আরশোলা এবং নিদারুণ বার্তা

তারাপদ রায়

আরশোলা এবং নিদারুণ বার্তা

রুদ্রনারায়ণ আচার্য মহাশয় বিভাগপূর্ব বঙ্গদেশের এমন একটি জেলায় বাস করিতেন যেখানে আরশোলাকে তেলাচোরা বলা হইয়া থাকে। আরশোলাই আমাদের বর্তমান গল্পের বিষয়বস্তু। তাই পূর্বাহ্নে কিঞ্চিৎ ভূমিকা করিয়া লইতে হইতেছে।

প্রথমে আচার্য মহাশয়ের পরিচয় প্রদান আবশ্যক। দেশে আচার্য মহাশয়ের বিরাট নারিকেল এবং সুপারি বাগান ছিল। নারিকেল এবং সুপারি বাগানের সুবিধা এই যে, এই প্রকার ফসল বৎসর বৎসর চাষ করিতে হয় না। কোনও পরিশ্রম নাই, লবণাক্ত মাটির আর্দসৌজন্যে অপর্যাপ্ত ফলন হয় এবং যথাকালে শুকাইয়া মাটিতে পড়ে। কোনও এক পরিশ্রমী পূর্বপুরুষের কল্যাণে বৎসর বৎসর পায়ের উপর পা তুলিয়া বংশধরদের চলিয়া যায়। যাহা কিছু পরিশ্রম বা অর্থব্যয় এই ফসলগুলি পাড়িয়া নামাইবার।

আচার্য মহাশয় অতিশয় বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। এইনামাইবার জন্যও তিনি কোনও রূপ পরিশ্রম বা তোক নিয়োগ করিতেন না। যতদিন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কার্যকরী আছে, শুকাইয়া বুনা হইলে, নারিকেল-সুপারি আপন আগ্রহেই ভূমিতলে খসিয়া পড়িবে, তাহার জন্য অপব্যয় করা একান্তই নিরর্থক।

এই সময়ে একবার তাঁহাকে আয়কর কমিশনের সঙ্গে দেখা করিতে হয়। আবেদন ছিল, এবার আয় ভাল হয় নাই, কিছু আয়কর পরবর্তী বৎসরে প্রদানের অনুমতি দেওয়া হউক। আয়কর সাহেব দেখিলেন, লোকটি আয়কর কমাইতে বলিতেছে না, শুধু সময় চাহিতেছে, কী মনে হইল, প্রশ্ন করিলেন, তোমার ফসল কম হলে আয়কর কম হবে, তুমি সময় চাও কেন, আয়কর কমাবার জন্য প্রার্থনা করো।

আচার্য মহাশয় ঘাড় চুলকাইয়া বলিলেন, ফসল ঠিক কম হয়েছে তা নয়, তবে এবার হাওয়া বড় কম।

সাহেব অবাক, হাওয়া কম!

আজ্ঞে হ্যাঁ, আচার্য মহাশয় জানাইলেন, এই হাওয়া লেগে শুকনো নারকেল-সুপারি মাটিতে পড়ে, এবার সেটা একটু কম পড়ছে।

ইহার পরে কী হইয়াছিল তাহা এই কাহিনির বিষয় নহে, তবে এই একটি প্রাক্তন ঘটনার উল্লেখ এইজন্য করিলাম যে, ইহাতে শ্রীযুক্ত রুদ্রনারায়ণ আচার্যের সম্পর্কে কিছু ধারণা করা সম্ভব হইতে পারে।

দেশ বিভাগের পরে আচার্য মহাশয় প্রথমেই কলিকাতায় চলিয়া আসেন। এই সময়েই টালিগঞ্জ থানার অফিস ঘরে তাহার সঙ্গে আমার আলাপ হয়।

আমরা ছাদে কাপড় মেলিয়া দিলে বিকালে যখন শুকাইয়া যাইত তখন আমাদের পরবর্তী প্রতিবেশী গোপনে সেগুলি একটি হোসপাইপ দিয়া ভিজাইয়া দিতেন। ইহাতে বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হইত। এবং প্রথম প্রথম সবই সহ্য করিতাম, বস্তুত বুঝিতেই পারিতাম না কেন আমাদের বস্ত্রাদি সারাদিনের রৌদ্রে শুকাইত না। অবশেষে একদিন আমার কনিষ্ঠ ভাগিনেয় মাতুলালয়ে বেড়াইতে আসিয়া নিকট প্রতিবেশীর এরূপ গর্হিত কার্য আবিষ্কার করিয়া ফেলে। আমরা উপায়ান্তর না দেখিয়া প্রতিদিন রাত্রে পাঁচফোড়নের তরকারি খাইতে লাগিলাম। সায়াহ্নবেলায় যখন প্রতিবেশীদের বাড়িতে সংগীতশিক্ষক আসিতেন, সেই সময়ে তিনি যে ঘরে বসিয়া সংগীত শিক্ষাদান করিতেন সেইমুখী আমাদের বারান্দায় যথাসমারোহে পাঁচফোড়নের ব্যঞ্জন প্রস্তুত করা হইত। ব্যঞ্জনের ঋজে ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকদের নাসারন্ধ্রে এবং কণ্ঠদেশে যে আকুতি উপস্থিত হইত তাহাতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইলেও সংগীত ওষ্ঠাগত হইত না। কিন্তু ইহাতেও কিছু হইল না। একদিন আমাদের অসাবধানতার সুযোগে শীতের অপরাহ্নে তাহারা আমাদের লেপগুলি ভিজাইয়া দিল।

 বাধ্য হইয়া থানায় ডায়েরি করিতে আসিয়াছিলাম, দেখিলাম এক প্রৌঢ় ব্যক্তি প্রবল আবেগে ফুসিতেছেন। তাহার সামনে মোটা ধুতি ও নীল কোট পরিধানে এক ব্যক্তিকে পুলিশ ধরিয়া রাখিয়াছে। দ্বিতীয় ব্যক্তিটির এক হাতে বর্শা এবং অন্য হাতে একটি প্রজ্বলিত পেট্রম্যাক্স। কিছুক্ষণ পরে বুঝিলাম এই দ্বিতীয় ব্যক্তিটি প্রথম ব্যক্তির সঙ্গী বা রক্ষী। প্রথম ব্যক্তি অর্থাৎ আচার্য মহাশয় কিছুতেই সন্ধ্যাবেলায় রাস্তায় পেট্রম্যাক্স এবং আলোবাহক একজনকে অগ্রবর্তী না রাখিয়া বাহির হইতে পারেন না, ইহা তাহার বহুকালের অভ্যাস। তদুপরি ইহা দ্বারা, আচার্য মহাশয়ের মতে, কোনওরকম আইনভঙ্গ হয় নাই। বর্শা অস্ত্র আইনে পড়ে না। বর্শার ফলা মাত্র ছয় ইঞ্চি ইত্যাদি ইত্যাদি বহু যুক্তি তিনি প্রবল রোষে প্রদান করিতে লাগিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তিরূপে আমাকে সাক্ষী মানিতে লাগিলেন।

থানা অফিসার বিবেচক ছিলেন। সব শুনিয়া তিনি আচার্য মহাশয়কে বলিলেন, কলকাতার রাস্তায় যথেষ্ট আলো। পেট্রম্যাক্স কী কাজ করবে আর এখানে রাস্তায় সাপ, শুয়োর, বুনো শেয়াল কিছুই নেই যে একজন বর্শাবাহী লাগবে। আপনি আজ যান কিন্তু ভবিষ্যতে এরকম করবেন না।

কী ভাবিয়া আমিও সেদিন আর থানায় কোনও ডায়েরি না করিয়া চলিয়া আসিলাম, আচার্য মহাশয়, তাহার রক্ষী এবং আমি তিনজনেই এক সাথে রাস্তায় নামিলাম।

পথে চলিতে চলিতে আলাপ হইল। আচার্য মহাশয় আর যাহা হউক তোক খারাপ নহে। তাঁহার কথাবার্তায় বুঝিলাম যে, তাহার আর কলিকাতায় থাকিবার মোটেই বাসনা নাই। দেশে দাঙ্গাহাঙ্গামা চলিতেছে, সেখানেও ফেরা সম্ভব নহে, কলিকাতারই কিছু দূরে গঙ্গাতীরে কোথাও বাড়ি করিয়া বাকি জীবনটা কাটাইয়া দিতে চান।

কী কারণে জানি না, আচার্য মহাশয় আমার সহিত যোগাযোগ রক্ষা করিতেন, এখনও করেন, নিয়মিত তাহার খবর পাই।

আচার্য মহাশয় সম্পর্কে এই পর্যন্ত পাঠ করিয়া যদি কাহারও কোনও ভুল ধারণা গঠিত হইয়া থাকে তাহাকে এখনই বলিয়া রাখা ভাল, আচার্য মহাশয়ের বুদ্ধির অভাব কখনওই ছিল না।

বর্ধমানের দিকে গঙ্গার ধার ঘেঁষিয়া বিঘা দেড়েক জমি লইয়া বাড়ি প্রস্তুত করিলেন। বাড়ির পিছনে গঙ্গা-সংলগ্ন নিচু জমিতে প্রথমে কচুর চাষ করিলেন, প্রচুর কচু ফলিল। কিন্তু একটি কচুও বিক্রয় না করিয়া, না খাইয়া সেইখানে পঞ্চাশটি শূকর কিনিয়া পুষিতে লাগিলেন। শূকরের অত্যাচারে এবং নোংরায় বাড়ির এবং পাড়ার লোক অস্থির হইয়া উঠিল। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি শূকরের দুগ্ধের কারবার শুরু করিলেন। প্রচারপত্রে লম্বা প্রবন্ধ লিখিয়া দেখাইলেন শূকর-দুগ্ধ যেকোনও দুগ্ধ হইতে বেশি উপকারী। কিন্তু একাধিক কারণে এই ব্যবসা চলিল না। প্রথমত বহু বিজ্ঞাপন দিয়াও শূকরী দুহিবার যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া গেল না। অবশ্য আচার্য মহাশয় শেষভাগে নিজেই দুহিতে লাগিলেন কিন্তু ক্রেতার বড় অভাব হইল। বিশেষ কেহ শূকরের দুগ্ধপানে উৎসাহী হইল না।

ফলে কচুক্ষেত এবং শূকরপাল অন্তর্হিত হইল। এইবার ওই নিচু জমিতে তিনি পেঁপে গাছ লাগাইলেন, প্রচুর ফলিল। কাঁচা পেঁপেগুলি কাটিয়া রৌদ্রে শুকাইয়া তারপর চূর্ণ করিয়া একপ্রকার মশলা প্রস্তুত করা হইল। নাম দেওয়া হইল হজমি মশলা। এই দুষ্ট পাকস্থলীর দেশে সেই মশলা কেন যে জনপ্রিয় হইল না তাহা অনুধাবন করিতে একান্তই ব্যর্থ হইয়া আচার্য মহাশয় প্রায় ভগ্নহৃদয় হইয়া পড়িলেন।

শূকর-দুগ্ধ এবং হজমি মশলা উভয় দ্রব্যই আমাকে খাইতে হইয়াছিল। আচার্য মহাশয়ের অনুরোধ এবং আগ্রহে আমি তাহার বাড়িতে একাধিকবার গিয়াছি।

সম্প্রতি এক পত্র পাইয়া জানিতে পারি যে, তিনি এখন একটি বিশেষ গবেষণায় ব্যস্ত আছেন। পত্রের পরে পরেই কয়েকটি এক্সপ্রেস চিঠি এবং দুটি তারবার্তা পাইলাম, আমাকে চলিয়া আসার জন্য বিশেষ অনুরোধ। বিগত কয়েকবারের অভিজ্ঞতা ভাল নহে, তবু অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া যাওয়াই স্থির করিলাম।

আচার্য মহাশয়ের বাড়ির সদরে তাহার ভ্রাতুস্পুত্রী করতোয়ার সহিত সাক্ষাৎ হইল। আচার্য মহাশয় চিরকুমার। এই বৃদ্ধ বয়সে এই ভ্রাতৃ-কন্যাটি তাঁহার একচ্ছত্র সঙ্গিনী। আমাকে দেখিয়া করতোয়া স্মিতহাস্য করিল, আপনি তাহলে এসে গেলেন! সে আমাকে কয়েকবারই দেখিয়াছে, তাহার জ্যেঠামহাশয়ের এই অনুগ্রাহকটিকে বিশেষ মমতার সঙ্গে দেখে।

আমি প্রশ্ন করিলাম–এবার কী?

মৃদু হাসিয়া করতোয়া জবাব দিল, আরশোলা। ইতিপূর্বে শূকর-দুগ্ধ এবং হজমি মশলা খাইয়া গিয়াছি, আরশোলা শুনিয়া হৃৎকম্প উপস্থিত হইল। ভাবিলাম তখনই ফিরিয়া যাই। করতোয়া বোধহয় আমার মনোভাব বুঝিতে পারিল, বলিল, ভয় নেই, আসুন। আরশোলা খেতে হবে না।

বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিতে যাইব, এমন সময় আকস্মিক গুলির শব্দে চমকিয়া উঠিলাম। তাকাইয়া দেখি একতলার চিলেকোঠার ছাদে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে মুখ করিয়া আচার্য মহাশয় বন্দুকের আওয়াজ করিতেছেন। কী লক্ষ করিয়া করিতেছেন কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।

করতোয়াকে আবার প্রশ্ন করিতে হইল। করতোয়া বলিল, জ্যেঠামশায় পাক্ষিক নিদারুণ বার্তার সম্পাদক নিবারণ সামন্তের বাড়ির দিকে ফঁকা আওয়াজ করছেন। নিদারুণ বার্তায় ওঁর একটা থিসিসের যাচ্ছেতাই সমালোচনা করা হয়েছে। সে যাহোক, ভয়ের কিছু নেই।

একটু পরেই আচার্য মহাশয় নামিয়া আসিলেন, ভীষণ উত্তেজিত। সেই টালিগঞ্জ থানায় প্রথমদিন যেরকম দেখিয়াছিলাম। আমাকে দেখিয়া কিছুটা শান্ত হইলেন। কিছুক্ষণ কুশল প্রশ্নাদি করিয়া ভিতরের ঘরে গিয়া একতাড়া কাগজ লইয়া আসিলেন। তাহার পরে করতোয়াকে ডাকিলেন, করতোয়া মা, এটা একবার পড়ে শোনা তো!

পিতৃব্যের আজ্ঞাতে আমার দিকে তাকাইয়া একটু মুচকি হাসিয়া নিয়া করতোয়া পড়িতে লাগিল। প্রবন্ধটির নাম কেশ-চর্চা এবং আরশোলা। অত দীর্ঘ প্রবন্ধ উদ্ধৃত করিয়া লাভ নাই। সারাংশ এইরকম:

আরশোলাকে কোথাও কোথাও তেলাচুরা বলা হইয়া থাকে। ইহার কারণ এই যে, ইহা মাথা হইতে নিদ্রাকালে তেল শুষিয়া লয়। অনেক সময় চুলও খাইয়া ফেলে। যে স্থানের চুল খায় সেখানে আর চুল গজাইতে চাহে না। ইহা প্রায় সকলেই জানেন।

আরশোলার যখন এবম্বিধ প্রকৃতির পরিচয় মানুষ মাত্রেই জ্ঞাত আছেন, ইহাকে অনায়াসেই মানুষের কাজে নিয়োগ করা যাইতে পারে। রজক, ক্ষৌরকার ইত্যাদি বাবদ প্রত্যেক গৃহস্থেরই এদেশে যথেষ্ট ব্যয় হয়। কিন্তু বিলাত ইত্যাদি দেশে কাপড় কাচিবার যন্ত্র, এমনকী দাড়ি কামাইবার বৈদ্যুতিক যন্ত্র আবিষ্কার হইয়াছে।

আমাদের দরিদ্র দেশের পক্ষে এইগুলি খুবই ব্যয়সাধ্য। সকলের ব্যবহার করিবার আর্থিক যোগ্যতা নাই।

জীব-জন্তুকে শিক্ষিত করিয়া নানাবিধ কার্য সম্পাদন করা যায়। বানর, হাতি, ঘোড়া, কুকুর, এমনকী পাখিও নানা কাজ করিতে পারে। আরশোলাকেও উপযুক্ত ট্রেনিং দিতে পারিলে তাহার দ্বারা কোনও কার্য অসম্ভব নহে। যথাসময়ে মাথায় ছাড়িয়া দিলে উপযুক্ত পরিমাণ চুল খাইয়া লইলেই চুল কাটার কাজ হইয়া যাইবে। প্রথম দিকে শিশুদের মাথায় ছাড়িয়া এবং গায়ে সুতা বাঁধিয়া মাথায় ঠিকমতো চালাইলে পরে ভাল কাজ পাওয়া সম্ভব।

এক-একটি আরশোলা গড়ে নয়মাস বাঁচে, অর্থাৎ একটি সামান্য আরশোলা নয়বার চুল কাটা এবং দুইশত সত্তর বার (যাঁহারা দৈনিক দাড়ি কামান) দাড়ি কামানোর খরচ বাঁচাইতে পারিবে।…

করতোয়া যখন প্রবন্ধটি পাঠ করিতেছিল, প্রত্যেক অংশ শুনিতে শুনিতে আচার্য মহাশয়ের মুখভাব উজ্জ্বল হইয়া উঠিতেছিল। আমার প্রায় কিছুই বলিবার ছিল না। শুধু জানিতে চাহিলাম, এইরূপ ট্রেনিংপ্রাপ্ত কোনও আরশোলা…

 আচার্য মহাশয় আমাকে বাক্য সম্পূর্ণ করিতে দিলেন না। একটি কাঁচের বাক্স বারান্দা হইতে লইয়া আসিলেন। তাহাতে দশ-পনেরোটি আরশোলা এবং একটি প্লেটে অল্প একটু দুধ রহিয়াছে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, প্লেটে কী, দুধ?

উপরের ছাদে আরেকটি খাঁচা আনিবার জন্য আচার্য মহাশয় উঠিয়া গিয়াছিলেন, করতোয়া ছিল, সেই জবাব দিল, হ্যা দুধ খেলে ওদের বুদ্ধি হবে। আচার্য মহাশয় ঘরে ঢুকিতে ঢুকিতে করতোয়ার কথা ধরিলেন, দুধ হল স্নেহ পদার্থ, এতে বুদ্ধি হবে। তবে তেলই ওদের খাদ্য, তবে সেটা দিলে মাথার চুলের তেল আর ওরা খেতে চাইবে না।

সন্দেহ নাই, অকাট্য যুক্তি। কিন্তু স্থানীয় পাক্ষিক নিদারুণ বার্তার মুর্থ সম্পাদক নিবারণ সামন্ত আচার্য মহাশয়ের এই গবেষণাকে পাগলামি বলিয়া হাসি-তামাসা করিয়াছে। আজ সকালেই নিদারুণ বার্তার বর্তমান সংখ্যা আচার্য মহাশয়ের হস্তগত হইয়াছে। পাঠ করিয়াই ছাদে উঠিয়া নিবারণ সামন্তের বাড়ির দিকে মুখ করিয়া তিনবার বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করিয়াছেন।

আরশোলার বুদ্ধি এবং নিবারণ সামন্তের বুদ্ধির অভাব বিষয়ে আচার্য মহাশয়ের সঙ্গে সেইদিন সারা দুপুর আলোচনা করিয়া বৈকালে করতোয়ার সঙ্গে গঙ্গাতীরে ভ্রমণ করিয়া সন্ধ্যাবেলা ফিরিয়া আসিলাম। কথা দিয়া আসিলাম, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে আবার আসিব। আরশোলা দিয়া চুল কাটাইয়া যাইব। ততদিনে আরশোলাগুলি উপযুক্ত শিক্ষিত হইবে এইরূপ আশা করা গেল।

কিন্তু দুই সপ্তাহ লাগিল না। আচার্য মহাশয় গুরুতর অসুস্থ, করতোয়ার নামে প্রেরিত এক তার পাইয়া সাতদিনের মধ্যে আরেকবার যাইতে হইল।

আচার্য মহাশয়ের বিরূপ সমালোচনা করিবার পর নিবারণ সামন্ত একটু মর্মপীড়ায় ভুগিতেছিলেন। তাহা ছাড়া নিদারুণ বার্তার নয়জন ক্রেতার মধ্যে আচার্য মহাশয় একজন। তাই তিনি একদিন আচার্য মহাশয়ের সঙ্গে একটি আপোস-রফায় আসিবেন ইচ্ছায় একদিন তাঁহার বাড়িতে আসেন। সামন্ত মহাশয় বুদ্ধিমান ব্যক্তির ন্যায় এইবার আরশোলা বিষয়ে যথেষ্ট উৎসাহ প্রদর্শন করিতে থাকেন। সামন্তকে দেখিয়া আচার্য মহাশয় প্রথমে উত্তেজিত হইলেও পরে তাহার আচরণের পরিবর্তন দেখিয়া তাঁহাকে যথেষ্ট সৌজন্য প্রদর্শন করেন। আরশোলাগুলিকে কীভাবে শিক্ষা দেওয়া হইবে তাহা খাঁচা খুলিয়া দেখাইতে যান। কিন্তু ইতিমধ্যে দুধ-ক্ষীর ইত্যাদি স্নেহপদার্থ খাইয়া আরশোলাগুলি যে ভীমরুলের প্রকৃতি ধারণ করিয়াছে, ইহা সামন্ত বা আচার্য মহাশয় কেহই অনুমান করিতে পারেন নাই। খাঁচা খোলামাত্র পনেরোটি দুর্দান্ত আরশোলা তাহাদের দুইজনের উপর ঝাপাইয়া পড়ে। করতোয়া বঁটা লইয়া ছুটিয়া না আসিলে সেইদিনই বোধ হয় এই দুইজনকেই আরশোলার দংশনে প্রাণত্যাগ করিতে হইত।

বর্তমানে সামন্ত ও আচার্য মহাশয় দুইজনেই স্থানীয় হাসপাতালে পাশাপাশি শয্যায় চিকিৎসিত হইতেছেন। দুজনেরই মুখ এত ফুলিয়া গিয়াছে যে প্রথম দর্শনে কে নিবারণ সামন্ত আর কে রুদ্রনারায়ণ আচার্য ঠাহর করা কঠিন।

করতোয়াকেও একটি আরশোলা দংশন করিয়াছিল, তাহার বিশেষ কিছু হয় নাই, শুধু গণ্ডদেশ কিঞ্চিৎ রক্তিম ও স্ফীত হইয়াছে।

সকল অধ্যায়

১. পঞ্চতন্ত্রের শেষ গল্প
২. খেজুরে গুড়ের সন্দেশ
৩. রেলবাজার স্টেশন
৪. চলন্তিকা
৫. জারিনা বিবি
৬. আরম্ভ
৭. মূল কাহিনি
৮. ব্লটিং পেপার
৯. ছোটসাহেব
১০. হন্তদন্ত
১১. ভাল খবর, খারাপ খবর
১২. হাস্যকর
১৩. সর্বাঙ্গসুন্দরের কবিতা
১৪. চেয়ার
১৫. মার্জার পুরাণ
১৬. কাঁঠালহাটির গল্প
১৭. গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি
১৮. লালমোহনের বিপদ
১৯. পটললালের বিপদ
২০. চর্মন্তুদ অথবা জুতো ও পটললাল
২১. বিবাহঘটিত
২২. একদা প্রভাতকালে
২৩. ফুটবল
২৪. রাঁধি মাছ না ছুঁই তেল
২৫. ছত্র বর্ধন
২৬. বিপদ ও তারাপদ
২৭. পটললাল, চলচ্চিত্র ও লেখক
২৮. অদূরভাষ
২৯. ধর্মাধর্ম
৩০. চাষির মুখে হাসি
৩১. বেশ-বেশ
৩২. ২৫০%
৩৩. একটি গল্পের নবজন্ম
৩৪. এখনই
৩৫. বইমেলায় পটলবাবু
৩৬. একটি পুস্তক সমালোচনা
৩৭. লক্ষ্মীর প্রত্যাবর্তন
৩৮. জটিলেশ্বর
৩৯. ডবল পটললাল
৪০. রোশনচৌকি
৪১. সুধানাথবাবু মন্ত্রী হলেন
৪২. ভাগলপুরের পাঞ্জাবি
৪৩. শেষ অশ্বারোহী
৪৪. স্বর্গের চাবি
৪৫. আরশোলা এবং নিদারুণ বার্তা
৪৬. একটি অখাদ্য গল্প
৪৭. একটি আদ্যোপান্ত দুর্ঘটনা
৪৮. গোরুর গল্প
৪৯. ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের চিঠি
৫০. আবহাওয়া
৫১. ঘুঘু কাহিনি
৫২. সাক্ষাৎকার
৫৩. ভজহরি চাকলাদার
৫৪. জয়াবতী ও জয়গোপালের কাহিনি
৫৫. নিরুদ্দেশ জানলা
৫৬. খদ্দের
৫৭. ভ্রমণকাহিনি
৫৮. লাথ্যৌষধি
৫৯. বাণেশ্বরের রোগমুক্তি
৬০. জীবনবাবুর পায়রা
৬১. মনোজ সান্যালের গল্প
৬২. ভজগোবিন্দ ভোজনালয়
৬৩. নবারুণবাবু সুখে থাকুন
৬৪. কণ্টকাকীর্ণ
৬৫. বেঁচে আছি
৬৬. সঞ্চয়িতা
৬৭. পুরনো পল্টন
৬৮. রেটটা একটু কমান
৬৯. গেঞ্জি
৭০. ভিখারি বিষয়ে
৭১. বইমেলা
৭২. পাদুকার বদলে
৭৩. নামাবলী
৭৪. পাপি সুইমিং স্কুল
৭৫. টমাটো সস
৭৬. গয়া ১৯২৪
৭৭. টাইপ-রাইটার
৭৮. দুই মাতালের গল্প
৭৯. মহামহিম
৮০. জয়দেবের জীবনযাত্রা
৮১. একদিন রাত্রে
৮২. কালমেঘ
৮৩. চশমা
৮৪. সার্জন সাহেবের বাড়িতে
৮৫. কবিতা ও ফুটবল
৮৬. এন-আর-আই
৮৭. গুপ্তপ্রসঙ্গ
৮৮. দাঁত
৮৯. একশো টাকার ভাঙানি
৯০. সান্যাল স্লিমিং
৯১. হাতে খড়ি
৯২. অন্য এক মাতালের গল্প
৯৩. অবসরের দিনলিপি
৯৪. বিমান কাহিনি
৯৫. শালিক ও শ্যালিকা
৯৬. তরমুজের বীজ
৯৭. টালিগঞ্জে পটললাল
৯৮. পটললাল ও মধুবালা
৯৯. নীল আলো
১০০. পাঁচ-পাঁচ
১০১. বেগুন, মোচা এবং কাফকা
১০২. হৃদয় ঘটিত
১০৩. অবিচ্ছিন্ন
১০৪. চিকিৎসা
১০৫. কে মারা যাচ্ছে?
১০৬. পটললাল ও মিস জুলেখা
১০৭. নিজেকে জানো
১০৮. ভাল-খারাপ
১০৯. ব্যাঙ
১১০. বরাহমিহিরের উপাখ্যান
১১১. বিবি এগারো বারো
১১২. হুঁকো
১১৩. ফুঃ
১১৪. স্বর্গের গল্প
১১৫. হরিনাথ ও হরিমতী
১১৬. জীবনযাপন
১১৭. ফুলকুমারী
১১৮. জতুগৃহ
১১৯. বিষ
১২০. বাঁচার মতো বাঁচা
১২১. নস্যি
১২২. ডিম
১২৩. এক প্রধানের গল্প
১২৪. আবগারীশ্বরী
১২৫. কাণ্ড-কারখানা
১২৬. আধকপালে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন