অভীক মুখোপাধ্যায়
দলের পরিচালনার জন্য, নির্বাচনের জন্য প্রতিটা দলেরই অর্থের প্রয়োজন হয়। ভাজপাও তার ব্যতিক্রম নয়। জনসঙ্ঘের সময়ে দলের জন্য টাকা জোগাড় করতেন নানাজি দেশমুখ। ভাজপা জন্ম নেওয়ার পরে বেশিরভাগ ফান্ডিং আসত রাজমাতার পক্ষ থেকে। নুসলি ওয়াডিয়ার মতো হাতেগোণা কয়েকজন ব্যবসায়ী ভাজপাকে অর্থ জোগাতেন। ব্যবসায়ী সমাজ মূলত কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষক ছিল।
’৯৬ সালে, ভাজপা যখন রাইসিনা হিলের দোরগোড়ায়, তখন হাওয়া বদলাচ্ছিল। ভারতের কর্পোরেট সমাজ নগদে টাকা দিচ্ছিল। ভাজপার খাজাঞ্চি তখন বেদপ্রকাশ গোয়েল। এই বেদপ্রকাশের ছেলে পীয়ুষকেই মোদী-শাহের যুগে ভারতবাসী ভাজপার খাজাঞ্চি হিসেবে দেখবে। বেদপ্রকাশ গোয়েলের সহকারী রূপে কাজ করছিলেন এক বুদ্ধিমান, সদাহাস্যমুখ মরাঠি ব্রাহ্মণ। প্রমোদ মহাজন।
আডবানিজির রামরথরাযাত্রার সারথী রূপে প্রমোদের উত্থান। মহারাষ্ট্রে ভাজপাকে ক্ষমতায় আনার কারিগর ছিলেন প্রমোদ। উচ্চ বর্ণের দল হিসেবে চিহ্নিত ভাজপাকে গ্রামে-গ্রামান্তরে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রমোদ মহাজন এবং তাঁর আত্মীয় গোপীনাথ মুণ্ডে। গুজরাতে জাতি সমীকরণকে ভাঙার যে কাজটা মোদী-শাহ জুটি করছিলেন, সেই একই কাজ মহারাষ্ট্রে চালাচ্ছিলেন মহাজন-মুণ্ডে। শিবসেনার সঙ্গে জোটের কাণ্ডারীও হয়ে উঠেছিলেন মহাজন। মুণ্ডে ছিলেন জননেতা, মহাজন সামলাতেন পর্দার আড়ালের রাজনীতি। মহাজন দলের মধ্যে ফাইভ স্টার কালচার আনছিলেন। দলের বাহ্যিক রূপ বদলে যাচ্ছিল। তবে অনেক পুরানোপন্থী নেতারা আবার এই আড়ম্বর অপছন্দ করছিলেন। একবার কোনও একটি কারণে মহাজনকে রাজস্থানের জয়পুর থেকে ভোটে দাঁড় করানোর কথা উঠলে ভৈরোঁ সিং শেখাওয়াতের মতো হেভিওয়েট নেতা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে বলেন, ‘আজ আমার দলীয় কর্মীরা পুরি-সবজি খেয়েই মন খুশি করে কাজ করছে। কাল মহাজন এখানে এলে, তারা দামী গাড়ি আর পাঁচতারা হোটেল চাইবে।’
নতুন আবহে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য অটল-মুখ নিয়ে ভাজপা এগোচ্ছিল। অটলবিহারী দলের ভাবমূর্তি বদলের জন্য নতুন বার্তা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, ‘ভাজপার কাছে সব ভারতীয় সমান।’ হিন্দুত্বের ভূমিতে সর্বসমতার বীজ দেখে কেউ কেউ টিপ্পনী করছিলেন যে, বাজপেয়ীজি ভুল দলে থাকা ঠিক লোক। ‘৯৬ নির্বাচনে অটলবিহারীর বিপরীতে থাকা কংগ্রেস প্রার্থী অভিনেতা রাজ বব্বর বলেছিলেন, ‘এই যুদ্ধক্ষেত্রে আমি অর্জুন, আর উনি ভীষ্ম পিতামহ।’
স্পটলাইটে তখন শুধুই অটল। আডবানিজি তখন সংসদে নেই। ‘৯৭ সালের অক্টোবরে ভাজপা দলের অধ্যক্ষ হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হতে চলেছিল। Out of sight, out of mind নীতিতে বিশ্বাসী জনগণের মন থেকে আডবানিজির নামও ক্রমশ আবছা হয়ে যাচ্ছিল। যদিও দলের সঞ্চালক হিসেবে আডবানিজি অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছিলেন, তবুও সবাই অটলবিহারীকেই চাইছিল। সিনেমা হিট করলে নির্দেশককে আর কে মনে রাখে? দর্শকের দল শুধু নায়ককে খোঁজে।
১৯৯৬ সালের ৯ই মে সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হল। দেখা গেল কংগ্রেস পেয়েছে ১৪০টি আসন। দেশের অ-কংগ্রেসি, অ-ভাজপা জোট পেয়েছে ১৭৩টি সিট। ভাজপার কপালে জুটল ১৬১টা আসন। সংসদে একক বৃহত্তম রাজনৈতিক দল রূপে আত্মপ্রকাশ করল ভাজপা। শিব সেনা, সমতা পার্টি এবং হরিয়ানা বিকাশ পার্টি ভাজপার জোট-সঙ্গী রূপে ভালো ফল করল। এই তিন সঙ্গী দল মিলিয়ে জোগাড় করল ২৬টি আসন।
.
১৫ই মে ১৯৯৬। দুপুর ১:৪০। নিউ দিল্লি। রাইসিনা হিল থেকে ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে সিক্স রাইসিনা রোডের বাংলো থেকে চারজন সওয়ারিকে নিয়ে একটি সাদা অ্যাম্বাসাডার গাড়ি বেরোলো। গন্তব্য রাষ্ট্রপতি ভবন। গাড়ির ড্রাইভার ছাড়া যে বাকী তিনজন আছেন, তাঁদের মধ্যে একজন চাপরাশি, অপর দুজনের মধ্যে কমবয়েসী ব্যক্তির গায়ে স্যুট, বয়স্ক মানুষটির পরনে ধুতি, কুর্তা। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটি এর আগেও একাধিকবার রাষ্ট্রপতি নিবাসে এসেছেন, সেসব অবশ্য অন্য প্রয়োজনে। তিনি নিজের স্যুটধারী সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাই, মামলা কুছ গড়বড় লগ রহা হ্যাঁয়।
এই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটি হলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। সঙ্গের জন সম্পর্কে তাঁর জামাই হন। রঞ্জন ভট্টাচার্য। রঞ্জনকে তিনি আদর করে ‘বঙ্গালিবাবু’ বলে ডাকেন। রাজকুমারী কৌলের মেয়ে গুন্নু’র বর রঞ্জনকে সঙ্গে নিয়ে বাজপেয়ীজি রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মার কাছে চলেছিলেন। ম্যাজিক ফিগার ছুঁতে না পারলেও তাঁরা সরকার গঠনের দাবি নিয়ে চলেছিলেন রাইসিনা হিলের পানে।
প্রাথমিকভাবে ভাজপা ঠিক করেছিল ২৩০-এর কম সিট পেলে সরকার গঠনের দাবি করাই হবে না। তাঁরা জানতেন শিবসেনা, অকালি দল পাশে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু বাকি দলগুলিকে পাশে পেতে হলে সত্তার মোহানায় গিয়ে দাঁড়ানোর দরকার ছিল। সুযোগ পেলে আমরা বৃহত্তম দাবিদার হয়ে দাঁড়াতে পারি এই বার্তা দেওয়াটা জরুরি ছিল।
গল্পের সরণী এখান থেকে দু’দিকে ভাগ হয়ে যায়। একটি পথ বলে, রাষ্ট্রপতি দেশের সংবিধানের নিয়ম মেনে তিনি অ-কংগ্রেসি, অ-ভাজপা জোটকে সরকার গঠনের সুযোগ দিয়ে বলেছিলেন, কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে আসুন। ১২ই মে পর্যন্ত তাঁরা নেতা চয়ন করা নিয়ে ব্যস্ত থাকল। নরসিমহা রাওয়ের পক্ষ থেকে সমর্থন জানিয়ে কোনও চিঠি তখনও এল না। এবার রাষ্ট্রপতি অটলবিহারীকে আমন্ত্রণ জানালেন। অটলবিহারী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের শেষে একটি ফাইল নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। হাতে একখানা ফাইল। রঞ্জন তখন একবার অটলজির মুখের দিকে, আরেকবার ফাইলের দিকে তাকাচ্ছেন। অটলজি বললেন, ‘কাল শপথ লেনি হ্যাঁয়।’ শঙ্করদয়াল শর্মা জ্যোতিষীদের পরামর্শ মতো শুভ মুহূর্ত দেখে শপথগ্রহণের দিনক্ষণ স্থির করে ফেলেছিলেন। ১৬ই মে ১৯৯৬। বেলা ১২টা। প্রথমবারের জন্য ভাজপার কোনও নেতা, প্রথমবার সঙ্ঘের নার্সারি থেকে আগত কোনও মুখ, প্রথমবার হিন্দুত্বের কোনও প্রতিনিধি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শপথ নিলেন। সফেদ ধোতি-কুর্তা পরিহিত, কমলা-গেরুয়া অঙ্গবস্ত্র গলায় অটলজি রাষ্ট্রপতি ভবনের অশোকা হলে বলে উঠলেন, ‘ম্যায় অটলবিহারী বাজপেয়ী, ঈশ্বর কে নাম কি শপথ লেতা হুঁ…’।
আমি গল্পের দুটো সরণীর কথা বলেছিলাম। একটা নিয়ে লিখলাম। অপরটা কী বলছে?
বলা হয়, এ ছিল তিন বাউনের কূটনীতি। কোন তিনজন? প্রথমজন শঙ্করদয়াল শর্মা— যিনি মধ্যপ্রদেশের আদি বাসিন্দা, পুরাতন কংগ্রেস ম্যান, সোনিয়া গান্ধী যাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চেয়েছিলেন (নরসিমহা রাও যেবারে প্রধানমন্ত্রী হলেন)। দ্বিতীয় ব্রাহ্মণের নাম তো বোঝাই যাচ্ছে— অটলবিহারী বাজপেয়ী। আর তৃতীয় ব্যক্তি? পামুলাপারথি ভেঙ্কটা নরসিমহা রাও। বলা হয়, কংগ্রেস সেন্ট্রাল ওয়ার্কিং কমিটির মতানুসারে থার্ড ফ্রন্টকে সমর্থন করার চিঠিতে তিনি সই করে দেন। কিন্তু সময়মতো চিঠিটা রাষ্ট্রপতিকে পাঠাতে ভুলে যান। কেন ভুলে গেলেন? বলা মুশকিল। এত বিদ্বান, এত ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী কি সত্যিই এতটা ভোলা মনের মানুষ ছিলেন?
তবে রাও চিঠি পাঠাতে ভুলে টুলে গিয়ে একটা ব্যাপার সুনিশ্চিত করলেন যে, ক’দিনের জন্যে হলেও অটলবিহারী বাজপেয়ী দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসবেন। কিন্তু মাত্র ক’দিনের জন্যে ওই আসনে বসে লাভ কী হবে? ক্যাডার জানবে আমাদের লোকও কিন্তু ওই আসন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। দেশ জানবে, ভালো লোক সংখ্যা গরিষ্ঠতা না পাওয়ার কারণে গদিতে টিকে থাকতে পারল না। রাজনীতির এটাই মজা। মাঝেমধ্যে পরাজয় সেখানে জয়ের থেকে বেশি দামী বলে প্ৰমাণিত হয়।
.
রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মা অটলবিহারীর ভাজপাকে বহুমত পেশ করার জন্য ৩১শে মে পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন। তা জোগাড় করতে পারলেন না অটলবিহারী। কংগ্রেস তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াবে না এটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। রইল ইউনাইটেড ফ্রন্ট। তাঁরা ঠিক করেই নিয়েছিলেন সরকারে কংগ্রেস বসলে বসুক, কিন্তু ভাজপাকে কোনভাবেই বসে থাকতে দেওয়া যাবে না। অগত্যা সরকার পতনশীল গতিতে অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছিল।
ইউনাইটেড ফ্রন্ট রাষ্ট্রপতির ওপরে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিল। অটলবিহারীকে ডেকে সরকার গঠন করার সুযোগ দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ফ্রন্টের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি ভবনেও গেলেন। হরকিষেণ সিং সুরজিত তখন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট)-এর জেনারেল সেক্রেটারি। তিনি তো সরাসরি রাষ্ট্রপতিকে একথাই বলে দিয়েছিলেন যে, এজন্যেই কি তাঁকে প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে যাতে তিনি সঙ্ঘের সরকার তৈরি করতে সাহায্য করবেন? সৌজন্য সাক্ষাৎকারের সময়ে চা ও স্ন্যাক্স ছুঁয়ে দেখতেও নারাজ ছিলেন সুরজিত। যেহেতু উপ-রাষ্ট্রপতি থেকে রাষ্ট্রপতির পদে উন্নীত হওয়ার সময় বাম দলগুলির ভোটের অবদান ছিল, তাই সুরজিত এমন মন্তব্য করেছিলেন।
অটলবিহারীকে মসনদ থেকে নামতেই হবে বুঝতে পেরে সংসদে ভাজপার শক্তি পরীক্ষণের আগেই সংযুক্ত মোর্চা নিজেদের মতো বাছবিচার করে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থী ঠিক করা শুরু করে দিয়েছিল। ফ্রন্টের প্রথম পছন্দ ছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং। করুণানিধি, চন্দ্রবাবু নাইডু, মুরাসোলি মারান, এইচ ডি দেবেগৌড়া মিলে ভিপির সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তাঁর রাজাজি মার্গের বাড়িতে। বাড়ির লন-এ চা, কফি, বিস্কিটের ট্রে সমেত অভ্যাগতদের বসিয়ে দিয়ে ভিপি সেই যে ভেতরে গেলেন আর ফেরার নাম নেই। প্রায় দুঘণ্টা পরে তাঁর স্ত্রী বেরিয়ে এসে জানালেন তাঁর জন্যে অপেক্ষা না করাই ভালো। তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে একদমই আগ্রহী নন। উপায়ান্তর না দেখে অতিথিরা তখন সেখান থেকে ফিরে আসেন। ভিপি সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে করে দিল্লির পথে পথে ঘুরে সময় কাটাচ্ছিলেন। হয়তো তাঁর মনে ভয় কাজ করছিল, ওই পদে ফিরে গেলে তিনি সামাল দিতে পারবেন না।
দেবেগৌড়া ভিপির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে যখন তাঁর নামের প্রস্তাব নিয়ে ফ্রন্টের আরেক নেতার সঙ্গে আলোচনা করেন, তখন সেই নেতা বলেছিলেন, ‘আপনি এখনও ওঁকে সম্মান করেন! ১৯৮৯ সালের সরকারের কথা মনে নেই, রাজনৈতিক পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা ভুলে গেলেন? উনি কি রাজনীতি নিয়ে আদৌ সিরিয়াস? যাই হোক, ওঁকে বোঝানোর চেষ্টা করুন।’ কাকতালীয়ভাবে দেবেগৌড়ার সঙ্গে কথা বলা এই নেতাই হয়ে উঠবেন ফ্রন্টের দ্বিতীয় পছন্দ। প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট জ্যোতি বসু। আমরা জ্যোতি বাবুকেই প্রথম কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী রূপে পেয়ে যেতাম যদি না তাঁর নিজের দলের মধ্যে থেকেই আপত্তিটা করা হতো। সম্ভবত সিপিআই(এম) বিপক্ষে থেকে বিরোধ করতে যতটা আত্মবিশ্বাসী ছিল, সরকারের মুখ হয়ে দায়িত্ব নিতে ততটা মনের জোর পায়নি। জ্যোতি বসু এই সিদ্ধান্তকে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বললেও দলের রায়ের বিরুদ্ধে যাননি। এই সিদ্ধান্তের একাধিক পক্ষ থাকতে পারে। কিন্তু দুটো ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
১. দল নিজের নীতি থেকে বিচ্যুত হয়নি।
২. দলের শৃঙ্খলার ঊর্দ্ধে কেউ কথা বলতেন না, সে তিনি যত বড় কিংবদন্তীই হন না কেন।
ফ্রন্টের তৃতীয় পছন্দ ছিলেন গোবিন্দাস্বামী কারুপ্পিয়াহ মুপানার। টিএমসির প্রতিষ্ঠাতা। টিএমসি বলতে তৃণমূল কংগ্রেস ভাববেন না জানি। এ হল ‘তামিল মানিলা কংগ্রেস’। কিন্তু দলের এমপি সংখ্যার আধিক্য না-থাকায় মূপানার প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করতে পারলেন না।
ফলস্বরূপ ফ্রন্টের চতুর্থ পছন্দকেই দেশের প্রথম পছন্দে পরিণত করা হল। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য ফ্রন্ট এইচ ডি দেবেগৌড়াকে বাছল।
.
ভাজপার ইতিহাস বলছে, তারা যে কোনও সুযোগ পেলে তার সদ্বব্যবহার করতে ছাড়ে না। মাত্র ১৩ দিন সময় পেলেন অটলবিহারী। তারই মধ্যে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটালেন। সংসদ চলাকালীন লাইভ টেলিকাস্টের শুভারম্ভ করা হল। সদনে শক্তি পরীক্ষার দিন আসন্ন হয়ে পড়ল। ২৭-২৮ মে দেশবাসী দেখল তাঁদের প্রধানমন্ত্রী সংসদে কীভাবে কথা বলছেন।
খদ্দরের কুর্তা গায়ে অটলবিহারী বাজপেয়ীকে দেখা যাচ্ছিল। পাশে সাদা সাফারি স্যুটে বসেছিলেন জশবন্ত সিং। পিছনে প্রমোদ মহাজনের হাসি মুখ ধরা পড়ছিল। অটলজির মুখেও হাসি ছিল, কিন্তু কথায় বেদনা, ‘আমাকে ক্ষমতালোভী বলা হয়েছে। আমি আহত হয়েছি। গত দশদিনে আমি যা করেছি, তা ক্ষমতার লোভেই করেছি। গত চল্লিশ বছর ধরে আমি সদনের সদস্য। সদস্যরা আমার আচার আচরণ দেখেছেন।’ দেশের নির্বাচনের মেজাজ অনুসারে সবথেকে বেশি সংখ্যক এমপি নিয়ে উঠে আসা দল হিসেবে রাষ্ট্রপতির ডাকে সাড়া না দিয়ে যে তাঁর কাছে আর কোনও উপায় ছিল না সে কথাই তিনি ব্যক্ত করলেন। কথায় কথায় বললেন যে লোকে বলে ‘বাজপেয়ী তো অচ্ছা হ্যাঁয় . মগর পার্টি ঠিক নহিঁ হ্যাঁয়।’ ওয়েল থেকে সুর ভেসে এল, ‘সহি হ্যাঁয়, সহি হ্যাঁয়।’ বাজপেয়ীজি বললেন যে, তিনি ভালো হলে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারেও ভাবা উচিত। দক্ষিণের এক রাজনেতাকে উত্তর দেওয়ার সময় বাজপেয়ীজি একজন তামিল কবি সুব্রাহ্মণিয়ান ভারতীর একটি কবিতা পাঠ করলেন। এই প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রী নিজের ভাষণে তামিল বললেন। ভাজপার নীতি বোঝাতে ইংরেজিতে বললেন, ‘The BJP does not stand for uniformity. We recognize the celebrated India’s plural multi-religious, multilingual and mul- ti-ethnic character.’ দলের হাতে পর্যাপ্ত বহুমত না থাকায় কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলোপ, অযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণ এবং ইউনিফর্ম সিভিল কোড নিয়ে কথা বলা আপাতত বন্ধ রাখলেও পরে তা পুনরুত্থাপিত হবে বলেও জানালেন। বিপক্ষের সাংসদদের থেকে বক্রোক্তি ভেসে আসছিল। তার উত্তরে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, যখন সঙ্গীদের নিয়ে জোট হয়, তখন সঙ্গীরা একটু একটু করে শক্তি জোটকে দেন, এবং নিজের শর্ত একটু একটু করে কমিয়ে নেন। আপোষ না করলে জোট টেকে না।
প্রায় ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের এই ভাষণের মাঝে মাঝেই অন্য পক্ষের নেতারা কথা কাটছিলেন। কটূক্তি করছিলেন। আর তারই মাঝে নিজের বাগ্মীতার পরিচয় দিয়ে ইতিহাস গড়ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বাজেপয়ীজি। দল ভাঙিয়ে, ঘোড়া কেনাবেচা করে সরকার গড়তে তিনি যে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নন তা বুঝিয়ে দিলেন— ‘পার্টি তোড়কর, সত্তাকে লিয়ে নয়া গঠবন্ধন করকে, আগর সত্তা হাথ মে আতি হ্যাঁয় তো ম্যায় অ্যায়সি সত্তা কো চিমটে সে ভি ছুঁনা পসন্দ নহিঁ করুঙ্গা।’ মৃত্যুর থেকে লোকোপবাদ যে তাঁর কাছে অনেক বেশি ভয়ানক তা বললেন স্পষ্ট ভাষায়।
‘… সত্তা কা খেল তো চলেগা। সরকারেঁ আয়েগি, জায়েগি। পার্টিয়াঁ বনেগি, বিগড়েগি। মগর ইয়ে দেশ রেহনা চাহিয়ে। ইস দেশ কা লোকতন্ত্র অমর রেহনা চাহিয়ে।’ সারা দেশ দেখল তাঁদের প্রধানমন্ত্রী যুক্তিপূর্ণ উত্তর দানের শেষে, নির্লোভ ভঙ্গীতে পদত্যাগ করলেন— ‘অধ্যক্ষ মহোদয়, আমি মাননীয় রাষ্ট্রপতির কাছে আমার পদত্যাগ পত্র জমা দিতে চলেছি।’
একেবারে নিখুঁত ফিনিশিং হল। ভাজপা তথা অটলজি বুঝেছিলেন ভারতবর্ষে বিজেতার থেকেও বেশি সম্মান ত্যাগীর। হার কে জিতনে ওয়ালে কো বাজিগর কেহতে হ্যাঁয়!
.
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেস থেকে নিজের নাম বাদ যাওয়ার পরে জ্যোতি বাবু দেবেগৌড়াকে বলেছিলেন, ‘মিস্টার গৌড়া, আপনিই দায়িত্ব নিন।
দেবেগৌড়ার উত্তর ছিল, ‘দলে অন্য অনেকেই আছেন, স্যার।’
স্বভাবসিদ্ধ রাশভারী গলায় জ্যোতি বাবু বলেছিলেন, ‘ওঁদের ঢের চেনা আছে আমার।’
‘স্যার, মাত্র দুবছর হল আমি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছি। আমার কেরিয়ার শেষ হয়ে যাবে। কংগ্রেস আমাদের সরকার চালাতে দেবে না। আপনিই হোন না, স্যার। আমি কর্ণাটকা চালাতে চাই। কংগ্রেস চরণ সিং, ভিপি সিং, চন্দ্রশেখরদের সঙ্গে কী করেছে সবাই জানে। ওরা আমাকেও ছেড়ে কথা বলবে না। প্লিজ স্যার, আমাকে ছেড়ে দিন। তাছাড়া হিন্দি বলতে পারি না ভালো করে। দেশের সব জায়গা চিনি না। আপনি আমাদের মধ্যে সিনিয়র, ছেড়ে দিন, স্যার, ছেড়ে দিন।’
কর্ণাটকায় দেবেগৌড়া যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন এস এস মীণাক্ষীসুন্দরম ছিলেন তাঁর চিফ সেক্রেটারি। ‘৯৬ সালের মে মাসের অন্তিম সপ্তাহে মীণাক্ষীসুন্দরম ওয়াশিংটন ডিসি সফরে গিয়েছিলেন। দেশে ফিরেই ‘অনুগ্রহ’ থেকে ফোন পেলেন। ‘অনুগ্রহ’ হল কর্ণাটকার মুখ্যমন্ত্রীর আধিকারিক বাসভবনের নাম। তড়িঘড়ি করে তিনি যখন সেখানে পৌঁছালেন, তখন দেখলেন দেবেগৌড়ার স্ত্রী চেন্নাম্মা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। চেন্নাম্মা বললেন, ‘উনি এবার দেশ শাসন করতে চলেছেন।’ দেবেগৌড়ার স্ত্রী’র গলায় যথেষ্ট উৎকণ্ঠা ধরা পড়ছিল। ‘জানি না আমাদের জন্য দিল্লিতে কী অপেক্ষা করছে?’
দেবেগৌড়ার পরিবার যেমন চিন্তা করছিল, তেমনি চিন্তা মীণাক্ষীসুন্দরমেরও হচ্ছিল। তাঁকেও পরিবার নিয়ে শিফট হতে হবে যে। কিন্তু দেবেগৌড়ার সঙ্গে দেখা করতেই তিনি বললেন, ‘আপনি পিএমও-তে জয়েন করুন। আমাদের টেনিওর খুব বেশিদিনের হবে না। পরিবারকে দিল্লিতে আনার দরকার নেই। আমিও আনছি না। একটা করে স্যুটকেস থাকলেই কাজ চলে যাবে।’
১লা জুন ১৯৯৬ দেবেগৌড়া দেশের প্রধানমন্ত্রী রূপে শপথ নিলেন। কংগ্রেসের ১৪০ জন এমপি ইউনাইটেড ফ্রন্টকে সমর্থন জোগাল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই— ভাজপা ক্ষমতায় আসতে দেওয়া চলবে না।
ভাজপাকে নাহয় আটকানো গেল, কিন্তু নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতা ছিল কি ইউনাইটেড ফ্রন্টের?
দক্ষিণী দেবেগৌড়ার সঙ্গে আরেক দক্ষিণী নরসিমহা রাওয়ের একটা সুন্দর বোঝাপড়া ছিল। সুখের সেদিন রইল না। পরাজয়ের দায় মাথায় নিয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পার্টি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে নরসিমহা রাওকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হল। তিনটি আলাদা আলাদা দুর্নীতির মামলায় তিনি তখন বিপর্যস্ত। রাও সরে গেলে কংগ্রেস দলের পার্টি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পেলেন সীতারাম কেশরী। কেশরী মশাইয়ের নাকি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুতীব্র বাসনা ও প্রবল তাড়না ছিল। তাছাড়া পুরোনো একটি কেসের প্রেক্ষিতে তাঁর বাড়িতে সিবিআই হানা দিল। বছর ঘোরার আগেই তিনি দেবেগৌড়া সরকারের পায়ের তলার জমি কাঁপিয়ে কংগ্রেসি এমপি-দের সমর্থন প্রত্যাহারকারী চিঠি রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিলেন। কংগ্রেসের এমপিরা পর্যন্ত বুঝতে পারেনি কী ঘটল। কেউ কেউ বলেন, দেবেগৌড়া কংগ্রেসের সাংসদদের ভাঙিয়ে এনে মন্ত্রীত্ব দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নিজের গদি ধরে রাখাটা পাকা করতে চেয়েছিলেন। কেশরী তাই নিজের মতো করে শিক্ষা দিয়েছিলেন দেবেগৌড়াকে। অটলবিহারী ১৩ দিনের প্রধানমন্ত্রী রূপে অন্তিম ভাষণে বলেছিলেন, ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারের জন্ম নেওয়া কঠিন। জন্ম নিলেও তার বেঁচে থাকাটা দুরূহ। ভুল কিছু বলেননি অটলজি।
.
দেবেগৌড়ার পরে প্রত্যেক পক্ষ নিজের নিজের মতো করে কামনা করছিল। কংগ্রেসের কেশরী ভাবছিলেন এবার তিনি দাবি পেশ করবেন ও আঞ্চলিক দলগুলি তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এলেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। ভাজপা চাইছিল ইউনাইটেড ফ্রন্ট ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাক। আর ইউনাইটেড ফ্রন্ট চাইছিল যে করেই হোক সরকারে থাকা যাক— এখন ভোট হলে জেতার ফর্মুলা হাতে নেই। কে প্রধানমন্ত্রী হবেন তাই মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা শুরু হল।
দাবি পেশ করে একাধিক নাম উঠে এল। যেমন?
যেমন মুলায়ম সিং যাদব। মুলায়মের সঙ্গে লালুপ্রসাদ যাদবের রেষারেষি আরম্ভ হল। লালু নিজের নাম এগিয়ে দিলেন। যে মুপানার আগেরবারে কম এমপি থাকায় পাত্তা করতে পারেননি তিনিও পিছিয়ে রইলেন না। উঠে এল কর্ণাটকার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বোম্মাই-এর নাম। করুণানিধির কথাও হচ্ছিল। এসবের মধ্যিখানে তুলনামূলক লাইটওয়েট ইন্দ্র কুমার গুজরালের কথা পালকের মতো ভাসছিল। চন্দ্রবাবু নাইডুর পলিটিক্যাল ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে শেষ অবধি গুজরালকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাঁড় করালেন। দিল্লির অন্ধ্র ভবনে দফায় দফায় বৈঠক চলছিল। গুজরাল নিজে বেশ কয়েকটা মিটিং-এ বসলেও অনেক বৈঠকে তিনি ক্লান্তির কারণে উপস্থিত থাকতে পারেননি। তেলেগু দেশম পার্টির এক সাংসদের জন্য নির্ধারিত ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। গুজরালের নাম স্থির হতেই নাইডু তাঁকে খবর দেওয়ার জন্য লোক পাঠালেন। তখন বাজে রাত দুটো। এক সাংসদ গিয়ে গুজরাল সাহেবের ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, ‘স্যার, আপনি প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন।’ গুজরাল আনন্দে সেই সাংসদকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আবারও কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারে ফিরল। মুকুট উঠল ইন্দ্র কুমার গুজরাল সাহেবের মাথায়।
এপ্রিল ১৯৯৭ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঘটনাবহুল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। বিভিন্ন দলের মধ্যে মতভেদের একাধিক পর্বের পর দেশ নতুন প্রধানমন্ত্রী পেল। ওই মাসের ৮ তারিখে আডবানিজি হাওয়ালা কাণ্ডে সসম্মান অব্যাহতি পেলেন। নানান কারণে বিরক্ত, ক্লান্ত হয়ে আডবানিজি রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। দল অটলজির সুরে চলছিল। তাই দলের জন্য আলাদা করে তাঁর আর কিছু করে দেখানোর অবকাশও ছিল না। দুজনের সম্পর্কের বাঁক বদল হচ্ছিল মিঠেকড়া দিকে।
.
অটল-আডবানিজির সম্পর্কের প্রভাবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি এঁদের দুজনের কারো না হয়ে হল এক তৃতীয় ব্যক্তির। তিনি হলেন কোড়িপকম নীলমেঘাচার্য গোবিন্দাচার্য।
গোবিন্দাচার্য সঙ্ঘের পক্ষ থেকে ভাজপাতে এসেছিলেন। পার্টির জেনারেল সেক্রেটারির পদ সামলাচ্ছিলেন। অটলজি তাঁকে বিশেষ পছন্দ করতেন না। এর একটা ইতিহাস আছে। রামমন্দির আন্দোলনের পর যখন আডবানিজি জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন, তখন সঙ্ঘ চাইছিল তিনিই পার্টির মুখ হিসেবে পরিচিত হোন। মুরলি মনোহর জোশি তখন দলের অধ্যক্ষ। আডবানিজির ইচ্ছে ছিল বাজপেয়ী লোকসভায় প্রতিপক্ষের নেতা রূপে থাকবেন। সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক তখন রাজ্জু ভাইয়া। আডবানিজি গোবিন্দাচার্যকে দিল্লির সঙ্ঘের কার্যালয়ে নিজের বার্তা সহকারে পাঠালেন। রাজ্জু ভাইয়া দূত গোবিন্দাচার্যকে বলে দিয়েছিলেন, এই নিয়ে আর কথা বলার প্রশ্ন ওঠে না, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। বাজপেয়ীজি সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও মনের মধ্যে একটা ধারণা পোষণ করতে শুরু করলেন যে, যা ঘটেছে তার জন্য দায়ী হলেন গোবিন্দাচার্য। কারণ গোবিন্দাচার্য আডবানিজির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। গোবিন্দাচার্যি রাজ্জু ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। পরে গোবিন্দাচার্য এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘রামচন্দ্রের বার্তা লঙ্কার দরবারে নিয়ে গিয়ে হনুমানকে লেজ আর মুখ পোড়াতে হয়েছিল।’
’৯২ সালে ভাজপার একটি রাষ্ট্রীয় অধিবেশনে বাজপেয়ীজি মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমার কাছে গোবিন্দাচার্যজির জন্য একটা প্রশ্ন আছে। একজন নেতার সম্মান বাড়ানোর জন্য কি আরেকজন নেতাকে অপমান করা উচিত?’ তখন বাজপেয়ীজির রাজনৈতিক কেরিয়ারের গ্রাফ ক্রমশ নীচে নামছিল। তাই হয়তো তাঁর কথায় কেউ বিশেষ আমল দেননি। আডবানিজির জনপ্রিয়তা এবং দলে গোবিন্দাচার্যর ক্ষমতা ক্রমশ বাড়ছিল। আডবানিজি অটলজিকে কখনও নিজের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দী রূপে দেখেননি। কিন্তু জোশি-আডবানি দ্বন্দ্বের কথা আগেও লিখেছি, তা এই সময়েরই ফসল। জোশি যেমন কল্যাণ সিং-এর মতো পছন্দসই ব্যক্তিদের প্রশাসনে পাঠাচ্ছিলেন, তেমনি আডবানি ঘনিষ্ঠদের সরিয়ে দিচ্ছিলেন সুকৌশলে। গোবিন্দাচার্যর কপালে তামিলনাড়ুর দায়িত্ব জুটল। দিল্লি থেকে দূরে সরে যেতে হল।
এরই মধ্যে ‘৯২ সালে আরও একটি ঘটনা ঘটে গেল। গুজরাটে ভাজপার কেন্দ্রীয় কার্যসমিতির বৈঠক ছিল। গোবিন্দাচার্য উপস্থিত ছিলেন। অধ্যক্ষ রূপে জোশিজির ভাষণ শেষ হতেই মহারাষ্ট্রের বরিষ্ঠ নেতা রাম নাইক মাইক ধরলেন, ‘অধ্যক্ষ জি, আমাদের একজন মহামন্ত্রী আর একজন মহিলা নেত্রীর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে চর্চা হচ্ছে, এটা কি সত্যি, আমরা স্পষ্ট কথায় ব্যাপারটা জানতে চাইছি?’ তখনই আডবানিজি মাইক নিয়ে বললেন, ‘গোবিন্দাচার্য চেন্নাইতে থাকবে, তামিলনাড়ুর দায়িত্বে। এই নিয়ে আর কোনও কথা হবে না।’ আডবানিজির কথা শেষ হতে না হতেই বাজপেয়ী বাণ ছুঁড়লেন, ‘না আডবানিজি, শুধুমাত্র সরিয়ে দিলে কাজ হবে না। সংগঠনের নাম আর ইমেজ নষ্ট হবে। তাছাড়া আমাদের এখানে কেউ কেউ কাউকে বড় করার জন্য কাউকে ছোট করে থাকে।’ গোবিন্দাচার্য কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আডবানিজি বিরক্তি সহকারে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কিচ্ছু বলার নেই এই নিয়ে, আপনি বসুন।’ গোবিন্দাচাৰ্য বসতে বসতে বলেছিলেন, ‘অটলজি ভুল কথা বললেন।’
এর বেশ কয়েক বছর পর গোবিন্দাচার্য নিজেই বলেছিলেন তিনি ‘সাধ্বীকে ভালোবাসতেন, বিয়েও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ‘সাধ্বী’ রাজী হননি, সঙ্ঘও অনুমতি দেয়নি। এই নিয়ে গোবিন্দাচার্য আডবানিজি এবং সঙ্ঘের ভাউরাও দেওরসের সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। আডবানিজির বক্তব্য ছিল বিয়ে হলে দুই নেতারই রাজনৈতিক ছবি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ১৭ই নভেম্বর, ১৯৯২ সাধ্বী সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। গোবিন্দাচার্য সাধ্বীর পায়ে হাত দিয়ে তাঁকে গুরু বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। রাজনীতির অলিন্দে এক প্রেমকাহিনি এভাবেই ট্রাজিক পরিণতি পেয়েছিল।
এবারে আমি যা বলব, তা যদি আপনাদের বইয়ের কোনও অংশের পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয় তাহলে ক্ষমা করে দেবেন। বলাটা নেহাতই দরকার। কারণ অটলজির আবার উত্থানের পর্বটা আবার মনে করানো প্রয়োজন। এই পর্বেই গোবিন্দাচার্যর প্রস্থান ঘটবে।
১১-১৩ই নভেম্বর ১৯৯৫। ভাজপার মুম্বাই অধিবেশন চলছে। ১২ই নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অধ্যক্ষ হিসেবে বিস্ফোরণ ঘটালেন আডবানিজি। ভাজপার রাজনৈতিক শৃঙ্গে বসে লালকৃষ্ণ আডবানি বললেন ১৯৯৬ সালে হতে চলা ভোটে ভাজপার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী পদের মুখ হবেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। মঞ্চে বসে থাকা অটলজি চমকে উঠলেন। সভাগারে তখন পিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে। পর মুহূর্তেই হাততালিতে ফেটে পড়ল সভাকক্ষ। ভাষণ সমাপ্ত হতেই আডবানিজিকে ধরে অটলবিহারী বললেন, ‘ইয়ে কেয়া কর দিয়া আপনে, মুঝসে তো পুছ লিয়া হোতা?’ আডবানিজি উত্তর দিলেন, ‘পুছতা তো কেয়া আপ মান জাতে?’ এরপর যখন অটলবিহারী বাজপেয়ীর বলার পালা এল, তিনি বললেন, ‘আডবানিই আমাদের প্রধানমন্ত্রী হবেন।’ ঠিক সেই মুহূর্তে একটি ঐতিহাসিক ক্যাচলানের জন্ম দিলেন আডবানিজি— ‘অগলি বারি, অটলবিহারী।’ ওই বিন্দু থেকেই শুরু হল অটলবিহারীর পুনরুত্থান পর্ব।
আমরা এবার ফিরে যাব ১৯৯৭ সালে। সঙ্ঘের মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’ ক’দিন ধরেই বাজপেয়ীজির বিরুদ্ধে নানান লেখা ছাপছিল। বাজপেয়ীজি দেখেও দেখছিলেন না। এবারে গোবিন্দাচার্যর বয়ান দিয়ে ভানুপ্রতাপ শুক্ল একটি লেখা ছাপলেন, জাতে বাজপেয়ীকে ‘মুখৌটা’ (মুখোশ) বলা হল। এর পিছনের ঘটনাটা একটু দেখে নেওয়া যাক। ১৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ ব্রিটিশ হাইকমিশনের দুজন আধিকারিক ভাজপার জেনারেল সেক্রেটারি গোবিন্দাচার্যর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এই সাক্ষাৎকারের প্রায় তিন সপ্তাহ পরে ৬ই অক্টোবর ১৯৯৭ হেডলাইন বেরোল— ‘বাজপেয়ী মুখৌটা হ্যাঁয় -গোবিন্দাচার্য’। লেখার মধ্যে দুপক্ষের সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলা হল গোবিন্দাচার্য বাজপেয়ীকে দলের মুখোশ বলেছেন। প্রশ্ন উঠল যে, দলের এহেন মুখের প্রতি এমন কথা বলা হলে দলীয় শৃঙ্খলার কী দশা হবে? আডবানিজি গোবিন্দাচার্যকে জিজ্ঞাসা করতে তিনি বললেন এমন কোনও কথাই হয়নি। তখন আডবানিজি বললেন, তাহলে এই বক্তব্য লিখিতভাবে খণ্ডন করে পাঠান। খণ্ডনপত্র পাঠানো হল। বিকেল চারটের সময় গোবিন্দাচার্যর কাছে ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে ফোন এল— এ ধরণের কথাই হয়নি, কীভাবে ছাপা হল। গোবিন্দাচার্য বললেন, ‘আপনারা লিখিত আকারে এই খবরের খণ্ডন পাঠান।’ সন্ধে ছ’টা নাগাদ তাও এসে গেল। পরদিন বিভিন্ন খবরের কাগজে দুটি খণ্ডনপত্রই ছাপা হল। বাজপেয়ীজি তখন বুলগেরিয়া সফর থেকে সদ্য ফিরেছেন। তিনি ফোনে ধরলেন সঙ্ঘের তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক কে এস সুদর্শনকে। সুদর্শন সব শুনে গোবিন্দাচার্যকে ফোন করলেন, ‘অটলজি বলছেন আপনাদের কথোপকথনের টেপ রেকর্ডিং আছে।’ গোবিন্দাচার্য বললেন, ‘তাহলে তো আরও ভালো হল, পরিষ্কার হয়ে যাবে যে আমি এরকম কিছু বলিইনি।’ তেমন কোনও টেপ সামনে আসেনি। কিন্তু চিঠি এল। বাজপেয়ীজি লিখলেন। একটি গোবিন্দাচার্যকে। অপরটি উত্তর প্রদেশ ভাজপার অধ্যক্ষ লালজি ট্যান্ডনকে। গোবিন্দাচার্যকে বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে বললেন। লালজি ট্যান্ডনকে লেখা চিঠির বয়ান ছিল, ‘শ্রী গোবিন্দাচার্যর ইন্টারভিউ পড়লাম। নিশ্চয়ই আপনিও পড়েছেন। বিজয়াদশমীর শুভেচ্ছা জানবেন।’ সঙ্কেত সাফ ছিল। গোবিন্দাচার্যর রাজনৈতিক বধের সময় উপস্থিত। দুটো চিঠিই মিডিয়াতে লিক হল, কেন কীভাবে তা ভগবানই জানবেন। ঝড় উঠতে চলেছিল। ভাজপার অভ্যন্তরে তখন শ্মশানের নীরবতা।
পরদিনই দিল্লিতে একটি বইয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে সঙ্ঘের এবং ভাজপার পক্ষ থেকে দিগগজ ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন। প্রধান বক্তা ছিলেন বাজপেয়ী। তিনি চিরপরিচিত ভঙ্গীতে বললেন, ‘আমি অবাক হচ্ছি যে আমাকে বলার জন্য কেন ডাকা হয়, একটা মুখোশের কী এমন গুরুত্ব আছে?’ এর দুদিন পরে ছিল ভাজপার যুবা মোর্চার অধিবেশন। সেখানেও বাজপেয়ী মুখ খুললেন। ‘রাজনৈতিক দল প্রধানমন্ত্রী তৈরি করে না, জনগণ প্রধানমন্ত্রী বানায়।’
গোবিন্দাচার্যকে সরতে হয়। স্টাডি লিভ নিয়ে তিনি চেন্নাইতে ফিরে যান। দুজনের সম্পর্ক বাজপেয়ীজির জীবদ্দশাতে আর ঠিক হয়নি। ২০০৩ সালে একটি অনুষ্ঠানে বাজপেয়ীজি এবং গোবিন্দাচার্যর আবার দেখা হয়েছিল। গোবিন্দাচার্য নিজের কাজের কথা বলে বাজপেয়ীজিকে বলেছিলেন, ‘আশীর্বাদ করুন।’ বাজপেয়ীজি বলেছিলেন, ‘আমি আশীর্বাদ দেওয়ার যোগ্য নই।’ গোবিন্দাচার্য বলেছিলেন, ‘তাহলে শুভকামনাই দিন।’ বাজপেয়ীজি শুভকামনা জানিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন।
.
গোবিন্দাচার্য পর্ব যখন ভাজপার অভ্যন্তরে ঝড় তুলেছিল, তখন রাজনীতির দাঁড়িপাল্লার অন্য দিকে এমন কিছু ঘটছিল যা আবার সরকারকে পতনোন্মুখ করে তুলল। আগস্ট ১৯৯৭, সোনিয়া গান্ধী একজন নিজের গৃহবধূ পর্ব কাটিয়ে উঠে কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্যতা পদ গ্রহণ করলেন। এর প্রায় দুমাসের মাথায়, ৯ই নভেম্বর ১৯৯৭ একটি খবর সংবাদপত্রে বেরোল— রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডে দক্ষিণ ভারতের ডিএমকে-এর যোগসূত্র ছিল। কংগ্রেস ধন্ধে পড়ে গেল। এই ডিএমকে ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারকে সমর্থন জুগিয়ে চলেছিল। এমতাবস্থায় কংগ্রেস কীভাবে সরকারের সমর্থন করতে পারে? ২৮শে নভেম্বর ১৯৯৭ কংগ্রেস আরও একটি বার ইউনাইটেড ফ্রন্টের সরকারের পাশ থেকে সরে দাঁড়াল। আবার ভোট আসতে চলেছিল। ভাজপা এটাই চাইছিল। এবারে দলের সেনাপতি ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। মুখোশ দলের মুখ হয়ে উঠল।
.
’৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ভাজপা যে নমনীয়তা অর্জন করেছিল, তার পরিশীলিত বহিঃপ্রকাশ দেখা দিল ‘৯৮ সালের নির্বাচনের আগে। দল হিন্দুত্বের হার্ড লাইনের বাইরে যাচ্ছিল। একটি ইফতার পার্টিতে ফেজ টুপি পরিহিত বাজপেয়ীজিকে দেখা গেল।
ভাজপার এই নব রূপের জন্যই হোক কিংবা ইউনাইটেড ফ্রন্টের ব্যর্থতার কারণে, বিভিন্ন ছোট আঞ্চলিক দল বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল ভাজপা বিনা গতি নাই। জোটসঙ্গী রূপে এগিয়ে এল জয়ললিতার এআইএডিএমকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। কর্ণাটকার রামকৃষ্ণ হেগড়ে, ওড়িশার নবীন পট্টনায়কের মতো ব্যক্তিরাও সঙ্গ দিলেন। নির্বাচনী প্রচারের সময়ে অতি সতর্কভাবে সুশাসনের ওপরেই জোর দিতে লাগলেন বাজপেয়ীজি।
দলের মধ্যে থেকেই মাঝে মাঝে আওয়াজ উঠল, আডবানিজি আমাদের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিছু মানুষ বুঝে বা না-বুঝে এই কাজটা করছিলেন। অটল- আডবানি জুটির মধ্যে ভাঙন ধরানোর কোনও চেষ্টাই সফল হল না। আডবানিজি নিজের জন্য কোনও আশাই পোষণ করেননি।
দল নিজের কট্টর দাবিগুলি থেকে সরে আসছে দেখে প্রশ্ন উঠল। ভাজপার জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে নরেন্দ্র মোদি সতর্কভাবে সেসব প্রশ্নের জবাবে বললেন, যা ভাজপার দীর্ঘদিনের ইস্যু তা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই।
মার্চ ১৯৯৮। নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হল। কংগ্রেসের পতন জারি রইল, ১৪১টি আসন পেল। ভাজপা ১৬১ থেকে বেড়ে ১৮২ হয়ে দাঁড়াল। ইউনাইটেড ফ্রন্ট পেল ৮৬টি সিট।
ভাজপা এবার আসন সংখ্যার নিরিখে দেশের সবথেকে বড় দল হয়ে দাঁড়াল। ফলে ছট-বড় অনেক দলই ভাজপার সঙ্গে সরকার গঠন করতে রাজী হয়ে গেল। জোটের জন্য ভাজপা নিজেদের ঘোষণা পত্রের তিনটি প্রধান বিন্দু (জম্মু-কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার বিলোপ, রামমন্দির নির্মাণ, ইউনিফর্ম সিভিল কোড)কে সরিয়ে নতুন ঘোষণা পত্র তৈরি করল, নাম দেওয়া হল ‘National Agenda for Governance’.
এবারে ভারতের মহামহিমের আসনে ছিলেন কে আর নারায়ণন। তিনি পুরানো কংগ্রেসি। ভাজপাকে মোটেই পছন্দ করতেন না। শঙ্কর দয়াল শর্মার মতো ঔদার্য না দেখিয়ে প্রথমেই ভাজপাকে বলে দিলেন, জোট সঙ্গীদের পক্ষ থেকে সমর্থনের চিঠি সহ সংখ্যা গরিষ্ঠতার প্রমাণ দিতে হবে। তারপরেই সরকার গঠনের অনুমতি মিলবে।
চিঠি এল। ওই মাসেই। বাজপেয়ীজি আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। এবারে আগেরবারের তুলনায় অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। কারণ সঙ্গে পেয়েছিলেন নিজের বহুদিনের ছায়াসঙ্গী আডবানিকে। দুজন প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের রাজনৈতিক যুগলবন্দি এবার অন্তিম অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চলেছিল।
.
৭, সফদরজঙ্গ রোড। ওখানেই তখন বাজপেয়ীজির নিবাস, ভাজপার সঙ্গ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন দল বৈঠকে বসল। আডবানিজি ভাজপার সহযোগী দলগুলিকে নিয়ে তৈরি হতে চলা জোটের জন্য একটি নাম প্রস্তাবিত করলেন— ন্যাশন্যাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স বা এনডিএ। ১৯৫১ সালের ভোটে ভারতীয় জনসঙ্ঘ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রতিপক্ষের জোট ‘ন্যাশন্যাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট’-এর হয়ে লড়েছিল, এই ব্যাপারটাকে মাথায় রেখেই আডবানিজি এহেন নামকরণ করেছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবেই বাজপেয়ীজিকে জোটের মুখ বা নেতা বলে বেছে নেওয়া হল। এনডিএ-এর অনেক দলই প্রথমবার এভাবে জোটে এসেছিল। ‘৯৬ সালে মাত্র চারটি দলের সমর্থন নিয়ে আসা ভাজপা এবারে তেরোটি দলের জোট তৈরি করে ফেলল।
আগেই বললাম, রাষ্ট্রপতি সরকার গঠন করার আমন্ত্রণ করতে বিলম্ব করছিলেন। একে তো দশ দিন দেরীতে আমন্ত্রণ জানালেন। তার পরে বললেন ভাজপাকে সমর্থনকারী দলগুলির নামের তালিকা আর চিঠি নিয়ে এসো। ভাজপার নেতারা সমর্থন-সূচী জমা দেওয়ার সময় তাড়াহুড়োতে সবার পক্ষ থেকে চিঠি আনালেও একজনের তরফের লিখিত সমর্থনপত্র আনাতে ভুলে গেলেন। তিনি হলেন জয়ললিতা। তাঁর দল এআইএডিএমকে-এর ১৮জন সাংসদের সমর্থনের বিনিময়ে তিনি কয়েকটা শর্ত বাজপেয়ীজির সামনে রাখলেন। তাঁর মধ্যে দুটো নিয়েই যত দ্বন্দ্ব।
১. তামিলনাড়ুতে তাঁর বিরোধী করুণানিধির সরকারকে বরখাস্ত করে দিতে হবে।
২. সুব্রাহ্মণিয়ান স্বামীকে দেশের অর্থমন্ত্রী করতে হবে। সেই সময়ের জন্য জয়ললিতাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজ উদ্ধার করা হল।
সাধারণত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান রাষ্ট্রপতি ভবনের অশোকা হলে হয়ে থাকে। এবারে ভবনের মাঠে হচ্ছিল। ম্যদানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জয়পুর স্তম্ভ শপথগ্রহণ সমারোহের সাক্ষী থাকতে চলেছিল। সেদিনের সবথেকে বড় প্রশ্ন ছিল বাজপেয়ীর সরকারে অর্থমন্ত্রী কে হতে চলেছেন। স্বামীর কপালে শিকে ছিঁড়ল না এবারেও। ‘এবারেও’ কেন বললাম? আগের বারে চন্দ্রশেখরের সরকারেও তিনি অর্থমন্ত্রক পাওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তখন চন্দ্রশেখর যশবন্ত সিনহাকে অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব সঁপেন।
স্বামীর নাম নাহয় বাজপেয়ী বাদ রেখেছিলেন, তাহলে কাকে অর্থমন্ত্রী করার কথা চলছিল। এক্ষেত্রে নাম উঠে আসছিল স্বতন্ত্র পার্টির জশবন্ত সিং-এর নাম। প্রাক্তন এই ফৌজি দেশের পরবর্তী বাজেট পেশ করবেন এমনটাই খবর ভাসছিল রাজনীতির গলিতে।
বাজপেয়ী এবারে একটা অলিখিত প্যাটার্ন অনুসরণ করছিলেন। আডবানিজি বাদ দিয়ে তাঁর কিচেন ক্যাবিনেটের আগামী নামগুলির মধ্যে সঙ্ঘের লোক থাকার সম্ভাবনা কম ছিল। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক দিতে চলেছিলেন বাইরে থেকে আসা ব্যক্তিদের। যেমন বিদেশমন্ত্রী হিসেবে জনতা দল থেকে ভাজপায় আগত যশবন্ত সিনহার নাম ভাসছিল, প্রতিরক্ষা দায়িত্ব পেতে চলেছিলেন সমতা পার্টির জর্জ ফার্নান্ডেজ।
এই নীলনকশা কেউ ধরতে পারুন বা না-পারুন, একজনের চোখে ঠিকই ধরা পড়েছিল। ১৯শে মার্চ ১৯৯৮ ছিল শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। ঠিক তার আগের দিন সন্ধ্যায় তিনি হবু প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছে গিয়েছিলেন। বাজপেয়ীজি তখন রাতের খাওয়া সারছেন, একজন ভৃত্য এসে খবর দিল ‘সুদর্শনজি এসেছেন।’
কে এস সুদর্শন। সঙ্ঘের তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক। তাঁর সঙ্গে বাজপেয়ীজির রুদ্ধদ্বার মোলাকাত প্রায় এক ঘণ্টা দীর্ঘ হয়েছিল। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে বাজপেয়ীজি মন্ত্রীতালিকায় রদবদল করেছিলেন। সকালে শক্তি সিনহা ও কাঞ্চন দাশগুপ্তকে তিনি মন্ত্রীপদের জন্য যে নামতালিকা দিয়েছিলেন, সেখান থেকে দুটি নাম বাদ পড়ল।
কান পাতলে শোনা যায় সুদর্শনজিই নাকি ওই রদবদলের কাণ্ডারী। তাঁর জোরাজুরিতেই নাকি জশবন্ত সিং-এর নাম অর্থমন্ত্রক থেকে সরে গিয়েছিল। বাদ যাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। সঙ্ঘ এবং স্বয়ংসেবকদের প্রতি সিং -এর দৃষ্টিভঙ্গী খুব একটা ভালো ছিল না। তিনি নাকি সুদর্শনকে নিয়ে নানান কথা বলতেন। সঙ্ঘের অর্থনীতির সঙ্গে তাঁর অর্থনৈতিক ধ্যানধারণার আকাশ-পাতাল ফারাক ছিল।
তাহলে কার নাম এল অর্থমন্ত্রী হিসেবে?
যশবন্ত সিনহার। সিনহার নাম আসার যথেষ্ট কারণ ছিল। সিনহা ‘৯৪ সাল থেকেই সঙ্ঘের স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে জুড়েছিলেন। হাজারিবাগ থেকে পটনা পর্যন্ত আড়াইশো কিলোমিটারের সাইকেল যাত্রা করেছিলেন।
রাজনীতিতে রাজনীতিকদের এক জীবনেই অনেক জীবন কাটাতে হয়। সেখানে কখন কী পরিবর্তন আসে তা আগে থেকে বোঝা অসাধ্য। শপথগ্রহণের কিছুদিন আগে টিভি চ্যানেলে একটি বিতর্কসভায় উপস্থিত যশবন্ত সিনহাকে টিভি অ্যাঙ্কর প্রশ্ন করেছিলেন, ‘অগলা বিত্ত মন্ত্রী কৌন হোগা?’ সিনহা জবাব দিয়েছিলেন, ‘এটা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষাধিকার, তবে আমি আস্থাবান যে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পেতে তাঁকে বিশেষ বেগ পেতে হবে না।’ আবার প্রশ্ন ধেয়ে এল অ্যাঙ্করের পক্ষ থেকে— ‘আপনিও তো এর আগে একবার অর্থমন্ত্রী ছিলেন?’ সিনহা কোনও উত্তর না দিয়ে শুধু হেসেছিলেন।
ভোটের ফল বেরোনোর পর থেকে সিনহা যেখানেই যাচ্ছিলেন সেখানেই তাঁর অর্থমন্ত্রী হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছিল। কিছুটা বিরক্ত হয়েই সিনহা দিল্লি থেকে পটনায় ফিরে গিয়েছিলেন। ঠিক করে নিয়েছিলেন, এবার দিল্লি থেকে ডাক এলে তবেই যাব। তিনি খবর পেলেন ১৯শে মার্চ শপথগ্রহণ সমারোহ। ডাক আর আসে না। অবশেষে ১৮ই মার্চ গোবিন্দাচার্য ফোন করে বললেন, ‘দিল্লিতে আসুন।’ সিনহা রাত দশটায় দিল্লিতে নামলেন। নিজের ডেরায় পৌঁছে খবর নিলেন আডবানিজি বা অটলজির কোনও মেসেজ আছে কিনা। জবাব মিলল, ‘না’। সিনহা ধরেই নিয়েছিলেন এবারে তাঁকে মন্ত্রী করা হচ্ছে না। এবং তাঁর সমস্ত ভাবনার জাল ছিন্ন করে রাত ১১টা নাগাদ আডবানিজির ফোন এল। তিনি বললেন, ‘সবেরে রাষ্ট্রপতি ভবন পঁওঁচে।’ সিনহার কাছে এরপর আরও একটি ফোন এল। সিনহার এক বন্ধু তাঁকে ফোন করে জানালেন যে, তাঁকে বাণিজ্য মন্ত্রকের দায়িত্ব প্রদান করা হবে। সিনহা খুশিই হলেন। এ ধরণের রাত সাধারণত খুব দীর্ঘ মনে হয়। ভোরবেলায় আবার ওই বন্ধু ফোন করলেন। খবর একটু অন্যরকম। সিনহার ভাগে অর্থমন্ত্রক আসতে চলেছে। সিনহা অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর জ্ঞানমতো এই বিভাগের দায়িত্ব জশবন্ত সিং পেতে চলেছিলেন। তিনি শুনলেন আরএসএস বলেছে, হেরে যাওয়া ক্যান্ডিডেটদের মন্ত্রীপদে বসানো চলবে না। এই ফর্মুলা সত্যি হলেও হতে পারে, কারণ বাজপেয়ীজির দুই প্রিয় পাত্র জশবন্ত সিং ও প্রমোদ মহাজন সেবারের শপথগ্রহণে মন্ত্রীত্ব পাননি। দুজনেই সেবারের ভোটে হেরে গিয়েছিলেন। তবে বাজপেয়ীজিও নাক ঘুরিয়ে ধরতে জানতেন। জশবন্ত সিংকে যোজনা আয়োগের উপাধ্যক্ষ এবং প্রমোদ মহাজনকে নিজের রাজনৈতিক উপদেষ্টা বানিয়ে তিনি নিজের জেদ বজায় রেখেছিলেন। সঙ্ঘ এই দুটি নিয়োগের কোনও বিরোধ করতে পারেনি।
.
নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে জোটকে আরও মজবুত করে তুলে সরকার চালনার দিকে মন দিচ্ছিলেন অটলজি। নিজের রাজনৈতিক জীবনের চল্লিশ বছর পেরিয়ে আসার পর তিনি এই সুযোগটাকে ঐতিহাসিক রূপ দিতে চাইছিলেন। ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী বাজপেয়ীজি বুঝতে পারছিলেন যে সরকার ও দেশ উভয়ের জন্যই এমন কোনও বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার জাতে ছোটখাটো সমস্যা, অভিযোগের দিক থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে আসবে।
’৯৬ সালে যখন বাজপেয়ীজি ১৩ দিনের সরকারে প্রধানমন্ত্রী হয়ে আসেন, তখন নরসিমহা রাও একটা ‘হ্যান্ডওভার’ করতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘সামগ্রী তৈয়ার হ্যাঁয়!’ হয়েছিল কি, ১৯৯১-১৯৯৬ এই পর্বে নরসিমহা রাও ভারতকে পরমাণু শক্তিতে পরিণত করার কাজটা প্রায় সম্পূর্ণ করে ফেলেছিলেন। ইত্যবসরে তিনি ভোটে হেরে বিদায়ী হন। নতুন সরকার এলেও ডামাডোলের বাজারে পরমাণু-পরীক্ষণ করে দেখানোর সাধ বা সাধ্য মেটাতে পারেনি। ওই কাজটা পূর্ণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন বাজপেয়ীজি। এপ্রিল ১৯৯৮-তে অটলজি সবুজ সঙ্কেত দিলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন