আমি চঞ্চল হে – ১

বুদ্ধদেব বসু

আবার পুজোর ছুটি এলো, আবার এলো শরৎ। বর্ষার পুবেল হাওয়া উত্তরে মোড় নিয়ে কোনাকুনি বইতে শুরু করেছে, এ-খবরটা এই রাজধানীর অতি সংকীর্ণ ও গৃহবহুল গলিও চাপা দিয়ে রাখতে পারেনি। আকাশে শাদা মেঘের সাবলীল স্থাপত্য ভেঙে-চুরে মিলিয়ে গিয়ে এখন নীলের জোয়ার উপচে পড়ছে কানায়-কানায়; সৰ্পিল গলির দু-ধারে উঁচিয়ে-ওঠা বাড়িগুলোর ফাঁকে-ফাঁকে হঠাৎ যেটুকু চোখে পড়ছে, তাতেই মনটা থেকে-থেকে প্রচণ্ড দোলা খেয়ে উঠছে। ঋতুর জগতে মস্ত একটা আলোড়ন যে চলেছে তার স্পষ্ট আভাস পাচ্ছি আকাশে-বাতাসে শরীরে চামড়ায়। যেন দীর্ঘ অসুখের অশান্তি-বিশৃঙ্খলার পরে কাপড়-চোপড় ধোবাবাড়ি পাঠিয়ে বিছানা-পার্টি রোদ্দুরে দিয়ে নতুন করে সংসার পাতবার আয়োজন।

আজকাল রাস্তায় বেরুলেই দেখতে পাই, ট্যাক্সি চলেছে মালপত্রে বোঝাই হয়ে ইস্টিশানের দিকে। মনটা ঈর্ষার কামড়ে মুচড়িয়ে ওঠে। কী সুখী ওরা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবি, কলকাতার হাটবাজার হিশেব-নিকেশ পিছনে ফেলে রেলগাড়ির কামরার কোণে একবার গ্যাট হয়ে যারা বসতে পেরেছে, তাদের মতো সুখী আর কে! আর আমার মতো দুঃখীই বা আর কে, এই অতুলনীয় ভ্রমণ-ঋতুতেও যাকে অল্-ডে টিকিটধারী নাবালকদের সংস্রবে ট্রামে চড়ে যেতে হচ্ছে কলকাতার এ-পাড়া থেকে ও-পাড়ায়। ‘ভবানীপুরের তেতলা বাড়িতে আলাপ চলছে সরু-মোটা গলায়—’ আমার বাড়ি ভবানীপুরে হলেও তেতলা নয়, এবং সেখানে এবার সরু-মোটা গলায় যে-আলাপ চলছে, আবু পাহাড় ড্যালহাউসি দূরে থাক, চিরকালের চিরচেনা দার্জিলিঙের সঙ্গেও তার কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই। গেলো বছর উড়িষ্যার কোনো- কোনো জনপদে ভ্রমণের শেষে আমরা সামনের ছুটির জন্য যে-সমস্ত ভ্রমণের সংকল্প করে রেখেছিলাম, এখন পর্যন্ত তাদের পূর্ণতার কোনো লক্ষণই দেখতে পাচ্ছিনে। হয়তো তারা পূর্ণ হবে— পরে— আরো পরে? নাকি তারা বিস্মৃতির পাতালে তলিয়ে যাবে, যেখানে আমার কত অলিখিত গল্প কবিতার ভাঙা কল্পনার ভিড়? ভবিষ্যতের নামহীন দেবতাই জানেন।

জীবনে যা চাই তা পাইনে, যখন পাই, তখন আর তা চাইনে, এই রকমের একটা কথা আছে। কথাটার পিছনে আছে বহু যুগের বহু মানুষের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, তবু এর সঙ্গে সম্পূর্ণ সায় দিতে পারিনে। কথাটা এইভাবে বলা যায় যে আমাদের সমস্ত চাওয়ার পিছনে আছে এক হিংসুক নেমেসিস : তাকে এড়ানো প্রায় অসম্ভব। ধরা যাক, এমন একদিন ছিলো যখন আমি অন্য সমস্ত কিছুর চাইতে এইটেই বেশি করে চাইতাম যে আমার একটি বই ছাপা হয়ে বেরোক। আর এখন সেই বইয়ের সংখ্যার ঠিক অঙ্কটা মনে রাখবার চেষ্টাও অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি; এবং এখানে এসেই যে থামবে এমন আশা করবারও উপায় দেখিনে। আমাকে খেতে হয় : আমাকে লিখতে হয়। আমাকে বাঁচতে হয় : আমাকে লিখতে হয়। এমনকি, এই যে কথাগুলো লিখছি, এ-ও আরো একটা বইয়েরই সূত্রপাত।

তবু জীবনে মাঝে-মাঝে মির‍্যাকলও ঘটে, তা না-হলে জীবন একেবারেই অর্থহীন হতো। কোনো আশা, কোনো কল্পনা— যা হয়তো অনেকদিন ধরে মনের অন্তঃপুরে গোপনে লালন করেছি, তা একদিন সত্যি-সত্যি পূর্ণ হয় : যা চেয়েছি তা-ই ঘটে, যখন এবং যেমন করে চেয়েছি, ঘটে সেই সময়ে ঠিক তেমনি করেই। স্থান-কাল-ঘটনার নৈমিত্তিকতায় চির-বন্দী আমরা, আমাদের পক্ষে এর চাইতে বড়ো সার্থকতা কিছু নেই। তা-ই হয়েছিলো গেলো বছর, যখন সমুদ্রে আর মন্দিরে আর হ্রদে, মর্মরে আর রোমাঞ্চে কয়েকটি দিন আমাদের কানায় কানায় ভরে গিয়েছিলো।

—কয়েকটা দিন! পাঁজির হিশেবে সময়টা খুব বেশি হয় না, সত্যি। কিন্তু যখনই আমরা আমাদের পরিচিত পরিবেশ ও দৈনন্দিন নিয়মিত কাজের এলাকার বাইরে চলে আসি তখনই একটা কাণ্ড ঘটে। মুহূর্তে দ্রুত হয়ে ওঠে সময়ের লয়। এখানে, আমাদের দিন কাটে শান্ত মন্থরতায়, নিয়মের মসৃণ আরামে; প্রতিটি দিন- রাত্রির চেহারা মোটামুটি তার পূর্ববর্তীরই মতো; কালকের দিন-রাত্রির কোন অংশ কী ভাবে কাটবে, আজ তা মোটামুটি বলে দেয়া যায় সহজেই। দিনগুলোর গায়ে ঘণ্টা-মাফিক কাজ, বিক্ষেপ ও বিশ্রামের খাঁজ কাটা, তার সাহায্যে তাদের চেহারাটা স্পষ্ট-নির্দিষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। এবং এও বলতে হবে যে জীবনের অধিকাংশ যাপন করবার পক্ষে এ-অবস্থাই আদর্শ। দিনের প্রতি ঘণ্টায় যদি নতুন উত্তেজনা ও রোমাঞ্চ ঘটতো তাহলে ও-কথাগুলোর কোনো অর্থই থাকতো না, এবং জীবনটা নির্বোধ লাগতো এডগার ওয়ালেসের গল্পের মতোই যেখানে প্রতি পাতায় একটা করে খুন ঘটে। চিরন্তন পিকনিকের মতো ক্লান্তিকর কিছুই নয়, যদি সে-রকম কোনো জিনিশ আমরা কল্পনাতেও আনতে পারি। যারা কেবল ‘ফূর্তি’ করে জীবন কাটায়, আসলে তাদের মতো ঘোরতর অসুখী আর কেউ নয়।

কিন্তু ওখানে, বাইরে, সবই অন্যরকম। এবং এ-রূপান্তর আরম্ভ হয় ইস্টিশানে গিয়ে গাড়িতে ওঠবার মুহূর্ত থেকেই। যেন প্রবেশ করি সময়ের অন্য কোনো স্তরে : গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়ে দু-দিন কাটিয়েই মনে হয় যেন একমাস এখানেই আছি। কেননা দিনরাত্রির গায়ের চিরপরিচিত খাঁজগুলো তখন হারিয়ে যায়, স্পষ্ট কোনো রেখা আর খুঁজে পাইনে। কখন শোয়া, কখন খাওয়া, কখন বেড়ানো কিছুরই ঠিক নেই, আর কাজ নামক অমন মস্ত জিনিশটাই একেবারে সশরীরে অনুপস্থিত। প্রতি মুহূর্তে চোখে ও মনে নতুন ও অনভ্যস্ত ছাপ পড়ছে, দিনগুলো তাই যতিচিহ্নহীন এলোমেলো অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখানে গেলাম, এটা দেখলাম, ওটা করলাম : এই করে-করে একটা দিন অসম্ভবরকম স্ফীত হয়ে উঠে নিছক সময়ের সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে যায়; একটা দিনের মধ্যে আমাদের মন যতবার ও যত নতুনভাবে নাড়া খায় বাড়িতে অভ্যস্ত জীবনে একমাসের মধ্যেও তা হয় না। এও বোধহয় বলা যায় যে বাড়িতে বসে আকস্মিক উত্তেজনাতেও মনে যে-ছাপ পড়ে, তা থেকে বাইরের এই ছাপগুলোর প্রকৃতিই আলাদা। পারিপার্শ্বিকের যেটা নিছক অভিনবত্ব সেটাই, আমার মনে হয়, সময়ের এই সম্প্রসারণের একটা কারণ। যেটা নতুন, যেটা অপরিচিত ও অনভ্যস্ত বলে কখনো অদ্ভুত কখনো আশ্চর্য, তার সম্বন্ধে মনের প্রতিক্রিয়া স্বভাবতই প্রবল। বাইরে গেলেই, সেইজন্যে, মনের ও ইন্দ্রিয়ের সচেতনতা অনেকগুণ সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে; আমাদের দেখাতে অনেক বেশি দেখা, শোনাতে অনেক বেশি শোনা; আমাদের অনুভূতিতে অনেক বেশি অনুভব।

কেননা একটা জিনিশ নিজের সত্তায় যতই আশ্চর্য কি অপরূপ হোক, তার সম্পূর্ণ মহিমা উপলব্ধি করতে হলে বিস্ময়ের দৃষ্টি নিতান্তই দরকার। পুরীতে সমুদ্রের ধার দিয়ে নুলিয়ারা অন্যমনে হেঁটে যায়; যদি কখনো সমুদ্রের দিকে তাকায় তা শুধু এই দেখতে যে নবীন কোনো স্নানার্থীর সাহায্যকারীর প্রয়োজন আছে কিনা। পুরীতে আমরা যে-হোটেলে ছিলুম সেখান থেকে সমুদ্রদর্শনের অপূর্ব সুযোগ মেলে : কিন্তু সে-সুযোগ সম্বন্ধে আমাদের চমৎকার ম্যানেজারটি শুধু পয়লা নম্বরের একটা বিজ্ঞাপন হিশেবেই সচেতন। এবং তিনি যে অবশ্যতই স্থূলমনা কি নির্বোধ কি কল্পনাহীন তাও নয়। তাঁর অবস্থায় পড়লে আমারও কি প্রায় ঐ মনোভাবই ঠিক হতো না? ধরা যাক, রোজ আমি বাস্-এ করে নির্দিষ্ট একটি কর্মস্থলে যাওয়া-আসা করি; চৌরঙ্গির মোড়ে বড়ো শহরের তীব্র ফেনায়িত প্রাণস্রোত দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠি ক-দিন? বলবেন কি, কোথায় সমুদ্র আর কোথায় চৌরঙ্গি! কিন্তু নগরের হৃৎপিণ্ডই কি সমুদ্রের চেয়ে কম বেগবান, কম রহস্যময়? তবু স্বীকার করতে হয় নগরের চেয়ে সমুদ্র নিজস্ব মহিমায় অনেক বেশি বলে ধোপেও ঢেঁকে অনেক বেশি। কিন্তু প্রতিরাত্রে আকাশে যে-তারাগুলো দেখা দেয়, প্রকৃতির প্রকাশ হিশেবে সমুদ্রের চেয়ে কম আশ্চর্য নয় নিশ্চয়ই? কিন্তু ক-দিন আমরা তাকাই, ক-জন আমরা তাকাই? মনে করুন হঠাৎ যদি আকাশে একদিন তারা উঠতো, যদি বিশ্বের ‘জটিল অঙ্কের কাটাকুটির একটা ফল এই হতো যে পৃথিবী থেকে তারাগুলো বছরে একদিন মাত্র দেখা যাবে!

অভ্যাসের পর্দা সরিয়ে যারা দেখতে পারে, তারা বিরল। এবং যারা পারে তারাও সব সময় পারে না। মুহূর্তের এক বিদ্যুৎ-ঝলকে বাইরের খোলস ভেদ করে দৃষ্টি প্রবেশ করে বস্তুর মর্মমূলে। এই ‘দেখা থেকেই সমস্ত আর্টের সৃষ্টি। এমনি উন্মোচন-মুহূর্ত যার জীবনে যত বেশি আসে, নিঃসংশয়ে বলতে পারি সেই তত বড়ো ভাগ্যবান। এই ‘দেখার ক্ষমতা নিয়ে যে জন্মায় সে তো বন্দী নয় তার পারিপার্শ্বিকের খাঁচায়, তার পারিপার্শ্বিককে সে থেকে-থেকে নতুন করে সৃষ্টি করে নেয় আপন কল্পনার রামধনু-রঙে। আর এ-ক্ষমতা যার মধ্যে একেবারেই নেই, জীবন তার পক্ষে অতি সহজেই জীর্ণ হয়ে আসে, হাঁপিয়ে ওঠে সে পারিপার্শ্বিকের একটানা একঘেয়েমিতে, তৃষিত হয়ে থাকে নিছক ভৌগোলিক পরিবর্তনের (যার মানে অনেক সময় নিছক জড়বস্তুর চেহারার পরিবর্তন) উত্তেজনার জন্য। কিন্তু সমস্ত পৃথিবী হাজারবার চষে বেড়ালেও তারা কি তার আণবিক ভগ্নাংশও পাবে যা পেয়েছিলেন রুগ্ন পাস্কাল ছোটো খুপরিতে আবদ্ধ হয়ে থেকে?

‘জীবনে বৈচিত্র্য নাই,’ আমার এক কবি-বন্ধু একদা এই বলে আক্ষেপ করেছিলেন। কথাটা এক হিশেবে এত সত্য যে প্রায় ধরা বুলির সামিল। কেননা আমাদের এই জীবনটার প্রকৃতিই এইরকম যে তার বৃহত্তম অংশ কাটে পুনরাবৃত্তিতে। প্রতিদিন একই গৃহে আমরা বাস করি, করি একই (কি একই রকমের) কাজ, ব্যবসার কি বন্ধুতার খাতিরে মিশি (মোটামুটি) একই জনগুচ্ছের সঙ্গে। এমনকি, আমাদের (অন্তত আমাদের অধিকাংশের) নিত্য-ব্যবহার্য জিনিশপত্র বাসনকোশন কাপড়চোপড় পর্যন্ত যথেষ্ট দীর্ঘকাল ধরে একই থাকে। রোজ নতুন সঙ্গী পাওয়া অসম্ভব, এবং বৈচিত্র্যের খাতিরে যদি গল্প লেখা ছেড়ে নিজের হাতে মোটর বানাবার শখও হয় তা পূর্ণ করবার পথে বাধা বহু ও অনতিক্রম্য। চাই আর না-ই চাই, এই একঘেয়েমি আমাদের ললাট-লিখন।

কিন্তু আসলে বৈচিত্র্যের অভাব আমাদের জীবনে নয়, আমাদের মনে— অভাব আমাদের মনের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করবার ক্ষমতার। মনের একটা সহজ রসক্ষারণ আছে, যার সাহায্যে প্রতিদিনের পুনরুক্ত এই জীবন-প্রণালীতে আমরা সুখ পাই। প্ৰতিদিন সকালে ভাঁজ-করা খবরের কাগজ খুলতে ভালো লাগে, ভালো লাগে স্নানের পরে চুল আঁচড়াতে, ভালো লাগে ঠিক সময়ে খাওয়া-শোয়া, ভালো লাগে চায়ের সঙ্গে খুচরো গল্প। এই ভালো লাগাটাই স্বাভাবিক। একই কাজ, একই জিনিশ প্রবৃত্তিগত কোনো উপভোগের সঞ্চারে বৈচিত্র্যে রসিয়ে ওঠে। এটা আমাদের ধর্ম। জাতির সংরক্ষণ ও চিরন্তনীকরণের জন্য প্রকৃতির যত ব্যবস্থা, এও তার একটা। মানুষ যে বাঁচতে চায় তার মূল রহস্যই এইখানে।

বিপদ তখনই ঘটে, যখন অন্তর সেই বৈচিত্র্যের রস আর জোগান দিতে পারে না। তখনই ক্লান্ত লাগে, জীবনের গ্রন্থি যেন শিথিল হয়ে আসে, আত্মরক্ষার অন্ধ চেষ্টায় অন্ধের মতো চারদিকে হাতড়াই। সাধারণ ছটফটানি খুঁতখুঁতানি থেকে মৃত্যূপম ক্লান্তি; সাধারণ ক্লান্তি, অবসাদ থেকে বোদলেয়ারের মুক্তিহীন তিক্ত বৈরাগ্য : এর আছে অসংখ্য সূক্ষ্ম স্তরবিভাগ। এটাই ভাগ্যের কথা যে আমাদের বেশির ভাগকেই খুব বেশি নিচে নামতে হয় না। খানিকটা কিছু ভালো-না-লাগার জড়তার পরে আমরা ফিরে আসি স্বাভাবিকতায়। নিম্নতম নরকে যাঁরা অবতরন করতে পারেন তাঁরা দেবতারই মতো বিরল। মৃত্যুপম, মৃত্যুহীন ক্লান্তিকে মুখোমুখি দেখতে হলে বোদলেয়ারই হতে হয়।

এও সত্য যে স্বাভাবিক উপভোগ-ক্ষমতা যাদের মধ্যে প্রচুর যারা জীবন শিল্পে প্রতিভাবান তারাও মাঝে-মাঝে ক্লান্তির আক্রমণ আর রোধ করতে পারে না, তাদেরও মন থেকে মাঝে-মাঝে এ-আক্ষেপ বেরোয়— জীবনে বৈচিত্র্য নাই। কী হয়? না, সমস্ত জীবনটার উপর যেন অভ্যাসের ঢাকনা পড়ে যায়, উপভোগের সূক্ষ্ম মুখগুলো সেই পুরু খোলস ফুঁড়ে পৌঁছতে পারে না। তখন, যে করেই হোক, জীবনটাকে নতুন করে নিতে হয়। এবং সকলেই জানে, এই নতুন করে নেয়ার সব চেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে— ভ্রমণ। কিছুদিন বাইরে ঘুরে ফিরে এলেই পুরোনো জীবনকে নতুন করে আবিষ্কার করি, নতুন— এবং দ্বিগুণ— উৎসাহ নিয়ে তাকে ভালোবাসি। চেস্টার্টন সেই যে লন্ডন থেকে গাড়িতে উঠে সহযাত্রীর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি লন্ডনে যাচ্ছি— প্যারিস, ভিয়েনা, বার্লিন, রোম হয়ে, – এই হচ্ছে সত্যিকারের কথা। আমরা যখন হাওড়া থেকে মুসৌরি কি উটকামন্ড, ওয়াল্ট্যায়ার কি জব্বলপুরের উদ্দেশ্যে গাড়িতে চেপে বসি, তখন আসলে আমরা কলকাতাতেই যাচ্ছি; এ হচ্ছে আমাদের কলকাতা-আবিষ্কার-যাত্রা। ফিরে এসে কলকাতাকে নতুন করে পাই, নতুন করে পাই আমাদের বাড়ি-ঘর কাজকর্ম। ফিরে আসবার নির্দিষ্ট ঘর আছে বলেই ভ্রমণ সুখকর ও সার্থক।

ভ্রমণের সার্থকতা সম্বন্ধে ইস্কুলের ছেলের যে-সব রচনা লিখতে হয় তা আমরা সকলেই জানি। এবং সেখানে ভ্রমণের প্রতি যে-সব মহৎগুণ আরোপ করা হয় তাও জানি। এক কথায় বলতে গেলে, ভ্রমণ হচ্ছে মানসিক ডন-কশরৎ, বুদ্ধিবৃত্তির স্যান্ডোসিস্টেম। তাতে আমাদের পরিপ্রেক্ষিত হয় উদার, দৃষ্টি হয় সূক্ষ্ম, সংস্কারের সংকীর্ণতা যায় কেটে; তার ফলে আমরা দেখতে শিখি, ভাবতে শিখি; সমস্ত শিক্ষার শেষ সম্পূর্ণতা সেখানেই। এ-সমস্ত কথায় বিশ্বাস করতে যদি পারতুম! কিন্তু প্রকৃত ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই— কী? যা দেখতে পাই, তা বাংলাভাষার ‘ভ্রমণকাহিনী’গুলোর একটু পাতা ওল্টালেই বোঝা যায়। (অবিশ্যি রবীন্দ্রনাথের ঐ শ্রেণীর রচনা বাদ দিয়ে বলছি; এবং রবীন্দ্রনাথের রচনার সঙ্গে অন্য যে-কোনো কাহিনীর ক্ষণিক তুলনা করলেই প্রভেদটা স্পষ্ট হবে।) য়োরোপে বেড়িয়েছেন এমন বাঙালি স্ত্রী-পুরুষের আজ অভাব নেই, ভ্রমণ-বৃত্তান্ত যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সংখ্যাও নেহাৎ অল্প নয়; এবং সে-সব লেখা পড়ে এটাই আমরা উপলব্ধি করি যে ঠিক যেমন বই পড়লেই শিক্ষা হয় না, তেমনি জলে-স্থলে-আকাশে বিভিন্ন যানে ঘোরাঘুরি করলেই ভ্রমণজনিত নানা মহৎ গুণ অন্তরে বর্তায় না। সেই এক বুড়ি জগন্নাথ দেখতে গিয়ে লাউমাচাই দেখেছিলো; সেই এক প্রহসনের চরিত্র বোম্বাই সম্বন্ধে এই মন্তব্য শুধু করেছিলো যে সেখানে গাঁজার দাম বড়ো বেশি। লন্ডনের হোটেলের বাথরুম কেমন সুন্দর, ভিয়েনার বাজারের মাংসের স্টল কী আশ্চর্যরকম পরিষ্কার, প্যারিসের প্রধান রাজপথে ক-টা ফুটপাত এই ধরনের বহু তথ্য বঙ্গীয় পশ্চিমযাত্রীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা সহজ। এ-নিয়ে অবিশ্যি আক্ষেপ করে লাভ নেই; কেননা আমরা যা দেখি, তা তো বাইরের কোনো বস্তু নয়; নিজেদেরই ভিতরে যা থাকে, তা-ই শুধু আমরা দেখি। এবং নিজেদের ভিতরে যা নেই, বাইরে আমরা কখনোই তা দেখতে পাবো না।

এই জন্যে এটা জোর করেই বলা যায় যে ভ্রমণের প্রতি যে-মহৎগুণই সাধারণত আরোপিত হোক না, সকলের জন্যে সেটা নয়। সকল ক্ষেত্রেই এমনি; বিদ্যাভ্যাস থেকে লাভের সম্ভাবনা তো অপরিসীম, কিন্তু একই ক্ষেত্র থেকে আহরণের বিভিন্নতা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে যে কত বেশি ও কত বিচিত্র তা আমরা প্রতিদিনই প্ৰত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছি। কোনো জিনিশই নিরপেক্ষ শুভ নয়, সমস্ত সত্যই ব্যক্তিগত। একখানা বইয়ের মধ্যেও আপনি তা-ই পড়বেন, যা আপনার নিজের মধ্যে আছে; সেই জন্যে হাজার লোকের কাছে একই বইয়ের হাজার রকম অর্থ। এক যাত্রায় পৃথক ফল মানবপ্রকৃতির অনিবার্য নিয়ম। কেউ কালিদাস পড়বে শুধু অশ্লীল শ্লোকের আশায়, কেউ কাশ্মীরে গিয়েও শুধু গণিকা অন্বেষণ করবে। কেউ বাড়ি থেকে বাস্-এর রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যা সংগ্রহ করতে পারবে, অন্য কেউ আফগানিস্থানের সীমান্ত পর্যন্ত ঘুরে এসেও তা পারবে না। এবং বাইরের ঘটনা থেকে কে কতটা আহরণ করতে পারবে তা অবিশ্যি নির্ভর একমাত্র তার নিজস্ব প্রতিভার উপর, যেটা সম্পূর্ণরূপে দৈব। (ম্যাডাম, আপনাকে যুক্তি দিতে পারি, বুদ্ধি দিতে পারিনে। মহাশয়, আপনাকে একটি লাইব্রেরি ও রেলকোম্পানির রিটন টিকিট দিতে পারি, অভিজ্ঞতা অর্জন করবার ক্ষমতা দিতে পারিনে।)

বই থেকে চরম রস নিষ্কাশণ করতে পারে যে-মানুষ, যে পারে সুখী হতে নিজের মনে চুপচাপ একা বসে, ঠিক সেই পারে ভ্রমণ থেকে পূর্ণতম লাভ নিংড়ে নিতে। ক্ষমতাটা একই, ক্ষেত্রটা শুধু আলাদা। বলা বাহুল্যমাত্র, ক্ষমতাটা খুব অল্প লোকেরই থাকে। অধিকাংশ— এবং অতিশয় অধিকাংশই— মূঢ়ের মতো পড়ে, অন্ধের মতো বেড়ায়, জীবনের নানা অনিবার্য ঘটনা থেকে মূল্যবান কিছুই সঞ্চয় করতে পারে না। ঘটনার নামই অভিজ্ঞতা নয়, ঘটনা হচ্ছে কাঁচামাল যা থেকে অভিজ্ঞতার সৃষ্টি। এবং সেই সৃষ্টি— মনের বিশেষ একরকম রসায়নক্রিয়া— বিশেষ একটি ক্ষমতাসাপেক্ষ। সেটাই শিল্পীর ক্ষমতা বলা যায়। কেননা এটা দেখা যায় অভিজ্ঞতার প্রতিভা আত্মপ্রকাশের ক্ষমতার সঙ্গে প্রায়ই সংযুক্ত। বাঁচতে যে জানে, বলতেও সে পারে।

ভুল বললাম কি? ছাপার অক্ষরে আত্মপ্রকাশ করে কত লোক, প্রকাশভঙ্গি যে সব সময় নিতান্ত অনিপুণ হয় তাও নয়, কিন্তু তাতে থাকে না দর্শন-গ্রহণ- মননশক্তির কোনো পরিচয়। যে লিখছে, বিশেষ একটি ব্যক্তি বলে তাকে ধারণা করতে পারিনে। নিজেকে সে দিতে পারেনি লেখার মধ্যে : আর তার কারণ কি এই যে তার নিজের মধ্যে দেবার মতো কিছু নেই, নাকি ভাষার উপর এমন প্রভুত্ব তার নেই যাতে সে যথেষ্ট করে বলতে পারে?

এ-সূক্ষ্ম প্রশ্নের মীমাংসা কখনোই হবে না। অন্যপক্ষে, এমন লোকও তো কতই থাকতে পারে, অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষমতা যাদের আছে, কিন্তু যারা প্রকাশ-অক্ষম বলেই অজ্ঞাত রইলো। চট করে কথাটাকে উড়িয়ে দেবার কিছু নেই। তবু এই শ্রেণীর লোক যদি থাকেও, বাধ্য হয়েই তাদের গণনার বাইরে ফেলতে হয়, প্রকাশহীন বলেই তারা পরিচয়হীন; তাদের অভিজ্ঞতার মূল্য নির্ধারণ করা স্পষ্টতই অসম্ভব।

এটুকু মাত্র নিরাপদে বলা যায় যে এই যুগ্ম ক্ষমতার আছে অসংখ্য স্তরবিভাগ; এবং যেখানেই জীবনের. ও প্রকাশের এই উভয় ক্ষমতার অবিচ্ছেদ্য চরম স্ফুরণ, সেখানেই মহৎ প্রতিভা। পিরামিডের সেই সূক্ষ্ম সংকীর্ণ চূড়ায় অতি অল্প লোকেরই আসন। কথাটা বলবার দরকার করে না, তবু বলি যে আমার স্থান সেখানে নয়। পিরামিডের তলার দিকে কোনোখানে একটু কোণ আমার জুটতে পারে কিনা সে- বিষয়েও অনেকে সন্দিহান। আমার নিজের ধারণা, এইমাত্র আমি যে-শ্রেণীবিভাগ করেছি, তার মধ্যে ‘অতিশয় অধিকাংশের অন্তত আমি বাইরে। তার কারণ অবিশ্যি শুধু আমার অতিরিক্ত আত্মপ্রীতি হতে পারে। বড়ো কষ্ট লাগে নিজেকে একেবারে জনগণের মধ্যে গণ্য করতে : বিশেষ, জনগণ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে আমি সহজেই পারি, যখন ছাপার কাগজের আড়ালে লুকিয়ে ঐ মনুষ্যমাংসপিণ্ডের উপর বক্রোক্তি করবার সুবিধে আমার আছে।

এই যে আমি কথাগুলো লিখছি তা কি এই প্রমাণ করতে যে আমি সেই স্বল্পসংখ্যকেরই একজন? কিন্তু কেন যে লিখি তা সত্যি আমি জানিনে। লিখতে হয়। কোনো ফরাশি লেখক কাগজে কলম ছোঁয়াবার initial vulgarity’র কথা উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু সেই প্রথম পাপ কবে যে করেছিলাম ভালো করে মনে ও নাই। তারপর চলেছে। শুভ্র কাগজের কৌমার্য সম্বন্ধে প্রথম লজ্জা ও ভীতি একবার কেটে গেলে তারপর বোধহয় ব্যাপারটা শাসনের বাইরে চলে যায়। অন্তত, কারো- কারো পক্ষে। নয়তো যা-কিছু দেখি, শুনি, ভাবি, অনুভব করি, সবই প্রকাশ করতে যাওয়া (হোক না সে প্রকাশ বিশুদ্ধীকৃত, রূপান্তরিত)— ভেবে দেখতে গেলে এর ভালগারিটি অসহ্য। আমরা যারা লিখি, অভ্যেসে গা-সহা হয়ে গেছে বলেই বোধহয় সহ্য করতে পারি।

কেন লিখি, সত্যি? কেন লিখছি এই কথাগুলো? কলকাতা থেকে তিনশো মাইল দূরে এক জায়গায় গিয়ে একদিন সকালে খুব ভালো আমার লেগেছিলো, এটা কি এতই বড়ো কথা যার জন্যে এখন হাজার কথার জাল বুনতে হবে বসে-বসে? কিন্তু মনে পড়ে যে, থেকে-থেকে কেবলই মনে পড়ে। আলো এলিয়ে পড়ে বিকেলের আকাশে, মনে পড়ে। মাঝরাতে তন্দ্রার উপর দিয়ে গড়িয়ে যায় বালিগঞ্জের রেলগাড়ির দূর, মন্থর শব্দ। হঠাৎ বেজে ওঠে গঙ্গার ঘাটের জাহাজের শিঙা, ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে যায়, শুয়ে শুয়ে ভাবি। আবার বেজে ওঠে দীর্ঘ, গম্ভীর নিস্বন; শুনতে-শুনতে বুকে এসে লাগে অজানা সমুদ্রের এলাচগন্ধী হাওয়ার ঝাপটা। মনে হয়, এই জাহাজের এঞ্জিন ধ্বক্ করে উঠলো, খালাসিরা দড়ি- দড়া নিয়ে ব্যস্ত, জলের উপর রাতের অন্ধকার থমথম করছে, ধীরে ঘুরে যাচ্ছে অস্পষ্ট বন্দর— ভেসে পড়লাম।

সত্যি বলতে, জগতে যতরকম শব্দ আছে তার মধ্যে স্তব্ধরাত্রে এই জাহাজের শিঙার মতো এমন রোমান্টিক, এমন কল্পনা-উদ্দীপক আমার কাছে আর কোনোটাই লাগে না। এ-শব্দ শুনলেই আমার মন উদাস হয়ে যায়, যমুনাকূলে কৃষ্ণের বাঁশির মতোই মনকে এ ঘরছাড়া করে। সেই ধ্বনির ধাক্কা খেয়ে মন উড়ে চলে কত নতুন আকাশ, কত অজানা সমুদ্রের উপর দিয়ে। আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী— এটা এই অবস্থারই কথা। এ-অবস্থা নেশার। সব নেশাই সাময়িক, কিন্তু প্রায় সব নেশাই থেকে-থেকে ফিরে-ফিরে আসে। কেটে যায় তখনকার মতো, আবার আচ্ছন্ন করে। ক্রনিক না-হলে তো নেশা বলে না।

দুঃখের বিষয়, মোর ডানা নাই আছি এক ঠাঁই। এবং যে-ইস্টিমার অমন রোমান্টিক সুরে ডাকে, তা কবিকে মাশুল রেয়াৎ করে না; এবং তার চেয়েও যা শোচনীয়, কখনো-কখনো মাশুল জুটলেও অন্য-কোনো বাধায় আটকে থাকতে হয়। কিন্তু কাঁধে আমার ডানা না-ই থাক, হাতে আমার কলম আছে। এবং সেই কলম নিয়ে বসলে আমি যে-জগতে পলায়ন করতে পারি তা এ-জগতের চাইতে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর, যেখানে আমি খাই, ঘুমোই, জিনিশ কিনতে দরদস্তুর করি। আমার এই মানসভ্রমণের রোমাঞ্চও বড়ো কম নয়। এমনকি, গেলো বছরের রোমাঞ্চিত দিনগুলোকে নতুন করে আবার সৃষ্টিও করতে পারি হয়তো। লাভটা ডবল হলো। তখনকার মতো অনুভূতিগুলি তো পেয়েছি, তার উপর এই স্মরণের সুখ। সময়ের সমুদ্রে স্মৃতির জাদু-ঘেরা দ্বীপ যেন। আমিই তা তৈরি করছি এই কথাগুলো দিয়ে; যা দেহহীন, নামহীন, চির-পলাতক তাকে বাঁধতে চাইছি একটি নির্দিষ্ট ও স্পর্শসহ রূপে। জীবনের সমস্ত আনন্দকেই স্মৃতির এই মায়া সম্পূর্ণ করে। প্রথম আনন্দ হচ্ছে করবার; তারপর মনে করবার, ভাববার আনন্দ। দুয়ে মিলে পূর্ণতা।

অধ্যায় ১ / ১০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন