অর্পিতা সরকার
‘লোপা তুমি তো একেবারেই নতুন এসেছ এবাড়িতে, মাত্র মাস তিনেক হল। এখনও এবাড়ির নিয়ম কানুন কিছুই জানো না। আগে একটু দেখেশুনে নাও,’ অরুণাদেবী বৌমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন। ‘তোমার অফিসের ছুটি যেদিন যেদিন থাকবে সেদিন সেদিন একটু একটু দেখিয়ে দেব আমি। দেখিয়ে বলতে আমাদের বাড়ির মালকিন জয়ন্তীকে কখন কী নির্দেশ দিতে হবে, এটুকুই শিখে নেওয়া। আমরা এবাড়ির সবাই জয়ন্তীর ওপরে নির্ভরশীল। জয়ন্তীর যখন মাত্র পনেরো বছর বয়স তখন থেকে ও এবাড়ির দায়িত্ব স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নিয়েছে। আমরা জলখাবারে কী খাব, দুপুরে কী খাব সব ওই ঠিক করে। বুকুন তো কলেজ থেকে ফিরে জয়ন্তীদির বানানো টিফিন ছাড়া খেতেই পারত না। আজও একই স্বভাব আছে।’
লোপার হাজবেন্ড সন্দীপের ডাকনাম বুকুন। সন্দীপ আর সুদীপা দুই ভাইবোন। সুদীপার বিয়ে হয়ে গেছে। কালেভদ্রে বাপের বাড়ি আসে। দুই ভাইবোনের একটাই মিল, ভীষণ রকমের অহংকারী আর মুডি। ওদের চোখে কারোর কোনো যোগ্যতা নেই একমাত্র ওদের ছাড়া। সুদীপা কলেজের প্রফেসর। তাই রেলে ক্ল্যারিক্যাল জব করা লোপা ওর চোখে নিতান্তই সাধারণ। আর সন্দীপ তো আরেক কাঠি এগিয়ে। সে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। তার ধারণা, এই পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা কম গরু-ছাগলের সংখ্যা বেশি। তিনি উচ্চমার্গে বিরাজ করেন। লোপার মতো মধ্যমেধার মেয়েকে যে সে বিয়ে করেছে এটাই অনেক। লোপার প্লাস পয়েন্টে বলতে, লোপা ভয়ানক সুন্দরী। সুদীপার বক্তব্য হল, এমন সুন্দরীদের নাকি মাথাটা নিরেট হয়। এ নিয়ে ভাই-বোন যথেষ্ট হাসাহাসিও করেছে।
এই তিন মাসের মধ্যে লোপা বুঝে গেছে এ বাড়িতে তার যদি বন্ধু কেউ থাকে, তিনি হলেন সন্দীপের মা অরুণাদেবী। ভদ্রমহিলার মধ্যে একটা চিরন্তন মাতৃরূপ রয়েছে। সকলকেই কী অদ্ভুত শক্তিতে আপন করে নিতে পারেন!
শ্বশুরমশাই একটু রাশভারী মানুষ। কথা বিশেষ বলেন না। কলেজের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন। বর্তমানে রিটায়ার্ড পার্সন। দিনরাত বই নিয়ে কেটে যায়। লেখালেখি করেন। মাঝে মাঝেই সভা সমিতিতে ডাক পড়ে। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে লোপার বিয়েটা হয়েছে। তাই এবাড়ির সবকিছুই তার অপরিচিত। এমনকী যার হাত ধরে এ বাড়িতে আসা সেই মানুষটাও। তিনমাসে কিছুই চেনা হয়নি। কারণ বিয়ের পর মাত্র পনেরো দিন লোপার সঙ্গে কাটিয়ে সে পাড়ি দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। চার মাস ওখানে থাকবে। কোম্পানির সিনিয়র অফিসার বলে তাকে প্রায়ই বিদেশে ট্রাভেল করতে হয়।
লোপার যখন সন্দীপদের বাড়িতে বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তখন সমস্ত আত্মীয়-স্বজন বেশ হিংসার চোখে দেখেছিল ওকে। সকলের ধারণা ছিল ধনী আর সুদর্শন স্বামী পাচ্ছে মানেই বড্ড সুখী হবে লোপা। সকলের কাছে শুনতে শুনতে লোপা নিজেও অবশ্য সেটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। একমাত্র ওর ছোটমাসি বলেছিল, ‘শোন, সুখ বৃষ্টির ফোঁটা নয়, যে পড়ছে আর তুই ধরে নিবি। সুখ পেতে গেলে অনেকটা স্যাক্রিফাইস করতে হবে। মানিয়ে নিতে হবে অনেক। আর গায়ের চামড়া, চোখের পর্দা এগুলোকে একটু মোটা করতে হবে। সকলের সব কথা গায়ে মাখলে চলবে না। তবে তুই সুখের চাবিকাঠির নাগাল পাবি। তোর ছোটমেসোও কিছু কম বড় চাকরি করে না, আর দেখতেও ছিল রাজপুত্র। তুই যদি আচমকা প্রশ্ন করিস, মাসিমনি তুমি কি জীবনে সুখী? তাহলে আমাকেও গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসতে হবে। সারাজীবন হীরের হার পরে অবহেলা পেয়ে হাসি মুখে ঘুরে বেড়ানোকে যদি সুখ বলিস, তাহলে আমি সুখী। তোর মাকে আমি বারণ করেছিলাম সন্দীপের সঙ্গে বিয়ে দিতে। ছেলেটাকে দেখেই অল্প বয়েসের তোর ছোটমেসোকে মনে পড়েছিল। তাই বুঝেছিলাম, তোরও আমার মতো বরের হাত ধরে বৃষ্টিতে ভেজার শখ পূরণ হবে না কোনোদিনই। সে যাই হোক, সুখী কেউ হয় না লোপা, সুখী হতে হয় চেষ্টা করে।’
ছোটমাসির সব কথার মানে যে ও বুঝেছে এমন নয়। কিন্তু এটুকু বুঝেছে, সুখ বড় দুর্লভ জিনিস। আত্মীয়-স্বজনের বলা কথার মতো সরলীকরণ না করাই ভালো। বিয়ের পরে সন্দীপদের বাড়ির স্বাচ্ছন্দ্য দেখে ওর মধ্যবিত্ত মন একটু ভয়ই পেয়েছে। এদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে তো? লোপার মা রান্নাবান্নার পরে হলুদ মোছা আঁচল দিয়ে ক্লান্ত মুখের ঘাম মুছেছে। এখানে জয়ন্তীদির পরনে থাকে কুকিং অ্যাপ্রন। বাড়িতে তিনটে পরিচারিকা। এক চিলতে বাগানের জন্য আবার সহদেবদা আছে মালি প্লাস ড্রাইভার হয়ে। তিনতলা বাড়ির গোটা একতলা জুড়ে এরাই থাকে। এত আতিশয্য দেখা অভ্যেস ছিল না লোপার। তবে পরিচারিকার সংখ্যা যতই বেশি হোক, এবাড়ির সকলে সব থেকে বেশি নির্ভর করে জয়ন্তীদির ওপরে।
কার ওষুধ কোন ড্রয়ারে থাকে থেকে শুরু করে কোন আলমারিতে কার পোশাক আছে পর্যন্ত জয়ন্তীদির নখদর্পণে। সোম থেকে রবি জলখাবারে কে কী খাবে তাও মুখস্ত ওর। এমনকী এ বাড়ির কার কীসে অ্যালার্জি সেটাও মনে রাখতে হয় জয়ন্তীদিকেই। তাকে আবার লোপা কী নির্দেশ দেবে, বুঝে উঠতে পারল না। তবুও শাশুড়িমায়ের কথায় ঘাড় নেড়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই মা, তুমি আমায় শিখিয়ে দিও।’
টুকিটাকি কাজ চালানোর রান্না লোপা জানে। তবে এবাড়ির সকলেরই জিভের স্বাদ একটু বেশিই উন্নত। লোপা একদিন শখ করে একটু আলুর চপ বানিয়েছিল। সন্দীপের সে চপে নুন কম, শ্বশুরের তেল চপচপে লেগেছিল। তাই আর শখ করে কিছু করতে যায় না লোপা। একমাত্র অরুণাদেবী বলেছিলেন, ‘আমার বাপের বাড়িতে একটা বিখ্যাত চপের দোকান ছিল। সুবোধের আলুর চপ। ঠিক যেন অমন স্বাদ পেলাম বহুদিন পরে।’
সন্দীপের দিদি সুদীপা ফোনে শুনে হেসে বলেছিল, ‘দেখো লোপা, আমাদের বাড়িটাকে আবার ছা-পোষা মধ্যবিত্ত চপ-মুড়ির বাড়ি করে দিও না। ভাইয়ের পছন্দের ডিশ কন্টিনেন্টাল। পারলে ইউটিউব দেখে ওগুলো বানানোর চেষ্টা করো।’
না, আর চেষ্টা করেনি লোপা।
অরুণাদেবী বললেন, ‘তুমি এবাড়ির বউ। আমার পরে এই বাড়ির দায়িত্ব তোমার। জয়ন্তী সব করে ঠিকই কিন্তু মাথার ওপরে একজনের নির্দেশ ছাড়া সে চলতে পারে না। তাই একটু একটু করে জেনে নাও এই বাড়ির নিয়মকানুনগুলো।’
জয়ন্তীদি শ্বশুরের দুপুরের চিকেন স্টু বানাচ্ছিল। রবিবারের দুপুরে বাড়ির সকলের জন্য মটন রান্না হলেও শ্বশুরমশাইয়ের যেহেতু হাই প্রেশার তাই সহদেবদা ছোট মুরগি নিয়ে আসে বাজার থেকে। চিকেন স্টু খান উনি। মটন খেতে বারণ করে দিয়েছেন মল্লিক ডাক্তার। মানে এবাড়ির হাউজ ফিজিশিয়ান ডক্টর আঙ্কেল। ডক্টর অঙ্কেলদের সঙ্গে এবাড়ির সম্পর্ক বহু পুরোনো। সন্দীপের দাদু সনাতন গোস্বামী ছিলেন এই চত্বরের বিখ্যাত ডাক্তার। তখন থেকেই মল্লিক আঙ্কেলের বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব। সেই থেকেই দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা। মল্লিক আঙ্কেল বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ডাক্তার হন। সনাতন গোস্বামীর বাড়ির আর কেউ ডাক্তার হননি। সন্দীপদের এই বিশাল বাড়ি, এত সম্পত্তির অধিকাংশই ওর দাদুর করে দেওয়া।
বনেদি বংশ বলেই সন্দীপের এত অহংকার। দিনরাত ব্লু ব্লাড বলে বলে লোপার মধ্যে একটা হীনমন্যতা জাগিয়ে তুলেছে। এমনকী ফুলশয্যার দিনে লোপাকে আদর করার আগে একটা গিনির হার পরিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘এটা আমার ঠাম্মার হার। নাতবউয়ের জন্য রেখে গিয়েছিলেন। বনেদি ব্যাপারটা ঠিক বুঝবে না হয়তো তুমি। কিন্তু এটা মূল্য রাখার চেষ্টা করো।’
কেন কে জানে এরপর সন্দীপের গভীর চুম্বনে লোপার মুখটা তেতো হয়ে গিয়েছিল, আচমকা একটা বিতৃষ্ণা এসে বাসা বেঁধেছিল খোঁপায় জড়িয়ে রাখা জুঁই ফুলের গন্ধে। তবুও সন্দীপ ওর স্বামী আর এই দিনটাকে ঘিরে অনেক রঙিন স্বপ্ন এঁকেছিল চোখের কাজল, তাই সুখ খুঁজতে সন্দীপের আদরে ভাসতে চেষ্টা করেছিল লোপা।
কথায় কথায়, ‘মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে লোপা, তুমি এখন গোস্বামী বাড়ির বউ।’ এই শুনতে শুনতে মাত্র কয়েকমাসেই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে লোপা। যদিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ওর ছবি দেখে বন্ধুরা ধরেই নিয়েছে হলুদ বন থেকে ও সুখের ঘরের চাবিকাঠিটা একাই আত্মসাৎ করে ফেলেছে। কারণ ওর ঠোঁটের হাসিটা সেখানে চিরস্থায়ী।
অফিস কলিগরাও কথায় কথায় বলে, ‘তোমার তো ব্যাপারই আলাদা লোপা। সুখ, শান্তি, ভালোবাসা এসব তো স্বেচ্ছায় তোমার পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়েছে। তুমি কতটা গ্রহণ করবে আর কতটা বর্জন করবে সেটা তো শুধুই তোমার ইচ্ছে।’
লোপা হাসে। ছোটমাসি বলেছিল, ‘সুখ মনে করলেই সুখ।’ সেটাই মনে করার চেষ্টা করে। এমনই কাটছিল দিনগুলো। রাতে একবার সন্দীপের সঙ্গে ভিডিও চ্যাট, ওখানের দিনগুলো ওর কেমন কাটছে তার ইতিবৃত্ত, ব্যস এইটুকুই।
সন্দীপ ফিরে আসবে খুব তাড়াতাড়ি। বাড়িতে খুশির হাওয়া বইছে। লোপার মনে ভয়। লোপা কী জানে না যে মডার্ন জগতের হিসেবের খাতাটাও যে সঙ্গে করেই আনবে সন্দীপ। আর বাড়ির সব পরিচারিকাদের সামনেই মজার ছলে বুঝিয়ে দেবে, লোপা একটা নিতান্ত সাধারণ মেয়ে। বুল্টি তো একদিন ঘর মুছতে মুছতে দাদার কথাতে হেসে কুটোপাটি হচ্ছিল। কারণ সন্দীপ খাবার টেবিলে বলেছিল, ‘লোপা তুমি ড্রাইভিং জানো না, তাই না? বিয়ের আগে তাহলে কলেজ যেতে কীসে? প্লিস, আমাদের বুল্টির মতো হারকিউলিস সাইকেল চালাতে বলো না যেন। মিনিমাম স্কুটি বলো।’
লোপা ব্রেডে কামড় দিয়ে বলেছিল, ‘পাবলিক বাসে যেতাম। কলকাতা শহরের নাইনটি পার্সেন্ট স্টুডেন্ট যেভাবে কলেজ যায়।’
বুল্টি ঘর মুছতে মুছতে হেসে উঠেছিল। বৌদি তার মানে তার থেকেও কমা, সাইকেলও ছিল না, ভেবে বেশ মজা পেয়েছে। আর সন্দীপ সবাইকে হাসিয়ে মজা নিয়েছে।
তাই অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে যে লোপার না পারার তালিকাটা কত বড় সেটা বুঝিয়ে দেবে সন্দীপ সকলের সামনেই। আর ভাই ফেরার আনন্দে সুদীপাদি নিশ্চয়ই আসবে। দুই ভাইবোন একসঙ্গে হওয়া মানেই লোপা বুঝতে পারে ও কতটা খুঁতযুক্ত মানুষ। গুড ফর নাথিং।
জয়ন্তীদি চিকেন স্টুটা নামিয়ে বলল, ‘দেখ বৌমনি, জেঠু কিন্তু স্টু’তে বাটার খায় না। অল্প গোলমরিচের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেই হবে।’
ঠিক সেই সময়েই জয়ন্তীদির ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভ করেই বলল, ‘বলিস কি রে সুকান্ত, সে ফিরে এসেছে? একা না দোকা কিছু দেখেছিস? আমি আজ বিকেলেই যাব।’
অরুণাদেবীর কপালে ভাঁজ পড়ল। সেটা লোপার নজর এড়াল না। জয়ন্তীদি ছাড়া গোস্বামী বাড়ি যে একদিনও চলবে না, সেটা এই তিনমাসে বেশ বুঝতে পেরেছে লোপা। এরা সবাই জয়ন্তীদির ওপরে ভীষণ রকমের নির্ভরশীল। আর জয়ন্তীদিও খুব ভালো, সকলের বড্ড খেয়াল রাখে। এ যেন তার নিজের বাড়ি।
সন্দীপের মা বলেন, ‘মাত্র পনেরো বছর বয়সে নাকি জয়ন্তীর মা ওর বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের ছ’মাস যেতে না যেতে বর বোম্বে চলে গিয়েছিল হিরো হবে বলে। তারপর আর ফেরেনি। সেই থেকেই জয়ন্তী এবাড়িতে। ওর মা এবাড়ির পরিচারিকা ছিল। তাই নিজের মেয়েকে অরুণাদেবীর সামনে এনে বলেছিল,
‘জয়ন্তীর কপাল পুড়ল, ওর বর ওকে ছেড়ে পালিয়ে গেল। এমন সোমত্ত মেয়েকে তো আর যার তার বাড়িতে দিতে পারি না, যদি তোমরা রাখো তো নিশ্চিন্ত হই।’ বুকুন তখন বছর পাঁচেকের আর তিতলি আট। পনেরো বছরের জয়ন্তী সেদিন থেকেই রয়ে গেল ওদের দিদি হয়ে।’
জয়ন্তীদির চোখে জল। হাতটা বেসিনে ধুয়ে বলল, ‘জেঠিমা, আমায় একবার গোপালপুর যেতেই হবে। সুকান্ত মানে আমার খুড়তুতো ভাই বলল, তিনি নাকি ফিরে এসেছেন। এসেই আমার খোঁজ করছেন।’
অরুণাদেবী বললেন, ‘কে ফিরে এসেছে সেটা তো বল।’
জয়ন্তীদি নিজের সিঁথির সিঁদুরে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘আমার স্বামী জেঠিমা। এতকাল পরে তার আমার কথা মনে পড়ল।’
জয়ন্তীদির বর্তমান বয়স পঞ্চাশ তো হবেই। সিঁদুর পরতে পরতে সিঁথি চওড়া হয়েছে, সিঁথির পাশের চুলে পাক ধরেছে। হাতের শাঁখায় গোস্বামী বাড়ির হেঁসেলের হলুদ-লঙ্কার ছোপ লেগে লেগে লালচে রং হয়ে গেছে। তার মনেও যে স্বামী সম্পর্কে এতটা আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, ধারণাই ছিল না লোপার। এখনও এই মানুষটা মনে মনে অপেক্ষা করত তার ফিরে আসার!
অরুণাদেবী একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তাতে তোর কী জয়ন্তী? বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে তোকে একলা ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল সেই লোকটা। তুই বাঁচালি কী মরলি সে খবর অবধি নেয়নি। তোকে তোর শ্বশুরবাড়ির লোক অপয়া বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এসব ভুলে গেলি? সে এসেছে শুনে অমনি ছুটছিস? সত্যি তোদের আর লজ্জা হবে না রে।’
জয়ন্তীদি মাথা হেঁট করে বলল, ‘কী করব গো জেঠিমা, অগ্নিসাক্ষী করে মন্ত্র বলে বিয়ে করেছিল যে। না গেলে ওপরে গিয়ে জবাব দেব কী?’
অরুণাদেবীর চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ। তবুও শেষ চেষ্টা করে বললেন, ‘আদৌ কি সত্যি ঘটনা এটা? এত বছর পরে চিনবি কী করে তাকে?’
জয়ন্তীদি চোখে জল নিয়ে একমুখ হেসে বলল, ‘তার নাকের পাশে বড় আঁচিল আছে যে। লুকোনোর পথ পাবে না ওটা।’
ওদের কথার মাঝেই শ্বশুরমশাই ড্রয়িংরুম থেকে উঠে এসে বললেন, ‘যেখানে যাচ্ছিস যা। দু’দিনের বেশি থাকবি না। তুই তো জানিস গোস্বামী বাড়ি তুই ছাড়া অচল। টাকা নিয়ে যাস আমার কাছ থেকে।’
জয়ন্তীদি যে এমন আচমকা চলে যাবে সেটা লোপাও বোঝেনি। এবাড়ির নিয়মকানুন বুঝতে এসে মহা সমস্যা হল। অরুণাদেবী রীতিমতো মাথায় হাত দিয়ে বসে বললেন, ‘এই লোপা এই ক’দিন কী করে চলবে বলো দেখি?’
লোপা বলল, ‘আমি অফিস যাওয়ার আগে না হয় একটু রান্না সেরে রেখে যাব।’ অরুণাদেবী বললেন, ‘অমন মনে হয়। পরশু দুই ভাইবোনেই আসছে। এদের বায়না সামলাবে কে? রান্না খারাপ হলে আমার সামনে তোমায় অপমান করবে। আমি বরং মালতিকে বলে একবার দেখি, ও যদি কাউকে ক’দিনের জন্য দিতে পারে। রান্নার হাত ভালো হতে হবে তার। তাছাড়া তুমি এত কষ্ট করবেই বা কেন? গোস্বামী বাড়ির সম্ভ্রমের গল্প করবে বাড়ির সবাই, আর নতুন বউ রান্না করে অফিস করবেই বা কেন?’
লোপার চোখে জল চলে এসেছিল। লোকে বলে শাশুড়িকে নিয়েই নাকি সব থেকে বেশি প্রবলেম হয় শ্বশুরবাড়িতে। লোপার তো এবাড়িতে ভালোবাসা পাওয়ার জায়গাই এটুকু। যেখানে ওকে মধ্যবিত্ত, ছা-পোষা, ব্যাকডেটেড এসব বলে ক্ষতবিক্ষত করা হয় না, বরং সবসময়ই প্রশ্রয়ের হাতটা থাকে ওর মাথায়।
এটুকুই লোপার সুখ এবাড়িতে। না শুধু এটুকু বললে হবে না। সহদেবদা বাগানের দক্ষিণ দিকে দুটো চৌবাচ্চা করে তাতে পদ্ম ফুটিয়েছে। কবে তাতে নতুন কুঁড়ি আসবে এটার প্রতীক্ষাটাও লোপার একটা মস্ত বড় সুখ। লোপার শাশুড়িমাও ওর মতো মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি থেকেই এবাড়ির বউ হয়ে এসেছিলেন। তাই বিশেষ সম্মান যে এবাড়িতে তিনি পাননি, সেটা বেশ বোঝা যায়। তাছাড়া শ্বশুরমশাইও নিজের জগতে ব্যস্ত থাকেন। কোনোকালে অরুণাদেবীকে তেমন গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হয় না। তাই হয়তো তিনি লোপার অপমানের জ্বালাটা বোঝেন।
মালতি এবাড়ির ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া-মোছার লোক। তিনতলা বাড়ি মোছামুছি করতেই হাঁপিয়ে যায় মালতি।
কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বিরক্ত মুখে বলল, ‘এই রাজপ্রাসাদ মোছার পরে যেন আমায় রান্নাঘরের দায়িত্ব নিতে বলো না। আমি পারব না। জয়ন্তীদি তার সোয়ামীকে পেয়ে গেছে, আর ফিরবে কিনা জানি না। আমি এই ঝামেলার হেঁসেল ধরতে পারব না।’
অরুণাদেবী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কী আমার দ্রৌপদী এলেন রে! এককাপ চা করতে বলেছিলাম একদিন, পাঁচন বানিয়ে এনেছিলিস, মনে নেই? তোকে কে রান্নার দায়িত্ব দেবে রে? তুই আমায় একটা ভালো লোক দেখে দে।’
মালতি একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘তাহলে ঐ চৌধুরী বাড়িতে নতুন ঢুকেছে সুমনাকে ডাকব? সে কিন্তু শিক্ষিত মেয়ে। জয়ন্তীদির মতো নয়। সাইকেলে করে রান্না করতে আসে। ওর বর হোম সার্ভিসের ব্যবসা করে। সব বাড়ি বাড়ি খাবার দিয়ে বেড়ায়। ও-ই সেসব রান্না করে শুনেছি। তারপর ওই চৌধুরী বাড়িতেই শুধু কাজটা ধরেছে। আর কাজ করবে কিনা জানি না অবশ্য। বলে দেখতে পারি।’
অরুণাদেবী বললেন, ‘তুই আর দেরি করিস না। একবার ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে ডেকে নিয়ে আয়।’
লোপা বেশ বুঝতে পারছিল মা চিন্তায় পড়ে গেছেন। সন্দীপ আর সুদীপার যা খাওয়ার ফিরিস্তি সেটা জয়ন্তীদি বলেই সামলাত। অন্য কেউ এসে এত যত্ন নিয়ে করবেই বা কেন! জয়ন্তীদির নিজের বাড়ির মতো হয়ে গেছে তাই করে।
লোপা ধীর পায়ে পদ্মের চৌবাচ্চার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। চারটে কুঁড়ি এসেছে। গোলাপি পদ্ম। পাতাগুলো নিজেদের গায়ে একফোঁটাও জল দাঁড়াতে দেবে না প্রতিজ্ঞা করেছে যেন। পাঁকে ফুটলেও নিজের গায়ে পাঁক মাখতে কিছুতেই রাজি নয় পদ্ম সুন্দরী নিজেও। হাওয়া দিলেই সবজে পাতাগুলো যেন হেসে কুটোপাটি করছে। ঠিক যেন প্রাইমারি স্কুলের টিফিনবেলা। অকারণ ঠেলাঠেলি আর হাসাহাসির ধুম পড়ে গেছে। জলে আলপনা এঁকে যাচ্ছে পাতার স্পন্দন। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লোপা। আগামীকাল সন্দীপ ফিরবে। ওর খুব আনন্দ হওয়ার কথা। নতুন বিয়ের ক’দিনের মধ্যেই সন্দীপ অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছিল। দীর্ঘ বিরহের পরে ওর স্বামী ফিরছে ওর কাছে, স্বাভাবিকভাবেই মনে মনে উৎফুল্ল হওয়ার কথা। কিন্তু কেন কে জানে লোপার এমন কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। জয়ন্তীদি তার এতদিনের ছেড়ে যাওয়া স্বামী ফিরে এসেছে শুনে যেভাবে ছুটল, তাতে বেশ বোঝা গেল জয়ন্তীদি মানুষটাকে ভালোবাসে। লোপা কেন পারছে না সন্দীপকে ভালোবাসতে! কেন মনে হচ্ছে সন্দীপ বাড়িতে ঢুকেই প্রথম মন্তব্যটা করবে, ‘কী গো এখনও তুমি তোমার ওই ক্লার্কের জবটার মায়া ত্যাগ করতে পারোনি? ওটা ছাড়বে কবে? পৃথিবীটা দেখবে কবে? ও জব ছাড়ো, চলো নেক্সট ট্যুরে তোমায় নিয়ে যাব।’
বড্ড অপমানিত বোধ করে লোপা। অনেকগুলো চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ওকে পেতে হয়েছে এই চাকরিটা। এবং রেলের এই চাকরিটা পাওয়ার পরে বন্ধুরা বলেছিল, ‘তুই তো লাকি রে, একেবারে সেন্ট্রালে পেয়ে গেলি?’
এতদিন পর্যন্ত ও জানত এটা ওর বড় অ্যাচিভমেন্ট। সন্দীপের তাচ্ছিল্যের ফলে লোপা বুঝতে পারছে ওর মধ্যে মারাত্মকরকম একটা নেগেটিভিটি কাজ করছে। এসব ছাড়িয়ে সন্দীপকে কিছুতেই আপন করে ভালোবাসতে পারছে না ও।
একটা বেগুনি রঙের বোগেনভেলিয়া গাছ ওদের গেটের মাথাটাকে রঙিন করে রেখেছে। সেদিকে তাকাতেই দেখল মালতি প্রায় ছুটতে ছুটতে ঢুকছে। ওর সঙ্গে একজন মেয়ে, চুড়িদার পরে লম্বা বিনুনি করে একটু সংকোচের সঙ্গে আসছে।
মালতি বলল, ‘এই যে জেঠিমা এই আমাদের সুমনাদিদি। মুখে সবসময় হাসিটি লেগে থাকে।’
সুমনা অরুণাদেবীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, ‘বলুন জেঠিমা, কেন ডেকেছিলেন?’
অরুণাদেবীর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সুমনাকে বেশ মনে ধরেছে। সুমনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রান্নাবান্না সব পারো তো?’
সুমনা শান্তভাবে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘সব পারি। আমার স্বামী হোম সার্ভিসের ব্যবসা খুলেছে। প্রায় কুড়িজন কাস্টমার হয়েছে আমাদের। সব রান্না আমিই একা হাতে করি। চৌধুরী বাড়ির কাজটা আমায় ছেড়ে দিতে হবে। ওদের যে কাজ করত সেই পুরোনো রাঁধুনি ফেরত এসেছে।’
শুদ্ধ উচ্চারণ, সুন্দর কথা বলার ভঙ্গিমা সুমনার। তাই একটা কাজ আমি খুঁজছিলাম। আমি কিন্তু সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে কাজ করে বাড়ি চলে যাব। তারপর আমায় হোম সার্ভিসের রান্না করতে হবে। আবার বিকেলে আসব সাড়ে চারটে নাগাদ। চলবে?’
জয়ন্তী একবেলা নেই তাতেই যেন নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। এত বাছাবাছির সময় নেই। পেয়েছেন এই না কত। লোপাকে হাত নেড়ে ডাকলেন অরুণাদেবী। একটু অস্বস্তি নিয়েই এসে দাঁড়াল লোপা।
সুমনা বলল, ‘বৌদি, আজকের রাতের রান্না কী কী করতে হবে তাহলে তুমি দেখিয়ে দিও।’
লোপা ঘাড় নাড়ল।
অরুণাদেবী বললেন, ‘মাইনে কেমন নেবে বলো দেখি।’
সুমনা দৃঢ় স্বরে বলল, ‘আট হাজারের কমও না বেশিও না।’
মালতি বলল, ‘একটু কম করো গো সুমনাদি।’
সুমনা হেসে বলল, ‘আমার কাজে ফাঁকি পাবে না। মাইনে আমি এটাই নেব। এতগুলো লোকের রান্না এর কমে করব না।’
অরুণাদেবীর টাকার অভাব নেই। তাড়াতাড়ি বললেন, ‘যা চাইছ তাই হবে। কিন্তু কামাই করবে না। করলে আগে জানিয়ে দেবে।’
লোপা ওকে রান্নাঘর দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘রাতে মটর পনির আর ডাল মাখানি করতে হবে। দেখো রান্না যেন ভালো হয়।’
সুমনা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘খেয়েই দেখো না।’
লোপা আর অরুণাদেবী মিলে সুমনাকে মোটামুটি বুঝিয়ে দিয়েছেন। রাতে খাবার টেবিলে শ্বশুরমশাই যে কথাটা প্রথম বললেন, ‘আরে রান্নাটা কি ওই নতুন মেয়েটা করল নাকি? এ যে দুর্দান্ত টেস্ট!’
সত্যিই সুমনার হাতের রান্না খেয়ে প্রশংসা করতে হবে। অরুণাদেবী বললেন, ‘নিশ্চিন্ত হলাম। বুকুন তিতলি এসে ঝামেলা বাঁধবে না।’
লোপা আজ অফিসে যাবে না। সন্দীপ বাড়ি ফিরছে, আজ অফিস গেলে দৃষ্টিকটু লাগে। তাছাড়া ও নিজেও সম্পর্কের ভিতটা তৈরি করতে চায়। বেডরুমটা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। ফুলদানিতে রজনীগন্ধা, বিছানায় নতুন বেড কভার, সুন্দর করে গোছানো সন্দীপের ল্যাপটপ টেবিল। নিজেও পরিপাটি করে সেজে নিয়েছে। খুব বেশি কিছু না হোক, চোখে হালকা কাজল টেনেছে আর ঠোঁটে নরম লিপস্টিক। লোপাকে অবশ্য সাজতে হয় না বেশি। এমনিতেই সে চোখে পড়ার মতো সুন্দরী।
ওপরের ব্যালকনি থেকে রাস্তাটা দেখা যায় পরিষ্কার। ওখানেই বেতের চেয়ারে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল লোপা। এয়ারপোর্টে নেমে গেছে সন্দীপ ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে লোপাকে। ওয়াশরুমে সন্দীপের ফ্রেশ পোশাক রেখে দিয়েছে লোপা।
রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখে পড়ল, সুমনা একটি ছেলের সাইকেলে চেপে আসছে। নিজের সাইকেল নেই আজ। ছেলেটার বয়স সুমনার থেকে বছর দুই তিনের বড়ই হবে। সাইকেলের রডে বসে আছে সুমনা। ছেলেটা একহাতে সাইকেল চালাচ্ছে একহাতে ছাতাটা ধরে আছে সুমনার মাথায়। এত যত্ন করে ধরে আছে ছাতাটা যে, সূর্যদেবের ক্ষমতা নেই ওটা ভেদ করে সুমনার মাথায় রোদের ছোঁয়াটুকুও লাগাবে।
গোস্বামী বাড়ির সামনে সাইকেল থেকে নেমেই নিজের ওড়না দিয়ে ছেলেটার মুখটা ভালো করে মুছে দিল সুমনা খুব অভ্যস্ত ঢঙে। তারপর আরও দু-একটা কথা বলে এগিয়ে এল বাড়ির গেটে। ছেলেটা সুমনার বাড়িতে ঢোকা পর্যন্ত অপেক্ষা করে চলে গেল বাজারের দিকে। সকালের নরম রোদে দেখা তুচ্ছ দৃশ্যটাও যেন বড্ড মূল্যবান মনে হল লোপার চোখে।
সুমনার ঠোঁটের কোণে সুখী সুখী একটা হাসি যেন লেগেই রয়েছে। চোখের দৃষ্টিতেও তারই পুনরাবৃত্তি।
বেশ লাগছিল দেখতে লোপার। সুমনা ঢুকতেই নীচ থেকে যে ডাক পড়বে সেটা জানে লোপা। তাই সময় নষ্ট না করে নীচে নেমে গেল।
সুমনার হাতে হাতে এটা ওটা দিতে দিতে লোপা বলল, ‘বিয়ে কতদিনের?’
সুমনার শ্যামলা গালে যেন এই সামান্য কথাতেই আবিরের ছোপ লাগল। মিষ্টি গলায় বলল, ‘বছর পাঁচেক হল। কৌশিকের সঙ্গে আমার প্রেম করে বিয়ে।
আমার মামার বাড়ির কাছে ওরও মামার বাড়ি। ওখানেই পরিচয়। বাড়ি থেকে বিয়েটা দিতে চায়নি। কিন্তু আমি কৌশিকের হাত ছাড়তে নারাজ ছিলাম। কৌশিক একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করত। এই কোভিড পরিস্থিতির জন্য চাকরিটা চলে গেল ওর। তখন বাধ্য হয়ে আমরা দুজনে মিলে এই খাবার হোম ডেলিভারির ব্যবসাটা খুলে বসলাম। আরেকটু পুঁজি দরকার বলেই আমি এক বাড়িতে রান্নার কাজ নিলাম। এক বছর করলেই ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে যাবে। তখন আর কৌশিককে এত পরিশ্রম করতে হবে না।’
লোপা বলল, ‘পরিশ্রম তো কৌশিকের থেকে তোমার বেশি হয় মনে হচ্ছে।’
সুমনা বলল, ‘না না। আমি আর এমন কী করি একটু খুন্তি নাড়া ছাড়া? ও তো বাজার করে, সব টিফিন কৌটোতে প্যাক করে, বড় বড় হাঁড়ি কড়া মাজে, তারপর লোকের বাড়ি বাড়ি দিতে যায়। প্রচুর পরিশ্রম করে কৌশিক। আমায় সুখে রাখার জন্য সব করতে পারে ও।’
লোপা অবাক হয়ে দেখছিল সুমনাকে। অন্যের বাড়িতে রান্না করতে আসা মেয়েটাও সুখের সংজ্ঞা জানে। ও জানে ওর হাজবেন্ড ওর সুখের জন্য সব করতে পারে।
সুমনা কৌশিকের নামে প্রশংসা শুরু করলে আর থামে না, এটা খেয়াল করল লোপা।
সন্দীপ বাড়ি ফিরে লোপাকে প্রথম কথাটাই বলেছে, ‘যাক বাঁচালে। অবশেষে জবটা তুমি ছেড়ে দিয়েছ। এই ক’দিন গোস্বামী বাড়ির আভিজাত্য দেখে নিশ্চয়ই আর বাসে করে চাকরি করতে যেতে ইচ্ছে করছে না। খুব ভালো করেছ লোপা। তুমি এখন সন্দীপ গোস্বামীর বেটার-হাফ। এবারে তোমায় এসব মিডলক্লাস মেন্টালিটি থেকে বেরোতে হবে। তাও যদি বুঝতাম দিদির মতো কলেজের প্রফেসর। তা নয় রেলের গ্রুপ ডি কর্মচারীর সম্মান বলে কোনো বস্তু আছে নাকি!’
সন্দীপের হাতে জলের গ্লাসটা ধরিয়ে দিয়ে লোপা বলল, ‘আজ তুমি ফিরবে বলে ছুটি নিয়েছি। আগামীকাল অফিস আছে। ওয়াশরুমে তোমার ফ্রেশ পোশাক রাখা আছে। চেঞ্জ করে নাও। আমি ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসছি।’
সন্দীপ বিরক্ত গলায় বলল, ‘ওহ্, নারী স্বাধীনতার ভূত তো আবার সহজে মাথা থেকে নামার নয়।’
লোপার মনটা মুহূর্তে বিরক্তিতে ভরে গেল। চোখের কোণের কাজল, ঠোঁটের নরম লিপস্টিক ব্যঙ্গ করল যেন। কারণ, লোপা ভেবেছিল এতদিন পরে হয়তো সন্দীপ এসেই ওকে জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘মিস করছিলাম।’ অথবা ‘কী মিষ্টি লাগছে আমার বউটাকে।’ না, ভাবনাগুলো সত্যি হয় না লোপার।
সুমনার ব্রেকফাস্ট বানানো হয়ে গেছে। দুপুরের রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। রান্না করতে করতেই ফোনে কথা বলছে। ‘এঁচোড় তুমি কাটতে যেও না কৌশিক। হাত কাটবে। আমি গিয়ে কেটে নেব। সবেতে ওস্তাদি কিন্তু আমার ভালো লাগে না। ন্যাকা, বউ যেন আর কারোর হয় না। শোনো, আমার এত ভালোবাসার দরকার নেই। তার থেকে আমার কথাটা শুনলে খুশি হব।’ ফোনটা কেটেই বলল, ‘ধুর, একটা কথা শোনে না লোকটা। হাত কেটে একটা কাণ্ড না বাঁধিয়ে রাখে।’
লোপা সুমনার ভালোবাসার উত্তাপে উষ্ণ হতে হতে সন্দীপের জন্য ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে নিল একটা থালায়।
সুমনা ওকে দেখে লজ্জিত গলায় বলল, ‘তোমরা তরকারিতে ঝাল বেশি খাও না কম?’
লোপা ছোট্ট করে বলল, ‘কম খাই। মাঝারি দিলেই হবে।’
লোপা ঘনঘন তাকিয়ে দেখছিল সুমনার মুখে দিকে। সুমনা একেবারে স্বাভাবিক দেখেই নিশ্চিন্ত হয়ে ওপরে উঠে গেল।
সন্দীপ ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলছে। ইশারায় খাবারের প্লেটটা দেখিয়ে বারান্দায় চলে এল লোপা।
মেঘ করেছে আকাশ জুড়ে। ঠিক ওর মনের মতো। কিন্তু কোনো একটা পিছুটানের জন্যই বোধহয় ঝমঝমিয়ে নামতে পারছে না গাল, চিবুক, বুক বেয়ে। কিন্তু বৃষ্টি নামটা খুব দরকার। গুমোট হয়ে আর কতদিন? নিম্নচাপ হয়ে থাকলে ক্ষত বাড়ছে ক্রমাগত। বৃষ্টি আসুক প্রবল বেগে, ক্ষতগুলো ধুয়ে যাক নোনতা জলে। প্রলেপ পড়ুক মনের গভীরে। মেঘেদের দিকে তাকিয়ে আছে লোপা। কেন সন্দীপের সঙ্গে এভাবে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে? কেন কিছুতেই ওকে আঁকড়ে ধরতে পারছে না ও?
রাস্তায় চোখ পড়ল। কৌশিক মানে সুমনার স্বামী দাঁড়িয়ে আছে গেটের বাইরে। সুমনার সাইকেলটা দোকানে দিয়েছে, বেলটা কাজ করছিল না বলে। তাই কৌশিক আজ ওকে নিয়ে এসেছে। কৌশিক অপেক্ষা করছে। লোপা দেখল নেহাতই সাধারণ চেহারার মানুষ। চেহারায় কোনো বিশেষত্ব প্রকাশ পায় না। শুধু অপেক্ষার ভঙ্গিমাটি বড় মনকাড়া। লোপার মনে হল, সুমনা সত্যিই খুব ভাগ্যবতী। দিনের শেষে একজন আছে যে ওর জন্য অপেক্ষায় আছে। একটা ভরসার কাঁধ আছে যেখানে ও ক্লান্ত মাথাটা ঠেকাতে পারে।
সুমনার গলা পেল, ‘জেঠিমা এলাম গো। সব করে টেবিলে ঢাকা দিয়ে রেখেছি। মালাইকারিটা মাইক্রোওভেনের বক্সে রেখে দিলাম। যদি গরম করো তাই।’
সুমনাকে দেখেই কৌশিকের মুখে হাসি ফুটল। যেন কতজন্ম পরে ওদের দেখা হল। মাঝের ঘন্টাতিনেক যেন কত বিরহে কাটিয়েছে। সত্যি, অপেক্ষা যে এত সুন্দর হয় জানা ছিল না লোপার। কারণ ও এতদিন একজনের অপেক্ষায় ছিল। ঘরদোর সাজিয়ে, নিজেকে গুছিয়ে বসেছিল। কিন্তু যার প্রতীক্ষায় ও ছিল, সে যেন এসে অবহেলায় বলে গেল, এসবের দরকার নেই। এত সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই!
সুমনা হাসতে হাসতে কিছু একটা বলল। কৌশিক হাত নেড়ে আইসক্রিমওয়ালাকে ডাক দিল। দুজনে দুটো আইসক্রিম নিয়ে অকারণে হাসতে হাসতে চলে গেল।
লোপার মেঘলা মনে কয়েকফোঁটা বৃষ্টি পড়ল যেন। সঙ্গে একটা অবুঝ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
সন্দীপ খেতে খেতেও কল করছিল। এখন ঘরে ঢুকে লোপা দেখল ও ঘুমাচ্ছে।
ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল লোপা। সন্দীপ এককথায় সুপুরুষ। ছাদনাতলায় সবাই প্রকাশ্যে বলছিল, ‘কী মানিয়েছে বর-বউকে।’
লোকের এসব টুকরো কথার স্রোতে অনেক অনুভূতিই গলার কাছে দলা পাকিয়ে এসেছিল লোপার। মনে হচ্ছিল সন্দীপের কানে কানে অনেক কিছু বলতে। কিন্তু আচমকাই যেন শব্দভাণ্ডারে টান পড়েছিল ওর। বলা হয়ে ওঠেনি কিছুই। শুধু সুখানুভূতিতে লাইনার পরা চোখের পাতাটা ভিজে ছিল।
আজও ইচ্ছে করছে ঘুমন্ত সন্দীপের কপালে একটা চুমু এঁকে দিতে। যেভাবে আকাশের বুকে চুম্বন করে বিদায়ী বেলার চাঁদ, ঠিক তেমনই। কিন্তু সন্দীপের ঘুম ভেঙে গেলে হয়তো বলবে, ‘ফ্লাইটে তো কখনো লং জার্নি করোনি। তাই ক্লান্তিটা বোঝো না। ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে তো আমার! এসব করার জন্য তো গোটা রাত ছিল লোপা।’
লজ্জায় অধোবদন হয়ে যাবে ও। প্রত্যাখ্যাত হওয়ার থেকে উপেক্ষিত হওয়া ভালো। সন্দীপ বুঝবেই না, ইচ্ছেগুলোর ইচ্ছেও হঠাৎ করেই হয়। সে রাতের জন্য অপেক্ষা করে না।
পাশের ঘরে গিয়ে একটা বই নিয়ে বসল লোপা। উফ একটা গোটা দিন অফিস না গিয়ে এবাড়িতে কাটানো সত্যি কঠিন। আজ বিকেলে সুদীপাদি আসবে। ভাবতেই ভয় ভয় করছে। আবার দুই ভাইবোনের মজা শুরু হবে ওকে কেন্দ্র করে। কতরকমভাবে যে মানুষ আনন্দ পেতে চায়, এদের না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। লোপাকে দুজনে মিলে ছোট করে অদ্ভুত একটা স্যাডিস্টিক প্লেজার পায়। লোপার মুখ নীচু দেখলে এদের হাসি পায়।
বিকেলে সুমনা এল। ছোট্ট একটা টিফিন কৌটো ওর হাতে লুকিয়ে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘খেও।’
সুদীপা ঢুকেই বলল, ‘জয়ন্তীদি নেই মা? এই ক’দিন তবে বাইরে খাবার অর্ডার করতে হবে।’
সন্দীপ বলল, ‘নতুন যাকে মা কাজে লাগিয়েছে, খুব ভালো না হলেও চলে যাবে বুঝলি!’
লোপা দেখেছে লাঞ্চ টেবিলে সুমনার রান্না করা মালাইকারি সন্দীপ প্রায় চেটে খেয়েছে, তবুও প্রশংসা করতে বড্ড কষ্ট এদের।
সুদীপা লোপাকে দেখে বলল, ‘তুমি আজ অফিস যাওনি মনে হচ্ছে। স্যালারি কাটবে না তো গ্রুপ ডি’দের? আসলে আমি ঠিক জানি না কিনা!’
ওদের কথার টুকটাক উত্তর দিয়ে লোপা ছাদে উঠে এসেছে। সুমনার দেওয়া ছোট্ট টিফিন কৌটোতে কী আছে দেখার আগ্রহই ওকে ছাদে টেনে এনেছে। খুলতেই বহু পুরোনো অথচ পরিচিত একটা গন্ধ ওর নাকে এসে ঝাপটা দিল। কয়েতবেল মাখা রয়েছে বেশ লঙ্কা দিয়ে। জিভে দিতেই সেই পুরোনো পরিচিত স্বাদটা!
এক নিমেষে লোপা পৌঁছে গেল ওদের বিনোদিনী বালিকা বিদ্যালয়ের টিফিন টাইমে। গেটের ঠিক বাইরেই বসত রামদুলাল কাকা। কয়েতবেল নিয়ে। সঙ্গে নুন, লঙ্কা, তেল আর অল্প মিষ্টি দিয়ে বেশ করে মেখে কাঠের চামচ দিয়ে ধরিয়ে দিত ওদের হাতে। আহা, অমৃতও হার মানত। সমস্যা হত অন্য জায়গায়। বাড়ি ফিরে দাঁত জিভ দিয়ে আর কিছু খাওয়ার ক্ষমতা থাকত না। মা পিঠে গুম করে কিল দিয়ে বলত, ‘আজকেও ওই টক বেল খেয়েছিস?’
ওসব টুকটাক মার সহ্য করে নিত ওরা। কিন্তু কয়েতবেলের স্বাদ ছাড়তে নারাজ ছিল। লোপা নিশ্চিন্ত হল, সুমনা ওকে চিনে ফেলেছে। তাই হয়তো আজকে বেল মেখে এনেছে। নাকি এমনিই কাকতালীয় ব্যাপার! মনের দ্বন্দ্বকে আপাতত পাত্তা না দিয়েই অল্প খেল। এখন আর বেশি খাওয়ার অভ্যাস নেই। আবার কাল খাবে বরং।
ইদানীং রোজই টিফিনে ওর পছন্দের তরকারি পাচ্ছে লোপা। যেমন লাউ চিংড়ি এবাড়ির কেউ মুখেই দেয় না। অথচ অফিসে টিফিনবক্স খুলে লোপা দেখল ভাতের সঙ্গে লাউ চিংড়ি রয়েছে। অবাক হয়ে গিয়েছিল ও। বাড়ি ফিরে অরুণাদেবীকে জিজ্ঞাসাও করেছিল, ‘আজ কি বাড়িতে লাউ চিংড়ি হয়েছিল?’
অরুণাদেবী হেসে বলেছেন, ‘ধুর পাগলী। ও জিনিস এবাড়ির কেউ খায় নাকি?’
চুপ করে গেছে লোপা। আর কথা বাড়ায়নি।
সন্দীপের ব্যবহার দিন দিন অসহ্য হয়ে উঠছিল। লোপার যেন সবকিছুই খারাপ। প্রতি মুহূর্তে ওর দোষ না ধরলে সন্দীপের চলে না। এমনকী রাতে বিছানায় শুয়েও ওর বক্তব্য, লোপার শরীরে নাকি সেই উত্তেজনটাই নেই যেটা সন্দীপ চায়। লোপা বোঝাতে পারে না, মনখারাপ থাকলে শরীর কথা বলে না। মনের ভাঙা-গড়ার সঙ্গে শরীরেরও ছন্দপতন ঘটে। একঘেয়ে দীর্ঘ অপমানের পরে অপমানিত ব্যক্তির শরীর জাগে না আর। তবুও সেই অপমান করা ব্যক্তিকে নিজের শরীরের অধিকার দিতে বাধ্য হয় লোপা—এটাই তো ওর হেরে যাওয়া, বোধহয় এটাই ওর ভবিতব্য।
জয়ন্তীদি ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে, সে আর ফিরবে না। স্বামী ফিরে এসেছে তার কাছে। বাকি জীবনটা তাকে নিয়েই কাটাবে। ক’দিনের মধ্যে আসবে জমানো টাকা নিতে। বাড়ির সবাই অল্পবিস্তর বিরক্ত জয়ন্তীদির ওপরে। এমন নির্ঝঞ্ঝাট সর্বক্ষণের সঙ্গী চলে গেলে বিরক্ত হয় বৈকি মানুষ। জয়ন্তীদি যে কোনোদিন গোস্বামী বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে, এ যেন ধারণার বাইরে ছিল। যার তিনকুলে কেউ ছিল না, তার আবার নতুন করে এই বয়েসে এসে সংসার হবে কে জানত! এবাড়ির সকলের সুমনার রান্না পছন্দ হলেও, জয়ন্তীদির অভাব সকলেই অনুভব করছে। অরুণাদেবী সুমনাকে আরেকটু তোয়াজ করে চলছেন। যদি ছেড়ে চলে যায় তো আবার মুশকিল।
সেদিন বৃহস্পতিবার ছিল, সুমনা এল বেশ সেজেগুজে। মাথায় একটা বেলির মালা জড়িয়ে, সুন্দর লালচে শাড়ি পরে। বেশ মিষ্টি লাগছিল সুমনাকে। লোপা অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। সুমনাকে দেখে বলল, ‘আজ এত সাজগোজ! কী ব্যাপার?’
সুমনা নতুন বউয়ের মতো লজ্জায় রাঙা হয়ে বলল, ‘আজ যে ১০ই বৈশাখ গো। আমাদের বিয়ের দিন। তাই হোম সার্ভিস বন্ধ রেখেছি। এই রান্নাটা করেই বেরিয়ে যাব। কৌশিক বলেছে, আজ রেস্টুরেন্টে খাব আর সিনেমা দেখব। এই মালাটা ও জড়িয়ে দিল। লজ্জা করছিল রাস্তা দিয়ে আসতে কিন্তু ও কষ্ট পাবে বলে খুলিনি।’
লোপার খুব ভালো লাগে ওদের এই খুনসুটি ভরা প্রেমের গল্প শুনতে। অধরা জিনিসের প্রতি মানুষের লোভ চিরকালের। ভালোবাসা, আবদার কেমন হয়, বিয়ের পাঁচমাস পরেও বুঝল না লোপা। মুখ নীচু করে থেকেও সন্দীপের ভালোবাসার পাত্রী হয়ে উঠতে পারল না। তাই সুমনা আর কৌশিকের সবকিছু ও যেন মানস চোখে দেখে নিতে পারে। ঠিক সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো। লোপা নিজের ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে একটা নতুন শাড়ি বের করল। সুমনাকে শাড়িটা দেবে বলে। বিয়েতে পাওয়া শাড়ির শেষ নেই। অফিস যাতায়াতের জন্য তো কুর্তি, চুড়িদারই পড়ে।
শাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে আসার আগেই সন্দীপ বলল, ‘শোনো, তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। তোমার বাড়িতে কীসের একটা কালীপুজো আছে তাই নিমন্ত্রণ করলেন। আমি এসব চিপ জায়গায় যেতে পারব না কিন্তু। তুমি তোমার বাবাকে জানিয়ে দিও। আর নিজেও জেনে নিও।’
লোপা বাইরে বেরোতেই দেখল সুমনা দুজনের টিফিনবক্স হাতে দাঁড়িয়ে আছে। লোপা টিফিনবক্স দুটো নিয়ে ওর হাতে শাড়িটা দিয়ে বলল, ‘এটা বিবাহবার্ষিকীর উপহার।’
সুমনা একমুখ হেসে বলল, ‘দারুণ শাড়ি।’
তারপরেও সুমনা দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির ওপরে। লোপা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘কিছু বলবে?’
সুমনা ফিসফিস করে বলল, ‘আমাদের বিনোদিনী গার্লস স্কুলে লোপা বলে একটা মেয়ে ছিল, ঠিক তোমার মতো দেখতে। কিন্তু স্বভাবটা একটু অন্যরকম। প্রতিবাদী মেয়ে ছিল। অন্যায় দেখলেই মুখের ওপর বলে দিত। আমাদের ক্লাস নাইনে পড়াকালীন একবার উঁচু ক্লাসের দিদিরা এসে খুব বাজে বাজে কথা শুনিয়েছিল। তখন লোপা একমাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘তোমরা বোধহয় জানো কোরাস গান একজনের গাওয়া নয়। তাই অনুষ্ঠানের কোরাস গানটা খারাপ হওয়ার জন্য শুধু ক্লাস নাইন দায়ী নয়। ওখানে নাইনের মাত্র দুজন মেয়ে ছিল। বাকি আটজন ছিল ইলেভেনের মেয়ে। বাকিদের কোনো দায় নেই তার মানে? লোপা রুখে দাঁড়াতেই মেয়েগুলো পিছু হঠেছিল। আমরা তারপর থেকে লোপাকে আমাদের রোল মডেল মানতাম। অকারণে অপমান সহ্য সে করত না। সে কয়েতবেল মাখা, লাউ চিংড়ি এসব খেতে খুব ভালোবাসত। কে জানে মেয়েটা কোথায় হারিয়ে গেল!’
সুমনা আর দাঁড়াল না।
লোপা সন্দীপের হাতে টিফিন বক্সটা দিতে দিতে বলল, ‘জানো সন্দীপ, আমিও চাই তুমি ওবাড়িতে আর যেও না। আসলে আমাদের বাড়ির লোকজন একটু রুচিসম্পন্ন তো। তাদের শিক্ষায় মানুষকে অপমান করতে শেখায় না। আসলে গোস্বামী বাড়ির সম্মান ডোবানোর জন্য তুমি একাই একশো। লোকে তোমায় দেখলে ভাববে সনাতন গোস্বামী নাতিকে মিনিমাম এটুকু শেখাননি।’
সন্দীপ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অপরিচিত লোপার দিকে। এভাবে কথা দিয়ে সপাটে থাপ্পড় যে লোপা মারতে পারে, সেই ধারণা ছিল না সন্দীপের।
লোপা একটু হেসে বলল, ‘চাকরিটা আমি ছাড়তে কেন পারছি না জানো? তোমার যা অসভ্য মেজাজ, প্রাইভেট কোম্পানি থেকে যদি এই বিহেভের জন্য তোমায় স্যাক করে দেয় তখন আমার গ্রুপ ডি’র মাইনে তোমায় খাইয়ে দিতে পারবে। চললাম, অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। অফিস থেকে সোজা ওবাড়ি চলে যাব।’
সন্দীপ পিছন থেকে হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আমি কি অফিস ফেরত ও বাড়ি যাব?’
লোপা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘উঁহু। তুমি না গেলে আমি খুশি হব।’
কতদিন নিম্নচাপের পরে আজ অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। ওড়না দিয়ে নিজের চোখ দুটো ভালো করে মুছে নিল লোপা।
সুমনার রান্না কমপ্লিট। ও বেরিয়ে যাচ্ছে। গেটের সামনে পরিপাটি হয়ে অপেক্ষা করছে কৌশিক।
সুমনার দিকে তাকিয়ে লোপা বলল, ‘চিনতে পেরেছিলি তো পরিচয় দিলি না কেন?’
সুমনা হেসে বলল, ‘যে কারণে তোর ইচ্ছে থাকলেও পারিসনি। বাড়ির রাঁধুনি তোর ক্লাসমেট জানলে তোর সম্মান কি এবাড়িতে বাড়ত?’
লোপা বলল, ‘কলেজে ভর্তি হলি না কেন?’
সুমনা হেসে বলল, ‘বাবা মারা যাওয়ার পরে আর সামর্থ ছিল না রে। তবে বিশ্বাস কর, ভালো আছি। বড্ড ভালোবাসায় রেখেছে কৌশিক।’
লোপা বলল, ‘তোর জন্য আবার আজ অনেকদিন পরে সেই পুরোনো লোপাকে আমিও ফেরত পেলাম।’
সুমনা বলল, ‘পুরোনো পরিচয় লুকানো থাক। আমার কাজটা দরকার আর তোকেও সসম্মানে বাঁচাতে হবে এবাড়িতে। তাই আজ আসছি বৌদিমনি।’
লোপা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘এসো।’
কৌশিকের মুখে সেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে দেখা হওয়ার হাসি। সুমনার চোখে খুশির ছোঁয়া। ওরা আজ সারাদিন আনন্দ করবে। আরও বেশি করে নিজেদের হবে।
লোপা উপভোগ করছে ওদের ভালোবাসার উষ্ণতাটা।
ওর গোটা মন জুড়ে বৃষ্টি নেমেছে। জলের ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে লোপার কষ্টগুলো। কে যেন বলেছিল, প্রেম শুধু হাসায় না কাঁদায়ও। কাঁদছে লোপা, সে কান্না পথ চলতি লোক দেখতে পাচ্ছে না, তবুও কাঁদছে ও।
আজ ১০ই বৈশাখ বিনোদিনী গার্লস স্কুলের এক ছাত্রীর বিয়ের দিন, আরেক ছাত্রীর নিজেকে আবার খুঁজে পাওয়ার দিন। তারিখটা লোপা বাংলাতেই মনে রাখতে চায়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন