবা একটু বিরক্ত হয়েই বলল, ‘রমলা, তুমি কি মনে করছ তোমার মেয়ে এতেই শান্ত হয়েছে? দেবদুলাল ফোন করে জানাল, দেবী নাকি এমন একজন কয়েদির ওপরে পেপার্স লিখতে চায় যাকে গত চারবছর ধরে কেউ একটাও কথা বলাতে পারেনি। এমনকী উকিলও না। কেন যে এমন ভয়ঙ্কর নেশা চাপে এই মেয়ের কে জানে!
আমি লোকাল থানায় ওই শতরূপের নামে একটা ডায়রি করে আসব। আজ না হয় অফিস ছুটি বলে আমি বাড়িতে ছিলাম। এরপর তুমি যেদিন একা থাকবে সেদিনও যদি এসে এমন হুজ্জুতি করে তো পুলিশি ব্যবস্থা নেওয়া ঢের ভালো।’
দেবসেনা নিজের রুমে যেতে যেতে হালকা চালে বলে গেল, ‘এত সিরিয়াসলি নেওয়ার কিছু হয়নি রূপকে। দু’দিন ইগনোর করলেই ও আর আসবে না। আর অর্জুন রায়কে ভয়ঙ্কর কোনো খুনি ভাবার কোনো কারণ নেই, ভদ্রলোক আদৌ খুনটা করতেই পারেননি। এতদিনে বেকসুর খালাস হয়ে যেতেন হয়তো, কিন্তু কাউকে সহযোগিতা করেছেন না বলেই এখনও জেলে পড়ে আছেন।’
বাবা একটু রাগত স্বরে বলল, ‘আমি তো একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছি না দেবী, অযথা উপযাচক হয়ে এসব ঝঞ্ঝাট তুমি কেন নিজের জীবনে নিয়ে আসছ?’
দেবসেনা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘বাবা সাইকোলজি সাবজেক্টটা বেছেছিলাম মানুষের মনের দরজা খুলব বলেই।’
নিজের ঘরে ঢুকে ড্রেস চেঞ্জ করে বিছানায় বসল দেবসেনা। আবারও ফোনটা বাজছে। শতরূপের ফোন।
ফোনটা রিসিভ করেই খুব ঠান্ডা গলায় দেবসেনা বলল, ‘তুই আজ আমাদের পাড়ায় এসে হিরোগিরি করে গেছিস শুনলাম। তা বেশ। তবে শোন রূপ, আমি বোধহয় আর কোনোদিনই তোর সঙ্গে রাস্তাঘাটে ঘুরতে পারব না রে। কারণ বন্ধুত্বের সম্পর্কটা নষ্ট করে দিয়েছিস তুই। আরেকটা জিনিস বারবার ভুলে যাচ্ছিস, আমি তোর প্রেমিকা নই। শুধুই বন্ধু ছিলাম আমরা। আজও হয়তো তাই থাকতাম যদি না আমি প্রেমে পড়তাম।’
শতরূপ ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলল, ‘প্রেমে পড়েছিস? কার? আমি জানতে পারি আশা করি।’
দেবসেনা শান্ত গলায় বলল, ‘নিশ্চয়ই জানতে পারিস। অর্জুন রায়। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।’
শতরূপ রাগী গলায় বলল, ‘এটা কীভাবে হয় রে দেবী? তুই তো নিজেই বলেছিলি সম্পর্কে নাকি তোর দমবন্ধ লাগে। তাহলে এখন প্রেমে পড়লি কী করে?’
দেবসেনা বালিশে মাথা দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে রিল্যাক্স মুডে বলল, ‘মন তো। আফটার অল মানুষের মন তো, বদলাতে কতক্ষণ? লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলে ইংরেজির ওই কথাটা আমাদের প্রেমের ক্ষেত্রে ভীষণ রকমের সত্যি জানিস তো। এনিওয়ে, অর্জুন মারাত্মক পজেসিভ। তাই এমন হুটহাট এসে হাজির হোস না। ও একেবারেই পছন্দ করে না।’
শতরূপ বলল, ‘ও, তার মানে তোর প্রেমিকের মনমর্জির ওপরে আমাদের এতদিনের বন্ধুত্ব নির্ভর করবে বলতে চাইছিস?’
দেবসেনা বলল, ‘বলতে চাইছি নয় রে, বলছি। চল এখন রাখছি।’
ফোনটা কেটে দিল দেবসেনা। আচমকা নিজের বলা কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন নিজের কানেই বাজল। অর্জুন রায় কে? একজন জেলের কয়েদিকে আচমকা প্রেমিক বানিয়ে ফেলল কেন দেবসেনা! শতরূপকে নিজের জীবন থেকে সরানোর তো অনেক পদ্ধতি আছে, সেগুলো অ্যাপ্লাই না করে নিজের প্রেমে পড়ার গল্প করতেই বা কেন গেল, আর কেনই বা অর্জুন নামটা এল ঠোঁটের ডগায়।
শতরূপকে কি আদৌ আর সরানোর প্রয়োজন আছে? দেবসেনা তো সেই কবেই বন্ধুত্বের শ্রেষ্ঠ আসনটা থেকে শতরূপকে এক ধাক্কায় নামিয়ে দিয়েছিল। সেই সেদিনই যেদিন ও প্রথম ওর প্রেমিকা অনুশ্রীর সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছিল।
চোখের সামনে আবারও ফুটে উঠল সেই চূড়ান্ত অস্বস্তিকর পরিবেশটা।
ক্যান্টিনে অনুশ্রী বসে ছিল আরও দুজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে। শতরূপের সঙ্গে দেবসেনা গিয়েছিল ক্যান্টিনে। ফুরফুরে মেজাজে, রূপকে লেগপুল করতে করতেই।
অনুশ্রীর সামনে রূপ হঠাৎই বলে বসল, ‘দেখো অনু যার কথা তোমায় সবসময় বলি। যে আমায় দ্বিতীয়বার জীবন দিয়েছে বলতে গেলে।’
অনুশ্রী হাসি মুখে বলেছিল, ‘দেবসেনা, তাই না? তোমার কথা রূপের মুখে এত শুনেছি যে, আমারও আলাপ করার ইচ্ছেটা বেড়েই চলেছিল। রূপের বেস্ট ফ্রেন্ড বলে কথা।’
দেবসেনা অনুশ্রীর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিতেই অনুশ্রী আন্তরিকভাবেই হাতটা ধরেছিল। ঠিক সেই অবস্থায় শতরূপ সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিল, ‘দেবসেনা আমার ব্যাপারে বড্ড পজেসিভ। অনুশ্রী তুমি হয়তো জানো আমরা শুধুই বেস্ট ফ্রেন্ড, তা কিন্তু নয়। দেবসেনা লাভস মি। এটা আমি ফিল করি গত তিনবছর ধরে। কিন্তু ওকে ঘিরে আমার কোনো ফিলিংস নেই, তাই হয়তো সম্পর্কটা এখনও বন্ধুত্বের আবরণেই আছে। তাই আমি জানি, অনুশ্রীকে দেখে হয়তো দেবসেনা খুব একটা খুশি হবে না, কিন্তু আমি নিরুপায় দেবী।’
দেবসেনা চমকে গিয়েছিল রূপের এমন অস্বাভাবিক ব্যবহারে। সকলে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল। অনু হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছিল অবজ্ঞায়। রূপ কিন্তু থামেনি। বলেই চলেছিল, ‘কতরাত আমরা একসঙ্গে জেগেছি দেবী, তুই আর আমি কথা বলতে বলতে ভোর করেছি। আমি অনুকে ভালোবাসলেও তোকে ভুলিনি বিশ্বাস কর। আমাদের সেই দিনগুলো কিন্তু আমি ভুলিনি। তুই একবারও ভাবিস না অনু আমার জীবনে এসেছে বলেই আমি তোকে নেগলেক্ট করব, কিছুতেই না।’ নিজের বুকের বাম দিকে জোরে একটা নাটকীয় ঘুষি মেরে রূপ বলেছিল, ‘তুই আমার যেখানে ছিলিস ঠিক সেখানেই আছিস।’
দেবসেনা লজ্জায় কারোর মুখের দিকে তাকাতে পারেনি। রূপের বলা সমস্ত কথা যে মিথ্যে এটা প্রমাণ করার ইচ্ছেটুকুও অবশিষ্ট ছিল না ওর। গোটা ক্যান্টিনের সকলের হাসি আর করুণার খোরাক হয়েই অবসন্ন পায়ে হেঁটে বেরিয়ে এসেছিল ও। ফিরে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করেনি ওকে এতটা অপমান করার পরে রূপের মুখটা কেমন হয়েছিল, অনুশ্রীই বা ঠিক কীভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, কিছু দেখতে ইচ্ছে করেনি ওর। ঝাপসা চোখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছিল।
ফোনে অনেক বন্ধুই বলেছিল, শতরূপ নাকি গোটা কলেজে রটিয়ে বেড়াচ্ছে, অনুশ্রীর সঙ্গে ওর সম্পর্ক হওয়ায় দেবসেনা প্রবল রাগ করেছে।
শতরূপের এমন ব্যবহারের কোনো হদিশ খুঁজে পায়নি দেবসেনা। বারংবার মনে পড়েছে ওর আর রূপের নিটোল বন্ধুত্বের দিনগুলোর কথা। শতরূপ খুব ভালো করে জানত দেবসেনা কোনোদিন রূপের প্রেমিকা হতে চায়নি। তাহলে এভাবে ওর বদনাম রটিয়ে ঠিক কী আনন্দ পেল ও!
দিন পাঁচেক কলেজ যায়নি ও, রূপের ফোনও ধরেনি। একটার পর একটা মেসেজ করেছে রূপ, উত্তর দেয়নি দেবসেনা। শেষে রূপ মেসেজ করেছে দশ মিনিটের মধ্যে যদি আমার ফোন রিসিভ না করিস, তাহলে আমি সুইসাইড করব। আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী তুই থাকবি দেবী।
আত্মহত্যার প্রবণতা যে রূপের আছে এটা নতুন কিছু নয়। তাই একটু ভয় ভয়েই রূপের ফোনটা রিসিভ করেছিল দেবসেনা। ফোনটা ধরেই প্রায় চিৎকার করে বলেছিল, ‘রূপ আমি কি এটা ডিসার্ভ করি? এতদিনের বন্ধুত্বের এই পরিণাম!’
শতরূপ ভীষণ রকমের শীতল গলায় বলেছিল, সবকিছু নিয়ে এত রিয়্যাক্ট কেন করিস রে তুই? আরে অনুশ্রী জেলাস ফিল করবে বুঝলি। ভাববে তোর মতো একটা সুন্দরী আমার প্রেমিকা হতে চায়, এই জেলাসি থেকেই তো আমাদের প্রেমটা আরও গভীর হবে।’
দেবসেনার দু’চোখ দিয়ে নীরবে জল পড়েছিল। নোনতা জলে ভিজেছিল ওর গাল থেকে চিবুক। ইচ্ছে করেই মুছে দেয়নি, মনে হচ্ছিল ভুল মানুষকে বন্ধু ভাবার প্রায়শ্চিত্ত হোক এই চোখের জল দিয়েই। যে নিজের সামান্য স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনায়াসে বিক্রি করে দিতে পারে ওর এতদিনের লালিত বিশ্বাসকে।
সেদিনই ও ঠিক করেছিল, শতরূপকে ও দূরে সরিয়ে দেবে, এতটা দূরে যেখান থেকে হাজার চেষ্টা করলেও রূপ আর আগের মতো ওকে বন্ধু ভাবতে পারবে না।
তারপরেও শতরূপ নিয়ম করে ফোন করেছে। ওর আর অনুশ্রীর প্রেমের কেমিস্ট্রি বলেছে। দেবসেনা শুধুই শুনে গেছে, কোনোরকম উত্তর দেয়নি। আস্তে আস্তে রূপের প্রতি ওর ঠান্ডা ব্যবহার দেখে ও নিজেই অবাক হয়ে গেছে। এতটা কঠিন যে দেবসেনা হতে পারে এটা বোধহয় ওর কাছে অজানা ছিল। নিজেকে আবিষ্কার করেছে ও প্রতিমুহূর্তে। নিজেকে চিনতে শিখেছে, বুঝতে শিখেছে যে, ওর নিজের মধ্যে অদ্ভুত একটা শক্তি আছে, যেটা প্রয়োগ করলে রক্তপাত ছাড়াই অনেকে ধরাশায়ী হতে বাধ্য হবে। ঠিক যেভাবে ওর অত্যন্ত শীতল ব্যবহারে রূপ চিৎকার করেছে। রেগে গিয়ে ফোন কেটে দিয়েছে। এক্সাম দিয়ে ফেরার পথে বাসের মধ্যেও সিনক্রিয়েট করেছে রূপ। দেবসেনা একমনে বাসের লোকজনের অভিব্যক্তিগুলো লক্ষ্য করতে করতে ভেবেছে, এরা ঠিক কী ভাবছে এই সময় ওর সম্পর্কে! পাঁচজনের মধ্যে ছোট্ট গবেষণা চালিয়ে বুঝেছে, প্রত্যেকেই পথচলতি একঘেয়েমির মধ্যে একটা চটপটে বিষয় দেখতে পেয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত হচ্ছে। সেই থোর বড়ি খাড়া জীবনে এক টুকরো উষ্ণ বাতাস।
একটি ছেলে তার গার্লফ্রেন্ডকে উচ্চস্বরে ক্রমাগত আক্রমণ করেই চলেছে, আর তার গার্লফ্রেন্ডটি নিতান্ত বোবার মতো আচরণ করে চলেছে। হ্যাঁ, শতরূপের বলার ভঙ্গিমায় মনে হচ্ছিল দেবসেনা ওর বন্ধু নয়, প্রেমিকা। শুধু প্রেমিকা নয়, বেশ পরাধীন প্রেমিকা যার প্রতিটা মুহূর্তের হিসেব দিতে হয় প্রেমিক নামক পুরুষটিকে। দেবসেনার বেশ মজা লাগছিল বাসের লোকজনের মুখ দেখে। অনেকের চোখে আবার এমনও দৃষ্টি ফুটে উঠল, মিটিয়ে নিলেই হয়। অনেকে ভাবছে, মেয়েটা কি ইচ্ছে করে ইগনোর করছে, নাকি ছেলেটারই দোষ? বেশ কয়েকজনের চোখের ভাষা পড়ে দেবসেনা বুঝল, এরা ভীষণভাবে চাইছে দেবসেনা কিছু বলুক, ঠিক যেভাবে শতরূপ চাইছে। একতরফা বলাতে আর কতক্ষণ ইন্টারেস্ট রাখা যায়! তাছাড়া দেবসেনার এমন নিস্পৃহতা দেখে শতরূপের গলার আওয়াজ কমে আসছিল। আধঘণ্টা পরে দেবসেনা নেমে এসেছিল নিজের স্টপেজে।
শতরূপ বাস থেকেই চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘যেটা করছিস ঠিক করছিস না।’
দেবসেনা বাঁ-হাতটা তুলে টা-টা দেওয়ার ভঙ্গি করেছিল নির্লিপ্ত মুখে।
এর থেকেই বুঝেছিল, ইগনোর করতে গেলে সহ্য শক্তি বাড়াতে হবে। নিজের মধ্যে আরেকটা ভিন্ন দেবসেনাকে আবিষ্কারের নেশায় ও তখন মনোনিবেশ করেছিল। সেটাতে যে সাকসেসফুল হয়েছে তার প্রমাণ তো শতরূপের আজকের ব্যবহারে পেয়েছে। শতরূপ বুঝেই গেছে দেবসেনা ওকে আর কোনোদিনই বন্ধু ভাববে না।
এরপরে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর। দেবসেনা নিজেকে সরিয়ে এনেছে একটু একটু করে। আচমকাই একদিন অনুশ্রী ফোন করে জানিয়েছে ওদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। কোনো মান-অভিমান হলেই নাকি শতরূপ আত্মহত্যা করার ভয় দেখাত অনুশ্রীকে। দিনদিন ওদের সম্পর্কটা বাতাসহীন দমবন্ধ একটা ঘরে পরিণত হয়েছিল। অনুশ্রী আতঙ্কে থাকত এই বুঝি রূপ রেগে যাবে। এই বুঝি ওর মুড সুইং করবে। কতদিন অনুশ্রী নিজের দিকে ভালো করে তাকাতেই ভুলে গিয়েছিল। শেষে বাধ্য হয়ে শতরূপের সঙ্গে সম্পর্কে বিরতি টেনেছে।
দেবসেনা মনে মনে হেসেছিল। আত্মহত্যার ভয় দেখানোটা এখন রূপের একটা ভয়ঙ্কর নেশায় পরিণত হয়ে গেছে, সেটা ও আগেই টের পেয়েছিল।
দেবসেনা শুধু একটাই কথা বলেছিল, ‘প্রাণ খুলে বাঁচ অনুশ্রী।’
অনুশ্রীর সঙ্গে ব্রেকআপের খবর শতরূপ নিজে বলেনি দেবসেনাকে। বরং মিথ্যে করে বলে চলেছিল, ‘আজ তো অনুশ্রীর সঙ্গে মুভি দেখতে যাব।’ দেবসেনা ঘৃণায় শিউরে উঠেছিল। তার মানে কি রূপ একইরকমভাবে অনুশ্রীর গল্প করে ওর মধ্যে পজেসিভনেস গ্রো করতে চাইছে! খুব ইচ্ছে করছিল, একদিন সকলের সামনে গালে একটা থাপ্পড় মেরে বলতে, ‘রূপ আমাদের নির্ভেজাল বন্ধুত্বটাকে তুই এভাবে কেন নীচে নামালি?’ না, কিছুই বলেনি দেবসেনা। ও জানে শতরূপ বদলাবে না। একইরকম সাইকো শয়তান থেকে যাবে। তাই বরফ শীতল ব্যবহারই ওর একমাত্র ওষুধ। সেটা প্রয়োগ করে ফলও পেয়েছে দেবসেনা।
অর্জুনকে নিয়ে বেরোনো খবরের ফাইলগুলো পরপর পড়তে শুরু করল। ইন্দ্রাণীর বয়ানের মধ্যে বড্ড বেশি অসামঞ্জস্যতা চোখে পড়ছে আজ দেবসেনার।
ইন্দ্রাণীর বক্তব্যগুলো লাল কালি দিয়ে মার্ক করছিল দেবসেনা। এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে অর্জুনের প্রায় বছর চারেকের সম্পর্ক ছিল। তারপরেও ভদ্রমহিলা একজায়গায় বলছে, ‘অর্জুন যে আমায় খুন করে দেবে এমন ভয় আমি আগেই পেয়েছিলাম?’ কেন ভদ্রমহিলা এমন অদ্ভুত ভয় পেত?
অর্জুনের অফিস রেকর্ড খুব ভালো। প্রত্যেকে একবাক্যে স্বীকার করেছে যে, অর্জুন রায় কলিগ হিসাবে অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। যে-কোনো অফিস পার্টিতে খুব হুল্লোড় করতে না পারলেও অংশগ্রহণ করত এবং এনজয় করত। কখনও অফিসে কারোর সঙ্গে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়নি। কর্পোরেট জগতের লোকজন বলছে ভদ্রলোক নির্বিবাদী। মিশুকে না হোক, বেশ হাসিখুশি স্বভাবের। তাহলে ইন্দ্রাণীর এমন ভয় পাওয়ার কারণটা ঠিক কী?
অর্জুনের বাড়িতে একবার ঢুঁ দিতে হবে কাল সকালেই। হয়তো দিন দুয়েকের মধ্যেই দেবদুলালকাকু ডাকবেন। তার আগেই এই কাজটা সেরে নিতে হবে।
চোখ বন্ধ করতেই অর্জুনের ইনোসেন্ট চোখ দুটো ভেসে উঠল চোখের সামনে। একটু কি বেশিই ইনভলভ হয়ে যাচ্ছে ও অর্জুনের কেসটা নিয়ে? কেন কে জানে প্রথম যেদিন কাগজে অর্জুনের ছবিটা দেখেছিল, সেদিন থেকেই অদ্ভুত একটা মায়া তৈরি হয়েছিল ছেলেটার জন্য। ওর ওই দু-চোখে যেন অনেক না বলা কথার বাস। ঠোঁটের পাশের হাসিতেও কিছু লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। সেই কারণেই দেবসেনার আরও বেশি করে আগ্রহ জন্মেছিল ওর ব্যাপারে।
‘আসতে পারি?’
বেলটা বার দুই বাজানোর পরে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা দরজাটা খুলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন দেবসেনার দিকে। ভদ্রমহিলার ভ্রুর ভাঁজ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, বাড়িতে ইদানীং মানুষের যাতায়াত বেশ কম। তাই একটু দ্বন্দ্বে পড়েছেন। দেবসেনা আবার বলল, ‘আসতে পারি? আপনি কি মিসেস অদিতি রায়?’
ভদ্রমহিলা কৌতূহলী গলায় বললেন, ‘আপনি কে? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।’
দেবসেনা নির্দ্বিধায় বলল, ‘আমি অর্জুনের পরিচিত। বলতে পারেন বন্ধুস্থানীয়।’
মহিলা একটু অপ্রস্তুত গলায় বললেন, ‘কিন্তু অর্জুন তো…’
ওঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই দেবসেনা বলল, ‘জানি, বছর চারেক হল জেলে আছে। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলব বলেই এসেছি আন্টি।’
অদিতিদেবী একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আসুন, ভিতরে আসুন।’
দেবসেনা ভিতরে ঢুকতেই অর্জুনের মা বললেন, ‘ওর বাবা তো এখন বাড়িতে নেই। চেম্বারে আছে।’
দেবসেনা হেসে বলল, ‘জানি, অংশুমান রায় একজন নামী চিকিৎসক। নিউরোলজিস্ট হিসাবে ওঁর নাম সকলেই জানি।’
অদিতিদেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ইদানীং আর আগের মতো চেম্বার করে না। মনে মনে বড্ড ভেঙে পড়েছে মানুষটা। একমাত্র সন্তানের এমন কর্মের দায় তো বাবা-মা হিসাবে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। তবুও পেশেন্টদের ফোন আসে। ভিড় হয় বলেই বসে সপ্তাহে দিন তিনেক। ভিতরে ভিতরে লজ্জায়, অপমানে মানুষটা ক্ষয়ে গেল একেবারে।’
দেবসেনা ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘আমি অর্জুনকে অনেকটাই চিনি। আমি কাল অথবা পরশু যাব ওর সঙ্গে কথা বলতে। ও কেন এভাবে স্বেচ্ছায় বন্দীজীবন মেনে নিয়েছে, এটা আমাকে জানতেই হবে।’
ভদ্রমহিলার চোখ দুটো কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। মুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলেন দেবসেনার সামনে। বললেন, ‘কি মনে হয়, অর্জুন কথা বলবে তোমার সঙ্গে? আমাদের সকলকে তো বিনাবাক্যে ফিরিয়ে দিয়েছে সে। এমনকী তিনটে নাম করা উকিল নিয়ে গিয়েছিলাম, তাদেরও কিছু বলেনি। দেখা করতে গেলেও আমার বা ওর বাবার সামনে আসে না। আমরা ওই দূর থেকে দেখে চলে আসি। ওর ছোটমামা ছিল একেবারে ওর বন্ধুর মতো। সে-ও অনেকবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অর্জুনের ওই এক কথা, ‘একবার ছেড়ে দাও আমায়, আমি ইন্দ্রাণীকে খুন করে আসব। কোনো অধিকার নেই ইন্দ্রাণীর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার। এরপরে কে ওকে মুক্ত করবে বলো তো মা?’
দেবসেনা আচমকা জিজ্ঞাসা করে বসল, ‘আপনি ইন্দ্রাণীকে চিনতেন? আলাপ ছিল?’
অদিতিদেবী ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, চিনতাম তো। প্রায়ই আসত এই বাড়িতে। অর্জুন না থাকলেও আসত। ও-ই ঘর গুছিয়ে রেখে, আমার সঙ্গে গল্প করে বাড়ি যেত। ওদের তো বিয়েও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। শপিং শুরুর পরে এসব ঘটল।’
দেবসেনা বলল, ‘ইন্দ্রাণী এখন কোথায়?’
অদিতিদেবী একটু আক্ষেপের গলায় বললেন, ‘আমাদের কপালে ভালো বউ নেই। তাই হল না। ওর বিয়ে হয়ে গেছে। ওর হাজবেন্ডকে হয়তো আপনি চিনবেন। অর্জুনের অফিসেই চাকরি করত, এই তো বছর দুয়েক আগে ওর ‘বৃষ্টি নামার পরে’ বইটা বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছে। রণজিৎ চক্রবর্তী। ছেলেটাও এসেছিল কয়েকবার আমাদের বাড়িতে অর্জুনের সঙ্গে। ইন্দ্রাণীর আর কী দোষ! আমাকে ফোন করে অনেক কেঁদেছিল। বলেছিল, ‘আন্টি তোমাকে আমার আর মা বলা হল না। আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।’ আমিও বলেছিলাম, ‘বিয়ে করে নে তুই। আমার কপালে তোকে বরণ করা নেই।’
দেবসেনা বলল, ‘আমি কি একবার অর্জুনের ঘরে যেতে পারি?’
অদিতিদেবী বললেন, ‘হ্যাঁ এসো। আমি রোজ যাই সন্ধেতে একবার করে। ওর বাবাও ঢোকে আমাকে লুকিয়ে রাতের দিকে। অফিসের বাইরে বাকি সময়টা তো এই ঘরেই কাটাত।’
দেবসেনাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে অদিতিদেবী চা করতে গেলেন। ঘরটা খুব দ্রুত, ভালো করে খুঁজে ফেলল দেবসেনা। বড় ঝোলা ব্যাগে বেশ কিছু জিনিস ঢুকিয়ে নিল। কাজ মিটে গেলে ক্ষমা চেয়ে ফেরত দিয়ে যাবে না হয়। কিন্তু এখন অর্জুনের মাকে বলতে গেলে অনেকগুলো প্রশ্ন আসবে।
ভদ্রমহিলা চায়ের ট্রে নিয়ে এসে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, ‘ঘরকুনো, একটা শান্ত ছেলে যে কাউকে খুন করতে যেতে পারে, মা হয়ে এটাই তো আমার কাছে সব থেকে অবিশ্বাস্য লাগছে।’
দেবসেনা চায়ে চুমুক দিতে দিতেই দেখল অদিতিদেবী চোখ মুছলেন। চার বছরে চোখের জল কমেছে। কিন্তু শুকিয়ে যায়নি।
দেবসেনা বাইরে বেরিয়ে এসেই ছুটল। বেশ কয়েকটা অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে ওকে খুব দ্রুত।
‘খুব সাবধানে কথা বলবে দেবসেনা। তোমার জেদের কারণে এই বিষয়টাতে রাজি হলাম।’ দেবদুলালকাকু নিজের প্যাডে লেখা চিঠিটা ওর হাতে দিতে দিতে সাবধান করলেন।
বুকের ভিতর লাবডুব শব্দটা যে দ্রুতগতি হয়েছে সেটা বেশ টের পাচ্ছে দেবসেনা। জেলের একজন কনস্টেবল ওর সঙ্গে আছে। দু’দিকের গরাদের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাচ্ছে বিভিন্ন অপরাধীদের। কেউ চুপচাপ বসে আছে। কেউ গল্প করছে। কেউ উদাস হয়ে তাকিয়ে আছে কংক্রিটের দেওয়ালের দিকে।
অর্জুনের কারাগারের সামনে গিয়ে থামল কনস্টেবল। বেশ জোরেই বলল, ‘অর্জুন রায়, এদিকে এসো। একজন দেখা করতে এসেছে।’
ভিতরের অল্প হলদে আলোয় দেবসেনা দেখতে পেল, অর্জুন কিছু একটা লিখছে ডায়রিতে। ওর ঘরে আর কেউ নেই। ও একাই আছে। বাকি দুজনের নাকি ছুটি হয়ে গেছে।
অর্জুন একবার তাকাল বাইরের দিকে। তারপর নিস্পৃহভাবে আবার ডায়রির পাতায় মনোনিবেশ করল।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ড বলল, ‘ও তো কারোর সঙ্গে দেখা করে না ম্যাডাম। ওর বাবা, মা, উকিল সবাই এসে ফিরে গেছে। কারোর সঙ্গে কথা বলে না।’
দেবসেনা নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। এই মানুষটাকে সে গত একবছর ধরে চিনেছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। বলতে গেলে ওর ধ্যান-জ্ঞান ছিল অর্জুন রায়কে চেনা।
দেবসেনা গার্ডকে ইশারায় থামতে বলে নরম গলায় বলল, ‘সেদিন আমি নন্দনে ঢুকেছিলাম তাড়াহুড়ো করে। হাতঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছিল আমি প্রায় মিনিট পনেরো লেট। ঠিক সেইসময় জুঁই ফুলের গন্ধ এসে ঝাপটা দিল আমার অনুভূতিতে। প্রবল ঝাঁকুনি খেলাম একজনকে দেখে। পরনে হলদে শাড়ি। আঁচলটা একটু যেন বেখেয়ালি, আলগা হাতখোঁপায় জড়ানো একটা জুঁইয়ের মালা। কানে দুটো ঝুমকো। প্রথম দর্শনেই আমার মতো অকাব্যিক মানুষেরও মনে হল, হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছি শুধু তোমারই অপেক্ষায়।
তুমি আমার ভাবনাকে আরেকটু উস্কে দিয়ে বললে, ‘বসন্ত উৎসব কি শুরু হয়ে গেছে?’ আমি এসেছিলাম নির্জনে একটা সিনেমা দেখব বলে। কিন্তু সেই আসার কারণই আমি ভুলতে বসেছি। অমোঘ আকর্ষণে পিছু নিলাম তোমার। সেটা যে চৈত্র মাস ভুলে গিয়েই সর্বনাশের পথে পা বাড়ালাম। ভুললাম নিজের অস্তিত্ব। তখন শুধুই জুঁইয়ের গন্ধ আর হলদে শাড়ির আঁচলের টানে আমি আমাকে ছাড়া।’
দেবসেনা দেখল, উঠে দাঁড়িয়েছে অর্জুন। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। ভয় করছে ওর। যদি সাকসেসফুল না হয়। যদি এরপরেও কথা না বলে অর্জুন। তাহলে তো নিজের কাছেই হেরে যাবে ও। হেরে যাবে ওর মনোবিজ্ঞানের শিক্ষা। শতরূপকে ও আগের অবস্থা থেকে বের করে আনতে পারলেও মানসিকভাবে সুস্থ করতে পারেনি, এই ব্যর্থতা ওকে ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত করে চলে। শতরূপের নোংরা অসুস্থ মনটাকে পাল্টাতে পারেনি বলে নিজেকে ব্যর্থ মনে হয় মাঝে মাঝে, আবার আরেকটা হার দেবসেনার মনোবল ভেঙে দেবে চিরতরে। তাই এই লড়াইয়ে ওকে জিততেই হবে। অর্জুন রায়কে দিয়ে স্বীকার করাতেই হবে কেন সে ইন্দ্রাণীকে খুন করতে গিয়েছিল।
অর্জুন রায় এগিয়ে আসছে ওর দিকে। লোহার রডের ওপরেই দেবসেনার হাতদুটো স্পর্শ করল অর্জুন। দুটো গাল বেয়ে জল পড়ছে। না কামানো দাড়ি ভিজে যাচ্ছে। কথা বলার অভ্যেস নেই বলেই হয়তো ঠোঁটটা নড়ছে শুধু।
দেবসেনা থামল না। বলেই চলেছে, ‘…যেদিন আমি বুঝলাম, কড়ে আঙুলে আঙুলে ছুঁয়ে গেলে ঝগড়া হয় না, ভাব হয়…সেদিন থেকে রাতের মাধবীলতা ফুলেরও গন্ধ পেলাম আমি। জানো রানি, আমার এই বদলটা শুধু যে আমি একা অনুভব করতে পারছিলাম, তা নয়। আমার আশেপাশে থাকা অনেক মানুষই টের পেয়েছিল আমার পরিবর্তনটুকু।
অন্যমনস্ক আমিটা ভুলে যাচ্ছিল নিত্যদিনের হিসেব-নিকেশ। শুধু মনে রেখেছিল আমাদের তৃতীয়বার দেখা হওয়ার দিনটাকে। রবিবার মধুসূদন মঞ্চের নাটক দেখা ছাড়া এ পৃথিবীর বাকি সব কাজ আমার কাছে বড় তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল রানি। না, না তুমি শুধু একে ভালোলাগা বলে তুচ্ছ করতে পারো না।’ ডুকরে ডুকরে কাঁদছে অর্জুন রায়। ফুলে উঠছে প্রায় ছয় ফিট লম্বা মানুষটার বুকের পেশী। দেবসেনার দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আপনি কে? কী করে জানলেন?’
দেবসেনা বলল, ‘আপনার লেখা পড়েছি। আসল পাণ্ডুলিপি পাইনি ঠিকই। কিন্তু আপনি বারবার যেগুলো লিখেছেন আর নীচে বাতিল বলে বাদ দিয়েছেন সেগুলোকে যত্নে তুলে এনেছি আমি। কিন্তু সব বাদ তো দেননি আসল বই থেকে।’
অর্জুন রায় বলল, ‘আপনি কে?’
দেবসেনা শান্ত গলায় বলল, ‘যদি বলি শুধুই জানতে চাই আমি অর্বাচীনকে, সাহায্য করবেন? নিজেকে অর্বাচীন বলেই তো পরিচয় দিতে চেয়েছিলেন আপনার উপন্যাসে তাই না? আপনার নায়িকা রানি, আর আপনি শুধুই অর্বাচীন।
আমি কাল সারারাত ধরে পড়লাম আপনার ‘বৃষ্টি নামার পরে’ উপন্যাসটা।
অর্জুন আচমকা খসখসে আওয়াজে চিৎকার করে বলল, ‘ওটা আমার লেখা নয়। আপনি জানেন না। ওটা ইন্দ্রাণীর স্বামী লেখক রণজিৎ চক্রবর্তীর লেখা।’
দেবসেনা দৃঢ় স্বরে বলল, ‘আমি জানি ওটা আপনার লেখা উপন্যাস। আপনার আর ইন্দ্রাণীর প্রেমকাহিনি। আমি দেখেছি আপনাদের অ্যালবামটা। নন্দন, প্রিন্সেপ ঘাট, শান্তিনিকেতনের খোয়াইয়ের ধারে আপনাদের অসংখ্য ছবি আছে। ঠিক ওই বর্ণনাগুলোই আছে আপনার ‘বৃষ্টি নামার পরে’ উপন্যাসে। আপনার ডায়রির পাতায় বেশ কিছু লাইনের নীচে বাতিল লিখে রেখেছিলেন, সেগুলোও পেয়েছি আমি ওই উপন্যাসে হুবহু। এবারে আমায় শুধু বলুন, কেন ওটা রণজিৎ চক্রবর্তীর নামে প্রকাশ পেল? কেন সে লেখক হিসেবে বঙ্কিম পুরস্কার পেল? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন আপনি অর্জুনবাবু। বাকি আপনার আর ইন্দ্রাণীর সবটুকু আমার পড়া কমপ্লিট।’
অর্জুন নিজের গালটা মুছে নিয়ে বলল, ‘আমি জানি না। আপনি যান এখান থেকে। কিছু বলব না আমি। ‘বৃষ্টি নামার পরে’ উপন্যাসের লেখক আমি নই। আমি নই।’
গার্ড বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি এখন আসুন।’
দেবসেনা একপা দুপা করে পিছোতে পিছোতে বলল, ‘এমন একজন প্রেমিকা চাই যে নদীর মতো ঘিরে রাখবে আমায়।
এমন একজন প্রেমিকা চাই যে নিজে এলোমেলো হয়েও গুছিয়ে নেবে আমায়।
এমন একজন প্রেমিকা চাই যে ভালোবাসার সমার্থকে বসাবে আমাকে।
এমন একজন প্রেমিকা চাই যার সামনে দোষ করলেই ধরা পড়ার ভয়ে চলবে আমার লুকোচুরি।
রানি তুমি আমার সেই প্রেমিকা হবে? আমার প্রেম আজীবন নতজানু থাকবে তোমার দ্বারে।’
পিছন থেকে অর্জুন ডেকে উঠল, ‘দাঁড়ান, যাবেন না।’
দেবসেনা এগিয়ে এসে আবার বলল, ‘প্লিস হেল্প মি অর্জুন। আমাকে হারিয়ে দেবেন না। আমি জিততে চাই।’
অর্জুন ফিসফিস করে বলল, ‘এমন একজন প্রেমিকা চাই যার চুলে বুনো ফুলের গন্ধ পাব, কাছে যেতে ভয় পাব, পাছে ভেসে যাই!’
দেবসেনা বলল, ‘দেখেছেন আপনার ‘বৃষ্টি নামার পরে’ উপন্যাসে রানিকে অর্বাচীন ঠিক এই কবিতাটাই শুনিয়েছিল। সেই কবিতার শেষ লাইনটা আপনার এখনও মনে আছে।’
অর্জুন বলল, ‘ইন্দ্রাণী বলুন। রানি নয়। রানি মরে গেছে।’
দেবসেনা বলল, ‘রানি হওয়ার যোগ্যতা ইন্দ্রাণীর কোনোদিনই ছিল না অর্জুনবাবু। কিন্তু ইন্দ্রাণী কেন আপনার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিটা রণজিৎকে দিল সেটা একটু বলবেন প্লিস?’
অর্জুন বলল, ‘জানি না। আমি জানতেও পারিনি কবে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে রণজিতের এমন গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সবটাই ঘটেছিল আমার আড়ালে। ইন্দ্রাণী ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি আমায়। আমিই ওদের পরিচয় করিয়েছিলাম। রণজিৎ কবিতা লিখতে ভালোবাসত। ইন্দ্রাণী ওর বেশ কয়েকটা কবিতা আবৃত্তি করেছিল। সেই থেকেই অল্প বন্ধুত্ব হয় ওদের মধ্যে। সেটা যে কবে এতটা ঘনিষ্ঠ হয়েছিল আমি জানতাম না বিশ্বাস করুন। আমি ওকে পাগলের মতো বিশ্বাস করেছি। ওকে নিয়ে এঁকেছি আমার প্রথম উপন্যাস। যেটাতে কল্পনার মাত্রা ছিল খুবই কম। ও নিজেও জানত, ওটা আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের দিনপঞ্জি। না, ওটা আমি কোনো প্রকাশককে দিতাম না। বই আকারে প্রকাশিত হত না ওটা। আমার হাতে লেখা ওই পাণ্ডুলিপিটাই হত আমাদের বিয়েতে আমার তরফ থেকে ইন্দ্রাণীকে দেওয়া উপহার। বিশ্বাস করুন, আমি বেচতে চাইনি ওই উপন্যাস। আমি কোনো লেখক নই। শুধুই নিজস্ব অনুভূতিটুকু ডায়রি বন্দি করে রেখেছিলাম। ইন্দ্রাণীকে প্রথম স্পর্শের মুহূর্তটুকুও খুব যত্নে লিখেছিলাম। সেটাও ইন্দ্রাণী এভাবে বিক্রি করে দিল?’ দেবসেনা বলল, ‘কিন্তু আপনাদের তো বিয়ে ঠিক হয়েই গিয়েছিল, তারপর ঠিক কী ঘটেছিল?’
গলাটা বোধহয় শুকিয়ে এসেছে অর্জুনের। দীর্ঘ কয়েকবছর পরে ও এত কথা বলছে একসঙ্গে। অর্জুন বলল, ‘বিয়ের যে খুব ইচ্ছে ছিল ইন্দ্রাণীর তা নয়। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা ততদিনে দুই বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেছে। তাই নিমরাজি হয়েছিল। শপিংয়ে যাব বলে রেডি হচ্ছিলাম আমি। হঠাৎই ইন্দ্রাণী আর রণজিৎ একসঙ্গে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। আমি ওদের দুজনকে দেখে একটু চমকে গেছিলাম। রণজিৎই বলল, ‘চল আমার সঙ্গে, তোদের জন্য একটা উপহার আছে।’
রণজিতের গাড়ি করে গেলাম ওর ফ্ল্যাটে। ও আমার হাতে তুলে দিল গাঢ় নীল কভারে মোড়া ‘বৃষ্টি নামার পরে’ উপন্যাসটা। বলল, ‘তোদের বিয়ের উপহার আমার তরফ থেকে।’ ওপরে জ্বলজ্বল করছে রণজিৎ চক্রবর্তীর নাম।
আমি বলেছিলাম, ‘তুই তো কবিতা লিখতিস, উপন্যাস কবে লিখলি?’ বলতে বলতেই প্রথম পাতা উল্টেই চমকে গিয়েছিলাম। এ তো আমার পাণ্ডুলিপি! আমি নাম দিয়েছিলাম, ‘যখন বর্ষা নামল’। নামটা পরিবর্তন করে দিয়েছে। হুবহু এক লেখা। পাতার পর পাতা আমার একান্ত নিজস্ব অনুভূতি।
রণজিৎ হেসে বলল, ‘কেমন লাগল আমার সারপ্রাইজ? দেখ ভাই, বইটা হট কেকের মতো বিক্রি হচ্ছে মার্কেটে। দশদিনে ফার্স্ট এডিশনের একহাজার কপি শেষ।’
আমি রাগে কাঁপছিলাম। ইন্দ্রাণীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘এর অর্থ কি?’
ইন্দ্রাণী একটু ভয় পেয়েই বলেছিল, ‘তুমি তো লেখক নও। তুমি তো ডায়রি বন্দি করেই রেখে দিতে। রণজিৎ লেখক। ও প্রকাশ করলে ক্ষতি কী?’
আমি দেখেছিলাম চোখের সামনে কালো অক্ষরে উড়ছে আমার গোপন অনুভূতিগুলো। বাজারে নাকি বিক্রি হচ্ছে এগুলো। বুঝেছিলাম, ইন্দ্রাণী আমার ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে গেছে পাণ্ডুলিপি। ও প্রায়ই এসে ঘর গুছিয়ে দিত। তখনই চুরি করেছে। রাগে অন্ধ হয়ে আমি ওর গলা টিপে ধরেছিলাম। তখনই ও বলেছিল, ‘আমি রণজিৎকে ভালোবাসি।’
আমি আরও চমকে উঠে ছেড়ে দিয়েছিলাম ওকে। কিন্তু খুব চেয়েছিলাম ওকে মেরে ফেলতে। এমন বিশ্বাসঘাতকের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমার অফুরন্ত ভালোবাসার ও এভাবে অমর্যাদা করবে আমি কল্পনা করতে পারিনি। ভাবতে পারছেন, আমার সমস্ত অনুভূতিগুলো আর ব্যক্তিগত রইল না। সব বাজারে বিক্রি করে দিল ও।
ওখান থেকে বেরিয়েই ও আর রণজিৎ কেস করে আমার নামে। আমি অ্যারেস্ট হই। আমি বেশ ভালো আছি। আমার বাইরে বেরোনোর ইচ্ছে নেই। ওখানে শুধুই বিশ্বাসঘাতকদের ভিড়। এখানে অন্ধকারে আমি একলা বেশ ভালো আছি। কেউ মিথ্যে করে বলে না, সে আমাকে আজীবন ভালোবাসবে।’
অর্জুন আবার চলে গেল নিজের জায়গায়।
দেবসেনা ফিরে এল নিজের বাড়িতে। অর্জুনকে জেল থেকে জামিন করাতে হবে। এটা ভাবতে-ভাবতেই চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এল ওর। স্বপ্নে দেখল শতরূপ হাসছে। বিশ্রীভাবে হাসছে। বলছে, ‘একটা জেলে থাকা আসামি যে তার প্রেমিকাকে খুন করতে গিয়েছিল, সে তোর প্রেমিক দেবী? বাহ্, ভালো চয়েস তোর, কংগ্রাচুলেশন। জেল ফেরত আসামি তোর প্রেমিক দেবী?’
শতরূপের বিকৃত হাসিটা দেখে চমকে উঠল ও। ঘুমটা ভেঙে গেল। কানের কাছে অর্জুনের কথার অনুরণন। অর্জুন বলছে, ‘এখানে বেশ ভালো আছি। বাইরে বিশ্বাসঘাতকের ভিড়।’
দেবসেনা ফিসফিস করে বলল, আমি আগামীকাল আবার আসব।
অর্জুন হ্যাঁ বা না কিছু না বলেই নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল।
দেবদুলালকাকুও যথেষ্ট অবাক হয়েছেন অর্জুন এত কথা বলেছে শুনে। যে ছেলে গত চার বছরে একটাও কথা বলেনি তাকে দিয়ে এত কথা বলাল কী করে দেবসেনা!
মোবাইলের রেকর্ডিং অপশনটা বন্ধ করে দেবসেনা বলল, ‘কাকু এটা হয়তো আমি অন্যায় করলাম। ওঁর পারমিশন না নিয়ে ওঁর কথাগুলো লুকিয়ে রেকর্ড করা আমার অনুচিত হয়েছে। কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম। হয়তো দেখা গেল পরের দিন আর কথাই বলছেন না। তাই প্রথম সুযোগেই ওঁর কথাগুলো আমি রেকর্ড করে নিয়েছি।’
দেবদুলালকাকু বললেন, ‘কিন্তু দেবসেনা, ও কি উকিলকে এসব বলবে?’
দেবসেনা হেসে বলল, ‘কাকু যদি ইন্দ্রাণী নিজেই এই কেসটা তুলে নেয় তাহলে কি আর এতকিছুর দরকার হবে?’
দেবদুলালকাকু ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘ব্রিলিয়ান্ট।’
স্টুডিওর সামনে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছে দেবসেনা। ইন্দ্রাণীর নাকি কবিতার রেকর্ডিং চলছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে হন্তদন্ত হয়ে বেরোল ইন্দ্রাণী। ওকে দেখেই ভিতরে বিজবিজ রাগটা অনুভব করল দেবসেনা। এই অসভ্য মেয়েটা অর্জুনের রানি? এত ভুল মানুষ করে কী করে! অবশ্য শতরূপকে বেস্টফ্রেন্ড ভেবে ভুল তো ও নিজেও কিছু কম করেনি। আসলে মানুষের গোটা জীবনটা একটা শিক্ষাক্ষেত্র। শেষ দিন পর্যন্ত শুধু শিখেই যেতে হয়।
ইন্দ্রানীকে দেখেই অর্জুনের বইয়ের কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেল। ‘কোনো এক তপ্ত দুপুরে যখন তোমার নাকছাবিকে ঘিরে বিন্দু বিন্দু বিরক্তিকর ঘামের উদয় হবে, তখন যদি আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে না দিই সেদিন তুমি রাগ করো রানি। এ তোমায় অধিকার।’
নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে দেবসেনা বলল, ‘হাই ম্যাডাম, আমি এসেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আপনি তো ভীষণ সুন্দর কবিতা বলেন শুনলাম। আমার একটা অডিওকে একটু সুন্দর করে পাঠ করে দিতে পারবেন? মানে অনেকগুলো অনুষ্ঠানে বাজবে ওই অডিওটা।’
ইন্দ্রাণী একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমি আবৃত্তি বা শ্রুতি নাটক করি। এভাবে আমার গলা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজানো হবে বলতে ঠিক ক্লিয়ার হল না।’
দেবসেনা বলল, ‘চলুন ওই টেবিলে গিয়ে বসি। ওটা বেশ ফাঁকা আছে।’
ইন্দ্রাণী এসে বসল দেবসেনার সঙ্গে। ফেমাস হওয়ার ইচ্ছে মানুষের রক্তে। হিউম্যান সাইকোলজি বলে, মানুষ সবসময় নিজেকে বিখ্যাত ব্যক্তি হিসাবে দেখতে চায়। টাকার থেকেও বেশি মূল্যবান সম্মান। তাই সম্মান পাওয়ার জন্য মানুষ সব করতে রাজি। ইন্দ্রাণীও তার ব্যতিক্রম নয়। বেশ আগ্রহের সঙ্গেই জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কি কোনো কোম্পানির প্রচার?’
দেবসেনা বলল, ‘আপনি আগে শুনেই দেখুন।’
অর্জুনের রেকর্ডিংটা চালিয়ে দিল দেবসেনা। ঠিক একমিনিট শোনার পরেই ইন্দ্রাণী লাফিয়ে উঠল।
‘কে আপনি, কী চান?’
দেবসেনা শীতল গলায় বলল, ‘অর্জুনকে মুক্ত করতে। আর আসল সত্যিটা জানতে।’
ইন্দ্রাণী ঘামছে। চোখ মুখে আতঙ্ক। তবুও স্টেডি থাকার চেষ্টা করে বলল, ‘অর্জুন দোষী সাব্যস্ত হয়েই গেছে। ও নিজে স্বীকারোক্তি দিয়েছে ও আমায় খুন করতে গিয়েছিল। আর বৃষ্টি নামার পরে বইটা রণজিতের লেখা। এখন যে কেউ মিথ্যে বললেই তো চলে না!’
দেবসেনা ততধিক শান্ত গলায় বলল, ‘যখন বর্ষা নামল’-র কিছু রাফ লেখা হাতে এসেছে আমার। আমি মিডিয়ায় খবর করব। আর অর্জুনের এই মিথ্যে কথাগুলো প্রচার করব চারিদিকে। দেখি কোথায় থাকে আপনার আর পুরস্কার বিজয়ী লেখকের ভাবমূর্তি। অর্জুনের দ্বিতীয় উপন্যাস, ‘বরফ যখন উষ্ণ হল’ খুব তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছে। দুটো লেখার ধরন যে একইরকম এটা প্রমাণ করতে আমার বিশেষ কষ্ট হবে না।’
দেবসেনা উঠে দাঁড়াল। ইন্দ্রাণী কুঁকড়ে গেছে। মিথ্যে নিয়ে যে লড়াই করা যায় না সেটা বোধহয় বুঝতে পেরেছে।
ইন্দ্রাণী কাকুতিমিনতি করে বলল, ‘আমায় এখন কী করতে হবে?’
দেবসেনা বলল, ‘কালকে গিয়ে কেসটা উইথড্র করুন। তারপর ভেবে দেখছি।’
অর্জুন রায় ছাড়া পেয়েছে। ইন্দ্রাণী অর্জুনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আর রাখতে চায় না—এমন একটা বয়ান দিয়েছে। অর্জুন রায়ের মুক্তি পাওয়ার দিনে দেবসেনা যায়নি।
আর দেখা না হওয়াই ভালো। গত সাত-আটদিন অর্জুনের সঙ্গে জেলে দেখা করে আর গল্প করে নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক দুর্বলতা লক্ষ করছে দেবসেনা। ও নিজে কোনো সম্পর্কের বন্ধনে জড়াতে চায়নি কোনোদিন, সেই দেবসেনাই ওর মধ্যে একটা অস্থিরতা টের পেয়েছে। অর্জুনের প্রতি এই অহেতুক দুর্বলতার নাম কি প্রেম? নাকি অন্য কিছু! তাই আর অর্জুনের মুখোমুখি হবে না এটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্জুনের মা দেবসেনাকে ফোন করে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। মনে মনে ভেবেছে ভালো থাকুক অর্জুন। আর মায়া বাড়িয়ে কী হবে!
দিনসাতেক পর পর দেবসেনা গিয়েছিল অর্জুনের সঙ্গে দেখা করতে। প্রতিদিনই একটু একটু করে জেনেছে অর্জুনকে। কতটা প্রবঞ্চিত হয়েছে ও, কতটা উজাড় করে ভালোবসেছে ইন্দ্রাণীকে—সবটুকু জেনেছে। ওর রিসার্চ পেপারের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এর বাইরেও যে অচেনা একটা অনুভূতির দোলাচল শুরু হয়েছে ওর মনের মধ্যে সেটার হদিস ও কিছুতেই পাচ্ছে না। অর্জুনের অ্যারেস্ট হওয়ার খবর এত মিডিয়া কভার করেছিল কেন এখন বুঝতে পারছে দেবসেনা। এটা রণজিতের কাজ। যাতে অর্জুন কোনোদিনই গলা তুলে না বলতে পারে ওই উপন্যাসটা ওর লেখা।
অর্জুন বাড়ি ফিরে এসেছে এই খবর ওর মা দিয়েছেন দেবসেনাকে। খুব ইচ্ছে করেছে দেবসেনার অর্জুনের সঙ্গে দেখা করতে। জেলের বাইরে মানুষটা কী করছে, জানতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু অবাধ্য মনকে আর একটুও বিশ্বাস করে না দেবসেনা। একটু একটু করে এই মনে অর্জুন আধিপত্য বিস্তার করছে। তাই এটাকে কিছুতেই প্রশ্রয় দেওয়া যায় না।
অর্জুনের নাম শোনার পর থেকে শতরূপ আর যোগাযোগ করেনি। নিজের মনেই হাসল দেবসেনা। যাক অর্জুন ওর একটা উপকারে তো লাগল। শতরূপের ইচ্ছাকৃত বদমাইসিগুলো হয়তো এবার কমল।
নিজেকে নিজের কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে দেবসেনা। কিন্তু বারবার সেই প্রথম দিনের কান্না ভেজা অর্জুনের মুখটা মনে পড়ছে। অর্জুন যখন ইন্দ্রাণী আর ওর প্রেমের দিনগুলোর কথা বলছিল, কেন কে জানে ভিতরে একটা ঈর্ষাজনিত কষ্ট হচ্ছিল। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। দেবসেনা এতদিন ধরে মানুষের মন নিয়ে পড়াশোনা করছে, অথচ নিজের মনটাই নিজের কাছে বড্ড অচেনা লাগছে। তবুও দিন কাটছিল, সময়ের যেহেতু সময় নেই থামার তাই এগিয়ে চলেছিল নিজের গতিতেই।
নিজের রিসার্চ পেপারগুলো নিয়ে গুছিয়ে বসেছে আজ। প্রায় দিন দশেক নিজেকে সময় দেওয়া হয়নি। কেমন যেন ওলটপালট হয়েছিল সবকিছু।
বাবা অফিস বেরিয়ে যাওয়ার আগেই বলে গেছে, ‘অনেক হয়েছে, এবারে পেপারস রেডি করো।’
মা গেছে ছোটমাসির বাড়ি।
বাড়িতে একাই আছে দেবসেনা। নিজের ঘরে বসে ফাইলগুলো খুলেছে। বেলটা বেজে উঠল। মা ফিরবে সন্ধেতে। বাবাও তাই। কে এল? শতরূপ নয় তো? ইদানীং আর ফোন করে না শতরূপ। তাই কিছুটা নিশ্চিন্তে আছে ও। আইহোল দিয়ে বাইরে তাকাল দেবসেনা। বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। ও কি ঠিক দেখছে? নাকি ওর অবচেতন মনে ভাবনার ফসল?
আবারও বেলটা বাজল।
দরজাটা খুলতেই একটু লাজুক মুখে অর্জুন বলল, ‘আপনার ঠিকানাটা মায়ের কাছ থেকে পেলাম। আপনাকে একটা থ্যাংকস জানানোর ছিল। আমি আমার পুরোনো কোম্পানি ছেড়ে দিয়েছি। নতুন একটা জব জয়েন করেছি আজকেই। তাই ভাবলাম আপনাকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে আসি।’
দেবসেনা কাঁপা গলায় বলল, ‘আসুন প্লিস।’
অর্জুন ওদের সোফায় বসে বলল, ‘আর কেউ নেই বাড়িতে?’
দেবসেনা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না, বাবা আর মা দুজনেই বেরিয়েছে।’
অর্জুন হেসে বলল, ‘ভয় নেই। জেল ফেরত আসামি হলেও আমি খুনি নই। পৃথিবীর কারোর ওপরে আমার ঘৃণা নেই। এমনকী রণজিতের ওপরেও নেই। শুধু ওই একজনকেই আমি ঘৃণা করি। তাই আমায় ভয় পাবেন না প্লিস। আপনার চোখ-মুখ একটু কেমন যেন লাগছে আজকে। যখন জেলে যেতেন তখনকার মতো নয়। একটু বোধহয় নার্ভাস হয়েছেন আমায় বাড়িতে দেখে!’
দেবসেনা কী করে বলবে ওকে যে, এই ক’দিনের ওর সমস্ত নিজস্ব মুহূর্ত জুড়ে শুধু অর্জুনেরই আনাগোনা ছিল। অনেক কষ্টে অবাধ্য মনটাকে শাসন করে রেখেছে বলেই হয়তো মুখে তার ছাপ পড়েছে।
দেবসেনা বলল, ‘আমি ভয় পাচ্ছি না। আপনি শরবত খাবেন?’
অর্জুন ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না। আমি আপনাকে একটা জিনিস দিতে এসেছি। বলতে পারেন আবার আমায় আলোর দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনার উপহার মাত্র।’
দেবসেনা বলল, ‘উপহার কেন? আমি তো সেভাবে কিছুই করিনি।’
অর্জুন একটা হালকা সবুজ ডায়রি ওর হাতে ধরিয়ে বলল, ‘জেলের শেষ সাতদিনের অভিজ্ঞতা লেখা আছে এতে। যদি আপনার রিসার্চের কাজে লাগে, পড়ে দেখবেন।’
উঠে দাঁড়াল অর্জুন। দেবসেনা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ওই নিষ্পাপ প্রেমিকের চোখের দিকে। খুব ইচ্ছে করছে অর্জুনের হাতটা ধরে বলতে, আরেকটু বসো প্লিস। না কিছুই বলা হল না দেবসেনার। অর্জুন যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমনই চলে গেল।
দেবসেনা কচিপাতা রঙের ডায়রিটা খুলল।
প্রথম লাইনেই লেখা আছে, ‘অন্ধকার, কী ভীষণ অন্ধকার এই বদ্ধ জীবন। তবুও বেশ ভালো লাগে আমার কারণ বাইরে বেরোলেই আবারও বিশ্বাসঘাতকদের ভিড়। আমি কোনোদিন বেরোতে চাইনি এখান থেকে। কিন্তু সে হঠাৎই এল। আমাকে ছুঁয়ে গেল তার কণ্ঠস্বর। আমাকে জিতিয়ে নিজের জিততে চাওয়ার আকুতি কাঁপিয়ে দিল আমার অন্তরাত্মা। কে ও? আমি তো চিনি না ওকে। অচেনা কারোর জন্য কেউ এমন করে ভাবে?
দেবসেনা, ওর নাম দেবসেনা। আমাকে আবার বাঁচার প্রেরণা জোগাল। নারী শব্দটাতেই তীব্র ঘৃণা জন্মেছিল। মাত্র দু’দিনেই সেই ঘৃণা থেকে হাত ধরে টেনে বের করে আনল আমায়। আমি এখন দেবসেনার হাতে নিজেকে সমর্পণ করেছি। ও যেদিকে নিয়ে যাবে এই জলে ডোবা তরীকে, সেদিকেই যাব আমি। দেখি না কোনদিকে নিয়ে যায় দেবসেনা আমায়।
দেবসেনার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আজ তৃতীয় দিন। আজও আসবে বলেছিল। আমার ভীষণ অস্থির লাগছে। কেন এখনও আসছে না মেয়েটা! তবে কি আমায় ছেড়ে চলে গেল! ওই তো দেবসেনা এসেছে। আকাশনীল রঙের চুড়িদারে ঠিক যেন নরম শরৎ। এগিয়ে আসছে দেবসেনা। আমার হৃৎপিণ্ড এমন দ্রুতগামী কেন হচ্ছে! এ তো শুধু ইন্দ্রাণীকে দেখেই হত। আর তো কখনও কোনো নারীকে দেখে এমন হয়নি। তবে কি আমি দেবসেনাকে…না না, আমি একজন আসামি। দেবসেনা আমায় বাঁচাতে চায় মাত্র।
আজ আমার ছুটি হবে। নিশ্চয়ই দেবসেনা আজ থাকবে। দাড়ি কেটে দিয়েছে আজ। বহুদিন পরে দাড়ি কাটলাম আমি। দেবসেনা দেখে চিনতে পারবে তো!
বাবা, মা, ছোটকাকা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। দেবসেনা তো আসেনি। কষ্ট হচ্ছিল আমার। ভীষণ কষ্ট। ইন্দ্রাণীকে হারানোর থেকেও কয়েকগুণ বেশি। তবে কি দ্বিতীয় প্রেমের অস্তিত্ব আছে এই পৃথিবীতে?’
ডায়রির পাতাগুলো ভিজে যাচ্ছে। আর পড়তে পারছে না দেবসেনা। ওকে নিয়ে লিখেছে অর্জুন। না, এটা বই হিসাবে ছাপা হবে না। এ ওর একান্ত নিজের।
ফোনটা ডায়াল করল দেবসেনা। অর্জুনের মোবাইল নম্বর। ওর ডায়রির শেষ পাতায় লেখা।
ফোনটা রিং হচ্ছে।
‘দেবসেনা আমায় তুমি ভুল বুঝো না। আমি দুশ্চরিত্র নই, আমি নারীতে আসক্ত নই। তবে আমার সমস্ত অনুভূতি নিঃশেষ করে দিলাম তোমায়। আমি আজ রিক্ত, শূন্য। ভালোবাসার মতো কিছুই অবশিষ্ট রইল না আমার কাছে। বুঝলাম, যাকে ভালোবাসার পরে নিজের বলে আর কিছুই থাকে না, সেটাই প্রেম।
না না, আমি তোমার কোনো উত্তর চাইনি। তুমি কেন একজন আসামিকে ভালোবাসবে? তবে এই অনুভূতিটুকু লিখতে ইচ্ছে হল। ভালো থেকো দেবসেনা।’
ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। শেষ লাইনগুলো পড়তে পড়তে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল দেবসেনা।
আবারও ফোন করল ও। অর্জুন ফোনটা রিসিভ করে বলল, ‘উঁহু, প্লিস কিছু বলো না। আমি কিছুই চাই না তোমার কাছে। শুধু অপমান করো না প্লিস।’
দেবসেনা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন