ঈশ্বর ভালো নেই – ১

মুখ থেকে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে প্রশ্ন করল মৈত্রেয়ী, “হোয়াটস রং অনির্বাণ?”

সামনের আরাম কেদারায় বসে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে ওলটাতে জবাব দিল অনির্বাণ দেশমুখ, “আমায় এসব জিজ্ঞেস না করাই ভালো।”

— হোয়াই নট? তুমি তো জানো আমি কতটা ব্যস্ত! সারাদিন সেভাবে খোঁজ খবর নিতে পারি না… তুমিও এতটা ক্যাজুয়াল হলে কীভাবে চলবে?

— সব দায়িত্ব কি আমার একার? মিম তো আমাদের দু-জনের সন্তান… তা ছাড়া ওর এখন তোমায় প্রয়োজন, বড়ো হচ্ছে ও, মায়ের একটা বড়ো ভূমিকা থাকে এসময়ে।

— ওহ প্লিজ… ডোন্ট টক লাইক ননসেন্স… আমি এখন কাজকর্ম ছেড়ে বাচ্চা মানুষ করি, আর কী! এতই যখন অসুবিধে, তখন আগে ভাবা উচিত ছিল তোমার। আমি কনসিভ করতেই চাইনি… বাট ইউ সেইড দ্যাট ইউ উইল হ্যান্ডেল এভরিথিঙ্।

— বারবার এক কথা বোলো না মিতু… ও তোমায় চাইছে ভীষণভাবে… আমি ডক্টরের সঙ্গে কথা বলেছি, উনি ক্লিয়ারলি জানিয়েছেন, এই বয়সের বাচ্চাদের জন্য তাদের বাবা-মা দু-জনকে ভীষণ কেয়ারিং হতে হয়।

— টাকার অভাব তো পড়েনি… দেন গো টু আ ডে কেয়ার।

— মায়েরা যা পারে, সেটা টাকা দিয়েও পাওয়া যায় না মিতু… তুমি কেন বুঝতে পারছ না যে…

— “কারণ আমি আমার কাজটাকে বেশি ইম্পর্টেন্ট মনে করি দ্যান দিস শিটি থিঙ্গস”, অনির্বাণের দিকে এগিয়ে আসে মৈত্রেয়ী, “যদি পারো তো তোমার বাচ্চাকে আলাদা ট্রিটমেন্ট করাও… আমার নিজের প্রফেশন যেন হ্যাম্পার না হয় এসবে, মাইন্ড ইট।”

অনির্বাণের স্তব্ধ দৃষ্টির সামনে দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যায় মৈত্রেয়ী।

.

অনির্বাণ আর মৈত্রেয়ীর আলাপ কলেজ লাইফে। লিটারেচারের ছাত্র অনির্বাণ যেমন মুখচোরা, জার্নালিজমের ছাত্রী মৈত্রেয়ী তেমনি ছটফটে। ডিবেট থেকে শুরু করে আড্ডা— সবকিছুতেই প্রাণবন্ত মৈত্রেয়ীর সঙ্গে হঠাৎ করেই আলাপ হয়ে যায় অনির্বাণের একটা ক্যাফেতে। শ্রীজাত’র একটা লেখায় ডুবে গিয়েছিল অনির্বাণ। মৈত্রেয়ী হঠাৎ এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে, “হাই, আমি মৈত্রেয়ী… বসতে পারি?”

— “হ্যাঁ… অবশ্যই”, একটু অবাক হয়েছিল অনির্বাণ।

— সেদিন কলেজ স্যোশালে আপনি একটা কবিতা শুনিয়েছিলেন কীটসের… কীটস আমার ভীষণ প্রিয়, তাই আজ এখানে দেখে আলাপ করার লোভটা সামলাতে পারলাম না।

— হাহাহা…, কোনো অসুবিধে নেই… তারপর বলুন?

.

সেই থেকেই দু-জনের পরিচয় একটু একটু করে গভীর হয়। প্রায় বছর সাতেক চুটিয়ে প্রেম করা আর নিজেদের কেরিয়ারে দাঁড়ানোর পর পরিবারের সম্মতিতে দু-জনেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। প্রথম প্রথম সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ১২ তলার ফ্ল্যাটে দু-জনের নতুন সংসার। মুখচোরা অনির্বাণ আর ছটফটে মৈত্রেয়ী অপটু হাতে গুছিয়ে তুলেছিল সংসার। নিজেদের কাজের ফাঁকে একে অপরকে সময় দেওয়া, দু-জনকে বোঝা… কখনও ক্লান্তিতে অপরজনের বুকে মাথা রেখে তৃপ্তিতে চোখ বোজানো— খুব সাবলীলভাবে কেটে যাচ্ছিল সময়। কখনো কখনো অনির্বাণ সারপ্রাইজ দিত স্ত্রীকে। পছন্দের লেখকের বই পেয়ে কিংবা হঠাৎ ক্যান্ডেল লাইট ডিনার ডেটে গিয়ে বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে উঠত মৈত্রেয়ী। ওর ঝলমলে মুখের দিকে তাকিয়ে নতুন করে প্রেমে পড়ে যেত অনির্বাণ। হঠাৎ করেই মাঝরাতে ওরা বেরিয়ে পড়ত লং ড্রাইভে। অনির্বাণের বুলেটের পিছনে ওকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকত মৈত্রেয়ী। হেলমেটের ফাঁকে ওর চুলগুলো হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিত। কখনও বা মনটা অশান্ত হয়ে উঠলে ঘুমন্ত স্ত্রীর নিষ্পাপ মুখটা দেখে ভেতরে ভেতরে স্বস্তি পেত অনির্বাণ। তাদের বিয়ের প্রায় সাড়ে চার বছর পর মিম জন্মায়। কনসিভ করতে চায়নি মৈত্রেয়ী। বলেছিল পিল খেয়ে নেবে, কারণ কেরিয়ারে এখন অনেক কিছু করা বাকি, এত তাড়াতাড়ি স্বপ্নগুলোকে হারাতে চায়নি ও। অনির্বাণ বুঝিয়েছিল, “দেখো মিতু, আমরা সারাদিন নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি, জানি দু-জন দু-জনকে খুব ভালোবাসি, কিন্তু কোথাও গিয়ে একটা কমতি রয়েই যায়। একটা বাচ্চা এলে এই দূরত্বটা মিটে যাবে, বিশ্বাস করো।”

 — না অনির্বাণ, জন্ম দেওয়াটা বড়ো কথা নয়… কিন্তু একটা বাচ্চাকে প্রপারভাবে মানুষ করতে হলে সময়ের দরকার… ওটার ভীষণ অভাব এই মুহূর্তে।

— আমি তো আছি মিতু… একটু ভরসা করো আমায়… তুমি যতক্ষণ থাকো না, ভীষণ একলা লাগে আমার… সেই সময়গুলোয় আমাদের সন্তানকে নিয়ে বেশ কাটিয়ে দেব আমি… কথা দিচ্ছি, ওর দায়িত্ব আমার, আমায় এই উপহার থেকে বঞ্চিত কোরো না প্লিজ।

মানতে পারেনি মৈত্রেয়ী, অনেকটা নিমরাজি হয়েই অনির্বাণের কথা রেখেছিল ও। মিম জন্মাবার আগে মৈত্রেয়ীর শরীরে হঠাৎ জল ভেঙে যায়। ভীষণ সিরিয়াস কন্ডিশন হয়ে গিয়েছিল তখন। সিজারে জন্ম হয়েছিল মিমের। শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্য প্রায় ছয় মাস নিজের কেরিয়ার থেকে সরে আসতে হয় মৈত্রেয়ীকে। এরপর থেকেই নিজের সন্তান আর সংসারের ওপর কেমন যেন বিরূপ হয়ে ওঠে মৈত্রেয়ী। ভীষণ রকমের দায়সারা মনোভাব। মিম জন্মাবার পর থেকে ওর সব দায়িত্ব নিয়েছে অনির্বাণ। যেসময়ে বাচ্চাটার মায়ের দুধ খাওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেই সময়গুলোয় কৃত্রিম দুধে কাজ চালিয়েছে অনির্বাণ। সেজন্যই হয়তো মিমের মানসিক গঠনটা অন্য বাচ্চাদের মতো হয়নি। অন্যদের থেকে যথেষ্ট আলাদা ও। বাচ্চারা যেখানে একসঙ্গে হেসে খেলে ছোটাছুটি করে, মিম সেখানে চুপচাপ কোনো একটা দিকে তাকিয়ে থাকে। কখনও বা একটা ছোট্ট ডায়েরিতে পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুকি কাটতে থাকে। অনির্বাণ ওর সঙ্গে খেলার চেষ্টা করেছে অনেকবার, কিন্তু প্রত্যেকবার ব্যর্থ হয়েছে ও। মিম কেমন যেন গভীর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ওই চোখের দিকে তাকালে বুকটা কেঁপে ওঠে অনির্বাণের। যেন কত বছরের দুঃখ, একাকিত্ব জমে রয়েছে চোখের ভাঁজে।

— বাবাই।

মিম ঘুম থেকে উঠে চোখ রগড়াতে রগড়াতে এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের ভেতর। বাবা-মায়ের মধ্যে হালকা বাকবিতণ্ডায় হয়তো বাচ্চাটার ঘুম ভেঙে গেছে। অনির্বাণ হেসে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয় মিমকে। মিমের শরীরের নরম আদুরে গন্ধে কেমন যেন আবেশ ধরে যায়। ওর কচি গাল, ঘন কালো চোখ আর চুলের গভীরে ডুবে যেতে চায় অনির্বাণ। কেমন যেন কান্না পায় অনির্বাণের। বাচ্চাটা এভাবে বঞ্চিত হয়ে যাবে জানতে পারলে কখনওই মৈত্রেয়ীকে জোর করত না ও। কিন্তু এখন আর কিই বা করার আছে! মৈত্রেয়ী তো নিজের সন্তানকে কোনোদিন জড়িয়েও ধরেনি। ওর কাছে জীবন মানে শুধুই একটা বেটার কেরিয়ার। বাকি সবকিছু হয়তো ফেলনা।

— জানো বাবাই, আজ আমি সেই জায়গাটার স্বপ্ন দেখেছি, মিম চোখ বড়ো বড়ো করে বলে ওঠে।

— তাই নাকি?

— হুমম, আমরা কবে যাচ্ছি বাবাই? ওখানে অনেক অজানা গুপ্তধন রয়েছে।

— যাব যাব মিম সোনা ; আমি, তুমি আর মাম্মাম তিনজনে মিলে যাব।

— নাহ্, মাম্মামের কোনোদিন সময় হবে না, শুধু তুমি আর আমি… জানো, ওখানে একটা মন্দির আছে, অনেক পুরোনো, সেখানে কে থাকে জানো?

— কে থাকে?

— ঈশ্বর!

— তাইই! তা সেই ঈশ্বর কোন্ ঈশ্বর?

— ওর মুখ কেউ দেখেনি… যারা যারা নিয়ম মানেনি, তারা কেউ বেঁচে ফেরেনি ওখান থেকে।

— মিম, এসব ভুল কথা সোনা… কে বলেছে এসব তোমায়?

— তুমিও আমায় বিশ্বাস করো না, তাই না বাবাই?

— না মিম, আমি তোমায় বিশ্বাস করি, ভালোবাসি… কিন্তু…

“তাহলে আমায় কেন বারবার ডক্টর আঙ্কেলের কাছে নিয়ে যাও? আমার একদম ভালো লাগে না ওখানে যেতে… আঙ্কেল বলে আমি নাকি বানিয়ে বলছি সব… আমি সত্যি বলছি বাবাই”, বলতে বলতে হাতে ধরা আঁকার খাতাটা অনির্বাণের দিকে বাড়িয়ে দেয় মিম, “এই দেখো বাবাই, ঠিক এইরকম দেখতে মন্দিরটা।”

মিমের আঁকা ছবিটা দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে যায় অনির্বাণের। সাদা পাতার বুকে মোম রঙ দিয়ে অদ্ভুত একটা ছবি ফুটিয়ে তুলেছে মিম। একটা আধপোড়া মন্দির… চারদিকে গাছপালা ঢেকে গিয়েছে সেটার। কালচে মন্দিরটার একপাশে একটা বেদী জাতীয় কিছু। সেখানে পিছন ফিরে বসে রয়েছে কেউ। অন্ধকার ঘন হয়ে রয়েছে সেইখানে।

“এটা সেই ঈশ্বর”, মিম বলে ওঠে, “আমরা এখানেই যাব বাবাই… কবে যাব… বলো… কীগো, বলো না…”

“সে যাওয়া হবে’খন… তুমি এখন ঘরে যাও মিম… আমার একটা কাজ আছে, ওটা মিটিয়ে তারপর তোমার সঙ্গে খেলব… ওকে সোনা”, বলে মিমের কপালে চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ায় অনির্বাণ। বাচ্চাটা নিষ্পলক চেয়ে আছে ওর দিকে। কেমন যেন অস্বস্তি লাগল অনির্বাণের। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এল ও।

.

পার্কের বেঞ্চটাতে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনির্বাণ। সম্পর্কগুলো কেমন যেন জটিল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। মৈত্রেয়ীর ব্যবহার, মিমের অদ্ভুত কথাবার্তা… সব গুলিয়ে যাচ্ছে যেন! মাঝেমধ্যে মিম এমন সব কথা বলে যে অনির্বাণ অবাক হয়ে যায়। বেশ কিছু জায়গার নাম, যেগুলো অনির্বাণ সেভাবে শোনেওনি কোনোদিন। সেখানে থাকা অতীতের কিছু ধ্বংসস্তূপ, আদিম ইতিহাস— মিম এসব জানল কীভাবে? এরকম কোনো বই তো ওদের বাড়িতে নেই, কিংবা এমন কোনো মুভি কখনও দেখেইনি ওরা। তাহলে? ডক্টর ব্যানার্জী অবশ্য বলেছেন,‌ “এটা একধরনের রোগ, যাকে বলে হাইপারথেমিস। এই রোগে আক্রান্ত মানুষ এমন অনেক কিছু ভিস্যুয়ালাইস করে, যেটা বাস্তবে তারা কখনও দেখেইনি। হতে পারে কোনো কিছু শুনে সেই নিয়ে কল্পনা করে ফেলে ওরা। তারপর সেগুলো স্বপ্নে দেখে আরও বেশি জড়িয়ে পড়তে থাকে তাতে। এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই… সঠিক ট্রিটমেন্ট আর প্যারেন্টসের তত্ত্বাবধানে বাচ্চার মন থেকে এসব ভুলভাল চিন্তাভাবনা দূর হয়ে যায়। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।”

কিন্তু মৈত্রেয়ী এসব বুঝলে তো! ওর কাছে মিমের কোনো অস্তিত্ব নেই যেন। অথচ মৈত্রেয়ী কিন্তু এমনটা ছিল না কখনওই। কলেজ জীবন থেকে চেনে ও মৈত্রেয়ীকে। বাচ্চাদের ভীষণ ভালোবাসত মৈত্রেয়ী। ওর নিজেরও ইচ্ছে ছিল এমন একটা মিষ্টি বাচ্চার মা হওয়ার। সবকিছু পালটে গেল কীভাবে! মাথাটা যন্ত্রণা করছে অনির্বাণের। দু’হাত দিয়ে কপাল চিপে ধরে ও।

ঘরে ঢুকতেই কেমন যেন অদ্ভুত লাগে অনির্বাণের। ঘরটা আজ এতটা থমথমে কেন? অন্যদিন মিম গান শোনে কিংবা কার্টুন দেখে। আজ ওর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না! মনটা একটা কু-ডাক ডাকে অনির্বাণের। তাড়াতাড়ি এ-ঘর সে-ঘর খুঁজতে খুঁজতে ডাইনিং রুমের টেবিলের সামনে দেখতে পায় মিমের ছোট্ট শরীরটা পড়ে রয়েছে।

— মিম…!

হালকা একটা আর্তনাদ বেরোয় অনির্বাণের গলা দিয়ে। ছুটে গিয়ে মিমের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে ও। কাঁপা কাঁপা হাতে বুকে তুলে নেয় মিমের ছোট্ট শরীরটা। কই… ওর শরীর তো গরমই আছে। তাহলে! শ্বাস পড়ছে তো! মিমের বুকে কান পেতে অনুভব করার চেষ্টা করে অনির্বাণ। হ্যাঁ… শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক। তাহলে কি ও ঘুমাচ্ছে? কিন্তু এখানে এইভাবে তো কখনও ঘুমায় না মিম। ওর ছোট্ট শরীরটা কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় অনির্বাণ। বিছানার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মিমের আঁকার খাতা, ডায়রি, মোম রঙ। সেগুলো গোছাতে গিয়েই অনির্বাণের চোখ পড়ে মিমের আঁকার খাতার ওপর। কীরকম অদ্ভুত অদ্ভুত ছবি আঁকে মিম! এসব পায় কোথায় ও? খাতাটা হাতে নিয়ে পাতা উলটে উলটে দেখছিল অনির্বাণ। হঠাৎ একটা পাতায় চোখ আটকে যায় ওর। চারদিকে ঘন সবুজ জঙ্গল, সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা ছোট্ট পায়ে হাঁটা রাস্তা। সেখানে জমাট বাঁধা অন্ধকারে একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে… মূর্তির চারপাশে লাল রঙের চাপ চাপ রক্তের মতো কীসব যেন রয়েছে। কিন্তু একটা বাচ্চার মাথায় এসব কল্পনা আসে কীভাবে? মিমকে তো কোনোদিনও ভূতের গল্প শোনায়নি অনির্বাণ। এসব গাঁজাখুরি জিনিসে ও কখনওই বিশ্বাস করে না। তাহলে এইসব আঁকছে কীভাবে ও? অনির্বাণের কি সত্যিই তাহলে কোনো খামতি রয়ে যাচ্ছে? কী হচ্ছে কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না।

নিজের ভাবনায় এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল অনির্বাণ যে, ফোনের রিংটোনটা বেজে উঠতেই চমকে উঠল ও। স্ক্রিনে মৈত্রেয়ীর নাম ভেসে উঠছে। ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ওপার থেকে মৈত্রেয়ীর গলা, “হেই বেব্‌স্‌…গুড নিউজ…”

“কী হয়েছে?” শুকনো ঠোঁটটা চেটে নেয় অনির্বাণ।

— তোমার মনে আছে, আগের বারের ট্রিপটা ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছিল আমাদের… দিস টাইম কোম্পানির তরফ থেকে আমরা একটা ফুল ফ্যামিলি প্যাকেজ পাচ্ছি।

— ওহ্… বুঝলাম।

— হোয়াই সো সিরিয়াস… ইটস জাস্ট এ গোল্ডেন অপারচুনিটি… উফফ, অ্যাম সো একসাইটেড… গেস করো তো আমরা কোথায় যাচ্ছি?

— কোথায়?

— রাজস্থান।

“কিহ্!” চমকে ওঠে অনির্বাণ।

— হ্যাঁ, না হলে আর বলছি কী! শুধু তাই নয়, এখানকার বেস্ট হোটেলে থাকব আমরা। সত্যি বলতে এই ট্রিপটা আমার কাছে শুধু একটা ট্রিপ নয়, এখানে আমার একটা ভীষণ ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে।

— কিন্তু…

— ওহ্ কাম অন… আমি ভীষণ এক্সাইটেড, বাই দ্য ওয়ে বাকি কথা বাড়িতে এসে বলব… লাভ ইউ।

 ফোন রেখে দেয় মৈত্রেয়ী। আজ অনেকদিন বাদে ফোন রাখার আগে এভাবে ‘লাভ ইউ’ বলল ও। কিন্তু কথাটা শোনার পর থেকে অনির্বাণ ভিতরে ভিতরে অশান্ত হয়ে উঠছে। কারণ একটা বিষয় ও কিছুতেই মিলিয়ে উঠতে পারছে না। এটা কি জাস্ট একটা কো-ইনসিডেন্ট নাকি…! কারণ এতদিন ধরে মিম যে জায়গাটায় যাওয়ার জন্য বায়না করছে, সেটা তো রাজস্থানের জয়সলমীরে! মনটা কিন্তু-কিন্তু করতে থাকে অনির্বাণের। এমন সময় পিছন থেকে মিম ওর গায়ে হাত রাখে।

— বাবাই… আমরা যাচ্ছি তাহলে… তাই না?

মিমের কথা শুনে বিস্ফারিত চোখে ওর দিকে তাকায় অনির্বাণ। ও কীভাবে জানল এটা? অনির্বাণকে চুপ করে থাকতে দেখে মিম কাছে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরে, “জানো বাবাই, আজ ফের আমি ওই জায়গাটায় গিয়েছিলাম… কত বড়ো মন্দির ওটা… ওর পাশে যে বেদীটা আছে, তার নীচে একটা সিক্রেট আছে।”

“কী সিক্রেট?” শুকনো গলায় বলে ওঠে অনির্বাণ।

— হিহি… ওটা এখন বলব না, আগে আমরা যাই… তারপর দেখবে।

— মিম, সোনা আমার… তুমি তো বাবাইকে ভালোবাসো… তাহলে একটা সত্যি কথা বলো যে, এসব তুমি কী বলছ? তুমি কি কোনো ভূতের মুভি দেখেছ, কিংবা তোমায় কি কেউ এসব নিয়ে গল্প বলেছে এর আগে?

— উফফ বাবাই… ইটস নট জাস্ট আ ড্রিম… আমি সত্যি বলছি, আমার কথা বিশ্বাস করো।

— কিন্তু মিম, তুমি যেখানে যাওনি, সেটা নিয়ে কী করে এতটা কনফার্ম হতে পারো?

— আমি তো গিয়েছি বাবাই, ও আমাকে… ও আমাকে রোজ নিয়ে যায়।

— কে?

— ও বলতে বারণ করেছে, ও খুব ভালো… তোমার সঙ্গে ওর একদিন আলাপ করিয়ে দেব।

— কার কথা বলছ মিম?

“ওই যে ওর কথা।” মিম অনির্বাণের পিছনে কোনো একটা দিকে আঙুল দেখায়।

দিনের বেলাতেও কেমন যেন গা-টা ছমছম করে ওঠে অনির্বাণের। আস্তে আস্তে পিছনে তাকাতেই চোখ পড়ে দেওয়ালের একপাশে শোকেসের ওপর রাখা একগাদা পুরোনো পেপারের ওপর।

“ও আসছে।” মিম ফিসফিস করে জানায়।

“কে?” অনির্বাণের গলার স্বর আরও ফ্যাকাশে।

“ওই যে।” মিমের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলিংবেল বেজে ওঠে।

 দরজার কি-হোলে চোখ রাখে অনির্বাণ। দরজার ওপাশে বছর পঁয়ষট্টির এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। মুখের চামড়া বয়সের ভারে কুঁচকে গিয়েছে। মাথা ভর্তি ফিনফিনে সাদা চুল। নাকের ওপর আবার একখানা পুরোনো আমলের গোল কাচের চশমা। দরজার এপাশে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অনির্বাণ। মিমের কথা শুনে ও মনে মনে কীসব কল্পনা করতে শুরু করে দিয়েছিল! গলাটা খাঁকড়ে নিয়ে দরজা খোলে অনির্বাণ। দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক ভদ্রলোক একগাল হেসে প্রশ্ন করলেন, “এটাই কি অনির্বাণ দেশমুখের ফ্ল্যাট?”

— হুমম, আমিই অনির্বাণ।

— নমস্কার অনির্বাণ বাবু, আমি বিনোদ ভটচাজ… আপনার নতুন প্রতিবেশী… ২১২ নম্বর ফ্ল্যাটে সপ্তাহখানেক হল ভাড়া এসেছি… তাই ভাবলাম একবার আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাই; তা ছাড়া আপনি মশাই দুর্দান্ত লেখেন, আপনার বেশিরভাগ লেখা আমার পড়া… এমন একজন মানুষের ফ্ল্যাটমেট যখন হলাম, তখন দেখা করাটা কর্তব্য বই কী!

— ও আচ্ছা… আসুন না, ভিতরে আসুন।

“আমি মানুষটা একটু আধপাগলা টাইপের, মানুষের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করতে ভীষণ ভালোবাসি… এখনকার দিনে মানুষ আর মানুষের বাড়ি যায় কোথায়।” বলতে বলতেই ঘরে ঢোকেন ভদ্রলোক।

অনির্বাণ দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়। ভদ্রলোক ঢুকে যাওয়ার পর একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় সে। ড্রয়িংরুমের সোফার ওপর বসে পড়েন ভদ্রলোক। অনির্বাণ “আপনি বসুন, আমি আসছি” বলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ফ্রিজ খুলে একটা প্লেটে দুটো সন্দেশ আর দুটো অমৃতি রাখে সে। কোল ড্রিংকসের বোতল বের করে নিয়ে একটা গ্লাসে ঢেলে নেয়। তারপর প্লেট আর গ্লাস নিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে টেবিলের ওপর রাখে।

— নিন একটু মিষ্টিমুখ করুন।

— এই রে, তোমায় সমস্যায় ফেললুম না তো আবার! ইয়ে মানে… তুমি বলে ফেললাম ভুল বশতঃ।

— না না, সমস্যা কীসের? আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়ো, তুমি করেই বলতে পারেন… তা ছাড়া আমার বেশ ভালোই লাগে নতুন মানুষদের সঙ্গে আলাপচারিতা।

— বেশ বেশ বাবা… সুখী হোয়ো… তা বউমাকে দেখছি না?

— ও কাজে বেরিয়েছে… সন্ধে নাগাদ ফিরবে।

— আচ্ছা আচ্ছা… বাড়িতে কি তোমরা দুটিতেই থাকো তাহলে?

— আমরা তিনজন, আমাদের সন্তান পাশের ঘরে রয়েছে।

— বাহ, বেশ বেশ… তোমার আগের বারের যে উপন্যাসটা বেরোল, ওটা পড়ে আমি তো একেবারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি… কী চমৎকার লেখনী, অসাধারন!

“ধন্যবাদ, আপনাদের ভালো লাগাটাই আমার প্রাপ্তি।” অল্প হাসে অনির্বাণ।

— আমাদের বুড়োদের একখানা আড্ডার গ্রুপ আছে, বুঝলে বাবা! সেই গ্রুপে এখনকার লেখক-লেখিকাদের নিয়ে বিপুল চর্চা হয়… আমাদের সময়ে ছিলেন সেই রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ… আর এখনকার দিনে মানুষ হুজুগে পড়ে যাই লিখে ফেলে, তাই-ই দেখি সব গোগ্রাসে গেলে… এর মধ্যে বেশ কিছু কিছু মানুষ আছেন, যাদের লেখা পড়ে সত্যিই মুগ্ধ হওয়া যায়… তাদের মধ্যে তুমি একজন।

— আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে এখনকার দিনের লেখকদের সেই আগের অবস্থাটা আর নেই… এখন সবই অনলাইনের যুগ… কটা মানুষ আর বই কেনে বলতে পারেন… আমি তো ছোটো থেকেই বইয়ের ভক্ত, আমার ঘরে প্রত্যেকটা পছন্দের লেখক-লেখিকার বই ডাঁই করে রাখা থাকত… এখনকার বাচ্চাদের বইয়ের নেশার বদলে গেমের নেশা চলে এসেছে… তাই খুব একটা পরিচিত না হলে এই প্রফেশনে টিকে থাকা মুশকিল।

— সেটা একদিকে ঠিক বটে… কিন্তু ৬০% মানুষ যদি অনলাইন বই পড়া বেশি পছন্দ করে, বাকি ৪০% মানুষ কিন্তু এখনও বইটা হাতে ছুঁয়ে পড়তে বেশি ভালোবাসে।

— সেইসব মানুষদের জন্যই আমাদের মতো কলম চালিয়ে খাওয়া মানুষদের বেঁচে থাকা।

— তোমার লেখায় এত সুন্দর বিবরণ থাকে যে, পড়লে মনে হয় যেন আমি নিজে সেই জায়গায় ঘুরে এসেছি… সবই কি তুমি গুগল ঘেঁটে তথ্য পাও নাকি নিজেও ঘুরতে গিয়েছ?

— ডিপেন্ড করে… সবসময় তো সবকিছু সম্ভব হয়ে ওঠে না, কিন্তু যতটা সম্ভব আমি নিজের চোখে দেখে সেখান থেকে লিখতে বেশি ভালোবাসি।

— বুঝলে বাবা, তখন বয়স কম ছিল, গায়ের রক্ত গরম… কোনো কিছুকে ভ্রূক্ষেপ না করে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত করে বেরিয়েছি, আর আজ… বয়সের ভারে আর কিছু করে ওঠা হল না… আমার ছেলেটাও এক্কেবারে আমার মতো, ঘুরতে ভীষণ ভালোবাসে, এমনও হয় কয়েক মাস অন্তর অন্তর বাবুর দেখা পাই… গিন্নি চলে গেছেন প্রায় ১০ বছর হতে যায়, একা আছি এই-ই বেশ আছি… মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ জমাই, ব্যস! দিন কেটে যায়।

কথা বলতে বলতে প্লেটের মিষ্টি আর গ্লাসের কোল্ড ড্রিংকস প্রায় শেষ করে এনেছিলেন ভদ্রলোক। কোল্ড ড্রিংকসের গ্লাসখানা সরিয়ে রেখে একখানা বড়োসড়ো ঢেকুর তুললেন তিনি। ইতিমধ্যে মিম এসে দাঁড়িয়েছে অনির্বাণের পাশে। ওর দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক হাসলেন, “নাম কী সোনা?”

মিম চুপচাপ চেয়ে রইল বৃদ্ধের দিকে, কোনো উত্তর দিল না। ও এইভাবে চুপচাপ থাকায় অনির্বাণের একটু খারাপ লাগল। কে জানে ভদ্রলোক কী ভাবছেন! ও হাত বাড়িয়ে মিমকে নিজের কোলে টেনে নিল। তারপর আলতো আদরে ওর মাথার চুল ঘেঁটে দিয়ে বলল, “মিম… ভালোবেসে মিম বলে ডাকি আমরা।”

— বেশ বেশ… তা মিম সোনা… একখানা কবিতা হবে নাকি?

এই কথাতেও মিমের কোনো ভাবান্তর ঘটল না। ও চুপচাপ চেয়েই রইল। অনির্বাণ একটু অপ্রস্তুতে পড়ে যায়, “আসলে মিমের শরীরটা ভালো নেই, তাই…”

— আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে… কোনো সমস্যা নেই, আমরা তো এখন বন্ধুই, তাই তো মিম বাবু… আজ না হোক পরে কোনো একদিন ঠিক আমি কবিতা শুনে নেব।

 আরও বেশ কিছুক্ষণ গল্পগাছা করে বিদায় নেন ভদ্রলোক। উনি চলে যাওয়ার পর অনির্বাণ মিমকে নিয়ে পড়ে, “কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে সেটার উত্তর দিতে হয় মিম, তোমাকে তো এটা আমি আগেও বলেছি সোনা।”

— মাম্মাম কখন আসবে বাবাই?

— চলে আসবে ঠিক সময়ে… তোমাকে আমি যেটা বললাম, সেটার উত্তর দাও।

— আচ্ছা বাবাই, অ্যাক্সিডেন্ট হলে ভীষণ কষ্ট হয়, তাই না?

— এসব কী কথা বলছ মিম?

— আমি জানি বাবাই… আমাদের গাড়িতেও অ্যাক্সিডেন্ট হবে… আমায় ও বলেছে।

“মিম, মিম… তুমি আমার দিকে তাকাও।” মিমের কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকায় অনির্বাণ, “এসব কথাবার্তা বলতে নেই সোনা… আমরা ঘুরতে যাব, তাই তো? তাহলে এসব আজেবাজে কথাবার্তা কেন বলছ!”

— তুমি আমায় পাগল ভাবছ, তাই না?

— না মিম… আমি তোমায় পাগল ভাবছি না, কিন্তু এসব কথা বলতে নেই।

— আমার কথা পরে মিলিয়ে নিয়ো

অনির্বাণের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় মিম। তারপর ওর আঁকার খাতা আর মোম রঙ নিয়ে পাশের ঘরে চলে যায়। অনির্বাণ কী করবে বুঝে উঠতে পারে না, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সামনের দিকে।

অধ্যায় ১ / ১০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন