সেই ফুলের দল – ১

অভীক মুখোপাধ্যায়

ভরি দুপহরি মেঁ অধিঁয়ারা,
সুরজ পরছাঈঁ সে হারা,
অন্তরতম কা নেহ নিচোড়েঁ, বুঝি হুয়ি বাতী সুলগাঁয়ে।
আও ফির সে দিয়া জলায়ে।

– অটলবিহারী বাজপেয়ী

.

১৩ই মে, ২০০৪। নিউ দিল্লি। সূর্যের অবস্থান বলছে দ্বিপ্রহর চলছে, আর পারদ বলছে তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়েছে। আকাশের দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। দিল্লির যেখানে যত বাগান আছে, সব জায়গার সমস্ত ফুলই মূর্ছা গিয়েছে তা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। আঁচ থেকে রেহাই পায়নি সেভেন রেস কোর্স রোডের বাংলোটাও। তবে এই আঁচ একটু আলাদা, ভিন্ন আগুনের।

আচ্ছা, খুব চেনা চেনা ঠেকছে বাড়িটার নাম, তাই না?

তা তো লাগবেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের বাসভবনের ঠিকানা যে ওটাই। তখন সেই পীঠে আসীন হয়ে আছেন মাননীয় অটলবিহারী বাজপেয়ীজি।

অটলবিহারীর চোখ তখন টিভির পর্দায়। সমস্ত ওপিনিয়ন এবং এগজিট পোলকে নস্যাৎ করে দিয়েছে ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল। সমস্ত খবরের কাগজ, সব টিভি চ্যানেল বলেছিল অটলবিহারীর নেতৃত্বে থাকা ভারতীয় জনতা পার্টি (ভাজপা) তথা ন্যাশন্যাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) বিপুল আসন নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসবে। একটি সমীক্ষায় জয়ের সূচক হিসেবে বলা হয়েছিল ৩৩৫/৫৪৩। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমীকরণ বদলাচ্ছিল। পালটে যাচ্ছিল দিল্লির অশোকা রোডের ভাজপা হেড কোয়ার্টার্স-এর তাবড় তাবড় নেতাদের মুখচ্ছবি।

সত্যি বলতে কী, এই নির্বাচন যতটা না ভাজপার ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর ভোট। ঢাকঢোল পিটিয়ে মহাসমারোহে ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ স্লোগান তুলে বলা হয়েছিল ‘অব কি বারি অটলবিহারী’। জ্যোতিষীরা সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন বাজপেয়ী ফিরছেন এবং সমস্ত গ্রহ নক্ষত্র চিৎকার করে বলছিল ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনিই একচ্ছত্র ভারতেশ হয়ে থাকবেন।

বিগত কয়েক মাসে একাধিক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের জয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতি ইত্যাদি বেশ কয়েকটি বিষয়কে মাথায় রেখে লোকসভার ভোটপর্বকে প্রায় ছ’মাস এগিয়ে আনা হয়েছিল। তেরো সংখ্যাটাই বাজপেয়ী তথা ভাজপাকে এর আগে অনেক কিছু দিয়েছে, কিন্তু ২০০৪ সালের মে মাসের তেরো তারিখটি আর কোনভাবেই শুভ সংবাদ বহন করে আনতে পারল না অটলজির কাছে।

তেরো! পাশ্চাত্য সভ্যতায় অতীব অশুভ অপবাদে দুষ্ট একটি সংখ্যা। আমাদের দেশে তেরো নিয়ে বিশেষ ভনিতা না-থাকলেও অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং তাঁর দলের সামনে ফিরে ফিরে দেখা দিয়েছে এই তেরো। ত্রয়োদশী আক্রান্ত হয়ে অটলবিহারী বারংবার ভূপতিত হয়েছেন ফিনিক্স পাখির মতো আবার ফিরে আসবেন বলেই। কিন্তু এবারে? এবারে শেষ রক্ষা হল না। অব কি বারি অটলবিহারী হল না। ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাগ্মী রাজনীতিকের আর মসনদে ফেরা হল না।

বলিষ্ঠ মুখের প্রতিনিধি নিয়েও ভাজপা মুখ থুবড়ে পড়ল। সবাইকে চমকে দিয়ে পুনরুত্থান ঘটল প্রায় নেতৃত্ববিহীন কংগ্রেস দলটির। ১৯৯৯ সালে কংগ্রেসের পকেটে ছিল ১১৪টি আসন। এবারে সেটা বেড়ে দাঁড়াল ১৪৫। এনডিএ-এর প্রত্যুত্তরে যে ইউপিএ তৈরি হয়েছিল, তারা বলবৃদ্ধি করে হয়ে গেল ২১৬। আর এনডিএ? তাদের দখলে ১৮৬টি সিট। ভারতের জনগণ কংগ্রেসকে স্পষ্ট বহুমত না দিলেও এটুকু বুঝিয়ে দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর গরিমাসন এবারে ভাজপার জন্য নয়।

প্রত্যেক ব্যক্তির এবং গোষ্ঠীর প্রতিটি মত ও অমতকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে এমন বিপর্যয়ের কারণ কী ছিল?

সমীক্ষায় মিথ্যে বলা হয়েছিল? নাকি ভুল ছিল জনমত সংগ্রহের মধ্যেই? যে বাজপেয়ীকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ বলে সারা ভারত চিনেছিল, সেই বাজপেয়ীকে হারালো কারা? না এক মুখহীন প্রতিপক্ষ।

সুদীর্ঘ পাঁচ দশকেরও বেশি রাজনৈতিক জীবনে অভ্যস্ত সেনানীর সামনে তখন টিভিতে বিপর্যয়ের ছবি ফুটে উঠছে। ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পর প্লাটফর্মের ভিড় যেমন পাতলা হয়ে যায়, দিল্লির ইলেভেন অশোকা রোডের ভাজপা হেড কোয়ার্টার্স-এর চিত্র তখন তদানুরূপ।

বাজপেয়ীর বয়স তখন ঊনআশি। বয়সের ভারে তাঁর একদা দৃপ্ত, পৌরুষ মুখ এমনিতেই ভারী, পরিস্থিতি সেটাকে থমথমে করে তুলেছে। গুছিয়ে আঁচড়ানো রূপোলি চুলের রেখা বলে দিচ্ছে তা রোদে পাকেনি, রাজনীতির আঁচে, অভিজ্ঞতার তাপেই এই রঙ, এই রূপ। একসময়ের বৃষস্কন্ধ মানুষটাকে ন্যুব্জ দেখাচ্ছে। হয়তো বয়সের ভার, কিংবা হয়তো পরাজয়ের। মুখ-বন্ধ করা খামের মতো দেখাচ্ছে তাঁকে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ভেতরে কী চলছে। তিনি এমনিতে রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় জুড়ে শুধুই পরাজয় দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু শীর্ষ আসনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরে, ক্ষমতায় থাকার পরে হারতে কি কারো ভালো লাগে? মন খারাপ কি হয় না? তার ওপরে যখন পরাজয়ের সঠিক কারণ নিরূপণ করা যায় না, তখন তা জবরদস্ত ধাক্কা দেয় বইকি। যখন কোনও মহানায়ক নিজের মহাপ্রস্থানকে মহিমামণ্ডিত করতে অপারগ হন, তখন তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হবেন এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

সেভেন আর সি আর-এর বাইরে তখন রিপোর্টার আর ক্যামেরাম্যানদের মেলা বসেছে। ফুটপাথে জায়গা নেই। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বেরিয়ে জর্জ ফার্নান্ডেজ। জর্জ তখন দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং এনডিএ-র আহ্বায়ক। ম্লান মুখে তিনি সাংবাদিকদের জানালেন, ‘আমরা পরাজয় স্বীকার করছি এবং প্রতিপক্ষে বসতে প্রস্তুত।’ প্রচুর প্রশ্ন ধেয়ে এল জর্জের দিকে। তিনি আর একটি কথাও না বলে সোজা হাঁটা দিলেন।

এই পরাজয় শুধু যে বাজপেয়ীজির রাজনৈতিক কেরিয়ারকে স্তব্ধ করে দিল তাই নয়, শেষ করে দিল আরও এক বিদগ্ধ রাজনীতিকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নকেও— তিনি হলেন লালকৃষ্ণ আডবানি। সকাল থেকে ভোট গণনার প্রতিটা মুহূর্তের খবর তিনিও নিজের বাড়িতে বসে টিভিতে দেখেছেন। পরাজয়, পরাভবের মুখোমুখি বসে তিনি হয়তো তখন স্মৃতিচারণায় ব্যস্ত। কোথা থেকে শুরু করে কোথায় তুলে এনেছিলেন কমল (পদ্ম) ছাপ দলটাকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য অস্তগামী হবে। মূর্ছা যাওয়া ফুলের বাগান কি আবার শোভিত হবে? আবার কি জিতবে সেই ফুলের দল?

*****

পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিপক্ষের আসনে গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে থাকার পরে ক্ষমতার অলিন্দে মাত্র ক’বছর পায়চারি করেছেন বাজপেয়ী। ছায়াসঙ্গী হয়ে সুখে দুঃখে পাশে থেকেছেন লালকৃষ্ণ আডবানি। শেষ বিকেলে আডবানিকে সঙ্গে নিয়েই বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী রাইসিনা হিলস-এ রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছলেন। রাষ্ট্রপতি তখন এপিজে আবদুল কালাম সাহেব। তিনিও এই আনুষ্ঠানিকতার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। ভুবন-ভাস্কর যখন অস্তাচলে যেতে ব্যস্ত, তখন ভারতের অ-কংগ্রেসী প্রধানমন্ত্রী রূপে প্রথমবারের জন্য নিজের কার্যকাল সম্পূর্ণকারী শ্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী পদত্যাগ করলেন। দস্তখৎসহ স্বীয় পদটিও ত্যাগ করলেন উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবানি। সূর্য অস্ত গেল। বলা হয়, যার উদয় আছে, তার অস্ত যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এর আরও একটা পক্ষ আছে— যা অস্ত যায়, তার উদয় আবার ঘটে, সূর্যের মতোই। ভাজপার সূর্য ডুবল বছর দশেক পরে আবার ওঠার জন্য।

সন্ধে নামার পর বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীজি প্রেসকে সম্বোধন করলেন, ‘আমার দল এবং আমাদের সঙ্গীরা পরাজিত হয়েছে,’ দুর্ধর্ষ বক্তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গী ফিরে এল বাক্যের অন্তিম অংশে, ‘কিন্তু ভারত এবং ভারতের গণতন্ত্র জয়ী হয়েছে।’

সুধী পাঠক, আপনারা হয়তো ভাবছেন, এমন বিষাদের সুর নিয়ে বইয়ের আরম্ভ হল নাকি শেষ। লেখক কি ভুল করে উপসংহার অংশটাকে ভূমিকার জায়গায় বসিয়ে ফেলেছেন? নাকি ছাপাই-বাঁধাইয়ের ভুল? না, বন্ধু, কোনও প্রমাদ নেই। আমরা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসের এক মহাপর্বের শেষ থেকেই শুরু করলাম। এখান থেকে ফিরে যাব সেই সময়ে, যখন সূর্য ছিল মধ্য গগনে, ফুল ছিল ঊর্দ্ধমুখী। কহানি অভি বাকী হ্যাঁয়, মেরে দোস্ত!

.

এখন ভারতের রাজনীতি দুটি স্পষ্ট ভাগে বিভক্ত। ভাজপা এবং অ-ভাজপা। স্বাভাবিক ভাবেই নিজ নিজ রাজনৈতিক দলগুলির অনুসারীদের মধ্যেও গড়ে উঠেছে সীমারেখা। ভক্ত এবং প্রতিভক্তের দল। ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষে থাকা লোকেরা বলে ভাজপা ‘প্রখর রাষ্ট্রবাদী’ দল, এবং বিপক্ষে থাকা প্রত্যেকের উক্তি হল ভাজপা একটি ‘উগ্র রাষ্ট্রবাদী’ দল। দুক্ষেত্রেই রাষ্ট্রবাদের উল্লেখ আছে, যে যার মতো করে ব্যবহার করছেন। সুবিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেনেডিক্ট আন্ডারসন রাষ্ট্রবাদ-এর একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন— ‘deep horizontal comradeship or imagined community, within territorial limits, and operating un- der a sovereign state.’ ভারতে যখন রাষ্ট্রবাদ জন্ম নিল, তখনকার প্রেক্ষিতে এই শব্দগুলোর, এই তিনটি বিন্দুর বিচার করলে কী দাঁড়ায়?

এই মুহূর্তে ভারতের রাষ্ট্রবাদীতা মানে হিন্দু রাষ্ট্রবাদ। তাহলে ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’? অতি অবশ্যই সেখানে উঠে আসবে ‘আইডিয়া অব আ হিন্দু স্টেট’। হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা।

আজকে না হয় গুগল সার্চ করে কিংবা ট্রেনে-প্লেনে চড়ে ঘুরে আমরা বুঝে নিতে পারছি ভারত নামক দেশটির মানচিত্র কেমন, ভূপ্রকৃতি কেমন, কোথায় কী মেলে, লোকজনের খাদ্যাভ্যাস কী, বেশবাস কেমনধারা। কিন্তু আজ থেকে ১০০, ২০০ কিংবা ৫০০-১০০০ বছর পিছিয়ে গেলে? সেই ভারতের একপ্রান্তের লোক কীভাবে জানত অন্য প্রান্তের মানুষের কথা? দেশের মানুষ নিজের দেশ ভারতবর্ষকে নিয়ে কী ভাবত, কোন ধারণা রাখত?

বিষ্ণু পুরাণে লেখা রয়েছে, ‘দক্ষিণে সাগর আর উত্তরে তুষারাবৃত পর্বতের মাঝে বিরাজ করছে ভারত নামক দেশ।’ কর্মের ভূমি ভারত, যেখানে মানুষ বিশ্বাস করে যে তাদের কর্মের ফল অনুসারে মৃত্যুর পরে তারা স্বর্গ কিংবা নরকে যাবে। ইহলোকে বসে চিন্তা করে পরলোকের। পাপ পূণ্যের নিক্তিতে নিজেদের তুল্যমূল্য বিচার করার পরে তারা কৃতকর্মের পাপ ধুয়ে ফেলার চেষ্টাও করেছে অনবরত। তীর্থযাত্রা, তীর্থে স্নান তাদের মুক্তির আশ্বাস দিয়ে এসেছে সেই কোন সুদূর অতীত থেকেই। লোনা জলের সমুদ্র আর গৌরীগুরু হিমালয়ের মধ্যিখানের এই ভূমিকে তীর্থের বিন্দুগুলিই জুড়েছে। আগে মানুষ শখের ভ্রমণে বেরোতো বলে তেমন কোনও লিখিত ইতিহাস মেলে না, কিন্তু তীর্থ অবশ্যই করত। দেশের এক প্রান্তের মানুষ অপর প্রান্তকে চিনত এভাবেই। বিবিধতার মধ্যে মহান মিলন গড়ে তোলার একমাত্র সেতু ছিল তীর্থগুলোই। শৈব, বৈষ্ণব, দেবী, দেবতা, কুলীন, কায়েত সবকিছু তীর্থে মিলে মিশে একাকার হতো। বহু অভ্যেস, আচার, বিচার, সংস্কার ও তীর্থ সমূহের মন্থনে জন্ম দিয়েছে ‘হিন্দু’ নামক শব্দের। জন্ম দিয়েছে ‘হিন্দু’ নামক সংস্কৃতির। এভাবে হাজার-হাজার বিভেদের মধ্যে থেকে উঠে এল একটি ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’। পারস্পরিক সহমর্মিতা জন্মানোর পর এই গোষ্ঠীর লোকজনের মধ্যে দেখা দিল একটা ‘হরাইজেন্টাল কমরেডশিপ’। যখন এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অন্য কোনও বহিরাগত সংস্কৃতির যুদ্ধ হবে, তখন এই কমিউনিটির লোকজনই হবে একে অন্যের কমরেড বা সহযোদ্ধা। আশা করি, প্রথম বিন্দুর স্পষ্টীকরণ করতে পারলাম।

রাষ্ট্র ছিল। রাষ্ট্র থাকলেই সীমাও থাকবে, কিন্তু মানচিত্রে হিন্দু রাষ্ট্র ছিল না (আজও নেই)। হিন্দু রাষ্ট্রের কথা আগেই ব্যাখ্যা করেছি। পৌরাণিক কালে এমন একটি ধারণার সূত্র রেখে গিয়েছেন বাল্মীকি মুনি। রামরাজ্যের কথা বলেছেন। সেখানে সবাই সুখে, আনন্দে থাকবে, ধর্মের পথে চলবে। কিন্তু সেই ধারণা আর মানচিত্রের বুকে হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা এক নয়। অনতি-অতীতে এই জাতীয় ধারণার জনক ছিলেন ছত্রপতি রাজা শিবাজী। তিনি কী করেছিলেন? হিন্দু-পাদ-পাদশাহীর কথা বললেন। পরে সেই বীজ থেকেই বৃহত্তর রূপ ধারণ করেছিল মরাঠা সাম্রাজ্য। ছত্রপতি ছিলেন বিদ্রোহী মেজাজের ব্যক্তি। নানা বুলি বলা মরাঠি জাতিদের একত্রিত করে নিজের বাহিনী বানালেন। নিজের রাজত্বের সীমানার উত্তরে মোগলদের, দক্ষিণে বিজাপুর আর গোলকোণ্ডার সলতনৎকে ঠেকিয়ে রাখলেন সমানে। তাঁর পরে তাঁর উত্তরপুরুষেরা এবং পেশোয়ারা তাঁরই বিচারধারাকে সামনে রেখে মরাঠা প্রদেশকে বাড়িয়ে চললেন। একটা সময় মরাঠা সাম্রাজ্যের আয়তন দাঁড়িয়েছিল পঁচিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। পশ্চিমে আরব সাগরের উপকূল থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগরের আগে পর্যন্ত, দক্ষিণে গোমন্ত্যক (গোয়া) থেকে উত্তরে দিল্লি অবধি মরাঠাদের ঘোড়া দাপিয়ে বেড়াত। আমাদের ইতিহাস বইতে যাই লেখা থাক, সত্য হল, ইংরেজরা যখন ভারতে আসে, তখন মোগলরা নয় মরাঠারাই ছিল এদেশের প্রধান শক্তি। রাজা শিবাজীর চিন্তাভাবনার হিন্দু রাষ্ট্র মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছিল, কিন্তু সেখানে হিন্দু ধর্মের শাসন সঞ্চালনা করা সম্ভব হয়নি। হতে পারে তার বড় কারণ ছিল সবসময় প্রতিপক্ষদের আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে ব্যস্ত থাকা শাসকেরা রাজ্য শাসনটাকে হিন্দুত্বের সঙ্গে মেলাতে পারেননি।

পরে রাজা শিবাজীর আদর্শ গ্রহণ করে, একটু যোগবিয়োগ করে নিয়ে এক মেধাবী মরাঠি ব্রাহ্মণ যুবক হিন্দুত্বের নিজস্ব একটি সংজ্ঞা তৈরি করবেন। কালক্রমে তাঁর সেই সংজ্ঞা আবার সঙ্ঘের হাত হয়ে ভাজপার রামরাজ্যের ধারণা গড়ে তুলবে।

যাই হোক, হিন্দুত্বের ব্যাপারটা ধারণা হিসেবে ঠিক ছিল, কিন্তু অভাব ছিল বাইবেল কিংবা কোরানের মতো এমন কোনও পবিত্র গ্রন্থের, যা হিন্দু নামক ধর্মের (পড়ুন সংস্কৃতির) অবলম্বীদের এক সুতোয় বাঁধবে। অভাব বোধ করা হচ্ছিল ভাটিকানের মতো কোনও সংস্থার, যারা নিজেদের হাতে রাখবে ধর্মের রাশ, নিজ অনুসারীদের ধর্মীয় শাসনের অধীনস্থ করে রাখবে।

কোরানসম্মত শাসনে খলিফার জায়গা আছে। হিব্রু বাইবেলে রাজনৈতিক ছাঁচ নিয়ে স্পষ্ট মতামত দেওয়া হয়েছে। নিউ টেস্টামেন্টে রয়েছে। কিন্তু হিন্দু ধর্মে এমন কোনও রাজনৈতিক চেতনার স্থান নেই।

যে মেধাবী মরাঠি যুবকের কথা আগে লিখেছি, তিনি এই নিয়ে উঠে পড়ে লাগলেন। নাম জানতে চাইছেন? বলছি, বলছি, একটু সবুর করুন না। তবে যখন তাঁর নাম বলব, আমি নিশ্চিত যে অনেকেই ভ্রূ কোঁচকাবেন। ওই যুবককে নিয়ে যে ব্যক্তি যে মতই রাখুন না কেন, একটি বিষয়ে প্রত্যেকে সহমত হবেন যে, তাঁর রাজনৈতিক মেধা ও দূরদর্শীতার কোনও অভাব ছিল না। নিজের বক্তব্য দিয়ে অন্যকে খুব সহজেই প্রভাবিত করতে পারতেন। হিন্দু ধর্মের রাজনৈতিক দিকটি নিয়ে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, সেদিকে শীতল হাওয়ার মতো ধেয়ে এলেন তিনি। বীজ বপন আরম্ভ হল ১৯০৯ সালে। ফল মিলল ১৯২০ সংলগ্ন দশকে। আমাদের কাহিনির প্রধান কুশীলবেরা অবশ্য তখন জন্মাবেন। এবং তার আগে জন্ম নিচ্ছিল এক যুগান্তকারী বন্দোবস্ত। ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতে সাধারণ নির্বাচন শুরু হতে চলেছিল।

তবে এমন ব্যাপার নয় যে সাধারণ নির্বাচন টুপ করে আকাশ থেকে এসে পড়েছিল। এ ছিল ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের এক সুদূরপ্রসারী ফল। সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে ভারতীয়দের কণ্ঠস্বর সরকার বাহাদুর অবধি পৌঁছে দেওয়ার ব্যাপারে কিছু ইংরেজ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তারই ফলস্বরূপ ১৮৮৫ সালে জন্ম নিয়েছিল ‘দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’। কেউ কেউ বলেছিলেন ভারতীয়দের উষ্মা কমাতে ওটাই ছিল ‘সেফটি ভাল্ভ’।

এক্ষেত্রে একটা মজার ব্যাপার ছিল। নির্বাচনী ব্যবস্থার জন্য ইংল্যান্ডে যে ছাঁচ ছিল, তা ছিল ব্যক্তিকেন্দ্রিক। কার মহিমা কতখানি সেই দেখে তাকে ভোট দিত ব্রিটিশরা। সেখানে জাতি, বর্ণ, ধর্মের ভেদাভেদ নেই। কিন্তু ভারতীয় সমাজ শতধারায় বিভক্ত। একাধিক গোষ্ঠী। তাই এখানে নির্বাচন গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হতে চলেছিল। যিনি নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তিনি হবেন নিজের গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। অপর গোষ্ঠীও তার / তাদের প্রতিনিধি তাঁর প্রতিপক্ষ হবে, যাকে তিনি অবিশ্বাসের চোখেই দেখবেন।

প্রতিনিধিত্বের অঙ্কটা সবচেয়ে আগে বুঝেছিলেন তৎকালীন ইউনাইটেড প্রভিন্সের মুসলিম জমিদারগণ। সরকারি দফতরে, বিচার বিভাগে, উচ্চপদে তাঁদের যথেষ্ট দখল ছিল। ভোটের কথা শুনেই তাঁরা প্রমাদ গুণলেন। কারণ হিন্দু প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়তে চলেছিল। কারণ প্রতিনিধি নির্বাচিত হতে চলেছিল গোষ্ঠীর জনসংখ্যার নিরিখেই। সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর প্রতিনিধির সংখ্যাও বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। হিসেব বলছিল ১:৩ অনুপাতে রাজনৈতিক ক্ষমতার বণ্টন হবে। এবং মুসলমান বুদ্ধিজীবিরা আশঙ্কা করছিলেন যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে ‘one-person-one-vote’ নিয়ম লাগু হয়, তাহলে মুসলিমরা ভারতীয় রাজনীতির অলিন্দে আজীবন সংখ্যালঘু হয়েই রয়ে যাবে। আর এই আশঙ্কা থেকেই ১৯০৬ সালে জন্ম নিল মুসলিম লীগ। যার এক এবং অদ্বিতীয় লক্ষ্য ছিল সংখ্যাতত্ত্বকে পিছনে ঠেলে দিয়ে হিন্দুদের সমতুল্য ভোটাধিকার নিয়ে লবি তৈরি করা। তিনবছর ধরে লবি নিজের কাজ করল। সুফল মিলল ১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কারের দ্বারা। সমতা ফেরাতে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচনমণ্ডলী গঠিত হল। মুসলমানদের জন্য চালু হল সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা। এর অধীনে মুসলিম সদস্যরা শুধুমাত্র মুসলিম ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার কথা ছিল। আসলে ইংরেজরা বুঝেছিল মন্দ নয় ব্যাপারটা, মেনে নিলে হিন্দু-মুসলিমকে লড়িয়ে রাখা যাবে, আর লড়িয়ে দিতে পারলে রাজত্ব করতে সুবিধেই হবে।

হিন্দু বুদ্ধিজীবী সকল নড়েচড়ে বসলেন। কারণ হিসেব বলছে একজন হিন্দুর একজন মুসলিমের তুলনায় ১/৩ ভাগ ভোটাধিকার রয়েছে। কংগ্রেসের গর্ভ থেকেই জন্ম নিল ‘হিন্দু মহাসভা’। নেতৃত্বে লালা লাজপত রাই, মদন মোহন মালব্য। হিন্দু রাজনীতির জুটির শুরু সেই রাই-মালব্য থেকে। পরে তা শ্যামাপ্রসাদ-দীনদয়াল, অটল-আডবানি হয়ে মোদী-শাহে এসে দাঁড়াবে।

হিন্দু মহাসভার জন্ম ১৯১৫ সালে। তার ঠিক এক বছর আগে এক প্রবাসী ভারতীয় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে আসেন। তিনি পেশায় আইনজীবী। বছর পঁয়তাল্লিশের এই ব্যক্তি কংগ্রেস নামক দলটিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই দলের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে দিলেন। এতদিন কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল তর্কসভার গোছের। এই ভদ্রলোক বললেন আন্দোলন করতে হবে। হিন্দু মহাসভার পাশাপাশি এনে দাঁড় করিয়ে ফেললেন কংগ্রেসকে। নিজে হয়ে উঠলেন ভারতের গরিবগুরবো চাষাভুষো হিন্দুদের প্রতিনিধি। হিন্দু চাষিদের প্রতিনিধি রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেও তাঁর রাজনীতি কিন্তু কোনও অর্থেই মুসলিম-বিরোধী ছিল না। তিনি মনেপ্রাণে চাইছিলেন মুসলিম লীগের সিদ্ধান্ত সমূহ কংগ্রেসের অনুকূলে থাকুক। চিনে ফেলেছেন নিশ্চয়ই এতক্ষণে। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমরা মাননীয় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীজির কথা বলছি।

ঠিক এর পর পরই সরকার বাহাদুর নির্বাচন পদ্ধতির ক্ষেত্রে আরেক দফা পরিবর্তন আনল। ১৯১৯ সালের কথা। মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারের মাধ্যমে খ্রিস্টান ও শিখদের জন্য পৃথক সাম্প্রদায়িক ভোটার আনা হয়েছিল। মুসলিমদের জন্যে আগেই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর থেকে ভারতীয়রা ভারতীয় হিসেবে নয়, হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান রূপে ভোট দিতে লাগলেন। এরপরে তিনটি সাধারণ নির্বাচন হয়, ১৯২০, ১৯২৩ এবং ১৯২৬ সালে। এবং প্রতিটি নির্বাচন ও উদ্ভুত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারতকে গভীরতর সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।

.

১৯২০ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস অংশগ্রহণ করেনি। এই বয়কটের কারণ ছিল খিলাফত আন্দোলন। ব্রিটিশরা তুরস্ক দখল করে নিয়ে সেখানকার খলিফার শাসন উচ্ছেদ করতে চলায় ভারতের দুই মুসলিম নেতা মহম্মদ আলি ও শৌকত আলি এখানকার ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সৃষ্টি করেন। তুর্কি খলিফার শাসনকে ইংরেজরা বলত ‘Caliphate’, সেখান থেকে এই আন্দোলনের ইংরেজি নাম হল ‘Caliphate Movement’। তাহাই যে কোনও প্রকারে হয়ে দাঁড়াল ‘খিলাফত আন্দোলন’। যদিও শব্দানুসারে মানেটা একেবারে ভিন্নতর দাঁড়ায়। তো যাই হোক, যেহেতু তৎকালীন খিলাফত নেতৃত্বের সঙ্গে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস দলটির সমঝোতা হয়েছিল, তাই কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তুরস্কের মুসলমানদের প্রতি সৌহার্দ্য প্রদর্শন করে ভোট বয়কট করা হয়।

ভোটের ঠিক আগে আগেই গান্ধীজি অধুনা উত্তর কেরালার মালাবার উপকূলে গেলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণভাবে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য মানুষকে উৎসাহিত করা। সরকারের বিরুদ্ধে চলতে থাকা বিরোধ কোথাও কোথাও শান্তির পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল। ১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মালাবার অঞ্চলের মুসলমান প্রজারা নিজেদের ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরল। শুরু হয়ে গেল দাঙ্গা। ৮৬ জন ভূস্বামীদের মধ্যে ৮৪ জন‍ই ছিল হিন্দু। খিলাফতকে সমর্থন করে আরম্ভ হওয়া বিক্ষোভ এবার হিন্দু-বিরোধী দাঙ্গায় পরিণত হল।

যে মেধাবী মরাঠি যুবককে নিয়ে একটু আগেই লিখেছিলাম, তিনি তখন ব্রিটিশদের চক্ষুশূল হয়ে রত্নাগিরির জেলে রয়েছেন। মালাবারের দাঙ্গা নিয়ে মরাঠি ভাষায় একটি উপন্যাস লিখলেন—‘মোপলা— মুঝে ইসসে কেয়া?’ সরকার বাহাদুরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আরোপে দোষে ১৯১০ সালে তাঁকে বিলেতেই পাকড়াও করা হয়েছিল। ১৯১১ সালে তাঁর কালাপানির সাজা হয়। ১৯২১ সালে তাঁকে মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরির জেলে স্থানান্তরিত করে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট।

এবারে নিশ্চয় চিনে ফেলেছেন ওই যুবককে?

নামটা হল শ্রী বিনায়ক দামোদর সাভারকর। পাতলা চেহারা। নিখুঁতভাবে কামানো গোঁফ আর দাড়ি। নাকের ওপর গোল কাচের চশমা। চোখের দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। ওঁর ছবি একসময় জায়গা পাবে সেই ফুলের দল-এর তাবড় তাবড় সব মহারথীদের দফতরে।

১৯০৯ সালে শ্রী সাভারকর যখন লন্ডনে, তখনই ১৮৫৭ সালের গদর নিয়ে অদ্ভুত একটা বিশ্লেষণ লেখেন।

কেমন ছিল সেই ব্যাখ্যা? কীসে আলাদা অন্যদের বিশ্লেষণের তুলনায়?

ব্রিটিশরা সুচতুরভাবে পরাধীন ভারতের এই বিদ্রোহকে ‘সিপাহী বিদ্রোহ নাম দিয়েছিল। যেন রাষ্ট্র থাকলেই তার সেনাবাহিনী থাকবে, আর সেনাবাহিনী থাকলে তারা বিদ্রোহও করতেই পারে। অতি সাধারণ ব্যাপার। শ্রী সাভারকর নিজস্ব বিচারবুদ্ধির নিরিখে এটাকেই বললেন ‘মহাবিদ্রোহ’। জিউসেপে ম্যাৎজিনি নামক যে ব্যক্তি ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, তাঁর লেখার অনুবাদ করলেন। মাত্র বছর ছাব্বিশের শ্রী সাভারকর ভারতবাসীকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, একতার অভাবই ভারতবাসীর পরাজয়ের প্রধান কারণ।

এরপরে শ্রী সাভারকরকে দীর্ঘ সময় কারাবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছিল। এই জেলপর্ব তাঁকে অনেকখানি বদলে দেয়। সেখানে থাকাকালীন মুসলিমদের প্রতি তাঁর পৃথক একটি দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে ওঠে। স্বচক্ষে তথাকথিত নিম্নবর্ণের (জেলবন্দি ) হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণ দেখতে-দেখতে তাঁর মনে শঙ্কা জন্মাচ্ছিল। উচ্চবর্ণের হিন্দু বন্দিরা নিম্নবর্ণের হিন্দু বন্দিদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করত, সেটাও প্রভাব ফেলেছিল শ্রী সাভারকরের মনে। তিনি ঐক্যের অভাব স্পষ্ট অনুভব করছিলেন। নিজের চিন্তাভাবনাগুলিকে তিনি নথিবদ্ধ করতে শুরু করলেন। একাধিক প্ৰবন্ধ প্রকাশিত হল স্বনামে ও ছদ্মনামে। ভারতের রাজনীতিতে নতুন দিক আনতে তিনি একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন। ইংরেজিতে। ‘Essentials of Hindutva’। খেয়াল করার মতো বিষয় হল ইংরেজির ‘Hinduism’ থেকে সরে এসে তিনি একেবারে দেশজ একটি শব্দ ‘হিন্দুত্ব’কে ইংরেজি অভিধানে ভরে দিচ্ছেন। হিন্দুত্ব শব্দের প্রথম ব্যবহার একজন বাঙালি লেখক ১৮৮০ সালে নিজের লেখাতে করেছিলেন। ভদ্রলোকের নাম চন্দ্রনাথ বসু। চন্দ্রনাথবাবু বঙ্গ সাহিত্য পরিষদের অধ্যক্ষ ছিলেন। হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে অগাধ পড়াশোনা করেছিলেন। ১৮৯২ সালে ‘হিন্দুত্ব’ নামে একটি বইও লেখেন। যাই হোক, শ্রী সাভারকর হিন্দুত্বকে ধর্মের মতো করে না দেখে বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ডিকোড করতে শুরু করলেন, শুরু করলেন মস্তিস্ক নিয়ে খেলা। ‘Essentials of Hindutva’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩ সালে। তখন তিনি রত্নাগিরির জেলে বন্দি। জেল থেকে পাণ্ডুলিপি বাইরে পাচার করে ‘মারহাট্টা’ ছদ্মনামে ছাপা হয়েছিল। ১৯২৮ সালে পুস্তিকা আকারে পরিবর্ধিত হয়ে এল ওই একই লেখা। এবারে লেখার নাম বদলে গেল—‘Hindutva: Who is a Hindu?’

শ্রী সাভারকর বলতে চাইলেন ধর্ম এবং জাতি ব্যতিরেকে ভারতবর্ষের সকল অধিবাসীই হিন্দু। তবে তিনি তাদেরই হিন্দুত্বের এই নতুন ধারণায় ঢোকালেন, যাদের পূর্বপুরুষের ভূমি ছিল ভারতবর্ষ। যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন। ইসলাম এবং খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের জন্যে তাঁর হিন্দুত্ব খাপ খাচ্ছিল না। তাঁর মত ছিল মুসলিমরা মক্কার দিকে তাকিয়ে থাকেন, খ্রিস্টানদের দৃষ্টি থাকে রোমের দিকে, ইহুদিরা খোঁজেন জেরুসালেমের পবিত্র দেওয়ালটাকে। তাহলে ভূগোল দিয়ে বাঁধা ধর্মের ইতিহাসকে ভিত্তি করে একটি দেশের মধ্যে নব রাষ্ট্রবাদ গড়ে তুলতে সমস্যা কোথায়? ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ সরকার যখন শ্রী সাভারকরকে সশর্ত মুক্তি দিল, তারপরে তিনি বৈপ্লবিক আন্দোলনের অভিমুখকে রাজনৈতিক দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। কর্ণাবতীতে (আজকের আমেদাবাদে) ভাষণে বললেন, ‘দুটি রাষ্ট্র আছে, একটি হিন্দু রাষ্ট্র এবং অপরটি মুসলিম রাষ্ট্র। যাদের পূণ্যভূমি এবং ধর্মভূমি ভারতের বাইরে, তারা হিন্দু নয়। তারা রাষ্ট্রীয় নয়।’

শ্রী সাভারকরের বিপক্ষ তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে যত না বিদ্ধ করেছে, তার হাজার গুণ বেশিবার আক্রমণ করেছে তাঁর মৃত্যুর পরে। কিন্তু তাঁদের কাউকেই কেউ এই প্রতিপ্রশ্ন করেননি যে, প্রায় ওই একই সময়কালে ইহুদিরা নিজেদের দেশ খুঁজছিল, ব্রিটেনে বসে এক মুসলিম যুবক চৌধুরী রহমত আলি পাকিস্তান গঠনের স্বপ্ন দেখছিল, তাঁদের রাষ্ট্রবাদে কি কোনও সমস্যা ছিল না? সেক্ষেত্রে প্রশ্ন নেই কেন? পিতৃতন্ত্রের পিঠে ভর করে যদি কেউ ফাদারল্যান্ড, ধর্মের ভিত্তিতে যদি কেউ হোলিল্যান্ড খুঁজতে পারে, তাহলে ভারতমাতার মূর্তিকে মনে রেখে মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠায় সমস্যা কোথায়? ইতিহাসের পাঠক হিসেবে আমাদের মনে প্রশ্ন থাকাটা স্বাভাবিক। হয়তো কেউ-না-কেউ কোনও-না-কোনও দিন এসবের উত্তরও দিতে বসবেন।

ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল ১৯২০ সালে। তখন শ্রী সাভারকর জেলে বন্দি। তাঁর কাছে বাইরের সব খবরই যাচ্ছিল। তিনি নিজের প্রবন্ধ লেখার সময়ে ভারতের রাজনীতিকে মাথায় রেখেছিলেন। ১৯২২ সাল নাগাদ তাঁর প্রবন্ধের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপিটির একটি কপি এক দেশজ ঋগবৈদিক ব্রাহ্মণ যুবকের হাতে এসে পড়ে। তীক্ষ্ণ মেধার সেই যুবক লেখাটি পড়ার পরে সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিক্ষোভ করলেই চলবে না, হিন্দুদের একত্রিত করতে গেলে, হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তুলতে গেলে, হিন্দু সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে গেলে সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করতে হবে।

যুবকের মনে আসলে মালাবারের দাঙ্গা ও নাগপুর দাঙ্গা একটা চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে গিয়েছিল। যুবকের পরিবার কোনও একটি সময়ে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে নাগপুরে এসেছিল। নাগপুর মরাঠা প্রদেশের অন্যতম শহর। মরাঠি আর হিন্দিতে তুখোড় যুবক শিবাজী মহারাজ এবং বীর মরাঠাদেরকে নিজের আদর্শ বলে মনে করতেন। ছোটবেলায় নাগপুরের নীল সিটি হাইস্কুলে বন্দে মাতরম গাইবার অপরাধে তাঁকে স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হয়। প্লেগে বাপ-মা হারানো ছেলেটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কংগ্রেসের বালাকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জে। তিনি ছেলেটির পড়ার দায়িত্ব নেন। পুণেতে প্রাথমিক শিক্ষালাভ শেষ হলে তাঁকে কলকাতায় পাঠান ডাক্তারি পড়ার জন্যে। কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে এলএমএস পাশ করে যুবক ফিরে যান নাগপুরে। লোকে তদ্দিনে তাঁকে ‘ডক্টরজি’ বলে ডাকতে শুরু করেছিল। বাংলায় থাকাকালীন তিনি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেশাত্মবোধক লেখা পড়ে বিশেষ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। যোগ দিয়েছিলেন বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতিতেও। ব্রিটিশ পুলিশের ওপরে বোমা নিক্ষেপ করার অপরাধে তাঁকে গ্রেফতার করা হলেও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তিনি ছাড়া পেয়ে যান। বাংলা আর সেন্ট্রাল প্রভিন্সের বিপ্লবীদের মধ্যে তিনি যোগসূত্র স্থাপন করতেন সমানে। যতবার নাগপুরে যেতেন, ততবার অস্ত্র পাচার করতেন বিপ্লবী দলের হয়ে। এইসব গোপন মিশনের জন্যে গুপ্ত সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করা হতো। অস্ত্রকে বলা হতো ‘অ্যানাটমি’। সম্ভবত তিনি চিকিৎসক ছিলেন বলেই এধরণের শব্দ চয়ন করা হয়েছিল। এর পাশাপাশি সংগঠনের মধ্যে তাঁর একটি কোডনেমও ছিল—‘কোকেইন’।

আর ভালো নাম?

হেডগেওয়ার— কে বি হেডগেওয়ার— কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার।

.

আমরা শ্রী হেডগেওয়ারকে নিয়ে, আরএসএস-কে নিয়ে পড়ব। আসুন, একবার অতীত থেকে চলে আসি অনতি-অতীতে। ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটের অব্যবহিত কাল পূর্বের এগারো সপ্তাহের একটা খতিয়ান দেখা যাক। এক বিখ্যাত অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের দিনলিপি থেকে কয়েকটা পাতা তুলে দেখব, বন্ধুরা।

২-৫ই ডিসেম্বর, ২০২০। গুয়াহাটি, অসম। এই মানুষটি আদিমগিরি পাহড়ের বুকের নিরিবিলি পরিবেশে, একটি আশ্রমে গিয়ে সাক্ষাৎ করছেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের সঙ্গে। ১২ই ডিসেম্বর কামাখ্যা মন্দির দর্শন করে ভদ্রলোক উড়ে আসছেন কলকাতায়, ২০১৯ সালের অগস্ট মাস থেকে এটা তাঁর পঞ্চম কলকাতা ভ্রমণ দাঁড়াচ্ছে। ২৯-৩০শে ডিসেম্বর, ২০২০ কেরালার গভর্নরের সঙ্গে মোলাকাত এবং একটি বইয়ের উদ্বোধন। ১৩-১৪ই জানুয়ারি, ২০২১ তিনি কাটাচ্ছেন চেন্নাইতে, পোঙ্গল উৎসবে অংশগ্রহণ করছেন। ১৭–১৯শে ফেব্রুয়ারি কাটাচ্ছেন কোয়েম্বাটোরে। এবং কোয়েম্বাটোরে তিনি দেখা করছেন এক ভারত-বিখ্যাত (বাঙালি) অভিনেতা তথা প্রাক্তন এমপি’র সঙ্গে।

এবার আন্দাজ করুন কে হতে পারেন সেই ব্যক্তিত্ব?

মাননীয় শ্রী নরেন্দ্র মোদী?

শ্রী অমিত শাহ?

শ্রী জে পি নাড্ডা?

শ্রী রাহুল গান্ধী?

সুশ্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?

নাকি শ্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল?

না, এঁদের কেউ নন। আগেই যেমনটা লিখেছি, ব্যক্তিটি কিন্তু অরাজনৈতিক।

তিনি হলেন আরএসএস সুপ্রিমো শ্রী মোহন ভাগবত। সুপ্রিমো শব্দের প্রয়োগ করাটা ঠিক হবে না, কারণ তিনি সরসঙ্ঘচালক, এবং সঙ্ঘে সরসঙ্ঘচালক একনায়কত্ব ভোগ করার সুযোগ পান না। তো যাই হোক, এহেন এক অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের এমনতর রাজনৈতিক সফরনামা অবাকই করছে। তিনি গুণে-গুণে পা ফেলেছেন এই কয়েক সপ্তাহে, এবং যেখানেই তাঁর পা পড়েছে সেখানেই এমন কিছু-না-কিছু যোগসূত্র মিলেছে যা উপরিউক্ত রাজ্যগুলির বিধানসভা ভোটের দিকে ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ, কোনও-না-কোনও প্রক্রিয়ায় সঙ্ঘ পরিবার ভারতের রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে এবং নিজেও প্রভাবিত হচ্ছে।

এবার ব্যাক টু মিস্টার হেগডেওয়ার। তাঁর কথা লিখেছি। তিনি শ্রী সাভারকরের লেখা পড়ে দারুণ ভাবে অনুপ্রাণিত হন। রত্নাগিরিতে গিয়ে শ্রী সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯২৫ সালে নাগপুরে প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল ভলান্টিয়ার অর্গানাইজেশন। দেশজ ভাষায় যার নাম দাঁড়াচ্ছে ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’। ভিতটার দিকে তাকাতে অনুরোধ করছি। সঙ্ঘের মূলে এক মরাঠিভাষী ব্রাহ্মণ, এবং অনুপ্রেরণায় এক মরাঠি ব্রাহ্মণ। সঙ্ঘের ভৌগলিক অবস্থানের দিকটা দেখে নেওয়া যাক— যথাযথ ভাবে মরাঠাপ্রদেশ নয় কিন্তু মরাঠাদের প্রভাব আছে, আবার হিন্দি বলয়ে না পড়লেও হিন্দি ভাষাটা চলে। এই ভিত্তি, এই ভূগোল, এই ইতিহাস, এই ভাষার বৈচিত্র সঙ্ঘকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নেতৃত্ব জোগাবে। মরাঠা সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস স্মৃতির ভবিষ্যতকে, আর বাকী সবকটা বিষয় সিঞ্চন করবে একটি সর্বভারতীয় বৃক্ষের শেকড়ে।

তবে শুরুর দিকটা খুব ধীর লয়ে ছিল। ৯৯ জন স্বয়ংসেবক একত্রিত হচ্ছেন তিন বছর ধরে। একদা এক রৌদ্রদগ্ধ বাসরে বজরংবলির পুত্তলিকাকে সামনে রেখে ওই ৯৯ জন উচ্চবর্ণের মরাঠি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার শপথ নেবেন। ‘হিন্দু’ নামক জাতির শত বিভেদ, শত জাতি এবং উপজাতিতে বিভাজিত শক্তিকে এক এবং অদ্বিতীয় করার জন্য জন্ম নিল একটি ধারা। নাম তার সঙ্ঘ পরিবার। কালচারাল লেক্সিকনে প্রবেশ করবে ‘হিন্দুত্ব’ নামক একটি ক্ষাত্র-শ্লাঘামূলক শব্দ, যা হিন্দুদের রক্ষা করবে এবং প্রয়োজনে প্রতি-আক্রমণ করতেও দ্বিধা করবে না। অতীত মন্থন করে তুলে আনা ইতিহাসকে একটু অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে ও দেখিয়ে উদ্বুদ্ধ করবে— হিন্দু তুমি এক হও। বীরত্বের এই বীজকে বপন করার জন্যে তাই একেবারে গোড়া থেকেই সঙ্ঘ একটি ‘All- male club ‘-এর প্রতিভূ। বীরত্ব, ক্ষাত্রশক্তি, পৌরুষ এই যা কিছু লিখছি, এসবই কিন্তু সঙ্ঘের পরিভাষা। আমার ব্যক্তিগত শব্দচয়নের এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নেই। রাজনৈতিক ইতিহাসের কথা বলতে গেলে মতাদর্শের কথাকে বিবৃতির মতো করেই বলতে হয়। সেই কাজটুকুই সারছি।

সঙ্ঘের প্রাথমিক ধ্যানধারণার কোনওটাই কিন্তু প্রো-মুসলিম ছিল না। কিন্তু ডক্টর হেডগেওয়ার শ্রী সাভারকরের ‘পূণ্যভূমি’ সংক্রান্ত বক্তব্য নিয়ে মৌনই থেকেছেন। অর্থাৎ এই সিদ্ধান্তে যে সঙ্ঘ সহমত পোষণ করত এমন কোনও প্রমাণ মেলে না। সঙ্ঘের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের একত্রিত করা। একটি বিষয়ে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া হচ্ছিল, তথাকথিত দলিত, অবহেলিত হিন্দু জাতিগুলিকে একত্রিত করা হোক। আদিবাসীদের কাছেও পৌঁছে যাচ্ছিল সঙ্ঘের সাহায্যের হাত।

যে কারণে শ্রী মোহন ভাগবতের ২০২০-২০২১-এর ট্যুর ডায়েরি তুলে ধরলাম এবার সেই কথায় আসি। জন্মলগ্ন থেকেই শ্রী হেডগেওয়ার বলে দিয়েছিলেন, আরএসএস রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে। এই একটা ব্যাপারে তিনি কিছুতেই শ্রী সাভারকরের সঙ্গে একমত হতে পারেননি। বিদগ্ধ শ্রী সাভারকর সঙ্ঘকে, সঙ্ঘের হিন্দুত্বকে শানিয়ে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি চাইছিলেন এর প্রভাব ভোটবাক্সে পড়ুক। সঙ্ঘ নিজের কাজকম্ম সাংস্কৃতিক পরিসরে ও প্রাত্যহিক কসরতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। শ্রী সাভারকর এধরণের অরাজনৈতিক দর্শন দেখে তাচ্ছিল্য করে মন্তব্যও করেছেন যে, জন্মাবে… আরএসএস করবে… এবং কিচ্ছু না-করে একদিন মরেও যাবে।

.

১৯২৫ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হয়। নাগপুরে। এর ঠিক তিনমাসের ব্যবধানে ২৬শে ডিসেম্বর, ১৯২৫ কানপুরে কয়েকজন তরুণ তুর্কি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। প্রায় একইসঙ্গে জন্ম নেওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান। একটি অরাজনৈতিক, অপরটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। মতাদর্শ অনেকটাই এক ধরণের। পরবর্তী কালে নিজেরা নিজেদের কট্টর না- বললেও একে অপরকে গোঁড়া বলেই দাবি করবে। একে অপরের আদর্শের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। একটি প্রতিষ্ঠান মতাদর্শের রদবদলে তথা ছলে- বলে-কৌশলে নিজেকে ক্ষুরধার করে তুলবে, অন্যটি আদ্যিকালের কোনও এক বদ্যিবুড়োর দেখানো পথেই চলবে। এক পক্ষ যে বেদবাক্যটা মনে রাখবে, অন্য পক্ষ তা-ই ভুলে যাবে। কোনও বাক্যটা বলুন দেখিনি?— A rolling stone gathers no moss.

যাই হোক, বোঝাই যাচ্ছে যে রাজনৈতিক হোক বা অরাজনৈতিক, সবকিছুই চলে বা চলছিল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ১৯২৬ সালে অক্টোবর-নভেম্বরে ব্রিটিশ-ভারতের তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। আগেই বলেছি, ভারতের রাজনীতিতে ক্রমশ জাতি আর ধর্মের ভিত্তিতে ভোটাভুটি মাথাচাড়া দিচ্ছিল। এর বছর কয়েক আগেই খিলাফত আন্দোলনের যেভাবে রাজনীতিকরণ হয়েছিল, তা শ্রী সাভারকরকে একটু অন্যরকম বুদ্ধি প্রয়োগ করতে বাধ্য করে তোলে। হিন্দু মহাসভা এবারে জোট বাঁধছিল সেইসব আঞ্চলিক মহাসভাগুলির সঙ্গে, যারা হিন্দুত্বের কথা বলছিল।

১৯২০-এর দশক যেমন সাধারণ নির্বাচনের দশক, তেমনি হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের দশকও বটে। যে যার মতো করে সুযোগ সন্ধানের দশক।

*****

অধ্যায় ১ / ২৪

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন