অর্পিতা সরকার
‘কীরে, শুনলাম নাকি আজকাল তোকে প্রায়ই বাজারে-হাটে দেখা যাচ্ছে? তোদের বাড়ির বাজার তো তোর বড়দা করে, এই বাজারের ব্যাগটা কার রে?’
মুচকি হেসে নীলাঞ্জন বলল, ‘এটা সম্ভবত দীপশিখাবউদির তাই না?’
একটু অন্যমনস্কভাবেই বসে আছে সৃজন। ক্লাবে এই টাইমটাতে ওরা সবাই আসে, একটু আড্ডা দেয়। ক্যারাম খেলে। দুজন ছাড়া সবাই বেকার। মোটামুটি টিউশনিকেই জীবিকা মেনে নিয়ে মনোযোগ সহকারে সেটাই করছে। এদের মধ্যে সৃজনের মূল্য একটু বেশি। কারণ ওর সব স্টুডেন্ট সিবিএসসি, আইসিএসসি বোর্ডের। ও নিজেও সিবিএসসি থেকেই পাস করেছে উচ্চমাধ্যমিকটা। তারপর ইংরেজিতে অনার্স আর মাস্টার্স করেছে। ওই আর কী, বাঙালির ইংরেজি প্রীতির মতোই বাংলা মিডিয়ামের পড়ুয়াদের থেকে ইংরেজি মিডিয়ামের পড়ুয়াদের একটু অন্য চোখে দেখে বন্ধুরা। তাই শক্তিনগরে টিউশন টিচার হিসাবে সৃজনের ডিমান্ড একটু বেশি। ইনকামও ও সকলের থেকে বেশিই করে। কিন্তু ওই বেকার শব্দটা পিছু ছাড়ে না এটাই যা দুঃখের।
কবে যে সব কাজকেই প্রফেশন হিসাবে মেনে নেবে মানুষ, কে জানে! আজ অবশ্য মনটা সেজন্য খারাপ নয় সৃজনের। কারণটা সম্পূর্ণ অন্য। অভিষিক্তাও ওকে এভাবে ভুল বুঝবে, কোনোদিন ভাবতে পারেনি সৃজন। ভাবত, এই একজন মানুষ ওকে ঠিক চেনে। যার কাছে কোনো কিছু কোনোদিন লুকনোর প্রয়োজন হয়নি। মায়ের কাছেও যেটা বলা হয়ে ওঠেনি সৃজনের, সেটাও ও বলেছে অভিষিক্তাকে। তারপরেও এভাবে আঘাত করল ও সৃজনকে! মানুষ চিনতে সত্যিই সৃজনের ভুল হয়েছে। আর ভালোবাসা শব্দের সঠিক অর্থ যে ঠিক কী—সেটা বোধহয় কোনোদিনই জানা হল না ওর।
ভালোবাসা শুধুই শরীর চেনা না, মনের খবরও রাখা, এটা যে কেন মানুষ বোঝে না কে জানে!
নীলাঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ রে, তুই ওই ধুমসি দীপশিখাবউদির জন্য অভিষিক্তার সঙ্গে ব্রেকআপ করলি? এটা মানা যায়? ওই বউদি তোর থেকে অন্তত বছর ছয়েকের বড় হবে। আর দেখতে লাগে মিনিমাম দশ বছরের বড়। ওই বউদির প্রতি তোর এত দরদ কেন রে? শোন বস, নিজেকে রবীন্দ্রনাথ ভেবে বসিস না।’
সৃজন অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘তোরা শিওর কাদম্বরীদেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল? কোনো প্রমাণ আছে? নেই। তারপরেও রবীন্দ্রনাথকে টেনে এসব বলতে একটুও বাধে না বাঙালির! বৌদি কারোর বন্ধু হতে পারে না? বউদি মানেই তার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক, এটা তোদের কে বলল রে? এই অদ্ভুত ধারণাটা ঠিক কেন এসেছে আমি জানি না।’
আকাশ হেসে বলল, ‘আরে বস আজকে হেভি মুডে আছে। হাতে একটা মাইক ধরিয়ে দিলে ফাটিয়ে দেবে। শিকাগোতে নিয়ে গেলে ওদেশের সবাইকে বশ করে ফেলবে।’
বন্ধুরা এমন ইয়ার্কি মারে। বিরক্তিকর হলেও সহ্য করে নেয় সৃজন। কিন্তু আজ ও নিজেই ভীষণরকমের ডিস্টার্বড আছে। তাই এসব কথা ভালো লাগছে না।
নীলাঞ্জন বলল, ‘শোন, ইয়ার্কি নয়। গোটা পাড়া তোদের রিলেশন নিয়ে আড়ালে কানাকানি করছে। বলছে, সৃজনের মতো অমন একটা ব্রিলিয়ান্ট ভালো ছেলের মাথাটা মোড়ালো কী করে ওই মুটকি কালো দীপশিখা? তবুও যদি লাভলিবউদি তোর মাথাটা ঘোরাত, তাহলেও বুঝতাম। লাভলিবউদি যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে তখন আমাদের মতো অনেকেরই হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বিশ্বাস কর, ওই মাসি মার্কা দেখতে দীপশিখার জন্য তুই যা করছিস, আজব! বুঝলি? এখন কি বাজার করতে চললি ওর জন্য? আরে, ওর বরটা অবধি ওর দিকে তাকায় না। আমাদের পাড়ার অনুরাধার সঙ্গে সুযোগ পেলেই গল্প করে। সেখানে তুই কেন গিয়ে ওই ফাঁদে পড়লি বল তো?’
সৃজনের এই পরিবেশটাই দমবন্ধকর লাগছে। বন্ধুর সংজ্ঞাটাও ধীরে ধীরে ভালোবাসার মতোই আবছা হয়ে যাচ্ছে ওর কাছে। তবুও সেই কবেকার বন্ধু সব। সেই প্রাইমারি বেলার। পরে সবাই অন্য স্কুলে পড়েছে বটে, কিন্তু বন্ধু শব্দটা যবে থেকে চিনেছে তবে থেকে ওদের বন্ধুত্ব। তাই এভাবে সকলের কথা অগ্রাহ্য করতে পারে না সৃজন। দরকার-অদরকারে এরাই পাশে থেকেছে বরাবর।
সৃজনের বাবার অসুস্থতার সময়ে এই নীলাঞ্জন, আকাশ, বাপ্পাদিত্য, অরিজিৎরাই প্রাণ দিয়ে করেছিল। একবারও মনে হয়নি, বাবাটা ওদের নয়। মনে হচ্ছিল বিপদটা শুধু সৃজনের নয়, ওদেরও। তাই যাই ঘটে যাক, এদের এড়িয়ে যেতে পারে না সৃজন। এমনকী অভিষিক্তাকে যখন কিছুতেই প্রোপোজ করতে পারছিল না, ব্যাগে চিঠি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল দিনের পর দিন, তখন এই বাপ্পাদিত্যই অভিষিক্তাদের লেটারবক্সে চিঠিটা ফেলে এসেছিল। অভিষিক্তার সঙ্গেও এই চারজনের বেশ ভালোই বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। তাই সৃজন না বললেও ওরা জেনে গেছে অভিষিক্তার সঙ্গে সৃজনের ব্রেকআপের আসল কারণ। মুশকিলটা হল, সৃজন ভেবেছিল এরা ওর ছোটবেলার বন্ধু, এদের কাছে অন্তত দীপশিখাবউদির সঙ্গে ওর সম্পর্কের আসল কথাটা বলতে পারবে। এখন বুঝল, গোটা পাড়া, ওর বাড়ি, অভিষিক্তা যা বুঝেছে এরাও সেভাবেই বুঝেছে ওদের সম্পর্কটাকে।
সৃজন বলল, ‘আজ উঠি রে।’
আকাশ বলল, ‘হ্যাঁ, তোকে তো এখন দীপশিখার বাজার বইতে হবে, তাই না? আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করিস না।’
সৃজনের মনটা এমনিতেই আজ তিক্ত হয়ে আছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চলে এল ক্লাব থেকে। রাস্তায় হাঁটছে সৃজন। আজ স্কুটি নিয়ে বেরোয়নি। পাড়ার মধ্যে থাকবে ভেবেই স্কুটিটা বের করেনি। সংযোগদার মেডিসিন শপে একবার যেতে হবে। কয়েকটা ওষুধ কিনতে বলেছে দীপশিখাবউদি। আসলে দীপাবউদির সঙ্গে ওর সম্পর্কটা যে ঠিক কী, সেটা বোধহয় ওকে বিশ্লেষণ করতে বললে ও নিজেও অপারগ হবে। ঠিক যেমন কালো রঙ বললেই সব কালোকে বোঝায় না, তেমনি সব সম্পর্ককেও এভাবে এক কথায় বোঝানো সম্ভব হয় না। কালোর কত রকমভেদ আছে। মেঘ ভর্তি আকাশ, অমাবস্যার ঘন রাত্রি, কুমারীর লম্বা বেণী, চোখের মণি, কাকের পালক…এমন কত উদাহরণ দিয়ে দিতে পারে সৃজন। এবং হলফ করে বলতে পারে, এই প্রতিটা কালো আলাদা। তাহলে প্রতিটা সম্পর্কের ডেফিনেশন কী করে একই সুতোয় বাঁধা হতে পারে? দেওর-বউদি মানেই পরকীয়া—এমন দাগিয়ে দেওয়ার মানে কী? যে যাই বলুক, দীপশিখাবউদির প্রয়োজনে সৃজন যাবেই। কারণ, ওদের সম্পর্কে কোনো কালিমা নেই, কোনোদিন ছিল না। অবৈধ সম্পর্ক যদি কারোর সঙ্গে থেকে থাকে দীপাবউদির, সেটা ওর স্বামীর সঙ্গে। অনীকদার সঙ্গে কোনো অ্যাঙ্গেল থেকে দীপাবউদির ভালোবাসার সম্পর্ক নয়। একটা ভালোবাসাহীন, আবেগহীন সম্পর্ক অবৈধ নয় তো কী? দুই বাড়ির অভিভাবকরা শুধু সামাজিক বন্ধনে যুক্ত করে দিলেই কোনো সম্পর্ক বৈধ হয়ে যায়! অদ্ভুত সব নিয়মকানুন।
সংযোগদার দোকানে গিয়ে দীপাবউদির লেখা কাগজটা ধরিয়ে দিল সৃজন। বলল, ‘ওষুধগুলো দাও তাড়াতাড়ি।’
সংযোগদা কাগজে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘এই দুটো ওষুধ দেওয়া যাবে না রে প্রেসক্রিপশন ছাড়া। দুটোই কড়া ডোজের ঘুমের আর নার্ভের ওষুধ। বাকিগুলো দিচ্ছি। থাইরয়েড, হাই প্রেশার, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিস…’
সংযোগদা বলল, ‘হ্যাঁ রে, জেঠিমার শরীর কি খুবই খারাপ নাকি রে? এতগুলো ওষুধ কন্টিনিউ করছেন? তুই একবার রোববার বিকেলের দিকে কৃষ্ণেন্দু ব্যানার্জীকে দেখিয়ে নিয়ে যা না। কলকাতা থেকে সপ্তাহে একদিন আসছেন। এমডি ডক্টর, ভালো ট্রিটমেন্ট করেন।’
অন্যমনস্কভাবে সৃজন বলল, ‘একজন বছর চৌত্রিশের মহিলার যদি এমন হয় তাহলে কী খুবই ক্ষতিকর সংযোগদা?’
সংযোগদা বলল, ‘ক্ষতি কী রে পাগল, তাহলে রীতিমতো বিপদ।’
ওষুধের দামটা মেটাতে গিয়েই পকেটে হাত ঠেকল সৃজনের। দীপাবউদি হাতের একটা সোনার আংটি দিয়েছে ওকে। ওটা বেচে এই ওষুধগুলো আনতে বলেছে। নিজের পার্স থেকে টাকাটা বের করে দাম মিটিয়ে দিয়ে পা চালাল সৃজন। বউদির শরীরটা এত ফোলা তাহলে কি এই জন্য! এত রোগ থাকলে সব কিছুরই তো গণ্ডগোল হবে।
ওষুধগুলো নিয়ে দীপশিখাবউদির বাড়িতে ঢুকতে যাবে, এমন সময় ভিতর থেকেই বেশ চিৎকার ভেসে এল। অনীকদার গলা শোনা যাচ্ছে।
‘দিনরাত রোগের বাহানা শুনতে শুনতে নিজেকে রুগি মনে হয় বুঝলে। বাড়িতে ঢুকেই দেখব একটা বেকার শরীর চিতিয়ে পড়ে আছে। পাশবালিশের মতো বিছানা জুড়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কী কাজ আছে তোমার, আমায় একটু বলো তো? চিকেনটা তো আমি রাতে খাব বলে এনেছিলাম। তুমি ফ্রিজে কেন ঢুকিয়ে রেখেছ? রাতে রান্না করতে কি কষ্ট হচ্ছে? আগামীকাল তোমার কষ্ট কমে যাবে? ঠকানোর একটা লিমিট থাকে বুঝলে? তোমার ওই জোচ্চোর বাপটা এভাবে ঠকাবে জানলে বিয়েটাই করতাম না। ধুত্তোর, তোমার ওই আলুর ঘ্যাঁট তুমি গেলো।’
ভিতর থেকে একটা রিনরিনে গলার স্বর শোনা গেল, ‘ডিম ভেজে দেব একটা?’
অনীকদা আবার বলল, ‘না না, এত কষ্ট তোমার ওই শরীরে সইবে কেন! আমি হোটেলে খেয়ে নিচ্ছি।’
ঝড়াম করে গেটের আওয়াজ হল, একটু সরে গেল সৃজন। অন্যদিন অনীকদা ওকে দেখে তেমন বিরক্ত হয় না। বলে, ‘যা, তোর বৌদি ভিতরে আছে।’ কিন্তু আজ যেভাবে রেগে আছে তাতে হয়তো ওকে দেখলে আরও রেগে যাবে। তাই উঠোনের উত্তর দিকের অন্ধকার গাছের কোণটাতে একটু সরে গেল সৃজন। অনীকদা বাইকটা নিয়ে বেশ রাগী ভঙ্গিমায় বেরিয়ে গেল। তারপরেও একটুক্ষণ অপেক্ষা করল সৃজন। বউদি হয়তো ঘরে কাঁদছে, ও সামনে গেলে অস্বস্তিতে পড়বে, তাই একটু অপেক্ষা করল।
ভিতর থেকে ভেসে আসছে গানের আওয়াজ…
‘ছোট ছোট দিন
আলাপে রঙিন, নুড়িরই মতোন
ছোট ছোট রাত
চেনা মৌতাত, পলাশের বন…আহা
অগোছালো ঘর, খড়কুটোময়
চিলেকোঠা কোণ
কথা ছিল হেঁটে যাব ছায়াপথ…’
বেল বাজাতে হল না, দরজা খোলাই আছে। সৃজন পায়ে পায়ে ঢুকল দীপশিখাবউদির ঘরে। বউদি বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছে। সামনে বউদির ভীষণ প্রিয় ছোট্ট জলপাই রঙের হোম থিয়েটারে বাজছে অন্তহীন সিনেমার গানটা।
ওকে দেখে গানটা অফ করে বউদি বলল, ‘এসো সৃজন। তুমি বাংলা গান ভালোবাসো?’
সৃজন একটু অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ বাসি। অনীকদা রাগ করেছিল কেন? কোনো সমস্যা?
বউদি অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘রাগের আর দোষ কী সৃজন? ওই মানুষটাই বা পেয়েছে কী জীবনে! আমায় বিয়ে করেছিল কিছু টাকার লোভে। বোনের বিয়ে দিতে পারছিল না টাকার জন্য। আমার বাবার কোম্পানিতেই জব করত। বাবাও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। রোগগ্রস্ত মেয়ের দায়ভার চাপিয়ে দিয়েছে অনীকের মাথায়। নিজের বাবা, মা, দাদা, বউদি যার দায় নেয় না, তার দায় কেন একজন অপরিচিত নেবে বলো তো সৃজন? অনীক আমার থেকে মাত্র বছর দেড়েকের বড়। ও কী পেল আমায় বিয়ে করে? বাবার দেওয়া বেশ কিছু টাকা দিয়ে বোনটার বিয়ে দিয়েছে। ওদের ভাঙা বাড়িটা সারিয়ে নিয়েছে। আর এই বাড়িটা আমার বাবা করে দিয়েছে তার মেয়ে-জামাইয়ের জন্য। কারণ, অনীকদের গ্রামের বাড়িতে আমার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া অনীকের মা-বাবা আমায় তেমন পছন্দ করে না। অনীক এখন আমার বাবার কোম্পানির ম্যানেজার হয়ে গেছে। স্যালারি বেড়েছে। কিন্তু কোম্পানিটাও এখন লসে যাচ্ছে। তাই ওরও মাথার ঠিক নেই। এমন একটা মোটা, কালো অসুস্থ শরীরের দায় যে ও নিয়েছে এটাই তো অনেক সৃজন। আমি কৃতজ্ঞ যে, ও আমায় আমার বাপের বাড়ি থেকে বের করে এনেছে। ওবাড়িতে দিনরাত একটাই কথা শুনতাম জানো তো, ‘দীপাকে নিয়ে যে কী হবে? ও-ই হল আমাদের ঘাড়ের বোঝা।’ বউদি মাঝে-মাঝেই বিরক্ত হয়ে দাদাকে বলত, ‘অন্যত্র ফ্ল্যাট কিনে রাখো। তোমার মা-বাবা চোখ বুঝলে আমি কিন্তু তোমার বোনের দায়িত্ব নিতে পারব না।’ দাদার চোখেও বিরক্তি দেখেছি। বলত, ‘এত ডাক্তার তো দেখানো হল, ভেলোর নিয়ে যাওয়া হল এত বার। দু’দিন ভালো থাকে তো তিনদিনের দিন পা ফুলে ঢোল। হাঁটার ক্ষমতা থাকে না। সত্যিই নিজেদের জীবনটা নরক হয়ে গেল।’ এসব শুনে শুনে বুঝতে পারতাম আমি ওদের বড্ড গলগ্রহ। ‘অনীক আমায় উদ্ধার করেছে ওখান থেকে।’
সৃজন একটু বিরক্ত হয়েই বলল, ‘উদ্ধার করার কী আছে? বিয়েটা করেছিল নিজের স্বার্থে। তোমায় উদ্ধারের জন্য নয়। এখন স্বার্থ মিটে গেছে তাই যাবতীয় রাগ ঝাড়ছে তোমার ওপরে। অনীকদা তো জানেই তুমি অসুস্থ থাকো। তাহলে একটা রাঁধুনি রাখলেই পারে। টাকা তো তোমার বাবা দেবে।’
ফোলা হাতগুলোর ওপরে প্রেশার দিয়ে অনেক কষ্টে বসল দীপশিখা। বলল, ‘ওর দোষ নেই। রাঁধুনি আমিই রাখতে দিইনি সৃজন। কাজের লোক সবটুকু করে দিয়ে যায়। আমি তো অনীককে কিছুই দিতে পারি না। রাঁধুনি রান্না করে দিয়ে গেলে এ সংসারে আমার প্রয়োজনটা কী বলো তো? নিজের অধিকারটুকু হারাতে চাইনি বলেই রাঁধুনি রাখিনি। শরীরটা এতটা খারাপ হত না, জানো। প্রায় দিন কুড়ি ওষুধ খাইনি তাই এতটা অসুস্থ হয়ে পড়লাম।’
সৃজন বলল, ‘তো খাওনি কেন?’
দীপশিখা মাথা নীচু করে বলল, ‘টাকা ছিল না আমার কাছে। বাবার পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু ব্যস্ত আছে হয়তো, তাই ভুলে গেছে।’
সৃজন বলল, ‘তো অনীকদার কাছে চাওনি কেন? ওষুধগুলো তো অনীকদাই এনে দিতে পারত।’
মাথাটা নীচু করে নিল দীপশিখা। নরম গলায় বলল, ‘শুকনো চোখের জল অন্যকে দেখালে যেমন কষ্টটা কমে যায় না, তেমনই নিজের রোগের গল্প অন্যকে বললেও সেটা ভালো হয়ে যায় না সৃজন। আমি চাই না, আমি দিনে কতগুলো ওষুধ খাই সেটা ও জানুক। সাধারণত আমাদের পরিচারিকার হাতে টাকা দিয়ে দিই, ও-ই এনে দেয়। এবারে টাকা ছিল না বলে, আংটি বন্ধক রাখতে হবে বলেই তোমায় ডাকলাম। ওদের তো জানো, সারা পাড়ায় বলে বেড়াবে।’
সৃজন ওষুধের ব্যাগটা সামনে রেখে বলল, ‘এতে সব আছে। আর এই নাও আংটিটা। এটা লাগেনি। তুমি টাকা পেলে আমায় ধার শোধ করে দিও।’
দীপশিখা আচমকা সৃজনের হাতটা টেনে কড়ি আঙুলে সাদা পাথরের আংটিটা পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা তবুও তোমার কাছে থাক।’
সৃজন হেসে বলল, ‘বুঝলাম এটা ইউনিসেক্স আংটি। কিন্তু তাই বলে সামান্য ক’টা ওষুধের জন্য এত দামি আংটি আমি নেব কেন?’
দীপশিখা বলল, ‘থাকুক না আমার একটা স্মৃতি তোমার কাছে।’
সৃজন আর কিছু বলল না।
দীপশিখা বলল, ‘সৃজন একদিন আমায় একটা সিনেমায় নিয়ে যাবে? সেই কলেজে পড়তে লাস্ট সিনেমা দেখেছি। তারপর আর দেখা হয়নি। বিয়ের পরে আমায় নিয়ে বেরোতে অনীকের লজ্জা করে বলে, আমিও জোর করিনি।’
সৃজন বলল, ‘সে যাব’খন। তার আগে তোমায় একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। আর তুমি ঘুমের ওষুধ কেন লিখেছিলে?’
দীপশিখা একটা ওষুধ জল দিয়ে গিলে নিয়ে বলল, ‘রাতে ঘুম আসতে চায় না তাই। তোমাদের বাড়িতে ক’দিন আগে একটা মেয়েকে দেখলাম ছাদে ঘুরছে। তোমার মা’ও ছিলেন। দুজনে খুব গল্প করছিল। ওটা কে গো? তোমার গার্লফ্রেন্ড? দারুণ দেখতে কিন্তু। আমায় বলোনি তো, তোমার গার্লফ্রেন্ডের কথা। আমার সঙ্গে আলাপ কবে করাবে?’
সৃজন বলল, ‘সে হবে’খন।’
অভিষিক্তা সময় পেলেই বাড়িতে আসে। মায়ের সঙ্গে ওর খুব জমে। হবু শাশুড়ি নয়, ঠিক যেন দুই বান্ধবী এমনভাবেই গল্প করে। অভিষিক্তার সঙ্গে ব্রেকআপ হয়ে গেছে খবরটা বোধহয় এতক্ষণে বাড়িতেও পৌঁছে গেছে। কারণটা যে দীপশিখাবৌদির সঙ্গে মেলামেশা সেটাও হয়তো মা জানে এতক্ষণে। সৃজনকে বেশ কিছু কড়া কথা যে শুনতে হবে বাড়িতে, সেটা ও বেশ জানে। কিন্তু মা যদি বউদিকে চারটি কুকথা শুনিয়ে দেয়, তাহলে লজ্জায় শেষ হয়ে যাবে সৃজন।
একটু অন্যমনস্কভাবেই বলল, ‘হ্যাঁ গার্লফ্রেন্ড।’
দীপশিখা বলল, ‘তোমাদের ভারি মানাবে জানো। এই যে তোমার অনীকদা এমন সুপুরুষ, তার পাশে আমায় যেমন বিকট লাগে তেমন নয়। তোমাদের ভীষণ মানাবে।’
সৃজন বলল, ‘তুমি আমার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে কবে যাবে?’
দীপশিখা বলল, ‘সিনেমা যাব, ফুচকা খাব, আইসক্রিম খাব। যদি পারো নিয়ে যেও। তোমার প্রেমিকাকেও সঙ্গে নিতে পারো। বেশ মজা হবে। বলা তো যায় না, বর্ষার প্রথম বৃষ্টির ফোঁটাটা যদি আর দেখা না হয় আমার। যদি আর উথাল করা কালবৈশাখী দেখা না হয়। ইস্ আফসোস হয়, জানো সৃজন।’
সৃজনের খুব রাগ হচ্ছিল অনীকদার ওপরে। স্ত্রী অসুস্থ জানে, তবুও তার মন ভালো রাখতে একটু সিনেমাও দেখাতে নিয়ে যেতে পারে না। এদিকে তো শ্বশুরের টাকায় ফুটানি করছে। বউদির অসুস্থতার জন্য অনীকদাই দায়ী। মন খারাপ থাকলে রোগ আরও বেড়ে যায়। অনীকদার যা ব্যবহার, তারপর বৌদির মন কীভাবেই বা ভালো থাকবে!
সৃজন বলল, ‘ওষুধগুলো নিয়ম করে খেও। পরের সপ্তাহে একটা ছুটির দিন দেখে আমরা সিনেমা দেখতে যাব।’
ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠল দীপশিখা। বলল, ‘সত্যি নিয়ে যাবে? খুব মজা হবে। আমার আলমারিতে কত নতুন শাড়ি আছে। একটা পরে যাব। কোথাও যাওয়া হয় না বলে পরাও হয় না।’
সৃজন বেরিয়ে এল। গেট থেকেই শুনতে পেল…
“চেনাশোনা মুখ জানাশোনা হাত রেখে যায়
ধীরে ধীরে ঘুম ঘিরে ঘিরে গান ডেকে যায়
আজও আছে গোপন
ফেরারি মন
বেজে গেছে কখন
সে টেলিফোন…”
আনমনে বাড়ির গেটে এসে বেল বাজাল সৃজন। মাত্র একটা বাড়ি পরেই দীপশিখাদের বাড়ি। সৃজনদের ছাদ থেকে বউদিদের ছাদ পরিষ্কার দেখা যায়। অনীকদার ফুলশয্যার দিনে ওরা বন্ধুরা খুব খেটেছিল। মাত্র বছর তিনেক আগের কথা। তবুও যেন মনে হয়, দীপশিখার সঙ্গে পরিচয় ওর কত দিনের। অনীক যেহেতু পাশের বাড়ির প্রতিবেশী তাই অনীকদার বিয়ের অনেক দায়িত্বই নিয়েছিল ওরা। অনীকদার এই বাড়িটা আসলে ছিল শিবাণী দিদিমনির। দোতলা বাড়িটা দিদিমনি মারা যাওয়ার পরে প্রায় তালা বন্ধ হয়ে পড়েছিল। হঠাৎই বছর চারেক আগে অনীকদা এসে একতলাটায় ভাড়া থাকতে শুরু করে। দিদিমনির মেয়ে-জামাই কলকাতা থেকে এসে লোক লাগিয়ে পরিষ্কার করে গিয়েছিল ক’দিন আগে। অনীকদা বলেছিল, বিজ্ঞাপন দেখেই ভাড়া এসেছে। সেই থেকেই অনীকদার সঙ্গে সৃজনদের পরিচয়। ছুটিছাটায় ওদের ক্লাবে এসে ক্যারাম খেলত অনীকদা। ক্যারাম খেলায় আজ অবধি কেউ হারাতে পারেনি অনীকদাকে। বেশ হাসিখুশি ছিল। কখনো পরিবারের কোনো সমস্যার কথা বলেনি ক্লাবের কাউকে। হঠাৎই একদিন এসে বলল, ‘বিয়ে করেছি আর শিবানী দিদিমনির বাড়িটাও কিনে নিচ্ছি।’
সৃজনরা মজা করে বলেছিল, ‘তোমার তো হেভি টাকা গো। এবারে সরস্বতী পুজোয় বেশি করে চাঁদা দিতে হবে।’
অনীকদা হেসে বলেছিল, ‘সে হবে রে। আপাতত বিয়েটা এই বাড়ি থেকেই হবে। তাই তোদের খাটতে হবে দাদার বিয়েতে। গ্রামের বাড়ি থেকে করব না। বোনের বিয়ে দিলাম, গোটা গ্রামকে নিমন্ত্রণ করতে হয়েছিল। এবারে আর অত পারব না।’ শিবাণী দিদিমনির পড়ে থাকা বাড়িটা কয়েকদিনের মধ্যেই রিপেয়ার হয়ে গেল। পিচ রং চড়ল বাড়ির গায়ে। সূর্যের আলোয় ঝকঝক করে উঠল। অনীকদাকে এক কথায় সুপুরুষ বলা চলে। সেই অনীকদা যেদিন বিয়ে করে বউ নিয়ে পাড়ায় এল, সবার মধ্যেই একটা চাপা ফিসফিস শুরু হল। অনীকের মতো সুদর্শন ছেলে কিনা এই কালো, মোটা মেয়েটাকে বিয়ে করে আনল? দেখে তো অনীকের থেকে বড়ই মনে হচ্ছিল বয়েসে। ওদের ক্লাবের টিমটা অবশ্যই বরযাত্রী হিসাবে গিয়েছিল। সৃজন সেদিনই দেখেছিল দীপশিখাকে। রীতিমতো কাঁচুমাচু হয়ে, অস্বস্তি নিয়ে বসেছিল বউয়ের সাজে। দামি বেনারসি, এক গা গয়না পরেও চোখ দুটোতে যেন অনেকটা কষ্ট লুকিয়ে আছে—এটাই মনে হয়েছিল সৃজনের। দীপশিখার মুখশ্রী মোটেই খারাপ লাগেনি ওর, বরং বেশ মিষ্টি লেগেছিল।
বন্ধুরা অবশ্য বলছিল, ‘দেখো বস, টাকার লোভে বিয়ে করলে এমনই বউ হবে। রাতারাতি যখন দোতলা বাড়ি হয়ে যাচ্ছে, দামি বাইক হয়ে যাচ্ছে, তখন বুঝতেই হবে গল্প কিছু আছে। অনীকদার বউকে দেখে বুঝলাম, অনীকদার শ্বশুর জামাই কিনেছে চড়া দামে।’
সৃজন সেদিনই শুনেছিল কানাঘুষো যে, অনীকদা দীপশিখার বাবার কোম্পানিতেই জব করে। কে জানে কেন সেদিন থেকেই দীপশিখার জন্য ওর কেমন মায়া লেগেছিল।
ফুলশয্যার দিন সৃজনরা সবাই মিলে প্রচুর খেটেছিল। নিমন্ত্রিত যদিও কম, মাত্র আড়াইশো মতো, তবুও অনীকদা বলেছিল, ‘দেখিস বদনাম যেন না হয়।’
অনীকদাদের লোকজন কম ছিল বলেই বউভাত আর ফুলশয্যা একই দিনে করে দিয়েছিল। সৃজনের মনে আছে, স্নান করতে দুপুর দুটো বেজে গিয়েছিল। প্রায় তিনটে নাগাদ এসে দেখেছিল, বন্ধুদের খাওয়া হয়ে গেছে। হঠাৎই একটা রিনরিনে গলায় কেউ বলেছিল, ‘তুমি সারাদিন এত কাজ করছ, অথচ এখনও খাওয়া হয়নি? এসো খেয়ে নেবে এসো।’
সৃজন দেখেছিল নতুন বউ একটা লাল হলুদে মেশানো শাড়ি পরে মাথায় অল্প ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর পিছনেই।
সৃজন অপ্রস্তুত গলায় বলেছিল, ‘না ঠিক আছে, আমি খেয়ে নিচ্ছি।’
দীপশিখা মিষ্টি করে হেসে বলেছিল, ‘আজ তো বউভাত। তাই আমাকেই বসিয়ে খাওয়াতে হয় আত্মীয়দের।’
নিজের হাতে পরিবেশন করে খাইয়েছিল দীপশিখা ওকে। দীপশিখার আন্তরিকতায় আপ্লুত হয়েছিল সৃজন। দীপশিখাও ইংরেজিতে অনার্স করেছে শুনে ওদের বন্ধুত্বটা আরও জোরালো হয়েছিল। সৃজন কোনোদিন ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি এই সম্পর্ক নিয়ে আড়ালে কানাকানি হতে পারে। অনীকদাও প্রায় বলত, ‘তোর বউদি তোকে খুব স্নেহ করে। মাঝেমাঝে যাস, গল্প করে আসিস। একাই থাকে তো।’
তখন অবশ্য সৃজন জানত না দীপশিখার শরীরে এত রোগের বাস। জানত না অনীকদার সঙ্গে দীপশিখার বিয়েটা একটা ডিল। ধীরে ধীরে ওর সঙ্গে একটা অসমবয়সি বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল দীপশিখার। কখনও ওরা রাজনীতি নিয়ে তর্ক করত। কখনো শেক্সপিয়ার নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভেসে যেত। অভিষিক্তাও জানত দীপশিখাবউদির কথা। কখনও এই নিয়ে কিছু বলেনি। আচমকাই একমাস ধরে এই নিয়ে ঝগড়া শুরু করল। তার ফলাফল আজকের ব্রেকআপ। অভিষিক্তার বক্তব্য, সৃজন দীপশিখার সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না। ওদের বাড়ির চৌকাঠ ডিঙাতে পারবে না।
সৃজন বলেছিল, কারণটা ঠিক কী? আচমকা এমন একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেবে কেন সৃজন! অভিষিক্তা কোনো যুক্তিতর্কের ধার ধারেনি। একটাই কথা বলেছিল, ‘ইয়েস অর নো?’
সৃজন বলেছিল, ‘আগে তুমি পুরোটা শোনো।’
অভিষিক্তা উত্তর দিয়েছিল, ‘তাহলে সম্পর্কটার ইতি টানা উচিত।’
এভাবে ভুল বোঝাবুঝিতে শেষ হয়ে যাবে ওদের স্টেডি রিলেশনশিপটা ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি সৃজন। একজন অসুস্থ মহিলার দিকে বাড়ানো হাতটা সরিয়ে নিতে পারেনি সৃজন। মাঝে-মাঝেই টুক করে একটা মেসেজ ঢুকেছে, ‘আজ একবার টিউশন থেকে ফেরার পথে আমার বাড়ি হয়ে যাবে। নতুন আইটেম বানিয়েছি, খাওয়াব।’
সৃজন ঢুকতেই মুখ কাঁচুমাচু করে দীপশিখা বলেছিল, ‘তোমার দাদা খেয়ে বলল ভালো হয়নি। ইউটিউব দেখে কত কষ্ট করে মোগলাইটা বানালাম।’
সৃজন হেসে বলেছে, ‘আমার খিদের মুখে সব অমৃত। তুমি ঝটপট দাও দেখি।’ অনীকদা হাসতে হাসতে বলেছে, ‘হ্যাঁ, এই তো নির্বিবাদী প্রশংসাকারী পাবলিক এসে গেছে। ওকে করে খাওয়াও তুমি।’
নিজের কাজে বেরিয়ে গেছে অনীকদা। বউদি গরম গরম মোগলাই ভেজে দিয়েছে। সৃজন খেয়ে দেখেছে বেশ সুন্দর খেতে হয়েছে। অদ্ভুত লেগেছে অনীকদার ব্যবহার। একটু ভালো বললেই তো বউদির মুখে হাসি ফুটত। সেটুকুতেও আপত্তি! তবে কোনোদিনও এত ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি সৃজনের। বরং ও খেতে খেতেই বলেছে, ‘হয়ে গেল বউদি, তুমি আমাদের স্কুল মোড়ের মদনদার মোগলাইয়ের দোকানটা উঠিয়ে ছাড়বে মনে হচ্ছে।’
বউদির মুখে হাসি ফুটেছে। ঠিক যেন থমথমে মেঘের পরে এক টুকরো সূর্যের উঁকিঝুঁকি। দীপশিখা অভিমানী গলায় বলেছে, ‘ধুর, তুমি মিথ্যে মিথ্যে প্রশংসা করছ। তোমার দাদা বলল, খাওয়া যায় না।’
সৃজন নিজের পাত থেকে এক টুকরো দীপশিখার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছে, ‘তুমি নিজেই খেয়ে দেখ।’
দীপশিখা বিস্ময়ে বলে উঠেছে, ‘খারাপ তো হয়নি। তোমার দাদার কিছুই পছন্দ হয় না।’
দীপশিখার গলার মনখারাপি বাতাসটাকে এক ঝটকায় সরানোর জন্যই সৃজন কলেজ লাইফে মোগলাই খাওয়ার গল্প ফেঁদেছে। সেই গল্পের স্রোতে মিশে গেছে দীপশিখাও। এমন কত সন্ধে কাটিয়েছে ওরা। একটা জিনিস ধীরে ধীরে বুঝেছে সৃজন, অনীকদার যেহেতু দীপশিখাকে পছন্দ নয়, তাই ওর করা কোনো জিনিসই পছন্দ করে না। ওই কারণেই সবসময় বিরক্তি ঝুলিয়ে রাখে ঠোঁটের কোণে। আর ওই বিরক্তিটুকুকে হাসিতে বদলাতে কী আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে চলে দীপশিখা।
একদিন মেসেজ এল, ‘চটপট আসবে বাড়িতে, গোপন পরামর্শ আছে।’
সৃজন টিউশন সেরে যেতেই দেখল দীপশিখা খুব উত্তেজিত। ওকে বসিয়ে চা আর জলখাবার দিয়ে বলল, ‘যা প্ল্যান সব তোমার দাদা ফেরার আগে কমপ্লিট করতে হবে।’
সৃজন দীপশিখার এসব ছেলেমানুষির সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত। কোনোদিন ফিসফ্রাই বানাবে ভেটকি চাই, কোনোদিন রজনীগন্ধার স্টিক চাই রবীন্দ্রজয়ন্তীতে নিজের ঘরেই রবি ঠাকুরকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেবে। এসব বায়না শুধু সৃজনের কাছেই করে। অবশ্য পাই-পয়সা হিসেব করে দিয়ে দেয় দীপশিখা। সৃজন নিতে না চাইলেও জোর করে দিয়ে দেবেই। তাই ‘উঠল বাই তো কটক যাই’ স্বভাবের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল সৃজন। দীপশিখার সব পাগলামির দোসর থেকেছে সৃজন। চায়ে চুমুক দিয়ে ও বলেছিল, ‘আজ্ঞা করুন মহারানি। আজ কি ডুমুরের ফুল আনার আদেশ হবে?’
দীপশিখা হো-হো করে হেসে বলেছিল, ‘বড্ড জ্বালাই আমি তোমায়, তাই না? আর তো কেউ নেই আমার বন্ধু এখানে, তাই তোমাকেই জ্বালাই।’
সৃজন হেসে বলেছিল, ‘এখন তাড়াতাড়ি বলো, করতে কী হবে?’
অনীকদার সারপ্রাইজ বার্থ-ডে পার্টি অ্যারেঞ্জ করেছিল দীপশিখা। অনীকের বাবা-মাকেও ডেকে এনেছিল। সারাদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে একা হাতে রান্না করেছিল অনীকের পছন্দের সমস্ত রকম খাবার। সৃজন কেক এনে দিয়েছিল দীপশিখার নির্দেশ মতো। কিন্তু সন্ধেতে এসে দেখেছিল মুখ ভার করে বসে আছে দীপশিখা। গালে চোখের শুকনো জলের দাগ বলে দিয়েছিল, মন ভালো নেই ওর।
সৃজন আসতেই অনেক খাবার সাজিয়ে দিয়েছিল। কেকের পিস দিয়েছিল। কিন্তু সেই উত্তেজনা, হাসি কিছুই ছিল না দীপশিখার মুখে।
সৃজন বলেছিল, ‘কী হল? হাসি নেই কেন মুখে?’
দীপশিখা করুণ হেসে বলেছিল, ‘হাসি, আনন্দ, সুখ এগুলো ভীষণ দামি সৃজন। সকলের ভাগ্যে থাকে না। এই সারপ্রাইজ বার্থ-ডে’তে অনীক ভীষণ বিরক্ত। ওর নাকি বন্ধুদের সঙ্গে অন্যত্র প্ল্যান করা ছিল। ওর বাবা-মাও বিশেষ খুশি নয়।’
সৃজন কিছু না বলে কোনোমতে খাওয়া-দাওয়া সেরে ফিরে এসেছিল। রাগ হয়েছিল অনীকদার ওপরে। কিন্তু অন্যের ফ্যামিলি ম্যাটারে কথা বলাটা সমীচীন নয় বলেই চুপ করে গিয়েছিল। এভাবে দীপশিখার কত আনন্দ, উত্তেজনাপূর্বক মুহূর্তকে এই তিনবছরে দুঃখে পরিণত হতে দেখেছে সৃজন, তার ইয়ত্তা নেই। তবুও অনীককে পাওয়ার কী ভীষণ ব্যাকুলতা ওর মধ্যে। অনীকদার মুখে একটু হাসি দেখবে বলে সব করতে রাজি ছিল মেয়েটা। কিন্তু অনীকদা ভালোবাসা তো দূরে থাকুক একটু ভালো ব্যবহার অবধি করেনি। দীপশিখার এত ডিপ্রেশনের কারণ একমাত্র অনীকদা। এটা সৃজন জানে।
বাড়িতে ঢুকতেই মা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সৃজনের ওপরে। বিরক্তির গলায় বলল, ‘একটু শান্তি কি তুই আমাদের দিবি না ঠিক করেছিস? এত লেখাপড়া শিখে চাকরি পেলি না। মেনে নিলাম। অভিষিক্তাকে ভালোবাসিস বললি, মেনে নিলাম। এখন শুনছি ওই অনীকের ঘরকুনো অহংকারী বউটার সঙ্গে নাকি তুই…ছি-ছি ভাবতেই তো কেমন লজ্জা করছে। হ্যাঁ রে, অভিষিক্তার মতো অমন একটা সুন্দরী, শিক্ষিত মেয়েকে ছেড়ে ওই বউটার মধ্যে তুই কী দেখলি যে, সম্পর্কটা নষ্ট করে ফেললি?’
সৃজন ভাবছিল, নিজের মা, গর্ভধারিণী মা, যে ওকে তিলতিল করে বড় করেছে তার যদি এমন ধারণা হয় ছেলের সম্পর্কে, তাহলে ক্লাবের বন্ধুদের বা অভিষিক্তাকে কী দোষ দেবে ও? একই কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত লাগছিল সৃজনের। যাদের কাছে সম্পর্কের ডেফিনেশন শুধুই ফিজিক্যাল রিলেশনে গিয়ে শেষ হয়, তাদের কাছে ওর আর দীপশিখাবৌদির সম্পর্কের রসায়ন বোঝানোর কোনো দায় নেই।
সৃজন নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল। কাঁধের ব্যাগটা চেয়ারে রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ওর আর অভিষিক্তার পুরোনো চ্যাটগুলো পড়ছিল। কে জানে কখন নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে ওর। ছেলেরা নাকি কাঁদে না, এমন ধারণার মান রাখার জন্যই তাড়াতাড়ি চোখের জলটা মুছে নিল। হোয়াটসঅ্যাপে ব্লক করেনি অভিষিক্তা ওকে। মিনিট দুয়েক আগেই অনলাইন ছিল। এখন সম্ভবত হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে। এটা ওর রেওয়াজের টাইম। ঘণ্টাখানেক রেওয়াজ করে তারপর পড়তে বসবে। গানের স্কুলটাকে রাখার জন্য অভিষিক্তা নিজেকেও তৈরি করে প্রতিমুহূর্তে। এই মুহূর্তে ওর গানের ‘কলাক্ষেত্র’ স্কুলটা বেশ নাম করেছে। ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা মন্দ নয়। একদিকে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অভিষিক্তা, অন্য দিকে গানের স্কুলটাকে বাড়াচ্ছে। প্রায়ই ওরা দুজন আলোচনা করত, বিয়েটা করেই ফেলবে কিছুদিন পরে। দুজনের রোজগারে চলে যাবে বেশ।
একটা মেসেজ চোখ পড়ল সৃজনের।
অভিষিক্তা লিখেছে, ‘একটা সময়ের পরে ভালোবাসাটা থিতু হয়ে যায়। তখন আর কোনো চঞ্চলতা কাজ করে না তার মধ্যে। রুটিন মাফিক রোজ দেখা করার তাগিদও থাকে না। সপ্তাহে একদিন দেখা হলেই চলে। আর ব্যস্ততার মাঝে ছোট্ট দুটো মেসেজ বা একটা ফোন কল। শুধু একটা গাঢ় অনুভূতি কাজ করে, তুমি আছ। আমারই আছ। এই অনুভূতিটুকুই বোধহয় ধীরে ধীরে বিশ্বাস, ভরসা এসব শব্দের জন্ম দেয় সম্পর্কের মধ্যে। সেই উথালপাথাল মনটা অনেক শান্ত হয়ে যায়। সব কিছু অকপটে বলার একজন আছে জেনেই হয়তো দস্যিপনা কমিয়ে দিয়ে শান্ত লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে যায় সে। আচ্ছা সৃজন, তোমার কোন অবস্থাটা বেশি ভালো লাগে? এই শান্ত ভরাট দিঘিকে? নাকি বর্ষার দামাল তিস্তাকে?’
সৃজন লিখেছে, ‘দুটোই। কখনও খুব ইচ্ছে করে তুমি আমার জন্য অস্থির হও। অনেক রাগ করো, গভীর অভিমান করো, ঝগড়া করে কথা বন্ধ হোক। আবার বিরহের পরে ঝাঁপিয়ে পড়ে মিলন হোক। আবার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, শান্ত ভরাট দিঘির পাশে বসে উপলব্ধি করি, ভালোবাসা তো আছেই। থাকবে এই নিশ্চিন্ত ভাবটাকেই অনুভব করি বরং।’
বুকের ভিতরটা তোলপাড় করছে সৃজনের। কখনো ভাবেনি কোনো পরিস্থিতিতেই অভিষিক্তা ওকে ভুল বুঝবে। ও তো বোঝাতে চেয়েছিল। আনতে চেয়েছিল দীপাবউদির বাড়িতে ওকে। সামনে বসে ওদের সম্পর্কটাকে দেখলেই বুঝতে পারত অভিষিক্তা, ওদের সম্পর্কের রসায়নটা। কিন্তু অবুঝের মতো ও কোনো কথাই শুনতে চাইল না।
দিন দুই হয়ে গেল দীপাবউদির কোনো মেসেজ আসেনি সৃজনের কাছে। কে জানে বউদির শরীরটা ভালো আছে তো? সেদিন ওষুধগুলো দিয়ে আসার পরে একবার নিজে থেকেই খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ছেলেমেয়েদের এক্সাম চলছিল বলে একটু ব্যস্ত ছিল সৃজন, তাই সময় করে উঠতে পারেনি। তাছাড়া অভিষিক্তার এই নীরব হয়ে যাওয়াটা প্রতি মুহূর্তে ক্ষতবিক্ষত করছে ওকে। আসলে যেটা কখনও ও বা অভিষিক্তা আলোচনা করেনি সেটা হল, ভালোবাসাটা একটা অভ্যেস। দীর্ঘদিনের অভ্যেস থেকে বেরোনো ভীষণ কঠিন। সৃজন ভাবল, দীপশিখাবউদির বাড়ি ঘুরে আসবে আজকে। শরীরটা কেমন আছে জেনে আসবে।
অন্যদিন বাড়িটা সন্ধেতে বেশ ঝলমল করে। বাড়ির সব আলো জ্বালিয়ে রাখাটা দীপশিখাবউদির নেশা। বলে, ‘আলো ঝলমল করলে বাড়িটাকে রুগির বাড়ি মনে হয় না। মনে হয় এ বাড়িতে খুব সুখী, সুস্থ একটা মানুষ থাকে। তাই ঘর অন্ধকার রাখতে আমার একেবারে ভালো লাগে না সৃজন। তোমার দাদা বলে, ইলেকট্রিক বিল কে দেবে? আমি বলি তোমার শ্বশুর।’
বলতে বলতেই ডাইনিং-এর আরও দুটো আলো পট পট করে জ্বালিয়ে দিয়ে বলত, ‘দেখো, বেশ অনুষ্ঠান বাড়ি অনুষ্ঠান বাড়ি ফিল হচ্ছে না?’
কী যে পাগলামি করে বউদি কে জানে! বড্ড ছেলেমানুষি বুদ্ধি নিয়ে চলে মানুষটা। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বেল বাজাল সৃজন। বেশ খানিকক্ষণ পরে এসে দরজাটা খুলল বউদি। মুখ চোখ বেশ ফোলা। থমথম করছে। দেখেই মনে হল দীর্ঘক্ষণ ধরে কেঁদেছে। ওকে দেখে বলল, ‘এসো সৃজন। খুব ভালো হল তুমি এলে।’
সৃজন বলল, ‘শরীর কেমন আছে তোমার? তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো। আমাদের সিনেমা যাওয়া আর ফুচকা খাওয়ার প্ল্যানটা সাকসেসফুল করতে হবে তো তাড়াতাড়ি। আর আজ লাইট জ্বালোনি কেন?’
দীপশিখা বলল, ‘এতদিন বুঝতে পারিনি অন্ধকারের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। অন্যের দুঃখ-কষ্ট নিমেষে লুকিয়ে রাখতে পারে। যারা অগভীর মনের অধিকারী তারাই নিজের দৈন্যতা লোকের সামনে দেখাবে বলে, আলো জ্বালিয়ে রাখে। জানো সৃজন, এপাড়ার অনেকে বলে আমি নাকি অহংকারী, মিশুকে নই। আসলে আমি মিশতে চাই, কিন্তু এই রোগগ্রস্ত ফোলা শরীর নিয়ে কারোর সামনে যেতেই বড় লজ্জা করে। শুধু মনে হয় যেই আমি ওই আড্ডা থেকে উঠে আসব, তখন সবাই বলবে, ‘ইস্ অনীক যে কী করে এই মেয়েকে বিয়েটা করল?’ তাই গত তিনবছরে যতটা পেরেছি নিজেকে লুকিয়েই রেখেছিলাম। সত্যি বলতে কী, অভিমানে বাপের বাড়িও যাইনি তেমন। আমার একমাত্র জানালা ছিলে তুমি। যেখানে থুতনি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আমি একটুকরো আকাশ দেখতাম, আকাশে বকমবকম করে উড়ে বেড়ানো পায়রার ঝাঁক দেখতাম, মেঘ থমথমে আকাশের পরে অঝোরে বৃষ্টি নামা দেখতাম।’
সৃজন লক্ষ করল, আজ যেন দীপশিখা একটু বেশিই কথা বলছে। এত ব্যক্তিগত কথা খুব কমই বলেছে ওকে।
‘তুমি হচ্ছ আমার সেই জানলা সৃজন, যেটা বন্ধ হয়ে গেলে আমি ইনহেলার নিয়েও নিশ্বাস নিতে পারব না। অনীকের কোনো দোষ নেই। ও আমার এই মোটা শরীরটা ভেদ করে মনের সন্ধানই করতে পারেনি। মধ্যরাতে ওর শরীর জেগেছে। পাশে শুয়ে থাকা আমায় আদর করবে বলে জড়িয়ে ধরেছে, তারপরই কেন কে জানে ওর শরীর শীতল হয়ে গেছে। কোনো আকর্ষণ অনুভব করেনি ও। কতরকম ডায়েট ট্রাই করেছি আমি। কাজ কিছুই হয়নি। ডায়াবেটিক পেশেন্টরা রোগা হয়ে যায়। কিন্তু আমার থাইরয়েডের মাত্রা এতটাই বেশি যে, আমি ফুলেই থাকি। কিছুতেই রোগা হতে পারিনি।
চামড়ার রংটাও অনীকের পাশে বড্ড বেমানান। তাই হয়তো আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখতে গিয়ে ওর ঠোঁটে বিরক্তি, হতাশা জমেছে। একজন সুস্থ পুরুষ মানুষ হয়ে, শারীরিক চাহিদাটুকু মেটাতে পারেনি ও। আমার প্রতি ওর যে দুর্ব্যবহার তার কারণটা পরিষ্কার আমার কাছে সৃজন। তাই দোষ ওকে দেব না। কিন্তু আমি কোনোদিন চাইনি আমার যে খোলা জানালাটা দিয়ে আমি মুক্তির শ্বাস নিই, আকাশ দেখি, সেই জানালাটার জীবনে কোনো কষ্ট নেমে আসুক। আমার জন্য তোমার আর অভিষিক্তার ব্রেকআপ হয়েছে সৃজন। আমি সব জানি, লুকিয়ে রেখো না।’
সৃজন বলল, ‘উঁহু, তোমার জন্য নয়। অভিষিক্তা আমায় ভুল বুঝেছে।’
দীপশিখা বলল, ‘ধুর পাগল। মেয়েমানুষের চোখকে ফাঁকি দেওয়া এত সহজ নয়। তারা নিজেদের সবটুকু দিয়ে দিতে প্রস্তুত, শুধু ভালোবাসায় কেউ ভাগ বসাবে এটা সহ্য করতে পারে না। অভিষিক্তা ভুল কিছু ভাবেনি সৃজন। আমি সত্যিই তোমায় ভালোবাসি। তুমি আমার সব থেকে কাছের বন্ধু, প্রাণ ভরে টেনে নেওয়া শ্বাস। অনেকটা মুক্ত আকাশ, একরাশ শিউলি ফুলের সুবাস। মন খারাপের অব্যর্থ ওষুধ তুমি। জমে থাকা কথারা শব্দ খুঁজে পায় তোমার উপস্থিতিতে। এত কিছু বুঝতে পারবে না, এমন মেয়ে অভিষিক্তা নয়। তাই সকলের চোখে ফাঁকি দিতে পারলেও আমি ওর চোখে ধরা পড়ে গেছি। ও আমায় না দেখেই বুঝতে পেরেছে, তুমি আমার দক্ষিণের বারান্দা। শুধু অবসর কাটানোর জন্য নয়, বেঁচে থাকার প্রয়োজন। সৃজন তুমি আমায় যা দিয়েছ, আমি ভীষণ ঋণী। কিন্তু তুমি আর আমার কাছে এসো না। আমি কোনোভাবেই চাই না তোমার বদনাম হোক, তোমাদের মিষ্টি সম্পর্কটা ভেঙে যাক।’
সৃজন অপলক তাকিয়ে আছে দীপশিখার দিকে। ওর গাল বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জমে থাকা যন্ত্রণাগুলো। দীপশিখার যেন সব প্রয়োজন ফুরিয়েছে নিজের কষ্টগুলোকে আড়াল করার। তাই মোছার চেষ্টাও করছে না। নরম গলায় বলল, ‘তুমি আজ এসো সৃজন। আমার সব ছেলেমানুষির সঙ্গী হওয়ার জন্য একটা পুরস্কার দিতে চাই তোমায়। এই নাও, এটা আমার ডায়রি। সময় পেলেই এতে হাবিজাবি লিখে ভরিয়েছি। পড়ে তোমার অভ্যস্ত ঢঙে প্রশংসা করো।’
সৃজন আজ কথা বলতে পারল না। বুঝতে পারল, হয় ওর মা নয়তো কোনো বন্ধু দীপশিখাকে জানিয়েছে এসব কথা। ওর আর অভিষিক্তার ব্রেকআপের কথা। তাই দীপশিখাবউদি এভাবে ওর মুখের সামনে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল।
প্রায় সপ্তাহখানেক হয়ে গেল, সৃজন যায় না দীপশিখার বাড়িতে। ছাদে উঠে দেখেছিল সন্ধেবেলা, বাড়িটা অন্ধকার। বুঝেছিল নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় বউদি। অভিষিক্তা ফোন করেছিল। টুকটাক কথা হয়েছে। কিন্তু কেন কে জানে, মনটা ভালো নেই সৃজনের। অভিষিক্তার সঙ্গে কথা বলতে বা দেখা করতেও ইচ্ছে করছে না ওর। শুধুই মনে হচ্ছে, অভিষিক্তার অকারণ সন্দেহের বশে একজন ভালো বন্ধুকে ও হারিয়ে ফেলল। সৃজনও কি ভালোবাসত দীপশিখাকে? হয়তো বাসত। সে ভালোবাসার সংজ্ঞা আলাদা। গড়পড়তা দুইয়ে দুইয়ে চার করে মিলিয়ে দেওয়া ভালোবাসা নয়। একজন বন্ধুহীন মানুষের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করতে করতে কবে যেন দীপশিখাও বন্ধু হয়ে গিয়েছিল সৃজনের। তাই আজ এত শূন্যতা।
ভোরবেলায় হাঁকডাকে ঘুম ভেঙে গেল সৃজনের। মা এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। দরজা খুলতেই মা বলল, ‘অনীক ডাকছে তোকে। দীপশিখা বোধহয় খুব অসুস্থ।’
কোনোমতে প্যান্টের ওপরে গেঞ্জিটা চাপিয়ে ছুটেছিল সৃজন। বাড়িতে ঢোকার আগেই দেখল বাড়ির সামনে দু-একজনের ভিড়। সৃজন ঢুকতেই অনীক প্রায় আর্তনাদ করে বলল, ‘সৃজন তোর বউদি আমায় মুক্তি দিয়ে চলে গেল। ভোরের দিকে শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। এদিকে গোটা বাড়িতে ইনহেলার খুঁজে পেলাম না। হার্টফেল করল জানিস।’
চমকে উঠল সৃজন। সেদিনই তো ও ওষুধের দোকান থেকে দুটো ইনহেলার কিনেছিল। এত তাড়াতাড়ি তো শেষ হওয়ার কথা নয়।
ডাক্তার এসেও বলে গেলেন, ‘হার্টফেল করেছেন।’
ঠিক যেমন করে ওরা অনীকদার বিয়েতে গিয়েছিল, সেভাবেই দীপশিখাবউদিকে শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল ক্লাবের ছেলেরা। সৃজন শুধু যায়নি। যেতে পারেনি।
দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল, ইনহেলার দুটো নীচে বেলফুলের গাছতলার কাছে পড়ে আছে। তার মানে দীপশিখা নিজেই ফেলে দিয়েছিল। হাতে তুলে দেখেছিল, ভর্তি রয়েছে। তবে কি দীপশিখা বৌদির দক্ষিণের জানালাটা বন্ধ হয়ে যেতেই বাঁচার শেষ ইচ্ছেটুকু চলে গিয়েছিল? তাই এভাবে চলে গেল?
বাড়ি ফিরে এসেছিল। অনীকদা বিলাপ করছিল, ‘আরেকটু যদি যত্ন করতাম!’ সৃজনের বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘কোনোদিন মানুষটার মনের খবর নিয়েছ অনীকদা? মানুষটা কীসে খুশি হত, কীসে দুঃখ পেত, জানো তুমি? তিন বছরের জন্য অতিথি হয়ে যে মানুষটা তোমার বাড়িতে থেকে গেল, তার প্রিয় রং কী সেটুকুও তো জানো না তুমি!’
এই সমস্ত কথা বলা হল না কিছুই। কারণ দীপশিখা ভালোবাসত অনীকদাকে। বাড়ি ফিরে এসে দেখল, অভিষিক্তা বসে আছে। ওকে দেখেই কেঁদে ফেলল। বলল, ‘সরি সৃজন। আমি জানতাম না উনি এতটা অসুস্থ ছিলেন। আমায় তোমাদের পাড়ার দুজন ভুলভাল বুঝিয়েছিল, তাই আমি মাথা গরম করে ফেলেছিলাম। তুমি শ্মশানে গেলে না?’
সৃজন বলল, ‘নিজের খুব প্রিয় মানুষকে শেষ হতে দেখতে পারব না বলেই যাইনি অভিষিক্তা। আসলে আমাদের সম্পর্কটা যে ঠিক কী ছিল, সেটা বোধহয় আমরাও জানতাম না। কখনও মনে হত আমি ওর ভালো বন্ধু। কখনও মনে হত আমি ওর ভাই। কখনও মনে হত আমি ওর আবদারের জায়গা, বায়নার জায়গা। শাসনে মনে হত আমার বড় দিদি। ঠিক বুঝতে পারিনি। আসলে সব সম্পর্ককে একই সমীকরণে ফেলে হিসেব মিলিয়ে দিতে চাইলেই তো মেলে না। বউদি বলত, আমি ওর দক্ষিণের বারান্দা। ও নাকি আমার সঙ্গে বকবক করে গল্প বলার স্বাদ মেটায়। জানো অভিষিক্তা, বউদির ইচ্ছে ছিল তোমার আর আমার সঙ্গে একটা মুভি দেখতে যাওয়ার। ঠিক কলেজের মতো। হল না যাওয়া।’
অভিষিক্তা সৃজনের হাতটা ধরে বলল, ‘ক্ষমা করো আমায় প্লিস।’
সৃজন বলল, ‘না না দোষ তো তোমার নয়। আমিই হয়তো বোঝাতে পারিনি।’
সৃজন একলা ঘরে বসে দীপশিখার ডায়রিটা খুলল, কত টুকরো কবিতা লিখেছে দীপশিখা। কখনও কোনো বিশেষ দিনের ঘটনা। তাতে সৃজনও আছে।
সৃজন বলল, ‘কেন নিজে ইচ্ছে করে তুমি তোমার দক্ষিণের জানালাটা বন্ধ করে দিলে বউদি? লোকের কথায় এভাবে অভিমান করে চলে গেলে?’
দীপশিখা যেন দূর থেকে বলে উঠল, ‘তুমিই আমার একমুঠো আকাশ ছিলে সৃজন। ভালোবাসি তোমায়।’
ভালোবাসার সংজ্ঞাটা আজও বোঝা হল না সৃজনের। দূর থেকে তাকিয়ে দেখল বাড়িটা অন্ধকার হয়ে রয়েছে। আর কেউ আলো জ্বালাবে না। বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসবে না সেই চেনা গানের লাইনগুলো।
‘আঙুলের কোলে জ্বলে জোনাকি
জলে হারিয়েছি কান সোনা কি?
জানলায় গল্পেরা কথা মেঘ
যাও মেঘ চোখে রেখো এ আবেগ…’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন