অর্পিতা সরকার
‘রেশমা, তুমি দিনরাত এই এক কথা বলে যাচ্ছ কেন বলবে? এই পৃথিবীতে তো এমন অনেক নিঃসন্তান বাবা-মা আছে, তারা কি কেউ সুখী নয়? বিয়ের ছয় বছর পেরিয়ে গেছে, বাচ্চা হল না এটাই কি আমাদের জীবনের মুখ্য আলোচনা? ডিউটি থেকে ফিরে তোমায় রোজ মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখলে কি আমার ভালো লাগে বলো?’
পুলিশের ইউনিফর্মটা খুলতে খুলতে আনোয়ার আবারও বলল, ‘এত ভালো নজরুলগীতি গাইতে তুমি সেটাও বন্ধ করে দিলে, কেন এমন করছ রেশমা? তোমার চোখে বর্ষার মেঘ দেখলে আমার যে কতটা কষ্ট হয় সেটা তোমায় আমি বোঝাতে পারব না। যতই হোক পুরুষমানুষ তো তাও আবার পুলিশে আছি, তাই হয়তো তোমার ধারণা দুঃখ-কষ্ট কিছুই আমায় ছুঁতেই পারে না।’
রেশমা ব্যালকনি থেকে উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল। রাতের রান্না অনেকক্ষণ সেরে রেখেছে। আনোয়ার এই সময় বাড়ি ফিরে আগে এককাপ ঘন দুধের চা পছন্দ করে। রোজকার মতো আজকেও রেশমা রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসে জল চাপাল। আনোয়ার বলে, ‘বুঝলে রেশমা, আমরা হলাম খাঁটি বাঙালি। জন্মকর্ম সব এই পশ্চিমবঙ্গে। তাই একদিন ওই শখের রেস্টুরেন্টে বসে ব্ল্যাক কফি উইদাউট সুগার বলতে ভালো লাগলেও আসলে মনটা কড়া করে চা-চা করে। আর সারাদিন থানায় বসে চোর-জোচ্চোরদের সঙ্গে চেঁচামেচি করতে করতে আরেক জোচ্চরের চা খাই আমরা। আমাদের থানার সামনেই লক্ষ্মণের চায়ের দোকান। সে-ই এক ছোঁড়াকে দিয়ে ঘন্টায় ঘন্টায় চা পাঠায় আমাদের। ওই সকালে যে চা পাতা ইউজ করে ওটা দিয়েই রাত অবধি চা খাওয়ায় আমাদের। আমরাও চোর ধরতে ধরতে ওই ঘোড়ার হিসি খেয়ে নিই চাঁদ মুখ করে।’
রেশমা হেসে ফেলত আগে আনোয়ারের কথা শুনে। কলেজে থাকাকালীন আনোয়ার ছিল মুখচোরা একটা ছেলে। পুলিশে ঢোকার পর থেকে যত বাজে ভাষা ব্যবহার করে। রেশমা চোখ পাকালে বলত, ‘বেশ বেশ তোমার ছেলেমেয়ের সামনে বলব না বাবা। এখন থেকেই প্রমিস করছি।’
একটা দীর্ঘশ্বাস বুক থেকে আবারও বেরিয়ে আসতে চাইছে, জোর করে তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিল রেশমা। সত্যিই তো মানুষটা সারাদিন পরে এসে যদি ওর এমন মুখ দেখে তাহলে তো রাগ হওয়ারই কথা। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল রেশমা। চায়ের সঙ্গে একটা বিস্কিটের বেশি আনোয়ার কিছু নেয় না এসময়। একটু পরেই রাতের খাওয়া। আনোয়ার বলে, ‘খিদে মেরে লাভ আছে? আমার বউয়ের হাতের রান্না মিস করতে রাজি নই আমি।’
মানুষটা সবসময় রেশমাকে খুশি করতে চায়। এ স্বভাব অবশ্য আনোয়ারের এখন থেকে নয়, সেই কলেজ লাইফ থেকেই। সেই লাজুক ছেলেটা তখন থেকেই রেশমাকে খুশি রাখার ঠেকা নিয়েছিল। সেই রীতি এখনও চলছে। চায়ের ট্রে-টা সামনে রেখে রেশমা বলল, ‘আজ তোমার আম্মা ফোন করেছিলেন। কোন মাজারে গিয়েছিলেন, একটা তাবিজ এনেছেন। রশিদকে দিয়ে কাল পাঠিয়ে দেবেন বলেছেন। ওটা শুক্রবার পরতে বললেন।’
আনোয়ার চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘রেশমা, নিজের বাড়ি শিবপুর ছেড়ে এই গ্রামে আমি বদলি কেন নিলাম জানো? এসব থেকে তোমায় সরিয়ে রাখব বলে। এই কবচ, তাবিজ, জলপড়া, তেলপড়া এসব থেকে তোমাকে আগলে রাখতে চাই বলেই ট্রান্সফারের কথাতে একমিনিটও দেরি করিনি সিদ্ধান্ত নিতে।
ভেবেছিলাম হোক গ্রাম, হোক জাঁকজমকহীন জীবন, তুমি তো থাকবে আমার কাছে। আর বাড়ির ওই সকলের বলা একই কথার পুনরাবৃত্তি তো হবে না। কিন্তু দেখো এ বিষয়টা আমার কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। আচ্ছা রেশমা, তুমি যে এই বিক্রমপুরে এসেছ এখানের কিছু দেখেছ তুমি?’
রেশমা অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘এটা তো হিন্দু গ্রাম। মোড়ে মোড়ে একটা করে মন্দির আছে। শিবমন্দির, মনসাতলা এসব। আর ওদিকে একটা প্রাইমারি আর হাইস্কুল। লাইব্রেরিতে বই হাতে গোনা। আর কী দেখার আছে?’
আনোয়ার বলল, ‘সে কী! এখানে সন্ধে হলেই যে জোনাকি নামে দেখোনি?
জোনাকির কাছ থেকে এক টুকরো আলো তো চেয়ে রাখতে পারতে আমার জন্য।
ওই যে গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা নদী আছে, নদীর নাম নাকি ব্রজেশ্বর। বর্ষায় বড্ড দামাল হয়। ওই মাতাল নদীটাকে তুমি শান্ত হতেও বলতে পারতে।’
রেশমা অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘ভালোবাসলে বুঝি সবসময় একটা সত্যিকে আড়াল করে রাখতে হয়?’
আনোয়ার বলল, ‘কোনটা সত্যি রেশমা? আমাদের সন্তান ধারণের ক্ষমতা নেই বা আল্লা আমাদের সন্তান দিচ্ছেন না। এটাই তো?’
রেশমা বলল, ‘আমাদের নয়। আমার সন্তান ধারণের ক্ষমতা নেই। সেটা স্বীকার করতে তোমার এত দ্বিধা কেন?’
আনোয়ার বলল, ‘বেশ, মেনে নিলাম তোমার শারীরিক সমস্যা। তাহলে এখন আমায় কী করতে বলছ রেশমা?’
রেশমা জানালার ঘন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দ্বিতীয়বার বিয়ে করো। আমায় তালাক দাও।’
আনোয়ার হো-হো করে হেসে বলল, ‘তাই নাকি? আজকাল আমার রেশমার দেখি খুব সাহস হয়েছে। আগে তো একা একা সন্ধের টিউশন থেকে ফিরতে সে ভয় পেত, এখন একা-একাই সে এমন চলতে শিখে গেল যে আমায় ছেড়ে দিতে চাইছে? তা বেশ। উন্নতি হওয়াই তো ভালো।’
রেশমা আনোয়ারের পিঠে হাত রেখে বলল, ‘তুমি জানো আমি কেন বলছি।’
আনোয়ার ভাঙা গলায় বলল, ‘না রেশমা, আমি সত্যিই জানি না। আমার সেই কলেজের কথা মনে পড়ছে। তখন আমি থার্ড ইয়ারে পড়ি। বাবার কাছে আবদার করে একটা বাইক কিনেছিলাম। মনে আছে?’
রেশমা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘সে আর মনে না থাকার কী আছে? ওই বাইকে করেই তো আমায় বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যেতে। একদিন ছোট কাকার নজরে পড়েছিলাম। সে কী বকুনি বাড়িতে ঢুকেই।’
আনোয়ার বলল, ‘এই তো তোমার স্মৃতিও তার মানে তোমার সঙ্গে বেইমানি করেনি। সবই মনে আছে দেখছি। তবুও আরেকটা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিই।
ওই বাইক চালাতে গিয়েই আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। গাড়ির কাঁচ এসে সোজা ঢুকেছিল ডান চোখে। সে তো এমন অবস্থা যে একটা চোখ হারাতে হবে এটাই ভেবেছিলেন ডক্টররা। আমার মা মাজারে গিয়ে পড়েছিল। বাবার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছিল। কোনোমতে নিজেকে সামলে রেখেছিল। দাদা, দিদিরা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছিল। ছোটবোনটা পর্যন্ত আমার পায়ের কাছে এসে বসেছিল।
আমি ল্যান্ড ফোনে তোমায় ফোন করলাম। তোমার আব্বু ফোন রিসিভ করলেন। আমি যথারীতি কেটে দিলাম। কথা হল না। একমাত্র দীপঙ্করকে ফোন করে জানালাম, রেশমা কলেজে এলে বলিস আমার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।’
রেশমা মুখ নীচু করে বসে আছে। স্মৃতির পাতাগুলো এসে যে তাকেও ঝাপটা দিচ্ছে না এমনটা তো নয়। রেশমা জানে এরপর আনোয়ার কী বলবে।
কলেজে যেতেই দীপঙ্কর ছুটতে ছুটতে এসে বলল, ‘রেশমা, আনোয়ারের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সেজন্য কলেজ আসছে না।’
দিন তিনেক হল আনোয়ার আসছে না। ফোন করেছিল রেশমা ওদের ল্যান্ডফোনে। ওর দিদি ধরেছিল বলে কেটে দিয়েছে। কথাটা শুনেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল ওর।
দীপঙ্করকে বলেছিল, ‘আমি কিছু জানতে চাই না, এখুনি নিয়ে চলো ওদের বাড়ি।’
তখনও রেশমা আর আনোয়ারের সম্পর্কের কথা কেউ জানত না দুই বাড়ি থেকে।
মুসলমান রক্ষণশীল পরিবার ওদের। তাই প্রেম করে বিয়ে করাটা কিছুজনের চোখে রীতিমতো গুনাহ। তবুও সেদিন রেশমার মাথায় এসব চিন্তা আসেনি।
দীপঙ্করের সঙ্গে পৌঁছে গিয়েছিল আনোয়ারের বাড়িতে।
সবাই ওর দিকে অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। কলেজে একসঙ্গে পড়লেও বাড়িতে মেয়ে বন্ধু আসা তখনও সেভাবে চল হয়নি আনোয়ারের বাড়িতে।
দীপঙ্করই বলেছিল, ‘আমরা এক সঙ্গে পড়াশোনা করি। আনোয়ারের বাইক অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে আমরা ওকে দেখতে এসেছি।’
আনোয়ারের মা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। তিনি রেশমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে বলেছিলেন, ‘ওই যে, ওই ঘরে আছে আনোয়ার।’
রেশমা আর দীপঙ্কর ঘরে ঢুকেছিল। আনোয়ারের একটা চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা। অপারেশন করতে হবে বলেছে ডক্টর। দু’দিন পরে ডেট দিয়েছে। ডক্টর বলেছেন, মাত্র ৩০% চান্স আছে চোখ ঠিক হওয়ার। হাতে-পায়েও টুকটাক ছিঁড়ে কেটে গেছে। সেখানেও ব্যান্ডেজ বাঁধা।
রেশমা একটাও কথা বলেনি সেদিন। শুধু চোখ দিয়ে অনর্গল জল গড়িয়ে পড়ছিল। আনোয়ার করুণ হেসে বলেছিল, ‘কাঁদছ কেন? আল্লাকে ডাকো যেন চোখটা ফিরে পাই। তবে রেশমা, একটা কথা আছে তোমার সঙ্গে।’
দীপঙ্কর ঘরের অন্য দিকে সরে গিয়ে ওদের একা করার চেষ্টা করেছিল।
আনোয়ার রেশমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলেছিল, ‘আমায় ভুলে যাও। যদি চোখে অন্ধ হয়ে যাই, একটা চোখে দেখতে হবে আজীবন। এমন খুঁতো ছেলেকে বিয়ে করে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে তোমায় আমি দেব না, রেশমা। তুমি আমার কাছ থেকে সরে যাও।’
রেশমা নিজের অবাধ্য চোখের জলকে সামলে দাঁত চেপে শুধু বলেছিল, ‘সরে যেতে হলে নিজের জীবন থেকেই সরে যাব। আর যদি এ পৃথিবীতে থাকতে হয় তাহলে তোমার সঙ্গেই পথ চলব।’
আনোয়ার খুব ভালো করে চিনত রেশমাকে। তাই এই মেয়ের জেদ যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা ও জানত। কিন্তু রেশমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে আনোয়ার। তাই এমন এক চোখ অন্ধ ছেলেকে বিয়ে করে ও জীবন কাটাক, এটা কিছুতেই চায়নি ও।
আনোয়ার শক্তভাবে বলেছিল, ‘যেটা বলছি সেটা করো। আমার পক্ষে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা আর সম্ভব নয়।’
রেশমা ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় বলেছিল, ‘রেখো না। কিন্তু আমায় বারণ করার তুমি কেউ নও। আমি কাকে ভালোবাসব সেটা ঠিক করে দেওয়ার তুমি কেউ নও।’
রেশমা চলে গিয়েছিল। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, ‘যতদিন বাঁচব তোমার নামেই বাঁচব।’
আনোয়ারের অপারেশনের দিনও হসপিটালের বাইরে ঠায় বসে ছিল রেশমা।
প্রায় একমাস পরে আনোয়ার আবার দেখতে পেয়েছিল স্বাভাবিকভাবে। ভাগ্যের জোরে সেবারের মতো ওর চোখটা বেঁচে গিয়েছিল। এমনকী পুলিশের চাকরির সময়েও ভিশন নিয়ে প্রবলেম হয়নি।
কলেজে এসেই রেশমার খোঁজ করেছিল আনোয়ার। কিন্তু রেশমা ওকে এড়িয়ে চলছিল। আনোয়ার ক্যান্টিনে দাঁড়িয়ে ওকে রাস্তা আটকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমার সঙ্গে কথা বলছ না কেন?’
রেশমা গম্ভীর মুখে বলেছিল, ‘একা বাঁচতে বলেছিলে, তোমার থেকে সরে যেতে বলেছিলে, তাই করেছি।’
আনোয়ার হেসে বলেছিল, ‘তাহলে ফারুক আর দীপঙ্করের কাছ থেকে রোজ আমার খবর নিতে কেন?’
রেশমার স্পষ্ট জবাব, ‘সে তো আমি ভালোবাসি বলে।’
আনোয়ারের প্রায় একমাস সময় লেগেছিল মেয়ের অভিমান ভাঙাতে। তখন থেকেই ওরা জানত, যাই ঘটে যাক ওদের জীবনে, ওরা একসঙ্গেই বাকি পথটুকু হাঁটবে।
আনোয়ার বলেছিল, ‘রেশমা, আমরা একদিন প্যারিসের সেইন নদীর তীরে একসঙ্গে হাঁটব। ভালোবাসার শহরে গিয়ে উদযাপন করব আমাদের ভালোবাসা।’
আনোয়ার চোখের স্বপ্নের সঙ্গে মিলিয়েই রেশমা বলেছিল, ‘তুমি আমার সঙ্গে থাকলে কৃষ্ণনগরের জলঙ্গীই আমার কাছে সেইন বা রাইন নদী হয়ে উঠবে।’
রেশমা শুধু বলার জন্য বলেনি, সত্যিই যে আনোয়ারকে নিয়ে রেশমা গর্বিত সেটা ওর প্রতিটা পদক্ষেপে বুঝিয়ে দিত।
রেশমার চোখদুটো আজ আবার অবাধ্য হয়েছে। আনোয়ার চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে ওকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘মনে পড়ল আমাদের শপথের কথা? নাকি এখন আর এ গ্রামের ব্রজেশ্বর নদী তোমার চোখে রাইন বা সেইন নদী নয়?’
রেশমা বলল, ‘তুমি কেন বুঝতে পারছ না, বলো তো? তোমাদের সব আত্মীয় আমায় ফোন করে জিজ্ঞাসা করেন, কিছু খবর আছে কিনা। আমি কোনো উত্তর দিতে পারি না। তুমি জানো তোমার বাবা, মা দত্তক সন্তান নিতে দেবেন না। তাহলে আর একটাই তো উপায় বেঁচে থাকল, তাই না?’
আনোয়ার বলল, ‘না, আরেকটা উপায়ও বেঁচে আছে। আমরা দুজনে মিলে সুন্দর করে বাঁচব। যাক গে, আমি এবার একটু টিভি দেখি। তুমি তোমার গল্পের বইয়ে মন দাও। ফালতু আলোচনা করে সন্ধেটা নষ্ট করে দিও না। এই বিষয়ে বাড়ির কারোর কথা আমি শুনতে চাই না রেশমা। তুমি যদি রাজি থাকো, তাহলে দত্তক আমি নিতেই পারি। আর তাছাড়া ডক্টরের ওষুধ তো চলছেই। দেখা যাক না আর কয়েক বছর।’
টিভির রিমোট প্রেস করল আনোয়ার। রেশমা বুঝল আর এসব শুনতে আগ্রহী নয় ও। ঘরে গিয়ে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা ‘কাঁচের দেওয়াল’ বইটি খুলল। গল্পের বই পড়ার নেশা ওর ছোট থেকেই। আনোয়ার এখনও ওর এই নেশাটাকে বেশ প্রশ্রয়ে আর আদরে বাঁচিয়ে রেখেছে। রেশমার প্রতিটা জন্মদিনে, বিবাহবার্ষিকীতে ওকে একগাদা করে বই উপহার দেয়। এছাড়াও লাইব্রেরির কার্ড তো ওর আছেই। এখানে এসেও ওর কার্ড করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখনও এখানের লাইব্রেরিতে যাওয়া হয়নি। সত্যি বলতে কী, এই জায়গাটা ঠিক ভালো লাগেনি রেশমার। শহরে মানুষ হওয়া মেয়ে। সন্ধে হলেই গ্রামটা যেন কেমন নিশ্চুপ আর অন্ধকার হয়ে যায়। সেই আলোজ্বলা সন্ধে নেই। মাল্টিপ্লেক্স নেই। বড় বড় মল নেই। শপিংয়ের নামে ঘুরে বেড়ানো নেই।
রেশমা জানে, আনোয়ারেরও যে এই গ্রামে থাকতে ভালো লাগছে, তা নয়। শুধুমাত্র রেশমাকে বাড়ি থেকে, চেনা গণ্ডি থেকে সরিয়ে আনবে বলেই এখানে পোস্টিং নিয়েছে ও। বিক্রমপুর নামেই মফস্সল, গ্রাম বললেই ঠিক হবে। ওই হাটতলা আর বাস স্ট্যান্ডের কাছটা একটু জমজমাট। বাকি চারিদিকে চাষের জমির ধূ-ধূ প্রান্তর।
আর একটা সৌন্দর্য হারানো নদী গোটা গ্রামটা জুড়ে আধিপত্য বিস্তারের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকালে তবুও তার কৌলিন্য কিছুটা ফেরত আসে। কিন্তু শীত গ্রীষ্মে লোকে ব্রজেশ্বরকে নালা বা ড্রেন ভেবে লাফ দিয়ে পেরিয়ে যায়। এতটাই পলি আর পানা জমেছে নদীর বুকে যে, জলধারণের ক্ষমতা হারিয়েছে। ঠিক ওর মতো সন্তান ধারণের ক্ষমতা না থাকা নারী।
এই গ্রামের নিস্তব্ধতা রেশমার একাকিত্বকে আরও একটু বাড়িয়ে দেয়। শিবপুরের বাড়িতে আনোয়ারের পরিবারে অনেক লোক। ওর কাকারাও পাশের বাড়িতেই থাকেন। আনোয়ারের দাদা, বউদি তার দুই বাচ্চা সব মিলিয়ে জমজমাট পরিবার। দোতলা বাড়িটা যেন সারাদিন কথা বলছে। কিছুদিন অন্তর অন্তরই আনোয়ারের বাইকে চেপে রেশমা চলে যেত বাপের বাড়ি। সেখানে দু’দিন পাখির মতো ডানা মেলে আবার ফিরে আসত। আনোয়ারের বাড়ির সবাই রেশমাকে এমনিতে মেয়ের মতোই ভালোবাসত। কিন্তু যেহেতু ওর দাদার দুই মেয়ে, আর বাড়িতে কোনো ছেলে নেই, তাই সবাই হয়তো আশা করেছিল রেশমার একটা ছেলে হোক। কিন্তু হাজার ডাক্তার, জলপড়া, তাবিজ পরেও বাচ্চা কোলে এল না রেশমার। রোজ রোজ বাড়ির লোকজন আর পাড়ার সবাই বলতে শুরু করল, ‘অমুক ডাক্তার দেখাও আনোয়ার। আমার পিসির বৌমারও বাচ্চা হচ্ছিল না। শেষে ডক্টর চক্রবর্তীর ওষুধ খেয়ে কাজ হল। এখন ওর ছেলে তো নার্সারিতে ভর্তিও হয়েছে।’
এমন কত ডাক্তার বদলে গেল রেশমার জীবনে। কত নতুন নতুন ওষুধ জমল ওর পেটে। কিন্তু প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক ওর পিরিয়ড হয়ে গেল। মিস করল না একবারও। সকলের কথা শুনে রেশমার কেমন পাগল পাগল লাগত। সবাই গর্ভবতী হয়, ও হয় না কেন! মাঝরাতে ঘুমন্ত আনোয়ারকে বিছানায় ফেলে চুপিচুপি ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ও।
সকালে হারমোনিয়াম নিয়ে বসত রেশমা। ওর গান শুনতে খুব ভালোবাসে আনোয়ারের বাবা। শ্বশুরমশাইয়ের রাশভারী ব্যাপার ছিল না। বরং যেন বাবা মেয়ের মতোই ছিল ওরা। অমন একখানা বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে খুব কষ্ট হয়েছিল রেশমার। কিন্তু ওই বাড়িতে থাকলে আত্মীয়স্বজন বাড়িতে ঢুকেই রেশমাকে নানা পরামর্শ দিতে শুরু করত। দমবন্ধ হয়ে আসত ওর। মনে হত সবাই বুঝি ওকে নিয়ে আড়ালে ব্যঙ্গ করে। রাত জেগে জেগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। হারমোনিয়ামের রিডে ধুলো জমছিল। এসব দেখেই আনোয়ার ওকে নিয়ে বদলি হয়ে চলে এল এই বিক্রমপুরে। কিন্তু এই গ্রামের নিস্তব্ধতা যেন ওকে আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিচ্ছে ওর অক্ষমতার কথা। আনোয়ার প্রায় সারাদিন ডিউটিতে থাকে। একা একা বইপত্র পড়ে দিন কাটায় রেশমা।
সোশ্যাল মিডিয়াতেও বেশিক্ষণ কাটাতে ইচ্ছে করে না। পুরোনো বান্ধবীরা সকলেই আছে ওর ফ্রেন্ড লিস্টে। সকলেই স্বামী-সন্তানের সঙ্গে ছবি দেয়। কেমন যেন একটা না পাওয়ার কষ্ট ওর মনে ক্রমাগত রক্ত ঝরিয়েই চলে। সুপর্ণার ফুটফুটে গোলাপি ফ্রক পরা মেয়েটার জন্মদিনে সুপর্ণা ছবি পোস্ট করেছিল মেয়ের। কমেন্ট বক্সে ও আশীর্বাদ আর আদর লিখতে গিয়েও থেমে গেছে। যদি সুপর্ণা কিছু মনে করে এই ভেবে। অনেকক্ষণ বাচ্চাটার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অদ্ভুত একটা হিংসে হচ্ছিল সুপর্ণার ভাগ্যকে। তারপর নিজেই অফলাইন হয়ে গিয়েছিল। ওর দৃষ্টিতে যেন কোনো শিশুর ক্ষতি না হয়ে যায়, এই ভেবেই ফোনটা সরিয়ে রেখেছিল। ও কি হিংসুটে হয়ে যাচ্ছে দিন দিন? কে জানে, হয়তো তাই!
আবারও বইয়ের পাতায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল রেশমা। রশিদ ভাইয়া কাল যে তাবিজটা আনবে সেটাতে কি আদৌ কাজ হবে? নাকি সেই আগের মতোই বৃথা যাবে?
রেশমা যখন ইলেভেনে পড়ত তখন ওর ছোট পিসি একবার বলেছিল, এক ফকির সাহেব আছে, খুব ভালো গুনতে পারে। গুনে বলে দেবেন রেশমার জীবন কেমন কাটবে আগামীতে।
রেশমা হেসে গড়িয়ে পড়ে বলেছিল, ‘আমার জীবন কেমন কাটবে সে শুধু আমি ঠিক করব। আমার জীবনের মালিক আমি। ওসব তাবিজ, কবজে কিছু হয় না।’
সেই রেশমা কীভাবে যেন বিজ্ঞান ছেড়ে এসবে ভরসা করতে শুরু করল। ওর সচেতন মন বলে এসবে কিছু হবে না। কিন্তু ওর দুর্বল মন যেন এসবকেই আঁকড়ে ধরতে চায়।
বাইরে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে রেশমা বেরিয়ে এল ড্রয়িংরুমে। দেখল আনোয়ার ড্রেস পরে রেডি।
রেশমা অবাক হয়েই বলল, ‘এখন কোথায় যাবে?’
আনোয়ার কোমরে বেল্ট লাগাতে লাগাতে বলল, ‘আর বলো না, এখুনি থানা থেকে ফোন এল, বেনেপাড়ায় নাকি কীসব গণ্ডগোল বেঁধেছে। বেনেপাড়ায় লোক ক’ঘর থাকে, তার আবার ঝামেলা!’
রেশমা বলল, ‘খেয়ে বের হও। কত রাত হবে তার ঠিক নেই।’
কথা বলতে-বলতেই টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিল রেশমা। ঘড়ির কাঁটা ন’টার ঘর ছোঁয়ার জন্য দৌড়াচ্ছে।
একটু চিন্তিত মুখেই তড়কায় ডুবিয়ে রুটিটা মুখে ভরল আনোয়ার। অন্যদিন হলে মুখে খাবার দিয়েই তৃপ্তির আওয়াজ করে বলে, ‘আহা! ফাইভ স্টারকে হার মানাবে আমার রেশমার হাতের রান্না।’
রেশমা কখনও কখনও খেতে গিয়ে দেখে নুন কম, বা ঝাল নেই। তাতেও আনোয়ারের মুখের হাসিটা মেলায় না। বলে, ‘ও এক-আধদিন একটু এদিক ওদিক না হলে বুঝব কী করে তুমি রক্তমাংসের মানুষ!’
আজ অমন কোনো প্রশংসা পেল না রেশমার অভ্যস্ত কান। একটু যেন অন্যমনস্কভাবেই মুখে খাবারটা ঢোকাচ্ছে আনোয়ার।
রেশমা বলল, ‘মন দিয়ে খেয়ে নাও আগে।’
আনোয়ার বলল, ‘বুঝলে রেশমা, এই গ্রামে লোক কম বাস করতে পারে, কিন্তু এ গ্রামে প্রায় ঝামেলা বাঁধে। বিশেষ করে ওই বেনেপাড়ায়। ক’দিন আগেই দুটো কলেজ পড়ুয়া ছেলে মাথা ফাটিয়ে থানায় এসেছিল। কারণটা কী জানো?’
রেশমা কৌতূহলী হয়ে বলল, ‘কী কারণ?’
আনোয়ার বলল, ‘একটি ছেলে নাকি আরেকজনের গার্লফ্রেন্ডের ছবিতে লাভ দিয়েছে ফেসবুকে। তাই অমন মারপিট। গোঁয়ার লোকজন এখানে। এখন আবার গিয়ে দেখি ক’জন হাত-পা ভাঙল! সব দোষ তো হবে প্রশাসনের। নিজেরা গণ্ডগোল লাগিয়ে রাখবে, এখন বোঝো ঠ্যালা।’
আনোয়ার বেরিয়ে গেল। রেশমাকে বলল, ‘আমি চাবি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ঘুমিয়ে পোড়ো, রাত জেগে থেকো না।’
রেশমা টেবিল মুছে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। জোৎস্নার আলো অল্প অল্প জানালায় এসে পড়ছে। হাওয়াকে যেমন দেখা যায় না, শুধু অনুভব করা যায় মাত্র, ঠিক তেমনই রেশমার এই হাসিমুখের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে তীব্র যন্ত্রণা যা শুধু অনুভব করা যায়। গাছের পাতাগুলো এলোপাথাড়িভাবে দুলছে। এ ওর গায়ে যেন হেসে গড়িয়ে পড়ছে। এই দৃশ্য দেখে রেশমার মনে পড়ে যায় প্রাইমারি স্কুলের বন্ধুদের কথা। শৈশবের সেই দিনগুলো কী সুন্দরই না ছিল। চোখদুটো জুড়িয়ে আসছিল মিষ্টি হাওয়ায়। বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল রেশমা। কখন ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেও পারেনি। ঘুম ভাঙল মাঝরাতে। দেখল আনোয়ার পাশে ঘুমাচ্ছে। কখন এসে শুয়েছে টের পায়নি ও। নাইট ল্যাম্পের আলোয় টেবিলের ওপর তাকিয়ে চমকে উঠল। ওখানে কী ওটা!
লাইট জ্বালালে আনোয়ারের ঘুম ভেঙে যাবে। কিন্তু কৌতূহল দমন করাও মুশকিল। সকাল অবধি অপেক্ষা করা আরও সমস্যার। সারারাত ঘুম আসবে না।
ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামল রেশমা। টেবিলের ওপর রাখা জিনিসটা হাতে নিয়েই ড্রয়িংরুমে এল। লাইট জ্বালতেই দেখল একটা পিতলের বেশ বড়সড় মূর্তি।
হিন্দু পাড়ায় বাড়ি ছিল রেশমাদের। প্রচুর হিন্দু বন্ধুও ছিল। তাই এটা যে হিন্দুদের ঠাকুর, বেশ বুঝতে পারল রেশমা। কৃষ্ণ নয়, এটা গোপাল। হাতে ছোট্ট একটা নাড়ু নিয়ে মিচকে হাসিতে মুখ ভরিয়ে রেখেছে। ঠিক যেন ছোট্ট ছেলে মাকে লুকিয়ে নাড়ু চুরি করে পালাচ্ছে। মূর্তির গায়ে চাপ চাপ কাদা লেগে আছে। একে আনোয়ার পেল কোথায়! বাথরুমে নিয়ে গিয়ে শ্যাম্পু দিয়ে ভালো করে ধুতেই চকচক করে উঠল। একমাথা কালো মিনে করা চুল। হাতে নাড়ু, লালচে ঠোঁটে মুচকি হাসি। ছোট্ট গোপালকে গামছা দিয়ে ভালো করে মুছিয়ে দিল রেশমা। যত্ন করে রেখে দিল টেবিলের ওপর। একটা পা মুড়িয়ে বসে আছে গোপাল।
তবুও ঘুম নেই ওর চোখে। আনোয়ার হঠাৎ গোপাল ঠাকুর কেন নিয়ে এল বাড়িতে! এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি হচ্ছে না ওর। বরং প্রশ্নের পর প্রশ্ন জমছে ওর মনে। আনোয়ার জাতি-ধর্ম এত মানে না ঠিকই, একটু বেশিই লিবারেল। কিন্তু তাই বলে হিন্দুদের ঠাকুরকে বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করবে এমন তো নয়। তাছাড়া কোরান অনুযায়ী ওরা মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী নয়। তাহলে? এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল রেশমা।
হঠাৎই স্বপ্ন দেখল, একটা ছোট্ট বাচ্চা ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। যার এক হাতে একটা সাদা রঙের নাড়ু। মাথার কাছে চুলটা ঝুটি করে বাঁধা। ঘুমের মধ্যেই ছটফট করছিল রেশমা, এই বাচ্চাটাকে কোথায় যেন দেখেছে? ঠিক এমনই চুল বাঁধা, এমনিই মিষ্টি হাসিটা!
ধড়ফড় করে উঠতেই চোখে রোদ পড়ল। পর্দাটা সরিয়ে দিয়েছে আনোয়ার। চোখ মেলে তাকাতেই দেখল ওর স্বপ্নে দেখা ছোট্ট ছেলেটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। টেবিলের ওপর বসে আছে। ওই গোপালকেই দেখল রেশমা এতক্ষণ ধরে!
আনোয়ার পাশে নেই। সম্ভবত বাথরুমে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে ছ’টা বাজে। মাঝরাতে কিছুক্ষণ জেগে থেকে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল রেশমা। তাই হয়তো টের পায়নি। ও রোজ সাড়ে পাঁচটায় ওঠে। তাড়াতাড়ি উঠে বাথরুমের দিকে গেল। আনোয়ার বেরোতেই ওকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওই গোপাল তুমি কোথায় পেলে?’
আনোয়ার দরজা খুলে গেটে গুঁজে রাখা খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বলল, ‘একটু চা দাও। বড় গল্প। চা খেতে খেতে বলছি।’
রেশমা চা নিয়ে এসে বসল।
আনোয়ার চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘কাল বেনেপাড়ায় একটা বাড়ির কাজ শুরু হয়েছে। পিলার তুলে বাড়ি করবে। উঠোনে একটা পাতকুয়া ছিল। সেটা ঢাকা পড়েছিল। খুঁড়তে খুঁড়তেই ঢঙ করে আওয়াজ হয়। শ্রমিকটা একটা লোহার বাক্স তুলে এনেছে। এখন যে জায়গাটা বেচেছে আর যে কিনেছে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। যার জায়গা ছিল সে বলে ওটা নাকি তার কোনো পূর্বপুরুষের সম্পত্তি। আর যে জায়গা কিনে বাড়ি করছে সে বলছে ওটা এখন আমার সম্পত্তি। এই নিয়ে মারদাঙ্গা শুরু হয়েছিল।
শেষে সরকারের সম্পত্তি বলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। কারণ, এগুলো যার সম্পত্তি তিনি আর বেঁচে নেই। ওয়ারিশহীন সম্পত্তি বলেই থানায় আনা হয়েছে। বিশেষ কিছু নেই। কয়েকটা তামার অচল পয়সা, একটা ঘুণ লাগা কাগজ, এসব ছিল বাক্সে। সঙ্গে এই গোপাল মূর্তি। আমাদের থানার মুখার্জীবাবু বললেন, ওঁদের বাড়িতে নাকি প্রতিষ্ঠিত গোপাল আছে। তাই দ্বিতীয় মূর্তি নিয়ে যেতে পারবেন না। এদিকে সুবীর বলল, দাদা বিয়ে করিনি। এই ঠাকুরকে নাকি উপোস রাখতে নেই। নিয়ে গিয়ে কোয়ার্টারে কোথায় রাখব? তারপর এতদিনের পুরোনো ট্রাঙ্ক থেকে বেরিয়েছে দেখে কেউ নিতে চাইল না। বাধ্য হয়ে আমিই নিয়ে এলাম। থানায় নাকি রাখা যাবে না। দেখি এখানে তো প্রচুর হিন্দু মন্দির আছে। দিয়ে আসব কোথাও একটা।’
রেশমা অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘আমরা রাখতে পারি না? ঈশ্বর না আল্লা জানি না। ছোট্ট বাচ্চারা যেভাবে থাকে সেভাবে রাখতে পারি না আমরা?’
আনোয়ার দেখল রেশমার চোখ দুটো সজল হয়েছে। এই গোপালমূর্তিকে তো থানার স্টাফরা বাড়িতে কেউ নিয়ে যেতেও চাইল না। রেশমার যদি মন ভালো থাকে, তাহলে থাকুক না, ক্ষতি কী?
আনোয়ার বলল, ‘বেশ, রাখো তবে।’
রেশমা বলল, ‘আমি আমার বান্ধবী নয়নাকে ফোন করে জেনে নেব গোপাল কী কী খায়। ওদের বাড়িতে ধুমধাম করে গোপাল পুজো করত আমার মনে আছে।’
আনোয়ার আর কথা না বাড়িয়ে ডিউটি বেরোবার জন্য রেডি হল।
রেশমা ফোনে জানল, গোপালের ভোগে তুলসী দিতে হয়। গোপাল লাড্ডু খেতে ভালোবাসে। দোলনায় দুলতে পছন্দ করে।
রেশমা মার্কেটে গিয়ে একটা ছোট্ট অন্নপ্রাশনের হার কিনল। রকমারি সব পোশাক কিনল। আর একটা সুন্দর কাঠের দোলনা আর রুপোর মুকুট কিনে বাড়ি ফিরল। সঙ্গে চকলেট থেকে লাড্ডু কিছু বাদ গেল না। রেশমার যেন এখন অনেক কাজ। এতটুকু অবসর নেই।
তুলো দিয়ে গোপালের বিছানা বানাতে হবে। বালিশ বানাতে হবে। নতুন পোশাক পরাতে হবে।
আনোয়ার রাতে বাড়ি ঢুকেই দেখল রেশমা হাসছে। আর হেসে হেসেই বলছে, ‘দেখবে এসো, গোপালকে কেমন সাজিয়েছি আজকে।’
গলায় সোনার হার, মাথায় ছোট্ট মুকুট পরনে সাদা জড়ির পোশাক, দোলনায় দুলছে গোপাল। সামনে বেশ কিছু চকলেট রাখা।
আনোয়ার বলল, ‘তোমার গোপালের থেকে একটা চকলেট পাওয়া যাবে রেশমা?’ রেশমা ধমক দিয়ে বলল, ‘কী হ্যাংলা গো তুমি? একটা বাচ্চার চকলেট নেবে? আচ্ছা নাও একটা। আমার গোপাল বড় শান্ত ছেলে।’
আনোয়ার একটা চকলেট মুখে দিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকল। রেশমার যেন কথা শেষ হয় না। গল্প করেই চলছে। ঠিক যেন সেই কলেজের রেশমা। বকবক করে মাতিয়ে রাখত একসময়। আনোয়ার ওকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে। চোখের নীচে এখনও নির্ঘুম রাত কাটানোর গভীর কালি। চামড়ায় অযত্নের চিহ্ন তীব্র। শুধু চোখ দুটোতে আজ কষ্টের ছাপ নেই, বরং বেশি হাসি রয়েছে।
আনোয়ার ওকে টেনে নিজের কোলের কাছে বসিয়ে বলল, ‘তো গোপাল কি তার মায়ের সেই সুন্দর রূপটা দেখতে পাবে? সেই যে মিষ্টি দেখতে রেশমাকে তো তারও দেখা দরকার। না হলে গোপাল ভাববে, এ মা! আমার মাকে দেখতে বড্ড পচা।’
রেশমা হেসে বলল, ‘ঠিক বলেছ তুমি। আজ থেকে আমি ভালো করে খাব, খুব ঘুমাব।’
চা খেতে খেতে আজ অনেক গল্প হল রেশমার সঙ্গে। আনোয়ার অবাক হয়ে দেখছিল পিতলের মূর্তিটাকে। একটা প্রাণহীন মূর্তি এভাবে তার রেশমাকে বদলে দিতে পারে? তাহলে ওকে বাড়িতে এনে লাভই হয়েছে।
রেশমা বলল, ‘জানো একটা অদ্ভুত ব্যাপার। আমি স্বপ্নে দেখলাম গোপাল আমায় মা বলে ডাকছে। আমার কানের কাছে এখনও সেই ডাক শুনতে পাচ্ছি যেন।’
আনোয়ার রেশমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমার এই হাসি মুখটুকু দেখব বলেই তো আমার লড়াই।’
রেশমা আলতো করে আনোয়ারের বুকে মাথা রেখে বলল, ‘গোপালকে কখনও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না প্লিস।’
আনোয়ার হেসে বলল, ‘ভুলে যাচ্ছ কেন তোমার কর্তা পুলিশ। তোমার সঙ্গে সঙ্গে তোমার গোপালের প্রোটেকশনের দায়িত্ব আজ থেকে আমার।’
বেশ কাটছিল রেশমার দিনগুলো।
হারমোনিয়ামের ধুলো ঝেড়ে বহুদিন পরে আজ গান নিয়ে বসেছে রেশমা। আসল উদ্দেশ্য গান শুনিয়ে গোপালকে ঘুম পাড়ানো। দিনরাত খাটিয়ে মারছে ছেলেটা রেশমাকে। এই স্নান করানো, পোশাক পরানো, চারবার করে খাওয়ানো, তারপর দোলনায় দোল দেওয়া। রোজ ফুলের মালা গেঁথে পরানো। সময় যেন কোথা দিয়ে কেটে যাচ্ছে রেশমার। আজ গোপালকে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াবে ভেবেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসল। টিউনিং করাতে হবে এটাকে। বেশ কিছু স্বর বসে গেছে।
তবুও রেশমা গাইছিল,
‘ওরে নীল যমুনার জল!
বল রে মোরে বল কোথায় ঘনশ্যাম—
আমার কৃষ্ণ ঘনশ্যাম।
আমি বহু আশায় বুক বেঁধে যে এলাম—
এলাম ব্রজধাম।’
গান গাইতে গাইতে রেশমার দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। বুকের সব জমে থাকা বরফ যেন ধীরে ধীরে গলছে। ওর কোলে শুয়ে আছে গোপাল।
আনোয়ার কখন এসেছে বুঝতেও পারেনি। বিভোর হয়ে গাইছিল রেশমা।
আনোয়ার ঢুকে বলল, ‘যাক, অনেকদিন পরে গান শুনতে পেলাম।’
রেশমা মুখে আঙুল দিয়ে ইশারায় বলল, চুপ করতে। গোপালকে দেখিয়ে বলল, ‘সবে ঘুমাল। চুপ করো একদম।’
আনোয়ার বেশ বুঝতে পারছে রেশমা গোপালকে নিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। গোপালের মধ্যেই ও নিজের সন্তানকে খুঁজে নিয়েছে। লোকে দেখলে হয়তো রেশমাকে পাগল বলবে। হয়তো এটা আনোয়ারের আটকানো দরকার ছিল। কিন্তু রেশমার মুখের হাসির থেকে মূল্যবান আর কিছু নেই। মাত্র দশ দিনের মধ্যে ম্যাজিকের মতো রেশমার চোখের নীচের সেই কালি গায়েব। মুখটা যেন ক’দিনেই চকচক করছে। ঠোঁটের কোণে সবসময় তৃপ্তির হাসি। এসব দেখেই আনোয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেশমা যাতে ভালো থাকবে তাতে ভালো থাকুক। ও কোনোরকম বাধা সৃষ্টি করবে না।
রেশমা তার গোপালকে শুইয়ে এসে খাবার সাজাল টেবিলে। খাওয়া-দাওয়া করে দুজনেই শুয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি। কাল ভোরে বেরোতে হবে আনোয়ারকে। একটা বিশেষ কাজ আছে। ওসি আসবেন।
হঠাৎই একটা চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল আনোয়ারের। কারা যেন খুব জোরে জোরে ওর বাড়ির দরজা ঠুকছে। জানালাতেও ঢিল জাতীয় কিছু ছুঁড়ছে। ঠিক বুঝতে পারল না আনোয়ার। রেশমা ঘুম চোখেই ছুটে গিয়ে গোপালকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
আনোয়ার দরজাটা খুলতেই দেখল প্রায় জনা পঁচিশেক লোকজন হাতে লাঠি নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু বলে চলেছে। ঘুমের ঘোরে ছিল আনোয়ার। তাই প্রথমে বুঝতেই পারেনি ঝামেলাটা ঠিক কী নিয়ে?
তারপর একজনকে দেখে চিনতে পারল। সেদিন যার বাড়ি খুঁড়ে ট্রাঙ্ক পাওয়া গেছে, সে-ও দলে আছে। একজন বছর পঞ্চাশের লোক বললেন, ‘দেখুন অফিসার, আপনি পুলিশ বলে আমরা এখনও আপনার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিইনি। না হলে সেটাই করা উচিত ছিল। আমাদের এটা হিন্দু গ্রাম। চারিদিকে মন্দির-বিগ্রহ সব আছে। এমনকী আমরা বুড়ো বটকেও দেবতাজ্ঞানে পুজো করি। আমাদের গ্রামের নদীর নাম কেন ব্রজেশ্বর জানেন? প্রতিবার চরকের সময় ওই নদীতে শিবলিঙ্গ নিজে ওঠেন। সেখানে আপনি বিধর্মী হয়ে এত বড় অনাচার করেন কী করে?’ আনোয়ার কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, ‘তো আমার অপরাধটা ঠিক কী যদি বলেন? আপনাদের কোন দেবদেবীকে আমি অসম্মান করেছি? এই তো দু’দিন আগে আপনাদের চণ্ডীতলায় মেলা বসেছিল। যাতে কোনোরকম ঝামেলা না হয় তাই আমি দুজন কনস্টেবল পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। নির্বিঘ্নে আপনাদের সব অনুষ্ঠান পালিত হয়েছে। তাছাড়া আমরা একই রাজ্যের মানুষ। আমার জন্মকর্ম সব এখানে। তাই ছোট থেকে দুর্গাপুজো, কালীপুজো দেখে এসেছি। এতে সমস্যা কোথায়?’
লোকটি চেঁচিয়ে বলল, ‘তাই বলে আমাদের ইষ্টদেবতা আপনার বাড়িতে থাকবেন, এটা তো আমরা মেনে নেব না।’
আনোয়ার বুঝল, ওদের পরিচারিকা করবীই রটিয়েছে কথাটা। না হলে গোপালের কথা এদের জানার কথা নয়। আনোয়ার পিছনে তাকিয়ে দেখল ঘরের মধ্যে রেশমা দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। বুকের কাছে চেপে ধরে আছে গোপালের মূর্তিটাকে। খুব অসহায় লাগছে আনোয়ারের। সামান্য এটুকু চেয়েছিল রেশমা সেটুকু দেওয়ার ক্ষমতা নেই ওর! কেমন ভালোবাসে ও রেশমাকে? ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, গোপালকে কেউ কেড়ে নেবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে যেভাবে গ্রামের সবাই ক্ষেপে উঠেছে ওর ওপরে তাতে জাতপাত নিয়ে অশান্তি শুরু হবে। ওসির কানে যাবে। মুশকিলের শেষ থাকবে না। এ দেশে সব থেকে বড় ইস্যু ধর্ম। কিছু ছেলে পিছনে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে দু’বেলা হয়তো পেট ভরে খেতে পায় না। মানুষের খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষার থেকেও এ দেশে ধর্ম বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এতদিন পুলিশে থেকে এটা ভালো করেই জানে আনোয়ার।
তবুও রেশমার রক্তশূন্য মুখটার দিকে তাকিয়ে ভাবল একটা শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। আনোয়ার বলল, ‘দেখুন, হতে পারি আমরা অন্য ধর্মের। কিন্তু ওই গোপাল মূর্তিকে আমার স্ত্রী অত্যন্ত যত্নে রেখেছে। কোনো অসম্মান করা হয়নি।’
গোটা চারেক লোক ঝাঁপিয়ে উঠে বলল, ‘আমাদের ইষ্টদেবতা একটা মুসলমান বাড়িতে থাকতে পারেন না। রাখবেন আপনাদের আল্লাকে আমাদের মণ্ডপে? মসজিদে ঢুকতে দেন আমাদের? উদার কথাবার্তা শুধু বলতেই ভালো লাগে। ওসব শুনব না। আমাদের মূর্তি ফেরত দিন। আমরা ব্রজেশ্বরের জলে শুদ্ধ করে তাঁকে নিয়ে যাব।’
রেশমা বুকে চেপে ধরে আছে গোপালকে।
আনোয়ার এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘রেশমা, এরা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে। দিয়ে দাও ওদের গোপালকে। আমি তোমায় অন্য গোপাল কিনে দেব।’
রেশমা বলল, ‘না, আমি দেব না। গোপাল আমায় ছাড়া খায় না, গান না শুনে ঘুমায় না। আমায় মা ডাকে। আমি দেব না ওকে।’
আনোয়ার দেখল রেশমার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে নিজের কান্না থামাতে চাইছে। কষ্ট হচ্ছে আনোয়ারের। কিন্তু এই আক্রোশের মুখে আর কোনো রাস্তা নেই। আনোয়ার শান্তভাবে রেশমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমি তোমায় এনে দেব, দেখো। একটু বিশ্বাস রাখো আমার ওপরে।’
রেশমা ঘাড় গোঁজ করে বলল, ‘আমি বাজারে দেখেছি সব গোপালের হাতে কমলা রঙের লাড্ডু থাকে। একমাত্র আমার গোপাল নারকেল নাড়ু হাতে রয়েছে। আমি কালকে সারা দুপুর ধরে নারকেল কুরে নাড়ু বানিয়েছি। ওগুলো খাবে কে?’
আনোয়ার হাঁটু মুড়ে বসে হাত দুটো বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইল রেশমার কাছে। এভাবেই প্রথম রেশমাকে কলেজ চত্বরের ফাঁকা গাছতলায় প্রোপোজ করেছিল। তখন অবশ্য জানত না জীবনটা এতটা জটিল মোড়ে এসে থামবে।
রেশমা আনোয়ারকে এতটা ভেঙে পড়তে কখনও দেখেনি। তাই হয়তো একটু হকচকিয়ে গিয়েই গোপালকে দিয়ে দিল ওর হাতে। আর কথা না বলে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল রেশমা।
আনোয়ার সোনার হার, মুকুট এগুলো খুলে নিল গোপালের শরীর থেকে। হয়তো মুসলমান পরিয়েছে তাই এগুলোও অপবিত্র বলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। আনোয়ার যখন বেশ ছোট তখন ওদের পাশের বাড়ির এক কাকিমা অষ্টমীর ভোগ দিয়েছিল ওকে। ও খিচুড়ি খেতে ভালোবাসে বলে কলাপাতায় নিয়ে খাচ্ছিল, তখনই আনোয়ারের পিসি এসে হাত থেকে প্রসাদটা নিয়ে জলে ফেলে দিয়ে বলেছিল, ‘মুসলমানের ছেলে হয়ে হিন্দুদের প্রসাদ খাস? তোর তো জাহান্নামেও ঠাঁই হবে না।’
আনোয়ার এই জীবনে বুঝতেই পারল না, মানুষগুলোর মধ্যে আলাদা কী আছে?
গোপালকে নিয়ে দিনরাত রেশমা মেতে ছিল। ক’দিনের মধ্যেই গোপাল যেন ওদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিল। ফেরত দিতে গিয়ে আনোয়ারের বুকটাও ধড়ফড় করে উঠল। মনে হল যেন নিজেদের কাউকে অন্যের হাতে তুলে দিল।
ওরা গোপালকে নিয়ে চলে গেল।
রেশমার দরজা বন্ধ। জানালার ফাঁক দিয়ে আনোয়ার দেখল রেশমা গোপালের দোলনায় কাছে বসে আছে। এই মুহূর্তে রেশমার যা মনের অবস্থা, ভালোমন্দ কিছু আবার না করে বসে। কোনো পশু-পাখি এনে দিলে কি ভালো থাকবে রেশমা? আজকেই বাজার থেকে গোপাল কিনতে সাহস হচ্ছে না ওর। তাছাড়া রেশমার বক্তব্য অন্য গোপালের সঙ্গে ওর গোপালের পার্থক্য আছে। বড্ড অসহায় লাগছে আনোয়ারের। আজ বুঝতে পারছে প্রেমিক হওয়া বড্ড কঠিন। রেশমার কান্নাভেজা চোখ, রক্তশূন্য মুখ দেখে নিজের হাজার কষ্ট হলেও ভেঙে পড়লে চলে না। আনোয়ার ওদের ভালোবাসার গল্পটা অন্যরকম ভাবে আঁকবে ভেবেছিল।
ভেবেছিল নদীর ধারে একটা ছোট্ট বাড়ি থাকবে। বাড়ির চারপাশে বেশ কিছু কৃষ্ণচূড়া গাছ। গরমে রঙিন হয়ে থাকবে ওদের বাড়ির চারপাশ। ছাদে উঠলে নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় রেশমার আঁচল উড়বে। অথবা ওই অবাধ্য হাওয়াকে বশ করে ভিজে চুল শুকিয়ে নেবে রেশমা। ঝগড়ার দিনে আনোয়ার ওই ছাদেই মাদুর বেছাবে। মাঝরাতে চুপিচুপি নেবে আসবে রেশমার পাশে। কখন আলগোছে ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়বে টের পাবে না রেশমা। বাড়ির উঠোন জুড়ে জ্যোৎস্না এসে পড়বে। ওখানে বসেই ওরা দুজন নামাজ পড়বে। ভাত ফোটার গন্ধে চাইচাই খিদে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকবে আনোয়ার। রেশমার ঘামে ভেজা মুখের প্রেমে পড়বে ও বারংবার। সেই নিকানো উঠোন, জোৎস্নাভেজা রাত্রি, সেই হাসিখুশি রেশমা সব যেন কেমন হারিয়ে গেল। ওর কল্পনার ছবিটাও যেন ধূসর রঙে আবছা হয়ে গেল।
আনোয়ার বেশ কয়েকবার ডাকল রেশমাকে। দরজা খোলার আওয়াজ নেই। সারা রাত সোফায় বসে থেকে থেকে ভোর হয়ে এল। আবার একটা কর্মব্যস্ত দিন শুরু হবে আনোয়ারের। কিন্তু রেশমার কাছে আজ ওর থাকা দরকার। এদিকে ওসির সঙ্গে মিটিং আছে। বাধ্য হয়েই পোশাক পরে রেডি হল। হঠাৎই দরজাটা খুলে গেল। কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যাওয়ার পরে ছোট গাছগুলো যেমন বিধ্বস্ত হয়ে যায় ঠিক সেরকম লাগছে রেশমাকে। মুখে কোনো কথা নেই। চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।
চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পরে দুটো টোস্ট আর চা এনে টেবিলে রেখে চলে গেল বেডরুমে।
আনোয়ার বলল, ‘তুমি খাবে না?’
রেশমার কোনো উত্তর নেই। অভিমান জমে আছে ঠোঁটের কোণে। ও হয়তো ভাবচ্ছে কেন ওকে দিয়ে দিতে হল গোপালকে? রেশমা বোঝে না, এ পোড়া দেশে একটা ভাইরাল ফিভারে সবাই কাবু, সেটা হল ধর্ম। মুসলমানের ঘরে হিন্দুদের ঠাকুর থাকতে পারে না এই ইস্যু যে কতদূর যেতে পারে ওর কোনো ধারণাই নেই।
কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিয়ে ডিউটি বেরিয়ে গেল আনোয়ার। দেখল গোপালের নারকেল নাড়ুর কৌটো নিয়ে বসে আছে রেশমা। ভাবতে ভাবতেই বাইকে স্টার্ট দিল, একটা পশু পুষলে কেমন হয়? সেটা নিয়ে তো আর কেউ কিছু বলতে পারবে না।
ওসি-র সঙ্গে মিটিং চলাকালীন আনোয়ারের মন পড়েছিল রেশমার দিকে। কী যে করছে একা একা। এমন প্রফেশনে আছে যে একটা দিন ও রেশমার সঙ্গে কাটাতে পারল না।
লাঞ্চ ব্রেকে ফোন করল রেশমাকে। ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। হোয়াটসআপের লাস্ট সিন সেই কাল রাতে।
এই কঠিন রেশমার কাছে আনোয়ার বড্ড অসহায়। এই সময় ও কারোর কথা শোনে না। রেশমার অভিমানকে বড্ড ভয় পায় আনোয়ার।
থানা থেকে বাড়ির দিকে যেতে যেতেই দেখল শিব মন্দিরের সামনে বেশ জটলা। অন্যদিন হলে বাইক দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞাসা করে আনোয়ার, ‘কী? সব ঠিক আছে তো?’ আজ মনটা এতটাই বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে যে ইচ্ছে করল না। মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে কী করে? শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে একজন নিঃসন্তান মহিলার কাছ থেকে সন্তানজ্ঞানে আদর করা গোপালকে কেড়ে নিতে যারা পারে তাদের কুশল সংবাদ নিতে আর ইচ্ছেই করল না আনোয়ারের। কয়েকজন ওকে দেখেই ছুটতে ছুটতে এল। বাইকের স্পিড কমাল আনোয়ার। দু-তিনজন বেশ ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘আমাদের ক্ষমা করবেন স্যার। ম্যাডাম আমাদের সাক্ষাৎ দুর্গা প্রতিমা।’
আনোয়ার কিছুই বুঝল না। কে ম্যাডাম? রেশমার কথা বলছে? মুসলমান ঘরনিকে দুর্গা প্রতিমা বলার কারণটাই বা কী? এই গ্রামে চাষীবাসি, ব্যবসাদার থাকলেও মানসিকতার দিক দিয়ে এরা বড্ড পিছিয়ে আছে। কুসংস্কার এদের ঢেকে রেখেছে। সেখানে এমন উক্তির কারণ জানতে আনোয়ার বেশ জোরেই বাইকটা চালাল।
বাড়ির সামনে এসে আরও অবাক হয়ে গেছে। বেশ কিছু লোক বারান্দায় বসে খাচ্ছে। রেশমা আর করবী আরও দুজন মহিলা মিলে তাদের পরিবেশন করছে।
একটু চমকে উঠল আনোয়ার। রেশমার মুখে হাসি ধরছে না।
আনোয়ার ঢুকতেই রেশমা হেসে বলল, ‘গোপাল ফিরে এসেছে গো। আমায় ছেড়ে এক বেলাও থাকতে পারেনি সে। এই যে এঁরা নিয়ে গিয়েছিলেন, এঁরাই ফেরত দিয়ে গেলেন। তাই আমি ওদের আজ একটু মিষ্টি খাওয়ালাম।’
আনোয়ার দেখল লুচি, আলুরদম, ছোলার ডাল, মিষ্টি এসব রয়েছে পাতে। আনোয়ারকে দেখে সবাই ক্ষমা চাইল। কিন্তু তবুও বিষয়টা বোধগম্য হল না। শুধু রেশমার কষ্ট বা কান্না দেখে এরা গোপালকে ফিরিয়ে দিয়ে গেল এটা হতে পারে না। আনোয়ার করবীকে ডাকল।
করবী এসে তার নিজস্ব ঢঙে বলতে শুরু করল, ‘আর বলবেন না দাদাবাবু, ওই সমর চাটুজ্জে তো গোপালটা মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছিল। শেষে সবাই বলেছিল আপাতত ওদের বাড়িতেই রাখা হবে। তারপর মন্দির গড়ে তাতে থাকবে গোপাল। ভোর রাতে সমর চাটুজ্জে গোপাল নিয়ে নিজেদের ঠাকুরঘরে রাখলেন। তার দু’ঘণ্টার মধ্যে সমর চাটুজ্জের মায়ের রক্ত বমি হল। সবাই বুঝল পাতকুয়োতে কেন গোপাল ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ও অপয়া গোপাল গো। তাই ভয়ে ভয়ে সমর চাটুজ্জে গোপাল বৌদিমনিকে ফেরত দিয়ে গেছে।’
আনোয়ার মনে মনে বলল, কুসংস্কার মাঝে মাঝে বেশ ভালো ফল আনে। ভাগ্যিস সমর চাটুজ্জের মায়ের বমি হল, তাই তো রেশমা গোপাল ফেরত পেল।
রেশমা তার গোপালকে ঘুম পাড়িয়ে আনোয়ারের পাশে এসে শুয়ে পড়ল।
ঘুমন্ত রেশমার দিকে তাকিয়ে আনোয়ার মনে মনে বলল, একটু ক্ষমতা দাও আল্লা যেন এই মুখটাতে হাসিটুকু চিরস্থায়ী করতে পারি।
রেশমার কপালে চুমু খেতেই দু’হাত দিয়ে আনোয়ারকে জড়িয়ে ধরে রেশমা বলল, ‘ক্ষমা করো। আমি মাঝে মাঝে বড্ড অবুঝ হয়ে যাই।’
আনোয়ার বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিল রেশমাকে। নতুন করে আঁকতে শুরু করল সেই ধূসর হয়ে যাওয়া ছবিটাকে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন