সেই ফুলের দল – ২০

অভীক মুখোপাধ্যায়

মে মাসের প্রথম সপ্তাহ ১৯৯৮। তিনটি পরমাণু বোমা ট্রম্বে থেকে রাজস্থানের পোখরানের দিকে চলেছে। আমেরিকার কৃত্রিম উপগ্রহে যাতে সেই ছবি ধরা না পড়ে তার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে রাতের অন্ধকারকে। চাঁদের আলোতেই মরুভূমির বুকে বসছে রেললাইন, সিসমোগ্রাফ। রাতের অন্ধকারে আলো না জ্বালিয়ে কাজ করে চলেছে খননের যন্ত্র, ভার উত্তোলনের মেশিন, অজস্র ট্রাক। সিনের আলো ফোটার আগেই সেগুলিকে নিরাপদ স্থানে এমনভাবে সেঁধিয়ে দেওয়া হচ্ছে যেন রাতে কিছুই ঘটেনি। মরুভূমির বুক চিরে ‘কেবল’ গিয়েছে, অজস্র কাঁটাঝোপ তুলে ‘কেবল’ বসিয়ে আবার কাঁটাঝোপগুলিকে যথাস্থানে রোপণ করে দেওয়া হয়েছে। সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময় প্রচুর বালি উঠেছে। সেই বালি দিয়ে বালিয়াড়ি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই বালিয়াড়ি যে প্রাকৃতিক নয় তা বোঝার সাধ্যি কারো নেই।

T-7 (7 days prior to testing) ৪ঠা মে ১৯৯৮। বাজপেয়ীজি নিজের এক ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে নিজের বাড়িতে ডাকলেন। কথা বলার জন্য বেছে নিলেন নিজের বেডরুম। সম্ভবত তার চেয়ে সুরক্ষিত স্থান গোটা ভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই। নিজের মন্ত্রীকে পরমাণু পরীক্ষণের দিনক্ষণ জানালেন অটলজি।

T-1 (1 day prior to testing) ১০ই মে। রাতের মধ্যে ২০০ মিটার একটি গভীর টানেলে একখানা মহা শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমাকে প্রবেশ করানো হল। এই টানেল আগে থেকে খোঁড়া ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর সময়কালে পোখরানে এখানেই নিউক্লিয়ার টেস্ট করা হয়েছিল, টানেলের নাম ‘হোয়াইট হাউজ’। পাশাপাশি আরও একটি টানেল, ‘তাজমহল’। তাজমহলের গভীরতা ১৫০ মিটার। সেখানে প্রবেশ করল একটি প্লুটোনিয়াম বম্ব। ইন্দিরা আমলের দুটি টানেলকে ব্যতিরেকেও এবারে আরও একটি নতুন সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়েছিল। তার নাম ‘কুম্ভকর্ণ’। কুম্ভকর্ণে রাখা হল একটি সাব-কিলোটন বোমা। এবারে অনুমতি নেওয়ার পালা। প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে বসে ‘ইয়েস’ বললেন।

সেই রাতে জশবন্ত সিং নিজের বাসভবনে স্ত্রী’কে বললেন, ‘কাল আমাকে বেরোতে হবে।’

‘কাল? কাল তো বুদ্ধ পূর্ণিমা! গেজেটেড হলিডে।’

‘কাল আমাদের পরীক্ষা আছে।’

.

১১ই মে ১৯৯৮। পোখরান। সকাল থেকে ঝড় হাওয়া মরুভূমির বুক থেকে বালি উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে পোখরানের বসতি অঞ্চলের দিকে। বিজ্ঞানীরা চিন্তায় পড়লেন। এখন টেস্টিং করা হলে তেজস্ক্রিয় বিকিরণে শহরের মানুষ ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। শুরু হল অপেক্ষা।

.

সেদিনই প্রধানমন্ত্রী নিজের আধিকারিক বাসভবনে প্রবেশ করেছেন। দুপুর তিনটে নাগাদ মেজর জেনারেল পৃথ্বীরাজের ফোন এল। ‘হাওয়ার বেগ কমতে শুরু করেছে। আপনার সম্মতি চাই।’ প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘আগে বঢ়ো!’

কুম্ভকরণ জাগ গয়া— কুম্ভকর্ণ জেগে উঠল। জাগালেন মেজর জেনারেল পৃথ্বীরাজ। সঙ্গে মেজর জেনারেল নটরাজ। ভারতীয় সেনার হয়ে এই দুই কর্তা সেদিন প্রধানমন্ত্রির হয়ে কুম্ভকর্ণকে জাগানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ধরিত্রীর গর্ভে শায়িত কুম্ভকর্ণ জেগে উঠতেই মাটি কেঁপে উঠল। তিন তিনটি মহা শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণে ভাঁজ পড়ল ধরণী মায়ের কপালে। মনে হল প্রলয় আসছে।

মহাকবি তুলসিদাস রামচরিতমানসে লঙ্কেশ রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণকে সবসময় ঘুমন্ত দেখিয়েছিলেন। বলা হয়, সে নাকি বছরের ছ’মাস ঘুমোতো, আর ছ’মাস জাগত। ১১ই মে ১৯৯৮, দুপুর ৩:৪৫ কুম্ভকর্ণ জাগ্রত হল। নিজেকে দুনিয়ার দাদা বলে অহংকার করা আমেরিকার চোখের ঘুম উড়ে গেল।

.

তবে সেদিন সাফল্যের খবর না আসা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নিবাসে উপস্থিত সাত ব্যক্তির মনেও শান্তি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী, গৃহমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবানি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্দেজ, যোজনা আয়োগের উপাধ্যক্ষ জশবন্ত সিং, অর্থ মন্ত্রী যশবন্ত সিনহা, প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক উপদেষ্টা প্রমোদ মহাজন, এবং প্রধান সচিব ব্রজেশ মিশ্রা। তাঁরা একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন, একবার ফোনের দিকে।

ফোন বেজে উঠল। ব্রজেশ মিশ্রা রিসিভ করলেন। ওপার থেকে কথা কানে আসতেই চোখ চকচক করে উঠল তাঁর, মুখে বিজয়ীর হাসি। মিশা ফোনের রিসিভার হাতে ধরেই বললেন, ‘তিনটে পঁয়তাল্লিশে টেস্টিং হয়েছে। সাকসেসফুল তিনটে টেস্টই।’ বাকিদের মুখের পেশির টানটান ভাব এবার উধাও হল। আডবানিজির চোখে জল। কিচ্ছু না বলে তিনি বাজপেয়ীজিকে আলিঙ্গন করলেন। দেশে-বিদেশে বিস্ফোরণের খবর দেওয়ার আগে বাজপেয়ীজি ডক্টর মনমোহন সিং এবং সোনিয়া গান্ধীকে নিজের বাসভবনে ডেকে নিজে বিস্তারে সব জানালেন।

বিকেল পাঁচটায় প্রেস কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী পরমাণু পরীক্ষণের বার্তা দেশ তথা বিশ্ববাসীর সামনে রাখলেন। সবাই হতবাক। তাবড় তাবড় দেশের শক্তিসম্পন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলির চোখে ধুলো দিয়ে শক্তি পরীক্ষণ করা প্রায় অসম্ভব কাজই ছিল। ওই দিন সকালেই প্রধানমন্ত্রী সেভেন আর সি আর-এ পা রেখেছিলেন। এমন গ্র্যান্ড এন্ট্রি এর আগে না কোনও প্রাইম মিনিস্টারের হয়েছিল, না এর পরে কখনও কোনও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সেভেন আর সি আর -এ প্রবেশের সমান্তরালে ভারত বিশ্বের নিউক্লিয়ার ক্লাবে এন্ট্রি নিল। পোখরানের কাঁপন অটলবিহারী বাজপেয়ীকে সম্ভবত ভারতের সবথেকে মজবুত প্রধানমন্ত্রী রূপে প্রতিষ্ঠিত করে দিল। নায়কের প্রবেশে থ্রিলার গল্প ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগোচ্ছিল।

‘৬২ সালের যুদ্ধে চিনের সামনে ভারতকে হার মানতে হয়েছিল। বাজপেয়ীজি সেই পরাভবের কাহিনি ভুলতে পারেননি। পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের ইচ্ছা নিয়ে এই অস্ত্রকে তৈরি করা হয়নি। কাউকে ভয় দেখানোও উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু আত্মরক্ষার তাগিদই কুম্ভকর্ণকে জাগিয়ে তুলেছিল। পরমাণু বোমার প্রেক্ষিতে ‘ভারত শান্তির দেশ’ ইত্যাদি প্রসঙ্গে অটলজি হিন্দি সাহিত্যের বিখ্যাত কবি রামধারী সিং দিনকরের একটি কবিতার পঙক্তি আওড়াতেন— ‘ক্ষমা শোভতি উস ভুজঙ্গ কো জিসকে পাস গরল হো— সেই সাপেরই ক্ষমা করা সাজে, যার কাছে বিষ আছে।’ পরম পূজনীয় শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বাণীও তো কিছুটা এমনই ছিল, না কামড়ালেও ফোঁস করবি।

প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পোখরানের পরেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। পাকিস্তান পরবর্তী পনেরো দিনে ছ’টা পারমাণবিক পরীক্ষণ করে শক্তির পালটা প্রদর্শন করে দেখাল

আমেরিকা ভারতের ওপরে স্যাংশন জারী করল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে রেস্ট্রিকশন তথা নিষেধাজ্ঞার জাল কাটার জন্য প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। এগুলো সাদা চোখে ধরা পড়ছিল, খবরে আসছিল। কিন্তু একজনের প্রয়াস কেউ দেখতে না পেলেও তা ভারতের ক্ষেত্রে মঙ্গলদায়ক হয়ে উঠেছিল। বছর সাতচল্লিশের একজন গুজরাতি তখন আমেরিকাতে প্রবাস কাটাচ্ছেন। আমেরিকাতে থাকা প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে তাঁর বেশ চেনাশোনা তৈরি হয়েছে। বিশেষত আমেরিকার উত্তরের দিকটাতে পটেল সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে তাঁর বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। পোখরানে নিউক্লিয়ার টেস্টের পরই তিনি নিজের পরিচিত মহলের লবিকে কাজে লাগিয়ে ইউএস কংগ্রেসের স্যাংশনগুলোকে শিথিল করার সর্বৈব প্রয়াস শুরু করে দিলেন। কাজও হল ম্যাজিকের মতো। সেদিনের সেই গুজরাতি ব্যক্তিকে চিনে ফেলেছেন নিশ্চয়ই। নরেন্দ্র মোদি। বাঘেলা বিদ্রোহের পরে গুজরাত থেকে নিষ্কাশিত মোদি তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের পক্ষে লড়ছিলেন।

অপর এক গুজরাতি যুবক আবার বাজপেয়ীজিকে পোখরান টেস্ট নিয়ে চিঠি লিখলেন। তিনি নারাজ ছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, বাজপেয়ীজির এই কাজের ফলে আমরা পাক-অধিকৃত কাশ্মীরকে চিরতরের জন্য হারিয়ে ফেললাম। এই যুবক ভাজপার একনিষ্ঠ কর্মী। বাজপেয়ীজি তাঁকে চিনতেন। তাই ডেকে পাঠালেন দিল্লিতে। সামনাসামনি বসিয়ে জানতে চাইলেন এমনটা লেখার কারণ কী। যুবক বললেন, ‘মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। মোরারজি চাইলেই পরামণু অস্ত্র তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, যদি আমরা (ভারত ও পাকিস্তান) উভয়েই পরমাণু শক্তিধর হয়ে উঠলে আমরা কোনও দিনই যুদ্ধের মাধ্যমে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরকে ফিরিয়ে আনতে পারব না।’ বাজপেয়ী আর কথা বাড়াননি। অখণ্ড ভারত নির্মাণের চেয়ে তাঁর কাছে বিশ্বের দরবারে ভারতের ভাবমূর্তি শক্তপোক্ত করা বেশি জরুরি মনে হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, সেদিন পত্রাঘাতকারী সেই যুবক ছিলেন অমিত শাহ।

.

১৫ই আগস্ট ১৯৯৮। পোখরানে শক্তি পরীক্ষণের পরে তখন দেশের মধ্যে অন্য ধরণের আমেজ এবং আত্মবিশ্বাসের ঢেউ। দেশের বাইরে ঠিক বিপরীত অবস্থা। আমেরিকার ইকোনমিক স্যাংশন নিয়ে তো লিখলামই। সুগ্রীব দোসরের মতো পাকিস্তান আগে থেকেই উপস্থিত ছিল।

লালকেল্লার প্রাচীরে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলনের পরে ভাষণে বললেন, ‘ভারত একটি মহান দেশ। আমাদের জনগণ পরাক্রমী। নিজেদের গৌরবের জন্য এই সাহসী জনতা যে কোনও সঙ্কটের মোকাবিলা করতে পারে। অতীতে আমরা বারে বারে নিজেদের সাহসের পরিচয় দিয়েছি। অহঙ্কারী হয় নয়, নম্রভাবে; আহ্বান রূপে নয়, স্পর্ধা রূপে নয়, কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে চাই দুনিয়ার কোনও শক্তিই আমাদের নির্ধারিত পথ থেকে সরাতে পারবে না। রাষ্ট্রের ঐক্য, অখণ্ডতা, সুরক্ষার জন্য আমরা যে কোনও মাপের বলিদান দিতে প্রস্তুত।’

এই ভাষণেই বাজপেয়ীজি নতুন একটি স্লোগানের জন্ম দিলেন। বাজপেয়ীজি বললেন, ‘লাল বাহাদুর শাস্ত্রী জি নে কহা থা— ‘জয় জওয়ান, জয় কিষাণ।’ কি সুন্দর দুটি কথা। যেন জওয়ান আর কিষাণ একে অপরকে ছাড়া পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। আমি এখন এতেই একটা নতুন মাত্রা জুড়ছি— ‘জয় বিজ্ঞান।’ একবিংশ শতকে দেশের সুরক্ষা, দেশের বিকাশ বিগত শতাব্দীর উপকরণ দিয়ে করা সম্ভব নয়।’

সেদিন লালকেল্লার পাঁচিল থেকে দেওয়া ভাষণ শুনে দেশবাসীর মনে হয়েছিল বাজপেয়ীজি সত্তার কিছু অবশ্যম্ভাবী বাধ্যবাধ্যকতার সঙ্গে লড়াই করছেন। তিনি বললেন, ‘আমি জানি যে, আজকের ব্যবস্থায় নির্দোষ সন্ন্যাসীকে সত্তা-লোভীর দল ফাঁসি দিয়ে দেয়। কিন্তু আমি আপনাদের ভরসা দিয়েই বলছি, জীবনে কোনও দিন সত্তার লোভে নিজের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আপোষ করিনি, ভবিষ্যতেও করব না। সত্তার সঙ্গে সহবাস এবং বিপক্ষে থেকে বনবাস আমার কাছে একই রকমের ব্যাপার। জীবনে কখনও এমন মুহূর্ত আসে, যখন ব্যক্তি চৌমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভাবে—

রাহ কৌন-সি জাউঁ ম্যায়?
চৌরাহে পর লুটতা চীর,
পেয়াদে সে পিট গয়া ওয়াজির।
চলু আখিরি চাল কি
বাজী ছোড় বিরক্তি রচাউঁ ম্যায়,
রাহ কৌন-সি জাউঁ ম্যায়?

আবার তখনই মন বলে, বিরক্ত হয়ে দান ছেড়ে পালানো যাবে না। যুঝতে হবে। আর তখনি আমি লাল কেল্লার প্রাচীরে দাঁড়িয়ে আপনাদের উপস্থিতিতে সংকল্প করি—

হার নহিঁ মানুঙ্গা
রার নহিঁ ঠানুঙ্গা,
কাল কে কপাল পর
লিখতা-মিটাতা হুঁ।
গীত নয়া গাতা হুঁ,
গীত নয়া গাতা হুঁ।’

নতুন গানই তো লেখা হতে চলেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে। কী বললেন? কে লিখছিলেন? আসছি, আসছি। অত তাড়া কীসের?

পোখরান ইত্যাদির ঠিক দুমাস পরে শ্রীলঙ্কার কলোম্বোতে বাজপেয়ীজির সঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সাক্ষাৎ হল। দুপক্ষের আবার দেখা হবে নিউইয়র্ক শহরের ইউএন জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে, সেপ্টেম্বর ১৯৯৮। এটা সেটার মাঝে নওয়াজ শরীফ বললেন ১৯৮২ সালের এশিয়ান গেমস্-এর সময়ে খেলা দেখার জন্য কীভাবে তিনি লাহোর থেকে দিল্লি নিজেই ড্রাইভ করে গিয়েছিলেন। ভারতের ডিপ্লোম্যাট বিবেক কাটজু উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, ‘একটা লাহোর-দিল্লি বাস সার্ভিস হলে কেমন হয়?’ একটুও দেরি না করে শরীফ মেজাজে শরীফ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেয়া বাত!’ বাজপেয়ীজিও শুনে ‘হ্যাঁ’ না- বললেও ‘না’ বললেন না।

তাৎক্ষণিক বক্তৃতার ধনী বাজপেয়ীর পক্ষে আসলে এমন একটা বিষয়ে তৎক্ষণাৎ ‘হ্যাঁ’ বলাটাও কঠিন ছিল। কারণ ছিল সঙ্ঘ এবং বিহিপ। এমনিতেই সঙ্ঘের সঙ্গে নানান বিষয় নিয়ে বাজপেয়ীজির টানাপড়েন চলছিল। জম্মুতে ২৬ জন হিন্দুকে সন্ত্রাসবাদীরা হত্যা করেছিল, তা নিয়ে বিহিপও সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করাটা হয়তো সরকারের পক্ষে খাল কেটে কুমীর আনার সামিল ছিল।

তাছাড়া এই সময়ে অটলজির ঘনিষ্ঠ বৃত্তের কারণে অটল-আডবানির মধ্যে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছিল বলেও শোনা যায়। যে প্রমোদ মহাজন আডবানিজির ঘনিষ্ঠ হিসেবে রাজনৈতিক কেরিয়ার আরম্ভ করলেও পরে অটলজির দিকে ঝুঁকেছিলেন। ভাজপার ফান্ডিং করা নুসলি ওয়াডিয়ার দাপট বাড়ছিল। সবথেকে বড় কারণ ছিলেন ব্রজেশ মিশ্রা। তাঁর সঙ্গে সকালবেলায় খবরের কাগজ পড়তে-পড়তে ব্রেকফাস্টের টেবলে অটলবিহারী দিনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করতেন। প্রত্যেক চন্দ্রগুপ্তের একজন করে চাণক্য থাকেন। ইন্দিরা গান্ধীর ছিলেন পি এন হাকসার, রাজীব গান্ধীর ছিলেন পি সি আলেকজান্ডার, নরসিমহা রাওয়ের অমর নাথ ভার্মা, আর বাজপেয়ীর ছিলেন ব্রজেশ মিশ্রা। অটলজির জামাতা রঞ্জন ভট্টাচার্য, ব্রজেশ মিশ্রা এবং অটলজি এই তিনজনে মিলেই গুরত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত নিতেন। আডবানিজির সঙ্গে দূরত্বের কথা উঠলেই অবশ্য অটলবিহারী বলতেন যে, তাঁরা রোজ দুপুরের খাবার একসঙ্গেই খান। হয়তো সত্যিই সম্পর্কে চিড় ধরেনি।

সম্পর্ক একই রকম ছিল কিনা বলা কঠিন, তবে ‘লাহোর-দিল্লি’ বাস সার্ভিসের ক্ষেত্রে দুজনেই সহমত হলেন। আডবানিজি একটা ব্যাপার বুঝেছিলেন— কংগ্রেস নয় পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কাজটা একমাত্র ভাজপাই পারবে।

দফায় দফায় দুপক্ষের কথা চলল। ঠিক হল ১৯৯৯ সালের শুরুতে পাকিস্তানি ক্রিকেট টিম ভারতে খেলতে আসবে। পাকিস্তান ভারতে খেলতে এল। দুই টেস্ট ম্যাচের সিরিজ। চেন্নাইতে প্রথম ম্যাচে সচিন তেন্ডুলকর দুর্দান্ত খেললেও পাকিস্তান ১২ রানে ম্যাচ জিতেছিল। দ্বিতীয় ম্যাচ হয়েছিল দিল্লির ফিরোজশাহ কোটলা গ্রাউন্ডে। ভারত ২১২ রানের সহজ জয়ের পর সিরিজ ড্র হয়ে যায়। এই ম্যাচের একটি ইনিংসে অনিল কুম্বলে দশ উইকেট নিয়ে নিজের কীর্তি স্থাপন করেন।

ক্রিকেট কূটনীতি ভালো কাজ করে। কিন্তু সেবারের ক্রিকেট সিরিজের পরেও যেন বরফ ঠিকভাবে গলছিল না। দুপক্ষের কূটনীতিকরা কিছুতেই লাহোর-দিল্লির পথকে সাবলীল হতে দিচ্ছিলেন না।

তবে সাফল্য এল। একটু ঘুরপথেই বলা যায়। পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ বিখ্যাত ভারতীয় সাংবাদিক শেখর গুপ্তার মাধ্যমে বাজপেয়ীজিকে ব্যক্তিগত স্তরে পাকিস্তানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। শেখরের লেখায় এই আমন্ত্রণের খবর ১৯৯৯ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ছাপা হল। সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই প্রধানমন্ত্রী যাবেন বলে সম্মতি দিলেন।

শুধুমাত্র অটলজিই নন, আডবানিজি এবং কুশাভাউ ঠাকরেও লাহোর বাসযাত্রার জন্যে উৎসাহী ছিলেন। কুশাভাউ ছিলেন তৎকালীন ভাজপা প্রেসিডেন্ট, এবং সঙ্ঘের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি।

পাক্কা দু’সপ্তাহ পর, ১৯শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ বিকেল চারটের সময় ওয়াঘা সীমান্ত পেরিয়ে দিল্লি ট্রান্সপোর্ট করপোরেশনের সোনালি রঙের একটি বিশাল বাস পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে দাঁড়াল। বাজপেয়ীজি সহ মোট পঁচিশজন যাত্রীকে নিয়ে বাস গিয়েছিল। বাজপেয়ীজি পাক-জমিনে পা রাখা মাত্রই ওদেশের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ তাঁকে উষ্ণ অভিবাদনে ভরিয়ে তুললেন। হবে নাই বা কেন, ব্যাপারটা অনেকটা নিক্সনের চায়না কিংবা গরবাচভের বার্লিন প্রাচীর দেখতে যাওয়ার মতো। জাভেদ আখতার, দেব আনন্দ, শত্রুঘ্ন সিনহা, রাজীব শুক্লার মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা সঙ্গে গিয়েছিলেন। আডবানিজি যাননি। নিজের জন্মভিটেয় ফিরে যাওয়ার তাগিদ থাকলেও হয়তো অন্য কারণে যাওয়া ঠিক হবে না মনে করেছিলেন। না, কোথাও কোনও লিখিত বয়ান নেই এ নিয়ে, তবে হতে পারে তিনি মনে করেছিলেন এমন সুন্দর একটি মুহূর্তে আলোর বৃত্তে কেবল একজন নায়কেরই থাকা উচিত।

বলা হয় প্রাথমিকভাবে বাজপেয়ীজির পরিকল্পনা ছিল বর্ডার পেরিয়ে গিয়ে শরীফের সঙ্গে দেখা করে আবার ফিরে আসা হবে। কিন্তু শরীফ বাজপেয়ীজিকে বলেন, ‘দর তক আয়ে হো, ঘর নহিঁ আয়োগে?’(দোরগোড়া অব্ধি এলেন, আর বাড়িতে ঢুকবেন না?) এরপর বাজপেয়ীজি মিনার-এ-পাকিস্তান দেখতে যান। ২০০ ফুট উঁচু সাদা রঙের একটি মিনার, যেখান থেকে ১৯৪০ সালে মুসলিম লিগ পৃথক রাষ্ট্র রূপে পাকিস্তানের জন্মের কথা প্রথমবার উত্থাপন করেছিল। ভিজিটর্স বুক-এ বাজপেয়ীজি লিখলেন, ‘A stable, secure and prosperous Pakistan is in India’s interest. Let no one in Pakistan be in doubt, India sincerely wishes Pakistan well.’

ভবিষ্যতের ভালো-মন্দ অনেক কিছু বিচার করেই অটলজি এই কথাগুলো লিখেছিলেন। তবুও প্রশ্নের মুখে তো পড়তেই হল, পাক-প্রসঙ্গ বলে কথা! দেশে ফেরার পরে কেউ অটলজিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি কি পাকিস্তানকে সার্টিফিকেট দিতে গিয়েছিলেন?’ নিজস্ব ঢঙে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কারো শংসাপত্র পাকিস্তানের দরকার নেই।’ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সন্দেহাতীত বলে সম্ভবত তিনি ‘অখণ্ড ভারত’-এর স্বপ্নকে একটু পিছনে ঠেলে দিয়েছিলেন।

বিদেশের সরকারি দাওয়াতের আসরে সবাই যেখানে সবাই শুকনো প্রোটোকল মানতে ব্যস্ত, সেখানে অটলবিহারী উর্দু শের আওড়েছিলেন। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনেছেন। নওয়াজ শরীফ বলেছিলেন, ‘বাজপেয়ী সাহাব, অব তো পাকিস্তান মে ভি ইলেকশন জিত সকতে হ্যাঁয়।’ নাদান শরীফ সাহেব বোঝেননি পাকিস্তানের হৃদয় জেতা মানুষটাকে তখন ভারতেরই কিছু মানুষ মসনদ থেকে নামানোর চেষ্টা করছিলেন।

এমনিতে এনডিএ সরকার ঠিকঠাকই চলছিল। বাজপেয়ীজি নিজের সহযোগীবৃন্দ, বিশেষত জর্জ ফার্নান্ডেজ, জশবন্ত সিং এবং প্রমোদ মহাজনের সাহায্য নিয়ে অন্যান্য দলগুলির সঙ্গে খুব সুন্দর তালমিল বজায় রেখে কাজ করছিলেন। জর্জকে এনডিএ-এর সংযোজক করা হয়েছিল। তিনি সবার সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক রাখতেন। সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি মোটেই ছিল না তাঁর। একসময়ের প্রচণ্ড সোশ্যালিস্ট জর্জ সমন্বয় সাধন করছিলেন দলগুলির মধ্যে। কেবল একজনই তাঁর বশে ছিলেন না। তিনি হলেন জয়ললিতা। আর জয়ললিতার দোসর হয়েছিলেন এক বিকট মেধার দক্ষিণী ব্রাহ্মণ, সুব্রাহ্মণিয়ান স্বামী।

স্বামী— রাজনৈতিক ওলটপালট করে দিতে ওস্তাদ। তিনি কখন শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন, এবং বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা তা তিনি নিজেও টের পান না। তবে বন্ধুত্ব বা শত্রুতা তিনি যেটাই করেন তা প্রাণপণে পালন করার চেষ্টা করেন। রামমন্দির থেকে শুরু করে রাম সেতু, সোনিয়া গান্ধীর ডিগ্রি থেকে আরম্ভ করে কংগ্রেসের ন্যাশন্যাল হেরাল্ড সমস্ত কোর্ট কেসের তিনিই মালিক। স্বামীর সঙ্গে জয়ললিতা, সোনিয়া গান্ধী এবং বাজপেয়ীজির দুশমনির কথা গোটা দুনিয়া জানে।

স্বামীর একটাই স্বপ্ন, তিনি দেশের অর্থমন্ত্রী হবেন। কিন্তু চাইলেই সব হয় না। নসিব আপনা আপনা। অত কামনা থাকা সত্ত্বেও তিনি সে মোরারজি দেশাই সরকার থেকে মোদি সরকার কোনও কালেই অর্থমন্ত্রকের চেয়ারে বসতে পারেননি। শোনা যায়, মোরারজি দেশাই নাকি তাঁকে নিজের সময়কালে বিত্ত রাজ্যমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাজপেয়ীজি বলেছিলেন এই সবে ৩৫ বছর বয়েস, এত তাড়াতাড়ি মন্ত্রী করার কী দরকার। নরসিমহা রাওয়ের সঙ্গে স্বামীর বন্ধুত্ব সেই ১৯৭৭ সাল থেকে, তিনিও নাকি স্বামীকে নিজের সরকারে অর্থমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন। স্বামী বলেছিলেন, ‘আপনি তো নিজেই এই দলে ভাড়াটে হয়ে আছেন, কোনও দিন সোনিয়া গান্ধী এসে যাবেন, তাই আমি কংগ্রেসে যোগ দিতে পারব না।’ স্বামী দাবি করেন অর্থনৈতিক উদারীকরণের নীলনকশা নাকি তিনিই তৈরি করেছিলেন। ভিপি সিং এর সঙ্গে স্বামীর বনিবনা ছিল না। চন্দ্রশেখরের সময়ে স্বামী আমেরিকায়, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে আর আইএমএফ-এ সম্পর্কের উন্নতি করছিলেন।

অর্থমন্ত্রী হতে না পারলেও তাঁর কাছ অস্ত্রের কমতি ছিল না। বিভিন্ন সংবেদনশীল মুহূর্তে চায়ের কাপে ঝড় তোলার মতো বিষয়ের জোগান দেওয়াতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ‘৯৮ সাল। স্বামী মাদুরাই সিট থেকে লড়ে জিতে লোকসভার সাংসদ হলেন। মাদুরাই সিট দ্রাবিড় বহুল হওয়াতে ডিএমকের গড় বলে মনে করা হতো। সেখান থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে কোনও ব্রাহ্মণের জেতাটা সত্যিই বড় ব্যাপার। স্বামীর আগে বা পরে কোনও ব্রাহ্মণ ক্যান্ডিডেট মাদুরাই থেকে জিততে পারেননি। তো যাই হোক, আমরা ‘৯৮ সালের ভোটের ফল আগেই দেখেছি। ভাজপা এবং তার জোটসঙ্গীরা ভালো ফল করলেও সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সিট কম পড়ছিল। এআইএডিএমকে-এর ১৮ জন সাংসদের সমর্থন পেয়ে গেলে মুশকিল আসান হয়। জয়ললিতা স্বামীকে বলেছিলেন, ‘বাজপেয়ী তোমাকে অর্থমন্ত্রী করতে রাজী হয়েছেন। তুমি দিল্লি চলে যাও।’ তারপর স্বামীর কাছে আডবানিজি, জে পি মাথুর, রঞ্জন ভট্টাচার্যর ফোনও আসে। পরদিন স্বামী যখন দিল্লিতে বাজপেয়ীজির সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তখন সেখানে রঞ্জন ভট্টাচার্য, রজত শর্মারা উপস্থিত ছিলেন। বাজপেয়ীজি স্বামীকে বলেছিলেন, ‘তুমি তো ডিফেন্স মিনিস্টারও হতে পারো।’ স্বামী কোনও উত্তর দেননি।

বাজপেয়ীজির সরকার গঠনের আগে মহামহিম কে আর নারায়ণন সবার সমর্থনের চিঠি চাইছিলেন। জয়ললিতার চিঠিটা ছাড়া বাকীদের চিঠি জমাও পড়েছিল। শপথগ্রহণের আগে জয়ললিতা স্বামীকে ফোন করে বলেন, ‘শপথ নেওয়ার আগে তুমি সমর্থনের চিঠি দেবে না, বাজপেয়ী বদলে গেছেন। অর্থ মন্ত্ৰক দিতে চাইছেন না, রাজ্য মন্ত্রীত্ব দিচ্ছেন।’ সমর্থন না দিলে লোকে তাঁদেরই মন্দ কথা কইবে বলে সে যাত্রা বুঝিয়ে সুঝিয়ে জয়ললিতার চিঠি জমা করিয়েছিলেন স্বামী। অন্তত তিনি এমনটাই বলেন।

বছর প্রায় ঘুরে গেল। একদিন আচমকাই জয়ললিতা স্বামীকে ফোনে ধরলেন, ‘এখুনি চেন্নাই এসো।’ চেন্নাই পৌঁছতেই জয়ললিতা স্বামীকে বললেন, ‘যেভাবে তুমি চন্দ্রশেখরের সরকার বানিয়েছিলে, ঠিক সেভাবেই বাজপেয়ীর সরকার ফেলে দিয়ে নতুন সরকার বানাও, এটা আমার সম্মানের ব্যাপার। বাজপেয়ী ধোঁকা দিয়েছেন।’ স্বামী বললেন, ‘সরকার ফেলে নাহয়য় দেওয়া গেল, কিন্তু কোনও বিকল্প তো চাই জাতে আমাদের সরকার তৈরি হয়। তার জন্য সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। কিন্তু সোনিয়াকে আমি পছন্দ করি না, আর উনিও আপনাকে অপছন্দ করেন।’ এসব কথার পরেও জয়ললিতা স্বামীকে কথা চালানোর জন্য বললেন। স্বামী দুই নেত্রীর মধ্যে মিটিং ফিক্স করলেন। ২৯শে মার্চ ১৯৯৯ দিল্লির একটি পাঁচটারা হোটেলে মোলাকাত হল। এখন যাকে ‘চায়ে পে চর্চা’ বলে আম আদমিকরণ করা হয়েছে, তাকেই আগে ‘টি পার্টি’ বলা হতো। বহু লোক আমন্ত্রিত ছিলেন। দেশের তিনজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। কিন্তু স্পটলাইট কাড়লেন দুই নারী— জয়ললিতা ও সোনিয়া। দুজনের ছবি উঠল ফটাফট। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছিল।

খবর আগে থেকেই ছিল। পরদিন যখন ছবি ছেপে বেরোলো, তখন ভাজপা নেতাদের বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গিয়েছে। আডবানিজি, মহাজন, কুশাভাউ ঠাকরেরা জয়ললিতার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করার বিপক্ষেই ছিলেন। নৌসেনার অ্যাডমিরাল বিষ্ণু ভাগবতের পুনর্বহাল এবং জর্জ ফার্নাণ্ডেজের ইস্তফা দাবি করে এমনিতেই এআইএডিএমকে এবং ভাজপার মধ্যে ফাটল বাড়ছিল। মন্ত্রী কুমারমঙ্গলম জয়ললিতাকে নিয়ে যে বয়ান দিয়েছিলেন, তা থেকে পিছু হটছিলেন না। ৫ই এপ্রিল যখন ক্যাবিনেট জয়ললিতার দাবিগুলি মানতে রাজী হল না, তখন জয়ললিতা নিজের দুই মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলে দিলেন। ১২ই এপ্রিল দিল্লির হোটেল থেকে বেরিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবন যাওয়ার আগে জয়ললিতা বলে দিলেন, ‘আমি বাজপেয়ী সরকার থেকে নিজের সমর্থন তুলে নিতে চলেছি।

স্বামীর মাথা কম্পিউটারের থেকেও দ্রুত কাজ করে। সমস্ত হিসেব নিকেশ শেষে তিনি অঙ্ক কষে জয়ললিতাকে বুঝিয়ে দিলেন নতুন কোন কোন দল ভাজপাকে সমর্থন দেবে, কারা কারা পিছিয়ে যাবে। দেখা গেল যদি অবিশ্বাস প্রস্তাব আনা হয়, তবে সব পরিস্থিতিতেই বাজপেয়ী সরকার কম করে এক ভোটে পড়ে যাবে।

১৭ই এপ্রিল ১৯৯৭। সকাল থেকেই সংসদের হাওয়া গরম। অবিশ্বাস প্রস্তাব পেশ হয়েছে। আস্থা ভোটের পালা। প্রমোদ মহাজন নিজের গণিতে আস্থা রেখে আত্মবিশ্বাসী হয়ে আছেন যে, যাই হোক সরকার পড়বে না। বিএসপির পক্ষ থেকে কাঁশিরাম বাজপেয়ীজিকে ফোন করে বলেছিলেন তাঁদের ৫ জন এমপি ভোটদান থেকে বিরত থাকবেন। ডিএমকে ভাজপার হাত ধরবে বলে কথা দিল।

বাজপেয়ীজি ‘৯৬ সালের শক্তি পরীক্ষণের দিনে দুর্দান্ত একটি ভাষণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে স্টাইলে পদত্যাগ করতে হয়। এবারেও তিনি ভাষণ দিলেন। ভাষণ শুনে সোনিয়া গান্ধী রেগে তাঁর দিকে উঠে এলেন। কারণ বাজপেয়ীজি কংগ্রেসকে ক্ষমতালোভী বলেছিলেন। মায়াবতী বিএসপির পক্ষ থেকে বলতে উঠে সরকারের বিরুদ্ধে বলে মহাজনকে চমকে দিলেন। মায়াবতীর বক্তব্য শুনে তাঁর সঙ্গী আকবর ডাম্পি আহমেদ, আরিফ মোহম্মদ খানরা টেবল চাপড়াচ্ছিলেন।

ভোট শুরু হল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাজপার সাংসদেরা এক অযাচিত ব্যক্তির মুখ দেখে চমকে উঠলেন। ভদ্রলোকের নাম গিরিধর গমাঙ্গ। তিনি লোকসভায় কংগ্রেসের সাংসদ ছিলেন। ওড়িশার কোরাপুটের এমপি। ফেব্রুয়ারি মাসে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী রূপে সংসদ ছেড়ে চলে গেলেও সাংসদ রূপে পদত্যাগ করেননি। আডবানিজি তাঁর ভোটের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও স্পিকার মহোদয় তাকে ওভাররুল করে দিলেন। ন্যাশন্যাল কনফারেন্স সরকার তথা এনডিএ –তে সামিল হয়ে থাকলেও পার্টি লাইনকে অগ্রাহ্য করে তাদের সদস্য সইফুদ্দীন সোজ বাজপেয়ীর সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। বিএসপি-এর সাংসদরা ও ভোট দিল, বাজপেয়ী সরকারের বিপক্ষেই দিল। মহাজনের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমছিল। পরে স্বামী বলেছিলেন, ‘মহাজন আর ভাজপার তো সেদিনই বোঝা উচিত ছিল, যেদিন ১৪ই এপ্রিল আম্বেদকর জয়ন্তীর অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে কাঁশিরাম, মায়াবতী আর আমি তিনজনে একসঙ্গে গিয়েছিলাম।’

ডিজিট্যাল বোর্ডে লেখা উঠছিল সরকারের পক্ষে ২৬৯টি ভোট এবং বিপক্ষে ২৭০টি ভোট পড়েছে। এক ভোটে সরকার পড়ে গেল। হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে কম ভোটে পড়ে গেল বাজপেয়ীর ১৩ মাসের সরকার। সংখ্যা তত্ত্বের সামনে হার মানলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী।

.

সোনিয়া গান্ধী সেলাই দিয়ে নতুন সরকারের জন্য জোট তৈরি করছিলেন। দিন তিনেক পরে তিনি ২৭২ জন সাংসদের সমর্থনের কথা মৌখিকভাবে ঘোষণাও করে দেন। কিন্তু এক কুস্তীগির নেতার মারপ্যাঁচের কারসাজি তখনও সোনিয়া গান্ধী ধরতে পারেননি। তিনি হলেন মুলায়ম সিং যাদব। সমতা পার্টির নেতা জয়া জেটলির বাড়িতে জর্জ ও আডবানিজি মুলায়মের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করেছিলেন। মুলায়ম প্রাথমিকভাবে সোনিয়া গান্ধীকে সমর্থন করবেন বললেও পরে তাঁর কথা থেকে তিনি সরে আসেন। সোনিয়া গান্ধী তাই সরকার গঠন করতে পারেননি।

সরকার গঠন নাহয় বাহ্যিক বিষয় ছিল, দলের মধ্যেই সোনিয়া গান্ধীকে ‘বিদেশিনী’ বলে বিদ্রোহ করলেন তিনজন কংগ্রেসি। শরদ পাওয়ার, পি এ সাংমা এবং তারিক আনোয়ার। সোনিয়া কংগ্রেস অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে চিঠি লিখলেন, ‘Although born in a foreign land, I chose India as my country and would remain an Indian till my last breath. India is my motherland, dearer to me than my own life.’ একাধিক কংগ্রেস দিগগজ এরপর সোনিয়াকে সমর্থন করে পদত্যাগ পত্র জমা করলেন। সারা দেশের কংগ্রেস কর্মীরা সোনিয়াকে ফিরে আসার অনুরোধ করতে লাগল। অবশেষে সোনিয়া নিজের পদত্যাগ পত্র ফিরিয়ে নিয়ে ফিরলেন এবং ঐ তিনজনকে দল থেকে ছ’বছরের জন্য বহিষ্কার করলেন।

লোকসভা ভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল ২৬শে এপ্রিল ১৯৯৯। দেশে ভোটের দামামা বাজছিল।

.

বাজপেয়ীজি যখন পাকিস্তানে গিয়েছিলেন, তখন পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ তাঁর সামনে তারই কবিতা উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘জঙ্গ না হোনে দেঙ্গে।’

বাজপেয়ীজিও কবিবর। রসিক মানুষ। তিনি তাৎক্ষনিক বক্তৃতায় দিগগজ। আমাদের দেশের এক বিখ্যাত শায়ের আলি সর্দার জাফরির থেকে পঙক্তি ধার করে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ফির উসকে বাদ ইয়ে পুছেঁ কি কৌন দুশমন হ্যাঁয়।’ তিনি জানতেন, ভারত যতই উদার হোক না কেন পাকিস্তান সময় এলেই নিজের রঙ দেখাবে।

ভারতের অভ্যন্তরে যখন রাজনৈতিক ডামাডোল চলছে, তখন পাকিস্তানে বসে থাকা একজন সেনা আধিকারিক পাঁয়তারা কষছিলেন— দিল্লি বড় ব্যস্ত, এটাই আঘাত করার মোক্ষম সময়।

জানি জানি যে, আপনারা জানেন সেই সেনাধিকারিকের নাম। পাকিস্তানের তৎকালীন আর্মি চিফ পারভেজ মুশারফ।

সরকারের পতনের পাঁচ মাস পরে আবার ভোট হবে বলে জানা গেল। এবং জানা গেল আরেকটি খবর। হে খবর দিল্লির নয়, পাহাড় থেকে উড়ে এসেছিল।

৩রা মে ১৯৯৯। কারগিল এলাকায় ভারত-পাক সীমান্তে ভারতের একজন পশুপালকের একটি চমরী গাই হারিয়ে যায়। পশুপালকের নাম তাশি নামগিয়াল। সে বেচারা খুঁজতে খুঁজতে একেবারে বর্ডারের কাছে পৌঁছে যায়। চোখে বাইনোকুলার রেখে নিজের হারানো প্রাণীটাকে দেখবে কি এমন সময় একটা দৃশ্য দেখে তার বুক ছ্যাঁত করে উঠল। জনা ছয়েক পাকিস্তানি সৈন্য ছদ্মবেশে এপারে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। তারা বাঙ্কার বানাচ্ছিল।

তাশি তৎক্ষণাৎ ফিরে এসে নিকটবর্তী আর্মি পোস্টে কথাটা জানায়। ভারতীয় সেনার যে দলটি ঘটনাটা খতিয়ে দেখতে যান, তাঁরা গোলাগুলির আঘাতে প্রাণ হারান। চার দিন পরে সমগ্র তথ্য ‘কেয়ারটেকার’ প্রাইম মিনিস্টার অটলবিহারী বাজপেয়ীর কাছে তুলে ধরা হয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আডবানিজি সহ নিজের সিনিয়র মন্ত্রীদের বৈঠকে ডেকে নেন।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬,০০০ ফুট উচ্চতায় ১৫০ কিলোমিটারের বিস্তীর্ণ সীমানা (এক্ষেত্রে পড়ুন লাইন অব কন্ট্রোল) পেরিয়ে ১৫০০-২৪০০ পাকিস্তানি সৈন্য অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিল। তাদের গোলাগুলি চলছিল শ্রীনগর-লেহ হাইওয়েকে লক্ষ্য করে। পরিকল্পনা ছিল ওই পথটিকে নষ্ট করে দিতে পারলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লাইফলাইন নষ্ট হয়ে যাবে।

ইসলামাবাদে অবস্থিত ইন্ডিয়ান হাইকমিশন দিল্লিকে জানাল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নর্দার্ন লাইট ইনফ্যান্ট্রির ১৭০০ সৈন্য ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে। দিল্লির পারদ চড়তে শুরু করে দিল।

স্তম্ভিত বাজপেয়ীজি নওয়াজ শরীফকে ফোন করে বললেন, ‘নওয়াজ সাহাব, এসব কী হচ্ছে? আপনার আর্মি আমাদের আর্মিকে আক্রমণ করছে।’

স্বাভাবিকভাবেই শরীফ সাহেব কোনও কিছুই জানেন না বলে উত্তর দিলেন।

‘আপ কো কুছ পতা নহিঁ?’

.

অটল-আডবানি দুটো বিষয়ে ভুল হিসেব করেছিলেন বলেই মনে হয়।

১. ভারতের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে দু-দেশের মধ্যে শান্তিরক্ষার প্রবণতা বাড়বে।

২. বেশ কয়েক প্রজন্মের পর পাকিস্তান নওয়াজ শরীফের মতো একজন শক্তপোক্ত প্রধানমন্ত্রী পেয়েছিল, যিনি কিনা পাক আর্মিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম।

প্রথম বিন্দুটি কেন ভুল হতে পারে তা নিয়ে তখনকার যুবক অমিত শাহের পত্রাঘাত এক্ষেত্রে স্মর্তব্য। আর দ্বিতীয় বিন্দুকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিলেন পারভেজ মুশারফ।

মুশারফ ভেবেছিলেন পাকিস্তানি আর্মি যদি শ্রীনগর-লেহ সড়ক নষ্ট করে দেয়, তখন পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে না গিয়ে ভারতকে নতজানু হতেই হবে। ভেবেছিলেন ভালোই, কিন্তু খোদা তাঁর ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করলেন না। ভারত যুদ্ধে নামল। দেশের ভেতরের ভোট-দামামার শব্দকে ছাপিয়ে সীমান্তে রণভেরী বাজতে লাগল। ‘অপারেশন বিজয়’ এবং ‘অপারেশন সফেদ সাগর’ শুরু হল। ২৫০ ‘আর্টিলারি গান’ সমানে গোলা বর্ষণ করতে লাগল। টিভির পর্দায় ভারতবাসী সেই বোফর্স কামানকে দেখল যা নিয়ে ভিপি সিং রাজীব গান্ধির সরকার ফেলে দিয়েছিলেন। এটাও বুঝল যে ভিপি এটা নিয়ে কিঞ্চিৎ মিথ্যাচারই করেছিলেন এই কথা বলে যে, কামানের গোলা সামনে না গিয়ে পিছনে পড়ে। আসলে গোলা নয় ফাঁকা খোল পিছন দিকে বেরিয়ে আসত।

বাজপেয়ীজির আরও একটি পদক্ষেপ পারভেজ মুশারফ আগফাম অনুমান করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী এয়ার ফোর্সকে স্ট্রাইক করার নির্দেশ দিলেন। সঙ্গে একথাও পইপই করে বলে দিলেন যে, কোনভাবেই এলওসি পেরিয়ে বোমা বর্ষণ করা চলবে না। ১২০০ ফাইটার জেট আর ২৫০০ চপার নির্ধারিত নিয়ম মেনে যেভাবে লড়েছিল তাতে শুধু ভারতের সীমানা রক্ষা করা হয়েছিল তাই নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তিও অক্ষুণ্ণ থেকে যায়।

নিজেদের ইজ্জত বাঁচাতে পাকিস্তান বলতে শুরু করল সীমান্তে যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারা নাকি সৈন্য নয় জঙ্গী। মে মাসে মুশারফ যখন চিনে গেছেন, তখন সেখান থেকে তাঁর একটি ফোন বার্তা ফাঁস হল। স্পষ্ট হয়ে গেল কোনও অনুপ্রবেশকারীই জঙ্গি ছিল না, প্রত্যেকেই ছিল পাক সরকারের বেতনভোগী সৈন্য।

জুলাই মাসে ভারতীয় বাহিনী হৃত শৃঙ্গগুলিকে একের পর এক জয় করে চলেছিল। বীর বিক্রমে লড়াই করে নাস্তানাবুদ করছিল পাক বাহিনীকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন মধ্যস্থতা করলেন। পাকিস্তানকে পিছু হঠতে বলা হল। আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তানি সৈন্যরা পিছু হঠল। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে পাকিস্তান আরও একবার ভারতের কাছে হারল। কারগিল আবার ভারতের হল। আস্থা ভোটে পরাজিত বাজপেয়ী সরকার কারগিলের যুদ্ধ জয় করল। ২৬শে জুলাই ১৯৯৯, ভারত সরকার ঘোষণা করল, এখন থেকে আজকের এই দিনটিকে ‘বিজয় দিবস’ রূপে পালন করা হবে।

.

সীমান্তের যুদ্ধে আডবানিজির প্রায় কোনও ভূমিকাই ছিল না। কিন্তু ভোট যুদ্ধে দলের হয়ে লড়ার জন্য আবার তিনি উন্মুখ হয়ে উঠেছিলেন। ভাজপার নির্বাচনী প্রচার কমিটির মাথা হিসেবে তাঁকেই নিযুক্ত করা হয়েছিল। এবারে আডবানিজিকে সাহায্য করছিলেন দলের জেনারেল সেক্রেটারি নরেন্দ্র মোদী।

সরকারে আডবানিজির গুরুত্ব যেমনই থাকুক না কেন, দলের হয়ে প্রচারে তিনি কেবল একজনের মুখই ভাসিয়ে তুলছিলেন। তিনি হলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। সঙ্ঘ থেকে জন্ম নেয় ভারতীয় জনসঙ্ঘ, এবং ভারতীয় জনসঙ্ঘ রূপান্তরের মাধ্যমে জন্ম দেয় ভাজপার। সঙ্ঘের ধারা মেনেই এতদিন দলে ব্যক্তিপূজার কোনও স্থান ছিল না। ব্যক্তিকে সমষ্টির থেকে বড় করে কোনও প্রকারের বিজ্ঞাপনও আগে কখনও চোখে পড়েনি। এবারে তার ব্যতিক্রম ঘটল। ভারতবাসী এই প্রথমবার টিভির পর্দায় ভারত-পাক যুদ্ধ দেখেছিল। ‘৭১ সালের মতো ব্যাপক যুদ্ধ না হলেও বোঝা যাচ্ছিল এনডিএ ফিরতে চলেছে। বিভিন্ন জনমত সংগ্রহ আগে থেকেই বলছিল জনপ্রিয়তার নিরিখে নিজের দলকে ছাপিয়ে গেছেন বাজপেয়ী। তাঁর ছবিসহ পোস্টারে লেখা হচ্ছিল ‘National Hero Of Kargil’. মাত্র কিছুদিন আগেই ‘বিদেশিনী’ প্রসঙ্গে জেরবার সোনিয়া গান্ধীর বিরুদ্ধে পাল্লা দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্তিশালী হাতিয়ার ছিল এটা।

১৫ই আগস্ট ১৯৯৯। আবার লালকেল্লা, আবার বাজপেয়ীর ভাষণ। ভাষণ তো নয়, কারগিলের বিজয়গাথা। বাজপেয়ী বুঝতে পারছিলেন যে, পরের বছর লালকেল্লার প্রাচীর থেকে ভাষণ দেওয়ার সুরটা এবছর থেকেই ভেঁজে রাখা দরকার।

তিনি বললেন, ‘আজ আমি স্থল ও বায়ুসেনার সেইসব সাহসী জওয়ান, অফিসার এবং অন্যান্যদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছি, যারা কারগিলে নিজেদের মাতৃভূমিকে শত্রুর হাত থেকে ছাড়াতে গিয়ে অদ্ভুত পরাক্রম, শৌর্য এবং বলিদান দেখিয়েছেন। আমরা সেইসব বাহাদুর পরিবারজনেদের কী করে ভুলে যাই, যারা নিজেদের প্রিয়জনের মরদেহ পেয়ে বলেন— আমাদের চোখে জল নয়, হৃদয়ে গর্ব আছে। আমরা সেই মা’কে কীভাবে ভুলতে পারি, যিনি এই নিয়ে দুঃখ করছেন যে, তাঁর কেবল এক ছেলেই দেশে কাজে লাগল। আরেকজন ছেলে থাকলে তিনি দেশের জন্য লড়তে পাঠিয়ে দিতেন।’

বাজপেয়ী আম আদমির স্পন্দন বুঝতেন খুব ভালোভাবে। বললেন, ‘বলা হয়, যুদ্ধের সময় আর তার ঠিক পরেই আমরা সৈনিকদের স্মরণ করি, সম্মান দিই, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কথা ভুলেও যাই। এ অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, বিগত যুদ্ধে যারা অসম সাহস দেখিয়ে আহত বা নিহত হয়েছেন, হয়তো তাঁদের অবদানের অনেক কিছুই আমরা মনে রাখতে পারিনি। আমি কথা দিচ্ছি, এবারে এই ভুল আর হবে না।’

বাজপেয়ী মিথ্যা বলেননি। তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়েই সৈনিকদের এবং তাঁদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন যোজনা চালু করা হয়। সেই প্রথমবার নিহত সৈন্যদের পার্থিব দেহ সসম্মানে তাঁদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা চালু হল। এবং সম্ভবত জর্জই প্রথম এমন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, যিনি যুদ্ধের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছে সৈনিকদের কুশল সংবাদ নিতেন।

সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৯৯। এনডিএ জোট নিয়ে ভাজপা ভোটের আসরে নামল।

দ্বাদশ লোকসভায় যেখানে ১৩টি দলের জোট ছিল, এবারে প্রায় তার দ্বিগুণ সংখ্যক, চব্বিশটি, দল ভাজপার সহযোগী হল। ‘৯৯ -এর ভোটে সুরক্ষা, স্থায়িত্ব এবং উন্নয়ন হয়ে উঠল প্রধান বিষয়। কারগিলে জিতে বাজপেয়ী সরকার মানুষের মনে ভরসা দিয়েছিল। তাছাড়া আস্থা ভোটের সময় এক ভোটে সরকার পড়ে যাওয়ার ফলে ভাজপার মতো জনগণও স্থায়ীত্বের দিকেই ঝুঁকছিল। এবং ভাজপা বারবার বলছিল, পাঁচ সালের স্থায়ী সরকার পেলে আমরা দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাব।

বাজপেয়ীর প্রথম সরকার ১৩ দিন চলেছিল, দ্বিতীয় বারে ১৩টি দলের সঙ্গে ১৩ মাসের সরকার চলে, এবারে ত্রয়োদশ লোকসভা ছিল, এবং সরকারের শপথগ্রহণের দিন নির্ধারিত হল ১৩ই অক্টোবর। বিশ্বের বহু দেশেই ১৩ সংখ্যাটিকে অশুভের দ্যোতক বলে মনে করা হলেও বাজপেয়ীর ক্ষেত্রে হয়তো তা শুভই ছিল।

৫ই অক্টোবর ১৯৯৯। ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হল। ভাজপার ভোট সেভাবে বৃদ্ধি না পেলেও কংগ্রেসের ভোট বেশ কমে গেল। ভাজপা জিতল ১৮২টি সিটে। কংগ্রেস ১১৪। এনডিএ জোট পেল ৩০২টি আসন। ভাজপার সঙ্গী দলগুলির ফল বেশ ভালো হয়েছিল। সংসদে বহুমত পেশ করার নির্ধারিত সীমার সবুজ দিকে রইল এনডিএ। কোনও একটি দল চাইলেই সরকার ফেলে দিতে পারবে না।

.

শপথ গ্রহণের আগের রাতে দিল্লিতে অনেকেরই রাজনৈতিক গতিবিধি দ্রুততর হয়ে উঠেছিল। নতুন সরকারে যাদের যাদের মন্ত্রীত্বের খবর পাকা হয়ে গিয়েছিল, তাঁরা মহা উৎসাহে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সারা রাত ধরে দিল্লিবাসী জাগিয়ে রাখছিল সাইরেনের শব্দ, আর লালবাতির ঝলকানি। শুধু লুটিয়েন্স দিল্লিতেই নয়, দেশের অন্যান্য অনেক রাজ্যের রাজধানীতেও তখন চিত্রটা একই রকমের। কারণ এনডিএ জোতে থাকা দলগুলির কাকে কাকে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হবে তার লিস্ট নিয়ে ছুটছিলেন নেতারা। জোটসঙ্গীদের মন রাখতে গিয়ে যদি ভাজপা নেতাদের নাম বাদ পড়ে যায়— এই ভয়ে তখন ভাজপার অনেক নেতার মুখে একটাই মন্ত্ৰ- সঙ্ঘম্ শরণম্ গচ্ছামি।

১৩ই অক্টোবরের এক হিমেল সকালে রাজনৈতিকভাবে উষ্ণ আবহের মধ্যে বাজপেয়ী নিজের মন্ত্রীসভার সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে শপথ গ্রহণ করলেন। রাষ্ট্রপতি ভবনের দালান সারা দেশ থেকে আগত রাজনীতিক, মুখ্যমন্ত্রী এবং দলীয় কর্মকর্তাতে ভরে উঠছিল। যুদ্ধের ময়দানে প্রাপ্ত জয়ের বিজয় দিবসের পর ভোট যুদ্ধের ‘বিজয় দিবস’ দেখল ভারতবাসী।

দিল্লির ভোটের আগে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী সাহিব সিং বর্মাকে মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে সরানো হয়েছিল। ভাজপার পক্ষ থেকে নেওয়া এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বাজপেয়ী সাহিব সিং বর্মাকে কথা দিয়েছিলেন যে, লোকসভা নির্বাচনে জিতলে তাঁকে মন্ত্রী করা হবে। সাহিব ভোটে জিতে এলেও তাঁকে মন্ত্রীত্ব দেওয়া হল না। স্বাভাবিকভাবেই একটা ক্ষোভ কাজ করছিল তাঁর মনে। পরে মন্ত্রীসভার বিস্তারের সময় দিল্লির বিজয় কুমার মালহোত্রার নাম মন্ত্রীপদের জন্য উঠতে শুরু করায় সাহিব সিং আরও বেশি মর্মাহত হন। প্রমোদ মহাজন ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে নেমে বাজপেয়ীকে এই নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, সাহিব সিংকে তিনি মন্ত্রী করতে চাইলেও দলের সবার মত না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এবারে প্রমোদ বাজপেয়ীর ইচ্ছার কথা সবার সামনে রাখেন। তারপর বিজয় মালহোত্রাকে বাদ দিয়ে সাহিব সিংকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়। দিল্লির পঞ্জাবি সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ মুখ বিজয়কে বাদ দিয়ে সাহিব সিংকে মন্ত্রী করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং কাজই ছিল।

বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার জন্য নতুন মুখের সন্ধানে ছিলেন। তিনি ফোন করলেন উত্তরপ্রদেশের এক নেতাকে। সেই নেতা তখন লখনউতে নিজের বাড়িতে বসে ইষ্ট দেবতার আরাধনায় ব্যস্ত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছেন বলে সেই নেতার স্ত্রী যখন ডাকলেন, তখন নেতা মশাই হাতের ইঙ্গিতে মানা করে দিলেন— এখন ফোন ধরা যাবে না। কিছুক্ষণ পরে আবার ফোন এল। এবারে নেতা ভদ্রলোক উঠে ফোন ধরলেন। বাজপেয়ী বললেন, ‘কী করছিলেন?’

‘পুজোয় বসেছিলাম।’

‘বিরাট পূজারী হয়েছেন দেখছি। দিল্লি কবে আসছেন? এসেই ফোন করবেন।’

নেতা মহোদয় দিল্লিতে পৌঁছলেন। বাজপেয়ীকে ফোন করতেই তিনি বললেন, ‘কাল সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে চলে আসুন।’

‘রাষ্ট্রপতি ভবনে? কেন?’

‘মূর্খ না কি?’

পরদিন অটলবিহারীর স্নেহভাজন এই নেতার পোর্টফলিওতে জুড়ল দেশের সড়ক ও পরিবহন মন্ত্রকের দায়িত্ব।

নেতার নাম?

সবই তো জানেন, বন্ধু। ইনি হলেন রাজনাথ সিং।

বাজপেয়ী নিজের মন্ত্রিসভায় দেশের সবথেকে কমবয়েসি মন্ত্রী হিসেবে শাহনওয়াজ হুসেনকে নিয়েছিলেন। মাত্র ৩২ বছর বয়েসে হুসেন মন্ত্রী হন। তিনি ছিলেন ভাজপার যে কোনও মন্ত্রিসভার প্রথম মুসলিম মুখ। মন্ত্রকের নাম সিভিল অ্যাভিয়েশন।

মন্ত্রীত্ব পেয়েই হুসেন আন্দামান বিমানবন্দরের নাম বীর সাভারকরের নামে,  গ্বালিয়র এয়ারপোর্টের নাম রাজমাতা সিন্ধিয়ার নামে এবং ভোপালের বিমানবন্দরের নাম রাজা ভোজের নামে নতুনভাবে নামাঙ্কিত করার সিদ্ধান্ত নেন। বাজপেয়ীর সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘রাজা ভোজ তো ঠিক হ্যাঁয় লেকিন গঙ্গু তেলি কা কেয়া হোগা?’

‘গঙ্গু তেলি’। হিন্দি বলয়ের একটি প্রবাদবাক্যে রয়েছে ‘কাঁহা রাজা ভোজ অউর কাঁহা গঙ্গু তেলি!’ প্রচলিত কাহিনি বলছে মধ্যপ্রদেশে একজন পরাক্রমী রাজা ছিলেন ভোজ। তাঁর সঙ্গে আরেক রাজা জয়সিং তৈলঙ্গ-এর যুদ্ধ বাঁধে। গাঙ্গেয়দেব কলচুরি নামে আরেক রাজা তৈলঙ্গের পক্ষে যোগ দেন। কিন্তু দুই রাজা এক হয়েও রাজা ভোজকে হারাতে পারেন না। সেই থেকেই লোকে বলতে শুরু করল, ‘কাঁহা রাজা ভোজ অউর কাঁহা গাঙ্গেয় তৈলঙ্গ!’ এই ‘গাঙ্গেয় তৈলঙ্গ’ জিভের সুখে হয়ে দাঁড়াল ‘গঙ্গু তেলি’। আপাতত ‘গঙ্গু তেলি’ হল আতিপাতি আম আদমির দ্যোতক।

ইন্দ্রপ্রস্থের নতুন সরকারের বিভিন্ন নীতি দেশের ‘গঙ্গু তেলি’দের (পড়ুন আম আদমির) মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে চলেছিল। আসছি সে কথায়। আগে একটু গান্ধারীর দেশ থেকে ঘুরে আসি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন