সেই ফুলের দল – ২২

অভীক মুখোপাধ্যায়

সঙ্ঘ আরেকটি ক্ষেত্রেও সরকারের নীতির বিরোধ করেনি। তা ছিল ভারতের টেলিকম পলিসিতে পরিবর্তন। ১৯৯৯ সালে প্রথম টেলিকমের ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণের ঘোষণা হয়। এর আগে পর্যন্ত শুধুমাত্র ভারত সরকারি সার্ভিস প্রোভাইডার রূপে কাজ করত। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অক্টোবর ২০০০-এ প্রথমে একটি নতুন কোম্পানি ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড বা বিএসএনএল বানানো হল। তারপর বিএসএনএল-এর বেসরকারিকরণ শুরু হল। বিএসএনএল ৮০০ কোটি টাকা লাভ করে দেখিয়েছিল। বাজারে নতুন সার্ভিস প্রোভাইডাররাও আসছিল। প্রতিযোগিতা বাড়ছিল। উপভোক্তাদের সুবিধে হচ্ছিল তার ফলে।

তবে টেলিকমের ক্ষেত্রটা বিরাট ঘোটালার জায়গা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। একটি নির্দিষ্ট কোপমানি বাজারে সার্ভিস প্রোভাইডার রূপে আসার পর থেকে অভিযোগের আঙুল উঠছিল। প্রমোদ মহাজন নাকি সেই কোম্পানিকে বাড়তি সুযোগ সুবিধে পাইয়ে দিচ্ছিলেন বলে কানাঘুষো চলছিল। কংগ্রেস এর বিরোধ করে। মহাজনকে সরিয়ে অরুণ শৌরিকে আনা হয়। জার্নালিস্ট হিসেবে শৌরির আবার ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রায় জেহাদ ঘোষণা করার একটা ট্র্যাক রেকর্ড ছিল। শোনা যায়, টেলিকম প্রসঙ্গে মহাজন এবং শৌরি প্রায় ডুয়েলের পর্যায়ে নেমে লড়েছিলেন। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে দুজনকে ডেকে অটল বুঝিয়েছিলেন।

প্রমোদ মহাজনের আকস্মিক মৃত্যু না হলে হয়তো ভারতবাসী আজ তাঁকে কোনও উচ্চপদে দেখতেন। একদা অটলবিহারীর ‘হনুমান’ জি (যেমন রামভক্ত হয়, তেমনি অটল-ভক্ত রূপে প্রমোদকে এই কথা বলা হতো।) এমনি তুখোড় ব্যাকরুম স্ট্রাটেজিস্ট ছিলেন যে লোকে বলত, ‘পেপসি আর প্রমোদ মহাজন নিজের ফর্মুলা কখনও বাইরে বলে না।’

ভাজপার রামের কথা আগেই হয়েছে, হনুমান জির কথাও হল। আর লক্ষ্মণ? তাঁর কথা?

.

লক্ষ্মণ। বঙ্গারু লক্ষ্মণ। ভাজপার প্রথম দলিত পার্টি প্রেসিডেন্ট।

বঙ্গারু লক্ষ্মণ দলীয় ব্যাপার স্যাপার নিয়ে আডবানির কাছে রিপোর্ট না করে অটলবিহারীকে খবর দিতেন। আসলে লক্ষ্মণকে অটলবিহারীই এনেছিলেন। অটলের ঘনিষ্ঠ বৃত্ত নিয়ে তিনি সরকার চালাচ্ছিলেন, দলের দায়িত্ব আডবানির ওপরে ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের আগস্ট মাসে বাজপেয়ী দলেও নিজের একজন পছন্দের লোককে জায়গা দিলেন।

সবর্ণ জাতির পার্টি বলে চিহ্নিত ভাজপার ক্ষেত্রে দলিত লক্ষ্মণের পার্টি প্রেসিডেন্ট হওয়াটা যুগান্তকারী ছিল। তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার ছিল। লক্ষ্মণ দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছিলেন। সেখানে তখনো দল সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে না পারায় একটা প্রতীকী ব্যাপার তো ছিলই— আমরা উত্তর-দক্ষিণে ভেদাভেদ করি না। লক্ষ্মণের বক্তব্য ছিল, ‘আমি দল এবং সরকারের মধ্যে সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে এসেছি।’

রাজনৈতিক মহলে বলাবলি চলছিল, বাজপেয়ী নতুন সঙ্গী পেয়ে গেছেন। রাম-পার্টি অটল-বঙ্গারু জুটির হাত ধরে রাম-লক্ষ্মণ যুগে প্রবেশ করছিল। ব্রজেশ মিশ্রা, রঞ্জন ভট্টাচার্যরা যেমন সরকার চালাচ্ছিলেন, অটল এবং বঙ্গারু লক্ষ্মণ তেমনি দল চালাতে লাগলেন। আডবানি দলে গুরুত্ব হারাচ্ছিলেন।

কিন্তু চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। লক্ষ্মণের উত্থান যতটা দ্রুত গতিতে হয়েছিল, পতনও ততটাই তাড়াতাড়ি ঘটল। আডবানির গুরুত্ব আবারও বাড়ল। কী হয়েছিল এবারে বলি।

১৩ই মার্চ ২০০১। একটি নিউজ ওয়েবসাইটে ১০৫ ঘণ্টার ভিডিওটেপ প্রকাশিত হল। তখন ইন্টারনেট ভারতে হামাগুড়ি দিচ্ছে। হাতেগোণা কিছু মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন। তাতেই হইচই পড়ে গেল। ‘তেহেলকা’র স্টিং অপারেশন ‘West End’ তখন ভাইরাল হয়ে গেছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছিল দেশের কিছু সেন আধিকারিক এবং কয়েকজন রাজনীতিক অর্থ আর নারী শরীরের বিনিময়ে একজন (ভুয়ো) অস্ত্র ব্যবসায়ীকে ‘ডিল’ পাকা করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ভিডিওতে বঙ্গারু লক্ষ্মণকে এক লক্ষ টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল। এবং তিনি দেশের একাধিক উচ্চপদস্থ অফিসারের নামও করছিলেন।

বঙ্গারু লক্ষ্মণ সঙ্ঘের পটভূমি থেকে এসেছিলেন। তাই সঙ্ঘ নিজের পক্ষ থেকে জানিয়ে দিল যে, লক্ষ্মণ একজন ‘ভ্রষ্ট স্বয়ংসেবক’ এবং ‘ছাত্র পাস করতে না পারলে তার দায় প্রধানশিক্ষককে দেওয়া যায় না’। পিএমও-এর যেসব আধিকারিকের নাম লক্ষ্মণ ভিডিওতে করেছিলেন, তাঁদের প্রসঙ্গেও সঙ্ঘ কড়া সমালোচনা করল।

ক’দিন পরে একটি ম্যাগাজিনে তিনজন উচ্চপদস্থ আধিকারিকের ছবি ও নাম দিয়ে একটি খবর বেরোলো। তাঁদেরকে প্রধানমন্ত্রীর ‘দুর্বলতা’ বলা হয়েছিল।

বঙ্গারু লক্ষ্মণ দলীয় পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন।

আরও একজন ইস্তফা দিয়েছিলেন। তিনি ইস্তফা দিয়েছিলেন মন্ত্রীত্ব থেকে। তিনি ছিলেন দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ।

ভিডিওতে দেখে গিয়েছিল জর্জের সমতা পার্টির প্রেসিডেন্ট জয়া জেটলি জর্জের বাড়িতে বসেই তেহেলকার আণ্ডারকভার অপারেটরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তিনি যেন টাকাটা দলের কাজের জন্য ওই ঘরে উপস্থিত একজনের হাতে তুলে দেন।

তেহেলকার টিম ১৩ তারিখ দিল্লির ইম্পেরিয়াল হোটেলে একটা প্রেস কনফারেন্স ডেকে ভিডিওর ক্লিপিংস দেখাচ্ছিল। আর প্রধানমন্ত্রী ভিডিওর প্রসঙ্গে ক্যাবিনেটের বৈঠক ডাকলেন। বৈঠক চলাকালীন জর্জ তিনবার নিজের ইস্তফা প্রদানের ইচ্ছাপ্রকাশ করেন। প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে তাঁর এই প্রস্তাব বাতিল করে দেয় ক্যাবিনেট।

১৪ তারিখ পার্লামেন্ট বিরোধীদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠল। সকলকে চমকে দিয়ে জর্জের পদত্যাগের দাবি তুলে এনডিএ-এর একজন জোটসঙ্গী জোট থেকে বেরিয়ে এল।

একসময়ে যারা জর্জকে সম্মানের চোখে দেখতেন, তাঁরাই জর্জকে চোর বলছিলেন। আত্মসম্মানী মানুষ জর্জ ১৮ই মার্চ নিজের মন্ত্রীপদ থেকে ইস্তফা দিলেন।

নিয়তি কার জন্য কী তুলে রাখা বলা বড় মুশকিল। আটের দশকে রাজীব গান্ধীর বোফর্স কেলেঙ্কারির সময়ে যে জর্জ রাজীবের প্রচণ্ড মুখর সমালোচক ছিলেন, তাঁকেই কিনা সেনার সরঞ্জামাদি ক্রয়ের ঘোটালার কলঙ্ক মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। আবার যে জোটসঙ্গী তেহেলকার স্টিং অপারেশনের ফলে জর্জের পদত্যাগ দাবি করে জোট ছাড়লেন, ভবিষ্যতের গর্ভে তাঁর দলের সদস্যরাই আবার স্টিং অপারেশনের মুখে পড়ে কলঙ্কিত হবেন। তেহেলকার যে তরুণ তেজপালের জন্য জর্জের মতো চূড়ান্ত সমাজবাদী, সাদামাটা ব্যক্তিকে স্টিং অপারেশনের জেরে পদত্যাগ করতে হয়েছিল, সেই তরুণ তেজপালকে অপারেশন ওয়েস্ট এন্ড-এর অনেক বছর পরে কন্যাসমা এক তরুণীর যৌন হেনস্থার দায়ে অপদস্থ হতে হবে। ইতিহাস আসলে কাউকে ক্ষমা করে না।

.

ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না সত্যিই, আবার এটাও সত্য যে ক্ষমার মাধ্যমেই ইতিহাস তৈরি করা যায়। ভারত ক্ষমার ভাষা বলাই বেশি পছন্দ করে। অটল আবার ক্ষমার পথে চলতে চাইছিলেন।

নভেম্বর ২০০০। রমজানের মাস চলছিল। অটলবিহারী সরকার জানাল যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী আগামী ছ’মাস কাশ্মীরে অনুপ্রবেশকারী কিংবা স্থানীয় উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে কোনও ধরণের অপারেশন চালাবে না। হয়তো ভালোবেসে মন জয় করার পন্থা নেওয়া হচ্ছিল। শোনা যায়, এই সিদ্ধান্তের পিছনে ছিলেন বাজপেয়ী, জশবন্ত সিং এবং ব্রজেশ মিশ্রা।

ছ’মাস কেটে গেল। সরকার সম্ভবত জারী করা ডিক্রিটির মেয়াদ বাড়ানোর কথা ভাবছিল। সিজফায়ারের চলতি মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র ক’দিন আগে ২৩শে মে ২০০১ বাজপেয়ী এবং জশবন্ত সিং আডবানিকে মধ্যাহ্নভোজে নিমন্ত্রণ জানালেন। হতে পারে যে, সিজফায়ারের মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য কথোপকথন প্রয়োজন ছিল।

বাজপেয়ী কিছু বলার আগেই আডবানি চমক দিলেন। বললেন, ‘অটলজি, আলোচনার জন্য জেনারেল (মুশারফ)কে ভারতে আমন্ত্রণ জানালে কেমন হয়?’ বাজপেয়ী প্রস্তাব লুফে নিলেন। তাঁর লাহোর বার্তা সাফল্যের মুখ দেখেনি, তাই বলে তাঁর আমন্ত্রণ বার্তা সফল হবে না এটা কে বলেছে?

কান্দাহার কাণ্ডের পর ভারত-পাক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকলেও আডবানি তলে তলে সম্পর্কে উন্নতি করানোর জন্য লেগে ছিলেন। ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানি হাই কমিশনারের সঙ্গে বিগত দেড় বছরে কুড়িবারের বেশি বসেছিলেন। এসবই হচ্ছিল তাঁর বাড়িতে, জনসমক্ষে খবর আসেনি।

নিখুঁত হোমওয়ার্ক করছিলেন আডবানি। পাক হাই কমিশনার আশফাক কাজীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতেন। কারগিলে যুদ্ধ বাঁধালেন যে ভদ্রলোক সে মানুষ হিসেবে কেমন? তাঁকে ভরসা করা যাবে কিনা? তিনি শান্তিচুক্তি করতে রাজী হবেন কিনা?

কাজী বলেছিলেন, ‘আপনি তো ওঁকে একবার নিমন্ত্রণ করেই দেখতে পারেন?’

আশফাক কাজীর করা এই প্রশ্নটাকেই বয়ানের মতো সেদিন আডবানি খাবার টেবলে বাজপেয়ীর সম্মুখে পেশ করেছিলেন। ‘Agra Summit’ রূপায়িত হতে চলেছিল।

.

‘হম অপনে রিস্তেদারোঁ কো চুন সকতে হ্যাঁয়, পড়োসি কো নহি।’— অটলবিহারী বাজপেয়ী

তাই প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া না বাড়িয়ে সৌহার্দ্য দেখানোই ঠিক পথ বলে মনে করছিলেন প্রাজ্ঞ এই রাজনীতিক। ১৪-১৬ই জুলাই ২০০১, আগ্রা সামিটের জন্য ঠিক করা হয়েছিল। আগ্রার লাক্সারি হোটেলের সেরা সুইটে মুশারফকে রাখার এবং তাঁর জন্য সেরার সেরা খানাপিনার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।

সঙ্ঘ বলছিল, ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলদায়ক পদক্ষেপ। বিহিপ বলছিল, এসব করে কোনও লাভ নেই।

শুরুর আলাপটা ভালো হল না। মুশারফ দিল্লিতে নেমেই আডবানির সঙ্গে মোলাকাত করলেন। আডবানি বর্ডারের ওদিক থেকে সন্ত্রাসবাদের আমদানি, দাউদ ইব্রাহিম ইত্যাদি প্রসঙ্গে কথা তুলতেই মুশারফ জবাব দিলেন কশমীরের বিতর্কিত ইস্যু দিয়ে।

১৬ই জুলাই ২০০১। কাশ্মীর প্রসঙ্গে মুশারফ সকালে সাংবাদিকদের বললেন, ‘আমরা ওখানে কোনোরকমের হিংসাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি না। যা ঘটছে, তা হল স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম।’

সেদিনই দুপুরে ভারত পাকিস্তান যৌথ বিবৃতি দেবে বলে ঠিক করেছিল। তার প্রাথমিক খসড়া পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। জশবন্ত সিং সেই ড্রাফট প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন যে, ওই ড্রাফট মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ক্রস বর্ডার টেররিজম নিয়ে যা লিখতে বলা হয়েছিল, তা পাকিস্তান সুচারু পদ্ধতিতে এড়িয়ে গেছে। উলটে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা ঢুকিয়ে দিয়েছে।

শান্তিচুক্তি ভেস্তে গেল। সেদিন রাত ১১টার সময় মুশারফ আর বাজপেয়ীর একটি সাক্ষাৎ হয়। মুশারফ বাজপেয়ীকে যা বলেছিলেন তার সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, আজ আমাকে আর আপনাকে অপদস্থ হতে হল কারণ কেউ একজন আমাদের ওপরে বসে ঠিক করে দিতে চাইছেন আমাদের কী করতে হবে।

ইঙ্গিত আডবানির দিকে ছিল। এবং তারও ওপরে সঙ্ঘের দিকে।

হয়তো আগ্রা সামিট-এ আগ্রহী আডবানি এবং আগ্রা সামিটের দিনের আডবানির মধ্যে ফারাক ছিল ঠিকই। কিন্তু ১৬ তারিখ সকালে মুশারফ যে যে কথাগুলো সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তার জন্য আডবানি দায়ী ছিলেন না। ওই মানসিকতা নিয়ে চুক্তি করতে বসলে আডবানি থাকুন বা না-থাকুন ভারতের পক্ষ থেকে কেউই রাজী হতেন না। তবে অটল এবং আডবানি দুজনেই মুশারফকে তুলনামূলক নিরীহ ভেবেছিলেন। তাঁরা যে ভুল করেছিলেন তা মাস দুয়েকের মধ্যেই বোঝা গেল।

.

১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১। সারা বিশ্ব দেখল আমেরিকার জোড়া টাওয়ার বিমান হানায় ভেঙে পড়ছে। পেন্টাগন জ্বলছিল। ৩,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। কট্টর ইসলামিক জেহাদের ধরণ দেখে বিশ্ববাসী তখন ত্রস্ত।

আমেরিকা তো বটেই, আরও অনেকগুলি দেশ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন রকমের আইন জারি করল। ভারতে কিছুদিনের মধ্যেই Prevenetion of Terrorisom Act 2002 চালু হল।

অ্যামেরিকার সর্বনাশের মধ্যে পাকিস্তান নিজের পৌষ মাস খুঁজে পেল। মুশারফ চট করে দল বদলে নিজের সন্ত্রাসবাদীদের পরিত্যাগ করে আমেরিকার সঙ্গী হয়ে উঠল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন সঙ্গী দেশগুলির সাথে মিলে আফগানিস্তান থেকে লাদেনকে খুঁজে বের করতে আর তালিবানদের শায়েস্তা করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। পাকিস্তান মার্কিন বাহিনীর ঘাঁটি হয়ে উঠল। পরিবর্তে পেল ১৯ বিলিয়ন ডলারের অর্থসাহায্য, যার ৭৫% তাঁরা নিজেদের মিলিটারি শক্তিকে বৃদ্ধি করতে ব্যয় করল। অনেকে মনে করছিলেন পাকিস্তান আমেরিকাকে সাহায্য করার পরিবর্তে কাশ্মীর ইস্যুতে তাদের সহায়তা চাইবে, মধ্যস্থতা করতে বলবে। তবে অল্পদিনের মধ্যেই বোঝা গেল পাকিস্তান ঠিক কী করতে চাইছিল।

.

১৩ই ডিসেম্বর ২০০১। সেদিনের অধিবেশন মুলতুবি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী এবং প্রতিপক্ষের নেতা সোনিয়া গান্ধী দুজনেই কিছুক্ষণ আগে পার্লামেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছেন। ১১টা নাগাদ উপ রাষ্ট্রপতি বেরোবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে তাঁর কনভয়ের একটি গাড়িতে একটা সাদা রঙের অ্যাম্বাসাডার এসে ধাক্কা মারল। আঘাতকারী গাড়িটার মাথায় লালবাতি জ্বলছিল, কাচে সাঁটানো ছিল গৃহমন্ত্রকের স্টিকার। গাড়ি থেকে পাঁচজন বেরিয়ে এসে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। তাদের প্রত্যেকের পরনে ছিল সুইসাইড ভেস্ট।

গৃহমন্ত্রী, বিদেশ মন্ত্রী সহ প্রায় ২০০ জন সাংসদ সেদিন সংসদে উপস্থিত ছিলেন। গ্রেনেড আর গুলির শব্দে ভবন প্রাঙ্গন কেঁপে কেঁপে উঠছিল। সুরক্ষাকর্মীদের ঐকান্তিক প্রতিরোধের পর সংসদ বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। সেদিন আটজন প্রহরী এবং একজন মালী প্রাণ হারিয়েছিলেন।

আডবানি কান্দাহার কাণ্ডের পরে যা বলেছিলেন, তার পুনরাবৃত্তি করলেন। আমরা দুর্বল। আমাদের দুর্বল মানসিকতার সমাজের অঙ্গ বলে আমাদের সরকার ও দুর্বল।

অটল সংসদে বিবৃতি দিলেন যে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে কোনও দ্বিচারিতা করা হবে না।

পাকিস্তানি গুপ্তচর এজেন্সি আইএসআই-এর মদতপুষ্ট দুটি জঙ্গী সংগঠনের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠছিল। সঙ্ঘ বলছিল, লাইন অব কন্ট্রল পেরিয়ে সন্ত্রাসবাদের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে হামলা করা হোক।

বাজপেয়ী ভারতের পশ্চিম সীমান্তে ৫ লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করার নির্দেশ দিলেন। পাকিস্তান ১,২০,০০০ সৈন্যকে মোতায়েন করল। ‘৭১ সালের যুদ্ধের পর দুপক্ষের মধ্যে এত বড় সৈন্য সমাবেশ এই প্রথম দেখা গেল।

১৪ই মে 2002। তিনজন পাকিস্তানি বর্ডার পেরিয়ে এসে জম্মুতে ভারতীয় সেনার পোশাক প’রে একটি সেনাছাউনিতে প্রবেশ করে। তিরিশজনকে হত্যা করে তারা। বেশ কয়েকজন সেনা জওয়ান, তাঁদের পরিজনদের মারা হয়েছিল।

সঙ্ঘ আবারও আক্রমণের কথা তুলেছিল। প্রধানমন্ত্রী কেবল আরব সাগরের বুকে একটি ন্যাভাল ব্লকেড-এর ফরমান জারী করেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন। অবশ্য আরও একটি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ভারতের পাকিস্তানি হাই কমিশনার আশফাক কাজীকে বলা হয়েছিল, আপনি নিজের দেশে ফিরে যান।

আগ্রা সামিট-এর অন্যতম স্থপতিকার আশফাক কাজী ফিরে গিয়েছিলেন। ২০০২ সালের শেষ দিকে ভারত নিজের সেনাদের সীমান্ত থেকে আবার ফিরিয়ে নিয়েছিল।

* * * **

বাজপেয়ী বারবার বলেছেন, ‘আমার রাজনৈতিক জীবন খোলা খাতার মতো।’ কিন্তু তাঁর সঙ্গে মিসেস কৌলের সম্পর্ক নিয়ে মানুষ খুব কমই জানে। এমন একটা সম্পর্ক, যার কোনও নাম নেই, কোনও বন্ধন নেই, তবুও সেই সম্পর্ক আমৃত্যু রয়ে গেছে, ভাঙেনি। তাঁরা উভয়েই সমাজের পরোয়া করেননি, কোনও দলের পরোয়া করেননি।

বাজপেয়ীর বাসভবনে ফোন করলে প্রায়ই একজন নারীর কণ্ঠ শোনা যেত। আত্মীয়তা বোধে ভরা কণ্ঠের মধ্যে উষ্ণতার সম্পৃক্তি থাকত।

মিসেস কৌল দিস সাইড।

হ্যাঁ ম্যাম, আমি জানি।

আপনি জানেন না আমি কে, ইউ ডোন্ট নো হু আই অ্যাম।

নো, ম্যাম।

আই অ্যাম মিসেস কৌল, রাজকুমারী কৌল। বাজপেয়ীজি আর আমি অনেকদিনের বন্ধু। চল্লিশ বছরেরও বেশি সময়ের বন্ধুত্ব আমাদের, আপনি শুনেছেন আগে?

মিসেস কৌল এবং তাঁর স্বামী বি এম কৌল দীর্ঘদিন ধরেই বাজপেয়ীর সঙ্গে থাকছিলেন। মিস্টার কৌল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন।

ভণ্ডামি আর দ্বিচারিতার মানদণ্ডে রাজনীতি করা ভারতীয়দের মধ্যে যদি কোনও রাজনীতিকের জীবনে এমন একটি অলিখিত প্রেমকাহিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে চলে, এবং তাকে কোনভাবেই আড়াল করার চেষ্টা না করা হয়, তাহলে তা প্রশংসনীয় হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। এমন একটি সম্পর্ক, যার কোনও নাম নেই, যা তাঁরা অস্বীকার করেন না, যা সকলে মেনে নিয়েছেন। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবার এমন হয়েছিল যখন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি নিবাসে এমন কেউ থাকছিলেন, প্রোটোকলে যার কোনও স্থান নেই। অথচ তাঁর উপস্থিতি ও কর্তৃত্ব ছিল যত্র তত্র সর্বত্র। তবে ওটুকুই, সরকারি বাসভবনের বাইরে মিসেস কৌল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কোনও সরকারি ভিজিটে যেতেন না।

প্রতিপক্ষের কোনও নেতা কখনও বাজপেয়ীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনও খারাপ মন্তব্য করেননি, প্রশ্ন তোলেননি। সঙ্ঘ পরিবারে বাজপেয়ীর প্রাথমিক বছরগুলিতে এই নিয়ে কিছু প্রসঙ্গ উঠে এলেও পরে সঙ্ঘ আর মুখ খোলেনি। হাতেগোণা দু-একজন ব্যক্তিগত স্তরে কানাঘুষো করলেও অটলবিহারী এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না।

১৯৭৮ সালের কথা। বাজপেয়ী তখন জনতা সরকারে বিদেশ মন্ত্রী। চিন আর পাকিস্তান ঘুরে দেশে ফিরেছেন। দিল্লিতে প্রেস কনফারেন্স চলছে। চিন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম হয়ে প্রশ্ন এবার তাঁর জীবনে প্রেমের দিকে ঘুরল। একজন তরুণ সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘বাজপেয়ীজি, পাকিস্তান, কাশ্মীর আর চিনের কথা ছাড়ুন, আপনি বলুন মিসেস কৌলের ব্যাপারটা কী?’

আচমকা এমন একটা প্রশ্ন কেউ আশাই করেননি। কনফারেন্স রুমে তখন পিনড্রপ সাইলেন্স। সবাই বাজপেয়ীর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কী হয়, কী হয়। বাজপেয়ী অবিচল, অটল। তিনি মাথা নেড়ে, চোখে হাসির ঝিলিক টেনে বললেন, ‘ব্যাপারটা কাশ্মীরের মতোই।’ সবাই হেসে উঠলেন।

মিসেস কৌল সেইসব মানুষদের কখনো ভোলেননি, যারা এমারজেন্সি পিরিয়ডে তাঁদের পাশে থেকেছিলেন। সে সবজিওয়ালাই হোক বা পুলিশ কর্তা। তাঁরা কখনও কোনও সাহায্য চাইলে মিসেস কৌল তাঁদের খালি হাতে ফিরিয়ে দিতেন না।

অটলবিহারী নামক সূর্য যখন মধ্য গগনে তখনও যেমন মিসেস কৌল তাঁর সঙ্গে থেকেছেন, তেমনি অস্তমান সূর্যেরও সঙ্গী হয়ে থেকে গেছেন তিনি। তখন মিস্টার কৌল, মিসেস কৌল, কৌল দম্পতির ছোট মেয়ে নমিতা, জামাই রঞ্জন ভট্টাচার্য এবং নমিতার মেয়ে নীহারিকা একসঙ্গে থাকতেন। রঞ্জন এবং নমিতা অনেকবার বাজপেয়ীর সঙ্গে অফিসিয়াল ট্যুরে গেছেন। বিদেশ যাত্রার সময় মিসেস কৌল রঞ্জনের মোবাইলেই বাজপেয়ীর ওষুধপত্রের কথা মনে করাতে থাকতেন।

আটের দশকে নমিতা আর রঞ্জনের বিয়ে হয়। রঞ্জন বাঙালি বাবু, তবে পটনার ছেলে; দিল্লির ওবেরয় হোটেলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নমিতা মৌর্যা হোটেলের সঙ্গে জুড়ে ছিলেন সেই সময়। ১৯৭৭ সাল থেকে দুজনের পরিচয় ছিল। বিয়ের আগেও রঞ্জন অটলবিহারীর বাসভবনে যেতেন। তখন অবশ্য তাঁর ভবিষ্যতের ‘বাপজি’(আদর করে অটলকে এই নামেই তিনি ডাকতেন) তাঁর সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলতেন না। কিন্তু বিয়ের জন্য বাজপেয়ীর অনুমোদন প্রয়োজন ছিল। না বলেননি অটলবিহারী। বিয়ের পর রঞ্জন অটলের বাসভবনে এসেই থাকতে শুরু করলেন। ‘৯৬ সালের ১৩ দিনের সরকারে অটলবিহারী যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন রঞ্জনকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি করা হয়েছিল। ‘৯৯-০৪ -এর পর্বে অবশ্য রঞ্জনকে কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তবে রাজধানীর শক্তি বলয়ে তিনি সবসময়েই থেকেছেন। বিতর্ক বহুবার তাঁকে ছুঁতে চেষ্টা করেছে। ‘তেহেলকা’ কাণ্ডে রঞ্জনের নাম শোনা গিয়েছিল। জর্জ যখন পদত্যাগ করলেন, তখন রাজনৈতিক মহলে কানাঘুষো চলেছিল যে, শক্তি বলয়ের লোকেদের রক্ষা করতে জর্জকে কুর্বান করা হল। তবে এ সবই রটনা, যার সত্যতা কখনও প্রমাণিত হয়নি।

‘অপারেশন ওয়েস্ট এন্ড’-এর পরে অটলের ঘনিষ্ঠদের নাম নিয়ে যখন মিডিয়াতে লোফালুফি চলছে, তখন একদিন আডবানি তাঁর বাসভবনে গেলেন। বেদনাভরা কণ্ঠে বললেন, ‘আপনার পরিবারের অন্যান্যদের মতোই মিসেস কৌল পর্যন্ত আমাকে নাগরাজ (আডবানি ‘সাঁপনাথ’ শবটা ব্যবহার করেছিলেন বলছেন।’ আসলে খবর ছড়াচ্ছিল যে, অটল ঘনিষ্ঠদের জব্দ করতে আডবানিই এসব ব্যবস্থা করেছিলেন। অটল অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এমন বক্তব্যকে খণ্ডন করেন। মিসেস কৌল নিজেও একথা শুনে বেরিয়ে অতিথি রূপে আগত আডবানিকে শান্ত করেন। দুপক্ষের মধ্যেকার বরফ আবার গলতে শুরু করে।

কিন্তু জীবনে আগত সব অতিথির রূপ সমান হয় না। আডবানি শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার প্রায় ন’মাস পরে এপ্রিল ২০০২-তে আরেক অতিথি এসে পৌঁছালেন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। তিনি প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন।

কীসের প্রস্তাব?

রাষ্ট্রপতিত্বের প্রস্তাব।

অটলবিহারীকে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি এবং আডবানিকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী করা হোক— এই ছিল প্রস্তাবে।

কে এসেছিলেন, বলুন তো?

সুদর্শন। কে এস সুদর্শন।

সবাই বলেন, আডবানি আগে থেকে এই খবর জানতেন না। সঙ্ঘের লোকেরা বলেন, এই মত সঙ্ঘের পক্ষ থেকে গৃহীত হয়নি, নিছক ব্যক্তিমত মাত্ৰ।

যখন সুদর্শন আডবানিকে এই প্রস্তাবের কথা বললেন, আডবানি অটলবিহারীর প্রতিক্রিয়ার কথা জানতে চেয়েছিলেন। সুদর্শন বলেছিলেন, ‘উনি হ্যাঁ বা না কোনটাই বলেননি। তাই ধরে নিচ্ছি, উনি আমার প্রস্তাবকে নাকচ করেননি।

পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হতে চলেছিল। সুদর্শন আসার কয়েক সপ্তাহ আগেই অটলকে একজন বিজনেস টাইকুন বলেছিলেন যে, আডবানির ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক মহলের সূত্র থেকে খবর ছড়াচ্ছে যে আডবানি প্রধানমন্ত্রী ও অটল রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন। নিজের প্রস্তুতিটা অটল তখন থেকেই সেরে রেখেছিলেন।

একদা রাজীব ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এবং পরে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল রূপে শিবসেনা তথা ভাজপার প্রিয় হয়ে ওঠা পি সি আলেকজান্ডারের নাম রাষ্ট্রপতি হিসেবে উঠছিল। আলেকজান্ডারের নাম সোনিয়া নাকচ করে দেন।

এই সময়েই সঙ্ঘের এম জি বৈদ্যর কাছে বলরাজ মাঢোকের ফোন আসে। তিনি সঙ্ঘের পক্ষ থেকে নিজের নাম প্রস্তাব করার অনুরোধ করেন। বৈদ্য সরাসরি অটলে সঙ্গে কথা বলতে বলেন। নিজের পুরোনো দুশমনের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেননি মাঢোক।

চালতে চালতে বাজপেয়ীর উঠে এল মেজর জেনারেল পৃথ্বীরাজের নাম। চেনা চেনা ঠেকল কি? তা তো ঠেকবেই। এই নামটা পোখরান টেস্টের সময় লিখেছিলাম। এটা কিন্তু কোডনেম ছিল। পরীক্ষণের গোপনীয়তা রক্ষার তাগিদে দেওয়া হয়েছিল।

তাহলে বাস্তবে কে ছিলেন এই মেজর জেনারেল পৃথ্বীরাজ?

আবুল পাকির জয়নুলাবদীন আবদুল কালাম।

মহা বিদ্বান এই মানুষটি হিন্দু রাষ্ট্রবাদীদের কাছে তাঁদের পছন্দের মুসলমান, যিনি মহাভারত, রামায়ণ, গীতা, উপনিষদের দখল রাখেন, রুদ্র বীণা বাজান। আবার মুসলিমদের কাছে তিনি আদর্শ, যিনি নিজের জ্ঞানের আলোয় সমগ্র দুনিয়ার সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত করেছেন।

বাজপেয়ী এর আগেও আবদুল কালাম সাহেবকে একবার মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি সাড়া দেননি। এবারে আর তেমন প্রত্যাখ্যান এল না। কংগ্রেসও রাজী হয়ে গেল। সঙ্ঘ না করতে পারল না। বাজপেয়ী নিজের কুর্সি রক্ষা করলেন।

উপ রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি নিজের এক পুরোনো সঙ্গীর নাম বাছলেন। রাজস্থানের ‘বাবোসা’— ভৈঁরো সিং শেখাওয়াত।

এর কিছুদিন পর জুন 2002-তে অটলবিহারী আরও একটি ঘোষণা করলেন। আডবানিকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ দেওয়া হল। ভাজপার অটল- আডবানি জুটি এবারে সরকারি ভাবে ভারতের অটল-আডবানি জুড়িতে পরিণত হল।

.

অটলকে এক নাম্বারে এবং আডবানিকে দু’য়ে নিয়ে সরকার নিজের অন্তিম বর্ষে পা রেখেছিল। ২০০৩ সাল। জুলাই মাস। দল ও সরকার, উন্নয়ন ও সরকার, সরকারের প্রথম আর দ্বিতীয় মুখের মধ্যে মোটামুটি একটা সামঞ্জস্য ফিরে এসেছিল।

তেহেলকার পর বঙ্গারু লক্ষ্মণ বিদায় নেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ভেঙ্কাইয়া নাইডু। নাইডু আডবানির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। নাইডুই বলেছিলেন, ‘বাজপেয়ীজি হলেন বিকাশ পুরুষ, আর আডবানিজি লৌহ পুরুষ।’

বাজপেয়ীর সরকারি বাসভবনের মধ্যেই একটি কর্মীসভার আয়োজন করা হয়েছিল। উপস্থিত ছিলেন প্রায় ২৫০ জন দলীয় কর্মী। বাজপেয়ীজি মঞ্চ থেকে বললেন, ‘আডবানিজি কে নেতৃত্ব মে বিজয় কি ওঢ় আগে বঢ়ে।’

অটলবিহারী না ভেবেচিন্তে কিচ্ছু বলতেন না। ‘৯৭ সালে ‘মুখোশ’ কাণ্ডের পর থেকে তিনি খুব সচেতনভাবেই নিজেকে পিছন রাখতেন। তিনি জানতেন, তাঁকে ছাড়া দলের পক্ষে জেতাটা কঠিন কাজ। দল তাঁর কাছে অনুরোধ করতে আসবেই আসবে।

হলও তা-ই। তিনি বক্তব্য রেখে বসার আগেই নাইডু এসে বললেন, ‘আরও একবার স্পষ্ট করে দেওয়া যাক ব্যাপারটা… পরের ভোটে অটলজিই আমাদের নেতৃত্ব দেবেন এবং উনিই আবার আমাদের প্রধানমন্ত্রী হবেন।’

ক’দিন পরে ক্যাবিনেট মিটিং ছিল। সেখানে মুরলী মনোহর জোশি বাজপেয়ীকেই একমাত্র নেতা বলে উল্লেখ করলেন। আডবানি নিজেও উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোনও মন্তব্য করলেন না। যে সঙ্ঘ এতকাল অটলকে সরিয়ে আডবানিকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসাবে বলে উঠে পড়ে লেগেছিল, সেই সঙ্ঘও নীরব সম্মতি জানাল। হয়তো প্রত্যেকেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিচ্ছিল। প্রত্যেকেরই হয়তো মনে পড়ছিল পানিপতের তৃতীয় যুদ্ধের কথা— যে যুদ্ধে অনেক সৈন্য, অনেক সেনাপতি থাকলেও যোগ্য কোনও নেতৃত্ব ছিল না।

* * * * *

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন