রেলবাজার স্টেশন

তারাপদ রায়

রেলবাজার স্টেশন

ঘটনাটা ঘটেছিল মফসলের রেললাইনের একেবারে শেষ স্টেশনে।

শেষ স্টেশন মানে এর পরে আর রেললাইন নেই। এই পর্যন্ত রেলগাড়ি এসে তার যাত্রা শেষ হয়ে যায়, তারপর আবার ফিরে যায় বড় শহরে। রেল পরিভাষায় যাকে বলে আপ ট্রেন। এই লাইনে সেই আপ ট্রেনের এটাই শেষ স্টেশন।

আপাতত রচনার সুবিধের জন্যে ধরে নেওয়া যাক, আমাদের এই শেষ স্টেশনের নাম রেলবাজার। যদিও সত্যি সত্যি স্টেশনের নাম রেলবাজার নয়। কিন্তু স্টেশনের কাছে একটা বাজার আছে। সে থাকুক।

আমাদের এই সামান্য রম্যকাহিনির একজন নায়কও আছেন। আবার ধরে নেওয়া যাক তাঁর নাম রম্যনাথবাবু।

একদিন ভরদুপুরবেলায় রেলবাজার স্টেশনের একটি ট্রেনের কামরায় বসে আছেন রম্যনাথবাবু। ডাউন ট্রেনের গোড়ায় এবং আপ ট্রেনের শেষের এই স্টেশনে থাকেন রম্যনাথবাবু।

যেহেতু রেলবাজার একটু প্রত্যন্ত জায়গা, নিতান্ত খোলামেলা মফসল। এখানে লোকজন একটু আপন আপন, কাজকর্ম একটু ছুটছাট।

একটা বুড়ো মহানিমগাছের নীচে টিকেট কাউন্টার, সেই সঙ্গে ওয়েটিং রুম (গত এগারো বছর তালাবন্ধ), স্টেশন মাস্টারের ঘর এবং অন্যান্য যা কিছু।

রেলবাজার প্যাসেঞ্জার (আপ) দুপুর সাড়ে এগারোটায় আসে রেলবাজার স্টেশনে তারপর ফিরে যায় বারোটায়। এই দুপুর বারোটায় ফেরত ট্রেনে তেমন যাত্রী হয় না, অবশ্য এই স্টেশনে। ট্রেন ঢিলেঢালা ভাবে যায়।

তবে আজ রম্যনাথবাবু এই ট্রেনে উঠেছেন এবং এই গল্প তাঁকেই নিয়ে, সুতরাং তার জন্যই ট্রেন যাবে।

কিন্তু গোলমাল শুরু হল ট্রেন ছাড়ার পনেরো মিনিট আগে, ওই পৌনে বারোটায়।

 নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট আগেই ওই পৌনে বারোটা নাগাদ ট্রেনটা হুশহুশ করে যাত্রা শুরু করল। প্রায় খালি কামরায় সুবিধেমতো জানলার পাশে বসে রম্যনাথবাবু পনেরো মিনিট আগে গাড়ি ছাড়ায় যারপরনাই আনন্দিত হলেন। তার একটা কারণ মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি খবরের কাগজে একটা চিঠি দিয়েছিলেন, এবং কী আশ্চর্য সে চিঠি ছাপাও হয়েছিল। সে চিঠির বক্তব্য ছিল যে রেলবাজার স্টেশন অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান সেখানে থেকে কোনও প্যাসেঞ্জার গাড়ি ঠিক সময়ে ছাড়েও না পৌঁছয়ও না। সেখানে খুব অনাচার চলছে।

আজ নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট আগে ট্রেন ছাড়তে দেখে রম্যনাথবাবু খুবই আহ্লাদিত হলেন এবং এই ভেবে খুশি হলেন যে তাঁর চিঠি পড়ে রেল কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছে।

অবশ্য তার ভেবে দেখা উচিত ছিল কোনও ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট পূর্বে ছেড়ে যাওয়াও রীতিমতো অনাচার। বহু যাত্রী এর জন্যে বিনা কারণে, নিজেদের বিনা দোষে ট্রেনটি ফেল করবে।

কিন্তু আসল ঘটনা অন্য রকম।

ট্রেনটি ছাড়ল বটে পনেরো মিনিট আগে। কিন্তু প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে পঞ্চাশ-ষাট মিটার এগিয়ে হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। তারপর গাড়িটা ধীরে ধীরে ব্যাক করে প্ল্যাটফর্মে ফিরে এল। অনেক সময় বিশেষ কারণে রেলগাড়ি স্টেশন থেকে বেরিয়ে গিয়ে ফিরে আসে, হয়তো জরুরি মেরামতির প্রয়োজন কিংবা ফায়ারম্যান সাহেব আত্মহারা হয়ে প্ল্যাটফর্মে তাস খেলছিলেন সঙ্গীদের নিয়ে, খেয়াল করে ইঞ্জিনে ওঠেননি; আবার হয়তো এমনও হতে পারে শেষ মুহূর্তে গার্ডসাহেব তার টিফিনের বাক্সটি স্টেশন মাস্টারের ঘরে ফেলে এসেছেন। গার্ডসাহেবের স্ত্রীর হাতে গড়া রুটি আর আলু-চচ্চরি, সেই লোভনীয় খাদ্য উদ্ধার করার জন্যই ট্রেনটির প্রত্যাবর্তন।

এসব ক্ষেত্রে ট্রেনটি ফিরে এসে ত্রুটি সংশোধন করে সঙ্গে সঙ্গে রওনা হয়।

কিন্তু রেলবাজার স্টেশনের আজকের পৌনে বারোটার ট্রেনটি তা করল না। স্টেশনে ব্যাক করে ফিরে এসে আবার পঞ্চাশ-ষাট মিটার গিয়ে একটু থেমে পুনরায় ব্যাক করে প্ল্যাটফর্মে ফিরে এল।

এবং একবার দুবার নয়, এরকম পর পর সাতবার ঘটল, ট্রেনটি স্টেশন ছেড়ে সামান্য এগিয়ে গিয়ে, তারপর থেমে, তারপর ব্যাক করে স্টেশনে এসে, ক্রমাগত এগোনো আর পিছনে চলতে লাগল।

রম্যনাথবাবু লক্ষ করলেন ট্রেনটির গার্ডসাহেব, টিকেট চেকারসাহেব এমনকী রেলবাজার স্টেশনের স্টেশন মাস্টারমশায় পর্যন্ত গম্ভীর হয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনটির এগোনো পিছন পর্যবেক্ষণ করছেন, এবং মাঝেমধ্যেই গাড়িটির এবম্বিধ আচরণে হর্ষধ্বনি করছেন।

অবশেষে ধৈর্য, ওই যাকে বলে সহ্য করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেল রম্যনাথবাবুর। সপ্তমবারের পর। অষ্টমবার যখন ট্রেনটি ব্যাক করে আবার স্টেশনে প্রত্যাবর্তন করল রম্যনাথবাবু চিৎকার করে কর্কশ গলায় প্রশ্ন করলেন, স্টেশনে দণ্ডায়মান স্টেশন মাস্টারবাবু এবং অন্যান্য রেলকর্মচারীদের, এ কী রকম রেলগাড়ি মশায়? এটা কি ইয়ার্কি হচ্ছে আধ ঘণ্টা ধরে?

স্টেশন চত্বর থেকে গার্ডসাহেব জবাব দিলেন, মোটেই ইয়ার্কি নয়।

গার্ডসাহেবের কণ্ঠস্বর আর শোনা গেল না। ততক্ষণে ট্রেন আবার সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। তবু একটু পরেই ট্রেনটি স্টেশনে ব্যাক করে ফিরে আসতেই আগের উত্তরের খেই ধরে রম্যনাথবাবু জানলা দিয়ে মুখ বার করে গার্ডসাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়ার্কি নয়? এটা কি ছেলেখেলা নাকি? বারবার ছাড়ছে, ফিরে আসছে, ফিরে আসছে, ছাড়ছে।

এবার আর গার্ডসাহেব নয় স্বয়ং স্টেশন মাস্টার মশায় জবাব দিলেন, মোটেই ছেলেখেলা নয়। আমাদের রেলগাড়ির ড্রাইভারসাহেব তার ছেলেকে রেলগাড়ি চালানো শেখাচ্ছেন।

এর জবাবে হতভম্ব রম্যনাথবাবু কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন ততক্ষণে ট্রেনটা আবার হুশহুশ করে ছেড়ে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি ছুটে গার্ডসাহেব ও টিকেটসাহেবও ট্রেনটায় উঠে পড়লেন। ট্রেনটা সত্যিই ছাড়ল। ষাট মিটারের সীমা অতিক্রম করে রেলবাজার প্যাসেঞ্জার এতক্ষণে রওনা হল।

তবু রম্যনাথবাবুর মনে একটা খটকা রয়েছে। রেলগাড়িটা কে চালাচ্ছে, ড্রাইভারসাহেব না ড্রাইভারসাহেবের ছেলে?

সকল অধ্যায়

১. পঞ্চতন্ত্রের শেষ গল্প
২. খেজুরে গুড়ের সন্দেশ
৩. রেলবাজার স্টেশন
৪. চলন্তিকা
৫. জারিনা বিবি
৬. আরম্ভ
৭. মূল কাহিনি
৮. ব্লটিং পেপার
৯. ছোটসাহেব
১০. হন্তদন্ত
১১. ভাল খবর, খারাপ খবর
১২. হাস্যকর
১৩. সর্বাঙ্গসুন্দরের কবিতা
১৪. চেয়ার
১৫. মার্জার পুরাণ
১৬. কাঁঠালহাটির গল্প
১৭. গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি
১৮. লালমোহনের বিপদ
১৯. পটললালের বিপদ
২০. চর্মন্তুদ অথবা জুতো ও পটললাল
২১. বিবাহঘটিত
২২. একদা প্রভাতকালে
২৩. ফুটবল
২৪. রাঁধি মাছ না ছুঁই তেল
২৫. ছত্র বর্ধন
২৬. বিপদ ও তারাপদ
২৭. পটললাল, চলচ্চিত্র ও লেখক
২৮. অদূরভাষ
২৯. ধর্মাধর্ম
৩০. চাষির মুখে হাসি
৩১. বেশ-বেশ
৩২. ২৫০%
৩৩. একটি গল্পের নবজন্ম
৩৪. এখনই
৩৫. বইমেলায় পটলবাবু
৩৬. একটি পুস্তক সমালোচনা
৩৭. লক্ষ্মীর প্রত্যাবর্তন
৩৮. জটিলেশ্বর
৩৯. ডবল পটললাল
৪০. রোশনচৌকি
৪১. সুধানাথবাবু মন্ত্রী হলেন
৪২. ভাগলপুরের পাঞ্জাবি
৪৩. শেষ অশ্বারোহী
৪৪. স্বর্গের চাবি
৪৫. আরশোলা এবং নিদারুণ বার্তা
৪৬. একটি অখাদ্য গল্প
৪৭. একটি আদ্যোপান্ত দুর্ঘটনা
৪৮. গোরুর গল্প
৪৯. ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের চিঠি
৫০. আবহাওয়া
৫১. ঘুঘু কাহিনি
৫২. সাক্ষাৎকার
৫৩. ভজহরি চাকলাদার
৫৪. জয়াবতী ও জয়গোপালের কাহিনি
৫৫. নিরুদ্দেশ জানলা
৫৬. খদ্দের
৫৭. ভ্রমণকাহিনি
৫৮. লাথ্যৌষধি
৫৯. বাণেশ্বরের রোগমুক্তি
৬০. জীবনবাবুর পায়রা
৬১. মনোজ সান্যালের গল্প
৬২. ভজগোবিন্দ ভোজনালয়
৬৩. নবারুণবাবু সুখে থাকুন
৬৪. কণ্টকাকীর্ণ
৬৫. বেঁচে আছি
৬৬. সঞ্চয়িতা
৬৭. পুরনো পল্টন
৬৮. রেটটা একটু কমান
৬৯. গেঞ্জি
৭০. ভিখারি বিষয়ে
৭১. বইমেলা
৭২. পাদুকার বদলে
৭৩. নামাবলী
৭৪. পাপি সুইমিং স্কুল
৭৫. টমাটো সস
৭৬. গয়া ১৯২৪
৭৭. টাইপ-রাইটার
৭৮. দুই মাতালের গল্প
৭৯. মহামহিম
৮০. জয়দেবের জীবনযাত্রা
৮১. একদিন রাত্রে
৮২. কালমেঘ
৮৩. চশমা
৮৪. সার্জন সাহেবের বাড়িতে
৮৫. কবিতা ও ফুটবল
৮৬. এন-আর-আই
৮৭. গুপ্তপ্রসঙ্গ
৮৮. দাঁত
৮৯. একশো টাকার ভাঙানি
৯০. সান্যাল স্লিমিং
৯১. হাতে খড়ি
৯২. অন্য এক মাতালের গল্প
৯৩. অবসরের দিনলিপি
৯৪. বিমান কাহিনি
৯৫. শালিক ও শ্যালিকা
৯৬. তরমুজের বীজ
৯৭. টালিগঞ্জে পটললাল
৯৮. পটললাল ও মধুবালা
৯৯. নীল আলো
১০০. পাঁচ-পাঁচ
১০১. বেগুন, মোচা এবং কাফকা
১০২. হৃদয় ঘটিত
১০৩. অবিচ্ছিন্ন
১০৪. চিকিৎসা
১০৫. কে মারা যাচ্ছে?
১০৬. পটললাল ও মিস জুলেখা
১০৭. নিজেকে জানো
১০৮. ভাল-খারাপ
১০৯. ব্যাঙ
১১০. বরাহমিহিরের উপাখ্যান
১১১. বিবি এগারো বারো
১১২. হুঁকো
১১৩. ফুঃ
১১৪. স্বর্গের গল্প
১১৫. হরিনাথ ও হরিমতী
১১৬. জীবনযাপন
১১৭. ফুলকুমারী
১১৮. জতুগৃহ
১১৯. বিষ
১২০. বাঁচার মতো বাঁচা
১২১. নস্যি
১২২. ডিম
১২৩. এক প্রধানের গল্প
১২৪. আবগারীশ্বরী
১২৫. কাণ্ড-কারখানা
১২৬. আধকপালে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন