আশাপূর্ণা দেবী
গুরুজন সম্মানের পাত্র এ কথা কেউ অস্বীকার করে না, কিন্তু চরিত্রহীন গুরুজনকে সে সম্মান দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না, দেওয়া সম্ভব কি না, এ প্রশ্ন ক্রমশঃই সংসারের তলায় তলায় ধূমায়িত হয়ে উঠেছে। যেন হঠাৎ কোন অসতর্ক বাতাসে জ্বলে উঠবে সেই উত্তপ্ত ধূমজাল।
মাঝে মাঝেই যেন সেই বাতাসের আভাস পাওয়া যাচ্ছে আজকাল। মনে হচ্ছে চন্দ্রভূষণকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো বুঝি!
প্রথম প্রথম সংসারের প্রধান সদস্যা ভাদ্রবৌরা আড়ালে তাদের ‘আইবুড়ো বটঠাকুর’কে নিয়ে হাসাহাসি করছিলো, বলছিলো, ‘ঝড়—বৃষ্টি বজ্রপাত যাই হোক, বটঠাকুরের অভিসার যাত্রাটি বন্ধ হবে না!’ কিন্তু ব্যাপারটা আর যেন হাসিঠাট্টার পর্যায়ে থাকছে না।
ওরা বলছে, ‘আশ্চর্য! বুদ্ধির অগম্য! এতই যখন দুর্বলতা, তখন আর ভীষ্মের প্রতিজ্ঞার ‘শো’ কেন?’
বলছে, ‘আরো আশ্চর্য, লজ্জা বলে বস্তুটার বালাইমাত্র নেই। যখন যান আসেন, কে বলবে কোনো খারাপ জায়গায় যাচ্ছেন! কী সপ্রতিভ!’
আবার নিজ নিজ বরের কাছে ঠোঁট উলটে মন্তব্য করছে, ‘ওই দাদাকে যে তোমরা কী করে এত পূজ্যি কর বুঝি না।’
তা’ ‘পূজ্যি’ কথাটা অতিশয়োক্তি নয়।
ছোট তিন ভাইয়ের কাছে বরাবর সেই আসনই ছিল চন্দ্রভূষণের। দাদাই ওদের আদর্শ নায়ক, দাদাই ওদের জীবনের ‘হীরো’! দাদার সব কিছুতেই মুগ্ধ বিমোহিত হতো ওরা।
হয়তো তার কিছুটা কারণ ছিল চন্দ্রভূষণের প্রকৃতির প্রাবল্য, আর কিছুটা ছেলেবেলার দূরত্বের মোহ।
হ্যাঁ’ দূরত্ব ছিল।
ছেলেবেলায় দাদা ওদের কাছে দুর্লভ বস্তু ছিল। কারণ চন্দ্রভূষণের পাঠ্যাবস্থাটা কেটেছে রাজশাহীতে মামার কর্মস্থলে। ছুটিছাটায় কলকাতায় আসতো চন্দ্রভূষণ মা বাপের কাছে।
বাড়িতে তখন ঠাকুমা, পিসি, জেঠা, কাকার ভিড়, চন্দ্রভূষণের মা’রও প্রথম ছেলেটির জন্মের পর বছর পাঁচেক বিরতির অন্তে উপর্যুপরি তিন মেয়ে, তিন ছেলে। অবশ্য সাতটি সন্তান এমন কিছু আশ্চর্যের ঘটনা নয়, চন্দ্রভূষণের জেঠিমার তো তেরোটি! কাকীমার দশটি!
কিন্তু আশ্চর্যের জন্যে নয়, হিতচেষ্টাতেই চন্দ্রভূষণের বড়মামা বলেছিলেন, ‘তোদের এই ভেড়ার গোয়ালের মধ্যে পড়ে থাকলে, চন্দরটার লেখাপড়া কিছু হবে না সুষি, তা’ বলে রাখছি। ছেলেকে যদি মানুষ করতে চাস তো আমার সঙ্গে দে, ওখানেই পড়াশুনো করুক দেবুর সঙ্গে।’
দেবু বড়মামার একমাত্র ছেলে দেবব্রত।
এক সন্তানের পিতার অবশ্যই এদের সংসারকে ‘ভেড়ার গোয়াল’ বলবার অধিকার আছে, কাজেই সে অপমান গায়ে মাখলেন না চন্দ্রভূষণের মা সুষমাসুন্দরী, তবে দিশাহারা হলেন আচমকা এই প্রস্তাবটায়। চট করে উত্তর দিতে পারলেন না।
বড়মামা বোনের এ বিমনা অবস্থা দেখে আর একটু জোর দিলেন, ‘ছেলেটার ব্রেন আছে বলেই বলছি। দেখেছি তো কথা কয়ে, সব দিকে চৌকস বুদ্ধি! এমন ছেলেটা মাঠে মারা যাবে, ভেবে কষ্ট হচ্ছে রে!’
মারা যাওয়া শব্দটায় বোধকরি শিউরে উঠেছিলেন সুষমাসুন্দরী, বড়ভাই সেটা লক্ষ্য করে অন্য অর্থে নিয়ে ব্যঙ্গহাসি হেসে উঠেছিলেন, ‘তবে থাক বাবা ছেলে তোর আঁচলের তলায়! তোর ওই শামুক গুগলিদের কাঁথা পাট করবে, আর ঝিনুক—বাটি কাজললতা এগিয়ে দেবে, ভালই থাকবে! কালে ভবিষ্যতে কাকার মত কবরেজ হবে।’
সুষমাসুন্দরী এবার বিচলিত হলেন তাঁর মগজওলা ছেলের এই ভয়াবহ পরিণামের আশঙ্কায়। কাতর হয়ে বললেন, ‘না না দাদা, তুমি নিয়ে যাও।’
‘নিয়ে যাও’ বললেই অবশ্য এককথায় নিয়ে যাওয়া হয় না। মা কিন্তু আর ছেলের গার্জেন নয়। এ প্রস্তাবে আপত্তি আর মন্তব্যের ঝড় উঠেছিল সংসারে—কলকাতা ছেড়ে পণ্ডিত হতে যাবে ‘বাঙাল দেশে’ গিয়ে, এ হাসির ঢেউও বয়েছিল, তবু কেমন করে যেন শেষ পর্যন্ত ঘটেও গেল ঘটনাটা! মামার কর্মস্থল রাজশাহীতে চলে গিয়েছিল চন্দ্রভূষণ তার স্বল্পসঞ্চয় জামা কাপড় আর পুঁথিপত্তর নিয়ে।
ছোট ভাই বোনেদের কাছে দিনটা দুর্দিন হলো। দাদাই যে তাদের দুষ্টুমির গুরু, যথেচ্ছাচারের পৃষ্ঠপোষক। নিত্যনূতন খেলার উদ্ভাবক দাদা, বড়দের ফাঁকি দিয়ে মজা করার ব্যাপারে দাদা, ভূতের ভয় দেখাতে, এবং ভূতের গল্প বলতে দাদা! দাদার প্রকৃতির প্রাবল্য, দাদার প্রাণপ্রাচুর্য, দাদার কল্পনাশক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, এবং নেতৃত্বের বুদ্ধি তাদেরকে মোহিত করে রাখতো।
শুধু তাদেরই বা কেন, জেঠতুতো খুড়তুতো বয়সে বড় ভাই বোনেরা পর্যন্ত চন্দরের গুণে বিগলিত হতো। তারাও অধস্তন বনে যেত। এহেন চন্দরের বিরহবিচ্ছেদ রীতিমত শোকাবহ বৈকি!
আবার সে যখন ছুটিতে বাড়ি আসতো, উৎসবের সাড়া পড়ে যেত। বুঝি বা আরো উজ্জ্বল হয়ে আসতো দাদা, আরো দীপ্ত তীক্ষ্ন চঞ্চল! পুব—বাংলার উদ্দাম প্রকৃতি তাকে বুঝি যোগান দিত অধিকতর প্রাণরস।
এ বাড়িতে খেলাধুলোর পাট ছিল না, চন্দ্রভূষণ মামার বাড়ির আবহাওয়ায় সেটা রপ্ত হয়ে খেলাধুলায় স্বাক্ষর রাখতে শুরু করলো। এ বাড়িতে গানবাজনার চর্চা ‘বখাটে ছেলে’র লক্ষণ বলে গণ্য হতো, চন্দ্রভূষণ সে বাড়িতে গান আনলো। চন্দ্রভূষণের কৈশোর যৌবনের কণ্ঠ তর্কে কল্লোলিত, উৎসাহে উল্লসিত।
চন্দ্রভূষণের তর্কে কেউ রাগ করতে পারতো না! ঠাকুমা বলতেন, ‘ওকে কে এঁটে উঠবে বাবা, ডাকাত একটা!’
পিসিমা বলতেন, ‘রূপেই মজিয়েছে তোমার নাতি! যা বলে তাই শোভা পায় কী আর সাধে! বলতে নেই মামার বাড়ি থেকে কেমনটি হয়ে আসে!’
জেঠা কাকারা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হতেন, ‘বুঝলাম তো বাবা তোর যুক্তি, কিন্তু তুই লেখাপড়া বজায় রেখে গানবাজনা খেলাধুলো করিস, সেটা সহ্য হয়, এগুলো যে এক—একটি গরু! এর উপর আবার গান ধরলে?’
এটা অতিশয়োক্তি, বাড়ির সব ছেলেরাই ‘গরু’ নয়, তবে হয়তো চন্দ্রভূষণের মত মেধাবী সবাই নয়। কিন্তু ওই রকমই বলতেন তাঁরা।
চন্দ্রভূষণ বলতো, ‘ব্যায়ামে মাথা পরিষ্কার হয়।’
‘গানবাজনা তো আর ব্যায়াম নয়?’
‘বলো কি? নিশ্চয়। সমস্ত স্নায়ু শিরার ব্যায়াম, মগজের ব্যায়াম। তা’ছাড়া এ যে একটা সাধনা! গানের সাধনা ঈশ্বর সাধনার সমতুল্য।
যুক্তিটা তাঁরা অখণ্ডনীয় বলে মেনে নিতেন কি না জানা নেই, তবে শেষ পর্যন্ত দেখা যেত অচলায়তনের দেয়াল ভাঙছে কিছু কিছু।
কিন্তু এসব তো অনেককালের কথা।
রাজশাহী থেকে ছুটিতে আসা, এবং পড়া শেষ করে আসার কাল। তারপর কতগুলো কাল গেল, সংসারের কত চেহারা বদল হলো। চন্দ্রভূষণ উত্তরবঙ্গের একটা কলেজে অধ্যাপনা করতে চলে গেল, বোনেদের বিয়ে হয়ে গেল, ভাইরা বড় হলো, চকমিলোনো বাড়ির উঠোনে পাঁচিল পড়লো, কাকা জেঠারা সেই পাঁচিলের অন্তরালে অন্তর্হিত হলেন।
কিছু পরে মা বাপ অন্তর্হিত হলেন ইহলোক—পরলোকের প্রাচীরের অন্তরালে। ভয়ানক মর্মবেদনা নিয়ে গেলেন, চন্দ্রভূষণ বিয়ে করলো না বলে। অথচ তার আশা একেবারে ত্যাগ করে মেজ সেজর বিয়েতেও উৎসাহী হতে পারেননি। চার চারটে ছেলেকে বেওয়ারিস রেখে মরা দুঃখজনক তাতে আর সন্দেহ কি!
মা বাপের সে দুঃখ অনুভব করেনি কি তাঁদের বড় ছেলে? হয়তো করেছে। তবু বিয়ে করতে নারাজ থেকেছে বহু অনুনয় মিনতি ঠেলে।
‘বিয়ে করব না’ হুজুগ তো সে আমলে সব ছেলেই তুলতো একবার করে, আবার শেষ পর্যন্ত টোপর মাথায় চড়িয়ে মাকু হাতে নিয়ে ‘ভ্যা’ও করতো। এক আধটা মাত্র থেকে যেত অনড় অচলদের দলে। চন্দ্রভূষণ পড়ে রইলো সেই দলে।
মা থাকতেই চন্দ্রভূষণ তার সেই কলেজের কাজে ইস্তফা দিয়ে চলে এলো। বাপ তখন সবে মারা গেছেন। বললো, ‘ঝগড়া করে ছেড়ে দিয়েছি।’
সুষমা আঁচলে চোখ মুছে বললেন, ‘ঝগড়া করবার ছেলে তুমি নও বাবা, তা’ আমি জানি। কিন্তু আমায় আগলাতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে এসে বসলে, সংসার চলবে কিসে?’
চন্দ্রভূষণ হেসে উঠে বললো, ‘এই সেরেছে! তোমাকে আগলাতে এলাম একথা আবার কে বললো? ঝগড়া, স্রেফ ঝগড়া! ঠিক করেছি আর চাকরি নয়, ব্যবসা করবো এবার।’
‘ব্যবসা করবি?’
মা হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন, ‘তুই করবি ব্যবসা?’
‘কেন মা, আমি কি তোমার এতই অধম সন্তান যে অতবড় একটা নিঃশ্বাস ফেললে? জানো না বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ!’
মা আরো হতাশ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। ‘লক্ষ্মীর আশা আর করি না! যে পাথুরে প্রতিজ্ঞা তোমার! স্ত্রীভাগ্যে ধন, বুঝলি? এমন বাউণ্ডুলে হয়ে বেড়ালে মা লক্ষ্মী কার আঁচলে ধরা দেবেন?’
চন্দ্রভূষণ আবার হেসেছে, ‘মা লক্ষ্মী কেবল আঁচলেই ধরা দেন, পকেটে ধরা দেন না, এমন ভুল ধারণা কেন বল তো? অনেক ‘বাউণ্ডুলে’র নজির দেখাতে পারি তোমায়, কিন্তু সে সব থাক। আমিই দেখিয়ে দেব।’
হয়তো মায়ের বিষণ্ণতা দূর করতেই এত উৎসাহের অবতারণা!
হয়তো সুষমার কথাই সত্যি, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝগড়াটা বানানো গল্প। হয়তো মাকে আগলাতেই চলে আসা তার। চলে আসা সংসারের অভিভাবকত্ব নিতে।
মার দুঃখ ঘোচাতে বাড়িতে বৌ আনা দরকার, মেজ সেজর বিয়ে দিয়ে ফেলা হোক, এসব সে ভেবেছে দূরে বসে। তবু বাপ বেঁচে থাকতে সে ভাবনাটা ছিল লঘু মেঘের মত, ক্ষণিক ছায়া ফেলেছে, ভেসে চলে গেছে।
এখন অন্য দায়িত্ব অনুভব করেই হয়তো চলে আসা।
হয়তো ভেবে দেখে স্থির করা বাইরে থেকে সামান্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা অমানবিকতা। এখনো সুষমার দায়িত্বের উপর তিন ছেলে, যাদের মধ্যে একজন এখনো মানুষ হয়ে ওঠেনি, আর দুজনও খুব একটা কৃতী হয়নি। কিছু করছে এই পর্যন্ত।
কলকাতায় কি অধ্যাপনার সুযোগ জুটতো না চন্দ্রভূষণের? পরীক্ষার রেজাল্ট যার অত ভাল ছিল! কিন্তু সে সুযোগ নেয়নি চন্দ্রভূষণ, চলে গিয়েছিল উত্তরবঙ্গের একটা মাঝারি কলেজে। সেখানের দক্ষিণা আর কত?
বিয়ে কেন করলো না, কেরিয়ার কেন গড়লো না, এ নিয়ে আর ভাবেননি চন্দ্রভূষণের বাবা। বলেছিলেন, ‘কিছু না, খেয়াল! আগাগোড়া দেখছো না খামখেয়ালের রাজা! কিচ্ছু করবে না ও ছেলে, স্রেফ সব দায়িত্ব এড়িয়ে ফাঁকি দিয়ে কাটিয়ে দেবে, এই তোমায় বলে রাখছি। পরের ঘরে মানুষ হওয়া ছেলে পরই হয়, বুঝেছ?’
কিন্তু বাপের ভবিষ্যৎবাণী সফল করেনি চন্দ্রভূষণ। দায়িত্বে ফাঁকি দিয়ে কাটিয়ে দেয়নি, সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব বহন করে চলেছে তদবধি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসে যে আপ্রাণ চেষ্টায় একটা কারখানা খুলে বসলো, সে তো শুধু ওই বহনটা করবে বলে!
তাই কি অধ্যাপকের উপযুক্ত নির্বাচন? খুলে বসলো একটা ফার্নিচারের কারখানা। না, নিজের দোকান নেই, শো—রুম নেই, শুধু অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ। ভাল কাঠ, ভাল মিস্ত্রী, ভাল তদারক, ভাল কাজ! বড় বড় ফার্নিচারের দোকান থেকে অর্ডার দিয়ে যায়, এবং বেশ তাড়াতাড়িই প্রমাণিত হয়, বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ!
কিন্তু মাকে কি সেই লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠা দেখাতে পেরেছিল চন্দ্রভূষণ?
পারেনি!
ব্যবসার নিতান্ত শৈশবদশায় সুষমাসুন্দরী দেহরক্ষা করলেন। তখন সবে মেজ ছেলের বিয়ে হয়েছে, সেজ ছোট বাকি।
তারপর ক্রমশঃ অবস্থার উন্নতি ঘটেছে, আরও দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে, শাবকের আবির্ভাবও ঘটেছে। মোটকথা, এখন একটি ভরন্ত সংসার। সংসারের কর্তা যে কেবলমাত্র গৃহকর্তা, কারও ভর্তা নয়, তার জন্যে কোনো শূন্যতা নেই। বিপত্নীক তো নয়, চিরকুমার!
যদিও ইদানীং ওই ‘কুমার’ কথাটা শুনতে পেলে হেসে গড়িয়ে পড়ে চন্দ্রভূষণের ভাদ্রবৌরা।
যাই হোক, এ সংসারের বর্তমান চেহারা এই—তিনটি দম্পতি, তাদের শাবককুল, এবং সারা সংসারের রসদদার ব্যাচিলার চন্দ্রভূষণ।
হ্যাঁ, রসদের ভারটা সম্পূর্ণ চন্দ্রভূষণের। ভাইদের কাছ থেকে মাথাপিছু ট্যাক্স আদায় করে সংসার পরিচালনা করাকে নিতান্ত নির্লজ্জতা মনে করেন চন্দ্রভূষণ।
হিতৈষী জনেরা অবশ্য কানে মন্তর দিতে আসে। যেমন বোনেরা, ভগ্নীপতিরা। চন্দ্রভূষণ বলেন ‘চাঁদা তুলে সংসার করতে পারবো না। যতক্ষণ চালাতে পারবো চালিয়ে যাব, যখন না পারবো, ওরা ভার নেবে।’
হিতৈষীরা বলেছে, ‘ব্যাচিলারদের সংসারজ্ঞান যে কম হয়, আর একবার সেটা প্রমাণ করলে তুমি! তুমি যখন পারবে না, তখন ওরা চালাবে? ওই আনন্দেই থাকো!’
‘তা যেদিক থেকেই হোক আনন্দটা পেলেই হলো। ওটার জন্যেই তো সব!’
‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই তো তুমি কর দেখতে পাই, সংসারের কাজগুলোও তো ওরা করতে পারে?’
‘বাঃ ওদের সময় কোথা? ওদের নটায় ভাত খেয়ে অফিসে ছুটতে হয়—’
‘তোমার কাজ কাজ নয়? যাতে টাকা আসছে সংসারে?’
‘তবু পরের চাকরি নয়, স্বাধীন ব্যবসা।’
‘তিনজনেই পরের চাকরিতে ঢুকলো কেন? তোমার সাহায্যে লাগলেও পারতো কেউ?’
‘ওদের ভাল লাগে না। বলে কাজটা সম্ভ্রান্ত নয়।’
‘অসম্ভ্রান্ত কাজের আয় থেকে তো দিব্যি—’
‘আঃ ওসব কথা থাক না।’
বাধা দেন চন্দ্রভূষণ। বলেন, ‘ওদের কাজ থেকেই কি ঘরে টাকা আসে না?’
‘আসবে না কেন?’ হিতৈষী বিদ্রূপের হাসি হেসে বলে, ‘ওদের ঘরে আসে!’
চন্দ্রভূষণ এবার গম্ভীর হন। বলেন, ‘ওদের ঘরটা কি আমার ঘর নয়?’
‘হুঁ, কথাটা উচ্চাঙ্গের, কানে শুনতে ভালই লাগলো, কিন্তু ভাবছি তোমার এই উদারনীতির মর্ম কে বুঝবে?’
‘অন্ততঃ আমি বুঝবো!’
‘বুঝবে ভাল কথা’, কিন্তু ভবিষ্যৎ?
‘ভবিষ্যৎ?’
চন্দ্রভূষণ হেসে উঠেছেন, ‘ভবিষ্যৎ কি কেউ ছক কেটে সাজিয়ে রাখতে পারে? কত পাশা উলটোয়, কত ঘুঁটি কাটা যায়!’
বলা বাহুল্য, হিতৈষীরা বিরক্ত হয়ে বিমুখ হয়েছে।
চন্দ্রভূষণ হেসেছেন।
চন্দ্রভূষণ তাঁর দরাজ গলা, দরাজ মেজাজ, আর দরাজ হৃদয় নিয়ে আপন পরিমণ্ডলে বাস করছেন। ভাইপো ভাইঝি, ভাগ্নে ভাগ্নী, এদের নিয়েই সুখে মশগুল, এদের বায়না মেটাতেই তৎপর।
তারাও জানে, মা বাপ কিছু না, চন্দ্রভূষণই তাদের আসল আশ্রয়। জানে, চন্দ্রভূষণ যতক্ষণ উপস্থিত ততক্ষণ তাদের কোনো ভয় নেই। আর যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণই তো ওরা তাঁর দেহলগ্ন!
চন্দ্রভূষণের ব্যবসা এখন অনেকটা যেন নিজের চাকাতেই চলছে, গড়গড়িয়ে চলছে। চন্দ্রভূষণ ধীরে সুস্থে বেলার দিকে যান, ঘণ্টা দুই তিন থাকেন, হিসেবপত্র দেখেন, অর্ডার নেন, মাল ডেলিভারি দেবার ব্যবস্থা করেন, তারপর চলে যান ‘সেখানে’।
‘সেখান’ শব্দটাই ব্যবহার করে এরা। আর কি বলবে? ফিরে এসে নেহাত যৎসামান্যই আহার করেন চন্দ্রভূষণ। বুঝতে অসুবিধে হয় না, খাওয়াটা সেখানেই সারা হয়ে গেছে। নেহাত বাড়িতে ভাইদের সঙ্গে খেতে বসার ঠাট বজায় রাখতেই—
ভাইরা যে খাওয়াটা তুলে রেখে বসে থাকে। বৌরা ব্যস্ত করলেও বলে, ‘দাদা আসুন না।’
মেজবৌ মুখের জন্য বিখ্যাত, সে ঝংকার তোলে। কিন্তু সেজ ছোটই কি কম যায়? এ যুগে আবার কে কিসে কম যাচ্ছে? বিশেষ করে কথায়?
তবে মেজবৌ রেগে রেগে তেতো গলায় বলে, সেজ ছোট তা নয়, তারা যা বলে হেসে হেসে।
বলে, ‘দাদা আসুন বলে তো রাত দশটা অবধি বসে থাকবে? দাদা এসে খাবেন তো কত! ‘সেখান’ থেকেই তো আসল খাওয়া সেরে আসেন, এখানে কেবল খাওয়ার অভিনয়!’
‘সেখান’ শব্দটাই চলিত হয়ে গেছে। ওটা নিয়েই বিরক্তি, ওটা নিয়েই ব্যাখ্যানা। সবদিক দিয়ে ভাল আর সুবিধের একটা লোকের এত বড় একটা গর্হিত দিক থাকবে, এটা কি কম অসহ্য?
তাই ওরা বলে, ‘বলে গেলেই পারেন বাড়িতে খাব না! তা’হলে আর সবাই মিলে ঝুলে থাকি না!’
বাস্তবিকই হয়তো সেটাই সুব্যবস্থা হতো। কিন্তু চন্দ্রভূষণ তা’ বলেন না। রাত্রের ওই একত্রে খাওয়ার পর চার ভাইয়ে বসে গল্পটাও যে প্রায় পারিবারিক ঐতিহ্যের সামিল।
সেই যখন তরুণ চন্দ্রভূষণ ছুটিতে আসতো, তখন দাদার গল্পের আশায় উদগ্রীব হয়ে থাকতো ছোটরা।
মাও থাকতেন।
ছুটে ছুটে একবার এসে বসতেন।
কিন্তু অবকাশ কোথায় তখন তাঁর?
পরে—
মা’র জীবনে কেমন করে না জানি এলো অনেক অবসর! আশ্চর্য, সংসারের কাজগুলো তো সবই রইলো! শুধু ভাত রাঁধার সময় একটা মানুষের ভাগের চালটা কম রান্না হবে, রুটি গড়ার সময় একটা মানুষের রুটি দুখানা কম হবে। আর কি? আর কি কাজ ছিল শশীভূষণের জন্যে? দৃশ্যতঃ কিছুই না।
কিন্তু অদৃশ্যলোকে কোথায় ছিল কাজ, কে জানে! বিধবা সুষমাকে দেখে মনে হতে লাগলো দিন বুঝি আর কাটতে চাইছে না তাঁর অফুরন্ত অবসরের ভারে।
চন্দ্রভূষণও তখন আর দূরের ছেলে নয়, ঘরের ছেলে, তখন মায়ের মনের বিষণ্ণতা দূর করতে যত গল্প ফাঁদতো রাত্রে খাবার সময়।
মা মারা গেলেও প্রথাটা রয়ে গেল।
নইলে সব ভাইরা একত্র হবে কখন?
আর তখনো তো সেজ ছোটর বিয়ে হয়নি। সিন্ধু আর বিন্দু আপন মেরুদণ্ডে স্থির আছে। ইন্দুভূষণের অবশ্য মুশকিলের অবস্থা ঘটেছিল, এদিকে যত রাত বাড়তো, বৌয়ের তত মেজাজ চড়তো। তবু ওদিকের ভয়ের থেকে এদিকের চক্ষুলজ্জাটা ছিল প্রবল।
তা’ আজও সেটা কিছু আছে বৈকি।
সেটাই আছে শুধু।
চক্ষুলজ্জাতেই ভাইরা বলে, ‘দাদা আসুন না!’
বলে, ‘তাড়া কি? দশটা তো বাজেনি এখনো?’
বৌরা এ ইচ্ছে প্রকাশ করেছে—খেয়ে নিয়ে দাদার জন্যে বসে থাকা হোক, কিন্তু সেটার যেন তেমন সায় পায়নি। ভাইরা ভেবেছে ওতে দাদাকে ক্ষুণ্ণ করা হবে। দাদাকে লজ্জায় ফেলা হবে।
এখন যে দাদা এসেই হৈ হৈ করে বলেন, ‘কি? সব আছিস তো না খেয়ে? তোরা সারাদিন খাটিস খুটিস, খেয়ে নিলে হয়!….আচ্ছা, জলদি জলদি—’
এরা তো তখন বলতে পারে, ‘না না, খিদেই পায়নি এখনো। সন্ধ্যেবেলা এসে চা—টা খাওয়া হয় কতকগুলো—’
খেয়ে দেয়ে বসে থাকলে বলতে পারবে সেটা।
লজ্জা উভয় পক্ষে!
ছোটবৌ উদিতা একটু বেশী প্র্যাকটিক্যাল।
উদিতা বলে, ‘এই অর্থহীন সেন্টিমেন্টের কী মূল্য বুঝি না! নাওয়া, খাওয়া, ঘুম, মানুষের নিজস্ব ব্যাপার। যার যখন সময় হবে, সুবিধে হবে, প্রয়োজন হবে, সে তখন সেরে নেবে! তা’ নয় একজনের জন্যে বাড়িসুদ্ধ সবাই ঝুলে বসে থাকবে। মানে নেই কোনো!’
উদিতার বর সিন্ধুভূষণ বলে, ‘তা জগতে তো কতই মানেহীন কাজ ঘটছে। ধর, আমার সঙ্গে তোমাকে জুড়ে দেওয়া, এটাই কি বিধাতার একটা মানেপূর্ণ কাজ হয়েছে?’
উদিতা রেগে গুম হয়ে যায়।
সেজবৌ সুনন্দা বলে, ‘রাত করে খেয়ে খেয়ে অম্বলের অসুখ ধরে গেল!’
‘তুমি খেয়ে নিলে পারো।’
বিন্দুভূষণ বলে।
সুনন্দা ভ্রূভঙ্গী করে উঠে যায়।
মেজ গজরায় বসে বসে। একশোবার ঘড়ি দেখে এবং প্রায়শঃই ঘুম পেয়েছে বলে শুয়ে পড়ে।
তা’ সত্যিই তো, ঘুম পায় না মানুষের?
খিদে পায় না?
একটা আধবুড়ো আইবুড়ো ভাসুরকে নিয়ে নিত্য এত অসুবিধা পোহাবার দরকার?
সংসারের রসদ যোগান বলে?
দরকার নেই যোগাবার।
যে যেমন পারবে নিজ নিজ সংসার চালাবে! তাতে স্বাধীনতা, তাতে সুখ, তাতে স্বাচ্ছন্দ্য!
হ্যাঁ, গুরুজন বলে মানা উচিত।
একশোবার উচিত।
কিন্তু গুরুজন যদি চরিত্রহীন হয়?
থাকবে শ্রদ্ধা, ভক্তি, উচিতবোধ?
যখন এসব ছিল না, এ রোগ ধরেনি, তখন কি বৌরা করেনি মান্য ভক্তি?
ভাইদের অবশ্য এখনো তেমন করে টলানো যাচ্ছে না, বলছে কি, ‘থাক না—ও নিয়ে আলোচনায় দরকার কি? বাড়িতেও তো অশোভন কিছু করছেন না! ব্যাচিলার মানুষের একটু আধটু দুর্বলতা আসাই স্বাভাবিক।’
কিন্তু মেজবৌ শেফালীর বিদ্রোহটাই বেশী। ও ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে, ‘বরং উলটো! না থাকাই স্বাভাবিক! স্বেচ্ছায় যখন এ জীবন বেছে নিয়েছেন! এমন তো নয় যে, সংসারের জ্বালায় বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি গো! তাই অতৃপ্ত ক্ষুধার বশবর্তী হয়ে—’
মেজ ইন্দুভূষণ গম্ভীর হয়ে বলেছে, ‘শেফালী, দাদা তোমার ভাসুর—’
‘ভাসুর, সে কথা অস্বীকার করছি না, তবু হককথা আমি বলবই।’
‘আমার শ্রবণশক্তির সীমানাটা বাদ দিয়ে বললেই ভাল হয়—’
‘ভাল মন্দ আমি বুঝি না। জানি যা সত্য, তা’ সত্য।’ সত্যভাষিণী শেফালী সত্যের মহিমায় আরো উদ্দীপ্ত হয়ে বলে, ‘শ্রদ্ধার যোগ্য হলে তবেই শ্রদ্ধা!’
সেজবৌ সুনন্দাও তার স্বামীর কাছে একথা তোলে। তবে রেগে নয়, হেসে। বলে—
‘নিত্য যদি ভাসুরের অভিসার যাত্রা দেখতে হয়, তা’হলে কি করে তাঁর মানসম্মান রেখে চলা যায় বল তো?’
সেজ বিন্দুভূষণ সর্বদাই ঈষৎ কৌতুকের গলায় কথা বলে, মুখের হাসিতেও সেই প্যাটার্ন। বলে, ‘দেখতে কে মাথার দিব্যি দিয়েছে? না দেখলেই পারো।’
‘আহা’ চোখের দেখাটাই যেন সব! মনে মনে দেখছি না? আমার মা দাদা সবাই যখন ওই কথা তোলেন, মাথা কাটা যায়।’
‘তাঁদের তোলার দরকার কি?’
‘দরকার নেই? বাঃ। কুটুম্বের সমালোচনা কে না করে?’
‘করে বুঝি? তবে তুমি তো কুটুম্ব নয়, তোমার এসব কথা থেকে বিরত থাকাই ভাল। যতই হোক গুরুজন!’
সুনন্দা হেসে গড়িয়ে বলে, ‘গুরুজনের পোষ্টটা আর রাখতে পারছেন কই?’
ছোটবৌ উদিতাও বলে, ‘অবিশ্বাস করতে পারলে বেঁচে যেতাম, কিন্তু অবিশ্বাস করতে পারছি কই? শুনলে তো সেদিন তোমাদের ছোট জামাইটার কথা?’
ছোট জামাইবাবু বলেছে বটে সেদিন, ‘সেই যে কথা আছে না, ‘সাধলে জামাই কাঁঠাল খায় না, শেষে আবার খোসা পায় না।’ আমাদের বড়দাটির হয়েছে তাই! আরে বাবা, জগতের সার তত্ত্ব হচ্ছে নারীতত্ত্ব! জোর করে তাকে অস্বীকার করলেই হলো? হয় না। পরিণামে এই হয়। পঞ্চাশ বছরে লোক হাসায়! আরে বাবা, প্রকৃতি বড় কড়া জমিদার, সে প্রজার ঘর জ্বালিয়ে দিয়েও বাকি খাজনা আদায় করে।
ছোট জামাইবাবুই বেশী বলে।
রহস্যের হদিসও সেই প্রথম দিয়েছিল। নইলে এরা কি স্বপ্নেও সন্দেহ করতো? করতে পারতো? এরা তো ভাবতো, ব্যবসার জন্যে বেচারা দাদাকে আজকাল বেশী রাত অবধি খাটতে হয়।
ছোট জামাইবাবুই প্রথম খবর আনলো, ‘রোজ সন্ধ্যেয় বড়দা বেলেঘাটায় যায় কেন বল দিকি?’
‘বেলেঘাটা?’
‘সে কি? বেলেঘাটার ধারেকাছেও তো দাদার যাবার দরকার পড়ার কথা নয়। তবে বোধহয় দৈবাৎ কোনোদিন মিস্ত্রীটিস্ত্রীর সন্ধানে—’
‘উঁহুঁ, ছোট জামাইবাবু রহস্যের হাসি হেসেছে ‘দৈবাৎ নয়, প্রতিদিন। মিস্ত্রী নয়, বোধকরি ওর সঙ্গে ছন্দ মেলানো আর কিছুর খোঁজে—’
‘তার মানে?’
‘আছে মানে।’
‘কী ব্যাপার তাই শুনি?’
‘ব্যাপার ঘোরতর! নারীঘটিত ব্যাপার!’
প্রথমটা বিশ্বাস করেনি এরা, ওকেই অবজ্ঞা করেছিল, কিন্তু ও অনেক চেষ্টায় নিজের প্রতিষ্ঠায় এসেছে। এমন প্রমাণপত্র যোগাড় করেছে, যাতে অবিশ্বাসের আর পথ থাকেনি।
অনেকদিন বেকার ছিল ছোট জামাইবাবু, চন্দ্রভূষণ মাসিক সাহায্য করে ওকে অসুবিধের হাত থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তাই হয়তো ঋণশোধের এই চেষ্টা কৃতজ্ঞ লোকটার!
দাদার এই বুড়োবয়সের অধঃপতন ভাইদের মাথা হেঁট করছে বৈকি। তবু দাদাকে মুখোমুখি কিছু বলতে যেন বাধে!
আর মুখোমুখি দাঁড়ালেই কি বিশ্বাস হয় লোকটা চরিত্র হারিয়েছে?
সেই ফরসা রং, সেই দীপ্ত দৃপ্ত চেহারা, সেই দীর্ঘ ঋজু ভঙ্গী, আর সেই উদাত্ত দরাজ মেজাজ! তারতো এতটুকু ব্যত্যয় ঘটেনি, তবে কোন ফাঁকে সাপে দংশে নীল করছে তাঁকে?
ঘুম থেকে ওঠেন চন্দ্রভূষণ সকলের আগে। স্নান করে নেন তখনি, উঠে যান তিনতলায় ঠাকুরঘরে, যেখানে সুষমার ফেলে যাওয়া ঠাকুরগুলি আছেন। গোপাল, গুরুদেব, রাধাকৃষ্ণ।
সুষমার বড় যত্নের জিনিস ছিল।
চন্দ্রভূষণ কি সেই যত্নের প্রতিমাগুলিকে পূজো করতে যান? নাকি মাকে? হয়তো একটা থেকেই দুটো হয়। হয়তো মায়ের এই আদরের আর ভক্তির বিগ্রহগুলির পূজা করলেই মাকে পূজা করা হলো ভাবেন চন্দ্রভূষণ।
তা যাই ভাবুন, তিনি যখন পূজো করে নামেন, পরনে থাকে মায়ের দরুনই একখানা গরদের থান ধুতি আর চাদর, দেবতার মত দেখতে লাগে তাঁকে। অন্ততঃ ওঁর ছোট ভাইদের চোখে লাগে। তখন মনে হয় না, ‘বেলেঘাটা’ নামক একটা জায়গা আছে, এবং সেখানে কোনো এক কুশ্রী রহস্যের সঙ্গে জড়িত আছেন দাদা।
চন্দ্রভূষণের পূজো করে নামার সময় ওরা ঘুম থেকে ওঠে কি ওঠে না। চন্দ্রভূষণই হইচই করে জাগান, চায়ের টেবিলে এসে বসেন, বৌমাদের নাম করে করে ডাকেন, সকালের খাদ্যতালিকার খোঁজ নেন। অপরাধীর ছাপ কোথায় সে মুখে?
ভাইরা ভাবে—আশ্চর্য!
বৌরা ভাবে—পাকা আসামী!
ভাবে, বেলেঘাটায় সেইখানে গিয়ে একবার হাতে নাতে ধরতে পারা যেত!
এ বাড়িতে চায়ের টেবিলের প্রবর্তক চন্দ্রভূষণই।
আগে চন্দ্রভূষণের মায়ের আমলে রান্নাঘরে মেজেয় বসে চা বানানো হতো। কেউ সেখানে গিয়েই হয়তো মাটিতেও চাপটি খেয়ে, কেউ বা চৌকাঠে উবু হয়ে বসে চা পর্ব সারতো। কারো এক পেয়ালা হয়তো তার শোবার ঘরেই পৌঁছে দেওয়া হতো।
মা রান্নায় ব্যস্ত থাকলে বোনেরা চায়ের সঙ্গে এগিয়ে দিত বড় বড় কাঁসার রেকাবিতে হয়তো লুচি আলুচচ্চড়ি, হয়তো পাঁপরভাজা হালুয়া।
চন্দ্রভূষণ শৌখিন মানুষ, চাকে চায়ের টেবিলে তুলেছেন, চায়ের মর্যাদা রেখে টা’য়ের আয়োজন করেছেন।
আরো অনেক কিছুই করেছেন চন্দ্রভূষণ। পৈত্রিক বাড়িকে রং করে বদল করে ঢেলে সাজিয়েছেন। করেছেন ঘরে ঘরে ভাল ভাল ফার্নিচার। কিনেছেন ফ্রিজিডেয়ার, মোটর, রেখেছেন চাকর ঠাকুর।
অন্য সব ব্যাচিলারদের মতই চন্দ্রভূষণও ঘোরতর সংসারী। কোথায় কি পাওয়া যায়, কখন কি পাওয়া যাবে না, কিসের কখন ঘাটতি ঘটতে পারে, এসব তথ্য চন্দ্রভূষণেরই চিন্তার জগতে আশ্রয় পায়, কদাচ অন্য ভাইদের নয়।
বৌদের অতএব সংসার পরিচালনার জন্যে কোনোদিন বেগ পেতে হয় না।
তবু অসহ্য লাগতে শুরু করেছে তাদের।
কারণ?
ওরা বলে, কারণ গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে না পারা! ভাসুর যখন পূজো করে নেমে মার গোপালের প্রসাদ খাও বলে সন্দেশের রেকাবি এগিয়ে দেন, ওদের নাকি বেলেঘাটার কথা মনে পড়ে যায়।
ওদের মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
কিন্তু সত্যিই কি তাই?
অন্য কারণও কি বিদ্যমান নেই?
হয়তো আছে, হয়তো সত্যকার কারণ স্বাধীনতার সুখের অভাব।
তা’ সে অভাব আছে।
জ্ঞানে হোক, অজ্ঞানে হোক, চন্দ্রভূষণ সে অভাব ঘটান!
হয়তো বরেদের ছুটির দিনে বৌরা প্রোগ্রাম ভাঁজছে নিজ নিজ পিত্রালয়ের দিকে ঢল নামানো যায় কিনা, চন্দ্রভূষণ চায়ের টেবিলে দুম করে বলে বসলেন, ‘আজ একটা ভোজ লাগানো যাক—কী বল মেজবৌমা? মেজবৌমাই সুষমার আমলের বৌ, সংসারের অনেক চেহারা দেখেছে সে, কাজেই বাড়ির গৃহিণীর মর্যাদাটা তাকেই দিয়ে থাকেন চন্দ্রভূষণ, পরামর্শের কাজেও তাকেই ডাকেন। আর দাবি তো তারই। বৌ হিসেবে সেই তো বড়!
তবে প্রশ্ন করার পর কি আর উত্তরের ধার ধারেন চন্দ্রভূষণ? তৎক্ষণাৎ গায়ে জামা চড়িয়ে উঠে পড়েন। হুকুম হয়ে যায়, ‘ছোটবৌমা, মাংসটা তুমি ছাড়া আর কেউ যেন হাত না দেয়। ও তোমাদের জগন্নাথের হাত পড়লে মাংসের বারোটা বেজে যাবে!…. সেজবৌমা, চপের মাছ আনছি তাহলে? নাকি ফ্রাইয়ের ভেটকি? ওটা তো আবার তোমার ডিপার্টমেন্ট! যা বলবে আনবো।’
ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে মনিব্যাগের পেট ভরাট করে বেরিয়ে পড়া!
নিশ্চিত জানা, প্রথমেই তিন বোনকে স—স্বামী স—সন্তান নেমন্তন্ন করে আসবেন, তারপর পর্বতপ্রমাণ বাজার করে আনবেন। অর্থাৎ বেচারা বৌদের আশার কুসুমকলির উপর বসিয়ে দেবেন খাঁড়ার কোপ।
ননদরা আসা মানেই তো সারাটাদিনের মত নিশ্চিন্দি!
নিত্যি ভাল লাগে?
ভাসুর না হয় পয়সা খরচ করেন, কিন্তু গতর খরচটি? সে বস্তু তো আর পয়সা দিয়ে মেলেনা? নিজের যার স্ত্রী নেই, তার আবার নিত্যি এত শখ করা কেন?
স্ত্রী নেই বলেই যে শখ, একা স্ত্রীতেই যে জীবনের সব শখ মেটে, এটা খেয়াল করে না ওরা।
তাই আড়ালে বলে, ‘যান না বাবু, বোন ভগ্নীপতিকে ওঁর সেই বেলেঘাটার সংসারে নেমন্তন্ন করুনগে যান না!’
বলে অবশ্য জায়েদের মধ্যে। আর বেশী সাহস হয় না।
বৌদের পিতৃকুলকেও বঞ্চিত করেন না চন্দ্রভূষণ, ডাকেন মাঝে মাঝে তাঁদেরও। সেদিন হয়তো পরিশ্রমটা ওদের গায়ে লাগে কম কিন্তু সেদিনই আবার মন বিগড়োয় বেশী।
নিজের নিজের ছোট ছোট বোনেদের কি বৌদিদের স্বাধীনতা দেখলে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। তারা ইচ্ছে মত খরচ করতে পায় ছুটির দিনগুলো।
তা’ছাড়া ওঁরা নেমন্তন্ন খেতে এসে আলোচনা করে যান, ‘বাড়ি তো তোমাদের তিনপুরুষের, যতই ওপরে রং বুলোও ভেতরে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। আর কী সুখেই বা আছ? পুরনোকালের প্যাটার্ন, ‘অ্যাটাচড বাথ’ নেই, হালকা ব্যালকনি নেই, ডাইনিং স্পেস নেই, বিরাট বিরাট কতকগুলো ঘরই আছে মাত্র। খেতে যাবে সেই রান্নাঘরের পাশে খাবারঘরে! অথচ তোমাদের এই বাড়িটার ইঁট কাঠ বাদ দিয়েও শুধু জমিটার দামই লাখ টাকার বেশী!’
তা খুব অত্যুক্তিও করেন না তাঁরা।
সত্যিই এ অঞ্চলে মাটির দর এখন সোনার দরের বেশী! আর অনেকটাই মাটি আছে সাবেকী বাড়িতে।
ওইটাই মনে পড়িয়ে দেওয়া।
ওইটুকুই ইশারা!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন