বাংলা সাময়িকপত্রে নৃতত্ত্বচর্চা : বিশ শতক

প্রদীপ বসু

বাংলা সাময়িকপত্রে নৃতত্ত্বচর্চা : বিশ শতক

১. জিজ্ঞাসু পাঠক, অনেকবিধ লেখক : বাংলা পত্রিকায় জাতি পরিচয়

বিশ শতকে বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্বচর্চা বিষয়-বৈচিত্র্যে আরও বিস্তৃতি লাভ করে। আদিবাসীদের জীবন, ইতিহাস, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যেমন আগ্রহ লক্ষ করা যায়, ঠিক তেমনি যাঁরা এদের নিয়ে লিখছেন তাঁদের মধ্যে শুধু পেশাদারদেরই দেখা পাচ্ছি না, দেখা পাচ্ছি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী অনেকেরই। এই পর্বের নৃতত্ত্বচর্চা সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল আমরা এবার পেশাদার, বিশেষজ্ঞ, নৃতাত্ত্বিকদের দেখা পাচ্ছি, যাঁরা বাংলা ভাষায় লিখছেন। এঁদের মধ্যে আছেন শরৎচন্দ্র রায় (১৮৭১–১৯৪২), বিরজাশঙ্কর গুহ (১৮৯৪–১৯৬১), নির্মলকুমার বসু (১৯০১–১৯৭২)। অন্যদিকে দেখছি প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালী (১৮৮৮–১৯৪৭), মনোবিকলন- তত্ত্ববিদ ও চিকিৎসক সরসীলাল সরকার (১৮৭৪–১৯৪৪), ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০–১৯৭৭), ছান্দসিক ঐতিহাসিক প্রবোধচন্দ্র সেন (১৮৯৬–১৯৮৬), বহুভাষাবিদ পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ (১৮৭৯–১৯৪০) প্রমুখ পণ্ডিতজনেরা আদিবাসী জীবনের নানাদিক নিয়ে বাংলা পত্রপত্রিকায় চর্চা করেছেন। এর থেকে প্রমাণিত হয় এইসব বিষয়ে সাধারণ পাঠকদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেটা আরও ভালোভাবে বোঝা যায় যখন দেখি সাহিত্যিক, কবি, সমাজসেবী, ঔপন্যাসিকরাও নিজেদের মতো করে এদের নিয়ে লিখছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে যাঁদের নাম আমরা উল্লেখ করতে পারি তাঁদের মধ্যে আছেন ঔপন্যাসিক ও সমাজসেবিকা স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫–১৯৩২), সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদার (১৮৭০–১৯২৯), সাহিত্যিক, সমাজসেবী, সম্পাদক হেমন্তকুমারী চৌধুরী (১৮৬৮–১৯৫০), প্রশাসক ও সাহিত্যিক সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৬৫–১৯৩১) প্রমুখ। এ ব্যাপারে যে পত্রিকাটি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে সেটি হল প্রবাসী; এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে ভারতী, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, মানসী ও মর্ম্মবাণী, সৌরভ প্রভৃতি পত্রিকারও।

প্রথমেই তাঁদের কথা বলি, যাঁরা পেশাদার নৃতাত্ত্বিক ছিলেন না বরং নিজেদের আগ্রহের কারণে বিভিন্ন জাতিদের বিবরণ লিখে গেছেন। এঁদের বিবরণের সঙ্গে নৃতাত্ত্বিকদের বিবরণের খুব যে একটা তফাত আছে এমন নয়। সাধারণভাবে এই বিবরণের একটা ছক আছে : চেহারা, রং, জীবনযাপন, বিবাহ, কাজকর্ম, নাচগান, এইসবই হল বিবরণের প্রধান উপাদান। অবশ্য এই বিবরণের পিছনে কিছুটা উহ্য রয়েছে সেই সময়ের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ডিসকোর্স, যা এই বিবরণগুলিকে বেঁধে রেখেছে। যদি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রথমে স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘নীলগিরির টোডা জাতি’ নামক লেখাটির কথা ধরি তাহলে দেখব লেখিকা শুরু করেছেন টোডাদের চেহারা, পোশাকের বর্ণনা দিয়ে, তারপর তাদের দৈনন্দিন অভ্যাস, রীতি-রেওয়াজের কথা বলেছেন, বিবরণ আছে তাদের বাসস্থান, কুটির, অর্থনৈতিক অবস্থা, নাচগান, বিশ্বাস এই সবকিছুরই। এক কথায় বলা যায়, সহজ ভাষায় টোডাদের এক পূর্ণাঙ্গ বিবরণ। গিরিবালা দেবী সিংভূমের কোলদের আরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। প্রায় পেশাদারদের মতো, নানাবিধ খুঁটিনাটি বিষয়ও তাঁর নজর এড়ায়নি। যেমন কোলদের বাসগৃহ : ‘ইহারা সমভূমি হইতে কিঞ্চিৎ উচ্চ এবং চারিদিকে ঢালুস্থানে পল্লি নির্মাণ করে। চারিদিকে ভূমি ঢালু থাকায় তাহাদিগের বাটীর নিকটে বৃষ্টির জল ও কর্দমাদি বড়ো দেখা যায় না। সুতরাং বর্ষাকালে তাহাদিগের বহুশ্রমসাধ্য ক্ষুদ্রকুটির সমূহের কোনো ক্ষতি হয় না। ইহাদের পল্লিগুলি স্বাভাবিক জলনির্গমনোপায় অতি সুন্দর।’ গিরিবালা দেবী তাঁর রচনায়, কোলদের ইতিহাস, ভাষা, শারীরিক গঠন, খাদ্যাভাস, রীতি-রেওয়াজ, কুসংস্কার, বিবাহ, সবকিছু বেশ বস্তুনিষ্ঠভাবে বর্ণনা করেছেন। এই ধরনের রচনার একটা দোষ হল বহু সময়ে লেখকের নিজের মতামত, বিশ্বাস রচনায় প্রবেশ করে বর্ণনাকে এক অন্য রং দেয়। গিরিবালা দেবী সে দোষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। গিরিবালা দেবী কোলদের সম্বন্ধে রচনার শেষে এমন এক কথা বলেছেন যা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কি না আমার জানা নেই। তিনি লিখেছেন : ‘আত্মহত্যার সংখ্যা ইহাদের মধ্যে অত্যন্ত অধিক। ইহারা মনে কোনোরূপ কষ্ট পাইলে এমনকি কাহারও সততা অথবা সত্যবাদিত্বে সন্দেহ করিলে আত্মহত্যা করিতে কিঞ্চিন্মাত্র কুন্ঠিত হয় না। স্ত্রীলোকদের অভিমান আরও বেশি। যৎসামান্য কথার জন্য মনে কষ্ট পাইলে ইহারা আত্মহত্যা করিতে প্রস্তুত। যদি স্বামী অথবা অন্য কোনো আত্মীয় কোনো কর্কশ কথা বলে, অথবা তিরস্কার করে, তবে সর্বদা যে হাস্যমুখী ও প্রফুল্ল সেও একেবারে ম্রিয়মাণা হইয়া পড়ে; এবং যদি শীঘ্র তাহার মনস্তুষ্টি না করা হয় তবে নিশ্চয়ই সে আত্মহত্যা করিয়া মনোকষ্ট দূর করে। শুনা যায়, একটি যুবতির প্রস্তুত খাদ্য তাহার পিতৃব্য খাইতে অস্বীকার করে। তাহাতে সে আত্মহত্যা করিবার জন্য বিষ পান করিয়াছিল।’

সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে কোল-সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায় ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ে লেখা ‘কোল জাতির সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে। তিনি বলেছেন আধুনিক কোল-জাতি সুপ্রাচীন দাক্ষিণ বা নিষাদ-জাতির বংশধর। ভাষাগত অল্পবিস্তর পার্থক্য ধরে এই জাতির গণ-সমূহকে যে প্রধান কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সাঁওতাল, মুন্ডারি-ভাষী মুন্ডা জাতি, হো, খাড়িয়া, ভূমিজ, শবর প্রভৃতি। তিনি লিখেছেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা অরণ্যবাসী কোলদের সম্বন্ধে খুব বেশি কৌতূহল দেখাননি। বাণভট্ট তাঁর শ্রীহর্ষচরিত গ্রন্থের অষ্টম উচ্ছ্বাসে জনৈক শবর যুবকের বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়া কোনো কোনো পুরাণে এদের মাঝে মাঝে উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘ইউরোপীয় বিদ্বজ্জনের কৌতূহল ইহাদের সম্বন্ধে আমাদের প্রথম নূতন করিয়া সচেতন করিয়া দিল, বিগত শতকের মধ্যভাগ হইতে। ইংরেজ রাজ্য স্থাপিত হওয়ার কিছু পরেই ছোটোনাগপুরে ইহাদের সংস্পর্শে ইংরেজ রাজপুরুষদের আসিতে হইল; এবং তৎপরে বিগত শতকের দ্বিতীয় অর্ধ হইতে খ্রিস্টীয় মিশনারিগণও ইহাদের মধ্যে আবির্ভূত হইলেন। তখন ইহাদের ভাষা রীতি-নীতি ধর্ম প্রভৃতির চর্চা আরম্ভ হইল। . . . ক্রমে বিদেশি মিশনারিদের দলের বাহিরে, আমাদের মধ্য হইতেই ইহাদের সম্বন্ধে দরদি অনুসন্ধিৎসু ও ইহাদের অকৃত্রিম বন্ধু বাহির হইলেন; কোল ও অন্য বন্য জাতিদের এইরূপ উদারহৃদয় প্রেমীদের মধ্যে রাঁচির স্বর্গীয় রায়বাহাদুর শরৎচন্দ্র রায় মহাশয়ের পুণ্য নাম প্রথম করিতে হয়। ইঁহার পূর্বে বাঙ্গালী সরকারি কর্মচারীদের কেহ-কেহ ইহাদের সম্বন্ধে সহানুভূতির দৃষ্টিতে আলোচনা করেন, যেমন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অগ্রজ সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-কোলদের বর্ণনা করিয়া লেখা ইঁহার সরস ভ্রমণ-কথা “পালামৌ” ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বাহির হয়।’ সুনীতিকুমার যেখানে এদের সাহিত্য, কবিতা, গল্প ইত্যাদির কথা বলেছেন, গিরিবালা, হয়ত নিজে মহিলা বলে, এদের বিবাহ নিয়ে কঠিন সমস্যার কথা বলেছেন। গিরিবালা দেবীর বিবরণ অনুযায়ী কোল রমণীদের বিবাহ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কারণ, কন্যার পিতামাতা বরের কাছ থেকে অত্যধিক পণ দাবি করে। তাই তিনি লিখেছেন : ‘অধিকাংশ কোল রমণীদিগের চির কৌমার্যে অতিবাহিত করিতে হয়।’ তিনি বলেছেন আগে পঞ্চাশ-ষাটটি গোরু পণ দিতে হত, পরে সেখানকার ডেপুটি কমিশনার কোল গ্রামের প্রধানদের একত্রিত করে স্থির করে দিয়েছিলেন যে পণ হবে একজোড়া বলদ, একটি গাই ও সাত টাকা। এর ফলে দরিদ্রদের মধ্যে বিয়ের প্রচলন বেড়েছে, কিন্তু ধনী ও মধ্যবিত্ত কোলেরা এই নিয়ম মানে না। তারা আগের নিয়মেই বিয়ের পণ আদায় করে থাকে। গিরিবালা লিখেছেন : ‘পণের এই কঠোর নিয়মবশত ইহাদের বিবাহ হওয়া বড় দুষ্কর, তজ্জন্য অনেক সুশ্রী কোল রমণীকেও অবিবাহিতা থাকিতে হয়। যদি কেহ তাহাদের সৌন্দর্যের বিষয় কখনও উল্লেখ করে-তবে তাহারা মুখখানি ম্লান করিয়া দুঃখের হাসি হাসিয়া বলে, “আমাদের যখন বিবাহই হইতেছে না, তখন আর এই সৌন্দর্যে কী ফল।”‘

প্রথম যুগে নৃতত্ত্বচর্চার ক্ষেত্রে পুরুষদেরই আধিপত্য ছিল। নৃতত্ত্বের বিবরণেও পুরুষকন্ঠই শোনা যেত। সেই দিক থেকে ভাবলে গিরিবালা, স্বর্ণকুমারী, হেমন্তকুমারী, এঁদের লেখার একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। আগেই বলেছি সেই সময়কার নৃতাত্ত্বিক বিবরণের যে ছক ছিল, তাঁরা মোটামুটি সেই ছকই অনুসরণ করেছেন, কিন্তু তাঁদের রচনায় এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ আছে যা হয়তো তাঁরা নারী বলেই লক্ষ করেছেন বা তাঁদের আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। স্বর্ণকুমারী যেমন টোডা মেয়েদের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন : ‘ফার্নহিল পাড়ায় দেখিলাম একজন স্ত্রীলোক একখানা লম্বা ভাঙা পাথরের শিল করিয়াছে, আর তাহার উপর একটা মোটা পাথরের টুকরা রাখিয়া তাহাই নোড়া করিয়া গম পিষিতেছে। শহর এত কাছে সেখান হইতে একটা জাঁতা আনিলেই আটা করিবার কত বেশি সুবিধা হয়-কিন্তু সেদিকে তাহাদের লক্ষ্য নাই।’ অথবা টোডা নারীদের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন : ‘সাধারণত যুবতিগণ বেশ ফিটফাট, সাজসজ্জার দিকে বিশেষ একটু মনোযোগী। সকলেরই সমুখের চুল বেশ পরিপাটি করিয়া আঁচড়ানো, হাত মুখ দাঁত মার্জিত পরিষ্কার, কেহ কেহ কেশগুচ্ছ কুঞ্চিত করিয়া মাথার মধ্যে গুঁজিয়া রাখিয়াছে, উপযুক্ত সময়ে ঝুলাইয়া দিবে, কাহারো অলক দ্বিধাযুক্ত সীমন্তের পার্শ্বে ও পৃষ্ঠদেশে আলম্বিত। কী করিয়া তাহারা চুল কোঁকড়ায় আমরা দেখিতে চাইলাম। একজন তাহার মাথায় গুটানো অলকগুচ্ছ খুলিয়া আবার আঙুলে জড়াইয়া দেখাইয়া দিল।’ হেমন্তকুমারী চৌধুরী প্রবন্ধ লিখেছেন খাসিয়া স্ত্রীজাতিদের নিয়েই।১০ এখানে যোগ করা প্রয়োজন যে, প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় মেয়েদের পত্রিকা অন্তঃপুর-এ। হেমন্তকুমারী প্রথমেই লেখেন : ‘খাসিয়া নারীগণ সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাহারাই গৃহসংসারের কর্ত্রী, কন্যাগণ পিতামাতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী। স্ত্রীলোকেরা পুরুষের ন্যায় প্রায় সকল কাজ করে, স্বাধীনভাবে সর্বত্র যাতায়াত করে। বিবাহ সম্বন্ধে পাত্রপাত্রীর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। ইহাদের মধ্যে বাল্যবিবাহ নাই। স্বামীর মৃত্যুর পর যখন ইচ্ছা স্ত্রীলোকে বিবাহ করিতে পারে।’১১ বেশ বোঝা যায় তাঁর এই লেখার লক্ষ্য ছিল অন্তঃপুর পত্রিকার বাঙালি পাঠিকা। তিনি এই পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন।

শুধু ঘরের কাছে কোল বা সাঁওতাল সম্বন্ধেই বাংলা ভাষায় লেখাপত্র প্রকাশিত হয়নি, কুকি, নাগা, গারো, রাভা, ত্রিপুরা রাজ্যের চাকমা, রিয়াং, ওড়িষ্যার ভুঁইয়া, জুয়াঙ্গ, খন্দ প্রভৃতি নিয়েও মনোজ্ঞ আলোচনা প্রকাশিত হয়। প্রথমে গারোদের কথা বলি। হরিপদ রায় ‘গারোদের কথা’ প্রবন্ধে গারোদের শারীরিক গঠন, পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, বাসস্থান, কৃষিকাজ, নৃত্য, বিবাহ, সৎকার প্রথা সবকিছুরই বর্ণনা দিয়েছেন।১২ নৃতাত্ত্বিক বিবরণ বা আখ্যানের একটি সমস্যা হল এই আখ্যান দুই ভিন্ন সংস্কৃতির সন্ধিস্থল। যিনি বিবরণ দিচ্ছেন বা আখ্যান রচনা করছেন তিনি এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে এসেছেন, আর যাদের সম্বন্ধে আখ্যান রচিত হচ্ছে তারা এক অন্য সংস্কৃতির মানুষ। তাই নৃতাত্ত্বিক বিবরণ নিরপেক্ষ হতে পারে না, যদিও এক সময় নৃতাত্ত্বিক রচনার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার কথা বলা হত। নৃতত্ত্ব নিজেকে বস্তুবাদী, নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় এই কারণেই যে, নৃতত্ত্ব নিজেকে বিজ্ঞান বলে সংজ্ঞায়িত করতে চায়। এইভাবে পেশাদারি নৃতত্ত্ব নিজেকে অপেশাদারদের দ্বারা লিখিত বর্ণনা, স্মৃতি, ভ্রমণসাহিত্য থেকে আলাদা করতে চায়। যদিও আমরা এই আলোচনায় দেখব বাংলা ভাষায় যখন লেখা হচ্ছে তখন লেখার গঠন, স্টাইল, রচনাশৈলী, রচনাপ্রণালী, রচনাভঙ্গি, প্রভৃতির দিক থেকে বস্তুত পেশাদার ও অপেশাদারদের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। কেন এমন হল এর আলোচনা এই বইয়ের নানা অধ্যায়ে করেছি। আমাদের আলোচনায় ফিরে এসে বলি, নিজেকে বিজ্ঞান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার ফলে এবং নিজেকে তার সন্নিহিত ও পূর্ববর্তী অন্যান্য রচনাগোত্রের থেকে পৃথক গণ্য করার ফলে নৃতত্ত্ব নিজের রচনার চরিত্র কিন্তু কোনোদিনই ভালোভাবে পরীক্ষা করেনি। অন্য রচনার বিরোধিতার প্রক্রিয়ায় নিজের বৈধকরণ করতে গিয়ে নৃতত্ত্ব এটাও কখনো ভালোভাবে দেখেনি যে, রচনাকৌশলের দিক থেকে নৃতত্ত্বের ঋণ এই সমস্ত রচনার কাছে কতখানি। নৃতত্ত্ব ভাবতে ভালোবাসে যে তার বিষয় ‘বাস্তব যে-রকম ঠিক সেইরকম’ ভাবে উপস্থিত করে, কারণ এটি হল বিজ্ঞান। অথচ নৃতত্ত্বও শেষ বিচারে এক ধরনের রচনা, যে রচনা তার বাচনিক কলাকৌশল, রূপকালংকার ইত্যাকার বিষয়াবলি ধার করেছে অন্য সাহিত্য থেকে। বাংলা ভাষায় লেখা নৃতাত্ত্বিক রচনার আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার হবে যে, যাঁরা পেশাদার নন, যাঁরা নিজের কৌতূহল বা আগ্রহের বশে এইসব জনজাতিদের নিয়ে লিখেছেন, কোনোভাবেই তাঁদের রচনা কম মূল্যবান নয়। অনেক সময় এইসব রচনায় তাঁদের নিজেদের বিশ্বাস বা মূল্যবোধ ঢুকে গেছে, কিন্তু মূলকথা হল এইসব ক্ষেত্রে সত্যিকারের নিরপেক্ষতা বলে কিছু হয় না। হরিপদ রায় যেমন লিখেছেন : ‘গারো পুরুষ অনেকটা সুশ্রী হইলেও গারো-রমণী দেখিতে ভয়ানক কুৎসিত। তাহারা স্থূল ও খর্বাকৃতি। তাহাদের মুখে কমনীয়তা নাই বলিলেই হয়।’১৩ টোডাদের সম্পর্কে যেমন স্বর্ণকুমারী লিখেছেন : ‘চেহারায় না হউক, ইহাদের বাসস্থলে, আচার-ব্যবহারে অনার্যত্ব অসভ্যত্ব প্রত্যক্ষ।’১৪ অথচ আমরা জানি সৌন্দর্য বা সভ্যতার ধারণা আমরা আমাদের সংস্কৃতি থেকে পাই, কিন্তু সেই মাপকাঠিকে সর্বত্র প্রয়োগ করার চেষ্টা করি।

গারোদের কথাতে ফিরে আসি। ‘গারো পল্লিতে একদিন’১৫ রচনার লেখক একজন রাজকর্মচারী কিন্তু নাম অজ্ঞাত। তিনি কাজে সুসঙ্গ পরগনায় গিয়েছিলেন এবং রচনাটি লিখেছেন অনেকটা ভ্রমণকাহিনির আদলে। এই রচনার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল গারোদের হাটের বর্ণনা। লিখেছেন : ‘গারো বালিকা এবং যুবতিতে বাজারখানা ভরপুর। যুবতি বিক্রয় করিতেছে, বালিকা ক্রয় করিতেছে। বালিকা বিক্রয় করিতেছে, যুবতি ক্রয় করিতেছে; যেন এ গিরি-প্রাচীর অভ্যন্তরে আসিয়া এক অভিনব স্বর্গীয় স্বাধীনতা শিক্ষা সভ্যতা ও স্ত্রী-স্বাধীনতার লীলাভূমি বৃটেনের স্বাধীনতাকে ধিক্কার দিয়া এক অভিনব স্ত্রী-স্বাধীনতার রাজ্য সৃষ্টি করিয়াছে।’১৬ গারো মেয়েদের পরিচ্ছদ সম্বন্ধে হরিপদ রায় বলেছেন এরা সবুজ বা সাদা ডোরা দাগ দেওয়া পনেরো ইঞ্চি প্রশস্ত লাল কাপড় পরে। এই কাপড় তাদের কটিতট অবেষ্টন করে থাকে, এদের উরুদেশ তাতে ঢাকা থাকে না। অজ্ঞাতনামী লেখকও বাজারে ক্রয়বিক্রয়রত মেয়েদের বস্ত্র সম্বন্ধে বলছেন এক হাত বহরের মতো কাপড় ‘রমণীগণ নাভির নিম্নে কটিদেশের চতুর্দিকে ঘেরিয়া পরিধান করে। উহা রমণীগণের জানু স্পর্শ করিতে কদাপি অধিকারী। তাহারা অন্যান্য অঙ্গে প্রায় কোন প্রকার বস্ত্র ব্যবহার করে না। তাহাতে সাক্ষাৎকালে আমরাই লজ্জা বোধ করিলাম বটে কিন্তু তাহারা অণুমাত্রও লজ্জিত বা সংকোচিত হইল না।’১৭ আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে লেখা এই বিবরণে আমরা গারোদের হাট সম্পর্কে অনেক তথ্য পাই। লেখক লিখেছেন এই হাটে শিল্পজাত, কৃষিজাত দুইরকমের পণ্যই বিক্রি হয়। কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে রয়েছে ধান, চাল, কলাই, ফুটি, আলু, তরমুজ প্রভৃতি; অন্যদিকে শিল্পজাত পণ্যের মধ্যে আছে কাপড়, ছালা, কাপড়ের থলি, বাঁশের দরমা, বেতের জিনিস, ইত্যাদি। লেখক বলেছেন বাজারে পশুপাখিও যথেষ্ট বিক্রি হয়, যেমন হরিণ, শুয়োর, ময়ূর, ময়না, মদনা, টিয়া প্রভৃতি। এ ছাড়া লেখক লিখেছেন : ‘বাজারে উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে পচা মৎস্যের আমদানিই খুব বেশি। যে কোনো স্থানের অবিক্রিত মৎস্য, বিক্রেতেরা পচাইয়া ভঙ্গের হাটে বিক্রয় করিতে লইয়া যায়। পচা মৎস্য গারোদিগের বড়োই প্রিয়।’১৮ অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি বাঙালি পাঠক অন্য জাতিদের দৈনন্দিন জীবন, সংস্কৃতি, বিবাহ, শোক, উৎসব নিয়েই শুধু জানতে পারছেন না, তাদের অর্থনীতি, ব্যাবসা, কেনাবেচা, লেনদেন সম্পর্কেও অবগত হচ্ছেন। নৃতত্ত্ব এইভাবে মানুষকে চেনার পরিধি অনেক বিস্তৃত করে দেয়।

টোডাদের বাসস্থানের কথা বলতে গিয়ে স্বর্ণকুমারী বলেছেন, এ এক ‘হীন আদিম’ অবস্থা। তিনি লিখেছেন : ‘কুটিরের আকার ধনুকাকৃতি, তিন দিক বন্ধ, এক দিক একটুখানি খোলা; একেবারে গুড়িসুড়ি না মারিয়া সেই অতিনিম্ন দ্বারপথে গৃহপ্রবেশ করা যায় না। দ্বারের কাছে বসিয়াও মাথা নীচু করিয়া উকি মারিয়া তবে গৃহমধ্যে আমাদের নজরে পড়িল। কুটির মধ্যে একদিকে একটুখানি রোয়াক, তাহাই শয়নস্থল, অন্যদিকে উনুনের কাছে বাসনকোসন প্রভৃতি সাজানো।’১৯ অন্যদিকে মোহাম্মদ মোদব্বের ‘নীলগিরির পাহাড়িয়া জাতি’ সম্পর্কিত রচনায় লিখছেন : ‘এরূপ দেখা গিয়াছে যে ইহারা উন্নত শ্রেণির মানুষের ন্যায় নিজেদের আবাসস্থল উচ্চ প্রাচীর দিয়া ঘিরিয়া রাখে।’২০ তাঁর টোডাদের বাসস্থল ‘অদ্ভুত’ মনে হয়েছে, ‘আদিম’ মনে হয়নি। তিনি লিখেছেন : ‘টোডাদের গৃহ নির্মাণের ধারা অদ্ভুত রকমের। মাটির উপর খড়-পাতার চাল তোলা হয় এবং সে চাল ডিম্বাকৃতি হইয়া চারিদিকে মাটি স্পর্শ করে। ভিতরে প্রবেশের পথ ১ হাত হইতে ২ হাত মাত্র প্রশস্ত। এই পথে হামাগুড়ি দিয়া গৃহে প্রবেশ করিতে হয়। গৃহগুলি দরজা-জানালা বিহীন। গৃহের অভ্যন্তরে-যে স্থানটিতে শয়ন করা হয়-তাহা মাটি দিয়া উঁচু করিয়া গাঁথা। এই উঁচু বেদির একপার্শ্বে তাহারা তাহাদের রন্ধন-কার্য সারিয়া লয়।’২১ বেশ বোঝা যায় আসলে নৃতাত্ত্বিক বিবরণ এক আখ্যান, এই বিবরণে আছে নানা দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ। গারোদের ঠিক পাশেই অপেক্ষাকৃত সমতলভূমিতে রাভা জাতির বাসস্থান। এদের বিবরণ দিয়েছেন গোপালচন্দ্র নিয়োগী। সাধারণভাবে সেই সময়কার বাঙালি লেখকদের মধ্যে আদিবাসী সমাজে নারীর স্থান, বিবাহ প্রথা, বিধবা বিবাহ, এইসব নিয়ে কৌতূহল ছিল। হয়তো নিজের সমাজের সঙ্গে একটা তুলনামূলক বিচারও করতে তাঁরা আগ্রহী ছিলেন। রাভাদের সম্বন্ধে লেখক লিখেছেন : ‘ইহাদিগের মধ্যে বিধবা-বিবাহ প্রচলিত আছে। যে-কোনো বিধবা তাহার দেবরকে বিবাহ করিতে পারে, ভাসুরকে পারে না। রাভাদিগের মধ্যে বিবাহভঙ্গের প্রথাও আছে। স্বামী স্ত্রী উভয়ের সম্মতি থাকিলে বিবাহভঙ্গে কোনো অসুবিধা নাই কিন্তু স্বামী ইচ্ছা করিয়া স্ত্রী ত্যাগ করিলে তাহাকে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কিছু টাকা দিতে হয়। বিবাহ ভঙ্গের পর সে পত্যন্তর গ্রহণ করিতে পারে। ইহাদিগের মধ্যে বহুবিবাহ ক্বচিৎ দেখা যায়।’২২ যেকোনো নৃতাত্ত্বিক বিবরণ পাঠকের নিজের সমাজের দর্পণ হিসেবে কাজ করে। অন্য সমাজ, সংস্কৃতি, জীবনের কথা শুনে মানুষ যেমন নিজেদের দোষত্রুটির কথা বুঝতে পারে, তেমনি তার সমাজের ইতিবাচক দিকগুলিও হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। ইতিহাস যেমন রচিত হয় বর্তমানকে কেন্দ্র করে, বর্তমানের পরিবেশই যেমন মানুষকে ইতিহাস অনুসন্ধানের দিকে নিয়ে যায়, বর্তমানই এককথায় ইতিহাসকে নির্ধারিত করে। নৃতত্ত্বের ক্ষেত্রেও আমরা একই কথা বলতে পারি। যে সমাজের মানষ নৃতাত্ত্বিক বিবরণ রচনা করে, পরোক্ষভাবে সেই বিবরণে লেখকের সমাজের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, উদবেগ, সংকটের ছায়াও পড়ে। সেইদিক থেকে আমরা বলতে পারি নৃতাত্ত্বিক বিবরণ বস্তুত দু-টি সমাজের বিবরণ, একটি প্রত্যক্ষ এবং অন্যটি পরোক্ষ।২৩

এই সময়ের পত্রপত্রিকাতেও কিছু লেখা প্রকাশিত হত, যা মূলত ইংরেজি লেখার অনুবাদ বা ইংরেজিতে লিখিত নৃতাত্ত্বিক বিবরণ-নির্ভর। আমরা দেখেছি এই পর্যায়ে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যা লেখকের নিজের পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। আগেই বলেছি পেশাদার বা অপেশাদার, যেই এই বিবরণগুলি লিখুন না কেন, মোটামুটি এক ধরনের ডিসকোর্স রচনায় অনুসরণ কর হত। তবে পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে নিজের দেশের অন্য মানুষদের নিয়ে যে রচনা তার বুনটের মধ্যে রয়ে যায় নানাবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপাদান, যা নৃতত্ত্বের ডিসকোর্সের চরিত্র বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। অন্যদিকে ইংরেজি অনুবাদের চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এই রচনার উৎস ইউরোপ, এই রচনা যে রীতি পদ্ধতি বিশ্বাস সংস্কারকে অবলম্বন করে রচিত হয়েছে তার ভিত্তিও আলাদা। কিন্তু এই অনুবাদগুলি পত্রপত্রিকায় যে সন্নিবেশিত হত তার কারণ বোধহয় বিষয় সম্পর্কিত আকর্ষণীয়তা এবং রচনার অপ্রতুলতা। যেমন আসামের উত্তর-পূর্ব অংশে বসবাসকারী মিশমি জাতির বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে প্রবাসী পত্রিকায়, মূলত ই টি ডালটনের Descriptive Ethnology of Bengal (১৮৭২) বইটি থেকে অনুবাদ করে, সেই রকমই ডালটন থেকে সংগৃহীত করে নাগাদের সম্বন্ধেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে।২৩ এই লেখাগুলি প্রকাশিত হয় বিশ শতকের শুরুতে। ক্রমশ আমরা দেখতে পাই বাঙালি লেখকরা নিজেই এই জাতিগুলি সম্বন্ধে লিখতে ও জানতে আগ্রহী হয়ে পড়েন।

নাগা ও কুকি নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ লক্ষ করা যায়। সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র ছিলেন, প্রাদেশিক সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে চাকরিজীবনে প্রথমে ডেপুটি কালেক্টর ও পরে ইনকামট্যাক্স বিভাগের ডেপুটি কমিশনার হয়েছিলেন। তিনি কর্মসূত্রে নাগারাজ্যে কয়েক বছর ছিলেন এবং এ বিষয়ে সৌরভ পত্রিকায় লিখেছিলেন।২৪ ‘নাগারাজ্যে কয়েক বৎসর’ নামক রচনায় তিনি কোহিমা থেকে মককচঙ্গ যাত্রার বিবরণ দিয়েছেন। আজকের দিনে যাঁরা ওই অঞ্চলে গিয়েছেন তাঁদের অনেকেরই এই যাত্রার বিবরণ ভালো লাগবে। সুরেন্দ্রনাথ কোহিমা থেকে যাত্রা করে তৃতীয় দিবসে ডিমাপুর পৌঁছোন। ডিমাপুর থেকে রাতে আসাম আপ মেল ধরে পরের দিন ভোর বেলা নকাছাড়ি পৌঁছোন। নকাছাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে যাত্রা। ক্রমশই উপরে উঠতে হবে। আঠারো মাইল উপরে উঠে লখুনি পৌঁছোন। লখুনির আরও উপরে মককচঙ্গ। এই যাত্রার এক সুন্দর বর্ণনা আছে তাঁর লেখায়। তিনি বলেছেন লখুনি থেকে আও নাগার দেশ আরম্ভ এবং এই প্রসঙ্গে নাগাদের বিভিন্ন ‘শ্রেণি’র কথা বলেছেন, যেমন, আও, আঙ্গামি, সেমা, লেটা, রেংমা, কাঁচানাগা, কুকিনাগা, মিরিনাগা, মেমিনাগা ইত্যাদি। একসময় এদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত, সেইজন্য সুরেন্দ্রনাথ লিখেছেন : ‘প্রত্যেক নাগা গ্রাম একটি সুরক্ষিত দুর্গ বিশেষ। অত্যুচ্চ পর্বত শৃঙ্গোপরি নিরেট পাথরের উপর তাহাদের গ্রাম অবস্থিত। . . . প্রত্যেক গ্রামের চতুর্দিকে বিস্তৃত ও গভীর পরিখা।’২৫ সুরেন্দ্রনাথের লেখায় আও নাগাদের গৃহের এক বিস্তারিত বর্ণনা আছে যা ডিটেলের দিক থেকে পেশাদার নৃতাত্ত্বিকদের থেকে কোনো অংশে কম নয়, তার কিছুটা উদ্ধৃত করছি : ‘বিভিন্ন জাতীয় নাগারা বিভিন্ন প্রকার গৃহ নির্মাণ করে। কিন্তু সকল গৃহই খড় নির্মিত ও দুই চালবিশিষ্ট। আউদের গৃহ দেখিতে একটি স্টিমারের ন্যায়। গৃহের প্রস্থ দিক রাস্তার উপর অবস্থিত এবং উহাই আউ গৃহের একটি দরজা এবং সাধারণ গৃহের মতো। গৃহে প্রবেশ করিয়াই ৮/১০ হাত দীর্ঘ ভিত্তিহীন খোলা জায়গা ইহা গৃহের ১ম প্রকোষ্ঠ এবং চতুর্দিকে মৃত্তিকা হইতে গৃহের চাল অবধি বাঁশের বেড়া। তৎপর সমস্ত গৃহব্যাপী ৩/৪ হস্ত উচ্চ বাঁশের মাচান এবং উক্ত মাচান গৃহের পশ্চাতে খোলা জায়গায় ১০/১২ হাত পর্যন্ত বিস্তৃত। পশ্চাৎ দিকের মাচান ভূমি হইতে ১০/১২ হাত উচ্চ এবং বাঁশের খুঁটির উপর স্থাপিত। গৃহের দৃশ্য সম্মুখে এবং পশ্চাতে দ্বিবিধ। দূরে পশ্চাৎ দিক হইতে গৃহ দেখিতে স্টিমারের ন্যায়। মাচানের চতুর্দিকে বাঁশের বেড়া সহযোগে উঠিবার সিঁড়ি ও দরজা এবং পশ্চাৎভাগে উন্মুক্ত স্থানে একটি ক্ষুদ্র দরজা আছে। গৃহখানি দুইটি প্রকোষ্ঠ ও একটি উন্মুক্ত বারান্দায় বিভক্ত। মাচানের মধ্যস্থলে ৪ হাত চতুষ্কোণ জায়গা ফাঁকা নিয়ে মৃত্তিকার বেদি মাচান পর্যন্ত উন্নত। উক্ত মৃত্তিকার উপর দিবারাত্রি ২৪ ঘণ্টা অগ্নি প্রজ্বলিত থাকে তাহাতে প্রস্তর খণ্ডোপরি আহার্য পরিপক্ক হয়। ভিতরে প্রবেশ করিলে ইঞ্জিন ঘরের মত বোধ হয়।’২৬ সুরেন্দ্রনাথ নাগাদের খাদ্যদ্রব্য, বিবাহ পদ্ধতি, মৃতদেহের সৎকার ইত্যাদির বেশ বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

কেদারনাথ মজুমদার সৌরভ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, ময়মনসিংহের ইতিহাস, ময়মনসিংহের বিবরণ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা ছাড়াও পাঠ্যপুস্তক প্রণেতা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। তিনি কুকিদের বিবরণ লিখেছেন।২৭ কুকিদের বাস আসাম, মণিপুর, চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার মধ্যে যে অরণ্য আছে, সেইখানে। কেদারনাথের বর্ণনায় কুকিরা যুদ্ধপ্রিয়, প্রতিহিংসাপরায়ণ, হিংস্র-‘ইহারা হিংস্র বন্য পশুর ন্যায় একে অন্যকে হিংসা করিয়া থাকে . . . শত্রু পরিবারের রমণীদিগের শিরশ্ছেদন তাহারা জীবনের প্রধান কার্য বলিয়া মনে করে . . . রমণী যদি গর্ভবতী হয়, তবে তাহার হত্যাকার্য আরও অধিকতর উৎসাহের সঙ্গে সম্পাদিত হইয়া থাকে।’২৮ এরা শত্রুকে ক্ষমা করে না, শত্রু পালালে এরা পরিত্যক্ত স্ত্রী, পুরুষ, বালক, বালিকা, সকলকে হত্যা করে। আমার নিজের ধারণা কেদারনাথের এই রচনাটি কোনো ইংরেজি রচনা থেকে নেওয়া। কেদারনাথ লিখেছেন : ‘কুকিগণ ভয়ংকর শত্রুনির্যাতন-প্রয়াসী। শত্রুনির্যাতন মানসে তাহারা শত্রুর গন্তব্য পথের পার্শ্বে অতি গোপনভাবে লুক্কায়িত থাকে। এবং অবসর পাইলেই শত্রুশোণিতে ধরাতল অভিষিক্ত করে। ঝোপের মধ্যে লুক্কায়িত থাকাকালে যদি বিষধর সর্পও তাহাদিগকে দংশন করিয়া যায়, শত্রু মস্তকের লাভাশায় তাহাও তাহারা নিতান্ত তুচ্ছজ্ঞান করে।’২৯ অন্যদিকে অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ তাঁর ‘কুকি’ নামক রচনায় এই ধরনের প্রবণতার কোনো উল্লেখ পর্যন্ত করেননি।৩০ অমূল্যচরণ কুকিদের এক বিস্তারিত ও তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণ দিয়েছেন যা এখনও নৃতত্ত্বের ছাত্রদের কাজে লাগতে পারে। অমূল্যচরণ আলোচনা করেছেন কুকিদের চব্বিশটি ভাগ, শিক্ষা, ধর্ম, আরাধ্য দেবতা, সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর ক্রিয়াকলাপ, বিবাহ, সমাজ, বারবণিতা, আমোদপ্রমোদ, বাদ্যযন্ত্র, যুদ্ধসামগ্রী, মৃত্যু এবং মৃত ব্যক্তির সমাধিস্থান। এক নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কুকিদের এক বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় অমূল্যচরণের লেখায়। মন দিয়ে পড়লে দেখা যায় তিনি নিজের বিশ্বাস-বিবেচনা কুকিদের উপর চাপিয়ে দেননি, তিনি অন্যদের মতো কুকি রমণীদের কুৎসিত বা কুদর্শনা বলেননি। তিনি বরং লিখেছেন : ‘সভ্যজাতিদিগের মধ্যে বর্ণের তারতম্য ব্যতীত চক্ষু নাসিকা প্রভৃতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দ্বারাও স্ত্রীজাতির সৌন্দর্য পরিকল্পিত হইয়া থাকে। কিন্তু ‘ভিন্নরুচির্হি লোকাঃ।’ দেশ কাল পাত্র ভেদে রুচিরও পরিবর্তন ঘটে। ‘স্ত্রীলোকের কোমর মোটা অথচ প্রশস্ত ও কর্ণের ছিদ্র বড়ো হইলে কুকিরা তাহাকে সুন্দরী বলিয়া থাকে। যাহার কর্ণের ছিদ্র যত বড়ো সে তত সুন্দরী। এই কারণে বাঁশের চোঙ দিয়ে কুকিরমণী কানের ছিদ্র বড়ো করিয়া থাকে।’৩১

অমূল্যচরণের অন্য কয়েকটি প্রবন্ধ আলোচনার আগে তাঁর সম্বন্ধে সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলা আবশ্যক। বহুভাষাবিদ অমূল্যচরণের ইতিহাস, ধর্ম, পুরাণ, ভাষাতত্ত্ব, লিপিতত্ত্ব, বেদ, হিন্দু ও জৈন দেবতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, এবং অন্য বহুবিষয়ে প্রখর পাণ্ডিত্য ছিল। বিভিন্ন পত্রিকা যেমন বাণী, ভারতবর্ষ, মর্ম্মবাণী, কায়স্থ-পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে সম্পাদনা করেছেন। সাময়িকপত্র সম্পাদনা ও বহুবিচিত্র বিষয়ে ব্যাপক ও গভীর জ্ঞান থাকার জন্য তিনি শিক্ষাকোষ, বিশ্বকোষ, বঙ্গীয় মহাকোষ প্রভৃতি কোষগ্রন্থের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অমূল্যচরণের এই বিশাল ও মূল্যবান গবেষণার বিবরণ এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা এখানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতি সম্পর্কে তাঁর লেখাগুলির উল্লেখ করব এবং কয়েকটি আলোচনা করব। তিনি ‘জাতি-বিজ্ঞান’ নিয়ে কায়স্থ-সমাজ ও ভারতবর্ষ পত্রিকায় লিখেছিলেন, প্রবাসী-তে ‘চেরোজাতি’, ‘দ্রাবিড় জাতি’, ‘বগধ জাতি’, ‘যোগি-জাতি’, ‘কেবট জাতি’ বিষয়ে লিখেছিলেন, ভারতী পত্রিকায় কুকি ছাড়া, ‘কিরাত জাতি’, ‘ত্রিপুরা-রাজ্যের কতিপয় জাতি’, ‘তিপরা বা তিপারা জাতি’ বিষয়ে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া তাঁর লেখা ‘জাতি’, ‘জাতি-বিজ্ঞান’, ‘অসুর-জাতি’ বিষয়ক প্রবন্ধ যথাক্রমে মোদক-সংহিতা, সুবর্ণবণিক সমাচার ও মাসিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।৩২ তাঁর পাণ্ডিত্য, গবেষণার খ্যাতি ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করতে থাকলে একসময় ত্রিপুরা রাজসরকার তাঁকে ‘রাজ-ঐতিহাসিক’ পদে নিয়োগ করেন। বহুদিন তিনি ত্রিপুরায় গবেষণা করেছিলেন। তাই বোধ হয় ত্রিপুরার জাতি সম্পর্কে তাঁর এত গভীর জ্ঞান ছিল। ‘ত্রিপুরা-রাজ্যের কতিপয় জাতি’ প্রবন্ধে তিনি পরিসংখ্যান সহ ত্রিপুরার চাকমা, মনিপুরি, রিয়াং, জুলাই, মগ, জমতিয়া, নওয়াতিয়া, হালাম, প্রভৃতি জাতির বিবরণ দিয়েছেন। এইসব জাতির পেশা, রীতি-রেওয়াজ, সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, জাতিগুলির মধ্যেকার বিভাগ, এই সবকিছুর পরিচয় তিনি দিয়েছেন।৩৩ তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের তিপরা বা তিপারা জাতি নিয়ে আলাদা রচনা লিখেছেন।৩৪ তিনি লিখেছেন : ‘তিপারাগণ ত্রিপুরা রাজ্যের আদিম অধিবাসী। ইহারা ‘পুরাণ তিপারা’, ‘দেশি তিপারা’ ও ‘জমাতিয়া’ এই তিনভাগে বিভক্ত। ‘নওয়াতিয়া’ ও ‘রিয়াং’ নামে ইহাদের আরও দুইটি বিভাগ আছে, কিন্তু তাহারা আসল তিপারা নয়। নওয়াতিয়াগণ চট্টগ্রাম হইতে আসিয়া এখানে বাস করিয়াছে। রিয়াংগণ কুকিবংশ সম্ভূত, ইহারা পূর্বে তিপারা রাজগণের পালকি-বেহারার কাজ করিত।’৩৫ তাঁর মতে, তিপারাদের মধ্যে পুরাণ তিপারারা শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হয়, তার নীচে দেশি তিপারা এবং তারপর যথাক্রমে জমাতিয়া, নওয়াতিয়া ও রিয়াং-দের স্থান। এরপর তিনি আলোচনা করেছেন পুরাণ তিপারাদের এগারোটি ‘হদা’ বা ভাগ। এরা রাজপরিবারে বিভিন্ন কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত, যেমন বাছালরা রাজদরবারে রুপোর পাঞ্জা বহন করে, রাজপরিবারের লোকেদের মৃতদেহ সৎকার করে, সিউকরা শিকারি, রাজপরিবারের আহারের জন্য পশুপাখি শিকার করে, কুয়াই-তুইয়ারা পানসুপারি বাহক, ইত্যাদি। এ ছাড়া তিনি বর্ণনা করেছেন এদের বাসস্থান, কৃষিকাজ, বিবাহ, ধর্ম ও দেবতা মৃত্যু, উৎসব, অলংকার, ব্রত ও খেলা।

সতীশচন্দ্র ঘোষ (১৮৮০–১৯২৯) চট্টগ্রামের মানুষ ছিলেন। তাঁর রচিত চাকমাজাতি (১৯০৯) বইটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশ করে তাঁকে পরিষদের সহায়ক সদস্যের পদ প্রদান করে। তিনি চাকমা জাতি বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং মৌলিক গবেষণার জন্য এই বইটি রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অফ গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ার্ল্যান্ডের মুখপত্রে বিস্তৃতভাবে সমালোচিত হয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক অভিধান সংকলনের জন্য তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানের প্রায় ছয় হাজার আঞ্চলিক শব্দ-সংগ্রহ করেছিলেন। চাকমাদের ভাষা নিয়ে বাংলায় তাঁর মূল্যবান প্রবন্ধ আছে যা নিয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। কলকাতা পণ্ডিতসভা তাঁকে ‘প্রত্নতত্ত্ববারিধি’ উপাধি দিয়েছিলেন। তিনি ‘চাকমা জাতির সংস্কার-কর্ম’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন প্রবাসী পত্রিকায়।৩৬ ১৯০৭ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধে সতীশচন্দ্র লিখেছেন : ‘যদিও চাকমারা এক সময়ে হিন্দুধর্মের অধিকারে ছিল, কিন্তু গত কয়েক বৎসর ধরিয়া বৌদ্ধধর্মের প্রবল সংঘর্ষণে দশাচারের অনেকগুলি পরিত্যাগ করিয়াছে, আবার বিভিন্ন ধর্মের সাহচর্যে দু-একটি অভিনব অনুষ্ঠানও এই সমাজে সংক্রামিত হইয়াছে।’৩৭ ধর্মের ব্যাপারে এই সমাজ যে একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ফলে নানা রকমের বিভিন্নতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে সেকথা বলার পর তিনি লিখেছেন : ‘বস্তুত সামাজিক ক্রিয়াকর্মাদি যে প্রধান ভিত্তির উপর অনুষ্ঠিত হয়, যতদিন পর্যন্ত সেই ধর্ম সম্বন্ধে কোনো এক মূল সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া না যায়, ততদিন ইহাদের মধ্যে এক অভিন্ন-আচার চলিবার আশা নাই।’৩৮ এই প্রবন্ধে সতীশচন্দ্র চাকমাদের লাইফ সাইকল রিচ্যুয়ালস বা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান-আচরণের বিবরণ দিয়েছেন। শুরু করেছেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া থেকে, তারপর যথাক্রমে আছে কর্ণবেধ, দীক্ষা, যৌবনোন্মেষ, বিবাহ, অন্ত্যেষ্টি। বেশ বিস্তারিত আলোচনা আছে চাকমাদের বিবাহ নিয়ে। তিনি লিখেছেন চাকমাদের মোট চারটি বিবাহ পদ্ধতি আছে : পাত্রী তুলে এনে, পাত্র তুলে এনে, বড়ো বিবাহ বা রাজপরিবার, সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিবাহ, ঘরজামাই প্রথা, মনোমিলনে পরিণয়। এখানে বলা প্রয়োজন পাত্রী বা পাত্র তুলে এনে বিয়ে অভিভাবকদের প্রস্তাব অনুসারেই হয়। সতীশচন্দ্র লিখেছেন, পাত্রী তুলে এনে বিয়ে এবং মনোমিলনে পরিণয়ই চাকমা সমাজে সমাধিক প্রচলিত। পাত্র তুলে এনে বিয়ে বা ঘরজামাই আনাকে সমাজ ভালো চোখে দেখে না। সেইজন্য অবস্থা ভালো হলে কেউ এতে রাজি হয় না। এ ছাড়া চাকমাদের মধ্যে বিধবা ও পরিত্যক্তা মহিলাদেরও বিবাহ আছে। রাজপরিবার ও সম্ভ্রান্ত দেওয়ান পরিবার ছাড়া আর কেউ বড়ো বিবাহে অধিকারী নয়। এই বিয়ে বংশমর্যাদা সাপেক্ষ, ব্যয়সাধ্যও বটে।

সতীশচন্দ্রের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হল ‘চাকমাদিগের ভাষা-তথ্য’।৩৯ চাকমাদের ভাষা নিয়ে সাধারণের পাঠযোগ্য এত ভালো লেখা এখনও চোখে পড়ে না। সতীশচন্দ্র লিখেছেন : ‘চাকমা ভাষার মূল বাঙ্গালা হইলেও মগ, ত্রিপুরা এবং মুসলমানি ভাষার সহিত সংমিশ্রণ অতিশয় বিস্তৃত। ফলকথা, ইহারা বিজাতীয় সমাজ হইতে যাহা যাহা অনুকরণ করিয়াছে, ভাষা তন্মধ্যে সাধারণ। মোটামুটি বলা যাইতে পারে চাকমাগণ হিন্দুদের হইতে ভাষা ও দেবদেবী; মগদিগের ধর্ম, ব্যবহার, ভাষা, এমনকি অক্ষরগুলি পর্যন্ত; ত্রিপুরাদের ভাষা, পূজাপদ্ধতি ও আচার-ব্যবহার এবং মুসলমানদিগের ভাষা ও খাঁ প্রভৃতি উপাধি ইত্যাদি পার্শ্ববর্তী প্রায় সমুদয় জাতি হইতে কিছু কিছু করিয়া গ্রহণ করিয়াছে। এই নিমিত্ত ইহাদের জাতীয় ইতিবৃত্ত সাতিশয় জটিল হইয়া পড়িয়াছে এবং ভাষাও এত দুরূহ হইয়াছে যে, অপর কোনো জাতিরই সহজবোধ্য নহে।’৪০ সতীশচন্দ্র চাকমা ভাষার মধ্যে সংস্কৃত শব্দ, ধর্ম বৌদ্ধ বলে পালি শব্দ, বাংলা শব্দ প্রভৃতির নানাবিধ দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। সম্পর্ক নামের দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখিয়েছেন এগুলি মূলত হিন্দুদের অনুকরণ। ক্রিয়া-বিভক্তির রূপ সংস্কৃতমূলক কিন্তু সংক্ষিপ্ত। এ ছাড়া তিনি আলোচনা করেছেন সর্বনাম ও কাল অনুযায়ী ভাষার ব্যবহার। তাঁর মতে, চাকমারা ব্রহ্মদেশীয়দের বর্ণ অনুকরণ করেছে, যদিও বর্ণের আকৃতিগত পরিবর্তন ঘটেছে, বর্ণসংখ্যারও সংক্ষিপ্তকরণ ঘটেছে। ব্রহ্মদের মূল স্বরবর্ণ দশটি, কিন্তু চাকমাদের শুধু অ-ই-উ-এ এই চারটি বর্ণ আছে, ই-ঈ এবং উ-ঊ’র মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। সতীশচন্দ্র ব্যঞ্জনবর্ণ, স্বরসংযোগ, হসন্ত বিধান, ফলা, সবকিছুই এই প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন, ভাষার মূল ও গঠনপ্রণালী যতটা প্রাঞ্জলভাবে সম্ভব প্রদর্শিত করেছেন। অন্যান্য ভাষা থেকে যেসব শব্দ চাকমা ভাষায় প্রবেশ করেছে তার এক সংক্ষিপ্ত তালিকা দিয়েছেন; এর মধ্যে আছে মগ, ত্রিপুরা, আরবি, ফারসি, চিনা, ইংরেজি, ফরাসি, পোতুÍগিজ, ইতালীয় ভাষা। তিনি লিখেছেন যে, এই যে বিভিন্ন দেশের ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটেছে ‘ইহা দ্বারা বিভিন্ন জাতি সমুদয়ের সহিত সংঘর্ষণ পরিমাণ নির্ণয় করিতে গেলে, প্রমাদে পতিত হইতে হইবে মাত্র, কারণ মগ ত্রিপুরারি জাতির, যাহাদের সহিত ইহাদিগের বহুকাল ধরিয়া বসবাস চলিতেছে, অতি অল্পসংখ্যক শব্দই চাকমা সমাজে অধিকার পাইয়াছে, সুতরাং প্রচলিত শব্দসংখ্যা লইয়া জাতীয় নৈকট্য পরিমাপ হইতেই পারে না।’৪১

নলিনীকুমার ভদ্র (১৯০৬–১৯৭৫) ত্রিপুরায় জন্মেছিলেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের আদিবাসীদের উপর বেশ কিছু বই লিখেছিলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিচিত্র মণিপুর, নেফার মানুষ মনফা, আমাদের অপরিচিত প্রতিবেশী প্রভৃতি। কর্মজীবনে তিনি বহুদিন প্রবাসী ও Modern Review পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। এই প্রবাসী পত্রিকায় তিনি হালাম ও সিন্টেংদের কথা লিখেছেন।৪২ হালামরা শ্রীহট্ট জেলার দক্ষিণ অংশে লুসাই পাহাড়ের নিকটবর্তী পার্বত্যস্থানে বাস করে। লেখক লিখেছেন : ‘ইহারা পার্বত্য টিপরা জাতির শাখা-বিশেষ। ইহাদের আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি সবই অদ্ভুত। বর্তমানকালে বাঙ্গালীদের সংস্পর্শে আসায় ইহারা কতকটা সভ্য হইয়াছে এবং নিজেদের প্রথাগুলি ক্রমশ পরিত্যাগ করিতেছে।’৪৩ অবশ্য লেখক নিজেই এদের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে এরা যে খুব একটা ‘অসভ্য’ মনে হয় না। এদের পোশাক পরিচ্ছদের কথাই যদি ধরা যায় : ‘হালাম-পুরুষেরা সকলেই ধুতি ও জামা পরিধান করে। স্ত্রীলোকেরা একখানা পাঁচ হাত ধুতি বুকের কাছে গেরো দিয়ে পরে এবং আর একখানা ছোট চাদর কটিতে জড়াইয়া রাখে, কেউ কেউ লম্বা হাতাওয়ালা একরকম কোর্তাও গায়ে দেয়। বয়স্কা নারীরা হাটে সওদা করিতে যাইবার কালে মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়া থাকে।’৪৪ হালামরা জুম কৃষি নির্ভর এবং ধান ও কার্পাস এদের প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য। হালাম-নারীরা খুব পরিশ্রমী, কৃষিকাজ, হাটবাজার ইত্যাদি বেশিরভাগ কাজ স্ত্রীলোকেরাই করে। প্রত্যেক বাড়িতে চরকা ও তাঁত আছে। নিজেদের আবশ্যক বস্ত্রাদি হালাম-নারীরা নিজেরাই বুনে নেয়। লেখক লিখেছেন সূচীশিল্পেও এদের অসাধারণ দক্ষতা, হালাম-নারীরা এক মুহূর্তও আলস্যে অতিবাহিত করে না। এর পর অবশ্যই হালামদের বিবাহের কথা এসেছে। ‘হালাম যুবক-যুবতিদের মধ্যে অবাধ মেলামেশা প্রচলিত আছে। বিবাহের আগেই যুবক-যুবতিদের মধ্যে প্রণয় হইয়া থাকে। গভীর রজনীতে বাড়ির সকলে নিদ্রিত হইলে পর প্রণয়ীরা নিজ নিজ প্রণয়িনীর সহিত দেখা করে।’৪৫ নলিনীকুমার হালামদের বিবাহ প্রথা, কন্যাপণ, ভূতপ্রেত ও উপদেবতা, অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া, দেব-দেবী ও পূজার অনুষ্ঠানে সব কিছুরই বিবরণ দিয়েছেন।

তাঁর অন্য একটি লেখা-‘সিন্টেংদের দেশে’-আরও বেশি আকর্ষণীয়।৪৬ এই লেখায় তিনি শ্রীহট্ট থেকে চেরাপুঞ্জি হয়ে শিলং থেকে তেত্রিশ মাইল দূরে জোয়াই যাত্রার বিবরণ দিয়েছেন। জয়ন্তিয়া পর্বতমালার অন্তর্গত এই খাসি অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। তিনি লিখেছেন : ‘দৃশ্য-সৌন্দর্যে জোয়াই অতুলনীয়। এখানকার মতো অমন সুন্দর পাইন-কুঞ্জ খাসিয়া পাহাড়ের কোথাও নাই। শিলঙের চেয়ে এ-জায়গা ঢের নির্জন ও নিরালা। যাঁহারা শিলঙে বেড়াইতে যান, তাঁহারা একটু কষ্ট স্বীকার করিয়া জোয়াইয়ে গেলে প্রচুর আনন্দ উপভোগ করিতে পারিবেন।’৪৭ তিনি সিন্টেংদের আচার-অনুষ্ঠান, পরিচ্ছদ, খাদ্য ইত্যাদির বিবরণ দিয়ে বলছেন, এরা ক্রমশই মিশনারিদের প্রভাবে খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন করছে এবং নিজেদের শিকড় হারিয়ে ফেলছে। লেখক লিখেছেন যে সিন্টেংদের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতিতে হিন্দু প্রভাবের অনেক ছাপ আছে, কিন্তু মিশনারিদের প্রভাবে পরস্পরের যোগসূত্র ছিন্ন হয়েছে : ‘জোয়াই, জৈন্তা পাহাড়ে মিশনারিদের সর্বপ্রধান কেন্দ্র। ওয়েলশ মিশন, চার্চ অব ইংল্যান্ড, রোমান ক্যাথলিক চার্চ, ইউনিটেরিয়ান চার্চ, ইত্যাদি সব কয়টাই এখানে আড্ডা গাড়িয়াছে। প্রত্যেক রবিবারে গির্জাগুলি সমবেত সিন্টেং নরনারীর কন্ঠনিঃসৃত খ্রিস্টবন্দনা গানে মুখরিত হইয়া উঠে। আর শুধু জোয়াই কেন, জৈন্তা পাহাড়ের সর্বত্রই দেখিয়াছি, অপ্রতিহত প্রভাবে আধিপত্য করিতেছে খ্রিস্টান মিশনারিরা। বলিতে গেলে গোটা সিন্টেং জাতিটাই স্বধর্ম পরিত্যাগ করিয়া পরধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। স্বীকার করি, মিশনারিরা কিয়ৎ পরিমাণে ইহাদের কল্যাণসাধন করিয়াছে। কিন্তু আজ যে ইহারা পরানুকরণকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বলিয়া বরণ করিয়া লইয়া বিলাসিতা এবং দুর্নীতিক স্রোতে গা ভাসাইয়া দিয়াছে, মেয়েদের মধ্যে সতীত্বের আদর্শটা পর্যন্ত যে লোপ পাইয়াছে, জিজ্ঞাসা করি সেজন্য দায়ী কে?’৪৮ লেখক বলেছেন শুধু সিন্টেং নয় কুকি, খাসিয়া, লুসাই, নাগা, গারো ইত্যাদি আসামের সমস্ত পার্বত্য জাতির একই দশা। এই বলে প্রশ্ন করেছেন : ‘এই সমস্ত পার্বত্য জাতিকে হিন্দু সমাজের অঙ্গীভূত করিবার জন্য এখনও কি আমরা উদ্যোগী হইব না?’ তিনি লিখেছেন, জোয়াইয়ের শিক্ষিত মানুষ বুঝতে পারছে জাতির দুর্গতিমোচন করতে হলে তাদের মিশনারি প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এরপর তিনি লিখেছেন : ‘সিন্টেংদের চিত্ত জয় করিবার দুইটি উপায় আছে। প্রথমত, তাহাদিগকে বাংলা ভাষা শিক্ষা দেওয়া, দ্বিতীয়ত, তাহাদের মধ্যে বাংলা সংগীত প্রচার করা, কেন-না, জীবিকার জন্য শ্রীহট্টের বাঙালিদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য না করিয়া ইহাদের গত্যন্তর নাই। ইহাদের নিজেদের মাতৃভাষাতেই প্রায় ছয় সাত শত বাংলা শব্দ ঢুকিয়াছে। বাংলা সংগীতও ইহারা অত্যন্ত ভালোবাসে। বাংলা গান শুনিয়া সিন্টেংরা নৃত্য করিতে আরম্ভ করে। ইহা স্বচক্ষে দেখিয়াছি। সুতরাং বাংলা ভাষা ও সংগীত প্রচার দ্বারা কাজের সূচনা করিলে ভবিষ্যতে অন্যান্য কাজ সহজ ও সুসাধ্য হইয়া উঠিবে। মিশনারিরা বিরোধিতা করিয়া, আমাদের কাজ পণ্ড করিয়া দিতে চাহিলেও সফলকাম হইবে না।’৪৯

এর আগে কুকি সমাজের শিরোমণি লালতুদাই রায় প্রবাসী পত্রিকায় ওই একই কথা বলেছিলেন।৫০ লালতুদাই নিজে কুকি সমাজের মানুষ, সুতরাং তাঁর লেখা ‘আসামের কুকি জাতি’ একজন ‘ঘরের লোকের’ বিবরণ। জাতি বিবরণ এবং সাধারণভাবে নৃতত্ত্বে আমরা বাইরের লোকেরা বিবরণ পড়তেই অভ্যস্ত। সেইদিক থেকে লালতুদাইয়ের রচনা বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। লালতুদাই প্রথমেই লিখেছেন : ‘বাঙ্গালী পাঠকগণ আসামের পার্বত্য কুকি জাতির নাম শুনিয়া থাকিবেন। কাছাড়, মণিপুর, লুসাই পাহাড় ও পার্বত্য ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলে এই কুকিজাতির বাস। আমি উক্ত কুকিজাতীয় লোক। আমাদের সভ্যতা, বর্বরতা, হিংস্রতা প্রভৃতি বিষয়ে নানা গল্প, আমাদের প্রতিবেশী বাঙ্গালী পাঠকগণ শুনিয়া থাকিবেন। আমিও আজ আমাদের অসভ্য সভ্যতা সম্বন্ধে কিছু বলিতে চেষ্টা করিতেছি-বিশেষভাবে বাঙ্গালীদের নিকট।’৫১ তিনি বলেছেন মিশনারি আন্দোলন কুকিদের ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে। সাধারণত বলা হয় মিশনারিরা অসভ্য জাতিকে সভ্য করেছে, ধর্মহীন জাতিকে ধর্ম দান করেছে, সাহিত্যহীন জাতিকে সাহিত্য দান করেছে, ওষুধ দিচ্ছে, মদ্যপান বন্ধ করেছে ইত্যাদি। লালতুদাই প্রশ্ন করেছেন হ্যাট, কোট, বুট পরাই কি সভ্যতা। বলেছেন, আগে কুকিদের অভাব অতি সামান্য ছিল, এখন নতুন নতুন জিনিস আমদানি হওয়ার ফলে অভাবও বেড়েছে, মানুষ বিলাসিতা শিখেছে, অথচ উদ্দাম বিলাসিতাকে কোনোক্রমেই সভ্যতা বলা যায় না। দ্বিতীয়ত তিনি বলেছেন, কুকিদের ধর্মগ্রন্থ নেই এটা হতে পারে, কিন্তু তারা কখনো ধর্মহীন ছিল না। তাদের প্রকৃত অভাব ধর্মের নয়, শিক্ষার। সাহিত্যের ক্ষেত্রে রোমান বর্ণমালায় কিছু খ্রিস্ট ধর্মগ্রন্থ ও চার্চের গান ছাপা হয়েছে, তাতে কুকি সাহিত্যের কী উন্নতি হল? বরং এর ফলে কুকিরা এদেশের ভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। মদ বন্ধ করার ব্যাপারে লালতুদাই বলেছেন যে, কুকিরা ভাত থেকে একরকম মদ তৈরি করে, তাতে কারও স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে তিনি অন্তত জানেন না। অন্যদিকে মদ বন্ধ করায় আবালবৃদ্ধবণিতা সিগারেট ধরেছে, পাঁচ বছরের শিশুরও সিগারেট না হলে চলে না। তিনি লিখেছেন : ‘আমরা অজ্ঞ, সাহিত্যহীন, নিরাশ্রয়, অরণ্যবাসী, নাবালক মাত্র। যে আমাদের সর্বস্ব হরণ করিতেছে তাহারই হাতে আত্মসমর্পণ করিতেছি। যে আমাকে আমার পূর্বপুরুষকে, আমার দেশকে শতমুখে নিন্দা করিতেছে-আমরা তাহারই সঙ্গে সহস্রমুখে আমাদেরই বাপান্ত করিতেছি ও মাথায় কুঠার মারিতেছি। এইভাবে ধ্বংসের চরমসীমায় উপস্থিত হইয়া সভ্যতা পাইতেছি-অন্ধকার হইতে আলোকে যাইতেছি।’৫২

লেপচা জাতির বিবরণ দিয়েছেন নলিনীকান্ত মজুমদার। তিনি মূলত আলোচনা করেছেন লেপচাদের বিবাহের রীতি-রেওয়াজ।৫৩ মধ্যপ্রদেশের গোঁড় বা গোন্ড জাতি সম্বন্ধে লিখেছেন সত্যকিঙ্কর চট্টোপাধ্যায়।৫৪ ভেরিয়ার এলুইনের একটি ইংরেজি লেখা অবলম্বনে লিখিত এই প্রবন্ধে লেখক গোঁড়দের অরিজিন মিথের কথা বলেছেন। একসময় মধ্যপ্রদেশের বেতুল, ছিন্দওয়ারা, মান্ডালা, চন্দা প্রভৃতি অঞ্চল গোঁড়দের শাসনে ছিল কিন্তু লেখক লিখছেন : ‘গোঁড়েরা এখন জগতের আপদগ্রস্ত জাতির মধ্যে গণ্য। বর্তমানে তাহারা প্রত্যেক আগন্তুকের কাছে চক্ষুশূল হইয়া পড়িয়াছে। তাহারা এখন দারিদ্র্যের চরমসীমায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে; তাহাদের গড়পড়তা দৈনিক আয় এক আনা মাত্র; তাহাদের সন্তানকে পাঁচ বৎসর বয়স হইতেই খাটিয়া খাইতে হয়; আহার্য তাহাদের অতি সাদাসিধা, কেবলমাত্র ফেনসমেত ভাত; পরিচ্ছদের দৈন্য এরূপ যে শীতকালে পার্বত্যপ্রদেশের আত্যন্তিক শীত কোনোরূপেই রক্ষা হয় না।’৫৫ লেখক এদের উপর মহাজন, তহশিলদার প্রভৃতির উৎপীড়নের কথা বলেছেন, লিখেছেন ‘ব্যাঘ্রের অপেক্ষাও ভীতি উৎপাদক ও রক্তপিপাসু মহাজন তাহাদের বিবাহ ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় টাকা লগ্নি করিবার জন্য তাহাদিগকে নানারূপ স্তোকবাক্য প্রয়োগ করে। এই সকল মহাজনের শোষণের পর তাহাদের যাহা অবশিষ্ট থাকে তাহা সভ্যসমাজে আদৃত ও রাজসরকারের পৃষ্ঠপোষিত আফিং ও মদ্যে নিঃশেষিত হইয়া যায়।’৫৬ ইংরেজি রচনা অবলম্বনে ১৯০১ সালেই প্রবাসী পত্রিকায় আন্দামানবাসীদের উপর নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।৫৭ ডাক্তার সরসীলাল সরকার পাহাড়ি জাতিরা খাদ্যের উপকরণ কীভাবে সংগ্রহ করে সে বিষয়ে ১৯২৯ সালে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন এবং তা নিয়ে আলোচনাও হয়, যার বিবরণী সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা-য় প্রকাশিত হয়। সরসীলাল পাহাড়ি জাতির মধ্যে অগ্ন্যুৎপাদনের উপায় বিষয়ক আরও একটি প্রবন্ধ পরিষদের সভায় ১৯১৯ সালে পাঠ করেছিলেন।৫৮ ভারতী পত্রিকায় ভারতের বিভিন্ন ‘অনার্যজাতি’-দের মধ্যে কতরকম বিভিন্ন বিবাহপ্রথা আছে তার বিবরণ প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে।৫৯ সবচেয়ে বড়ো কথা হল, শরৎচন্দ্র মিত্র বম্বের অ্যানথ্রোপলজিকাল সোসাইটিতে বাঘ নিয়ে লৌকিক বিশ্বাস বিষয়ে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন, যা পরবর্তী সময়ে Journal of the Anthropological Society of Bombay (৩(১), ১৮৯৩) নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি তাঁর এই লেখাটি সংক্ষেপে ‘ব্যাঘ্র-পূজা’ নামে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত করেন।৬০ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিরা কীভাবে বাঘের উপাসনা করে, বাঘ সম্বন্ধে কী তাদের বিশ্বাস, বাঘ নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে কী ধরনের কিংবদন্তি প্রচলিত আছে, এই ছিল তাঁর আলোচ্য বিষয়।

আমরা তাহলে দেখছি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকেই ভারতের বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতি, জীবন, বিশ্বাস, ধর্ম সম্বন্ধে আগ্রহ ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমরা প্রবন্ধের এই অংশে দেখলাম যাঁরা এইসব বিষয়ে লিখেছিলেন তাঁরা কেউই পেশাদার নৃতাত্ত্বিক অন্তত ছিলেন না। এ বিষয়ে প্রবাসী, ভারতী প্রভৃতি পত্রিকাগুলি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অংশে আমরা যে-সব জাতিদের বিবরণ আলোচনা করলাম তাদের মধ্যে রয়েছে টোডা, কোল, খাসিয়া, গারো, রাভা, মিশমি, কুকি, তিপারা, চাকমা, হালাম, সিন্টেং, লেপচা, গোঁড় এবং আন্দামান, ত্রিপুরা, নাগারাজ্যের অন্যান্য আদিবাসী। অবিভক্ত ভারতের ভৌগোলিক পরিধি ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয়ও আমরা পাই লেখাগুলি থেকে। বিশেষজ্ঞ পত্রপত্রিকা নয়, সাধারণ পাঠকদের পত্রিকায় এই রচনাগুলির প্রকাশ যে কথাটি বলে তা হল সাধারণ পাঠকদের সংস্কার মুক্ত করে তোলার একটা সচেতন প্রয়াসের কথা। আগেই বলেছি, অনেক সময় লেখক নিজেই সংস্কার মুক্ত হতে পারেননি। কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখলে এই লেখাগুলি পাঠকদের মধ্যে যে বোধ জাগ্রত করে তা হল আমার থেকে ভিন্ন জীবন, সংস্কৃতি, বেশভূষা, খাদ্য, পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্ক আছে। বস্তুত এই বোধ জন্ম দেয় এক কসমোপলিটান দৃষ্টিভঙ্গির, যার কথা কান্ট বলেছিলেন এবং যে কথা আমি ভূমিকায় উল্লেখ করেছি। বিশ শতকে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই সময় থেকে আমরা বেশ কিছু গবেষকের দেখা পাই যাঁদের পেশা নৃতত্ত্ব হয়ে উঠবে এবং তাঁরাও বাংলায় তাঁদের বিষয় নিয়ে লিখবেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শরৎচন্দ্র রায়, বিরজাশঙ্কর গুহ, নির্মলকুমার বসু। কিন্তু এঁদের লেখা আলোচনা করার আগে অন্য এক ধরনের নৃতত্ত্বচর্চার পরিচয় দিতে চাই। এই নৃতত্ত্বচর্চা মানব ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত, অনেকে একে মানববিজ্ঞান আখ্যা দিয়েছেন।

২. নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, মানববিজ্ঞান

একদম গোড়া থেকেই নৃতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে মানব ইতিহাসের অধ্যয়ন। মানব জাতির উৎপত্তি ও বিকাশ, মানুষের প্রাক-ইতিহাস অনুসন্ধানের শুরু নৃতত্ত্বের জন্ম থেকে। এই নৃতত্ত্বের অন্য একটি শাখা হল শারীরিক নৃতত্ত্ব, যা মানুষের শারীরিক গঠনের বিভিন্ন দিক বিচার করে। বিশ শতকের শুরু থেকেই এই দু-টি বিষয়ে বাংলা পত্রপত্রিকায় লেখা চোখে পড়ে। অবশ্য আরও আগে, ১৮৭৫ সালে, ‘আদিম মনুষ্য’ নামক রচনায় লেখক লিখেছেন : ‘প্রথমে মনুষ্য হীনবল নিঃসহায় কেবল আত্মরক্ষায় ও আত্মপোষণে সকল সময় অতিবাহিত করিত। অতি আয়াসে ও বহু কষ্টে দিন দিন বন্য পশুর অপক্ক মাংস উদর করিত, সময় বিশেষে মনুষ্য মাংস বা শৃগাল ও ইন্দুরের মাংস তাহার অভক্ষ্য ছিল না। ক্রমে অগ্নির আবিষ্ক্রিয়া হইল, তখন দগ্ধ মাংস ভোজন, প্রস্তর নির্মিত অস্ত্র ও তৈজসাদির গঠন ও ব্যবহার ও কৃষিকার্যের আরম্ভ, শেষে লৌহের আবিষ্ক্রিয়া ও কৃষিকার্যের উন্নতি। গৃহবাসী মনুষ্য পর্যায়ক্রমে শিকার, পশুপালক, কৃষিজীবী হইয়া শেষে বাহ্যিক সমস্ত বিষয়ে নিরুদ্বেগ হইয়া জ্ঞানোপার্জনে সক্ষম হইয়াছে। মনুষ্য প্রথমে হীনবল ও নিঃসহায় ছিল, এক্ষণে মনুষ্য পৃথিবীতে অধিপতি। জ্ঞানবলে মনুষ্যের অবস্থার আরও যে কত উন্নতি হইবে তাহা কে বলিতে পারে?’৬১ এরপর লেখক লিখেছেন ইউরোপের গিরিগুহায় মানুষের যে অস্ত্রশস্ত্র, তৈজসপত্র ইত্যাদি পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে পণ্ডিতরা মনে করছেন আদিম মানুষের পুরাবৃত্ত দুইভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথমটি হল প্রস্তর যুগ এবং দ্বিতীয়টি হল ধাতু যুগ। এরপর তিনি এই দুই যুগের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। যেটা বলতে চাই তা হল, বাংলা ভাষায় আদিম মানুষ সম্পর্কে সেই সময়ের সাম্প্রতিক জ্ঞানই প্রতিফলিত হয়েছে এই রচনায়। পরবর্তী সময়ে মানুষের উৎপত্তি ও বিকাশের অনুসন্ধানকে বিজ্ঞান হিসেবে ভাবা হতে থাকে। ‘মানব-বিজ্ঞান’ নামে একটি রচনায় লেখক বলেন : ‘যে বিজ্ঞানের সাহায্যে নৃতত্ত্ব অবগত হওয়া যায় তাহার নাম Anthropology বা নৃবিজ্ঞান বা মানব-বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞান মানবের গোটা ইতিহাস জানবে। মানব-বিজ্ঞান শুধু আজিকার মানবের ইতিহাস নয়, পরন্তু ক্রমবিকাশ লক্ষ করে সেই আদি যুগ হতে আরম্ভ করে বর্তমান কালের সকল মানবের ইতিহাস জানতে চেষ্টা করবে।’৬২

লেখক বলেছেন, এই বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হল একদম শুরু থেকেই মানুষের দৈহিক ও মানসিক যে যে পরিবর্তন ঘটেছে তার একটা নকশা প্রস্তুত করা। কিন্তু মানব-জীবন নানা জটিলতায় পূর্ণ, তাই এই ক্রমবিকাশের ধারা জানা সহজ নয়। তাই মানব-বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় বিশাল ও বিস্তৃত। এর মধ্যে রয়েছে প্রাক-ইতিহাস (শিল্পতত্ত্ব, চিত্রকলা), ভূতত্ত্ব, প্রাণীতত্ত্ব, প্রত্নজীববিদ্যা (palaeontology), দেহতত্ত্ব (anatomy), নৃকুলতত্ত্ব (ethnology), সমাজতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদি। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত এই রচনায় লেখক লিখছেন : ‘মানব-বিজ্ঞান অল্পদিনের বস্তু। যদিও ইহা এখনও মাতৃগর্ভে অবস্থিত বললেই চলে, কিন্তু ইহার প্রসারতা দিন দিন বর্ধিত হচ্ছে। . . . ভারতবর্ষের মধ্যে শুধু বাঙ্গালা দেশে স্বর্গীয় স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপার্টমেন্টে সম্প্রতি এই বিজ্ঞান পড়াবার জন্য বি-এস-সি, এম-এ, এম-এসসি ক্লাস খোলা হয়েছে।’৬৩ ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব বিভাগ খোলা হয় এবং এই বিভাগে যোগ দেন পঞ্চানন মিত্র (১৮৯২–১৯৩৬)। তিনি পরে এই বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন। তিনি এই সময় ভারতীয় জাদুঘরের নৃতত্ত্ব অংশের অবৈতনিক সহকারী কিউরেটর হিসেবেও কাজ করেছিলেন। তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রি পান ১৯২৯–৩০ সালে। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল আমেরিকান নৃতত্ত্বের গবেষণা পদ্ধতি ও ধারণার ঐতিহাসিক অনুসন্ধান। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যানথ্রোপলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের সভ্য এবং গ্রেট ব্রিটেন ও আয়ার্ল্যান্ডের রয়াল অ্যানথ্রোপলজিকাল ইনস্টিটিউটের ফেলো ছিলেন। ভারতের প্রাক-ইতিহাস, আমেরিকান নৃতত্ত্বের ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। পঞ্চানন মিত্রের ভারতে মানবের প্রাচীনত্ব বিষয়ে একটি রচনা সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা-য় ১৯১৯ সালে প্রকাশিত হয়।৬৪ তিনি বলেছেন, এদেশে সাহেব বিশেষজ্ঞদের বক্তৃতায় মানবজাতির প্রাক-ইতিহাস সম্বন্ধে নানাবিধ তথ্য থাকলেও ভারতের মানব সম্বন্ধে বিশেষ কোনো উল্লেখ থাকে না। তিনি এই রচনায় ভারতের মানুষের প্রাচীনত্বের কথা বলেছেন। তিনি প্রস্তর আয়ুধ, প্রাক-কুঠার (Celt) ইত্যাদির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেছেন এগুলি কমপক্ষে চার লক্ষ বছর পুরোনো। অবিনাশচন্দ্র দাস (১৮৬৭–১৯৩৬) বৈদিক ইতিহাসে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং তিনিও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। ঋগবেদ-এর ভারত, ঋগবেদ-এর সংস্কৃতি বিষয়ক গ্রন্থ রচনা ছাড়াও নাটক ও উপন্যাস লিখেছিলেন। অবিনাশচন্দ্র ‘অতিকায় প্রত্নমানব’ নামে একটি রচনা ১৯২৬ সালে বঙ্গবাণী পত্রিকায় প্রকাশ করেন।৬৫ এই রচনায় তিনি অনার্যভূমিতে অতিকায় মানুষদের অস্তিত্বের কথা বলেন। তিনি লেখেন বীরভূম অঞ্চলে এইরকম বিশাল কঙ্কাল পাওয়া গেছে বলে তিনি শুনেছিলেন।

অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ তাঁর ‘জাতি-বিজ্ঞান’ প্রবন্ধে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের বর্ণ-বিভিন্নতার কারণ আলোচনা করেছেন।৬৬ তিনি বলেছেন সকল দেশের মানুষই এক-জাতীয়, একই মূল বংশ থেকে সকল দেশের মানুষের উদ্ভব। তাহলে বর্ণ-বিভিন্নতা কেন? অমূল্যচরণ বলেছেন, এ ব্যাপারে অনেকে বলেন জলবায়ুর প্রভাবই বর্ণের একমাত্র কারণ। তিনি নানারকম বিরুদ্ধ দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে চেষ্টা করেছেন যে, জলবায়ু বর্ণের একমাত্র ব্যাখ্যা নয়। তিনি বলেছেন, ‘আজকাল নৃতত্ত্ববিদদিগের অনুমান যে, বর্তমানকালের মানব-সাধারণের মধ্যে বিভিন্ন জাতিগত বিশেষত্ব যতই পরিস্ফুট থাকুক না কেন, প্রাথমিক মানবে তাহা আদৌ পরিস্ফুট ছিল না। প্রাথমিক অবস্থায় সকল মানবই এক জাতীয় ছিল।’৬৭ কিন্তু নানাবিধ কারণে আকৃতি, বর্ণ, ভাব সব দিক থেকে মানুষের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায় এবং মানুষ নিজের বিশেষত্ব রক্ষাও করে চলে। অমূল্যচরণ লিখেছেন : ‘প্রত্যেক জীবের ব্যক্তিগত বিশেষত্ব আছে। তাহাকে তার ব্যক্তিত্বও বলা যাইতে পারে। . . . [কিন্তু] বস্তুর স্বভাব এই যে, সে গোড়া হইতে দল বাঁধিবার জন্য ব্যস্ত হয়। ইহাই জাতি-গঠনের মূল কারণ! দল বাঁধার অর্থ পরস্পর আদান-প্রদান। এই আদান-প্রদান হইতে ক্রমশ জাতির গঠন হয়। যদি আদান-প্রদান না হইত, জাতি-গঠন হইতে পারিত না। সকলেই পরস্পর স্বতন্ত্র থাকিত।’৬৮ প্রবোধচন্দ্র সেন বাংলার ইতিহাসের গোড়ার কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন যে, প্রাচীন বাংলার অঙ্গ, বঙ্গ প্রভৃতি কোনো একটি বিশেষ রেস-এর (race) অন্তর্গত বিভিন্ন শাখাজাতি বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।৬৯ কিন্তু কোন রেস-এর অন্তগর্ত? প্রবোধচন্দ্র বলেছেন, দুইভাবে এটা জানা যেতে পারে। একটি হল নৃতাত্ত্বিকরা দেহের সংগঠন-বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি করে যেভাবে সমাধান করেন সেই উপায় অবলম্বন করে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা হল ভারতের বিভিন্ন জাতির মধ্যে এত বেশি সংমিশ্রণ ঘটেছে যে এই উপায়ে, তাঁর মতে, যথাযথ উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। প্রবোধচন্দ্র বলছেন, এর চেয়ে ভাষা বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে এই প্রশ্নের সমাধান অধিকতর নির্ভরযোগ্য। তিনি লিখেছেন : ‘ভাষাতত্ত্বের আলোচনার দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, অঙ্গ-বঙ্গ প্রভৃতি বাংলার প্রাচীন অধিবাসীরা খুব সম্ভবত অস্ট্রিকভাষী মহাজাতিরই কয়েকটি শাখা।’ তিনি ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক সিলভ্যাঁ লেভি ও ভাষাতাত্ত্বিক জ্যঁ প্রজিলুস্কির গবেষণা উল্লেখ করে এবং বাংলায় ব্যবহৃত শব্দের সম্ভাব্য উৎসের অনুমান থেকে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ‘বাংলার হিন্দুরাও মূলত আর্য বংশধর নয়, বাংলার মুসলমানরাও মূলত আরব, তুর্কি কিংবা পাঠান-মোগলের বংশধর নয়। আসলে বাংলার হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই একই অস্ট্রিক-ভাষী মহাজাতি [race] সম্ভূত-এই হচ্ছে বাংলার ইতিহাসের সর্বপ্রথম এবং বোধ করি সর্বপ্রধান তথ্য।’৭০ বাঙালি আর্য জাতির সাক্ষাৎ বংশধর বলে যে জাত্যভিমান উনিশ শতক থেকে প্রকাশ করে এসেছে, এই নৃতত্ত্ব সেখানে এক অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংশোধনীর অন্তর্নিবেশ ঘটায়।

বাঙালির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় বা জাতি পরিচয় নিয়ে এইসময় আরও অনেক লেখা প্রকাশিত হয়। এইসব লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শারীরিক নৃবিজ্ঞানী বিরজাশঙ্কর গুহ (১৮৯৪–১৯৬১), প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ নলিনীকান্ত ভট্টশালী (১৮৮৮–১৯৪৭), হরিদাস পালিত প্রমুখ। বিরজাশঙ্কর মাথা, নাক ও মুখের গঠনবিষয়ক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে বাঙালির জাতি পরিচয় নির্দিষ্ট করতে চেয়েছেন।৭১ নলিনীকান্ত বলেছেন বাংলা দেশের অধিবাসীদের প্রাগার্য ও আর্য এই দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রাগার্যরা হলেন কৈবর্ত, নমশূদ্র, রাজবংশী ইত্যাদি। তিনি লিখেছেন যে, চীন, জাপানের মানুষরা নিজেদের প্রাগার্য বলতে কুন্ঠিত হয় না। ‘বাঙ্গালা দেশের প্রাগার্যগণই কি চিরদিন এই দারুণ আর্যমোহে আচ্ছন্ন হইয়া থাকিবেন?’৭২ হরিদাস পালিত বলেছেন, বাংলার আদিম অধিবাসী হল কোল জাতি, তিনি এদের ‘মারাং-বুরু মানব’ বলেছেন।৭৩ এইসব রচনাই তদানীন্তন জ্ঞানের ভিত্তিতে রচিত, কিছু রচনা যে দূরকল্পনাভিত্তিক একথাও অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এখানে মূল কথা হল এইসব লেখকরা তাঁদের জ্ঞান বাংলাভাষী পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে আগ্রহী ছিলেন। সেইজন্য শ্রম স্বীকার করতেও অরাজি ছিলেন না। কারণ এই প্রাপ্ত জ্ঞান ছিল ইংরেজি ভাষায়, অ-বিশেষজ্ঞ পাঠকের জন্য সেই তত্ত্ব ভাষান্তর করা সহজ কাজ নয়। এঁরা বাঙালির উৎস বা নৃতত্ত্ব নিয়ে যে-কথা বলছেন আজকের বিজ্ঞান হয়তো তার সত্যতা আর মানবে না। নতুন গবেষণা আরও নতুন নতুন তথ্য আমাদের কাছে উপস্থিত করেছে। কিন্তু এখানে সেটা আমাদের বিচার্য নয়। আমরা এখানে বরং যেটা দেখতে উৎসাহী সেটা হল কীভাবে সমাজবিদ্যা, নৃবিদ্যা প্রথম যুগে বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এই রূপান্তরে ঠিক কোন জায়গায় ভাষা ও জ্ঞান নিজেদের মধ্যে আপোশ করছে, কীভাবেই-বা ভাষা এই নতুন জ্ঞানসমূহকে আয়ত্ত করছে।

৩. বাংলা রচনায় পেশাদার নৃতাত্ত্বিকরা

আগেই বলেছি, বিশ শতকে বাংলা পত্রপত্রিকায় পেশাদার নৃতাত্ত্বিকরাও তাঁদের বিষয় নিয়ে লিখতে আরম্ভ করেন। এ বিষয়ে যাঁর নাম সর্বপ্রথম উল্লেখ করতে হয় তিনি হলেন শরৎচন্দ্র রায়। তিনি তাঁর ইংরেজি রচনার তুলনায় বাংলায় কমই লিখেছেন, কিন্তু নিজের গবেষণার কথা বাংলা পত্রিকায় সহজভাবে লিখতে শুরু করেন ১৯১৩ সাল থেকে। শরৎচন্দ্র রায় (১৮৭১–১৯৪২) শুধুমাত্র নৃতত্ত্ববিদই ছিলেন না, পুরাতত্ত্ব সম্বন্ধেও তাঁর অনুসন্ধান ছিল গভীর ও ব্যাপক। তিনি রাঁচিতে ওকালতি করতেন এবং সেইজন্য রাঁচিকেই নিজের আবাসস্থল করে নিয়েছিলেন। এই রাঁচিকে কেন্দ্র করেই পুরো ছোটোনাগপুর অঞ্চলে নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব সম্বন্ধীয় তাঁর অনুসন্ধান ও গবেষণা ব্যাপ্তিলাভ করে। প্রায় পঞ্চাশ বছর তিনি সেখানে ওরাওঁ, মুন্ডা, হো, খেড়ি, পড়িহা, কুরমি প্রভৃতিদের নিয়ে অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ, গবেষণা করেছিলেন। তিনি স্থানীয় আদিবাসীদের ভাষা শিখে, তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে, তাদের আচার-আচরণ, রীতিনীতি, ধর্ম-সংস্কৃতি, জীবনযাপন প্রণালী, সামাজিক পরিবেশ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, আর্থিক অবস্থা, একান্তভাবে অনুধাবন করেছিলেন। ভারতে নৃতত্ত্বচর্চার বিখ্যাত পত্রিকা Man in India তিনি ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের মৃত্যুকাল পর্যন্ত অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে এই পত্রিকার সম্পাদনা করে গেছেন। অধ্যাপক জে এইচ হাটন, যিনি নিজে ভারতের জাতি-ব্যবস্থা সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন, ১৯৩৮ সালে ইন্ডিয়ান অ্যানথ্রোপলজিকাল ইনস্টিটিউট-এর বার্ষিক অধিবেশনে শরৎচন্দ্রকে ‘ফাদার অফ ইন্ডিয়ান এথোনলজি’ বলে আখ্যাত করেন। আগেই বলেছি, শরৎচন্দ্র তাঁর বিষয় নিয়ে বাংলায় লিখেছিলেন এবং এই লেখাগুলি মূলত প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়।৭৪ সেই লেখার কয়েকটি আমরা আলোচনা করব।

‘ছোটোনাগপুরের ওরাওঁ জাতি’ নামে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত এই ধারাবাহিক রচনাটিতে শরৎচন্দ্র প্রচলিত কাঠামো অনুসরণ করে ওরাওঁদের পরিচয় দিয়েছেন। এখানে ওরাওঁদের যে-সব বিষয়গুলি সম্পর্কে বিবরণ পাচ্ছি তা হল : শারীরিক গঠন ও শারীরিক দক্ষতা, গৃহ, গ্রাম, গ্রামের পরিবেশ, খাদ্য, পরিচ্ছদ, নারীদের পোশাক ও অলংকার, বাদ্যযন্ত্র, উপজীবিকা। এ ছাড়া তিনি আলোচনা করেছেন ওরাওঁদের ধর্মবিশ্বাস, ঠাকুর-দেবতা, ভূতপ্রেত। তিনি লিখেছেন : ‘ওরাওঁ-এরা ভুঁইহার ও রাইয়ৎ-এই দুইটি সামাজিক বিভাগে বিভক্ত। যাহারা জঙ্গল কাটিয়া গ্রাম স্থাপনা করিয়াছিল তাহাদের বংশধরেরা ভুঁইহার নামে পরিচিত। জঙ্গল কাটিবার সময় জঙ্গলের ভূতপ্রেতগণের শান্তিসুখে বাধা পড়িয়াছিল, তাই মধ্যে মধ্যে প্রেতাত্মাদিগকে বলি প্রদান করিবার ভারটা ভুঁইহারদের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। এই ভূতগুলিকে খুঁট-ভূত বলা হয়। . . . জমিতে এক স্থানে একটি কাঠের খোঁটা পুঁতিয়া প্রেতাত্মার আবাসস্থলটি চিহ্নিত করিয়া রাখা হয়।’৭৫ তিনি লিখেছেন, প্রধান প্রধান ভূত ছাড়া ছোটোখাটো ভূত, প্রেতাত্মা অসংখ্য আছে, এদের কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান নেই, বৈরভাবটাই এদের মধ্যে প্রবল। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ও অন্যান্য সময় ওরাওঁরা যে-সব সামাজিক আচার ও অনুষ্ঠান করে তার অধিকাংশই এইসব সংখ্যাতীত ছোটো ভূতের শত্রুতা এড়াবার জন্য। শরৎচন্দ্র ওরাওঁদের জন্ম, বিবাহ, গর্ভ, অন্ত্যেষ্টি প্রভৃতি অনুষ্ঠানের বিবরণ দিয়েছেন। ‘ওরাওঁদের ঐতিহ্য’ নামে অন্য একটি লেখায় শরৎচন্দ্র ওরাওঁদের ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘ঐতিহ্যকে মানিতে হইলে ওরাওঁ জাতির আদি নিবাস যে দাক্ষিণাত্যে ছিল এ কথাটি মানিয়া লইতে হয়। দাক্ষিণাত্যের অধিবাসীদিগের সহিত ইহাদের জাতিগত এবং ভাষাগত অনেক সাদৃশ্যও আছে।’৭৬ এখানে শরৎচন্দ্র ওরাওঁদের কিংবদন্তি, লোককথা, লোকইতিহাসকে আশ্রয় করে তাদের ইতিহাস বলার চেষ্টা করেছেন, তাদের লোককথা অনুযায়ী কীভাবে তারা উত্তর ভারতের নন্দনগড়, পিপড়িগড় প্রভৃতি স্থান থেকে বিহারের সাহাবাদ হয়ে রোহিতাস্য বা রোটাস অধিত্যকায় আশ্রয় নেয়। যুদ্ধবিগ্রহের পর রোটাস দুর্গ পরিত্যাগ করে দুর্ভেদ্য বনের মধ্যে দিয়ে কোয়েল নদীর তীর ধরে তারা প্রথমে পালামৌ এবং তারপর ছোটোনাগপুরে এসে উপনিবেশ স্থাপন করে। ওরাওঁরা তাদের নিজেদের ইতিহাস যেভাবে বলে শরৎচন্দ্র সেই ইতিহাসকেই বিবৃত করেছেন। ঠিক একইভাবে তিনি মুন্ডাদের কিংবদন্তি আশ্রয় করে মুন্ডা জাতির ইতিহাস বলেছেন।৭৭

অন্যদের মধ্যে ওরাওঁদের পুজোপার্বণ নিয়ে লিখেছেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।৭৮ ধান চাষের আগে ও পরে ওরাওঁরা কী-কী উৎসব করে থাকে তার বিবরণ দিয়েছেন তিনি। দু-টি পূজার বিবরণ দিয়েছেন-একটি শস্য বপনের আগে, নাম ‘বন-গাড়ি’, এবং ধান পেকে উঠলে ‘নওয়াখানি’ বা নবান্ন। প্রথমে পুজোর আগে গ্রামের দেবীমণ্ডপে ‘গাঁওয়া দেওতি’ বা গ্রাম্য দেবতার পুজো করে এবং বীজ বপনের আগের দিন নিজের বাড়িতে গৃহদেবতা “বুঢ়াবুঢ়ি”র কাছে সাদা মুরগি ও মদ দেয়। শরৎচন্দ্রের মতো যতীন্দ্রমোহনও বলেছেন যে, ওরাওঁরা নানা অপদেবতায় বিশ্বাস করে। ‘বুঢ়াবুঢ়ি’র পুজোর সময় খুব সাবধানে থাকে এবং চলাফেরা করে, যেমন ‘রাস্তায় চলিবার সময়, কোনোরূপ শব্দ করা একেবারে নিষিদ্ধ। খুব সতর্কতার সহিত পশ্চাৎদিকে না চাহিয়া চলিয়া যাইতে হয়। কারণ ওরাওঁদের বিশ্বাস যে, সেই সময়ে তাহাদের গৃহদেবতা ‘বুঢ়াবুঢ়ি’র প্রতিকূল যে সকল দেবতা ও অপদেবতারা আছে, তাহারা উহাদের সৌভাগ্যের পথে বাধা-বিঘ্ন ঘটাইয়া অমঙ্গল করিতে পারে। তাহারা (অপদেবতারা) উহার পিছনে-পিছনে যাইতে থাকে। সেইজন্যই পশ্চাৎদিকে দৃষ্টি ফিরানো বারণ, পাছে তাহাদের সহিত “চোখাচোখি” হইলে অনিষ্ট হয়।’৭৯ এই ছোটোনাগপুরের হো-দের নিয়ে লিখেছেন পরমেশপ্রসন্ন রায়। তিনি হো-দের কিংবদন্তি আলোচনা করে বলেছেন, সিংভূমের হো-জাতি কোলদেরই এক শাখা। লিখেছেন : ‘ছোটোনাগপুরের অনার্যদিগকে আমরা সাধারণত ধাঙ্গড় বলিয়া থাকি। প্রকৃত নাম কোল। কোলদের তিন শ্রেণি বলা যাইতে পারে। প্রথম মুন্ডারি; ইহারা রাঁচি ও হাজারিবাগে বাস করে। দ্বিতীয় ভূমিজ; ইহারা মানভূম ও ধলভূমে এবং কতকটা হিন্দু ভাবাপন্ন। তৃতীয় লড়াই-কোল বা হো জাতি; ইহারা সিংভূমের পার্বত্য প্রদেশে বাস করে। ইহা ছাড়া ওরাওঁ বলিয়া আর এক জাতি আছে। সিংহভূম জেলা ছোটোনাগপুরের দক্ষিণ পূর্ব অংশে অবস্থিত। ইহার প্রায় চারিদিকেই পাহাড়, এজন্য এ জেলার কোলগণ (হো-জাতি) অন্য স্থানের কোলদের অপেক্ষা অসভ্য, উগ্র এবং কতকটা “যুদ্ধং দেহি” ভাবাপন্ন।’৮০ লেখক এই রচনায় হো-দের পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কে গল্প শুনিয়েছেন, হো-দের কিলি বা গোত্রের বিবরণ দিয়েছেন, পোশাক পরিচ্ছদ, উলকি, সন্তান জন্ম, নৃত্যগীত, হো ভাষার নমুনা এইসব কিছুরই একটা ধারণা পাঠকদের দিতে চেষ্টা করেছেন।

আর এক প্রথিতযশা ও পেশাদার নৃতাত্ত্বিক নির্মলকুমার বসু (১৯০১–১৯৭২) বাংলায় লিখেছেন অনেক। তাঁর নৃতত্ত্বচর্চা বিষয়ে আলাদা করে অন্য একটি অধ্যায়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেছি। এই অধ্যায়ের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এখানে তাঁর কয়েকটি রচনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেব। নির্মলকুমার এক সময় নৃতত্ত্বের শাখা প্রগৈতিহাসিক নৃতত্ত্বের গবেষণায় যুক্ত ছিলেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দলের সদস্য হিসেবে ময়ূরভঞ্জ উৎখননে যোগ দিয়েছিলেন। সেই ময়ূরভঞ্জ নিয়ে তিনি প্রবাসী পত্রিকায় ‘ময়ূরভঞ্জ রাজ্যে প্রাচীনকালের মানব’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই রচনায় নির্মলকুমার শুধুমাত্র ময়ূরভঞ্জের প্রাচীন মানুষ, তাদের পাথুরে অস্ত্র ইত্যাদির কথা বলেননি, একই সঙ্গে সেই অঞ্চলের আজকের মানুষের কথাও বলেছেন, তারা পুরোনো দিনের পাথরকে কী দৃষ্টিতে দেখে তারও বিবরণ দিয়েছেন : ‘আমরা যে-সকল পাথরের অস্ত্র মাটি খুঁড়িয়া পাইয়াছিলাম, তাহা লইয়া খাড়িয়া, বাথুড়ি, ভূমিজ প্রভৃতি সকলের সঙ্গেই আলোচনা করিতাম। আজকাল সকল জাতিই লোহার যন্ত্রাদি ব্যবহার করে। পাথরের মতো যাঁতা, শিল-নোড়া, থালা, বাটি ও তেল পিষিবার জাঁতার অংশবিশেষ নির্মিত হয়। সেইজন্য পুরাকালের পাথরের অস্ত্রগুলি ইহাদের নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিত বস্তু। তাহারই মধ্যে যেগুলি ঘষিয়া মাজিয়া পালিশ করা হইত, ময়ূরভঞ্জের গ্রামাঞ্চলের লোকে এখনও সেগুলিকে সংগ্রহ করিয়া থাকে। তবে পূর্বকালে লোকে নিত্য প্রয়োজনের জন্য উহা ব্যবহার করিত, ইহারা তাহার লৌকিক ব্যবহার কিছু জানে না। এগুলিকে অলৌকিক পদার্থ বলিয়া কল্পনা করে। পালিশ করা পাথরের কুঠারকে উড়িয়া ভাষায় চড়কপাথর বলে, ইহার অর্থ বাজ-পাথর। ইহাদের ধারণা বজ্রপাতের সময়ে মাটির উপর একখণ্ড এইরূপ পাথর বর্ষিত হয়। অনেকের বিশ্বাস চড়কপাথর কুড়াইয়া পাইলে ঘরে রাখা উচিত, তাহাতে গৃহস্বামীর মঙ্গল হয়।’৮১ নির্মলকুমার এই রচনায় খুব সুন্দরভাবে প্রাক-ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্বের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। তিনি প্রাগৈতিহাসিক মানুষের কথা বলেছেন আবার তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আদিবাসীদের কী বিশ্বাস তার কথাও বলেছেন।

নির্মলকুমার জুয়াঙ্গদের নিয়ে অনেকদিন গবেষণা করেছেন। জুয়াঙ্গদের কথা তাঁর হিন্দুসমাজের গড়ন (১৩৫৬) বইটিতে আছে। সাধারণ পাঠকদের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত লেখায় তিনি এদের কথা বলেছেন, কিন্তু বলেছেন তাঁর অনবদ্য স্টাইলে। খানিকটা ভ্রমণকাহিনির ঢঙে, খানিকটা নৃতাত্ত্বিক বিবরণের রীতিতে। অরণ্য, নদী, হরিণের বর্ণনা দিয়েছেন, আবার জুয়াঙ্গদের কাজকর্ম, গ্রাম, পুজো, এসবের কথাও বলেছেন।৮২ ময়ূরভঞ্জের পার্বত্য জাতির উপর এর আগে লিখেছেন ফণীন্দ্রনাথ বসু। তিনি এখানে ভুঁইয়া, পুরাণ, বাথুড়ি, ভূমিজ, পান প্রভৃতিদের বিবরণ দিয়েছেন। এইসব জাতিদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি এবং বিশেষ করে এদের উপর হিন্দুদের প্রভাব নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘একটু মজা এই যে ভুঁইয়া পুরাণ ও বাথুড়িদেরও দেহুরি পুরোহিত আছে, আবার উড়িয়া ব্রাহ্মণ পুরোহিত আছে। যখন হিন্দু দেবদেবীর পূজা হওয়া দরকার, তখন ব্রাহ্মণ এসে শাস্ত্রবিধান মতো পূজা করে, কিন্তু যখন নিজেদের জাতীয় পূজার দরকার তখনই দেহুরির ডাক পড়ে। সেজন্য এদের পূজা পার্বণের মধ্যে দু-টি স্তর আমরা পাই, এক স্তর হচ্ছে হিন্দু সমাজ থেকে আমদানি, আর এক স্তর হচ্ছে এইসব জাতির উপর নিজের প্রভাব বিস্তার . . . তেমনি এদের যে আদিম পূজা তাও ওই দেশের হিন্দুসমাজে প্রবেশ করেছে।’৮৩ এঁদের চেয়েও আগে বাংলা পত্রিকায় ‘ওড়িষ্যার আদিম অধিবাসী’দের নিয়ে লেখেন ভূপতিভূষণ মুখোপাধ্যায়।৮৪ এই রচনায় তিনি মূলত বর্ণনা দিয়েছেন ভুঁইয়াদের, বিশেষত তাদের বিবাহ, গীত, পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির।

বাঙালির ঘরের খুব কাছে থাকে সাঁওতালিরা। সুতরাং সাঁওতালদের সম্বন্ধে অনেক বেশি আলোচনা হবে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। ১৮৮৮ সালে রামব্রহ্ম সান্যাল, সখা পত্রিকায় সাঁওতালদের একটা ছোটো বিবরণ দেন।৮৫ তারপর তাদের জীবন, আচার-আচরণ, পূজা-পদ্ধতি, গ্রাম, পুরাণ, গান নিয়ে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যার কয়েকটা আমরা এখানে আলোচনা করব। রামব্রহ্ম সান্যাল সখা পত্রিকায় এইভাবে তাঁর রচনা শুরু করেন : ‘সখার পাঠক পাঠিকা! সাঁওতালের নাম তোমরা অনেকেই শুনিয়াছ; ধাঙ্গড়, পাহাড়ি এবং কোলদিগের মত ইহারাও ভারতের আদিম অধিবাসী। বাঙ্গালার পশ্চিম সীমান্তে যে সকল জঙ্গল এবং পাহাড় আছে সাঁওতালেরা সেই সকল জঙ্গল এবং পাহাড়ে বাস করে।’৮৬ এরপর তিনি লিখেছেন, ‘সাঁওতালদিগের মধ্যে প্রায়ই কাহারও গোঁফ দাড়ি দেখিতে পাওয়া যায় না। তোমরা মনে করিও না যে, ইহারা গোঁফ দাড়ি কামাইয়া ফেলে, ইহাদের গোঁফ দাড়ি উঠেই না।’৮৭ তিনি বলেছেন সাঁওতালরা অলস নয়, সেইজন্য তাদের মধ্যে অভাব দেখা যায় না, নিজের পরিবারের জন্য যতই পরিশ্রম করতে হোক, সাঁওতালরা তা ‘প্রফুল্ল চিত্তে স্বীকার করে’, প্রাণান্তে অপরের দাসত্ব স্বীকার করে না। তারা যদি শিক্ষার সুযোগ পেত তাহলে মণি-কাঞ্চন যোগ হত। লিখেছেন : ‘পাঠক পাঠিকা! তোমরা সৌভাগ্যক্রমে বিদ্যালয়ে শিক্ষক মহাশয়দিগের নিকট হইতে যে সকল সৎশিক্ষা পাইতেছ, সাঁওতালরা তাহা পায় নাই। যদিও তাহাদিগের চরিত্রে অনেক দোষ দেখিতে পাওয়া যায়, তত্রাচ তাহাদিগের মধ্যে এমন সকল সদগুণ আছে যাহা তোমাদিগের অনুকরণীয়। যদি যথার্থ মনুষ্যত্ব লাভ করিতে চাও তাহা হইলে তোমরাও সাঁওতালদিগের মত শ্রমদক্ষ এবং ধৈর্য্যশীল হও এবং আত্মনির্ভর শিক্ষা করো।’৮৮ প্রভাসচন্দ্র রায় বিশ শতকের শুরুতে সাঁওতালদের পৃথিবী গঠন সংক্রান্ত প্রবাদ, ধর্ম ও দেবতা, রীতিনীতি, বিবাহপ্রথা এবং বিদ্রোহের বিবরণ তাঁর পার্বত্য-কাহিনী গ্রন্থে সংকলিত করেছিলেন। ‘সাঁওতালগণের বিবরণ’ নামে একটি প্রবন্ধে তিনি সাঁওতালদের ভাষা নিয়ে আলোচনা করেছেন।৮৯ তিনি এই প্রবন্ধে কীভাবে সাঁওতালি ভাষায় বিশেষণের সঙ্গে শব্দ সংযুক্ত হয়ে ক্রিয়ার সূচনা করে, ক্রিয়ার সঙ্গে শব্দ যোগ হয়ে কাল সূচনা করে, লিঙ্গ, বচন ইত্যাদি আলোচনা করেছেন। কীভাবে সাঁওতালরা সংখ্যা গণনা করে তারও পরিচয় দিয়েছেন। সত্যেশচন্দ্র গুপ্ত সাঁওতালি ভাষায় সংস্কৃত ও প্রাদেশিক ভাষার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে, সাঁওতালি ভাষায় ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি শব্দ ঢুকে পড়েছে, তাদের ভাষাও আর সমস্ত ভাষার মতো মিশ্রভাষা, যদিও ‘প্রচলিত সাঁওতালি ভাষায় সংস্কৃত শব্দই সর্বাপেক্ষা বেশি-সংস্কৃত বা সংস্কৃতমূলক। পূর্বেই বলেছি যে অনেক বাংলা, হিন্দি ও ওড়িয়া শব্দ সাঁওতালি ভাষার সম্পদ বৃদ্ধি করেছে।’৯০

সাঁওতাল জীবন নিয়ে লিখেছেন বিভূতিভূষণ গুপ্ত।৯১ তিনি সাঁওতালদের আবাসস্থল, খাদ্যাভাস, পঞ্চায়েত, জন্ম, বিবাহ, বিভিন্ন পূজাপার্বণ, অপদেবতা ও ভাষা সম্পর্কে লিখেছেন। প্রমথনাথ চট্টোপাধ্যায় সাঁওতাল গ্রাম ভ্রমণের বিবরণ দিয়েছেন।৯২ প্রমথনাথ অবস্থা বিপাকে সাঁওতালদের গ্রামে থাকতে বাধ্য হন। কীভাবে তাঁর সঙ্গে সাঁওতালদের প্রথম মোলাকাত হল তার বিবরণ বেশ আকর্ষণীয়। সাঁওতাল গ্রামে প্রবেশ করার সময় ‘কী প্রকারে তাহাদের সম্ভাষ করিব ভাবিতে লাগিলাম-একটা বুদ্ধি চট করিয়া জোগাইল। আমার তখন নস্য লওয়া অভ্যাস ছিল (এখনও আছে)। নস্যের ডিবেটা বাহির করিলাম এবং সকলকে বলিলাম “হাত পাত”। নিজ হস্ত প্রসারণ করিয়া দেখাইয়া দিলাম। কিছুমাত্র দ্বিধা না করিয়া গম্ভীরভাবে তাহারা হাত পাতিল। আমি একটু-একটু নস্য লইয়া সকলের হাতে দিলাম। তাহারা নস্য লইয়া কী করিবে তাহা জানিত না, আমি তাহাদের সম্মুখে একটু নস্য লইলাম এবং বলিলাম “এইরকম কর”। তাহারা দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহাই করিল-তাহার পর যাহা হইল তাহা বর্ণনা করা আমার পক্ষে অসাধ্য। হাঁচির সঙ্গে-সঙ্গে হাসির ফোয়ার খুলিল . . . তাহারা বুঝিল যে স্কুলের ডেপুটি একটি অদ্ভুত জীব নয়, তাহাদেরই মত মানুষ।’৯৩ দিনাজপুরের সাঁওতালদের বিবরণে নরেন্দ্রনাথ রায় জানিয়েছেন সাঁওতালরা প্রথমে এখানে জংলা অনাবাদি স্থানে এসে জঙ্গল পরিষ্কার করে জমি আবাদ করে এবং এদের মাধ্যমে অনাবাদি জমিতে চাষবাস বাড়তে থাকে। তিনি এদের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করেছেন, বলেছেন ইংরেজরা এদের অ্যানিমিস্ট আখ্যা দিয়েছে কিন্তু ‘দিনাজপুর জেলার সাঁওতালদিগকে এখন আর অ্যানিমিস্ট বলা যায় কি না সন্দেহ। তাহাদিগের ধর্মবিশ্বাস দেখিতেছি অনেকটা হিন্দুর প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের মতোই হইয়াছে। হাড়ি-বাগদি প্রভৃতির ধর্মবিশ্বাসের সহিত ইহাদের ধর্মবিশ্বাসের একটা আকাশ-পাতাল প্রভেদ মালুম হয় না। আচার-ব্যবহার দেখিয়া ইহাদিগকে অহিন্দু বলা চলে না। এই জেলার বহু সংখ্যক সাঁওতাল দেখিতেছি কালীপূজাও করিয়া থাকে।’৯৪ এই প্রসঙ্গে তিনি স্থানীয় বাঙালি উকিল কাশীশ্বর চক্রবর্তীর কথা বলেছেন, যিনি প্রায় সাত-আটশো সাঁওতালকে ‘সত্যং শিবং সুন্দরং’ মন্ত্র দিয়ে হিন্দু করেছেন এবং সাঁওতালরা তাঁকে গুরু মানে। ‘এই জেলার সাঁওতালগণ দলে দলে চক্রবর্তী মহাশয়ের নিকট হইতে উক্ত মন্ত্র লইয়া হিন্দু হইতেছে।’৯৫ প্রশ্ন করেছেন : ‘লক্ষাধিক সাঁওতাল যখন হিন্দু বলিয়া পরিচিত হইতে চায় এবং হিন্দু সভ্যতার আওতায় থাকিতে চায় তখন হিন্দু সমাজের ও হিন্দু সভ্যতার ধুরন্ধরদিগের কি এই বিষয়ে কিছু কর্তব্য নাই।’৯৬ সাঁওতালদের ‘বাদনা’ উৎসবের বেশ বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় রণেন্দ্রবিজয় দাসের লেখা ‘সাঁওতালদের পূজা-পদ্ধতি’ রচনায়।৯৭

এবার আসি সাঁওতালদের পুরাণ ও গানের প্রসঙ্গে। সাঁওতালদের পুরাণ নিয়ে ১৯২২ সালেই বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘সাঁওতাল পুরাণ’ নামে একটি রচনা লিখেছিলেন।৯৮ এখানে তিনি সাঁওতালদের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্পর্কিত কাহিনি বলেছেন। এর সঙ্গে যোগ করেছেন জন্মান্তরবাদ, তামাকের উৎপত্তি, হরিচন্দ ও ষোলো-শত গোপিনীর কাহিনি। সরসীলাল সরকার-এর কথা আগেই বলেছি। তিনি সাঁওতালদের কিছু গান প্রকাশ করেন সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা-য় ১৯০৯ সালে। সরসীলাল আক্ষেপ করেছেন যে, বাঙালি এদের প্রতি একবার ফিরেও তাকায় না, ‘হিন্দু ভ্রাতৃগণ ইহাদের দিকে মুখ ফিরাইয়া তাকাইয়া ইহাদের অবজ্ঞা-প্রদর্শন ব্যতীত সুখে দুঃখে কখনও সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছেন এরূপ মনে হয় না।’৯৯ তিনি লিখেছেন : ‘সাঁওতাল জাতির গান তাহাদের জীবনের একটি প্রধান অঙ্গ। ইহারা পরিশ্রমশীল, কর্ম করিতে করিতে শ্রমভার লাঘবের জন্য গান করিয়া থাকে, বিশ্রামের সময় সংগীত উপভোগ করাই ইহাদের একটি প্রধান আনন্দ। বিবাহ এবং উৎসবাদির সময় দলবদ্ধ হইয়া বাজনার সহিত নৃত্য করিয়া গান করাই ইহাদের প্রধান স্ফূর্তি।’১০০ সন্তোষচন্দ্র মজুমদার (১৮৮৪–১৯২৬) ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সুহৃদ শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের পুত্র এবং শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের প্রায় সূচনাকালের ছাত্র। রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমেরিকায় কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষা করে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। রথীন্দ্রনাথই তাঁকে এই পদে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি বহু সাঁওতালি গান সংগ্রহ করে গদ্যে সেগুলির বাংলা অনুবাদ করেছিলেন, কিছু গান ইংরেজিতেও অনুবাদ করেন। তাঁর অকাল মৃত্যুর অনেক বছর পর বিশ্বভারতী পত্রিকা-য় তাঁর সংগৃহীত গানের একটি অংশ মুদ্রিত হয়, এর সঙ্গে মুদ্রিত হয় সাঁওতাল-প্রসঙ্গের ‘আলোচনা’ উপলক্ষে প্রবাসী পত্রিকায় (শ্রাবণ ১৩৩২) সাঁওতালি গান সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য।১০১ সন্তোষচন্দ্র লিখেছেন সাঁওতালদের উপর জমিদার, মহাজনদের অত্যাচার বেড়েই চলেছে, জমিদাররা এদের দিয়ে ‘অনুর্বর কঙ্করময় অমসতল’ জমি বহু পরিশ্রমে উর্বর জমিতে পরিণত করিয়ে তা এদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে অন্যকে উচ্চহারে বিলি করেন। ‘তথাপি ইহাদের জীবনযাত্রার মধ্যে যে সংযম, যে শান্তি, যে সৌন্দর্য এবং অনাবিলতা আছে, সভ্যতাভিমানী খুব অল্প মানব-সমাজেই তাহা সুলভ। ইহারা দরিদ্র, কিন্তু বর্বর নহে।’১০২ সাঁওতালদের গান সম্পর্কে সন্তোষচন্দ্র লিখছেন : ‘কিছুকাল হইতে সাঁওতালি প্রেমের এবং বিবাহের গান আমি সংগ্রহ করিতেছি। সংগৃহীত চার পাঁচ শত গানের মধ্যে এমন কিছু পাই নাই যাহাকে অশ্লীল অথবা ইতর বলা চলে। সব ভাষাতেই অল্পাধিক পরিমাণে অশ্লীল গান প্রচলিত থাকে, সাঁওতালি ভাষাতেও আছে-এই শ্রেণির গান “বীরগান” নামে পরিচিত। সাঁওতালি ভাষায় “বীর” শব্দের অর্থ জঙ্গল-বৎসরের মধ্যে দুই-একবার যখন ইহারা শিকারে যায়, গভীর জঙ্গলের মধ্যে পুরুষেরা তখন এই সকল গান গাহিয়া থাকে। এ দলে মেয়েরা কখনও থাকে না। অল্পবয়স্ক ছেলেদেরও এখানে প্রবেশ নিষেধ। . . . বস্তুতপক্ষে মদ্যপানে বিহ্বল কোনো সাঁওতালও এ ধরনের কোনো গান গ্রামে কাছাকাছি গাহিলে কঠিন সামাজিক দণ্ড ভোগ করে এবং এ অপরাধে আট দশ বছরের মধ্যে গ্রামে দুই-একজনকেও অপরাধী হইতে শোনা যায় না।’১০৩ এবার সব শেষে সন্তোষচন্দ্রের অনুবাদ থেকে কয়েকটি সাঁওতালি গানের উল্লেখ করি :

আমাদের দেশে তো মহুয়াগাছের অভাব নেই,
দুপুরে বিকালে সব সময়েই তো মহুয়া ঝরে পড়ছে।
বাতাস হিংসুটে, রোদ্দুরটা অলস-
প্রিয়, গরম বাতাসের দিনে আজ মহুয়া না-ই কুড়লে।

নদীর পাড়ে পাড়ে সুপুরুষটি তো বেশ শিস দিয়ে ফিরছ।
শরীরের সাজ দেখে আর কী করব।
ঘরে তোমার না আছে ধন, না আছে অন্ন।

ভোরে জল আনতে গিয়েছিলুম, মা-পিছন ফিরে দেখলুম,
রেড়িগাছের ডগাগুলো কে ভেঙে দিয়েছে।
বড়ো পাথরের চাতালটার উপর স্নান করে মাথা ঘসে
নিজের ছায়ার দিকে চাইলুম।
যৌবন তো আর আমার নেই।

পথে পথে চলেছি, মাঝ সড়কে এসে দাঁড়ালুম।
এর আশেপাশে কোথাও থাকো যদি
তোমার পিতল-বাঁধানো বাঁশিটি
একবার বাজাও তো জীবন।

আমরা তাহলে দেখছি বিশ শতকে বাঙালির জানার পরিধি ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে, নিজের গণ্ডির বাইরে অন্য মানুষ, অন্য সংস্কৃতি, অন্য ধরনের জীবন, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান জানার মধ্যে দিয়েই বাঙালির চিন্তায় নৃতত্ত্বের অনুপ্রবেশ। অন্য জাতির বিবরণ, তার পরিচয় বাংলা ভাষায় বিবৃত করার এই যে প্রচেষ্টা, এর মধ্যে পেশাদার নৃতাত্ত্বিকরা সংখ্যায় বেশি নন। যাঁরা এই বিষয় নিয়ে লিখছেন তাঁরা বিভিন্ন পেশার মানুষ, তাঁদের শিক্ষা, বিশেষজ্ঞতা, অভিজ্ঞতা ভিন্ন ভিন্ন এবং নিজেদের চিন্তাবুদ্ধি মতো এইসব মানুষদের নিয়ে লিখেছেন। সাঁওতালদের নিয়ে একদম প্রথম দিকে লিখেছিলেন যে রামব্রহ্ম সান্যাল (১৮৫০–১৯০৮) তিনি ছিলেন জীববিজ্ঞানী, কলকাতা পশুশালার প্রথম তত্ত্বাবধায়ক এবং একজন উদ্ভিদবিদ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ভাষাতত্ত্ববিদ, প্রবোধচন্দ্র সেন ছিলেন ছান্দসিক, স্বর্ণকুমারী ছিলেন সাহিত্যিক, সন্তোষচন্দ্র শিক্ষক, অমূল্যচরণ ছিলেন বিশ্বকোষ রচয়িতা, এ-রকম আরও অনেকের সাক্ষাৎ পেয়েছি এই আলোচনায়। অর্থাৎ বিশ শতকে এক সাধারণ জ্ঞানের অঙ্গ হিসেবেই এই জাতি পরিচয়গুলি লিখিত হয় এবং পরোক্ষভাবে এই বিবরণগুলির মাধ্যমে নৃতত্ত্বচর্চা বিকশিত হয়। আমি আগে বলেছি, নৃতত্ত্বচর্চার সঙ্গে ভ্রমণকাহিনি, পরিব্রাজন এইসব কিছুর একটা সম্পর্ক আছে। এই আলোচনায়ও আমরা সেই গোত্রের বেশ কিছু রচনা দেখেছি। সবচেয়ে বড়ো কথা হল এই রচনাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল সাধারণ পাঠকের জন্য প্রকাশিত বাংলা পত্রপত্রিকায়। নিশ্চয়ই এই আশা করে যে পাঠক বাঙালি সংস্কারমুক্ত হবে, তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত হবে, সে হবে উদারচেতা।

৪. পঞ্চানন মিত্র ও বিশ শতকের প্রারম্ভে নৃতত্ত্বচর্চা

পঞ্চানন মিত্র (১৮৯২–১৯৩৬) কিন্তু প্রথমে নৃতত্ত্বের ছাত্র ছিলেন না। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষার ছাত্র। ছাত্রজীবন শেষ করে তিনি তিন বছর (১৯১৫–১৮) বঙ্গবাসী কলেজে ইংরেজি ভাষার অধ্যাপনা করেন। নৃতাত্ত্বিক জগতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয় পি আর এস গবেষণাপত্র লেখার সময়-যার বিষয় ছিল ‘Prehistoric Arts and Crafts of India’. পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপকের পদে আসীন হয়েছিলেন। নৃতাত্ত্বিক হিসেবে যখন তাঁর খ্যাতি প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে ওই সময়, ১৯২৫ সালে, শাশ্বত সংবাদ নামে এক সাময়িক পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, যার বিষয় ছিল আদিম মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও তার উৎপত্তি। এই বিষয়টি আলোচনা প্রসঙ্গে লেখক সমাজতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব দু-টি বিষয়ই গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করেন। তাঁর প্রবন্ধের নামগুলি ছিল, ‘ফ্রেজারের সমাজতত্ত্ব’, ‘ডুর্কহাইমের সঙ্ঘ ধর্মবাদ’, ‘লেভিব্রুলের জনমন ও ফ্রয়েডের সুপ্তমনবাদ’, ‘ডারুইনের জীববর্গোৎপত্তি তত্ত্ব’ ইত্যাদি।১০৪ আমার ধারণা বাংলা ভাষায় এমিল ডুরখাইম (১৮৫৮–১৯১৭) এবং লুসিয়েন লেভি-ব্রুহল (১৮৫৭–১৯৩৯) নিয়ে এই প্রথম আলোচনা হল। এই প্রসঙ্গে তিনি সিগমন্ড ফ্রয়েড ও জার্মান মনস্তত্ত্ববিদ উইলহেলম ভুন্ট (Wilhelm Wundt, ১৮৩২–১৯২০) এই দু-জনের গবেষণারও পর্যালোচনা করেন।

আদিম মানবের ধর্মবোধের উৎপত্তির কথা বলতে গিয়ে পঞ্চানন মিত্র প্রথমে হার্বার্ট স্পেনসার (১৮২০–১৯০৩) বর্ণিত সামাজিক বিশ্লেষণ দিয়ে শুরু করেন। তিনি বলেন, স্পেনসারের মতে ধর্মের উদ্ভবের হেতু হল-১) ভীতি, ব্যাধি, জরা, মৃত্যুভয়; ২) ভূতপ্রেতের ধারণা যা মানুষের স্বপ্নদৃষ্ট মূর্তি থেকে সৃষ্ট ও ৩) পূর্বপুরুষ পূজা। এই থেকেই ক্রমশ বৃক্ষ, পশু প্রভৃতির পুজো আরম্ভ হয়, যা একেশ্বরবাদে পরিণতি লাভ করে। লেখক, অবশ্য ভীতিই যে ধর্মভাবের প্রবর্তনের একমাত্র কারণ এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এরপর তিনি Golden Bough (১৮৯০) গ্রন্থের বিখ্যাত লেখক জেমস জর্জ ফ্রেজার (১৮৫৪–১৯৪১)-এর তত্ত্ব আলোচনা করেন। তিনি বলেন ফ্রেজার আদিম মানবের মনকে প্রধানত দু-ভাবে আমাদের সামনে উপস্থিত করেন। প্রথম হল ম্যাজিকের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নির্ণয় করে এবং দ্বিতীয় টোটেমিজম ও এক্সোগামির সম্পর্কসূত্রে। ফ্রেজার বলেন ম্যাজিক ছিল আদিম যুগের বিজ্ঞান। এই প্রসঙ্গেই লেখক ফ্রেজারের সমাজতত্ত্ব আলোচনা করেছেন, যেখানে ফ্রেজার বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিবাহ সম্পর্কের বিবরণ দিয়েছেন। ফ্রেজারের সমাজতত্ত্ববাদের বিপরীত দৃষ্টিকোণ হিসেবে লেখক উইলহেলম ভুন্টের মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে একটা ধারণা দিতে চেষ্টা করেছেন। ভুন্ট বলেছেন আদিম মানবের মধ্যে ভাব প্রবণতাই বেশি ছিল এবং ভাবের ঘোরেই তারা জগৎ পর্যবেক্ষণ করত, ‘সুতরাং ফ্রেজারের সমাজতত্ত্ববাদ তাহার কাছে টিকিল না।’ পঞ্চানন মিত্র লিখেছেন : ‘সমাজমন ও ব্যক্তিগত মন অন্যান্য দার্শনিকের ন্যায় একেবারে ভিন্ন না করিয়াও ভুন্ট বহু ব্যক্তির একত্র সমাবেশ, তাহাদের ভাব ও অনুষ্ঠানের আদান প্রদান ও তাহাদের পরস্পরের সম্বন্ধ ও সৃষ্টি ক্ষমতাই যে সভ্যতার মূল তাহাই বারবার দেখান। ভুন্ট স্পষ্টই দেখেন ধর্ম্ম ও পৌরাণিক ইতিকথার মূলে মানবমনের অন্তর্নিহিত ভাব ও ধারণাবলীর বহির্জগতে আরোপ মাত্র আর কিছুই নয়। এইরূপ ধর্ম্মের মানসিক ভিত্তি প্রায় ফ্রয়েডের ‘চিন্তার সর্ব্বপ্রাধান্যের’ তুল্যমূলক।’১০৫

ডুরখাইম সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে লেখক বলেন যে টাইলর ও স্পেনসার আদিম মানুষের আচার-ব্যবহার ও অনুষ্ঠান আলোচনা করে এটাই বলতে চেয়েছেন যে তারা জড়বস্তুতে চৈতন্য আরোপ করত এবং জড়বস্তু পুজোই ছিল আদিম মানবের প্রকৃতি ও ধর্ম। অন্যদিকে ‘ফরাসী সমাজতত্ত্ববিদ ডুর্কহাইমই প্রথমে মানবের যে দুটি চিন্তার ধারা আছে-একটি ব্যক্তিগত অপরটি সঙ্ঘগত এ কথার উপর বিশেষ জোর দেন। তিনি আরও বলেন যে স্বপ্ন, মোহ, আবেশ, ভ্রান্তি প্রভৃতি কতকগুলি অলীক ধারণার উপর যে শত সহস্র মানবপূজিত ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম্মপন্থা গড়িয়া উঠিয়াছে ইহা কখনই সম্ভবপর নহে। ধর্মের মূলে একটি বাস্তব পদার্থ আছে-সেটা মানব সঙ্ঘমনের অনুভূতি। এই সঙ্ঘমনের প্রকৃতি ও গঠন প্রণালীর অনুসন্ধান দ্বারাই ধর্ম্মবিশ্বাস গঠনের তত্ত্ব পাওয়া যাইবে।’১০৬ এখানে লেখক মূলত ডুরখাইমের The Elementary forms of Religious Life (১৯১২) বইটির কথা বলছেন, যেখানে ডুরখাইম ধর্মের উৎস হিসেবে কলেকটিভ রিপ্রেজেনটেশনের কথা বলেছেন। মনে রাখতে হবে পঞ্চানন মিত্র এ লেখা বাংলায় লিখছেন ডুরখাইমের মৃত্যুর মাত্র আট বছর পর, ১৯২৫ সালে। সমাজতত্ত্বের ছাত্ররা জানেন, লুসিয়েন লেভি-ব্রুহল, ডুরখাইমের অনুগামী ছিলেন এবং তিনিও ডুরখাইমের ধারা অনুসরণ করে বলেন যে আদিম মানুষের কলেকটিভ রিপ্রেজেনটেশন বস্তুত যুক্তি-পূর্ব (pre-logical) এবং রহস্যময় [How Natives Think (১৯১০) এবং Primitive Mentality (১৯২২)]। পঞ্চানন মিত্র লিখেছেন : ‘লেভি-ব্রূল জনমনবাদ বেশ এক নূতনভাবে খাড়া করেন। তিনি দেখাইতে চেষ্টা করেন বিভিন্ন স্থানের বিচিত্র সভ্যতাই জনমনের পৃথক পৃথক আকার এবং ইহা হইতে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ধর্ম্ম প্রভৃতি গঠিত হইয়াছে। লেভি-ব্রূল জনমনের একটি প্রধান বিশেষত্ব দেখান যে ইহা যুক্তি বিচারের উপর আদৌ প্রতিষ্ঠিত নয়।’১০৭ এই প্রসঙ্গেই লেখক ফ্রয়েডের টোটেম ও টাবু আলোচনা করেছেন।

এই সিরিজে লেখকের শেষ লেখা ‘সেরাইকেলায় মানব-তত্ত্ব’। এখানে লেখক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের পাঠক্রমের অংশ হিসেবে যে-সব ফিল্ড-ওয়ার্কে তাঁরা অংশ নিয়েছেন তার কথা বলছেন। তিনি বলেছেন নৃতত্ত্ব কোর্সে ফিল্ড-ওয়ার্ক কম্পালসারি ছিল। ‘গত বৎসর ও এ বৎসর আমার সহকারী অধ্যাপক শ্রীতারকচন্দ্র দাস ও শ্রীতারকচন্দ্র রায়চৌধুরী সহ আমরা সরাইকেলা স্টেটের আতিথ্য ও অনুগ্রহে সুনিয়মিত কার্য্য করিবার অবসর পাই। এখানে বলা দরকার যে আমাদের প্রিয় ছাত্র শ্রী নির্ম্মলকুমার বসু এম এস সি এই দুই বৎসরের কার্য্য বৈজ্ঞানিকভাবে ও আন্তরিক অনুরাগের সহিত চালাইয়া সকলকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করিয়া রাখিয়াছেন।’১০৮ ছাত্রদের দ্বারা বিভিন্ন এথনোগ্রাফি স্পেসিমেন সংগ্রহ ও তাদের বিচারের কথা বলতে গিয়ে লেখক প্রশ্ন করেছেন : ‘এই গবেষণার ফল কী?’ উত্তর দিয়েছেন, কূপমণ্ডূকতার মোহ দূর করা।৫. শেষ কথা

দার্শনিক ইম্যান্যুয়েল কান্ট তাঁর শেষ জীবনে প্রায় পঁচিশ বছর নৃতত্ত্ব পড়িয়েছিলেন। কান্ট মনে করতেন নৃতত্ত্ব মানুষকে সংস্কারমুক্ত করে, তার মনকে সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডূকতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে। বিশ শতকে বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্বচর্চার ইতিহাস নিয়ে আমরা যে আলোচনা করলাম সেখানে আমরা দেখতে পাই বিশ শতকের শুরুতেও খুব বেশি পেশাদার নৃতাত্ত্বিক ছিলেন না। যাঁরা বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্বচর্চা করেছিলেন তাঁরা ছিলেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। আমরা দেখি এঁদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যিক, কবি, সমাজসেবী ও ঔপন্যাসিক- তাঁরা নিজেদের মতো করে নৃতত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন। এঁদেরও মূলত উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির জানার পরিধিকে ক্রমশ বিস্তারিত করা। জাতপাত, সমাজে উঁচু-নীচুর বিভেদ, রক্ষণশীলতা ও অন্যান্য নানাবিধ বিভাজনে বিজড়িত বাঙালি সমাজকে এঁরা জানাতে চেয়েছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অন্যান্য গোষ্ঠী বা সমাজের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে। ভারতের মধ্যেই এমন অনেক গোষ্ঠী বা সমাজ আছে যেখানে অন্যরকম প্রথা বা সংস্কৃতি দেখা যায়। এঁরা বলেছেন বহু সমাজ আছে যেখানে বিধবার বিয়ে হয়, যেখানে নারীরা বাজারে বসে নানাবিধ ব্যাবসা করেন। আমরা দেখেছি এই রচনাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল সাধারণ পাঠকের জন্য প্রকাশিত বাংলা পত্রপত্রিকায়। আসলে এইসব লেখার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি সমাজকে উদারমনস্ক করা, বাঙালি সমাজকে আরও একটু সামাজিক সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

 ১. এই অধ্যায়টি লেখার জন্য যে-বইটির উপর আমি সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করেছি সেটি হল : দীপঙ্কর ঘোষ (সম্পা.), বাংলা সাময়িকপত্রে আদিবাসীকথা : প্রাক-স্বাধীনতাপর্বে প্রকাশিত ও নৃতত্ত্ব ও আদিবাসীচর্চা বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন (কলকাতা : লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, ২০০৫)। অত্যন্ত মূল্যবান এই সংকলনটি বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্বচর্চা সম্পর্কে এক সম্যক ধারণা দেয়। এই অধ্যায়ে, আলাদাভাবে বলা না থাকলে, সমস্ত উদ্ধৃতি এই সংকলনে পুনর্মুদ্রিত প্রবন্ধগুলি থেকে নেওয়া হয়েছে। পাঠকদের সুবিধার জন্য প্রবন্ধটি মূল যে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেই পত্রিকার নাম এবং বছর দিয়েছি। কিন্তু উদ্ধৃতির পৃষ্ঠা সংখ্যা এই সংকলন থেকে, এটা যেন পাঠক মনে রাখেন।

 ২. স্বর্ণকুমারী দেবী, ‘নীলগিরির টোডা জাতি’, ভারতী, ১৯ মাঘ ১৩০২ (১৮৯৬)।

 ৩. গিরিবালা দেবী, ‘সিংভূমের কোলজাতি’, ভারতী, ভাদ্র ১৩০০ (১৮৯৩), পৃ. ১০৩–৪।

 ৪. ওই, পৃ. ১১২।

 ৫. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘কোল-জাতির সংস্কৃতি’, বিশ্বভারতী পত্রিকা, কার্ত্তিক-পৌষ ১৩৫৩ (১৯৪৬), পৃ. ১২২–২৩।

 ৬. গিরিবালা দেবী, ‘সিংভূমের কোলজাতি’, পৃ. ১০৯।

 ৭. ওই, পৃ. ১০৯।

 ৮. স্বর্ণকুমারী দেবী, ‘নীলগিরির টোডা জাতি’, পৃ. ৩০৯।

 ৯. ওই, পৃ. ৩০৬।

 ১০. হেমন্তকুমারী চৌধুরী, ‘খাসিয়া জাতি’, অন্তঃপুর, ৪(৫), জ্যৈষ্ঠ ১৩০৮ (১৯০১)।

 ১১. ওই, পৃ. ১৬৯।

 ১২. হরিপদ রায়, ‘গারোদের কথা’, প্রবাসী, ২৬, ১ম খণ্ড, ২য় সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩ (১৯২৬)।

 ১৩. ওই, পৃ. ১৫৮।

 ১৪. স্বর্ণকুমারী দেবী, ‘নীলগিরির টোডা জাতি’, পৃ. ৩০৬।

 ১৫. অজ্ঞাত, ‘গারো পল্লিতে একদিন’, সৌরভ, ২(৬), চৈত্র ১৩২০ (১৯১৪)।

 ১৬. ওই, পৃ. ১৬৫।

 ১৭. ওই, পৃ. ১৬৬।

 ১৮. ওই, পৃ. ১৬৬।

 ১৯. স্বর্ণকুমারী দেবী, ‘নীলগিরির টোডা জাতি’, পৃ. ৩০৭।

 ২০. মোহাম্মদ মোদাব্বের, ‘নীলগিরির পাহাড়িয়া জাতি’, মাসিক মোহাম্মদী, ৭(৩), পৌষ ১৩৪০ (১৯৩৩), পৃ. ৩১৩।

 ২১. গোপালচন্দ্র নিয়োগী, ‘রাভা জাতির বিবরণ’, সৌরভ, ৬(৫), ফাল্গুন ১৩২৪ (১৯১৮), পৃ. ১৭৪।

 ২২. মুদ্রারাক্ষস, ‘মিশমি জাতি’, প্রবাসী, ৭(১১), ফাল্গুন ১৩১৪ (১৯০৭); রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ‘চুলকাটা মিশমি’, প্রদীপ, ১(৫), বৈশাখ ১৩০৫ (১৮৯৮); মুদ্রারাক্ষস, ‘আসামের নাগাজাতি’, প্রবাসী, ৭(১২), চৈত্র ১৩১৪ (১৯০৭)।

 ২৩. সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, ‘নাগারাজ্যে কয়েক বৎসর’, সৌরভ, ১৪(৭), শ্রাবণ ১৩৩৩ (১৯২৬); ‘নাগারাজ্যের অভিজ্ঞতা’, সৌরভ, ১৪(৮), ভাদ্র ১৩৩৩ (১৯২৬)।

 ২৪.  সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, ‘নাগারাজ্যে কয়েক বৎসর’, পৃ. ২১৫।

 ২৫. ওই, পৃ. ২১৬।

 ২৬. কেদারনাথ মজুমদার, ‘কুকিদিগের বিবরণ’, নব্যভারত, ২০(২), জ্যৈষ্ঠ ১৩০৯ (১৯০২)।

 ২৭. ওই, পৃ. ২২৩।

 ২৮. ওই, পৃ. ২২৫।

 ২৯. অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, ‘কুকি’, ভারতী, ৪১(১০), মাঘ ১৩২৪ (১৯১৮)।

 ৩০. ওই, পৃ. ২৩৬।

 ৩১. অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, ‘জাতি-বিজ্ঞান’, কায়স্থ-সমাজ, মাঘ-ফাল্গুন ১৩৩২, ৫০৫–৫১৭; ভারতবর্ষ, আষাঢ় ১৩২৮ থেকে; সুবর্ণবণিক সমাচার, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪, ২০১–২০৫; ‘দ্রাবিড় জাতি’, প্রবাসী, কার্তিক ১৩২৮, ৬১–৬৭; ‘চেরোজাতি’, প্রবাসী, পৌষ ১৩২৮, ২৮৯-২৯৬; ‘বগধ জাতি’, প্রবাসী, অগ্রহায়ণ ১৩২৯, ১৪৫-১৫৫; ‘যোগি জাতি’, প্রবাসী, চৈত্র ১৩২৯, ৭৫৭–৭৬৪; ‘কেবট জাতি’, প্রবাসী, পৌষ ১৩৩১, ৩০৩–৩১২; ‘কিরাত জাতি’, ভারতী, ভাদ্র ১৩২৬, ৩৪১–৩৪৫; ‘অসুর জাতি’, মাসিক বসুমতী, অগ্রহায়ণ ১৩৩৩, ১৯১–১৯৮; ‘জাতি’, মোদক-সংহিতা, ফাল্গুন-চৈত্র ১৩৪৩, ৯২–৯৮।

 ৩২. অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, ‘ত্রিপুরা-রাজ্যের কতিপয় জাতি’, ভারতী, ৪১(১১), ফাল্গুন ১৩২৪ (১৯১৮)।

 ৩৩. অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, ‘ত্রিপরা বা তিপারা জাতি’, ভারতী, ৪১(৯), পৌষ ১৩২৪ (১৯১৭)।

 ৩৪. ওই, পৃ. ১৯৮।

 ৩৫. সতীশচন্দ্র ঘোষ, চাকমাজাতি (রাঙামাটি : লেখকদ্বারা প্রকাশিত, ১৯০৯)। শরৎচন্দ্র দাস এই বইটির ভূমিকা লেখেন। এই লেখকের অন্য একটি বই হল : চট্টগ্রামের বিবরণী (রাঙামাটি : লেখকদ্বারা প্রকাশিত, ১৯১৬)। তিনি চাকমাদের নিয়ে প্রবাসী পত্রিকার আষাঢ় ও মাঘ ১৩১৩ সংখ্যা দু-টিতে লিখেছিলেন। এ ছাড়া চাকমাদের বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন নিয়ে বৌদ্ধবন্ধু পত্রিকার বৈশাখ থেকে কার্ত্তিক ১৩১৩ সংখ্যাগুলিতে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন।

 ৩৬. সতীশচন্দ্র ঘোষ, ‘চাকমা জাতির সংস্কার-কর্ম’, প্রবাসী, ৭(৮), অগ্রহায়ণ ১৩১৪ (১৯০৭)।

 ৩৭. ওই, পৃ. ২৬২।

 ৩৮. ওই, পৃ. ২৬২–৬৩।

 ৩৯. সতীশচন্দ্র ঘোষ, ‘চাকমাদিগের ভাষা-তথ্য’, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ৪র্থ সংখ্যা ১৩১৩ (১৯০৬)।

 ৪০. ওই, পৃ. ২৫৩।

 ৪১. ওই, পৃ. ২৬০।

 ৪২. নলিনীকুমার ভদ্র, ‘হালামদের কথা’, প্রবাসী, ৩০(১), ৪র্থ সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩৩৭ (১৯৩০)।

 ৪৩. ওই, পৃ. ২৭৭।

 ৪৪. ওই, পৃ. ২৭৭।

 ৪৫. ওই, পৃ. ২৭৮।

 ৪৬. নলিনীকুমার ভদ্র, ‘সিন্টেংদের দেশে’, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪০ (১৯৩৩)।

 ৪৭. ওই, পৃ. ২৮৬।

 ৪৮. ওই, পৃ. ২৯০।

 ৪৯. ওই, পৃ. ২৯১।

 ৫০. লালতুদাই রায়, ‘আসামের কুকি জাতি’, প্রবাসী, ৩০(১), ৫ম সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৩৭ (১৯৩০)।

 ৫১. ওই, পৃ. ২৩৮।

 ৫২. ওই, পৃ. ২৪৩। এর উত্তরে আরও একটি লেখা প্রকাশিত হয় : জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সোমদ্দার, ‘আসামের কুকি জাতি’, প্রবাসী, ৩০(১), ৬ষ্ঠ সংখ্যা, আশ্বিন ১৩৩৭ (১৯৩০)।

 ৫৩. নলিনীকান্ত মজুমদার, ‘লেপচা জাতির কথা’, মানসী ও মর্ম্মবাণী, ১৬(২), ৬ষ্ঠ সংখ্যা, মাঘ ১৩৩১ (১৯২৫)।

 ৫৪. সত্যকিঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, ‘গোঁড় জাতি’, প্রবাসী, অগ্রহায়ণ ১৩৪১ (১৯৩৪)।

 ৫৫. ওই, পৃ. ৩০০।

 ৫৬. ওই, পৃ. ৩০০।

 ৫৭. গিরিজাকুমার ঘোষ, ‘আণ্ডামানি’, প্রবাসী, ১(৫), ভাদ্র ১৩০৮ (১৯০১)।

 ৫৮. সরসীবালা সরকার, ‘পাহাড়ি জাতির মধ্যে অগ্ন্যুৎপাদনের উপায়’, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ৩য় সংখ্যা, ১৩২৬ (১৯১৯); ‘পাহাড়ি জাতির খাদ্যের উপকরণ’, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ২য় সংখ্যা, ১৩২৮ (১৯২১)।

 ৫৯. অজ্ঞাত, ‘ভারতে অনার্যদিগের মধ্যে বিবাহপদ্ধতি’, ভারতী, ৩৭(১০), মাঘ ১৩২০ (১৯১৪)।

 ৬০. শরৎচন্দ্র মিত্র, ‘ব্যাঘ্র-পূজা’, ভারতী, আষাঢ় ১৩০০ (১৮৯৩)।

 ৬১. অজ্ঞাত, ‘আদিম মনুষ্য’, বঙ্গদর্শন, ৪, ভাদ্র ১২৮২ (১৮৭৫), পৃ. ১০–১১।

 ৬২. চিত্তরঞ্জন রায়, ‘মানব-বিজ্ঞান’, ভারতবর্ষ, ১৪(২), ১ম সংখ্যা, পৌষ ১৩৩৩ (১৯২৬), পৃ. ৪।

 ৬৩. ওই, পৃ. ৫।

 ৬৪. পঞ্চানন মিত্র, ‘ভারতে মানবের প্রাচীনত্ব ও ন্যূনাধিক চারি লক্ষ বৎসর পূর্বের কয়েকটি প্রাগৈতিহাসিক নিদর্শন’, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ৩য় সংখ্যা, ১৩২৬ (১৯১৯)।

 ৬৫. অবিনাশচন্দ্র দাস, ‘অতিকায় প্রত্নমানব’, বঙ্গবাণী, ৫(৫), আষাঢ় ১৩৩৩ (১৯২৬)।

 ৬৬. অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, ‘জাতি-বিজ্ঞান’, ভারতবর্ষ, ১০(১), ২য় সংখ্যা, শ্রাবণ ১৩২৯ (১৯২২)।

 ৬৭. ওই, পৃ. ৩৪।

 ৬৮. ওই, পৃ. ৩৬-৩৭।

 ৬৯. প্রবোধচন্দ্র সেন, ‘বাংলার ইতিহাসের কয়েকটি গোড়ার কথা’, বিচিত্রা, ৬(২), চৈত্র ১৩৩৯ (১৯৩৩)।

 ৭০. ওই, পৃ. ৪২।

 ৭১. বিরজাশঙ্কর গুহ, ‘বাঙালির জাতি-বিশ্লেষণ’, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪০ (১৯৩৩)।

 ৭২. নলিনীকান্ত ভট্টশালী, ‘বাঙ্গালাদেশের আদিম অধিবাসী’, সোনার বাংলা, শারদীয় সংখ্যা ১৩৫২ (১৯৪৫)।

 ৭৩. হরিদাস পালিত, ‘বাংলার আদিম জাতি ও সভ্যতা’, কায়স্থ-সমাজ, ১২(১২), চৈত্র ১৩৩৮ (১৯৩২); ‘আদ্য বাঙ্গালী জাতি-মারাং-বুরু মানব’, উদয়ন, ১(২), একাদশ সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩৪০ (১৯৩৪)।

 ৭৪. শরৎচন্দ্র রায় লিখিত বাংলা প্রবন্ধগুলি হল : ‘ছোটনাগপুরের ওরাওঁ জাতি’, প্রবাসী, ১৩(১), ১, ৩, ৪ সংখ্যা, বৈশাখ, আষাঢ়, শ্রাবণ ১৩২০ (১৯১৩); ‘ওরাওঁদের প্রতিবেশী’, প্রবাসী, আশ্বিন ১৩২০ (১৯১৩); ‘একজন ওরাওঁর আত্মকাহিনি’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩২১ (১৯১৪); ‘ওরাওঁ যুবকদের জীবনযাত্রা’, প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩২১ (১৯১৪); ‘ওরাওঁদের শিল্প’, প্রবাসী, আশ্বিন ১৩২১ (১৯১৪); ‘ওরাওঁদের ঐতিহ্য’, প্রবাসী, ১৪(২), ১ম সংখ্যা, কার্তিক ১৩২১ (১৯১৪); ‘নর ও বানর’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪০ (১৯৩৩); ‘আদি মানব ও আসল’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪১ (১৯৩৪); ‘ছোটনাগপুরের সাহিত্য-সেবার উপাদান’, প্রবাসী, মাঘ ১৩৪১ (১৯৩৫); ‘প্রবাসী বাঙ্গালীর বর্ত্তমান সমস্যা ও তাহার সমাধান সম্বন্ধে দুই একটি কথা’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪২ (১৯৩৫); ‘মানভূম জেলায় সাহিত্য-সেবা ও গবেষণার উপাদান’, প্রবাসী, শ্রাবণ ১৩৪২ (১৯৩৫); ‘সাধারণ গ্রন্থাগার, সৎসাহিত্য ও গবেষণা’, প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৪২ (১৯৩৫); ‘ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব’, প্রবাসী, ফাল্গুন ১৩৪৩ (১৯৩৬); রাঁচির কথা’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪৪ (১৯৩৭); ‘সভ্যতার অভিব্যক্তি’, প্রবাসী, চৈত্র ১৩৪৪ (১৯৩৭); ‘ভারতের মানব ও মানব সমাজ’, সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা, ৪৫, চৈত্র ১৩৪৪ (১৯৩৭)।

 ৭৫. শরৎচন্দ্র রায়, ‘ছোটনাগপুরের ওরাওঁ জাতি’, পৃ. ৭৯।

 ৭৬. শরৎচন্দ্র রায়, ‘ওরাওঁদের ঐতিহ্য’, পৃ. ৮৯।

 ৭৭. শরৎচন্দ্র রায়, ‘মুণ্ডা জাতি’, বাণী, ৪(৩), আষাঢ় ১৩১৮ (১৯১১); ‘ছোটনাগপুরের সাহিত্য-সেবার উপাদান’, প্রবাসী, মাঘ ১৩৪১ (১৯৩৫); মোহাম্মদ মোদাব্বের, ‘ধ্বংসোন্মুখ মুণ্ডা জাতি’, মাসিক মোহাম্মদী, ৭(১), কার্ত্তিক ১৩৪০ (১৯৩৩)।

 ৭৮. যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ভারতবর্ষ, ১০(১), ৫ম সংখ্যা, কার্তিক ১৩২৯ (১৯২২)।

 ৭৯. ওই, পৃ. ৮৫।

 ৮০. পরমেশপ্রসন্ন রায়, ‘ছোটনাগপুরী হো’, সৌরভ, ৩(৭), বৈশাখ ১৩২২ (১৯১৫), পৃ. ৯৮।

 ৮১. নির্মলকুমার বসু, ‘ময়ূরভঞ্জ রাজ্যে প্রাচীনকালের মানব’, প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৪৭ (১৯৪০), পৃ. ১৪৭-৪৮।

 ৮২. নির্মলকুমার বসু, ‘জুয়াঙ্গ জাতি’, প্রবাসী, আশ্বিন ১৩৪০ (১৯৩৩)।

 ৮৩. ফণীন্দ্রনাথ বসু, ‘ময়ূরভঞ্জের পার্বত্যজাতি’, প্রবাসী, ২৮(২), ৬ষ্ঠ সংখ্যা, চৈত্র ১৩৩৫ (১৯২৯), পৃ. ১৫২।

 ৮৪. ভূপতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, ‘ওড়িষ্যার আদিম অধিবাসী’, সাহিত্য, ৩০(৭), কার্ত্তিক ১৩২৭ (১৯২০)।

 ৮৫. রামব্রহ্ম সান্যাল, ‘সাঁওতাল জাতির বিবরণ’, সখা, ৬(১), জানুয়ারি ১৮৮৮।

 ৮৬. ওই, পৃ. ৩২৫।

 ৮৭. ওই, পৃ. ৩২৫।

 ৮৮. ওই, পৃ. ৩২৬।

 ৮৯. প্রভাসচন্দ্র রায়, ‘সাঁওতালগণের বিবরণ’, বঙ্গীয়-সাহিত্য-সম্মিলনের কার্যবিবরণ, তৃতীয় অধিবেশন, ভাগলপুর, ১৩১৮ (১৯১১)।

 ৯০. সত্যেশচন্দ্র গুপ্ত, ‘সাঁওতালি ভাষায় সংস্কৃত ও প্রাদেশিক ভাষার প্রভাব’, ভারতবর্ষ, ১৪(২), ২য় সংখ্যা, মাঘ ১৩৩৩ (১৯২৭), পৃ. ৩৭৬।

 ৯১. ভূপতিভূষণ গুপ্ত, ‘সাঁওতাল-জীবন’, প্রবাসী, ২৫(১), ২য় সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩২ (১৯২৫)।

 ৯২. প্রমথনাথ চট্টোপাধ্যায়, ‘সাঁওতালদের গ্রামে’, প্রবাসী, ২৫(১), ৫ম সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৩২ (১৯২৫)।

 ৯৩. ওই, পৃ. ৩৪২–৪৩।

 ৯৪. নরেন্দ্রনাথ রায়, ‘দিনাজপুরে সাঁওতাল’, প্রবাসী, ২৭(২), ৩য় সংখ্যা, পৌষ ১৩৩৪ (১৯২৭)।

 ৯৫. ওই, পৃ. ৩৪৮।

 ৯৬. ওই, পৃ. ৩৪৮।

 ৯৭. রণেন্দ্রবিজয় দাস, ‘সাঁওতালদের পূজা-পদ্ধতি’, শান্তিনিকেতন, ৫(৩), ভাদ্র ১৩৩১ (১৯২৪)।

 ৯৮. বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘সাঁওতাল পুরাণ’, মানসী ও মর্ম্মবাণী, ১৪(১), ৩য় সংখ্যা, বৈশাখ ১৩২৯ (১৯২২)।

 ৯৯. সরসীলাল সরকার, ‘সাঁওতালি গান’, বিশ্বভারতী পত্রিকা, ৫(২), কার্ত্তিক-পৌষ ১৩৫৩ (১৯৪৬)।

 ১০০. ওই, পৃ. ৩৫৭।

 ১০১. সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, ‘সাঁওতালি গান’, বিশ্বভারতী পত্রিকা, ৫(২), কার্ত্তিক-পৌষ ১৩৫৩ (১৯৪৬)।

 ১০২. ওই, পৃ. ৩৬০–৬১।

 ১০৩. ওই, পৃ. ৩৬০–৬১।

 ১০৪. পঞ্চানন মিত্র, ‘পাশ্চাত্য বিজ্ঞানে প্রকৃত মানব’, শাশ্বত সংবাদ, ১ম পক্ষ, ফাল্গুন ১৩৩১; ‘ফ্রেজারের সমাজতত্ত্ব’, শাশ্বত সংবাদ, ২য় পক্ষ, ফাল্গুন ১৩৩১; ‘ভুন্ট’, শাশ্বত সংবাদ, ২য় পক্ষ, ফাল্গুন ১৩৩১; ‘ডুর্কহাইমের সঙ্ঘ ধর্মবাদ’ শাশ্বত সংবাদ, ১ম পক্ষ, আষাঢ় ১৩৩২; ‘লেভি-ব্রুলের জনমন ও ফ্রয়েডের সুপ্তমনবাদ’, শাশ্বত সংবাদ, ২য় পক্ষ, আষাঢ় ১৩৩২; ‘পাশ্চাত্য ক্রমবিকাশবাদ’, শাশ্বত সংবাদ, ২য় পক্ষ, আষাঢ় ১৩৩২; ‘ডারুইনের পূর্ব্বযুগ’, শাশ্বত সংবাদ, ১ম পক্ষ, শ্রাবণ ১৩৩২; ‘ডারুইনের জীববর্গোৎপত্তিতত্ত্ব’, শাশ্বত সংবাদ, ভাদ্র ১৩৩২; ‘প্রাচীনযুগের প্রাকৃত মানব’, শাশ্বত সংবাদ, ১ম পক্ষ, শ্রাবণ ১৩৩২; ‘সেরাই কেলায় মানব-তত্ত্ব’, শাশ্বত সংবাদ, ২য় পক্ষ, মাঘ ১৩৩২; এই সব ক-টি রচনা সংকলিত হয়েছে, পঞ্চানন মিত্র, নির্বাচিত প্রবন্ধ, অজয়হৃদয় মিত্র (সম্পা.) (কলিকাতা : সারস্বত লাইব্রেরী, ১৩৮৬); সমস্ত উদ্ধৃতি এই বই থেকে নেওয়া।

 ১০৫. পঞ্চানন মিত্র, ‘ভুন্ট’, পৃ. ৯।

 ১০৬. পঞ্চানন মিত্র, ‘ডুর্কহাইমের সঙ্ঘ ধর্মবাদ’।

 ১০৭. পঞ্চানন মিত্র, ‘লেভি-ব্রুলের জনমন ও ফ্রয়েডের সুপ্তমনবাদ’, পৃ. ১৬–১৭।

 ১০৮. পঞ্চানন মিত্র, ‘সেরাই কেলায় মানব-তত্ত্ব’, পৃ. ৩৫-৩৬।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন