সেই ফুলের দল – ৫

অভীক মুখোপাধ্যায়

স্বাধীন ভারতের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে অটল-আডবানি জুটি প্রায় কিছুই করে দেখাতে পারেননি। তাঁরা স্বল্প অভিজ্ঞতাতেই বুঝেছিলেন যে, জিতবে কংগ্রেস, জিতবেন নেহরু, প্রধানমন্ত্রী নেহরু আরামসে নিজের ক্যাবিনেট গঠন করবেন। সেবারে সারা দেশে জনসঙ্ঘ লড়েছিল মাত্র ৩৪টি আসনে। জিতেছিল ক’টায়? তিনখানা সিটে। ভোট পেয়েছিল ৩.০৬ শতাংশ। আর এই ভোটই জনসঙ্ঘকে একটি জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিতি এনে দিল। নবাগত জনসঙ্ঘ পুরোনো হিন্দু মহাসভা কিংবা রামরাজ্য পার্টির চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল। রাজনৈতিক হিন্দুত্বের অঘোষিত মুখ হয়ে উঠল জনসঙ্ঘ।

যা বলছিলাম, অটলবিহারীর করা হিন্দি অনুবাদের ফলে যে অনেক সিট জেতা গিয়েছিল তেমন কিছুই কিন্তু ঘটেনি, কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় অটলবিহারীকে সরালেন না। বরং কিছু নতুন কাজ জুড়ে দিলেন। বললেন, এবার থেকে পার্লামেন্টের কাজকম্ম দেখবে, স্টেনোগ্রাফি করবে। আডবানি তখনও রাজস্থানে সঙ্ঘের প্রচারকের ভূমিকায় কাজ করছিলেন। অটলবিহারী ঢুকে পড়লেন লুটিয়েন্স দিল্লির সংস্কৃতিতে।

জনসঙ্ঘের মাথা হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সংসদে বিরোধী নেতার ভূমিকাটিকে যথাযথ ভাবে পালন করছিলেন। দিল্লিতে তখন মিউনিসিপ্যাল ভোট হয়েছিল। কংগ্রেস সেখানেও জয় লাভ করে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সংসদে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করলেন, কংগ্রেস ‘ওয়াইন অ্যাণ্ড মানি’ দিয়ে ভোট কিনেছে। নেহরুজি সেটাই ভুল শুনলেন, কংগ্রেস ‘ওয়াইন অ্যাণ্ড উম্যান’ দিয়ে ভোটে জিতেছে। তিনি তীব্র বিরোধ জানালেন। শ্রী মুখোপাধ্যায় বললেন, আপনি সদনের রেকর্ড তুলে দেখুন, এধরণের অসংসদীয় কথা বলার মতো কাজ আমি করি না। নেহরুজি নিজের ভুলে বুঝতে পেরে সেদিন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সামনে দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। রাজনীতির মূল্যবোধ তখন এমনই ছিল।

তবে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রাজনীতির পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসছিল। তিনি লোকসভায় মুখর হওয়ার চেয়ে বেছে নিলেন অন্য পথ। পথে নামো বন্ধু। ১৯৫৩ সালের জুন মাসে কাশ্মীরের উদ্দেশে রওনা দিলেন। একটাই প্রশ্ন, দেশের অংশ হওয়া সত্ত্বেও সেখানে কেন আলাদা আইনকানুন চলবে? ‘এক দেশ, এক বিধান, এক প্রধান, এক নিশান।’ কাশ্মীরের ক্ষেত্রে কেন সংবিধান আলাদা কথা বলবে? কেন সেখানে আলাদা প্রধানমন্ত্রী থাকবে? কেন সে রাজ্যের জন্যে পৃথক পতাকার ব্যবস্থা?

শ্রী মুখোপাধ্যায় যখন কাশ্মীরের জন্যে যাত্রা শুরু করেন, তখন তাঁর সঙ্গে একটি ছোট্ট প্রতিনিধি দল ছিল। সেই দলের অপরিহার্য অঙ্গ রূপে ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। শ্রী মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দলটি যখন পাঠানকোটের কাছাকাছি পৌঁছয়, তখন তাঁকে গ্রেফতার করে জম্মু এবং কাশ্মীর পুলিশ। শ্যামাপ্রসাদ তখন অটলবিহারীকে বলেন, দিল্লি ফিরে যাও, সেখানে বিক্ষোভ- প্রদর্শন চালাতে থাকো। অটলবিহারী ফিরে আসেন। শ্যামাপ্রসাদবাবুকে একটি বাড়িতে নজরবন্দি করে রাখা হয়। সেখানে থাকাকালীন অবস্থাতেই তিনি শারীরিক অসুস্থতার কথা জানান। ২২শে জুন তাঁকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি টেলিগ্রাম মারফত নিজের ভাইকে জানান, ‘আমার চিকিৎসার জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। বিধাতার অঙ্গুলিহেলনে সকলে পাঠের পুতুলের মতোই নাচতে থাকে। যদি শ্রী মুখোপাধ্যায়ের ভাবনা মতো চিকিৎসা অনুসারে তিনি আরোগ্য লাভ করতেন, তাহলে আগামী একাধিক দশক অটলবিহারী বাজপেয়ী নামক হিন্দি অনুবাদকটি তাঁর অধীনে কাজ করে যেতেন। ওদিকে লালকৃষ্ণ আডবানি রাজস্থানে সঙ্ঘের প্রচারক হিসেবে কাজ করতে-করতে একটার পর একটা ধাপ পেরোতেন। এর চেয়ে বেশি হয়তো কিছু হতো না। প্রতিটা মানুষ সমান্তরাল জীবন যাপন করে খুব বেশি হলে একে অপরের খোঁজখবরটুকুই রাখতে পারতেন। কিন্তু অদৃষ্ট এমনটা চায়নি। প্রত্যেকের ললাটলিপিতে অন্য কিছু লেখা হয়েছিল। সকলকে অবাক করে দিয়ে ১৯৫৩ সালের ২৩শে জুন খবর শোনা গেল: ‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আর নেই।’

শ্যামাপ্রসাদবাবুর মৃত্যুর খবর শুনে জনসঙ্ঘের সদস্যরা হায়-হায় করে উঠলেন। হিন্দুত্বের রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসার পরেও কিন্তু শ্যামাপ্রসাদবাবুর দল রাজনৈতিক হিন্দুত্বের মুখ হয়ে উঠেছিল। নেহরুজি-শেখ আবদুল্লাহর দিকে হিন্দুত্ববাদীরা আঙুল তুলল— শ্রী মুখোপাধ্যায়ের এই মৃত্যু হত্যা নয় তো? চাপানউতোর ছিল। আর ছিল উত্থানপতন। এক তারকার পতনে আরেক নক্ষত্রের জন্মের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল। তিনি ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী।

সুযোগটা এল শ্যামাপ্রসাদবাবুর মৃত্যুর ঠিক একবছরের মাথায়। ১৯৫৪ সাল। নেহরুজির বোন বিজয়ালক্ষ্মী পণ্ডিত তখন লখনউয়ের সাংসদ পদ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন ইউনাইটেড নেশনস-এ ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে। দীনদয়াল উপাধ্যায় এককভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন, ওই সিট থেকে জনসঙ্ঘের হয়ে ভোটে দাঁড়াবে বাজপেয়ী। সোনালি সুযোগ। এই উপকার নিজের জীবনে বাজপেয়ীজি ভুলতে পারেননি। তিনি যতদিন যেখানে-যেখানে অফিসে বসেছেন, সেখানে তাঁর টেবলে দীনদয়াল উপাধ্যায়জির ছবি সসম্মানে রক্ষিত থেকেছে। যদিও অটলবিহারী বাজপেয়ী সাধারণত এধরণের কাজ করা পছন্দ করতেন না।

যদিও সেবারের নির্বাচনে অটলবিহারী জিততে পারেননি। এক নম্বর দূরের কথা, দুইয়েও ঠাঁই হয়নি তাঁর। তৃতীয় নম্বর স্থান পেয়েছিলেন। পরাস্ত অটলবিহারী সেদিন এক বন্ধুকে নিয়ে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিলেন।

দীনদয়ালজি কিন্তু অটলের পরাজয়ে হার দেখলেন না। ভোটের প্রচার পর্বে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন অটলবিহারীর ভাষণ শুনে। সত্যিই বাজপেয়ীর মন্ত্রমুগ্ধকর বক্তৃতা রাখার ক্ষমতা ছিল বাজপেয়ীর। সেই ভাষণ লিখে-লিখে দিকে-দিকে ছড়িয়ে দিলেন শ্রী উপাধ্যায়। মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ছিল যুবক অটলবিহারীর তেজস্বী বাগ্মীতার কথা। ১৯৫৭ সালে আবার নির্বাচনের পালা এল। এবারে লখনউ আর মথুরার পাশাপাশি বলরামপুরের সিট থেকে অটলবিহারীকে দাঁড় করালেন দীনদয়াল উপাধ্যায়। ট্রেনের স্লিপার ক্লাসে চড়ে সারা রাত লৌহপথে অতিক্রম করে কোনও এক কাক-ডাকা ভোরে বলরামপুরে গিয়ে নামলেন বাজপেয়ী। শুরু হল জনসংযোগ। তিনি ভাষণের মধ্যে প্রবল প্রজ্ঞার ছাপ ফেলেছিলেন। কী দিন, কী রাত, নিজের হাতে দেওয়াল লিখলেন। সন্ধ্যে নামতে পাঁচিলে- পাঁচিলে জ্বেলে দিলেন জনসঙ্ঘের প্রতীক চিহ্ন, মাটির প্রদীপ। ওই নির্বাচনে তিনি লখনউ থেকে আবার হারলেন। মথুরাতেও জয় মিলল না। কিন্তু জিতে নিলেন বলরামপুরের আসন। এখানে একটা সমীকরণ ছিল। বলরামপুর ব্রিটিশ ভারতে একটি প্রিন্সলি স্টেট ছিল। হিন্দু রাজার শাসন ছিল সেখানে। দেশও স্বাধীন হওয়ার পর বলরামপুরে মুসলিম জমিদারদের রমরমা হল। কিন্তু প্রজারা আবার সকলেই হিন্দু চাষি। হিন্দু-মুসলিম ব্যাপারটা ভোটের ফলে ছাপ ফেলেছিল। এ এক অদ্ভুত নিদর্শন— ভবিষ্যতে যে ব্যক্তি ভারতের সেকুলার রাজনীতির মুখ হবেন, নির্বাচনে তাঁর প্রথম জয়টা এসেছিল বিভাজনের রাজনীতির হাতে ধরেই। আসলে সবই নিয়তির খেলা। ওই যে, কথায় বলে না, নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে!

.

অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রথমবার লোকসভায় পদার্পণ করলেন, তখন তাঁর বয়েস মাত্র ৩৩ বছর। তাঁর সহযোদ্ধা হিসেবে আরও তিনজন জনসঙ্ঘ প্রতিনিধি ছিলেন, কিন্তু দীনদয়াল উপাধ্যায় তাঁকেই লোকসভায় জনসঙ্ঘের দলনেতা রূপে বেছে নিলেন। পরে এই ভূমিকাটাই একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বাজপেয়ী আগামী ৫২ বছর ধরে পালন করবেন। তাঁর একটা বড় গুণ ছিল, তিনি এটা মাথায় রাখতেন না যে দলটা কে চালাচ্ছে, একটাই বিন্দু তাঁর মনে কাজ করত— তাঁকে সংসদে বলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কিনা।

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাজপেয়ীর বেশ কয়েকটি বিষয়ে দারুণ মিল ছিল। দুজনেই সংসদীয় শিষ্টাচারকে দারুণ ভাবে সম্মান করতেন। দুজনেই সুবক্তা ছিলেন। পার্থক্য অন্যত্র ছিল। শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং আদবকায়দায় কেতাদুরস্ত মানুষ। ইংরেজি মিডিয়া, বিদেশি অভ্যাগত এবং যে সকল রাজনেতারা শুধুমাত্র ইংরেজিতেই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন, তাঁদের জন্যে একেবারে লাজবাব। অটল এব্যাপরে একটু অসহজ ছিলেন। কেউ তো একবার বলেই বসেছিলেন, আমাদের দেশে দুধরণের নেতারা আছেন। এক, যারা কমোড ব্যবহার করেন, দ্বিতীয় শ্রেণীর নেতারা ভারতীয় প্যানে বসতে ভালোবাসেন। কমোড ব্যবহারকারী নেতারও দরকার আছে বইকি।

শ্যামাপ্রসাদ চলে গেলেন। তাহলে ইংরেজি ধাঁচের নেতার অভাব পূরণ হবে কী করে? সঙ্ঘের রাজনীতির একটা বড় দিক হল সেখানে সবসময় ব্যাক আপ বেঞ্চ থাকে। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেইসব খেলোয়াড়রা কিন্তু শুধুমাত্র ঠেকনা দেওয়া গোছের নন, তাঁরা খেলতে নামলে সেঞ্চুরিও করেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অভাব পূরণ করার জন্যে বেছে নেওয়া হল আডবানিকে। ১৯৫৭ সালের সাধারণ নির্বাচন শেষ হতেই তাঁকে দিল্লিতে ডেকে নেওয়া হল। বলা হল, আপনি এবার থেকে নতুন সাংসদ অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ‘ইংরেজি বলা’ লুটিয়েন্স দিল্লিতে সাহায্য করবেন।

শুরু হল এক অদ্ভুত যুগলবন্দি। আমি খুব সচেতন ভাবে এই শব্দটা লিখলাম। যুগলবন্দি তে যেমন পারস্পরিক সাহচর্য থাকে, তেমনি থাকে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রচ্ছন্ন প্রয়াস। একে অপরের বন্ধু হয়ে ওঠার পরবর্তী প্রায় ছ’দশক সময়কাল জুড়ে তাঁদের দুজনের সম্পর্ক যুগলবন্দির মতোই চলবে। কি, খুব ভুল বললাম?

প্রথম থেকেই দুর্দান্ত ভাষণ দিতে থাকা বাজপেয়ী তখন সংসদের তারকা- বক্তা। স্বয়ং পণ্ডিত নেহরুজি তাঁর ভাষণ শুনে মুগ্ধ হতেন। অত অল্প বয়েসে এধরণের সম্মান আদায় করে নেওয়া সহজ কাজ ছিল না। কারণ, সেই যুগটা বামনদের ছিল না যে।

আডবানির তখন কতই বা বয়েস? টেনেটুনে তিরিশ বছর। তিনি সঙ্ঘের হয়ে অনেক কাজ করলেও রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি তখনও শূন্য। তিনি কোনও কেউকেটা ছিলেন না। কোনও স্থানে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পাননি, এমনকি সেই সুযোগ পেলেও আদৌ কতটা ভালো বক্তব্য পেশ করতে পারবেন সেই নিয়ে সম্ভবত তাঁর নিজের মনেও অযুত-নিযুত সন্দেহ ছিল। বাজপেয়ীর কাছে আডবানি তখন কেমন বলুন তো? এই ধরুন, হোমসের পাশে ওয়াটসন কিংবা ব্যোমকেশের পাশে অজিত অথবা ফেলুদার পাশে তোপসে, এরকম।

বাজপেয়ীর ঠিকানা তখন ৩০ রাজেন্দ্র প্রসাদ রোডের সরকারি বাংলো, পার্লামেন্টের কাছেই। সাদা চুনকাম করা বাড়িটাতেই আস্তানা বাঁধলেন আডবানি। সঙ্গে আরেকজন ছিলেন, একুশ বছরের এক যুবক। এন এম ঘাটাটে। সঙ্ঘের একনিষ্ঠ ব্যক্তি।

বাজপেয়ী, আডবানি আর ঘাটাটের মধ্যে অদ্ভুত এক বন্ধন, একটি বন্ধুত্ব তৈরি হচ্ছিল। এবং এটা থেকে যাবে। দুজন রাজনীতিক ও একজন আইনজীবী আজীবন বন্ধু হয়ে থাকবেন।

পরের দিকে আডবানি অবশ্য রাজেন্দ্র প্রসাদ রোডের বাংলো থেকে সরে চলে আসেন রামলীলা ময়দানের বিজেপি কার্যালয়ের কাছে। তবে প্রতিদিন তিনি বাজপেয়ীর সঙ্গে দেখা করতেন। বন্ধুত্ব তো ছিলই, সম্পর্কের মধ্যে একটা শ্রেণীবিভাজনও ছিল। গুরু-শিষ্যর মধ্যে যেমনটা থাকে।

.

সংসদে তখন জনসঙ্ঘের লোক তখন মাত্র চারজন। বসতে দেওয়া হতো অনেক পেছনে। বলার সময় আর সুযোগ মিলত না। বাজপেয়ী রেগে যেতেন এসব দেখে। ওয়াক আউট করতেন। কিন্তু যতবার বাজপেয়ী বলার সুযোগ পেতেন, ততবার সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত। দেখলে মনে হতো, গোটা সংসদে শুধু জনসঙ্ঘের লোকেরাই আছেন, তাঁরাই শুনছেন বাজপেয়ীকে।

বাজপেয়ীর মতো প্রত্যুৎপন্নমতি ব্যক্তি কমই মেলে। তিনি যখন বলতে উঠতেন, তখন তাঁকে থতমত খাইয়ে দেওয়ার জন্যে আওয়াজ উঠলেও তিনি কুশলভাবে সেসব সামলে দিতেন। একবার বামপন্থীদের আক্রমণ করছেন, বাজপেয়ী বললেন, ‘স্পিকার মহোদয়, কমিউনিস্ট পার্টির ডেপুটি লিডার প্রফেসর হীরেন মুখার্জি মহাশয়, যাকে আমি খুব সম্মান করি…’ ফ্লোরে তখন রোল উঠল, ‘কব সে— কবে থেকে?’ বাজপেয়ী সুচারু ভঙ্গীতে বলে চললেন, ‘তাঁর জ্ঞানের জন্যে, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যে নয়…’।

একজন বাধ্য ছাত্র যেভাবে পড়াশোনা করে, বাজপেয়ী সেভাবে নিজের ভাষণ নিয়ে কাটাছেঁড়া করতেন। প্রতিদিন লোকসভার কাজকম্ম মিটিয়ে বাংলোতে ফেরার পর বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তিনি নিজের সারাদিনের বক্তব্যের খসড়া নিয়ে বসে সেগুলোকে শোধরাতেন। এ এক বিরল অভ্যাস ছিল। কস্মিনকালে কেউ করেছেন বলে মনে হয় না।

বাজপেয়ী কবিতা লিখতেন, কিন্তু হিন্দি এবং বাংলা অনেক কবিই বলেছেন যে তাঁর কবিতা উচ্চমানের ছিল না। ছিল কি ছিল-না সে তর্কে জড়াব না, তবে এটুকু মানতেই হয় একজন রাজনীতিক রূপে তাঁর শব্দচয়ন অন্যদের তুলনায় এতটাই উৎকৃষ্ট ছিল যে তিনি চোখে পড়ার মতো বক্তৃতা দিতেন। তাঁর কবিতা ভালো নাও হতে পারে, কিন্তু তাঁর ভাষণ সত্যিই খুব ভালো হতো।

নেহরুজি বাজপেয়ীর বিদেশনীতি সংক্রান্ত ভাষণের ভুয়সী প্রশংসা করে একটি বক্তব্য রেখেছিলেন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এগুলো শুনলে গুলগল্প মনে হতে পারে। কিন্তু সত্যিই এমনটা ঘটেছিল। একবার রাশিয়ান প্রিমিয়ার নিকিতা ক্রুশ্চেভ ভারতে এসেছেন। পার্টি থ্রো করেছেন প্রধানমন্ত্রী। খেয়াল রেখেছেন যেন তাঁর প্রিয় বাজপেয়ী বাদ না পড়েন। বাজপেয়ী পৌঁছতেই তিনি ক্রুশ্চেভের কাছে নিয়ে গেলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘এই দেখুন, এই ছেলেটি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।’ ক্রুশ্চেভ যেমন ক্ষুরধার পলিটিসিয়ান ছিলেন, তেমনি ধারালো ছিল তাঁর রসিকতাও। সোজা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন পণ্ডিত নেহরুজিকে, ‘তা ইনি এখানে কী করছেন? আমাদের দেশে হলে তো গুলাগে থাকতেন।’’গুলাগ’–এর কথা কে না জানে? গুলাগ হল সোভিয়েতের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, যেখানে স্তালিন বহু মানুষকে বন্দি করে নির্যাতন দিতেন, হত্যা করতেন।

ভাবছেন, শুধু মাত্র বাজপেয়ীর মহিমাকীর্তন করে চলেছি। আডবানিকে জায়গা দিচ্ছি না। না রে, ভাই। তিনি তাঁর মতো করে পরিপক্ক হয়ে উঠছিলেন। প্রতিদিন বাজপেয়ীর বক্তৃতাকে আরও ক্ষুরধার কীভাবে করে তোলা যায় তার কাজ করছিলেন। দিল্লির জনসঙ্ঘ ইউনিট নিয়ে খাটছিলেন। একটা বিষয় আডবানিকে অবাক করেছিল, ১৯৫৮ সালের দিল্লি মিউনিসিপ্যাল ইলেকশনে জনসঙ্ঘের মতো একটি দল কীভাবে বাম দলের সঙ্গে জোট করতে পারে। তিনি বুঝছিলেন, রাজনীতি মানে দিবে আর নিবে, মেলাবে মিলিবে।

ওই নির্বাচনে জনসঙ্ঘ হেরে গিয়েছিল। আডবানি আর বাজপেয়ী মিলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। সিনেমার নাম ‘ফির সুবহ হোগি’। প্রধান চরিত্রে রাজ কপূর আর মালা সিনহা। ফিয়োদোর দস্তভয়েস্কির লেখা ‘ক্রাইম অ্যাণ্ড পানিশমেন্ট’-কে ভিত্তি করে গড়ে তোলা কাহিনির মূল উপজীব্য বিষয় ছিল সদ্য স্বাধীন দেশ ভারতের অন্ধকার দিক। মুভির থীম সং ছিল ‘উয়ো সুবহ কভি তো আয়েগি’। সমাজের নির্যাতনে অস্থির নায়ক-নায়িকা একে অপরের বাহুডোরে আবদ্ধ হয়ে নতুন এক প্রভাতের স্বপ্ন দেখছিলেন। দুই বন্ধু যেমন ওই ছায়াছবি দেখতে-দেখতে কোনো ভোরের স্বপ্ন দেখছিল। যে ভোরে অন্ধকারের বুক ভেদ করে আলো ফোটার সাথে-সাথে পদ্ম ফুটবে। অন্ধেরা ছুঁটেগা, কমল খিলেগা!

.

বাজপেয়ীজি সময় কাটানোর জন্যে সিনেমা দেখতে ভালোবাসতেন, আর আডবানিজির কাছে সিনেমা ছিল প্যাশন। অর্গানাইজার পত্রিকার ফিল্ম রিভিউ কলামটা চালাতেন আডবানিজি। তাঁর একটা ছদ্মনাম ছিল। রাজনেতা লালকৃষ্ণ আডবানির সেই ছদ্মনাম আজ ক’জন মনে রেখেছে কে জানে? তিনি ‘নেত্র’ নামের আড়ালে লিখতেন। এখন বলতেই পারেন যে, সিনেমার রিভিউ লেখার জন্যে আবার ছদ্মনাম ধারণের ভনিতার কী প্রয়োজন? ছিল রে, ভাই। দরকার ছিল। বলছি সে কথাই।

ধরুন, রিচার্ড অ্যাটেনবোরো যখন ‘গান্ধী’ সিনেমাটি তৈরি করছেন, তখন পণ্ডিত নেহরুজির সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল। রিচার্ড কোনও ভারতীয়কে নামভূমিকায় অভিনয় করতে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁর মনে হয়েছিল গান্ধীজির চরিত্রে কোনও ভারতীয়ই ভালো অভিনয় করতে পারবে না। পণ্ডিত নেহরু এই মানসিকতার কথা জানা সত্ত্বেও রিচার্ডকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। আডবানি এটা নিয়েই লিখলেন। তুলোধোনা করলেন সরকারকে। স্বাভাবিকভাবেই এসব নিয়ে লিখতে গেলে ছদ্মনামের দরকার ছিল। পরে ১৯৮২ সালে গিয়ে ছায়াছবিটি মুক্তি পায়, এবং আটটি অস্কার জেতে।

সিনেমার রিভিউ লিখে আডবানিজি উপার্জন করছিলেন। টাকাটা তখনকার দিনের হিসেবে খুব কম কিছু ছিল না। ছ’য়ের দশকে প্রতিমাসে সাড়ে তিনশো টাকা। নেহরুজির জমানায় সাংবাদিকদের যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হতো। তাঁদের বাসস্থানের জন্যে একটি বিশেষ কোটা সিস্টেম চালু ছিল। সেই কোটার ভিত্তিতে আডবানিজি আর.কে.পুরম-এ একটি ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট পেয়েছিলেন। তেরো বছর আগে দেশভাগের ধাক্কা করাচি থেকে যে গাছটাকে উপড়ে দিয়েছিল, দিল্লির মাটিতে আবার তারই শেকড় গজাচ্ছিল।

আডবানির একটা স্কুটার ছিল। প্রতিদিন সকাল হলেই সেটায় চড়ে চলে যেতেন দিল্লির আরএসএস হেডকোয়ার্টার ঝান্ডেওয়ালায়।

স্বাধীন ভারতের তৃতীয় সাধারণ লোকসভা নির্বাচন হল ১৯৬২ সালে। অটলবিহারী বাজপেয়ী নিজের জেতা সিট বলরামপুর থেকে দাঁড়ালেন। বিপক্ষে সুভদ্রা জোশি। একটু ভুল বললাম, এবারে তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন তৎকালীন ভারতীয় সংসদের সবচেয়ে বড় নেতা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। কারণ সুভদ্রা জোশির জন্য পণ্ডিতজি নিজে অটলবিহারীর কেন্দ্রে গিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন এবং সুনিশ্চিত করে এসেছিলেন অটলবিহারীর পরাজয়। অটলবিহারী হারলেন। খুব অল্প ভোটেই তাঁর পরাজয় ঘটেছিল। দলের সম্পদ বাজপেয়ীজি কেন্দ্রে দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন না একথা তখন দীনদয়াল উপাধ্যায়ের ভাবনার অতীত ছিল। তিনি অটলবিহারীকে সুযোগ করে দিলেন রাজ্যসভায়।

ওদিকে ভারত-চিন সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ছিল। ছোটখাটো কথা- কাটাকাটি, হাতাহাতির ঘটনার পর চিন ভারতীয় ভূভাগে অনুপ্রবেশ ঘটাল। বীরের মতো লড়লেন ভারতের জওয়ানরা। অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে চিন হামলা করেছিল। ভারতীয় সেনার কাছে ঠিকঠাক পোশাক, অস্ত্র কিছুই ছিল না। ভারত হারল চিনের কাছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির মধ্যস্থতায় পরে অবশ্য চিন পিছু হটে। ‘যুযুৎসু’-তে একথা বিস্তারে লিখেছি।

চিনের কাছে ভারতের পরাজয় মানতে পারল না সঙ্ঘ। ফুঁসে উঠল। বলা হল, নিজেদের হৃত ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্যে ভারতের ধর্মযুদ্ধে নামা উচিত। হিন্দু ঐক্যের কথা তোলা হল। নেহরুজি সংসদে বললেন যে, কিছু পাথুরে, বাঁজা জমি দখল হয়েছে মাত্র— ‘একটা ঘাসও গজায় না ওখানে…’। নেহরুজির কথার প্রসঙ্গে একজন অভিজ্ঞ কংগ্রেস সাংসদ বলতে উঠলেন। ভদ্রলোকের নাম মহাবীর ত্যাগী। তাঁর চোখে চশমা, মাথাজোড়া টাক। নিজের ইন্দ্রলুপ্ত সম্পন্ন মাথাটিকে দেখিয়ে বললেন, ‘এখানেও কিচ্ছু গজায় না, তাহলে এটাও কাউকে দিয়ে দিই?’

সদনে নেহরুর সবচেয়ে সুযোগ্য ছাত্র বাজপেয়ী কি কিছুই বলেননি? তা কী করে হয়? তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশ মাটির টুকরো নয়, জ্বলজ্যান্ত দেশমাতৃকা।’ এর কয়েক বছরের মধ্যেই চিন পরমাণু পরীক্ষণ করল। অটলবিহারী তখন বলেছিলেন, ‘পরমাণু বোমার উত্তর কী হতে পারে? শুধুমাত্র আরেকটা পরমাণু বোমাই হতে পারে তার যোগ্য জবাব, আর কিচ্ছু নয়।’ সম্ভবত নিজের মনের সঙ্গোপনে তিনি এই উত্তরটিকে লালন করেছিলেন বছরের -পর-বছর। অনেক পরে নেহরু-কন্যার যোগ্য উত্তরসূরী রূপে বন্ধু তথা পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওয়ের হাত থেকে ব্যাটন নিয়ে একদিন গোটা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমরা উত্তর দিতে জানি। কোন দিন বলুন তো? যেদিন বুদ্ধ দ্বিতীয় বার হেসেছিলেন।

যাক গে, এসব অনেক পরের কথা। আসব… আসব… আমরা আসব এসবেও। কিন্তু আপাতত চিনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধের পরের গল্পটা বলি। সঙ্ঘ ভারতের অস্মিতা রক্ষার তাগিদে কিংবা নিজেদের হিন্দুত্বের মানচিত্রকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধের কথা জোর গলায় বলছিল। যুদ্ধ চাই জিগির উঠছিল। সঙ্ঘের পক্ষ থেকে নেহরুজিকে বলা হল, আমাদের স্বয়ংসেবকেরা দরকারে যুদ্ধে যেতেও রাজি। পণ্ডিত নেহরু সঙ্ঘের ডাকে একটু অন্যভাবে সাড়া দিলেন। ১৯৬৩ সালের ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসে সঙ্ঘের পোশাকে, সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকেরা প্যারেড করলেন দিল্লির রাজপথে। পরনে সাদা জামা, খাঁকি হাফ প্যান্ট (পরে সঙ্ঘের বিরোধীরা এই হাফ প্যান্টের দরুণ সঙ্ঘীদের চাড্ডি বলতে শুরু করবে। যদিও চাড্ডি নামকরণের ইতিহাস অবশ্য একেবারে অন্য। অনেকেই না-বুঝে হাফ প্যান্টের প্রসঙ্গ বোঝাতে সঙ্ঘের লোকেদের চাড্ডি বলে থাকেন।), বেল্ট, মাথায় কালো টুপি পরে দুহাজার স্বয়ংসেবক দিল্লির মাটি দাপিয়ে বেড়ালেন। চোরা স্রোতের মতোই আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে সঙ্ঘ ভারতীয় রাজনীতির মূল শাখায় প্রবেশ করল। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ভয় এবং সমালোচনার ঝড় দেখা দিল। মিটিং বসল। নেহরুজি জবাবদিহি করলেন, স্বাধীন ভারতের যে কোনও নাগরিক প্যারেডে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সঙ্ঘ-ও করেছে। পালটা প্রশ্ন উঠল: ‘দিল্লি সেবাদল (কংগ্রেসের দ্বারা পরিচালিত স্বয়ংসেবক সংস্থা)-ও তো অংশগ্রহণ করতে পারত?’ নেহরু সেদিন যে উত্তর দিয়েছিলেন, তা স্পষ্ট করে দিয়েছিল সঙ্ঘের অনুশাসনের দিক যথেষ্ট উন্নত। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের স্বয়ংসেবকদের কাছে মাত্র ২৫০ খানা ইউনিফর্ম আছে। সঙ্ঘের শক্তি অনেক বেশি। সেবাদলের প্রদর্শনও ভালো হতো না।’

রাজনৈতিক তর্কের আসরে কেউ মানুক বা না-মানুক, আসলে ১৯৬২ সালের চিন-ভারত দ্বৈরথের পরে কিন্তু সঙ্ঘের হিন্দুত্ব নেহরুজির শাসনে দাঁত ফোটাতে আরম্ভ করেছিল। সঙ্ঘ এইসময়ে তিনটি বিন্দুকে নিজেদের এজেন্ডা হিসেবে নেবে। এই নীতিগুলি পরবর্তীকালে ভারতীয় রাজনীতিকে আকার প্রদান করবে। কী ছিল সেই তিনটি নীতি?

১. হিন্দু জনসংখ্যার দিকে নজর দেওয়া। (যা অনেক পরে ভারতকে এনআরসি, সিএএ সংক্রান্ত বিষয়ের দিকে নিয়ে যাবে।)

২. সীমান্তের সঙ্গে ধর্মের প্রসঙ্গ জুড়তে থাকা। (পাকিস্তান কিংবা চিনের ক্ষেত্রে যা দেখা দেবে।) এবং

৩. রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে অসাম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে। (এর সবথেকে বড় উদাহরণ হল জন্ম এবং কাশ্মীরের ৩৭০ ধারার বিলোপ।)

জনসঙ্ঘ নিজের মতো করে রাজনৈতিক ছবি তৈরি করছিল, বাজপেয়ীজি নিজের মতো করে। আর নেহরুজি? ১৯৬৪ সালের ২৭শে মে তিনি এই সবকিছুর ঊর্দ্ধে চলে গেলেন। অটলবিহারী নিজের শ্রেষ্ঠ শব্দ চয়নের মাধ্যমে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিলেন, ‘আজ ভারতমাতা দুখী হ্যাঁয়, উনহোনে আপনে সবসে কিমতি সপুত খো দিয়া…।’

বাজপেয়ী মুখর হলেও শুধু মুখই ছিলেন, মস্তিষ্ক তখনও দীনদয়াল উপাধ্যায়। তাঁরই অঙ্গুলিহেলনে সঙ্ঘের পক্ষ থেকে জনসঙ্ঘকে উদারবাদী ভাবে বিচরণ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল। এই ঔদার্য পরবর্তীকালে আডবানিকে প্রভাবিত করবে।

জনসঙ্ঘ একটা সময়ে এসে মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলের পথ থেকে সরে একটু অন্যরকম ভাবে আচরণ করছিল। আচরণটা ছিল আন্দোলনকারীদের মতো। শ্রী সাভারকর এবং শ্রী গোলওয়ালকর হিন্দুত্বের কথা বলেছিলেন, কিন্তু উভয়ের বক্তব্যে এটা বলা ছিল না যে, বিরোধী পক্ষ থেকে (কেন্দ্রীয় সরকারে) ক্ষমতাধারী রাজনৈতিক দলে পরিণত হলে হিন্দুত্বের মানচিত্রটা কেমন দাঁড়াবে। যেহেতু জনসঙ্ঘের জনপ্রিয়তা বাড়ছিল, সেহেতু এই ভাবনাটা নিয়ে বসার সময় এসে গিয়েছিল। আর এই ঠিক ওই সময়েই দীনদয়াল উপাধ্যায় একটি নতুন মতবাদ খাড়া করলেন— ‘একাত্ম মানবতাবাদ’।

এই মতবাদের আমদানি হয়েছিল ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে, জনসঙ্ঘের বিজয়ওয়াড়া সম্মেলনে। সঙ্ঘের মতো একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের ছত্রছায়া থেকে জন্ম নেওয়া একটি রাজনৈতিক দলের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে এর থেকে বড় যুগান্তকারী পদক্ষেপ আর কিছুই হতে পারে না।

ওই বছরের এপ্রিল মাসের অন্তিম সপ্তাহে বোম্বে’তে দীনদয়াল উপাধ্যায় নিজের তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিলেন—

১. অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী আনতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের-নিজের ধর্মমত অনুসারে উপাসনা করার স্বাধীনতা আছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রনীতির পরিপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে মান্যতা দিতে হবে। ভারতবর্ষ কতদিন মুসলিম কিংবা ব্রিটিশ শাসনে থেকেছে সে কথা বলে লাভ নেই। সত্যিই তো, গঙ্গা দিয়ে যে জল বয়ে গেছে, তাকে আবার ফিরিয়ে আনা যায় কি?

২. কংগ্রেসের বিভিন্ন পরস্পর-বিরোধী নীতির বিপরীতে তিনি একগুচ্ছ নীতি নিয়ে এগোনোর কথা বললেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা হয়েছিল, কংগ্রেসের ঝাঁপিতে শুধু সাপ আর নেউল থাকে, জনসঙ্ঘের ক্ষেত্রে সমগ্র অরণ্যের সম্পদ থাকবে।

৩. চিত্তকে শুদ্ধ করতে হবে। একমাত্র শুদ্ধ চিত্তই ভারতবাসীকে ভারতের সঙ্গে একাত্ম করতে পারবে।

এই তিনটি বিন্দুই আগামীদিনে ভারতীয় জনতা পার্টির নীতি নির্ধারক হয়ে দাঁড়াবে।

বিজয়ওয়াড়া সম্মেলন থেকে আডবানি দিল্লির বাড়িতে না-ফিরে সোজা চলে গিয়েছিলেন বোম্বে শহরে। একটি মেয়ের টানে। করাচি থেকে যখন আডবানিকে চলে আসতে হয়, তখন তিনি প্রায় উনিশ। সেই সময়ে ওই বয়েসি ছেলেদের বিয়ে হয়ে যেত। আডবানির বিয়েথা হয়ে ওঠেনি। এদেশে আসার পরে তিনি টানা একটা দশক রাজস্থানে সঙ্ঘের প্রচারক রূপে কাজ করছিলেন। তাই ওই সময়টাতে বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এরপরে তিনি প্রবেশ করেছিলেন রাজনৈতিক আঙিনায়। পা রেখেছিলেন বড় শহরে। মাথাগোঁজার মতো আস্তানা পেয়েছিলেন। মাস গেলে হাতে মাইনে বাবদ কিছু অর্থকড়ি আসছিল। আডবানির ছোট বোন দাদার বিয়ের জন্যে উতলা হয়ে উঠেছিলেন। দাদাকে বিয়ের কথা বললেই তিনি বলছিলেন, ‘জীবনে কোনও মেয়ের সঙ্গে কথাই বলিনি।’ শেষে বোনের আদেশের মতো অনুরোধে তিনি দক্ষিণ বোম্বের উদ্দেশে রওনা দিলেন। মেয়ে দেখতে।

জগতিয়ানি পরিবার করাচি থেকে বোম্বেতে এসেছিল। করাচিতেই রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিল নিজেদের জাতকাট ব্যবসা, টাকাপয়সা সবকিছু। বাড়ির মেয়ে কমলাকে তাই সংসার চালাতে বাইরে বেরোতে হচ্ছিল। তিনি স্থানীয় পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। সিন্ধি পরিবারের ছিন্নমূল হওয়ার এই সূত্রটাই সম্ভবত কমলা আর লালকৃষ্ণকে একে অপরের মনের খুব কাছাকাছি এনে ফেলেছিল।

আডবানির মধ্যে ছিল অসম্ভব দায়িত্ববোধ। রাজনীতি তাঁকে অভিজ্ঞতা দিচ্ছিল ঝুলি ভরে। কমলার মধ্যে ছিল বাস্তববোধ। রশি ছিঁড়ে বয়ে যাওয়া একটা নৌকো ঘাট খুঁজে পেয়েছিল যেন।

যে আডবানি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলিকে দেওয়া বিশেষ ছাড়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাঁরই বিয়ের সম্পূর্ণ আয়োজনটা হয়েছিল চার্চগেট স্টেশনের কাছে সিন্ধিদের কে.সি. কলেজে। কে.সি. কলেজ ছিল সংখ্যালঘুদের জন্যে বিশেষ অধিনিয়মের ভিত্তিতে তৈরি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

বিয়ের পর কমলা ঘরে-বাইরে সবদিকই সামলাবেন। চাকরি করবেন। দুই সন্তান জয়ন্ত এবং প্রতিভাকে বড় করে তুলবেন। লালকৃষ্ণ তাঁর কাছে পরের একান্ন বছরের জন্যে শুধুই ‘আডবানি’। অনেক পরে আডবানি ভারতের গৃহমন্ত্রী হলে কী হবে, তাঁর গৃহমন্ত্রকের ক্ষমতা থাকবে কমলার হাতেই।

বিয়ে, দাম্পত্য এসবের কথা যখন উঠলই, আমরা আবার ফিরে যাব বাজপেয়ীর কাছে। তিনি একটি অমোঘ মন্তব্য করেছিলেন নিজেকে নিয়ে— ‘ম্যায় কুঁয়ারা হুঁ, ব্রহ্মচারী নহি।’ আডবানি যতখানি সংসারি ছিলেন, বাজপেয়ী ছিলেন সে তুলনায় অনেকটাই রঙিন, বেপরোয়া।

আচ্ছা, বাজপেয়ীর জীবনে সেই যে একবার প্রেম এসেছিল, তারপর কী হল? কিচ্ছু হয়নি। রাজকুমারী নাম্নী মেয়েটির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এক অধ্যাপকের সঙ্গে। তারপর কী হল? ভাবছেন ধুর মশাই, খালি তারপর আর তারপর। আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। বলছি। বুঝেছি, আপনারা বাজপেয়ীর জীবনের নাড়ীনক্ষত্র না-জেনে ছাড়বেন না। লোকসভার সাংসদ হওয়ার পরে বাজপেয়ী সঙ্ঘের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ পেয়ে গেলেন রামযশ কলেজে। উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে এক মধ্যবয়স্ক প্রফেসর নিজের স্ত্রী’কে নিয়ে সেদিন উপস্থিত ছিলেন। ভাগ্যের কেমন ফের দেখুন, যে ভালোবাসাকে বাজপেয়ী কলেজ জীবনের পরে ছেড়ে এগিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেই ভালোবাসাকেই আবার ফিরে পেলেন অন্য একটি কলেজে। আজ্ঞে হ্যাঁ, ওই প্রফেসর ভদ্রলোকের নাম ছিল বৃজমোহন কৌল, আর তাঁর স্ত্রী’র নাম রাজকুমারী কৌল। ষোল বছর পরে আবার দুজনের চোখাচুখি হল।

কথা হল। সম্পর্ক আবার দানা বাঁধল। বাজপেয়ী নিয়মিত কৌলদের বাড়িতে যেতেন, নিজের বাড়িতে মিস্টার কৌলকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ জানাতেন। একটা কালো অ্যাম্বাস্যাডার গাড়ি এসে প্রায়ই দাঁড়াত কৌলদের ঠিকানায়। অটলবিহারী আসতেন। কৌল ফ্যামিলির বাচ্চাদের সঙ্গেও তিনি বেশ মিলেমিশে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে পরিবারের ছোট মেয়ে নমিতার সাথে। অটলবিহারী তাঁকে আদর করে ডাকতেন ‘গুন্নু’ বলে।

রাজকুমারীর সঙ্গে অটলবিহারীর সম্পর্কের ভিত্তি ছিল বুদ্ধিমত্তা। নরম ভাবে কথা বলা রাজকুমারী দৃঢ় ভাবে বক্তব্য পেশ করে অটলের মতো সুবক্তাকেও প্রভাবিত করে ফেলতে পারতেন। ভদ্রমহিলা ইংরেজিতে কথা বলায় ছিলেন একেবারে সাবলীল। লুটিয়েন্স দিল্লিতে স্বাধীনতার পর থেকে যে ‘কাশ্মীরি মাফিয়া’ চক্রটি ছিল, তিনি সেটাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তাই প্রশাসন এবং রাজনীতি দুটো ব্যাপারই তিনি বেশ ভালো বুঝতেন। কাশ্মীরি মাফিয়ার কথা যখন উঠলই, তখন ছোট্ট করে দু-চার শব্দে এটা নিয়ে বলে রাখি। পণ্ডিত নেহরু নিজে কাশ্মীরি ছিলেন। তাঁকে ঘিরে যে সকল প্রশাসনিক ব্যক্তিরা থাকতেন, তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন কাশ্মীরি পণ্ডিত। ইন্দিরা গান্ধীর সময়েও এই একই জিনিস দেখে গিয়েছিল। এঁরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে মাথা গলাতেন। হাকসার সাহেব, পি এন ধর (বাঙালি ধর নন, কাশ্মীরি। ইসলামে ধর্মান্তরিত হলে ধর’টাই দাঁড়ায় দার।) প্রমুখ ব্যক্তিরা। তা এঁদেরই খুব কাছ থেকে দেখতে-দেখতে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ় ভাবে বলতে শিখে গিয়েছিলেন রাজকুমারী।

রাজকুমারীর সঙ্গে অটলবিহারী বাজপেয়ীর এই সম্পর্কটাকে সঙ্ঘ ভালো চোখে দেখছিল না। এমনিতেই বাজপেয়ী সমাজবাদী ধারায় প্রভাবিত ছিলেন। তার ওপরে রাজকুমারী কৌলের সঙ্গ তাঁকে আরও বেশি উন্মুক্ত, উদারমনা করে তুলছিল। নিজেদের সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন বাজপেয়ীর মধ্যে এই পরিবর্তনগুলোকে কিছুতেই মানতে পারছিল না সঙ্ঘ।

মিস্টার কৌল এই সম্পর্ক নিয়ে কখনওই অস্বস্তিতে ছিলেন না। তিনি খুব সোজাসাপ্টা কথা বলতেন। প্রশ্নটা তুলছিল বাজপেয়ীর নিজের দল থেকেই। জনসঙ্ঘের এক প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য তথা নেতা বাজপেয়ীকে ডেকে বললেন, ‘তুমি বিয়ে করে নাও, নইলে তোমার বদনাম হবে, আর তোমার জন্যে জনসঙ্ঘের গায়েও কালি লাগবে।’ এই নেতাই হয়ে দাঁড়াবেন বাজপেয়ীর রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম প্রতিপক্ষ। নাম বলরাজ মাঢোক।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন