ভূমিকা : নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, বাংলাভাষা

প্রদীপ বসু

ভূমিকা : নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, বাংলাভাষা

১. জাতি, নৃতত্ত্ব, সমাজবিদ্যা

এই বইয়ে ‘সমাজবিদ্যা’ কথাটি একটু বিস্তৃত অর্থে ব্যবহার করেছি। এখানে ‘সমাজবিদ্যা’ বলতে শুধু সমাজতত্ত্বই বোঝাচ্ছে না, নৃতত্ত্ব এবং নৃকুলতত্ত্ব বা এথনোলজিও বোঝানো হচ্ছে। এই বিষয়গুলির ইতিহাস আলাদা হলেও সমাজ ও তার মানুষদের ঘিরে এদের কারবার। অবশ্যই দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, তত্ত্বও বিভিন্ন, পদ্ধতিও পৃথক, কিন্তু মূল বিষয়টা যে সমাজ ও তার অন্তর্ভুক্ত মানুষ, এ কথা কে অস্বীকার করবে? বাংলা ভাষায় এই আলোচনার সূত্রপাত হয় রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২৪–১৮৯১) সম্পাদিত বিবিধার্থ-সংগ্রহ (১৮৫১), রহস্য-সন্দর্ভ (১৮৬২) পত্রিকায়। এই দুই পত্রিকাই বাংলা ভাষায় জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সুন্দর লাইন এনগ্রেভিং ছবি সংবলিত বাংলার প্রথম সচিত্র শিক্ষাদায়ক মাসিক পত্র বিবিধার্থ-সংগ্রহ বিবিধ বিদ্যার প্রসারে উদ্যোগী হয়েছিল একটি কাঠামোকে অনুসরণ করে। অক্ষয়কুমার দত্তের (১৮২০–১৮৮৬) বিজ্ঞান দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত এবং তাঁর প্রদর্শিত পথ অনুসারে বিজ্ঞান বিষয়ে বেকনের দর্শনকেই রাজেন্দ্রলাল আদর্শ হিসেবে নিয়েছিলেন। বিষয়বৈচিত্র্য, উপস্থাপন, দর্শনীয় ছবি এইসব নিয়ে পত্রিকাটি যে পাঠকদের মন জয় করেছিল তার সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। শৈশবে এই পত্রিকা যে তাঁকে মুগ্ধ করেছিল সে-কথা তিনি জীবনস্মৃতি রচনায় লিখে গেছেন : ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র মহাশয় বিবিধার্থ-সংগ্রহ বলিয়া একটি ছবিওয়ালা মাসিকপত্র বাহির করিতেন। তাহারই বাঁধানো একভাগ সেজদাদার আলমারির মধ্যে ছিল। সেটি আমি সংগ্রহ করিয়াছিলাম। বার বার করিয়া সেই বইখানা পড়িবার খুশি আজও আমার মনে পড়ে। সেই বড়ো চৌকা বইটাকে বুকে লইয়া আমাদের শোবার ঘরের তক্তাপোশের উপর চিত হইয়া পড়িয়া নর্হাল তিমিমৎস্যের বিবরণ, কাজির বিচারের কৌতুকজনক গল্প, কৃষ্ণকুমারীর উপন্যাস পড়িতে কত ছুটির দিনের মধ্যাহ্ন কাটিয়াছে। এই ধরনের কাগজ একখানিও এখন নাই কেন।’

এই পত্রিকায় ভারতবর্ষে নৃতাত্ত্বিক ও নৃকুলতাত্ত্বিক আলোচনার একদম প্রথমদিকের পরিচয় রয়েছে। শুধুমাত্র ভারতীয় জাতিগুলিই নয়, দেশ-বিদেশের নানা জাতির নিয়ম, রীতি, আচার, অনুষ্ঠান, ধর্ম, দৈনন্দিন জীবনের পরিচয় পাঠকদের কাছে বর্ণিত হয়েছে বেশ আকর্ষক ভাষায়। এর মধ্যে যেমন আছে ভারতবর্ষের কুকি, টোডা, চণ্ডাল, রামুসি, সাঁওতাল, কোলি এবং আন্দামানবাসী জাতিরা, সেইরকমই রয়েছে পলিনেশিয়া, তিব্বত, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশের জাতিগুলির কথা। এ ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে উলকি, বেশভূষা, সম্ভাষণ, সৌন্দর্য-বিষয়ক প্রবন্ধ, দেশভেদে মানুষের সৌন্দর্যের ধারণা, বিভিন্ন জাতির কেশসজ্জা- এইরকম নানাবিধ বিষয়ের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে পাঠকের কাছে। এই বইয়ের আলোচনার জন্য আমাদের নৃতত্ত্ব, নৃকুলতত্ত্ব বা সমাজতত্ত্বের ইতিহাসে যাবার প্রয়োজন নেই। শুধু এইটুকু বললে যথেষ্ট হবে যে, প্রথমদিকের এইসব লেখা অনেকটাই এথনোলজি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এর অবশ্য একটা বড়ো কারণ ছিল ঔপনিবেশিক শাসন। এথনোলজি বা এথনোগ্রাফি, যাকে আমরা নৃকুলতত্ত্ব বলছি, তা নৃতত্ত্বেরই একটি শাখা, যেখানে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ, তথ্যের নথিভুক্তি, এবং লিখিত বর্ণনা বা রিপোর্টাজের মাধ্যমে জাতি, গোষ্ঠী, মানুষের জীবন-ধারণের পদ্ধতির বিবরণী আমরা পাই। ঐতিহাসিক দিক থেকে দেখলে নৃকুলতত্ত্বের বিষয় ছিল পর্যবেক্ষকের নিজের সমাজের বাইরে যারা, তাদের সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা। এই ‘অন্য’রা অবস্থান করেছে পশ্চিমের ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে অনেক দূরে। নৃতত্ত্বের তাই সূত্রপাত এক ধরনের প্রাকৃতিক বিজ্ঞান থেকে; পশ্চিমের সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে তারা যে-সব বিভিন্ন ধরনের জাতি, গোষ্ঠী, মানুষের সম্মুখীন হয়েছে তাদের অধ্যয়ন হিসেবে।

নৃতত্ত্ব কথাটি তাই এক বৃহত্তর বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যার মধ্যে অবস্থান করছে নৃকুলতত্ত্ব। এই বিষয়টির শুরুতে ‘অন্য’ সংস্কৃতি নির্মিত হত এক্সোটিকের এক ধারণার মাধ্যমে, যা তাদের ইউরোপের মানুষদের থেকে পৃথক করত। অথবা নির্মিত করত এক ‘প্রিমিটিভ’ বা আদিম, যা তাদের ডারউইনের মানবজাতির ‘বিকাশ’-এর একটি ধাপ হিসেবে দেখত। এই ধ্যানধারণা ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের জন্য খুব উপযোগী ছিল, কারণ এর ফলে সংস্কৃতির একটা স্তরবিন্যাস সম্ভব ছিল। এই কারণেই উত্তর-ঔপনিবেশিক রচনায় নৃতত্ত্ব ও নৃকুলতত্ত্বের ডিসকোর্সের সমালোচনা করা হয়েছে এই বলে যে এগুলি হল পশ্চিমের ক্ষমতার দ্বারা তার এক ‘আদিম অন্য’ নির্মাণের দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে যাঁরা নৃকুলতত্ত্বের সমর্থক তাঁরা বলেন, এটা শুধুমাত্র সামাজিক গবেষণার এক পদ্ধতি, যেখানে নৃতাত্ত্বিক তাঁর অনুসন্ধানের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনে অংশগ্রহণ করছেন, পর্যবেক্ষণ করছেন, তাদের কথা শুনছেন, প্রশ্ন করছেন, এককথায় তাদের জীবন সম্বন্ধে যা যা তথ্য পাওয়া সম্ভব, সেই তথ্য তাদের বসবাসস্থান থেকে সংগ্রহ করছেন। যদিও সমালোচকরা বলেন এই কাজগুলি-পর্যবেক্ষণ, শ্রবণ, প্রশ্ন-এর কোনোটাই নিরক্ষেপ মূল্যবোধ-মুক্ত কাজ নয়, এগুলির অবস্থান নৃতাত্ত্বিকের নিজের সংস্কৃতির ডিসকোর্সের বাইরেও নয়। এমনকী জ্ঞানের ধারণাও মূল্যবোধ বিযুক্ত হতে পারে না, কারণ যা জানা গেছে সেটা নির্ভর করে তা কীভাবে জানা গেছে তার উপর। অর্থাৎ, নৃতত্ত্বের দ্বারা সাংস্কৃতিক জ্ঞান ‘নির্মিত’ হয়, আবিষ্কৃত হয় না। অনেকে আরও একটু এগিয়ে বলেছেন, নৃতত্ত্ব শুধুমাত্র উপনিবেশবাদের সন্তান নয়, কারণ উপনিবেশই তার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে এই গবেষণা ও বিষয়ের ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে, বরং নৃতত্ত্ব উপনিবেশবাদের ‘যমজ’-ও বটে। উপনিবেশবাদ ‘অন্য’ মানুষদের এমন এক ছবি প্রস্তুত করে, যা তাদের শোষণ করতে সাহায্য করবে। বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্বচর্চার প্রেক্ষাপট হিসেবে এই কথাগুলি মনে রাখতে হবে।

বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বিবিধার্থ-সংগ্রহ ও রহস্য-সন্দর্ভ পত্রিকায় বিভিন্ন জাতির বিবরণ ও অন্যান্য বিষয়ে প্রকাশিত অনেক রচনাই ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লেখা প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ। অনেক সময় বাংলায় প্রকাশিত রচনাগুলি যে আদতে ইংরেজ পাঠক-পাঠিকাদের উদ্দেশে লেখা সেটাও গোপন থাকেনি। রচনাগুলি যে সময়ের সেই সময় ইউরোপে নৃতত্ত্বচর্চা বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছে। এই নৃতত্ত্ব বা নৃকুলতত্ত্ব যেমন বস্তুনিষ্ঠ বিবরণে আগ্রহী, তেমনি অন্যান্য বিজ্ঞানের অনুসরণে মানুষের নানাবিধ দৈহিক মাপজোকের ভিত্তিতে শ্রেণিকরণ করতেও সচেষ্ট। প্রকাশিত লেখাগুলি সেই সময়ের নৃতাত্ত্বিক রচনারীতি অনুসরণেই লেখা। পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার মধ্যে যেমন আছে ভীল, টোডা, সাঁওতাল, কুকি প্রভৃতি ভারতীয় জাতিগুলির কথা, তেমনি রয়েছে পলিনেশিয়ার বৃত্তান্ত, তাতার জাতির বিবরণ, আফগান স্ত্রীদের অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে রচনা। একদম প্রথম থেকে সাঁওতালদের নিয়ে আগ্রহ দেখা যায়। সাঁওতালদের ব্যবহারাবলি এবং তাদের সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে রহস্য-সন্দর্ভ পত্রিকায় ১৮৭২ সালেই লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখব সাঁওতালি জীবনের নানা দিক নিয়ে নানা ধরনের লেখকের লেখা বাংলা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। শুধু সাঁওতালই নয়, বিশ শতকের বাংলা পত্রপত্রিকায় আমরা দেখতে পাই ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন রাজ্যের নানা আদিবাসী বা জাতির বিবরণ, আর এই বিবরণ লিখিত হচ্ছে বাঙালি লেখকদের দ্বারাই। এইসব লেখা প্রকাশের ব্যাপারে বহু পত্রিকা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল, কিন্তু প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল প্রবাসী। প্রবাসী পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের জাতির বিবরণ প্রকাশিত হতে থাকে, তাদের জীবন, ভাষা, প্রবাদ, কিংবদন্তি, আচার-আচরণ কোনো বিষয়ই বাদ পড়েনি। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই পর্বে আমরা বাঙালি লেখকদের দেখি নিজের দেশের মানুষদের সম্পর্কে লিখতে।

অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে, এই যে নিজের দেশের মানুষের বিবরণ, এই বিবরণের ভিত্তি কি কলোনিয়াল ডিসকোর্সের বাইরে ছিল? আমরা আগেই বলেছি, এই ধরনের জাতি-বিবরণ ঔপনিবেশিক জৈব-রাজনীতির এক অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ ছিল। পপুলেশনের জৈব-রাজনীতির জন্য পপুলেশন বিষয়ক তথ্যসংগ্রহও জরুরি। অন্যদিকে, অন্য মানুষের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতির বিবরণে একটা তুলনাও এসে পড়ে, এসে পড়ে উৎকৃষ্ট আর নিকৃষ্টের তুলনা। আবার অন্যদিকে, এদের বর্ণনায় এক ইউটোপিয়ারও সাক্ষাৎ পাই। কোলদের কথা বলতে গিয়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যেমন লিখেছেন : ‘তাহারা কঠোর পরিশ্রমী, নিজেদের সামান্য অভাবমোচনে নিজেরাই তৎপর, এবং তদুপরি সদানন্দ জাতি; তাহারা সকলেই মাদল-বাজানো, নাচ ও গান ভালোবাসে, এবং সময় পাইলেই তাহার দ্বারা চিত্তবিনোদন করে। তাহাদের পারিবারিক জীবন সাধারণত নিষ্পাপ, প্রকৃতির আবেষ্টনীর মধ্যে তাহারা সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করে। নর-নারীর প্রেম ইহাদের কবিতায় ও রূপকথায় একটা লক্ষণীয় অংশ জুড়িয়া আছে-ইহাদিগের দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়া ইহাদিগকে romantic বা রমন্যাসপ্রিয় জাতি বলিতে পারা যায়। আমাদের আধুনিক নগরিয়া সভ্যতার নানা পঙ্কিলতা ও আবর্জনার পাশে ইহাদের এই সরল বন্য বা গ্রাম্য জীবন পবিত্র ও কাব্যময় বলিয়া মনে হয়।’ প্রশ্ন হল, ‘অন্য’দের সঠিক রিপ্রেজেনটেশন কি সম্ভব? না কি আমরা বলব ‘অন্য’দের কথা বলতে গিয়ে আখ্যায়ক আসলে নিজের কথাই বলেন? জাতি পরিচয় ও জাতি বিবরণের মাধ্যমে আসলে বাঙালি লেখকরা নিজের এবং নিজের সমাজের কথা বলতে চাইছেন? এ ধারণা একেবারে ভ্রান্ত নয়। অন্য সমাজ-সংস্কৃতি যে অনেক সময় এক দর্পণের কাজ করে এবং নিজের সমাজের ত্রুটি, বিচ্যুতি, অসম্পূর্ণতা, প্রতিফলিত করে-একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। আমরা এইসব রচনাগুলি পড়লে দেখব যে, অন্য বেশ কিছু জাতির বর্ণনাকালে তাদের নারীদের স্বাধীনতা, নিজ ইচ্ছামতো বিবাহের অধিকার, বিধবা বিবাহ, সম্পত্তির উপর অধিকার, শ্রমশীলতা, কার্যকুশলতা, প্রভৃতি প্রসঙ্গ এসেছে। এই বর্ণনার মধ্যে অন্য সমাজের দর্পণে নিজের সমাজকে অবলোকন করার প্রয়াসই শুধু দৃষ্ট হয় না, পরোক্ষভাবে পাঠককে একটু সচেতন, আলোকিত করার প্রয়াসও দেখা যায়।

এই প্রসঙ্গেই নৃতত্ত্বের অন্য এক ভূমিকার কথা বলতে হয়, যা যুক্ত পশ্চিমের আলোকপ্রাপ্তির ইতিহাসের সঙ্গে। পশ্চিমের আলোক-প্রাপ্তি ঘোষণা করে তাদের অধ্যয়নের বিষয় হবে মানুষ, ঈশ্বর নয়। ইম্যান্যুয়েল কান্ট (১৭২৪–১৮০৪) বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর দর্শনের জন্য। তাঁর দর্শন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এবং দর্শনের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। তিনি কিন্তু তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন ছাড়া প্রায় চব্বিশ বছর নৃতত্ত্ব পড়িয়েছিলেন। তাঁর নৃতত্ত্বের কোর্স খুব জনপ্রিয়ও ছিল। অবসর গ্রহণের পর ১৭৯৮ সালে তিনি তাঁর কোর্স-মেটিরিয়ালের ভিত্তিতে একটি বই লেখেন, নাম হল : Anthropology from a Pragmatic Point of View (১৭৯৮)। কান্ট এই নৃতত্ত্বকে প্র্যাগম্যাটিক বা ব্যাবহারিক নৃতত্ত্ব বলেছেন এবং এর তফাত করেছেন তাঁর সময়ের তাত্ত্বিক নৃতত্ত্বের সঙ্গে, যাকে কান্ট অনুমানভিত্তিক বলে ভাবতেন। যদিও এখানে বলে রাখা উচিত যে, আজকে আমরা নৃতত্ত্ব বলতে যা বুঝি তার সঙ্গে কান্টের সময়কার নৃতত্ত্বের পার্থক্য অনেক, মিলের চেয়ে অমিলই বেশি; তবুও কান্টের নৃতত্ত্বের উল্লেখ করছি অন্য কারণে। কান্ট তাঁর নৃতত্ত্বকে গড়ে তুলেছিলেন যে পাঠ বা পঠনের মাধ্যমে তার মধ্যে ছিল উপন্যাস, বিশ্ব ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি, ভূগোল, নাটক, এমনকী জীবনীও। কান্ট মনে করতেন নৃতত্ত্বের উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন রকমের মানুষকে জানা, তাদের প্রকৃতিকে জানা। এই জ্ঞানই একজনকে সভ্য করে তুলবে, বিশ্বের নাগরিক তৈরি করতে সাহায্য করবে। কান্ট মনে করতেন এই জ্ঞানের শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক মূল্য নেই, বরং আত্মজ্ঞানের জন্যও এই জ্ঞান উপযোগী। এই জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষ আরও অন্তরঙ্গভাবে নিজেকে জানতে পারবে এবং তার ফলে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার সম্বন্ধে সচেতন হবে। কান্ট একে বলেছেন ‘কসমোপলিটান নলেজ’ বা সংস্কারমুক্ত জ্ঞান। তাঁর নৃতত্ত্বের বক্তৃতায় কান্ট মানুষের সম্পর্কের বিষয় নিয়ে বলতেন, মনে করতেন এইভাবেই ছাত্ররা বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে, আরও বিচক্ষণ হয়ে উঠবে। তিনি মনে করতেন ছাত্রদের চিন্তা (বা দর্শন) শেখানো হয়, চিন্তা করতে শেখানো হয় না। জাগতিক জীবনে মানুষ যদি জ্ঞান প্রয়োগ না করতে পারে, তাহলে সে-জ্ঞান নিষ্ফল। এই অবস্থার প্রতিকারের জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, ছাত্ররা চিন্তা শিখবে না, চিন্তা করতে শিখবে, তাদের বহন করে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, তাদের পরিচালিত করতে হবে। তিনি বলেন, যদি এটা কাঙ্খিত হয় যে ছাত্ররা নিজেদের সম্বন্ধে পারদর্শী হবে, তাহলে তাদের নৃতত্ত্ব অধ্যয়ন করা উচিত। এই নৃতত্ত্বের একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের বিচক্ষণতা এবং প্রজ্ঞা শিক্ষা দেওয়া, যে শিক্ষার জন্য প্রয়োজন মানুষের প্রকৃতি-সম্পর্কিত ঐতিহাসিক জ্ঞান।

কান্টের নৃতত্ত্ব নিয়ে এই কথাগুলি বললাম এই কারণে যে, এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বুঝতে সুবিধে হবে উনিশ এবং বিশেষ করে বিশ শতকে লেখক-সম্পাদকরা এই নৃতাত্ত্বিক লেখা প্রকাশ করে ঠিক কী করতে চেয়েছিলেন। কী ছিল তাঁদের অভীষ্ট? কোনো বিভ্রান্তি যাতে সৃষ্টি না হয় সেজন্য একটা কথা পরিষ্কার করে বলে রাখা উচিত, সেটা হল আমাদের লেখক-সম্পাদকরা কান্ট পড়েননি, কিন্তু ভেবেছিলেন অনেকটা ওইরকম। ওই সময়ের বাঙালি জীবন ধর্ম-আচার-সংস্কার-এর এক সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল এবং অন্য মানুষদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় প্রকাশ করে তাঁরা এই বাঙালি মনকে সংস্কারমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে প্রথমে শরৎচন্দ্র রায়ের একটি উদ্ধৃতি দিই : ‘নৃতত্ত্বের আলোচনা দ্বারা বিভিন্ন প্রদেশের পরস্পরের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক যোগ এবং জাতিগত সম্বন্ধের পরিচয় পাওয়া যায় তাহা প্রাদেশিক সঙ্কীর্ণতা ও ঔদ্ধত্যের প্রতিষেধক। এইরূপ তুলনামূলক আলোচনা দ্বারা একপক্ষে বিভিন্ন প্রদেশের সভ্যতার সাধারণ ভিত্তির পরিচয়ে; অপর পক্ষে বিভিন্ন প্রদেশের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও বিষয়-বিশেষে উৎকর্ষের পরিচয়ে, ভারতের বিভিন্ন জাতি পরস্পর লাভবান হইবে ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার উদ্রেক হইবে এবং জাত্যভিমান প্রসূত ঔদ্ধত্য দূরীভূত হইবে। জাতির শ্রেষ্ঠত্ব বা হীনত্ব সম্বন্ধে সাধারণ সংস্কার ভ্রমাত্মক।’ সুতরাং বোঝা যায়, নৃতত্ত্বচর্চা যে আসলে মানুষকে আরও উদারমনস্ক, সংস্কারমুক্ত করে তুলবে এ কথা অনেকেই মনে করতেন। নির্মলকুমার বসুও তাঁর জুয়াঙ্গদের নিয়ে এক লেখায় লিখেছেন : ‘আমি যখন প্রথম জুয়াঙ্গদের মধ্যে যাই তখন তাহারা জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার কি কুলির দরকার?” আমি যে তাহাদের ভাষা শিখিতে আসিয়াছি, তাহাদের সঙ্গে মিশিতে আসিয়াছি একথা তাহারা আদৌ বিশ্বাস করিল না। ক্রমে আলাপসালাপের পর যখন তাহাদের মধ্যে বসিয়া গানবাজনা শুনিতেছি তখন পার্শ্ববর্তী গ্রামের একজন ব্রাহ্মণ জনমজুরের খোঁজে একদিন সেখানে আসিয়া পড়িল। সে তো ভাষা শেখার কথা শুনিয়া হাসিয়াই ফেলিল। বলিল, “বাবু ওদের তো ভাষা নেই। বাঁদরেরা যেমন কুঁই-কাঁই করে, ওদেরও সেইরকম ঠার আছে।” ভাবিলাম, হায় রে, সুখে দুঃখে পাশাপাশি থাকিয়াও মানুষে এমন করিয়া মানুষের সহিত ব্যবধান সৃষ্টি করে, তাহাকে মানুষ বলিয়া ভাবিতে পারে না, ইহার চেয়ে দুঃখের কথা আর কিছু হইতে পারে না।’ তাহলে আমরা দেখলাম নৃতত্ত্বচর্চার যেমন একটা ঔপনিবেশিক সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি নিজের ভাষায় মানুষদের নৃতাত্ত্বিক তথ্য পরিবেশনের একটা ইতিবাচক উদ্দেশ্যও রয়েছে।

২. ভাষা ও সমাজবিদ্যাচর্চা

ভারতে নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব এই দু-টি বিষয়ই আমদানি হয়েছে বিদেশ থেকে। তাই এদের মূল ধ্যান, ধারণা, প্রত্যয়, অভিব্যক্তি, চিন্তা, মত এইসব কিছুর ভাষান্তরের প্রয়োজন, যখন এইসব বিষয়ে নিজের ভাষায় লেখা প্রক্রিয়া শুরু হবে। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি সমাজচর্চার একটা ভাষা না গড়ে তুললে এইসব বিষয়ে সঠিক আলোচনা কখনোই সম্ভব নয়। এই ভাষা তৈরি করা খুব সহজ কাজ নয় আর তা একদিনে সম্ভবও হয় না। অনেক সময় বিষয়টি হয়তো জটিল কিন্তু বাংলায় উপযুক্ত পরিভাষা নেই বা তৈরি হয়নি, ফলে বিষয়ের এক সরলীকৃত পরিচয় দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। অর্থাৎ বলতে চাইছি ভাষাকে তৈরি করতে হবে, নতুন বিষয়ের পরিভাষাকে পাঠকের মধ্যে প্রচলিত করতে হবে, তবেই পাঠক সেই আলোচনা বুঝতে পারবে। বাংলা সমাজতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক আলোচনায় ভূদেব থেকে শুরু করে ধূর্জটিপ্রসাদ, নির্মলকুমার, বিনয় ঘোষ সকলেই তাঁদের লেখার প্রয়োজনে পরিভাষা সৃষ্টি করেছেন, আবার অনেক সময় জটিলতা এড়িয়ে বিষয়টি পাঠককে সহজভাবে বলেছেন। এই প্রসঙ্গে ভাষা নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে হয়। প্রত্যেক ভাষার এক নিজস্ব কনসেপচুয়াল স্ট্রাকচার আছে যা নির্ধারিত করে আমি কীভাবে কথা বলব বা লিখব। বঙ্কিমচন্দ্র যে বাংলা ভাষা লিখতেন তার চেয়ে অনেক ভালোভাবে আজকের বাংলায় আমরা ক্রিকেট ম্যাচের বর্ণনা দিতে পারি। কারণটা এই নয় যে আমাদের সাহিত্য-ক্ষমতা বেশি, কারণটা হল আজকে ক্রিকেট বর্ণনার ভাষা আমাদের আয়ত্তে রয়েছে। অতএব একজন সমাজতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক বাংলা ভাষায় কী লিখছেন তা নির্ভর করে ভাষার কতটা সামর্থ্য আছে, ভাষাটি কতটা তৈরি হয়েছে বিষয়টির মোকাবিলার জন্য। অনেক সময় ভাষার কিছু মজ্জাগত সীমাবদ্ধতা থাকে, ফলে সেই ভাষায় কিছু কাজ সম্ভবই হয় না। ভিটগেনস্টাইন বলতেন ভাষা মানুষের জীবনের প্রকরণ, ‘ফর্ম অফ লাইফ’। লিখেছেন যে-ভাষায় শুধু আদেশ করা যায় সে-ভাষার চেয়ে যে-ভাষায় আদেশ ও প্রশ্ন দুই করা যায়, সেই ভাষার মানুষদের জীবন বেশি জটিল। কোনো একটি ভাষায় যদি অনুরোধ না করা যায় বা প্রশ্ন না করা যায় তাহলে সেই ভাষার মানুষদের মধ্যে এই কাজগুলিও নেই। অন্য যে-ভাষায় এই কাজগুলি করা যায় সেখানে জীবনের প্রকরণও আলাদা। অর্থাৎ নৃতত্ত্ব বা সমাজতত্ত্ব নিয়ে বাংলা ভাষায় কী আলোচনা করা যায় তা ভাষার গঠন, প্রকৃতির উপর এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ওই সময়ে ভাষা তার বিকাশের কোন পর্যায়ে আছে, তার উপর নির্ভর করবে।

ভাষা ও সমাজবিদ্যাচর্চার সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে সচেতন ছিলেন ধূর্জটিপ্রসাদ। তাই তাঁর লেখা নিয়েই একটু আলোচনা সেরে নেওয়া যাক। তাঁর ১৯৩১ সালে প্রকাশিত আমরা ও তাঁহারা বইটি তিনি লিখেছিলেন ডায়লগ ফর্মে। বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন : ‘প্রবন্ধ যে লিখিনি তা নয়। তবু ‘ডায়লগ’ ভালো লাগে কেন, কথোপকথনের রূপ নিলাম কেন?’ একটা কারণ বলেছেন সবুজ পত্র-এর সদস্য হিসেবে তর্ক করার অভ্যাস। কিছুটা সেই অভ্যাসের বশে। ‘অপর কারণ হচ্ছে “ডায়লগ”-এর অনায়াস গতি, কথোপকথনের আপেক্ষিক স্বাধীনতা। এই ছকে অনেক সত্যের বুনন চলতে পারে। এই কাঠামোর মধ্যে নড়বার চড়বার স্থান একটু বেশি। এতে দায়িত্ববোধ থাকলেও তেমন আড়ষ্ট হয়ে থাকতে হয় না। এতে মোড় ঘোরানো সহজ। এর ভেতর প্রবেশলাভ করা যেমন সহজ, এর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া তেমনই সহজ। অর্থাৎ এর প্রবেশপথ আর নিষ্ক্রমণ পথ-দুটোই উন্মুক্ত ও ঋজু।’ লিখেছেন, সব চিন্তাই তো একরকম ডায়লগ, হয় আমি ও তুমির মধ্যে নয় ইগো ও সুপার-ইগোর মধ্যে। প্রশ্ন করেছেন, কথোপকথনের রূপে বিষয়ের গুরুত্ব ও গাম্ভীর্য কতটা ধরা পড়ে। উত্তর দিয়েছেন, হয়তো ধরা পড়ে না। লিখেছেন : ‘অতএব যদি সমস্যা বিচারের প্রয়োজনই থাকে, তবে সহজ, স্বচ্ছ ও স্বল্প ভাষার প্রবন্ধ লিখলেই চলে। কথাবার্তার রূপটি নেব অথচ “ডায়লগ”-এর স্বাভাবিকত্বটুকু বাদ দেব, এটা অন্যায়।’১০ তবুও যে কথোপকথনের রূপ গ্রহণ করেছেন তার কারণ আগেই বলেছি। যেটা বলতে চাইছি, বাংলা ভাষায় সমাজতাত্ত্বিক বিতর্ক বা নৃতাত্ত্বিক বিবরণ রচনার জন্য লেখকরা নানাবিধ ফর্মের কথা ভেবেছেন, নির্মলকুমার যেমন পরিব্রাজকের ডায়েরী (১৩৪৭) লিখেছেন। এই ‘ডায়লগ’ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ধূর্জটিপ্রসাদ মনে এলো-তে লিখেছেন : ‘দর্শনশাস্ত্রের দুটি পদ্ধতি প্রচলিত : (১) ডায়লগ-কথোপকথন, আর (২) ডায়লেকটিক। ডায়লগ বিভিন্ন মনোভাব ও পরিশীলনের প্রতি শ্রদ্ধা আর ডায়লেকটিকে মতবাদের পার্থক্য উত্তীর্ণ হয় নৈর্ব্যক্তিক সত্যের সন্ধান।’১১ আবার ধূর্জটিপ্রসাদ যখন মনে এলো লিখেছেন, যার মধ্যেও সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি নিয়ে অনেক কথা আছে, তখন একটু অন্যভাবে লিখেছেন। তিনি লিখছেন : ‘বলা বাহুল্য, এটা ঠিক ডায়েরি নয়। . . . মনোভাবটাও ঠিক রোমান্টিক নয়, আবার দার্শনিকও নয়। অন্যদিকে মানসিক রিপোর্টাজও লিখতে বসিনি। সারাদিন খেটেখুটে একলা খাবার টেবিলের ধারে বসে নিজের সঙ্গে কথোপকথন করেছি এ খানিকটা তাই।’১২ ধূর্জটিপ্রসাদের দৃষ্টান্ত দিয়ে বাংলা ভাষায় সমাজবিদ্যাচর্চা সম্পর্কে যে-কথা বলতে চাই সেটা হচ্ছে সমাজ-আলোচনায় ভাষার প্রয়োগও কিন্তু আমাদের লক্ষ করতে হবে। বস্তুত এই সমাজবিদ্যা গড়ে উঠেছে ভাষাকে আধার করেই। নানা বিষয় নিয়ে লিখেছেন ধূর্জটিপ্রসাদ, নানারকমভাবেও লিখেছেন : ‘অত বিভিন্ন বিষয়ে মনোযোগ দিই কেন প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রথম জবাব আগেই দিয়েছি-এই আমার স্বভাব। অর্থাৎ আমি যাঁদের সঙ্গে ঘরে বসত করেছি, যে-যে ধরনের যা যা বই পড়েছি ও পড়িয়েছি, সে সব আমার মনে আঘাত করেছে। অতএব এগুলি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। সোজা কথা এই, নিজেকে ক্ষুদ্র গণ্ডিবদ্ধ করতে মন চায়নি। দ্বিতীয় কথা এই : অন্তত বিভিন্ন সামাজিক চিন্তাগুলিকে আমি গ্রথিত একত্রিত সমন্বিত করতে চেষ্টা করেছি এটা দুঃসাহস, এক প্রকারের দম্ভ। . . . এক হিসেবে ঠিক চেষ্টা করিনি, সহজে যতটা হয়, ততটা হয়ে গেছে। অবশ্য বেশিরভাগই হয়নি। তবে এই একত্র সমাবেশের আন্তরিক ইচ্ছাই হলো আমার প্রথম ও শেষ কার্যকরী মনোভাব।’১৩ প্রশ্ন হল, এই যে ধূর্জটিপ্রসাদ তাঁর চিন্তাভাবনা প্রকাশের জন্য নানা বিষয়, নানা উপায় ভেবেছিলেন, পাঠক সমাজ কি তা গ্রহণ করতে পেরেছিল? ধূর্জটিপ্রসাদ বলছেন, ‘না’। আমরা ও তাঁহারা যদিও লিখেছিলেন ডায়লগের ফর্মে কিন্তু নিজেই মুখবন্ধে বলেছেন লেখার ভাষা খুব সহজ হয়নি, ‘অধ্যাপকদের ভাষা দুর্বোধ্য ও ইংরেজীবহুল হতে বাধ্য। যে ভাষায় আমরা কথোপকথন ও বক্তৃতা করি, সেটি আমাদেরই আবিষ্কৃত ইংরেজী ভাষার অনুবাদ।’ এতদসত্ত্বেও তাঁর রচনা পাঠকের পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি, এই অভিযোগ তিনি তাঁর জীবনের শেষ দিন অবধি করে গেছেন। আমরা ও তাঁহারা বইটির মুখবন্ধেও লিখেছিলেন : ‘আমার বন্ধুরা ছাড়া অন্যে আমার লেখা পড়েন না, কারণ উপকৃত হবার প্রবৃত্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে খুবই কম।’১৪

৩. বাংলা ভাষায় সমাজতত্ত্ব

এই বইয়ে আমরা যে চারজন সমাজতত্ত্ববিদের আলোচনা করেছি তাঁরা হলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকার, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও বিনয় ঘোষ। একটা বড়ো কারণ হল, এঁরা চারজনই বাংলা ভাষায় সমাজতত্ত্ব-বিষয়ক অনেক রচনা লিখেছেন। ভূদেব, বঙ্কিমচন্দ্রের মতোই, কোঁতের পজিটিভতত্ত্বের সমালোচক ছিলেন, যদিও প্রয়োজনে এই তত্ত্ব নিজের সমাজচিন্তায় ব্যবহারও করেছেন।১৫ বিনয়কুমার গবেষণা করেছেন ইতিহাস, দর্শন, নৃতত্ত্ব, ধনবিজ্ঞান, সমাজশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে। ধূর্জটিপ্রসাদ ও বিনয় ঘোষ দু-জনেই মার্কসবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, কিন্তু দু-জনেই এই তত্ত্বকে ব্যবহার করেছেন সৃষ্টিশীলভাবে। মার্কসবাদ তত্ত্ব হিসেবে পজিটিভ তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত, সুতরাং সমাজতত্ত্বের যে ধারা আমরা এই বইয়ে আলোচনা করেছি তার প্রেক্ষাপট সঠিকভাবে বুঝতে গেলে সংক্ষেপে বাংলায় সমাজতত্ত্বের অনুপ্রবেশের কথা বলতে হয়। বাংলায় ১৮৬৭ সালে বেঙ্গল সোশ্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন স্থাপিত হয়। বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভা বিজ্ঞানকে তাদের সমাজ বিশ্লেষণের মডেল হিসেবে ঘোষণা করে এবং আশা প্রকাশ করে যে, বিজ্ঞানের দ্বারা প্রযুক্তি ও কলাকৌশলের যেমন উন্নতি হয়েছে, ‘পজিটিভ বিজ্ঞান’ অনুসরণ করে সমাজের সে-রকমই উন্নতি হবে। সেকালের সমাজবিজ্ঞানের ধারণায় এই বিষয়টি সমাজ সম্পর্কে ব্যবস্থার কথা বলবে, বিধান দেবে, এই রকমই ভাবা হত। এই ধরনের সভা এলিটদের রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণের একটা ক্ষেত্রও ছিল। আমরা বলতে পারি অ্যাকাডেমিক সমাজতত্ত্ব উনিশ শতকে যে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল তার একটি কারণ হল প্রভাবশালীদের রাজনৈতিক হতাশা। সমাজবিজ্ঞান সভা এই রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ পূর্ণ করার একটা মঞ্চ ছিল বলা যায়। এই সম্পর্কে সোমপ্রকাশ পত্রিকা লেখে : ‘যেরূপ রাজনীতি সম্বন্ধে হইতেছে, সমাজেরও সেইরূপ জাতি সাধারণ্যে উন্নতিসাধন চেষ্টা করা আবশ্যক। আমাদিগের উদ্দেশ্য এই দেশের প্রধান প্রধান লোকেরা ইংলণ্ডের সামাজিক বিজ্ঞান সভার (সোসিয়াল সায়েন্স কংগ্রেস) ন্যায় এক সভা করুন। মধ্যে মধ্যে দেশের স্থানে স্থানে সভার অধিবেশন হউক। . . . সভ্যগণ সমাজের অবস্থা ও উন্নতির প্রস্তাব ও তৎসম্পাদনের চেষ্টা করুন। ইংলণ্ডীয় “সামাজিক বিজ্ঞান সভা” অনেক কাজ করিতেছেন, এ দেশেও সে প্রকার না হইবে কেন?’১৬

পজিটিভতত্ত্ব বলে, মানুষের সভ্যতা কিছু নিয়মের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয় এবং বিজ্ঞান যেমন প্রাকৃতিক নিয়মকে অনুসন্ধান করে, সামাজিক নিয়মের অনুসন্ধানও এক বিজ্ঞান। বিজ্ঞান যেমন তার নিয়মের মাধ্যমে জীবনকে সংস্কার করে, সমাজবিজ্ঞানও তা-ই করবে। অর্থাৎ, সমাজবিজ্ঞান হল ‘সংস্কারের বিজ্ঞান’। ‘বিজ্ঞান’ ও ‘সংস্কার’ এই দুই চাবিকাঠির মাধ্যমে আমরা বঙ্গীয় সমাজবিজ্ঞান সভার কাজকর্ম বুঝতে পারি। উনিশ শতকের ষাট ও সত্তর দশকে পজিটিভতত্ত্ব নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (১৮৪৫–৮৬) ১৮৭২ সালে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ‘কোমৎ দর্শন’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।১৭ তিনি বলেন কোৎদর্শন নিরীশ্বর কিন্তু তা বলে তাকে অশ্রদ্ধা করলে চলবে না। মানুষকে ধর্মশৃঙ্খলে আবদ্ধ করাই এই দর্শনের উদ্দেশ্য। এই বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১৮৭৪ সালে রাজকৃষ্ণ ‘সমাজ বিজ্ঞান’ নামে আরও একটি প্রবন্ধ লেখেন।১৮ তিনি লিখেছেন, আজকের যুগের প্রধান লক্ষণ হল বিজ্ঞানের অধিকার বিস্তার : ‘কার্য্যকারণসূত্র ধরিয়া বিজ্ঞান জগন্মণ্ডলে সর্ব্বত্রই নিয়মের আধিপত্য সংস্থাপন করিতেছে, এক্ষণে মনুষ্যসমাজকেও ছাড়িতেছে না। সূক্ষ্মদর্শী পণ্ডিতগণ বলিতেছেন যে, মানবজাতিও কার্য্যকারণশৃঙ্খলে গ্রথিত, মানবজাতিও নিয়মের অধীন।’১৯ রাজকৃষ্ণ নিজে বিজ্ঞানের অনুরাগী ছিলেন এবং মনে করতেন বিজ্ঞানের সাহায্যে জ্ঞানবৃদ্ধি করলে সমাজের উন্নতি হবে। ‘সমাজ বিজ্ঞান’ প্রবন্ধে কোঁৎ-এর সমাজ দর্শনের তিনটি পর্যায়ের উল্লেখ করে তিনি লেখেন : ‘সুপ্রসিদ্ধ ফরাসি পণ্ডিত অগোস্ত কোমত বলেন যে জ্ঞানোন্নতির তিনটি সোপান আছে, (১) পৌরাণিক, (২) দার্শনিক, (৩) বৈজ্ঞানিক আর যে বিজ্ঞানের বিষয় যত সরল, তাহা তত শীঘ্র বৈজ্ঞানিক সোপানে উত্তীর্ণ হয়। অদ্যাপি ইহার অতিরিক্ত উচ্চ কথা আর কেহই বলিতে পারেন নাই, এবং ইহার সাহায্যে কোমত ঐতিহাসিক তত্ত্বের অনেক ব্যাখ্যা করিয়াছেন।’২০ রাজকৃষ্ণ যেহেতু বৈজ্ঞানিক চেতনার উন্নতি চাইতেন, তিনি পজিটিভতত্ত্বের ধর্মীয় দিক নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি, তিনি এই বিষয়টি ভারতের জন্য যে খুব প্রাসঙ্গিক, এ-রকমও মনে করতেন না। তাঁর বন্ধু বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু পজিটিভতত্ত্বের ধর্মীয় দিকটির প্রতি অনেক বেশি মনোযোগ দিয়েছেন।

কোঁৎ ও তাঁর পজিটিভতত্ত্বকে যদি কেউ বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে জনপ্রিয় করে থাকেন, তাহলে তিনি হলেন বঙ্কিমচন্দ্র। ১৮৭২ সালে বঙ্গদর্শন প্রকাশিত হবার আগে পজিটিভতত্ত্ব সম্পর্কে ইংরেজিতে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয় Calcutta Review ও The Bengalee পত্রিকায়। বঙ্কিমচন্দ্রের নিজের পজিটিভতত্ত্ব সম্পর্কে আপত্তি ও সমালোচনা থাকলেও সমসাময়িকদের মধ্যে এই তত্ত্বের প্রচারে তাঁর বঙ্গদর্শন একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বঙ্গদর্শন-এর নিয়মিত পাঠকের কোঁৎ নামটি লক্ষ না করে উপায় ছিল না। প্রথম বছরেই তিনি রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘কোমৎ দর্শন’ প্রকাশ করেন, পরের বছর যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ ‘জাতিভেদ’ নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখেন। Calcutta Review পত্রিকায় যাঁরা পজিটিভতত্ত্ব নিয়ে লিখতেন স্যামুয়েল লব (১৮৩৩–১৮৭৬) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ (১৮৪২–১৯০২) লবের অনুগামী ছিলেন এবং ‘ইন্ডিয়ান পজিটিভিস্ট সোসাইটি’র একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের অবশ্য পজিটিভতত্ত্ব সম্পর্কে নিজস্ব মত ছিল এবং সে-কথা তিনি বিভিন্ন রচনায় লিখেও গেছেন। সেই সময়ে কোঁৎ-এর দর্শন নিয়ে বাঙালি শিক্ষিত মহলে যেমন উৎসাহ ছিল, তেমনি জন স্টুয়ার্ট মিল লিখিত কোঁৎ-এর সমালোচনার কথাও সকলে অবহিত ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রও এ সম্পর্কে যা লিখেছিলেন, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। বঙ্কিমচন্দ্র রজনী উপন্যাসে ‘শচীন্দ্র বক্তা’ অংশে লিখেছেন : ‘প্রাচীন ইতিবৃত্ত-লেখকদিগের মত লইয়া অমরনাথ কোমতের ত্রৈকালিক উন্নতিসম্বন্ধীয় মতের সমর্থন করিলেন। কোমৎ হইতে তাঁহার সমালোচক মিল ও হকসলীর কথা আসিল।’২১ এখানে বঙ্কিমচন্দ্র কোঁৎ-এর ‘Law of three stages’-এর কথা বলছেন। বঙ্কিম মনে করতেন কোঁৎ নিরীশ্বরবাদী নন কিন্তু তাঁর তত্ত্ব যে মানুষ যত বিজ্ঞানমনস্ক হয়, তার ঈশ্বরের প্রয়োজন তত কম হয়-এই সিদ্ধান্ত নিরীশ্বরবাদী। বঙ্কিমের মতে এই দর্শনের সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে এর এক উচ্চ মূল্য আছে। তিনি লিখেছেন এই দর্শনের সঙ্গে সাংখ্যদর্শনের মিল আছে, যে সাংখ্যদর্শন বলে এই জগতে বাস করে ও নিজের কর্তব্য পালন করে মানুষকে নির্লিপ্ততা অর্জন করতে হবে। বঙ্কিম মনে করতেন কোঁৎ যে নির্দেশ দিয়েছেন, নিজের ব্যক্তিগত সুখ পরিত্যাগ করা, নিষ্ঠাসহকারে নিজের কর্তব্য করা, মানুষের জন্য জীবনযাপন করা, এইসব নির্দেশের সঙ্গে সাংখ্যদর্শনের শিক্ষার সদৃশতা আছে। পজিটিভতত্ত্বের সঙ্গে সাংখ্যদর্শনের তুলনা করে বঙ্কিমচন্দ্র বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভারতবাসী এই চিন্তা পশ্চিমের চেয়ে অনেক আগে করেছে।

তাঁর ধর্ম্মতত্ত্ব রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন ভারতীয়দের প্রকৃতি ও মনুষ্যত্ব সম্পর্কে কোঁৎ-এর বিজ্ঞান থেকে শিখতে হবে, যে বিজ্ঞানের বিভিন্ন পর্যায় আছে এবং ঈশ্বর সম্পর্কে জানতে হবে হিন্দুশাস্ত্র থেকে, উপনিষদ, পুরাণ, ইতিহাস এবং বিশেষ করে গীতা থেকে। কোঁৎ থেকে ভারতীয়রা পাশ্চাত্য বিজ্ঞান এবং মানুষের ধর্মীয় প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারে। ধর্ম্মতত্ত্ব রচনায় বঙ্কিম, কান্ট, ফিকতে, মীল, সীলি প্রভৃতির ধর্ম সম্পর্কিত মতামত তুলনা করে বলেন এই সব ক-টি ব্যাখ্যার মধ্যে কোঁৎ-এর ব্যাখ্যা ‘উৎকৃষ্ট বলিয়া বোধ হয়। আর যদি এই ব্যাখ্যা প্রকৃত হয়, তবে হিন্দুধর্ম্ম সকল ধর্ম্মের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম্ম।’২২ তিনি কোঁৎ-এর সঙ্গে একমত ছিলেন যে, মানুষ যত ধার্মিক হবে তত তার উন্নতি হবে এবং ধর্ম মনুষ্যত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত, ব্যক্তির মুক্তির সঙ্গে নয়। আগেই বলেছি সেইসময় ভারতে অনেকেই কোঁৎ-এর তত্ত্ব জানতে পারেন জন স্টুয়ার্ট মিলের সমালোচনার মাধ্যমে। বঙ্কিম তার এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন মিলের মৃত্যুর পর লেখা তাঁর এক রচনায় : ‘মিল প্রথমাবস্থায় অনেক বিষয়ে কোমতের সহিত একমত ছিলেন কিন্তু পরিণামে নানা মতভেদ উপস্থিত হয়। আমরা মনে করি যে পরস্পরের বিবাদের স্থূল কথা এই যে-ব্যক্তিবিশেষ ও জনসমাজ এতদুভয় মধ্যে, মিলের মতে ব্যক্তির প্রাধান্য রক্ষা করিয়া সমাজের উন্নতিসাধন করিতে হইবেক নতুবা পৃথিবী ক্রমশ নিস্তেজ হইয়া যাইবেক। আর কোমত বলেন যে, সহস্র চেষ্টা করিলেও মনুষ্যের স্বার্থানুরাগ পরহিতৈষিতা অপেক্ষা ক্ষুণ্ণ হইবেক না; ব্যক্তিবিশেষের প্রাধান্য রক্ষার্থ যত্ন প্রয়োগ হইলে, সেই যত্নের দ্বারা সমাজের যে উন্নতি হইতে পারিত তাহার ব্যাঘাত হইবেক। অতএব স্বার্থানুরাগ কেবল দমন করিবার চেষ্টা করাই কর্তব্য। মিল ও কোমতের ন্যায় মহোপাধ্যায়গণ যে সকল বিষয়ের ঐক্যমত সংস্থাপন করিতে পারেন নাই, তাহার কোনো পক্ষের মত সমর্থন করা সামান্য লোকের পক্ষে অবশ্যই অসাধ্য। সুতরাং মতদ্বয় মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ এবং কোনটি নিকৃষ্ট তদ্বিষয়ে আমরা কোনো কথা বলিতে পারি না। কিন্তু এই পর্য্যন্ত বলিতে ইচ্ছা করি যে, মিল, কোমত দর্শন বিচার করিবার জন্য Auguste Comte and Positivism২৩ নামক যে পুস্তক রচনা করিয়াছেন, তাহাতে জনসমাজের কথঞ্চিৎ ক্ষতি হইয়াছে। কিন্তু তাহা মিলের অভিপ্রেত নহে বলিয়া তজ্জন্য মিলকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। অনেকে কোমতের গ্রন্থ পাঠ করা দুরূহ বলিয়া মিলের গ্রন্থ হইতে তাঁহার মতের সার সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইহার পরিণাম কেবল এইমাত্র হয় যে, যেমন কিছুদিন পূর্ব্বে খৃষ্টান মহাশয়েরা সকল কথা না বুঝিয়া কেবল হিন্দুধর্ম্মের প্রতি ব্যঙ্গ করিতেই পটু হইতেন, মিলকৃত কোমতভাষ্যের পাঠক মহাশয়েরাও তদ্রূপ কেবল ব্যঙ্গ করিবার ক্ষমতা লাভ করেন।’২৪ এই রচনার দু-বছর পর মিল ও ডারউইন নিয়ে তাঁর অন্য একটি প্রবন্ধ ‘মিল, ডার্বিন এবং হিন্দুধর্ম্ম’ বঙ্গদর্শন-এ প্রকাশিত হয়।২৫ এই প্রবন্ধে তিনি লেখেন যে ডারউইনের বিবর্তনবাদ ও আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে ত্রিদেব উপাসনার ধর্ম অনেক বেশি স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। তিনি লেখেন : ‘প্রচলিত হিন্দুধর্ম্মের শিরোভাগ এই যে, ঈশ্বর এক, কিন্তু তিনটি পৃথক পৃথক মূর্ত্তিতে তিনি বিভক্ত। এক সৃজন করেন, এক পালন করেন এবং এক ধ্বংস করেন। এই ত্রিদেব লোকপ্রথিত। . . . ত্রিদেবের অস্তিত্বের কোন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নাই, ইহা যথার্থ, কিন্তু ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে মহাবিজ্ঞানকুশলী ইউরোপীয় জাতির অবলম্বিত খ্রীষ্ট ধর্মাপেক্ষা হিন্দুদিগের এই ত্রিদেবোপসনা বিজ্ঞান সঙ্গত এবং নৈসর্গিক। ত্রিদেবোপসনা বিজ্ঞানমূলক না হউক, বিজ্ঞান বিরুদ্ধ নহে।’২৬

বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত্র (১৮৮৬) বা ধর্ম্মতত্ত্ব (১৮৮৮) গ্রন্থে যে হিন্দুধর্মের কথা বলেছেন তার সঙ্গে পরম্পরাগত হিন্দুধর্মের কোনো মিল নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দুধর্ম পুরোহিততন্ত্রবিরোধী, মানবতাবাদী ও সেবামূলক। বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মের এই ধারণা বহুলাংশে কোঁৎ দ্বারা প্রভাবিত। বিনয় সরকারও মনে করতেন যে বঙ্কিমচন্দ্র কোঁৎ-এর পজিটিভতত্ত্ব আত্মীকরণ করেছিলেন এবং তাঁর হিন্দুধর্মের ধারণা এক মানবতাবাদী, অ-পুরোহিততান্ত্রিক রূপ পরিগ্রহ করে।২৭ বঙ্কিমচন্দ্রের সমালোচনা করে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন : ‘কেন বঙ্কিম দুটো কৃষ্ণের অবতারণা করিলেন, এবং এক কৃষ্ণকে আদর্শ পুরুষ বলিয়া দাঁড় করাইতে চেষ্টা করিলেন? বঙ্কিমচন্দ্র শেষাশেষি যতই গীতাভক্ত হউন না কেন, তিনি অনেক দিন ধরিয়া পাকা positivist ছিলেন। Positive philosophy যাহাই হোক না কেন, শুধু মানুষকে লইয়া একটা positive religion দাঁড় করাইবার চেষ্টা করিলে চলিবে কেন? Religion কি অমনি গড়িয়া তুলিলেই হয়? Positivist চাহিল একজন grand man মহাপুরুষ। বঙ্কিমবাবু ভাবিলেন, এই ত আমার হাতের কাছে একজন grand man রহিয়াছেন; যেমন বিষয়বুদ্ধি, তেমনি পরমার্থজ্ঞান, এইরকম চৌকস মানুষ দরকার। অতএব আমাদের দেশে Positivist religion দাঁড় করাইতে হইলে শ্রীকৃষ্ণকে grand man করিলেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হইবে।’২৮ সাধারণভাবে বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে এই ধারণা অনেকের মধ্যেই ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র নিজে আধুনিক ধ্যানধারণার প্রতি আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু সেই তত্ত্ব বা মতবাদ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব কিছু মতামতও ছিল। পজিটিভতত্ত্ব সম্পর্কেও ওই একই কথা বলা যায়। কোঁৎ-এর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল কিন্তু তিনি তাঁর শিষ্য ছিলেন না, যেমন সেই সময় বাংলায় অনেকেই ছিলেন। সেইজন্য পজিটিভতত্ত্ব থেকে প্রয়োজনে কিছু ধ্যানধারণা গ্রহণ করে তিনি হিন্দুধর্মের সংস্কারসাধন করতে চেয়েছিলেন। যে পশ্চিমি ধ্যানধারণা তিনি হিন্দুধর্মের সঞ্জীবনের জন্য গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে বিজ্ঞান ছিল একটি।

ভূদেবও মনে করতেন ভারতের পুনরুজ্জীবন সম্ভব হিন্দুধর্মের নীতি-নিয়ম অবলম্বন করেই, হিন্দু ঐতিহ্য রক্ষা করে। কিন্তু তিনি মনে করতেন এই নিয়ম-নীতি রক্ষা করার জন্য আছে হিন্দু সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি। আমরা ভূদেব নিয়ে যে অধ্যায়ে আলোচনা করেছি, সেখানে দেখব যে ভূদেব মনে করতেন পশ্চিম থেকে আমাদের বিশেষ কিছু শিক্ষার নেই-বিজ্ঞান, ব্যাবসাবাণিজ্য ও অ্যাডভেঞ্চারের মানসিকতা ছাড়া। তিনি মনে করতেন আমরা যদি হিন্দু সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির সংরক্ষণ করতে পারি তাহলে তার থেকে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হবে, যা আমাদের স্বাধীনতা দেবে। প্রাচীন হিন্দুরা যে আচার-আচরণ অনুসরণ করতেন মানুষের তা-ই অনুসরণ করা উচিত। তিনি যখন ভবিষ্যৎ ভারতের কথা বলছেন, তখন তিনি রাজনৈতিক তত্ত্ব বা অর্থনৈতিক বিকাশের কথা বলেননি, তাঁর মনে হয়েছে হিন্দু আচরণবিধি পালনই যথেষ্ট। ভূদেব ভাবেননি যে এই আচরণবিধি কীভাবে এক আধুনিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন মেটাবে। তাঁর এ-রকম ভাববার একটা প্রধান কারণ ছিল, তিনি মনে করতেন ইংরেজ হিন্দুধর্মের শিকড় উপড়ে ফেলতে চাইছে। বঙ্কিম কোঁৎ-এর নিরীশ্বরবাদের প্রতি সহনশীল ছিলেন, কোঁৎ যে বিজ্ঞানের কথা বলেছেন তার সম্বন্ধে উৎসাহী ছিলেন। ভূদেব পারতপক্ষে কোঁৎ-এর কোনো ধ্যানধারণার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন না। কোঁৎ-এর তত্ত্ব, যে, বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে সাম্রাজ্য, ধর্মীয় প্রভেদ, জাতি বিরোধ, যুদ্ধ লোপ পাবে, মানুষ স্বার্থ ছেড়ে পরার্থপর হয়ে উঠবে, ভূদেব এই মতের সঙ্গে একমত হননি। তিনি লিখেছেন : ‘কোমটি বলেন (১) পৃথিবীতে ধর্মভেদ রহিতে হইবে (২) বর্ণভেদ রহিত হইবে (৩) যুদ্ধবিগ্রহ উঠিয়া যাইবে (৪) বৃহৎ বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা বন্ধ হইবে . . . অভ্যাসগুণে পরার্থপরতা মানবহৃদয়ে স্বার্থপরতার আসন পরিগ্রহ করিবে।’২৯ ভূদেব বলছেন যুদ্ধবিগ্রহ থামবে না কারণ ভোগ্যবস্তুর সসীমতা। সীমিত ভোগ্যবস্তুর অধিকারের জন্য যুদ্ধ চলতে থাকবে। বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপনের চেষ্টা রহিত হবারও কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তিনি মনে করতেন ঈশ্বর ছাড়া ধর্মের কোনো মূল্য থাকে না। এবং বঙ্কিমের মতো তিনিও মনে করতেন যখন পূর্ণাঙ্গ ঈশ্বর রয়েছেন তখন অপূর্ণাঙ্গ মানুষকে পূজা করার কী মানে হয়।

প্রশ্ন হল, উনিশ শতকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা পজিটিভ দর্শনের প্রতি আকর্ষিত হয়েছিলেন কেন? তাঁদের এই আগ্রহের কারণ কী? যে উত্তরের কথা সর্বপ্রথম মনে আসে তা হল পজিটিভ দর্শনে বিজ্ঞান ও ধর্মের সমন্বয় ঘটেছে অর্থাৎ বলতে পারি এই দর্শনের প্রধান দু-টি উপাদান হল বিজ্ঞান ও ধর্ম। সেই সময়ে বাঙালি জীবনে সমাজবোধ এবং সমাজ পরিচালনার কাঠামো ছিল ধর্ম। নিজের ধর্মকে পজিটিভ ‘বিজ্ঞান’-এর আলোকে বিচার করার তাই একটা আগ্রহ চোখে পড়ে। দ্বিতীয় হল, পজিটিভ দর্শন সমাজ বিকাশের বিভিন্ন ধাপের কথা বলে, বলে সমাজের কিছু নিয়ম আছে এবং সেই নিয়ম অনুযায়ী উন্নতি সুনিশ্চিত। যেটা প্রয়োজন তা হল ‘সামাজিক মেশিন’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান, যাতে উন্নতি মসৃণভাবে হতে পারে। সেই অর্থে পজিটিভ তত্ত্ব এক আশাবাদী তত্ত্ব। পজিটিভ তত্ত্ব অভিজ্ঞতালব্ধ প্রত্যক্ষের উপর নির্ভর করে, কোনো প্রাকসিদ্ধ (a priori) ধারণার উপর নয়। সেইজন্য পজিটিভ দর্শন, ক্রিটিকাল দর্শনকে, যেমন হেগেলের দর্শনকে, ‘নেগেটিভ’ দর্শন আখ্যা দেয়। কারণ, এই দর্শনের কনসেপচুয়াল কাঠামো বস্তু যেমনভাবে আছে, সেই বিদ্যমানতাকে অস্বীকার করে। বাস্তবে যা আছে ক্রিটিকাল যুক্তির আলোকে তা সীমিত, অনিত্য ও নেতিবাচক হিসেবে প্রতিভাত হয়। পজিটিভ দর্শন তাই হেগেলীয় ডায়ালেকটিকসকে এক ধ্বংসমূলক প্রক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করে। তাই পজিটিভ দর্শনে ক্রিটিকের কোনো স্থান নেই। কোঁৎ বলেছিলেন পজিটিভ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন মানুষ তার জীবন ও কাজকর্মকে ইতিবাচকভাবে দেখবে, অথবা এই দর্শন তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে শেখাবে। পজিটিভ দর্শন বিদ্যমান ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করবে, নেতিবাচক প্রক্রিয়ায় তাকে বাতিল করবে না। যে বাঙালি ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার ফলে উপকৃত হয়েছিল, তাদের চিন্তায় এই সিস্টেম সাধারণের উন্নতির এক তন্ত্র হিসেবে মনে হয়েছিল।

সমাজকে প্রকৃতির মতো বিচার করে এবং তাকে বিকাশের নিয়মাধীন করার ফলে মানুষের স্বাধীনতার ধারণা এই দর্শন থেকে অবলুপ্ত হয়েছে। মানুষের র্যাশনাল উইলের থেকে স্বাধীনতা এখানে বিচ্ছিন্ন, স্বাধীনতার পরিসর হল সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার বাস্তব আইনকানুন। মার্কসের একটা ব্যাখ্যা হতে পারে যে, তিনি মনে করতেন সমাজ অযৌক্তিক ও অনিষ্টকর যতক্ষণ অবধি তা পরিচালিত হচ্ছে অমোঘ বাস্তব নিয়মকানুনের মাধ্যমে। উন্নতি তাঁর কাছে এই আইনকে বদলে দেওয়া, যা সম্ভব হবে মানুষের স্বাধীন বিকাশের মাধ্যমে। পজিটিভতত্ত্বের মত ঠিক বিপরীত। এখানে সমাজের নিয়ম প্রকৃতির নিয়মের মতোই এবং মানুষ এই সর্বত্র বিরাজমান উন্নতির নিয়মের এক সাধন মাত্র, যার এই নিয়ম পরিবর্তনের কোনো ক্ষমতা নেই। পজিটিভ তত্ত্বে ‘উন্নতি’ এক স্বাধীন নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতির অনুকরণে এখানে সমাজের ধারণা অরগ্যানিক বা জৈবিক। সমাজের জৈবিক ধারণা ভারতবর্ষে অপরিচিত নয়। চতুবর্ণ ব্রহ্মার শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে উদগত হয়েছিল এ গল্প সকলে জানে। কিন্তু এ ছাড়াও সমাজের জৈবিক ধারণা এক স্থিতিশীলতার কথা বলে, শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন সামঞ্জস্যবিধান করে শরীরকে স্থিতিশীল রাখে সমাজও সে-রকম। এই শৃঙ্খলা থাকলেই সমাজ উন্নতি করতে পারবে অর্থাৎ শৃঙ্খলার শর্তে উন্নতি। সমাজে বিরোধ আছে কারণ শৃঙ্খলা ও উন্নতি এই দুই ধারণা এখনও আলাদা, সমাজতত্ত্ব এই পৃথকত্বের অবসান ঘটাবে, দেখাবে উন্নতিই বস্তুত শৃঙ্খলা। এই কারণেই উনিশ শতকে পজিটিভতত্ত্ব এত গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। এটা ছিল এক আশাবাদী মতবাদ, যা বিরোধকে গুরুত্ব দেয়নি, সংগতির উপর জোর দিয়েছিল এবং এক সর্বজনীন উন্নতির কথা বলেছিল। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালিকে সমাজ পরিবর্তনের এক আকর্ষক তত্ত্ব প্রদান করেছিল এই দর্শন। এই সমাজতত্ত্ব ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্নকরণ দাবি করেনি, বলেছে যদি ঐতিহ্যকে সুরক্ষিত করা যায় সমাজ পরিবর্তন স্বাচ্ছন্দ্যময় হবে। সেই সময় যাঁরা ভয় পেতেন যে পশ্চিমের প্রভাবে আমাদের নিজস্ব বলে আর কিছু থাকবে না তাঁদের এই সমাজতত্ত্ব স্বস্তি দেয় এই বলে যে, পরিবর্তন হবেই এবং তা হবে সর্বজনীন। এই তত্ত্ব একদিকে হিন্দু সমাজব্যবস্থাকে নিকৃষ্ট না বলেও পরিবর্তনের কথা বলে, যে পরিবর্তন বিবর্তনবাদী, ফলে এই তত্ত্ব রক্ষণশীলদের সমর্থন পায়; অন্যদিকে বিজ্ঞানধর্মী, সর্বজনীন উন্নতির কথা বলে এই তত্ত্ব জাতীয়তাবাদীদেরও আস্থা অর্জন করে।

আলোচিত অন্য দুই সমাজতাত্ত্বিক ধূর্জটিপ্রসাদ ও বিনয় ঘোষ দু-জনেই মার্কসবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন একথা আগেই বলেছি। অনেকেই মার্কসবাদের সঙ্গে পজিটিভতত্ত্বের যোগস্থাপন করেছেন। ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে এক ‘বিজ্ঞান’ হিসেবে দেখার প্রবণতাও দেখা গেছে। রাজনৈতিক প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রেও এক ধরনের ‘বিজ্ঞান’-এর প্রয়োগের কথা অনেকে বলেছেন, যা এক প্রকারের ‘অভিজ্ঞতাভিত্তিক সমাজতত্ত্ব’-এর সঙ্গে যুক্ত। এই ইমপিরিকাল সমাজতত্ত্ব পরিকল্পনামাফিক সমাজের পরিবর্তন ঘটাবে, যেমন বিজ্ঞানী তাঁর ল্যাবরেটরিতে করে থাকেন। এই পরিকল্পনাকে অনেকে ‘সোশ্যাল ইনজিনিয়ারিং’ বলেছেন। সংক্ষেপে বলতে চাই মার্কসবাদের মাধ্যমেও বাংলার সমাজতত্ত্ব চিন্তায় সাধারণভাবে পজিটিভতত্ত্বের প্রভাব পড়েছে। যদিও আমাদের আলোচ্য দু-জনই মার্কসবাদকে আপ্তবচন বা অভ্রান্তবাক্য হিসেবে গ্রহণ করেননি; নিজেদের চিন্তা-ভাবনায় মার্কসবাদের প্রয়োগ করেছেন অনেক সৃষ্টিশীল প্রক্রিয়ায়। মার্কসবাদী লেখা সম্পর্কে মিশেল ফুকো এক বিভাজনের কথা বলেন, বিভাজনটি হল পোলেমিকস (polemics) এবং প্রবলেমেটাইজেশন (problematization)-এই দুইয়ের মধ্যে। পোলেমিকস এক মতবাদের কাঠামোর মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রাখে, এই কাঠামোকেই যথেষ্ট মনে করে। যে এই কাঠামো মানতে অস্বীকার করে, তাকে শত্রু মনে করে, তার মতামতকে খণ্ডন করতে চায়; তাকে এক সমস্যার সমাধানের অংশীদার বলে মনে করেন না। ধর্মীয় সংগঠন যেমন বিধর্মীদের চিহ্নিত করে, সেইরকমই পোলেমিকস সহযোগীদের স্থির করে, অনুগামী ও প্রতিরোধবাহিনীকে প্রস্তুত করে, অন্যকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ততক্ষণ যুদ্ধ চালায় যতক্ষণ শত্রু না পরাজিত হচ্ছে। ফুকো প্রশ্ন করেছেন, কেউ কখনো দেখেছে পোলেমিকস থেকে নতুন আইডিয়ার জন্ম নিতে? প্রবলেমেটাইজেশন অনেক সময়ই মতবাদের কাঠামোকে অস্বীকার করে না, কিন্তু শুরু করে সেইসব প্রশ্ন থেকে যার উৎপত্তি কাঠামো থেকে নয়, বরং সমাজের ‘জীবন্ত অভিজ্ঞতা’ থেকে। একভাবে দেখতে গেলে ধূর্জটিপ্রসাদ ও বিনয় ঘোষ দু-জনেই এই সমস্যাকরণের উপর দিয়েছেন, মার্কসবাদের সমস্যার কথা বলেছেন, অনেক সময় তার সমাধানের কথাও বলেছেন। তাঁরা পোলেমিকস এড়িয়ে চলেছেন। এই প্রসঙ্গে বিনয়কুমার সরকারের Positive Background of Hindu Sociology (১৯১৪) বইটির কথা ভুললে চলবে না।

সবশেষে বলি, এই বইটি বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব-চর্চা নিয়ে, বাঙালি অথবা বাংলার সমাজবিদদের নিয়ে নয়। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি যে, আমার আলোচনার বিষয়বস্তু বাংলায় লেখা সমাজবিদ্যা বিষয়ক রচনাগুলি। বাংলার অনেকেই সমাজবিদ্যা চর্চা করেছেন, ইংরেজিতে মূল্যবান বইও লিখেছেন, কিন্তু তাঁদের লেখা আমি এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করিনি। প্রধান কারণ, বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব লেখা হয়েছে সাধারণ পাঠকের জন্য, প্রকাশিত হয়েছে সেইসব পত্রপত্রিকায় যা সাধারণ মানুষ পড়তেন। যাঁরা বই লিখেছেন-যেমন বিনয়কুমার, ধূর্জটিপ্রসাদ, নির্মলকুমার বা বিনয় ঘোষ-তাঁরাও বিশেষজ্ঞদের কথা ভেবে বই লেখেননি। যে সমাজতত্ত্ব বা নৃতত্ত্ব সাধারণের জন্য, তার রূপ, গঠন, বিষয়, বিন্যাস পৃথক হতে বাধ্য। এখানে জটিল তত্ত্বকেও সাধারণের উপযোগী করে বলতে হয়, তার জন্য প্রয়োজন হয় নানাবিধ বোঝাপড়ার। অন্যদিকে, লেখকও যখন এই ধরনের লেখা লেখেন তিনি নিজেকে অনেক সহজভাবে প্রকাশ করেন, কারণ এই ক্ষেত্রে বিষয়ের পেশাদারি নিয়মকানুন মানতে হয় না। এর ফলে সৃষ্টি হয় যে সমাজচর্চা, তার আকৃতি, সীমা, প্রসঙ্গ ও রূপ কিন্তু আলাদা। এই প্রবন্ধগুলিতে সেই পৃথকত্বকেই ধরতে চেয়েছি।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

 ১. এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : প্রদীপ বসু (সম্পা.), সাময়িকী : পুরনো সাময়িকপত্রের প্রবন্ধ সংকলন, প্রথম খণ্ড : বিজ্ঞান ও সমাজ (কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৮)।

 ২. সিদ্ধার্থ ঘোষ, ‘বিজ্ঞান-পথিক রাজেন্দ্রলাল মিত্র’, এক্ষণ, ৩১ (৩–৪), শারদীয় ১৩৯৮।

 ৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ৯ম খণ্ড (কলকাতা : বিশ্বভারতী, ১৩৯৬), পৃ. ৪৫২।

 ৪. এইসব প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হয়েছে : প্রদীপ বসু, সাময়িকী, প্রথম খণ্ডের সংকলনে। অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু নৃতাত্ত্বিক রচনাও এই সংকলনে আছে।

 ৫. Talal Asad (ed.), Anthropology and the Colonial Encounter (London : Ithaca, 1973); Richard Fardon (ed.), Localizing Strategies : Regional Traditions of Ethnographic Writing (Edinburgh : Scottish Academic Press, 1990).

 ৬. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘কোল জাতির সংস্কৃতি’, বিশ্বভারতী পত্রিকা, ৫(২), কার্ত্তিক-পৌষ ১৩৫৩, পৃ. ৯৯।

 ৭. যোগেশচন্দ্র বাগল, শরৎচন্দ্র রায় (কলিকাতা : বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১৩৭০), পৃ. ৬০।

 ৮. নির্মলকুমার বসু, ‘জুয়াঙ্গ জাতি’, প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৪০, পৃ. ৮০৪।

 ৯. ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আমরা ও তাঁহারা, ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী, ২য় খণ্ড (কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮৭), পৃ. ৮।

 ১০. ওই, পৃ. ৭।

 ১১. ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মনে এলো, ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী, ৩য় খণ্ড (কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮৭), পৃ. ৪১–৪২।

 ১২. ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ঝিলিমিলি, ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৯৭–৯৮।

 ১৩. ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আমরা ও তাঁহারা, ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী, ২য় খণ্ড, (কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮৭), পৃ. ৫।

 ১৪. ওই, পৃ. ৫–৬।

 ১৫. Geraldine Forbes, Positivism in Bengal (Calcutta : Minerva Associates, 1975), পৃ. ১২৫–৪৫।

 ১৬. সোমপ্রকাশ, ৫ অগ্রহায়ণ ১৮৭৩ শকাব্দ (নভেম্বর ১৮৬৬); Bela Duttagupta, Sociology in India (Calcutta : Centre for Sociological Research, 1972), পৃ. ১২৪।

 ১৭. রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ‘কোমৎ দর্শন’, বঙ্গদর্শন, ১(৪), শ্রাবণ ১২৭৯।

 ১৮. রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ‘সমাজ বিজ্ঞান’, বঙ্গদর্শন, ৩(১১), ফাল্গুন ১২৮১।

 ১৯. রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ‘সমাজ বিজ্ঞান’, বঙ্গদর্শন, ৩য় খণ্ড (কলকাতা : রিফ্লেক্ট পাবলিকেশন, ১৯৮০, পুনর্মুদ্রণ), পৃ. ৪০৫।

 ২০. ওই, পৃ. ৪১০।

 ২১. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রজনী, বঙ্কিম রচনাবলী, ১ম খণ্ড (কলকাতা : সাহিত্য সংসদ, ১৯৩৫), পৃ. ৪৬৩।

 ২২. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ধর্ম্মতত্ত্ব, বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, (কলকাতা : সাহিত্য সংসদ, ১৯৩৫), পৃ. ৬৭৬।

 ২৩. John Stuart Mill, August Comte and Positivism (Cambridge : Cambridge University Press, [1865] 2016). মিলের পজিটিভিজমের সমালোচনা প্রথমে Westminister Review পত্রিকায় ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত হয়, পরে এই বইয়ে সংকলিত হয়।

 ২৪. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘জন স্টুয়ার্ট মিল’, বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৮১–৮২।

 ২৫. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘মিল, ডার্বিন এবং হিন্দুধর্ম্ম’, বঙ্গদর্শন, ৪(১), বৈশাখ ১২৮২ (১৮৭৫), পৃ. ২৯–৪১।

 ২৬. ওই, পৃ. ২৯, ৪১।

 ২৭. Geraldine Forbes, Positivism in Bengal, পৃ. ১৩৫।

 ২৮. বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ (কলকাতা : পুস্তক বিপণি [১৩২০] ১৯৮৯), পৃ. ২৬৭।

 ২৯.  ভূদেব মুখোপাধ্যায়, সামাজিক প্রবন্ধ, প্রবন্ধ সমগ্র (কলকাতা : চর্চাপদ, ২০১০), পৃ. ২১৬।

অধ্যায় ১ / ১০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন