অভীক মুখোপাধ্যায়
আমরা এবার গান্ধী-পরিবারের মধ্যে ভাঙনের ক্ষেত্রে গ্বালিয়রের ভূমিকাটা দেখব। অতীতের চারণা তো। আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অটলবিহারীর জন্ম দেখব। তাঁর গুরুকে দেখব। তাঁর গুরুর গুরুকে দেখব। আলোচনা দীর্ঘ হতে পারে। দয়া করে ধৈর্য হারাবেন না।
স্যার জন ম্যালকমের ‘আ মেমোয়ার অব সেন্ট্রাল ইন্ডিয়া, ইনক্লুডিং মালওয়া অ্যান্ড অ্যাজয়েনিং প্রভিন্সেস’। প্রকাশকাল ১৮২৪। মধ্যভারতের কথা। আজকের নয়, ব্রিটিশদের সময়কার বা তারও আগেকার। এই গ্বালিয়রের সিন্ধিয়াদের কথা উঠল বলেই আজ এটার কথা বলছি। হয়তো সমকালীন রাজনীতির ক্ষেত্রে এর কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই।
এই বইতে গ্বালিয়রের সিন্ধিয়া, ইন্দোরের হোলকার, দেবাসের পওয়ার, ভোপালের নবাবদের কথা রয়েছে। সালটা দেখেই বুঝছেন যে, মহাবিদ্রোহ তখনও প্রায় তিরিশ বছর দূরে। সিন্ধিয়ারা সেসময়ে অবশ্য কোম্পানি বাহাদুরকে সঙ্গ দিয়েছিল। একেবারে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস। সজীব বিবরণ দেওয়ার সময় স্যার ম্যালকম তো আর জানতেন না যে আগামীদিনের ভারতের রাজনীতিতে সিন্ধিয়ারা ঠিক কী ভূমিকা নিতে পারে।
এই বইতে বেশ কিছু অদ্ভুত জিনিস উদ্ঘাটিত হয়েছে। একটা বলি। সাতারার রাণোজি। এই রাণোজির থেকেই সিন্ধিয়া রাজঘরানার জন্ম। রাণোজি ছিলেন বালাজি এবং বাজিরাও পেশোয়ার বিশ্বস্ত অনুচর। নিজে রাজপুত ছিলেন না রাণোজি, কিন্তু ওঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন রাজপুত রমণী। তাঁরই গর্ভে তুকাজি। বাজিরাও একদিন সাহুরাজার সাথে কোথাও চলেছিলেন। হঠাৎই চোখে পড়ল রাণোজি খুব যত্ন করে সামলাচ্ছেন বাজিরাওয়ের পাদুকাজোড়া। স্বাভাবিক ভাবেই রাণোজির প্রভুভক্তিতে বাজিরাও প্রসন্ন হলেন। নিজের প্রভুদের প্রতি সিন্ধিয়াদের আনুগত্য ছিল রক্তেই। রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর একটা কবিতা আছে পানিপতের তৃতীয় যুদ্ধ নিয়ে — উইদ সিন্ধিয়া, টু ডেলহি। সেখানে তিনি মহাদজি সিন্ধিয়ার কথা বলেছেন।
উজ্জয়নী— একদা গ্বালিয়রের এস্টেটের হিসসা ছিল। সারা শহর জুড়ে সিন্ধিয়াদের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে। উজ্জয়নীর বিখ্যাত মহাকালেশ্বর মন্দিরের নির্মাতাও সিন্ধিয়ারাই। নগরীর একাধিক মহল্লায় সিন্ধিয়া রাজাদের নামের ছাপও রয়েছে জীবাজিগঞ্জ, মাধবগঞ্জ, দৌলতগঞ্জ। ছত্রিচৌকে সিন্ধিয়া মহারাজার মূর্তি। যুবরাজ লাইব্রেরির যুবরাজাটিও কিন্তু সিন্ধিয়াই ছিলেন। ক্ষীরসাগরের দ্বার সিন্ধিয়া রাজকুমারের জন্ম উপলক্ষ্যেই বানানো হয়েছিল। মহারাজবাড়ার মহারাজও সিন্ধিয়া। বলতে গেলে, সিন্ধিয়া রাজঘরানার চিহ্ন নিজের মুখে বুকে বহন করছে উজ্জয়নী। বিজয়ারাজের নামে বালিকা বিদ্যালয়। একটা সময় অবধি গোপাল মন্দিরের পূজা করার অধিকারও কেবল সিন্ধিয়াদেরই ছিল। বিশ-তিরিশ বছর আগে অবধি গ্বালিয়র রাজার নিজস্ব সীল, মোহর, বাটখারা দেখা যেত।
রাজনীতির ভালো লাগা বা না-লাগা বাদ দিলে কিন্তু বিজয়ারাজের সুপুত্র মাধবরাও সিন্ধিয়ার ইমেজ উজ্জয়নীতে দারুণ ছিল। মুগ্ধকর। তাঁর গাড়ির কর্ডন দেখা যেত। প্রজা না হয়েও প্রজা মনে মনে সম্মান করত না-রাজাকে। ওনার আকস্মিক মৃত্যুতে জনতা বিলাপ করেছিল হমারে মহারাজ চলে গয়ে। রাজমাতার নিধনেও শোকাকুল ছিল উজ্জয়নী। জ্যোতিরাদিত্য তখন সদ্য যুবক। ২০০১ সাল নাগাদ মধ্যপ্রদেশের স্থানীয় খবরের কাগজের শিরোনাম হিসেবে ছাপা হতো ‘কোন দলে যোগ দেবেন যুবরাজ?’
.
বলা হয়, সিন্ধিয়ারা শক্তির পাশাপাশি চলেন। ১৯৫৭ সাল। সিপাহি বিদ্রোহের বর্ষপূর্তীতে কংগ্রেসের টিকিটে লড়লেন বিজয়ারাজে। পরে জনসঙ্ঘে গেলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে এমারজেন্সি হল। মিসাবন্দিতে জয়পুর ঘরানার রাজমাতার সাথে তিহাড় জেলে আটক হলেন বিজয়ারাজে সিন্ধিয়া।
জীবনের শেষ পর্ব আসতে আসতে উনি ভারতীয় জনতা পার্টির শীর্ষ নেত্রীতে পরিণত হয়েছিলেন।
বিজয়ারাজে তো যে পথে যাওয়ার গেলেন, কিন্তু উলটো পথে চললেন মাধবরাও সিন্ধিয়া। অবশ্য শুরুটা অন্যভাবে করেছিলেন মহারাজ। প্রথম ভোট লড়েছিলেন জনসংঘের আসনে। চালে বদল করলেন ‘৮৪ সালে। কংগ্রেসের টিকিট। গ্বালিয়রের আসন। প্রতিপক্ষের নাম অটলবিহারী বাজপেয়ী। হারিয়েও দিলেন অটলজিকে। এটাই ছিল সিন্ধিয়াদের রাজনৈতিক চাল। জ্যোতিরাদিত্য কংগেসের হাত ধরলেন ২০০১ সালে। আর ছাড়লেন ২০২০ সালে এসে। ঊনিশ বছর। মোটামুটি একটি নবজাতক এই বয়েসে এসে ভোট দেওয়ার অধিকার পায়। কেউ কেউ মজা করে বলছেন, রাজনৈতিক প্রাপ্তবয়স্কতা লাভ করার পরে জ্যোতিরাদিত্য বিজেপিতে চলে এলেন। রাজনৈতিক পরম্পরা বজায় রাখলেন সিন্ধিয়াদের। ক্ষমতার কাছে থাকার। ক্ষমতা মাখার
যে যতই বলুন, এটা ভারতবর্ষ। এখানে চিরকালই মেধাকে নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে ক্ষমতা। যোগ্যতাকে হাতের পুতুল করে রেখেছে ক্ষমতাবানে। আর ক্ষমতাবানই রাজা। সিন্ধিয়া-রাজার গায়েও তো সেই রক্তই বইছে। আর রাজা অন্ন চান না। রূপোর টাকার লোভ তাঁর নেই। রাজার চাই মান। গুরুত্ব চাই। আগে এগুলোই তাঁরা জন্মসূত্রে পেতেন, গণতন্ত্রের কালে চেয়ে নিতে হচ্ছে, ছিনিয়ে আনতে হচ্ছে ভোট জয় করার মাধ্যমে। লড়াই করে আগেও জিতেছেন, এখনও জিতে নিতে হচ্ছে ইলেকশনে লড়ে। আগে যখন সিন্ধিয়ারা গ্বালিয়র থেকে উজ্জয়নীতে যেতেন, তখন নগরীর বাইরে শয়ন করার ব্যবস্থা করা হতো।
কারণ কী?
কারণ তাঁরা বলতেন, উজ্জয়নীর রাজা একজনই — ভগবান মহাকাল। আর একই নগরে দুজন রাজা থাকতে পারেন না।
আজ জ্যোতিরাদিত্য কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে চলে গেলেন। এখানেও কি তাহলে সেই একই থিওরি? একটু ফেরবদল করেই বলা চলে, ‘এক দলে দুজন যুবরাজ মেনে নিতে পারলেন না সিন্ধিয়াদের যুবরাজা?’
ভারতের ইতিহাসের রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ কাছ থেকে দেখতে চাইলে ম্বালিয়রের রাজমহলের ঝরোখা দিয়ে দেখতে হবে। এখানে শো-এর ফ্রন্ট সিট খুঁজুন। কারণ এক্ষেত্রে কাছ থেকে দেখলে ভালো করে দেখা যাবে।
শো শুরু হচ্ছে ১৮৫৭ সাল থেকে। ততদিনে এসে গেছে কোম্পানি বাহাদুর। দেওয়ানি তখন লালমুখোদের হাতে। তবে ফৌজদারী সংক্রান্ত অধিকার তারা ছেড়ে রেখেছিল বিভিন্ন রাজ্যের রাজাদের কাছেই। ১৮৫৮ সালে রদবদল ঘটে গেল। কোম্পানির হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হল ব্রিটিশ ক্রাউনে।
কারণ কী ছিল?
‘গদর’। না, এ কোনো প্রেমকথা নয়। সিপাহি বিদ্রোহ বা মহাবিদ্রোহের কথা বলছি। তাকেই তো ‘গদর’ বলে।
মহাবিদ্রোহে হিন্দু-মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিল। এটা যে কোনো সরকারের কাছেই সমস্যার বিষয়। এটাকে ভাঙার খুব দরকার ছিল। রাজা- নবাবদের হাতে ক্ষমতা রাখলে ডিভিসন করা সম্ভব নয়। তাই ব্রিটিশ সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করল।
কী করল তারা?
মুসলিম নবাবদের প্রতি কড়া এবং হিন্দু রাজাদের সাথে কোমল আচরণ করতে আরম্ভ করল ব্রিটিশরা। অভিভাবক যদি বৈষম্যমূলক আচরণ করে, তখন সন্তানদের মধ্যে রেষারেষি দেখা দেওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে চিড় দেখা দিল।
ইংরেজদের এই নরম-গরম নীতি প্রশাসকের পক্ষ থেকে একেবারে স্বাভাবিক প্রসেস ছিল। যে কোনো বুদ্ধিমান শাসকই এটা করবে। আর ওই সময়ে তো মোগল শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মুসলিম নবাব, মরাঠা খণ্ডহরে প্রতিপালিত হিন্দু রাজ্য নিয়েই দেশ চলছিল। ১৮৫৭ সালের গদরে মুসলিম রাজ্যগুলো থেকে আসা প্রতিস্পর্ধার মুখ এবং ওয়াহাবি আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া নায়কদের ক্ষমতা দেখে ভীত হচ্ছিল ব্রিটিশ প্রশাসন। এরা কিন্তু ইংরেজদের কথা সেভাবে মানছিল না। উলটো দিক থেকে সিন্ধিয়াদের মতো মরাঠাধীন রাজারা আবার লালমুখোদের সহায়ক রূপে দেখা দিচ্ছিল। সত্যি কথা লিখলে অনেকেই রে রে করে তেড়ে আসতে পারেন, কিন্তু স্বর্গত রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা এবং সম্মান জ্ঞাপন করেই বলা চলে যে, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পটভূমি কিন্তু ঝাঁসিতে ছিল না, ছিল বেগম হজরত মহলের লখনউতে। আজ নানা কারণে আমরা এটা ভুলে গেছি বা আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই আমরা জানিও না; কিন্তু ইংরেজরা এটা জানত এবং এখনও জানে।
মুসলিমদের হাত থেকে ক্ষমতা ক্রমশ পিছলে যাচ্ছিল। যারা একটু বুঝদার ছিলেন, তাঁরা সমাজ সংস্কার এবং শিক্ষার প্রসারের দিকে নজর দিলেন। নবাবি না-থাকলেও যদি নিজের পরিবার এবং নিজের কৌমের লোকেরা পড়াশোনা করে অফিসারও হতে পারে, সেক্ষেত্রেও লাভ। ক্ষুদ্র বা বৃহৎ স্বার্থ তখনও ছিল। সেগুলো নিয়ে বলাই বাহুল্য। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল লেখাপড়া করা। তাহলেই ক্ষমতার কাছে থাকা যাবে। প্রশাসনে দখল থাকবে। সত্তায় ভাগীদার হওয়া সম্ভবপর। আলিগড় কলেজের পত্তন হল। মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের জন্ম হল। নবাবরা কলেজের জন্য মুক্তহস্তে দান করলেন। ভবিষ্যৎ অন্য ইঙ্গিত দিতে চলেছিল। এখান থেকেই জন্ম নিতে চলেছিল মুসলিম লীগ।
ইংরেজ সরকারও কম বুদ্ধিমান ছিল না। রাজনৈতিক চালে তাদের মাত দেওয়ার মতো জাতি সম্ভবত সেই মুহূর্তের ইতিহাসে বিরল। সরকার বাহাদুর বুঝল একটা সেফটি ভাল্ভ দরকার। জনতার সমস্যা হতেই পারে, সেক্ষেত্রে আবেদন নিবেদন গোছের তরজায় কাজ মেটানো ভালো পথ, বিদ্ৰোহ না-হতে দেওয়ার সরকারের সাথে সরাসরি পাবলিক ডিলিং একটা ব্যাপার। তার জন্য তৈরি হল ‘কংগ্রেস’। সারা দেশের এন জি ও, উকিল গোছের লোকজনের জন্য বাৎসরিক মিলনসভা। প্রায় প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত এবং প্রগতিশীল বর্গের মানুষ। বেশ কিছুদিন এই পদ্ধতিটা সাফল্যের সঙ্গে চললও। চালচিত্র বদলে দিলেন বাল গঙ্গাধর তিলক।
কংগ্রেস ছিল একেবারে আলট্রা-মডার্নদের সংস্থা। অনুনয় বিনয় বা যে দাবি দাওয়াগুলো করা হতো, সেগুলো সবই হতো দেশীয় রাজা বা নবাবদের ট্যাক্স, আইনকানুন এসবের বিরুদ্ধে। কংগ্রেসের সভা মানেই সেখানে এসব কথা উঠত, আর উঠলেই রাজা-নবাবদের পকেটমারি হতো। বিষের মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছিল ব্যাপারটা। আর সব বিষেরই একটা অধিবিষ দরকার হয়। এক্ষেত্রে দরকার ছিল একটা জবরদস্ত জনসংগঠন। মুসলিম নবাবদের অ্যাক্টিভিটি বেশি ছিল। ইসলামকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবিদের গবেষণাগার থেকে অ্যান্টিডোট হিসেবে পাওয়া গেল মুসলিম লীগ।
হিন্দু রাজাদের চেতনা বরাবরই কম। সবকিছুতেই পিছিয়ে থাকে। দেরীতে হল বোধোদয়। এগিয়ে এলেন মদন মোহন মালব্য। রাজাদের থেকে দান চাইলেন। পেলেনও। আলিগড় কলেজের মতো একই পদ্ধতি অবলম্বন করে জন্ম নিল বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি। এই অনুদানকারীদের মধ্যে সিন্ধিয়া রাজারাও ছিলেন কিন্তু। মালব্য সকলকে সঙ্গে নিয়েছিলেন। ওঁর নেতৃত্বে হিন্দু-সেন্ট্রিক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠিত হল হিন্দু মহাসভা।
আমরা ইতিহাসের পাতায় পড়ার সময়ে পড়ি এত সালে এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, অত সালে অমুক বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু এর পিছনের রাজনীতি এবং উদ্দেশ্য কেউ কোথাও বলে না। বললে মানুষ বুঝে ফেলবে বলেই বলে না।
তিনটে বড় বড় টিম খেলছিল। শুধু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল দলগুলোর ক্যাপ্টেন। নববাদের টিম মুসলিম লীগ, ক্যাপ্টেন ছিলেন জিন্নাহ। এবং কমন ম্যানের টিম কংগ্রেসের দলপতি তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরত এক আইনজীবি, নাম তো শুনা হি হোগা— মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। হিন্দুদের টিমের ক্যাপটেনের কথায় পরে আসছি।
প্রথমবারের জন্যে ভোট শুরু হবে-হবে। তিনটে দলই ম্যাচ চালিয়ে যাচ্ছিল। আম্পায়ার ছিল ব্রিটিশরা। তারা কখনও একে সমর্থন করছিল তো কখনও ওকে। আসলে তাদের সমর্থনের উদ্দেশ্য ছিল একটাই-নিজেদের সমর্থন করা।
সবদিক দিয়ে বিচার করলে সবথেকে মজবুত দল ছিল কংগ্রেস। তাই এমনও হয়েছে যে রাজা আর নবাবদের দল একজোট হয়ে তার বিরোধ করেছে। সেটা আজকের এই হিন্দু-মুসলিম বিরোধের রাজনীতির দিনে দাঁড়িয়ে বললে বা শুনলে অবাক করার মতোই বিষয়। আপাতত আমরা হিন্দু টিমের ক্যাপ্টেনের কথা বলব।
এই ক্যাপ্টেনের ছবিই একটা সময়ে লালকৃষ্ণ আডবানি কিংবা অমিত শাহের অফিস ঘরের শোভা বর্ধন করবে। এই যুবককে নিয়েই অটলবিহারী বাজপেয়ী একদা বলবেন—
সাভারকর মানে তেজ
সাভারকর মানে ত্যাগ
আজ্ঞে হ্যাঁ, হিন্দু রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হিন্দু মহাসভার (গান্ধীকালীন) ক্যাপ্টেন শ্রী বিনায়ক দামোদর সাভারকর।
.
শ্রী সাভারকর তখন রত্নগিরিতে। এক কিশোরের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গেল। ছেলেটির বাবা পোস্টমাস্টার হিসেবে সদ্য বদলি হয়ে রত্নগিরিতে এসেছেন।
ছেলেটিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন— ‘কী নাম তোমার?’
‘নাথুরাম।’
‘নাথুরাম। তা এমন ধারা নাম কেন হে? নাথু?’
‘এই যে এখানে একটা নথ পরানো ছিল,’ বলে নিজের নাকের ডান পাটাটাকে ইঙ্গিত করে কিশোর। বাপ-মায়ের প্রথম তিন পুত্রসন্তান পর পর মারা যাওয়ার ফলে চতুর্থ পুত্রটির জন্মের পর বেশ কয়েক বছর ধরে তাঁরা তাকে মেয়ে হিসেবেই বড় করে তুলেছেন। নথ পরিয়েছেন নাকের পাটায় ফুটো করে। সেই নথ থেকেই নাম দিয়েছেন ‘নাথুরাম’।
‘ওহ… আর পদবী?’ আবার প্রশ্ন করলেন শ্রী সাভারকর।
‘গডসে।’
‘তাহলে তোমার নাম দাঁড়াল নাথুরাম গডসে। তাই তো?’
‘হুম।’
স্বল্পভাষী নাথুরামকে দেখে বেশ ভালোই লাগল শ্রী সাভারকরের। নাথুরাম গান্ধীবাদী। মাথায় একটা গান্ধী-টুপি পরে রয়েছে। কথায়-কথায় জানা গেল সত্যাগ্রহের সময় স্লোগানও দিয়েছে। শ্রী সাভারকর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিয়ে নাথুরামের দিকে তাকালেন। গান্ধীজির এই এক অমোঘ আকর্ষণ। ছেলে-বুড়ো সকলেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। কেউ বুঝে, আবার কেউ না-বুঝেই। বিনায়ক দামোদর সাভারকর আর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর লক্ষ্য একই, কিন্তু পথ আলাদা। এই মুহূর্তে শ্রী সাভারকরের সহযাত্রীর সংখ্যা গান্ধীজির হামসফরদের তুলনায় কমই। সংখ্যাটা বাড়াতে হবে। এবং শ্রী সাভারকর বিশ্বাস করেন যে এই ভারতেই এমন একটা সময় আসবে, যখন তাঁর অনুগামীদের সংখ্যা গান্ধীবাদীদের সংখ্যার থেকে অনেক-অনেক গুণ বেশি হয়ে দাঁড়াবে।
শ্রী সাভারকরের সান্নিধ্যে আসার পর থেকেই নাথুরামের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দিল। মতে। আস্থায়। বিচারে। বিশ্লেষণে। নাথুরাম আরএসএস-এর স্বয়ংসেবক হয়েছিলেন। হিন্দুধর্মের জাতি আর উপজাতির বেড়াজাল ভেঙে কাজ করাটাই ছিল আরএসএস-এর পন্থা। আর এটা দেখেই নাথুরাম প্রবলভাবে উদ্বুদ্ধ হন। এবং পরবর্তীকালে নাথুরামের কৃতকর্মের ফল তাঁর ও আরএসএস-এর যোগসূত্র ধরে গিয়ে পৌঁছায় আরএসএস-এর হেঁশেলে।
আগেই বলেছি যে, এই নাথুরামই গান্ধীজিকে হত্যা করে। গান্ধীবাদীরা হত্যাই বলছিলেন বা বলেন, আর কেউ কেউ বলে— বধ। ভারতীয় রাজনীতি যুগে-যুগে প্রচুর হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়েছে। কালে-কালে অজস্ৰ মহাত্মা, রাজনীতিকের রক্তে সিক্ত হয়েছে ভারতের মাটি। গুরু তেগ বাহাদুর থেকে শুরু করে রাজীব গান্ধী, তালিকাটা ইয়াব্বড়। দশজনকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো একজনও এই তালিকার মধ্যে থেকে কারো খুনির নাম বলতে না-পারলেও একজনেরটা বলতে পারবেন— গান্ধীজির খুনির নাম— নাথুরাম গডসে। এটাও এক ধরণের ন্যারেটিভ। মেমোরি গেমের মতো। সব মুছে দিয়ে তুমি যেটুকু মনে রাখলে আমার কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে, সেটুকুই মনে রাখো।
নাথুরাম গান্ধীজিকে হত্যা করল। কেন করল সেকথা আগেই বলেছি।
আদালত যখন কিছু প্রমাণ করতে না-পেরে শ্রী সাভারকরকে বেকসুর মুক্তি দিয়েছে, তখন আর বিভ্রান্তিমূলক কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত না-হওয়াই ভালো। কিন্তু সেইদিন থেকে আজ অবধি অনেক ভারতবাসীর মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে যে গান্ধীজি ভালো আর শ্রী সাভারকর খারাপ, গান্ধীজি সাদা হলে শ্রী সাভারকর হলেন কালো। ভারতের সংসদ ভবনে গান্ধীজি এবং শ্রী সাভারকর দুজনেরই ছবি টাঙানো রয়েছে। একটি ছবির বিপরীত দেওয়ালে অন্যটি। যেন অনন্তকাল পর্যন্ত বিপ্রতীপ হয়েই থেকে যাবেন একে অন্যের। মাঝে রয়ে যাবে একাধিক বুলেট, নাথুরাম গডসে আর গান্ধী-রক্তের দাগ
ওহ ভালো কথা, শ্রী সাভারকর, গডসে এবং গান্ধী-হত্যা নিয়ে সাংঘাতিক একটা থিওরি চলে। সিদ্ধান্ত নয়, মতবাদ, যার কোনও প্রামাণ্য নথি নেই। তবে তা যদি কোনও থ্রিলার লিখিয়ের হাতে পড়ে, তবে একটা ঢাউস বই নেমে যেতে পারে। আগেই শুনেছেন হয়তো, তবুও এত বকবক করছি যখন এটুকুও বলি।
তো যেটা বলছিলাম, নাথুরাম গডসে গান্ধীজিকে হত্যা করার পর বলেছিলেন যে যেহেতু গান্ধীজি পাকিস্তানকে ৫৫ কোটি টাকা দেওয়ার জেদ করছিলেন, তাই একজন দেশভক্ত হিন্দু হিসেবে আবেগতাড়িত হয়ে তিনি এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এই যুক্তি অত্যন্ত ফাঁপা ছিল। কারণটা আমি আগেই লিখেছি— তার আগেও গান্ধীজিকে হত্যা করার একাধিক অসফল প্রয়াস করা হয়েছিল। আর এখানে বিদেশি শক্তির হাতের কথাও উঠে আসে।
বিদেশি শক্তি?
হ্যাঁ সুধী পাঠক, বিদেশি শক্তি। যা পড়লেন তাতে ভ্রূ কোঁচকাবেন না। নাম উঠে আসে ইলুমিনাতির। একটা ভয়ঙ্কর কন্সপিরেসি থিওরি চলে। ইলুমিনাতি থিওরি। ড্যান ব্রাউনের লেখালিখির সূত্রে আজকাল সকলেই এই গুপ্ত সংস্থার নামের সঙ্গে পরিচিত।
কিন্তু গান্ধীজিকে হত্যা করার পেছনে ইলুমিনাতির ঠিক কী ভূমিকা থাকতে পারে? আদৌ এমন কিছু ছিল কি?
প্যালেস্টাইনের মাটি নিয়ে ইহুদি আর আরবদের মধ্যে যত গণ্ডগোল। একথা সবার জানা আছে। শ্রী নেহরু এবং গান্ধীজি দুজনেই কিন্তু প্যালেস্টাইনকে আরব দেশের অংশ বলে মানতেন। তাদের বক্তব্য ছিল, ইহুদিরা কী করে এভাবে একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি করতে পারে? গান্ধীজির মতে, যদি একজন ইহুদি ফ্রান্সে জন্মায় তবে সে হবে ফ্রান্সের নাগরিক, যদি তার জন্ম স্পেনে হয় তবে সে স্প্যানিশ হবে, ইংল্যান্ডে জন্ম নিলে সে হবে ইংরেজ, এভাবেই যে দেশে কোনও ইহুদির জন্ম হবে সেই দেশকেই সে নিজের দেশ বলে মেনে নিলে আর কোনও সমস্যাই থাকে না। নিজের ব্যক্তিগত ধার্মিক আস্থা কোনও ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়, তার ভিত্তিতে কেন কোনও রাষ্ট্রের গঠন করা হবে? অর্থাৎ, আমরা পাচ্ছি যে, ইসরায়েল যে ইস্যু নিয়ে আজ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, সেই ইস্যুটাকেই নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন গান্ধী-নেহরুরা। তাঁরা ইসরায়েলকে পৃথক দেশ হিসেবে মান্যতা বা স্বীকৃতি দেননি। গান্ধীজির হত্যার পরে ১৯৪৮ সালের মে মাসে ইসরায়েল এই বিশ্বের মানচিত্রে একটি পৃথক দেশ রূপে স্থান পায়। অরিজিন দেখলে বোঝা যায় ইলুমিনাতির সঙ্গে ইহুদি জাতি তথা ইসরায়েল রাষ্ট্রের একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
কন্সপিরেসি থিয়োরিস্টরা বলে, গান্ধী-হত্যার পরেও কিন্তু গান্ধীজির হত্যাকারীরা গান্ধীজির পিছু ছাড়েনি। তারা এখনও তাঁর চরিত্রহননের চেষ্টা করে চলেছে। গুগলে যদি আপনি ‘ওয়াজ গান্ধী আ গে’ লিখে সার্চ করেন, তাহলে হাজার একটা প্রোপাগাণ্ডামূলক লেখা পেয়ে যাবেন।
বলা হয় যে এই কারণেই বিশ্ববাসীর কাছে অহিংসার পূজারী রূপে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও গান্ধীজি শান্তিতে নোবেল পাননি। কিন্তু নোবেল আর ওপরের থিওরির মধ্যে কী সম্পর্ক?
নোবেল পুরষ্কার প্রদানকারী সংস্থা রথসচাইল্ড-দের। রথসচাইল্ডরা ইহুদি।
সবই বোঝা গেল, এবার হত্যার দিকে আলো ফেলা যাক। গডসে, আপটে কিংবা শ্রী সাভারকরের মধ্যে একটা বিশেষ যোগসূত্র আছে। সেটা কী? এঁরা সকলেই ‘চিতপাবন’ বংশীয় ব্রাহ্মণ। চিতপাবন শব্দটাকে একটু ভালো করে অনুধাবন করলেই বোঝা যায় এর মানে— ‘চিত্ত যাদের পবিত্র’। ১৬১৪-১৮১৮ সাল পর্যন্ত ভারতের মরাঠা সাম্রাজ্যের ভিত ছিলেন এই চিতপাবনরাই। মরাঠা পেশোয়ারা চিতপাবন ছিলেন। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা রূপে তাঁদের ক্ষমতা, বিচার, বিশ্লেষণ ইত্যাদি ছিল অপরিসীম। এখনও তা-ই। চিতপাবনরা সামাজিক ভাবে উচ্চ বিভিন্ন পদে আসীন, স্ব-স্ব ক্ষেত্রে শীর্ষ স্থান দখল করেছেন। গোভিত্রিকর, আগারকর, শ্রী সাভারকর, হেডগেওয়াড়, গোলওয়ালকর, ভাগবত, রাণাড়ে, মঞ্জরেকর, মঙ্গেশকর, গাভাস্কর, তেণ্ডুলকর, গোখলে, তিলক ইত্যাদি পদবী শুনলেই হয়তো পাঠকদের এমন কারো-না-কারো নাম মনে পড়বে, যারা বেশ সফল ব্যক্তিত্ব। এই পদবীগুলির প্রতিটাই চিতপাবন বংশীয় ব্রাহ্মনদের। যাই হোক, চিতপাবনরা ইতিহাসের সুদূর কোনা থেকেই অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে এসেছেন। এতটাই এঁদের ক্ষমতা যে একদা বীর শিবাজীকে (তখনো রাজা হননি) ছত্রপতি হওয়ার জন্য এঁদের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। চিতপাবনদের কিছু অদ্ভুত শারীরিক বৈশিষ্ট্য আছে, যেমন বেশিরভাগই ফরসার দিকে, এবং চোখের মণির রঙ আম ভারতীয় উপমহাদ্বীপের বাসিন্দাদের থেকে একটু আলাদা। এঁদের নিয়ে নানা গল্প চলে। কোনওটা পুরাণের, কোনওটা পুরাণেতিহাসের, আবার কোনওটা ইতিহাসের। চিতপাবনরা নাকি ভগবান পরশুরামের বংশধর। পরশুরাম ছিলেন জামদগ্নী এবং রেণুকার পুত্র। রেণুকা নিজে ছিলেন ক্ষত্রিয়-কন্যা। পরশুরাম ভগবান শিবের কাছ থেকে পরশু বা কুঠার লাভ করেন বলেই পরশুরাম নামে পরিচিত হন। নাহলে তিনিও কেবল রাম রূপেই সম্বোধিত হতেন। মাতার রক্তধারা পেয়েই হোক বা নিজের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টার গুণে পরশুরাম মহাযোদ্ধা হয়েছিলেন। পরশুরাম ধরাকে ২১ বার ক্ষত্রিয়মুক্ত করার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন। এখনকার দিনে হলে এধরণের ঘটনাকে নরসংহার বা জেনোসাইড বা এথনিক ক্লিনজিং-এর পর্যায়ে ফেলে দেওয়া হতো। তা এই মহাকার্যটিকে সম্পন্ন করার পরে প্রায়শ্চিত্তের জন্য তিনি একটি সুবিশাল যজ্ঞের আয়োজন করেন। ঋষি কাশ্যপকে সমস্ত ভূমি দান করে দেন। নিজে চলে যান দাক্ষিণাত্যে, মহেন্দ্র পর্বতে। সেখান দীর্ঘকাল ধরে তপস্যা করেন। তাঁর তপে সন্তুষ্ট হয়ে বরুণদেব তাঁকে সাগরের বুকে নতুন ভূমি প্রদান করেন। কিন্তু হলে কী হবে, সাগরদেবতা আবার কিছুতেই সেই ভূমি থেকে নিজের আধিপত্য ছাড়তে চাইছিলেন না। ক্ষত্রিয়-বিনাশক পরশুরাম তখন ক্ষেপে আগুন। তিনি নিজের ধনুর্বাণ নিয়ে তির নিক্ষেপ করে বসলেন। সাগরদেবতা নিজের ভুল বুঝেছেন ততক্ষণে। তিনি হাতজোড় করে অনুরোধ করলেন, হে পরশুরাম, আপনি নিজের বাণ ফিরিয়ে নিন। কিন্তু চলা পা, বলা মুখ, আর ছোঁড়া তিরের গতি কে, কবে রুদ্ধ করতে পেরেছে? পরশুরামের ছোঁড়া তিরকে ভয় পেয়ে সাগরদেবতা দ্রুত পিছু হটতে লাগলেন। সাগরের বুকে যে বিন্দুতে গিয়ে পরশুরামের তির নিক্ষিপ্ত হল, সেই পর্যন্ত ভূমি এল তাঁর দখলে। পরশুরাম নিজের পরশুটিকেও নিক্ষেপ করেছিলেন। যেখানে তাঁর কুঠার গিয়ে পড়েছিল, সেই স্থানটিকে তিনি নিজের বাসস্থান রূপে বেছে নেন। কোণ-এর কণা (ভূমি) থেকে কোঙ্কণ এসেছে। চিতপাবনদের ১৪টি গোত্র। কথিত আছে, পরশুরাম এই যজ্ঞ করার সময়ে সমুদ্রে ১৪ জন মানুষের মৃতদেহ ভাসতে দেখেছিলেন। তিনি চিতার আগুনে সেই মৃতদেহগুলিকে শুইয়ে নিজ মন্ত্রবলে তাদের পুনর্জীবন দেন। সেই ১৪ জন থেকেই আসে চিতপাবনরা। ১৪ গোত্রের চিতপাবনরা। চিতপাবনরা চিতার আগুনে পবিত্র হয়েছিলেন বলেই এমন নামকরণ একথাও প্রচলিত আছে। পরশুরাম তাঁদের জীবনদান করায় তিনিই তাঁদের জনক। পরবর্তীকালে কোঙ্কণেই চিতপাবনরা বাস করতে থাকেন। তাঁরা নিজেদের গ্রাম-নামের মাধ্যমে নিজেদের পদবী স্থির করতেন।
এই অবধি গল্পটা পুরাণের ছিল। এবার আমরা ঢুকব পুরাণেতিহাসের দিকে। আশা করি, এত বকবকানির পরেও আপনাদের আগ্রহটা বজায় রাখবেন।
১৪টি মরদেহ। সেই ১৪ জনকে চিতার আগুনের স্পর্শে জীবন ফিরিয়ে দিলেন ভগবান পরশুরাম। এ হল মিথ। শুনলে বা পড়লে মিথ্যে মনে হয়। কিন্তু যদি একটু অন্যরকম ভাবে এর ব্যাখ্যা করা যায়। হতেই তো পারে কোনও এক সুদূর দেশ থেকে বানিজ্যতরী নিয়ে ভেসে আসছিল একদল বণিক। পথে জাহাজডুবি হয়ে যায়। হয়তো অনেক লোকের মধ্যে ১৪জন মানুষ ভেসে আসে কোঙ্কণ উপকূলে। তারা জল খেয়ে আধমরা হয়ে গেলে মারা যাননি। কোনও এক মহাপ্রতাপী অথচ সদাশয় ব্রাহ্মণ সেই ১৪ জনকে মৃত ভেবে সৎকার করার জন্য চিতায় তোলেন। আগুনের তাপ লাগতেই নড়েচড়ে ওঠে সেই ১৪ জন মানুষ। তখন ব্রাহ্মণ বুঝতে পারেন যে তারা বেঁচে আছে। তাদের শুশ্রূষা করা হয়। তারা বলে, আমরা বেনে। ব্রাহ্মণ নিজের বাসভূমিতেই সেই ১৪ জন বণিককে চিরস্থায়ী ভাবে থাকার বন্দোবস্ত করে দেন।
কী, হতেই তো পারে? তাই না?
বলা হয়, ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। ইহুদিদের একটি শাখা বেনে-ইসরায়েল (দয়া করে রাষ্ট্র ইসরায়েলের কথা ভাববেন না। সেটার গঠন বহু শতাব্দী পরের ঘটনা) –এর ১৪ জন মানুষ থেকেই জন্ম নিয়েছিল চিতপাবন ব্রাহ্মণরা। আর সেই চিতপাবনরাই পরবর্তী কালে মরাঠা সাম্রাজ্যের শাসনে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই চিতপাবনদেরই সন্তান ছিলেন নাথুরাম গডসের মতো মহাবিতর্কিত চরিত্র। নারায়ণ আপটেও চিতপাবন ছিলেন। ভারতের মহা-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির রিমোট কন্ট্রোল নাকি আজও চিতপাবন বংশীয় ব্রাহ্মণদের হাতেই রয়েছে।
আর এখান থেকেই শুরু হচ্ছে কন্সপিরেসি থিওরি। ইহুদিরা অন্যান্য ভারতীয়দের তুলনায় চিতপাবনদের অনেকটা নিকটস্থ ভাবে। যদি সত্যি সত্যিই বেনে ইসরায়েলদের রক্ত চিতপাবনদের গায়ে বয়, তাহলে ইহুদিরা নিজেদের রক্তকে অগ্রাধিকার দেবেই বইকি। কন্সপিরেসির থিওরিস্টরা বলেন, ইহুদিদের না-পসন্দ করায় তাদের গুপ্ত সংগঠন ইলুমিনাতি গান্ধীজিকে সরিয়ে দিয়েছিল। ইলুমিনাতির মতো শক্তিশালী সংগঠন নাকি আজও ভারতের রাজনীতিতে নিজেদের ক্ষমতা বহাল রেখেছে। এর সত্যমিথ্যা যাচাই করার সাধ থাকলেও সাধ্য সম্ভবত কারো নেই। শুধু বহমান ধারাপ্রবাহে ভেসে যাওয়াই শ্রেয়।
গান্ধীজির হত্যার ঘটনায় আরেক মরাঠা-যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছিল। গান্ধীজিকে একটি ইতালিয়ান পিস্তল দিয়ে হত্যা করা হয়। বেরেট্টা-এম ১৯৩৪, সেমি অটোম্যাটিক, পয়েন্ট ৩৮০ এ সি পি ক্যালিবার। সিরিয়াল নাম্বার ছিল ৬০৬৮২৪। গুলি চালিয়েছিলেন গডসে। এই হত্যাকাণ্ডের আগে গডসে খালিয়রে যান। সেখানে তাঁকে পিস্তল জোগান গঙ্গাধর দণ্ডবতে। দণ্ডবতেকে পিস্তলটা দিয়েছিলেন জগদীশ প্রসাদ গোয়েল। গোয়েল বন্দুক বিক্রেতা ছিলেন। এই বন্দুক তিনি কোথা থেকে পেলেন? এটা নাকি মুসোলিনির বাহিনীর বন্দুক ছিল। সেখান থেকে অ্যাবসিনিয়া হয়ে হাতফেরি হয়ে আসে গ্বালিয়র ইনফ্যান্ট্রিতে। ইয়েস, ম্বালিয়র ইনফ্যান্ট্রি। মানে, গ্বালিয়রের সিন্ধিয়াদের প্রিন্সলি স্টেটের মালখানার জিনিস। গান্ধীহত্যার পর্ব নিয়ে আমরা এখানেই থামব। এত দূরের ইতিহাসে চারণ করতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা প্রবল। আসুন, আমরা এবারে অনতি-অতীতে ফিরি। অবশ্য স্থান পরিবর্তন করব না। থাকব সেই গ্বালিয়রেই।
ইংরেজরা চলে গেল। গান্ধীজি চলে গেলেন। রাশ পণ্ডিত নেহরুজির হাতে। গ্বালিয়রের গুণা নামক স্থানে কংগ্রেস তখন জাঁকিয়ে বসতে চাইছে। গুণা জয় করতে হলে সিন্ধিয়াদের আশীর্বাদ চাই। কিন্তু মহাত্মার হত্যা নিয়ে হিন্দু মহাসভার নাম জড়িয়েছে, মরাঠা-কানেকশনের কথাও তো বললাম। সিন্ধিয়ারা হিন্দু মহাসভার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সব মিলিয়ে সিন্ধিয়ারা কংগ্রেসের বিপক্ষেই থাকছিলেন সেই সময়। তবুও পণ্ডিত নেহরুজি বার্তা দিলেন মহারাজাকে। মহারাজা মানে জীবাজিরাও সিন্ধিয়া। তিনি বললেন, রাজনীতিতে আমার কোনও রুচি নেই। আমি তাই কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছি না। ক্ষমা করুন। জীবাজিরাওয়ের রাজনীতির চাল ভালোই ছিল। কিন্তু নেহরুজি তার থেকেও ভালো চাল চাললেন। মহারাজা আসছেন না তো কী হয়েছে, মহারানি তো আছেন? রাজমাতা বিজয়ারাজে সিন্ধিয়া।
১৯৫৬ সালে মহারাজা তখন বোম্বেতে গিয়েছেন। রাজমাতা দিল্লি গেলেন। পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। কথা কী হয়েছিল তা বাইরে আসেনি। তবে শোনা যায় দুই হেভিওয়েট নেতাকে দিয়ে মহারানিকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। গোবিন্দবল্লভ পন্থ আর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ছিলেন সেই দুই নেতা।
‘মহারাজা ভোটে না দাঁড়ালে আপনিই দাঁড়াতে পারেন?’
‘আমি?’
‘হ্যাঁ, আপনি।’
‘কিন্তু মহারাজের যেখানে সম্মতি নেই, সেখানে আমি গ্বালিয়র থেকে কীভাবে দাঁড়াব?’
‘গ্বালিয়র কেন? গুণা থেকে দাঁড়ান।’
‘গুণা! বেশ।’
এরপর রাজনীতি অন্য খাতে বইল। রাজমাতা কংগ্রেসের হয়ে ভোটে লড়লেন। এলাকায় তখন কংগ্রেসি হাওয়া বইল। বইবে না-ই বা কেন? এটা যে সময়ের কথা, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি রাজমাতা বিজয়ারাজে কাউকে একটা চিরকুটেও নিজের আশীর্বাদ দিয়ে দেন সে ভোটে দাঁড়ালেও জিতে যাবে। আর সেখানেই তিনি নিজে ইলেকশন লড়ছেন, এ সামান্য ভূমিকম্প নয়, সুনামির সমান। ১৯৫৭ সালে গুণা থেকে জিতলেন। ১৯৬২ সালে জিতলেন গ্বালিয়র থেকে। দুবারই লোকসভার সাংসদ। মহারাজের মৃত্যু হয় ১৯৬১ সালে।
তখন মধ্যপ্রদেশের রাজনীতিতে কংগ্রেসের ধ্রুবতারা ছিলেন ডি পি মিশ্র। পুরো নাম দ্বারিকা প্রসাদ মিশ্র। ভদ্রলোক রাজবংশের লোকেদের একদমই সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্বে থাকাকালীন ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে মধ্যপ্রদেশের (তখনকার) জগদলপুরে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে গেল। ভীষণ রক্তপাত ঘটল। বাস্তারের মহারাজা প্রবীর চন্দ্র ভঞ্জ দেবকে তাঁর ১১ জন সহযোগী সমেত গুলি করে মারল রাজ্যের পুলিশ। রাজবাড়িতেই ঘটল এই মর্মান্তিক ঘটনা। পুলিশের বক্তব্য ছিল, মহারাজা আদিবাসীদের বিদ্রোহ করার জন্য উসকানি দিচ্ছিলেন। অবশ্য পুলিশের আরোপ মিথ্যা ছিল না, তাই বলে কোনও প্রকার রক্তপাতকেও সমর্থন করা চলে না।
ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে খালিয়রে একটি ছাত্র আন্দোলন আরম্ভ হয়। পুলিশ দুই ছাত্রকে গুলি মারে। তাদের মৃত্যু ঘটে। ব্যাপারটা রাজমাতার আত্মসম্মানে আঘাত করে। যে গ্বালিয়রে তাঁর মর্জি না-হলে গাছের পাতাটিও নড়ে না, সেখানে পুলিশের গুলিতে লোক মরছে? তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন- ‘কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যাব।
একটি তুলনামূলক ক্ষুদ্র ঘটনা। সেটাই হয়ে গেল এই দেশের কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতির সবথেকে বড় টার্নিং পয়েন্ট। এই বিন্দুটাই পরে জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলনকে হাওয়া দেবে। এই বিন্দুটাই গড়ে তুলবে জনতা পার্টি। এই বিন্দু থেকেই জন্ম নেবে সেই ফুলের দল। গ্বালিয়রের এই গুলি চালনার ঘটনাখানা হিন্দুত্ব ব্রিগেডকে তাদের দুই দশক ব্যাপী অন্বেষণের ফলাফল এনে দিল। রাজমাতা যদি জনসঙ্ঘে যোগ দেন তাহলে সমীকরণ বদলে যাবে— এই কথা মাথায় রেখে সঙ্ঘের প্রচারক কুশাভাউ ঠাকরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। কথা হল। রাজমাতা কথাও দিলেন— আমি আপনাদের সঙ্গে আছি। ১৯৬৭ সালে করেরা বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে জনসঙ্ঘের টিকিটে দাঁড়ালেন বিজয়ারাজে সিন্ধিয়া। জয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। রাজমাতা নিজের কূটনীতির গুণে কংগ্রেসের বিধায়কদের ভাঙিয়ে আনলেন। রেওয়ার রাজবংশের গোবিন্দ নারায়ণ সিং রাজমাতার তথা জনসঙ্ঘের দিকে আসায় মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের রাজ্যসরকারের পতন ঘটল। আজকাল এই যে দেখেন বাগী বিধায়ক বা সাংসদদের নিয়ে গিয়ে কোনও পার্টি রিসর্টে-হোটেলে তুলছে, এর প্রাথমিক সংস্করণ কিন্তু মধ্যপ্রদেশের মাটিতেই শুরু হয়েছিল। সেবারে রাজমাতা ভাঙিয়ে আনা বিধায়কদের গ্বালিয়রের রাজমহলে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলেন। যাক, জনসঙ্ঘ সরকার গঠন করল। ক্ষমতার স্বাদ পেতে শুরু করল।
১৯৭১ সালে রাজমাতা জনসঙ্ঘের টিকিটে গুণা থেকে জিতলেন। তখন মাধবরাও-এর বয়েস মাত্র ২৬ বছর। তিনি মায়ের মতোই জনসঙ্ঘের ছায়াতলে ভিও থেকে জিতলেন। গ্বালিয়রের সিটে সেবারে জনসঙ্ঘ থেকে দাঁড়িয়েছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। এখানে একটা সুতো বের করে যাই, পরে সুযোগ পেলে সেটায় ফিরব। এই যে ডি পি মিশ্রর কথা পড়লেন, কয়েক বছর পরে এঁর ছেলের সঙ্গে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সাক্ষাৎ হবে ইউনাইটেড নেশনস-এ গিয়ে। ডি পি মিশ্রর মতো কট্টর কংগ্রেসীর সন্তান ভারতীয় জনতা পার্টির চূড়ান্ত বিশ্বস্ত ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। দেশের সিকিউরিটি অ্যাডভাইজারের পদও আলোকিত করবেন। ফিরব তাঁকে নিয়েও। অন্যত্র।
জনসঙ্ঘ ফুলকির খেলা দেখাতে শুরু করে দিয়েছিল, এবার দরকার ছিল দাবানলের। মুখ চাই এমন এক নেতার, যার কপালে কোনও কলঙ্ক লাগেনি। যেমন? যেমন ধরুন, জয়প্রকাশ নারায়ণ। নারায়ণের নেতৃত্বে আন্দোলনের গল্প আগুপিছু করে তো লিখছিই। আপনারা এই যে দয়া করে মনোনিবেশ করলেন সিন্ধিয়াদের পর্বটায়, তাতে আজকের ভাগোয়া রাজত্বের শেকড়টা স্পষ্ট হল, আশা করি।
তো যেখান থেকে সিন্ধিয়াদের গল্পটা শুরু হয়েছিল, সেখানে ফিরে যাই। ইন্দিরা গান্ধীর ঘর ভাঙা নিয়ে…
কে ভাঙছিলেন?
রাজমাতা বিজয়ারাজে সিন্ধিয়া।
কাকে দিয়ে ভাঙছিলেন?
রাজকুমারী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া।
টার্গেট কে ছিলেন?
মানেকা গান্ধী।
কিন্তু রাজমাতা একটা জিনিস বুঝতে ভুল করেছিলেন। কোলাকুলিটা সেয়ানে-সেয়ানে চলছিল। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে— জিন কে খুদ কে ঘর শিশে কে হোতে হ্যাঁয়, উয়ো দুসরোঁ কে ঘরোঁ মে পথথর নহিঁ ফেঁকতে।
বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া আর মানেকা গান্ধীর বন্ধুত্বের কথা আগেই বলেছি। দুজনের মধ্যে মাত্র ৩ বছরের ফারাক। বসুন্ধরা বড়। বেশ অল্পবয়েসেই বসুন্ধরার বিয়ে হয় আগ্রা থেকে কিছুটা দূরের ঢোলপুর রিয়াসতের শেষ রাজা হেমন্ত সিং-এর সঙ্গে। সন্তান দুষ্যন্তের জন্মের পর বিয়ের মাত্র দুবছরের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটে। বসুন্ধরা আর মানেকার জীবনে এখানেই একটা মিল ছিল। একজন স্বামীর সংসার থেকে সরে এসে একাকী, অপরজন কিছুদিন আগেই স্বামীকে হারিয়েছিলেন। সেইসময়ে রাজনীতির আঙিনায় মহিলাদের সংখ্যা কমই ছিল। বিপক্ষ শিবিরের হলেও দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে গেল।
১৩ই মার্চ, ১৯৮১। তৎকালীন গান্ধী-পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যটি ওইদিন একবছরে পা রাখছিল। কনিষ্ঠতম সদস্য বলতে আমরা ফিরোজ বরুণ গান্ধীর কথা পড়ছি। বরুণের জন্মদিন উপলক্ষ্যে বসুন্ধরা নিজের মেহরৌলির বাসভবনে একটা পার্টি দিয়েছিলেন। তখনও সঞ্জয়ের মৃত্যুর একবছর পূর্ণ হয়নি, তাই শ্রীমতি গান্ধীর বাসভবনে কোনও ধরণের আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এমন এক অপ্রীতিকর সময়কালে মানেকা গান্ধী অন্যত্র গিয়ে পার্টি করবেন এটা শ্রীমতি গান্ধী ঠিক মেনেও নিতে পারছিলেন না। স্থান আর পাত্রের চয়নটাও তাঁকে স্তম্ভিত করছিল। তাঁর বিপক্ষ রাজমাতা বিজয়ারাজের মেয়ের বাড়িতে? তবে এটাও একটা ব্যাপার যে তিনি কিন্তু বসুন্ধরার সঙ্গে মানেকার বন্ধুত্বের দিকটা আগে থেকেই জানতেন; বসুন্ধরা নিয়মিত প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনেও যাতায়াত করতেন।
এবং ঠিক এই সময়েই একটি চরিত্রের উত্থান ঘটছিল ভারতীয় রাজনীতির বৃত্তে। অদ্ভুত। অপ্রতিম। তাঁর নাম? আরে ভাই, আসছি-আসছি। আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা সেরে নিই। ভারতে একাধিক প্রধানমন্ত্রীদেরই একজন করে আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন। তাঁরা আধ্যাত্মিকতার চর্চা করতে-করতে কখন যে দেশের রাজনীতির পলিসিমেকার হয়ে উঠেছেন, তা বোঝা যায়নি। যেমন নরসিমহা রাওয়ের সময়ে কিংবা চন্দ্রশেখরের সময়ে চন্দ্রস্বামী কিংবা ইন্দিরা গান্ধীর আমলে …আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, আমাদের গল্পে এবার ঢুকে পড়বেন গান্ধী-পরিবারের রাসপুতিন শ্রী ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী। এখন অনেকেই ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর সঙ্গে বাবা রামদেবের তুলনা করেন, কিন্তু এখানে একটা টেকনিক্যাল পার্থক্য আছে। ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী ছিলেন আধ্যাত্মিক গুরু তথা যোগগুরু, আর বাবা রামদেব শুধুই যোগগুরু। পার্থক্য বিস্তর। সেসব বিশারদরা ভালো করে বোঝাতে পারবেন। আমরা ব্রহ্মচারীর দিকে মনোযোগ দিই। ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর উত্থান সেইসময়ে দেশের সবথেকে বড় যোগগুরু রূপে হয়েছিল। তাঁর লাইফস্টাইল ছিল তৎকালীন ভারতের তাবড় তাবড় সেলিব্রিটিদেরও মাত দিয়ে দেওয়ার মতো। ফ্লাইটে যাতায়াত করার মতো যাত্রী যখন হাতেগোনা, তখনকার দিনে দাঁড়িয়ে ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী নিজস্ব লাক্সারি জেট ব্যবহার করতেন। মিডিয়া ব্রহ্মচারীকে বলত ‘ফ্লাইং যোগী’। জম্মুতে তাঁর আশ্রম ছিল— অপর্ণা যোগ আশ্রম। সেখানে ছিল প্রাইভেট এয়ারস্ট্রিপ, নিজস্ব হেলিপ্যাড। গুরুগ্রামেও একটা আশ্রম ছিল। এখনো সেখানকার হ্যাঙ্গারে গুরুবরের লাক্সারি জেটখানা পড়ে রয়েছে।
ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী জম্মুর গান্ধীনগরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে ‘শিব গান ফ্যাক্টরি’ নামক একটি ফ্যাক্টরি চালাতেন। ব্রহ্মচারী যত বড় যোগগুরু ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বড় বিজনেসম্যান হয়ে উঠেছিলেন। সেইসময়কার ভারতের সবথেকে বড় আর্মস ডিলার ছিলেন ব্রহ্মচারী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বেশিরভাগ সওদা তাঁর মধ্যস্থতাতেই হতো। দেশে তো বটেই দেশের বাইরেও তাঁর রোয়াব ছিল অদম্য। সুইডেনের বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল ব্রহ্মচারীর।
ভদ্রলোকের উত্থানটাও বেশ অদ্ভুত। জন্মনাম ছিল ধীরেন্দ্র চৌধুরী। বিহারের মধুবনীর বস্তিগাঁওতে জন্ম। ভগবৎ গীতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মাত্র ১৩ বছর বয়েসে বাড়িঘর ত্যাগ করে চলে যান বারাণসী। গুরু বানালেন মহাঋষি কার্তিকেয়-কে। গোপাল খেড়ায় তাঁর আশ্রম ছিল। লখনউ থেকে ১২ কিমি দূরে, সেখানেই জন্ম হল ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর। এই ব্রহ্মচারীই যে পরবর্তীকালে ভারতের ক্যাবিনেটের রিমোট কন্ট্রোল হাতে রাখবেন সেই খবর কি আর তখন কেউ জানত?
১৯৬০ সালের পর সোভিয়েত রাশিয়া যখন মহাকাশে যাত্রী পাঠানোর জন্যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তখন তাদের দরকার পড়ল একজন যোগীর। যে সে যোগী হলে চলবে না, হঠযোগী চাই। ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীই গেলেন রাশিয়ানদের প্রশিক্ষণ দিতে। প্রসিদ্ধি বাড়ল। এদিকে ইন্দিরার জন্যে একজন ভালো যোগ প্ৰশিক্ষক খুঁজছিলেন পণ্ডিতজি। মেয়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে না, যোগ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাকে সুস্থ রাখোতে হবে। অবশেষে নেহরুজির ডাকে ইন্দিরার যোগপ্রশিক্ষক হলেন ব্রহ্মচারী। আর এখান থেকেই সূত্রপাত হল ব্রহ্মচারীর ক্ষমতাধারণের।
দিল্লির কেন্দ্রস্থলে তাঁর বিশ্বায়তন যোগাশ্রম ছিল। এখন অবশ্য সেটাই হয়ে গেছে মোরারজি দেশাই যোগ সংস্থান। জম্মুর আশ্রমের কথা আগেই বলেছি, তাছাড়াও কাটরায় আশ্রম ছিল, মানতলাই-তে ছিল। মানতলাইয়ের আশ্রমেও হ্যাঙ্গার ছিল প্লেন রাখার। আর ছিল চিড়িয়াখানা
ধীরেন্দ্রর অনেক উপমা ছিল। কেউ বলত, তিনি ভারতের সবথেকে সুদর্শন (এবং সেক্সি) যোগগুরু। কেউ বলত, তিনি ভারতের রাসপুতিন। বিখ্যাত লেখক খুসবন্ত সিং ধীরেন্দ্রকে নিয়ে একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একটা কথা লিখেছিলেন- ‘ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী একজন সুন্দর, দীর্ঘদেহী বিহারী ছিলেন, যিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার কক্ষে একঘণ্টা করে সময় কাটাতেন…’। যোগাভ্যাস করাতেন ধীরেন্দ্র। বাকী ইশারা-ইঙ্গিতের কথা পাঠকরা নিজ-নিজ বুদ্ধি অনুসারে ঠিক করে নিতে পারেন। তবে একথা সর্বৈব সত্য যে নিজের পিতার মৃত্যুর পর ইন্দিরা নিজের যোগগুরুর ওপরে প্রবল ভরসা করতে শুরু করেছিলেন। যে প্লেনটি দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয়ে সঞ্জয়ের মৃত্যু হয়েছিল, সেটাও কিন্তু ধীরেন্দ্রই আনিয়ে দিয়েছিলেন।
ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীকে বেশিরভাগ সময়েই ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে দেখা যেত। তাঁর ক্ষমতার একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। একবার আবাস মন্ত্রী শ্রী ইন্দোর কুমার গুজরাল ধীরেন্দ্রর আশ্রমকে বেশি জমি দেওয়ার ব্যাপারে ‘না’ বলে দেন। ইন্দর কুমার গুজরালকে ধীরেন্দ্র বলেছিলেন, ‘কল হি আপ মন্ত্রী পদ সে হটা দিয়ে জায়েঙ্গে।’ সত্যিই শ্রী গুজরালের বিভাগ বদলে যায়।
ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীকে এত কথা বলার কারণ হল মানেকা গান্ধীর গতিবিধির ওপরে দুজনের নজর ছিল। একজন ছিলেন ধীরেন্দ্র। আর অন্যজন? তিনি হলেন আর কে ধাওয়ান। সঞ্জয়ের মৃত্যুর আগের ঘটনার কথা বলতে গিয়ে ধাওয়ানের প্রসঙ্গ এসেছে। ধাওয়ান আবার রাজিব গান্ধীর স্কুলবেলার বন্ধু। মানেকারও কিন্তু বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী নিতান্ত কম ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন আকবর ডাম্পি আহমেদ। এই ডাম্পি আবার সঞ্জয়ের স্কুলবেলার বন্ধু। বেশ ধনী মানুষ। একবার তো খবর রটে গিয়েছিল যে আকবর ডাম্পি আহমেদ বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়াকে বিয়ে করতে চলেছেন। আকবর ডাম্পি আহমেদকে যদি মনে না করতে পারেন তাহলে একটা ছোট্ট সূত্র দিই— এই যে ভারতে করোনা আসার গোড়ার দিকে বিখ্যাত গায়িকা কণিকা কপূর খবরের শিরোনামে এসেছিলেন, বলা হয়েছিল যে তিনি করোনা ইনফেক্টেড অবস্থায় একটি পার্টিতে গান গিয়াতে গিয়েছিলেন, সেই পার্টির আয়োজক ছিলেন এই আকবর। সেখানে বসুন্ধরা রাজেও সপুত্র এসেছিলেন। এসেছিলেন অন্যান্য বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। আকবর, বসুন্ধরা রাজের বন্ধুত্ব ৪০ বছরের পুরোনো।
দিল্লিতে আকবরের বাড়িতেই একটা ডিল হল। মানেকা গান্ধী আর তাঁর মা ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁদের ‘সূর্যা’ ম্যাগাজিনটাকে বেচে দিলেন। পত্রিকার কেনাবেচা চলতেই থাকে। এটা কোনও বড় ব্যাপারই নয়, কিন্তু গুরুত্বটা অন্য জায়গায়। এই ম্যাগাজিনটা কংগ্রেস দলের অঘোষিত মুখপত্রে পরিণত হয়েছিল। অনেক কেচ্ছা বেরোতো বিরোধীদের। দেশের অন্যতম হেভিওয়েট নেতা বাবু শ্রী জগজীবন রামের রাজনৈতিক কেরিয়ার ধ্বংসের মূল কারণ ছিল এই কাগজটাই। কোনও প্রকার বিনিয়োগ না- থাকলেও আদপে পত্রিকাটা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীরই হয়ে গিয়েছিল। যে গোরু না-খেয়েই ভালো দুধ দেয়, তাকে আর কে বিক্রি করতে চায়? ইন্দিরাও চাননি। কিন্তু প্রশ্ন হল কিনছিল কে বা কারা?
মানেকা গান্ধী তাঁর ‘সূরিয়া’ ম্যাগাজিন বিক্রি করে দিচ্ছিলেন। কিনছিলেন রাজমাতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়ার সচিব— সর্দার সাম্ভাজি চন্দ্রোজি আঙগ্রে, এবং একজন চিকিৎসক শ্রী জিতেন্দ্র কুমার জৈন। দুজনেই আরএসএস -এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজমাতা তখন সদ্য জন্ম নেওয়া একটি দলের সংস্থাপক উপাধ্যক্ষ হয়েছেন। দলটির নাম? আজ্ঞে, ওটাই তো সেই ফুলের দল, যার চিহ্ন ছিল প্রস্ফুটিত কমল, ভারতীয় জনতা পার্টি।
আরে বাপু আসব আসব, সেই ফুলের দলের কথায় আসব। এখন একটু রাজমাতা ভার্সেস ইন্দিরাজির গল্পটা বুঝে নিই। দুজনের মধ্যে বরাবরের রেষারেষি ছিল। এমারজেন্সি পর্বে রাজমাতাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। তিহাড়ে। সেখানেই দানা বেঁধেছিল অনেক কাহিনি। লিখেছি সেই কথাগুলো। এখন একটু একটু করে বলব, কীভাবে ইন্দিরা গান্ধী-মানেকা গান্ধীর সম্পর্কে ফাটলের পরিবর্তে রাজমাতা-মাধবরাও সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরল। গুলিয়ে গেলে ক্ষমা করবেন, সব সম্পর্কযুক্ত তো, এভাবেই বলে নেওয়া ভালো।
এই যে একটু আগে শ্রী আঙগ্রের কথা লিখলাম, এঁকে কিন্তু যে সে লোক ভাবার ভুল করবেন না। ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীকে যেভাবে গান্ধী পরিবারের রাসপুতিন বলা হতো, ঠিক সেভাবেই শ্রী আঙগ্রে-কে বলা হতো সিন্ধিয়া পরিবারের রাসপুতিন। আঙগ্রে ছিলেন মহারাজ জীবাজিরাও-এর তুতো ভাই। মহারাজার মৃত্যুর পরে রাজমাতার পলিটিক্যাল কেরিয়ারের গ্রাফটা তিনিই এঁকেছিলেন। নিজের আত্মজীবনীতে রাজমাতা লিখছেন, ‘… সাম্ভাজিরাও আমার স্বামীর কাছে নিজেদের আত্মীয়তার সূত্র নিয়েই আসেন। সেবাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। এবং প্রথম দিন থেকেই তিনি মহারাজের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। সঙ্গে আমারও। আমিও তাঁকে তাঁর ডাকনাম ধরেই ডাকতাম— বাল বলে ডাকতাম।’ এই আঙগ্রেই মধ্যপ্রদেশে জনসঙ্ঘের রাজনীতিতে অনুঘটকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ডি পি মিশ্রর কংগ্রেস গভর্নমেন্ট ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল ছত্রিশজন এম এল এ। এই গল্পটা আগেই করেছি, তখন ইচ্ছে করেই আঙগ্রের নামটা তুলিনি।
বিজয়রাজে সিন্ধিয়াজিকে যখন তিহার জেলে পাঠানো হয়, তখন মাধবরাও পালিয়ে যান নেপালে। নেপালে তাঁর এক বোন ঊষা রাজে সিন্ধিয়া থাকতেন। ঊষা ছিলেন নেপালের শমসের জং বাহাদুর রাণার স্ত্রী। মাধবরাও দেশে ফেরার পরে নির্দল ক্যান্ডিডেট হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। জিতেওছিলেন। ধীরে- ধীরে তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসের দূরত্ব কমতে থাকে। ১৯৮০ সালে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। ভোটে লড়েন। সেবারেই রাজমাতা ইন্দিরাজির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, সিট ছিল রায়বরেলির। রাজমাতা হেরে যান। ইন্দিরা গান্ধীর চাল ঠিক পড়েছিল। মা- ছেলের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হল। মানেকা গান্ধীকে ইন্দিরা গান্ধীর থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে দিয়ে রাজমাতা যে কাজটা করেছিলেন, মাধবরাওকে নিজের শিবিরে টেনে নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী সেই স্কোরটাকেই এক-এক করে দিলেন। শোধবোধ। এবার রাজমাতার পক্ষ থেকে আঘাত আসা স্বাভাবিক ছিল।
মাধবরাও নিজে তাঁর এবং রাজমাতার মধ্যেকার বিভেদের ব্যাপারটা নিয়ে আঙগ্রে-কে দায়ী করতেন। আর আঙগ্রে? তিনি কী বলেছেন এটা নিয়ে?
আঙগ্রে একটা অদ্ভুত উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মরাঠা রানি অহল্যাবাই হোলকার অত্যন্ত দয়ালু প্রকৃতির ছিলেন। তিনি প্রতিদিন দুঃস্থ মানুষকে দানধ্যান করতেন। একদিন এমন দানপর্বের সময়েই তিনি দেখেন তাঁর ছেলে তাঁর এক প্রজার গায়ে কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দিয়ে মজা নিচ্ছে। রানি অহল্যাবাই এই দৃশ্য দেখামাত্র ছেলেকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। হাতির পায়ের নীচে ফেলে তাঁকে পিষ্ট করা হয়। আঙগ্রের বক্তব্য ছিল রাজমাতা বিজয়রাজে সিন্ধিয়া হলেন এযুগের রানি অহল্যাবাই, যিনি ধর্মের জন্যে, প্রজার জন্যে ছেলের ভুল পদক্ষেপকে কোনভাবেই সমর্থন করতে পারেননি। নিজের বক্তব্যকে পোক্ত করতে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন— ‘আমি কি মাধবরাওকে এমন কিছু করতে বলেছিলাম যাতে রাজমাতা নারাজ হয়ে যান?’ মাধবরাও-এর নেপাল পলায়ন এবং কংগ্রেসে যোগদান নিয়ে আঙগ্রে সদা সরব ছিলেন।
মানেকা গান্ধী ইন্দিরাজিকে ম্যাগাজিন বিক্রির বিষয়টা জানাননি। সূরিয়া পত্রিকা বিক্রি হয়ে গেল। খবর ছড়িয়ে পড়ল। এই কাগজ ইন্দিরা গান্ধীকে অনেক ফুটেজ দিয়েছিল। এমারজেন্সির পরে যখন ইন্দিরা গান্ধী হারতে হারতে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর শুকোনো বাগানে ফুল ফুটিয়ে ছিল এই সূর্যটাই। জগজীবন রামের সুপুত্রের সেক্স স্ক্যাণ্ডালের পোলারয়েড ছবি রাজধানী কাঁপিয়ে দিয়েছিল। হেভিওয়েট নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী পদের অন্যতম দাবিদার জগজীবন রামের রাজনৈতিক কেরিয়ার শেষ করে দিয়েছিল এই পত্রিকাটাই। এই পত্রিকার সঙ্গে কংগ্রেস দলের সরাসরি কোনও সম্পর্ক না-থাকলেও আশা করি ওজনটা বোঝাতে পারলাম। আজ যদি আরএসএস-এর মুখপত্র ‘অরগানাইজার’- কে কংগ্রেস কিনে নেয়, কিংবা কংগ্রেসের ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’-কে কিনে নেয় বিজেপি, তাহলে যেমন হইচই পড়বে ঠিক তেমনটাই ঘটেছিল ‘সূরিয়া’র বেলায়। ডক্টর জিনেন্দ্র জৈনকে প্রধানমন্ত্রী নিবাসে ডেকে পাঠালেন ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারী। খেলা জমে গেল। যখন কংগ্রেসের আহমেদ পটেল জীবিত ছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে অমিত শাহের টক্কর হলেই কাগজে লেখা হতো ‘কংগ্রেসের চাণক্য বনাম বিজেপির চাণক্য’, ঠিক সেভাবেই সূরিয়ার বেলায় গেমটা দাঁড়াল ‘গান্ধী পরিবারের রাসপুতিন বনাম সিন্ধিয়াদের রাসপুতিন’। মাইন্ডগেম। মিটিং-এর সময়ে মানেকা গান্ধী এবং বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া উপস্থিত ছিলেন। আঙগ্রে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু তিনি এই খেলার অন্যতম সূত্রধার ছিলেন। জৈনর বক্তব্য থেকে জানা যায় তাঁকে প্রথমে বোঝানো হয় যাতে তিনি এই ডিল থেকে সরে আসেন। পরে সেই বোঝানোটাই ধমকিতে পরিণত হয়। তাতেও কাজ না-হলে রাজ্যসভার সিট অফার করা হয়। এবং সবশেষে পঁচাত্তর লক্ষ টাকা অফার করা হয় ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর পক্ষ থেকে। জৈন কোনও কিছুতেই কর্ণপাত করলেন না। ইন্দিরা গান্ধী এবার ধর্মগুরু মা আনন্দময়ী দেবীর মাধ্যমে প্রস্তাব পাঠালেন। জৈনর মুখে তখন একটাই কথা, যদি স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী এসে কথা বলেন, তবেই এই নিয়ে আলোচনা হবে। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রীকে নত হতে হবে। তা আর হয়নি। জৈন তথা আঙগ্রেকেও কেনা যায়নি। আঙগ্রের কথানুসারে এটা একটা ব্যবসায়িক ডিল ছিল, যেটাকে শ্রীমতি গান্ধী একটি পলিটিক্যাল ডিলে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটাই ভুল করেছিলেন শ্রীমতি গান্ধী। তিনি আঙগ্রের মূল্য বুঝতে পারেননি। আঙগ্রে ছবিতে বিশেষ ভাবে না-থেকেও সবিশেষ ছিলেন। তিনি অমূল্য। তাঁকে কেনা বা বেচা যায় না। জিনেন্দ্র জৈন ‘সূরিয়া’র মালিকানা হাতে পেতেই আবার একটা হইচই বাঁধিয়ে দেওয়া খবর ছেপে বেরোল।
‘সূরিয়া’ পত্রিকায় খবর ছাপা হল— মানেকা গান্ধীকে তাঁরই বাড়িতে হত্যা করার ষড়যন্ত্র চলছে। চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল। একমাসের মধ্যে আবার শোরগোল উঠল। তবে এবারে আর মানেকা-হত্যার খবর নিয়ে নয়, যদিও খবরের কেন্দ্রে মানেকা গান্ধীই ছিলেন। আর ছিলেন মানেকার বন্ধু— আকবর ডাম্পি আহমেদ। আকবর লখনউতে কংগ্রেস পার্টির একটা সম্মেলন ডাকলেন। তারিখ ছিল ২৮শে মার্চ, ১৯৮২। স্বাভাবিক ভাবেই মানেকা-লবির পক্ষধর লোকজন, অর্থাৎ সঞ্জয় গান্ধীর অনুগামীদের জমায়েত হতে চলেছিল লখনউয়ের সম্মেলনে।
এটা তো গেল মানেকা-লবি। আর বিপক্ষে?
ইন্দিরা গান্ধী?
ঠিক ভাবে ভেবে দেখলে ইন্দিরা গান্ধী তখনও মানেকাকে প্রতিপক্ষ বলে চিহ্নিত করেননি, কিন্তু এবার জল বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছিল। ইন্দিরা ক্ষুব্ধ হলেন। সেই সময়ে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। কংগ্রেসের লোক। সঞ্জয় গান্ধীর সমর্থকেরা আবার এই ভদ্রলোককে বিশেষ সহ্য করতে পারত না। স্বাভাবিক ভাবেই তিনিও উত্তর প্রদেশের বুকে এই সম্মেলনকে ভালো চোখে দেখছিলেন না।
ইন্দিরা গান্ধী লখনউ সম্মেলনের জন্যে সম্মতি দিলেন না। উল্টে আকবর ডাম্পি আহমেদকেই দল থেকে বের করে দিলেন। পোড়খাওয়া চোখে শ্রীমতি গান্ধী দেখতে পাচ্ছিলেন মানেকাকে মেঘের মতো ব্যবহার করতে-করতে একদিন ইন্দ্রজিৎ হয়ে ওঠা আকবররাই রাজীব গান্ধীর বিরোধ করতে শুরু করে দেবে।
২৫শে মার্চ, ১৯৮২। ইন্দিরাজি তখন লণ্ডনে গেছেন। মানেকা নিজের ছেলে বরুণকে সঙ্গে নিয়ে জিম করবেট ন্যাশন্যাল পার্কে ঘুরতে গেলেন। পশু প্রেমী মানেকার কাছে এটা একটা সাধারণ ব্যাপার ছিল। কিন্তু অসাধারণ ছিল অন্য জায়গায়। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন মানেকার সেই বন্ধু, যাকে ইন্দিরা গান্ধী দল থেকে বহিষ্কৃত করে দিয়েছিলেন। ওখান থেকেই মানেকা গান্ধী ইন্দিরাজিকে একটা চিঠি লিখলেন—
‘আশা করছি, আগামীদিনেও আপনি আমাকে পথ দেখাবেন, কিন্তু কিছু বললেন না বলেই আমি এখানে চলে এলাম। যদি কোথাও, কোনও ধরণের দলবিরোধী গতিবিধি দেখা যায়, আমি তা থামিয়ে দেব। মনে হয় ২৮শে মার্চের পর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
ইন্দিরা গান্ধী ২৭শে মার্চ দিল্লিতে ফিরলেন। সাংবাদিকদের বললেন— ‘লখনউতে যা কিছু ঘটছে বা ঘটে চলেছে, তা কংগ্রেস বিরোধী। এতে আরএসএস এবং ভাজপার হাত রয়েছে।’
এসব ঘটছে ’৮২ সালে। আর ভাজপার জন্ম?
’৮০ সালে।
সাল-টাল সব্বার জানা। ও নিয়ে সময়সারণি খুলে বসে লাভ নেই। বিশ্বের ইতিহাস সম্পর্কে হিটলার সাহেব এক অমোঘ উক্তি করে গেছেন— ‘To study history means to search for and discover the forces that are the causes of those results which appear before our eyes as historical events.’ এবার একটা গোদা গোছের বাংলা তর্জমা করে ফেলি। কী দাঁড়ায়? ইতিহাসের বইতে থাকবে কবে, কখন, কোথায় ঘটনাটা ঘটেছে, আর আমাদের জানতে হবে কেন ঘটেছে। ধরুন, কোনও এক বিখ্যাত পরিচালকের বানানো সিনেমা গোড়াতে দেখছেন শিয়ালদা স্টেশনের ওপরে সারি সারি শুয়ে রয়েছে বাংলাদেশী শরণার্থী। এটা হল রেজাল্ট। এর কারণ সেই সিনেমাতে নেই, আপনাকে কারণ খুঁজতে হবে ইতিহাসের পাতায়-পাতায়। আশা করি, বোঝাতে পারলাম। তা ওই যে বললাম, ভাজপার জন্মসাল সবার জানা, ও নিয়ে কচকচানি টেনে এনে কী লাভ? আমরা বরং খুঁজি বিজেপির জন্মের কারণ। ও, ভাবছেন এই লোক আবার ট্র্যাক হারাচ্ছে! আরে না মশাই, দিগভ্রষ্ট হইনি। আমরা আবার শাশুড়ি-বউমার রাজনীতির লড়াইতে ফিরে আসব। বিরিয়ানি রাঁধার আগে মশলাটা কিনে আনি।
গান্ধী-হত্যার কথা আগেই লিখেছি। আরএসএস-নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। আরএসএস-এর ক্ষেত্রে জারি হওয়া এই নিষেধাজ্ঞার ফরমান ছিল দ্বিতীয় বারের। প্রথম ব্যানটা এসেছিল ব্রিটিশ শাসনকালে। আরএসএস তৃতীয় বার ব্যানড হয় এমারজেন্সির সময়ে। এই পর্বে অর্থাৎ ১৯৭৫-১৯৭৭ নাগাদ আরএসএস সর্বাধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সঙ্ঘ শাখার ৩০% বিস্তার ঘটে। আগে শাখা ছিল ৮৫০০, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় ১১০০০। প্রচারকদের কাঁধে ভর করে ২৫% স্বয়ংসেবক বাড়িয়ে আরএসএস তখন ফিনিক্সের মতো ফিরে আসার মুখে।
জয়প্রকাশ নারায়ণ জনসঙ্ঘের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। আর জনসঙ্ঘ ছিল আরএসএস -এর ছায়াতলে। কালক্রমে জেপি-এর ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’র কাঁধে চড়ে ভারতে প্রথম অকংগ্রেসী সরকার (জনতা পার্টির) আসে। খিচুড়ি সরকার। অনেক দলের। এই সময়ে আরএসএস-এর ক্ষমতাবৃদ্ধি অনেক রাজনীতিকের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ বাড়াচ্ছিল। জনতা পার্টির নেতারা এবার সেদিকটায় নজর দিলেন। প্রশ্ন উঠল— আরএসএস রাজনীতি করছে। যারা জনতা পার্টিতে জনসঙ্ঘের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে হবে। মানে, জনতা পার্টি আর আরএসএস দুটোই একসাথে করা চলবে না।
তখন বাজপেয়ীজি জনতা পার্টির সরকারে জনসঙ্ঘের অন্যতম মুখ সরকারের বিদেশমন্ত্রী পদে আসীন। তিনি রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ। সঙ্ঘের নার্সারি থেকে হিন্দুত্বের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে আসা সমাজবাদী ভাবধারার নেহরুপন্থী ব্যক্তি। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে তাঁর রাজনৈতিক দান চেলে দিলেন। প্রাথমিক ভাবে প্রতিক্রিয়া দিলেন— আরএসএস-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে জনতা পার্টিতে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেনের মতো আচরণ করা হয়। আরএসএস -এর সঙ্গে তাঁর / তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনও সম্ভাবনাও নেই বলে জানিয়ে দিলেন। আবার সেই তিনিই ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে আরএসএস-এর বার্ষিক অনুষ্ঠানে আলোকবৃত্ত থেকে দূরে দ্বিতীয় সারিতে গিয়ে বসলেন। অনুরোধ সত্ত্বেও সেদিন প্রথম পঙক্তিতে জায়গা নেননি অটলবিহারী বাজপেয়ী। এই দ্বৈত চরিত্রাচরণে জনতা পার্টির রাজনীতিকদের মুখে কুলুপ পড়ে গেল। মোরারজি দেশাই নিজের মুখেই বলে দিলেন, আরএসএস একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, তাই এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কেউ জনতা পার্টির সদস্য হলেও কোনও সমস্যা নেই।
এই সমস্যা সাময়িক ভাবে মিটলেও অন্য সমস্যা দেখা দিচ্ছিল জনতা পার্টির অভ্যন্তরে। চরণ সিং। গোবলয়ের অবিসংবাদিত কৃষক নেতা। ভদ্রলোকের পুরপুরুষরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিলেন। দেহে বইছে হরিয়ানার জাট রক্ত। যখন দেশ কৃষি বিল নিয়ে উত্তাল এবং জাটরা নিজেদের ছন্দে আন্দোলন করছেন, তখন তাঁদের আন্দোলনকে ভুঁইফোঁড় বলা হলেও ভুলে গেলে চলবে না যে কৃষক আন্দোলন নিয়ে তাঁদের একটা সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। আমরা চরণ সিং-এর কথায় ফিরি। চরণ সিংকে জনতা সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা হয়নি। তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। অটলবিহারী বাজপেয়ী তখন আরেক সোশ্যালিস্টকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর মান ভাঙাতে ব্যস্ত। এই সোশ্যালিস্টের প্রসঙ্গ আগে টেনে এনেছিলাম তাঁর জীবনটাও অদ্ভুত। ম্যাঙ্গালোরের ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম নেওয়া এই সোশ্যালিস্ট একদা পাদ্রী হতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে ওই কচি বয়েসেই বুঝেছিলেন সামাজিক ভেদাভেদ অব্যাহত রয়েছে। রেক্টর আর সেমিনারিয়ানদের মধ্যে পার্থক্য প্রবল। রেক্টরদের জন্যে ভালো খাবার, সেমিনারিয়ানরা বসবে নিচু টেবল-এ। প্রতিবাদ করে জনজীবনে ফিরে এসে শ্রমিকদের হকের কথা বলার ভূমিকা নিয়েছিলেন। পরে এই ভদ্রলোক বাজপেয়ীজির সরকারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সামলাবেন। চিনতে পারছেন এবার, আশা করি— জর্জ ফার্নাণ্ডেজ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন