প্রদীপ বসু
বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্বচর্চার প্রথম অধ্যায় : উনিশ শতক
ভারতবর্ষে নৃতাত্ত্বিক আলোচনার একদম প্রথমদিকের পরিচয় রয়েছে এই অধ্যায়ে।১ উনিশ শতকে প্রকাশিত বাংলা পত্রপত্রিকায় শুধুমাত্র ভারতীয় জাতিগুলিই নয়, দেশ-বিদেশের নানা জাতির নিয়ম, রীতি, আচার, অনুষ্ঠান, ধর্ম, দৈনন্দিন জীবনের পরিচয় পাঠকদের কাছে বর্ণিত হয়েছে বেশ আকর্ষক ভাষায়। এর মধ্যে যেমন আছে ভারতবর্ষের কুকি, টোডা, চণ্ডাল, রামুসি, সাঁওতাল, কোলি এবং আন্দামানবাসী জাতিরা, সেইরকম রয়েছে পলিনেশিয়া, তিব্বত, আফগান প্রভৃতি দেশের জাতিগুলির কথা। সাঁওতালদের উৎপত্তি বিষয়ক কথা আলোচিত হয়েছে, ‘সাঁওতালদিগের সৃষ্টি প্রকরণাদি বিষয়ক প্রবাদাবলী’ রচনায়। ১৮৭২ সালে প্রকাশিত এই রচনা নিঃসন্দেহে এ বিষয়ে প্রকাশিত প্রথম রচনা।২ এ ছাড়া প্রকাশিত হয়েছে উলকি, বেশভূষা, সম্ভাষণ, সৌন্দর্য বিষয়ক প্রবন্ধ, দেশভেদে মানুষের সৌন্দর্যের ধারণা, বিভিন্ন জাতির কেশসজ্জা-প্রভৃতির পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে পাঠকের কাছে।
অবশ্যই উদ্দেশ্য ছিল মনুষ্য সমাজ সম্বন্ধে বাঙালি পাঠকের জ্ঞানের পরিধিকে প্রসারিত করা, কিছুটা তার মনোরঞ্জন করাও। রহস্য-সন্দর্ভ-এর লেখক লিখেছেন যে, সাধ্য থাকলে ‘আমরা একবার ভূমণ্ডলের সর্বত্র ভ্রমণ করিয়া কত দেশের নীতি রীতির বিবরণ প্রত্যক্ষ করত পাঠকদিগের মনোরঞ্জন করিতে পারিতাম। কত বিদ্যা, কত কৌশল, কত নৈসর্গিক আশ্চর্য্য পদার্থ দেখিয়া জ্ঞান ও সাধারণের ঐহিক মঙ্গলের বৃদ্ধি করিতে সক্ষম হইতাম।’৩ নৃতত্ত্বচর্চার প্রাথমিক স্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর তথাকথিত অভিনব বা আশ্চর্য প্রথা বর্ণনার একটা ঝোঁক দেখা যায়, সেই ঝোঁক থেকে এই রচনাগুলিও মুক্ত নয়। এই নৃতাত্ত্বিক চর্চার সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ভ্রমণ-সাহিত্যের রীতিনীতির, যেখানে আশ্চর্য এবং অভিনব বস্তুর বর্ণনা দিয়ে পাঠকের মনোরঞ্জনের একটা প্রচেষ্টা সবসময় দেখা যায়। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিয়ে কিছুটা আগ্রহ এবং কিছুটা কৌতূহল এই সময় বাঙালি সমাজে দেখা যায়। নব্যভারত-এর লেখক লিখেছেন ‘আন্তর্জাতীয় প্রদর্শনী উপলক্ষে আন্দামান ও নিকোবরবাসী কতিপয় কলিকাতায় আনীত হইয়াছিল। আলিপুর প্রাণি বাটিকায় উহাদের বাসস্থান প্রদত্ত হয়। এই অভিনব মনুষ্যদিগকে দেখিবার জন্য কলিকাতা ও উহার চতুঃপার্শ্ববর্ত্তী গ্রাম এবং বহু দূর হইতে সহস্র সহস্র মনুষ্যের সমাগম হইত। এমনকি, বঙ্গ সমাজের দূষিত অবরোধ প্রথার কঠোর অনুশাসনে যে সকল পুরসুন্দরীরা, কখনও কোন অভিনব বস্তু দেখিতে গৃহের নির্দিষ্ট সীমার বাহিরে পদার্পণ করেন নাই, তাঁহারাও এই অবসরে আপন আপন গুরুজনের তত্ত্বাবধানে উহাদিগকে দেখিয়া বিশেষ আনন্দ লাভ করিয়াছেন।’৪ বস্তুত আন্দামানবাসীদের প্রতি বাঙালিদের এই উৎসাহ দেখেই লেখক এদের বিষয়ে লিখতে মনস্থ করেন যাতে ‘যাঁহারা উল্লিখিত মনুষ্য কখনই দেখেন নাই এবং উহাদের বিষয়ে কিছুই অবগত নহেন, আশাকরি ইহা তাঁহাদের কিছু উপকারে আসিবে।’৫ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত অন্য রচনার উদ্দেশ্য সম্বন্ধেও এই একই কথা প্রযোজ্য।
প্রকাশিত অনেক রচনাই ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লেখা প্রবন্ধের বঙ্গানুবাদ। অনেক সময় রচনাগুলি যে আদতে ইংরেজ পাঠক-পাঠিকাদের উদ্দেশে লেখা সেটাও গোপন থাকেনি। যেমন অস্ট্রেলিয়া দ্বীপবাসীদের বিবাহরীতির বিবরণ দিতে গিয়ে লেখক বলছেন যে এই রীতি ‘শ্বেতাঙ্গ মহিলামণ্ডলে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠাযোগ্য হইবেক না।’৬ এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। রচনাগুলি যে সময়ের, সেই সময় ইউরোপে নৃতত্ত্বচর্চা বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চাইছে। এই নৃতত্ত্ব যেমন বস্তুনিষ্ঠ বিবরণে আগ্রহী, তেমনি অন্যান্য বিজ্ঞানের অনুসরণে মানুষের নানাবিধ দৈহিক মাপজোকের ভিত্তিতে শ্রেণিকরণ করতেও সচেষ্ট। প্রকাশিত লেখাগুলি সেই সময়ের নৃতাত্ত্বিক রচনারীতি অনুসরণেই লেখা। জাতিগুলির আলোচনায় তাদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য, উচ্চতা, বর্ণ, চুলের রং ও প্রকার, স্ত্রী ও পুরুষের দৈহিক বৈশিষ্ট্যভেদ, এই সকল বিবরণ যেমন আছে, সেই সঙ্গে আছে সেই জাতিগুলির জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান ও নিয়মরীতির বিবরণ এবং অনেক সময় কিছু অভিনব বা ‘আশ্চর্য্য প্রথার’ নমুনা। রচনার ভঙ্গি আপাতনিরপেক্ষ এবং বিবরণাত্মক। বিভিন্ন জাতিসমূহকে প্রচলিত বিবর্তনবাদী তত্ত্বানুসারে অসভ্য এবং সভ্য হিসেবে ভাগ করা হয়েছে, অসভ্য ও সভ্যের মধ্যে বিভিন্ন স্তরবিভাগেরও এক পরোক্ষ অনুমান রয়েছে। অসভ্যতার মাপকাঠিও যে কত ভিন্ন, প্রকাশিত রচনাগুলি থেকে তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে। যেমন একটি হল বিবাহপ্রথা। বঙ্গমহিলা পত্রিকায় বলাই হয়েছে অসভ্য জাতিদের যে রকম বিবাহপ্রথা দেখা যায় ‘পশুর সহিত তাহাদের অল্প প্রভেদ . . . তাহারা প্রকৃত দাম্পত্য প্রণয় কাহাকে বলে জানে না। কেবল ইন্দ্রিয় তুষ্টি বিবাহের একমাত্র উদ্দেশ্য বলিয়া মনে করে।’ এই কারণেই মালাবারের নায়ারদের অসভ্যদের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে, কারণ, ‘এই জাতির স্ত্রীদিগের গর্ভে যে সকল সন্তান হয়, তাহাদের সহিত বিবাহকর্ত্তার কোন সম্পর্ক নাই।’ অন্যদিকে আন্দামানবাসীরা অসভ্য হলে কি হবে ‘বস্তুঃত এই অসভ্য জাতির মধ্যে সতীত্বের যেরূপ আদর, অনেক সভ্য জাতির মধ্যে সে রূপ নাই।’৭
বেশ কিছু রচনা আছে যাকে আমরা আজকের পরিভাষায় ‘তুলনামূলক নৃতত্ত্ব’ বলতে পারি। বেশভূষা, কেশচর্চা, সম্ভাষণ, উলকি, সৌন্দর্যবোধ বিষয়ক রচনাগুলি মূলত তুলনামূলক রচনাই।৮ সেই সময়ের নৃতত্ত্বচর্চায় বিবর্তনবাদী ধারা অনুসারে ধরেই নেওয়া হত যে, যারা চর্চার বিষয়, সভ্যতার মাপকাঠিতে তাদের অবস্থান যাঁরা তাদের নিয়ে চর্চা করছেন তাদের চেয়ে অনেক নিচু এবং অসভ্য জাতিদের সভ্য করার দায়িত্ব তথাকথিত সভ্য জাতিদের উপর বর্তেছে। এই রচনাগুলিও সেই বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত নয়, মিশনারি এবং ইংরেজ জাতিদের সভ্যকরণ প্রচেষ্টার জয়গান অনেক রচনায় চোখে পড়বে। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রমী রচনাও আছে। যেমন বেশভূষার আলোচনয় লেখক বলেছেন, ‘প্রত্যেকে দেশেই এক এক ভিন্ন পরিচ্ছদ; তাহা ধারণ না করিলে তদ্দেশীয়দিগের মনে সৌন্দর্য্যের হানি ও কুপ্রথার অনুসরণ অনুভূত হয়; ইহাতেই পরিচ্ছদ দ্বারা জাতির নিরূপণ হয়; কেবল নব্য বাঙ্গালীরা এই নিয়মের আয়ত্ত নহে। ইহাদিগের মধ্যে সকল দেশের সকল পরিচ্ছদই প্রচলিত; কেহ ইংরেজি পাণ্টালুন, কেহ রাম-জামা, কেহ চীনে-কোট প্রভৃতি বিবিধ বস্ত্রে তাহারা বহুরূপার কনিষ্ঠ সহোদর হইয়া থাকেন . . . দুই ব্যক্তি বাঙ্গালীকে এক রূপ পরিচ্ছদে দেখা ভার; সকলেই স্ব স্ব প্রধান এবং সকলেই নূতন প্রথা প্রচলিত করিতেছেন, তাহাতে বিদেশীয়দিগের নিকট বাঙ্গালীরা যে কি পর্যন্ত হেয় হইতেছেন তাহার পূর্ণ বর্ণনা করা দুষ্কর।’৯ অথবা আফগান জাতীয় স্ত্রীদিগের অবস্থা এবং বিবাহরীতি প্রসঙ্গে নারীস্বাধীনতার আলোচনায় লেখক প্রথমেই বলে দিচ্ছেন : ‘যদি কোন কোন বিদ্যায় নবানুরাগিণী বিবিধার্থ-সংগ্রহ বিলাসিনী আমাদিগের প্রতি বিরক্তা হইতে পারেন তদাপি ইহা স্বীকার করিতে হইবেক যে এতদ্বিষয়ে বঙ্গদেশীয় অঙ্গনারা সর্ব্বতোভাবে নিকৃষ্টাবস্থায় পতিতা আছেন।’১০
নৃতত্ত্বচর্চার একটা নৈতিক দিক আছে এবং বিভিন্ন জাতির আচার-ব্যবহারের জ্ঞান থেকে নৈতিক শিক্ষাও নিতে হবে, এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক রচনায় দেখতে পাওয়া যাবে। অসভ্য জাতির নৈতিকতা এবং নৈতিকতার মান নিয়ে যেমন নানা রকম বিচার ও মন্তব্য আছে, সেই রকম বাঙালিদের নিয়েও কটূক্তি আছে। বেশভূষার উপর কোপ পড়েছে সব চেয়ে বেশি। যেমন বেশভূষার আলোচনায় বলা হয়েছে যে, ‘এতদ্দেশীয় অনেকে সভ্য পরিচ্ছদের প্রধান উদ্দেশ্য যে দেহাবরণ তাহা এককালে বিস্মৃত হইয়া স্বয়ং ও আপনাদিগের মহিলাদিগকে বায়ু হইতেও সূক্ষ্ম “সিমলে” ও “শান্তিপুরে”-দ্বারা আবৃত করেন; ইহাতে তাঁহারা সভ্যতা ও লজ্জা যে একেবারে জলাঞ্জলি দেন তাহা তাঁহাদিগের একবার মাত্র বোধ হয় না। ইহাতে বীর্য্যের হানি ও লাম্পট্যের বৃদ্ধিও ঘটিতেছে।’১১
রহস্য-সন্দর্ভ পত্রিকায় নৃত্য নিয়েও আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। দেশভেদে কোথাও নৃত্য সমাদৃত, আবার কোথাও নৃত্যের কোনো আদর নেই। লেখক বলেছেন আহ্লাদ প্রকাশের জন্য নৃত্য করা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম, আদিম জাতিরা আনন্দ উৎসবে, সব সময়েই নৃত্য করে থাকে। এই প্রসঙ্গেই লেখক বলেছেন : ‘নৃত্য স্বভাবসিদ্ধ হওয়াতে স্ত্রী-পুরুষ সকলেই নৃত্য দেখিতে বাসনা রাখেন এবং দেখিয়াও থাকেন। এই ক্ষণে বাঙালীরা সেই নৃত্য দুশ্চরিত্রা বেশ্যাদ্বারা নিষ্পন্ন করাইয়া থাকেন।’১২ অথচ নৃত্য আনন্দ, স্বাস্থ্য, বল এবং হৃদ্যতা সব কিছুরই বিকাশ করে, ফলে তা বঙ্গীয় সমাজে প্রচারিত হলে উপকারই হবে। লেখক প্রস্তাব দিয়েছেন ভারতের অন্য প্রদেশে স্ত্রীলোকেরা যেমন নৃত্য করেন এবং তার জন্য তারা কোনো মতে দূষণীয়া হন না, সেই রকম বাঙালিরাও ভদ্রগৃহে নৃত্যের প্রচলন করতে পারেন। এতে বঙ্গনারীরা ‘আপনি স্বামী ও পরিজনদের মনোমোহিনী হইবে সন্দেহ নাই।’১৩
বিবিধার্থ-সংগ্রহ ও রহস্য-সন্দর্ভ পত্রিকায় প্রকাশিত জাতি পরিচয় বিষয়ক প্রতিটি রচনার সঙ্গে মুদ্রিত হয়েছিল সুন্দর সব ছবি। সেই সব ছবির অধিকাংশের পুনর্মুদ্রণ এখানে আর সম্ভব হল না। ছবির প্রতিরূপে জাতিগুলির উপস্থাপনা কীভাবে হয়েছিল, তা-ও আজকের নৃতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয়বস্তু। সুতরাং সে ধারণা হয়তো পাঠকের হবে না, কিন্তু বাংলা ভাষায় একদম প্রথম যুগের নৃতত্ত্বচর্চা এবং তার অন্তর্নিহিত তত্ত্বের একটা ধারণা এই রচনাগুলি পড়লে নিশ্চয়ই হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
নৃতত্ত্বের বিষয়কে মোটামুটি যে তিনটি বিভাগে ভাগ করা হয়, তা হল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শারীরিক। নৃতত্ত্বের ইতিহাসে শারীরিক নৃতত্ত্বই প্রথমে নিজেকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস করে। শারীরিক মাপজোকের ভিত্তিতে মানুষের শ্রেণিবিন্যাস করাই ছিল এই প্রচেষ্টার ভিত্তি। এই বিষয়ে যাঁর কথা প্রথম উল্লেখ করা হয় তিনি হলেন জোহান ফ্রেইডরিশ ব্লুমেনবাখ (১৭৫২–১৮৪০), যিনি মুখমণ্ডল ও করোটির গঠনের ভিত্তিতে মানুষের শ্রেণিবিন্যাস করেছিলেন। বস্তুত তাঁকে করোটিতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। ব্লুমেনবাখের নৃতাত্ত্বিক রচনাসংগ্রহ ইংরাজি অনুবাদে প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে।১৪ তার আগেই অবশ্য বিবিধার্থ-সংগ্রহ পত্রিকায় ব্লুমেনবাখের তত্ত্ব প্রকাশিত হয়।১৫ গাত্রবর্ণ এবং করোটির গঠনে মাপকাঠিতে ব্লুমেনবাখ মানুষকে যে পাঁচটি গোষ্ঠীতে ভাগ করেছিলেন, তা হল ককেশীয়, মঙ্গোল, ইথিওপীয়, আমেরিক ও মালয়ন। এ বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বিবিধার্থ-সংগ্রহ-এর লেখক বলেছেন : ‘দেশভেদে মনুষ্যের আকৃতি, গঠন, বর্ণ এবং স্বভাবের বৈলক্ষণ্য হয়, এবং ওই সকল লক্ষণ সকল দৃষ্টে তাহাদিগের জাতিভেদ করা যায়। মনুষ্য মধ্যে এই লক্ষণ ভেদের কারণ অনেক পণ্ডিতেরা অনুসন্ধান করিয়াছেন, কিন্তু অদ্যাবধি তদ্বিষয়ের কোন মীমাংসা নাই।’১৬ নৃতত্ত্বে করোটিতত্ত্বের প্রভাব কিন্তু বেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়, করোটির মাপজোকের জন্য নতুন নতুন যন্ত্রপাতিই শুধু আবিষ্কৃত হয়নি, মাপজোকের নতুন পদ্ধতি এবং অন্য বিজ্ঞানের রীতিনীতি অনুযায়ী বিভিন্ন রেখা, অর্ধবৃত্ত, ও নানা সূচক উদ্ভাবিত হয়। বস্তুত করোটিতত্ত্বকে ভাবা হত সেই জাদুদণ্ড, যার মাধ্যমে সমস্ত নৃতাত্ত্বিক জটিলতার সমাধান হবে, কিন্তু ক্রমশ মানুষের শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন, পরিমাপ ও বিবরণ এই বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে কেশ, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, গাত্রবর্ণের প্রকার এই সবই নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয় ভ্রমণসাহিত্য, স্মৃতিচারণ, প্রতিবেদনধর্মী রচনা, খ্রিস্টধর্ম প্রচারক ও উপনিবেশে বসবাসকারীদের বিবরণের আধারে। ম্যালিনোস্কি সামাজিক নৃতত্ত্বকে ফিল্ড ওয়ার্কের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠা দিতে গিয়ে তাঁর রচিত ১৯১২ সালের একটি গ্রন্থে এই ধরনের রচনার উল্লেখ করে লেখেন : ‘এক সময় ছিল যখন নেটিভদের এক বিকৃত শিশুসুলভ ক্যারিকেচার আমাদের সহ্য করতে হত। কিন্তু এখন সেদিন শেষ হয়েছে।’ একই সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেন ‘নেটিভদের এই ছবি মিথ্যা এবং অন্যান্য মিথ্যার মতো এই মিথ্যাকেও বিজ্ঞান হত্যা করেছে।’১৭ মজার কথা হল ম্যালিনোস্কি এবং তাঁর পরবর্তী নৃতাত্ত্বিকদের রচনাশৈলী ভ্রমণসাহিত্যেরই অনুরূপ ছিল।১৮ ভ্রমণসাহিত্যে ব্যক্তিগত আখ্যান এবং নৈর্ব্যক্তিক বিবরণ, বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও নির্বিশেষ বর্ণনা এই দু-টি ভিন্ন ধারা প্রায়শই স্থান বদল করে চলতে থাকে। নৃতাত্ত্বিক রচনা কৌশলও তা-ই। সামাজিক নৃতত্ত্ব নিজেকে বিজ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা ও তার সন্নিহিত এই সম্পর্কিত পূর্ববর্তী রচনাগুলি থেকে পৃথক বিষয় রূপে গণ্য করার প্রচেষ্টা চালালেও এই সমস্ত রচনার কাছে নৃতত্ত্বের ঋণ অনেকখানি।
সুতরাং ঠিক অথবা ভুলের বিচারে না গিয়ে বাংলা ভাষার নৃতত্ত্বচর্চার গোড়াপত্তন যে রচনাগুলির মাধ্যমে হয়েছিল তার প্রবণতা, বিবরণের শৈলী, তাত্ত্বিক ঝোঁক, ঠিক কীরকম ছিল সেদিকে মনোযোগ দিলে এই নৃতত্ত্বের মূল্যায়ন অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে। যে বিভিন্ন ধারার সমন্বয় এই রচনাগুলিতে ঘটেছে তা হল, প্রাকৃতিক ইতিহাস, শারীরিক নৃতত্ত্ব, সামাজিক নৃতত্ত্বচর্চা, যা সেই সময় সীমাবদ্ধ ছিল বিবাহ, মৃত্যু এবং বিশেষ কিছু আচার-আচরণ, প্রথা ও উৎসবের বিবরণে, তুলনামূলক নৃতত্ত্ব এবং এক ধরনের বিবর্তনবাদী চিন্তাধারায়, যার মাধ্যমে বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীকে সভ্য এবং অসভ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হত। বিবর্তনবাদী অনুমান প্রাকৃতিক ইতিহাস রচনার ধারার মধ্যেই রয়েছে, যদিও বিবাহের প্রকার, আচার-অনুষ্ঠান ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের ভিত্তিতেও উন্নত/অনুন্নত, সভ্য/অসভ্য মানুষ চিহ্নিত হয়েছে। মানুষের প্রাকৃতিক ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে বিবিধার্থ-সংগ্রহ-এর লেখক লিখেছেন : ‘যদি মনুষ্য জাতি সভ্যতার ভিন্ন ভিন্ন সোপানে সমারূঢ় হইয়াছে, তত্রাপি তাহারা পৃথিবীস্থ অন্য সকল প্রাণী হইতে আপনাদের উৎকৃষ্টত্ব সংস্থাপন করিয়া আসিতেছে।’১৯ অর্থাৎ প্রকৃতির বিভিন্ন সোপানে বিভিন্ন প্রাণীর অবস্থান, যার মধ্যে মানুষের অবস্থান সবচেয়ে উঁচুতে। আবার মানুষের মধ্যেও সভ্যতার মাপকাঠি অনুযায়ী উঁচু নিচু আছে। সামগ্রিকভাবে উনিশ শতকে নৃতত্ত্বের মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রাকৃতিক ইতিহাস, শারীরিক বৈশিষ্ট্য, ধর্ম ও অন্য প্রথার আধারে মানুষের বিভিন্ন গোষ্ঠীকে বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপে বিন্যস্ত করা। ইউরোপে বিবর্তনতত্ত্বের কেন্দ্রে ছিল ‘প্রগতি’ সম্বন্ধে এক বিশেষ ধারণা। স্পেন্সার (১৮২০–১৯০৪) তাঁর তত্ত্বে বিবর্তনবাদ ও প্রগতির মধ্যে বিশেষ পার্থক্য খুঁজে পাননি। বিভিন্ন ধর্মের বিবর্তনের যে ধাপগুলির বিবরণ স্পেন্সার দিয়েছেন, তার প্রায় একদম নীচে হল হিন্দু ধর্ম এবং উপরে প্রোটেস্টান্ট ধর্ম। তারও উপরে ডিইজম-এর অবস্থান, যাতে স্পেন্সার নিজে বিশ্বাসী ছিলেন। ‘আদিম’ ধর্ম থেকে ‘সভ্য’ ধর্মের এই যে বিবর্তনের ধাপ তার মূলে কিন্তু ওই একই প্রগতির ধারণা, যে মানুষ কুসংস্কার ও আদিম বর্বর অনুষ্ঠানের অন্ধকারাচ্ছন্ন ধর্ম থেকে ক্রমশ যুক্তির পথে উন্নীত হচ্ছে। স্পেন্সারের সমসাময়িক নৃতত্ত্ববিদ টাইলারও মোটামুটি একইভাবে বিবর্তনের ছক রচনা করেন। বিবর্তনবাদী তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, এই তত্ত্বে শিশু ও আদিম মানুষের সদৃশতা; আদিম স্তরে মানুষ হল এক শিশুর মতো, যে তার শিশুকালে নানাবিধ উদ্ভট কল্পনা ও জাদুতে বিশ্বাস করে, বয়ঃসন্ধিতে তা ধর্মবিশ্বাসে রূপান্তরিত হয় এবং তা পূর্ণতাপ্রাপ্ত হলে পরিণত হয় বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারায়। এই শিশুসম আদিম মানুষ কোনো কোনো নৃতাত্ত্বিক বয়ানে দুষ্ট আবার কোনো কোনো বয়ানে নিষ্পাপ। উনিশ শতকের নৃতত্ত্বকে যে ‘উপনিবেশের সন্তান’ বলা হয় তার একটা কারণ হল, উপনিবেশের প্রসারের ফলেই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পরিচয় সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্যসংগ্রহ সম্ভব হয়। এর সঙ্গে যোগ করা উচিত যে, বিবর্তনবাদ উপনিবেশবাদের এক নৈতিক বৈধতার ভিত্তিও সঙ্গে সঙ্গে তৈরি করে দেয়। উপনিবেশ এইসব মানুষদের সভ্য করে তুলবে, প্রগতির পথে নিয়ে যাবে, এই হল উপনিবেশকারীর ‘সিভিলাইজিং মিশন’।
নব্যভারত-এ আন্দামানবাসীদের আলোচনায় বলা হয়েছে অভাবই মানুষের সভ্যতা ও উন্নতির আদি জননী। যে ‘বিশ্ববিজয়ী বৃটিশ জাতির কতিপয় সুসন্তান হতভাগ্য অধঃপতিত ও ঘোর দুর্দশাগ্রস্ত ভারতভূমির বক্ষের উপর বাস করিয়া কৃপার ভিখারি ভারতবাসীকে সুশিক্ষা ও সভ্যতার অমৃতস্বাদ উপভোগ করাইতে একান্ত যত্নবান কতিপয় শতাব্দী পূর্বে তাঁহাদের পূর্বপুরুষগণের কিরূপ অবস্থা ছিল?’ বৃক্ষছাল ও পশুচর্ম এদের পোশাক ছিল, ফলমূল, নরমাংস এদের আহার ছিল, কিন্তু অভাবের সঙ্গে ঘোর সংগ্রাম করে ইংরেজরা ‘উন্নতি ও প্রভুতার মহাসিংহাসনে অধিরোপণ করিয়াছেন।’ অন্যদিকে ‘অজ্ঞানান্ধকারাচ্ছন্ন আন্দামান-বাসীগণের শিখিবার কি আছে? তাহারা অভাব অনুভব করিতে জানে না, জন্মিয়া অবধি তাহারা একই অবস্থায় সন্তুষ্ট থাকে। নতুন কিছু শিক্ষা করিতে তাহাদের প্রয়োজন হয় না। বিশ্বজননী প্রকৃতি প্রতিদিন তাহাদিগকে যাহা স্বহস্তে দান করিতেছেন, তাহারা তাহাতেই পরিতৃপ্ত।’ এদের স্বভাবও শিশুর মতো। ‘ইহারা স্বভাবঃত অতিশয় সরল, ইহাদের প্রশান্ত ও গম্ভীর মুখশ্রী দর্শন করিলেই বোধ হয়, সরলতা ইহাদের জাতীয় প্রধান গুণ; কিন্তু ইহারা সহসা উত্তেজিত হইয়া থাকে’, এবং উত্তেজিত হলে এরা ‘তৎক্ষণাৎ অত্যাচারীকে দীর্ঘ লৌহ-ফলক বিশিষ্ট তীক্ষ্ণধার তীর বিদ্ধ করিয়া অপমানের প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’ এই আদিম জাতিদের জগৎ সহজ-সরল, অনাড়ম্বর, কিন্তু সভ্য মানুষের কাছে কিছুটা আশঙ্কারও বটে, কারণ এদের কাছে কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার আশা করা যায় না। এরা সত্যবাদী, ভুল করেও মিথ্যা কথা বলে না, ‘মিথ্যা কথা বলিয়া কোনওরূপ স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজন হয় না বলিয়া ইহারা মিথ্যা কথা বলে না’, সাহসী, আমোদপ্রমোদ প্রিয়, অর্থাৎ চরিত্রগুণের দিক থেকে মহৎ, নৃতাত্ত্বিক ভাষায় যাকে বলা হয় ‘নোবল স্যাভেজ’, কিন্তু যে সব বৈশিষ্ট্যের মাপকাঠিতে সভ্যতা নির্ধারিত হয়, সেই সব বিষয়ে পশ্চাদপদ। যেমন ‘ইহারা অতি কদর্য গৃহে বাস করে এবং উহার নির্মাণপ্রণালী নিতান্ত কুৎসিৎ’, এদের কোনো ধর্ম নেই, ‘ঈশ্বর কে, এবং ঈশ্বর বলিয়া কেহ আছেন কিনা, তাহা তাহারা জানে না এবং তাহারা পরিবর্ত্তে অপর কোনও দেবতা বা কোনও শক্তিমান পদার্থের উপাসনা করে না’, ভাষা ‘নিতান্ত অসম্পূর্ণ এবং বাক্যকথন প্রণালী অতিশয় কর্কশ’, এমনকী এদের কোনো সমাজও নেই, ‘ইহাদের মধ্যে কোনও গ্রাম নাই এবং ইহারা পরস্পর সমাজবদ্ধ হইয়া বাস করে না’, ‘সংখ্যাগণনা, কাল নির্ণয় আপন আপন বয়স নিরূপণ এবং কে কোথা হইতে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহাও উহারা অবগত নহে। ইহারা কিছু না জানিয়াই পরম সুখী-অজ্ঞান অবস্থাই ইহাদের সুখের কারণ।’ অবশ্যই ইংরেজদের প্রচেষ্টায় এরা একদিন সভ্য হবে, কিন্তু সুখী হবে কি? এই সংশয় ও বিতর্ক পরবর্তী সময়ে নৃতাত্ত্বিক আলোচনায় বার বার এসেছে। আন্দামানবাসীদের প্রসঙ্গে লেখক লিখেছেন : ‘আজি যাহারা অজ্ঞানতাজনিত বিমল সুখে বিভোর হইয়া সর্বদা নাচিয়া গাইয়া, হাসিয়া খেলিয়া দিন যাপন করিতেছে, সভ্যতার কঠোর দিনে আর তাহারা তেমন সুখ পাইবে না, তখন তাহারা ক্ষতি লাভ গণনায় তৎপর জগতের শত অত্যাচারে উৎপীড়িত ও শত অসুখী হইয়া স্ব-স্ব অভাব ও উচ্চাভিলাষের সহিত তুমুল সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইবে এবং তখন তাহারা মানুষ হইতে শিখিবে।’২০ এ-ও সেই শিশুকালের সুখ, আনন্দ, আহ্লাদকে অতিক্রম করে সাবালকত্ব অর্জন করার মূল্য প্রদান।
এই নৃতাত্ত্বিক রচনাগুলির একটি প্রধান উপাদান হল জাতিগুলির শারীরিক আকার, গঠন প্রণালী ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের বিবরণ। আগেই বলেছি শারীরিক নৃতত্ত্ব এক নতুন বিজ্ঞান হিসাবে উনিশ শতকে স্বীকৃতি লাভ করে, ফলে শরীর সম্বন্ধীয় তথ্য যে মানুষের ‘বিজ্ঞানসম্মত’ আলোচনায় প্রাধান্য পাবে এটাই স্বাভাবিক। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জাতিগুলির জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ-বিষয়ক আচার-আচরণের বর্ণনা, ভাষার বিবরণ, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশভূষা, বাসগৃহ, আমোদপ্রমোদ, স্বভাবচরিত্রের বিবরণ। বস্তুত এই ছিল মানব বিজ্ঞান বা ‘এথনোলজি’র ধারা, যার ভিত্তি স্থাপিত হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। ডালটন তাঁর Descriptive Ethnology of Bengal (১৮৭২) গ্রন্থ এই ধারা অনুসারেই রচনা করেন।২১ এই গ্রন্থের ভূমিকায় ডালটন লিখেছেন যে ১৮৬৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে কলকাতায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রজাতির মানুষের এক প্রদর্শনীর পরিকল্পনা হয়, কিন্তু শেষ অবধি তা করা যায়নি এই কারণে যে, এইসব ‘অদ্ভুত ভীরু জীব’দের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া নিয়ে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। তখন ডালটন মনস্থ করেন তিনি জাতিগুলির যে বিবরণ লিখবেন তা প্রায় চাক্ষুষ দেখার সমতুল্য হবে। পরবর্তী সময়ে কলকাতায় আন্দামান ও নিকোবরবাসীদের নিয়ে যে একটি প্রদর্শনী হয়েছিল এবং এদের দেখার জন্য প্রতিদিন যে ‘সহস্র সহস্র মনুষ্যের সমাগম হইত’ সে কথা এই অধ্যায়েই আলোচিত হয়েছে।২২ যে শারীরিক আকার ও গঠন প্রণালীর বিবরণ দিয়ে এই রচনাগুলি সাধারণত আরম্ভ হত, তার দু-টি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে পারি। সংক্ষিপ্ত বিবরণের প্রকার এইরকম : ‘(কুকিরা) অপরাপর পার্ব্বত্য লোকের ন্যায় খর্বকায়, দ্রঢ়িষ্ঠ, বলিষ্ঠ ও পরিশ্রমী এবং পূর্ব্ব-দেশীয় অন্যান্য লোকবৎ নতনাসিকা, ক্ষুদ্রচক্ষু ও বত্তুÍল সদৃশ মুখবিশিষ্ট।’২৩ আরও বিস্তারিত বিবরণের নিদর্শন পাওয়া যায় আন্দামানবাসীদের বিবরণে : ‘এই জাতীয় পূর্ণবয়স্ক ও দীর্ঘাবয়ব পুরুষের দৈর্ঘ্য ৫ ফিট, বক্ষস্থলের বেষ্টন ২ ফিট ৯ ইঞ্চ, স্ত্রীর দৈর্ঘ্য ৪ ফিট ৯ ইঞ্চ, বক্ষস্থলের বেষ্টন ২ ফিট ৭ ইঞ্চ। ইহারা ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ- আফ্রিকার নিগ্রোদিগের অপেক্ষা গাঢ়তর। ইহাদের শরীর সুদৃঢ় ও সবল; মস্তক অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং পশমের ন্যায় কোমল ও সঙ্কোচশীল কটাবর্ণের এক প্রকার অতি অপরূপ অনতিদীর্ঘ জটিল চুলে আবৃত। মনুষ্যের মস্তকে এরূপ কেশ পূর্ব্বে আর কখনও দৃষ্ট হয় নাই; কোনও পশুর গাত্রজাত লোমও এরূপ নহে। আমাদের দেশীয় উড়িয়াদের ন্যায় উহারা মস্তকের কতকাংশের কেশ মুণ্ডন করে বলিয়া উহা অতি কুৎসিত দেখায়। ইহাদের চক্ষু কিয়ৎপরিমাণে বৃহৎ উজ্জ্বল এবং দেখিতে অতি সুশ্রী, গ্রীবা ক্ষুদ্র ও ঈষৎ স্থূল; মুখে গোঁফ দাড়ির লেশমাত্র নাই, এই জন্য এবং আকারের খর্ব্বতা প্রযুক্ত পূর্ণবয়স্ক যুবকদিগকে অল্পবয়স্ক বলিয়া বোধ হয়।’২৪ শারীরিক আকার, গঠন, গাত্রবর্ণ, মুখাবয়ব দ্বারা নির্ধারিত শ্রেণিবিন্যাসে যেমন ব্লুমেনবাখের প্রভাব দেখা যায়, সেই রকমই আবার ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগুলিকে আর্য ও অনার্য এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিন্যাস করতেও দেখা যায়। কোনো জাতি কোন গোষ্ঠীভুক্ত তাতে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ ছাড়াও ভাষা একটি অতিরিক্ত প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভারতবর্ষে কোল, ভীল, গোণ্ড, সাঁওতাল, গারো, কুকি এবং অন্যান্য অরণ্যজাতিরা যে অনার্য বংশের প্রশাখামাত্র, কারণ ‘তাহাদের অঙ্গসৌষ্ঠব ও মুখশ্রী ককেশীয় জাতীয়ের ন্যায় সুদৃশ্য নহে। তাহারা প্রায় সকলেই খর্ব্বকায় ও কৃষ্ণবর্ণ। তাহাদের মুখ চেপ্টা, নাসিকা অনুন্নত ও স্থূল, এবং নাসারন্ধ অতিবৃহৎ। বিশেষত তাহাদের ভাষা পর্যালোচনা করিলে তাহাদিগকে কোন মতে ককেশীয় শ্রেণীমধ্যে পরিগণিত করা যাইতে পারে না।’২৫ বলা বাহুল্য এখানে আর্য ও ককেশীয় জাতি এক শ্রেণিভুক্ত।
প্রাকৃতিক ইতিহাসের ধারা অনুযায়ী এই রচনাগুলিতে যেমন আলোচিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মানবজাতির মধ্যে সম্বন্ধ, শরীর ও গঠনের সঙ্গে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য এবং সেই অনুযায়ী মানবজাতিগুলির শ্রেণিকরণ ও স্তরবিন্যাস, একই সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে তাদের বিভিন্ন সামাজিক ক্রিয়াকলাপের বিবরণের মাধ্যমে জাতিগুলির সামাজিক পরিচয়। অবশ্য এর মধ্যে অভিনব প্রথা বর্ণনার ঝোঁক কিছুটা লক্ষ করা যাবে। একটি কারণ নিশ্চয়ই রচনাগুলিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা, কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল দেশের মানুষের সংকীর্ণ নিজ-সমাজকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও প্রসারিত করা। এখানেও সামাজিক নৃতত্ত্বচর্চার সঙ্গে ভ্রমণসাহিত্যের এক বিশেষ অবদান আছে। সঞ্জীবচন্দ্রের পালামৌ তো এ বিষয়ে এক অতি পরিচিত রচনা।২৬ ১৮৫৪ সালে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর ধারাবাহিক ‘ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র’ রচনায় পূর্ববাংলার গ্রাম, জাতি, উপজাতি, আহার, সামাজিক ক্রিয়া ইত্যাদির অত্যন্ত মনোজ্ঞ বিবরণ দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গেই তিনি চট্টগ্রামে ‘পর্ব্বতীয় জাতিসমূহ, আহার-বিহার, বিবাহ-পদ্ধতি, ধর্ম্ম’ ইত্যাদিও আলোচনা করেছেন।২৭ বিভিন্ন জাতির বিবাহ পদ্ধতির বিবরণে যেমন ভীলদের কন্যা অপহরণের কথা আছে। ‘নির্বিঘ্নে কন্যাপহরণ হইলে ঐ বিবাহ মঙ্গলদায়ক নচেৎ অমঙ্গলজনক জ্ঞান করে’,২৮ সেই রকম ‘উদ্বাহ ক্রিয়ায় কুকিদের বিশেষ প্রথা এই যে বরকর্ত্তা কন্যাকর্ত্তার নিকট স্বকীয় পুত্রের সাহস, সংগ্রামপ্রিয়তা, চৌর্যনৈপুণ্যের পরিচয় দেয়’,২৯ আবার অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপবাসীরা নিজেকে ভাবী স্ত্রীকে মনোনীত করার পর ‘সুযোগক্রমে গোপনে তাহার সন্নিধানে আগমন করে। পরে তাহার সহিত প্রীতি-গর্ভ-মিষ্ট-মধুরালাপ করার পরিবর্তে কাষ্ঠযষ্টি বা অন্যকোন কঠোর দণ্ডদ্বারা এককালে অচৈতন্য করিয়া ফেলে। তদনন্তর তাহাকে স্বজাতি মধ্যে আনিয়া বিবাহ করে। এতদর্থে তাহারা সর্ব্বদা যুদ্ধযাত্রায় প্রবৃত্ত থাকে।’৩০ বিবিধার্থ-সংগ্রহ-তে প্রকাশিত নৃতাত্ত্বিক রচনাগুলির বৈশিষ্ট্য হল বিবরণগুলি আপাত নিরপেক্ষ, বাস্তবানুগ প্রতিবেদনের ভঙ্গিতে লেখা। সাধারণভাবে তথ্য বিশ্লেষণ বা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার কোনো চেষ্টা এই রচনাগুলিতে করা হয়নি। অন্যদিকে বঙ্গমহিলা পত্রিকায় প্রকাশিত ‘অসভ্যজাতির বিবাহ প্রথা’ প্রবন্ধের প্রাথমিক অবস্থানই হল আধুনিক দাম্পত্য প্রণয়, একগামিতা, ইত্যাদি একমাত্র স্বাভাবিক ও সভ্য বিবাহপ্রথা, বাকি বিবাহ পদ্ধতি অসভ্য পর্যায়ভুক্ত। ‘যে সকল জাতি অসভ্যতার সর্ব্বনীচ পদবীতে অবস্থান করিতেছে, তাহারা বিবাহ যে কি পদার্থ তাহা অবগত নহে। . . . যে সকল অসভ্যজাতির মধ্যে উদ্বাহপ্রথা প্রচলিত আছে, তাহারা প্রকৃত দাম্পত্য প্রণয় কাহাকে বলে তাহা জানে না, কেবল ইন্দ্রিয়তুষ্টিই বিবাহের একমাত্র উদ্দেশ্য বলিয়া মনে করে।’ মালাবারের নায়ারদের মাতৃকৌলিক প্রথার উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, এই বিবাহ প্রথা ‘অতিশয় জঘন্য’, ‘এরূপ হলে স্ত্রী পুরুষের বিবাহ যে কেন দেওয়া হয় তাহা বুঝিতে পারা যায় না।’৩১ আবার আন্দামানবাসীরা একদম অসভ্য হলে কী হবে, অন্য এক প্রবন্ধে তাদের বিবাহ পদ্ধতি সম্বন্ধে লেখকের সপ্রশংস উক্তি হল : ‘ইহাদের মধ্যে বাল্যবিবাহ প্রচলিত নাই। বিবাহের কোনও বিশুদ্ধ প্রথা প্রচলিত না থাকিলেও এই অজ্ঞান ও অসভ্যদিগের মধ্যে যে প্রণালী বিদ্যমান আছে তাহা বিশেষ প্রশংসনীয়। স্ত্রীর ইচ্ছার উপর নির্ভর করে এবং তাহার ইচ্ছানুসারেই বিবাহ কার্য্য সম্পাদিত হয়।’৩২ এখানে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, নিজের সমাজের বাল্যবিবাহের প্রথার সঙ্গে তুলনা করেই লেখকের এই প্রশংসাবাণী। সামাজিক নৃতত্ত্বচর্চার আরও পরিপক্ক দৃষ্টান্ত হল ‘সাঁওতালদিগের ব্যবহারাবলী’ প্রবন্ধটি। এখানে লেখক সাঁওতালদের জীবনধারার ছয়টি প্রধান কর্তব্যক্রিয়া আলোচনা করেছেন। এগুলি হল : পরিবারে গ্রহণ, গোষ্ঠীভুক্ত করণ, জাতিতে গ্রহণ, বিবাহ, মরণ এবং জীবনান্তে পূর্বপুরুষগণের সঙ্গে মিলন।৩৩ কোনো একটি জাতির জীবনধারার প্রতিটি পর্যায়ের বর্ণনা ভারতের নৃতাত্ত্বিক চর্চায় আজও বহাল আছে।
উনিশ শতকের নৃতত্ত্বচর্চার দু-টি দিক আছে। একটি হল অন্য সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে মানুষকে আরও বেশি উদার ও সহনশীল করে তোলা, অন্যদিকটি হল নানাবিধ তত্ত্ব, তথ্য, ও ‘বিজ্ঞান’-এর মাধ্যমে মানবজাতিগুলির স্তরবিন্যাস করে তাদের বিভিন্ন সোপানভুক্ত করা। ভারতবর্ষের জাতি ব্যবস্থায় শুদ্ধতা ও অশুদ্ধতার ভিত্তিতে এই স্তরবিন্যাস অনেকদিন থেকেই প্রচলিত। ফলে এই নৃতাত্ত্বিক স্তরবিন্যাস দেশের নৃতত্ত্বচর্চা নিজের মতো করে আত্মসাৎ করে নেয় এবং তার প্রতিফলন এই রচনাগুলিতেও আছে। কিন্তু আবার তুলনামূলক নৃতত্ত্বের প্রয়োগে দেশের মানুষের সংকীর্ণ, কূপমণ্ডুক, নিজ-সমাজকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করার উদ্যোগ অনেক রচনায় দেখতে পাওয়া যাবে। লক্ষ করতে হবে এখানে বিষয়গুলি নির্ধারিত হয়েছে দৈনন্দিন জীবন থেকে, যেমন বেশভূষা, কেশচর্চা, বা সৌন্দর্যের ধারণা। এই ধরনের দৃষ্টান্তের মাধ্যমে আরও ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর কাছে সরাসরি পৌঁছে যাওয়া যেতে পারে। এই বিষয়ের রচনাগুলি লেখা হয়েছে বেশ সরসভঙ্গিতে, হালকা চালে। সৌন্দর্য বিষয়ে যেমন লেখা হয়েছে : ‘হিন্দুরা অণ্ডাকৃতি মুখই সর্ব্বোত্তম বলিয়া থাকেন; কিন্তু চীনদেশীয়রা তাদৃশ মুখবিশিষ্টাকে “ঘোড়ামুখী” বলিয়া গোলাকার “শরামুখীর” অনুরাগে গদগদ-চিত্ত হয়েন, এবং এস্কুইম জাতীয়েরা তদুভয়ের পরিহরণ করিয়া বর্তুলাকার “মালসামুখীর” অনুসরণ করিয়া থাকেন।’৩৪ সৌন্দর্যের ধারণা যে দেশ ও কাল নির্ভর একথা নানা দৃষ্টান্ত দিয়ে বোঝানো হয়েছে : ‘প্রাচীন সংস্কৃত কবিরা “বিম্বোষ্ঠ” “বিদ্রুমোষ্ঠ” তথা “মুক্তা-দন্ত” ও “কুন্দ-দন্তের” মহিমা বর্ণনে গদগদচিত্ত হইতেন; ইদানীন্তনীয় বিলাসবতীদিগের মিসি-ঘর্ষিত ভ্রমর-গঞ্জক নিবিড়কৃষ্ণোষ্ঠ ও দন্ত দেখিলে তাঁহাদের মনে সৌন্দর্যের কি ব্যাঘাত ঘটিত? আরব দেশীয় ললনারা নীল ওষ্ঠের অনুরাগিণী। কাফরী রমণীরা স্থূল ওষ্ঠের লালসায় সর্ব্বদা অধর টানিয়া লোলাইত করেন।’৩৫ সামাজিক ধ্যানধারণার যে আপেক্ষিক সেই আলোচনার একটা পরোক্ষ ইঙ্গিত এ-ও ছিল যে, দেশের প্রথা, আচার এগুলিও কোনো অনড় অটল নিয়মাধীন নয়, সমাজের পক্ষে সব সময় আবশ্যকও নয়, বরং পরিবর্তনীয় এবং বেশ কিছু প্রথার পরিবর্তন করলে সমাজের উপকারই হবে।
এই মনোভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত নৃতত্ত্বচর্চার আর একটি ইতিবাচক দিক প্রতিফলিত হয়েছে এই বিশ্বাসে যে, উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সব মানুষেরই সমানভাবে বিকশিত হবার ক্ষমতা আছে। বিবিধার্থ-সংগ্রহ-তে প্রকাশিত ‘চণ্ডাল জাতি’ রচনাটি এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। খেয়াল করলে দেখা যাবে চণ্ডাল জাতি সম্বন্ধে এই রচনাটি অন্যান্য জাতি পরিচয় সম্পর্কিত রচনাগুলি থেকে একটু পৃথক। অন্যান্য জাতি পরিচয়ের বিবরণ যেমন রচিত হয়েছে শরীরের গঠন, জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ এবং ভাষার পরিচয় দিয়ে, এখানে লেখক বরং ভারতীয় জাতি ব্যবস্থার আলোচনা, বর্ণসংকর জাতির উৎপাদন এবং শাস্ত্র অনুযায়ী জাতিগুলির অবস্থান পর্যালোচনা করেছেন। চণ্ডাল জাতির হীন অবস্থান বিবরণ দিয়ে লেখক বলেছেন, এরা যে অবস্থার উন্নতি করতে পারে না তার কারণ এদের বিদ্যাশিক্ষার এবং ধন উপার্জনের কোনো সুযোগ নেই। যাদের মানসিক প্রবৃত্তিও আছে তারাও সুযোগ অভাবে এবং ‘অভ্যাসাভাবে’ পূর্বাবস্থায় থেকে যায়। এইসব চণ্ডালরা ‘সকলেই অত্যন্ত অধমাবস্থাতে দিন যাপন করিতেছে। একথা বলায় আমাদিগের এমত অভিপ্রায় নহে যে চণ্ডালদিগের আর ভদ্র হইবার উপায় নাই; প্রত্যুত তাহারা অন্যান্য মনুষ্যের ন্যায় সুখস্বচ্ছন্দে থাকিয়া বিদ্যাভ্যাস করিলে অন্যের ন্যায় ভদ্র হইতে পারে। জগৎপিতা সকল মনুষ্যকে তুল্য করিয়াছেন, সকলেই সমান মানসিক শক্তিপ্রাপ্ত হইয়াছে; অতএব ওই শক্তির ওই তুল্য আলোচনা করিলে যে সকলে তুল্য হইবে ইহাতে সন্দেহ কি?’৩৬
শারীরিক নৃতত্ত্বের মাধ্যমে মানুষের শরীর থেকে নৃতত্ত্বের যাত্রা আরম্ভ হলেও নৃতত্ত্বের প্রশ্ন কিন্তু মানুষকে নিয়ে নয়, বরং সেই পরিসর নিয়ে যেখানে মানুষ সম্পর্কে এক সার্বিক ও সাধারণ জ্ঞান সম্ভব বলে ভাবা হয়। নৃতত্ত্ব এই পরিসর নিয়েই প্রশ্ন তোলে। আপেক্ষিতার আধারেই নৃতত্ত্ব এক সাধারণ মানব বিজ্ঞানের সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেয়। একভাবে দেখলে মনে হবে নৃতত্ত্ব অ-ঐতিহাসিক, কারণ এর বিষয়বস্তু হল সেই সব প্রাক-ঐতিহাসিক সমাজ বা সংস্কৃতি, যাদের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু আসলে এর শিকড় প্রোথিত আছে আধুনিক ইতিহাসেই। আধুনিক ইতিহাসই নৃতত্ত্বের জন্ম দিতে পারে। নৃতত্ত্বের অবস্থান মানুষ এবং তার ‘অন্যের’ মধ্যবর্তী পরিসরে এবং এই অবস্থান থেকেই নৃতত্ত্ব মানুষের সাধারণ সংজ্ঞা ও বিজ্ঞানের ধারণায় এক বড়ো ফাটল সৃষ্টি করে। ফলে ‘অন্য’ সমাজ সংস্কৃতি যেমন বৈধ হিসেবে বিবেচনার দাবি জানাতে পারে, সেই রকম ‘অন্য’ জ্ঞান ও অভ্যাস তার ন্যায্যতা ও উপযোগিতার স্বীকৃতি দাবি করতে পারে। দেশীয় চিকিৎসাবিদ্যা, জাতীয় স্বাস্থ্য বা সংক্রামক রোগের আলোচনায় দেখেছি যে, চিকিৎসাশাস্ত্রের মূল্যায়ন করা হয়েছে এক নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। ‘অন্য’ চিকিৎসাশাস্ত্রের উপযুক্ততার বিচার হয়েছে, দেশ, কাল, মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতির পরিসরে এবং তার বৈধতার দাবিও করা হয়েছে এই বিশেষ অনুষঙ্গের ভিত্তিতে। একথা অনেকাংশে সংগীত সম্পর্কেও প্রযোজ্য। ভাষার বিচরণ তো নৃতত্ত্বের আওতার মধ্যেই। দার্শনিক কান্ট নৃতত্ত্বের এক বিস্তৃত সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, নৃতত্ত্বের বিষয় হল মানুষকে সমস্ত কল্পনাসাধ্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা। বস্তুত নৃতত্ত্বকে দর্শনের এক বুনিয়াদি বিচার্য বিষয় হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাবও তিনি দিয়েছিলেন। কারণ, অন্য যে-সব প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজেছিলেন-যেমন, আমি কী জানতে পারি? আমার কী করা উচিত? আমি কী আশা করতে পারি? তাঁর মতে, এই সব ক-টি প্রশ্নকে একটি সাধারণ প্রশ্নে সীমিত করা যায় : মানুষ কী? মানুষের প্রাকৃতিক ইতিহাস এবং সামাজিক নৃতত্ত্ব এই প্রশ্নেরই উত্তর সীমিতভাবে অনুসন্ধান করেছে। উনিশ শতকে এই নৃতত্ত্বচর্চার একটি আশাব্যঞ্জক দিক ছিল মানুষের বিকাশের অপরিসীম সম্ভাবনার প্রতি আস্থা। বিবিধার্থ-সংগ্রহ-তে বলা হয়েছে পশুরা ‘স্বাভাবিক সংস্কার’-এর অধীন, কিন্তু মানুষ তা নয়। ‘মনুষ্যের জ্ঞান, শিক্ষা ও পরীক্ষার ফল।’ ‘মনুষ্য সর্ব্বত্র উন্নতীচ্ছুক হইবাতে স্থানভেদে সভ্যতারও অবস্থাভেদ হইয়াছে’ এবং এই উন্নতি নির্ভর করে মানুষের পরিশ্রম করার ইচ্ছায়। এইভাবে মানুষ কৃষি ও বাণিজ্যে নিজেদের নিয়োগ করেছে, নানা বিদ্যাতে মনোযোগ দিয়েছে ‘তথা পরস্পর সুশীলতা ও নম্রতা ও শিষ্টতা ও সৌজন্য প্রকাশ, ও বুদ্ধি ও জ্ঞান ও বিদ্যাদির আলোচনা করিতে যাহাদিগের যে প্রকার আগ্রহ হইয়াছে তাহারা তদ্রূপ সভ্যতা ও স্বচ্ছন্দতা ও সুখভোগ করিতেছে।’৩৭ এর অন্তর্নিহিত একটি অর্থ নিশ্চয়ই এই যে সঠিক পথে চললে এই সুখ ও স্বচ্ছন্দতা ভোগ আমাদের দেশবাসীদের পক্ষেও সম্ভব।
নৃতত্ত্ব বর্ণনার প্রথমদিকে আমরা উদ্ভট, অদ্ভুত, অভিনব সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করার ব্যাপারে একটা উৎসাহ লক্ষ করি। এর কারণ হল এই বর্ণনা অন্য সংস্কৃতিকে ইউরোপীয় সংস্কৃতি থেকে আলাদা করে দেয় এবং অন্যদের মানবসমাজের বিকাশের এক নিম্নস্তরে স্থান দেয়। এই ধারণা উপনিবেশিক ডিসকোর্সের পক্ষে খুব উপযোগী ছিল। কারণ এর ফলে সংস্কৃতির এক স্তরবিন্যাস করা যেত। সেই কারণেই পরবর্তী সময়ে নৃতত্ত্বের ক্রিটিকে পশ্চিমের ক্ষমতার প্রতিফলনের কথা বলেছেন অনেকে। যদিও অন্যদিকে নৃতত্ত্বের প্রবক্তারা বলেছেন এথনোগ্রাফি একটা গবেষণা পদ্ধতি ছাড়া কিছু নয়, যেখানে নৃতত্ত্ববিদ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অংশগ্রহণ করেন, পর্যবেক্ষণ করেন এবং যা তথ্য পান সংগ্রহ করেন। ক্রিটিকরা উত্তরে বলেছেন পর্যবেক্ষণ, শোনা, প্রশ্ন করা বা তথ্য সংগ্রহ করা কোনোটাই নিরপেক্ষ কাজ নয় এবং এর অবস্থিতি ডিসকোর্সের অনুমান ও বিধানের বাইরে নয়। বস্তুত জ্ঞানও এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নয়, যে জ্ঞান লাভ হচ্ছে তা নির্ভর করে কীভাবে সেই জ্ঞান প্রাপ্ত হল তার উপর। অন্যভাবে আমরা বলতে পারি, এথনোগ্রাফি সাংস্কৃতিক জ্ঞান ‘নির্মাণ’ করে, আবিষ্কার করে না। অনেক ক্রিটিক আরও এগিয়ে বলেছেন নৃতত্ত্ব শুধুমাত্র উপনিবেশবাদের সন্তান নয়, ‘যমজ’ও বটে।
নৃতত্ত্ববিদ জেমস ক্লিফোর্ড সাম্প্রতিক এক গ্রন্থে বলেছেন সংস্কৃতি সম্পর্কে যা লেখা হয়, তা বস্তুনিষ্ঠ তো নয়ই, নৃতাত্ত্বিক লেখাগুলি হল নির্মিত বিবরণ। এককথায় উদ্ভাবন ও বানানো গল্প।৩৮ এগুলি গল্প এইজন্য যে ঐতিহাসিকভাবে অবস্থিত সত্য সবসময় আংশিক সত্য হয়, এবং যিনি গল্প বলেন তিনি অন্য প্রেক্ষিত থেকে গল্পটিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। নীট্শে যেমন বলেছিলেন সমস্ত নির্মিত সত্য সম্ভব হয় শক্তিশালী বর্জন ও অলংকরণের ‘মিথ্যার’ সাহায্যে।৩৯ সুতরাং নৃতত্ত্ববিদ হলেন তাঁরা, যাঁরা পরম্পরাগতভাবে অন্য সংস্কৃতির গল্প বলার ক্ষমতা অর্জন করেছেন, সংস্কৃতির প্রকৃত সদস্যদের কন্ঠস্বর নীরব করে এবং এই ভান করে যে তাঁরা প্রামাণিক, বস্তুনিষ্ঠ গল্প একজন সর্বজ্ঞ হিসেবে বলছেন। আমরা বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্বচর্চার কথা যখন বলছি তখন এই দিকটাও মনে রাখতে হবে। কিন্তু যতই নৃতাত্ত্বিক লেখন নিরপেক্ষ হবার দাবি করে, বা হতে চায়, এই লেখন সবসময়ই ক্ষমতার অসাম্যের জালে আবদ্ধ, যা আবার নতুন ক্ষমতা সৃষ্টি করে। সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি নৃতত্ত্ববিদকে সবসময়ই আত্মসচেতন থাকতে হবে, যখন তিনি লিখবেন। তাঁকে ঐতিহাসিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, যে পরিস্থিতি তাঁকে অন্যদের সম্পর্কে এই লেখার কাজ দিয়েছে; সচেতন থাকতে হবে প্রতিযোগী বিবরণের সম্ভাবনা সম্পর্কে; সচেতন থাকতে হবে তিনি রচনা কীভাবে নির্মাণ করছেন সে ব্যাপারে, যাতে তিনি স্বীকার করতে পারেন এ হল তাঁর ব্যক্তিগত আখ্যান। বাংলা ভাষায় প্রথম পর্যায়ের নৃতত্ত্বচর্চার ক্ষেত্রে, এবং সাধারণভাবে সমস্ত নৃতত্ত্বচর্চার ক্ষেত্রেই, বিশ্লেষকদের এই সব ক-টি বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, তাহলেই এই বিদ্যার প্রকৃত ক্রিটিক নির্মাণ করা যাবে।
১. বিবিধার্থ-সংগ্রহ ও রহস্য-সন্দর্ভ পত্রিকা দু-টিতে প্রকাশিত নৃতাত্ত্বিক রচনাগুলি এবং উনিশ শতকের অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু নৃতত্ত্ব সম্বন্ধীয় রচনা সংকলিত হয়েছে এই বইটিতে : প্রদীপ বসু (সম্পা.), সাময়িকী : পুরনো সাময়িকপত্রের প্রবন্ধ সংকলন, প্রথম খণ্ড : বিজ্ঞান ও সমাজ (কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৯৮)। এই রচনায় ব্যবহৃত উদ্ধৃতিগুলি নেওয়া হয়েছে ওই সংকলন থেকে, যদিও পাঠকের সুবিধার জন্য মূল পত্রিকার নাম দেওয়া হয়েছে। উদ্ধৃতির পৃষ্ঠাসংখ্যা কিন্তু ওই সংকলন থেকেই।
২. ১৮৭০–৭১ সালে নরওয়েজীয় মিশনারি Rev. L O Skrefsrud কলিয়ান গুরুর শিষ্যদের থেকে শুনে সাঁওতালদের উৎপত্তি-কথা লিপিবদ্ধ করেন। রোমান হরফ ও সাঁওতালি ভাষায় লিখিত হড়কোরেন মারে হাপড়ামকো রেয়াঃক কথা নামে এই গ্রন্থটি অসলো থেকে ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি P O Bodding অনুবাদ করেন : Traditions and Institutions of Santals, Bulletin No. 6, Ethnograpnic Museum (Oslo : University of Oslo, 1942) এই নামে।
৩. ‘সৌন্দর্য্য কাহাকে বলে’, রহস্য-সন্দর্ভ, ২৬ খণ্ড, ১৯২২ সংবৎ (১৮৬৫), পৃ. ৪৪৭।
৪. ‘আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী’, নব্যভারত, আশ্বিন, অগ্রহায়ণ ১২৯০ বঙ্গাব্দ (১৮৮৩), পৃ. ৪১৫।
৫. ওই।
৬. ‘অস্ট্রেলিয়া-দ্বীপের আদিমবাসীদিগের বিবরণ’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, ফাল্গুন ১৭৭৯ শকাব্দ (১৮৫৭), পৃ. ৪২৮।
৭. ‘অসভ্যজাতির বিবাহ প্রথা’, বঙ্গমহিলা, আষাঢ় ১২৮৩ ব. (১৮৭৬) পৃ. ৪৪৪–৪৫।
৮. যেমন, ‘বেশ’, রহস্য-সন্দর্ভ, ১ম খণ্ড, ১৯১৯ সংবৎ (১৮৬২), পৃ. ৪৫২–৫৫; ‘দেশ-ভেদে অন্ত্যেষ্টি-ক্রিয়া ভেদ’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, কার্ত্তিক ১৭৭৫ শকাব্দ (১৮৫৩), পৃ. ৪৩৪–৩৬; ‘দেশ-ভেদে নমস্কার ভেদ’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, ভাদ্র ১৭৭৯ শকাব্দ (১৮৫৭), পৃ. ৪৩৬–৩৮; ‘কায়িক-সৌন্দর্য্য বিষয়ে জাতিভেদে মত-ভেদ’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, বৈশাখ ১৭৭৬ শকাব্দ (১৮৫৪), পৃ. ৪৪৫–৪৭; ‘সৌন্দর্য্য কাহাকে বলে?’, রহস্য-সন্দর্ভ, ২৬ খণ্ড, ১৯২২ সংবৎ (১৮৬৫), পৃ. ৪৪৭–৫০; ‘উলকী’, রহস্য-সন্দর্ভ, ৭৬ খণ্ড, ১২৭৯ বঙ্গাব্দ (১৮৭২), পৃ. ৪৫৫–৫৬।
৯. ‘বেশ’, রহস্য-সন্দর্ভ, ১ম খণ্ড, ১৯১৯ সংবৎ (১৮৬২), পৃ. ৪৫৫।
১০. ‘আফগান জাতীয় স্ত্রীদিগের অবস্থা এবং বিবাহ-রীতি’ বিবিধার্থ-সংগ্রহ, আষাঢ় ১৭৭৪ শকাব্দ (১৮৫২), পৃ. ৪৪২।
১১. ‘বেশ’, রহস্য-সন্দর্ভ, পৃ. ৪৫৫।
১২. ‘নৃত্য’, রহস্য-সন্দর্ভ, ১৩ খণ্ড, ১৯২০ সংবৎ (১৮৬৩), পৃ. ৪৫৮।
১৩. ওই, পৃ. ৪৫৮।
১৪. Thomas Bendyshe (ed. and transl.), The Anthropological Treatises of Johann Friedrich Blumenbach (London : Longman, Green, Longman, Roberts & Green, 1865).
১৫. ‘মনুষ্যের প্রাকৃতিক ইতিবৃত্ত’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, চৈত্র ১৭৭৩ শকাব্দ (১৮৫১), পৃ. ৩৯২–৯৫।
১৬. ওই, পৃ. ৩৯৩।
১৭. Bronislaw Malinowski, Argonauts of the Western Pacific (London : Routtedge 1922).
১৮. দ্রষ্টব্য : প্রদীপ বসু; ‘নৃতাত্ত্বিক রচনাশৈলী, ভ্রমণসাহিত্য এবং বিজ্ঞান’, লোকলৌকিক, ২ (৩–৪), ১৪০১।
১৯. ‘মনুষ্যের প্রাকৃতিক ইতিবৃত্ত’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, পৃ. ৩৯৪।
২০. ‘আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী’, নব্যভারত, আশ্বিন-অগ্রহায়ণ ১২৯০ ব. (১৮৮৩), পৃ. ৪১৮–১৯।
২১. E T Dalton, Descriptive Ethnology of Bengal (Calcutta : Office of the Superintendent of Government Printing, 1872).
২২. ‘আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী’, পৃ. ৪১৫।
২৩. ‘কুকি জাতির বিবরণ’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, চৈত্র ১৭৭৫ শকাব্দ (১৮৫৩), পৃ. ৩৯৯।
২৪. ‘আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী’, পৃ. ৪১৬।
২৫. ‘পতুয়াজাতি’, রহস্য-সন্দর্ভ, ৫৯ খণ্ড, ১৯২৭ সংবৎ (১৮৭০), পৃ. ৪০৯।
২৬. এ বিষয়ে দ্বিতীয় অধ্যায় ‘নৃতত্ত্ব ও ভ্রমণসাহিত্য : সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ দ্রষ্টব্য।
২৭. ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ঈশ্বরগুপ্ত রচনাবলী, ১ম খণ্ড, শান্তিকুমার দাশগুপ্ত ও হরিবন্ধু মুখুটি (সম্পা.) (কলকাতা : দত্তচৌধুরী এণ্ড সন্স, ১৩৮১)।
২৮. ‘ভীল জাতির বিবরণ’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, পৌষ ১৭৭৩ শকাব্দ (১৮৫১), পৃ. ৩৯৮।
২৯. ‘কুকি জাতির বিবরণ’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, চৈত্র ১৭৭৫ শকাব্দ (১৮৫৩), পৃ. ৩৯৯।
৩০. ‘অস্ট্রেলিয়া-দ্বীপের আদিমবাসীদিগের বিবরণ’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, ফাল্গুন ১৭৭৯ শকাব্দ (১৮৫৭), পৃ. ৪২৮।
৩১. ‘অসভ্যজাতির বিবাহ প্রথা’, বঙ্গমহিলা, আষাঢ় ১২৮৩ বঙ্গাব্দ (১৮৭৬), পৃ. ৪৪৪।
৩২. ‘আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী’, পৃ. ৪২০।
৩৩. ‘সাঁওতালদিগের ব্যবহারাবলী’, রহস্য-সন্দর্ভ, ৭২ খণ্ড, ১২৭৯ শকাব্দ (১৮৭২), পৃ. ৪১১–১৩।
৩৪. ‘সৌন্দর্য্য কাহাকে বলে?’, পৃ. ৪৪৭।
৩৫. ‘কায়িক-সৌন্দর্য্য বিষয়ে জাতিভেদে মত-ভেদ’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, বৈশাখ ১৭৭৬ শকাব্দ (১৮৫৪), পৃ. ৪৪৬।
৩৬. ‘চণ্ডাল-জাতি’, বিবিধার্থ-সংগ্রহ, কার্ত্তিক ১৭৮০ শকাব্দ (১৮৫৮), পৃ. ৪০৬।
৩৭. ‘মনুষ্যের প্রাকৃতিক ইতিবৃত্ত’, পৃ. ৩৯৫।
৩৮. James Clifford, ‘Introduction to Partial Truths’, in G Marcus and J Clifford (eds), Writing Culture : The Poetics and Politics of Ethnology (Berkeley : University of California Press, 1986).
৩৯. Friedrich Nietzsche, ‘On Truth and Falsity in their Ultramoral Sense (1873)’, in Early Greek Philosophy and Other Essays (London : Foulis, 1911).
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন