সেই ফুলের দল – ১৭

অভীক মুখোপাধ্যায়

জনতা দলের পক্ষ থেকে ভিপি সিং প্রধানমন্ত্রী হলেন। খিচুড়ি ফ্রন্টের সরকার। এর আগে ভারতবাসী জনতা পার্টির রামধনু সরকার দেখেছিল। মোহভঙ্গ হয়েছিল বলে আবার ইন্দিরা গান্ধী ফিরে এসেছিলেন। এবারে একদম গোড়া থেকেই মনে হচ্ছিল জোট ভঙ্গুর। জনতা দলের স্তম্ভ ভিপি সিং নিজে প্রাক্তন কংগ্রেসী, তিনি হাত মিলিয়েছেন কাদের সঙ্গে? না, মুলায়ম সিং, লালু প্রসাদ যাদব ইত্যাদি ইত্যাদি নেতার সঙ্গে। গান্ধীবাদীর সঙ্গে সমাজবাদীর মিশেল কি হয়? হতে পারে, সে বড় বিরল ঘটনা। যেমন ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ কিংবা অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু সবাই তো জেপি বা অটল হয় না, ভাই। জনতা দলের অন্দরে শুধু স্পর্ধা ও প্রতিস্পর্ধার দৌড় জন্ম নিতে শুরু করল। ‘ক্যু’ ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর গদি উলটে দেওয়ার চক্রান্ত হতে থাকল।

জনতা দলের সরকার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল। ক্রাচের মতো ঠেকনা জোগাচ্ছিলেন ভাজপার ৮৫ জন এমপি। ভাজপার অধ্যক্ষ আডবানিজি তখন অন্য কিছু ভাবছিলেন। না, ভিপি-কে সরিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন তিনি দেখেননি। তাঁর স্বপ্ন তখন রামমন্দির। আর এখান থেকেই সংঘাত জন্ম নিল। কারণ ভিপি নিজে এ জাতীয় প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। তাঁর ‘বামো-রামো’ সরকারের বাম জোটসঙ্গীরাও অযোধ্যায় রামমন্দিরের কথা কল্পনা করতে পারতেন না।

ইত্যবসরে বিহিপ জানাল ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা অযোধ্যায় রামমন্দিরের কাজ আরম্ভ করবে। সরকার সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেল। আডবানিজিও ফাঁপরে পড়লেন। তাঁর তখন শাঁখের করাত গোছের দশা। তিনি রামমন্দির চান, কিন্তু এটা চান না যে সরকার পড়ে যাক। বিহিপ পক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে এই নির্মাণের কাজকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া গেল।

চাপান উতোরের এই খেলায় জনতা দল ও ভাজপার মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠছিল। সামনে তখন ছ’টা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। সিট ভাগাভাগি নিয়ে হাওয়া গরম হতে লাগল। হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান আর গুজরাতে ভাজপা জিতল। গুজরাতের ভোটে গ্রামে গ্রামে ঘুরে হিন্দু ভোটকে একত্রিত করতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সেদিনের যুবক নরেন্দ্র মোদি। বলা হয়, জাতির নিরিখে কোথায় কত ভোট আছে, কোন জাতির কী প্রথা, সেখানে কার কথা কতখানি চলে তা নরেন্দ্র মোদি নিজের নখদর্পণে রাখতেন।

এই জয় আডবানিজির রাজনৈতিক ওজন বৃদ্ধি করল। বিখ্যাত কার্টুনিস্ট আর কে লক্সমণের ততোধিক বিখ্যাত কমন ম্যানের মূর্ত প্রতীক লালকৃষ্ণ আডবানি আস্তে আস্তে অসাধারণ হয়ে উঠছিলেন। একজন পলিটিক্যাল লেজেন্ড জন্ম নিচ্ছিল।

পাশাপাশি আরেকজনের উচ্চতা ভাজপার মধ্যে ক্রমশ বাড়ছিল। তাঁকে আডবানিজিই সঙ্ঘের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তিকে দলের জেনারেল সেক্রেটারি রূপে চেয়ে এনেছিলেন। হাতে গ্রহরত্নের অঙ্গুরীয় আর কপালে সিঁদুরের তিলক কাটা ভদ্রলোক ফিজিক্সের অধ্যাপনা করেছিলেন এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে। তাঁর থিসিস পেপার ছিল স্পেক্ট্রোস্কোপি। আডবানিজির চেয়ে বছর সাতেকের ছোট এই ব্যক্তিটিকেও হিরের মতো পরখ করে জনসঙ্ঘের রত্নমালায় গেঁথেছিলেন। চিনে ফেলেছেন, আশা করি। নাম মুরলি মনোহর জোশি।

তো যা বলছিলাম, এম এম জোশির উত্থান ঘটছিল। তিনি কিন্তু অটল এবং আডবানির থেকে একদম আলাদা একজন মানুষ। নেহরুপন্থী নন। গান্ধীবাদী সমাজবাদে বিশ্বাসী নন। দেশভাগের যন্ত্রণায় মনে বদল এসেছে এমনও নন। হয়তো এগুলোর কোনটাই না থাকাটা জোশিজির সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হয়ে উঠেছিল। তিনি তখন সঙ্ঘের নয়নমণি। ১৯৮৬ সালে জোশি ভাজপার জেনারেল সেক্রেটারি হন, আর পরবর্তী চার বছরের মধ্যে হয়ে ওঠেন আডবানিজির বৃহত্তম প্রতিদ্বন্দী। ভাজপার অন্দরমহলে শীতযুদ্ধ চলছিল।

ভাজপার ভেতরে যেমন যুদ্ধ চলছিল, তেমনি লড়াই চলছিল খিচুড়ি সরকারের পাওয়ার করিডরে। জোটসঙ্গীদের প্রায় প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রী হতে চাইছিল। সবচেয়ে হেভিওয়েট দাবিদার ছিলেন হরিয়ানার দেবীলাল। আসছি, দেবীলালের কথায়। আগে সময়সারণীতে সামান্য পিছিয়ে গিয়ে একটু গৌরচন্দ্রিকা সেরে নিই।

৬ই এপ্রিল, ১৯৯০ ভাজপার দশ বছর পূর্ণ হল। কলকাতায় রাষ্ট্রীয় কার্যকারিণী বৈঠক ছিল। আডবানিজি বললেন, ‘১৯৯০ সাল ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। এই বছরটা অনেকটাই ১৯৭৭ সালের মতো, সেবারের মতো এবারেও ভোটে নতুন দিল্লিতে কংগ্রেসকে সরিয়ে একটি অ-কংগ্রেসী সরকার তৈরি হয়েছে। তবে একটা বড় ফারাকও আছে। ১৯৭৭ সালে মনে করা হয়েছিল দেশ রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে এগোচ্ছে, কিন্তু ১৯৯০ সালে এসে একথা প্রমাণিত যে, ভারতে বিশুদ্ধ দ্বিদলীয় পদ্ধতি ব্যবহার্য নয় এবং আমরা এবার বহুদলীয় রাজনীতির দিকে এগোচ্ছি।’

এপ্রিল থেকে জুলাই, মাত্র চারটি মাস। তার মধ্যেই জনতা দলের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ দেখে আডবানিজির মতের পরিবর্তন ঘটল।

২১শে জুলাই, ১৯৯০। মাদ্রাসে ভাজপার রাষ্ট্রীয় কার্যকারিণী বৈঠক। একটু নাটকীয়ভাবেই বক্তব্য শুরু করলেন আডবানিজি। বললেন, ৮ই জুলাই রবিবার দূরদর্শনের মহাভারত শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু জনতা দলের রাজনৈতিক মহাভারত ১৫ই জুলাই পর্যন্ত চলেছে। এই যুদ্ধ শুধু দেশের মানুষ দেখেছেন এমন নয়, সারা বিশ্ব দেখেছে যে, আট মাস আগে গঠিত সরকার কীভাবে কাজ করতে চলেছে।

সমস্যাটা বাঁধছিল দেবীলালের হরিয়ানায়। চরণ সিং-এর রাজনৈতিক শিষ্য দেবীলাল। জাট নেতা দেবীলাল। জনতা দলের খিচুড়ি সরকারের ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার দেবীলাল। দেবীলাল যখন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেশের উপ- প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন তিনি নিজের ছেলে ওমপ্রকাশ চৌটালাকে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী করে এসেছিলেন। এখানে মনে রাখার মতো ব্যাপার হল ওমপ্রকাশ কিন্তু ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হননি। তাই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার ছ’মাসের মধ্যে তাঁকে কোনও একটি আসনে জিতে আসতে হতো। মেহাম নামে একটি জায়গাতে উপনির্বাচনে প্রার্থী হলেন ওমপ্রকাশ, জিতলেন। কিন্তু ব্যাপক রিগিং করার অভিযোগ উঠল। জনরোষ এমন জায়গাতে পৌঁছাল যে ওমপ্রকাশকে পদত্যাগ করতে হবে মনে হল। ওমপ্রকাশের এমন বিপদে দলের নেতারা ছোটবড় কথা বলছে দেখে দেবীলাল ক্ষেপে গেলেন। বললেন, ‘জনতা দল আবার কী? আমি বানিয়েছি জনতা দল।’

১৬ই মার্চ ভিপি সিং-এর বাড়িতে একটি দলীয় বৈঠক ছিল। বৈঠক আরম্ভ হওয়ার আগেই ঘটনাটা ঘটল। অরুণ নেহরু আর অজিত সিং শৃঙ্খলা ও মূল্যবোধের রাজনীতি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। পড়িল কথা সবার মাঝে, যার কথা তার গায়ে বাজে। দেবীলালের গায়ে লেগে গেল কথাগুলো। রেগেমেগে ‘পদত্যাগ করব’ বলে মিটিং ছেড়ে দেবীলাল বেরিয়ে গেলেন। ভিপি আর শরদ যাদব বাদে কেউ তাঁকে থামতে বললেন না। অরুণ নেহরু বললেন যে। এসব মুখেই বলছে, চিঠি দিয়ে দেখাক আগে। ষাট ঘণ্টার টালবাহানার পর দেবীলাল পদত্যাগ করলেন। পারদ চড়ছিল। শক্তি প্রদর্শন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল দেবীলালের জন্য। তিনি ঘোষণা করলেন ৯ই আগস্ট দিল্লিতে কিষাণ র‍্যালি হবে। কয়েক লক্ষ কৃষক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাবে।

প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং এই রাজনৈতিক মহাভারতে নিজের লোকেদের ওপরে চালানোর জন্যে তৃণীর থেকে দশ বছরের পুরোনো একটা তির বের করলেন। ৭ই আগস্ট, ১৯৯০, কিষাণ র্যালির দুদিন আগে ঝুলি থেকে বিড়াল বেরোলো। মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট লাগু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীদের সংরক্ষণ দেওয়া ঠিক করল সরকার।

এবার তাহলে মণ্ডল কমিশনের গল্পটা বলতে হয়। বলছি। ১৯৭৯ সালে মোরারজি দেশাই সরকার সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে থাকা জাতিগুলিকে চিহ্নিতকরণ ও সংরক্ষণ প্রদানের জন্য একটি কমিশন গঠন করে। তার মাথায় অধ্যক্ষ হিসেবে বসানো হয় ভি পি মণ্ডলকে। সামাজিক বৈষম্য ও দুর্দশাকে চেনার জন্য এগারোটি বিন্দুকে মানদণ্ড মানা হয়। কমিশনের মতে শিডিউলড কাস্ট ও ট্রাইবকে ব্যতিরেকেও এমন ৫২% মানুষ আছেন, যারা সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছেন। তাঁদের উন্নতির কল্পে আলাদাভাবে লক্ষ্য দেওয়া প্রয়োজন। কমিশন তখন রায় দিয়েছিল চাকরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ২৭% সিট অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর জন্য সংরক্ষিত করতে হবে। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে ৩৭৪৩টি জাতিকে ওবিসি বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল।

মণ্ডল কমিশন মোরারজি দেশাইয়ের সময়ে গঠিত হলেও রিপোর্ট জমা করার আগেই জনতা পার্টির সরকার চলে যায়। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে এই রিপোর্ট পেশ হয়। ইন্দিরাজি এই রিপোর্টকে ঠাণ্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেন। ভিপি আবার সেই রিপোর্টকে খুঁড়ে বের করে এনে নিজের রাজনৈতিক চাল চেলেছিলেন।

জনতা দলের সরকারে আগের যে কোনও সরকারের তুলনায় পিছিয়ে পড়া জাতির এমপি-দের সংখ্যা বেড়েছিল। তাই স্বাভাবিকভাবেই পার্টির মধ্যে থেকে ভিপি সমর্থন পাচ্ছিলেন। স্লোগান উঠছিল, ‘ভোট সে লিয়া সিএম, পিএম; মণ্ডল সে লেঙ্গে এসপি, ডিএম।’

৭ই আগস্ট ভিপির ঘোষণা করার আগে পর্যন্ত কেউ মণ্ডলের রিপোর্ট লাগু করার কথা ভাবতে পারেননি। সরকারি চাকরির প্রায় অর্ধেক আসন সংরক্ষিত হতে চলেছিল।

মোক্ষম চালের ধাঁচে মণ্ডলের রিপোর্ট লাগু করার পরিকল্পনা থাকায় ভিপি নিজের ক্যাবিনেটের সদস্যদের মাত্র একদিন আগে খবরটা জানিয়েছিলেন। আডবানিজিকে ফোন করে খবর দেওয়া হয়েছিল ঘোষণার দিন সন্ধেবেলায়।

সমাজের মধ্যবর্তী শ্রেণীকে উন্নীত করার এই প্রয়াস দেখে দেবীলাল কিছু বলতেই পারলেন না। বামেরা চুপ। কংগ্রেস স্তম্ভিত, রাজীব সংসদে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টের বিরোধীতা করেছিলেন।

সমস্যাটা এল সামাজিক দিক থেকে। উচ্চবর্ণের পক্ষ থেকে বিরোধ আরম্ভ হল। একটা সরকারি চাকরি অনেক পরিবারের কাছেই সহজ জীবনযাপনের পাসপোর্ট। উত্তেজনা ক্রমশ হিংসার রূপ নিল। দেশের বিভিন্ন শহর থেকে প্রতিদিনই প্রাণহানির খবর আসছিল। সবথেকে বড় ক্ষতি হয়ে গেল ইন্দোরে। ১৪ই অক্টোবর সেখানে ৪০ জন প্রাণ হারালেন। বিহার জ্বলছিল। সেখানে রাজীব গোস্বামী নামে এক ব্রাহ্মণ যুবক ন’দিন অনশনের পরে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলেন।

সঙ্ঘ নড়েচড়ে বসল। তাঁদের মত ছিল মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট লাগু করার ফলে সামাজিক বৈষম্য বেড়ে যেতে চলেছে। বহু বিভক্ত হিন্দু সমাজ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

ভাজপার নেতারা অন্দরমহলে সঙ্ঘের সঙ্গে একমত হলেও বাইরে এই নিয়ে বিরোধ করলেন না। ভোট ব্যাঙ্ক বড় দায়। মঝঝিম পন্থায় দল একটি দাওয়াই বাতলাল:মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট ঠিকই আছে, কিন্তু সমগ্র সংরক্ষণের পরিমাণ যেন ৫০% না ছাপিয়ে যায়।

ছাত্ররা চাইছিল আডবানিজি এর বিরুদ্ধে বলুন। আডবানিজি প্ৰমাদ গণলেন। ভাজপা আগে গুজরাতে উচ্চবর্ণের ছাত্রদের বিক্ষোভের ফল ভুগেছে। এবং ভাজপা কখনও একই ভুল দুবার করে না। তাই এবারে অন্য কিছু করার পালা ছিল। মণ্ডলে বিভক্ত হিন্দু ধর্মকে কমণ্ডলে একাকার করার পালা অনুষ্ঠিত হতে চলেছিল।

২৬শে আগস্ট, ১৯৯০। সঙ্ঘ মিটিং ডাকল। ঠিক হল বিহিপর পরিকল্পনা অনুসারে আগামী দুমাসের মধ্যে অযোধ্যার রামজন্মভূমিতে মন্দিরের উদ্বোধন করানো হবে।

রাজনৈতিক সুতো জোড়ার পর্ব শুরু হল। প্রমোদ মহাজন বুদ্ধি দিলেন যে, মিনি ট্রাককে রথের মতো সাজিয়ে আডবানিজি রামরথযাত্রা করবেন। গুজরাতের সোমনাথধাম থেকে যাত্রা শুরু হবে, শেষ হবে অযোধ্যায়। মাঝে দশটি রাজ্যের ১০,০০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করা হবে। যাত্রা আরম্ভ হবে ২৫শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯০। সমাপ্তি হবে ৩০শে অক্টোবর, ১৯৯০। ৩০শে অক্টোবর বিহিপর মন্দির উদ্বোধনের দিন, মনে পড়ছে কি? এবং এই যাত্রার ঘোষণার পর থেকেই ভারতের ইতিহাসে বড় রদবদল ঘটতে চলেছিল।

.

গুজরাতের সোমনাথ থেকে লালকৃষ্ণ আডবানি সস্ত্রীক রামরথযাত্রায় বেরোলেন। সোমনাথ থেকে যাত্রা আরম্ভ করার দুটো কারণ ছিল।

১. সোমনাথের মন্দির ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। তাহলে রামমন্দির কেন সরকার তৈরি করাবে না?

২. কানহাইয়ালাল মাণিকলাল মুন্সীর ‘জয় সোমনাথ’ উপন্যাস তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলে গিয়েছিল। হিন্দুত্বের প্রতীক রূপে তাই তিনি সোমনাথ মন্দিরকেই বেছে নিয়েছিলেন যাত্রারম্ভের বিন্দু হিসেবে।

যাত্রা যখন শুরু হল তখন চারিদিকে গেরুয়া সমুদ্র। আডবানিজির টয়োটা গাড়িটিকে রথের মতো করে সাজানো হয়েছিল। অত্যাধুনিক ওয়্যারলেস ফোন, ইলেকট্রনিক মাইক্রোফোন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের যন্ত্র সবই ছিল রথে। রথ ঘিরে সারি সারি ত্রিশুল, গৈরিক বস্ত্রের ফেট্টি। সারথী হলেন প্রমোদ মহাজন, আর বড় ভূমিকা পালন করছিলেন গুজরাতে ভাজপার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব নরেন্দ্র মোদি।

সাড়া মিলবে এমন আশা আগে থেকেই ছিল, কিন্তু এতটা সাড়া পাওয়া যাবে তা আডবানিজি কল্পনাও করতে পারেননি। রথ থামিয়ে আরতি করছিলেন মেয়ে-বউরা। পথের দুপাশ থেকে ফুল, মালা, খুচরো পয়সা উড়ে আসছিল। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, উড়ন্ত কয়েনে আহত হয়ে যেতে পারতেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা। কিন্তু মানুষের আবেগকে আহত করতে চাননি কেউ, তাই এসব করতে মানাও করা হল না।

মণ্ডল-এ বিভক্ত হিন্দু কমণ্ডলে একজোট হচ্ছিল। যে আডবানি মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট লাগু করা নিয়ে কিছু না বলায় জনগণের আস্থা হারাচ্ছিলেন, সেই আডবানিই রথে চড়ে, ধনুক হাতে ভারতীয় জনমানসের একটি বড় অংশের কাছে শ্রীরামচন্দ্র হয়ে উঠছিলেন। উন্মাদনা এমন স্তরে পৌঁছায় যে, এক জায়গায় এক যুবক নিজের হাত কেটে সেই রক্ত দিয়ে আডবানিজিকে তিলক প’রিয়ে দিয়েছিলেন।

এতকাল ধরে অটলবিহারীর ছায়া রাজনৈতিকভাবে বড় হতে থাকা আডবানি এবার নিজের মতো করে নিজের ছবি তৈরি করছিলেন। যে আডবানি রথে চেপেছিলেন, এবং যে আডবানি রথ থেকে নেমে এসেছিলেন, দুজনে একদম ভিন্ন মানুষ ছিলেন। কর্মীদের খুব কাছের মিতবাক নেতা এবার জননেতা হয়ে উঠছিলেন।

.

অটলবিহারী অন্তর্যামীর মতো নীরবে সব দেখে চলেছিলেন। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেলানোর পক্ষধর তিনি কখনোই ছিলেন না। তবুও দলের মতকে সম্মান জানিয়ে দিল্লির কনস্টিটিউশন ক্লাব থেকে আডবানিজির যাত্রাকে তিনি সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন। অটলজির ছাত্র গুরুর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসছিল। একদা ‘একাত্ম মানবতবাদ’ এবং পরে ‘গান্ধীবাদী সমাজবাদ’-এর পথে চলা অটল স্পষ্ট অনুভব করছিলেন রথকে রাজনৈতিক মঞ্চ রূপে ব্যবহার করা যতটা সহজ, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা ততটাই কঠিন।

সোমনাথ থেকে রথের চাকা গড়াতেই ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কিছু কর্তা ব্যক্তি অটলবিহারীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। তাঁদের বক্তব্য ছিল রথযাত্রার ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক হিংসা সৃষ্টি হচ্ছে। ফোনে আডবানিজিকে ধরলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী— ‘তুমি বাঘের পিঠে চড়ে বসেছ।’ অনেক অনুনয়ের শেষেও আডবানিজি সেদিন রথ থামাতে রাজী হননি। বাঘের পিঠ থেকে নামা সোজা কাজ নয় যে।

আডবানিজির মধ্যে আসা পরিবর্তন দেখে দুঃখী হয়েছিলেন অটলবিহারীজি। ঘনিষ্ঠ মহলে এই নিয়ে বলতেন। কিন্তু বাইরে নৈব নৈব চঃ। কথার জাদুকর অটল বলতেন, ‘আডবানি অযোধ্যায় রাবণকে মারতে নয়, প্রায়শ্চিত্ত করতে যাচ্ছেন। কিন্তু বানরসেনা অনেক সময় বুঝতে পারে না তাদের কী করা উচিত।’

রথ রথের মতো চলছিল, দলের কাজকর্ম চলছিল নিজের ছন্দে। ১৭ই অক্টোবর দিল্লিতে ভাজপার একটি মিটিং ছিল। আডবানিজি রথ থেকে নেমে দিল্লি এসে বৈঠকে যোগ দিলেন। যদি রথযাত্রা চলাকালীন আডবানিজিকে কোথাও গ্রেফতার করা হয় তাহলে দল কী করবে? বাজপেয়ীজি বললেন যে, সরকার যেন না পড়ে। দলের পক্ষ থেকে কেউ বাজপেয়ীর সমর্থনে বললেন না। এরপর একের পর এক বক্তা আডবানিজির প্রশংসা করতে শুরু করলেন। দলীয় সিদ্ধান্ত মোটামুটি এই দাঁড়াল যে, যদি আডবানিজিকে রথ থেকে নামতে বাধ্য করা হয়, তবে প্রধানমন্ত্রীকে নিজের গদি থেকে নামতে বাধ্য করা হবে।

যাত্রা জারী রইল। রথ পৌঁছল বিহারে। বিহারে তখন লালু যাদবের রাজত্ব চলছিল। যাদব-মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের ওপরে ভর করে লালু ছড়ি ঘোরাচ্ছিলেন। আডবানিজির রথ লালুর রাজত্বে ঠিক খাপ খাচ্ছিল না। লালু ভিপির কাছে আদেশ চাইলেন, আডবানিজিকে গ্রেফতার করার আদেশ। সরকার পরে যেতে পারে বলে ভিপি রাজী হলেন না। কিন্তু ২২শে অক্টোবর বাম দলগুলি রথ থামাতে বদ্ধ পরিকর হয়ে উঠল। বলা হয় জনতা দলের সরকারের গাড়িতে তাউজি (দেবীলাল) ছিলেন চালক, আডবানিজির ভাজপা ছিল অ্যাক্সিলারেটর, এবং বাম দলগুলি ছিল ব্রেক। বামেরা ব্রেক কষল।

২২ তারিখ রাতে আডবানিজি সমস্তিপুরের সার্কিট হাউজে পৌঁছালেন। অতি ভোরে সরকারি আধিকারিকেরা হেলিকপ্টারে করে পৌঁছে গেলেন তাঁর কাছে। ঘুমন্ত আডবানিজিকে জাগিয়ে তুলে জাতীয় সুরক্ষা আইনের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হল।

নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং দলমতের পক্ষে গিয়ে অটলবিহারী বাজপেয়ী ভিপি সিং -এর সরকার থেকে ভাজপার সমর্থন প্রত্যাহার করলেন।

৩০শে অক্টোবর আসছিল। বিহিপর দেওয়া সময়সীমা শেষ হতে চলেছিল। হাজারে হাজারে করসেবক জড়ো হচ্ছিলেন অযোধ্যায়।

করসেবক, করসেবা এই শব্দ দুটি ভারতের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। একটু এদের ইতিহাসটা দেখে নেওয়া যাক। ‘কর’ মানে ‘হাত’। হাতের দ্বারা যে সেবা করা যায়, তাকেই করসেবা বলে। সেটা প্রার্থনাস্থল তৈরি হতে পারে, ধোওয়া হতে পারে, পূণ্যার্থীদের খাওয়ানো হতে পারে। যারা কোনও উপাসনাস্থলে করসেবা করেন, তাঁদের বলা হয় করসেবক। শিখ ধর্মে প্রথম ‘করসেবা’র উল্লেখ রয়েছে। ভক্তরা করসেবার দ্বারা স্বর্ণমন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

ব্যাক টু অযোধ্যা। ৪০,০০০ করসেবক জমায়েত করেছিলেন। রাজ্য সরকার দেখল বাবরি মসজিদ নষ্ট করা হতে পারে। গুলি চালাতে নির্দেশ দিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব। ফায়ারিং হল। অনেক করসেবক প্রাণ হারালেন। মসজিদ অক্ষত রইল।

ওদিকে দিল্লিতে সরকারের পতন হল। বাইরে থেকে কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে জনতা দলের আরেক মুখ চন্দ্রশেখর প্রধানমন্ত্রী হলেন।

সরকারের ডামাডোলের মতো ভাজপার অন্দরেও কিছুটা ঝঞ্ঝা চলছিল। মুরলি মনোহর জোশি আর আডবানিজির মধ্যে। আডবানিজি যেমন অটলবিহারী ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে এসে রাজনৈতিকভাবে সাবালক হয়ে উঠেছিলেন, সেই একই ধারা অনুসরণ করে জোশি আডবানির ছায়া থেকে মুক্ত হতে চাইছিলেন।

জোশি আডবনিজির রামরথযাত্রার অনুকরণে একটি রথযাত্রার ঘোষণা করলেন। ‘একতা রথযাত্রা’। রথযাত্রা সেভাবে সফল হয়নি। কিন্তু এই যাত্রাকে স্মরণীয় রাখার কারণ হল এর সারথীর নাম। নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। প্রমোদ মহাজন আডবানিজির রথের জন্য যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, সেদিনের নরেন্দ্র মোদি জোশিজির রথের ক্ষেত্রে একই ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি সবকিছুর দায়িত্বে ছিলেন। রথকে ঘিরে পার্টির ক্যাডারদের এমন এক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছিলেন যে পুলিশ পর্যন্ত রথের কাছে ঘেঁষতে পারত না। রথের সঙ্গে গাড়ির কনভয় চলত। মোবাইল, এস এম এস, হোয়াটসঅ্যাপের আগের সেই জমানায় যে কোনও বার্তা রথ থেকে পরের গাড়িতে পৌঁছনোর জন্য অদ্ভুত একটা উপায় প্রণয়ন করেছিলেন সারথী মশাই। বার্তা ক্যাসেটে রেকর্ড করে পরের গাড়িতে ছুঁড়ে দেওয়া হতো। তারা ক্যাসেট প্লেয়ারে চালিয়ে শুনে নিত। ফ্যাক্স মেশিন রাখা হয়েছিল প্রতিটা গাড়িতে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজি যে সুবক্তা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ১৯৯০- ১৯৯১ সালের একটা যাত্রাতেই সেই প্রমাণ মিলেছিল। রথ এগোনোর আগে মোদিজি গিয়ে বক্তব্য রাখতেন। প্রচুর ভিড় হতো। যা বলার সব গুছিয়ে বলে দিতেন। ফলে জোশিজির রথ সেখানে পৌঁছালে পরে লোকের আর শোনার আগ্রহ থাকত না। ব্যাপার স্যাপার দেখে জোশিজি মোদিজির ভাষণ দেওয়াই বন্ধ করিয়ে দেন।

জোশি-আডবানিজির মধ্যে যা কিছু চলছিল, তা দলের মধ্যে রেখাপাত করলেও বাইরে ঝড় তোলেনি। হয়তো সঙ্ঘের পটভূমি থেকে আসা দুই সুযোগ্য রাজনেতাকে এই শিক্ষা দিয়েছিল হিন্দুত্বের আঠা— কমলালেবুর কোয়ার মতো ভেতরে আমরা যতই বিভক্ত হই না কেন, বাইরে যেন একটাই মনে হয়।

কিন্তু সঙ্ঘের নার্সারির বাইরে এহেন শিক্ষা বিরল। এবং তাকে আবার প্রমাণিত করে চন্দ্রশেখরের সরকার পড়ে গেল। সেও এক অদ্ভুত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটল।

কোন ঘটনা?

২রা মার্চ, ১৯৯১। কংগ্রেসের অধ্যক্ষ রাজীব গান্ধীর বাসভবন ১০, জনপথের সামনে থেকে দিল্লি পুলিশ দুই সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করল। তাদের নাম প্রেম সিং ও রাজ সিং। খতিয়ে দেখে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড় তারা কোনও চোর, ডাকাত বা উগ্রপন্থী নয়। হরিয়ানা পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের লোক। সাদা কাপড়ে দাঁড়িয়ে নজর রাখছিল হরিয়ানার কোনও রাজনেতা রাজীব গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে কিনা। কার নির্দেশে এসব চলছিল? জানা গেল দেবীলালের বড় ছেলে ওম প্রকাশ চৌটালার নির্দেশে হরিয়ানার গৃহমন্ত্রী সম্পত সিং দুজনকে নিয়োগ করেছিলেন। দেবীলালের ছোট ছেলে রঞ্জিত সিং- এর ওপরে নজর রাখা হচ্ছিল।

ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর রাজীব গান্ধী ক্ষেপে উঠলেন। চন্দ্রশেখর ভরা সংসদে এর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তাতে স্বস্তি ফিরছিল না। চন্দ্রশেখর একটা সত্য বুঝে নিলেন যে, তিনি যত চেষ্টাই করুন, হয় রাজীব সমর্থন তুলে নিয়ে সরকার ফেলে দেবেন, নয় তো তাঁর এমপি-দের ভাঙিয়ে নিজে সরকার গঠনের পথে এগোবেন। এই দুটো ক্ষেত্রেই পরাজিত হয়ে তাঁকে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র জমা দিতে যেতে হবে। একজন ‘ঠাকুর’ হিসেবে বিষয়টা তাঁর আত্মমর্যাদায় বাঁধছিল। তাই শুধু পরাজিত হওয়ার থেকে তিনি পরাজিত নায়ক হওয়াটাকেই বেছে নিলেন। সরকার পরে যাওয়ার আগে নিজেই পদত্যাগ করে দিলেন।

ভোট আসতে চলেছিল।

’৮৯ সালের ভোটে ভাজপা ২২৫টি আসনে প্রতিদ্বদন্দিতা করেছিল। এবারের নির্বাচনে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়াল ৪২৫। আডবানিজি নিজে দুটি আসনে দাঁড়াবেন বলে ঠিক করলেন। নিউ দিল্লিতে কংগ্রেসের স্টার ক্যান্ডিডেট রাজেশ খান্নার বিরুদ্ধে এবং গুজরাতের গান্ধীনগর আসনে।

সে বছর গান্ধীনগরে যখন তিনি মনোনয়ন দাখিল করতে যান, তখন সঙ্গে ছিলেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। সেই ছবি এখন সোশ্যাল মিডিয়াতে ঘোরে। বাজপেয়ীজি উত্তর প্রদেশের লখনউ এবং মধ্যপ্রদেশের বিদিশা থেকে মনোনয়ন জমা দিলেন।

নিজের রামরথযাত্রা সম্পূর্ণ করতে না পারলেও তার ফসল ঘরে তুলতে উদ্যোগী হলেন আডবানিজি। ভোটারদের উদ্দেশ্যে বললেন যে, তাঁরা যেন তাঁদের আত্মীয়বর্গকে পোস্টকার্ড পাঠিয়ে ভাজপাকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ জানান। কার্ডের মাথায় যেন অতি অবশ্যই ‘জয় সিয়া রাম’ লেখা থাকে।

এবারের জাতিগত সমীকরণ মাথায় রেখে আডবানিজি তাস সাজালেন। উত্তর প্রদেশের বিধানসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী রূপে অনগ্রসর শ্রেণী লোধ মুখ কল্যাণ সিংকে বেছে নেওয়া হল।

’৮৪ সালের ভুল থেকে ভাজপা শিক্ষা নিয়েছিল। সঙ্ঘের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা চলল। দু’লক্ষ স্বয়ংসেবক দোরে দোরে ঘুরে ভাজপার জন্য কাজ করতে লাগলেন। আডবানিজি নিজে সঙ্ঘের সঙ্গে তাঁর পরিচয়কারী মধুকর রাও ভাগবত-এর নাগপুরের বাড়িতে গেলেন। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, এই মধুকর রাও ভাগবত-এর ছেলে হলেন সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত।

তিনটি পর্যায়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঠিক হল। প্রথম পর্বের দিন ঠিক হয়েছিল ২০শে মে, ১৯৯১। সেদিনের ভোটদান মিটতেই রাজীব গান্ধী চলে গেলেন দ্বিতীয় দফার ভোটের প্রচারে তামিলাড়ুতে। পেরাম্বুদুরে জনসভায় তাঁর গলায় মালা দেওয়ার সময় এক এলটিটিই জঙ্গী আত্মঘাতী হামলা করল। চোখের নিমেষে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেন ইন্দিরা-তনয়।

.

ভিপির ‘মণ্ডল’, ভাজপার ‘কমণ্ডল’ সব হার মেনে গেল রাজীব গান্ধী হত্যার আবেগের কাছে। কংগ্রেস পেল ২৩২ / ৫২৪। ভাজপার ঝুলিতে এল ১২০টি আসন। বাজপেয়ীজি, আডবানিজি দুজনেই নিজেদের প্রত্যেকটা আসনেই জিতলেন। ভাজপার প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ বাড়ল ৪০%।

কংগ্রেস সরকার গঠন করবে। রাজীব গান্ধী নেই। তাহলে কে? উত্তর খুঁজতে খুঁজতে একজনের নাম উঠে এসেছিল। তিনি কে আপনারা সবাই জানেন। তিনি হলেন পি ভি নরসিমহা রাও। ভারী অদ্ভুতভাবে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়া।

কেন?

বলছি বলছি…।

রাজীব গান্ধী ঠিক করে ফেলেছিলেন ‘বুড়োহাবড়া’দের টিকিট দেওয়া হবে না। নরসিমহা রাও তাই ‘৯১ -এর নির্বাচনে টিকিট পাননি। রাজনৈতিক ভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন ভদ্রলোক। বইপত্র সব পাঠিয়ে দিলেন হায়দ্রাবাদে। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার দরখাস্ত দিয়ে এলেন। দিল্লি ছেড়ে গেলে আবার দিল্লিতে এলে উঠবেন কোথায়, এসব সাতপাঁচ ভেবে ‘ইন্ডিয়ান ইন্টার ন্যাশন্যাল সেন্টার’-এর সদস্যপদের জন্য আবেদন সারলেন। এই সব করলেও তাঁকে তাঁর জ্যোতিষী এন কে শর্মা বলেছিলেন যে, ভারতের রাজনীতিতে তিনি আবার দাপটের সঙ্গে ফিরে আসবেন।

২১শে জুন, ১৯৯১ প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হলেন নরসিমহা রাও।

নরসিমহা রাও নাহয় প্রধানমন্ত্রী হলেন, কিন্তু লোকসভায় তো একজন প্রতিপক্ষের নেতাও দরকার। ভাজপা তখন প্রধান প্রতিপক্ষ দল। এতদিন লোকসভায় অটলবিহারী দলের প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন। তাই তাঁর নাম উঠে আসাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এবারে সমীরকণ অন্যরকম মনে হচ্ছিল। সঙ্ঘ চাইছিল আডবানিজি দায়িত্বটা নিন।

আডবানিজি এমন কিছু করতে চাইছিলেন না যাতে অটলবিহারী বাজপেয়ীর অপমান না হয়। তাই নেতা প্রতিপক্ষের পদটা তাঁর থালাতেই সাজিয়ে দিতে উন্মুখ ছিলেন। কিন্তু সঙ্ঘ জানাল, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট করে লাভ নেই।

মাথা চাপড়ালেন আডবানিজি। এতদিনের সুসম্পর্ক এসবের জেরে না বিগড়ে যায়। অটল-আডবানির সম্পর্কের ভারসাম্য একই রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেটা নিয়ে আডবানিজি বা অটলবিহারীর কেউই ভাবেননি তেমন একটা বিষয় দেশবাসীর মাথাখারাপ হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াতে চলেছিল।

কী বলুন তো?

মার্কেট। বাজার।

.

দেশ তখন চূড়ান্ত অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়তে চলেছে। জাতীয় উৎপাদন তলানিতে এসে ঠেকেছে। নেহরু জমানা থেকে চলে আসা বদ্ধ সোশ্যালিস্ট ইকোনমির জেরে লাইসেন্স রাজ, পারমিট রাজ-এর জোড়া ফলায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি বিদ্ধ। অতিমাত্রায় জাতীয়করণ, দেশজোড়া কলকারখানায় উৎপাদন, মূল্য নির্ধারণ ও বিক্রয়ের ওপরে সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বৃহৎ শিল্পের উৎপাদনকে প্রায় বন্ধ্যা করে তুলেছে। বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগ নেই। ব্যক্তির পুঁজি সীমিত। বিকল্প অর্থনীতি তাই ডানা মেলতে অক্ষম। বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে না পারার মতো অবস্থায় দাঁড়িয়ে ভারত তখন দেনায় বিকিয়ে যেতে চলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ভাঁড়ার সর্বকালীন সর্বনিম্ন। এক সপ্তার বেশি ক্রুড অয়েল কেনার অর্থও ভারতের মুদ্রা ভান্ডারে অমিল। আগের প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গচ্ছিত সোনা বিদেশি ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে পেট্রোলিয়াম কেনার ব্যাপারে সব ঠিকঠাক করে গেছেন। এই অসম্ভব পরিস্থিতি দেখে শপথ গ্রহণের আগেই রাও নিজের উপদেষ্টা পি সি আলেকজান্ডারের কাছে বুদ্ধি ধার চাইলেন। আলেকজাণ্ডার বললেন আগের প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা ডক্টর মনমোহন সিংকে অর্থমন্ত্রী করুন। বাঁচালে তিনিই বাঁচাতে পারবেন।

শপথ গ্রহণের দিন সকাল দশটার সময় ইউজিসির চেয়ারম্যান ডক্টর মনমোহন সিং-এর অফিসের ফোন বেজে উঠল। সিং ফোন ধরতেই উল্টোদিক থেকে রাও বললেন, ‘আপনাকে আমি অর্থমন্ত্রী হিসেবে চাই। বারোটার সময় আমার শপথ গ্রহণ। আপনি এগারোটার মধ্যে রাষ্ট্রপতি ভবনে চলে আসুন।’ একটু থেমে রাও আবার বললেন, ‘আমরা সফল হলে দুজনেই সাফল্যের ভাগ পাব, আর যদি ব্যর্থ হন তাহলে আপনাকে সরে যেতে হবে।’

এরপর সিং-রাও জুটি যে বাজেট পেশ করলেন, তা ইতিহাস তৈরি করে দিল। প্রচলিত অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ সব মুছে গেল। বিশ্বায়নের পথে ভারত পা বাড়াল। বেসরকারিকরণ গতি পেল। ৫১% পর্যন্ত ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টের অনুমোদন মিলল। অবসান ঘটল লাইসেন্স রাজ ও পারমিট রাজের। আর এসবের

চক্করে ভাজপা পড়ল মহা ধন্ধে।

ভাজপার মধ্যে বেশ কয়েকটা মত দেখা দিল।

কী কী?

১. ভাজপার রিমোট হাতে নিয়ে থাকা সঙ্ঘ বলছিল বিশ্বায়নের ফলে ভারতের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে যাবে।

২. মুরলি মনোহর জোশি বলতে লাগলেন যে, বিদেশি ঋণের ফাঁদে পড়ে বহু দেশ রসাতলে গেছে। যুবকেরা বাইরের দেশে গিয়ে মুটেগিরি করছে। মেয়েদের বাধ্য হয়ে দেহ ব্যবসায় নামতে হচ্ছে।

তিন, অটলবিহারী বললেন টিভিতে বিজ্ঞাপনের জমানায় চটক দেখে মানুষ দরকারি ভুলে লাক্সারিতে মাতবে। যার দুধ কেনার টাকা নেই সে শ্যাম্পু কিনে পয়সা নষ্ট করবে।

চার, একমাত্র আডবানিজি অর্থনৈতিক উদারীকরণকে সমর্থন করলেন।

শেষ পর্যন্ত ভাজপা উদারীকরনের পক্ষেই রায় দিয়েছিল।

সঙ্ঘ কিন্তু ভাজপার এই সমর্থনের ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখল না। ভাজপার অর্থনৈতিক উদারীকরণকে জবাব দেওয়ার জন্যে নভেম্বর, ১৯৯১ তে সঙ্ঘ ‘স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ’ তৈরি করল। ঠিক এক দশক আগে ভাজপাকে হিন্দুত্বের পাঠ পড়ানোর জন্য এভাবেই সঙ্ঘ বিহপ-কে পুনরুজ্জীবিত করেছিল। যখনই সঙ্ঘের চোখে ভাজপার নৈতিকতা গড়বড়ে মনে হতো, তখনই সঙ্ঘ সমান্তরাল কোনও সংগঠন তৈরি করে ভাজপাকে চাপ দিত। তবে অন্যবারের তুলনায় এবারের ব্যাপারটা একটু আলাদা ছিল। এবারে সঙ্ঘের লক্ষ্যে অটলজি নন আডবানিজি ছিলেন।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন