পরিব্রাজকের নৃতত্ত্বচর্চা : নির্মলকুমার বসু

প্রদীপ বসু

পরিব্রাজকের নৃতত্ত্বচর্চা : নির্মলকুমার বসু

১. নৃতাত্ত্বিক বৈজ্ঞানিক?

১৯৪৬ সালে গান্ধীজি যখন দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালিতে সফর করছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন নির্মলকুমার বসু। নির্মলকুমার তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ওই সময়ে একদিন গান্ধীজি তাঁকে ডেকে প্রশ্ন করেন যে, তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন কি না। উত্তরে নির্মলকুমার বলেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি নেই এ নিয়ে তিনি কখনোই মাথা ঘামাননি। গান্ধী তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, তিনি আদৌ কোনো কিছুতে বিশ্বাস করেন কি? উত্তরে তিনি বলেন : ‘বিজ্ঞানী হিসেবে আমি সত্যে বিশ্বাস করি। কারণ, আমাদের ল্যাবরেটরি বা আমাদের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে আমরা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে সত্যকেই আবিষ্কার করতে চেষ্টা করি। যদি আমরা বিশ্বাস না করি কোনো কিছু চেষ্টা করার যোগ্য তাহলে তার পেছনে মিছিমিছি দৌড়ব কেন?’ এর কয়েকদিন পর আবার যখন ওই একই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়, তখন নির্মলকুমার গান্ধীকে বলেন, বৈজ্ঞানিক গবেষণা হল তাঁর স্বধর্ম। অন্যদিকে রাজনৈতিক কার্যকলাপ তাঁর কাছে অপধর্মের বেশি কিছু নয়।

নিজেকে নির্মলকুমার বৈজ্ঞানিক গবেষক ভাবতেন, কারণ, তিনি নৃতত্ত্বকে বিজ্ঞান ভাবতেন। তাঁর এক সময়ের ছাত্র ও পরে ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুরজিৎ চন্দ্র সিংহ নির্মলকুমার সম্পর্কিত তাঁর বইয়ে লিখেছেন যে, একজন তরুণ নৃতাত্ত্বিক হিসেবে নির্মলকুমারের সঙ্গে বিশ বছর কাটানোর পর তাঁর অনেক সময় মনে হয়েছে তিনি নিজেকে বিজ্ঞানী হিসেবে প্রমাণ করার ব্যাপারে একটু বেশিই সচেষ্ট ছিলেন। এটা অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নয় যে, নৃতত্ত্ব একটি বিজ্ঞান, বিশ শতকের এই ডিসকোর্সে নির্মলকুমার বিশ্বাসী ছিলেন। এই নৃতত্ত্ব যে বিজ্ঞানকে মডেল করে গড়ে উঠেছে তা এক ধরনের অভিজ্ঞতাবাদী, প্রত্যক্ষবাদী ও বিজ্ঞানবাদী চিন্তাধারার সংমিশ্রণ। নির্মলকুমার যখন বিশেষভাবে নৃতত্ত্বের পদ্ধতি নিয়ে লিখেছেন তখন তিনি জোর দিয়েছেন বিষয়কেন্দ্রিকতা, ক্ষেত্র-সমীক্ষা, সঠিক তথ্যসংগ্রহ এবং সতর্ক ও সীমিত অনুমানের উপর। যে নৃতাত্ত্বিক নির্মলকুমারের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন, তিনি হলেন ফ্রান্স বোয়া। বোয়াকে নির্মলকুমার নিজের গুরু বলেছেন। বোয়া নৃতত্ত্বের নামে দূরকল্পনা-ভিত্তিক ইতিহাস রচনা বা যথেষ্ট তথ্য ছাড়া সামান্যীকরণের একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন। তিনি বরং বিশ্বাস করতেন নৃতত্ত্বকে অত্যন্ত সতর্কভাবে সম্পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। তাহলেই নৃতত্ত্ব নিয়মকানুনগুলি আবিষ্কার করতে পারবে, ঠিক যেমন বিজ্ঞানে হয়। বোয়ার এই আরোহ-পদ্ধতি নির্মলকুমারকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। তিনি মনে করতেন এই পদ্ধতি কিছু অপ্রত্যাশিত আবিষ্কারের পথ উন্মুক্ত করে দেয়।

নৃতত্ত্বকে বিজ্ঞানের ভাষায় প্রকাশ করার পেছনে যে অনুমানগুলি কাজ করে তা হল-নৃতত্ত্ব যেন এক নিরপেক্ষ ডিসকোর্স, যা বৈজ্ঞানিক ভাষায় বাস্তব ঠিক যেমন সেইভাবেই প্রকাশিত করবে। অথচ নৃতত্ত্বও শেষ বিচারে এক ধরনের রচনা, যে রচনা তার রাচনিক কলাকৌশল, রূপকালংকার ইত্যাকার বিষয়াবলী ধার করেছে অন্যান্য সাহিত্য থেকে। নিজেকে বিজ্ঞান বলে সংজ্ঞায়িত করার ফলে এবং নিজের বিষয়কে তার সন্নিহিত ও পূর্ববর্তী অন্যান্য রচনাসমগ্র থেকে পৃথক হিসেবে গণ্য করার ফলে, নৃতত্ত্ব নিজের রচনার চরিত্র কিন্তু কোনোদিনই ভালোভাবে পরীক্ষা করেনি। অন্য রচনার বিরোধিতার প্রক্রিয়ায় নিজের বৈধকরণ করতে গিয়ে নৃতত্ত্ব এটাও কখনো ভালোভাবে বিচার করেনি যে, রচনাকৌশলের দিক থেকে নৃতত্ত্বের ঋণ এই সমস্ত রচনার কাছে কতখানি। নৃতত্ত্ববিদ নিজে স্বীকার না করলেও এই সমস্যা কিন্তু নৃতাত্ত্বিক রচনার মধ্যেই রয়ে গেছে এবং এটা সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে দৃষ্ট হয় নৃতাত্ত্বিকের ব্যক্তিগত আখ্যান (পার্সোনাল ন্যারোটিভ) ও নৈর্ব্যক্তিক বিবরণের (ইম্পারসোনাল ডেসক্রিপশন) দ্বন্দ্বের জটিল সম্পর্কের মধ্যে, যে আলোচনা আমি আগের অধ্যায়ে করেছি। নৃতাত্ত্বিক রচনার মধ্যে যেমন ‘আমি’ আছে এবং এই ‘আমি’-র উপস্থিতি যেমন পাঠক টের পান, সেই ‘আমি’-ই আবার যখন প্রয়োজনবোধে অন্তর্ধান করে, তখন সন্ধান মেলে শুধুমাত্র নৈর্ব্যক্তিক ‘বৈজ্ঞানিক’ বিবরণের, যেন-বা ব্যক্তি-নির্বিশেষে বস্তুগত বর্ণনা। এই সমস্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে চারটি পৃথক প্রবণতা : নৃতাত্ত্বিক কর্তৃত্ব, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, বৈজ্ঞানিকতাবাদ এবং অভিব্যক্তির কৌশল। বস্তুত, এই চতুর্বিধ প্রবণতার টানা-পোড়েনে গঠিত হয় নৃতাত্ত্বিক রচনা। ব্যক্তিগত আখ্যান নৃতাত্ত্বিক রচনার একটি অবশ্যম্ভাবী উপাদান। প্রতিটি রচনার ভূমিকা বা আলোচনার প্রথম অংশে ব্যক্তিগত আখ্যানের অন্তর্ভুক্তি নৃতাত্ত্বিক রচনার একটি প্রচলিত প্রথা। প্রারম্ভেই এই ব্যক্তিগত আখ্যান দিয়ে নৃতাত্ত্বিক যেমন নিজের রচনাটিকে নোঙ্গরবদ্ধ করেন তেমনি পাঠকদের জানিয়ে দেন ‘আমি সেখানে ছিলাম।’ অর্থাৎ এই ব্যক্তিগত আখ্যানের মাধ্যমে নৃতাত্ত্বিক প্রথমেই নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নেন। শুধুমাত্র তা-ই নয়, ব্যক্তিগত আখ্যানের মাধ্যমে নৃতাত্ত্বিক-রচনার প্রধান তিনটি চরিত্রের অবস্থানও নির্ণীত হয়ে যায়। এই তিনটি চরিত্র হল-নৃতাত্ত্বিক, পাঠক এবং নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু।

ব্যক্তিগত আখ্যান নৃতত্ত্বের একটি প্রধান দ্বন্দ্বের মধ্যস্থতা করে। এই দ্বন্দ্ব এককথায় ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব ও বৈজ্ঞানিক কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়েছে যেদিন থেকে নৃতত্ত্বে ক্ষেত্র-সমীক্ষার পদ্ধতিগত আবশ্যকতা স্বীকৃত হয়েছে। একদিকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে তথাকথিত বৈজ্ঞানিক রচনার রীতিনীতি, এই দুই বিপরীতের সমন্বয় সাধন সম্ভব নয়। মনে রাখা দরকার, নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় ক্ষেত্র-সমীক্ষা কিন্তু নৃতাত্ত্বিকের বুদ্ধি, জ্ঞান ও অনুভূতি-নির্ভর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। তিনি দুই চোখ দিয়ে দেখেন, দুই কান দিয়ে শোনেন, অনেক সময় হয়তো যে জায়গায় রয়েছেন সেখানে কোনো ভূমিকাও পালন করেন। অথচ বিষয়ের রচনাশৈলীর প্রথা মানতে এবং রচনার বৈজ্ঞানিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এই ‘ব্যক্তি’টিকে অন্তর্ধান করতে হবে। ক্ষেত্র থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা বা তথ্যকে প্রথাগত নৃতাত্ত্বিক রচনায় পরিবর্তন করতে নৃতাত্ত্বিককে এক কঠিন সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। ফলে রচনা তৈরির সময় নৃতাত্ত্বিক বহুকিছুই পিছনে ফেলে যেতে বাধ্য হন। অনেক নৃতাত্ত্বিককে এই কারণে বলতে শোনা যায় যে, তাঁরা তাঁদের প্রকৃত উপলব্ধির কথা কিছুই লিখতে পারেননি। এই উক্তির মধ্যে সত্য বই মিথ্যা নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে, নৃতাত্ত্বিক তাঁর ব্যক্তিগত আখ্যানের মাধ্যমে এই জটিল দ্বন্দ্বের মধ্যস্থতা করারই চেষ্টা করেন।

নির্মলকুমারের লেখাপত্রে আমরা ওই একইরকম টানা-পোড়েন লক্ষ করি, হয়তো আরও তীব্রভাবে, কারণ এখানেও আছেন একজন নৃতাত্ত্বিক, যিনি নিজেকে ‘বিজ্ঞানী’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন, বলেছেন বিজ্ঞান তাঁর স্বধর্ম, অথচ যিনি তাঁর পরিব্রাজক জীবনের অভিজ্ঞতা, অনুভব, উপলব্ধিও লিপিবদ্ধ করে যেতে চান। মনে রাখতে হবে নির্মলকুমার শুধুমাত্র নৃতাত্ত্বিকই ছিলেন না, তাঁর আগ্রহ ছিল নানা বিষয়ে, লিখেওছেন বহু বিচিত্র বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে শিল্পকলা, ইতিহাস, রাজনীতি, গান্ধীবাদ, পুরাতত্ত্ব যেমন আছে, তেমনই আছে মন্দির স্থাপত্য, শিক্ষা, ভূগোল, সমাজকর্ম ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় নিজের ভ্রমণ বৃত্তান্ত, আত্মজীবনীমূলক স্কেচ, ব্যক্তিগত আখ্যান এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাভিত্তিক সামাজিক ছবি লিপিবদ্ধ করেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, যা পরবর্তী সময়ে গ্রন্থিত হয়েছে যে দু-টি বইয়ে তা হল : পরিব্রাজকের ডায়েরী (১৯৪০) এবং নবীন ও প্রাচীন (১৯৩০)। নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানের পক্ষে যা তুচ্ছ, মামুলি বা অবান্তর এখানে প্রাধান্য পেয়েছে সেই ব্যক্তিগত আখ্যানগুলি। এইসব রচনায় নির্মলকুমারের ঘাড়ে আর বিজ্ঞান ভর করে নেই, বস্তুগত বিবরণের দায়বদ্ধতা থেকেও তিনি মুক্ত, রচনার উপর তাঁর ব্যক্তিগত কর্তৃত্বই স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত। এখানে রচনাকারকে বৈজ্ঞানিক রচনার শর্ত মেনে নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই, তাই তিনি অনেক স্বচ্ছন্দ, রচনাগুলিও অনেক বেশি সাহিত্যধর্মী। ফলে এইসব রচনায় আমরা এমন এক নৃতাত্ত্বিককে দেখি, যিনি তাঁর নিজের ‘বিজ্ঞান’কেই ধ্বংস করেছেন। এই সব রচনাই বাংলা ভাষায় রচিত, যে ভাষায় নির্মলকুমার ছিলেন অত্যন্ত সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। বস্তুত নৃতত্ত্বকে বাংলা ভাষায় প্রকাশের মাধ্যমেই সৃষ্টি হচ্ছে এই পরিসর যা নৃতত্ত্ব হয়েও বিজ্ঞানধর্মিতা থেকে মুক্ত। এ বিষয়ে আমরা পরে আরও আলোচনা করব, কিন্তু তার আগে নির্মলকুমারের নৃতাত্ত্বিক গবেষণার কিছুটা পরিচয় দেওয়া আবশ্যক।

২. সংস্কৃতি ও নৃতত্ত্ব

নির্মলকুমারের প্রথম দিকের নৃতত্ত্বে বোয়া এবং ক্রোয়েবার-এর সংস্কৃতি-তত্ত্বের বেশ গভীর প্রভাব ছিল। সংস্কৃতির এই ধরনের বিশ্লেষণে এক-একটি অঞ্চল ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হত, যাতে অঞ্চলটির সংস্কৃতিতে ভৌগোলিক, ভাষাগত ও পরিবেশগত সম্পর্কগুলি বিশ্লেষণ করা যায়। এই ধরনের গবেষণায় ক্রোয়েবার ও তাঁর ছাত্ররা এক-একটি সমাজকে বিশ্লেষণের একক হিসাবে বেছে নিতেন এবং সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলির এক তুলনামূলক চিত্র প্রস্তুত করতেন। নির্মলকুমার এই ধরনের বিশ্লেষণের প্রতি আগ্রহী হন মূলত এইজন্য যে, তিনি বিশ্বাস করতেন ভারতীয় সভ্যতার প্রকৃত ধ্যানধারণার জন্য নৃতাত্ত্বিককে শুধুমাত্র আদিবাসী সমাজের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে চলবে না, তাকে আরও এক বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কাজ করতে হবে। সংস্কৃতির এই ধরনের বিশ্লেষণের সঙ্গে যে তত্ত্বের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ তাকে ডিফিউশনের তত্ত্ব বা পরিব্যাপ্তির তত্ত্ব বলা হয়। এই তত্ত্বে সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য বা ট্রেইট-এর কোনো এক কেন্দ্র থেকে পরিব্যাপ্তির ধরন বিশ্লেষণ করা হয়। নির্মলকুমার একদম প্রথম জীবনে বসন্তোৎসব নিয়ে যে কাজ করেন তাতে এই উৎসবের সংস্কৃতির পরিব্যাপ্তির এক মানচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন এই উৎসবের কেন্দ্র ছিল পূর্ব ভারত। এই অঞ্চলের আদিবাসীদের মধ্যেই এ উৎসবের বিশুদ্ধ রূপটি দেখতে পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে তিনি এই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিব্যাপ্তির পদ্ধতি অনুসরণ করে মন্দির স্থাপত্যের উপর উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেন।

আন্দ্রে বেতেই তাঁর নির্মলকুমার সম্পর্কিত এক রচনায় ঠিকই মন্তব্য করেছেন যে, নির্মলকুমার লুই ডুঁমোর অনেক আগে ভারতীয় সমাজ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নৃতত্ত্ব ও ভারতবিদ্যার সমন্বয়ের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তিনি আরও মনে করতেন, এই দুই বিদ্যার সমন্বয়ে সামাজিক গঠনের যে স্বরূপ উন্মোচিত হবে তা অসম্পূর্ণ থাকবে, কারণ উপনিবেশবাদ এই সামাজিক গঠনেরই পরিবর্তন করে দিয়েছে। সুতরাং তিনি ইতিহাসকে তাঁর গবেষণা পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করেন, যাতে সামাজিক পরিবর্তনের ধারা বোঝা যেমন সম্ভব হবে, ঠিক সেইরকম সামাজিক পুনর্গঠনও সম্ভব হবে। সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে এই ছিল নির্মলকুমারের ধারণা। তাঁর সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব সম্পর্কিত বইয়ে তিনি প্রথমেই লিখেছেন বর্তমানের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেই সমাজবিজ্ঞানকে পুনর্গঠিত করতে হবে।

সমাজবিজ্ঞানের এই ধারণার সঙ্গে ফলিত বিজ্ঞানের মিল আছে। নির্মলকুমার বিশ্বাস করতেন এই ‘বিজ্ঞান’ আমাদের ‘মানবিক ইতিহাসের কলকব্জা’ বুঝতে সাহায্য করবে-যেমন একটি চার্ট বা নকশা একজন প্রযুক্তিবিদকে যন্ত্রের গঠন বুঝতে সাহায্য করে। তিনি মনে করতেন বিজ্ঞান হিসেবে নৃতত্ত্ব মানুষের মনে আশা হয়তো জাগাতে পারে না, কোনো নতুন বিশ্বাসেরও জন্ম দিতে পারে না যেখানে বিশ্বাসের কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সীমিতভাবে নৃতত্ত্ব সমাজের বর্তমানকে বিশ্লেষণ করতে পারে, তার ভিত্তিতে সমাজের বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের প্রক্রিয়া আবিষ্কার করতে পারে ও সামাজিক পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা চালাতে পারে। নৃতত্ত্বের এই ধারণা যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ফলিত নৃতত্ত্ব হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, অনেকে একে উন্নয়নমূলক নৃতত্ত্বও বলে থাকেন। নৃতত্ত্বের এই বিশেষ শাখা মূলত এক অরাজনৈতিক অবস্থান থেকে শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার ভিত্তিতে উন্নয়নের সমস্যা বিশ্লেষণ করে। এখানে জাতীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার গঠন বিশ্লেষণের আওতার মধ্যে আসে না। অথচ অনেক সময়ই সামাজিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রক্রিয়াই উন্নয়নের সমস্যা সৃষ্টি করে। তাঁর উন্নয়নমূলক নৃতত্ত্বের ধারণা এই সমস্যা থেকে মুক্ত নয়।

নির্মলকুমার যে বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন তা হল সংস্কৃতি, এবং এই সংস্কৃতিকে তিনি বোঝার চেষ্টা করেন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বা কালচারাল ট্রেইট-এর মাধ্যমে। যেকোনো সংস্কৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নানা শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। কিন্তু বৈশিষ্ট্যগুলি আবার এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ, একে অন্যকে প্রভাবিতও করে। তিনি মনে করতেন এই সংস্কৃতি মানবিক ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার দ্বারা নির্দিষ্ট। সংস্কৃতির এই তত্ত্ব যদিও বিদেশি, নির্মলকুমার কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি বিশ্লেষণে ভারতীয় কিছু ধ্যানধারণার প্রয়োগ করেন। যেমন, তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির বিশ্লেষণের মাধ্যম হিসেবে তিনটি ধর্ম-অর্থ, কাম, মোক্ষ-বেছে নেন। প্রতিটি ধর্ম তাঁর মতে চারটি বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে- বাস্তু, ক্রিয়া, সংহতি ও তত্ত্ব। তত্ত্বকে আবার দু-টি আলাদা শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-বিচারমূলক ও বিশ্বাসমূলক। বাঙালির ধর্মীয় সংস্কৃতির বিচার-বিশ্লেষণে তিনি ওই একইরকম পদ্ধতি অবলম্বন করেন। বাংলার বৈষ্ণব ধর্মকে তিনি বোঝার চেষ্টা করেন বিভিন্ন ভাবের মাধ্যমে-যেমন, সখ্য, দাস্য, সংস্কার ও গুণের মাধ্যমে।

পরবর্তী সময়ে নির্মলকুমার এই সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি ভারতের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অঞ্চলের সীমানা নির্দেশের কাজে প্রয়োগ করেন। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন যে, যদিও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভাষার দিক থেকে পৃথক কিন্তু সংস্কৃতির দিক থেকে তাদের মধ্যে নানারকম মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ এই অঞ্চলগুলি এক উচ্চতর সাংস্কৃতিক সম্পর্কে আবদ্ধ। সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবর্ষ নির্মলকুমারের লেখাপত্রে এমন এক স্থান যেখানে উচ্চতর স্তরে এক সাংস্কৃতিক ঐক্য বিদ্যমান। তাই তিনি লেখেন যে, যদিও ভারতবর্ষে বিভিন্ন ভাষা আছে এবং এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সাংস্কৃতিক পার্থক্যও চোখে পড়ে, তবুও সামগ্রিকভাবে এক নির্দিষ্ট ঐক্যের ছকও দেখা যায়, যার ফলে সকলেই যেন এক পরিবারভুক্ত। স্থান থেকে স্থানে নানা পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে, তবুও একথা উপেক্ষা করা যায় না যে, সকলেই একই ঐতিহ্যের উত্তরসূরি।

নির্মলকুমার তাঁর সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব বিষয়ক রচনাগুলির সার এইভাবে উপস্থিত করেন : ১) সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানবিক ক্রিয়া-কলাপের এক সুসংহত রূপ। ২) মানুষ তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় তার পরিবর্তন সাধন করে। এবং জীবন ও সংস্কৃতির মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই সংস্কৃতিকে এক সক্রিয়, গতিশীল ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই তিনি মনে করতেন, সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে মানবিক উপাদানের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এইখানেই তাঁর সঙ্গে ক্রোয়েবার-এর একটা বড়োরকমের তফাত ছিল। নির্মলকুমারের নৃতাত্ত্বিক চিন্তা তাঁকে ক্রমশই ব্যক্তিত্ব ও সংস্কৃতির ক্রিয়াপ্রক্রিয়ার দিকে টেনে নিয়ে যায়, অন্যদিকে ক্রোয়েবার সম্পূর্ণ বিপরীত তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন। তাঁর মতে ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে সংস্কৃতির অধীন। এই তত্ত্বই তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘সুপারঅরগানিক’ সম্পর্কিত রচনায় প্রকাশ করেন।১০ নির্মলকুমার বিশ্বাস করতেন, ইতিহাসে অনেক সময় সৃষ্টিশীল, ব্যতিক্রমী ব্যক্তি দিয়েই পরিবর্তনের শুরু হয়।

যেহেতু ইতিহাস ও পরিবর্তন নির্মলকুমারের চিন্তার এক প্রধান বিষয় ছিল তাই তিনি তত্ত্বকেও সেই মতো রূপান্তররিত করতেন। তাঁর Cultural Anthro-pology (১৯২৯) গ্রন্থটি ম্যালিনোস্কি ও র‍্যাডক্লিফ ব্রাউনের ফাংশনালিস্ট বা উপযোগবাদী নৃতাত্ত্বিক রচনার কয়েক বছর পরেই প্রকাশিত হয়। কিন্তু তখন ছিল উপযোগবাদী তত্ত্বের একদম প্রথম দিক এবং উপযোগবাদ ঠিক তত্ত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। নির্মলকুমারও তাঁর এই রচনায় উপযোগবাদিতার কথা বলেছেন, কিন্তু তিনি এটাকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বুঝতে চেষ্টা করেছেন।১১ তিনি মনে করতেন কিছু অমীমাংসিত সমস্যার ফলে ইতিহাসে পরিবর্তন আসে, তখন অনেক সময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এই পরিবর্তনের উপযোগী হয় না। সুতরাং তাকে পরিবর্তনের উপযোগী করে তুলতে হয়। মনে রাখতে হবে নির্মলকুমার বিশ শতকের শুরুতে নৃতাত্ত্বিক চর্চার যে ধারা ছিল তাকেই অনুসরণ করেছেন। এই সময় নৃতত্ত্বে অনুসন্ধানের যে প্রধান দু-টি ধারা ছিল তার একটিকে আমরা বলতে পারি ভৌগোলিক এবং অন্যটিকে সমাজতাত্ত্বিক। ভৌগোলিক ধারার নৃতাত্ত্বিকরা মনোযোগ দিয়েছেন প্রব্রজন, সাংস্কৃতিক প্রসারণ, মানুষের শ্রেণিকরণের উপর; সমাজতাত্ত্বিক ধারার নৃতাত্ত্বিকরা সামাজিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে গবেষণা করেছেন। প্রথম ক্ষেত্রে নৃতত্ত্ব হয়েছে বিবরণাত্মক ও বিশেষীকৃত এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তুলনামূলক ও তাত্ত্বিক। নির্মলকুমার এই দুই ধারার মধ্যে স্বচ্ছন্দ বিচরণ করেছেন। তিনি এক ধরনের সাংস্কৃতিক পরিব্যাপ্তির তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন এবং সংস্কৃতির অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সতর্ক ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক বিশ্লেষণে আগ্রহী ছিলেন। একটি বিশেষ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর এই ধ্যানধারণার প্রয়োগ করেন এবং এই বিষয়ে তাঁকে একজন পথিকৃৎও বলা যায়-বিষয়টি হল স্থাপত্যকর্ম ও স্থাপত্যকলা।

৩. নৃতত্ত্ব ও স্থাপত্য

নৃতত্ত্ব ও স্থাপত্যের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ নৃতত্ত্বচর্চায় আজ খুব বেশি চোখে পড়ে না, যদিও এই বিষয়টির সম্ভাবনা কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না। একটি বড়ো কারণ হল যে, এটি এমন এক ক্ষেত্র যেখানে ভাবাদর্শ ও প্রযুক্তি মিলিত হয়েছে। মানুষের বাসস্থান ও বসতি প্রতিফলিত করে তার পরিবেশ ও জীবনধারণের বাধ্যবাধকতা ও প্রয়োজনীয়তা এবং একই সঙ্গে প্রতিফলিত করে ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীজীবন সম্পর্কে তার ধারণা। নির্মলকুমার একদম প্রথম থেকেই দেশের স্থাপত্য বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। স্থাপত্যকলায় একভাবে মানুষ তার পরিবেশ থেকে কী আশা করে এবং তার ব্যবহারযোগ্য সম্পদ কীভাবে কাজে লাগায় দুই-ই প্রতিফলিত হয়। যেসব গ্রামীণ ও আদিবাসী মানুষ উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী নয়, তাদের বাসস্থান এবং বসতি হয়তো একটি শহরের মতো স্থায়ী নয়, কিন্তু পরিবেশ, সম্পদ নিয়ে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের যে মডেল তার আন্তঃক্রিয়ার এক পরিচায়ক।

নির্মলকুমার তাঁর নৃতত্ত্বচর্চায় বহু জায়গায় গ্রামীণ মানুষের বাসস্থানের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। যেমন তাঁর প্রথম দিকের রচনায় বঙ্গদেশের কুটিরশৈলীর বিশেষত্ব আলোচনা করেছেন, বঙ্গ থেকে ছোটোনাগপুর যেতে কীভাবে এই শৈলী বদলে যাচ্ছে, ঝালদার কাছে কীভাবে শৈলীর সংমিশ্রণ হচ্ছে এবং ছোটোনাগপুরে তা ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে-এর বিবরণ তাঁর রচনায় পাওয়া যাবে।১২ যদিও এইসব বিবরণের একটি উদ্দেশ্য ছিল, কীভাবে সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলির পরিব্যাপ্তি ঘটছে তার একটা পরিচয় দেওয়া, কিন্তু এইসব পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরও সূচনা দেয়। এই স্থাপত্য বসবাসকারীদের কাজকর্মের যেমন পরিচয় দেয় সেইরকমই বাসস্থানের সঙ্গে গোষ্ঠী পরিচয়ের অভিন্নতার সিম্বলও তুলে ধরে। বিরহোড়দের বাসস্থান সম্পর্কিত একটি রচনায় তাদের বাসস্থান নির্মাণের বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গোলাকৃতি দেওয়াল, কৌণিক ছাদ এই বিশেষ গৃহনির্মাণের কারণ হল এদের পরিযায়ী জীবন। কিন্তু তিনি আবার বিষয়টিকে জটিল করে তোলেন যখন বলেন, অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ালটেয়ার-এর কাছে কিছু জাতির মধ্যে ঠিক ওই একই রকমের গৃহ দেখা যায়, যেমন দেখা যায় গুজরাটের রেওয়ারি, মের ইত্যাদি জাতিদের মধ্যে।১৩ ক্রমাগতই তিনি বাস্তুনির্মাণের এই ধরনের সমস্যা যেমন তুলে ধরেছিলেন, তার সমাধানও খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।

বাস্তুশিল্পে তাঁর আগ্রহ জন্মায় মন্দির স্থাপত্য বিষয়ে কৌতূহল ও অনুসন্ধান থেকে। ১৯২১ সালে তিনি গান্ধীজির ডাকে সাড়া দিয়ে কলেজ ছেড়ে পুরীতে বসবাস করতে থাকেন। এই সময় তিনি পুরী, কোণারক, ভুবনেশ্বর প্রভৃতি স্থানের মন্দির ও ভাস্কর্যে আকৃষ্ট হন এবং মন্দিরের স্থাপত্যরীতি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। এই অনুসন্ধান পর্বেই তিনি কিছু শিল্পীর সংস্পর্শে আসেন যাদের জাতিগত পেশা ছিল মন্দির নির্মাণ এবং এঁদের মাধ্যমে তিনি বেশ কিছু পুথির পরিচয় পান, যা Canons of Orissan Architecture (১৯৩২) নামে অনুবাদ করেন।১৪ এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রবন্ধও প্রকাশ করেন এবং কোণারকের বিবরণ (১৯২৬) নামে বাংলায় একটি বইও প্রকাশ করেন।১৫ কোণারকের মন্দিরের স্থাপত্যরীতি, ভাস্কর্য, ইতিহাস নিয়ে এর চেয়ে ভালো বই বাংলা ভাষায় আজ অবধি প্রকাশিত হয়নি। বইটির শেষ মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। নির্মলকুমার মনে করতেন পশ্চিমের পণ্ডিত এবং তাঁদের ভারতীয় অনুগামীরা পশ্চিমের স্থাপত্যরীতি বিষয়ে শিক্ষিত হওয়ার জন্য ভারতীয় কারিগর ও বাস্তুশিল্পীদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই স্থাপত্যগুলি কখনো বিচার করেননি। এইসব পণ্ডিত ও গবেষকরা জানার চেষ্টা করেননি ভারতীয় শিল্পীরা কীভাবে মন্দিরগুলির শ্রেণিকরণ করতেন, বিভিন্ন ধরনের মন্দিরের মধ্যে কীভাবে পার্থক্য করতেন, স্থাপত্যরীতির সূক্ষ্ম বিচার্য বিষয়গুলিই-বা কী ছিল।১৬ নির্মলকুমার ওড়িশার স্থাপত্যরীতি অধ্যয়ন করেছিলেন স্থানীয় বাস্তুশিল্পীদের সাহায্যে এবং ওড়িশার বিভিন্ন অঞ্চলে নিজে অনুসন্ধান ও ক্ষেত্র-সমীক্ষা করে। তিনি মনে করতেন, এইভাবেই ভারতীয় স্থাপত্য ‘বিজ্ঞান’-এর পুনরুদ্ধার সম্ভব।১৭

মনে হয়, এইসব পুথিপত্র শুধুমাত্র শিল্পীদের দৃষ্টিকোণ বুঝতে সাহায্য করে বলেই তাঁকে আকৃষ্ট করেনি, এসব রচনা এক ধরনের সাংস্কৃতিক ঐক্যেরও সূচনা করে। সর্বভারতীয় স্তরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্যাটিগরিগুলির ব্যবহারও এইসব পুথিতে দেখা দেয়। যেমন বাস্তুবিদ্যার প্রথম বিষয় হল, যে জমির উপর স্থপতি কাজ করবেন তাকে চেনা এবং তার শ্রেণিকরণ করা। জমির মাটিকে এখানে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ব্রাহ্মণ মাটি যার রং সাদা, ক্ষত্রিয় মাটি-লাল রং, বৈশ্য মাটি-হলুদ রং এবং শূদ্র মাটি যার রং কালো। বলা হয়েছে, মানুষ যদি নিজ নিজ জাতির মাটিতে বসবাস করে তাহলে তারা সুখী হবে। ব্রাহ্মণরা অবশ্য যেকোনো চার ধরনের মাটিতে বসবাস করতে পারে, ক্ষত্রিয়রা তিন, বৈশ্যরা দুই এবং শূদ্ররা এক। এর বিপরীত যদি হয়, অর্থাৎ শূদ্র যদি ব্রাহ্মণ মাটিতে বসবাস করে তাহলে সে বিনাশপ্রাপ্ত হবে, সে ভিটেতে দিনের বেলা শেয়াল ডাকবে।১৮

নির্মলকুমার এইসব পুথিপত্র এবং মন্দির নিয়ে তাঁর নিজস্ব গবেষণার ভিত্তিতেই ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে তাঁর ধ্যানধারণা প্রকাশ করেন, কণারকের বিবরণ গ্রন্থে তিনি এক আত্মবিশ্বাসী ও প্রসার্যমান ভারতীয় সভ্যতার কথা লিখতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন যে পদ্ধতিতে এই মন্দির স্থাপত্য অনুসন্ধান করেছেন তা এক বৈজ্ঞানিক প্রণালী। গ্রন্থটির ভূমিকায় লিখেছেন : ‘এই কয় বৎসর ধরিয়া আমি নিরন্তর কণারকে গমন করিয়াছি এবং অনেকবার মন্দিরের সমস্ত জিনিস তন্নতন্ন করিয়া দেখিয়াছি। মূর্ত্তিগুলো সব গুণিয়া তাহার শ্রেণীবিভাগ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। অবশ্য ততটা পরিশ্রমের হয়ত দরকার ছিল না, অথবা তাহা সার্থক হইয়াছে এমন কথাও বলি না। কিন্তু আমার বিশ্বাস জ্ঞান আহরণের বৈজ্ঞানিক প্রণালী আমাদের নিকট যতটা পরিশ্রম দাবী করে, ততটা দিতে আমরা প্রায়ই কুন্ঠিত হই। এইজন্য আমার কর্মক্ষেত্র ক্ষুদ্র হইলেও তাহাতে যে বিজ্ঞানের শাসন মানিয়া চলিয়াছি ইহাই আমার আনন্দ ছিল।’১৯

১৯৪৯ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের নৃতত্ত্ব ও পুরাতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি থাকাকালীন তিনি ভারতীয় মন্দিরের কালনির্ণয়ের বিষয়টি উত্থাপন করেন।২০ তিনি বলেন, পুরাতত্ত্ব নৃতত্ত্ব থেকে লাভবান হতে পারে। কারণ নৃতত্ত্বেরও একটি প্রধান বিষয় হল বিভিন্ন তথ্যকে কালানুক্রমিকভাবে সাজানো। তাঁর মতে, ঐতিহাসিকরা মন্দিরের কালনির্ণয় বিষয়ে যেহেতু একরৈখিক ক্রমবিকাশ তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল ছিলেন তাই তাঁদের তথ্য যাচাই করার যথাযোগ্য উপায় ছিল না। নৃতত্ত্বের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন, একটি সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান একই হারে সম্প্রসারিত হয় না। যেমন মন্দিরের অলংকরণের ক্রমবিকাশ একভাবে হয়েছে, স্থাপত্যরীতির অন্যভাবে। তিনি মনে করতেন, সঠিক কালনির্ণয়ের জন্য সব মন্দিরের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে এবং যথেষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা হলে, বিভিন্ন উপাদান কীভাবে ছড়িয়ে আছে সে মানচিত্র প্রস্তুত করার পরই এই ক্রমবিকাশের চিত্র পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে বলেন, এই ক্রমবিকাশের মানদণ্ড এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পৃথক হতে পারে, ফলে প্রতিটি অঞ্চলেই হয়তো এক ধরনের আঞ্চলিক সিরিজ প্রস্তুত করার প্রয়োজন আছে। নির্মলকুমার বিজ্ঞানের শাসনের মধ্যে থেকেই পুরাতত্ত্ব ও নৃতত্ত্বের সেতুবন্ধনের কথা ভেবেছিলেন। এই বিজ্ঞান নিরপেক্ষ-পর্যবেক্ষণ, তথ্যসংগ্রহের উপর নির্ভরশীল। একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আমাদিগকে প্রথমে ধীরভাবে উত্তর-ভারতের সমস্ত রেখমন্দিরের পরিমাপ লইতে হইবে। তাহার পর শিলালেখের সাহায্যে বা যদি অন্য কোন উপায় থাকে তাহার সাহায্যে সেই সমস্ত রেখমন্দিরগুলিকে দেশ ও কাল অনুসারে সাজাইতে হইবে। তাহার পর মন্দিরের বিভিন্ন অংশের অনুপাত অঙ্ক কষিয়া বাহির করিতে হইবে। মুখ্য লক্ষণগুলিকে আশ্রয় করিয়া গৌণগুলিকে পরিহার করিতে হইবে। এই তো গেল দেহাবয়বের কথা। ইহা ছাড়া প্রত্যেকটিতে কিরূপ সাজ, কোন অলঙ্কার প্রযুক্ত হইয়াছে তাহাও পরীক্ষা করিতে হইবে। এই সকল তথ্য সম্যকভাবে সংগৃহীত হইলে সেই সমুদ্র সমান তথ্যপুঞ্জের সম্মুখে বসিয়া তুলনা ও বিচারের দ্বারা আমরা উত্তর ভারতের মন্দির বিভিন্ন প্রদেশে এবং বিভিন্ন কালে কিরূপ পরিণতি লাভ করিয়াছিল তাহার ইতিহাস রচনা করিতে পারিব, তাহার পূর্বে নয়। ইতিহাস রচনার এই বৈজ্ঞানিক সাধনায় পরিশ্রম আছে সত্য, কিন্তু আনন্দও প্রচুর আছে সন্দেহ নাই।’২১

৪. জাতি ব্যবস্থার নৃতত্ত্ব

ঠিক একই বিজ্ঞান এবং একই পদ্ধতির কথা তিনি বলেছেন ভারতের জাতি-ব্যবস্থার স্বরূপ বোঝার জন্য। ভারতের নৃতত্ত্বচর্চার ইতিহাস প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধে বলেছেন, একদম প্রথম থেকে জাতিবর্ণনের নৃতাত্ত্বিক ধারাটি লক্ষ করলে কয়েকটি বিশিষ্টতা চোখে পড়ে। ‘প্রথম দিকে সমগ্র ভারতের জাতি বর্ণনার কয়েকটি চেষ্টা হইয়াছিল। কিন্তু তাহা পর্যাপ্ত নহে দেখিয়া তাহার পরে এক-একটি প্রাদেশিক বৃত্তান্ত লিখিবার চেষ্টা হয়। অবশেষে তাহাও যথেষ্ট নয় দেখিয়া তৃতীয় যুগে প্রধানত জর্জীয় আমলে এক-একটি জাতির সর্বাবয়বে পূর্ণ বর্ণনা প্রকাশ করিবার চেষ্টা হইতেছে। ইহার মধ্যে মধ্যে রিসলে ও বেনস প্রভৃতি পণ্ডিতগণ কয়েকবার ট্রাইবস অ্যান্ড কাস্টস সিরিজের সাহায্য লইয়া সমগ্র ভারতের জাতি বর্ণনার চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু যতই দিন যাইতেছে ততই দেখা যাইতেছে যে সমগ্র ভারতের বিষয়ে ওরূপ কোনও পুস্তক লিখিবার সময় এখনও হয় নাই। ছোটনাগপুর বা আসামের জঙ্গল ছাড়িয়া দিলেও ভারতের বিভিন্ন সমতল প্রদেশে এত জাতির বাস ও তাহাদের আচার ব্যবহার ও প্রচলিত সংস্কারের মধ্য হইতে নৃতত্ত্বের এত মূল্যবান সামগ্রী পাইবার আশা আছে যে অন্ততঃ বিশ বৎসর ধরিয়া রীতিমত বৈজ্ঞানিক প্রণালী অনুসারে যদি ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলিতভাবে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করেন তবেই ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ নৃতত্ত্ববিজ্ঞানের দিক দিয়া জগৎকে নূতন কিছু দিতে পারিবে অথবা ভারতবর্ষের জাতিতত্ত্বের সম্বন্ধে জ্ঞান আমাদের আংশিকভাবেও সম্পূর্ণ হইবে।’২২ পঁচিশ বছর পর ওড়িশার জাতি-বিষয়ক তথ্য সম্পর্কিত একটি গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি ওই একই কথা বলেন। শুধু ওড়িশা নয়, সমস্ত রাজ্যগুলি থেকে এইরকম তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ প্রকাশ পেলে তবেই তুলনামূলক আলোচনার ভিত্তিতে ভারতীয় জাতিব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব।২৩

তা সত্ত্বেও ভারতীয় বর্ণব্যবস্থা সম্পর্কিত কিছু নির্দিষ্ট ধ্যানধারণা তাঁর ছিল। তিনি মনে করতেন, জাতিব্যবস্থা ছিল মূলত এক অর্থনৈতিক সংগঠন। পুঁজিবাদ যেমন উৎপাদন সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রিত করে, জাতিব্যবস্থাও সেইরকম উৎপাদন ও বণ্টনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রিত করত।২৪ অবশ্য পুঁজিবাদ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যও ছিল। যেমন জাতিব্যবস্থায় মানুষের পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা নেই, সে পেশায় যোগ দেয় উত্তরাধিকার সূত্রে। এ ছাড়া তার কিছু কর্তব্য ও দায়িত্বও আছে। নির্মলকুমার মনে করতেন জাতিব্যবস্থা যে এতদিন স্থায়ী হয়েছিল তার কারণ এই ব্যবস্থা মানুষকে অথনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা দিতে পারত, কারণ এই ব্যবস্থা ছিল অ-প্রতিযোগিতামূলক, বংশানুক্রমিক, গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি-নির্ভর। তিনি অবশ্যই জাতিব্যবস্থার বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। মনে করতেন এই ব্যবস্থায় পেশাগত সাম্য ছিল না বলেই নিম্নবর্গীয় মানুষদের পূর্ণবিকাশ সম্ভব হয়নি।

নির্মলকুমার জাতিব্যবস্থাকে বিচার করেছেন সংস্কৃতি ও সভ্যতার কাঠামোর মধ্যে। তাই তিনি জাতি বিষয়ক তত্ত্বে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না, যতটা আগ্রহী ছিলেন এই ব্যবস্থার ঐতিহাসিক পরিবর্তনে। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন, এই ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সীমিত হলেও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। তিনি লিখেছেন, ‘উপরন্তু গ্রাম্য সমাজে এই সহযোগিতার অতিরিক্ত আরও একটি ব্যবস্থার দ্বারা মানুষকে পরম আশ্বাস দেওয়া হইয়াছিল। যে যে-সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত, তাহার কুল বা জাতির আচার যেমনই হউক না কেন, সে সেই আচার বজায় রাখিয়াও হিন্দু সমাজে স্থান পাইত। . . . বর্ণগত সমাজের অন্তরে যে অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড বর্তমান ছিল, এবং স্বধর্ম পালনের যে আশ্বাস বহু জাতি লাভ করিয়াছিল, তাহারই কারণে ভারতীয় সমাজে বিজিতের বিদ্রোহ দেখা দেয় নাই . . .।’২৫ তিনি বলেছেন, এই ব্যবস্থায় যেহেতু অর্থনৈতিক ভাগ্যের স্থিরতা এবং আচার পালনের স্থিরতা ছিল তাই মোটের উপর সকলেই সন্তুষ্ট থাকত। ‘নানক, চৈতন্যদেব অথবা রামমোহন ভেদনীতি বর্জন করিয়া যখন সামাজিক সমতা এবং জাতির পরিবর্তে ব্যক্তিগত গুণ ও কর্মকে সমধিক মর্যাদা দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, তখন শুধু ব্রাহ্মণ নহে, আপামর জনসাধারণ তাহাদিগকে বৃহৎ হিন্দুসমাজের মধ্যে নূতন একটি জাতিতে পরিণত করিয়া মহাপুরুষদের সংস্কারচেষ্টাকে পরাস্ত করিয়াছিল। বৈষ্ণবকে আমরা “বোষ্টম” নামক এক জাতিতে পরিণত করিয়াছি। শিখ এবং ব্রাহ্ম সমাজকে আমরা প্রায় একটি “জাতি”তে পরিণত করিয়া ফেলিয়াছিলাম, যাহার বিবাহ একান্তভাবে স্বীয় সমাজের মধ্যেই আবদ্ধ।’ তিনি মনে করতেন এর মূলে রয়েছে ‘আপামর সাধারণের মনে বর্ণব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য।’ তাই বলেছেন, ‘বর্ণব্যবস্থার অর্থনৈতিক ভারকেন্দ্রের স্থৈর্যের বশেই ভারতীয় সংস্কৃতির স্থৈর্য সম্ভব হইয়াছিল। এই মৌলিক সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করিবার বিশেষ আবশ্যকতা আছে।’২৬

এর সঙ্গেই তিনি যুক্ত করেছেন হিন্দুসমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নটি। হিন্দুসমাজে মানুষ যতক্ষণ সমাজে থাকে সে সমাজের দাস। কুলাচার লোকাচার পালন করবার স্বাধীনতা তার আছে কিন্তু বৃত্তি পরিহারের স্বাধীনতা তার নেই। সমাজের জন্য নির্ধারিত সেবা করে বিভিন্ন জাতি নিজের জীবনযাপন করে। সমাজকে তারা দেখে এবং সমাজও তাদের দেখে। এখানে অধিকার ও দায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে। ‘কিন্তু এই বন্ধনের ঊর্ধ্বে আরও একটি নীতি প্রাচীন হিন্দুগণ স্বীকার করিতেন। যেব্যক্তি সন্ন্যাস গ্রহণ করে, পরিব্রাজক হয়, তাহাকে গৃহস্থের শেষ কর্তব্য অগ্নিরক্ষণের দায় হইতে নিষ্কৃতি দেওয়া হয়। সে বিরজা হোম করিয়া আত্মার প্রতি শেষ নৈবেদ্যও স্বহস্তে সারিয়া ফেলে। অতঃপর তাহার পূর্বাশ্রমের সঙ্গে যোগসেতু বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, নামগোত্র লুপ্ত হয়, এবং সে নিকেতনবিহীন হইয়া চলে। সমাজ তাহার উপর কোন দাবি রাখে না। সেও সমাজের প্রদত্ত ভিক্ষান্ন ভিন্ন অপর কিছু গ্রহণ করিতে পারে না। অর্থাৎ প্রাচীন বর্ণব্যবস্থাযুক্ত হিন্দুসমাজে আমরা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ সমাজের দাসে পরিণত করিবার যে বুদ্ধি দেখি, তৎসহ ইহাও দেখি, ব্যক্তিও যাহাতে বিনষ্ট না হয়, তাহার মৌলিক প্রতিভা বিকাশের জন্য, সন্ন্যাসের খিড়কি দরজা দিয়া মুক্ত আকাশের তলে দাঁড়াইবার একটা ব্যবস্থাও প্রাচীনগণ নির্মাণ করিয়া গিয়াছিলেন।’২৭ পরবর্তী সময়ে ল্যুই ডুঁমো তাঁর Homo Hierarchicus (১৯৬৬) গ্রন্থে ঠিক একই কথা বলেছেন। হিন্দুসমাজে মানুষ তার সামাজিক ভূমিকা ত্যাগ করে সন্ন্যাসীরূপে ব্যক্তি-ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।২৮ তাই সন্ন্যাসীকে তিনি বলেছেন ‘ইনডিভিজুয়াল-আউটসাইড-দ্য-ওয়ার্ল্ড’। সমাজ ও সন্ন্যাসী তাই এই সম্পূর্ণকে তৈরি করে, যার একটা অংশে রয়েছে এমন এক প্রতিষ্ঠান, যা পরস্পরনির্ভরতাকে অতিক্রম করে ব্যক্তিকে উন্মোচন করে।

নির্মলকুমার নিজে বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি ভারতের সামাজিক সংস্কৃতির কিছু উপাদানের স্থায়ী মূল্য আছে বলে বিশ্বাস করতেন, যেমন সংস্কৃতির গণতন্ত্র ও সন্ন্যাস গ্রহণের সেফটি ভালভ-যার ফলে সমাজের স্বৈরাচার যখন মানুষের কাছে অসহনীয় বোধ হত তখন একটি বিকল্প উপায় তার কাছে খোলা থাকত। হিন্দুসমাজের গড়ন (১৯৪৯) গ্রন্থের শেষে তিনি বলেছেন, কীভাবে এই ব্যবস্থা মুসলমান আমলেও টিকে ছিল। কারণ হিসেবে তিনি লিখেছেন, ‘হিন্দুসমাজের মধ্যে কৌলিক বৃত্তিকে আশ্রয় করিয়া যে উৎপাদন এবং বণ্টনব্যবস্থা গড়িয়া উঠিয়াছিল, তাহার মধ্যে শোষণ ও শ্রেণীগত অসমতা থাকা সত্ত্বেও পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধন, নূতন স্থানে গ্রামপত্তনের সম্ভাবনা, বিদেশে শিল্পজাত মাল বিক্রয় এবং প্রতি কুল অথবা জাতির দেশাচার বা কুলাচার পালনে স্বাধীনতা থাকার কারণে তাহা দীর্ঘদিন ধরিয়া টিঁকিয়া রহিল।’২৯ তাঁর মতে, উপনিবেশবাদ এই উৎপাদন ব্যবস্থাকে একটা বড়ো রকম ধাক্কা দেয়। তিনি মনে করতেন ধনতন্ত্র অবশ্যই সমাজে নতুন শক্তির জন্ম দিয়েছে, একই সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের আতিশয্যের জন্য সমাজের ক্ষতিও করেছে। তাই তিনি লিখেছেন, ‘ইউরোপীয় ধনতন্ত্রকে গালি দিব না। তাহা যেখানে মানবসমাজের বৈষয়িক সম্পদ বৃদ্ধির ব্যাপারে সহায়তা করিয়াছে, সেখানে তাহার যোগ্য প্রশংসা করিব। কিন্তু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের আতিশয্যের দ্বারা তাহা যে ক্ষতিসাধন করিয়াছে সে সম্বন্ধেও আমরা অবহিত থাকিব। তেমনই আবার প্রাচীন বর্ণব্যবস্থার মধ্যে যেখানে দোষের যাহা আছে, তাহাকে ক্ষমা করিব না। কিন্তু প্রাচীন উৎপাদনব্যবস্থা ও জাতিসংশ্লেষ, অথবা সমাজ ও ব্যক্তির সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণে যদি কিছু ভাল পাই, যাহা আজও আমাদের প্রয়োজনে লাগিতে পারে, তবে অবশ্যই তাহা গ্রহণ করিব।’৩০

ভারতের আদিবাসী সম্প্রদায় ও হিন্দুসমাজের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর ওই একই যুক্তি ছিল। তিনি দাবি করেন যে, হিন্দু সভ্যতা যেমন জাতিকে স্বীকৃতি দিয়েছে তেমনই জন বা আদিবাসীকেও স্বীকৃতি দান করেছে এবং জাতি ও জন দুই বহুযুগ ধরে ভারতে সহাবস্থান করে এসেছে। হিন্দুসমাজ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে আর্থিক নিরাপত্তা ও স্বধর্ম পালনের স্বাধীনতা দিয়ে এসেছে এই যুক্তি ব্যবহার করে তিনি আদিবাসীদের হিন্দুসমাজে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার এক বিশেষ প্রক্রিয়ার কথা বলেন, যার নাম দেন আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করার হিন্দু পদ্ধতি। নৃতত্ত্বে এই প্রক্রিয়াকে অ্যাকালচারেশন বা সাংস্কৃতিক অভিযোজন প্রক্রিয়া বলা হয়। নির্মলকুমার আদিবাসীদের ক্ষেত্রে এক বিশেষ হিন্দু সাংস্কৃতিক অভিযোজন প্রক্রিয়ার কথা বলছেন। তাঁর মতে, এই পদ্ধতির বিশিষ্টতা হল আদিবাসীদের হিন্দুসমাজে অন্তর্ভুক্তির জন্য তাদের স্বধর্ম পরিত্যাগ করতে হয় না। অন্যভাবে দেখতে গেলে বলা যায়, তিনি দুই ধরনের সামাজিক সংগঠনের সহাবস্থানের কথা বলেছেন, একটি হল ব্রাহ্মণ্য সংগঠন এবং অন্যটি কৌম সংগঠন। প্রথমটি ছিল জটিল, অনেক বড়ো এবং এর প্রযুক্তিগত ভিত্তিও ছিল উন্নত। প্রান্তিক কৌম সমাজ এই ব্রাহ্মণ্য সংগঠনের প্রতি আকর্ষিত হত তার রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য নয় বরং এর প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং হিন্দু সমাজবিন্যাসে একটি স্থান পাওয়ার পরও স্বধর্ম পালনের অধিকার-এই দুই কারণে। হিন্দুসমাজের গড়ন গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে তেলিদের মধ্যে ঘানির উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন জাতি বা উপজাতির সৃষ্টি হয়েছে।

যেহেতু হিন্দুসমাজে কোনো বৃত্তির উপর গোষ্ঠী বা জাতির একচ্ছত্র অধিকার স্বীকৃত ছিল, তাই কৌম সমাজের মানুষ এই ব্যবস্থার প্রতি আকর্ষিত হত। পাল লহড়ার জুয়াঙ্গদের দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেছেন, একসময় এরা শিকার বা জঙ্গল থেকে ফলমূল সংগ্রহ করে জীবিকানির্বাহ করত এবং পরবর্তী সময় বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র তৈরি করতে শেখে এবং নিকটবর্তী গ্রামবাসীদের কাছে বিক্রি করে। এইভাবেই তাদের হিন্দুসমাজের সঙ্গে লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে এই বৃত্তিতে জুয়াঙ্গদের একচ্ছত্র অধিকার, অন্য কোনো জাতি এই বৃত্তিতে প্রবেশ করবে না। তাই তিনি লিখেছেন, ‘পাল লহড়া, ঢেঙ্কানাল, ময়ূরভঞ্জ প্রভৃতি স্থানে ঘুরিয়া আমার আরও একটি বিষয় মনে হইয়াছে। আগেকার আমলে, অনার্য জাতির সহিত গ্রামবাসী ব্রাহ্মণ্য বা আর্যসভ্যতার অন্তর্গত জাতিদের সম্পর্ক ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাইত। এবং অনার্য জাতিবৃন্দের পরিবর্তন ধীরে ধীরে হইত বলিয়া তাহারা স্থানীয় প্রয়োজন অনুসারে এক বৃহত্তর অর্থনৈতিক পরিবারের মধ্যে শ্রমবিভাগের নিয়ম অনুসারে কোনো-একটি বিশেষ বৃত্তি অবলম্বন করিত। কেবল, আর্যসমাজের নিয়ম অনুসারে প্রতি জাতির কৌলিক বৃত্তিতে পুরুষানুক্রমে একাধিপত্য স্বীকৃত হইত।’৩১ এই সাংস্কৃতিক অভিযোজনের ইতিহাস তাঁর মতে সাংস্কৃত্যায়নের রূপ নিয়েছিল এবং এই প্রক্রিয়ায় আদিবাসীরা ক্রমশ জাতি হিসেবে পরিচিত হয়। তাঁর যুক্তি ছিল, বিদ্যুৎ যেমন উঁচু স্থৈতিক শক্তি থেকে নীচু স্তরে প্রবাহিত হয়, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তেমনি অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী স্তর থেকে দরিদ্রশ্রেণির দিকে বয়ে যায়।

কৌম সমাজের অন্তর্ভুক্তির এই বিশেষ পদ্ধতির দু-টি ফলিতার্থের কথা তিনি বলেছেন। প্রথমটি হল, দরিদ্র আদিবাসীদের উন্নত উৎপাদন সংগঠনে অন্তর্ভুক্তি খুব একটা কঠিন হয়নি এবং দ্বিতীয়, এই বিশেষ পদ্ধতির জন্য আদিবাসীরা বিদ্রোহও করেনি-যদিও সমাজ বিন্যাসে তাদের স্থান নীচুতেই ছিল। তিনি লিখেছেন, ‘অধিকাংশ অনার্য জাতি যেসকল বৃত্তি অনুসরণ করিয়া থাকে, তমোগুণের বাহুল্যবশত সেগুলি নিম্নপর্যায়ে পড়ে। অতএব অর্থনৈতিক বন্ধনে অপরের সহিত আবদ্ধ হইলেও অনার্য জাতিবৃন্দ সচরাচর অনাদর অবহেলায় কালাতিপাত করিত। ইহা সত্ত্বেও অনার্য জাতিবৃন্দ কেন বনের স্বয়ংসম্পূর্ণতা পরিহার করিয়া অপরের সহিত অন্নসূত্রের বন্ধনে আবদ্ধ হইবার চেষ্টা করিত? অথবা লক্ষ্মীদেবতা বা অপরাপর আর্য-দেবতা বা অনুষ্ঠানেরই বা অনুকরণ করিত কেন? অনেকে মনে করেন, আর্য জাতিবৃন্দের নিকট যুদ্ধে পরাভব স্বীকার করিয়া কোল জুয়াঙ্গ প্রভৃতি জাতি দাসসুলভ মনোভাবের পরিচয় দিত। ইহা আংশিকভাবে সত্য হইতে পারে। কিন্তু “দাসের” মনে স্বাধীনতার সকল আকাঙ্খা নিঃশেষে মুছিয়া গিয়া অপরের অনুকরণে উৎসাহ কেন জন্মে, তাহার অন্তর্নিহিত কারণ সম্বন্ধে কি আমাদের আরও অনুসন্ধানের প্রয়োজন নাই?’৩২

নির্মলকুমারের জাতি ও জন সম্পর্কিত আলোচনা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা অবশ্য বলার থেকে যায়। তিনি এই বিষয়গুলিকে বিচার করেছেন হিন্দুসমাজের সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার এক আদর্শ কাঠামোর মধ্যে। অন্যভাবে বলতে গেলে, তাঁর বর্ণিত জাতিবিবরণ গঠিত হয়েছে হিন্দুত্বের এক আদর্শে যা বস্তুত ব্রাহ্মণ্যবাদী। তিনি যে মডেলকে আশ্রয় করে এই বিবরণ তৈরি করেছেন, আগেই বলেছি, তা হল সাংস্কৃতিক অভিযোজনের মডেল। এই প্রক্রিয়ায় অন্য গোষ্ঠীগুলি মূল সমাজব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত হবার রসদ সংগ্রহ করে এবং তাঁর মতে হিন্দুধর্মই এই উপাদানগুলি প্রান্তিক গোষ্ঠীদের সরবরাহ করেছে। যদিও তিনি অন্তত তত্ত্বগতভাবে পরিব্যাপ্তিবাদ ও সাংস্কৃতিক অভিযোজনবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, তাঁর জাতি বিষয়ক আলোচনায় কিন্তু এক অর্থে তা প্রতিফলিত হয়নি। বস্তুত সাংস্কৃতিক অভিযোজন প্রক্রিয়ায় মিলমিশ দুই দিক থেকেই হয়, এই প্রক্রিয়া কখনোই একপেশে নয়। তাঁর বিবরণে প্রান্তিক গোষ্ঠী বা জাতির অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে উপর থেকে নীচ, ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শে নির্ভর করে। প্রথমদিকের প্রাচ্যবাদীরা ভারতের সামাজিক ইতিহাসকে যেমন হিন্দুধর্মের ইতিহাস হিসেবে দেখতেন অথবা অহিন্দু গোষ্ঠীদের হিন্দুসমাজে সংমিশ্রণের ইতিহাস হিসেবে দেখতেন, নির্মলকুমারও সেই দোষ থেকে মুক্ত নন।

৫. বৈজ্ঞানিক নৃতত্ত্ব বনাম স্বভাষায় নৃতত্ত্ব

ফিরে আসি যে আলোচনা দিয়ে এই প্রবন্ধ শুরু করেছিলাম সেই প্রসঙ্গে। নির্মলকুমার মনে করতেন তিনি একজন বিজ্ঞানী, বিজ্ঞান হল তাঁর স্বধর্ম। বিজ্ঞান শুধু তাঁর কাছে সত্য আবিষ্কারের হাতিয়ার নয়, সামাজিক কর্মপন্থা নির্দিষ্ট করার উপায়ও। তিনি নৃতত্ত্বকে বিজ্ঞানের ক্ষেত্র হিসেবেই দেখেছেন, এবং তাঁর বিশ্বাস ছিল এই বিজ্ঞানের শিক্ষা হয় গ্রামে-গঞ্জে আদিবাসী অঞ্চলে কাজ করার মাধ্যমে। তিনি বিজ্ঞানের কোনো বিমূর্ত ধারণায় উৎসাহী ছিলেন না বরং মনে করতেন এই বিজ্ঞানের কার্যকারিতা প্রমাণিত হবে কাজের মধ্য দিয়ে। এই বিজ্ঞান তাঁর কাছে খুব একটা উন্নত, পরিশীলিত বা পরিমার্জিত বিজ্ঞান ছিল না। তিনি বরং মনে করতেন একে পরিমার্জিত করার উদ্দেশে শক্তি ক্ষয় করলে তাঁর বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। নিজেকে তিনি একজন ফিল্ড সায়ান্টিস্ট বা ক্ষেত্র-বিজ্ঞানী হিসেবে ভাবতেন, মনে করতেন তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে খুব বড়ো সত্য না হোক, ছোটো ছোটো সত্য আবিষ্কৃত হবে। তাঁর কাছে এই বিজ্ঞান ছিল বস্তুনির্ভর, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ-নির্ভর, যে বিজ্ঞান সত্যের সন্ধান দেবে ‘তথ্য’কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার পর। ভারতের জাতি, কৌম সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের পরিধি বিস্তৃত করাকেই তিনি প্রকৃত জ্ঞানের উপায় বলে মনে করতেন।

অথচ তাঁর বাংলাভাষায় লেখা রচনাগুলি এই বিজ্ঞানের বিরুদ্ধাচরণ করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, তিনি তাঁর বাংলা রচনায় স্বকল্পিত বিজ্ঞানের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং আধুনিক নৃতত্ত্বের অনেক কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। তিনি নিজেকে পরিব্রাজক বলতেন, মধ্যযুগীয় পরিব্রাজকের মতো তিনি সত্যের সন্ধানী ছিলেন এবং সেই সত্যের প্রচারেও উৎসাহী ছিলেন। তাই অপেশাদার সাধারণ পাঠকের জন্য বাংলা ভাষায় প্রবন্ধও লিখেছেন অনেক। এ ব্যাপারে তিনি উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার যে ধারা আরম্ভ হয় তার সুযোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। বস্তুত বাংলায় নৃতত্ত্বচর্চার প্রচার ও প্রসারে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত পত্রপত্রিকার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যে নৃতত্ত্বচর্চা সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি লাভ করে বিশ্ববিদ্যালয় বা অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমে। বঙ্গদেশে নৃতত্ত্বের প্রচারে এই প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা তুলনামূলকভাবে গৌণ, বরং ও ব্যাপারে প্রথম রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত বিবিধার্থ-সংগ্রহ পত্রিকা এবং পরবর্তী সময়ে নির্মলকুমার, বিনয় ঘোষ প্রমুখ লেখকেরা নৃতত্ত্বকে বাঙালি পাঠকের অনেক কাছাকাছি নিয়ে আসেন। বস্তুত এই চর্চা ছিল এক ধরনের সাংস্কৃতিক শিক্ষা যা মানুষকে অন্যজাতি, গোষ্ঠী, রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি সহনশীল হতে শেখাত। বিবিধার্থ-সংগ্রহ পত্রিকায় যে বিভিন্ন জাতির নৃতাত্ত্বিক পরিচয় প্রকাশিত হত, তারও একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশের মানুষের সংকীর্ণ নিজ-সমাজকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও প্রসারিত করা।৩৩ বহুত্ববাদে বিশ্বাসী নির্মলকুমার এই ধারাকে যে আরও শক্তিশালী করবেন এ আর আশ্চর্য কী!

বাংলা ভাষায় নৃতত্ত্বচর্চার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় যে, নৃতত্ত্ব এক ধরনের আখ্যান যা সংস্কৃতি নির্ভর। ভাষাই যেহেতু আখ্যানকে গঠিত করে তাই ভাষার রীতিনীতি, প্রকরণ, অলংকরণ সবই এই আখ্যানের সঙ্গে ওতপ্রোত থাকে। বস্তুত আখ্যানকে মানুষ সত্য বলে স্বীকার করবে কেন? এইখানে আখ্যানের উপর বিজ্ঞানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়, বলতে হয় এটা বিজ্ঞান তাই এই আখ্যান সত্য। অথচ এই আখ্যানের অন্তর্নিহিত গঠন সর্বক্ষণই বিজ্ঞানের বিরোধিতা করে যায়। বিজ্ঞান তথ্যের নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ দাবি করে, কিন্তু নৃতত্ত্ব শুরু হয় ব্যক্তিগত আখ্যান দিয়ে। নৃতত্ত্বে ব্যক্তিগত আখ্যান এবং বস্তুগত বিবরণের যুগ্মপ্রয়োগ ও টানা-পোড়েনের কথা এই প্রবন্ধের গোড়ায় বলেছি। মনে রাখতে হবে, এটা কিন্তু নৃতত্ত্বের আবিষ্কার নয়, নৃতত্ত্বের অনেক আগে থেকে ভ্রমণ-সাহিত্যেও এটা দেখা যায়। নৃতত্ত্ব সবসময়ই নিজেকে ভ্রমণসাহিত্য থেকে আলাদা ঘোষণা করতে চায়, কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নৃতাত্ত্বিক আখ্যানে ভ্রমণসাহিত্যের অবদান অনেকটাই। ভ্রমণসাহিত্যের একটি প্রচলিত রীতি হল ব্যক্তিগত আখ্যানের সঙ্গে সেই স্থানের প্রাণীকুল, উদ্ভিদকুল, অনুষ্ঠান, রীতিনীতির বিবরণ যোগ করা। ভ্রমণসাহিত্যে ব্যক্তিগত আখ্যান এবং নৈর্ব্যক্তিক বিবরণ, বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং নির্বিশেষ বর্ণনা, এই দু-টি ভিন্ন ধারা প্রায়শই স্থান বদল করে চলতে থাকে। এখানে বাংলা ভ্রমণসাহিত্য থেকে নানা দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। ১৮৫৪ সালে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ধারাবাহিক-ভাবে প্রকাশিত তাঁর ‘ভ্রমণকারি বন্ধুর পত্র’ রচনায় পূর্ববাংলার গ্রাম, জাতি, উপজাতি, আহার, সামাজিক ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদির অত্যন্ত মনোজ্ঞ বিবরণ দিয়েছিলেন। আমি এখানে দৃষ্টান্ত হিসেবে বেছে নেব আরও একটি বিখ্যাত ভ্রমণসাহিত্য-সঞ্জীবচন্দ্রের পালামৌ বইটিতে আমরা যেমন দেখি কোলভূমির বিবরণ, সেখানকার উদ্ভিদকুল (‘তাল, হিন্তাল একেবারেই নাই, কেবল শালবন, অন্য বন্য গাছও আছে। শালের মধ্যে প্রকাণ্ড গাছ একটিও নাই, সকল গুলিই আমাদের দেশী কদম্ববৃক্ষের মত’)৩৪, বসবাসের স্থান (‘সকলেরই পর্ণ কুটির’), নারীদের পোশাক অলংকার (‘সকলের কটিদেশে একখানি করিয়া ক্ষুদ্র কাপড় জড়ান, সকলেরই কক্ষ, বক্ষ আবরণশূন্য। সেই নিরাবৃত বক্ষে পুতির সাতনরী, তাহাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরসী ঝুলিতেছে; কর্ণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বনফুল, মাথায় বড় বড় বনফুল।’)৩৫, অথবা কোলদের বিবাহরীতি, নৃত্যগীত, মদ্যপানের বিবরণ, এই সমস্ত কিছুই রয়েছে। ভ্রমণসাহিত্যের এটাই সর্বজনীন রীতি। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো কথা হল, আধুনিক নৃতত্ত্বের মতো এখানেও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রয়েছে নিরপেক্ষ বর্ণনা, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা-যেমন দেখি সঞ্জীবচন্দ্রের লেখা কোলদের বিবাহ বর্ণনায়, ‘এবার তাহাদের বিবাহের পরিচয় দিতে ইচ্ছা হইতেছে। . . . তাহাদের প্রত্যেক গ্রামের প্রান্তে একখানি করিয়া বড় ঘর থাকে। সেই ঘরে সন্ধ্যার পর একে একে গ্রামের সমুদায় কুমারীরা আসিয়া উপস্থিত হয়, সেই ঘর তাহাদের ডিপো। বিবাহযোগ্যা হইলে আর তাহারা পিতৃগৃহে রাত্রি যাপন করিতে পায় না। সকলে উপস্থিত হইয়া শয়ন করিলে গ্রামের অবিবাহিত যুবারা ক্রমে ক্রমে সকলে সেই ঘরের নিকটে আসিয়া রসিকতা আরম্ভ করে; কেহ গীত গায়, কেহ নৃত্য করে, কেহ বা রহস্য করে। . . . নৃত্য হাস উপহাস্যের পর পরস্পর মনোনীত হইলে সঙ্গী সঙ্গিনীরা তাহা কাণাকাণি করিতে থাকে। ক্রমে গ্রামে রাষ্ট্র হইয়া পড়ে। রাষ্ট্র কথা শুনিয়া উভয় পক্ষের পিতৃকুল সাবধান হইতে থাকে। সাবধানতা অন্য বিষয়ে নহে। কুমারীর আত্মীয় বন্ধুরা বড় বড় বাঁশ কাটে, তীর ধনুক সংগ্রহ করে; অস্ত্রশস্ত্রে সান দেয়। আর অনবরত কুমারের আত্মীয় বন্ধুকে গালি দিতে থাকে। চীৎকার আর আস্ফালনের সীমা থাকে না। আবার এদিকে উভয় পক্ষে গোপনে গোপনে বিবাহের আয়োজনও আরম্ভ করে।’৩৬

এখানে সবিশেষ লক্ষ করার বিষয়টি হচ্ছে, ভ্রমণসাহিত্যের প্রথাগত এই যে রচনাশৈলী, অর্থাৎ নৈর্ব্যক্তিক বিবরণ এবং ব্যক্তিগত আখ্যানের সংমিশ্রণ, এটাও কিন্তু আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক চিন্তার ফসল নয়; বরং এই একই শৈলী ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপীয় ভ্রমণসাহিত্যেও দেখতে পাওয়া যায়। সঞ্জীবচন্দ্রের এই বিবাহবর্ণনার উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বর্ণনার সাধারণীকরণ। এই বিবরণ বস্তুত কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা পরিবারের নয়, সম্পূর্ণ কোল জাতির। আরও লক্ষ করার বিষয় হল বিবাহের বিবরণ দেওয়া হয়েছে সাধারণ বা নিত্য বর্তমান কালে এবং এর ফলেও বিবরণের সাধারণীকরণ হচ্ছে। নৃতাত্ত্বিকও নিজের রচনায় এই কৌশল ব্যবহার করে থাকেন। বহু সময় ভ্রমণসাহিত্যে বর্ণনামূলক নিবন্ধ তার আখ্যানের মধ্যেই মিশে থাকে। যেমন : ‘অপরাহ্নে পালামৌয়ে প্রবেশ করিয়া উভয়পার্শ্বস্থ পর্ব্বত শ্রেণী দেখিতে দেখিতে বনমধ্য দিয়া যাইতে লাগিলাম। বাঁধা পথ নাই, কেবল এক সঙ্কীর্ণ গো-পথ দিয়া আমার পালকি চলিতে লাগিল, . . . কতকদূর গিয়া দেখিলাম, পথশ্রান্তা যুবতীরা মদের ভাঁটিতে বসিয়া মদ্যপান করিতেছে। . . . যুবতীরা উভয় জানুদ্বারা ভূমি স্পর্শ করিয়া দুই হস্তে শালপত্রের পাত্র ধরিয়া মদ্যপান করিতেছে, . . . জানুস্পর্শ করিয়া উপবেশন করা কোলজাতির স্ত্রীলোকদিগের রীতি; . . .।’৩৭ বলাবাহুল্য, ব্যক্তিগত আখ্যান ও সাধারণ উক্তি এখানে মিলেমিশে থাকলেও, দু-টিকেই আলাদা করে চেনা যায়। এখানে রচনাশৈলীর মধ্যে বিভিন্ন কালের প্রয়োগও লক্ষ করতে হয়।

বিভিন্নভাবে আখ্যান-বিবরণের দ্বৈততা ভ্রমণসাহিত্যে আছে একদম প্রথম থেকেই, যেমন আছে এর প্রথাগত ক্রম, অর্থাৎ প্রথমে আখ্যান পরে বিবরণ বা প্রথাগত রীতি অর্থাৎ আখ্যান মুখ্য, বিবরণ গৌণ। নৃতত্ত্বও এই ধারার মধ্যে তার রচনা গঠিত করে, যদিও বিষয় হিসেবে নিজেকে বিজ্ঞান বলে নৃতত্ত্ব ভ্রমণসাহিত্য থেকে নিজের দূরত্বও জাহির করে। নৃতাত্ত্বিক রচনায় অবশ্য বিবরণই মুখ্য এবং আখ্যান গৌণ ভূমিকা পালন করে। তবুও ব্যক্তিগত আখ্যানের ভূমিকা নৃতাত্ত্বিক রচনায় অপরিসীম। এই ব্যক্তিগত আখ্যান মূল রচনার প্রেক্ষাপট তৈরি করে এবং পরবর্তী বিবরণের জন্য পাঠককে প্রস্তুতও করে। বিবরণের বিশ্বাসযোগ্যতার পটভূমি এই আখ্যানভাগেই নিহিত থাকে।

এবার ভ্রমণসাহিত্য থেকে নৃতাত্ত্বিক রচনার দিকে যদি ফিরে তাকাই তাহলে এই ধারাবাহিকতার চেহারা আরও স্পষ্ট ধরা যাবে। নির্মলকুমার তাঁর ক্ষেত্র-সমীক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কিত এক রচনায় লিখেছেন যে, একজন ভ্রমণকারী নানারকম মালমশলা সংগ্রহ করে, যা হয়তো ভবিষ্যতে বিভিন্ন শ্রেণির বিজ্ঞানীর কাজে আসতে পারে। কিন্তু পরিকল্পিত ক্ষেত্র-সমীক্ষা ভ্রমণকারীর পর্যবেক্ষণ থেকে পৃথক। এর সঙ্গে তুলনীয় গবেষণাগারের পরীক্ষামূলক নিরীক্ষণ। অর্থাৎ এখানেও সেই নৃতত্ত্বকে বিজ্ঞান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা। বৈজ্ঞানিক যেমন গবেষণাগারে পরীক্ষানিরীক্ষা করেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যেমন সুশৃঙ্খল, সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে, নৃতাত্ত্বিকের ক্ষেত্র-সমীক্ষাও ঠিক সেইরকম পরীক্ষানিরীক্ষা করার মতো বিষয়, তারও সেই একইরকম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি রয়েছে। মূলত এখানেও সেই ভ্রমণসাহিত্য থেকে নৃতত্ত্বের দূরত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা; কারণ, ভ্রমণসাহিত্য বৈজ্ঞানিক রচনা নয়, পরিকল্পিত ক্ষেত্র-সমীক্ষার মাধ্যমে তা রচিত হয়নি।

অথচ, একদম প্রথম যুগ থেকেই নৃতাত্ত্বিক রচনার সূত্রপাত হয়েছে ভ্রমণসাহিত্যের কয়েকটি বিশেষ ভঙ্গিকে অবলম্বন করে। যেমন, নৃতাত্ত্বিকের নিজের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আবির্ভাবের বর্ণনায়, ভ্রমণসাহিত্যের শুরুতে ভ্রমণকারী গন্তব্যস্থানে কীভাবে এলেন, এসে প্রথম দৃষ্টিতে কী দেখলেন, দেখে কী তাঁর প্রতিক্রিয়া হল-এই সমস্ত কিছুরই এক বিশদ বর্ণনা দেন। তাঁর যাত্রা কষ্টকর ছিল, না মনোরম ছিল, যে পথে তিনি এসে পৌঁছোলেন তা সুগম না দুর্গম, প্রথম দৃষ্টিতে তিনি আশ্চর্য হলেন, না হতাশ হলেন ইত্যাকার বিবরণের সঙ্গে ভ্রমণসাহিত্যের সকল পাঠকই পরিচিত। নৃতাত্ত্বিকও তাঁর রচনায় ওই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন। যেকোনো ক্ষেত্র-সমীক্ষার বিবরণ আরম্ভ হয় নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে নৃতাত্ত্বিকের প্রবেশ সংক্রান্ত বিবরণ দিয়ে। নৃতাত্ত্বিক তাঁর ব্যক্তিগত আখ্যান দিয়েই রচনা আরম্ভ করেন। কোথাও নৃতাত্ত্বিক এক স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করেছেন যেখানে নেটিভরা দুই হাত বাড়িয়ে তাঁকে টেনে নিচ্ছে, কোথাও তিনি পরিত্যক্ত, তাঁকে ছেড়ে জাহাজ চলে গেছে আবার কোথাও তিনি নানা বাধাবিপত্তি, অসহযোগিতায় হতাশ, বিরক্ত।৩৮

এবার নির্মলকুমারের কথায় আসি। একটু আগেই বলেছি তিনি মনে করতেন নৃতত্ত্ব ভ্রমণসাহিত্য নয়। নৃতত্ত্ব হল বিজ্ঞান। অথচ অন্যান্য নৃতাত্ত্বিকের মতো ভ্রমণসাহিত্যের আখ্যানরূপ ধার করেই তিনি নিজের নৃতাত্ত্বিক রচনা শুরু করেছেন। হিন্দুসমাজের গড়ন বইতে তিনি জুয়াঙ্গদের অনুসন্ধানভিত্তিক বিবরণ দিয়েছেন। এই বিবরণের প্রথমেই রয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত আখ্যান : ‘১৯২৮ সালের প্রারম্ভে আমি পাল লহড়া রাজ্যের মধ্যে কণ্টলা নামক এক গ্রামে জুয়াঙ্গ এবং শবরদের দ্বারা অধ্যুষিত পল্লীতে কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করিয়াছিলাম। বাহির হইতে কোনো লোক আসিলে জুয়াঙ্গেরা স্বভাবতই সন্ত্রস্ত হয়। তাহারা প্রথমে মনে করিয়াছিল, আমি হয়তো কোনও অসদুদ্দেশ্য লইয়া সেখানে উপস্থিত হইয়াছি, সরকারী বনবিভাগের এলাকায় তাহারা যেসকল বস্তু অপরের অগোচরে সংগ্রহ করিয়া থাকে সম্ভবত তাহারই সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছি। কিন্তু যেদিন আমি কণ্টলা গ্রামের অধিষ্ঠাতৃদেবতার নামে পূজা দিলাম এবং দুটি মোরগ বলি দেবার পর সমস্ত গ্রামবাসীকে পেট ভরিয়া ভাত খাইবার জন্য নিমন্ত্রণ করিলাম, সেদিন হইতে আমাকে বন্ধুভাবে গ্রহণ করিতে জুয়াঙ্গেরা আর ইতস্তত করে নাই।’৩৯

মনে রাখতে হবে নৃতাত্ত্বিকের তথ্যসংগ্রহ পদ্ধতি ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তিগত আখ্যান এই তথ্য এবং নৃতত্ত্বর নিজেকে বিজ্ঞান হিসেবে দাবি করার প্রচেষ্টার মধ্যে মধ্যস্থতা করে। এই ব্যক্তিগত আখ্যান দিয়ে নৃতাত্ত্বিক পাঠককে বুঝিয়ে দেন যে, পরে তাঁরা যে বিবরণ পড়বেন সেই বিবরণ বিশ্বাসযোগ্য, সেই তথ্য নৃতাত্ত্বিক স্বঃতস্ফূর্তভাবে পেয়েছেন, তার মধ্যে কোনো জোরজবরদস্তি ছিল না। এমনকী যাদের বিবরণ নৃতাত্ত্বিক দিতে চলেছেন তিনি তাদেরই একজন হয়েছিলেন (যার থেকে নৃতত্ত্বে ‘অংশগ্রহণকারী পর্যবেক্ষণ’ পদ্ধতির তত্ত্ব এসেছে), তিনি যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন তা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার তথ্য, এই তথ্য তাঁকে উদ্দেশ্য করে সংগঠিত হয়নি। যে লোকসমাজ নৃতাত্ত্বিকের অধ্যয়নের বিষয়বস্তু তাদের থেকে নৃতাত্ত্বিকের নিজের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ সকল বিষয়েই পৃথক। বস্তুত, নৃতাত্ত্বিকের উপস্থিতি তাদের জীবনযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যের সূচনা করে, স্বচ্ছন্দ সেই জীবনযাত্রায় কিছুটা ছন্দপতনও বোধহয় ঘটে। কিন্তু নৃতাত্ত্বিক তাঁর রচনা পাঠকের কাছে উপস্থিত করেন যেন এই পার্থক্যের বিলোপ ঘটেছে। রচনার প্রারম্ভে ব্যক্তিগত আখ্যানের মাধ্যমে তিনি এই পার্থক্যের বিলোপসাধন করেন। রচনার বিবরণের অংশে নৃতাত্ত্বিক যেমন নিজে অদৃশ্য হয়ে যান, ঠিক তেমনই তথ্য সংগ্রহের সময়ও তিনি যেন অদৃশ্য হয়েই ছিলেন। তিনি যেন অন্যদের থেকে আর আলাদা নন।

নির্মলকুমারের উপরোক্ত আখ্যান ভ্রমণসাহিত্য ও নৃতাত্ত্বিক বিবরণের একটি পরিচিত আখ্যান। নতুন জায়গায় প্রথমে মানুষের মনে নানাবিধ সন্দেহ দেখা দেবে, তারা মন খুলে কথা বলতে চাইবে না, পরে নৃতাত্ত্বিকের কিছু আচরণ দেখে তারা সন্দেহমুক্ত হবে। প্রারম্ভিক আখ্যানের পর নির্মলকুমার নিজে রচনা থেকে মোটামুটি অদৃশ্য হয়ে যান, শুরু হয় ‘বৈজ্ঞানিক’ আলোচনা, ‘বৈজ্ঞানিক’ বিবরণ। যেমন কোলদের কথা বলতে গিয়ে সঞ্জীবচন্দ্রের মতোই তিনি লিখেছেন, ‘. . . মুণ্ডাগ্রামে আরও একটি বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান দেখা যায়। গ্রামের অবিবাহিত যুবকগণ রাত্রে বাড়িতে শোয় না। তাহারা একত্র হইয়া যে ঘরে রাত্রিযাপন করে সে ঘরটিকে গিতি-ওড়া বা শুইবার ঘর বলা হয়। কুমারীদের জন্যও তেমনই কোনও বর্ষীয়সী বিধবার বাড়িতে অতিরিক্ত ঘর থাকিলে আর একটি গিতি-ওড়া প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে।’৪০

নৃতাত্ত্বিকরা ভ্রমণকারীদের থেকে নিজেদের পৃথক করেন এই বলে যে, ভ্রমণকারী শুধু ভ্রমণ করে চলে যান, কিন্তু নৃতাত্ত্বিক সেই স্থানে বা সমাজে থেকে অধ্যয়ন করেন। ভ্রমণকারীর দৃষ্টি হল নেহাতই তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টি, অন্যদিকে, নৃতাত্ত্বিকের দৃষ্টি হল ‘বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষকের’ অবলোকন। অথচ নৃতাত্ত্বিক রচনা বারবার এই বৈজ্ঞানিক-পর্যবেক্ষকের দৃষ্টির গণ্ডি ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে, ভ্রমণসাহিত্যের মতো নৃতাত্ত্বিকও তাঁর রচনায় ছোটো ছোটো গল্প, কথোপকথন, ঠাট্টা-রসিকতা মিশিয়ে দেন, রচনায় নৃতাত্ত্বিক বারবার লেখক হিসেবে নিজের অবস্থান বদল করতে থাকেন। কখনো-বা তিনি বৈজ্ঞানিক-পর্যবেক্ষক, কখনো-বা গল্পকার, কখনো-বা কৌতূহলী জিজ্ঞাসু, কখনো-বা রসিক-দর্শক। হিন্দুসমাজের গড়ন-এ মাণ্ডা পরবের বিবরণ আছে। এই বিবরণ আরম্ভ হয়েছে এক নৈর্ব্যক্তিক ভাষ্য হিসেবে, ‘রাঁচি জেলায় গ্রীষ্মকালে মাণ্ডা পরব নামে একটি পরবের অনুষ্ঠান হয়। ইহাতে কেবল মুণ্ডা বা উরাঁওরা নহে, অপর নানা জাতিও যোগ দিয়া থাকে।’৪১ এরপর বিভিন্ন লোকাচারের বিবরণ দিয়ে তিনি ‘ফুলকুদনা’র বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু এই সম্পূর্ণ বিবরণে যোগ করেছেন কিছু ছোটো ঘটনা এমনকী কিছু শোনা কথা, ‘ভোক্তা এবং সোকথাইগণের হাঁটা শেষ হইলে আমার এক বন্ধু দৌড়াইয়া আগুন পার হইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার পায়ে ফোস্কা পড়িয়াছিল। . . . আবার রাঁচি শহর হইতে দূরে, খুঁটি-মহকুমার অন্তর্গত একটি গ্রামে শুনিয়াছি যে, ভোক্তাগণ শুধু আগুনের উপর দিয়া হাঁটিয়া ক্ষান্ত হয় না। যতক্ষণ পর্যন্ত কাঠকয়লার আগুন নিভিয়া না যায়, ততক্ষণ পর্যন্ত সকলে মিলিয়া তাহার উপরে নাচিয়া পায়ে করিয়া কয়লা চতুর্দিকে ছড়াইতে থাকে।’৪২ বস্তুত এইসব রচনায় লেখকের বহু সত্তা, বহু আনন প্রতিভাত হয়, এই বহু সত্তাবিশিষ্ট ব্যক্তিত্বই কিন্তু সম্পূর্ণ রচনার উৎস এবং রচনাটিকে ধরে রেখেছে। ভ্রমণসাহিত্য বা স্মৃতিচারণও কিন্তু তাই। তবে ভ্রমণসাহিত্যের বিজ্ঞান হবার আকাঙ্খা নেই, নৃতত্ত্বের আছে।

নির্মলকুমার একই সঙ্গে সমান্তরালভাবে ছোটো ছোটো বাংলা রচনার মাধ্যমে তাঁর পরিব্রাজক জীবনের কথা লিখতে থাকেন যা পরে পরিব্রাজকের ডায়েরী (১৯৪০) নামে প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া আদিবাসী জীবন, সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর বাংলা লেখার আর একটি সংকলন হল নবীন ও প্রাচীন (১৯৩০)। এইসব রচনায় তিনি আর বিজ্ঞানী নন, বরং এখানে তাঁর পরিব্রাজক সত্তাই প্রধান। এক খোলামেলা বর্ণনায় এখানে তিনি পাঠককে তাঁর যাত্রা ও চিন্তার সহযাত্রী করে নেন। এই রচনা নৈর্ব্যক্তিক বৈজ্ঞানিক রচনার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে অনেক বেশি আত্মজীবনীমূলক, স্বীকারোক্তিমূলক। নির্মলকুমার লিখেছেন এই রচনাগুলির মধ্যে তাঁর নিজস্ব বিকাশের সূত্রগুলি ছড়িয়ে আছে। শহর জীবনের ক্লান্তি ও জড়তা দূর করবার জন্য তিনি প্রথমে প্রকৃতির স্বরূপসন্ধানে অনুরাগী হয়েছিলেন। অচেনা সংস্কৃতি তার সম্পূর্ণতা নিয়েই প্রথমে ধরা দেয়, তাই এই পর্যায়ের রচনায় ব্যক্তি নেই। কিন্তু ক্রমশ ব্যক্তির সন্ধান পেলেন এবং এই সন্ধান লাভের পর অন্তরে ভরসাও পেলেন। এই ভরসাই তাঁকে নিজের চারিদিকের সমাজ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করতে উৎসাহী করল। এবং শেষে, ‘প্রকৃতির সংস্পর্শে, প্রকৃতিজ মানুষের ঋজু ব্যক্তিত্বের সঙ্গগুণে যে-শক্তি লাভ করিয়াছিলাম তাহার প্রভাবে পারিপার্শ্বিক জীবনের গ্লানিটুকুও যেন অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলাম। আমাদের সমাজের মধ্যে, শহরের সংস্কৃতির আবেষ্টনের ক্ষুদ্রতা অতিক্রম করিয়াও মানুষ যে পূর্ণতম ব্যক্তিত্ব লাভ করিতে পারে এই সত্যের সন্ধানে ভক্তিভরে তীর্থের শেষ অঙ্কটুকু আগাইয়া চলিলাম। . . . মানুষের ব্যক্তিত্ব যে আবেষ্টনের সর্ববিধ বন্ধনকে অতিক্রম করিতে পারে, এই সত্যের সমর্থনই আমার সকলের চেয়ে বড় লাভ হইল। মানুষের মন অজেয়। অজয় নদীর কূলে এই অতি পুরাতন সত্যটিকে নিজের জীবনে নূতন করিয়া উপলব্ধি করিলাম।’৪৩ তীর্থের অন্তে এই যে উপলব্ধি, তারই সূত্র পাঠকদের ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি। বলা বাহুল্য, এই রচনাগুলি কোনোভাবেই বৈজ্ঞানিক নয় কিন্তু রচনাগুলি নৃতাত্ত্বিক নয় এমন কথা কিন্তু বলা যাবে না।

নিজের দেশের মানুষের কাছাকাছি থাকব, তাদের জানব, তাদের থেকে শিখব, এই শিক্ষা বোধহয় তিনি পেয়েছিলেন তাঁর গান্ধীবাদে অনুরাগ থেকে। এই শিক্ষা তাঁকে সমাজ, সংস্কৃতি সম্পর্কে কিছু সত্য উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। এই উপলব্ধির কথাই তিনি বলেছেন এইসব রচনায়। এই উপলব্ধি গবেষণাগারে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা লব্ধ উপলব্ধি নয় বরং মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করার ফলে যে উপলব্ধি হয় সেই প্রতীতি। ধাওতাল উরাঁও বা চইতার সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘গ্রামের সংস্কৃতির মধ্যে যাহা কিছু জীবন্ত যাহা কিছু সত্য তাহা ধাওতাল বা চইতার মত মানুষের চরিত্র সৃষ্টির মধ্যেই পরিপূর্ণতা লাভ করে। এমন মানুষের সন্ধান লাভের পর অন্তরে ভরসা পাইলাম। নিজেদের সমাজ এবং সংস্কৃতির মধ্যে অনুসন্ধান করিবার মত উৎসাহ হইল।’৪৪

আগেই বলেছি এইসব রচনা পাঠককে সংস্কৃতির শিক্ষা দেয়, পাঠককে তার নিজস্ব ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে বার করে এক বৃহত্তর জগতের খোঁজ দেয়। আজকের দিনে বাংলা ভাষায় এই ধরনের রচনা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না, সেসব পাট বহুদিনই চুকেবুকে গেছে। কিন্তু নির্মলকুমারের রচনা পড়লে অবাক হয়ে যেতে হয় এই ভেবে যে, কত সহজে তিনি এই শিক্ষা দিয়েছেন। বহু উদ্ধৃতি দেওয়া যায়, প্রবন্ধের শেষে একটি দু-টি উদ্ধৃতি দেব। নবীন ও প্রাচীন গ্রন্থে জুয়াঙ্গ জাতির পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আমি যখন প্রথম জুয়াঙ্গদের মধ্যে যাই তখন তাহারা জিজ্ঞাসা করিল, আপনার কি কুলির দরকার? আমি যে তাহাদের ভাষা শিখিতে আসিয়াছি, তাহাদের সঙ্গে মিশিতে আসিয়াছি এ-কথা তাহার আদৌ বিশ্বাস করিল না। ক্রমে আলাপ-সালাপের পর যখন তাহাদের মধ্যে বসিয়া গান-বাজনা শুনিতেছি, তখন পার্শ্ববর্তী গ্রামের একজন ব্রাহ্মণ জনমজুরের খোঁজে একদিন সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। সে তো ভাষা-শেখার কথা শুনিয়া হাসিয়াই ফেলিল। বলিল, বাবু ওদের তো ভাষা নাই। বাঁদরেরা যেমন কুঁইকাঁই করে, ওদেরও সেই রকম ঠার আছে। ভাবিলাম, হায় রে, সুখে দুঃখে পাশাপাশি থাকিয়াও মানুষে এমন করিয়া মানুষের সহিত ব্যবধান সৃজন করিয়া রাখে, তাহাকে মানুষ বলিয়া ভাবিতে পর্যন্ত পারে না, ইহার চেয়ে দুঃখের কথা আর কিছু হইতে পারে না।’৪৫ পরিব্রাজকের ডায়েরী বইটিতে ‘কোলদের দেশ’ নামে একটি রচনা আছে, সেখানে তিনি সিংভূম জেলার কোলদের কথা লিখেছেন। নৈর্ব্যক্তিক বিবরণ নয়, এখানে লেখক তাঁর নিজস্ব ভাবনাচিন্তা নিয়ে রচনার মধ্যে ভীষণভাবে উপস্থিত, ‘কোলদের জীবন-নাট্যের কথা ভাবিতে লাগিলাম। তাহারা আমাদের দেশের লোকের মতই পরিশ্রম করে, লজ্জা পায়, ভীত হয়, গান গায়, বাঁশি বাজায়। সবই করে, কিন্তু যৌবনের কলরবে তাহাদের সবই যেন সুন্দর দেখায়। সেই একই মানুষের মন, এখানেও যেমন, আমাদের দেশেও তেমনই, প্রভেদ কেবল প্রকাশের ভঙ্গীতে। আমরা লজ্জিত হই, ভয় পাই, কিন্তু স্পষ্টভাবে যেন সব কথা প্রকাশ করিতে পারি না। কোলেরা প্রকাশ করিতে ভয় পায় না। আনন্দ হইলে গান গায়, খেলার ইচ্ছে হইলে খেলে। আবার স্ত্রীর নাচগান করা পছন্দ না হইলে চেলা কাঠ লইয়া তাহাকে তাড়া করে, স্ত্রী ভয়ে পালাইয়া যায়। কিন্তু ঈর্ষার মধ্যে তাহার প্রতি স্বামীর অনুরাগের আভাস পাইয়া পুলকিত মনে হাসে, ইহাও দেখিয়াছি। এই স্বচ্ছ প্রকাশেই ইহাদের জীবনকে আমাদের অপেক্ষা লীলায়িত করিয়া তুলিয়াছে। তাহাদের জীবনের উপর দিয়া যেন স্বল্পতোয়া পার্বত্য নদী মুখর শব্দে বহিয়া চলিয়াছে, আর আমাদের জীবনের অন্তঃস্থল যেন সভ্যতার গভীর জলে ভারাক্রান্ত হইয়া আছে। তাহার না আছে গতি, না আছে স্বচ্ছতা। আবরণের ভারে আমরা নিষ্পেষিত হইয়া আছি, জীবনের অন্তরে যাহা ঘটিতেছে, তাহা ঋজু সরলভাবে ভাবিতে বা করিতে আমাদের হৃদয় সংকুচিত হইয়া যায়। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর জীবনের কথা ভাবিতে আর ভাল লাগিল না।’৪৬

বাংলা ভাষায় বিভিন্ন দেশ জাতি-সমাজ-সংস্কৃতির যে-কথা তিনি লিখেছেন সেগুলি যে নৃতাত্ত্বিক নয়, একথা কোনোভাবেই বলা যাবে না। তাঁর ভাষা ধার করেই বলি যে, তফাতটা হল এইসব রচনায় তিনি বিজ্ঞানের আবরণের ভারে নিষ্পেষিত নন, সমাজজীবনের অন্তরে যা ঘটছে তা ঋজু সরলভাবে ভাবতে বা লিখতে এখানে তার হৃদয় সংকুচিত হয়ে যায়নি।

আমার বক্তব্য হল, এটা সম্ভব হয়েছে তিনি বাংলা ভাষায় লিখেছিলেন বলেই। এখানে ভাষা সম্পর্কে ঐতিহ্য, ইতিহাস, প্রকরণ, রীতিনীতি এইসব কিছু নিয়েই ভাবতে হবে। এইসব রচনাই একভাবে আধুনিক নৃতত্ত্বকে অনুমান করে এবং প্রমাণ করে বিজ্ঞান ঐতিহাসিক ও ভাষাগত প্রক্রিয়ার ঊর্ধ্বে নয়।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

 ১. Nirmal Kumar Bose, My Days With Gandhi (Bombay : Orient Longman, 1947), পৃ. ৪৯–৫০।

 ২. ওই, পৃ. ৬৭।

 ৩. Surajit Chandra Sinha, Nirmal Kumar Bose : Scholar Wanderer (New Delhi : National Book Trust, 1986), পৃ. ৪৫।

 ৪. Nirmal Kumar Bose, ‘Spring Festival of India’, Man in India, vol. 7, no. 2–3, 1927, পৃ. ১১২–১৫৫।

 ৫. André Béteille, ‘Introduction’, The Structure of Hindu Society, tr. André Béteille (New Delhi : Orient Longman, 1975).

 ৬. Nirmal Kumar Bose, Cultural Anthropology and Other Essays (Calcutta : Indian Associated Publishing Company, [1929] 1953), পৃ. ১।

 ৭. ওই, পৃ. ১৩–২০।

 ৮. Nirmal Kumar Bose, Culture and Society in India (Calcutta : Asia Publishing House, 1967), পৃ. ৯।

 ৯. ওই, পৃ. এগারো।

 ১০. A L Kroeber, ‘The Superorganic’, American Anthropologist Vol. 19, No. 2, 1917, পৃ. ১৬২–২১৩।

 ১১. Cultural Anthropology and other Essays, পৃ. ৮–১২।

 ১২. ওই, পৃ. ১৬–১৭।

 ১৩. Culture and Society in India, পৃ. ১৭২।

 ১৪. Nirmal Kumar Bose, Canons of Orissan Architecture (Calcutta : R Chatterjee, 1932).

 ১৫. নির্মলকুমার বসু, কণারকের বিবরণ (কলিকাতা : পুরোগামী প্রকাশনী, ১৯৬০; প্রথম প্রকাশ ১৯২৬)।

 ১৬. Canons of Orissan Architecture, পৃ. ১।

 ১৭. ওই, পৃ. ৪।

 ১৮. ওই, পৃ. ১২–১৩।

 ১৯. কণারকের বিবরণ, পৃ. এক।

 ২০. Culture and Society in India, পৃ. ৮৫–১০৪।

 ২১. নির্মলকুমার বসু, ‘মন্দিরের কথা’, অলকা, ১(২), কার্ত্তিক ১৩৪৫, পৃ. ১৫৪।

 ২২. নির্মলকুমার বসু, ‘ভারতে নৃতত্ত্বচর্চার একটি অধ্যায়’, কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস (সম্পা.), রজত জয়ন্তী : ভারত সাম্রাজ্যের পঁচিশ বৎসর (১৯১১–১৯৩৫), (কলকাতা : বেঙ্গল জার্নালস লিমিটেড, ১৯৩৫), পৃ. ৬৫।

 ২৩. Nirmal Kumar Bose, Data on Caste : Orissa (Anthropological Survey of India, 1962), ‘ভূমিকা’।

 ২৪. ওই।

 ২৫. নির্মলকুমার বসু, হিন্দুসমাজের গড়ন (কলিকাতা : বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৩৫৬), পৃ. ১৪৯।

 ২৬. ওই, পৃ. ১৫১।

 ২৭. ওই, পৃ. ১৫৪।

 ২৮. Louis Dumont, Homo Hierarchicus (Delhi : Vikas, 1971)।

 ২৯. হিন্দুসমাজের গড়ন, পৃ. ১১৭।

 ৩০. ওই, পৃ. ১৫৫।

 ৩১. ওই, পৃ. ১৫।

 ৩২. ওই, পৃ. ১৬।

 ৩৩. এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : প্রদীপ বসু, সাময়িকী : পুরনো সাময়িক পত্রের প্রবন্ধ সংকলন, প্রথম খণ্ড : বিজ্ঞান ও সমাজ (কলকাতা : আনন্দ, ১৯৯৮)।

 ৩৪. সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পালামৌ, সত্যজিৎ চৌধুরী সম্পাদিত (কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০০৯), পৃ. ১০।

 ৩৫. ওই, পৃ. ১১।

 ৩৬. ওই, পৃ. ২৭–২৮।

 ৩৭. ওই, পৃ. ১০, ১২।

 ৩৮. Raymond Firth, We the Tikopia : A Sociological Study of Kinship in Primitive Polynesia (London : Allen and Unwin, [1936] 1957]; Bronislaw Malinowski, Argonauts of the Western Pacific (London : Routledge, 1922); E E Evans-Pritchard, The Nuer : A Description of the Modes of Livelihood and Political Institutions of a Nilotic People (Oxford : Clarendon Press, 1940) দ্রষ্টব্য।

 ৩৯. হিন্দুসমাজের গড়ন, পৃ. ৬।

 ৪০. ওই, পৃ. ২১।

 ৪১. ওই, পৃ. ৩৮।

 ৪২. ওই, পৃ. ৪০–৪১।

 ৪৩. নির্মলকুমার বসু, ‘ভূমিকা’, পরিব্রাজকের ডায়েরী (কলকাতা : বিদ্যোদয় লাইব্রেরী, ১৩৬৬; প্রথম প্রকাশ ১৯৪০) পৃ. আট।

 ৪৪. ওই, পৃ. সাত।

 ৪৫. নির্মলকুমার বসু, নবীন ও প্রাচীন (কলিকাতা : বেঙ্গল পাবলিশার্স, ১৩৫৬; প্রথম প্রকাশ ১৯৩০), পৃ. ৭৯।

 ৪৬. পরিব্রাজকের ডায়েরী, পৃ. ৪।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন