ফেসবুক প্রোফাইল

অর্পিতা সরকার

আত্রেয়ী ডাইনিং টেবিলে নিখুঁত করে ভাতের থালা সাজিয়ে একটু তটস্থ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে। সায়ন্তন ভীষণ রকমের খুঁতখুঁতে আর রাগী। পছন্দ না হলে ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে না খেয়ে চলে যাবে। তারপর থেকে শুরু হবে আত্রেয়ীর শাশুড়ির অমৃতবাণী। কেন তাঁর ছেলে না খেয়ে চলে গেল, ঠিক কী খুঁত হয়েছিল তাকে খেতে দিতে, এসব তল্লাশি চালিয়ে মহিলা শেষ পর্যন্ত ওকেই দোষী সাব্যস্ত করবেন। আত্রেয়ী নিজেও চায় দোষী হয়ে এই দায়িত্ব থেকে রেহাই পেতে। রান্নাবান্না করে দিলেও সায়ন্তনকে খেতে দিতে ওর একটুও ভালো লাগে না। বিয়ের পর পর অনেক আগ্রহ নিয়ে খাবার সাজিয়ে অপেক্ষা করত আত্রেয়ী। কিন্তু দেখেছে কোনো না কোনো খুঁত বের করে, চিৎকার করে আত্রেয়ীকে দুটো বাজে কথা বলার মধ্যে সায়ন্তন একটা স্যাডেস্টিক প্লেজার পায়। সায়ন্তন খুব চিৎকার করে কথাগুলো বলে, যাতে আশেপাশের বাড়ির লোকজন শুনতে পায়। আত্রেয়ীর শাশুড়ি বেশ গর্ব করে বলেন, ‘আমার সোনুর কাছে এসব ছাড় নেই। বেশ শাসনে রেখেছে বউকে।’

আত্রেয়ীর কোনো রাগ বা অভিমান হয় না এদের প্রতি। আত্রেয়ী নিজেকে শক্ত করে নিয়েছে। তার একমাত্র অভিমানের জায়গা তার বাবা। বাবাই পছন্দ করে বিয়ে দিয়েছে সায়ন্তনের সঙ্গে। নিজের বাবাই যখন মেয়ের মনের খবর নিল না, তখন পরের বাড়িতে এর থেকে বেশি আর কী বা আশা করা যায়! সায়ন্তন, ওর বাবা বা মা এদের ওপরে কখনও তেমন রাগ বা অভিমান হয়নি। কারণ এদের কোনোদিন ও নিজের মানুষ ভাবেইনি। তাই এদের ওপরে কোনো রাগ নেই ওর। আত্রেয়ী শুধু বিয়ের পর থেকে বাবার সঙ্গে আর কখনও আগের মতো প্রাণখুলে গল্প করেনি। বাবা শ্বশুরবাড়িতে এলে যত্ন করে খাইয়েছে, আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি করেনি, কিন্তু আগের মতো বাবার সঙ্গে গল্পে ভাসেনি। বাবা হয়তো আত্রেয়ীর পরিবর্তনটা খেয়াল করেছে, তাই বারংবার বলেছে, ‘মামনি আমার কাছে একটু বস না।’

আত্রেয়ী হেসে বলেছে, ‘উঁহু, তুমি এবাড়ির আত্মীয়, তোমার যত্নের যেন কোনো ত্রুটি না হয় সেটা দেখা আমার কর্তব্য।’

বাবা গাঢ় গলায় বলেছে, ‘আর তুই বুঝি আমার মেয়ে নোস?’

আত্রেয়ী হেসে উত্তর দিয়েছে, ‘ছিলাম বিয়ের আগে।’

মা-ও অনেক চেষ্টা করেছে বাবার সঙ্গে দূরত্বটা ঘুচিয়ে দিতে। কিন্তু আত্রেয়ীর জেদ বড় ভয়ঙ্কর। নিজেকে একটু একটু করে শেষ করে দেবে তবুও বাবাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না ও। ওর কাছে বাবার এখন একটাই পরিচয়—বিশ্বাসঘাতক।

সায়ন্তন ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে বলল, ‘আজ মাত্র তিনরকম ভাজা কেন? আর নেই? এরপর সারাদিন তো শুয়ে-বসে সিরিয়াল দেখে সময় কাটবে। একটু রান্না করতেও কষ্ট হয়? তাও তো তাপুর মা আছে হেল্পিং হ্যান্ড হিসাবে।’

গলার পারদ চড়ছিল সায়ন্তনের। এ ওর রোজকার রুটিন। এরপর খেয়ে নেবে চুপচাপ। কিন্তু বসেই একপ্রস্থ চিৎকার করে নেবে। খুব রেয়ার ভাত ফেলে বেরিয়ে যায়। আত্রেয়ী জানে সেদিন অন্যত্র নিমন্ত্রণ থাকে ওর। ফোনে কখনও কখনও শুনেছে সে কথা। নিমন্ত্রণ আছে জেনেও ওকে দিয়ে রান্না করাবে, খেতে দেওয়াবে তারপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে বীরত্ব দেখাবে। প্রথম বছরটা খুব কষ্ট হত, কান্না পেত। দু-একটা কথাও বলে ফেলত আত্রেয়ী। কথা বললেই সায়ন্তন আরও ভায়োলেন্ট হয়ে যেত। তাই আত্রেয়ী টেকনিকটা শিখে নিয়েছিল। একটা কথাও উচ্চারণ করত না। শুধু বলত, ‘সরি।’ এতে অনেকটা কাজ হতো। আত্রেয়ী জানে এবাড়ির সকলেই মানসিকভাবে অসুস্থ। এরা কখন যে কী করবে, কেউ জানে না। সেসব কবেকার কথা। প্রায় বছর আঠেরো তো হবেই। তবুও চোখ বন্ধ করলেই টেবিলের ধারে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা নিজেকে প্রায় দেখতে পায় আত্রেয়ী। নীচ থেকে সুনেত্রা ডাকছে। সুনেত্রা আত্রেয়ীর একমাত্র সন্তান। মুখ-চোখ-স্বভাব—সবই প্রায় বাবার মতো পেয়েছে। ছোটবেলায় যদিও বা আত্রেয়ীকে মা বলে একটু ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত, তবে এই পনেরো বছরে এসে বাবার মতোই ওকে বাড়ির আর দুটো পরিচারিকার মতোই মনে করে। প্রথম যেদিন আত্রেয়ীর নামে মিথ্যে নালিশ করে, সায়ন্তনের কাছ থেকে থাপ্পড় খাইয়েছিল, সেদিনই আত্রেয়ী বুঝেছিল, আম গাছে আমই হয়।

সায়ন্তন যখন আত্রেয়ীকে মারছিল তখন সুনেত্রার চোখে আনন্দের রেশ ফুটে উঠেছিল। বাবার আদরের মেয়ে বলে কথা! সায়ন্তনও মেয়ে অন্ত প্রাণ। মেয়েটার স্বভাবও ওর মতো উগ্র। কথায় কথায় চিৎকার করা, গায়ে হাত তোলা, ঠিক যেন দ্বিতীয় সায়ন্তন। অবশ্য আত্রেয়ী বিশেষ কিছু আশাও করেনি ওর মেয়ের কাছ থেকে। আত্রেয়ী যত তাড়াতাড়ি পারত সংসারের কাজ মিটিয়ে ছুটে চলে যেত ছাদে। বিশাল আকাশের নীচে একা দাঁড়িয়ে থেকে প্রাণভরে প্রকৃতির নির্যাসটুকু শুষে নিতে। এভাবেই বেঁচে থাকাটা ছিল ওর কাছে একমাত্র বিলাসিতা। ওই বিশালত্বের সামনে নিজের সব সমস্যাগুলোকে যেন মনে হত বড্ড ছোট। সায়ন্তন বিয়ের পর থেকেই আত্রেয়ীকে এবং আত্রেয়ীর শরীরটাকে নিজের সম্পত্তি ভেবে নিয়েছিল। রাতে বিছানায় শুয়ে চুলের মুঠি ধরে টেনে শোওয়াত আত্রেয়ীকে। তারপর, দাঁত-নখ বের করে রক্তাক্ত করত ওর গোটা শরীর। ওটাই নাকি সায়ন্তনের আনন্দ। ওতেই নাকি ও শারীরিক সুখ পায়। এমন অমানুষিকভাবে আঁচড়ানো কামড়ানোর কোনো খবর পায়নি নিউজ চ্যানেলগুলো। কারণ, আত্রেয়ী বিবাহিত। বন্ধ ঘরের এই শারীরিক অত্যাচারগুলোকে লোকে বৈবাহিক মিলন বলে, ধর্ষণ নয়।

আত্রেয়ীর চেহারায় পরিবর্তন দেখা দিল, চোখের নীচে কালি পড়ে গিয়েছিল। ওর বাবা মাঝে-মাঝেই জিজ্ঞাসা করত, ‘সায়ন্তন তোকে ভালোবাসে তো মামনি?’

একমুখ হেসে আত্রেয়ী বলত, ‘ও বড্ড ভালোবাসে বাবা।’

‘তাহলে তোর চোখের তলায় এত কালি কেন, মুখটা এমন পেলব কেন?’

আত্রেয়ী হেসে বলত, ‘সুখে।’

সায়ন্তন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। নম্র-ভদ্র, আত্রেয়ীর খেয়াল রাখা ঠিক যেন পারফেক্ট হাজবেন্ড। সায়ন্তনের এরূপ আচরণ দেখে আত্রেয়ী বেশ মজা পায়। মা তো জামাই বলতে অজ্ঞান। বাবাও বারংবার বলে, সায়ন্তনের মতো ছেলে নাকি লাখে একটা পাওয়া যায়। এটা অবশ্য আত্রেয়ীও মানে। সত্যিই সায়ন্তনের মতো ছেলে লাখে একটা হয়। আত্রেয়ী ওর পরিচিত বন্ধুমহলেও এমন কোনও চরিত্রের মানুষকে দেখেনি।

আত্রেয়ী জীবনের শেষদিনের অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে। একটু একটু করে পুরোনো আত্রেয়ীকে বদলে ফেলে। সায়ন্তনের যেকোনো অন্যায় ব্যবহারে কোনোদিন ওর বাবা-মাকেও প্রতিবাদ করতে দেখেনি। আর শ্বশুরবাড়িতে তো সায়ন্তন বেস্ট জামাই। বাপের বাড়িতে আত্রেয়ী ভীষণ সুখী স্ত্রী। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির চিত্রটি বিপরীত। আত্রেয়ী ছাদের বারোটা টব আর আকাশ নিয়ে সারাদিন মেতে থাকে। ছাদের ওই টবগুলোতে আত্রেয়ী বেলফুল ফুটিয়েছে। না কোনো ভ্যারাইটি নেই, শুধুই বারোটা বেলফুলের গাছ। গাছ ভর্তি সাদা বেলফুল ছেয়ে থাকে চারিদিকে। সেই ফুল দিয়ে আত্রেয়ী ঠাকুর পুজো অবধি করে না। ওগুলো নিজেদের খেয়ালে ফোটে আবার নিজের খেয়ালেই ঝরে পড়ে। শাশুড়ি হাঁটুর ব্যথা নিয়ে দোতলার ওপরের ছাদে উঠতে পারেন না। সায়ন্তনের অকারণ নষ্ট করার সময় নেই বলেই বেঁচে আছে গাছগুলো। এরাই নির্দ্বিধায় বাঁচিয়ে রেখেছে আত্রেয়ীকে।

আরেকটা জিনিস ও বরাবর লুকিয়ে এসেছে সকলের কাছ থেকে। তা হল, কৃষ্ণেন্দুর আঁকা ছবি দেখার নেশাটা। বছর দশেক আগে ফেসবুকে কৃষ্ণেন্দুর নিজস্ব প্রোফাইলে গিয়ে ওর আঁকা ছবিগুলো দিনে অন্তত পাঁচ থেকে ছয়বার করে দেখে আসে। ওর আঁকা সেই ছবি, যেগুলো একসময় সবার প্রথম আত্রেয়ী দেখত। না, অন্য কারোর দেখার অধিকার ছিল না ওর আগে। কৃষ্ণেন্দু ছবি এঁকেই আত্রেয়ীকে ফোন করে বলত, ‘এই যে ম্যাডাম, আরেকটা ছবি এঁকেছি, দেখবে নাকি?’

কৃষ্ণেন্দুর জন্মদিনে ওর স্ত্রী ওকে কেক খাইয়ে দিচ্ছে, অথবা ওদের অ্যানিভার্সারির ছবি দেখে আত্রেয়ীর বুকের ভিতরটা চিনচিন করে উঠত। কৃষ্ণেন্দুর পাশে তো ওরই থাকার কথা ছিল। দুজনের কেউ কোনোদিন ভাবেনি কেউ কারোর প্রাক্তন হয়ে যাবে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। কৃষ্ণেন্দুর স্ত্রীকে ভারি মিষ্টি দেখতে। ওর সঙ্গে দারুণ মানিয়েছে। অবশ্য আত্রেয়ীর থেকে বেশি কাউকে মানাত না কৃষ্ণেন্দুর পাশে। গোটা কলেজ বলত, ওরা নাকি উত্তম-সুচিত্রা জুটি।

ফেসবুকে কী সুন্দর করে ক্যাপশন লেখে কৃষ্ণেন্দু—‘ঠিক এমনই এক রক্তপলাশ আর শিমুলের মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার দিনে আমি পেয়েছিলাম আমার স্বপ্নের রাজকন্যাকে। যে আমার জীবনটা কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে দিয়েছে।’

নীচে ওদের দুজনের হাসি মুখের ছবি। কমেন্টে উপচে পড়া শুভেচ্ছাবার্তা এবং অভিনন্দন। কমেন্ট বক্সের অনেক মুখই আত্রেয়ীর চেনা। ওরা সবাই একই ব্যাচের সহপাঠী ছিল।

কৃষ্ণেন্দু কখনও আবার ক্যাপশন দেয়, ‘যাকে ভালোবেসে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া যায়, যাকে ভালোবেসে কাটিয়ে দেওয়া যায় একটা গোটা জীবন, আজ তার সঙ্গে পাহাড়ের কিনারায়।’ ক্যাপশনের নীচে কৃষ্ণেন্দু এবং ওর স্ত্রী রঞ্জিনীর ছবি। পাহাড়ের ধারে দুজনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ছবিগুলো দেখলে আত্রেয়ীর ভীষণ কষ্ট হয়। তবুও ওর দেখতে ইচ্ছে করে। মনে মনে বলে ওঠে, ওরা ভালো থাকুক। কৃষ্ণেন্দুও নিশ্চয়ই তাই চায়। আত্রেয়ী ভালো থাকুক এটাই সবসময় চাইত ও। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর চাওয়ায় কিছু এসে গেল না আত্রেয়ীর। ওর ভালো থাকা হল না। আত্রেয়ী চেষ্টা করেছিল কৃষ্ণেন্দুকে ভুলে সায়ন্তনকে ভালোবাসতে। কিন্তু সমস্যাটা হল অন্য জায়গায়, সায়ন্তন আত্রেয়ীর কাছ থেকে একেবারেই ভালোবাসা চায় না। ও আত্রেয়ীর শরীর চায়, আত্রেয়ীর যত্ন, তোষামোদ চায়, আত্রেয়ীকে অপমান করে সুখ পেতে চায়, আত্রেয়ী কাঁদছে এটা দেখে অনন্দ পায়, শুধু ও ভালোবাসছে এটুকুই চায় না সায়ন্তন। ভালোবাসা শব্দটা বোধহয় বড্ড বিরক্তিকর ওর কাছে। আরও একটা জিনিস চায় না সায়ন্তন, আত্রেয়ী হাসছে এটাও সহ্য করতে পারে না ও।

সুনেত্রা হওয়ার পর থেকে মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে সায়ন্তন। মেয়েকে নিজের মতো গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। অবশেষে সাফল্যের হাসি হেসেছে। কিন্তু যবে থেকে ফেসবুকে কৃষ্ণেন্দুর প্রোফাইলটা খুঁজে পেয়েছে তবে থেকে যেন নতুন নেশায় বেঁচে আছে ও। আজ কী পোস্ট করল কৃষ্ণেন্দু? এটা দেখার নেশায় এবাড়ির অনেক অপমান তুচ্ছ হয়ে গেছে ওর কাছে। মাঝে মাঝেই ওর বিভিন্ন এগজিবিশনের ছবি দেয় কৃষ্ণেন্দু। আত্রেয়ী সেদিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এবাড়িতে এত সময় কোথায়? দিনরাত কাজ আর কাজ।

তাড়াতাড়ি করে নিজের কাজকর্ম সেরে দরজা বন্ধ করল আত্রেয়ী। আজ ২২শে জুন, বাংলা তারিখ অনুযায়ী ৭ই আষাঢ়। আজ কৃষ্ণেন্দুর জন্মদিন। এবারে বাংলা আর ইংরাজি ডেট একই পড়েছে। আত্রেয়ী মনে মনে ভাবল ওর প্রোফাইলে গিয়ে দেখতে হবে, কে কে উইশ করেছে। এই দিনটায় প্রতিবার ওরা বৃষ্টির মধ্যেই কফি হাউজে যেত। বর্ষাকালের কলেজ স্ট্রিট। হাঁটুজল উঠে সে এক বিশ্রী অবস্থা। আত্রেয়ী বলত, ‘তোমার সঙ্গে পবনদেবের আগের জন্মে মনে হয় ঝামেলঝাটি হয়েছিল, বুঝলে। তোমার জন্মদিনের দিনই কুলোয় করে জল ঢালে কেন?’

কৃষ্ণেন্দু হাসতে হাসতে বলত, ‘গোটা শহরটাকে ধুয়ে দেবে বলে। আর তোমার মনটাকে আমার জন্য ভিজিয়ে দেবে বলে।’

আত্রেয়ী লজ্জা পেয়ে বলেছিল, ‘আর কত ভেজাবে? চব্বিশঘন্টা তো তোমাকে নিয়েই ভেবে যাই। এবারে বোধহয় বন্যা নামবে আমার মনে।’

বৃষ্টির সকালে মা বলত, ‘আজ কোথায় বেরোবি? আজ কলেজ ছুটি হয়ে যাবে যে!’

আত্রেয়ী চুড়িদারের প্যান্ট হাঁটু অবধি গুটিয়ে বলত, ‘স্পেশাল ক্লাস আছে। যেতেই হবে।’

একবার তো কৃষ্ণেন্দুর জন্মদিনে কলেজ স্ট্রিটে ঢুকে জল-কাদার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল আত্রেয়ী। হাতের গোলাপগুলো কাদা জলে পড়ে মাখামাখি। তার মধ্যে থেকেই একটা গোলাপ তুলে বৃষ্টির জলে ধুয়ে নিয়ে কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, ‘বৃষ্টিধোয়া একটা গোলাপ তো রইল আমার কাছে। মনখারাপ না করে তাড়াতাড়ি ট্যাক্সি ধরে বাড়ি যাও। ভেজা জামা পরে ঠান্ডা লাগবে।’

কৃষ্ণেন্দু বরাবর এরকমই। সবরকম পরিস্থিতিতেই নিজেকে মানিয়ে নিত। কোনো অবস্থাতেই ওর কোনো বিরক্তি দেখেনি আত্রেয়ী। ও মাঝে মাঝে কৃষ্ণেন্দুর গায়ে চিমটি কেটে বলত, ‘তুমি কী ধাতু দিয়ে গড়া গো? কিছুতেই তোমার কষ্ট হয় না?’

কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, ‘যখন আমার বছর পাঁচেক বয়েস তখন আমি প্রথম জানতে পারলাম, আমার সঙ্গে যারা বড় হচ্ছে তারা আমার ভাই-বোন নয়। কারণ আমার আদৌ কোনো বাবা-মা নেই। আমি অনাথ। অনাথ তো কেউ হয় না। আমরা জানি বায়োলজিক্যাল ফাদার বা মাদার নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু তারা আমায় অস্বীকার করেছিল, হয়তো তাদের নিজেদের কোনো সমস্যা ছিল আমার পরিচয় দিতে। আমাদের আশ্রমে যিনি থাকতেন, তাঁকে আমরা সকলে বাবা বলতাম। ওনার নাম হরিনারায়ণ চক্রবর্তী। খাঁটি ব্রাহ্মণ। তাই তো আমাদের সবার সারনেম চক্রবর্তী। উনি আর ওনার ওয়াইফ আমাদের গোটা পঞ্চাশেক ছেলে-মেয়েকে নিয়ে একটা অনাথ আশ্রম তৈরি করেছিলেন। কাউকে আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনেছিলেন, কাউকে আবার রেললাইনের ধার থেকে। ওনারা নিঃসন্তান ছিলেন। আমরাই ছিলাম ওনাদের সন্তান। কী অদ্ভুত ভঙ্গিমায় মা আমাদের সকলকে সমানভাবে ভালোবাসতেন, সমানভাবে শাসন করতেন। তারপর উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পরেই আমি অনেকগুলো টিউশনি পড়াতে শুরু করলাম। তখন থেকেই বুঝেছিলাম, আমাকেই আমারটা বুঝে নিতে হবে। আমরা সবাই ছোটখাটো কাজ করে নিজেদের পড়াশোনা চালাতাম। এই যে কলেজের পরে আমি সোজা যাব একটা কোচিংয়ে। এখন ভাবি ওঁরা যদি নিজেদের সুখের কথা ভাবতেন, তাহলে হয়তো আমি রাস্তায় ভিক্ষা করতাম বা মরেই যেতাম। ওঁরা আমাদের সকলের জন্য যে কষ্ট সহ্য করেছেন, সে তুলনায় আমাদের সমস্যা তো কিছুই নয়। এখন তো আমি মেসে বিন্দাস আছি। টিউশনি করছি, পড়াশোনা করছি। তুমি আছ। সমস্যা আর কী!’

আত্রেয়ী অবাক হয়ে দেখত কৃষ্ণেন্দুকে। অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে যায় ছেলেটা। কী অপূর্ব ছবি আঁকে, খালি গলায় কী সুন্দর গান গায়। ভগবান যেন ঢেলে সাজিয়েছেন কৃষ্ণেন্দুকে। তেমনই তুখোড় পড়াশোনায়। কলেজের প্রফেসররা ওর নামে ঢোক গেলেন। অমন ছেলে নাকি কেমিস্ট্রির ব্যাচে এই প্রথম। হিস্ট্রি অনার্সের আত্রেয়ীর সঙ্গে কেমিস্ট্রির ছেলের কেমিস্ট্রি যে কীভাবে জমেছিল সেটা অবশ্য ওদের দুজনেরই অজানা ছিল। ওই আর পাঁচটা প্রেমের মতোই, কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে হয়নি। ভালোলাগা থেকেই সম্পর্কটা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আত্রেয়ী জানত কৃষ্ণেন্দু ওকে ভীষণ রকমের রেসপেক্ট করে। শুধু ভালোবাসা নয়, সম্মানও পেত ও কৃষ্ণেন্দুর কাছ থেকে। তাই হয়তো নিজেকে উজাড় করে ভালোবেসেছিল। গোটা কলেজ জানত ওদের সম্পর্কের কথা। আত্রেয়ী বলত, ‘আমার লজ্জা করে, সবাই জানে বলে।’

কৃষ্ণেন্দু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলত, ‘জানো আত্রেয়ী, আমি সবথেকে বেশি ভালোবাসি আকাশকে। দেখো আকাশ কিন্তু খারাপ-ভালো বিচার করে না। সে সবার মাথায় ছাতা ধরে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ সবটা কেমন উন্মুক্ত। কোনো লুকিয়ে রাখার বাসনা নেই। জানুক না সবাই আমাদের সম্পর্কের কথা। আমরা তো ভালোবেসেছি, অন্যায় তো করিনি।’

কৃষ্ণেন্দুর সমস্ত নেশাগুলো কীভাবে যেন আত্রেয়ীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে গেল সে টেরটিও পায়নি। এই যেমন, অবসরে আকাশ দেখা, বেলফুল ভালোবাসা ইত্যাদি। কৃষ্ণেন্দুর পছন্দের ফুল ছিল বেল। ও বলত, ‘জানো আত্রেয়ী বেলফুল নিজেকে বিশাল দামি, ক্ষত্রিয় ফুল বলে দাবি করে না। রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে ফোটে। আড়ম্বর লাগে না। তবুও এমন তার সুবাস যে নিজেকে কিছুতেই লুকিয়ে রাখতে পারে না। আমার মনে হয় আমাদের প্রত্যেকেরই বেলফুলের মতো হওয়া উচিত, আড়ম্বরহীন, অহংকারহীন কিন্তু অস্তিত্বহীন নয়। সবাই খুঁজে নেবে তোমায়।’

মোহিত হয়ে শুনত আত্রেয়ী।

নিজের জন্মদিনে ফেসবুকে একটা সুন্দর ছবি পোস্ট করেছে কেমিস্ট্রির প্রফেসর কৃষ্ণেন্দু চক্রবর্তী। ওর স্ত্রী ওকে কেক খাইয়ে দিচ্ছে। সামনে থালায় সাজানো প্রচুর খাবার। বাটিতে পায়েস।

ক্যাপশনে লেখা—‘জন্মদিনে আগে কলেজ স্ট্রিট যেতাম। কফি হাউজে ঢুঁ দিতাম। এখন বাড়িতেই কাটাই। দিনটাকে বিশেষ করে তোলে আমার একমাত্র ঠাঁই রঞ্জিনী।’

প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী কমেন্টের মাধ্যমে ওদের প্রিয় স্যারকে শুভেচ্ছাবার্তায় ভরিয়ে দিয়েছে। আত্রেয়ীর খুব ইচ্ছে করে একটা ছোট্ট কমেন্ট করতে, ঠিক আগে যেমনটা বলত, ‘শুভ জন্মদিন আমার কৃষ্ণেন্দু।’

কিন্তু না, আত্রেয়ী লিখতে পারে না। সব অধিকার হারিয়ে ফেলেছে ও। কৃষ্ণেন্দুর আত্রেয়ী মারা গেছে বহুবছর আগে।

বহুবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতে গিয়েও পাঠানো হয়নি। লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেছে।

আত্রেয়ী নিজের মনেই বলল, শুভ জন্মদিন আমার কৃষ্ণেন্দু। ভালো থেকো তোমরা।

দশ বছর ধরে এই ফেসবুক প্রোফাইলটা ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সায়ন্তন, সুনেত্রা, সায়ন্তনের বাবা-মা সকলের অত্যাচারে ও হয়তো এতদিন পাগল হয়ে যেত। ভুলে যেতে ওর নাম আত্রেয়ী। কিন্তু শুধু কৃষ্ণেন্দুকে দেখবে বলেই যেন ওর বেঁচে থাকা।

নীচ থেকে সুনেত্রার গলা পেল আত্রেয়ী। অশান্তি চায় না ও। আর ভালো লাগে না। তাই দরজা খুলে তাড়াতাড়ি ছুটল নীচে। মেয়ে টিউশন থেকে এসে ফ্রুট জুস খায়। সেটা বানাতে ভুলে গেছে। ঝটপট রান্নাঘরে গিয়ে মুসম্বি, চিনি আর বরফ নিয়ে জুসারের সামনে দাঁড়াল।

সুনেত্রা পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মা, তুমি এক কাজ করো। তুমি বসে বসে কবিতা লেখো। শুনেছি এত ভুলো মন নাকি কবিদের হয়। বাবাকে বলতে হবে বিষয়টা।’

আত্রেয়ী জানে সুনেত্রা বাবাকে নালিশ করলেই সায়ন্তন ওর হাতটা মুচকে ধরে বলবে, ‘এত ভুল হয় কী করে!’

আবার সুনেত্রাকে বারণ করলে ও বেশি করে নালিশ করবে বাবাকে। তাই বোবার শত্রু নেই এই বিশ্বাসের ওপরে ভর করেই চুপ করে জুসের গ্লাসটা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আর বরফ দেব কিনা দেখ।’

মেয়ে চুমুক দিয়ে বলল, ‘তুমি আসলে কিছুই ভালোমতো পারো না।’

আত্রেয়ী অন্য কাজে মনোনিবেশ করল। সুনেত্রা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বেরিয়ে গেল।

মেয়েটাকে মা হিসাবে শাসন করা হয়তো দরকার ছিল। কিন্তু আত্রেয়ী জানে যে এ বাড়িতে ও সেটা পারবে না। হিতে বিপরীত হবে। তাই নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ কৃষ্ণেন্দুর ফেসবুক প্রোফাইল। আর ওই বেলফুলের গাছগুলো।

বাবা, মায়ের বয়েস হয়েছে। কর্তব্য করতে মাঝেমাঝে যায় বাপের বাড়ি। কিন্তু আজও অভিমানটা জমাট বেঁধে আছে ওই বাড়ির উঠোনের পূর্ব কোণের শিউলি গাছের তলায়। যেখানে কৃষ্ণেন্দু ঠায় একঘন্টা দাঁড়িয়ে ছিল। যাকে ভিতরে অবধি ঢুকতে দেয়নি ওর বাবা। গোটা উঠোনে সেদিন বৈশাখের তীব্র রোদ। সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করেছে আত্রেয়ী। কৃষ্ণেন্দু ভর্তি হয়েছে এমএসসি-তে। বাড়িতে আত্রেয়ীর বিয়ের তৎপরতা। মাসি-পিসি থেকে প্রতিবেশীদের দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম কেড়েছে আত্রেয়ীর বিয়ের ভাবনা। তাই সবাই পাত্র খুঁজতে ব্যস্ত। বাবা সবাইকে পারমিশন দিয়েছে ভালো পাত্র খুঁজে আনার। মা বলেছে, ‘আর ইউনিভার্সিটি গিয়ে কাজ নেই। রান্না-বান্না একটু শেখ, রূপচর্চা কর।’ আত্রেয়ী অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে বাড়িতে বোঝাতে। শেষে কৃষ্ণেন্দুকে গিয়ে বলেছিল বিষয়টা। কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, ‘কিন্তু আমার এস্টাব্লিশড হতে তো কয়েক বছর দেরি আছে আত্রেয়ী। এটুকু সময় অপেক্ষা করতে হবে তোমায়। তুমি চাইলে তোমার বাবার কাছ থেকে আমি সেই সময়টুকু চেয়ে আনতে পারি।’

কোনো উপায় না দেখে ও কৃষ্ণেন্দুকে নিয়ে গিয়েছিল নিজের বাড়িতে। তখন দুপুর বারোটা। ছুটির দিন বলে সবকিছুই একটু দেরিতে শুরু হয়েছিল। বাবা বাজার থেকে ফিরে আয়েশ করে খবরের কাগজের খুঁটিনাটি দ্বিতীয়বার পড়তে শুরু করেছিল। মা রান্নাঘরে খাসির মাংসের সুবাস তুলেছিল।

কৃষ্ণেন্দু বাড়িতে ঢুকতেই আত্রেয়ীর বাবা বলেছিল, ‘উঠোনেই দাঁড়াও। আগে কয়েকটা প্রশ্ন করি। তুমি আমার মেয়েকে ভালোবাসো? তোমার বাড়ি কোথায়? বাবা কী করেন?’

কৃষ্ণেন্দু মাথা নীচু করে নয় মাথা উঁচু করেই উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি একটা অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছি। ওঁরাই নিজেদের পরিচয়ে আমায় মানুষ করেছেন।’

আত্রেয়ী বলেছিল, ‘বাবা, ও আমাদের কলেজের টপার। খুব ভালো ছেলে।’

বাবা ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গাত্মক হাসি চেপে বলেছিল, ‘ও, তার মানে তুমি নিজের বাপের নাম জানো না। ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢোকার আগে এটুকু জেনে আসা দরকার ছিল।’

মাথায় গনগনে বৈশাখের রোদ। তাই হয়তো একটু ছায়ার সন্ধানে শিউলি গাছের নীচে এসে দাঁড়িয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। ও বলেছিল, ‘আমার মনে হয় আমি প্রতিষ্ঠিত হব। আর আপনার মেয়েকে ভালোই রাখব। তাই আপনি এটুকু ভরসা করে দেখতে পারেন। আর অনাথ হওয়াটা দোষের নয়। অন্তত এক্ষেত্রে আমার কোনো দোষ নেই।’

আত্রেয়ীর বাবা তীক্ষ্ণ স্বরে বলেছিল, ‘না, তোমার কোনো দোষ নেই। দোষ আমার মেয়ের। যে নিজের বংশের মুখে চুনকালি মাখাবে বলে একটা নামহীন ছেলেকে বিয়ে করতে চাইছে। যার না আছে জন্মতারিখ না আছে বংশ পরিচয়। দোষ তো তোমার নেই।’

কৃষ্ণেন্দুর মুখটা রোদের তাপে লাল হয়ে গেছিল, নাকি অপমানে, সেটা বুঝতে পারেনি আত্রেয়ী। ও শুধু চিৎকার করে বলেছিল, ‘তুমি চলে যাও কৃষ্ণেন্দু। আর এসো না কখনও। এখানে বংশপরিচয়ওয়ালা ভদ্রলোক বাস করে।’

কৃষ্ণেন্দু তবুও বলেছিল, ‘আঙ্কেল প্লিস। আত্রেয়ী আর আমি দুজনে দুজনকে ভালোবাসি। ওকে ভালো থাকতে দিন প্লিস।’

বাবা চিৎকার করে বলেছিল, ‘তোর বন্ধুকে কি গলা ধাক্কা দিয়ে বের করতে হবে?’

মা এসে বলেছিল, ‘তুমি চলে যাও।’

তবুও বৃথা একটু অপেক্ষা করে ফিরে এসেছিল কৃষ্ণেন্দু।

ওই শিউলি তলায় এখনও জমে আছে অনেকটা অভিমান আর অপমানের জমাট অন্ধকার। তাই ওটাকে আর কোনোদিন নিজের বাড়ি ভাবতে পারিনি আত্রেয়ী।

কৃষ্ণেন্দু মেসে থাকত, ওর কোনো বাড়ি ঘর ছিল না। তাই ও যে এই মুহূর্তে আত্রেয়ীকে বিয়ে করতে পারবে না সেটা ওরা দুজনেই বুঝেছিল। তাই কেউ আর দেখা করেনি কারোর সঙ্গে। ওই বৈশাখের দুপুরে শিউলি গাছের নীচেই কৃষ্ণেন্দুকে শেষ দেখেছিল আত্রেয়ী।

ইচ্ছে করেই আর ফোন করেনি, যোগাযোগ করেনি। কৃষ্ণেন্দুও হয়তো এই তীব্র অপমানের পরে বুঝেছিল, এই সম্পর্ক কোনোদিন সম্ভব নয়। আত্রেয়ীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, বড় ব্যবসাদার, বনেদি পরিবারের সন্তান সায়ন্তনের সঙ্গে। ঠিক সেদিন থেকে বাবা আর ওই বাড়িটা ওর কাছে বহুদূরের দ্বীপ হয়ে গিয়েছিল। যার চারপাশটা শুধুই অহংকারে পরিপূর্ণ। তবুও নিজের কর্তব্যটুকু করতে যায়। বাবা আজও ছানি পড়া চোখে ওর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। হয়তো ওর মুখে খুঁজতে থাকে খুশি-অখুশির সূক্ষ্ম রেখাগুলো। কারণ বাবা আজও জানে না আত্রেয়ী বিবাহিত জীবনে সুখী না সুখী নয়। সুনেত্রাও ছোট থেকেই বাবার মতো পাক্কা অভিনেত্রী। দাদুর বাড়ি গিয়ে মা’কে বেশ নরম গলায় কথা বলে। কে বলবে, এ বাড়িতে মাকে সে তিন নম্বর পরিচারিকার আসনে বসিয়েছে!

আত্রেয়ী মনে মনে হাসে। বাবার মনের এই দ্বন্দ্বটুকুই কৃষ্ণেন্দুকে অপমানের শাস্তি হয়ে থাকুক।

বিকেলে ছাদে উঠে আবারও প্রোফাইলটি খুলল আত্রেয়ী। কী সুন্দর একটা ছবি এঁকেছে কৃষ্ণেন্দু। সারা রাস্তা জুড়ে বিছিয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া। দুটো ছেলে-মেয়ে হাত ধরে হেঁটে চলেছে। খুব জানতে ইচ্ছে করে, ওকে কি আদৌ মনে আছে কৃষ্ণেন্দুর? নাকি স্ত্রীকে পেয়ে আত্রেয়ীর অস্তিত্বটাই ভুলে গেছে ও? আদৌ কি মনের এককোণে অবহেলায় হলেও পড়ে আছে ওর স্মৃতি? নাকি সব ধুয়েমুছে ফেলেছে ওর স্ত্রী উজাড় করা ভালোবাসা দিয়ে? কত কত প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে আত্রেয়ীর। কিন্তু সেই দুপুরে বাড়ির উঠোনে একগ্লাস জল অবধি খাওয়াতে পারেনি ও ছেলেটাকে, এটা মনে করেই ‘অ্যাড ফ্রেন্ড’ বাটম থেকে হাতটা সরিয়ে নেয় সংকোচে।

রোজই নতুন কিছু পোস্ট দেখার আশায় কৃষ্ণেন্দুর প্রোফাইলটা খোলে আত্রেয়ী। কিন্তু প্রায় দিন পনেরো হল আর কোনো পোস্ট নেই কৃষ্ণেন্দুর। অবাক লাগছে ওর। কৃষ্ণেন্দু হয়তো ব্যস্ত কলেজ আর এগজিবিশন নিয়ে। তাই ফেসবুকে পোস্ট করার সময় নেই ওর। অথবা স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে গেছে। কিন্তু কৃষ্ণেন্দু জানেই না, এদিকে একজনের দিনরাত্রি কাটছে ওর পোস্টের অপেক্ষায়।

অপেক্ষার সময়টা ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে আসছে। প্রায় পঁচিশ দিন হয়ে গেছে কৃষ্ণেন্দুর কোনো পোস্ট নেই। আত্রেয়ী আকাশ আর বেলফুলের গাছগুলোকে সঙ্গী করে কাটিয়ে দিচ্ছে অবসরের অল্প সময়টুকু। প্রায় মাসখানেক কোনো পোস্ট করেনি কৃষ্ণেন্দু। আর সহ্য করতে না পেরেই আত্রেয়ী মেসেঞ্জারে লিখে পাঠাল, ‘হাই। চিনতে পারছ?’

কোনো রেসপন্স নেই। প্রায় দিন চারেক বারংবার চেক করেই যাচ্ছিল মেসেজটা। না, কোনো উত্তর নেই। ওদিক থেকে সিনও হয়নি। প্রায় সপ্তাহখানেক পরে ওদিক থেকে উত্তর এল, ‘আত্রেয়ী, কেমন আছ?’

বুকের ভিতরটা ধুকপুক করে উঠল আত্রেয়ীর। কৃষ্ণেন্দু উত্তর দিয়েছে ওকে।

ও লিখল, ‘তুমি এতদিন পোস্ট করোনি কেন? প্রায় একমাস কোনো পোস্ট করছ না?’

কৃষ্ণেন্দু লিখল, ‘আত্রেয়ী সব বলব তোমায়। তোমাকে ছাড়া আর কাকেই বা বলা যায়! একবার আসতে পারবে? দেখা করে সব বলব।’

এই মধ্যবয়েসে এসেও ঠিক কলেজের মতোই বুকটা কেঁপে উঠল কৃষ্ণেন্দুর একটা মেসেজে। এতদিন ধরে ও ভেবেছিল, নিজের অনুভূতির সব সূক্ষ্ম তারগুলো বিকল করে ফেলেছে দায়িত্ব নিয়ে। কিন্তু আজ বুঝল, রাতের সব তারাই থেকে যায় দিনের গভীরে। যে অনুভূতি, উপলব্ধিদের ও এতদিন বাধ্য করে রেখেছিল, তারাই আচমকা বড্ড চঞ্চল, অবাধ্য হয়ে উঠল।

বাপের বাড়ি যাচ্ছি-র নাম করে বেরিয়ে পড়ল আত্রেয়ী। আজ কি সাজগোজ একটু বেশি করে ফেলেছে ও?

সুনেত্রা বারবার আড়চোখে মায়ের দিকে তাকাচ্ছিল। কৃষ্ণেন্দুর পছন্দের আকাশনীল শাড়ি পরা বন্ধ করে দিয়েছিল বিয়ের পর থেকেই। সায়ন্তনদের বাড়িতে দুটো আকাশনীল শাড়ি পেয়েছিল ও উপহারে। কিন্তু পরেনি কখনও। আজ আলমারি ঘেঁটে তারই একটা বের করে পরে নিল। একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছে না আত্রেয়ী, কোনো কথা না বলে এভাবে ডেকে কেন পাঠাল কৃষ্ণেন্দু।

কৃষ্ণেন্দুর লিখে দেওয়া অ্যাড্রেসে পৌঁছে দেখল, ও একটা অনাথ আশ্রমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আশ্রমের নাম ‘আত্রেয়ী সেবা নিকেতন’।

ওর নামের আশ্রম! গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণেন্দুর স্ত্রী। ছবিতে বারবার দেখার ফলে চিনতে অসুবিধা হল না আত্রেয়ীর। কিন্তু ছবির থেকে বড্ড শুকনো লাগছে যেন। রঞ্জিনী এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনিই আত্রেয়ী, তাই না? আসুন প্লিস।’

আত্রেয়ী একটু চমকে গিয়েই বলল, ‘কৃষ্ণেন্দু আসেনি? ও যে আজ দেখা করতে চেয়েছিল।’

রঞ্জিনী বলল, ‘না, ওর প্রোফাইলের মেসেজটার উত্তর আমি দিয়েছিলাম।’

আত্রেয়ী বেশ বুঝতে পারছে স্ত্রীকে দিয়ে প্রাক্তনকে ওই একইভাবে অপমান করাবে কৃষ্ণেন্দু। ঠিক যেভাবে কৃষ্ণেন্দু অপমানিত হয়েছিল ওদের বাড়িতে গিয়ে। পা দুটো কাঁপছে আত্রেয়ীর। এমনিতেই বাইরে সেভাবে বেরোনোর অভ্যেস নেই দীর্ঘদিন। ওই সায়ন্তনের সঙ্গে টুকটাক নিমন্ত্রণ বাড়ি ছাড়া। অপরিচিত পরিবেশে আজকাল অনভ্যাসে কেমন একটা আনইজি ফিল করে আত্রেয়ী। তারওপর বাড়ি থেকে একটা মন নিয়ে বেরিয়েছিল, এখানে এসে দেখল কৃষ্ণেন্দু নেই, ওর স্ত্রী। এমনকী ওর মেসেজের উত্তর অবধি দিয়েছে রঞ্জিনী। রীতিমতো ভয় করতে শুরু করল ওর। হয়তো এখুনি রঞ্জিনী ঘুরে দাঁড়িয়ে বলবে, লজ্জা করে না অন্যের স্ত্রী হয়ে আমার স্বামীকে মেসেজ করেন? কী উত্তর দেবে আত্রেয়ী!

রঞ্জিনী একটা অফিস মতো রুমে ওকে বসিয়ে বলল, ‘আপনি বসুন, আমি শরবত আনতে বলছি।’

গরম রয়েছে বেশ। নার্ভাস লাগছে আত্রেয়ীর। রঞ্জিনীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা অসম্ভব স্মার্ট। এর সামনে আত্রেয়ী ঠিক করে কথাই বলে উঠতে পারবে না হয়তো। কৃষ্ণেন্দুকে আরেকবার খোঁজার চেষ্টা করল আত্রেয়ী। তার আগেই শরবতের গ্লাস এনে রাখল একটি মেয়ে।

রঞ্জিনী বলল, ‘খেয়ে নিন।’

আত্রেয়ী এতক্ষণ বুঝতে পারেনি ওর এতটা পিপাসা পেয়েছিল, অথবা শরবতের গ্লাসের পিছনে একটু যেন আড়াল খুঁজল ও। শরবত খাওয়া শেষ করে টেবিলে গ্লাসটা নামাতেই রঞ্জিনী বলল, ‘আপনারা তো কলেজ ফ্রেন্ড ছিলেন তাই না? ফ্রেন্ড বললে ভুল হবে, আপনারা তো বিয়ে করবেন সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। তাই না?’

আত্রেয়ী কিছু বলার আগেই রঞ্জিনী বলল, ‘সেই আপনি মেসেজ করলেন শেষ পর্যন্ত, কিন্তু আর মাসখানেক আগে যদি করতেন। তাহলে আপনার সঙ্গে কৃষ্ণেন্দুর দেখা হত।’

আত্রেয়ী কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কেন আজ দেখা হবে না?’

রঞ্জিনী দেওয়ালের এক কোণে ঈশারায় তাকাতে বলল, আত্রেয়ী দেখল কৃষ্ণেন্দুর একটা বড় সাইজের ছবিতে মালা দেওয়া আছে। অদ্ভুত গলায় আত্রেয়ী প্রশ্ন করল, ‘মালা কেন ওর গলায়? ও কোথায়?’

রঞ্জিনী বলল, ‘মাসখানেক আগে বাইক দুর্ঘটনায় ব্রেন হেমারেজ হয়ে মারা গেছে কৃষ্ণেন্দু।’

আত্রেয়ীর বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। রঞ্জিনী বলল, ‘আমরা দুজনেই একই কলেজের প্রফেসর। আমার সঙ্গেও ওর প্রেম করেই বিয়ে। না, না আপনাদের মতো অতটা সুন্দর ছিল না আমাদের প্রেমটা। বলতে পারেন দুজনেরই একটা অবলম্বন দরকার ছিল ওই বয়েসে এসে, তাই আমরা আন্ডারস্ট্যান্ডিং করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন, কৃষ্ণেন্দুকে ভালো না বেসে কেউ থাকতে পারবে না। ভালোবাসা, সম্মান, আদরে ভরিয়ে দিয়েছিল ও আমাকে। তাই আমিও নিরুপায় হয়েই ওকে উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম। আমরা ভীষণ হ্যাপি ছিলাম জানেন। আমার শারীরিক সমস্যার কারণে আমাদের কোনো বাচ্চা হয়নি। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর সেই নিয়ে কোনোদিন কোনো আক্ষেপ ছিল না। পাড়ার লোকজন বলত, ‘বাঁজা বউয়ের আবার জন্মদিন করছে ঘটা করে!’ অথবা ‘বাচ্চার জন্মদিন করার সময়ে নিজেদের বিবাহবার্ষিকী করছে!’ এসব কথাতে আমার মনখারাপ হলেও ও কোনোদিন পাত্তা দিত না। ওর সবটা জুড়ে আমি ছিলাম। সরি ভুল বললাম, অন্তত ৩০% আমি ভরাট করতে পারিনি, ওখানে আপনি ছিলেন। কৃষ্ণেন্দু বলত, ‘জানো রঞ্জিনী, আত্রেয়ী আমাকে ভীষণ ভালোবাসত, তাই আর বিয়ের জন্য বিব্রত করেনি।’ আপনাদের সব গল্প আমি জানি, সবটুকু বলেছে ও। আমি আপনাকে রেসপেক্ট করি। কৃষ্ণেন্দু আর আমার সম্পর্কটা ছিল স্বচ্ছ জলের মতো। কোনো রাখঢাক নেই সেখানে। কোনো পজেসিভনেস নেই। শুধু রয়েছে অফুরন্ত বিশ্বাস, সম্মান আর ভালোবাসা। কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর মতো মানুষরা বেশিদিন পৃথিবীর মায়ায় নিজেদের জড়িয়ে রাখতে পারে না বুঝলেন। স্বর্গের মায়াকানন ওদের ডাকে।’

আত্রেয়ী দেখল রঞ্জিনী কথা বলতে বলতেই কাঁদছে। ফুঁপিয়ে উঠছে ওর ঠোঁট দুটো। তবুও কৃষ্ণেন্দুর জন্য ওর কান্নাভেজা দু’চোখে অনেকটা গর্ব আর সম্মান রয়েছে। আত্রেয়ী এখনও নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কৃষ্ণেন্দু নেই! ওর সঙ্গে আর দেখা হল না আত্রেয়ীর! সেই শিউলিতলার অপমানটুকু নিয়েই চলে গেল কৃষ্ণেন্দু!

আত্রেয়ী প্রায় কঁকিয়ে বলে উঠল, ‘আমি ওর প্রোফাইলে আপনাদের ছবিগুলো দেখেই বেঁচে আছি প্রায় বছর দশেক। এখন আমার অবসর কাটবে কীভাবে রঞ্জিনী? আমি তো সবসময় চেয়েছিলাম, আপনারা ভালো থাকুন। তাহলে কেন এমন হল?’

রঞ্জিনী বলল, ‘কৃষ্ণেন্দু বলত, ‘‘জানো রঞ্জিনী এই গোটা বিশ্বে আমি অনাথ। আমার ভালো-খারাপ চাওয়ার হয়তো কেউ নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি একজন আমার ভালো চায়।’’ আপনার প্রোফাইলটি আমায় দেখিয়ে বলেছিল, ‘‘এই যে কোনো পোস্ট নেই, প্রায় ইনঅ্যাক্টিভ প্রোফাইলটা আত্রেয়ী কেন খুলে রেখেছে জানো? শুধু আমায় খুঁজবে বলে।’’ ’

আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে ওকে একটা মেসেজ করো।’

বলত, ‘না। ও অন্য সংসারে অনেক কষ্টে মন বসিয়ে নিয়েছে। আর ওকে বিরক্ত করে লাভ নেই।’

আসলে কৃষ্ণেন্দুর ফেসবুক প্রোফাইলটি আমিই খুলে দিয়েছিলাম। তাই পাসওয়ার্ড আমার কাছেই ছিল। অপনার মেসেজ পেয়ে খুব ইচ্ছে করছিল, গল্পে চেনা মানুষটাকে একবার অন্তত সামনে দেখি। কৃষ্ণেন্দুর চলে যাওয়ার খবরটা ভাগ করে কষ্টটা একটু কমিয়ে নিই অন্তত। হয়তো আপনি আমাকে স্বার্থপর ভাববেন, কিন্তু কাকে বলব এই কষ্টের কথা। এমন একটা মানুষকে আমরা দুজনেই পেয়েছিলাম আত্রেয়ী, কিন্তু কেউই ধরে রাখতে পারলাম না। আমাদের বাড়ির গেটে বড় করে পাথরের ফলকে লেখা আছে রঞ্জিনী ভিলা। কৃষ্ণেন্দু বলত, ‘এই বাড়িটা আমার তরফ থেকে তোমায় উপহার দিলাম রঞ্জিনী। এখানে প্লিস আমার নাম ঢোকাবে না।’ আপনি বোধহয় জানতেন চক্রবর্তী দম্পতির কথা, যাঁদের কাছে ও মানুষ হয়েছিল?’

আত্রেয়ী ঘাড় নেড়ে বলল, ‘জানতাম। ওদের মা, বাবা বলত কৃষ্ণেন্দু।’

রঞ্জিনী বলল, ‘হ্যাঁ ওঁরা আর নেই। মারা গেছেন। এটাই ওঁদের সেই আশ্রম। মারা যাওয়ার আগে ওঁরা কৃষ্ণেন্দুকে সব দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন এই অনাথ আশ্রমের। এমনকি আশ্রমের ট্রাস্টি বোর্ডের নমিনি অবধি কৃষ্ণেন্দু আর আমাকে করে গেছেন ওঁরা। কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, ‘‘রঞ্জিনী, নাও কত সন্তান নেবে নাও। একটা সন্তান হয়নি বলে দুঃখ করছিলে!’’ ’

‘আত্রেয়ী, আপনাকে একটা বিশেষ প্রয়োজনে ডেকেছি আমি। প্লিস না বলবেন না।’

আত্রেয়ী বিহ্বল চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বলুন।’

রঞ্জিনী বলল, ‘এই আশ্রমের দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। আপনার নামেই কৃষ্ণেন্দু আশ্রমের নামকরণ করেছিল, দেখতেই তো পাচ্ছেন। ও তো আর নেই। আমার একার পক্ষে কলেজ সামলে এত কিছু করা সম্ভব হবে না।’

আত্রেয়ী নরম গলায় বলল, ‘আমি যদি এই আশ্রমের দায়িত্ব নিই, তাহলে কি আমি এখানে থাকার জন্য একটা ঘর পাব? আর খাওয়া-দাওয়াও পাব?’

রঞ্জিনী বলল, ‘হ্যাঁ, সে তো পাবেনই। কিন্তু আপনি আপনার সংসার ছেড়ে হয়তো সারাদিন সময় দিতে পারবেন না, তাই…’

রঞ্জিনীর কথা শেষ হওয়ার আগেই আত্রেয়ী বলল, ‘পারব। ও সংসারে আমার আর বিশেষ প্রয়োজন নেই। আমি এখানে চলে আসতে পারি?’

রঞ্জিনী কাঁপা ঠোঁটে, কান্না ভেজা গালে আত্রেয়ীর হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সত্যি আপনি আসবেন? কৃষ্ণেন্দুর প্রিয় রং আকাশনীল। আপনাকে এই রঙের শাড়িতে বড্ড মিষ্টি লাগছে। ফাঁকিবাজি করে আগে চলে গেল, তাই আপনার সঙ্গে আর ওর দেখা হল না। জানেন, এই ক’দিন শুধু কেঁদেছি। তারপর আচমকাই আপনার মেসেজের ওই একটা হাই আমাকে সোজা হতে সাহায্য করল। আমি ভাবলাম, এতগুলো বছর তো আমি মানুষটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে পেলাম। নিংড়ে নিলাম সব ভালোবাসাটুকু। হাত ধরে চললাম অনেকটা পথ। কিন্তু আপনি কী পেলেন! একজনকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসে অপরিচিত একজনের সংসারে সারাজীবন অভিনয় করে গেলেন। হয়তো ভালোবাসলেন তাকেও কিছুটা, কিন্তু কৃষ্ণেন্দুকে তো পেলেন না। তাই নিজেকে বড্ড লাকি মনে হল। আর তখনই মনে হল, কৃষ্ণেন্দু আমাকে অনেকগুলো দায়িত্ব দিয়ে গেছে, সেগুলো করতে হবে। আত্রেয়ী সেবাশ্রমের দায়িত্ব আপনার কাঁধে তুলে দিতে হবে। কৃষ্ণেন্দুর আঁকার স্টুডিওটা দিয়ে দিতে হবে ওরই এক প্রিয় ছাত্র সপ্তর্ষিকে। রঞ্জিনী ভিলাকে পরিষ্কার করে রাখতে হবে। তাই সোজা হয়ে দাঁড়ালাম সব শোক ভুলে। আপনার ওই একটা মেসেজ আমার বড্ড উপকার করল আত্রেয়ী।’

আত্রেয়ীর আজ আর কিছুই বলার নেই। কৃষ্ণেন্দু ওকে মনে রেখে, ওর ভালোবাসাকে এতটা সম্মান দিয়ে ওর নামে আশ্রমের নাম করে রেখে গেছে দেখার পর থেকেই বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে ও। রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছে বুকের মধ্যে। কৃষ্ণেন্দু বলত, ‘আত্রেয়ী, ভালোবাসার সুখটুকু নেবে আর বিচ্ছেদের যন্ত্রণাটুকু নেবে না, বললে তো চলে না। ভালোবাসা তো সবটুকু নিয়েই।’

সায়ন্তনকে আত্রেয়ী শুধু একটাই কথা বলল, ‘আমি এ বাড়িতে আর থাকব না। একটা কাজ পেয়েছি। ওখানেই থাকব।’

সায়ন্তন অবাক হয়ে বলল, ‘তোমার মতো অকর্মণ্যকে কাজ দেবে কে? এত বাজে বকো কেন?’

সুনেত্রা হেসে বলেছিল, ‘ডোন্ট ওরি ড্যাড। মা কোনো বাড়িতে রান্নার কাজ পেয়েছে। তিনদিন করতে দাও। ফোর্থ ডে’তে তারাই তাড়িয়ে দেবে।’

সায়ন্তন আর সুনেত্রার হাসির মধ্যেই নিজের ছোট্ট ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়েছিল ও। ওদের অবাক দৃষ্টির মধ্যে দিয়েই সম্মানের সঙ্গে এই বাড়ি ছাড়ল আত্রেয়ী। মনে মনে বলল, কৃষ্ণেন্দু এতদিনে নিজেকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তুমি আমাকে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে শিখিয়ে গেলে। বেলফুলের গাছগুলো একটা ভ্যান রিক্সায় তুলে নিয়ে এল আশ্রমে।

রঞ্জিনী হেসে বলল, ‘বেলফুল? তুমি তো দেখছি কৃষ্ণেন্দুর পছন্দেই নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিলে এত বছর। মৃত মানুষকে হিংসে করতে নেই, তবুও আমার হিংসে হচ্ছে কৃষ্ণেন্দুকে। একটা মানুষকে সবাই কেন এত ভালোবাসে কে জানে!’

রঞ্জিনীর চোখের জল সঞ্চারিত হল আত্রেয়ীর চোখেও। কৃষ্ণেন্দু ছবির ভিতর থেকে হাসছে।

অধ্যায় ১ / ১০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন