পরাজয়

অর্পিতা সরকার

পরাজয়

‘রঞ্জন, ভালো বন্ধু আর প্রেমিকের মধ্যে যে বেসিক পার্থক্যটা আছে সেটা বোধহয় তুই জানিস না, তাই না রে?’

রঞ্জন একটু বিরক্ত হয়েই বলল, ‘কীসের বন্ধু রে রোহিনী? আমরা কোনোকালে ক্লাসমেট ছিলাম না। তোর থেকে আমি আর শুভম দুজনেই বছর চারেকের বড়। তাই আমি তোর ঠিক সহপাঠী তো নই।’

রোহিনী ওর কাঁধের শান্তিনিকেতনী ব্যাগটা স্বস্থানে সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আসলে কী জানিস রঞ্জন, অনেকেই এটা বুঝতে পারে না যে, প্রেম জোর করে হয় না। অনুভূতির কাছে আমরা নিজেরাও বড্ড অসহায়। বিশ্বাস কর, তোকে আমার ভালো বন্ধু মনে হয়। প্রেমিক হিসাবে কল্পনা করার ইচ্ছেও হয়নি কখনও। তুই নাটক আর বাস্তব জীবনটাকে একই সুতোয় গাঁথতে চেষ্টা করছিস। এটা হয় না রে। আমরা একসঙ্গে নাটক করেছিলাম মাত্র।’

রঞ্জন কাতর গলায় বলল, ‘নাটকের নন্দিনী তো রঞ্জনকেই ভালোবাসত, এটা অস্বীকার করতে পারিস?’

রোহিনী হেসে বলল, ‘পাগল। ওটা রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তাই। তুই অরিজিনাল রঞ্জন হতে পারিস, আমি নন্দিনী নই। এনিওয়ে ট্রামে ফিরবি না বাসে?’

রঞ্জন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ট্যাক্সিতে ফিরব। তুই নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে ট্যাক্সিতে চাপবি না?’

রোহিনী হেসে বলল, ‘একটু কাজ আছে, সেরে বাড়ি ফিরব। তাছাড়া তোর বাড়ি আমার বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে। অকারণ ট্যাক্সি ভাড়া গুনবি কেন?’

রঞ্জন মুচকি হেসে ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল, ‘তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস আমি একটা সরকারি চাকরি করি এবং বেশ ভালো স্যালারি পাই। বামপন্থী ড্রামা ডিরেক্টর নই।’

রোহিনী কথা না বাড়িয়ে ট্রামের সিঁড়িতে পা দিল।

রঞ্জন ট্যাক্সিতে বসে একটা বিজবিজে আক্রোশে ট্যাক্সির সিটটা নিজেই নখ দিয়ে ছেঁড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। রোহিনীর ছিপছিপে শরীর, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, আটপৌরে তাঁতের শাড়ি, আর কপালের মাঝে পরা কালচে মেরুন টিপটা চোখের সামনে ভাসছিল। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট কোনো চরিত্র। সৌন্দর্য আছে, কিন্তু তার আড়ম্বর নেই। ক্ষুরধার বুদ্ধি আছে, কিন্তু তার উগ্রতা নেই। ঠিক এমন একজনকেই যেন সেই কবে থেকে খুঁজে আসছিল রঞ্জন। শুধু বেশভূষায় আধুনিক নয়, মননেও ভীষণ রকমের আধুনিক রোহিনীকেই যেন এতকাল খুঁজছিল ওর মন। আর এখন সামনে পেয়েও, নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেও, কিছুতেই রোহিনীর প্রেমিক হতে পারল না। অদ্ভুতভাবে ওকে ‘বন্ধু স্থানীয়’ করে রেখে দিল রোহিনী। হয়তো রোহিনী ওর হতে পারত, যদি ওই ট্যালেন্টেড ডিরেক্টর শুভম মুখার্জী রোহিনীর মন জুড়ে বসবাস না করত।

শুভমের বড্ড গুণ। শুভম খালি গলায় দুর্দান্ত গান গায়, কবিতা বলে উদাত্ত কণ্ঠে, আচমকা কাগজ টেনে নিয়ে লিখে ফেলে দু’লাইন কবিতা বা মুক্ত গদ্য। অথবা আনমনে এঁকে ফেলে রোহিনীর চোখ দুটো। আর স্টেজে উঠে মাইক পেলে তো একাই উত্তেজিত করে তোলে দর্শকদের, ওর প্রতিবাদী বক্তব্য দিয়ে। এত এত গুণের অধিকারী শুভম নাকি জীবন সম্পর্কে বড্ড এলোমেলো। মেয়েদের আবার এই এলোমেলো টাইপ ছেলেগুলোকেই পছন্দ হয়। রঞ্জনকে ভোরবেলা ফোন করে ডেকে দেয় না ওর কোনো প্রেমিকা। এমনকী অ্যালার্মও দিতে হয় না ওকে। ওর মাথার মধ্যে অদ্ভুত একটা রুটিন সেট হয়ে আছে। ও জানে ওকে ভোর ভোর উঠতে হবে। নিজের বিছানাপত্র গুছিয়ে, এককাপ চা খেয়েই বাজারে যেতে হবে। বাজারে যেতে দেরি হলে ওর মেড চলে যাবে ফিরে। ফলে ওর সেদিনের রান্না হবে না। মেড রান্না করে দিয়ে গেলে নিজেই জল ভরে, টিফিন ভরে, আয়রন করা জামা-প্যান্ট পরে ঢুকতে হবে অফিসে। যেহেতু ব্যাঙ্ক-এ চাকরি করে ও, তাই ঘাড় তোলার সময় খুব কমই পায়। বাবা-মা দেশের বাড়িতে থাকেন। এখানে রেন্টের ফ্ল্যাটে ও একা থাকে। ফ্ল্যাট একটা বুক করেছে, কিন্তু সেটা হ্যান্ডওভার হতে হতে এখনও এক বছর। তার আগে যদি কোনো বাড়ি পায়, নিয়ে নেবে। বাড়িই ভালো লাগে ওর বেশি। মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে এসে রঞ্জন কিছু কম অ্যাচিভ করেনি। অন্তত লোকের কাছে সিগারেট খাওয়ার টাকা চাইতে হয় না শুভমের মতো।

মায়ের পেনশনের টাকায় শুভমদের সংসার চলে। গোটা দুই চাকরিতে ঢুকেছিল শুভম। কারণ ফিজিক্সে এমএসসি করা শুভমের যোগ্যতা নিয়ে কোনো কথা হবে না। কিন্তু দুটো চাকরিতেই নাকি ওর বাক্‌স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে বলে চাকরির মুখে লাথি মেরে সেই স্বাধীনচেতা পুরুষ বেরিয়ে এসেছেন। এসব গল্পগুলোই রোহিনী মুগ্ধতা নিয়ে শোনে। আর রঞ্জনকে বলে, ‘আসলে কী জানিস, শুভম অন্য ধাতুতে গড়া। ও ঠিক ভেতো বাঙালির মতো নয়। ওই দশটা-পাঁচটার অফিস কি ওকে মানায়? আসলে যারা ক্রিয়েটিভ জগতের মানুষ হয়, তারা আর পাঁচজনের থেকে একটু হলেও আলাদা হয়। সেই কারণেই সবাই তাদের বুঝতে পারে না।’

রোহিনীর মুখে শুভমের সম্পর্কে এমন প্রশ্রয় শুনতে শুনতে কবে যে শুভমকে হিংসা করতে শুরু করেছিল রঞ্জন নিজেও বুঝতে পারেনি। অথচ শুভমের সঙ্গে ওর বন্ধুত্বটা বেশ গভীরই ছিল। শুভমের ট্যালেন্ট নিয়ে রঞ্জনেরও যথেষ্ট গর্ব ছিল এতদিন। শুভমের সঙ্গে ওর পরিচয়টা আজও মনে আছে রঞ্জনের। তখন ও এই ব্যাঙ্ক-এর ব্রাঞ্চে নতুন ঢুকেছে। একটি ছেলে তার মাকে নিয়ে এসেছে পেনশন তুলতে। সোমবারের সকালে লাইন মন্দ নয়। কাউন্টারের ভিতর থেকেই রঞ্জন লক্ষ করেছিল লাইনে দাঁড়িয়ে ছেলেটি বারবার ওকে দেখছে আর হাতের কাগজে কিছু একটা লিখছে। অস্বস্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল রঞ্জন। কিন্তু একজনের পর একজন কাস্টমার আসার কারণে রঞ্জন কাউন্টার থেকে উঠতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ছেলেটা তার মাকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল রঞ্জনের কাউন্টারে। আচমকা প্রশ্ন করেছিল, ‘এমন ফটোজনিক ফেস নিয়ে ব্যাঙ্কে কেন ভাই? এনিওয়ে, এই যে এটা রেখে গেলাম। পিছনে আমার ফোন নম্বর লেখা থাকল, যদি মনে হয় জীবনে মাঝে মাঝে পাগলামি করা একান্ত প্রয়োজন, তাহলে যোগাযোগ করবেন।’

মায়ের কাজ মিটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ছেলেটা। ওর কথা বলার ধরণে কিছু একটা ছিল যেটা ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল রঞ্জনকে। কাগজটা খুলে দেখেছিল, ওর নিখুঁত একটা পেন্টিং, তাও পেন দিয়ে। নীচে লেখা, ‘নাটকে নায়কের চরিত্রে আপনাকে ভেবেছি। যদি রাজি থাকেন প্লিস কল মি।’

রঞ্জন ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে ফোন করেছিল ছেলেটাকে। বলেছিল, ‘থ্যাঙ্কস আমার এমন একটা সুন্দর ছবি এঁকে দেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি আবৃত্তি বলতে ওই স্কুলে বারদুয়েক স্টেজে উঠেছিলাম। নাটক করার তো অভ্যেস নেই।’

ছেলেটা বলল, ‘আমি শুভম, শুভম মুখার্জী। আমি চ্যালেঞ্জ লড়তে পারি আপনাকে দিয়ে আমি নাটক করাবই।’

রঞ্জনের বেশ মজা লাগছিল এমন আধপাগলা, জগৎ বহির্ভূত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে। সাধারণ একঘেয়ে অফিস আর পরিচিত মানুষের গণ্ডিতে সেই কিছু চেনা মুখের কেজো প্রশ্নের ভিড়ে দমবন্ধ হয়ে আসছিল রঞ্জনের। এমন বেহিসেবি অথচ আত্মবিশ্বাসী কথা ও শুনেছিল সেই স্কুল লাইফে ওর লাইফ-সায়েন্স স্যারের মুখে। জীবনবিজ্ঞান সাবজেক্টটাকে যখন ও রীতিমতো ভয় পেতে শুরু করেছিল, যখন নিজের অজান্তেই ওই বইটাকে লুকিয়ে রাখছিল সব বইয়ের নীচে, ঠিক তখনই দেখা হয়েছিল বিনোদ স্যারের সঙ্গে। বিনোদ স্যার রঞ্জনকে বলেছিলেন, ‘আমি যদি তোকে জীবনবিজ্ঞানের প্রেমে ফেলতে না পারি, তাহলে শিক্ষকতাই ছেড়ে দেব।’ স্যারের এই আত্মবিশ্বাসই রঞ্জনের লাইফ-সায়েন্সের ভীতি কাটিয়ে দিয়েছিল।

শুভম বলল, ‘এ পৃথিবীতে আমাদের সকলের সময় বড্ড অল্প রঞ্জন। ক’টা দিনই বা আমরা জঙ্গলে হাঁটতে পারব? ক’টা দিনই বা চাঁদকে মনখারাপের সঙ্গী ভাবতে পারব? কতদিনই বা রবীন্দ্রনাথকে নিজের সব সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারব? সময় নেই বুঝলেন রঞ্জন, সময় নেই। তাই যা করতে হবে এইবেলা করে ফেলতে হবে। নিজেকে নিজের কাছে প্রমাণ করে নিতে হবে তাড়াতাড়ি। না হলে চন্দনকাঠের চিতায় শুয়ে শুয়ে আফসোস করতে হবে। আপনি যদি আমার নাটকের দলে যোগ দেন, তাহলে আমি আপনাকে টাকা হয়তো দিতে পারব না, কিন্তু একঝাঁক জোনাকির জগৎ দেব। উঁহু, হ্যালোজেনের তীব্রতা নেই সেখানে, বরং নরম আলোয় স্নান করে নিতে পারবেন এই স্বল্প সময়ের জীবনে।’

রঞ্জন বলেছিল, ‘শনি আর রবি দু’দিন যেতে পারব আমি রিহার্সালে, এতে চলবে?’

শুভম হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘দৌড়াবে।’

শুভমের দোতলা বাড়ির একতলায় ওর নাটকের মহড়া চলে। ওর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ভালো চাকরি করতেন। তাই দক্ষিণ কলকাতার মতো জায়গায় দোতলা বাড়ি তুলেছিলেন। শুভম যখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে, তখন ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে বাবাকে হারায় শুভম। ওর মা পেনশন পেলেও সেই আতিশয্য থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় ওদের পরিবার। ওর মায়ের পেনশনের টাকায় টলোমলো করে চলে যাচ্ছিল দুজনের সংসারটা। কিন্তু কক্ষচ্যুত পৃথিবীর মতোই শুভম চলছিল ওর বানানো নিজস্ব গতিপথ ধরে। তাই সমাজের সবকিছুর সঙ্গেই ওর অনবরত সংঘর্ষ বেধে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে পরিবর্তন না করে ও নিজের চারপাশে থাকা মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টায় উঠে-পড়ে লেগে গেল। পড়াশোনায় ভালো, ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করা মানেই দশটা-পাঁচটার চাকরি জয়েন করার ধারণাটাই নাকি ভুল। মানুষ দু’দিন না খেয়েও কাটাতে পারে অভাবে পড়লে, কিন্তু শিল্পীদের মৃত্যু তখনই হয় যখন তাঁরা ধরাবাঁধা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। এসব তথ্যের এক বিশাল ভাণ্ডার নিয়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতেই ‘ঘরে বাইরে’ নাটকের দলটা তৈরি করে ফেলেছিল ও। এই দলটাতে মূলত অ্যামেচার আর্টিস্টরা কাজ করে, যাদের রোজগারের অন্য পথ আছে। যারা শুধুই একঘেয়েমি কাটাতে, আর নিজেকে শিল্পী হিসেবে দেখতে চায় তারাই আসত শুভমের ‘ঘরে বাইরে’ নাটকের দলে। তা নয় নয় করে প্রায় পঁচিশ জনের একটা দল গড়ে ফেলেছিল শুভম।

রঞ্জন যখন কসবা রথতলায় শুভমদের বাড়িটাতে পৌঁছাল, তখন শুভম হাতে একটা স্ক্রিপ্ট নিয়ে ঘনঘন মাথা নেড়ে চলেছে। বড় হলঘরে ঢুকেই রঞ্জনের দৃষ্টি আটকে গিয়েছিল যার ওপরে, সে রোহিনী। রঞ্জন সেই মুহূর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল রোহিনীর কপাল জুড়ে রাজত্ব করা নীলচে টিপটাতে। হিংসে হয়েছিল ওর চোখের ঘন কাজলটাকে।

শুভম রঞ্জনকে দেখেই উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠল, ‘এই যে, আরেকজনকে পেয়েছি যার রক্তে নাটক বিরাজ করে। তাই এক ডাকে ছুটে এসেছেন। এসো, এসো রঞ্জন, এসো। আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম। তুমিও ‘ঘরে বাইরে’-র মেম্বার হলে।’

রঞ্জন অপলক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল রোহিনীর দিকে। বারংবার মনে হচ্ছিল ঠিক এমনই কাউকে ও খুঁজে যাচ্ছিল এতদিন ধরে। হাজার বছর ধরে যেন এরই অপেক্ষায় ছিল রঞ্জন। শুভম সকলের সঙ্গে রঞ্জনের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল। রঞ্জন অপেক্ষায় ছিল ওই পেঁয়াজ খোসা আর নীলের রঙের ডোরার আটপৌরে শাড়ি পরা অসাধারণ ব্যক্তিত্বের মেয়েটার নাম জানার অপেক্ষায়। অবশেষে এল সেই মুহূর্ত।

শুভম বলল, ‘ইনি হলেন মিস রোহিনী আচার্য। ইংলিশে বিএড কমপ্লিট করেছেন। পিএইচডি করবেন নাকি চাকরির হাতছানিতে সাড়া দেবেন এই দ্বিধায় দিন কাটাচ্ছেন। তবে ‘ঘরে বাইরে’-র একজন মেম্বার। আগের নাটকে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, এবং বলাই বাহুল্য প্রশংসা অর্জন করেছেন নিজগুণে।’

রোহিনী অদ্ভুত মিষ্টি একটা ভঙ্গিমায় হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল, ‘রঞ্জনদা, শুভমের স্বভাব অন্যের প্রশংসা করা। তাই ওতে খুব বেশি পাত্তা দেবেন না।’

রঞ্জন হেসে বলেছিল, ‘এ তো ঘোর অন্যায়। আমি শুভমের বন্ধু হলে আপনার দাদা কী করে হই রোহিনী? আমাকেও শুধু রঞ্জন বলেই ডাকবেন।’

শুভম বলেছিল, ‘তাহলে আর দেরি কেন? আমাদের সামনে রঞ্জন রেডি, রবিঠাকুর ‘রক্তকরবী’ লিখে গেছেন। রোহিনীর নাম বদলে নন্দিনী করে দিতে আমার দু’মিনিট লাগবে। এই নববর্ষে ‘ঘরে বাইরে’-র নিবেদন হোক— রক্তকরবী।’

রঞ্জন স্তম্ভিত হয়ে বলেছিল, ‘আমার যে কোনো অভিজ্ঞতা নেই শুভম। একেবারে নায়ক? তারপরে আবার অমন বিদুষী নায়িকার বিপরীতে? এভাবে বিপাকে কি কেউ ফেলে?’

শুভম হেসে বলেছিল, ‘শুভম মুখার্জী গাধা পিটিয়ে টাট্টু গড়তে পারে। এক রঞ্জনকে পিটিয়ে আরেক রঞ্জন গড়ে নিতে বেশি পরিশ্রম করতে লাগবে না আমার।’

শুভমের এই আত্মবিশ্বাস অনেকটা সাহস জুগিয়েছিল রঞ্জনকে। তাছাড়া রোহিনীর বিপরীতে অভিনয় করার উত্তেজনায় রঞ্জন বিভোর হয়ে ছিল। আচমকাই ওর ওই এককামরার ভাড়াটে জীবন, ব্যাঙ্কে ক্যাশিয়ার পদের একঘেয়ে কাজ, অন্যের টাকার ভ্যাপসা গন্ধ—সবকিছুর বিরক্তি উবে গিয়েছিল রোহিনী নামের উপস্থিতিতে।

সারা সপ্তাহ রঞ্জন অপেক্ষা করে থাকত কবে শুভমের বাড়ির ওই স্যাঁতস্যাঁতে হলঘরে রক্তকরবীর রিহার্সালের ফাঁকে রোহিনীকে অপলক দেখবে, আর কখনও অভিনয়ের সূত্রে ওর হাত ছুঁয়ে যাওয়ার মুহূর্তটুকুর জন্য। এইটুকুর জন্য রঞ্জন আজীবন অপেক্ষা করতে পারবে, এই বিশ্বাস ওর আছে। রঞ্জন বেশ বুঝতে পারছিল, রোহিনী ওর একটা অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে। শুধু প্রিয়জন নয়, প্রয়োজন হয়ে উঠছে ওর জীবনে।

মন-প্রাণ ঢেলে অভিনয় করার চেষ্টা করছিল রঞ্জন। শুভম ঠিক যেভাবে দেখাচ্ছিল, সেভাবেই আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছিল। রোহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় হয়তো রঞ্জন কোনোদিনই করতে পারবে না। শুভমের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারবে না কোনোদিন, তবুও ওর সাধ্যমতো আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। সিনের শেষে যখন রোহিনী এসে হাসি মুখে বলত, ‘দেখ শুভম, রঞ্জনকে কিন্তু মনেই হচ্ছে না ও নতুন। রঞ্জন তুই দারুণ করছিস রে।’

ক’দিনের মধ্যেই রোহিনী ওকে ডিরেক্ট তুই বলে ডাকতে শুরু করেছে। রঞ্জনের ‘তুই’তে একটু আপত্তি ছিল। ‘তুমি’তেই রয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু রোহিনী বলল, ‘দেখ বস, তুই হয়তো একটু বড় আমার থেকে, হয়তো শুভমের বয়েসিই হবি, কিন্তু তুই বললে বেশ একটা বন্ধু বন্ধু ফিলিংস আসে। সব কথা শেয়ার করা যায় নির্দ্বিধায়।’

রঞ্জনও বাধ্য হয়েই রোহিনীকে তুই ডেকেছিল।

রঞ্জনের সব থেকে বিরক্তির বিষয় ছিল যখন রোহিনীর গলায় শুভমের প্রশংসা শুনত। রোহিনী আর শুভম যখন একসঙ্গে অভিনয় করছিল, রঞ্জন দেখেছিল, এরা মেড ফর ইচ আদার। তারপর থেকেই তীব্র রাগ হচ্ছিল শুভমের উপর। বারবার মনে হচ্ছিল, ও কেন শুভমের মতো নয়? কেন নয়? শুভম কেন এতটা ব্যতিক্রমী হল?

একদিন রিহার্সাল থেকে ফেরার পথে রোহিনীর মনে শুভম সম্পর্কে একটু বিরক্তি ঢোকানোর জন্যই রঞ্জন বলেছিল, ‘রোহিনী, তোর কখনও মনে হয় না শুভমের একটা চাকরি করা দরকার? মানে এই বয়সের একটা ছেলে বাড়িতে বসে বসে মায়ের পেনশনের টাকায় খাচ্ছে, মায়ের প্রতি কোনো দায়িত্ব নেই ওর! বড্ড দৃষ্টিকটু লাগে, তাই না রে? শুভম এত পড়াশোনা শিখে শেষে এই ফ্রি-র নাটকের ডিরেক্টর হয়ে জীবন কাটাবে? কোনো মেয়েই তো ওকে বিয়ে করবে না। প্রেমে হয়তো পড়তে পারে কেউ, কিন্তু নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিয়ে কেউ করবে না, বুঝলি?’

রোহিনী রাস্তার মাঝেই একটু থমকে দাঁড়িয়েছিল। তারপর কপালে উড়ে আসা অবাধ্য চুলের গোছাকে সরিয়ে আবারও টিপটাকে প্রকাশ্যে এনে বলেছিল, ‘শুভম তো চাকরি পেয়েছিল, জানিস না? কলেজের লেকচারার ছিল বছরখানেক। তারপর একদিন হাঁপিয়ে উঠল বুঝলি। ঠিক যেমন নীল আকাশের পাখিকে খাঁচায় ভরলে ছটফট করবে, ওরকম ছটফট করছিল শুভম। নাটক, কবিতা কিছুতেই মন দিতে পারছিল না ও। একদিন আমায় বলল, ‘রোহিনী চাকরিটা কি আমি ছেড়ে দেব?’

বিশ্বাস কর রঞ্জন, ওর মুখের ওই অসহায়তা, কষ্ট দেখে আমার মনে হয়েছিল শুভম ভালো নেই। এভাবে চলতে থাকলে ও ক্ষয় হয়ে যাবে। ওর প্রতিভার মৃত্যু হবে। তাই আমিও বলেছিলাম, ‘ছেড়ে দে।’

ও যেন আমার মুখ থেকে এই উত্তরটাই শুনতে চাইছিল। বাচ্চাদের মতো ভিড় রাস্তার মোড়ে জড়িয়ে ধরেছিল আমায়। তারপর বলেছিল, ‘রোহিনী, আজ আমি আবার স্বাধীন হলাম। নিজের ইচ্ছের মালিক হলাম।’

রাগে রঞ্জনের ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গিয়েছিল। শুভম রোহিনীকে জড়িয়ে ধরার অধিকার পেয়েছে। রোহিনী যতবার শুভম নামটা উচ্চারণ করছে ততবার যেন আলতো করে একটু নরম যত্ন ছড়িয়ে দিচ্ছে এই নামের মানুষটার ওপরে। অসহ্য রাগ হচ্ছিল রঞ্জনের। রোহিনীর চোখে শুভমের প্রতি শ্রদ্ধা মিশ্রিত প্রশ্রয় দেখতে দেখতে রঞ্জনের মনে শুভম সম্পর্কে যে ভালোলাগাটা ছিল, সেটা ক্রমশ আক্রোশে পরিণত হতে লাগল।

তার মানে কি ও আসার আগেই শুভম আর রোহিনীর মধ্যে দানা বেঁধেছে সম্পর্কের বীজ? কারণ রোহিনী ‘ঘরে বাইরে’-তে আছে জন্মলগ্ন থেকে।

রঞ্জন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘তোর সঙ্গে শুভমের আলাপ হয়েছিল কী করে?’

রোহিনীর গালে বোধহয় শেষ বসন্তের একমুঠো আবীর এসে পড়ল। আনমনে হাসল যেন। ঠোঁটের কোণে অনেক কথার ভিড়। চোখে পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়ার তাড়া। স্বপ্নিল গলায় বলল, ‘মেট্রোতে দেখা। আমি ডুবে ছিলাম ‘শেষের কবিতার’ নিবারণ চক্রবর্তীতে। শুভম আমার পাশের সিটে ছিল। আচমকাই বলে উঠেছিল, ‘যদি নিবারণ চক্রবর্তী কবিতা না লিখে ফুটবল খেলত, তাহলে কি সুন্দরী মহিলারা তাকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকত?’

আমি চমকে উঠে তাকাতেই বলেছিল, ‘কাকে বেশি ভালো লাগে অমিত না নিবারণ? îûÄy!þ›’þ ফায়ার রাউন্ড। কুইক।’ ওর বলার ধরণে কিছু একটা ছিল। তাই অপরিচিত কারোর কথায় আমি উত্তর দিতে শুরু করলাম। বললাম, ‘অমিতকে দশ দিলে নিবারণকে এগারো দেব দশে।’

পরের প্রশ্ন, ‘লাবণ্যর জন্য কে পারফেক্ট, অমিত না শোভনলাল?’

আমি বলেছিলাম, ‘শোভনলাল।’

‘শিলং পাহাড়ের বদলে কাশ্মীরের কমলালেবু আনতে গেলে কি অমিতকে বেশি মানাত?’

আমি একটুও দেরি না করে বলেছিলাম, ‘উঁহু, শিলং পাহাড় পারফেক্ট।’

এরপরেই শুভম বলেছিল, ‘কেন অমিতের থেকে নিবারণ বেশি নম্বর পেল?’

আমি বলেছিলাম, ‘বাহ্‌ রে। এত ভালো কবিতা লেখে যে।’

শুভম বলল, ‘আমি হলে অমিতকে দিতাম। কেন জানেন? নিজেকে গোপন রাখার ক্ষমতার জন্য। না, লাবণ্যর জীবনে শোভনলাল পারফেক্ট নয়। অমিত পারফেক্ট ছিল। তর্ক যুদ্ধ না হলে প্রেম কীসের? বুদ্ধির গোড়ায় জল দেবে কে? শোভন পাহাড়ের মতো গম্ভীর। লাবণ্যর গাম্ভীর্যকে তাই স্পর্শ করতেই পারেনি। আর তৃতীয়টা? অবশ্যই শিলং পাহাড়। নিস্তব্ধতাই যার সৌন্দর্য।’

নিজের ফোন নম্বর দিয়ে নেমে গিয়েছিল শুভম। যাওয়ার আগে বলেছিল, ‘তাহলে নিবারণ ফুটবল খেললে তাকে ভালোবাসতেন না তো? তার মানে যার যেটা কাজ তার সেটাই করা উচিত। আপনার কাজটা আপনি এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন ফোনে। আপনার আসল জায়গাটা আমি খুঁজে দেব আপনাকে। যদি মনে করেন অসম্ভব স্পর্ধা, তাহলে ভুলে যাবেন এই পনেরো মিনিট।’

তারপরেই আমি হাজির হয়েছিলাম শুভমের বাড়িতে। তখন ‘ঘরে বাইরে’-র মেম্বার মাত্র চারজন। আমায় শুভম আমার আসল কাজ খুঁজে দিল, বিনাপয়সায় নাটক করা। তাই এখনও করছি।’ হো-হো করে প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছিল রোহিনী।

রঞ্জনের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল একটা আট চাকার লরি। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল লরিটা রঞ্জনকে পিষে দিয়ে যাক। রোহিনীর এই প্রশ্রয় মিশ্রিত হাসি, শুভমের নামটাকে আলতো করে মনকুঠুরিতে ভরে তালা দিয়ে দেওয়া, এগুলো আর সহ্য হচ্ছিল না ওর। দিশাহারা লাগছিল।

রঞ্জন নিজের অস্থিরতা কোনোভাবে প্রশমিত করে বলল, ‘শুভম জানে তুই ওকে এত ভালোবাসিস? নাকি শুভমের সেটুকু খেয়ালও নেই? দেখ রোহিনী, নাটক আমরাও করছি। তাই বলে শুভমের মতো বাকি সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে নয়। একটা সামঞ্জস্য তো দরকার জীবনে। যাকে বলে প্রপার ব্যালেন্স।’

রোহিনী কলকাতার ফুটপাথে দাঁড়িয়ে হো-হো করে হেসেছিল রঞ্জনের কথায়। রঞ্জন একটু ভয় পেয়েই গিয়েছিল। এসব কথা যদি রোহিনী শুভমকে বলে দেয়! কাল থেকে যদি রঞ্জন রক্তকরবীর রঞ্জনের ভূমিকা থেকে বাদ পড়ে যায়, তখন কী হবে? রোহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের এই সামান্য সুতোটুকুও তো ছিঁড়ে যাবে। তাই তাড়াহুড়ো করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘না…মানে, তোদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বললাম আরকি। তোদের দুজনকেই যেহেতু পছন্দ করি তাই।’

রোহিনী এমনভাবে তাকাল, যেন রঞ্জনের ভিতরটা অবধি দেখতে পেল। রঞ্জনের মুখের কৃত্রিম হাসিতে কিছুতেই যেন রোহিনীকে নিজের করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটাকে চাপা দিতে পারল না ও।

রোহিনী স্বভাবিক গলায় বলল, ‘শুভম সামঞ্জস্য করতে পারে না বলেই, যেটা করে সেটা নিখুঁত করে। তারপরে আর কোনো প্রশ্ন চিহ্নের অবতারণা ঘটে না। আর আমরা এদিক-ওদিক ব্যালেন্স করতে গিয়ে সবকিছুতেই মধ্যমমানের নম্বর পাই, তাই না রঞ্জন?’

রঞ্জন বলল, ‘কিন্তু তুই তো এই নাটকটা দুর্ধর্ষ করছিস।’

রোহিনী কয়েক পা চুপচাপ হেঁটে বলেছিল, ‘সে তো শুভম শেখাচ্ছে বলে। তোতাপাখির আর কী ক্রেডিট বল দেখি!’

শুভমের প্রশংসা শুনতে শুনতে ক্লান্ত রঞ্জন বাসের পা-দানিতে পা দিয়ে হাত নেড়েছিল রোহিনীকে।

বাসটা এগোচ্ছিল। রঞ্জন দেখতে পাচ্ছিল রোহিনী দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমশ, আরও বেশি করে শুভমের হয়ে যাচ্ছে।

প্রতিটা রাতে ঘুমের মধ্যেও ছটফট করে রঞ্জন। বারংবার মনে হয় শুভমের মতো একটা চাকরিবাকরি নেই, বেকার ছেলের কাছে হেরে যাবে ও? সরকারি চাকরি করে রঞ্জন, তারপরেও হেরে যাবে! রোহিনী হচ্ছে সেই মেয়ে যার অবয়ব আঁকা ছিল ওর মনের গভীরে। তাকে এতটা কাছে পেয়েও নিজের করে পাবে না ভাবলেই অসহ্য কষ্টে ভেঙেচুরে যাচ্ছে রঞ্জন।

‘রক্তকরবী’ মঞ্চস্থ হওয়ার দিন এগিয়ে আসছে। শুভম দিনরাত এক করে খেটে চলেছে। ব্যানার বানানো, আমন্ত্রণ পত্র রেডি করা থেকে মধুসূদন মঞ্চ বুক করা। রঞ্জন জানে, ওর সঙ্গে এসব কাজে রোহিনীও যায়। রঞ্জনের অফিস আছে। ওর পক্ষে ব্যাঙ্কে চাকরি করে এসব দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়।

কাউন্টারে বসে অন্যমনস্ক হয়ে যায় রঞ্জন। বাইরের রোদের দিকে তাকিয়ে ভাবে, শুভম নিশ্চয়ই রোহিনীকে রোদে রোদে হাঁটাচ্ছে। পকেটে তো পয়সা নেই তাই ট্যাক্সি করবে না। আর রোহিনীর বাবার যত টাকাই থাকুক রোহিনী শুভমের সঙ্গে পা মেলাতেই পছন্দ করে। ওরা কি কাজের মাঝে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কুলফি খাচ্ছে আর হাসছে? নাকি আনমনে দুজনে হেঁটে চলেছে পাশাপাশি। দুজনের কাঁধ দুজনকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বেখেয়ালে? নাহ্‌, এভাবে চলতে পারে না। রঞ্জন পাগল হয়ে যাবে। এর থেকে রক্তকরবীর শেষ দিনে ও প্রপারলি প্রোপোজ করবে রোহিনীকে। শুভম ভালোবাসার, আগলে রাখার, যত্নের কী বোঝে? ও তো দিনরাত শিল্পের পিছনে ছুটছে। ও কেমন করে রোহিনীকে পেতে পারে! রোহিনীকে ভালো রাখার যোগ্যতা নেই শুভমের। থাকতে পারে না। শুধু নাটক-কবিতা দিয়ে পেট চলে না। শুভম কিছুতেই রোহিনীকে ডিজার্ভ করে না।

নাটকের দিন যত এগিয়ে আসছে সকলের মধ্যে উত্তেজনা তত বাড়ছে। অ্যামেচার গ্রুপের নাটক হলেও ভালো পারফরমেন্স দেওয়াটা খুব জরুরি। তাহলেই ওরা পরে কল শো পাবে। ‘ঘরে বাইরে’ নাম করবে। এসব ভাবনা শুভম সকলের মধ্যে সঞ্চারিত করতে সমর্থ হয়েছে।

নাটকের ঠিক আগের দিন শুভম হঠাৎই বলল, ‘রঞ্জন, চল একটু চা খেয়ে আসি তুই আর আমি। মাথাটা ফ্রেশ হওয়া দরকার।’

রঞ্জন আর শুভম চা হাতে আগামীকালের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা করছিল। শুভমের ভাবনায় এখন শুধুই রক্তকরবী।

রঞ্জন বলল, ‘ভালোবাসিস কাউকে?’

শুভম হেসে বলল, ‘বাসি তো। এই যে ‘‘ঘরে বাইরে’’ আমার প্রথম ভালোবাসা।’

রঞ্জন বলল, ‘সেটা জানি। আমি কোনো মেয়ের কথা বলছিলাম। আমায় বলতে পারিস বন্ধু হিসাবে।’

একটু এলোমেলো কথা বলে কথাটা ঘোরানোর চেষ্টা করছিল শুভম। রঞ্জন আবার বলল, ‘ভালোবাসিস রোহিনীকে?’

শুভম চায়ের ভাঁড়টা দূরে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘আওয়াজ শুনতে পেলি ভাঁড়টা পড়ার?’

রঞ্জন ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না পাইনি।’

শুভম অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘কিন্তু আমার হাতে যেহেতু ভাঁড়টা নেই, তাই ওটা যে ফেললাম সেটা নিশ্চিত, তাই না? সবকিছুর আওয়াজ পাওয়া যায় না, বুঝলি। চল, কালকে ভালো করে নাটকটা উতরে আমায় তোরা উদ্ধার কর মেরে বাপ। তোদের টেনশনে ঘুম উড়ে গেছে আমার।’

রঞ্জন বলল, ‘তাহলে রঞ্জনের চরিত্রটা আমায় কেন দিলি? রোহিনী যখন নন্দিনী, তখন শুভমের তো রঞ্জন হওয়া দরকার ছিল, তাই না?’

শুভম হো-হো করে হেসে বলেছিল, ‘সমুদ্রকে তুই বালির বাঁধ দিয়ে আটকাতে চেষ্টা করতেই পারিস, সেটা তোর ইচ্ছে। সমুদ্র সে বাঁধ ধুয়ে-মুছে দেবে, সেটাও নিশ্চিত। মানুষের মনকে যে আগলে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে তার মতো বোকা খুব কম আছে। রোহিনী খোলা আকাশে ঘুরুক। যদি ওর ক্লান্ত লাগে, যদি কখনও বিশ্রাম নেবে বলে কোনো গাছতলা খোঁজে আর সেটা যদি আমি হই তাহলে ও এমনই এসে জিরিয়ে নেবে আমার ছায়ায়। তার জন্য ওর কাছ থেকে আমি আকাশ কেড়ে নিতে পারি না রঞ্জন।’

রঞ্জন আরেকটু তৎপর হয়ে বলল, ‘এই নাটকের কারণে তো আমি রোহিনীকে স্পর্শ করছি। তোর রাগ হচ্ছে না?’

শুভম মুচকি হেসে বলল, ‘রঞ্জন স্পর্শ করছে রক্তকরবীর নন্দিনীকে। রোহিনীকে নয়। আর সব স্পর্শ ছোঁয়া হয় না রে পাগল। চল, অনেক কাজ বাকি এখনও। আমার প্রেম নিয়ে পরে একদিন আমরা দীর্ঘ আলোচনায় বসব।’

শুভম পা চালিয়ে চলে গিয়েছিল। রঞ্জন একলা দাঁড়িয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ।

শুভম আর রোহিনীর বন্ডিংটা এতটাই দৃঢ় মনের দিক থেকে যে, ওদের একে অপরকে ‘ভালোবাসি’ কথাটাও বোধহয় বলতে হয় না। সেটাও বোধহয় ওদের নিঃশ্বাসই জানিয়ে দেয় দুজন দুজনকে। দুজনেরই প্রবল শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস দুজনের প্রতি। এদের মাঝে পাঁচিল তৈরি করা কোনোদিন সম্ভব নয় রঞ্জনের পক্ষে। আবার রোহিনীকে ছেড়ে থাকাও অসম্ভব।

মধুসূদন মঞ্চের দর্শকাসন কানায় কানায় পূর্ণ। শুভমের মুখে দুশ্চিন্তা আর জয়ের একটা অদ্ভুত অভিব্যক্তি। কম টাকার টিকিট রেখেছিল শুভম, যেহেতু ওরা নতুন দল। কিন্তু সব টিকিট বুক হয়ে গেছে দেখে উত্তেজনা বাড়ছে সকলের মধ্যেই। গ্রিনরুমে ঢুকল শুভম। রঞ্জনের মেকআপ কমপ্লিট। রোহিনীর মেকআপ চলছে।

হঠাৎই শুভম খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল, ‘রোহিনী তুই এদিকে ঘুরে যা একবার। অরিজিনাল রক্তকরবীর মালা এনেছি নিউ মার্কেট থেকে। দাঁড়া তোর খোঁপায় লাগিয়ে দিই।’

রোহিনীর ঠোঁটে আবেশ। চোখে মুগ্ধতা। শুভম মালাটা খোঁপায় জড়িয়ে দিয়েই বলল, ‘স্টেজ রেডি। সবাই রেডি তো?’

রঞ্জনের মনে হচ্ছিল এক টানে করবীর মালাটা ছিঁড়ে ফেলে দিতে।

ওদের নাটক যে সফল হয়েছে তা দর্শকের উচ্ছ্বসিত করতালিই প্রমাণ করছে।

শুভম বেশ ক্লান্ত গলায় বলেছে, ‘এবার কিছুদিন রেস্ট নেব। কবিতা লিখব রোহিনীর জন্য। রোহিনী আবৃত্তি করবে সেগুলো। আপাতত ছুটি নিলাম বন্ধুরা।’

রঞ্জন আর রোহিনীর দেখা হয়নি বহুদিন। শনিবার আর রবিবার সন্ধেগুলো বড্ড ফাঁকা লাগে রঞ্জনের। ওদের মঞ্চের ছবিগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতেই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল রঞ্জনের। তাই বাধ্য হয়েই রোহিনীকে ফোন করে আজ প্রায় দু’মাস পরে ডেকেছিল। রোহিনী বলেছিল, ‘কেন রে? কোনো দরকার?’

রঞ্জন এলোমেলোভাবে উত্তর দিয়েছিল, ‘বন্ধুরা বুঝি প্রয়োজন ছাড়া মিট করতে পারে না? একটা জিনিস দেখাব তোকে।’

সেই কারণেই আজ রোহিনী এসেছে রঞ্জনের কাছে। রঞ্জন বলল, ‘একটা বাড়ি কিনেছি লোন নিয়ে। ছোট দোতলা বাড়ি। কিন্তু একটু রেনোভেট করা দরকার বুঝলি। ফ্ল্যাটও একটা বুক করা আছে। ওটা হাতে পেলে ভাড়া দিয়ে দেব। বাড়িই বেশি ভালো, বল? একটা নিজস্ব ছাদ থাকে।’

রোহিনী খুব খুশি হয়ে বলেছিল, ‘পার্টি কবে দিবি?’

আর থাকতে না পেরে রঞ্জন বলেছিল, ‘এই বাড়িটা কেন কিনলাম জানিস? এখানে আমাদের নতুন সংসার পাতব।’

রোহিনী হেসে বলেছিল, ‘ওহ্‌, প্রেমে পড়েছিস বুঝি?’

রঞ্জন ভনিতা না করে বলেছিল, ‘আমি তোকে ভালোবাসি রোহিনী। আমি তোর সঙ্গে ওই বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় একটা জোনাকি জ্বলা সন্ধে, একটা বৃষ্টিভেজা দুপুর কাটাতে চাই।’

এটা শোনার পরেই রোহিনী পরিষ্কার জানিয়েছিল, প্রেম নাকি জোর করে হয় না। এমনকী অনুভূতির ওপরেও জোর চলে না। মুখের ওপর সজোরে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল রোহিনী। নাটক আর বাস্তব জীবন নাকি এক নয়।

রঞ্জন ফিরছে ট্যাক্সিতে। অপমানের গভীর ক্ষতটা থেকে রক্ত পড়ছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। রোহিনী আচমকাই পিএইচডি করবে না সিদ্ধান্ত নিয়ে স্কুলের চাকরি জয়েন করার পিছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। শুভমকে আর্থিকভাবে সাপোর্ট করা হয়তো। অথবা একজন চাকরি করবে, আরেকজন বামপন্থী লেকচার ঝেড়ে নাটক করে বেড়াবে, এমনই প্ল্যান হয়তো। কোথায় কোন কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে নাকি মিটিং করছে শুভম। ভালো বক্তা হায়ার করে নিয়ে গেছে দল। সেটা আবার গর্বের সঙ্গে বলছিল রোহিনী।

নাহ্‌, আর ভেবে লাভ নেই। সিদ্ধান্ত আজকেই নিতে হবে রঞ্জনকে। শুভমকে ফোনটা করল ও।

‘কোথায় আছিস রে? নাটক শেষ হয়ে যাবার পরে এতগুলো মাস তো খোঁজও নিলি না?’

শুভম ওর পরিচিত ভঙ্গিমায় বলল, ‘তোরা আর কী বুঝবি শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট? মাসের শেষে অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকছে, নিশ্চিন্ত জীবন।’

রঞ্জন বলল, ‘চলে আয় কাল অথবা পরশু, সেলিব্রেট করব। আমি বাড়ি কিনেছি।’

শুভম বলল, ‘এখন জোরদার মিটিং চলবে পরপর সাতদিন। তারপরে আসছি।’

ঠিক দিনছয়েক পরে শুভমকে আরেকবার ফোন করল রঞ্জন।

‘কী রে, আজ আসবি?’

শুভম এককথায় রাজি।

শুভম হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকে বলল, ‘কী ব্যাপার বস? আজ ফুটের চায়ের দোকান বাদ দিয়ে একেবারে বারে? আমি কিন্তু এসব খাই না।’

রঞ্জন হেসে বলেছিল, ‘তুই এমন ভাব করছিস যেন আমি রেগুলার খাই! আরে জীবনে সব কিছু একবার অন্তত খেয়ে দেখা উচিত। এ তো তোর থিওরি শুভম।’

দুজনেই দু’পেগ করে খেল। শুভমের নেশা বেশ গাঢ় হয়েছে। সেটা ওর বুজে আসা চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রঞ্জন নিজে লাইট ভদকা খেলেও শুভমের জন্য কড়া হুইস্কি অর্ডার করেছিল। অনভ্যস্ত শুভমের উঠে দাঁড়াতেও অসুবিধা হচ্ছিল।

রঞ্জন বলল, ‘চল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।’

শুভম টলোমলো পায়ে এগোচ্ছিল রাস্তা দিয়ে। পিছনে রঞ্জন। আচমকাই একটা বীভৎস চিৎকারে স্তব্ধ হয়ে গেল ‘ঘরে বাইরে’ নাট্য সংস্থা। আট চাকার লরিটা পিষে দিয়ে গেল শুভমের শরীরটা। ভূতে পাওয়া মানুষের মতো ছুটে পালিয়ে গেল রঞ্জন।

ছোট্ট একটা ধাক্কা ও দিয়েছিল শুভমের পিঠে, তাতেই শুভম রাস্তায় গিয়ে পড়ল। আর তারপর জান্তব শব্দে লরিটা স্তব্ধ করে দিল ওর ব্যারিটোন ভয়েসকে।

নিরুপায় ছিল রঞ্জন। শুভম যতদিন এই পৃথিবীতে থাকবে ততদিন রোহিনী রঞ্জনের হবে না।

কোনোমতে টলতে টলতে নিজের ভাড়া ফ্ল্যাটের দরজা খুলল রঞ্জন। বাথরুমে গিয়ে অনেকটা বমি করল। জীবনের প্রথম খুনের উত্তেজনায় এখনও কাঁপছে ওর গোটা শরীর।

ভোরে রোহিনীর ফোনে ঘুম ভাঙল। কাঁপা গলায় রোহিনী বলল, ‘একবার আসতে পারবি? থানায় যেতে হবে।’

রঞ্জন ভাগ্যিস কাল শুভমের ফোনটা থেকে নিজের লাস্ট কলের হিস্ট্রিটা মুছে দিয়েছিল। তাই থানা থেকে ডিরেক্ট ফোনটা ওর ফোনে আসেনি। রঞ্জন ঘুম জড়ানো গলায় বলেছিল, ‘থানায় কেন রে?’

রোহিনী বুজে আসা গলায় বলল, ‘বডি শনাক্ত করার জন্য।’

রঞ্জন বলল, ‘কী সব বকছিস রোহিনী? কার কী হয়েছে একটু ক্লিয়ারলি বল প্লিস। এভাবে টেনশনে ফেলিস না।’

রোহিনী থমকে গিয়ে বলল, ‘শুভম কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি। এখন ফোন এল শুভমের নম্বর থেকে। রিসিভ করতেই বলল, থানা থেকে বলছে। শুভম নাকি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। তাই বডি শনাক্ত করার জন্য ডাকছে। একা একা যেতে ভয় করছে। তুই আসবি?’

রঞ্জন বলল, ‘এত বাজে বকছিস কেন রোহিনী? এমনও তো হতে পরে কোনো চোর শুভমের মোবাইলটা চুরি করে ছুটছিল তার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। ওটা শুভম হতে পারে না রোহিনী।’

রোহিনী বলল, ‘কাল রাতে কাকিমা আমায় ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিল, শুভম কোথায়? ও নাকি বাড়ি ফেরেনি।’

রঞ্জন তবুও আশ্বাসের গলায় বলল, ‘হয়তো কোনো কাজে আটকে গেছে। কী সব শ্রমিক আন্দোলনে ধরনা দেবে বলছিল তো ক’দিন আগে ফোনে। ওখানে আটকে যেতেও তো পারে রে, রোহিনী। আগেই এমন ভাবিস না প্লিস।’

ভয় করছে রঞ্জনের। আয়নায় সামনে দাঁড়াল। রোহিনীর সঙ্গে থানায় যাবে ও। কিন্তু ওর মুখে-চোখে কি কোথায় কোনো অপরাধী বাসা বেঁধে আছে ঘাপটি মেরে? যদি রোহিনী ওর দৃষ্টি দিয়ে এক্স-রে করে ধরে ফেলে রঞ্জনকে? তাহলে তো এত পরিশ্রম সব বৃথা যাবে। ঘৃণা করবে ওকে রোহিনী। জীবনে আর ওর মুখদর্শন করবে না। নিজেকে ভালো করে গুছিয়ে নিল রঞ্জন। অভিনয়টা ও মন্দ করে না, শুভমই সার্টিফিকেট দিয়েছিল। শুভম যখন অভিনয় শেখাত, তখন বারবার ওদের একটাই কথা বলত, ‘তুই যেমন, ঠিক তেমন ভাবেই ডায়ালগগুলো থ্রো করবি। এমন কিছু অস্বাভাবিক করবি না যাতে সকলের মনে হয় তুই অভিনয় করছিস। যেমন ধর তুই কথা বলার সময় “ল” অক্ষরে একটু জোর দিস, ওটাই অরিজিনাল তুই। ওটাই তোর টেকনিক। যখন অভিনয় করবি তখনও একইভাবে কথা বলবি। অভিনয়ের সময় ‘ল’ অক্ষরে জোর দিবি না কোনোভাবে, এটা ভাবতে শুরু করলেই তোর অভিনয়ে কৃত্রিমতা আসতে বাধ্য। তাই তুই যা, ঠিক সেভাবে স্বাভাবিকভাবে অভিনয় করবি। সকলে অরিজিনালিটির প্রেমে পড়বে।’

আজকেও রোহিনীর সামনে খুব বড় একটা একাঙ্ক নাটক অভিনীত হবে, যেটাতে নিখুঁত অভিনয় করতে হবে রঞ্জনকে। ভয়ে ভয়েই বেরোল রঞ্জন। শুনেছে মেয়েদের নাকি সিক্সথ সেন্স ভীষণ প্রখর হয়।

রোহিনী ওর জন্যই দাঁড়িয়ে আছে থানার সামনে। মুখের সেই সপ্রতিভ হাসি, গোছানো ভাবটাই যেন নেই। মুখে যেন অবসাদ ইচ্ছে করেই আঁকিবুঁকি কেটে দিচ্ছে। বিধ্বস্ত লাগছে রোহিনীকে।

রঞ্জন ট্যাক্সি থেকে নামতেই রোহনী ছুটে এসে রঞ্জনের হাত ধরল। কাঁপা গলায় বলল, ‘ভিতরে শুভম নেই তো রে?’

রঞ্জন ওর হাতটা আলতো করে ধরে বলল, ‘চল রোহিনী, আমরা ভিতরে যাই।’

থানায় ওটা শুভমের বডি শনাক্ত করে সইটা রঞ্জনই করল। কারণ রোহিনী পাথরের মতো স্থির। কোনো কথা বলছে না। পুলিশ জানাল, ‘বডি মর্গে যাবে। পোস্টমর্টেম হবে। তারপর সন্ধের দিকে বডি পাবেন। ফোন নম্বর রেখে যান, আমরা কল করে দেব।’

রঞ্জন নিজের ফোন নম্বর দিল থানায়।

শুভমের ক্ষতবিক্ষত শরীরটা দেখে কালকে ওর বলা কথাগুলো মনে পড়ছিল। রোহিনী শক্ত করে ধরে রয়েছে রঞ্জনের হাত। রঞ্জন বলল, ‘ঘরে বাইরে’-র সবাইকে খবরটা দিতে হবে তো। আর শুভমের মাকে…’

রোহিনী ডুকরে কেঁদে উঠল এতক্ষণে। ‘কাকিমাকে আমি কী বলব রে রঞ্জন? কত অল্পবয়সে স্বামীকে হারিয়েছেন। এখন আবার ছেলেকে। আমি পারব না কিছুতেই।’

রঞ্জন আর রোহিনী শুভমের বাড়িতে বসে আছে। শুভমের মা স্থির হয়ে বসে আছেন। আঘাত পেতে পেতে মহিলা বোধহয় কাঁদতেও ভুলে গেছেন। রোহিনী শুভমের দোতলার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। ‘ঘরে বাইরে’-র প্রায় সবাই এসেছে। সবার সাহায্যেই শুভমের দেহ সৎকার মিটে গেছে।

রঞ্জন প্রায় মাঝরাতে বাড়ি ফিরে এসেছে। গা’টা কেমন যেন ছমছম করছে ওর। অপরাধবোধ ওকে ঘুমাতে দিচ্ছে না কিছুতেই। একটা রাতচরা পাখি তীব্র স্বরে ডেকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন শুভম চিৎকার করে সবাইকে বলে দিতে চাইছে, ও-ই খুনি।

শুভমের মৃত্যুর পর প্রায় মাসখানেক পেরিয়ে গেছে। এই একমাসে রঞ্জন বহুবার ফোন করেছে রোহিনীকে। প্রতিবারই শুভমের কথা আলোচনা করেই ফোনটা রেখে দিয়েছে রোহিনী। রঞ্জন যেন একমাত্র ব্যক্তি যে রোহিনী আর শুভম দুজনের বন্ধু ছিল। তাই শুভম কেন্দ্রিক যত স্মৃতির পসরা, রোহিনী রঞ্জনের সামনেই খুলে বসে।

রঞ্জন রোহিনীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্যই ওকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া, নাটক দেখতে যাওয়া, বা ওর নতুন বাড়ির জন্য শপিং করতে যাওয়া এগুলো করছে। রোহিনীর বাবা-মায়ের রঞ্জনকে বেশ পছন্দ, সেটা ওঁদের ব্যবহারেই বোঝা যায়। রোহিনীর মা তো একদিন বলেই ফেললেন, ‘ভাগ্যিস তুমি ছিলে রঞ্জন নাহলে শুভমের মৃত্যুর পরে রোহিনী যেভাবে চুপ করে গিয়েছিল আমরা তো ভেবেছিলাম, বোধহয় আমাদের সেই আগের রোহিনীকে আর খুঁজেই পাব না।’

রোহিনীর বাড়িতে এখন অবাধ যাতায়াত রঞ্জনের। কিন্তু রোহিনীর মনের দরজায় সেই বড় সাইজের তালাটা ঝোলানোই আছে। যেটার চাবি নিয়ে শুভম স্বর্গে চলে গেছে। রোহিনীরও কোনো ইচ্ছে নেই ওই তালাটার আরেকটা ডুপ্লিকেট চাবি বানানোর। যেন মনে হচ্ছে, হারিয়ে গেছে তো যাক। বন্ধ থাকুক ওই দরজাটা।

রোহিনী আর রঞ্জন আজকে বসে আছে প্রিন্সেপ ঘাটে। সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ আগেই। তবুও আকাশ জুড়ে এখনও নিজের সাম্রাজ্য সামলানোর চেষ্টায় পশ্চিমাকাশ লালচে হয়ে আছে। সেদিকে বিভোর হয়ে তাকিয়ে রোহিনী বলল, ‘দেখ রঞ্জন, চলে যাওয়া মানেই মুছে যাওয়া নয়। ঠিক আমাদের শুভমের মতো। চলে গিয়েও আমাদের জুড়ে আছে, তাই না? তুই, আমি রোজ একবার হলেও ওর নামটা উচ্চারণ করি। শুভমের বাড়িতে গিয়েছিলাম কালকে। মানুষের কী অদ্ভুত জীবন কাকিমাকে দেখলে বোঝা যায়। নিখুঁত করে গোছাচ্ছিলেন শুভমের ঘরটা। যেন ও এখুনি ফিরবে কোথাও থেকে। আমাকে দেখে বললেন, আগে তো ঘরে হাত দিতে দিত না কাউকে। তার নাকি অনেক কাগজপত্র সম্পত্তি সব আছে সেসব হারিয়ে যাবে। জঞ্জাল করে রেখেছিল ঘরটা। আজ ভাবলাম, এখন তো বকার নেই কেউ তাই গুছিয়ে রাখি একটু। কাকিমাকে দেখে ভাবলাম, জীবন কী ভীষণ রকম চলমান তাই না রে! বেশ গড়িয়ে গড়িয়েও চলছে।’

রঞ্জন আলতো করে রোহিনীর হাতটা তুলে নিয়ে বলল, ‘শুভম তোকে কখনও কিছু বলেনি রোহিনী?’

রোহিনী আজ আর হাতটা সরিয়ে নিল না। বরং রেখেই দিল। বলল, ‘কী বিষয়ে?’

রঞ্জন বলল, ‘না, মানে…ও তোকে ভালোবাসে বলেনি কোনোদিন?’

রোহিনী হেসে বলল, ‘বলার কি খুব প্রয়োজন ছিল? ছিল না, জানিস। ও জানত ওকে আমি ওর থেকেও ভালো চিনি। ওর মনের প্রতিটা আনাচে কানাচে আমি ঘুরে বেড়াই। তাই ও আর নতুন করে কী বলবে বল? আমি তো জানতাম শুভমের মনে একটাই নামের অস্তিত্ব ছিল, সেটা রোহিনী।’

রঞ্জন বলল, ‘আমার মনের গলিতে কখনো ঘুরেছিস রোহিনী? একবার কষ্ট করে ঘুরে দেখিস তো, কার নাম পাস ওখানে!’

রোহিনী চুপ করে থেকেছে। তারপর বলেছে, ‘বাবা-মা আমার বিয়ের কথা ভাবছে তোর সঙ্গে। যদি আমি রাজি না হই তোকে বিয়ে করতে তাহলে অন্য কাউকে দেখবে পাত্র হিসাবে। আমি বাবা-মাকে বলেছিলাম, আমি চাকরি করছি। বিয়েটা কি না করলেই নয়?’

বাবা আমার স্বাধীনতায় কখনও হস্তক্ষেপ করেনি জানিস। তারপরেও বলল, ‘করলে খুব একটা খারাপ হবে না রুহু। আমরা চাই তুই রঞ্জনের সঙ্গে সংসার পাত। যদি তোর আপত্তি থাকে রঞ্জনকে বিয়ে করতে তাহলে জানাস, আমরা অন্য পাত্র দেখব।’

বাবা আসলে কখনও চায়নি আমার কাছে কিছু। আমিও ভেবে দেখলাম, তোর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে লাভ বিশাল কিছুই হবে না। বরং শুভম তোর বন্ধু ছিল, তাই তুই আর আমি মিলে শুভমের ‘ঘরে বাইরে’ দলটা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারি, কি বলিস?’

রঞ্জন ওর লক্ষ্যের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রোহিনী ওর হতে চলেছে। এর থেকে বড় পাওনা আর কিছুই নেই ওর জীবনে। এই দিনটার জন্য ও অনেক কিছু করেছে। তবুও কোথায় যেন চিনচিনে ব্যথাটা পীড়া দিচ্ছে। ওকে বিয়ে করার কারণটাও রোহিনীর কাছে সেই শুভম-ই। যেহেতু রঞ্জনের সঙ্গে বিয়ে হলে শুভমকে নিয়ে আলোচনা করতে পারবে, ‘ঘরে বাইরে’ দলটাকে আবার জাগিয়ে তোলা সম্ভব হবে, তাই রোহিনী রঞ্জনকে বিয়ে করতে নিমরাজি হয়েছে। সূক্ষ্ম অপমানবোধ ওর পৌরুষে এসে তীব্র আঘাত করল যেন। তবুও রোহিনীকে পেতে ও সব করতে পারে।

রোহিনী যতক্ষণ ওর পাশে থাকে, ততক্ষণই যেন বসন্ত থাকে ওর জীবনে। রোহিনী যখনই চলে যায়, অদ্ভুত এক ধূসরতা ধীরে ধীরে গ্রাস করে ওর ছাপোষা কেরানি জীবনটাকে।

রোহিনীর সঙ্গে ধুমধাম করে বিয়েটা হয়ে গেল রঞ্জনের। শুভমের মৃত্যুর পর প্রায় দশমাস অতিক্রান্ত। রঞ্জন জানে নতুন সংসার, নতুন বাড়ি, নিজের চাকরি, কবিতা, শ্রুতিনাটক নিয়ে ধীরে ধীরে ভুলে যাবে রোহিনী শুভমকে। আর তখনই হবে রঞ্জনের নিরবিচ্ছিন্ন জয়।

ফুলশয্যার বিছানাতেও রোহিনী রঞ্জনের বউ হিসাবেই ধরা দিয়েছে। কোনো ছন্দপতন ঘটেনি সেখানে। ওদের নতুন বাড়িটা রোহিনীর হাতের ছোঁয়ায় নতুন করে সেজে উঠেছে। ড্রয়িংয়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্তের বড় বাঁধানো ছবি। ফুলদানিতে রজনীগন্ধা। বইয়ের তাকে রবীন্দ্র রচনাবলী, ঠিক যেন পারফেক্ট সংস্কৃতিবান বাঙালি বাড়ি। সঙ্গে শিক্ষিতা, রুচিসম্পন্না, সুন্দরী বিদুষী স্ত্রী। রঞ্জনের জীবন কানায় কানায় পরিপূর্ণ।

এবার শুধু নিজের প্রমোশন নিয়ে একটু ভাবতে হবে। রোহিনী আর রঞ্জনের উপার্জনে ওদের সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য রয়েছে ঠিকই। তবুও রঞ্জনের নিজেকে প্রমাণ করার ইচ্ছেটা চেপে বসেছে। রোহিনীর চোখে আরেকটু শ্রদ্ধার আসনে বসার ইচ্ছে থেকেই এমন জেদ হয়েছে ওর।

অফিস থেকে ফিরে নতুন করে পড়াশোনায় মন দিয়েছে রঞ্জন। রোহিনীকেও বলেছে, ‘পারলে পিএইচডি-টা কমপ্লিট করতে পারতিস।’

রোহিনী হেসে বলেছে, ‘ইচ্ছেটা মরে গেল যে আচমকাই। যদি কখনও আবার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দেয় তাহলে দেখব। আপাতত লেকচারার হয়েই চলুক জীবন।’

রোহিনীর চলার মধ্যেও যেন অদ্ভুত একটা ছন্দ আছে। সেদিকে মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে রঞ্জন। বারংবার মনে হয়, একটা মেয়ে কী করে এত সুন্দর হয়! ভাবতেই অবাক লাগে রঞ্জনের। রোহিনীর শরীর-মন জুড়ে ওর একাধিপত্য। বিছানায় রোহিনীকে আদর করতে করতে কেঁপে ওঠে রঞ্জন। বিশ্বাস হয় না যেন রোহিনী শেষ পর্যন্ত ওর হয়েছে!

ওদের আজ ফার্স্ট অ্যানিভার্সারি। রঞ্জন রোহিনীর জন্য একটা ছোট্ট পেনডেন্ট কিনেছে। ওদের দুজনের একটা ছবি লকেটের মধ্যে মিনাকারী কাজে বাঁধানো হয়েছে। সন্ধেতে এটা পরিয়ে দেবে রোহিনীকে। সঙ্গে একটা ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের ব্যবস্থাও করেছে।

বাড়ি ঢুকতেই রোহিনী এসে হাসিমুখে জড়িয়ে ধরল রঞ্জনকে। বলল, ‘তোর জন্য একটা উপহার আছে।’

রঞ্জন দেরি না করে লকেটটা একটা সরু সোনার চেন সমেত পরিয়ে দিল রোহিনীর গলায়।

রোহিনী লকেটটা দেখেই বলল, ‘দারুণ ছবিটা। এটা আমাদের মালাবদলের ছবি, তাই না রে?’

রঞ্জন ওর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল, ‘ঠিক। থাকুক তোর গলায় এটা, আমি-তুই একসঙ্গে।’

রঞ্জনকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল রোহিনী ওদের বেডরুমে। দেওয়াল জুড়ে শুভমের একটা ছবি। শুভম হাসছে। হাসিটা ভীষণ মিনিংফুল। কিছু যেন বোঝাতে চাইছে হাসির মাধ্যমে।

রঞ্জন অবাক হয়ে বলল, ‘হঠাৎ শুভমের ছবি বেডরুমে কেন?’

রোহিনী বলল, ‘যেদিন আমি বিয়েতে রাজি হলাম, সেদিন ভেবেছিলাম, শুভমকে ছেড়ে আমি বোধহয় আর কাউকেই মানিয়ে নিতে পারব না, জানিস রঞ্জন। সেদিন আমি শুভমের কাছ থেকেই শক্তি চেয়ে নিয়েছিলাম। ও সেই শক্তি আমাকে দিয়েছিল বলেই তো আমরা আজ একসঙ্গে একবছর কাটিয়ে দিলাম সুন্দরভাবে। তাই ভাবলাম, শুভম থাকুক আমাদের বেডরুমে। আমি তোকে বিয়ে করতে রাজিই হয়েছিলাম শুভমকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব এই ভেবে। তাছাড়া তুইও শুভমের ভালো বন্ধু ছিলি। আমাদের পরিচয়ও ওর ‘ঘরে বাইরে’-তে গিয়েই। সব মিলিয়ে এটা আমাদের বিবাহবার্ষিকীর বেস্ট গিফ্ট আমাদের দুজনের জন্যই।

তুই বস, আমি চা আনছি।’ বলেই শুভমের ছবিটাতে নরম করে গাল ঠেকিয়ে চলে গেল রোহিনী।

রঞ্জন শুভমের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। শুভম যেন বলছে, ‘সব স্পর্শে আদর থাকে না। কিছু ছোঁয়ায় শুধুই কর্তব্য থাকে বুঝলি রঞ্জন? তুই এখনও প্রেম আর বন্ধুত্বের মানে বুঝলি না রে। রোহিনী আজও আমার, শুধুই আমার। তুই হেরে গেছিস রঞ্জন, ভীষণ রকমের হেরে গেছিস।’

রোহিনী চায়ের কাপ হাতে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘ঘরে বাইরে’ নাট্যগোষ্ঠীর সবাইকে ডেকেছি। আবার আমরা নাটকটা শুরু করব বুঝলি?’

রঞ্জন হেরে গেছে। মারাত্মক পরাজয় ঘটেছে ওর। রোহিনীর মনের ঘরের ওই কুঠুরিটার তালার চাবিটা কিছুতেই খুঁজে পেল না রঞ্জন। ছবিতে থাকা শুভম হাসছে। ওদের বেডরুমে বসে হাসছে।

***

অধ্যায় ১০ / ১০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন