রোশনচৌকি

তারাপদ রায়

রোশনচৌকি

সত্তর বছর বয়েস কম কথা নয়। এই মাত্র গত মাসে সত্তর বছর পূর্ণ হল দিলীপকুমারের। পাঠক-পাঠিকা ভুল ভাববেন না। আমাদের গল্পের দিলীপকুমার কোনও চিত্রতারকা নন, নেহাতই আটপৌরে দিলীপকুমার চৌধুরী, নেহাতই আটপোরে বিপত্নীক ভদ্রলোক, অবসরপ্রাপ্ত রেলওয়ে। অফিসার।

দিলীপকুমারের স্ত্রী বিগত হয়েছেন অনেকদিন। এ বাসায় আসার কয়েকবছর আগে।

এ বাসায় মানে কলকাতা শহরের পূর্বপ্রান্তে জলাজমিতে গড়ে ওঠা নতুন শহরতলির বাসা। নোনা জলের হ্রদ বুজিয়ে তৈরি উপনগরী। বছর কয়েক আগে এখানেই বাসা বেঁধেছেন। দিলীপকুমার।

সরকারি জমি, তবে সরকারি আনুকূল্যে জমিটা পাননি দিলীপবাবু। জমিটা তিনি পেয়েছিলেন রীতিমতো একশো টাকার টিকিট কিনে লটারির মাধ্যমে নিতান্ত ভাগ্যবলে।

বাড়ির জমিটা বেশ ভাল। সোয়া তিন কাঠা। দক্ষিণমুখী বা পূর্বমুখী জমি পাননি। তবে এরকম খোলামেলা জায়গায় পূর্ব-দক্ষিণ ইত্যাদি কোনও ব্যাপার নয়, রোদ-হাওয়া সব বাড়িতেই প্রায় সমান সমান।

দিলীপবাবুদের ছোট গলিটা বড় রাস্তা থেকে বেরিয়ে দুপাশে দশ-দশটা প্লট পেরিয়ে একটা পার্কের দেয়াল পর্যন্ত এসেছে। সেখানেই শেষ, ইংরেজিতে যাকে বলে ব্লাইন্ড লেন।

এই ব্লাইন্ড লেনের শেষ প্লটটাতেই দিলীপবাবুর ছোট একতলা বাড়ি। সামনে এক চিলতে বাগান, দুপাশে দুটো নারকেল গাছ। পাশের পার্কের সুবিধেও যথেষ্ট পাওয়া যায়। পার্কে বিকেলের দিকে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা খেলা করে। বাকি সময় প্রায় ফাঁকাই থাকে।

শীতের সকালে খবরের কাগজ নিয়ে পার্কের রোদে গিয়ে বসেন দিলীপবাবু। আবার গরমের সন্ধ্যায় খোলা বাতাসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শরীর জুড়িয়ে নেন।

সবচেয়ে বড় কথা এদিকটায় শব্দদূষণ নেই। নেই বলাটা অবশ্য সঠিক হচ্ছে না, বলা উচিত শব্দদূষণ ছিল না।

.

এই শব্দ-দূষণের জন্যেই বালিগঞ্জের পুরনো পাড়া ছেড়ে কষ্ট করে জমি সংগ্রহ করে, কষ্ট করে বাড়ি তৈরি করে বুড়ো বয়েসে এতদূর চলে এসেছেন দিলীপবাবু।

ভাড়াবাড়ি ছিল সেটা। একতলায় বড় বড় তিনটি ঘর। উঠোন, উঠোনের একপাশে রান্নাঘর, অন্য পাশে কলঘর। বাবার আমল থেকে পঞ্চাশ বছর সে বাড়িতে বাস করেছেন দিলীপবাবু। পঁয়তাল্লিশ টাকা ভাড়া ছিল যখন ওই বাসায় বাবা ঢুকেছিলেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। বাড়তে বাড়তে শেষ পর্যন্ত আশি টাকা হয়েছিল। বাড়িওয়ালার কোথাও কেউ ছিল না। তার মৃত্যু হয়। সেও বছর পনেরো আগে। শেষের দিকে বাড়িভাড়ার টাকা নেওয়ার কেউ ছিল না। মৃত বাড়িওয়ালার দুই দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মধ্যে বাড়ি নিয়ে ঝগড়া, মারামারি, মামলা। শেষে বাড়িভাড়া আদালতে দিতে হত।

এমন চমৎকার ভাড়াবাড়ি ছেড়ে কেউ কষ্ট করে নিজের বানায়? কিন্তু দিলীপকুমার ভাড়াবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

না। বাড়িওয়ালা কোনও অত্যাচার করেননি। তিনি আর কী অত্যাচার করবেন, তিনি তো পরলোকে। আর তার জীবিত আত্মীয়দের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে ভাড়াটের ওপর ঝামেলা করার আর সময় ছিল না।

দিলীপবাবুকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল শব্দের অত্যাচারে। একালে যাকে শব্দদূষণ বলা হয় সেই শব্দদূষণের ভয়াবহ শিকার হয়েছিলেন তিনি।

ঘটনাটা বুঝিয়ে বলছি।

.

দিলীপবাবুরা থাকতেন পুরনো বালিগঞ্জে। হাজরা রোডের দক্ষিণ দিকে চোরাগোপ্তা, আঁকাবাঁকা অনেক গলি রয়েছে। তারই একটিতে একটা গলির তিনকোনাচে বাঁকা সস্তা ভাড়ায় ভালই ছিলেন বহুকাল। তবে এ রাস্তাগুলোকে আজকাল আর রাস্তা বলে চেনা যায় না। সবই মোটর গাড়ি সারানোর গ্যারেজ। বনেট খোলা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার মধ্যিখানে, চারদিকে গাড়ির টায়ারটিউব, যন্ত্রপাতি, গাড়ি সারানোর যন্ত্রপাতি। গাড়ি নিয়ে আজকাল এসব রাস্তায় প্রবেশ করা প্রায় অসম্ভব। পায়ে হেঁটে যাতায়াতও খুব সাবধানে করতে হয়।

তবুও একরকম কষ্ট করেই তিনমুখী মোড়ের একতলার সামনের ফ্ল্যাটে দিন কাটাচ্ছিলেন চৌধুরী পরিবার। মূল চৌধুরী অর্থাৎ দিলীপবাবুর বাবা কয়েক বছর আগে বিগত হয়েছেন, মা মারা গেছেন তারও আগে। এর মধ্যে পত্নীও বিগত হলেন।

একমাত্র ছেলে তখন বড় হচ্ছে। স্কুল পার হয়ে কলেজে পড়ছে। দিলীপবাবুরও চাকরি থেকে অবসরের দিন সমাগত। কোনওরকমে এই বাসায় শুধু কম ভাড়া আর বালিগঞ্জ পাড়ার মোহে দিনাতিপাত করছিলেন দিলীপবাবু।

কিন্তু শেষের দিকে এমন একটা অবস্থা দাঁড়াল যে এখানে থাকা অসহ্য হয়ে উঠল।

পাশের পাড়ার এক মিস্ত্রি ভদ্রলোক ঠিক উলটো দিকের বাড়ির গ্যারেজটা ভাড়া নিলেন। তিনি উত্তরপাড়ার মোটর কোম্পানিতে কাজ করেন, সেটা দিনের বেলা। অফিস থেকে ফিরে ঘণ্টা কয়েক ঘুমিয়ে তিনি তার গ্যারেজ তথা কর্মশালা খোলেন রাত এগারোটা নাগাদ।

ভদ্রলোক গাড়ির হর্ন সারানো এক্সপার্ট। মোটর কোম্পানিতে হর্ন-সারাই সেকশনে দীর্ঘকাল যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছেন, এ কাজে তার বিপুল অভিজ্ঞতা।

সেই অভিজ্ঞতার খেসারত দিতে হল পাড়া-প্রতিবেশীদের। খুব বেশি চাপ পড়ল ঠিক সামনাসামনি ফ্ল্যাটের আমাদের এই দিলীপবাবুর ওপরে।

রাত এগারোটার পর থেকে হর্ন খারাপ যত ট্যাক্সি আছে, সেগুলো সারাই হতে আসে এই গ্যারেজে।

খারাপ হর্ন বাজিয়ে কিংবা বাজানোর চেষ্টা করে প্রথমে দেখা হয় কী খারাপ হয়েছে, কতটা খারাপ হয়েছে। কোনও কোনও গাড়ির হর্ন এতটাই খারাপ হয়েছে যে একবার বাজতে শুরু করলে আর বন্ধ হতে চায় না। কোনওটা প্রহৃত জন্তুর মতো আর্তনাদ করতে থাকে।

আবার সারানোর পরেও ঝামেলা কম নয়। ড্রাইভারেরা বাজিয়ে বাজিয়ে পরীক্ষা করে নেয় কেমন সারানো হল।

এইরকম চলে রাত তিনটে-চারটে পর্যন্ত। প্রতিদিন বিনিদ্র রজনী যাপন করে, শব্দের অত্যাচারে জীবন ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল দিলীপকুমার চৌধুরীর।

ভাগ্যক্রমে এই সময়ে শহরতলির জমিটা পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। যথাসাধ্য দ্রুত ছোট একটা একতলা বাড়ি করে ভাড়াটে বাড়ির লোভ বিসর্জন দিয়ে চলে এলেন।

সাড়ে তিনখানা ঘরের ছোট বাড়ি। কিন্তু তাতে দিলীপবাবুর কোনও অসুবিধে নেই, তাঁর সংসারও ছোট। বছর আড়াই আগে এ বাড়িতে এসে ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। গত বছরে বউমা একসঙ্গে দুটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। এই দুজনকে ধরে ছেলে, ছেলের বউ আর তিনি সবসুদ্ধ এই পাঁচজনের সংসার।

বাড়িটা ছোট করা হয়েছে বলে পাশে এক চিলতে জমি কঁকা আছে। সেখানে নানা জাতের দিশি ফুলগাছ লাগিয়েছেন, জবা, টগর, গন্ধরাজ, কামিনী এই সব চেনা গাছ। এ কয় বছরে গাছগুলো বড় হয়েছে, আজকাল বেলফুল আসছে।

এ ছাড়া দুটো গাছ একা একাই জন্মেছে। তার একটা পেয়ারা অন্যটা আমগাছ। গাছ দুটো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। পেয়ারা গাছটায় এর মধ্যেই ফল ধরতে শুরু করেছে।

সব মিলিয়ে এ বাড়িতে বেশ ভাল আছেন দিলীপবাবু। নাতি দুটো সাড়ে দশ মাস বয়েস হল। তারা সারাদিন ঘরের মধ্যে হামাগুড়ির প্রতিযোগিতা দিচ্ছে। কখনও টলমল হাঁটার চেষ্টা করছে। পড়ে যাচ্ছে, কাঁদছে। এটা ছিঁড়ছে, ওটা ভাঙছে।

 বউমা গৃহকর্মনিপুণা। শ্বশুরের যত্ন নেয়। স্বামীর সঙ্গেও বেশ বনিবনা আছে।

সবচেয়ে বড় কথা, বড় আরাম এই বাড়িতে কারণ এখানে শব্দের যন্ত্রণা নেই। অন্তত এতদিন পর্যন্ত ছিল না। সেই পুরনো পাড়ায় মোটর গাড়ির হর্ন-তাড়িত বিভীষিকাময় রাত্রিগুলি এখন দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়।

এ পাড়ায়, কয়েক বছর আগে যখন প্রথম এসেছিলেন দিলীপকুমার চৌধুরী, কারওই কোনও গাড়ি ছিল না। দুয়েকজনের অফিসের গাড়ি আসত, নিয়ে যাওয়া দিয়ে-যাওয়ার জন্যে। কখনও কখনও কোনও বাড়িতে, দিলীপবাবুর বাড়িতেও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আসত। কিন্তু সে তো স্বাভাবিক ব্যাপার। শ্রবণেন্দ্রিয়ের কোনও অত্যাচার হত না।

তবে এ বয়েসে যেমন হয়ে থাকে, আজ কয়েক মাস হল সঁতের যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন দিলীপবাবু। কখনও এ মাড়ির দাঁত যন্ত্রণায় কাতর করে তোলে, কখনও ও মাড়ি ফুলে যায়। চোয়ালের নীচ পর্যন্ত টনটন করে। কখনও ওপরের পাটির দাঁত কষ্ট দেয়, কখনও নীচের পাটির ক্ষয়ে যাওয়া, ভাঙা দাঁতের ধারে জিব ছড়ে ঘায়ের মতো হয়ে যায়। জিবে ব্যথা হয়, ঝাল কিছু খেতে গেলে জ্বালা করে।

অবশেষে দন্তচিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে দিলীপবাবু সব কয়টি দাঁতই তুলে ফেলেছেন। কয়েকদিন ফোকলা দাতে থাকার শিশুসুলভ আরাম অনুভব করার পরে দাঁতজোড়া বাঁধিয়ে নিয়েছেন। তেমন ফিট করেনি।

প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হত। দুয়েকবার দাঁত ব্যথাও হয়েছে। এখন প্রায় সয়ে এসেছে।

.

নাতি-অন্ত-প্রাণ দিলীপবাবুর।

সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে সন্ধ্যায় শিশুদুটি না ঘুমানো পর্যন্ত তিনি তাদের আগলে রাখেন। অপত্য স্নেহমাধুর্যে অবসরপ্রাপ্ত শূন্য জীবনের বিলম্বিত সময় চমৎকার উতরিয়ে যায়।

সাড়ে দশ মাস বয়েস হলেও নাতি দুটোর এখনও অন্নপ্রাশন হয়নি। মুখেভাত বা অন্নপ্রাশনের নিয়ম একেক পরিবারে একেক রকম। কোথাও চার মাসে বা ছয় মাসে মুখেভাত হয়, কোনও বাড়িতে আট মাসে, অনেক জায়গায় দশ মাসেও শিশুর অন্নপ্রাশন হয়। কিন্তু গোকুলপুরের চৌধুরীদের মানে দিলীপবাবুদের পরিবারে এগারো মাসে অন্নপ্রাশনের বিধি। কবে কোন দূর অতীতকালে চৌধুরীবাড়ির শিশুগুলি জন্মানোর পরে আট-দশ মাস বয়েস হতে না হতে পট-পটাৎ করে মরে যেত। তাই এই সতর্কতা, এগারো মাস পর্যন্ত না দেখে এই বংশের বাচ্চাদের অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান করা হয় না।

তা কুসংস্কারের মুখে ছাই দিয়ে দিলীপবাবুর পৌত্রদ্বয় এগারো মাস বয়েসের কাছে সজ্ঞানে, সুস্থ শরীরে পৌঁছে গেছে। এবার তাদের অন্নপ্রাশন দিতে হয়।

নাতি দুটির দিলীপকুমার নামকরণ করেছেন রাম-শ্যাম। সেই কতকাল আগে একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিলেন, রাম ঔর শ্যাম। দুই যমজ ভাইয়ের গল্প। সেই অনুসারে নাতিদের এই নামকরণ, তা বলা যাবে না তা নয়। তবে এর মধ্যে সাবেকি ব্যাপারও আছে। একজন সত্তর বছরের বৃদ্ধের ঈশ্বরভক্তি শুধু নয়, প্রাচীন নামের প্রতি দুর্বলতাও এর মধ্যে জড়িত।

দিলীপকুমার বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি জানেন পিতামহ-প্রদত্ত এই নাম দুটি টিকবে না, এই নাম দুটির পরমায়ু পিতামহের আয়ু পর্যন্ত। ইতিমধ্যেই মামার বাড়ি থেকে শিশুদুটির নামকরণ হয়ে গেছে, লালকমল আর নীলকমল। যতদূর মনে হয় দিলীপকুমার, শেষ পর্যন্ত এই দুটো নামই বহাল থাকবে। আজকাল এই রকম লম্বা নাম খুব চলছে।

.

এসব নিয়ে দুঃখ নেই দিলীপবাবুর।

পাঁজিতে একটা ভাল দিন পাওয়া গেছে। পুরুতমশায়ের সঙ্গে কথাও হয়েছে। সামনের মাসেই রাম-শ্যামের অন্নপ্রাশনের তারিখ ধার্য করেছেন।

নিমন্ত্রণপত্র অবশ্য ছাপতে দেননি। মুদ্রিত পত্রের চেয়ে হাতে লেখা চিঠির আবেদন ও দাবি বেশি। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে আর বিজয়া দশমীতে ডাকঘর থেকে গোছাগোছা পোস্টকার্ড কিনে আনেন, তার অনেকটাই পড়ে থাকে। যত দিন যাচ্ছে চিঠি দেয়ার লোক তত কমে যাচ্ছে।

এখন বছর বছর পোস্টকার্ডের দাম বেড়ে যাচ্ছে। একদিন যে পোস্টকার্ডের দাম ছিল পুরনো দুপয়সা, তিন পয়সা, এখন সেই দাম আট-দশ গুণ হয়ে গেছে।

এসব পুরনো পোস্টকার্ড এইবার ব্যবহার করলে অনেকটা লাভ হবে ভেবেছিলেন দিলীপবাবু, কিন্তু সে গুড়ে বালি। ডাকঘর থেকে জেনে এলেন তিনি, পুরনো পোস্টকার্ড ব্যবহারে আপত্তি নেই কিন্তু এখনকার মাসুলের সমপরিমাণ স্ট্যাম্প লাগাতে হবে।

তা দিলীপবাবু কৃপণ ব্যক্তি নন, বিশেষ করে নাতিদ্বয়ের অন্নপ্রাশনের ব্যাপারে কোনও কার্পণ্য তিনি করবেন না। এমনকী তিনি এও ঠিক করেছেন যে অন্নপ্রাশনের দিন সকাল থেকে বাড়িতে রোশনচৌকি বসাবেন।

রোশনচৌকি, সানাই-ঢোলকঁসির সমন্বয়ে বাদ্যতান, রক্তমাংসের সব বাজনদার। আজকাল উৎসবে-অনুষ্ঠানে এদের আর দেখাই যায় না। দিলীপবাবুর বিশেষ ইচ্ছা এই রোশনচৌকি, নাতিদের অন্নপ্রাশনে যেখান থেকে তোক নিয়ে আসতে হবে।

রোশনচৌকি নিয়েই এই গল্প। সে প্রসঙ্গ অবশেষে আসবে।

আপাতত দৈনিক পনেরো-বিশটা পোস্টকার্ড নিজের হাতে লিখে আত্মীয়-বান্ধবদের পাঠাচ্ছেন যুগোপযোগী ডাকমাসুল সমেত। যেমন হয়, পৌত্রদ্বয়ের অন্নপ্রাশনের দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। এই আনন্দ-উত্তেজনার মধ্যে দুটি জিনিস দিলীপকুমারকে পীড়িত করছে।

প্রথমটি হল তার দাঁত।

 নতুন দাঁতজোড়া একেক সময় খুব কষ্ট দিচ্ছে। কাল সকালেই একটা ব্যাপার হয়েছিল।

প্রত্যহ সকালে হাত-মুখ ধুয়ে তজোড়া মুখে পরে চা খেতে খেতে এবং খবরের কাগজ পড়তে পড়তে নাতিদের কাছে ডাকেন দিলীপকুমার, রামশ্যাম, রামশ্যাম।

রাম-শ্যাম তখন যেখানেই থাকুক, তারা নিয়মিত অভ্যাস মতো এই ডাকের অপেক্ষা করে। ঠাকুরদার ডাক শোনামাত্র তারা দ্রুত হামা দিয়ে কিংবা টলমল পায়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ছুটে আসে।

আজ সকালেও অনুরূপভাবে রামশ্যাম, রামশ্যাম বলে নাতিদের ডাকলেন। তারা কাছেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল।

 কিন্তু দাঁতের পাটি জোড়া আজ খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে, মুখের মধ্যে ভাল বসেনি, নীচের পার্টিটা তো জিবকে চেপে ধরেছে আর ওপরের পাটি আর টাকরার মধ্যে বেশ খানিকটা ফাঁক।

তার চেয়েও বড় কথা, তিনি ডাকলেন, রামশ্যাম শোনাল যেন মরা মশা। পরীক্ষা করার জন্যে নাতিরা সামনে আসার পরেও তিনি আরও দুবার রামশ্যাম করে ডাকলেন, দুবারই শোনাল মরা মশা-মরা মশা। রাম আর শ্যাম শব্দ দুটো একেবারে উলটে গেছে।

রান্নাঘরে পুত্রবধূ কাজে ব্যস্ত থাকে এই সময়। এই বিপরীত উচ্চারণ তার কানে পৌঁছায়নি। কিন্তু দিলীপবাবু দ্বিতীয় দফায় রামশ্যামকে ডাক দেওয়ায় ভাবল, রামশ্যাম দাদুর কাছে যায়নি নাকি? কোথায় গেল?

সে রান্নাঘর থেকে শ্বশুরের ঘরে ছুটে এল, এসে দেখে নিশ্চিত হল রামশ্যাম সঠিক জায়গাতেই এসেছে। দাদুর খবরের কাগজের ক্রোড়পত্রটি মেজের ওপরে নিয়ে দুজনে ছিঁড়ে কুটিকুটি করছে। মূল কাগজটা অবশ্য বহুকষ্টে বাঁচিয়ে দিলীপবাবু উঁচু করে পড়ছেন।

বউমাকে দেখে খবরের কাগজটা মুখের সামনে থেকে সরালেন। রামশ্যামের মা শ্বশুরমশায়ের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে, মুচকি হাসি শাড়ির আঁচলে চাপা দিয়ে বলল, বাবা বোধহয় দাঁত জোড়া উলটো করে পরেছেন। এই বলে রান্নাঘরে যথাস্থানে প্রত্যাবর্তন করল।

বউমা চলে যেতে দাঁতজোড়া খুলে দিলীপকুমার দেখলেন বউমার কথাই ঠিক। এবং এটাও বুঝতে পারলেন এই ওলটানো সঁতের জন্যেই শব্দগুলো মুখ থেকে উলটো হয়ে বেরিয়েছে। তাড়াতাড়ি ঠিকমতো লাগিয়ে নিলেন এখন আর অস্বস্তি নেই, ব্যথা করছে না।

কিন্তু কেন এমন হল?

দিলীবাবু চিন্তা করে দেখলেন একটু আগে দাঁত লাগানোর সময় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন।

 তিনি যখন দাঁতজোড়া মুখে লাগাতে যাচ্ছেন সেই সময় একটা টেলিফোন এল। এত সকালবেলার টেলিফোনে অনেক সময় গোলমেলে খবর, দুঃসংবাদ আসে। তিনি ছুটে গিয়ে টেলিফোনটা ধরলেন, তখনও ফোনটা বাজছে আবার ডায়াল টোনও শোনা যাচ্ছে।

সেই সময় দিলীপবাবু দেখতে পেলেন, মোড়ের দিকের একটা বাড়ির নতুন গাড়িটা ব্যাক। করছে। আর সেই গাড়ি থেকেই এই শব্দ একটু বিলম্বিত লয়ে এবং উচ্চ গ্রামে নির্গত হচ্ছে। ধুত্তোরি বলে তিনি টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন। সেই সময়েই দাঁত লাগানোর এই অঘটনটা ঘটেছে।

এ গলিতে কোনও গাড়ি ঢুকলে বেরোতে গেলে গলির শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ দিলীপবাবুর বাড়ির কাছে এসে ব্যাক করে বেরোতে হয়।

এই সেদিন পর্যন্ত এ গলিতে একটাও গাড়ি ছিল না। অথচ গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এ পাড়ার বাসিন্দারা অন্তত তিন-চারটে নতুন গাড়ি কিনেছে এবং প্রত্যেকটি গাড়িই ব্যাক করার সময় কোনও-না-কোনও রকম ধ্বনিমাধুর্য রচনা করে। একটিতে নূপুর নিক্কন শোনা যায়, একটিতে বেহাগের সুর, অন্য একটি রীতিমতো ঢাক-ঢোল বাজায়। টেলিফোন বা সাইরেনের বাজনা তো আছেই। একসঙ্গে একাধিক গাড়ি ব্যাক করলে একটা ঐকতান, বিরল সুরের মূর্ধনা তৈরি হয়। ব্যাক করার সময় কখনও কখনও দুর্ঘটনা ঘটে, পথচারী বুঝতে না পেরে চাপা পড়ে। তাদের সতর্ক করে দেওয়াই বোধ হয় এসব গান-বাজনার উদ্দেশ্য।

জীবনের বেশ কয়েক বছর গাড়ির হর্নের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হতে হয়েছিল দিলীপবাবুকে। এখনও সে বিভীষিকার ঘোর কাটেনি। তবে এখনকার অবস্থাটা এখনও বিভীষিকার পর্যায়ে যায়নি।

এদিকে রামশ্যাম পিতামহের খাটের নীচ থেকে তার চটি জোড়া বার করে নিবিষ্ট চিত্তে, মনের আনন্দে দুজনে দুটো চটি চিবোচ্ছে। তাদের মুখ থেকে সে দুটো ছাড়িয়ে ভাল করে তাদের মুখ ধুইয়ে দিলীপকুমার ভাবতে লাগলেন, এদের তো অন্নপ্রাশন এসে গেল।

রোশনচৌকির ব্যবস্থা এখনও হয়নি। ব্যান্ড পার্টি, সানাই এসবের খোঁজ পাওয়া যায় কিন্তু রোশনচৌকির খোঁজ কেউ দিতে পারে না। দূরসম্পর্কের এক তালেবর শ্যালক বলেছিল, বৈদ্যবাটি শেওড়াফুলি, কোথায় যেন রোশনচৌকির দল আছে, সে খোঁজ করবে। সেই শ্যালক গতকালই এসে বলে গেছে তারা উত্তরবঙ্গে কোথায় লোক উৎসবে গেছে। আসাম হয়ে ফিরবে অন্তত দুমাস পরে।

কিন্তু অন্নপ্রাশন তো পিছোনো যাবে না। কুলাচার বলে কথা তা ছাড়া পৌত্রদ্বয় এর মধ্যে চটি চিবোনো শুরু করেছে, এদের এখনই ভাত ধরানো দরকার।

.

সহসা দিলীপবাবুর চিন্তাজাল ছিন্ন হল কীর্তনের সুরে। আরেকটি গাড়ি ব্যাক করছে। একেবারে নতুন গাড়ি, আজকালের মধ্যে কেনা। প্রতিবেশীদেরই কারও হবে।

কীর্তনের সুরে গাড়ির ব্যাক করা দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা আশ্চর্য বুদ্ধি ঝিলিক দিয়ে গেল দিলীপবাবুর মাথায়।

রোশনচৌকির দরকার কী? এই সব গাড়ি ব্যবহার করলেই হয়।

সেদিনই সন্ধ্যায় করিৎকর্মা দিলীপবাবু নতুন গাড়ি কেনা প্রতিবেশীদের বাড়িতে গেলেন। নাতিদের অন্নপ্রাশনের কথা বললেন, নিমন্ত্রণ করলেন। তারপর অন্নপ্রাশনের দিন সকালবেলা দুঘণ্টা এবং সন্ধ্যায় তিন ঘণ্টার জন্যে তাঁদের গাড়িগুলি চাইলেন।

উৎসবে-অনুষ্ঠানে প্রয়োজনবশত আত্মীয়, প্রতিবেশীর কাছে লোকে এমন গাড়ি চায়। সবাই রাজি না হলেও দু-তিনজন রাজি হলেন। শুধু একজন জিজ্ঞাসা করলেন, কতদূর যাবে?

ব্যাপারটা না ভেঙে দিলীপবাবু বললেন, এই কাছেই। বলতে গেলে পাড়ার মধ্যেই।

রোশনচৌকির বন্দোবস্ত হয়ে গেল। হৃষ্টচিত্তে প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করে দিলীপবাবু বাড়ি ফিরে এলেন।

.

আমিও দিলীপবাবুর একজন প্রতিবেশী। একই গলিতে থাকি। নতুন-পুরনো কোনও রকম গাড়িই আমার নেই। কিন্তু দিলীপবাবু আমাকে ভালবাসেন, পছন্দ করেন। রাতের দিকে এসে আমাকেও নিমন্ত্রণ করে গেলেন। অনেকক্ষণ বসলেন। অনেক কথা বললেন। তার মধ্যে এই গল্পের ঘটনাটি রয়েছে। গল্পের খাতিরে কিছু হেঁটেছি, কিছু জুড়েছি।

এখন অপেক্ষা করছি, রাম-শ্যামের শুভ অন্নপ্রাশনের দিনের জন্যে। না, ভুরিভোজনের লোভে নয়। গাড়িগুলির রোশনচৌকি কেমন জমজমাট হয়, গাড়ির মালিকেরা তাদের নতুন মোটর গাড়ির বাদ্যযন্ত্রে পরিণত হওয়ার ব্যাপারটা কেমন ভাবে গ্রহণ করেন–সেসব ব্যাপার তো থাকছেই।

তা ছাড়া দিলীপবাবুর পরিকল্পনা যদি সামান্য মাত্রও সফল হয়, সিনেমা-থিয়েটার-দূরদর্শনের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যাকে বাংলায় বলে নেপথ্য সংগীত, তার বন্দোবস্ত, এমনকী আবহসংগীতের বন্দোবস্তও অতঃপর কয়েকটি সংগীতময় গাড়ি পর পর ব্যাক করিয়ে করা যাবে।

দিলীপবাবু রাজি হলে তার সঙ্গে যুগ্মভাবে আমি এই বাজনার পেটেন্ট নেব এবং সেই। পেটেন্টের নাম দেব রোশনচৌকি।

সকল অধ্যায়

১. পঞ্চতন্ত্রের শেষ গল্প
২. খেজুরে গুড়ের সন্দেশ
৩. রেলবাজার স্টেশন
৪. চলন্তিকা
৫. জারিনা বিবি
৬. আরম্ভ
৭. মূল কাহিনি
৮. ব্লটিং পেপার
৯. ছোটসাহেব
১০. হন্তদন্ত
১১. ভাল খবর, খারাপ খবর
১২. হাস্যকর
১৩. সর্বাঙ্গসুন্দরের কবিতা
১৪. চেয়ার
১৫. মার্জার পুরাণ
১৬. কাঁঠালহাটির গল্প
১৭. গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি
১৮. লালমোহনের বিপদ
১৯. পটললালের বিপদ
২০. চর্মন্তুদ অথবা জুতো ও পটললাল
২১. বিবাহঘটিত
২২. একদা প্রভাতকালে
২৩. ফুটবল
২৪. রাঁধি মাছ না ছুঁই তেল
২৫. ছত্র বর্ধন
২৬. বিপদ ও তারাপদ
২৭. পটললাল, চলচ্চিত্র ও লেখক
২৮. অদূরভাষ
২৯. ধর্মাধর্ম
৩০. চাষির মুখে হাসি
৩১. বেশ-বেশ
৩২. ২৫০%
৩৩. একটি গল্পের নবজন্ম
৩৪. এখনই
৩৫. বইমেলায় পটলবাবু
৩৬. একটি পুস্তক সমালোচনা
৩৭. লক্ষ্মীর প্রত্যাবর্তন
৩৮. জটিলেশ্বর
৩৯. ডবল পটললাল
৪০. রোশনচৌকি
৪১. সুধানাথবাবু মন্ত্রী হলেন
৪২. ভাগলপুরের পাঞ্জাবি
৪৩. শেষ অশ্বারোহী
৪৪. স্বর্গের চাবি
৪৫. আরশোলা এবং নিদারুণ বার্তা
৪৬. একটি অখাদ্য গল্প
৪৭. একটি আদ্যোপান্ত দুর্ঘটনা
৪৮. গোরুর গল্প
৪৯. ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের চিঠি
৫০. আবহাওয়া
৫১. ঘুঘু কাহিনি
৫২. সাক্ষাৎকার
৫৩. ভজহরি চাকলাদার
৫৪. জয়াবতী ও জয়গোপালের কাহিনি
৫৫. নিরুদ্দেশ জানলা
৫৬. খদ্দের
৫৭. ভ্রমণকাহিনি
৫৮. লাথ্যৌষধি
৫৯. বাণেশ্বরের রোগমুক্তি
৬০. জীবনবাবুর পায়রা
৬১. মনোজ সান্যালের গল্প
৬২. ভজগোবিন্দ ভোজনালয়
৬৩. নবারুণবাবু সুখে থাকুন
৬৪. কণ্টকাকীর্ণ
৬৫. বেঁচে আছি
৬৬. সঞ্চয়িতা
৬৭. পুরনো পল্টন
৬৮. রেটটা একটু কমান
৬৯. গেঞ্জি
৭০. ভিখারি বিষয়ে
৭১. বইমেলা
৭২. পাদুকার বদলে
৭৩. নামাবলী
৭৪. পাপি সুইমিং স্কুল
৭৫. টমাটো সস
৭৬. গয়া ১৯২৪
৭৭. টাইপ-রাইটার
৭৮. দুই মাতালের গল্প
৭৯. মহামহিম
৮০. জয়দেবের জীবনযাত্রা
৮১. একদিন রাত্রে
৮২. কালমেঘ
৮৩. চশমা
৮৪. সার্জন সাহেবের বাড়িতে
৮৫. কবিতা ও ফুটবল
৮৬. এন-আর-আই
৮৭. গুপ্তপ্রসঙ্গ
৮৮. দাঁত
৮৯. একশো টাকার ভাঙানি
৯০. সান্যাল স্লিমিং
৯১. হাতে খড়ি
৯২. অন্য এক মাতালের গল্প
৯৩. অবসরের দিনলিপি
৯৪. বিমান কাহিনি
৯৫. শালিক ও শ্যালিকা
৯৬. তরমুজের বীজ
৯৭. টালিগঞ্জে পটললাল
৯৮. পটললাল ও মধুবালা
৯৯. নীল আলো
১০০. পাঁচ-পাঁচ
১০১. বেগুন, মোচা এবং কাফকা
১০২. হৃদয় ঘটিত
১০৩. অবিচ্ছিন্ন
১০৪. চিকিৎসা
১০৫. কে মারা যাচ্ছে?
১০৬. পটললাল ও মিস জুলেখা
১০৭. নিজেকে জানো
১০৮. ভাল-খারাপ
১০৯. ব্যাঙ
১১০. বরাহমিহিরের উপাখ্যান
১১১. বিবি এগারো বারো
১১২. হুঁকো
১১৩. ফুঃ
১১৪. স্বর্গের গল্প
১১৫. হরিনাথ ও হরিমতী
১১৬. জীবনযাপন
১১৭. ফুলকুমারী
১১৮. জতুগৃহ
১১৯. বিষ
১২০. বাঁচার মতো বাঁচা
১২১. নস্যি
১২২. ডিম
১২৩. এক প্রধানের গল্প
১২৪. আবগারীশ্বরী
১২৫. কাণ্ড-কারখানা
১২৬. আধকপালে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন