হিন্দুত্ব ও সমাজতত্ত্ব : ভূদেব মুখোপাধ্যায়

প্রদীপ বসু

হিন্দুত্ব ও সমাজতত্ত্ব : ভূদেব মুখোপাধ্যায়

১. অবতারণা

সমাজ কী? কে-ই বা সামাজিক? এক সময় সমাজ বলতে স্বজাতীয় লোকজন বোঝাত, অনেক সময় গ্রামের লোকসমূহ, যারা নিজেদের মধ্যে পরিচিত, সেই সমষ্টিকেই সমাজ আখ্যা দেওয়া হত। শরৎচন্দ্র তাঁর পল্লী-সমাজ উপন্যাসে এইরকম সমাজের কথাই বলেছেন। তিনি যখন লিখেছেন, ‘বেণী প্রভৃতির হাত-ধরা পল্লী-সমাজ সত্য চাহে নাই’, তখন তিনি যে-সমাজের কথা বলছেন সেখানে মানুষ পরস্পরের পরিচিত, সন্নিহিত, এই সমাজ মানুষের মুখোমুখি সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত। এখানে তাই সামাজিক বলতে সমাজের প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি, নিয়মকানুনের প্রতি কুশলতা বোঝায়। এই উপন্যাসে যখন জ্যাঠাইমা বলেন, ‘সমাজ যাকে শাস্তি দিয়ে আলাদা করে রেখেছে, তাকে জবরদস্তি ডেকে আনা যায় না। সমাজ যাই হোক, তাকে মান্য করতে হবে’, অথবা অন্য প্রসঙ্গে যখন বলেন, ‘আমাদের এই গোবিন্দ গাঙ্গুলী সেদিন তার বিধবা বড়ভাজকে নিজের হাতে মেরে আধমরা করে দিলে, কিন্তু সমাজ থেকে তার শাস্তি হওয়া চুলোয় যাক, সে নিজেই একটা সমাজের মাথা হয়ে বসে আছে।’ তখন আমরা এই মুখোমুখি সমাজ ও তার সামাজিকতার কথা বুঝি। পশ্চিমেও ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীতে ‘সোসাইটি’ কথাটি মানুষের অন্তরঙ্গ, ঘনিষ্ঠ সম্মিলনী-র অর্থেই ব্যবহৃত হত। আধুনিক বিমূর্ত অর্থে সমাজ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে, তখন থেকে সমাজ কথাটি এক বিশেষ ‘সামাজিক বিন্যাস’ বোঝাতে থাকে। এই পরিবর্তনের একটি মূল কারণ ছিল পশ্চিমে জাতি-রাষ্ট্রের উত্থান, যখন সমাজের একটি মাত্র প্রচলিত ধারণাই রাষ্ট্রের স্তরবিন্যাস ও আধিপত্যমূলক নিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠানগুলি সূচিত করতে থাকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর রাজনৈতিক আলোড়নের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন বুর্জোয়া রাজনৈতিক বিন্যাস সংগঠিত করতে গিয়েই সমাজ এক সর্বজনীন ও বিমূর্ত অর্থে গঠিত হয়। সমাজ-এর এই অর্থ নাগরিক সমাজ ও সামাজিক চুক্তির ধারণার সঙ্গে জড়িত, এবং এর থেকে উদ্ভূতও বটে।

এই যে বিমূর্ত সমাজের ধারণা, যে-সমাজে আমাদের অবস্থান নৈর্ব্যক্তিক, যে-সমাজের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ব্যক্তিগত সম্পর্কহীন, এর সঙ্গে মুখোমুখি সমাজের যে প্রসঙ্গ দিয়ে এই আলোচনা শুরু করেছি, তার একটা বড়ো তফাত আছে। আধুনিক সমাজের অর্থ আজকে যা হয়ে উঠেছে, তা হল এক ওজনদার একীভূত সমষ্টি, এবং ভূদেব পশ্চিমের সমাজ সম্পর্কে তাঁর নানাবিধ সমালোচনা সত্ত্বেও সমাজের এই ধারণাটাই মেনে নিয়েছেন। পশ্চিমে সমাজের ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে তার সামাজিক জীবনের পরিবর্তনের সঙ্গে। এই সমাজে শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক জীবন রাজনৈতিক জীবন থেকে ভিন্ন হয়ে যায়, রাজনৈতিক জীবনও চার্চ থেকে মুক্ত হয়ে ওঠে, গৃহ-পরিবারকে আবার এসবের থেকে আলাদা হিসেবে দেখা হতে থাকে। জীবনের এই বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলি আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এরকম ভাবা হতে থাকে যে, ‘সমাজ’ এই চতুর্বর্গ নিয়েই গঠিত, এই চারটি প্রতিষ্ঠান যেন স্বাভাবিকভাবেই সমাজের অঙ্গ। তাই সমাজতত্ত্বে সমাজকে বুঝতে গেলে তার অর্থনীতি, রাজনীতি, ধর্ম এবং আত্মীয়সম্পর্ককে বুঝতে হবে। যা পশ্চিমের ক্ষেত্রেই শুধু নরমাটিভ ছিল, তাই শেষ পর্যন্ত সমাজের সাধারণ সংজ্ঞায় পরিণত হল। সামাজিক প্রবন্ধে ভূদেব পশ্চিমের সমাজ যে উপাদানগুলি নিয়ে গঠিত হয়েছে, তার প্রভূত সমালোচনা করেছেন, কিন্তু মূল সমাজের ধারণাটিকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। বরং তাঁর মনে হয়েছে পশ্চিমের প্রসূত উপাদানগুলির পরিবর্তে ভারতের ঐতিহ্য থেকে আহরিত উপাদানগুলি যদি সমাজে প্রতিস্থাপন করা যায়, তাহলে সে সমাজ আমাদের উপযোগী হবে, সর্বাঙ্গসুন্দর হবে। ভূদেবের এই অবস্থান নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা পরবর্তী অংশে এসব নিয়ে আলোচনা করব, কিন্তু তার আগে ভূদেব ও তার প্রকাশিত বইগুলি সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন।

২. প্রেক্ষাপট

ভূদেবের পিতা বিশ্বনাথ তর্কভূষণ যখন কলকাতার ৩৭নং হরিতকীবাগান লেনে থাকতেন তখন ভূদেবের জন্ম হয়। প্রচলিত সংক্ষিপ্ত ভূদেব জীবনী ও ভূদেব চরিত অনুসারে তাঁর জন্ম তারিখ ৩ ফাল্গুন ১২৩১ (১৭৪৬ শক) (ইংরেজি ১২ ফেব্রুয়ারি ১৮২৫), কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন ভূদেবের কোষ্ঠী অনুযায়ী তাঁর জন্ম তারিখ হবে ১১ ফাল্গুন ১৭৪৮ শক (ইংরেজি ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮২৭)। প্রথমে কয়েকটি ভিন্ন স্কুলে পড়বার পর, তেরো বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজ জুনিয়র স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভরতি হন। এই শ্রেণিতে তিনি মধুসূদন দত্তকে সহপাঠীরূপে পেয়েছিলেন। মোট ছ-বছর পাঁচ মাস তিনি হিন্দু কলেজে পড়েছিলেন, ১৮৪৫ সালে তিনি কলেজ ত্যাগ করেন। চাকরি জীবনে প্রথমে তিনি হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন, পরে তিনি ১৮৪৭ সালে চন্দননগরে নিজেই ‘চন্দননগর সেমিনারি’ নামে একটি ইংরেজি স্কুল স্থাপন করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁকে আবার চাকরির অন্বেষণ করতে হয়, এবার তিনি কলকাতা মাদ্রাসায় ইংরেজির দ্বিতীয় শিক্ষকের পদে যোগদান করেন। এরপর তিনি সরকারি শিক্ষা-বিভাগের কাজেই নিযুক্ত ছিলেন, নিজের যোগ্যতাবলে স্কুল পরিদর্শকের সর্বোচ্চ পদ পেয়েছিলেন। ১৮৮৩ সালে চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যু হয় ১৫ মে ১৮৯৪ সালে। তিনি পনেরোটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৯৫), বাঙ্গালার ইতিহাস (১৯০৪), ক্ষেত্রতত্ত্ব (১৮৬২), পুষ্পাঞ্জলি (১৮৭৬) প্রভৃতি। এ ছাড়া শিক্ষা বিষয়ক দু-টি বাংলা সাময়িকপত্র, শিক্ষাদর্পণ ও সংবাদসার এবং Education Gazette ও সাপ্তাহিক বার্ত্তাবহ তিনি পরিচালনা করেছেন বহুবছর। Education Gazette-এই তাঁর পারিবারিক প্রবন্ধ, সামাজিক প্রবন্ধ, আচার প্রবন্ধ, স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস, বাঙ্গালার ইতিহাস, বিবিধ প্রবন্ধ গ্রন্থগুলিতে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধের অধিকাংশ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।

ভূদেবের যে গ্রন্থগুলি নিয়ে এই আলোচনা তাদের প্রকাশনার কালক্রমিক ইতিহাস এইরকম : পারিবারিক প্রবন্ধ, ১২৮৮ সালে (২০ সেপ্টেম্বর ১৮৮২); সামাজিক প্রবন্ধ, ১২৯৯ সালে (সেপ্টেম্বর ১৮৯২); আচার প্রবন্ধ, ১৩০১ সালে (২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫); এই পুস্তকের মুদ্রণ ভূদেবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে শেষ হয়; বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম ভাগ, ১৩০২ সালে (১ জুন ১৮৯৫); বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় ভাগ, ১৩১১ সালে (১৩ এপ্রিল ১৯০৫)। ভূদেব প্রথমে পারিবারিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, সেখান থেকেই তাঁর সামাজিক প্রবন্ধ লেখার সূত্রপাত। ভূদেব বলেছেন-‘আমি পারিবারিক প্রবন্ধ লিখিতে লিখিতে অনেকস্থলেই সামাজিক প্রভাবের উল্লেখ করিয়াছি, বিশেষত, ‘ধর্ম্মচচর্চা’ এবং ‘সন্তানের শিক্ষা’ এই দুইটি প্রবন্ধে যাহা যাহা লিখিয়াছি, তাহাতে সমাজকেই প্রধানতম উদ্দেশ্য করা হইয়াছে। ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ই আমাকে ‘সামাজিক প্রবন্ধ’গুলির বিরচনে প্রবৃত্ত করিতেছে।’ সামাজিক প্রবন্ধ প্রকাশ করার আগে ভূদেব বেশ কয়েকজনের মতামত নেন, এঁদের মধ্যে অক্ষয় সরকারও ছিলেন। তিনি ভূদেবকে পুস্তকখানি প্রকাশ করতে বিশেষ অনুরোধ করেন। পুস্তকটি প্রকাশিত হয় চুঁচুড়ার বুধোদয় যন্ত্রে। কাশীনাথ ভট্টাচার্য কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হবার পর ভূদেব এক বছর আট মাস জীবিত ছিলেন।

৩. সামাজিক প্রবন্ধ

সামাজিক প্রবন্ধ বইটির বিষয় ভূদেব নিজেই ‘গ্রন্থের আভাস’ অংশে বলেছেন। বইটি মূলত দু-টি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন স্বদেশি সমাজের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে জাতীয় ভাবের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার করা যায় কি না। তিনি বিচার করে দেখাতে চেষ্টা করেছেন যে, জাতীয় ভাব গ্রহণ করার পথ আমাদের কাছে রুদ্ধ নয়। এর সমর্থনের জন্য তিনি দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইউরোপে প্রচলিত কয়েকটি সমাজতাত্ত্বিক মতবাদের ভ্রান্তি প্রদর্শন করেছেন। এই প্রসঙ্গে তৃতীয় অধ্যায়ে ভারতে ইংরেজ আগমনের ফলাফল বিচার করেছেন এবং পঞ্চম অধ্যায়ে পরবর্তী ফল কী হতে পারে সেটা অনুমান করার চেষ্টা করেছেন। মাঝে, চতুর্থ অধ্যায়ে ভারতীয় এবং ইংরেজদের সম্বন্ধ ঠিক কীরকম এবং এই যোগাযোগের পরিণাম কী হতে পারে, সেটা বিচার করেছেন। পরিশেষে, দেশের উন্নতির জন্য, জাতীয় ভাবের সংরক্ষণের জন্য, দেশবাসীর কর্তব্য কী তাই আলোচনা করেছেন। তিনি পরিষ্কার বলেছেন যে, তিনি কোনো ‘সর্বদেশসাধারণ সমাজতত্ত্ব’-এর গ্রন্থ প্রণয়ন করছেন না, এই প্রকল্পগুলির মাধ্যমে কোনো আন্দোলনের সহযোগিতা করাও তাঁর উদ্দেশ্য নয়। মূল কারণ হল ইংরেজ এদেশে আসার ফলে এবং ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে অনেকেই আমাদের নিজের ধর্ম, সমাজ, পারিবারিক ব্যবস্থা, আচার-অনুষ্ঠান এইসব বিষয়েই অজ্ঞ হয়ে পড়েছেন। ভূদেবের এই গ্রন্থ রচনা করার উদ্দেশ্য হল যাতে দেশবাসী প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারে এবং সেই অনুযায়ী কর্তব্য নির্ণয় করতে পারে।

জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার একটি বৈশিষ্ট্য হল, তা দেশীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম সংরক্ষণের কথা বলে। এর প্রধান কারণ হল, বিদেশি শাসন, শিক্ষা, অর্থনীতির প্রভাবে এমন এক শঙ্কা উদ্ভূত হয় যে আমরা বোধহয় আমাদের যা-কিছু নিজস্ব, আমাদের স্বকীয়তা, বিশিষ্টতা, মৌলিকতা, এইসব কিছুই হারাতে চলেছি। কীভাবে এর পুনরুদ্ধার সম্ভব? কীভাবেই-বা একে বাঁচিয়ে রাখা যাবে? ভূদেব তাই এই গ্রন্থে নব্যশিক্ষিত হিন্দুদের জন্য আর্য হিন্দুত্বের মহত্ত্ব তুলে ধরার প্রচেষ্টা করেছেন। ভূদেবের জাতীয়তাবাদ ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ। তিনি লিখেছেন : ‘আমার সমস্ত কামনা ত্যাগ করিতে পারিয়াছি, কেবল আমার দেশের লোক সত্য সনাতন ধর্ম্মের মহত্ত্ব উপলব্ধি করিয়া যাহাতে ভাল লোক হয়, এ সাধ এখনও ছাড়িতে পারি নাই।’ তাই ইংরেজ-অধিকৃত ভারতে কীভাবে জাতীয় ভাবের উদবোধন, সংরক্ষণ ও প্রসার করা যায়, কীভাবে ইংরেজ অধিকারের মধ্যে থেকেও দেশবাসী জাতীয় আদর্শের অনুগামী হতে পারে, এই গ্রন্থে ভূদেব সেটাই আলোচনা করেছেন। ভূদেব এই হিন্দু-আদর্শকে এক যুক্তির কাঠামোর মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন, এ হিন্দুত্ব যেন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাবিধানে পরীক্ষিত; এরকমই এক হিন্দুত্বের আদর্শ পাঠকের কাছে প্রস্তুত করতে চেয়েছেন। তাঁর অন্য দু-টি গ্রন্থ, পারিবারিক প্রবন্ধ ও আচার প্রবন্ধ হিন্দুসমাজের জন্য রচিত, তফাত হল সামাজিক প্রবন্ধ-এ তিনি হিন্দুসমাজের বহির্মহলের কথা বলেছেন এবং অন্য দু-টি গ্রন্থে তিনি হিন্দুসমাজের অন্দরমহলের কথা বলেছেন, এখানে তিনি প্রাচীন শাস্ত্রের মর্ম বাঙালি হিন্দু গৃহস্থের যেভাবে বোঝা উচিত ও পালন করা উচিত সেটা ব্যাখ্যা করেছেন। বাঙালি কীভাবে তার গৃহ পরিচালনা করবে, হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী নিত্যনৈমিত্তিক আচার-অনুষ্ঠান করবে, এককথায় হিন্দু সমাজের অন্দরমহল কীভাবে সুরক্ষিত হবে, সেটা সুনিশ্চিত করাই ভূদেবের উদ্দেশ্য।

আগেই বলেছি, ভূদেব সামাজিক প্রবন্ধ আরম্ভ করেছেন জাতীয় ভাবের প্রসঙ্গ দিয়ে। এই জাতীয় ভাবের উপাদান কী? ভূদেব বলেছেন নানাবিধ সাদৃশ্যের উপলব্ধি এবং তার ফলস্বরূপ এক বিশেষ সহানুভূতি হল জাতীয় ভাব। জাতীয় ভাবের অর্থ হল জাতিগত এমন একটি ভাব, যা নিজের সমাজ, জাতির প্রতি মানুষকে সমাজবন্ধনে আবদ্ধ করে। এই জাতীয় ভাবের প্রসার ও বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে ইংরেজ শাসন এবং তাদের অধীনে সমস্ত ভারতবর্ষের রাজ্যশাসন সর্বতোভাবে এক হয়ে উঠেছে বলে। ইংরেজ দ্বারা প্রচলিত ডাক, রেলওয়ে, মুদ্রাযন্ত্র, সংবাদপত্র, টেলিগ্রাফ প্রভৃতি ভারতবাসীকে অনেক কাছে নিয়ে এসেছে, ‘এক্ষণে আমাদের সাধারণ সুখ, দুঃখ, আশা, ভরসা, আকাঙ্খা এবং নিরাশা, এক সূত্রে সম্বন্ধ হইয়া উঠিয়াছে,’ [সা : ১৩২]।১০ ভূদেব আরও মনে করেন যে, সামাজিক রীতিনীতি, আচারপ্রণালী এই সবই ভারতবর্ষের সর্বত্র সমপ্রকৃতির, ভারতবর্ষের যেখানেই যাওয়া যাক, সর্বত্রই বাড়িঘরের ধরন, খাওয়াদাওয়া, ক্রিয়াকলাপের রীতিপদ্ধতি মোটামুটি এক। ফলে জাতীয় ভাব গ্রহণের প্রকৃত অধিকারীর সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাবে। জাতীয় ভাব গ্রহণের পক্ষে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম যে কোনো বাধা হয়ে উঠতে পারে না, এটা ভূদেব বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন মুসলমান, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা জাতীয় ভাবের আদর্শেই পুষ্ট। জাতীয় ভাব সৃজনের এক প্রধান উপাদান হল ইতিহাস, অথচ বিদেশিরা বলেন ভারতের কোনো ইতিহাস নেই, ফলে জাতীয় ভাব সৃষ্টি হবে কী করে? ভূদেব এই মত খণ্ডন করেন এই বলে যে, ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলি ‘গ্রীক বা ইউরোপীয়দিগের ইতিহাসের অনুরূপে রচিত নয় বলিয়া ভারতবাসীর ইতিহাস নাই, একথাও অসঙ্গত। সুতরাং ঐতিহাসিক গ্রন্থ না থাকিলে যে জাতীয় ভাবের অসদ্ভাব বুঝায় সে কথা ভারতবর্ষের পক্ষে খাটে না’ [সা : ১৪১]। তাঁর মত হল প্রত্যেক জাতির ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন ভাবে লেখা হয়। একটি জাতির ইতিহাস তার জাতীয় প্রকৃতির দর্পণ। ভারতবর্ষেরও ইতিহাস আছে, পুরাণগুলি হল ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক কাব্য।

জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিকরা জাতি গঠনের ভিত্তি আলোচনা প্রসঙ্গে যে বন্ধনগুলির কথা বলেছেন, তা হল, ইতিহাস বা অতীতের স্মৃতি, সকলে যার অংশীদার, সামগ্রিকভাবে গভীর সাংস্কৃতিক যোগসূত্র, এবং এমন একটি বোধ যে জাতির সদস্য একটি নাগরিক সমাজের অংশ। জাতীয়তাবাদের আধুনিক ঐতিহাসিক বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন আরও যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন, তা হল, জাতি এক কল্পিত কমিউনিটি, ইম্যাজিনড কমিউনিটি, এই কমিউনিটির গঠন সম্ভব হয়েছে মুদ্রণ ধনতন্ত্রের (প্রিন্ট ক্যাপিটালিজম) প্রচারের ফলে। মুদ্রণশিল্প, সংবাদপত্র, উপন্যাস ও অন্যান্য বইপত্র প্রকাশের ফলে, এইগুলির মাধ্যমে যে মানুষরা নিজেদের মধ্যে সম্পূর্ণ অপরিচিত, তারাও কাছাকাছি আসার সুযোগ পেল, মুদ্রণ ধনতন্ত্র এইভাবে এক কমিউনিটি সৃষ্টি করল, যা বাস্তবে কাল্পনিক।১১ এইভাবে পুঁজিবাদ ও মুদ্রণশিল্প একযোগে এক কাল্পনিক কমিউনিটির সম্ভাবনা সৃষ্টি করে, যা আধুনিক জাতির ভিত্তি গড়ে দেয়। জাতীয়তাবাদের এই ধারণা উপনিবেশ শিক্ষিত মানুষ পায় ইউরোপ থেকেই, কারণ তাঁরা দ্বিভাষী ছিলেন এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতি, রাজনীতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। অন্যকথায় অ্যান্ডারসন বলছেন উপনিবেশবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ সম্ভব হয়েছিল ইউরোপীয় রাজনৈতিক ও ইনটেলেকচুয়াল ইতিহাসকে অবলম্বন করে। এই কারণেই এই জাতীয়তাবাদের ধারণাকে কেউ কেউ বলেছেন ‘ডিরাইভেটিভ ডিসকোর্স’, অর্থাৎ এই ডিসকোর্সের উৎস রয়ে গেছে উপনিবেশবাদীদের রাজনৈতিক-দার্শনিক তত্ত্বে, শিল্পে-সাহিত্যে। অ্যান্ডারসনের মডেলের সঙ্গে পুরোনো দিনে উপনিবেশে জাতীয়তাবাদের যে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাখ্যা পাওয়া যেত, তার মিল আছে। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা অনেকেই দাবি করতেন যে, ভারতবাসী স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ধারণাগুলি ইংরেজি বই থেকেই পেয়েছে। অন্যদিকে আমাদের দেশের আধুনিক জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিকরা অ্যান্ডারসনের এই মডেলকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন উপনিবেশবাদ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ এবং ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের মধ্যে এক জটিল আদান-প্রদানের ও পার্থক্য রচনার সম্পর্ক আছে।

এই প্রসঙ্গে পার্থ চট্টোপাধ্যায় যে প্রশ্নগুলি তুলেছেন তা খুবই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলছেন যে, পৃথিবীর বাকি অংশে জাতীয়তাবাদ যদি ইউরোপীয় মডেলকেই অনুসরণ করে, যদি তাদের ইম্যাজিনড কমিউনিটির কল্পনা ইউরোপ, আমেরিকাতেই সারা হয়ে গেছে, তাহলে উপনিবেশবাসীদের কল্পনা করবার বাকি রইল কী? ইতিহাস যেন আমাদের মতো উপনিবেশবাসীদের জন্য এই ডিক্রি জারি করে দিয়েছে যে, আমরা চিরজীবন আধুনিকতার গ্রহীতা হয়েই থাকব। ইউরোপ ও আমেরিকাই ইতিহাসের প্রকৃত সাবজেক্ট, এরাই আমাদের হয়ে ভাবনাচিন্তা করে উপনিবেশে আলোকপ্রাপ্তির ও শোষণেই স্ক্রিপ্টই শুধু রচনা করে রাখেনি, উপনিবেশবাদ-বিরোধী প্রতিরোধ ও উত্তর-উপনিবেশিক দুর্গতির নথিও প্রস্তুত করে রেখেছে। পার্থ বরং বলছেন উপনিবেশে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করতে গেলে একটি পার্থক্য মনে রাখতে হবে, জাতীয়তাবাদ একটি রাজনৈতিক আন্দোলন যা উপনিবেশের রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানায় এবং জাতীয়তাবাদ একটি সাংস্কৃতিক নির্মাণ যা উপনিবেশের মানুষকে তাদের পার্থক্য ও অটোনমি বুঝতে সক্ষম করে। প্রথম জাতীয়তাবাদটি অবশ্য ডিরাইভেটিভ, কিন্তু দ্বিতীয়টি তার শক্তি সঞ্চয় করে অন্যান্য সূত্র থেকে। তাই তিনি বলেন জাতীয়তাবাদের অফিশিয়াল ইতিহাস, যার শুরু ১৮৮৫ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম থেকে, অ্যান্ডারসনের থিসিসকেই অনুসরণ করে। কিন্তু এই ইতিহাস ভুলবশত বিশ্বাস করে যে, জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। পার্থ দাবি করেন যে, জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকে প্রতিরোধ জানাবার অনেক আগেই, উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ এক নিজস্ব সার্বভৌম এলাকা সৃষ্টি করে। এই সার্বভৌম পরিসর সৃষ্টি হয় এক মূল বিভাজনকে ভিত্তি করে : এই বিভাজনের একদিকে রয়েছে বস্তুজগৎ, এক বহির্জগৎ, যেখানে আছে অর্থনীতি, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, শিল্প ও প্রযুক্তিবিদ্যা, অন্যদিকে আছে এক আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির অন্তর্জগৎ, যেখানে রয়েছে ধর্ম, আচার, পরিবার।১২ ভূদেবের জাতীয়তাবাদ হল এই অন্তর্জগতের জাতীয়তাবাদ, ভূদেব তাই জাতির আধ্যাত্মিক মোকাম নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন, আচার, পরিবার নিয়ে বই লিখেছেন।

বস্তুগত দিক থেকে পশ্চিম যে আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত এটা মেনে নিয়েও এই জাতীয়তাবাদ বলে জাতীয় সংস্কৃতির মূল সত্তা হল তার আধ্যাত্মিক জগৎ, যাকে রক্ষা করতে হবে। উপনিবেশের মানুষ যতই বস্তুজগতে পশ্চিমি কলাকৌশল আয়ত্ত করবে, ততই আধ্যাত্মিক পরিসর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। জাতীয় এই সংস্কৃতি আমাদের নিজস্ব, যদি জাতি এক কাল্পনিক কমিউনিটি হয়, তাহলে, উপনিবেশের ক্ষেত্রে বিশেষ করে তা এই সংস্কৃতির পরিসরেই। এখানে জাতি সার্বভৌম, যদিও রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক ক্ষমতার দখলে। তাই উপনিবেশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদ শুধু পশ্চিমের মুক্তি, স্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা, প্রভৃতি ধ্যানধারণার অনুকরণ নয়, বরং নিজেদের পার্থক্যকে সংজ্ঞায়িত করার একটা প্রচেষ্টাও। তাই ভূদেব বলেছেন হিন্দুসমাজ ‘অন্তঃশাসনে শাসিত’ এবং শান্তিপ্রবণ, তাই এই সমাজে আছে দুঃখ সহনশীলতা। এইজন্যই হিন্দুরা বহু বছর পরাধীন, কিন্তু পরের অধীন হলেই সমাজ অপকৃষ্ট হয় না। হয় না এইজন্যই যে, সমাজের এই অন্তঃকরণ স্বাধীন, সার্বভৌম। ভূদেব বলছেন মানুষ সমাজ গঠন করেই উন্নতি করেছে, কিন্তু সকল সমাজ এরকম নয়। মানুষের মনের গঠনও তার সমাজের প্রকৃতি গ্রহণ করে, সমাজ ‘শাসনে পিতা, শিক্ষায় গুরু, দুঃখে সহদোর, সুখে মিত্র’ [সা : ১৪৫]। ভারতবর্ষের সামাজিক প্রকৃতি বিচারে ইউরোপীয়রা যখন বিজ্ঞানের প্রয়োগ করেন, তখন ভূদেব বলেন এই বিজ্ঞানে যুক্তি কম, কল্পনা বেশি। তাই এই বিজ্ঞানের এখনও শৈশবাবস্থা। সমাজবিজ্ঞানও একটি নতুন শাস্ত্র এবং ভ্রান্তিমূলক। এই সমাজতত্ত্ব নানারকম উপমাত্মক বিচার করে থাকে, যা তর্কের অতীত নয়। যেমন এই সমাজতত্ত্ব সমাজকে প্রাণীশরীরের সঙ্গে তুলনা করে থাকে, বলে প্রাণীর মতোই সমাজের জন্ম, জরা, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ভূদেব বরং মনে করেন, ‘সমাজকে দেবশরীর মনে করাই শ্রেয়’ [সা : ১৫৫], দেবশরীরের মতো সমাজের জরা, বার্ধক্য, মৃত্যু নেই। ভূদেবের এই উক্তিগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে দু-একটি মন্তব্য করা যেতে পারে। প্রথম হল, হিন্দুসমাজ সম্পর্কে ভূদেবের বক্তব্যও এক কল্পনাই; আগেই বলেছি জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রভাবে এ হল এক কাল্পনিক কমিউনিটি গড়ার প্রচেষ্টা। দ্বিতীয় হল, সমাজকে যখন প্রাণীশরীরের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তখন বলা হয় সমাজের প্রতিটি অংশ পরস্পর সম্পর্কিত, এক অংশ অন্য অংশকে প্রভাবিত করছে, এবং যত সময় যাবে ততই সমাজ আরও জটিল হয়ে উঠবে। এই সমাজকে এইভাবে বোঝার ঠিক বিপ্রতীপ তুলনা হল সমাজকে এক যন্ত্র হিসেবে বোঝা। সমাজ যখন প্রাণীশরীরের মতো তখন তা মানুষের হস্তক্ষেপের ঊর্ধ্বে, এই সমাজ এক স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক সংগঠন, যা মানুষের পরিকল্পনা-নিরপেক্ষ, যে সমাজের পরিবর্তনের এক নিজস্ব নিয়ম আছে। ভূদেব যখন সমাজকে দেবশরীরের সঙ্গে তুলনা করেন তখন সেই সমাজ হয়ে দাঁড়ায় অনন্ত, ধ্রুব, নিত্য, যে সমাজ অক্ষয়, চিরন্তন।

ভূদেবের সামাজিক প্রবন্ধ সম্পর্কিত এই আলোচনা এগোবার আগে ভূদেবের পদ্ধতি সম্বন্ধে কয়েকটি কথা আবশ্যক। এই গ্রন্থে ভূদেব যে-পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তাকে তুলনামূলক সমাজতত্ত্ব বলা হয়। বস্তুত, সব সমাজতাত্ত্বিক গবেষণায়, কোনো-না-কোনো স্তরে তুলনা প্রয়োজন হয়ে পড়ে, কিন্তু তুলনামূলক সমাজতত্ত্বে বিভিন্ন সমাজের প্রাতিষ্ঠানিক ও বৃহদায়তন সামাজিক উপাদানগুলির এক তুলনামূলক বিশ্লেষণ প্রস্তুত করে। এই ধরনের বিশ্লেষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিগত সমস্যা হল তুলনার এককগুলি, যেমন সম্পূর্ণ সমাজ, প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান, ধর্ম, গোষ্ঠী ইত্যাদি এবং তুলনার যে সূচকগুলি নির্বাচিত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে পার্থক্য, ভিন্নতা অথবা সাদৃশ্য, আনুরূপ্য চিহ্নিত ও বর্ণিত হচ্ছে, সেইগুলি কতটা যথার্থ এবং কতটা বৈধভাবেই বা তাদেরকে নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বাইরে ব্যবহার করা যায়। বিভিন্ন সমাজের মধ্যে তুলনার আর একটি সমস্যা হল, মূলত জোরটা দেওয়া হবে কীসের উপর; সাদৃশ্যের উপর না ভিন্নতার উপর, এই দ্বন্দ্ব থেকেই যায়। যে সমাজবিশ্লেষণ এক সাধারণ তত্ত্ব প্রমাণ করতে চায় সেই বিশ্লেষণ নিজের তত্ত্বের সমর্থনে সাদৃশ্যের উপর গুরুত্ব দেয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, যদি কোনো সমাজতত্ত্ব দেখাতে চায় সব শিল্পোন্নত সমাজের বৈশিষ্ট্য এক, তাহলে এই বর্ণনা ভিন্ন ভিন্ন সমাজের সাদৃশ্যের উপর গুরুত্ব দেবে। অন্যদিকে, তুলনামূলক পদ্ধতি তুলনামূলক বর্ণনায় পর্যবসিত হয় যখন দুই সমাজের পার্থক্যকে তুলে ধরা হয়, কিন্তু সেই পার্থক্যের কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। ব্যাখ্যা বলতে শুধু এইটুকু জানানো হয় যে, দু-টি সমাজের ইতিহাস আলাদা। সত্যি বলতে কী, তুলনামূলক বিশ্লেষণ কোনো এক বিশেষ পদ্ধতিও নয়, কোনো বিশেষ তত্ত্ব নয়, শুধুমাত্র একটি দৃষ্টিভঙ্গি। ভূদেব তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে ভারতবর্ষের যে-সমাজ বর্ণনা করেছেন, এ তাঁর কল্পনামাত্র। ভূদেব ও তাঁর সমসাময়িক অনেক বাঙালি কোঁৎ-বর্ণিত পজিটিভ সমাজতত্ত্বে বিশ্বাস করতেন, যে সমাজতত্ত্ব এক বৈজ্ঞানিকতার কথা বলে, দৃষ্টিগ্রাহ্য বস্তুর বর্ণনা ও ব্যাখ্যার কথা বলে। কিন্তু ভূদেব যে হিন্দুসমাজের কথা বলেছেন, সেই হিন্দুসমাজের নির্মাণ হয়েছে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার পরিকাঠামোর মধ্যে, কোনো প্রকৃত তুলনার মাধ্যমে নয়।

ভূদেব যখন ইংরেজদের পাশ্চাত্যভাবের কথা বলেছেন, তখন তিনি একই সঙ্গে একথা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন যে, এইসকল ভাবের অনুকরণ ভারতের অপকারই করবে। এখানেও তিনি হিন্দু ও ইংরেজদের গুণাবলির তুলনামূলক বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছেন; কিন্তু একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে তাঁর বর্ণিত তালিকার কোনো স্বাধীন ব্যাখ্যা নেই, এই তালিকা তিনি তাঁর নিজস্ব বক্তব্যকে শক্তিশালী করার জন্য প্রস্তুত করেছেন। ভূদেব লিখেছেন যে, ইংরেজরা ‘ইংরাজমাহাত্ম্য কীর্তনেই শতমুখ-উহারা ভারতবর্ষীয়দিগের সম্বন্ধে সর্ব্বদাই বলিতেছেন, ইংরাজ তাহাদিগকে কত কি শিখাইয়া মানুষ করিয়া তুলিতেছে, এবং ইংরাজ প্রবর্ত্তিত পাশ্চাত্য, মহান ভাবসকলের প্রভাবে ভারতবর্ষ উন্নত হইয়া উঠিতেছে। দেশীয় “কৃতবিদ্যেরাও” ঐ সকল কথা কন্ঠস্থ করিতেছেন, এবং আপনাদিগকেই পাশ্চাত্যভাবের অধিকারী জানিয়া সেই সকল ভাবের ভাবে একান্ত গদগদ হইতেছেন’ [সা : ১৬৭]। কী এই পাশ্চাত্যভাব? ভূদেব মোট সাতটি ‘পদার্থ’-এর নাম করেছেন : স্বার্থপরতা, উন্নতিশীলতা, সাম্য, ঐহিকতা, স্বাতন্ত্রিকতা, বৈজ্ঞানিকতা ও শাসনকর্তার সমাজপ্রতিভূত্ব। বলেছেন ভারতবাসীর এসব শেখার বা জানার প্রয়োজন নেই। হিন্দুদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন : ‘ইংরাজ কার্য্যতৎপর কার্য্যকুশল, অহঙ্কারী, এবং লোভী; হিন্দু শ্রমশীল, সুবোধ, নম্রস্বভাব এবং সন্তুষ্টচেতা’ [সা : ১৩২]। ভূদেব যেমন অভিযোগ করেছেন ইংরেজরা তাদের নিজেদের মাহাত্ম্যকীর্তনে শতমুখ, সেই একই অভিযোগ ভূদেবের বিরুদ্ধেও করা যায়। যাই হোক, ভূদেব বলেছেন হিন্দুকে শুধু কার্যকুশলতা শিখতে হবে, ইংরেজদের থেকে আর কিছু না শিখলেই ভালো। কিন্তু সমস্যা হল, ভারতবাসী ইংরেজদের দোষকেই বেশি অনুকরণ করেছেন।

তিনি বলেছেন ইংরেজদের স্বার্থপরতা অতি সংকীর্ণ বস্তু, এই স্বার্থপরতা পরের প্রতি সহানুভূতিহীন। অন্যদিকে হিন্দুর স্বার্থ এক সুবিস্তৃত বস্তু, হিন্দুর কোনো আত্মপর নেই, একান্ত স্বার্থপরতা ভারতবাসীর প্রকৃতিবিরুদ্ধ। উন্নতিশীলতা বলতে ভূদেব বিচার করেছেন ইভোলিউশনিজম বা বিবর্তনবাদ। ভূদেব একে বলেছেন পরিণামবাদ। ‘ইউরোপীয় বাহ্যবিজ্ঞান শাস্ত্রে আধুনিক প্রচলিত মত পরিণামবাদ বলেন যে, কী সজীব, কি নির্জীব সকল প্রকার পদার্থই আপনাপন পরিবৃত্তির প্রভাবে নিরন্তর কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হইয়া রূপান্তর ও গুণান্তর প্রাপ্ত হইতেছে’ [সা : ১৭০]। ভূদেবের মতে, এই তত্ত্ব ভ্রান্ত, নব্য ইউরোপ কোনো দিক থেকেই উন্নতিলাভ করেনি। তিনি এই প্রসঙ্গে সমাজতত্ত্ব ও তার বিষয়ভূত ডিভিশন অফ লেবার বা শ্রমবিভাজনের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, ভূদেব একে বলেছেন বার্ত্তাশাস্ত্র। ‘এক্ষণে সমাজতত্ত্ব অথবা ইউরোপীয় মতে সমাজতত্ত্বের অস্থিকল্প বার্ত্তাশাস্ত্র, কি বলেন দেখা যাউক। ইউরোপীয় বার্ত্তাশাস্ত্র বলেন, সমাজবন্ধন যত দৃঢ় হয়, সমাজ মধ্যে শ্রমবিভাগের নিয়ম ততই বিস্তৃত হইয়া ওঠে। শ্রমবিভাগের গুণে ভোগ্যদ্রব্যের পরিমাণ বাড়িয়া উঠে, এবং সেইজন্য সমাজের কতক লোক দৈহিক পরিশ্রমের দায় হইতে অব্যাহতি পাইয়া জ্ঞানচর্চায় নিযুক্ত হইতে পারে’ [সা : ১৭২]। তিনি বলেছেন এই শ্রমবিভাগের ফল হয়েছে অত্যন্ত বিষময়, এর ফলে কিছু লোক একেবারে অবকাশশূন্য হয়ে পড়েছে, পরিণত হয়েছে মনুষ্যত্বহীন যন্ত্রে। এর ফলে কিছু লোক অপরিসীম ধনী এবং অধিকাংশ মানুষ সর্বতোভাবে নিরন্ন হয়ে পড়েছে। এই শ্রমবিভাগ বিষম ও তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। ফলে সমাজে উপপ্লব আসন্ন হয়েছে। যাতে সমাজের বৃদ্ধি, তার ফলেই সমাজের বিনাশের সূত্রপাত ঘটেছে। পুঁজিবাদের অনুপ্রবেশের ফলে পশ্চিমের সমাজের পরিবর্তনের যে মূল্যায়ন ভূদেব করেছেন তা খুব একটা ভুল নয়, কিন্তু যে বিকল্পের কথা বলেছেন তা-ও যে গ্রহণযোগ্য এমন মনে হয় না।

ভূদেব বলেছেন ক্রমোন্নতির নিয়ম আবিষ্কার করতে হবে মনস্তত্ত্বের নিয়ম মেনে। চিত্তাদর্শের মান অনুযায়ী জাতির শ্রেণিবিভাগ করতে হবে। শুধুমাত্র বৈষয়িক উন্নতির উপর ভিত্তি করে সভ্যতার তারতম্য বিচার করা অনুচিত। যে-জাতির চিত্তাদর্শ আংশিক, তাদের সভ্যাবস্থাও হীন, যাদের চিত্তাদর্শ সুসংস্কৃত, তাদের সভ্যাবস্থাও উন্নত। যারা তাদের চিত্তাদর্শ অন্যের সংসর্গে উন্নতিলাভ করে, তার সভ্যাবস্থা উন্নতিশীল। চিত্তাদর্শ বলতে ভূদেব বুঝিয়েছেন চিত্তক্ষেত্রে একটি আদর্শের প্রতিষ্ঠান, যেমন সংস্কৃত চর্চার ফলে রাম-সীতার যে-আদর্শ চিত্তে অঙ্কিত হয়ে যায়, সেইসব মানুষ ‘ইংরাজী শিখিয়া ইংরাজকে আপনাদিগের আদর্শস্থলাভিষিত্ত করিতে পারে না। কারণ, তাহাদিগের চিত্তাদর্শ ইংরাজ প্রদর্শিত সকল আদর্শ অপেক্ষা সহস্রগুণে উৎকৃষ্টতর’ [সা : ১৭৩]। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে তার চিত্তাদর্শ সুসংস্কৃত, এর প্রতি মানুষের অনুরাগও আছে কিন্তু সাধনচেষ্টা কম, তাই ভারতের সভ্যাবস্থা স্থগিতগতি। ইংরেজদের চিত্তাদর্শের প্রতি কোনো অনুরাগ নেই, তাই তাদের সভ্যাবস্থা পতনশীল। উন্নতিশীলতার প্রকৃত পথ যে চিত্তাদর্শের উন্নতিসাধন, সেই উন্নতি তাই ইংরেজ সংস্রবে সম্ভব নয়। তাই ভূদেব বলেছেন সমাজের প্রকৃত উন্নতি কলাকৌশলের সৃষ্টিতে হয় না, সস্তায় উপভোগ্য জিনিসপত্র তৈরি করলেও হয় না, ধনের বৃদ্ধিতেও হয় না, আর নিজের মুখে আত্মগরিমা প্রচার করলেও হয় না। প্রয়োজন উচ্চ চিত্তাদর্শের প্রতি প্রীতি, ভক্তি এবং সত্যিকারের সাধনচেষ্টা। এইভাবে ভূদেব দেখিয়ে দেন ইংরেজরা আসলে পতনশীল, ভারতবাসী তাদের চেয়ে অনেক বেশি সভ্য। সত্যিকারের উন্নত, সভ্য হওয়ার জন্য তো ঐহিক উন্নতির প্রয়োজন নেই, চিত্তাদর্শ উন্নত থাকলেই হল। এ হল সামাজিক উন্নতির এক ব্রাহ্মণ্য মডেল। চিত্ত শুদ্ধ, পবিত্র, নির্মল, উচ্চ আদর্শে বাঁধা থাকবে, প্রাচীন আদর্শে ভক্তি অচল থাকবে, ‘যদি কোন নূতন ভাব আইসে, তাহা ঐ প্রাচীনের সহিত মিলাইয়া দেখিলে ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি হয়, তবেই উহাকে গ্রহণ করিতে হয়। নচেৎ উহাকে গ্রহণ করিতে হয় না’ [সা : ১৭৩]। তাহলেই সেই জাতি সভ্য, উন্নতিশীল।

ভূদেব সাম্যবাদকে অগ্রাহ্য করেছেন, ভারতের জাতিভেদ প্রথাকে সমর্থন করেছেন। বলেছেন ইউরোপীয় সাম্যবাদ মৌখিক, মিথ্যা, ভারতে এর পর্যাপ্ত স্থান নেই। সাম্যের ধারণার মধ্যে যেমন সমান অধিকারের প্রসঙ্গ আছে, তেমনি সমান সুযোগের কথাও আছে। আইনের দৃষ্টিতে সাম্যের আদর্শ সকলে সমান একথা যেমন বলে, সকলের সমান রাজনৈতিক অধিকার, সকলের জন্য সমান সুযোগ, সামাজিক ক্ষেত্রে মানুষের সমত্বের কথাও সাম্যের ধারণার অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত, আমাদের দেশে উপনিবেশ-বিরোধী ধ্যানধারণা ও আন্দোলন যে অনেকটাই সাম্যের আদর্শে প্রভাবিত এ সত্য কে অস্বীকার করবে? কোনো দেশ বা সমাজব্যবস্থা এক সর্বব্যাপী সাম্যব্যস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছে এমনটা কখনোই সম্ভব নয়, কোনোদিন হবেও না। সাম্য এমন এক আদর্শ যা মানুষের মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করতে সাহায্য করে, প্রথাগত ভেদ-বিলোপের প্রতি মানুষকে সচেতন করে সামাজিক ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে। ভূদেব বলেছেন জগতের কোথাও সাম্য নেই। তিনি স্বীকার করেছেন যে, সাম্যবাদের প্রভাবে, অন্যের প্রতি পীড়ন কমেছে, সাধারণের উন্নতিসাধন অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে গণ্য হয়েছে, সকলের মধ্যে উন্নতির আশা প্রদীপ্ত হয়েছে এবং সমাজের চেষ্টাশক্তি জাগরিত হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে সকলের মনে নিজের উন্নতির আশা প্রজ্জ্বলিত করে মানুষকে ঈর্ষা, বিদ্বেষ, দুরাকাঙ্খার আগুনে দগ্ধ করছে। সমাজে দয়াবৃদ্ধি সন্তুষ্টির বিলোপ ঘটায় সাম্যবাদ। তাই ভূদেব বলেছেন-‘ভারতবর্ষে যে সামাজিক বর্ণভেদের ব্যবস্থা আছে, তাহার প্রকৃতি পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলেই বুঝা যায় যে, উহা অতি উদার উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই প্রবর্ত্তিত হইয়াছে’ [সা : ১৭৮]। জাতিভেদ ব্যবস্থা প্রচলিত থাকলে ধনের গৌরব বৃদ্ধি হতে পারে না, কারণ জাতি ধনের আয়ত্ত নয়। ধনের প্রতি লোভ কিছু কম থাকলে সমাজ ভালো থাকে, লোকের প্রকৃত সুখ অধিক হয়। ভূদেব বলেছেন, জাতি-ব্যবস্থায় ‘একমাত্র ব্রাহ্মণের ব্যবসায় ভিন্ন অপর সকল ব্যবসায়ই সকলে অবলম্বন করিতে পারে, এবং তাহাই চিরকাল করিয়া আসিতেছে’ [সা : ১৭৮]। তাই জাতিভেদ থাকায় লোকে আপন ইচ্ছা অনুযায়ী বৃত্তি অবলম্বন করতে পারে না এইরকম উক্তি ভূদেবের মতে সত্য নয়। বস্তুত, জাতিভেদ সম্পর্কে ভূদেবের এই উক্তি যে কতটা ভুল, আজগুবি ও ভিত্তিহীন সে-কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভূদেব সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে অনেকে বলেছেন, তিনি ‘সনাতন হিন্দুধর্মের অতি উদার সঙ্কোচমুক্ত’ হিন্দুদের প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁর ‘হিন্দুত্ব বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাবিধানে পরীক্ষিত, ঐতিহাসিক অনুসন্ধান বিশ্লেষিত, প্রখর যুক্তির আলোকে বিচারিত’,১৩ ইত্যাদি। আসলে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল, ব্রাহ্মণ্যবাদী, আর্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক, আর্যধর্মের গৌরব ঘোষণা ও তার আদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই ছিল তাঁর সব চিন্তার মূল।

পাশ্চাত্যসমাজ যে ঐহিকতাকে তাদের সর্বস্ব বলে মনে করে, ভূদেব বলেছেন এ হল তাদের পাশব ভাব, প্রবৃত্তিপরায়ণতার পোষক। আর্যশাস্ত্র শিক্ষা দিয়েছে প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সামঞ্জস্য বিধানে। পাশ্চাত্যসমাজ ভাবে সুখই সব, বর্তমানই হল সুখপ্রাপ্তির কাল, এবং এই পৃথিবী হল সুখপ্রাপ্তির স্থান। ইংরেজি শিক্ষার ফলে আমাদের দেশে এই ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু এইভাবে চিত্তশুদ্ধি হয় না, দিব্যভাবও মনে জাগে না। চরম ভোগ বা চরম বৈরাগ্য, কোনোটাই প্রকৃত পথ নয়। দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধনই হল আর্যধর্মের শিক্ষা। অন্য যে পাশ্চাত্যভাবের কথা ভূদেব উল্লেখ করেছেন, সেটা হল স্বাতন্ত্রিকতা বা ইনডিভিজুয়ালিজম। আজকের দিনে আমরা এর যে বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করি তা হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। ভূদেব বলেছেন হয় সমাজে সামাজিকতার প্রাধান্য থাকে নয় স্বাতন্ত্রিকতার। তিনি লিখেছেন : ‘যে শক্তির প্রভাবে সমাজান্তর্গত পরিবারসমূহ সহানুভূতিসম্পন্ন এবং কিয়ৎপরিমাণে একপ্রকৃতিক এবং একাকার হইয়া যায় তাহার নাম সামাজিকতা। আর যে শক্তির প্রভাবে প্রত্যেক পরিবার আপনাপন সুখদুঃখ, হিতাহিত, কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য বিচারপূর্ব্বক পৃথগভূত থাকে, এবং যাহার প্রাবল্যে কখনও কখনও সমাজবিধির পরিবর্ত্ত ঘটিয়া যায়, তাহার নাম স্বাতন্ত্রিকতা’ [সা : ১৮১]। ভারতে সামাজিকতার অত্যাধিক্য এবং স্বাতন্ত্রিকতার অতি ন্যূনতম কথা যে ইংরেজরা বলেন, ভূদেবের মতে তা যথার্থ বলেই স্বীকার করতে হবে। কিন্তু সমাজে স্বাতন্ত্রিকতার একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। সব সময় সমাজকে মান্য করে চললে একটা অন্ধ সামাজিকতা জন্ম নেয়। ভূদেব বলেছেন এই কারণে দেশীয় রাজারা প্রয়োজনবোধে সংহিতার বদল ঘটাতেন। কিন্তু ‘এখন এদেশের বিধিব্যবস্থা ইংরেজ-রাজেরই ইচ্ছানুযায়ী হইয়া থাকে। তাহাতে দেশীয় জনগণের মধ্যে প্রকৃত স্বাতন্ত্রিকতা জন্মিতে পারে না’ [সা : ১৮৩]। এখানে ভূদেব একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলছেন উপনিবেশে যেখানে সমস্ত ক্ষমতার রাশ ইংরেজের হাতে, সেখানে দেশীয় মানুষের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি হবে কেমন করে? তিনি বলেছেন এদেশে ইংরেজদের অধিকার বিস্তৃত হওয়ায় প্রকৃত স্বাতন্ত্রিকতার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। তবুও যাঁরা বলেন ইংরেজ আসার ফলে দেশে স্বাতন্ত্রিকতার বৃদ্ধি হয়েছে, তাঁরা স্বাতন্ত্রিকতা বলতে বোঝেন নিজের সমাজের বিধিব্যবস্থার প্রতি অবজ্ঞা। এ ধরনের স্বাতন্ত্রিকতা সমাজের পক্ষে হিতকর নয়। স্বাতন্ত্রিকতার এই যে পথ খুলেছে, এ আসলে অতি মারাত্মক উচ্ছৃঙ্খলতার পথ।

এখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। ভূদেব যেমন সাম্যের প্রকৃত তাৎপর্য বোঝেননি, সেইরকমই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নানাদিক তাঁর অধরা থেকে গেছে। এটা ঠিক যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আসলে ব্যক্তির এক বিশেষ ধারণা, যে ধারণা জন্ম নেয় পশ্চিমে। এই আদর্শ ব্যক্তির মর্যাদা, তার নৈতিক ও বৌদ্ধিক স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য প্রদান করে, তার যুক্তিবোধ, আত্মজ্ঞান, আত্মিকতা, ব্যক্তিগত জীবনযাপনের অধিকার, আত্ম-সার্বভৌমতা, আত্মবিকাশের ক্ষমতাকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়। এই ধারণা মনে করে ব্যক্তি তার নিজ ইচ্ছায় সমাজ, বাজার, রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করবে, যেমন হবস বলেছেন রাষ্ট্র স্বেচ্ছাচারী হবে না, রাষ্ট্র থাকবে ব্যক্তির প্রাকৃতিক অধিকার দ্বারা সীমাবদ্ধ। স্পিনোজাও রাষ্ট্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের কথা বলেছেন, তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতাকে অপরিহার্য মৌলিক মূল্যবোধ হিসেবে দেখেছেন। বস্তুত ব্যক্তির এই ধারণা, মধ্যযুগীয় কিছু বিশেষ মানুষের বিশেষ অধিকার বা প্রিভিলেজকে নির্বাসিত করেই সৃষ্টি হয়, প্রিভিলেজের জায়গায় স্থান করে নেয় আধুনিক ব্যক্তির অধিকারের ধারণা। ভূদেব কিন্তু তাঁর সমাজতত্ত্বে সেই বিশেষ অধিকারকেই আঁকড়ে থাকলেন। ‘ভারতবর্ষীয় সমাজে স্বাতন্ত্রিকতা অতি বিস্তৃতরূপ হইয়া সমাজের পূর্ণ সজীবতার ব্যাঘাত জন্মাইতেছে। এমন অবস্থায় ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রিকতার বৃদ্ধি কখনই অপকারক বই উপকারক হইতে পারে না। এখন সমাজান্তর্গত জনগণের মধ্যে বশ্যতা, পরস্পর সহানুভূতির আধিক্য এবং সম্মিলনই একান্ত প্রয়োজনীয়, এবং ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রিকতা অবশ্যপরিহার্য’ [সা : ১৮৪]। অথচ আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূলে রয়েছে ব্যক্তির অধিকার ও তার স্বাধীন সত্তার স্বীকৃতি, আইনের অনুশাসন মেনে সকলের মধ্যে সাম্য। ব্যক্তির অধিকারের সীমানাই নির্দিষ্ট করে দেয় এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার সীমানা।ভূদেব যখন বলেন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিকশিত হতে পারে না, তখন তিনি ঠিকই বলেন। কিন্তু যখন তিনি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দেন এই বলে যে, এতে আমাদের লাভ হবে না, তখন তিনি সামাজিক রক্ষণশীলতার কাছেই নতিস্বীকার করেন।

ভূদেব বলেছেন, এদেশে বৈজ্ঞানিকতার প্রকৃত প্রভাব সঞ্চারিত হয়নি। তাঁর মতে কোনো দেশে বৈজ্ঞানিকতার প্রকৃত আবির্ভাব বুঝতে হলে সেই দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বুদ্ধি ও চিত্তবৃত্তি পরীক্ষা করে তা বুঝতে হয়। তিনি বলেন বৈজ্ঞানিকতা হল এমন এক মনের ভাব যেখানে প্রত্যক্ষ প্রমাণ, পরীক্ষা ও সিদ্ধান্ত হল মূল বিষয়। এরকম মনের ভাব আমাদের নেই, তাই আমাদের বাহ্য বিজ্ঞানশাস্ত্রের উন্নতি হয়নি। আগেই বলেছি ভূদেব ও তাঁর সমসাময়িক অনেকেই পজিটিভ বিজ্ঞানের গুণগ্রাহী ছিলেন, যদিও তাঁদের নিজস্ব চিন্তাভাবনায় বা লেখাপত্রে তদানীন্তন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বা আদর্শের সুসম্বদ্ধ প্রয়োগ করেছেন এমন নয়। তাই ভূদেব এখানে অন্যান্য পশ্চিমিভাবের মতো বৈজ্ঞানিকতাকে সম্পূর্ণ বাতিল করেননি। তিনি বলেছেন ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানচর্চা সম্পূর্ণ হয় না। এর ফলে অনেকটা আন্দাজি শিক্ষা হয় এবং এটাই বিজ্ঞানশিক্ষার প্রধান অন্তরায়। পরিণাম এই হয় যে, অধীত বিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলি কন্ঠস্থ হয়, কিন্তু বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টি জন্মায় না। এ ছাড়া, আমাদের দেশে বিজ্ঞানকে প্রয়োগ করা যায় এমন শিল্প বা কলকারখানা নেই, ফলে বৈজ্ঞানিক তথ্য বা সূত্রের প্রয়োগ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান হয় না। বইয়ে পড়া কথাগুলি যথাসাধ্য অনুভব করে বিজ্ঞানকে বুঝতে হয়, কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তা যখন সম্ভব হয় না তখন ইংরেজি বইয়ের কথাই আপ্তবাক্য বলে মেনে নিতে হয়। ‘সুতরাং বুদ্ধি এবং চিত্তবৃত্তির প্রতি বিজ্ঞানানুশীলনের যে বিশেষ প্রভাব আছে তা অতি অল্পমাত্রায় দেখিতে পাওয়া যায়’ [সা : ১৯০]। এইরকম শিক্ষায় বৈজ্ঞানিকতা জন্মাবে? ভূদেব বলেছেন বৈজ্ঞানিকতা বলতে বুঝতে হবে এমন মনের ভাব যেখানে প্রত্যক্ষই সকল প্রমাণের মূল এটা যেমন স্বীকৃত, তেমনি প্রমাণ গ্রহণের জন্য পরীক্ষাবিধানের আবশ্যকতাও স্বীকৃত। আমাদের এইরকম মনের ভাবের জন্ম হয়নি। দেশের কৃষি এবং শিল্পের প্রকৃত অবস্থা বিবেচনা করলেও বোঝা যায় কেন এদেশে বৈজ্ঞানিকতার প্রবেশ ঘটেনি। কৃষিকাজে বৈজ্ঞানিকতার কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না। আর এদেশে বৈজ্ঞানিকতার সত্যি প্রবেশ ঘটলে কলকারখানার সংখ্যা এত কম হত না এবং তাদের মধ্যে দেশীয়দের সংখ্যা এত নগণ্য হত না। সত্যি কথা বলতে কী আমাদের বিজ্ঞানবিদ্যা বইয়েই আছে, এই বিজ্ঞান আমাদের বুদ্ধির বা চিত্তের সংস্কার করতে পারেনি।

ভূদেবের আলোচনার শেষ পাশ্চাত্য ভাবটি হল, রাজার সমাজ-প্রতিভূত্ব। তিনি বলেছেন ইউরোপে শাসনব্যবস্থা ‘সামাজিক চুক্তি’-নির্ভর, সেখানে নানা বিবাদ-বিসংবাদ, রাষ্ট্রবিপ্লরেব পর এই চুক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর মতে ইউরোপীয়দের চুক্তির প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ হয়তো এইজন্য যে, তারা বণিক, অথবা স্বভাবে স্বৈরতান্ত্রিক। কিন্তু ভারতবর্ষে এরকম কোনো চুক্তির প্রয়োজন নেই, রাজশাসনের উপর আছে ধর্মশাসন, রাজা ধর্ম অনুযায়ী বিধিপালন করবেন। তাই পশ্চিমে চুক্তির মূলে রাজা সমাজের প্রতিভূ, আর আমাদের দেশে বিধিপালনের মান্যতার উপর রাজার প্রতিভূত্ব দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজশাসন এই দেশীয় ধর্মশাসন-নিরপেক্ষ হওয়ায়, ভারতের পুরোনো শাসনব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়েছে। যদিও ভূদেবের মতে চুক্তিরক্ষা এবং বিধিপালনের মধ্যে নিঃসন্দেহে বিধিপালনের ভিত্তি অনেক বেশি দৃঢ় ও প্রশস্ত, কারণ ‘চুক্তিরক্ষাও বিধি-প্রতিপালনের উপর প্রতিষ্ঠিত’। এই প্রসঙ্গে ভূদেব সমাজতাত্ত্বিক কোঁৎকে উল্লেখ করে বলেছেন যে, তিনিও বলেছেন সমাজ মধ্যে ধর্মশাসনের প্রাধান্য সংস্থাপিত হওয়া বিধেয়। সামাজিক চুক্তির সমালোচনা করতে গিয়ে ভূদেব ভুলে গেছেন যে, জ্যঁ জাক রুশো জোর দিয়ে বলেছিলেন সার্বভৌমত্ব জনসাধারণেরই অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং কোনো সরকার এই অধিকারের অংশ দাবি করতে পারে না। রুশো বলেন সার্বভৌমত্ব বস্তুত জনসাধারণের ইচ্ছার পরিচালনা ছাড়া আর কিছু নয় এবং সেইজন্যই এর হস্তান্তর করা চলে না। সেই সময়ের রাজনৈতিক চিন্তার প্রধান দু-টি বিষয় ছিল উইল বা ইচ্ছা এবং ক্ষমতা। রুশোর মত ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তর করা চলে কিন্তু ইচ্ছা নয়। যে-কারণে সার্বভৌমত্বের হস্তান্তর হয় না, কারণ এই ইচ্ছা জনসাধারণের ইচ্ছা। রুশোর এই বৈপ্লবিক তত্ত্ব-জনসাধারণই সার্বভৌম-যাকে ইংরেজিতে পপুলার সভরিনটি-র তত্ত্ব বলা হয়, উনিশ ও বিশ শতকের রাজনৈতিক বৈধতার একমাত্র স্বীকৃত ভিত্তি হয়ে ওঠে। সেইজন্যই বিশেষ করে গণতন্ত্র আজকের রাজনীতির এক সর্বজনীন আদর্শ হয়ে উঠেছে। ভূদেবের দর্শনক্ষেত্রে অবশ্য এই বিষয়গুলি আসবার কথা নয়, তিনি ধর্মের শাসন নিয়ে এতটাই আগ্রহী। ভারতবর্ষে ধর্মশাসনের নেতা ব্রাহ্মণ, এই ব্রাহ্মণ গৃহস্থ, কোনো দলপতির অধীন নন, রাজার ‘ভৃতিভূক’ নন, ব্রাহ্মণ সত্ত্বগুণপ্রধান, তাই ধর্মাধিকরণের নিযুক্ত। এই যদি ভারতবর্ষের আদর্শ রাজ্যশাসনের নমুনা হয়, তাহলে তার ভয়াবহ পরিণামও বিচার করা আবশ্যক। ভূদেব উপসংহারে বলেছেন ইংরেজ অধিকারের ফল কীরকম হয়েছে এবং তার কী সম্ভবনা সেটা ভালোভাবে বিচার করতে হবে। ওই একই কথা তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারা সম্পর্কেও প্রযোজ্য। বলেছেন পাশ্চাত্য ভাবের কতগুলি ভুয়ো এবং মেকি, আর অপর কতগুলি ভাঙা ও ‘বে-কেজো’ হয়ে এদেশে এসেছে। কিন্তু তবু ওদের চলন বাড়ছে। স্বার্থপরতা, স্বাতন্ত্রিকতা, ঐহিকতা গুণে কারও ভালো হয়নি। তাই ভারতবর্ষে এইসকল ভাবের প্রবেশ রুদ্ধ হওয়া আবশ্যক।

ভূদেব মনে করতেন ভারতবর্ষে ইংরেজ অধিকারের অনেক ইতিবাচক দিক আছে। সামাজিক প্রবন্ধ গ্রন্থে ‘ইংরাজাধিকার’ অধ্যায়ে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এখানেও তিনি ইংরেজদের তিনটি ভাবের কথা বলেছেন; বণিকভাব, রাজভাব ও বৈদেশিকভাব। তাঁর মতে, ইংরেজ ভারতবর্ষে বণিকমূর্তিতে এসেছে, রাজারূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং বৈদেশিক নীতি অবলম্বনে স্থিতি লাভ করেছে। ভারতবর্ষ যে ইংরেজ দ্বারা পরাজিত হয়েছিল, ইংরেজ যে দুর্বল ভারতকে অধিকার করেছিল এটা ভূদেবের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি বলেছেন ইংরেজ ভারতবর্ষ অধিকার করেনি, ভারত যেন স্বেচ্ছায় ইংরেজকে সিংহাসন প্রদান করেছে। কারণ, ভারত যে লক্ষ্যের দিকে এগোতে চাইছে, ইংরেজ অধিকার তার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক। তাই ভারত নিজের মঙ্গলের জন্য বিদেশিদের হাতে নিজের দায়িত্বভার অর্পণ করেছে। ইংরেজ অধিকারের ফলে দেশে শান্তি এসেছে, বিজাতীয় আক্রমণ বন্ধ হয়েছে, যাতায়াতের সুবিধাবৃদ্ধির ফলে আন্তর্বাণিজ্যের উন্নতি হয়েছে। ‘ইংরাজ ভারতবাসীর আচারের প্রতিও যেমন ব্যাঘাত করেন নাই, তেমনি এখানকার ব্যবহার শাস্ত্রেরও গৌরব রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন’ [সা : ২০৪]। ইংরেজ হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম অনুমোদিত আলাদা ব্যবহার শাস্ত্র প্রচলনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ইংরেজ যেসব কাজকর্ম করছে তার কতকগুলির মাধ্যমে ভারতের অভীষ্ট সিদ্ধ হচ্ছে। ‘অতএব মুক্তকন্ঠে বলা যায় যে, ইংরাজ ভারতকে তাহার গন্তব্য পথে লইয়া আসিয়াছেন . . . এইজন্য ইংরাজ ভারতবাসীর কৃতজ্ঞতার, শ্রদ্ধার এবং ভক্তির ভাজন হইয়াছেন’ [সা : ২০৫]। যদিও ইংরেজরা আত্মদোষ-সমীক্ষার কোনো চেষ্টা করে না, ভারতবাসী যে ইংরেজদের ভালোবাসে না, ইংরেজরা ভাবে এর কারণ ভারতবাসীরা অজ্ঞ ও অক্ষম, কিন্তু ইংরেজরা কার্যপ্রণালীতে কোনো পক্ষপাত করে না, ধর্মপ্রণালীতে হস্তক্ষেপ করে না। ‘ভারতবর্ষে ইংরাজের প্রতাপ দোর্দণ্ড, তাঁহার শাসনরীতি দৃঢ়শৃঙ্খলাবদ্ধ, তাঁহার কার্য্যপ্রণালীতে হঠকারিতা, অন্যায়কারিতা, পক্ষপাতিতাদি দোষ নাই বলিলেও চলে। . . . ইংরাজের রাজত্বে ভারতবর্ষের প্রতি বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ নাই, ইহার আভ্যন্তরীণ যুদ্ধবিগ্রহাদি নাই, চৌর্য্য দস্যুতাদির প্রাদুর্ভাব নাই, সমস্ত দেশ সর্ব্বতোভাবে উপশান্ত। ইংরাজের রাজত্বে বহির্বাণিজ্যের বিস্তৃতি হইতেছে, আন্তর্বাণিজ্যের সৌকর্য্য বাড়িতেছে, বিচারকার্য্যে ন্যায়পরতা রক্ষিত হইতেছে, মুদ্রাযন্ত্র স্বাধীনভাবে চলিতেছে . . . ফলকথা, ইংরাজের রাজত্ব একটী অভূতপূর্ব ব্যাপার’ [সা : ২০৭]। এরপর কী চাই?

বিদেশ সম্পর্কে ইংরেজের ভাব হল, তোমরা ‘কখনই আমার সমান হইতে পারিবে না। কারণ আমিই ইংরাজ, তুমি ইংরাজ নহ’ [সা : ২১২]। হিন্দুরাও মনে করে যে, ‘এক জাতীয় লোক কিছুতেই অপর জাতীয় হইতে পারে না,’ কিন্তু দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে : ‘হিন্দুর আত্মগৌরবে অন্যের প্রতি ঘৃণা জন্মিতে পারে না। ইংরাজের আত্মগৌরবে অন্যের প্রতি অবজ্ঞা জন্মাইয়া দেয়’ [সা : ২১২]। সুতরাং দেখা গেল, যে ‘হিন্দুও বৈদেশিকের সঙ্গে মিশ্রণে অনিচ্ছু এবং ইংরেজও বৈদেশিক-বিদ্বেষ্টা’ [সা : ২১২]। কিন্তু আমাদের মধ্যে বর্ণভেদ প্রথা থাকায় আমরা জানি যে, লোকের এক ধর্ম, দেশ ও ভাষা হওয়া সত্ত্বেও, তারা পরস্পরে বিয়ে করে না, পানভোজন করে না, এমনকী অন্যের শরীরও স্পর্শ করে না, কিন্তু এক সমাজ-সম্বন্ধ, এক শাসনের অধীনে থাকতে পারে। তাই আমাদের হৃদয়ে বিজাতীয় লোকের প্রতি তেমন বিদ্বেষভাব জন্মাতে পারে না। অন্যদিকে ইংরেজ বর্ণভেদ মানে না, কিন্তু তাদের জাতীয় গৌরব বোধটি এত তীব্র যে, ভেদবুদ্ধি, বিদ্বেষ সহজেই প্রশ্রয় পায়। ভূদেব বলেন ইংরেজ যদি জাতিভেদ প্রথা তুলে দেবার চেষ্টা করে তাহলে দেশের মঙ্গল হবে না, দেশের অন্তঃশাসনশক্তি দুর্বল হয়ে পড়বে, অশান্তি বাড়বে, রাজ্যশাসন কঠিনতর হয়ে উঠবে। ভবিষ্যতে ভারতের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য প্রয়োজন একজন দেশীয় নেতা, এই নেতাকে হতে হবে সর্বগুণসম্পন্ন। এর সঙ্গে ভারতকে পূর্ণাঙ্গ ধর্মের অনুশীলন করতে হবে, পারিবারিক জীবনে কায়মনোবাক্যে সন্তানদের সুগঠিত করে তুলতে হবে, সামাজিক জীবনে অন্যের প্রতি সহানুভূতি যাতে সংবর্ধিত হয় সেই চেষ্টা করতে হবে। তাঁর মতে, ভারত সমাজের ভয়ের কারণ দুটো, বিদ্যাহীনতা ও ধনহীনতা। ধনহীনতা পরিহারের ব্যাপারে ভূদেব বলেছেন তিনটি বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে : ব্যয়ের লাঘব, ক্ষতির নিবারণ ও আয়ের বৃদ্ধিসাধন। অন্যদিকে শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর মত হল, সংস্কৃত, দর্শন, শাস্ত্র শিক্ষার সঙ্গে বিজ্ঞানের যোগসাধন প্রয়োজন। ইউরোপীয় সমাজের সূত্র ধরে ভারতসমাজের পরিণতি বিচার করা ভুল, ইংরেজদের মতো এটা ভাবাও ভুল যে, ভারতীয়দের মধ্যে এখনও কোনো জাতীয় ভাব জন্মায়নি। ভারতবাসী যখন পাশ্চাত্যভাবের কুশিক্ষা পরিহার করে আত্মসমাজের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, তখন ভারত বিশ্ববাসীর শিক্ষাস্থল হবে।

ভূদেব গ্রন্থের আভাসে বলেছেন যে, তিনি সমাজতত্ত্বের বই লিখতে চাননি, বরং আর্যসমাজের বৈশিষ্ট্য ও উৎকর্ষ স্থাপনই তাঁর সামাজিক প্রবন্ধাবলির অন্যতম উদ্দেশ্য। ভূদেবের সামাজিক চিন্তা নির্মিত হয়েছে এক জাতীয় ভাবধারার পরিকাঠামোর মধ্যে। বস্তুত যে বিভাজনটি ভূদেবের সামাজিক চিন্তায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে, সেটি হল জাতীয়ভাব ও পাশ্চাত্যভাব। ভূদেব পাশ্চাত্যভাবের মধ্যে গ্রহণযোগ্য কিছু পাননি, বরং তিনি মনে করেছেন তাদের প্রচার ও প্রসার দেশের ক্ষতি করছে। এইসব পাশ্চাত্যভাবের প্রবেশ রুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। অন্যদিকে তিনি দেশের প্রাচীন প্রথা, আচার-আচরণ, রীতিনীতির মধ্যে খুব একটা দোষ দেখতে পাননি। সাম্যের আদর্শের চেয়ে জাতিভেদ প্রথা অনেক ভালো মনে হয়েছে তাঁর কাছে। আমাদের দেশে যে ধর্মের শাসন অবলম্বন করার পক্ষে তিনি জোর সওয়াল করেছেন, তা হল এক ব্রাহ্মণ্য শাসনব্যবস্থা। যাঁরা বলেছেন তাঁর হিন্দুত্ব অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারযুক্ত নয়, তাঁর হিন্দুত্ব হল সনাতন হিন্দুধর্মের অতি উদার সংকোচমুক্ত হিন্দুত্ব, তাঁদের এই মূল্যায়ন যে সঠিক নয়, তা জাতিভেদ নিয়ে ভূদেবের উক্তিগুলি দেখলেই বোঝা যায়। তবে ভূদেবের হিন্দুত্ব গোঁড়া, রক্ষণশীল হিন্দুত্ব হলেও, আজকের দিনের সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ব নয়। ভূদেব মনে করতেন ভারতের মুসলমান, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা জাতীয় ভাবের আদর্শে পুষ্ট। তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি যে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তার দৃষ্টান্ত আচার প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে রয়েছে। তিনি মনে করতেন ‘পৃথিবীর মধ্যে মুসলমানই প্রকৃতপ্রস্তাবে সাম্যধর্ম্মী। ফলতঃ মুসলমান সমাজের মূল প্রকৃতি সমতা’ [সা : ১৫১]। বস্তুত ভারতবর্ষে আমরা সাম্প্রদায়িকতা বলতে এমন এক চেতনা বুঝি যা এক ধর্মীয় আইডেনটিটিকে অবলম্বন করে এবং তাকে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবাদর্শের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে। তারপর সেই ধর্মের মানুষের থেকে সমর্থন দাবি করে এবং সেইসব কার্যকলাপে নিজেদের সমর্থন দেয় বা নিজেদের নিয়োগ করে, যা সেই ধর্মের মানুষদের স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ভূদেবের কালে এই সাম্প্রদায়িকতার সুযোগ খুব একটা ছিল না, তিনি নিজেও মনে করতেন ভারত হিন্দুদের প্রকৃত মাতৃভূমি, হিন্দুরা এই মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়েছে, কিন্তু মুসলমানরা এই মা-র দত্তক সন্তান, তাই হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন রয়েছে। মুসলমানেরা যে ধর্মোন্মত্ত সেটা ভূদেব বলেছেন; ইংরেজ যে হিন্দু-মুসলমান বিভেদ সৃষ্টি করছে, সেটাও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। তবুও যে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা বলেছেন তার কারণ, তিনি মনে করতেন মুসলমানরা সকলেই এদেশীয়, তারা এদেশের স্ত্রীলোকদের বিবাহ থেকে উৎপন্ন এবং ক্রমশই হিন্দুদের আচার-ব্যবহার গ্রহণ করছে; তাই তাঁর বিশ্বাস ছিল ‘হিন্দু এবং মুসলমান যে মিলিবে তাহার সূত্রপাত অনেকদিন হইতেই হইয়া আসিতেছে’ [সা : ১৩৪]। যে জাতীয় ভাবের কথা তিনি বলেছেন, তার মধ্যে তিনি এক ধরনের ঐক্য ও সম্মিলন দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু যে ভাবাদর্শর ছত্রছায়ায় এই সম্মিলন হবে তা রক্ষণশীল হিন্দুর ভাবাদর্শই রয়ে গেছে।

৪. পারিবারিক প্রবন্ধ

ইতিপূর্বে বলেছি পারিবারিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল সামাজিক প্রবন্ধ বইটির প্রায় দশ বছর আগে। দু-টি বইয়ে চিন্তা-ভাবনার সাদৃশ্যের কথা ভূদেব নিজেই লিখে গেছেন। মূল বিষয় হল পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনা সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের যা কিছু একান্ত, নিজস্ব, স্বকীয়, অনন্য এই সবকিছুই নষ্ট হয়ে যাবে। উপনিবেশবাদ এমন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে, যে পারিপার্শ্বিক অবস্থা সৃষ্টি করেছে, তার ফলে আমাদের এই পরিস্থিতির সঙ্গে একভাবে সামঞ্জস্যবিধান না করে উপায় নেই। বহির্জীবনে এই পাশ্চাত্য ভাবধারা, মূল্যবোধ ইত্যাদির প্রভাব এড়ানো যাবে না, তার অনুকরণও করতে হবে। কিন্তু গৃহ ও পরিবার আমাদের নিজস্ব পরিসর, পাশ্চাত্যভাব যদি এখানে প্রবেশ করে তাহলে আমাদের নিজস্ব সত্তা বলতে আর কী থাকবে? আমাদের কোনো স্বতন্ত্র পরিচয় থাকবে কি? প্রশ্ন হল পুরোনো পরিবারের ধারা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধগুলি আবার করে বলা এখানে যথেষ্ট নয়, নতুন রীতি, আদর্শের প্রবর্তন করতে হবে, যা আধুনিক বহির্জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অথচ পশ্চিমের অনুকরণ নয়। কোন সূত্রের মাধ্যমে এই নতুন আদর্শ সৃষ্টি হবে, ভূদেব পারিবারিক প্রবন্ধ বইটিতে এটাই বিস্তারিত ভাবে দেখিয়েছেন। ভূদেব ‘সূচনা’তে লিখেছেন : ‘আমাদিগের পারিবারিক ব্যবস্থা আমার চক্ষে ভাল লাগিয়াছে। যে জন্য এবং যেরূপে ভাল লাগিয়াছে, তাহা প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। যদি প্রবন্ধগুলিতে মনের কথা ঠিক করিয়া বলিতে পারিয়া থাকি, তবে স্বজাতীয় অন্য ব্যক্তির মনেও স্ব স্ব পারিবারিক অবস্থা ভাল বলিয়া বোধ হইতে পারিবে, এবং তাহা বোধ হইলে এই পরাধীন, হীনবীর্য্য, অবজ্ঞাত জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করা চিরন্তন বিড়ম্বনা বলিয়া বোধ হইবে না। কারণ উপাসনাপ্রণালীই বল, আর ধর্ম্মপ্রণালীই বল, সামাজিকপ্রণালীই বল, আর শাসনপ্রণালীই বল, এক পারিবারিক ব্যবস্থাই সকলের নিদানভূত। আমাদিগের পারিবারিক সুখ অধিক-এটী নিতান্ত অল্প কথা নয়; যদি পারিবারিক সুখ অধিক, তবে ধর্ম্মও অধিক এবং ধর্ম্ম অধিক থাকিলে কখনও না কখনও অবশ্যই মহিমশালিতাও জন্মিতে পারে’ [পা : ৫]। ভূদেব তাঁর পারিবারিক প্রবন্ধ বইটিতে যে পরিবার নিয়ে আলোচনা করেছেন, সেটি বস্তুত এক যৌথ পরিবার, সেখানে পিতা-মাতা, পিতামহ, পুত্রকন্যা, পুত্রবধূ, ভাই-ভগিনী সকলেই আছে, যে বিষয়গুলি আলোচনা করেছেন, তার মধ্যে পরিবার গঠনের মৌলিক বিষয়গুলি যেমন আছে, যথা সন্তানপালন, সন্তানের শিক্ষা, দাম্পত্যপ্রণয়, দাম্পত্যকলহ, গৃহকাজের ব্যবস্থা, গৃহিণীপনা প্রভৃতি, তেমনি আছে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলি, যেমন বাল্যবিবাহ, দ্বিতীয় দারপরিগ্রহ, চিরকৌমার, ইত্যাদি।

ভূদেব বইটির ‘গৃহকার্য্যের ব্যবস্থা’ অধ্যায়ে আমাদের সমাজের বেশ কিছু পরিবর্তনের কথা বলেছেন, যা পারিবারিক ব্যবস্থার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে বিশৃঙ্খলার জন্ম দিচ্ছে। ভূদেব এই সামাজিক পরিবর্তনকে ‘বাবুয়ানা বা চৈক্কণ্যলালসা’ বলেছেন, যা তাঁর মতে সর্বনাশের উপক্রম করেছে। আগে যে ব্যাবসা দেশীয়দের হস্তগত ছিল তা ক্রমেই বিদেশিদের আয়ত্তে চলে গেছে। মোটামুটি দেশের এক দৈন্যদশা উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশে একরকম চিকনাইয়ের চাল প্রচলিত হয়ে উঠছে। তিনি বলেছেন : ‘এইরূপ হইবার কারণ দুইটী। এক ইংরাজদিগের অনুকৃতি। দ্বিতীয়, ইংরাজদিগের প্রবর্ত্তিত সাম্যবাদের বহুল বিস্তার’ [পা : ৮৩]। ভূদেব এই অনুকরণ বলতে সর্বশ্রেণির, এবং বিশেষত মধ্যবিত্তের, পোশাক, পরিচ্ছদ, আসবাব, ইত্যাদি ঠাটচমকের কথা বলেছেন। আর এর ফলেই আমাদের পরিবারপ্রণালীর মধ্যে দোষ প্রবেশ করছে। ভূদেব লিখেছেন : ‘ইংরাজদিগের দেখাদেখি বাহ্য আড়ম্বর এবং চৈক্কণ্যের প্রতি লালসা হওয়ায়, ইংরাজদিগের স্বদেশের ব্যবহার কিরূপ তাহা অপরিজ্ঞাত থাকায়, ইংরাজদিগের গৃহকার্য্যের আভ্যন্তরিক ব্যবস্থা না জানায়, আর ইংরাজদিগের মৌখিক সাম্যবাদে উন্মত্ত হওয়ায়, আমাদিগের অপরাপর যে সমূহ ক্ষতি হইতেছে, তাহার ত ইয়ত্তা নাই-গৃহাভ্যন্তরে বড়ই বিপ্লব সংঘটিত হইতেছে। ছেলেরা ইংরাজী শিখিয়া সাহেব হইলেন। মেয়েরা ইংরাজী না শিখিয়াই বিবি হইতে বসিল। যে বাটীতে মাসে একশত টাকা আসিল, যে বাটীর স্ত্রীলোকেরা আর ভাত রান্ধে না, ঘর ঝাঁইট দেয় না, বিছানা শুকায় না, তোলে না, পাতে না, বাটনা বাটে না, কুটনা কুটে মাত্র আর সব কাজ চাকর চাকরাণীতে করে-উঁহারা বহি পড়েন, কার্পেট বুনেন, তাস খেলেন। ফল কি হয়? গৃহ ও গৃহোপকরণ অপরিচ্ছন্ন থাকে, খাওয়া খারাপ হয়, শরীর মাটী হইয়া যায়-যেসকল সন্তান প্রসূত হয় তাহারা ক্ষুদ্রাকার, স্বল্পবল, রুগ্নদেহ হইয়া জন্মে, সর্ব্বদাই পীড়িত হয়, স্বল্পায়ু হইয়া থাকে, অথবা অকালেই চলিয়া যায়’ [পা : ৮৪–৫]। ভূদেব বলছেন এদেশে নানারকম সংস্কার আন্দোলন হচ্ছে, স্ত্রীশিক্ষা নিয়ে নানাবিধ কাজকর্মের কথা সবসময়ই শোনা যাচ্ছে, কিন্তু অন্যের অনুকরণের ফলে যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছি এবং এই বিপদ থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য স্ত্রীলোকদের যে মহতী শিক্ষাটুকু ছিল, সেই শিক্ষা রক্ষা করার ব্যাপারে কোনো কথাই শোনা যায় না। ভূদেব এখানে যে সংকটের কথা বলছেন, তা ছিল এক বাস্তব সংকট, সেই সময়ের মধ্যবিত্ত বাঙালির অনেকেই মনে করতেন উপনিবেশের শাসনের ফলে আমাদের গৃহ ও পরিবার এক সমূহ বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। মূল প্রশ্নটি ছিল পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে একটা সামঞ্জস্যবিধানও প্রয়োজন, অথচ সেই সামঞ্জস্যবিধান করতে গিয়ে আমাদের নিজস্ব সত্তা যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় তাহলে আমাদের অস্তিত্বের আর রইলটা কী? নিজেদের পরিবর্তন করতে হবে, কিন্তু অনুকরণ করে নয়, কী হবে এই পরিবর্তনের সূত্র?

এর উত্তর খুঁজতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ভূদেবের ‘লজ্জাশীলতা’র দৃষ্টান্ত দিয়েছেন : ভূদেব বলেছেন লজ্জাশীলতা মানুষের ধর্ম, পশুর ধর্ম নয়। মানুষ নিজের প্রকৃতিতে যখন পশুধর্মের অস্তিত্ব অনুভব করে তখনই লজ্জার উদ্রেক হয়। বস্তুত পাশব ধর্মের প্রতি মানুষের ঘৃণাই লজ্জার মূল কারণ। মানুষ যখন সভ্য হতে চায়, দিব্যভাবাপন্ন ও সুশীল হতে যত্নবান হয়, তখনই মনুষ্যসমাজে লজ্জার আধিক্য দেখা যায়। যেহেতু স্ত্রীলোকের মধ্যে পশুভাব অপেক্ষা দিব্যভাব বেশি তাই স্ত্রীলোকেরা পুরুষদের চেয়ে বেশি লজ্জা অনুভব করেন। যেহেতু আমাদের দেশে নারীরা বহির্জগতে কাজকর্মের বাস্তব প্রয়াসের সঙ্গে ততটা যুক্ত নন, তাঁদের আচার-আচরণে, চেহারায় দিব্যভাব প্রকাশ পায়, যা সভ্য ও পরিশীলিত সমাজের বৈশিষ্ট্য। পার্থ বলেছেন, এখানে ভূদেব সেই একই ধরনের বিভাজন করেছেন এবং উপমা ব্যবহার করেছেন, যেমন, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক, যা যথাক্রমে যুক্ত পাশব ও দিব্য ভাবের সঙ্গে এবং এই পাশব ও দিব্য ভাব যথাক্রমে পুরুষ ও স্ত্রীর ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ভূদেব এই কাঠামোর মধ্যে এবার জাতীয়তাবাদী বিষয়টি যোগ করেছেন : ‘যে সমাজে স্ত্রী-পুরুষের একত্র সমাবেশ, সকল সময়েই একত্র বসিয়া বাক্যালাপ, একত্র পানভোজন, একত্র পর্য্যটন, সে সমাজে স্ত্রীলোকদিগের চরিত্র কিছু অকোমল, কিছু দিব্যভাববর্জ্জিত এবং অধিকতর পরিমাণে পশুভাবসংশ্লিষ্ট হইয়া পড়ে। এইজন্য তাদৃশ সামাজিক রীতি সম্যক নির্দ্দোষ বলিয়া আমার বোধ হয় না। কেহ কেহ বলেন বটে যে, তাদৃশ সমাজে স্ত্রীলোকদিগের ঘনিষ্ঠ সংস্রব নিবন্ধন পুরুষদিগের স্বভাব কিছু কোমল এবং পবিত্র হয়। ইহা স্বীকার করিলাম। কিন্তু স্ত্রীস্বভাব অকোমল এবং বিকৃত হওয়ায় যত দোষ, পুরুষস্বভাব কোমল হওয়ায় গুণ ততটা কি?’ [পা : ২০] এরপর ভূদেব তাঁর বক্তব্যকে আরও একটু বিস্তৃত করে, তাঁর মূল কথাটি বলছেন : ‘আমাদের শাস্ত্রকারেরা এইরূপে পশুধর্ম্মের অন্তর্গূঢ় ব্রহ্মভাবের আবিষ্কৃতি করিয়া পাশব কার্য্যগুলির পাশবত্ব মোচন করিয়া গিয়াছেন। ইউরোপখণ্ডে এরূপ হয় নাই। সেখানকার লোকদিগের ধর্ম্মচর্য্যা এবং জীবনচর্য্যা পরস্পর পৃথকভূত। তাঁহারা ধর্ম্মভাবের অধীন হইয়া সকল কাজ করিতে চাহেন না-ওরূপ করাকে যাজক-তন্ত্রতা বলিয়া ঘৃণা করেন। . . . ফলকথা, আর্য্যপ্রণালীতে ধর্ম্মভাবের আধিক্য, ইউরোপীয় প্রণালীতে ভোগসুখের আধিক্য। আর্য্যপ্রণালীতে স্ত্রী, দেবী। ইউরোপীয় প্রণালীতে স্ত্রী, সখী ও সহচরী।’ [পা : ২১]।

অর্থাৎ, পারিবারিক জীবনের নতুন আদর্শ এবং বিশেষ করে পরিবারে স্ত্রীলোকদের আচরণ এইভাবে ভূদেব নির্দিষ্ট করে দিলেন। আধুনিক সময়ে বহির্জগতের সঙ্গে নানাবিধ সামঞ্জস্যবিধান করে চলতে হবে এবং সেই দায়িত্ব নেবে পুরুষরা। পরিবার যতক্ষণ অবধি এই বিস্তৃত সামাজিক সম্পর্কের অঙ্গ, পরিবারও এর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। সুতরাং পারিবারিক জীবনের ধারা ও প্রকৃতি পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু সত্যিকারের প্রয়োজন হল আমাদের দেশজ সামাজিক জীবনের অন্তরাত্মাকে ধরে রাখা। গৃহ ও পরিবার হল সেই পরিসর যেখানে জাতীয় সাংস্কৃতিক গুণাবলি প্রকাশিত হয়, এবং এই গুণাবলিকে সংরক্ষণ করা ও লালনপালন করার দায়িত্ব নারীদের। যতই নারীদের ক্ষেত্রে বাইরে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হোক না কেন, তারা যেন তাদের মৌলিক নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলি না হারায়। অর্থাৎ তারা যেন পাশ্চাত্যভাবাপন্ন না হয়ে যায়, অথবা মেমসাহেব না হয়ে যায়। পুরুষ ও নারীর মধ্যে বস্তুগত ও আত্মিক গুণের এই মৌলিক পার্থক্য বজায় থাকবে কি না, এই হয়ে দাঁড়ায় সমাজ সংস্কার বা পরিবর্তনকে বিচার করার মাপকাঠি। পুরুষ ও নারীদের মধ্যে পাশ্চাত্যভাবাপন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে সুপষ্ট এক পার্থক্য থাকা প্রয়োজন। তাই ভূদেব পরিশেষে লিখেছেন : ‘আজিকার নিমন্ত্রণে যে স্ত্রীলোকেরা আসিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে একজনের শব্দ অনেকবার বাহির বাটী পর্যন্ত গিয়াছিল।-“কে বল দেখি।” . . . “ও সেই সুকুমারী-যে চলিলে পায়ের শব্দ হইত না মুখ তুলিয়া কথা কহিত না-যাহার মুখের হাসি মুখেই মিলিয়া থাকিত, ও সেই সুকুমারী, আহা বাছার দোষ কি?” স্বামী উহাকে ইংরাজদের সহিত কথা কহাইয়াছে, তাহাদের সামনে গান করাইয়াছে-আপনার সঙ্গে মদ পর্য্যন্ত খাওয়াইছে-আর কি ওর লজ্জা রাখিয়াছে? তাই অত গলা হইয়াছে। ধরণধারণ সব বদল হইয়া গিয়াছে।’ [পা : ২১–৫]।

পরিবার সম্পর্কে ভূদেব আমাদের প্রাচীন রীতিনীতির মধ্যে খুব একটা দোষ কিছু দেখেননি। উনিশ শতকে বাংলায় পরিবার নিয়ে তর্কবিতর্কের শেষ নেই, পরিবারের নানাবিধ আদর্শ এই আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসে।১৪ যেমন বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অনেকেরই মত, এই ব্যবস্থা পরিবারের পক্ষে ক্ষতিকারক, কারণ এর ফলে সন্তান দুর্বল হয়। ভূদেব বলেছেন বাল্যবিবাহ দাম্পত্যপ্রণয়কে সংবর্ধিত করে, ‘আমাদিগের মধ্যে যে বাল্যবিবাহ প্রচলিত হইয়া আছে, তাহাতেই দাম্পত্যপ্রণয় সঞ্চারিত এবং সম্বর্দ্ধিত করিবার উপায় আমাদিগের নিজের হাতে আছে’ [পা : ১০]। বলেছেন আমাদের পক্ষে প্রকৃত দাম্পত্যপ্রণয় লাভ করিবার যত সুবিধা এমন আর কোনো জাতির নেই। যারা বঙ্গভূমিতে জন্মগ্রহণ করে এই সুখময়, ধর্মময় প্রেমালাভের অধিকারী হয়েও তাদের অনুকরণপ্রিয়তার ফলে বঞ্চিত হন তাদের চেয়ে হতভাগ্য কে? ঠিক এই একই ভাবে ভূদেব বলেছেন, যে বাড়িতে সতীসাধ্বী স্ত্রী আছে সেখানে দাসদাসী, পরিজন সকলেই সদাপ্রসন্ন, নম্র, কলহপরিশূন্য ও কর্তব্যপরায়ণ। যে কাজে স্বামীপূজা নেই, সেই কাজ সতীর মনেই আসে না। সেইজন্য সতীধর্ম্মের পুষ্পসৌরভ সমস্ত সংসারে ছড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ সতীর সংসার সব সময়েই সুখের সংসার। বলেছেন, গৃহিণীপনা দুই রকমের, প্রথম হল সেখানে গৃহিণী কর্তার অনুমতি নিয়ে গৃহকার্য করেন, এটা হল কর্তৃত্ববিহীন গৃহিণীপনা, অন্যটা হল যেখানে গৃহিণী কর্তার মন বুঝে, নিজের বিবেচনা-সহ কাজ করেন, এটা হল কর্তৃত্বসমন্বিত গৃহিণীপনা। ভূদেব পুরুষদের বলেছেন, পরিবারে তুমিই যদি খুঁটিনাটি সব দেখবে, চিন্তা করবে, তাহলে তোমার স্ত্রী আর কী করবেন? বরং পত্নীর হাতে গৃহকাজের ভার দিলে, তাঁর বুদ্ধির বিকাশ হবে, তিনি মানুষ হবেন। ‘অতএব ঘরে কাজ স্ত্রীর হাতে ফেলিয়া দেও, কিন্তু মধ্যে মধ্যে তাঁহার সহিত গৃহকার্য্যের কথা কহ’ [পা : ২৩]। গৃহের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা গৃহিণীর অবশ্যকর্তব্য। এর সঙ্গে যুক্ত আছে দ্রব্যের অপচয় না করা। গৃহের উপকরণ যথাস্থানে ঠিকমতো রাখলেই গৃহ পরিচ্ছন্ন থাকে, অপচয়ও হয় না। ‘অতএব পরিচ্ছন্নতা সাধনের একটি প্রধান সূত্র এই যে . . . দ্রব্যসকল রাখিবার পৃথক পৃথক স্থান এবং পাত্র নির্দিষ্ট করিয়া রাখিবে’ [পা : ৩৬] এবং গৃহোপকরণ ‘বে-কেজো’ করে রাখলেই সম্পত্তি নষ্ট হয়, গৃহ অপরিচ্ছন্ন হয়। গৃহের পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে যুক্ত আছে এক প্রণালীবদ্ধ গৃহ পরিচালনার ব্যবস্থা এবং পরিবারের স্বাস্থ্যরক্ষার প্রশ্ন। এইগুলি সবই পরিবারের আধুনিক ধারণা, যা ভূদেবের লেখায় গ্রথিত হচ্ছে ভারতীয় পরিবারের বেশ কিছু ঐতিহ্যিক ধ্যানধারণার সঙ্গে। ভূদেব পরিশেষে যা বলেছেন তা আমাদের মনোযোগ দাবি করে; ভূদেবের পরিবারে নারীদের আচরণগত বৈশিষ্ট্যের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন : ‘যে গৃহিণী সর্ব্বদা গৃহকার্য্যে ব্যাপৃত থাকেন বলিয়া স্বয়ং পরিচ্ছন্ন এবং সুসজ্জিত থাকিতে চাহেন না, তাঁহার অন্তরে একটি গূঢ় অভিমান আছে-সেটি ভাল নয়; যিনি চেষ্টা করিয়াও পারেন না, তাঁহার লক্ষ্মীচরিত জ্ঞান এখনও সুপক্ক হয় নাই। যিনি বাঁদী এবং বিবি উভয়েই হইতে পারেন, তিনিই লক্ষ্মী-তিনিই সম্পত্তি এবং শোভা উভয়েরই অধিষ্ঠাত্রী দেবতা’ [পা : ৩৬]।

রন্ধন ও ভোজন হল পরিবারের একটি প্রধান কাজ এবং এই কাজটি করতে হবে শুচিতা রক্ষা করে। ভূদেব বলেছেন, ইংরেজদের বাবুর্চিখানা অত্যন্ত নোংরা হয়, পাচকদের পোশাক, হাত, পা, অপরিচ্ছন্ন থাকে, খাদ্যসামগ্রী রন্ধনশালা থেকে যখন বাইরে আসে, তখন পরিবেশনকারীরা ফিটফাট হন, দ্রব্যগুলিকে সাজানো হয়। বলেছেন ইংরেজদের ভোজনপ্রণালী থেকে আমাদের শেখবার বিশেষ কিছু নেই। বরং পরিবারে গৃহস্বামী যদি রান্নার দিকে মনোযোগ দেন, তাহলেই সেই পরিবারের উন্নতি হয়। ‘আমাদের দৃঢ় সংস্কার এই যে, যে বাটীর রান্না ভালো নয়, সে বাটীও ভালো নয়; অর্থাৎ সে বাটীর স্ত্রী পুরুষ(রা) . . . কিছু অলস প্রকৃতিক, কিছু অযত্নপর, কিছু সুখ্যাতিবিমুখ এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সুখ-দুঃখ বোধে কিছু অনুভূতিশূন্য হইয়া থাকে, [পা : ১০১]। তাই যে বাড়ির কর্তা রন্ধনকাজের প্রতি মনোযোগী, কীভাবে নতুন নতুন ব্যঞ্জন রান্না করতে হয় বলে দিতে পারেন, সে বাড়ির স্ত্রীলোকেরা রান্নার কাজকে গৌরবসূচক মনে করে, এবং রান্নার উৎকর্ষ ও পরিপাট্য সাধন করতে পারে। কিন্তু পারিবারিক সুখের জন্য কঠোর হতে হবে, অনেক সময় নিষ্ঠুর হতে হবে। ভূদেব লিখেছেন : ‘গৃহস্বামীর কর্ত্তব্য তিনি গৃহপ্রস্তুত যে খাদ্যসামগ্রী ভোজন করিবেন যেন অবশ্য অবশ্য তাহার দোষগুণ বলিয়া দেন। তিনি যদি না বলেন তবে কখনই তাঁহার বাটীর রান্না ভালো হইবে না। এ বিষয়ে আমার অতি আত্মীয় কোনো এক ব্যক্তির সহিত এরূপ কথোপকথন হইয়াছিল। তিনি বলিলেন, আপনাদের বাটীর রান্না উৎকৃষ্ট হয়, কিন্তু তথাপি দেখিতে পাই-যদি কখন একটী ব্যঞ্জন কিঞ্চিন্মাত্র স্বাদহীন হয়, আপনি তৎক্ষণাৎ সেই ব্যঞ্জনটীর যে দোষ হইয়াছে, তাহা প্রকাশ করিয়া বলেন। আমি ওরূপ করিতে পার না। বৌ, ঝি, গৃহিণী প্রভৃতি যাহারা রন্ধনকার্য্যে ব্যাপৃত হয় তাহারা কতটা পরিশ্রম করে স্মরণ করুন, উহারা যতদূর সাধ্য তাহা করে-উহাদের কার্য্যে প্রশংসা না করা কি একটু নৈষ্ঠুর্য্য নয়? আমাকে যা দেয়, আমি তাহাই ভালো বলিয়া খাই। আমি বলিলাম-আমার প্রণালীতে একটু নৈষ্ঠুর্য্য আছে বই কি?-কিন্তু শিক্ষা প্রদান কাজটা যে বিষয়েই প্রযুক্ত হউক তাহাতে একটু কঠোরতা থাকেই থাকে। যদি বাটীর রান্না ভালো করিতে চাও তবে ঐ কঠোরতা প্রয়োগে অত ভীত হইও না’ [পা : ১০১]। ভূদেব বলেছেন, যে কাজটি করব, সেটা ভালো করে করব, পরিবারের মধ্যে এই সংস্কারটি বদ্ধমূল করার আবশ্যকতা আছে। এটা পরিবারের একটি ধর্মবীজ হিসেবে মান্য করা উচিত।

আধুনিক পরিবারের ধারণার একদম কেন্দ্রে আছে শিশু। শিশুকে ঘিরেই আধুনিক পরিবারের পরিবেশ, তার শিক্ষা, বিকাশ, তার উপর নজরদারি, এই সবই পারিবারিক কার্যকলাপের অঙ্গ।১৫ ভূদেবও সন্তানপালন, শিক্ষা, পরিচর্যা নিয়ে বেশ কিছু অধ্যায় লিখেছেন। ভূদেব বলেছেন সুস্থ-সবল, নীরোগ, চরিত্রবান সন্তানের জন্য পিতামাতাকে তৈরি হতে হবে। নানাবিধ নিয়মরক্ষা করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল নিজেদের ধর্মশীল হতে হবে, সুস্থশরীর নিত্যাচারী, বিদ্যাচর্চার প্রতি উন্মুখ হতে হবে। সন্তানের শিক্ষাও এমন হবে যাতে সে সমাজের অভাবমোচনে সাহায্য করতে পারে। বাঙালি দুর্বল শরীর, সুতরাং শৈশব থেকে ব্যায়ামচর্চায় মনোনিবেশ করতে হবে। বাঙালির স্মৃতিশক্তি প্রখর, কিন্তু ধীশক্তি ও উদ্ভাবনীশক্তি তেমন অধিক নয় এরকম কথা যাঁরা বলেন, তাঁদের প্রতি ভূদেবের উত্তর, স্মৃতি কোনো স্বতন্ত্র মনোবৃত্তি নয়, স্মৃতিকে অবলম্বন করেই অন্য মনোবৃত্তি কার্যকরী হয়। কিন্তু মনোবৃত্তি তেজস্বিনী হওয়ার ফলে বাঙালির একটা দোষও জন্মায়, সব ভালো সুপরিস্ফুট না হলেও মনে থেকে যায়, তাতে কার্যকালে ক্ষতি হয়। তাই শিক্ষার সময় সব ভাব যাতে সুপরিস্ফুট হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। বাঙালি দুর্বল, তাই ভীরু, সেইজন্য মিথ্যাভাষী হবার সম্ভাবনা থাকে। এই ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। বাংলার বায়ু সজল ও উষ্ণ, আর বাঙালি দুর্বল তাই বাঙালি সহজেই শ্রমবিমুখ, অতএব সন্তান যাতে শ্রমশীল হয়, সেইজন্য পিতা-মাতাকে সচেষ্ট থাকতে হবে। বাঙালি নিস্তেজ, আর নিস্তেজ হলেই পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা বৃদ্ধি পায়। দেখতে হবে স্বজাতীয়দের প্রতি ঈর্ষা না জন্মায়, এই ঈর্ষাকে অন্যজাতীয়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রূপান্তরিত করতে হবে। বাঙালিকে বিলাসী হলে চলবে না, অযথা ইংরেজের অনুকরণ করে একপ্রকার আত্মহত্যা করাও চলবে না, নিজেদের আত্মগৌরব বাড়াতে হবে। বাঙালির নিজ সমাজের প্রতি খুব একটা সহানুভূতি নেই, বরং ‘ইংরাজের প্রশংসা এবং ইংরাজের নিন্দাই বাঙ্গালিকে যেন বেশি লাগে। এটি সাংঘাতিক দোষ’ [পা : ৬৪]। মোটকথা হল, সন্তানপালনের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, বাঙালিকে অনেক ভার সহ্য করতে হবে, অনেক চাপ ঠেলে ওপরে উঠতে হবে, সুতরাং বাঙালির শিক্ষা কঠোর হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ‘প্রতি পরিবারের কর্ত্তাকে এক একটি লাইকর্গস হইতে হইবে; কারণ বাঙ্গালিকে স্পার্টান করিবার রাজকীয় লাইকর্গস জন্মিবে না’ [পা : ৬৪]।

ভূদেব যে পরিবারের কথা বলেছেন সেখানে আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে, এখানে পরিবারের কর্তা ডাক্তারের সহযোগী, এই পরিবারের রোগীর যথোপযুক্ত সেবা হয়। এককথায়, এই পরিবার স্বাস্থ্যবিধি সম্বন্ধে সচেতন এবং আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার সহযোগী। যদিও ভূদেব যে পারিবারিক আদর্শ তুলে ধরেছেন, সেই পরিবারে সতীর ধর্ম, বাল্যবিবাহ, পতিপ্রাণা স্ত্রী, ইত্যাদির গুণকীর্তন যেমন আছে, আবার স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতার মতো আধুনিক শিক্ষার প্রয়োগেরও কথা আছে। ভূদেব যে একান্নবর্তী পরিবারের কথা বলেছেন, সেই পরিবার যত না এক বাস্তব অবস্থার কথা বলে, তার চেয়ে বেশি এক নৈতিক, আদর্শ, পরিসরের কথা বলে। বস্তুত একান্নবর্তী পরিবারের কথা সবসময়ই এক ইউটোপিয়াকে তুলে ধরে, যে-পরিবারে মানুষ স্বার্থচিন্তাকে প্রাধান্য দেয় না, সেখানে পরিজনরা পরস্পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। ভূদেবের পরিবারও এরকম এক আদর্শ তুলে ধরে বলতে চায়, আমাদের ইংরেজদের অনুকরণের প্রয়োজন নেই, আমাদের পরিবারেও দাম্পত্যপ্রেম, ভালোবাসা আছে, আমাদের সন্তানদেরও ইংরেজদের অনুকরণে শিক্ষা দেবার প্রয়োজন নেই, আমাদের শাস্ত্র, সমাজব্যবস্থা এক উৎকৃষ্ট জীবনযাত্রার উপযোগী, এই হল ভূদেবের মত। আর এই জীবনপ্রবাহ, তার সংস্কৃতি ও প্রণালীকে আমরা যেন সংরক্ষণ করতে পারি, এই হল পারিবারিক প্রবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য।

৫. আচার প্রবন্ধ

আমরা দেখেছি পারিবারিক প্রবন্ধ বইটিতে ভূদেব বাঙালি হিন্দুসমাজের রীতিনীতি, আদর্শ নিয়ে আলোচনা করেছেন। আচার প্রবন্ধ বইটির যোগ হল হিন্দুশাস্ত্রের সঙ্গে। আচার প্রবন্ধ গ্রন্ধের মূল হিন্দুশাস্ত্র, অন্যদিকে পারিবারিক প্রবন্ধ গ্রন্থটির মূল হল হিন্দুর দেশাচার। আচার প্রবন্ধ সম্বন্ধে বলে রাখা প্রয়োজন যে, বইটি ব্রাহ্মণদের আচার-পদ্ধতি নিয়ে, অন্য জাতির আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে নয়। প্রশ্ন হল, ভূদেব শুধুমাত্র বাঙালি ব্রাহ্মণদের আচার নিয়ে এই গ্রন্থ লিখলেন কেন? এর উত্তর ভূদেব যা দিয়েছেন, একটু পরেই আমরা সেটা আলোচনা করব। এর প্রধান কারণ হল ভূদেব মনে করতেন ব্রাহ্মণ্য আচারই সর্বশ্রেষ্ঠ ও অনুকরণযোগ্য। ‘পূর্ণ সহানুভূতি প্রণোদিত আর্য্যশাস্ত্রকে সর্ব্বপেক্ষা উচ্চাধিকারী ব্রাহ্মণদিগের নিমিত্ত সম্যক পবিত্রতার সাধক একটি উৎকৃষ্ট আচারপদ্ধতির ব্যবস্থা করিতে হইয়াছে এবং তদনন্তর নিকৃষ্টাধিকারী অপরাপর লোকদিগকেও স্ব স্ব ক্ষমতানুসারে ব্রাহ্মণদিগেরই অনুসরণ করিতে উপদেশ দিতে হইয়াছে’ [আ : ৩৫৪]। ব্রাহ্মণেতর বর্ণের লোকেরা নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ব্রাহ্মণাচার অনুসরণ করে চলবে, এছাড়া ‘উচ্চবর্ণের স্ত্রীলোকেরাও কনিষ্ঠাধিকারী বলিয়া সাধারণঃত শূদ্রদিগের ন্যায় আচার অবলম্বন করিতে আদিষ্ট’ [দ্র. ‘গ্রন্থপরিচয়’-এ ‘স্ত্রী শূদ্রাদির আচার’, ৬২৮] তাই তাদের অবস্থানও শূদ্রের মতোই। ভূদেব লিখেছেন : ‘শূদ্রের প্রধান কর্ম্মকার্য্য দ্বিজ-শুশ্রূষা . . . বৈদিক মন্ত্রপাঠে শূদ্রের অধিকার নাই। পৌরাণিক মন্ত্রপাঠে শূদ্রের অধিকার আছে। কিন্তু পঞ্চ যজ্ঞ সম্বন্ধে পৌরাণিক মন্ত্রেও শূদ্রের অধিকার নাই। শূদ্রের বৈধকার্য্য অধিকাংশই “নঃম” মন্ত্রের দ্বারা সাধিত হয়। . . . শূদ্রের দন্তধাবন কষ্ঠিকা চতুরাঙ্গুল পরিমাণের হইবে, ব্রাহ্মণের দন্তকাষ্ঠিকার ন্যায় দ্বাদশাঙ্গুল দীর্ঘ হইবে না। শূদ্রের তিলক গোলাকার হইবে। শূদ্রের ভোজনপাত্রের নিম্নবর্ত্তী মণ্ডল বর্তুলকার হইবে’ [দ্র. তদেব]। সমাজতত্ত্বের পাঠকরা জানেন যে, ভারতবর্ষে শুদ্ররা নিজের ইচ্ছামতো ব্রাহ্মণদের আচার-অনুষ্ঠান অনুকরণ করতে পারতেন না, প্রতিরোধ আসত ব্রাহ্মণদের থেকেই, বহু জায়গায় এ নিয়ে শূদ্রদের দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন করতে হয়েছে। যাই হোক, ভূদেব এই ব্রাহ্মণদের আচার-অনুষ্ঠানকে দেশের মানুষের আদর্শ মনে করতেন, এবং যেহেতু এইসব আচার-আচরণ মানুষ ভুলে যাচ্ছে, তাই ভূদেব সেগুলিকে পুনরুদ্ধার করে উপস্থিত করছেন।

ভূদেব বলেছেন, মোট পাঁচটি কারণে ‘সদাচার’ পালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে : বিধি বিষয়ে অজ্ঞতা, শ্রদ্ধাহীনতা, বিজাতীয় অনুকরণের আতিশয্য, স্বেচ্ছাচারিতার প্রাবল্য ও স্বাভাবিক আলস্য। আমরা আগেও দেখেছি ইংরেজদের অনুকরণের ভূদেব প্রবল বিরোধিতা করেছেন। তাঁর নানাবিধ লেখার একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাঠককে এই অনুকরণের অন্তঃসারশূন্যতা সম্পর্কে সচেতন করা। এই গ্রন্থটিও সেই উদ্দেশ্যেই লেখা। ভূদেব লিখেছেন, ইংরেজিশিক্ষিত যেসব মানুষ শাস্ত্রাচারের প্রতি অশ্রদ্ধা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করে নিজেদের ‘নৈতিক সাহস’-এর প্রমাণ দেন, তাদের এই কাজে কিন্তু কিছুমাত্র সাহসিকতা প্রমাণিত হয় না। কারণ যার ভালো-মন্দ করার ক্ষমতা আছে সে-ই ভয়ের পাত্র, আমাদের সমাজের আর সেই ক্ষমতা নেই, এই ক্ষমতার অধিকাংশই ইংরেজের হস্তগত হয়েছে, তাই ইংরেজই এখন ভয়ের পাত্র, সমাজ নয়। এখন তাই ইংরেজ অনুকরণে সাহস প্রদর্শিত হয় না, প্রবলের তোষামোদ হয় মাত্র। তাই ‘সমাজকে অপমানিত করায় পুত্রবৎসল পিতাকে অপমানিত করার ন্যায় পাপেরই প্রমাণ হয়, উহা সাহসের প্রমাণ হইতে পারে না’ [আ : ৩১০]। ভূদেব তাই বাঙালি ব্রাহ্মণদের আচার সংস্কার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। বইটির বিষয়সূচি দেখলেই এ ব্যাপারে এক সম্যক ধারণা হয়। ভূদেব বইটিকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন, প্রথম ভাগ আছে নিত্যাচার প্রকরণ এবং দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে নৈমিত্তিকাচার প্রকরণ। যে আচারগুলি প্রতিদিন পালন করতে হয়, যেমন, প্রাতঃকৃত্য, পূর্বাহ্নকৃত্য, মধ্যাহ্নকৃত্য, অপরাহ্ন, সায়াহ্ন ও রাত্রিকৃত্য, এগুলি হল নিত্যাচারের অন্তর্গত। অন্যদিকে নৈমিত্তিকাচার প্রসঙ্গে ভূদেব লিখেছেন : ‘নিমিত্ত শব্দের অর্থ হেতু। কোনো হেতুর অবলম্বনে বা উপলক্ষে যেসকল অনুষ্ঠান করণীয় বলিয়া শাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে, তাহা নৈমিত্তিকাচারের অন্তর্গত; অর্থাৎ দৈনন্দিন ভিন্ন যেসকল শাস্ত্রাদিষ্ট কর্ম্ম, সময়বিশেষে অনুষ্ঠেয়, সেগুলিকে নৈমিত্তিক কর্ম্ম বলা যায়। নৈমিত্তিক কর্ম্মের মধ্যে কতকগুলির নাম পূজা, কতকগুলির নাম ব্রত, কতকগুলির নাম শ্রাদ্ধ এবং কতকগুলির নাম সাধন’ [আ : ৩৫৮]। ভূদেব এই বইতে আলোচনা করেছেন গর্ভসংস্কার, শৈশব সংস্কার, কৈশোর সংস্কার, যৌবন সংস্কার, শ্রাদ্ধকৃত্য, ইত্যাদি। বিভিন্ন আচারের অনেক সময় এক ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যাখ্যা দেবারও চেষ্টা করেছেন, হয়তো এটাই প্রমাণ করতে যে, পশ্চিমের চেয়ে আমরা কোনো অংশে কম উন্নত নই।

যেমন, দন্তধাবন সম্পর্কে অনেকগুলি বিধির মধ্যে একটি হল পূর্ব বা উত্তর মুখ হয়ে দন্তধাবন করতে হবে এবং চতুর্দশী, অষ্টমী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা, এইসব পর্বাহে দন্তকাষ্ঠিকা ব্যবহার করা উচিত নয়। এই প্রসঙ্গে ভূদেব বলেছেন, এই বিধির ‘বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য্যগ্রহ ইউরোপীয় বিজ্ঞানের অধিকতর উন্নতিসাপেক্ষ। ভারতবর্ষ যে অক্ষাংশ মধ্যে অবস্থিত তাহাতে এদেশে উত্তর শিয়রে শয়ন করার দোষ বিজ্ঞান দ্বারা প্রতিপন্ন প্রায় হইয়া উঠিয়াছে; এইজন্য বোধ হয় যে, বিজ্ঞান নিজে আরও একটু বড়ো হইয়া উঠিলে পূর্ব্ব এবং উত্তরাস্য হইয়া দন্তধাবন করিবার উপকারিতাও বুঝিতে পারিবে। আর পূর্ণিমা এবং অমাবস্যাদি তিথির ভেদে মনুষ্যদেহে রোগ প্রবণতার ন্যূনাতিরেক হয়, ইহা বহুকালের পর ইউরোপীয় বিজ্ঞানের অনুভূত হইয়াছে; সুতরাং কালক্রমে সেই বিজ্ঞান যে মনুষ্যদেহে অন্যান্য তিথ্যাদিরও প্রভাব বুঝিবে এবং তাহা বুঝিয়া তিথ্যুপযোগী অনুষ্ঠানের নিদান দেখিতে পাইবে, ইহাও অনুভবযোগ্য’ [আ : ৩২০]। এরপর তিনি দন্তধাবনের নানা বিধির কথা বলেছেন। কোনোটি অবশ্যপালনীয়, কোনটিই-বা নিষিদ্ধ, সে-সব কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। যেমন, দন্তধাবনকালে কথা বলতে নেই, অধিক বেলা করে দন্তধাবন করাও নিষিদ্ধ। নিত্যকর্মের একটি প্রধান উদ্দেশ্য হল শরীরের শুচিতা রক্ষা করা। দিবারাত্রি নানাভাবে শরীর অশুচি হচ্ছে, তাই প্রাতঃস্নান দ্বারা এর শোধন হয়। এই প্রসঙ্গে ভূদেব মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি যে, ইউরোপীয়রা আমাদের তুলনায় কতটা অপরিচ্ছন্ন ও অশুচি। কারণ, তাদের আচার শাস্ত্র নেই। ‘একজন ফরাসী পণ্ডিত একটু গর্ব্ব করিয়াই বলিয়াছেন যে, তাঁহার স্বদেশীয়েরা গড়ে দুই বৎসরের মধ্যে একবার স্নান করে। তিনিই বলেন ইংলণ্ডবাসীরা গড়ে তিন বৎসরান্ত একবার স্নান করিয়া থাকে’ [আ : ৩২১]। মূল কথা হল, আমাদের আচার কত উন্নত, সমৃদ্ধ, অগ্রসর ও বৈজ্ঞানিক এবং সেই তুলনায় পশ্চিম কত পিছিয়ে আছে। এই প্রসঙ্গে ভূদেব থেকে আরও একটি দৃষ্টান্ত দিই। ভূদেব বলেছেন, আমাদের শাস্ত্রের বিধি হল ভোজনকালে মৌনী হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু ইউরোপীয়রা ঠিক এর বিপরীত ব্যবহার করেন, তাঁরা খাওয়ার সময় গল্পসল্প করেন, তাঁরা বলেন কথোপকথন করলে পরিপাকক্রিয়া সুসম্পন্ন হয়। ‘কিন্তু কথা কহিতে গেলেই মুখের লালা নিঃস্রাব কম হইয়া জিহ্বা শুষ্ক হয়; এইজন্য বোধ হয় তাঁহাদের ঘন ঘন জল বা মদ্যপান করিতে হয়। লালা শুষ্ক হওয়া এবং তজ্জন্য মধ্যে মধ্যে জল খাওয়া পরিপাকক্রিয়ার অনুকূল নহে’ [আ : ৩৩৩]।

আমাদের দেশে মানুষের ধাতু বিচার করা হয়। শাস্ত্র অনুযায়ী মোট তিনটি ধাতু আছে-বায়ু, পিত্ত ও কফ, কিন্তু মানুষের ধাতু অবিমিশ্র হয় না, সকলের শরীরে বায়ু পিত্ত কফ এই ত্রিদোষের মিশ্রণ আছে, এর মধ্যে যার শরীরে যেটির বাহুল্য তাকে সেই ধাতুর লোক বলা হয়। ধাতুর সঙ্গে সম্পর্ক আছে, তাই আমাদের শাস্ত্রে ঋতুভেদে পথ্যাপথ্যের নির্দেশ আরও বিস্তৃত করা হয়েছে। তাই যদি কোনো ইংরেজি চিকিৎসাগ্রন্থ থেকে পথ্যাপথ্যের নির্দেশ হয়, তখন ভীষণ গোলযোগে পড়তে হয়, কারণ দ্রব্যের রাসায়নিক বিশ্লেষণের ফলই চিকিৎসাগ্রন্থে লিখিত থাকে। কোন পথ্য কেমন অবস্থায় কোন সময়ে শরীরের পক্ষে উপকারী বা অনুপকারী ওদের ডাক্তারি বইগুলি এসব কথার কোনো ধার ধারে না। ভূদেব বলেছেন, ওরা শীতপ্রধান দেশের মানুষ ‘স্থূলেন্দ্রিয়সম্পন্ন, সূক্ষ্মদর্শনে হীনশক্তি’, ওরা কখনোই ধাতু, শরীরের ভাব এবং অবস্থা ও দ্রব্যের স্বভাব বুঝে পথ্যাপথ্য বিচারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যরক্ষা ও রোগের প্রতিকার করতে সমর্থ হতে পারে না। এ ছাড়া আমাদের শাস্ত্রে বিরুদ্ধ ভোজনের কথা আছে। যেমন, সত্ত্বগুণবিরোধী কতকগুলি দ্রব্য হল রসুন, পেঁয়াজ, ইত্যাদি, যা দ্বিজাতির পক্ষে নিষিদ্ধ।

ভূদেব আমাদের শাস্ত্র অনুযায়ী বিভিন্ন খাদ্যদব্যের গুণাগুণের একটা লম্বা তালিকা দিয়েছেন, ধাতু ও ঋতু বিচার করে এই খাদ্য গ্রহণ করলে অনুরূপ ফল পাওয়া যাবে। উনিশ শতকে পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতিও আমাদের দেশে আগ্রহ জন্মায়, এই ব্যবস্থার এক ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যাখ্যা দেবার প্রচেষ্টাও দেখা যায়।১৬ বলা হয় মানুষের চিকিৎসা পথ্যাপথ্য, তার পরিবেশ, পারিপার্শ্বিক, আবহ ইত্যাদি বিচার করে নির্দিষ্ট করা উচিত। শীত ও গ্রীষ্মপ্রধান দেশে তাই মানুষের পথ্যাপথ্য ভিন্ন হবে, মানুষের প্রকৃতিভেদেও চিকিৎসাপ্রণালী আলাদা হবে। ভূদেবও ওই একই মত পোষণ করেন, তাই তিনি ইংরেজদের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘সর্বভূক ইউরোপীয়দিগের মধ্যে একটি কিম্বদন্তী এই যে যাহা মুখের ভিতর যায় তাহাতে পাপ হয় না, যাহা হইতে বাহির হইয়া আইসে (অর্থাৎ বাক্যাদি) তাহাতেই পাপ হইতে পারে। এটা প্রকৃত কথা নয়, বালকের ন্যায় স্বল্পদর্শীর কথা’ [আ : ৩৪২]। ভূদেব বিভিন্ন নিত্যাচার, যেমন প্রাতঃকৃত্য, পূর্বাহ্নকৃত্য, মধ্যাহ্নকৃত্য, অপরাহ্নকৃত্য ইত্যাদি আলোচনা করে বলেছেন যে, এইসব নিত্যাচার মনের শুচিতা ও শরীরের স্বাস্থ্য সম্পাদন করে, এ ছাড়া আত্মসংযম, পরার্থপরতা, প্রভৃতি গুণ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করে। অবশ্য একই সঙ্গে বলেছেন : ‘এই পদ্ধতি শান্তশীল এবং পবিত্রতা ও মুক্তিপরায়ণ ব্রাহ্মণদিগের জন্য উদ্ভুত . . . ভারতবাসী অপরাপর বর্ণের লোকেরাও, যাঁহারা যতদূর পারিয়াছেন, এই আচারপদ্ধতিতে শিক্ষিত হইয়া এবং তাহার যাথাযোগ্য অনুকরণ করিয়া কষ্টসহ, ধৈর্যশীল এবং ধর্ম্মভীরু হইয়াছেন। কারণ ব্রাহ্মণাচারই সকল ভারতবাসীর সদাচারের আদর্শ স্বরূপে নির্দ্দিষ্ট’ [আ : ৩৫৩]।

ভূদেব তাই আচার প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে ব্রাহ্মণদের আচারপদ্ধতি এক আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছেন। বলেছেন, ভারতবর্ষে যেহেতু বিভিন্ন বর্ণের মানুষ আছে, যাদের মধ্যে বুদ্ধি ও ধর্মবৃত্তির একটা সহজাত ভেদ আছে, তাই ‘এখানে “অধিকারী ভেদ”রূপ সরল তথ্যের স্বীকার সহজেই হইয়াছে এবং তৎসহই “আদর্শ নির্দ্দেশনার” পরিস্ফূটতা জন্মিছে’ [আ : ৩৫৩]। তা সত্ত্বেও ভূদেব মনে করেন ‘ভারতবর্ষের শাস্ত্রকারেরা যেমন বিভিন্ন শ্রেণীর সকল লোকেরই প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন তেমন আর কোথাও কখনও হয় নাই’ [আ : ৩৫৩]। এদেশে ব্রাহ্মণরা যেমন ‘সর্বাপেক্ষা উচ্চাধিকারী’ এবং অন্যদের নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের অনুসরণ করতে হবে, আবার অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় এই আমাদের বাংলার ব্রাহ্মণরা অনেক উচ্চ অবস্থিত। কী কারণ? ভূদেব লিখেছেন : ‘ভারতবর্ষের অপর সকল প্রদেশের অপেক্ষা স্মার্ত্তশিরোমণি রঘুনন্দনের প্রসাদে বাঙ্গালাতে স্মার্ত্তাচার অধিকতর প্রবল হইয়া আছে। এই প্রদেশের ব্রাহ্মণেতর জাতীয়েরা বোম্বাই এবং মাদ্রাজের তুলনায় সমধিক পরিমাণেই ব্রাহ্মণাচারের অনুকরণ করিয়াছেন এবং তজ্জন্য সমধিক পরিমাণ শুচি, পবিত্র এবং শ্রী ও বুদ্ধিসম্পন্ন হইয়া . . . সমস্ত সংস্কারেরও অধিকারী হইয়াছেন’ [আ : ৩৫৪]। শাস্ত্রাচার সঠিকভাবে পালন করার জন্য ভূদেব এত আগ্রহী এই কারণেও যে ভারতবাসী শাস্ত্রাচার যদি না মেনে চলে তাহলে তার নিজ সমাজের প্রতি সহানুভূতি আরও কম হবে, এবং তাহলে তার ধর্মভাবের মূলেও কুঠারাঘাত হবে, আর ধর্মভাব বিনষ্ট হলে সকলের পূর্ণগ্রাস হবে, মুক্তির কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। ভূদেব বলেছেন ‘আর্য্যাচারবিহীন কোনো জাতি আর্য্যাচারসম্পন্ন’ মানুষদের চেয়ে কিছুতেই উৎকৃষ্ট হতে পারে না। ‘আমার বিবেচনায় সকল দিক দেখিয়া বুঝিলে পৃথিবীর কোন জাতিকেই ভারতবাসী আর্য্যদিগের অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর বলা যায় না’ [আ : ৩৫৬]। তাই ভারতবর্ষের মানুষ হয়তো দরিদ্র, দুর্বল, কিন্তু এদের মধ্যে দয়া, সহিষ্ণুতা, পবিত্রতা, পরার্থপরতা প্রভৃতি সদগুণ পৃথিবীর অন্য জাতির লোকেদের চেয়ে অনেক বেশি, আর এটা শাস্ত্রাচারের ফল। এইজন্যই ভূদেব আবার আমাদের শাস্ত্রাচারের কথা বিস্তারিতভাবে মনে করিয়ে দিতে চান, তাঁর বিশ্বাস এই শাস্ত্রাচার অতি উৎকৃষ্ট বস্তু এবং এটা পরিত্যাগ করলে আমাদের অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল যেভাবে বিজাতীয় শিক্ষার প্রভাবে শাস্ত্রাচার যতটা পরিত্যক্ত হচ্ছে, ঠিক সেই পরিমাণেই আমাদের দেশে উৎকর্ষের লাঘব এবং অপকর্ষের বৃদ্ধি হচ্ছে।

৬. বিবিধ প্রবন্ধ

Education Gazette এবং শিক্ষাদর্পণ পত্রিকায় ভূদেব নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। তার মধ্যে সংস্কৃত নাটক সমালোচনা সম্পর্কিত তিনটি প্রবন্ধ প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত হয়। ভবভূতির  উত্তররামচরিতম, শ্রীহর্ষের রত্নাবলী এবং শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকম নাটকের এই সমালোচনায় তিনি যেন সংস্কৃত সমালোচনা সাহিত্যের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করছেন। তিনি তাঁর ‘উত্তরচরিত’ প্রবন্ধ আরম্ভ করেছেন এই বলে যে ‘প্রাচীন গ্রন্থের সমালোচনা এক্ষণে প্রায় হয় না।’ এই সমালোচনাত্রয়ীর বিস্তারিত বিচারবিবেচনায় যাবার প্রয়োজন নেই; শুধু এইটুকু বললে যথেষ্ট হবে যে, তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এখানেও তিনি সংস্কৃত নাটকের উচ্চতর চরিত্র চিত্রায়ণ ও মহত্তর আদর্শের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন। একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করলেই হবে। মৃচ্ছকটিক নাটক আলোচনা প্রসঙ্গে ভূদেব বলেছেন, চারুদত্ত হিন্দু আর্য্য, তাঁর ইচ্ছাবৃত্তি শাস্ত্রশাসনের অধীন, অন্যদিকে শার্ব্বিলক ‘ইউরোপীয় ছাঁচের লোক’, তাঁর ইচ্ছাবৃত্তি ধর্মশাসনের বশীভূত নয়। চারুদত্ত সাত্ত্বিক, শার্ব্বিলক রাজস পুরুষ। ইউরোপীয়রা যেহেতু স্বৈরস্বভাব, তাদের কাছে রজোগুণের আদর বেশি। তাই ইউরোপীয় আলংকারিকের চোখে মৃচ্ছকটিক-এর নায়ক চারুদত্ত না হয়ে শার্ব্বিলক হলে ভালো হত। সমস্যা হল, ‘আজিকাল ইউরোপীয় শিক্ষা, ইউরোপীয় ভক্তি এবং ইউরোপীয় অনুকরণের দিন পড়িয়াছে। অতএব বোধ হয়, ইংরাজীতে কৃতবিদ্য এতদ্দেশীয় নব্যেরাও যদি মৃচ্ছকটিক পাঠ করেন, তবে তাহাদিগের মনে চারুদত্ত অপেক্ষা শার্ব্বিলককেই ভালো লাগিবে। ইউরোপীয় শিক্ষার প্রভাবে এতদ্দেশীয় জনগণের হৃদয়ে যে চিত্তাদর্শের প্রভেদ জন্মিয়া যাইতেছে, তাহার প্রতি লক্ষ্য করিয়াই এই কথার উল্লেখ করা গেল।’ [বি১ : ৪৮৩]। ভূদেবের মতে ইংরেজ শাসনের প্রভাবে এবং দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনের ফলে আমাদের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে। ‘কিন্তু এই যে পরিবর্ত্ত ঘটিতেছে, তাহার প্রকৃতি কি? আমাদিগের পূর্ব্বাচার্য্যেরা যেসকল গুণ এবং চরিত্রকে অপেক্ষাকৃত দুষ্ট এবং হেয় জ্ঞান করিতেন এক্ষণে তাহাই ভাল এবং সাদরণীয় হইয়া উঠিতেছে বই তো নয়’ [বি১ : ৪৮৩]। ভূদেব বলেছেন মৃচ্ছকটিক রচয়িতা চারুদত্তকে নায়ক করে, সত্ত্বগুণের সম্যক প্রাধান্য প্রদর্শিত করেছেন। এই নাটক থেকে ভারতীয়দের সাত্ত্বিক ঐতিহাসিক পাঠ করলে মনে হয় জনগণের মধ্যে ধর্ম নিয়ে বিরোধ হলেই ঘোরতর বিদ্বেষ উপস্থিত হয়। কিন্তু এর কারণ হল, ইউরোপীয়রা রজোগুণপ্রধান, তারা কামক্রোধের একান্ত বশীভূত, অন্যদিকে ভারতীয়রা সাত্ত্বিক শিক্ষার গুণে চিরকাল রিপুদমনে প্রবণ এবং পারমার্থদৃষ্টি। তাই শেষ অবধি ভূদেব লিখেছেন : ‘মৃচ্ছকটিক নাটকে যেসকল পাত্রের উল্লেখ আছে, তাহাদিগের মধ্যে দুইজনের চরিত্র পর্য্যালোচনা করিয়া সাত্ত্বিক এবং রাজস, হিন্দু আর্য্য এবং ইউরোপীয় আর্য্য, এতদুভয়ের মধ্যে যে চিত্তাদর্শ সম্বন্ধীয় মৌলিক ভেদ জন্মিয়া গিয়াছে, তাহা সংক্ষেপে প্রদর্শিত হইল। ইউরোপীয় পুরুষ সাহস, নির্ভীকতা এবং স্বৈরাচারকে বীরস্বভাবের প্রধান উপকরণ মনে করেন। তাঁহার মতে যুদ্ধবীরই বীর। সংস্কৃত গ্রন্থকার সাহস ও নির্ভীকতার গৌরব করিয়াও উহাদিকে বীরভাবের অতি গৌণ উপাদানই মনে করেন। তাঁহার চক্ষে বীর দেখিতে হইলে, দানবীর, সত্যবীর, দয়াবীর, ক্ষমাবীর, ধৈর্য্যবীর প্রভৃতি প্রথমে উদিত হয়-যুদ্ধবীর সকলের পশ্চাদ্ভাগে আইসেন’ [বি : ৪৮৭–৮]।

ভূদেবের লেখা পুরাবৃত্ত সার গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ সালে। বাংলা ভাষায় ইতিহাসের খুব বেশি গ্রন্থ নেই বলে ভূদেব ছাত্রদের জন্য এই বইটি লিখেছিলেন। বস্তুত ইংরেজিতে প্রকাশিত নানাবিধ বই থেকে তিনি এই ‘সার’ সংকলিত করেছিলেন। বিবিধ প্রবন্ধ (দ্বিতীয় ভাগ) গ্রন্থে প্রকাশিত ‘পুরাবৃত্তের কথা’ এই গ্রন্থের এক প্রাথমিক খসড়া বলে মনে হয়। এখানেও ভূদেব এক তুলনামূলক ইতিহাস রচনার প্রয়াস করেছেন। এই খণ্ডেই প্রকাশিত সমাজ বিষয়ক প্রবন্ধগুলি ভূদেব লিখেছিলেন সামাজিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার অনেক আগে, কিন্তু কোথাও ছাপাননি। এই প্রবন্ধগুলি তাঁর মৃত্যুর পর Education Gazette প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধগুলির সঙ্গে সামাজিক প্রবন্ধ গ্রন্থে প্রকাশিত লেখার অনেক মিল আছে, সুতরাং এই প্রবন্ধগুলি নিয়ে আলাদা আলোচনার প্রয়োজন নেই। ভূদেব তন্ত্র নিয়ে যে একটি বড়ো লেখার পরিকল্পনা করেছিলেন, এই সংগ্রহ থেকে তা-ও বোঝা যায়। আমি এখানে সংক্ষেপে একটি লেখা নিয়ে আলোচনা করব। সেটা হল ‘বঙ্গসমাজে অন্তঃশাসন’। এখানে ভূদেব সমাজের এক অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থার কথা বলেছেন। ইংরেজ প্রবর্তিত রাষ্ট্রব্যবস্থার বিস্তার সত্ত্বেও হিন্দুসমাজে এই অন্তঃশাসন ব্যবস্থা যে বিলুপ্ত হয়নি ভূদেব তার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। উপনিবেশের গোড়াপত্তন থেকেই ভারতীয় গ্রামীণ সমাজ সম্পর্কে এরকম একটি জোরালো তত্ত্ব ছিল যে, এই গ্রামীণ সমাজগুলি একটি কমিউনিটি বা রিপাবলিক। এইগুলি এক-একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ একক, অর্থনৈতিক অথবা রাজনৈতিক দিক থেকে এদের বাইরের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না, এদের নিজেদের শাসনব্যবস্থা আছে, অর্থনৈতিক দিক থেকেও এরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই ‘ভিলেজ রিপাবলিক’ সম্পর্কেই তাই চার্লস মেটকাফ তাঁর বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন যে, বাইরে সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন ঘটে যায়, এক বিপ্লবের পর আর এক বিপ্লব হয়, কিন্তু গ্রাম একই থাকে। কার্ল মার্কসও এই ভিলেজ কমিউনিটির কথা লিখেছেন, তবে তিনি মনে করতেন এই গ্রামীণ সমাজ অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ম্ভর ছিল, রাজনৈতিক দিক থেকে নয়। ভিলেজ কমিউনিটির এই ধারণা ভারতের রাজনৈতিক সামাজিক চিন্তাধারায় এক গভীর প্রভাব ফেলেছিল এতে কোনো সন্দেহ নেই, গান্ধীর গ্রামস্বরাজের ধারণা এই আদর্শ দ্বারাই প্রভাবিত। বস্তুত যাঁরাই রাষ্ট্রকে দমনমূলক, পীড়নমূলক, দৌরাত্ম্যকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেছেন, তাঁরাই এরকমভাবে এই ধরনের অন্তঃশাসনের কথা বলেছেন, এমনকী আজকের দিনেও।১৭

ভূদেব লিখেছেন : ‘হিন্দুসমাজের মধ্যে সর্বত্রই অন্তঃশাসনের উপায় আছে। … ইংরাজ এদেশের রাজা হইয়া এবং সর্বত্র আপনার দত্ত ক্ষমতার বিস্তার করিয়া এদেশের সমাজশাসনপ্রণালী বদ্ধপ্রায় করিয়াছেন। তথাপি কোথাও কোথাও তাহার কিছু অবশেষে আছে’ [বি২ : ৫২২]। ভূদেব অবশ্য এখানে ঠিক যে-কথা বলেছেন তা হল, এই অন্তঃশাসনের বিষয় হল ‘এমন সকল পাপাচরণ যাহা রাজদণ্ডের অন্তর্ভূত নহে’ [বি২ : ৫২৪]। অর্থাৎ তিনি এখানে রাষ্ট্রব্যবস্থার সমান্তরাল এক শাসনব্যবস্থার কথা বলছেন যা আংশিক স্বাধীন। কিন্তু তাঁর এই ধারণার উৎস যে গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনের ধারণা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তিনি লিখেছেন : ‘বঙ্গদেশে, সমাজের শাসন নিতান্ত অল্পপ্রবল নহে। রাজধানীতে এবং বড়ো বড়ো শহরে কিছু কম বটে, কিন্তু সমস্ত পল্লীগ্রামে সমাজের শাসন বিলক্ষণ সজীব ও সতেজ। শহরের অপেক্ষা পল্লীগ্রামের লোকেরা সরল এবং ধর্ম্মভীরু। কোনো সমাজেরই শাসন সাক্ষাৎ ধনদণ্ড প্রয়োগ দ্বারা সাধিত হয় না। সমাজের দণ্ড ত্যাগরূপকই হইয়া থাকে। সমাজ পিতৃতুল্য; দুষ্ট সন্তানের প্রতি বলেন, “রে দুষ্ট! তোকে আমি ত্যাগ করিলাম।” বঙ্গসমাজ ঐ ত্যাগের কয়েকটি চিহ্ন করিয়া রাখিয়াছেন, যথা-(১) পঙতি বারণ (২) নিমন্ত্রণ বারণ (৩) হুঁকা বারণ (৪) আসন বারণ (৫) নাপিতধোপা বারণ’ [বি২ : ৫২৫]। আজকের দিনের সমাজতাত্ত্বিকরা বলেন এই সনাতন সমাজ কলহ, ঝগড়া, বিবাদ-বিসংবাদ, দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করতে পারত, পার্থক্যকে সহন করার মতো ক্ষমতা ছিল, এবং মানবিক সত্তার এক পূর্ণাঙ্গ বিকাশে সহায়তা করত। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এই সনাতন সমাজব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলেছে, কিন্তু শূন্যস্থানটি কোনো যথোপযুক্ত পরিবর্তনের মাধ্যমে পূরণ করতে পারেনি।১৮ ভূদেব অন্তঃশাসনের কথা বলে ইংরেজ প্রবর্তিত রাষ্ট্রাব্যবস্থারই সমালোচনা করেছেন। একই কথা একটু ভিন্নভাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : ‘ইংরেজিতে যাহাকে স্টেট বলে, আমাদের দেশে আধুনিক ভাষায় তাহাকে বলে সরকার। এই সরকার প্রাচীন ভারতবর্ষে রাজশক্তি আকারে ছিল। কিন্তু বিলাতের স্টেটের সঙ্গে আমাদের রাজশক্তির প্রভেদ আছে। বিলাত, দেশের সমস্ত কল্যাণকর্মের ভার স্টেটের হাতে সমর্পণ করিয়াছে-ভারতবর্ষে তাহা আংশিক ভাবে মাত্র করিয়াছিল। . . . নিঃস্বকে ভিক্ষাদান হইতে সাধারণকে ধর্মশিক্ষাদান এ সমস্ত বিষয়েই বিলাতে স্টেটের উপর নির্ভর-আমাদের দেশে ইহা জনসাধারণের ধর্মব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত-এই জন্য ইংরেজ স্টেটকে বাঁচালেই বাঁচে, আমরা ধর্মব্যবস্থাকে বাঁচালেই বাঁচিয়া যাই।’১৯

৭. উপসংহার

ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক ল্যুই ডুমোঁ Homo Hierarchicus গ্রন্থে২০ বলেছেন যে, পশ্চিমে সমাজ সাম্য ও ব্যক্তির ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত, আর ভারতে সমাজ গড়ে উঠেছে হায়ারারকি বা উচ্চ-নীচ সম্পর্কের বৈধতা ও সমষ্টির ধারণাকে ভিত্তি করে। ভারতবর্ষের জাতিব্যবস্থা এই উচ্চ-নীচ সম্পর্কের বিন্যাস, যেখানে মানুষের মধ্যে অধিকারভেদ রয়েছে, ফলে তাদের অবস্থানও আলাদা। বলা বাহুল্য, এই ধারণা সাম্যের ধারণার বিপরীত। ভূদেবও পশ্চিমের সমাজ ও আমাদের সমাজকে মোটামুটি একইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং কোন সমাজ কাম্য সে-ব্যাপারে তাঁর সমর্থন ভারতের দিকে। মনে রাখতে হবে সমাজতত্ত্ব আধুনিক সমাজেরই ফসল, বস্তুত আধুনিক সমাজের এক অচ্ছেদ্য অংশও বটে। আধুনিক সমাজের দু-টি মৌলিক আদর্শ হল সাম্য এবং স্বাধীনতা আর তা রূপান্তরিত হয়েছে ব্যক্তিমানুষের মাধ্যমে, এদের দেখা হয়েছে মনুষ্যত্বের সারাৎসার হিসেবে। এই ব্যক্তি প্রশ্নাতীত, পরম, অনতিক্রমণীয়, এই ব্যক্তির বৈধ অধিকারের উপরে আর কিছু নেই, এই ব্যক্তির অধিকার শুধুমাত্র অন্য ব্যক্তিদের একইরকম অধিকারের দ্বারা সীমিত। এই ব্যক্তি এক একক, যাকে দার্শনিক লাইবনিৎজ বলেছেন মোনাড, এই ব্যক্তি একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা, এবং সমাজ হল এই মোনাডদেরই এক সমাবেশ। অনেক সময় তাই বলা হয় ‘ব্যক্তি’ ও ‘সমাজ’-এর মধ্যে একটা বিরোধিতা আছে, ‘সমাজ’ এখানে যেন এক অ-মানবিক অবশেষ, যেখানে শুধু সংখ্যার স্বৈরাচার আছে, যদিও একমাত্র নৈতিক বাস্তব হল ব্যক্তি।

সাম্য এবং স্বাধীনতার আদর্শের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত এই মতবাদ অনেকে খুব সন্তোষজনক মনে করেন না, কারণ সমাজতত্ত্বের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, তা হল মানুষের সামাজিক সত্তা। এই সামাজিক সত্তার ধারণা স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তির ধারণার বিপরীত, এখানে মানুষ এক সমষ্টিগত মানবিকতা, যাকে আমরা সমাজ বলি, তার অঙ্গ। এই অর্থেই যুবক মার্কস একবার লিখেছিলেন, ‘আমার মধ্যে দিয়ে সমাজই চিন্তা করে’। ভূদেব যে-সমাজের কথা বলেছেন, সেই সমাজে ব্যক্তি নেই, সাম্য নেই, এই সমাজে সমষ্টিগত মানুষ আছে, মানুষের মধ্যে উচ্চ-নীচ সম্পর্কের বিন্যাস আছে। এই হল আমাদের সনাতন সমাজ এবং ভূদেব এই সমাজের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি প্রাচীন ভারতীয় সমাজকেই তাঁর আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং এই সমাজ অন্যান্য যেকোনো সমাজ থেকে কত উৎকৃষ্ট সেটা প্রমাণ করাই তাঁর সামাজিক প্রবন্ধ রচনার অন্যতম উদ্দেশ্য। ভূদেব এইভাবে এক জাতীয়তাবাদী ধারারও সূত্রপাত করেন, যার প্রভাব আজকের দিনেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। আমরা এই আলোচনায় বলেছি যে ভূদেবের আশঙ্কা ছিল যে, বিজাতীয় প্রভাবে আমাদের সমাজ, সংস্কার, আচার-আচরণ, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। শুধুমাত্র সামাজিক প্রবন্ধ ও আচার প্রবন্ধ প্রভৃতি গ্রন্থে তিনি যুক্তি ও বিজ্ঞানের দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করে সনাতন হিন্দুধর্ম, সমাজ, জীবন, পরিবার, আচার-অনুষ্ঠানকে যেমন সংরক্ষণ করতে চেয়েছেন, তেমনি তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করতে চেয়েছেন, সমসাময়িক কালে যুক্তিবাদের মাধ্যমে পশ্চিমের প্রবল অনুপ্রবেশ ঠেকাবার প্রচেষ্টা লক্ষ করি শশধর তর্কচূড়ামণি (১৮৫১–১৯২৮) ও কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন (১৮৪৯–১৯০২) প্রমুখের কার্যকলাপে, যাঁরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করে হিন্দুধর্মের সপক্ষে একটা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। শশধর, ভূদেব, এবং চন্দ্রনাথ বসু, যিনি ভূদেবকে তাঁর আচার্য মনে করতেন, জাতিভেদ প্রথার সমর্থনে এগিয়ে আসেন, শশধর মনে করতেন জাতিভেদ ঈশ্বর-আদিষ্ট, ভূদেবও জাতিভেদের সমর্থক কিন্তু আন্তঃপ্রাদেশিক সবর্ণ বিবাহের প্রতি তাঁর সমর্থন ছিল, আর হিন্দুর জাতিভেদের মধ্যেও চন্দ্রনাথ সমত্ববাদ ও মৈত্রীচেতনার প্রতিফলন লক্ষ করছিলেন। জ্ঞানেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন তখন ঐতিহ্যপন্থীরা সত্যই মনে করতেন ‘চতুর্দিকে ইউরোপীয় সভ্যতা ও সাহিত্যের গোলাগুলি ছুটিতেছে তাহাতে জাতিভেদ স্বরূপ দুর্গ হিন্দুসমাজের একমাত্র আশ্রয়, তাহার জীবন রক্ষার একমাত্র উপায়।’ তাই তিনি দুঃখ করে লিখেছিলেন, ‘জাতিভেদের প্রাণবায়ু চলিয়া গিয়াছে এখন আছে জাতিভেদের মৃতদেহ। . . . আমাদের দেশে ভূদেববাবু চন্দ্রবাবু প্রভৃতি স্বদেশপ্রেমিক মহাত্মাগণ জাতিভেদের মৃতদেহ স্কন্ধে করিয়া মহাদেবের ন্যায় নৃত্য করিতেছেন।’২১

ভূদেব নিজে যুক্তিবাদের প্রয়োগ করলেও, উপনিবেশের মানুষ যে যুক্তির ভুক্তভোগী তা-ও হয়তো ভূদেব বুঝতে পেরেছিলেন, আর তাই তিনি যুক্তিকে অতিক্রম করে এক বিকল্প বাস্তববিরোধী ইতিহাস রচনা করেছিলেন, স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস (১৮৯৫)। এই বইটিতে ভূদেব এক কাল্পনিক ইতিহাস রচনা করেছেন এই ভাবনা থেকে যে, তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে যদি মারাঠাশক্তি জয়ী হত তাহলে ভারতবর্ষের ইতিহাস কীরকম হত। অর্ধ-বাস্তব, অর্ধ-কাল্পনিক, অর্ধ-ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি মিলিয়ে তিনি তাঁর স্বপ্নের ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রকাশ করেছেন; তিনি স্বপ্ন দেখেছেন মহারাষ্ট্র শক্তির নেতৃত্বে ভারতের ঐক্য ও পুনরুত্থানের। তিনি কল্পনায় যে ভাবী হিন্দু সাম্রাজ্যকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন তার মূলে আছে তিনটি উপাদান : হিন্দুর পুনর্জাগরণ, হিন্দুর সাম্রাজ্য বিস্তার ও ব্রাহ্মণ্যত্বের উত্থান। বস্তুত, সামাজিক প্রবন্ধ গ্রন্থেও তিনি এই একই কথা বলেন আমাদের আলোচনায় আমরা তা দেখিয়েছি। এই কারণেই ভূদেব ভারতের জাতীয় স্বাস্থ্যের অবক্ষয় নিয়ে এত চিন্তিত ছিলেন, তিনি মনে করতেন বর্তমানকালে স্বল্প আহারের জন্য আমাদের শরীরের সমস্ত উপকরণের বিকৃতি ও অপকর্ষ ঘটেছে, অর্থাৎ ক্রমেই আমাদের জীবনীশক্তি কমে যাচ্ছে।২২ সামাজিক প্রবন্ধ বইটির শেষে ভূদেব ‘নেতৃ প্রতীক্ষা’ নামে একটি অধ্যায় লেখেন। এই অধ্যায়ে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন এমন এক মহান নেতার, যাঁর আবির্ভাব হবে আমাদের দেশে, যিনি জন্মাবেন আমাদেরই ঘরে। কাজেই দেশবাসীর পক্ষে একটা কর্তব্য ভূদেব নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যে, ‘আপনার গৃহকে সর্ব্বতোভাবে সেই আবির্ভাবোন্মুখ দেবতার পবিত্র মন্দিরের ন্যায় প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিতে হয়।’ [সা : ২৬০]। এই কারণেই তাঁর পারিবারিক প্রবন্ধ লেখা, তিনি পরিবার-জীবনের সংস্কারকে ধর্মীয় কর্তব্যের অঙ্গীকার করে দিয়েছিলেন। এর সঙ্গে যদি আচার প্রবন্ধ যোগ করি, তাহলে আমরা দেখব এই দু-টি বইয়ের মাধ্যমে ভূদেব নতুন করে বাঙালির ‘গৃহসূত্র’ রচনা করতে উদ্যোগী হয়েছেন, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শে।

টীকা ও সূত্রনির্দেশ

 ১. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পল্লী-সমাজ, শরৎসাহিত্য সমগ্র, অখণ্ড সংস্করণ (কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স, ১৩৯২), পৃ. ১৭৫।

 ২. ওই, পৃ. ১৪৪।

 ৩. ওই, পৃ. ১৬৪।

 ৪. The Shorter Oxford Dictionary, vol. 2 (Oxford : Clarendon Press, 1959), পৃ. ১৯৩৬।

 ৫. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব মুখোপাধ্যায় (কলিকাতা : বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, ১৩৮১), পৃ. ৬।

 ৬. শিক্ষাদর্পণ ও সংবাদসার। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ১২৭১ সালের বৈশাখ মাসে (১৮৬৪ এপ্রিল) এই মাসিক পত্রিকাটির জন্ম হয়। ১২৭৪ সালের পৌষসংখ্যা (৪র্থ ভাগ, ৯ম সংখ্যা) থেকে পত্রিকাটির নামকরণ হয় শিক্ষাদর্পণ ও মাসিক পত্রিকা। ১৮৬৮ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর থেকে ভূদেব Education Gazette পত্রিকার সম্পাদনভার গ্রহণ করেন। গেজেটের দ্বারা শিক্ষাদর্পণ-এর প্রয়োজন মিটেছিল। তাই বোধ হয় তিনি শিক্ষাদর্পণ প্রকাশ বন্ধ করে দেন। শিক্ষাদর্পণ ৫ম ভাগ, ১০ম সংখ্যা, মাঘ ১২৭৫ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল।

 ৭. Education Gazette ও সাপ্তাহিক বার্ত্তাবহ। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ৪ জুলাই ১৮৫৬ (২২ আষাঢ় ১২৬৩)। প্রথমে এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন প্যারীচরণ সরকার। ভূদেব এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন ১৮৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। তিনি দীর্ঘকাল পত্রিকাটির সম্পাদন করেন। সরকার ভূদেবকে পত্রিকার সর্বস্বত্ব দান করেছিলেন।

 ৮. মুকুন্দদেব মুখোপাধ্যায়, ভূদেব চরিত (চুঁচুড়া : কুমারদেব মুখোপাধ্যায় দ্বারা প্রকাশিত, ১৯১৭–২৭), ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪।

 ৯. ওই, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৪।

 ১০. টীকার সংখ্যা না বাড়াবার জন্য ভূদেবের লেখার উদ্ধৃতির সূত্রনির্দেশ রচনার মধ্যেই সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রথমে গ্রন্থের সংক্ষেপিত নাম এবং কোলন চিহ্নের পর পৃষ্ঠা সংখ্যা। সংক্ষেপিত নামগুুলি এইরকম : সা = সামাজিক প্রবন্ধ; পা = পারিবারিক প্রবন্ধ; আ = আচার প্রবন্ধ; বি১ = বিবিধ প্রবন্ধ, প্রথম ভাগ; বি২ = বিবিধ প্রবন্ধ, দ্বিতীয় ভাগ। উদ্ধৃতির পর তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে সূত্রনির্দেশ করা আছে। উদ্ধৃতিগুলি নেওয়া হয়েছে : ভূদেব মুখোপাধ্যায়, প্রবন্ধ সমগ্র (কলকাতা : চর্চাপদ, ২০১০) থেকে।

 ১১. Benedict Anderson, Imagined Communities (London : Verso, 2006).

 ১২. Partha Chatterjee, The Nation and Its Fragments : Colonial and Postcolonial Histories (Delhi : Oxford University Press, 1995).

 ১৩. জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী, ‘আলোচনা’, সামাজিক প্রবন্ধ (কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, ১৮৯১), পৃ. ১৬, ১৪।

 ১৪. পরিবার নিয়ে উনিশ ও বিশ শতকে নানাবিধ পত্রিকায় আলোচনার জন্য দেখুন : প্রদীপ বসু, সাময়িকী : পুরনো সাময়িকপত্রের প্রবন্ধ সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড : গৃহ ও পরিবার (কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০৯)।

 ১৫. দ্রষ্টব্য : সাময়িকী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬২১–৮০৮।

 ১৬. এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : প্রদীপ বসু, সাময়িকী : পুরনো সাময়িকপত্রের প্রবন্ধ সংকলন, প্রথম খণ্ড : বিজ্ঞান ও সমাজ (কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৮)।

 ১৭. ভারতের ভিলেজ কমিউনিটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : Pradip Kumar Bose, ‘Community in India : Continuity and Change’, N Jayram and R S Deshpande (ed.), Footprints of Development and Change : Essays in Memory of Professor VKRV Rao Commemorating His Birth Centenary (New Delhi : Academic Foundation, 2008).

 ১৮. দেখুন : Ashis Nandy, The Romance of the State (Delhi : Oxford University Press, 2003); The Intimate Enemy : Loss and Recovery of Self under Colonialism (Delhi : Oxford University Press, 1993).

 ১৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘স্বদেশী সমাজ’, রবীন্দ্র-রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড (কলিকাতা : বিশ্বভারতী, ১৩৯৩), পৃ. ৬২৭।

 ২০. Louis Dumont, Homo Hierarchicus : The Caste System and Its Implications (Delhi : Vikas, 1970).

 ২১. জ্ঞানেন্দ্রলাল রায়, প্রবন্ধ লহরী (কলিকাতা : ১৩০৩), পৃ. ১৬২।

 ২২. বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, প্রদীপ বসু, সাময়িকী, প্রথম খণ্ড।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন