ঐতিহ্য ও প্রাতিস্বিকতার সমাজতত্ত্ব : ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

প্রদীপ বসু

ঐতিহ্য ও প্রাতিস্বিকতার সমাজতত্ত্ব : ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়

১. পূর্বভাষ

কিছুটা ঠাট্টা করেই নিজের সম্বন্ধে বলতেন, ‘যখন সমাজতাত্ত্বিকরা ধোঁয়া ছড়ায় তখন আমি ইকনমিস্ট-কারণ ইকনমিকসে যতটা বুদ্ধির শাসন ততটা এক জুরিসপ্রুডেন্স ছাড়া অন্য কোনো সমাজবিজ্ঞানে নেই। আবার যখন ইকনমিস্টরা অঙ্কের ধোঁয়া ছাড়েন, তখন তাঁদের সামাজিক রিয়ালিটির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।’ আসলে শুধু অর্থনীতি বা সমাজবিদ্যা নয়, তাঁর বিচরণ ছিল আরও এক বিস্তৃত ক্ষেত্র জুড়ে, যেখানে আছে ইতিহাস, সাহিত্য, শিল্প, দর্শন এবং সংগীত। নিজেকে একজন জিজ্ঞাসু ছাত্র হিসেবেই ভেবেছেন সারাজীবন, নানাবিধ জ্ঞানকে নিজের মতো করে সমন্বয় করতে চেয়েছেন, কখনো সফল হয়েছেন, কখনো হননি। কিন্তু বিশেষজ্ঞ হতে চাননি। এই কথাই বলতে গিয়ে লিখেছেন : ‘এক বন্ধুর মুখে শুনেছি যে, প্রথম যুদ্ধের সময় রামবাগানে একটা গানের খুব চলন হয় : ‘শসা-কলা নয়তো যাদু যে চিরে-চিরে ভাগ দেব।’ জ্ঞানের ভাগকরণ বুদ্ধির বেশ্যাবৃত্তি এবং তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা রক্ষিতার সামিল।’ অথচ নিজের লেখার সম্বন্ধে এক নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, লিখেছেন ‘বাঙ্গলা প্রবন্ধ, গল্প, নভেলের মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগ লিখেছি পরের তাগিদে। টাকার জন্য যা সব লিখেছি তার মধ্যে অধিকাংশই বাজে . . . আমার নিজের বিশ্বাস এই যে যখনই আমি চটে লিখেছি তখনই আমার লেখা সুখপাঠ্য হয়েছে। . . . মোটামুটি দাঁড়ায় এই : লিখি দম্ভের জন্য, আত্মসম্মানের জন্য, রাগ প্রকাশের জন্য প্রধানত।’ প্রমথ চৌধুরীর দীক্ষায় একদিন বের্গসঁ-তে মজেছিলেন, বের্গসঁ থেকে রাসেল, রাসেল থেকে ক্রোচে, তারপর মার্কস। নিজেকে মার্কসবাদী বলতেন না, বলতেন মার্কসোলজিস্ট। নিজের লেখা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তাঁর শেষ বই ঝিলিমিলি-তে লিখেছেন : ‘এইটা নিয়ে উনিশখানা বই লিখলাম। আরো দু-একটা লেখা চলত, যদি স্বাস্থ্যে কুলোত। কী লিখেছি তাই জানি না। তবে বোধ হয় একটা মোটা ধারা আছে। তাকে Personality বলা চলে-নভেলে তাই, সমাজতত্ত্বে তাই, অর্থনীতিতে তাই, ইতিহাসেও তাই, সঙ্গীতেও তাই। এরই আশেপাশে কার্ল মার্কস। আমার জীবনে মার্কসিজম-এর প্রভাব বেশি। সমাজতত্ত্বে ইতিহাসে মার্কসিজম চলে, তাই এখনও লিখি। আমার নভেলেও তাই আছে। নিজেকে Marxologist বলা চলে। ভারতবর্ষে সে বস্তু বিরল, তাই আমিও বিরল।’

মার্কসবাদে সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারেননি কারণ তাঁর মনে হয়েছে মার্কসবাদের ভাব ও কার্যগত উপকারিতা থাকলেও থিয়োরির দিক থেকে তার কোনো মূল্য নেই। মার্কসবাদের অন্তর্গত বনেদ ও উপরিকাঠামো সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন : ‘যুক্তিটা এই প্রকার : সামাজিক অবস্থা ও ধারণা থেকেই কল্পনার জগৎ উঠেছে। অতএব কল্পনার জগৎ থেকেই বাস্তব সামাজিক জগতের পুরো ছবি পাওয়া যাবে। বাস্তব ও কাল্পনিক জগতের প্রকৃত সম্বন্ধ কিন্তু এই যুক্তিতে ধরা পড়ল না। জ্ঞান-বিজ্ঞানে মার্কসীয় সমাজ-দর্শনের বিপদ এইখানে। ম্যানহাইম, স্কেলার প্রভৃতি পণ্ডিতেরা সামলাতে গিয়েছেন, পারেননি।’ তিনি মার্কসবাদকে ‘ডগমা’ হিসেবে ভাবেননি, বরং ভারতীয় ঐতিহ্যে, ইতিহাসে, পরিবেশ মার্কসবাদের প্রয়োগ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চেয়েছেন, মার্কসের দর্শনের সৃষ্টিমূলক ব্যবহার চেয়েছেন। তিনি ক্রোচের ধারণা সব ইতিহাসই সমসাময়িক ইতিহাস, মার্কসের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেন। অতিপ্রাকৃতের সাহায্যে ইতিহাসের ব্যাখ্যার সমালোচনা করে তিনি বলেন : ‘এই প্রকার অতিপ্রাকৃতের হস্তে ইতিহাসের রীতি-উদঘাটনের ভার ন্যস্ত করলে . . . ব্রাহ্মণ প্রফেসর হয়ে ওঠেন ব্রহ্মজ্ঞানী, এবং দর্শন হয়ে ওঠে সোহংবাদ। পূর্বোক্ত মন্তব্যের এ অর্থ নয় যে আমাদের কোনো ইতিহাস ছিল না। বক্তব্য এই, আমাদের যে ইতিহাস ছিল, মাত্র এখনই তা আমরা বুঝতে পারি। এই অর্থেই সব ইতিহাস সমসাময়িক ইতিহাস। বক্তব্য এই যে অতিপ্রাকৃতের সাহায্যে ইতিহাসের অর্থ পাওয়া যাবে না।’ তিনি মনে করতেন ভারতের ইতিহাসবিদরা দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মৌলিক শক্তিগুলিকে যথাযথভাবে পরীক্ষা করে দেখেননি এবং তার বৈশিষ্ট্য বা স্বকীয়তাকে ব্যাখ্যার কোনো চেষ্টা করেননি। এই কারণেই তিনি ঐতিহ্যের সমাজতত্ত্বের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যেহেতু তিনি মনে করতেন ইতিহাস রচনার উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ ইতিহাস গঠনের প্রক্রিয়ায় যোগদান করা, তাই প্রয়োজন ভারতীয় ইতিহাসের মৌলিক শক্তিগুলি পরীক্ষা করা। ভারতের ইতিহাসবিদরা দু-টি কারণে এই কাজ করতে পারেননি : তাঁরা ইতিহাসকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বুঝতে চাননি এবং তাঁরা ইতিহাসের এক সঠিক দর্শন বেছে নিতে পারেননি।

ধূর্জটিপ্রসাদের রচনার প্রেক্ষাপট হিসেবে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন। নিজের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণিসংস্থিতি সম্পর্কে তিনি সচেতন। তিনি তাই লিখছেন : ‘কার্ল মার্কসের প্রত্যেক বাক্য বেদবাক্য না মেনেও সত্যের খাতিরে মানতে হয় যে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে বর্তমান সমাজের মেরুদণ্ড বা উত্তমাঙ্গের সঙ্গে তুলনা করা যায় না।’ ভারতের সমাজ, তাঁর মতে, প্রতিষ্ঠিত ছিল জাতিগত বৃত্তি ও সামাজিক ধর্মের আধারে। সেই সমাজ যে ভিন্ন শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে তার অন্যতম প্রধান কারণ ইংরেজি সভ্যতা ও শিক্ষা। সেইজন্য বর্তমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের বিভাগই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায়। তাঁর মতে, উচ্চশিক্ষিত সম্প্রদায় অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ-উপাধিধারীরা নতুন সমাজের ব্রাহ্মণ হয়েছেন। কিন্তু উনিশ শতকে যদি বা এদের এক ইতিবাচক ভূমিকা ছিল, অবক্ষয়িত এই শ্রেণির পক্ষে নতুন কোনো দিশা দেখানো মুশকিল বলেই তিনি মনে করেন। তাই তিনি লিখেছেন : ‘আমরা ও তাহারা’ উভয়েই তথাকথিত মধ্য শ্রেণির জীব, সেইজন্য গোড়ায় তাঁদের মিল আছে। পার্থক্য এইটুকু; আমরা অর্থাৎ সমাজ-সচেতন ব্যক্তিরা জানেন যে এ শ্রেণির দম, জান এবং শাঁস ফুরিয়েছে আর তাঁহারা বুদ্ধিমান ভদ্রজন হলেও ঠিক সচেতন নন।’ এই দুই শ্রেণির দোষগুণ, সংস্কার, বিশ্বাস এই সবকিছুর প্রতি তিনি শ্লেষবিদ্রূপের মাধ্যমে ইঙ্গিত করতে চান। প্রশ্ন হল, ধূর্জটিপ্রসাদও তো নিজে এই শ্রেণির অন্তর্গত, তাহলে ‘আমরা’ বলে যিনি উক্তি করছেন, তাঁর অবস্থান ঠিক কোথায়? তিনি কি এই ‘ক্ষয়রোগ’-এ আক্রান্ত নন? আমার মনে হয় ধূর্জটিপ্রসাদ এখানে যেন নিজের অবস্থানের গণ্ডির ‘বাইরে’ থেকে নিজেরই আত্মসমালোচনা করেছেন। ‘তাঁহাদের’ সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে একটা পথ খোঁজার প্রয়াস করছেন। আর সেই জন্যই ডায়ালগ। এই কারণেই বোধহয় তাঁর বাংলা লেখাগুলির মধ্যে বিশেষ করে এক ধরনের খোলামেলা ভাব আছে, তিনি যেন তাঁর প্রস্তাব, মন্তব্য, অনুমান, তত্ত্ব হালকাভাবে ভাসিয়ে দেন, জানতে চান পাঠক, প্রতিপক্ষ তোমার মতটা কী সেটাও একবার শুনি। নিজে একটু অন্যভাবে বলেছেনও সেটা : ‘সব চিন্তাই তো ডায়লগ, হয় ‘আমি’-‘তুমি’র না হয় ego-super-ego মধ্যে। সমগ্র ইতিহাস না হোক, তার বিপ্লবী অংশটুকু অন্তত এই নিজের সঙ্গে নিজের, নিজের সঙ্গে পরের বাক্যালাপ, তর্ক-বিতর্ক, অর্থাৎ কথোপকথন।’

২. ঐতিহ্যের সমাজতত্ত্ব

মনে এলো বইয়ে এক জায়গায় লিখেছেন : ‘ক্রমেই আমি ঐতিহ্যে বিশ্বাসী হয়ে পড়ছি, প্রাণের দায়ে। আমাদের ‘ভ্যালুজ’ বা মানগুলো মরেও মরছে না-এটা মস্ত কথা। ঐতিহ্যে দিক-নির্ণয় নেই, কিন্তু প্রয়াসের সমর্থন আছে।’১০ ভারতের সমাজবাস্তবকে বোঝবার জন্য ঐতিহ্যের অনুশীলন প্রয়োজন বলে তিনি মনে করতেন। এই কারণে অনেকের কাছে তিনি ‘ঐতিহ্যের সমাজতাত্ত্বিক’ হিসেবে পরিচিত। তাঁর মৃত্যুর প্রায় সাত বছর আগে, ১৯৫৫ সালের এপ্রিলে, প্রথম নিখিল ভারত সমাজতাত্ত্বিক সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে তিনি ভারতীয় ঐতিহ্য ও সামাজিক পরিবর্তনের উপর ভাষণ দেন।১১ তিনি বলেন, আমাদের দেশের প্রগতিশীলরা বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন, ফলে রাজনীতি ও অর্থনীতিতেও ব্যর্থ হয়েছেন মূলত ভারতের সমাজবাস্তব সম্বদ্ধে তাঁদের অজ্ঞতা ও শিকড়হীনতার কারণে।১২ তিনি বলেছেন, দেশে পরিকল্পনার ক্ষেত্রে আমরা যে যথেষ্ট করতে পারিনি তার কারণ হল ঐতিহ্য, যা ধৃতি অর্থাৎ ধর্মের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, যা ধারণ করে, প্রতিপালন করে এবং চলতে থাকে, সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুন ঐতিহ্য, যা মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমশ গড়ে তুলছে, তার বিরোধের মীমাংসা হয়নি, এই দুই ঐতিহ্যের বিরোধ এখনও অসমাধিত। ধূর্জটিপ্রসাদ দুই ধরনের ঐতিহ্যের কথা বলে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সম্পর্কের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের এই দ্বিপ্রান্তিক বিভাজন আজকে হয়তো অচল হয়ে গেছে, কিন্তু আধুনিকতা বলতে ঠিক কী বুঝব, এই প্রশ্ন অচল হয়নি। এবং ধূর্জটিপ্রসাদ এক্ষেত্রে হয়তো আমাদের গাইড হতে পারেন, কারণ এই প্রশ্নের মধ্যে যে বিপত্তি আছে, তার সম্পর্কে তিনিই আমাদের সচেতন করেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে এবং তাঁর বাংলা লেখা আলোচনার আগে তাই আমাদের প্রথমে তাঁর প্রথম দিকের কিছু ইংরেজি বইয়ের কথা বলতে হবে।

ধূর্জটিপ্রসাদ তাঁর প্রথম দুটি বই, Personality and the Social Sciences (১৯২৪) এবং Basic Concepts in Sociology (১৯৩২) সম্পর্কে বলতেন এগুলি তাঁর ‘ব্যক্তিগত নথি’-সমাজবিজ্ঞানের প্রত্যয় গড়ে তোলার এক উদ্যোগ।১৩ প্রথম থেকেই তাঁর চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রে ছিল পার্সোনালিটির ধারণা। আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবার আগে পার্সোনালিটি কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে দেখা যায় ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিপরিচয়, ব্যক্তিস্বরূপ, ব্যক্তিসত্তা প্রভৃতি। কিন্তু ধূর্জটিপ্রসাদ পার্সোনালিটি কথাটির সঙ্গে ‘ব্যক্তি’র কোনো যোগ চাইতেন না। আমরা দেখব তাঁর পার্সোনালিটির তত্ত্ব ব্যক্তিকে বিরোধ করেই সৃষ্টি হয়েছে। এইজন্য তিনি পার্সন-এর বাংলা হিসেবে ‘পুরুষ’ কথাটি ব্যবহার করেছেন, আমরাও এই রচনায় তাই করব। পার্সনের বাংলা হিসেবে ‘পুরুষ’ কথাটি ঠিকই আছে, আমরা ব্যাকরণে যেমন ‘থার্ড-পার্সন’-এর জন্য ‘তৃতীয়-পুরুষ’ কথাটি ব্যবহার করি। যে বক্তৃতার উল্লেখ করে এই উপ-অধ্যায় শুরু করেছি সেখানে ধূর্জটিপ্রসাদ বলেছেন, আমাদের দেশে মানুষের ধারণা হল পুরুষের ধারণা, ইনডিভিডুয়াল বা ব্যক্তির ধারণা নয়। প্রশ্ন করেছেন, কতবার আমাদের শাস্ত্রে অথবা সাধুসন্তদের উক্তিতে ‘ব্যক্তি’ কথাটি পাওয়া যাবে।১৪ যেহেতু পার্সোনালিটি কথাটি পার্সন কথা থেকে উদ্ভূত, তাই ধূর্জটিপ্রসাদ এই কথাটির মধ্যেও ব্যক্তির অনুপ্রবেশ দেখতে চান না, কিন্তু তাঁর বাংলা রচনায় এর কোনো উপযুক্ত প্রতিশব্দ ব্যবহার করেননি, বরং ইংরেজি শব্দটির ব্যবহার করেছেন। আমি এই রচনায় পার্সোনালিটি কথাটির বাংলা প্রতিশব্দ, ব্যক্তি বাদ দিয়ে, ‘প্রাতিস্বিকতা’ করেছি। এতে বোধহয় ধূর্জটিপ্রসাদের আপত্তি হবে না।

একদম গোড়া থেকেই ধূর্জটিপ্রসাদের ধ্যানধারণার কেন্দ্রে ছিল পার্সোনালিটি বা প্রাতিস্বিকতার বিষয়টি। তিনি মনে করতেন সমাজতত্ত্বের কাজ বিমূর্ত ব্যক্তিকে নিয়ে নয়, এবং প্রাতিস্বিকতা বোঝার জন্য প্রয়োজন এক মনস্তাত্ত্বিক-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির। ব্যক্তিত্বের প্রক্রিয়া ও তার সামাজিকীকরণ এই দুইয়ের সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রাতিস্বিকতা গড়ে ওঠে, যা মানবজীবনের এক অনন্য ঐক্য বা ধূর্জটিপ্রসাদের ভাষায় অনবদ্য ঐক্য।১৫ তাঁর সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন যে, তিনি সমাজতত্ত্বে এসেছেন অর্থনীতি ও ইতিহাস থেকে, কারণ তিনি তাঁর প্রাতিস্বিকতার বিকাশ চেয়েছিলেন জ্ঞানের মাধ্যমে। আগেই বলেছি, তিনি জ্ঞানের বিভাজন চাইতেন না, তিনি মনে করতেন বিভিন্ন ধরনের জ্ঞানের সমন্বয়ের মাধ্যমে এক বহুমুখী অথচ পূর্ণ প্রাতিস্বিকতা সৃষ্টি হয়। তাঁর ইন্টেলেকচ্যুয়াল জীবনের প্রথম থেকেই তাই তিনি জ্ঞান ও জ্ঞাতার এক বিশেষ ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। জ্ঞান, তাঁর মতে, শুধু তথ্যমূলক নয়, তার এক দার্শনিক দিকও আছে। অর্থনীতির শিকড় থাকতে হবে সমাজবাস্তবে, অর্থাৎ তাকে সমাজতাত্ত্বিক হতে হবে, অর্থাৎ তাকে ঐতিহাসিক হতে হবে; ইতিহাসকে অকিঞ্চিৎকর ঘটনার উপরে উঠে দার্শনিক হতে হবে। এই উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে যে জ্ঞাতা তাকে এক সাহসী অভিযাত্রী হতে হবে, সংকীর্ণ বিশেষজ্ঞ নয়। যে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির তিনি অনুশীলন চেয়েছিলেন তা ছিল যুক্তিবাদী, ব্যাবহারিক ও সম্ভাবনার যুক্তির। যুক্তিকে এখানে বুঝতে হবে এক সাধন হিসেবে, বাস্তবকে বোঝার জন্য শুধু নয়, প্রাতিস্বিকতার বিকাশের জন্যও।

গত শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকে ধূর্জটিপ্রসাদ ভারতের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যে চিন্তাভাবনা করেছিলেন, তাতে তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন যে, এঁদের ধ্যানধারণার আমদানি হয়েছে পশ্চিমের উদারনৈতিক চিন্তাভাবনার থেকে এবং এই চিন্তাভাবনার কয়েকটি মূল বিষয় ছিল ‘সাম্য’ ও ‘প্রগতি’। তিনি তাঁর বিশ্লেষণে এর সঙ্গে যুক্ত করেন ‘সামাজিক শক্তি’ ও ‘সামাজিক নিয়ন্ত্রণ’ সম্পর্কিত ধারণাগুলিও। তাঁর Basic Concepts in Sociology (১৯৩২) বইতে তিনি ‘প্রগতি’-র সঙ্গে ‘প্রাতিস্বিকতা’-র সম্পর্ক নিয়ে কিছু প্রাথমিক উক্তি করেন, যা পরে তাঁর আধুনিকতা সম্পর্কিত চিন্তাভাবনায় আরও পরিণত রূপ নেয়। তিনি ‘প্রগতি’-র বিবর্তনবাদী ধারণাকে বাতিল করে বলেন প্রগতি কোনো স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়। তিনি বরং জোর দেন মানবজীবনের ‘উদ্দেশ্য’-এর প্রতি। প্রগতি তাই সমগ্র মানবজীবনকে নিয়ে এবং এর জন্য প্রয়োজন শুধু আর্থিক উন্নতি নয়, বিভিন্ন মূল্যবোধের সামঞ্জস্য। যখন আমরা মূল্যবোধের কথা বলি তখন তার মধ্যে একটা স্তরবিন্যাস চলে আসে, আমরা পরম বা মৌলিক মূল্যবোধের খোঁজ করি। ধূর্জটিপ্রসাদ উপনিষদ থেকে এই পুরুষার্থের উল্লেখ করেন-শান্তম, শিবম, অদ্বৈতম। প্রথমটি হল পরিবর্তনের মধ্যে সামঞ্জস্যের নীতি, দ্বিতীয়টি হল সমন্বয়সাধনের নীতি এবং তৃতীয়টি হল একীকরণের নীতি।১৬ প্রশ্ন হল পশ্চিমের প্রগতির ধারণার মধ্যে আমাদের উপনিষদের শ্রেয়োনীতির অনুপ্রবেশ কতটা যুক্তিযুক্ত? তিনি একে ‘সিনথিসিস’ বা সমন্বয় বলেছেন। তাহলে অবশ্য এই ‘সমন্বয়’-এর প্রক্রিয়া ও বৈধতাকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পরীক্ষা করতে হয়। ধূর্জটিপ্রসাদ এর বৈধতা যেন ধরেই নিয়েছেন। আরও সমস্যা হল, এই নীতিগুলি এত অস্পষ্ট, অনির্দিষ্ট ও স্বল্পজনবোধ্য যে তাঁর ডিসকোর্সে এদের ভূমিকা বোঝা মুশকিল। তা ছাড়া তিনি এটাও দেখান না যে, পশ্চিমের শিল্পসভ্যতার মূল্যবোধের সঙ্গে এই নীতিগুলির সংযুক্তি ঘটবে কেমন করে। অন্যদিকে আমরা বলতে পারি এই শ্রেয়োনীতিগুলিকে পরম মূল্য দিয়ে ধূর্জটিপ্রসাদ বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে মানবজীবনের পরিত্রাতা হিসেবে মানতে চাননি, সমাজবিজ্ঞানেরও না।

স্বাধীনতার বছরে ধূর্জটিপ্রসাদ তাঁর ১৯৪২ সালে লেখা বই Modern Indian Culture : A Sociological Study পরিমার্জিত সংস্করণ সম্পূর্ণ করেন।১৭ আসন্ন দেশভাগের ছায়ায় লেখা বইটিতে লেখকের মুড যন্ত্রণা ও উদবেগের। সমস্যা লেখক যেভাবে দেখেছেন তা হল, সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এবং এই ব্যাখ্যা আরও একটু ভালো ভবিষ্যতের জন্য কীভাবে কাজে লাগানো যায়। তিনি বলছেন, সমাজতত্ত্বকে ইতিহাসের সহায়ক হতে হবে এবং এটা কোনো তুচ্ছ ভূমিকা নয়। তাঁর বিশ্লেষণ তাঁকে বলে যে, ভারতীয় ইতিহাসের সুদীর্ঘ ধারায় এক বিকৃতি ঘটেছে এবং তাকে পঙ্গু করে দিয়েছে। তিনি এই দোষ চাপান ইংরেজ শাসনে। তিনি মনে করতেন, ভারতীয় সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন ধর্মের সমন্বয় ও বিরোধের প্রক্রিয়ার মধ্যে। এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সমন্বয় ছিল প্রধান সাংগঠনিক নীতি। উপনিষদ থেকে তাঁর প্রিয় উদ্ধৃতি ছিল চরৈবতি, এগিয়ে চলো। তিনি মনে করতেন ইংরেজ আমলে ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমূল বদলে যায়, নতুন স্বার্থের উন্মেষ হয় এবং প্রতিষ্ঠিত মধ্যমবর্গের বদলে এক মেকি মধ্যবিত্তশ্রেণির জন্ম হয়। এই মধ্যবিত্তশ্রেণি ইংরেজ শাসনকে সংগঠিত করতে সাহায্য করে, এবং পরবর্তী সময়ে তাদের চ্যালেঞ্জও জানায়। এই মধ্যবিত্তশ্রেণিই তাঁর মতে দেশভাগের জন্য দায়ী। এই মধ্যবিত্তশ্রেণির শিকড়হীনতাই তাদের মেকি তৈরি করেছে, ফলে তাদের ক্রিয়াকর্ম, তা সে শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি যেখানেই হোক, এক ধরনের সারশূন্যতাই সৃষ্টি করে এসেছে। এই ‘এলিট’-দের পক্ষে স্বাধীন ভারতের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি বললেন, স্বাধীন ভারত পুনর্গঠনের প্রয়োজন। এদের সচেতনভাবে ভারতের ঐতিহ্যের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে, কারণ সংস্কৃতি শূন্য থেকে সৃষ্টি হয় না।১৮ ভারতবর্ষে ‘শ্রেণি’ ‘জাতি’কে স্থানচ্যুত করেনি, তারা দু-টি আলাদা কম্পার্টমেন্টেও অবস্থান করে না। তাদের সংযুক্তি হয়, কিন্তু তারা একীভূত হয় না। ধূর্জটিপ্রসাদ যে ভারতবর্ষের কথা বলেছেন সেখানেও বিভিন্ন উপাদান, তাদের আঞ্চলিক সংস্কৃতিসহ একসঙ্গে থাকবে, কিন্তু কোনো একত্ব উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হবে না। তিনি জাতীয় পরিকাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন আনুগত্য ও স্বার্থের সহাবস্থানের কথা বলেছিলেন, কোনো জাতীয় একীকরণের কথা নয়। ধূর্জটিপ্রসাদের এই চিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক। তাই তিনি ঐতিহ্যে যে নতুন করে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার কথা বলেছিলেন, সেটা ছিল, তাঁর মতে, এগিয়ে যাবার প্রাথমিক শর্ত। ফ্রাঙ্কলিন গিডিঙ্গসের ঐতিহ্যের শ্রেণিকরণ প্রয়োগ করে তিনি ঐতিহ্যকে তিনভাগে ভাগ করেন : প্রাথমিক, দ্বিতীয়বর্গীয় ও তৃতীয়বর্গীয়; তিনি বলেন ইংরেজরা ভারতে যখন আসে তখনও হিন্দু ও মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রতিটি স্তরের ঐতিহ্যের পূর্ণ সমন্বয় ঘটেনি। ব্যবহারযোগ্য সম্পদ কীভাবে কাজে লাগাবে এই নিয়ে তারা আপসে একটা সহমতে ছিল, কিন্তু নান্দনিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সেই ঐকমত্য ছিল না। তৃতীয়বর্গের ঐতিহ্যে অর্থাৎ প্রত্যয়ভিত্তিক চিন্তার ক্ষেত্রে পার্থক্য খুব স্পষ্টরূপ বজায় ছিল। এই অবস্থায় ইংরেজ অন্ধের মতো ভারতের সমাজব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে ইতিহাসকে প্রচণ্ড ধাক্কা দেয়। তারা দেশীয় বণিক পুঁজিকে বিনষ্ট করে, গ্রাম্য অর্থনীতির হানি করে, জমিব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে সম্পত্তি ও লাভের এক বিদেশি ধারণার সাহায্যে এবং এক সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করে, যার কোনো সামাজিক ভূমিকা ছিল না। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার সম্ভব হয়নি, কারণ তা ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই ছিল না।

তিনি চেয়েছিলেন সমাজতত্ত্ব রূপান্তরের প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে সমাজকে পথ দেখাবে। এবং এটা সম্ভব যদি প্রথমে আমরা ঐতিহ্যের প্রতি মনোযোগ দিই, আর তারপর পরিবর্তনের প্রতি। তাই তিনি বলেছিলেন প্রথম কাজ হবে সামাজিক ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করা, যে ঐতিহ্যের মধ্যে আমাদের জন্ম এবং যেখানে আমাদের সত্তা নিহিত। এই কাজের অন্তর্ভুক্ত হল বাইরের ও অভ্যন্তরীণ চাপে এই ঐতিহ্যের পরিবর্তনের প্রকৃতি অধ্যয়ন করা। বহিঃস্থ চাপের একটা প্রধান উপাদান হল অর্থনৈতিক, আর অর্থনৈতিক শক্তি যদি প্রচণ্ড শক্তিশালী না হয়, ঐতিহ্য নানারকম বোঝাপড়ার মাধ্যমে বেঁচে থাকে। ঐতিহ্যের বোঝাপড়া করার ক্ষমতাই তার জীবনীশক্তির মাপদণ্ড, আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই এই জীবনীশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তাই তিনি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন এই ঐতিহ্যকে বোঝা, এমনকী তাদের পরিবর্তনের অধ্যয়নের বিষয়ে। অন্যকথায় তিনি বলছেন, ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিবর্তনের অর্থনৈতিক কারণ অনুসন্ধানের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার আগে ঐতিহ্যকে অনুধাবন করতে হবে।১৯ ধূর্জটিপ্রসাদ মনে করতেন, ভারতের ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস নয়, কারণ এরকম কোনো অভিজ্ঞতা ভারতের হয়নি। ধর্ম ও দর্শন এই ইতিহাসের প্রধান কথা এবং এই ইতিহাস হল এক লম্বা সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ধারা। তিনি বলতেন ‘ভারতীয় ইতিহাস হল ভারতীয় সংস্কৃতি।’২০ তাই নিজের সংস্কৃতি ছেড়ে অন্যের অনুকরণের মাধ্যমে কোনো সফলতা আসতে পারে না। দেশের বিকাশ সম্বন্ধে তাই তাঁর মত ছিল, প্রকৃত আধুনিকতা অনুকরণের মাধ্যমে আসতে পারে না। তিনি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্য সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি উদবিগ্ন ছিলেন। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার ডায়েলেকটিকসের সূত্র তিনি দিয়েছেন তাঁর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত গ্রন্থে।২১ তিনি বলেছেন রবীন্দ্রনাথের উপরও পশ্চিমের প্রভাব বেশ ভালোরকম ছিল কিন্তু তাকে অতিরঞ্জিত করা উচিত নয়। ঐতিহ্যের যে ধারা রামমোহন ও দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের প্রজন্মকে দিয়ে গিয়েছিলেন, এই প্রভাব সেই সজীব ঐতিহ্যের ধারার সঙ্গে বিজড়িত। যখনই রবীন্দ্রনাথ আরও গভীরে পৌঁছতে চেয়েছেন, বিস্তৃতি চেয়েছেন বা উপরে উঠবার প্রয়াস করেছেন তখনই তিনি এই ঐতিহ্যের সাহায্য নিয়েছেন। তাঁর গদ্য, কবিতা, নাটক, সংগীতের বিকাশের প্রত্যেকটি ধাপে এবং তাঁর প্রাতিস্বিকতার ক্ষেত্রেও তাই আমরা দেখি দেশের মাটি, প্রাণসত্তা ও মানুষদের কাছ থেকে রসদ সংগ্রহ করছেন।২২ এর থেকে বোঝা যায় আধুনিকতার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধূর্জটিপ্রসাদের মত ঠিক কী ছিল। তিনি ঐতিহ্য থেকে সম্পূর্ণ সরে আসা চাইতেন না, তাঁর কাছে ঐতিহ্য ছিল ধারাবাহিকতা, আধুনিকতার এক শর্ত, আধুনিকতার পথে বাধা নয়। আমরা ধূর্জটিপ্রসাদের ঐতিহ্যের ধারণার কিছু সমস্যা নিয়ে এবার আলোচনা করতে পারি।

আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ইতিহাসের মাধ্যমে ধারাবাহিকতা প্রদান করি। যা আসলে বিচ্ছিন্ন, ইতিহাসে তা ধারাবাহিক হয়ে ওঠে। এই ইতিহাসের নানাবিধ পদ্ধতি আছে। কখনও আমরা ঘটনাবলির বিচার করি কার্যকারণ সম্পর্কের মাধ্যমে, তখন আলাদা আলাদা ঘটনাগুলি এক সম্পর্কে বাঁধা পড়ে। কখনো আবার ঘটনাকে বিচার করি কোনো পরম কারণের পরিপ্রেক্ষিতে। কার্যকারণ, উদ্দেশ্যবাদ, পরম কারণ ইতিহাসকে এক ধারাবাহিকতা প্রদান করে। বস্তুত ঐতিহ্য হল ঠিক ঐ একরকম এক প্রত্যয় বা সাধন, যার সাহায্যে যা আসলে বিচ্ছিন্ন ইতিহাসে তা ধারাবাহিকতা পেয়ে যায়। ঐতিহ্য বিভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে এক বিশেষ কালিক শৃঙ্খলার মধ্যে বেঁধে ফেলে। আমরা একটু আগেই বলেছি, ধূর্জটিপ্রসাদ মনে করতেন ঐতিহ্য মানে ধারাবাহিকতা। বস্তুত ঐতিহ্য এমন এক নির্মাণ, যা ইতিহাসের অবিন্যস্ততা, বিক্ষিপ্ত অসম্বদ্ধতাকে এক অভিন্ন ধারণার মধ্যে দেখা সম্ভব করে। ঐতিহ্য পার্থক্যকে হ্রাস করে, মূলে যে পার্থক্য ছিল তার অবসান করে এবং আমাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে উৎস সন্ধানে সাহায্য করে। ঐতিহ্য আমাদের যা স্থায়ী তার থেকে যা নতুন তাকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। সমাজতত্ত্বের কাজ হল ঐতিহ্যের ধারণাকেই প্রশ্ন করা, ঐতিহ্যকে আমাদের এক মূল্যবান সম্পত্তি হিসেবে না ভেবে। বস্তুত ঐতিহ্যকে যদি আরও একটু গভীরভাবে বিচার করি, তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, অনেকক্ষেত্রেই ঐতিহ্য আবিষ্কৃত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক প্রয়োজনে ‘ঐতিহ্য’-কে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য সাধনের কর্মকৌশল আমরা সব দেশেই দেখতে পাই। এর জন্য ঐতিহ্য বলে যা প্রচারিত হয়, বা ঐতিহ্য বলে যা মানুষকে বিশ্বাস করানো হয়, তা এক অলীক ঐতিহ্য, যা নির্মিত হয়েছে কোনো এক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। তাই ধূর্জটিপ্রসাদ যখন ঐতিহ্যের কথা বলেন, তখন মনে রাখতে হবে, এই ঐতিহ্য তাঁর নিজেরই নির্মাণ, ঠিক যে-রকম জাতীয়তাবাদীরা ভারতের ঐতিহ্যের কথা বলতেন বা আজকের দিনে আমরা হিন্দু বা মুসলমান ঐতিহ্যের কথা শুনতে পাই।

৩. দূরত্বের সমাজতত্ত্ব

ধূর্জটিপ্রসাদের আমরা ও তাঁহারা প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। এই বইটি তিনি লিখেছিলেন ডায়ালগের মাধ্যমে, বলেছিলেন সব চিন্তাই তো এক ধরনের ডায়ালগ। এইভাবে লেখার আরও একটি ইতিবাচক দিক হল আলোচনার বিষয়গুলি নিয়ে কোনো উপসংহারে না এসে বরং বিষয়গুলিকে খোলা রাখা, যেখানে পাঠকও তর্কবিতর্ক করার একটা স্পেস পেয়ে যান। বইটির বিষয় সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন : ‘বিষয়বস্তু এবং বক্তব্য সম্বন্ধে কিছু না বলে পরাছি না। “আমরা ও তাঁহারা” যখন প্রথম আরম্ভ করি, তখন অর্থশাস্ত্র ও সমাজতত্ত্বে social distance প্রত্যয়টির আলোচনা সবে শুরু হয়েছে। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা তখনই বুঝতে পেরেছেন যে সমাজ ভেঙেছে এবং টুকরো টুকরো ছোটো-খাটো দল বা উপদল তৈরি হচ্ছে। কেন এমন হল, জানবার জন্য তাঁরা উৎসুক হলেন। এই সময় থেকেই মার্কসবাদের চলন হয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে। তাঁরা শ্রেণি-বিভাগের উপর সেই দ্বন্দ্ব ও ভাঙনের দায়িত্ব অর্পণ করলেন। আর যাঁরা মার্কসবাদ গ্রহণ করলেন না, অতটা সরলীকরণে যাঁদের আপত্তি ছিল, তাঁরাও সামাজিক দূরত্ব মানতে বাধ্য হলেন। এবং সেই দূরত্বের কারণ খুঁজতে গিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সমাজস্তরের আচার-ব্যবহার মনোভাব (folkways, mores) প্রভৃতির পার্থক্যে এসে পৌঁছলেন।’২৩ ধূর্জটিপ্রসাদ সামাজিক দূরত্ব সংক্রান্ত প্রশ্নের মোকাবিলার চেষ্টা করেছেন জ্ঞানের সমাজতত্ত্বের সাহায্যে, তিনি মূলত প্রভাবিত হয়েছেন কার্ল ম্যানহাইমের রচনার দ্বারা। তিনি মানুষের সামাজিক স্তর ও তার মনোভঙ্গির মধ্যে এক সম্পর্ক দেখছেন।

সামাজিক দূরত্বের আলোচনায় একটি প্রধান প্রশ্ন হল ভাষা নিয়ে। ভাষার ব্যবহার কি সামাজিক দূরত্বের কারণ? না কি একজন ধনী ও একজন গরিব তাদের অর্থনৈতিক দূরত্বের জন্য ভিন্ন রকমের ভাষা ব্যবহার করে, একজনের শিক্ষিত ভাষা, অন্যজনের অশিক্ষিত ভাষা। যেমন ধূর্জটিপ্রসাদ বলেছেন, ‘আপনারা আমাদের কথা বোঝেন না, আর আমরা আপনাদের কথা বুঝি না, অথচ প্রত্যেকেরই ধারণা যে কোনো দুর্বোধ্য ভাষা প্রয়োগ করা হয়নি।’২৪ শিক্ষিতজনের যে-ভাষা সে-ভাষা বহু সময়েই সমাজের নিম্নবর্গের চিন্তাভাবনা, কামনা-বাসনার প্রকাশ মাধ্যম হয়ে ওঠে। কারণ, নিম্নবর্গের কাছে উপযুক্ত ভাষা নেই, অথবা সে-ভাষা কেউ বোঝে না। তাই ‘তাঁহারা’ বলছেন : ‘আপনাদের মুখে তাদের বর্ণনা শুনলে মনে হয় যেন ভগবান তাদের মূক করেছেন আপনাদের মুখর করার জন্য।’২৫ শুধু ভাষা নিয়ে নয়, দুই শ্রেণির মধ্যে তর্ক হয়েছে সুর, সংগীত, মন, দেশ এবং স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়েও। সমাজে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ফলে জাতি-ধর্ম-সমাজ-ভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসের বদলে এক নতুন ধনী-মধ্যবিত্ত-শ্রমিক-শ্রেণির জন্ম হয়েছে। এই মধ্যবিত্তের মধ্যে আবার এক ধরনের সূক্ষ্ম পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। একদল উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিজীবী, অন্যদল অল্পশিক্ষিত কেরানিকুল। আগেই বলেছি ধূর্জটিপ্রসাদ মনে করতেন, ‘এ শ্রেণির দম, জান এবং শাঁস ফুরিয়েছে’, কিন্তু তবু তিনি এই দুই জাতের মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দূরত্বের অনুসন্ধান করেছেন। এই ধরনের ডায়ালগে সাধারণত কথাবার্তা হয় দু-টি ভিন্ন ‘টাইপ’-এর মধ্যে, এখানেও ধূর্জটিপ্রসাদ তাই করেছেন, কিন্তু অনেক সময়েই দুই টাইপের পার্থক্য রক্ষা করতে পারেননি, ‘তাহারা’-ও তাদের টাইপের বিরুদ্ধে গিয়ে যথেষ্ট বৈদগ্ধ্য দেখিয়ে ফেলেছেন। ফলে আলাদা জাতের মধ্যবিত্তের স্বভাবগত পার্থক্য বা সামাজিক দূরত্ব ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। মনে হয়েছে লেখক যেন নিজের সঙ্গে কথা বলছেন। এই বইয়ে ‘মনের কথা’ অধ্যায়ে ধূর্জটিপ্রসাদ তাঁর এক প্রিয় বিষয়ে ফিরে এসেছেন, যা নিয়ে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। সেটা হল পার্সোনালিটি ও ইনডিভিডুয়ালিটি। বস্তুত ‘তাঁহারা’ হলেন ‘আমরা’-র অন্য বা আদার। বুদ্ধিজীবীর ‘আমিত্ব’-র জন্য ‘তাঁহাদের’ প্রয়োজন, অন্যদিকে ‘তাঁহারা’ উপস্থিত হন বুদ্ধিজীবীর কাছে, তাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে ধার দিতে।

আমরা ও তাঁহারা বইটির দু-বছর পর প্রকাশিত হয় তাঁর চিন্তয়সি (১৯৩৩) প্রবন্ধ সংকলন। এই বইয়ের ধূর্জটিপ্রসাদ যেমন ‘নর্মাল’ প্রবন্ধে অ্যাভারেজকে ব্যঙ্গ করেছেন, তেমনি সাহিত্যের সমাজতত্ত্ব নিয়েও লিখেছেন। নর্মালের মানে বলতে তিনি বুঝেছেন ‘খানিকটা’ গড়পড়তা, খানিকটা স্বাভাবিক এবং খানিকটা আদর্শ।’২৬ সমাজে অনেক নর্মাল আছে এবং বহু নর্মালের সামান্যীকরণে একটি বৃহৎ নর্মালের সৃজন হয়। ধূর্জটিপ্রসাদের আপত্তি হল, নর্মাল সৃজনে এক ছাঁচে ঢালতে গিয়ে প্রত্যেকে তার বৈশিষ্ট্য হারাল। বৈচিত্র্য গেল। লিখেছেন ‘বাস্তব জগতে নর্মালের অস্তিত্ব নেই’, ‘দেশ কালের প্রাণ নেই, সেইজন্য সমাজতত্ত্ববিদ, অর্থশাস্ত্রী ও রাজনৈতিক এই জড়ের নর্মাল তৈরি করতে তত গোলে পড়েন না, যত গোলে পড়েন একটি নর্মাল মানুষ গড়তে।’২৭ রাজনীতিতে এই সামাজিক নর্মালের কাছে মানুষ আত্মবলি দেয়, ধূর্জটিপ্রসাদ একেই বলেছেন ‘ডিসিপ্লিন’ বা ‘জার্মান ড্রিল’। আজকের দিনের সামাজিক অনুশাসনের আলোচনার ক্ষেত্রে ধূর্জটিপ্রসাদের এই মন্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক। বস্তুত ধূর্জটিপ্রসাদ বলেছেন নরম্যাটিভ এক ধরনের অনুশাসনেরই ফল। এই একই বইয়ে তিনি সাহিত্যের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন বাহির ও অন্তরের এই বিরোধের মাধ্যমে। মানুষ অনুশাসনের বিরোধ করবেই, কারণ লেখকের ভাষায় ‘মানুষ বিরক্ত হয়ে মহাপুরুষের মত সংসার ত্যাগ করতে পারে না-সে যখন সমাজের মধ্যে থাকতে বাধ্য হয় তখন তার বুদ্ধিবৃত্তিও অসামাজিক হতে বাধ্য।’২৮ তাই সাহিত্যকে গোটা মানুষের সঙ্গে বাইরের সমাজ ও অন্তরের প্রকৃতির নতুন নতুন বিরোধকে রূপ দিতে হবে, কারণ সাহিত্যের বিষয় মানুষ। তিনি বলেছেন সমাজতত্ত্ববিদের কাজও অনেকটা সাহিত্যিকের মতোই, কারণ তার কাজও মানুষকে নিয়েই : ‘সমাজতত্ত্ববিদ অবশ্য রূপ সৃষ্টি করে না, কিন্তু সেও মানুষের দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনতে পায়, সেও সামাজিক অত্যাচার লক্ষ করে, এবং অত্যাচার উপশম করবার জন্য জ্ঞাত অসামাজিক মতামত পোষণ ও প্রচার করতে বাধ্য হয়-এই হতে বাধ্য যতদিন সমাজতত্ত্বের বিষয় প্রথমে মানুষ, পরে মানুষের অনুষ্ঠান থাকবে-যতদিন সমাজতত্ত্ব লিখতে মানুষের দরকার হবে।’২৯

৪. ব্যক্তি, পুরুষ, প্রাতিস্বিকতা

আগেই বলেছি, ধূর্জটিপ্রসাদের সমাজভাবনার কেন্দ্রে আছে পার্সোনালিটি-সম্পর্কিত চিন্তা। তিনি মনে করতেন মানুষ হবে ‘পুরুষ’; সে একক ব্যক্তিসত্তা বা ইনডিভিডুয়াল হবে না, হবে ‘পার্সন’। এই পার্সনের ধারণা ধূর্জটিপ্রসাদের লেখায় নানাভাবে এসেছে, এর বিশ্লেষণ তিনি করেছেন বহুবার এবং এই ধারণা মধ্যবয়স থেকে পরিণত বয়স অবধি তাঁর মনকে অধিকার করেছিল। এই চিন্তায় তিনি যে রবীন্দ্রনাথ দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তাই প্রথমে রবীন্দ্রনাথের পার্সোনালিটি নিয়ে লেখা একটা আলোচনা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর Personality (১৯১৭) বইয়ে হুইটম্যানের কবিতা উল্লেখ করে বলেছেন যে, হুইটম্যান যে জগৎ সৃষ্টি করেছেন, তার আকার, তথ্য, গঠন সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে তাঁর প্রাতিস্বিকতা।৩০ এই জগৎ তাঁর সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে সম্পর্কিত, এই জগৎ হয়তো আলাদা কিন্তু তার একটা নিজস্ব সংগতি, সামঞ্জস্য আছে; এবং তার কারণ হল এই কেন্দ্রীয় প্রাতিস্বিক শক্তি। অন্যদিকে বিজ্ঞান এই প্রাতিস্বিকতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, বিজ্ঞান দেশকালের এক নৈর্ব্যক্তিক, অপরিবর্তনীয় স্ট্যান্ডার্ড স্থির করতে চায়, যা কিন্তু সৃষ্টির মান নয়। তাই এই বাস্তবের স্পর্শে জগৎ এতটাই বিলোড়িত হয় যে তা এক বিমূর্ততায় অদৃশ্য হয়ে যায়। বিজ্ঞানের জগৎ যুক্তির জগৎ কিন্তু প্রকৃত জগৎ হল মানুষের প্রাতিস্বিকতার, যুক্তির নয়। যুক্তি আমাদের কাজে লাগতে পারে, কিন্তু যুক্তি মানুষ নয়। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বেঠোফেন-এর উল্লেখ করে বলেছেন যে আমরা যদি তাঁর সংগীতের রহস্যময়তা না বুঝি তাহলে তাঁর সোনাটায় আমরা তাঁর প্রাতিস্বিকতার উপাদানকে সন্দেহ করব। আমরা এই সোনাটা সম্বন্ধে নানাবিধ পর্যবেক্ষণ করতে পারি, সাদা কালো কী-এর সংখ্যা গুনতে পারি, আঙুলের চলন দেখতে পারি, বলতে পারি এই হল বেঠোফেনের সোনাটা। কিন্তু এইভাবে সোনাটাকে দেখতে গিয়ে আমরা ভুলে যেতে পারি যে, এর উৎস ও অভীষ্টের অবস্থান হল মানুষের প্রাতিস্বিকতায় এবং যত সঠিকই আমাদের আঙুলের চলন ও কী-সম্পর্কিত তথ্য হোক না কেন, তারা এই সংগীতের বাস্তব বুঝতে কোনো সাহায্য করবে না। অন্যকথায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, একটি সৃষ্টি মূর্ত হচ্ছে মানুষের প্রাতিস্বিকতার মাধ্যমে। মানুষের প্রাতিস্বিকতা একটি সৃষ্টির বাস্তব।

এই প্রসঙ্গে তিনি খেলার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন একটা খেলাকে আমরা খেলা বলি যখন সে খেলা খেলবার খেলোয়াড় থাকে। অবশ্যই খেলার নিয়ম থাকে, যার মাধ্যমে আমরা খেলাটাকে বুঝি, খেলোয়াড় খেলাটাকে অনুশীলন করে। কিন্তু কেউ যদি বলে এই নিয়মই খেলার বাস্তব তাহলে সেটা স্বীকার করা যায় না। কারণ খেলা তা-ই যা খেলোয়াড়রা ভাবে। খেলোয়াড়দের প্রাতিস্বিকতার সঙ্গে খেলার ধরনও বদলে যায়। কেউ লাভের লোভে খেলে, কেউ-বা হাততালি পাবার জন্য; কেউ ভাবে এইভাবে সময় কাটবে, কেউ-বা তার সামাজিক প্রবৃত্তির সন্তুষ্টির জন্য খেলে। কিন্তু খেলার নিয়ম একই থাকে। এই জগৎও আমাদের কাছে খেলার মতো-এটা একই আবার এক নয়ও। বিজ্ঞানের কাজ হল এই একত্বকে নিয়ে; ছবিকে নিয়ে নয় পরিপ্রেক্ষিতের নিয়মকে নিয়ে। ছবি সৃষ্টি হয় প্রাতিস্বিকতার মাধ্যমে এবং যারা সেটা দেখে তাদের প্রাতিস্বিকতায় আবেদন করে। বিজ্ঞান প্রাতিস্বিকতার অপসারণ করে যেকোনো সৃষ্টিতে তার মাধ্যমের প্রতি মনোযোগ দেয়। মানুষের প্রাতিস্বিকতা পূর্ণতা লাভ করে বহুবিধ সম্পর্কের মাধ্যমে, জগতের সঙ্গে একত্বে। প্রাতিস্বিকতা সম্পর্কে সচেতনতা শুরু হয় অন্য সকল থেকে বিযুক্তির অনুভবের মধ্য দিয়ে, আর শেষ হয় সকলের সঙ্গে একত্বের অনুভূতি দিয়ে। এই প্রাতিস্বিকতাই সমস্ত সম্পর্কের কেন্দ্রে আছে এবং এটাই বাস্তব। তাই এই হল মানুষের পরম অভীষ্ট। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, জগৎ যে বাস্তব তার কারণ এই জগৎ প্রাতিস্বিকতার সঙ্গে সম্বন্ধিত। এই হল বাস্তবতার কেন্দ্রস্থল। এই কেন্দ্র যদি অপসারিত হয় তাহলে জগৎও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে, পর্যবসিত হয় এক বিমূর্ততার স্তূপে। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি প্রাতিস্বিকতা মানুষের এক সম্পর্কিত সত্তা, যে সম্পর্কের ডালপালা ছড়িয়ে আছে সারা জগৎ জুড়ে, আর এই সম্পর্কই প্রাতিস্বিকতাকে পূর্ণতা দেয়।

আমরা জানি পশ্চিমের সমাজদর্শনে ব্যক্তির ভূমিকা অপরিসীম। এই ব্যক্তির ধারণা মধ্যযুগীয় কিছু বিশেষ মানুষের বিশেষ অধিকারকে নাকচ করেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিশেষ অধিকারকে প্রিভিলেজ বলা যায়, ব্যক্তির ধারণা এই প্রিভিলেজকে নাকচ করেই সৃষ্টি হয়। ব্যক্তির এই ধারণা মনে করে ব্যক্তি স্বাধীন এবং অটোনোমাস। ফলে এই ধারণা ব্যক্তির নৈতিক ও বৌদ্ধিক স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য প্রদান করে; তার যুক্তিবোধ, আত্মজ্ঞান, আত্মিকতা, ব্যক্তিগত জীবনযাপনের অধিকার, আত্ম-সার্বভৌমতা, আত্ম-বিকাশের ক্ষমতাকে চরম গুরুত্ব দেয়। এই ব্যক্তি প্রশ্নাতীত, পরম, অনতিক্রমণীয়। এই ব্যক্তির বৈধ অধিকারের উপরে আর কিছু নেই, এই ব্যক্তির অধিকার শুধুমাত্র অন্য ব্যক্তিদের একইরকম অধিকারের দ্বারা সীমিত। লাইবনিৎস যেমন বলেছেন ব্যক্তি হল মোনাড এবং সমাজ হল মোনাডদের সংঘ। ধূর্জটিপ্রসাদ মনে করেন, ব্যক্তির জন্ম ধনতন্ত্রের প্রসারের সঙ্গে, কিন্তু ব্যক্তির জন্মের সঙ্গে থেকেই ইউরোপের সংস্কৃতির পতন আরম্ভ হয়; কারণ, সংস্কৃতির ভিত্তি ব্যক্তিগত কৃষ্টি নয়, কমিউনিটি-যাকে হিন্দুরা ‘সমাজ’ বলেন। এই ‘সমাজবোধ নষ্ট হবার পরই শূন্যতা ভরাট করবার জন্য জাতীয়তার (nationalism) প্রয়োজন হয়। ব্যক্তি যেমন এক, নেশন বা জাতিও তেমনি একটি; ব্যক্তি যেমন লাভের জন্য দুঃসাহসী, জাতিও তেমন শক্তিপ্রসারের অভিলাষী।’৩১ তিনি মনে করেন ব্যক্তি বস্তুত এক বিমূর্তভাব। এই ব্যক্তির প্রতিতুলনায় তিনি নির্মাণ করেন অন্য একটি সংজ্ঞা, যার নাম পুরুষ বা পার্সন, আর একমাত্র পুরুষেরই আছে পার্সোনালিটি, ব্যক্তির নয়। লিখেছেন : ‘মানুষ হবে পুরুষ; সে একক ব্যক্তিসত্তা বা ইনডিভিডুয়াল হবে না-হবে ‘পার্সন’।৩২

তিনি বলেছেন ব্যক্তিবাদের সঙ্গে পুরুষবাদের পার্থক্য অনেক। তাঁর মতে, ব্যক্তি সমাজ থেকে ছিন্ন ও ভিন্ন, অতএব হয় সে সমাজের শত্রু, না হয় ব্যর্থতাবোধে সামাজিকতায় আত্মহারা। এই ভিন্নতাবোধের জন্য সে একাকিত্বের শিকার, যে-জন্য ডুরখাইমের মতে আত্মহত্যা (এটা অবশ্য ডুরখাইমের ঠিক পাঠ নয়) অথবা এরিক ফরমের মতে ফ্যাসিজম। ব্যক্তির দ্বিতীয় অবস্থা হল ‘দায়িত্বহীন সমালোচনা ও অসামাজিক ব্যবহার, যার প্রমাণ কলকাতা শহরের অলিতে গলিতে, ট্রামে-বাসে, চা-এর ও কাপড়ের দোকানে।’৩৩ তৃতীয় অবস্থা হল বিরোধিতার জন্যই বিরুদ্ধতা অর্থাৎ নিয়মকানুনে অবিশ্বাস ও অনিয়মের অভ্যাস। ‘কবিতায় দুর্বোধ্যতা, বৈজ্ঞানিক ও আর্টিস্টের আত্মম্ভরিতা, বিশেষজ্ঞের দম্ভ, কী সমাজ-সংস্কারকের আত্মপ্রসাদ, প্রত্যেকটি ঐ ব্যক্তিবাদের অন্তঃস্থ বৈপীরত্য-বোধের প্রকাশ।’৩৪ ঠিক কী এই বিপরীত বোধ? ধূর্জটিপ্রসাদ বলছেন, এই বিপরীত বোধ হল হয় এই নয়তো ওই, আইদার অর, অ্যারিস্টটলীয় যুক্তি। হয় তুমি আমার বন্ধু না হয় শত্রু। বলেছেন এর জন্য বিজ্ঞানে ও অন্যজ্ঞানে কত সর্বনাশ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বিপরীত বোধ হল ক বনাম খ, ক-এর বিরুদ্ধে খ। পুরুষবাদে এই বিপরীতবোধ নেই, পরিবর্তে আছে সংযোগবোধ, এর যুক্তি ডায়ালেকটিক অর্থাৎ সমন্বয়সাধনের যুক্তি। তাই তিনি বলেছেন : ‘সমবায়ী, সংযোগী পুরুষ বাস্তব, ব্যক্তি অবান্তর।’৩৫ মানুষ সামাজিক জীব, এর অর্থই তাই। পুরুষ তাই বৃহত্তর সঙ্গ, সহবাস, সম্পর্ক, সহযোগ, সমবায় সৃষ্টি করতে চায়, যেখানে তার মনুষ্যত্বের যাচাই হতে পারে। তাই পুরুষ অধিকার অর্জন করবে আবার দায়িত্বশীল হবে। পুরুষ সংজ্ঞার মধ্যে অধিকার-দায়িত্ব একত্রিত হয়েছে। পুরুষ আরও একটি বিরোধের সমন্বয় ঘটায়, সেটা হল ঐতিহ্য ও পরীক্ষার বিরোধ। সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয় ঐতিহ্য মানে রক্ষণশীল আর পরীক্ষা মানে প্রগতি। কিন্তু ধূর্জটিপ্রসাদ বলেছেন, ‘পুরুষ জন্মায় ঐতিহ্যের গর্ভে এবং কর্মের জোরে বেরিয়ে আসে জীবনের পরীক্ষাগারে। একই মানুষ ঐতিহ্যের ভার বহন করে আগুয়ান হয়, কখনও ভার কমায়, কখনও আবার নতুন ভার গ্রহণে ভয় পায় না।’৩৬ তিনি বলেছেন, ভারতীয় সমাজ ভাঙছে ঠিকই, কিন্তু তা অসংলগ্ন ‘ব্যক্তিকণার জঞ্জালে’ পরিণত হয়নি। ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন এক মানব প্রত্যয়ের আভাস মেলে যেটা, তাঁর মতে, ব্যক্তিত্বের অপেক্ষা পুরুষ-তত্ত্বের অনুকূল। পশ্চিমের ও ভারতের সমাজের পার্থক্য প্রদর্শিত করে তিনি বলছেন : ‘তবে যদি এমন কোনো মনোনয়ন আমাদের করতেই হয়, য়ুরোপীয় সভ্যতার খণ্ড-বিখণ্ডিত, অবরোহী নির্ণয়-সিদ্ধ ভাসমান, শিকড়-ছেঁড়া ও সে হিসেবে স্বাধীন, ব্যক্তি-প্রত্যয় গ্রহণ করবো, কিংবা ভারতীয় সভ্যতার এখনও অখণ্ড, জমাটবদ্ধ-concrete, এবং সে হিসেবে আচার ও নিয়মাধীন মানুষকে দিয়ে নব্য, সমাজের গোড়া পত্তন করবো, তখন আমরা নিশ্চিন্ত মনে ঐতিহ্যের ধারা অনুসারে অগ্রসর হতে পারি।’৩৭ তিনি বলছেন এই পুরুষতত্ত্ব মার্কসবাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ : ‘আমি যতটা মার্কস-এঙ্গেলস বুঝেছি তাইতে আমার ধারণা হয়েছে এই যে, এই প্রকার পুরুষতত্ত্বই তাঁদের মনের কথা ছিল।’৩৮

তাঁর মতে, মার্কসবাদের কেন্দ্রে আছে মানুষ, কিন্তু মানুষ আর ব্যক্তি এক বস্তু নয়। যদি বলা হয় ব্যক্তি সত্য, তাহলে মার্কসবাদের সঙ্গে এই ব্যক্তিসত্তার যোগাযোগ মানবগোষ্ঠীর মাধ্যমে, অর্থাৎ সেই গোষ্ঠী স্বাধীন হলে ব্যক্তি হলে ব্যক্তি হবে মুক্ত। অন্যদিকে যদি বলা হয় সমষ্টিই সত্য, ব্যক্তি বলে কোনো বস্তু নেই, কারণ ব্যক্তি সমষ্টি দ্বারাই প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত, তবে মার্কসবাদের সঙ্গে সমষ্টির যোগ নিতান্ত প্রত্যক্ষ। এরপর ধূর্জটিপ্রসাদ বলেছেন : ‘আমার নিজের বিশ্বাস, যে ব্যক্তি পদার্থটি একটি প্রকাণ্ড abstraction বা বিমূর্তভাব, যার উৎপত্তি ইংলন্ডে ধনিকতন্ত্রের যুগে এবং যার সঙ্গে ভারতীয় চিন্তার ও ভারতীয় সমাজের ও ঘটনার কোনো যোগ নেই। ভারতীয় চিন্তায় আছে পুরুষ; . . . ব্যক্তিত্ববাদের মূলকথা আর্থিক উন্নতির সাধনা। পুরুষবাদের তত্ত্বকথা বর্ণাশ্রম, অর্থাৎ সমাজের ভেতরে বিকশিত হবার পর গুটিপোকার মতন কেটে বেরোনো।’৩৯ বলছেন, তার মানে মার্কসবাদ ও হিন্দুত্ব এক বস্তু এরকম নয়, কিন্তু মার্কসবাদ ব্যক্তিত্ব নামক ‘কল্পিত বস্তু’-র উন্নতিবিধানের স্থান নয়। মার্কসবাদের সঙ্গে মানবধর্মের সম্বন্ধ পুরুষতত্ত্বের (personalism) ভেতর দিয়ে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের মারফত নয়।’৪০

ধূর্জটিপ্রসাদের ‘ব্যক্তি’ সম্পর্কিত উক্তির প্রসঙ্গে বলা যায়, পশ্চিমের সমাজদর্শনে ‘ব্যক্তি’ একটি আইডিয়া, বাস্তব নয়, ঠিক যেমন ‘সাম্য’ বা ‘ন্যায়’ এক-একটি আইডিয়া, পশ্চিমের রাজনীতি এবং তার দর্শন নির্মিত হয়েছে এই ধারণাগুলিকে ভিত্তি করে। কিছু কিছু রাজনৈতিক মতবাদের ক্ষেত্রে, যেমন উদারনৈতিকবাদ, এই ধারণাগুলির অর্ন্তনিহিত অর্থ, ব্যঞ্জনা, তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই ব্যক্তিকে বাস্তব জগতে খোঁজা খুব একটা যুক্তিযুক্ত নয়। পশ্চিমের সমাজতত্ত্বে ‘ব্যক্তি’ ও ‘সমাজ’-এর মধ্যে অনেক সময় বিরোধিতা দেখা যায়, যেখানে সমাজ প্রতিভাত হয় এক অ-মানবিক অবশেষে, এখানে সংখ্যার প্রাধান্য; আর উলটোদিকে আছে মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক বাস্তব, যা রয়েছে ব্যক্তির মধ্যে। সমাজতত্ত্বের কাজ হল মানুষকে সামাজিক সত্তা হিসেবে জানা, বা মানুষের সামাজিক প্রত্যভিজ্ঞান (apperception)। স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তির তাই সে বিরোধিতা করে সামাজিক সত্তার মাধ্যমে, যেমন ধূর্জটিপ্রসাদ করেছেন। সমাজতত্ত্ব প্রতিটি মানুষকে এক বিমূর্ত মানবিকতার উত্তরাধিকারী মনে করে না, বরং মনে করে এমন এক বিন্দু যেখান থেকে সমষ্টিগত মানবিকতা, বা সমাজ উৎপন্ন হয়েছে। এইখানে মানুষের মধ্য দিয়ে সমাজ কথা বলে। ডুরখাইম এই অর্থেই ‘সমষ্টিগত চেতনা’-র কথা বলেছিলেন। মাক্স হ্বেবার বলেছিলেন যে, ‘ব্যক্তি’ শব্দটি নিয়ে নানাবিধ সমস্যা আছে। প্রধান সমস্যা হল এই পার্থক্য করা যে, কখন ব্যক্তি একজন ইমপিরিকাল এজেন্ট, যে ভূমিকায় সে সমাজতত্ত্বের কাঁচামাল এবং কখন সে একজন যৌক্তিক ও নরম্যাটিভ সাবজেক্ট। পশ্চিমে এই নরম্যাটিভ সত্তার সঙ্গে যুক্ত সাম্য ও স্বাধীনতার ধারণা এবং এই অর্থেই আমি ব্যক্তিকে এক আদর্শের আইডিয়া বলেছি। সমাজতাত্ত্বিক তুলনার জন্য ব্যক্তির পূর্ণ অর্থই গ্রহণ করা উচিত এবং যে সমাজে এই ব্যক্তির আদর্শের স্বীকৃতি নেই, সেই সমাজে তার স্থানও নেই। তাহলে আমরা দু-টি বিপরীত ধারণা পাচ্ছি, প্রথমটিতে জোর দেওয়া হয়েছে সমগ্র সমাজের উপর, সমষ্টিগত মানুষের উপর; এই আদর্শে সমাজ সংগঠিত হয়েছে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য-সাধনের লক্ষ্যে, ব্যক্তির সুখের জন্য নয়। এই সমাজ নির্মিত হয়েছে এক নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা ও স্তরবিন্যাসের মাধ্যমে এবং প্রতিটি মানুষ এই নিয়মনীতি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কাজ করবে। আধুনিক সমাজে মানুষ অবিভাজনীয় বলে ভাবা হয়, এই অবিভাজ্য মানুষ এক জৈব সত্তা এবং চিন্তাশীল সাবজেক্ট। প্রতিটি মানুষই একভাবে সমগ্র মানবতার মূর্ত রূপ। এখানে মানুষের বৈধ লক্ষ্য বা অভীষ্টই হল সমাজের অভীষ্ট। অর্থাৎ এখানে যাকে ‘সমাজ’ বলা হচ্ছে তা এক সাধন, প্রতিটি মানুষের জীবন হল লক্ষ্য। সত্তাতাত্ত্বিকভাবে সমাজের এখানে বস্তুত কোনো অস্তিত্ব নেই, এই ‘সমাজ’ কোনোভাবেই সাম্য ও স্বাধীনতার দাবিকে বাধা দিতে পারে না। আধুনিক যুগে সমাজকে ভাবা হয় ব্যক্তির সমষ্টি হিসেবে, যে সমষ্টির ‘ইচ্ছা’ ও ‘সম্পর্ক’ আছে, যেমন আছে অবিভাজ্য ব্যক্তির; কিন্তু ব্যক্তির মতো এই ‘ইচ্ছা’ কোনো সামাজিক নিয়মের অধীন নয়। ধূর্জটিপ্রসাদ বলছেন, সকলেই ব্যক্তি বলতে ভেতরের বস্তু আর সমাজ বলতে বাইরের বস্তু বোঝেন, কিন্তু এই ভেতর ও বাহিরের মধ্যে একটা সম্পর্কের ধারাবাহিকতা আছে যেটি ব্যক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে কংক্রিট, কিন্তু যার স্বভাব হচ্ছে সর্বজনীন-এই সম্পর্কের ধারাবাহিকতাকেই ধূর্জটিপ্রসাদ বলেছেন পার্সোনালিটি।৪১

৫. সংগীতের সমাজতাত্ত্বিক?

ধূর্জটিপ্রসাদ সংগীত অনুরাগী মানুষ, সংগীত নিয়ে লিখেছেনও অনেক। কিন্তু সমাজতাত্ত্বিক হিসেবে সংগীতের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক ভাবতে পেরেছিলেন? সংগীতের যে সমাজতত্ত্ব হতে পারে এরকম চিন্তা তাঁর মনে কখনো এসেছিল? আমার নিজের মনে হয় তিনি খুব স্পষ্টভাবে সংগীতের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যার কথা ভাবেননি, সংগীত ও সমাজের সম্পর্ক তাঁর লেখায় এসেছে অনেক অস্পষ্টভাবে। আমরা সকলেই জানি যাঁরা গান-বাজনা করেন তাঁরা সমাজেরই সদস্য, তাঁদের সংগীতের অনুরাগী থাকতে পারেন, আবার সেই সংগীত মানুষের অপছন্দও হতে পারে। সংগীতের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সমাজের রুচিভেদ, প্রবৃত্তিভেদ, পছন্দ, মর্যাদা, সৌন্দর্যবোধ ইত্যাদি নানা প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ। অর্থাৎ সংগীতের এক কমনসেন্স সমাজতত্ত্ব আছে, যা সংগীতে ও সমাজের পর্যবেক্ষণস্তরে যে সম্পর্ক তার অনুশীলন করে। কিন্তু এই উপরিস্তরের নীচে, আরও গভীরে, সংগীতের মৌলিক বিষয় নিয়ে এক সমাজতত্ত্ব সম্ভব, যা মাক্স ভেব্যর প্রদর্শিত করেন। মাক্স ভেব্যর তাঁর The Rational and Social Foundation of Music লেখেন ১৯১১ সালে। এর অনুবাদ অবশ্য প্রকাশিত হয় আরও পরে, ১৯৫৮ সালে। তাই মূল রচনাটি হয়তো ধূর্জটিপ্রসাদের পক্ষে পাঠ করা সম্ভব ছিল না, কিন্তু সংগীতের সমাজতত্ত্বের মূল কিছু ধারণার কথা তিনি চেষ্টা করলে জানতে পারতেন। নতুন নতুন বিষয়ের বইয়ের প্রতি তাঁর সারাজীবন আগ্রহ ছিল, তাঁর বই পড়ার বিষয়গুলিও ছিল খুব বিস্তৃত। যাই হোক, ঠিক যেমন তাঁর পার্সোনালিটি-সম্পর্কিত তত্ত্বের জন্য তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী, সংগীত ও সমাজের সম্পর্ক সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথই তাঁকে সচেতন করেন। প্রথমদিকে চিঠিপত্রে তিনি সংগীতকে এক সর্বজনীন শিল্প বলে ভাবতেন, যার আবেদন দেশকালপাত্রের ঊর্ধ্বে। রবীন্দ্রনাথই তাঁকে বলেন সমাজ-সংস্কৃতি ভেদে সংগীতও ভিন্ন রূপ পরিগ্রহণ করে, তাঁর আবেদনও ভিন্ন হয়। সুর ও সঙ্গতি বইটিতে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, শিল্পভাবনার প্রকাশে জার্মান, ফরাসি, ইতালির চরিত্র ভিন্ন কারণ তাদের ইতিহাস, পরম্পরা ভিন্ন : ‘চরিত্র কর্মসৃষ্টিতে এবং হৃদয়বৃত্তি ও কল্পনাশক্তি রসসৃষ্টিতে আপন পরিচয় দিয়ে থাকে। তাই য়ুরোপীয় সংগীতের কাঠামো এক হলেও ইটালীয় ও জার্মান সংগীতের রূপের ভেদ আপনিই ঘটেছে। ওদিকে রুশীয় সংগীতেরও বৈশিষ্ট্য রসজ্ঞেরা স্বীকার করেন।’৪২

বাঙালির সংগীত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মত ছিল ‘হিন্দুস্থানীর সঙ্গে বাঙালীর প্রভেদ আছে, দেহে, মনে, হৃদয়ে, কল্পনায়’, বাঙালির চিত্তবৃত্তি প্রধানত সাহিত্যিক এবং কীর্তনগানে সাহিত্য ও সংগীত মিলে এক অপূর্ব সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি মনে করতেন হিন্দুস্থানী সংগীতের মধ্যে তত্ত্বও আছে সৃষ্টিও আছে, কিন্তু সে সৃষ্টি দেশকালপাত্র দ্বারা নির্ধারিত। সেই সৃষ্টি প্রশংসাযোগ্য, ‘কিন্তু অনুকরণ করতে গেলে নতুন দেশকালপাত্র হুঁচট খেয়ে সেটা সত্য হারাবে।’ অন্যকথায়, তিনি বলতে চেয়েছেন সমাজ-সংস্কৃতি-পরম্পরার প্রকারভেদে সংগীতও তার রূপ বৈশিষ্ট্য পালটাবে, আর বাঙালি চিত্তে আছে এক গভীর হৃদয়বেগ, এই হৃদয়বেগ হিন্দুস্তানী গানের পিঞ্জরে আবদ্ধ না থেকে প্রকাশিত হয়েছে কীর্তনগানের মাধ্যমে। অথচ হিন্দুস্তানী রাগরাগিণীর উপাদান সে বর্জন করেনি, বরং সে-সমস্ত নিয়েই সে সৃষ্টি করেছে নিজের সংগীতলোক। এই কীর্তনগানকে কিন্তু ‘প্রিমিটিভ এবং ফোক ম্যুজিক বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। উচ্চ অঙ্গের কীর্তন গানের আঙ্গিক খুব জটিল ও বিচিত্র, তার তাল ব্যাপক ও দুরূহ, তার পরিসর হিন্দুস্থানী গানের চেয়ে বড়ো। তার মধ্যে যে বহুশাখায়িত নাট্যরস আছে তা হিন্দুস্থানী গানে নেই।’৪৩ বস্তুত এ হল সংগীতের এক সমাজতাত্ত্বিক মূল্যায়ন। রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্যগুলি করেন ধূর্জটিপ্রসাদের সঙ্গে পত্র বিনিময়ে। ধূর্জটিপ্রসাদ মনে করতেন সুরে সংগতি রক্ষার সঙ্গে পরিশীলনের যোগ আছে, জাতিগত বৈশিষ্ট্যের নয়। ‘যে-কোন দেশের ভদ্রলোকের কাছে আমি সংগীতকলা প্রত্যাশা করতে পারি।’৪৪ রবীন্দ্রনাথ বরং একটু অন্য মত পোষণ করতেন। সুর ও সঙ্গতি বইটির ভূমিকায় ধূর্জটিপ্রসাদ লিখেছেন যে তাঁর অনুরোধে ১৯৩৪ সালে রবীন্দ্রনাথ এক সংগীত সমাবেশে বক্তৃতা করেন : ‘তাঁর বক্তব্য ছিল দুটি, সংগীত ও জীবন নিবিড়ভাবে যুক্ত, অতএব জীবনের বিকাশ যেমন রূপবৈচিত্রে সংসাধিত হয়, সংগীতেরও তেমনি অনুযায়ী অভিব্যক্তি নিতান্তই বাঞ্ছনীয়। হিন্দুস্থানী সংগীত পদ্ধতির যুগোপযোগী রূপপরিবর্তন যদি কল্পনার অতিরিক্ত হয় তবে বুঝতে হবে যে তার মৃত্যু ঘটেছে। . . . তাঁর দ্বিতীয় বক্তব্য ছিল বাংলা গানের বিশেষ রূপ সম্বন্ধে। বাংলা গানের একটি স্বকীয়তা আছে-সেটি সুরেরও নয়, কথারও, সুর ও কথার প্রকৃষ্ট মিলনের। তার রস ভিন্ন, কারণ তার রূপ পৃথক। সুতরাং বাংলা গানের ভবিষ্যৎ ওস্তাদের মুখের হিন্দুস্থানী রাগ-রাগিণীর অনুকরণের ওপর নির্ভর করছে না, পুনরাবৃত্তির ওপরও না।’৪৫

সুর ও সঙ্গতি প্রকাশিত হয় ১৯৩৫ সালে। এরপর ধূর্জটিপ্রসাদের দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন হয়, যার পরিচয় মেলে ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত তাঁর কথা ও সুর গ্রন্থে। এই বইয়ে সংগীতের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রবেশ না করলেও সংগীতের একরকম সমাজকেন্দ্রিক আলোচনার ঝোঁক তাঁর মধ্যে দেখা যায়। তিনি এখানে সংগীতের রূপ, রীতি, গায়ন-পদ্ধতি এবং সংগীত-সম্পর্কিত রুচির পরিবর্তন বোঝার জন্য একদিকে করদ-রাজ্য এবং অন্যদিকে ব্রিটিশ-শাসিত প্রদেশগুলির মধ্যে এক তুলনামূলক আলোচনা করেন। কথা ও সুর বইটির অন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই বিশ্লেষণে তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দেন ইমপিরিকাল তথ্যের উপর। তিনি বলেন, করদ-রাজ্য ধ্রুবপদ্ধতিই চলছে কিন্তু ব্রিটিশ-শাসিত অঞ্চলে ধ্রুবপদ্ধতির পাশে একটি নতুন গায়ন-পদ্ধতি সৃষ্টি হচ্ছে। সংগীতের পরিবর্তনের পিছনে অনাদর নেই, রয়েছে ক্রমবর্ধমান ঔৎসুক্য, নতুন গায়ন-পদ্ধতির পেছনে আছে সাধারণের মধ্যে সংগীতানুরাগের প্রসার : ‘অনুরাগের প্রসার ঘটেছে প্রধানত রঙ্গমঞ্চ, গ্রামোফোন, রেডিও, টকি এবং খবরের কাগজের জন্য। প্রসারের ফলে অনুরাগের বিষয়বস্তুর রূপ বদলে যায়। এই রুচি পরিবর্তন কিংবা বিকারের (?) সঙ্গে সামাজিক অবস্থান্তরের নিগূঢ় সম্বন্ধ।’৪৬ একই সঙ্গে ধূর্জটিপ্রসাদ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের দিকে। ভারতীয় পরম্পরায় সংগীত শিক্ষাদান গুরু-শিষ্য সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রচলিত ছিল। কিন্তু ক্রমশ এই শিক্ষাদান আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিল। সংগীতের স্কুল-কলেজ ঠিক গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক অনুযায়ী চলে না, এখানে পাঠক্রম, সময়-নির্ভর শিক্ষাদান, মূল্যায়ন, পরীক্ষা, ইত্যাদির একটা বড়ো ভূমিকা আছে। ধূর্জটিপ্রসাদ বলেছেন যেখানে বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে সেখানে প্রথাগত শিক্ষাপদ্ধতি অর্থাৎ গুরু-পরম্পরার মৌখিক শিক্ষা বিনষ্ট হচ্ছে। আবার কিছু ওস্তাদ ‘সর্বসাধারণের অর্থহীন সংগীতস্পৃহা’র বিপক্ষে তীব্র প্রতিবাদস্বরূপ শেখাতে চান না। অন্যদিকে ‘প্রাদেশিক শহরের প্রত্যেক ওস্তাদেরই সংগীত বিদ্যালয় আছে-প্রতি ওস্তাদের শিষ্যবৃন্দের সংখ্যা অগুনতি। শহরের ওস্তাদ আজ আর শিক্ষাদানে কৃপণ হতে পারেন না।’৪৭

প্রদেশ অনুযায়ী সংগীতের প্রতি অনুরাগও ভিন্ন। মাদ্রাজ, মুম্বই অঞ্চলে ধ্রুবপদ্ধতির প্রতি অনুরাগ, ধূর্জটিপ্রসাদের মতে, উত্তর-ভারতের থেকে তীব্রতর। মুম্বই-এর নাট্য-সংগীতও খেয়াল ঘেঁষা, বাংলার নাট্য-সংগীত ও সিনেমা-সংগীত সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। মাদ্রাজ ও মুম্বই অঞ্চলে উচ্চাঙ্গ-সংগীতের আসরে প্রকৃত শ্রোতার সংখ্যা বাংলার চেয়ে অনেক বেশি। তিনি লিখেছেন : ‘বাঙালি মহিলারা আজকাল অনেকেই গান বাজনা করে থাকেন, তাঁদের মধ্যে দু’চারজন ছাড়া আর সকলেই নতুন ধরনের বাংলা গান ও এসরাজ বাজান। মাদ্রাজে অনেক মধ্যবিত্ত গৃহস্থের বাড়িতে মহিলাদের মধ্যে এখনো বীণার প্রচলন রয়েছে।’৪৮ একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, যে-অঞ্চলে যে-ধরনের সংগীতের চলন, তার অনুসারী বা সামঞ্জস্যপূর্ণ যন্ত্রের কদর হয়েছে সেখানে। যেমন, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খেয়াল, বিশেষত ঠুংরি এবং বাংলায় ধ্রুপদ টপ্পার প্রচলনই বেশি ছিল। তাই উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সারেঙ্গি ও তবলা, আর বাংলার পাখোয়াজ জনসাধারণের প্রিয় হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে আরও এক ধরনের যন্ত্রসংগীতের প্রতি নব্য-মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, যাঁরা উচ্চাঙ্গ সংগীতে অনভিজ্ঞ ছিলেন তাঁদের আকর্ষণ দেখা যায়। এঁরা রঙ্গমঞ্চের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন আর রঙ্গমঞ্চের জন্য বিলাতি আদর্শে কনসার্ট তৈরি হল। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য উল্লেখযোগ্য : ‘বাংলার যন্ত্রসংগীত সৃষ্টি কোন লক্ষ্যে পৌঁছবে তা বলা কঠিন, প্রতিভার লীলা অভাবনীয়। এক কালে থিয়েটারে কনসার্ট নামে যে কদর্য অত্যাচারের সৃষ্টি হয়েছিল সেটা মরেছে এইটেই আশাজনক।’৪৯ রেকর্ড, রেডিয়ো অনুষ্ঠান, নতুন সংগীত বিদ্যালয়, সংগীত বিষয়ে পুস্তক প্রকাশনী ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে ধূর্জটিপ্রসাদ এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, ভারতবর্ষে সংগীতের প্রতি অনুরাগের দু-টি দিক আছে : পুনরুদ্ধার ও নতুন সৃষ্টি। তিনি লিখেছেন : ‘একদল বলছেন, পুরাতন পদ্ধতির এতই উৎকর্ষ সাধন হয়েছিল যে তার বেশি উন্নতি অসম্ভব, অতএব পুরাতন পন্থায় চলতেই হবে। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকে বলেছেন, প্রাদেশিক ভাষা ও কৃষ্টির অভাব অনুসারে নতুন রচনা হোক। বাংলাদেশে এই মতটারই প্রসার অন্য প্রদেশ অপেক্ষা বেশি। রবীন্দ্রনাথ এই মত সমর্থন করেন। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে যাঁরা উচ্চ-সংগীতে অভিজ্ঞ, তাঁদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি বলেছেন যে খেয়ালের হিন্দুস্থানী ঢং বাংলাভাষায় আনা যাবে না, কারণ বাংলায় স্বরবর্ণ কম, ব্যঞ্জন ও যুক্তবর্ণ বেশি, সুতরাং তান দেওয়া বাংলাগানে অসম্ভব। . . . সংগীতের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্যপ্রদেশে কোনো আলোচনা হয় বলে আমার জানা নেই। সে যাই হোক-নানা কারণে বাংলা দেশে হিন্দুস্থানী পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি অসম্ভব। বাঙালী বোধ হয় কখনো অন্ধ অনুকরণ করতে পারেনি।’৫০ এটাও রবীন্দ্রনাথের মত, সুর ও সংগীত বইয়ের চিঠিপত্রে এ কথা রবীন্দ্রনাথ নানাভাবে বলেছেন।

ধূর্জটিপ্রসাদ সংগীত ও সমাজের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্কের কথা বলেছেন, কিন্তু সমাজ বিশ্লেষণের গভীরে যাননি। তাঁকে ঠিক সংগীতের সমাজতাত্ত্বিকও বলা চলে না। কারণ, তিনি এই বিষয়ে সচেতনই ছিলেন না, এবং দ্বিতীয়ত, ঠিক কোনো তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি সংগীত ও সমাজের সম্পর্ক অনুসন্ধান করেননি, যেমন মাক্স ভেব্যর এবং পরবর্তীকালে থিয়োডোর অ্যাডোর্নো করেছিলেন। কিন্তু তিনি সংগীতবোদ্ধা ছিলেন, অনুরাগী হিসেবে অসংখ্য সংগীতের আসরে গেছেন, ভারতীয় সংগীতের ঘরানার ইতিহাস, আঞ্চলিক পার্থক্য, চাল-চলন সম্পর্কে তাঁর সম্যক জ্ঞান ছিল, সুতরাং সংগীত নিয়ে চিন্তাভাবনা ও এই শিল্পের পরিবর্তনের তিনি যে ছবি এঁকেছেন তা সমাজতাত্ত্বিকদের আগ্রহ সৃষ্টি করবে এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

৬. সমাজ, সমাজপরিবর্তন

বিক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু লেখায় বাঙালি সমাজ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, সংক্ষিপ্ত কারণও দিয়েছেন, কিন্তু অ্যাকাডেমিক পেপারের ধরনে পুরোদস্তুর বিশ্লেষণ করেননি। এই ধরনের মন্তব্য সমাজ সম্পর্কে হঠাৎ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের কাছে উপস্থিত করে, আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। যেমন, ঝিলিমিলি বইয়ে এক জায়গায় বলেছেন : ‘আবার আমার মনে হচ্ছে যে কলকাতা শহরে intellectual তৈরি হলো না। ভালো মন্দ জানি না, তবে বুঝলাম, হলো না।’ এখানে তিনি লেখকরা গোষ্ঠী তৈরি করে সবকিছু নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিচ্ছেন, এরকম একটা কারণ জানিয়ে লিখেছেন : ‘এইরকম racket হলে intellectual class-ও সৃষ্টি হতে পারে না। সমাজ উচ্ছন্ন যাচ্ছে।’৫১ তাঁর নিজের লেখাও যে বাংলার পাঠকসমাজ ভালোভাবে লক্ষই করেনি একথাও বলে গেছেন জীবনের শেষে। ঝিলিমিলি বইয়ে লিখেছেন : ‘পাঠকও আমার প্রতি নজর করেননি। পাঠক-লেখকের সম্বন্ধ নিতান্ত আলগা, আলগোছা, আবছা গোছের। অবশ্য আমার চিন্তাধারা চলেছে এবং বেশিরভাগ পাঠকের চিন্তাধারা কম, নিতান্ত কম, নেই বললেই হয়। তাই আমার-তোমার সম্বন্ধটি প্রায় ছিন্ন হয়েছে আমার লেখায়।’৫২ নিজের লেখা যে পাঠকের অবহেলাই পাবে সেটা জানতেন, এটাও জানতেন তাঁর বক্তব্যের যোগ্য মূল্যায়ন অন্তত বাঙালি পাঠক ও বুদ্ধিজীবীসমাজে হবে না। তবুও চেয়েছেন একটা ডায়লগ হোক, তর্ক-বিতর্ক হোক। তবে এক্ষেত্রে নিজের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। লিখেছেন বুদ্ধির পরিচয় তর্কে, যে-তর্কের গোটাকয়েক রীতিনীতি আছে। যেহেতু বুদ্ধি সাধারণ, অবিশেষ, তাই বুদ্ধি স্বাধীন। ‘এই স্বাধীনতা থেকে আমরা অনুমান করেছিলাম যে, লেখক কর্মজীবনে কারুর দাসত্ব করবে না . . . সমালোচনার বিষয় অবশ্য নির্দিষ্ট ছিল না, তবে সমাজই ছিল প্রধান। পলিটিকস-এ আমাদের আগ্রহ ছিল না, তার বদলে পলিটিকাল গোঁড়ামি, এমনকি বিজ্ঞানের, দর্শনের। মোদ্দা কথা কিছুই বাদ পড়েনি। ফলে লেখায় এসেছিল ফূর্তি, এবং সাহিত্যে এল প্রবন্ধ, সর্ববিষয়ে জানবার আগ্রহ। তবে নিশ্চয় মানবো যে তার বিপদও ছিল যথেষ্ট, হালকা বেহায়াপনা তার মধ্যে সবচেয়ে কম। সবচেয়ে বেশি ছিল জীবন থেকে, বিশেষত সামাজিক জীবন থেকে বিচ্যুতি। বুদ্ধির চর্চায় আমরা বৃন্তচ্যুত হয়ে পড়ি। বুদ্ধিবাদের সর্বনাশ ঐ করেই ঘটে, আমরাও বাদ পড়িনি।’৫৩

আগেই দেখিয়েছি তাঁর নিজের আগ্রহ ছিল ঐতিহ্য, প্রাতিস্বিকতা, সংগীত, সাহিত্যের প্রতি, ভারতীয় পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে পড়াশোনা করতেন, ইকনমিক থিয়োরির বর্তমান অবস্থা নিয়ে কয়েকটি লেখাও লিখেছেন, কিন্তু শেষ বই ঝিলিমিলি-তে লিখেছিলেন ‘মার্কসিজম ছাড়া অন্য অর্থনীতিতে অবিশ্বাসী’।৫৪ যদিও ঐতিহাসিক পদ্ধতি হিসেবে মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতেন : ‘উনবিংশ শতাব্দীর প্রধান সমাজশক্তির জের এখনও মেটেনি, তাই মার্কসের ঐতিহাসিক নিয়ম এখনও খাটছে, কিন্তু তাই বলে তাঁর আবিষ্কৃত নিয়মের সাহায্যে পৃথিবীর আদিম, মধ্যযুগীয় এবং যাবতীয় সমাজ-সংস্থান ও বিবর্তনের ব্যাখ্যা করা সেন্ট পিটারের চাবি দিয়ে স্বর্গের দ্বার খোলার মতো গোঁড়ামি মাত্র। অর্থাৎ মার্কসীয় ব্যাখ্যার সাহায্যে এই যুগের আকস্মিক পরিবর্তনের ঘটনা সম্ভব হলেও সর্বপ্রকার ও সর্বকালীন সামাজিক নকশায় ধীর বিবর্তনের প্রকৃত ব্যাখ্যা তাতে পাওয়া যায় না।’৫৫ তিনি বলেছেন, এদেশে মার্কসের অনুগামীরা সমাজ অর্থে মূলত শ্রেণি বোঝেন, সামাজিক ধর্ম বদলাচ্ছে মানে তাঁদের মতে শ্রেণিগত ধর্ম বদলাচ্ছে। কিন্তু তাঁর মতে সমাজে অন্যান্য ঘটনাও ঘটেছে, যার কোনো মূল্য দেওয়া হচ্ছে না। এই ঘটনার ফলে যে নতুন মানুষ হচ্ছে তার স্থানও কেউ নিরূপণ করছে না। এখানে ধূর্জটিপ্রসাদ তাঁর সামনে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন : ‘এই যে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের লোকেরা গ্রাম ছেড়ে ছোটো বড়ো শহরে বাস করছে, এই যে লোকেরা ব্যবসা শুরু করছে, ধান চাল ডাল যবের ক্ষেত না করে পাট এবং রপ্তানীর উপযোগী শষ্যের চাষ আরম্ভ করেছে, এই যে টাকার আধিপত্য শুরু হয়েছে, যেখানে কল-কারখানা সেখানে মুটে মজুরের দল ঝুঁকে পড়েছে অথচ স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঘরকন্না করতে পারছে না, কিংবা যে ঘরে ঘরকন্না করছে সেটা বাসের উপযুক্ত মোটেই নয়, এই যে মধ্যবিত্ত ভদ্রসম্প্রদায় শহরের মেসে বাস করছে এর ফলে কি ধর্ম, সমাজ এবং গোষ্ঠী ভেঙে যাচ্ছে না-এবং ভাঙনের ফলে মানুষের আচরণ ব্যবহারগুলি কি বদলে যাচ্ছে না? মুটেমজুর, চাকরবাকর, বাড়ির স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, চাষী ও গরীব কেরাণির দল সকলেই অত্যাচারের বিপক্ষে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, সঙ্ঘ বাঁধছে, ধর্মঘট করছে, টাকা দিয়ে মানুষের মূল্য ঠিক করছে, এককথায় ‘জড়বাদী’ হয়ে উঠেছে।’৫৬ অর্থাৎ, এখানে ধূর্জটিপ্রসাদ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি পরিবর্তনের দিকে নজর রাখতে বলছেন, মানুষের মনোবৃত্তি, আচার-ব্যবহার কীভাবে বদলাচ্ছে তার দিকে দৃষ্টিপাত করতে বলছেন।

ধূর্জটিপ্রসাদ নিজে সমাজের ধ্যানধারণা, প্রত্যয়, আদর্শ এইসব বিষয় নিয়েই লিখেছেন বেশি। মানুষের জীবনে, দৈনন্দিন কর্মক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রকৃতি বা অভিমুখ নিয়ে তিনি কোনো সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করেননি। কিন্তু তাঁর একটি ছোটো বাংলা লেখা এ-ব্যাপারে প্রায় ব্যতিক্রম বলা যায়, সেই লেখার কথা বলে এই অধ্যায় শেষ করব। লেখাটির নাম হল ‘বৈঠকখানা ও সমাজ’। লেখকের ভাষায় শুরু করি : ‘আমার বক্তব্য গৃহের একটি ঘর মাত্র। সমাজতত্ত্বে সাধনার একটি প্রত্যঙ্গ নিয়ে আলোচনা করার রীতি আছে। আমি সেই সনাতন রীতিতেই প্রবন্ধটি লিখছি।’৫৭ তিনি লিখেছেন যে, সমস্ত সভ্যতার মাপকাঠি বৈঠকখানার আকারপ্রকার, তার সাজানো এবং অন্তঃপুর থেকে তার দূরত্বের উপর নির্ভর করে। কলকাতা শহরে যাঁদের পুরোনো বাড়ি তাঁদের বৈঠকখানা আছে কিন্তু যাঁরা ভাড়া থাকেন সেইসব গৃহস্থরা বৈঠকখানাওলা বাড়ির ভাড়া জোগাতে পাবেন না। ফলে, এইসব বাড়ির ছেলেদের আড্ডা হয় চায়ের দোকানে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত গৃহস্থের মেয়েদের বৈঠকখানা ছাদ, শোবার ঘরের বা সিঁড়ির ধারের জানালা। এই জায়গা থেকে অন্য মেয়েদের সঙ্গে পরিচয়, তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা, সুখদুঃখের কথা। যেহেতু মেয়েরা বৈঠকখানা থেকে দূরে, ফলে তাদের নিজ মূর্তিতে দেখতে হচ্ছে না, ‘মোদ্দা কথা এই যে বৈঠকখানা, স্নানের ঘর এবং রান্না ঘর থেকে দূরে থাকলে স্ত্রীজাতির প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা . . . অক্ষুণ্ণ থাকে।’৫৮ বৈঠকখানা না থাকার অন্য সমস্যা হল স্বামী-স্ত্রীর আলাপের সুবিধা ও সময় বেশি। আগেকার দিনে যখন বৈঠকখানা ছিল, তখন কর্তা রাত করে শোবার ঘরে আসতেন, তাই দু-জনের দেখা-সাক্ষাতের সময়ও কম ছিল। ‘এখন সুবিধা ও সময় বেশি-সেই বৈঠকখানার অভাবের জন্য। স্বামী-স্ত্রীর সর্বক্ষণ আলাপ পরিচয়ে সুফল কুফল দুইই আছে। একটি কুফল এই-প্রেম ও অভিমানের অশ্রুতে বিষবৃক্ষ যত শীঘ্র বেড়ে উঠে অত আর কিছুতে বাড়ে না।’৫৯

এই তির্যক প্রবন্ধে ধূর্জটিপ্রসাদ এরপর বলেছেন বড়োলোকেদের কথা। এঁদের মধ্যে যাঁরা উচ্চশিক্ষিত ও সাহেবি ভাবাপন্ন তাঁদের ড্রইংরুম থাকে, এই ঘরের মাঝখানে পিয়ানো থাকে ছিটের কাপড়ের মোড়কে। যখন মোড়ক খোলা হয় তখন এই যন্ত্রের সাহায্যে, লেখকের ভাষায়, সুরে ও বেসুরে দেশি ও বিদেশি গান গাওয়া হয়। এইভাবে ড্রইংরুমে পূর্ব ও পশ্চিমের মিলন সাধিত হচ্ছে। সংগীতের সঙ্গে অন্যভাবেও বৈঠকখানার সম্পর্ক রয়েছে : ‘আমার বিশ্বাস, কলকাতা শহরে বৈঠকখানাওয়ালা বাড়ি পাওয়া দুর্লভ বলে থিয়েটারী সঙ্গীত, কনর্সাট বাজনা, গ্রামোফোন ও রেডিও সঙ্গীতের আবির্ভাব হয়েছে। শহরের ভাড়াটে বাড়ির নীচের তলার ঘর ছোটো, অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে। যেখানে গাইয়ে বাজিয়েদের আসতে বলা যায় না।’৬০ বড়োলোকের ড্রইংরুমে সংগীতের রূপ ও প্রকৃতি ভিন্ন হতে বাধ্য। খুব বড়োলোকের বাড়িতে পিয়ানো থাকে আর মাঝারি বড়োলোকের বাড়িতে থাকে জাপানি অর্গান ও এসরাজ। ‘অল্প বয়সী মেয়েরা এসরাজ বাজাতে বসলে ভারী সুন্দর দেখায়, বাঁ হাতের হীরের আংটি জ্বল জ্বল করে ওঠে, এসরাজের সুরটাও করুণ ও নাকী। বাঙ্গালী মেয়েদের প্রাণের কথা (শুধু বাঙালী কেন? সমগ্র বাংলা জাতির মর্মবাণী) এসরাজ যেমন আত্মপ্রকাশ করে অমন আর কিছুতে হয় না।’৬১ অন্যদিকে গ্রামের জমিদারদের বৈঠকখানায়ও সুরবাহার, তানপুরা, পাখোয়াজ দেখতে পাওয়া যায়। বৈঠকখানা অন্দরমহল থেকে খুব দূরে হওয়ার দরুন পাখোয়াজ ও ধ্রুপদ গানের বিকট আওয়াজ অন্দরমহলে প্রবেশ করে না। সেইজন্য গ্রামের বৈঠকখানার গানের আওয়াজ খুব চড়া ও গম্ভীর হওয়া সম্ভব হয়। গ্রামের জমিদাররা এতেই অভ্যস্ত। ফলে, মৃদু গলায় নাকী সুরের ড্রইংরুমের গান তাঁদের পছন্দ নয়। এইজন্যই আবার ড্রইংরুমে অতুলপ্রসাদ এবং বিশেষ করে রবিবাবুর গান গাওয়া হয়, আর দেশের সংগীতজ্ঞ জমিদাররা রবিবাবুর গান ভালোবাসেন না। শেষে ধূর্জটিপ্রসাদ লিখেছেন : ‘যদি জমিদারের দলকে কলকাতায় ছোটো ভাড়াটে বাড়ি কিম্বা বালিগঞ্জের সাহেব পাড়ায় থাকতে হত, তাহলে রবিবাবুর গানই রামপ্রসাদী, নিধুবাবুর টপ্পা ও রজনী সেনের চেয়ে ভাল লাগত। অতএব সঙ্গীতে মত পার্থক্যের কারণ সঙ্গীত-সম্বন্ধীয় কোনো গূঢ় তত্ত্ব নয়-কারণ বৈঠকখানার রূপ ও অন্দরমহল থেকে দূরত্ব।’৬২

৭. সবশেষে

‘কেন লিখি’ নিবন্ধে ধূর্জটিপ্রসাদ বলেছেন যে, ইংরেজি বই ও প্রবন্ধ লিখেছিলেন চাকরি বজায় রাখার জন্য। লিখেছেন, বাবা যে টাকা রেখেছিলেন সেটা তিন পার্সেন্টের বদলে ছয় পার্সেন্ট থাকলে ইংরেজিতে বই লেখার কোনো প্রয়োজন হত না। অন্যদিকে বাংলা প্রবন্ধ, গল্প, ইত্যাদি লিখেছেন পরের তাগিদে, ‘টাকার জন্য যা সব লিখেছি তার মধ্যে অধিকাংশই বাজে’, যে-সব লেখা চটে লিখেছেন সেগুলি, তাঁর মতে, সুখপাঠ্য হয়েছে। তাঁর লেখায় প্রেরণার কোনো জায়গা নেই, প্রেরণায় বিশ্বাসও করতেন না। ‘মোটামুটি দাঁড়ায় এই : লিখি দম্ভের জন্য, আত্মসম্মানের জন্য, রাগ প্রকাশের জন্য প্রধানত। . . . পরের উপকারের জন্য লিখিনি, প্রেরণার জন্যও নয় এটাই সত্য উত্তর। আমি অন্তত জানি যে আমি তৃতীয় শ্রেণীর লেখক, প্রাণপণে চেষ্টা করি দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠতে। বলা বাহুল্য এটা আমার বিনয় নয়, কারণ চতুর্থ শ্রেণীর লেখক সম্প্রদায় আজও নির্মূল হয়নি বাঙলা দেশ থেকে।’৬৩ এই কথা লিখেছিলেন তিনি ১৯৪৪ সালে, যখন তাঁর বয়স ঠিক পঞ্চাশ বছর। তাঁর শেষ বই ঝিলিমিলি-তে চৌষট্টি বছর বয়সে লিখেছিলেন : ‘এই নিয়ে উনিশখানা বই লিখলাম। আরো দু-একটা লেখা চলত, যদি স্বাস্থ্যে কুলোত। কী লিখছি তাই জানি না। তবে বোধ হয় একটা মোটা ধারা আছে। তাকে personality বলা চলে- নভেলে তাই, সমাজতত্ত্বে তাই, অর্থনীতিতে তাই, ইতিহাসেও তাই, সঙ্গীতেও তাই। . . . পঁয়ত্রিশ বছর ধরে লিখে আসছি। থিতিয়েছে কিনা জানি না। যে-সব বই লিখেছি তার প্রায় অনেক কথাই মনে নেই। অনেক বই আমার কাছেই নেই। চোখে পড়লে হঠাৎ মনে পড়ে-নিজের কাছেই অদ্ভুত ঠেকে। বই লেখবার পরই ভুলে যাই, মনে থাকে না। এই চলে আসছে চিরকাল। . . . আমার কোনো লেখাই থাকবে না, তার থাকা উচিতও নয়। চিন্তার গতি নিয়েই আমার কারবার। চিন্তা নেই, আমিও নেই। চিন্তার দানা বাঁধত তো আমিও থাকতুম। স্বল্পক্ষণের জন্যই বেঁচে থাকা। স্বল্পক্ষণের জন্য যারা ভাববে, তারা আমার কথা মনে রাখবে-তার বেশি নয়। এটা বোধ হয় দম্ভ হল।’৬৪

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

 ১. এই লেখার বেশিরভাগ উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী, ২য় খণ্ড ও ৩য় খণ্ড (কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ১৯৮৭) থেকে। এরপর থেকে উদ্ধৃতি সূত্রনির্দেশ করতে, বইয়ের নাম, রচনাবলীর খণ্ড ও পৃষ্ঠা সংখ্যার উল্লেখ করা হবে। এ ছাড়া অন্য রচনাগুলির ক্ষেত্রে পুরো বিবরণই থাকবে। মনে এলো, ৩য়, পৃ. ১৩৬।

 ২. মনে এলো, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৩৭।

 ৩. ‘কেন লিখি’, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৫।

 ৪. ঝিলিমিলি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২১৭–১৮।

 ৫. মনে এলো, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৫।

 ৬. বক্তব্য, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৭।

 ৭. আমরা ও তাঁহারা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪।

 ৮. ওই, পৃ. ১১।

 ৯. ওই, পৃ. ১১।

 ১০. মনে এলো, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৪০–৪১।

 ১১. D P Mukerji, ‘Indian Tradition and Social Change’, Diversities (New Delhi : Peoples Publishing House, 1958), পৃ. ২২৮–৪১।

 ১২. ওই, পৃ. ২৪০।

 ১৩. D P Mukerji, Personality and the Social Sciences (Calcutta : The Book Company, 1924); Basic Concepts in Sociology (London : Kegan Paul, 1932).

 ১৪. ‘Indian Tradition and Social Change’, পৃ. ২৩৫।

 ১৫. Personality and the Social Sciences, পৃ. ২।

 ১৬. Basic Concepts in Sociology, পৃ. ৩৫।

 ১৭. D P Mukerji, Modern Indian Culture : A Sociological Study (Bombay : Hind Kitabs, 1948).

 ১৮. ওই, পৃ. ২১৪–১৫।

 ১৯. ‘Indian Tradition and Social Change’, পৃ. ২৩২।

 ২০. ‘Philosophy of Indian History’, Diversities, পৃ. ১২৩।

 ২১. D P Mukerji, Tagore : A Study (Calcutta : Manisha, [1943] 1972).

 ২২. ওই, পৃ. ৬০।

 ২৩. আমরা ও তাঁহারা, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০।

 ২৪. ওই, পৃ. ১৫।

 ২৫. ওই, পৃ. ১৬।

 ২৬. চিন্তয়সি, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮।

 ২৭. ওই, পৃ. ১৯, ২১।

 ২৮. ওই, পৃ. ৬০।

 ২৯. ওই, পৃ. ৬১।

 ৩০. Rabindranath Tagore, Personality (London : Macmillan, 1917), পৃ. ৫০–৫১; চিন্তয়সি, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭২।

 ৩১. বক্তব্য, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯–১০।

 ৩২. ওই, পৃ. ১৫।

 ৩৩. ওই, পৃ. ১৬।

 ৩৪. ওই, পৃ. ১৬।

 ৩৫. ওই, পৃ. ১৭; নজরটান আরোপিত।

 ৩৬. ওই, পৃ. ২১।

 ৩৭. ওই, পৃ. ২১।

 ৩৮. ওই, পৃ. ২১।

 ৩৯. ওই, পৃ. ২৬।

 ৪০. ওই, পৃ. ২৬।

 ৪১. আমরা ও তাঁহারা, ২য় খণ্ড, পৃ. ৮৪।

 ৪২. সুর ও সঙ্গতি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৫৭।

 ৪৩. ওই, পৃ. ৫৮–৬০।

 ৪৪. ওই, পৃ. ৫৬।

 ৪৫. ওই, পৃ. ১৯।

 ৪৬. কথা ও সুর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬৯।

 ৪৭. ওই, পৃ. ৬৯।

 ৪৮. ওই, পৃ. ৬৯–৭০।

 ৪৯. সুর ও সঙ্গতি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬১।

 ৫০. কথা ও সুর, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৭৮–৭৯।

 ৫১. ঝিলিমিলি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৮৮।

 ৫২. ওই, পৃ. ২১৮।

 ৫৩. বক্তব্য, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮০–৮১।

 ৫৪. ঝিলিমিলি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২১৭।

 ৫৫. অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৬৬০।

 ৫৬. চিন্তয়সি, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৬-৬৭।

 ৫৭. ‘বৈঠকখানা ও সমাজ’, অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৯১।

 ৫৮. ওই, পৃ. ২১৮।

 ৫৯. ওই, পৃ. ২৯৩।

 ৬০. ওই, পৃ. ২৯৫।

 ৬১. ওই, পৃ. ২৯৬।

 ৬২. ওই, পৃ. ২৯৭।

 ৬৩. ‘কেন লিখি’, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৫।

 ৬৪. ঝিলিমিলি, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২১৭–১৮।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন