অবিচ্ছিন্ন

তারাপদ রায়

অবিচ্ছিন্ন

সেই কবেকার ডোডোতোতাই। তারা এখন আর সেই ছয়-সাত বছরে আটকিয়ে নেই, ঢের বড় হয়েছে।

তাতাইবাবু এখন বিদেশবাসী। সেখানে পড়াশুনো শেষ করে এখন নিজেই পড়াচ্ছেন। আর ডোডোবাবু পুরোদস্তুর এঞ্জিনিয়ার, তাকেও কাজেকর্মে প্রায়ই বিদেশে যেতে হয়।

প্রায় আড়াই বছর পরে এবার তাতাইবাবু কলকাতায় এসেছিলেন। সঙ্গে মেমবউ, বিশাল বড়সড় মেমসাহেব। তাতাইয়ের কাকা বউ দেখে বলেন, এই একটা বউ একাই চারটে বউয়ের সমান, বাড়ি ভরে গেছে।

তাতাইবাবু কিন্তু একদম বদলাননি। প্রথম দিন এসেই দশ বারোটা কঁচা জলপাই নুন দিয়ে খেয়ে ফেললেন। জলপাইগুলো বাজার থেকে আনা হয়েছিল চাটনি করার জন্যে। তাতাইবাবুর গোগ্রাসে জলপাই খাওয়া দেখে তাতাইবাবুর মা হায়-হায় করে উঠলেন। তাতাইবাবু বললেন, ভয় পেয়ো না। কিছু হবে না।তাতাইবাবুর মা বললেন, চাটনিও হবে না। এই শুনে তাতাইবাবুর কাকা সাইকেল নিয়ে বেরোলেন আবার জলপাই কিনে আনতে।

তাতাইবাবুর মা খুব চিন্তা করেন, বউয়ের সঙ্গে আমি তো ইংরেজিতে কথা বলতে পারব না।

তাতাইবাবু বলেন, পারবে না কেন?

বউয়ের উচ্চারণ তো আমি কিছুই ধরতে পারি না।তাতাইবাবুর মা কবুল করেন।

সে ভেবো না।তাতাইবাবু আশ্বাস দেন, আমি ওকে চটপট বাংলা শিখিয়ে দিচ্ছি।

শুরু হল মেমবউকে বাংলা শেখানো। প্রথমে লেখাপড়া নয়, কথাবার্তা বলা। তাতাইবাবুর ইচ্ছে চমকপ্রদ কিছু বাক্য শিখিয়ে সবাইকে বিস্মিত করে দেওয়া।

ইতিমধ্যে কয়েকদিন বাদে তাতাইবাবুর আসার খবর পেয়ে ডোডোবাবু এলেন। ডোডোবাবু ছিলেন কুয়ালালামপুরে, সেখানে ব্রিজ বানাচ্ছেন। কাজের ছুটিতে তিনি তাতাইবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

ডোডোবাবু কুয়ালালামপুরে কী কাজ করছেন শুনে তাতাইবাবু বললেন, ওখানে সাঁকো বানাচ্ছেন কেন, আমাদের দেশে কি সাঁকো বেশি হয়ে গেছে?

সঙ্গে সঙ্গে ডোডোবাবু পালটা প্রশ্ন করলেন, আপনিই-বা বাইরে কী পড়াচ্ছেন, আমাদের দেশে কি ছাত্র কম পড়ে গেছে?

প্রায় পুরনো দিনের মতো বাদ-বিসম্বাদ শুরু হয়ে যায় আর কী এমন সময় ডোডোবাবু এসেছেন শুনে বাইরের ঘরে তাতাইবাবুর মেমবউ এলেন। তাতাইবাবুর কাছে ডোডোবাবুর কথা তিনি অনেক শুনেছেন।

ডোডোবাবু ঝাড়া পৌনে ছয় ফুট লম্বা। ডোডোবাবু দেখলেন, তাতাইবাবুর বউ বোধ হয় তার চেয়েও লম্বা। বিস্ময়ের ভাবটা কেটে যেতে ডোডোবাবু পকেট থেকে একটা চকোলেটের বার বের করে মেমবউকে দিলেন।

 মেমবউ হাসিমুখে সেটা হাতে নিয়ে ভাঙা বাংলায় বললেন, এখন খাওয়া আছে না। এখন লুচি পায়েস খেয়েছি। পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে।

মেমসাহেবের কথা শুনে ডোডোবাবু অবাক হয়ে তাতাইবাবুর দিকে তাকালেন, তাতাইবাবু বললেন, আমি ওকে বাংলা বলা শেখাচ্ছি।

ডোডোবাবু বললেন, কিন্তু এসব কী শেখাচ্ছেন? খিদে লাগলে পেটে ছুঁচোয় ডন দেয়, ভরা পেটে ছুঁচো ডন দিতে যাবে কেন?

তাতাইবাবু কিছু বলার আগে মেমসাহেব ভুলটা অনুমান করতে পেরে বললেন, ওই একই কথা, যা ফিফটি থ্রি তাই ফিফটি টু।

ডোডোবাবু এবার তাতাইবাবুকে চেপে ধরলেন, এসব ওঁকে কী শেখাচ্ছেন।

তাতাইবাবুদের বাড়ির পুরনো রান্নার মহিলা তাকে তাতাইবাবু মাসি বলেন, মেমবউও মাসি বলছেন। সেই মাসি এর মধ্যে ডোডোবাবু এসেছেন শুনে নালিশ জানিয়ে গেলেন, আজ সকালে বউ আমাকে বরের ঘরের পিসি কনের ঘরের মাসি বলেছে।

ডোডোবাবু বুঝলেন ব্যাপার গুরুতর। তাতাইবাবুর মা-ও বললেন পুরো অবস্থা খুব জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তিনি এই জন্যে তাতাইবাবুকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন।

কিন্তু কী আর করা যাবে মেমসাহেব তখন গড়গড় বলে চলেছেন, রীতিমতো প্রশ্নের ভঙ্গিতে, রাতে মাছি, দিনে মশা, এই জন্যে কলকাতায় আসা?

 কলকাতা বিষয়ে এরকম কথা বলায় ডোডোবাবু খুব চটে গেলেন, তিনি সামাজিকতার ধার না ধরে কড়া ভাবে বললেন, এলেন কেন?

মেমবউ তখন প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাতাইবাবুর দিকে তাকাতে তিনি ডোডোবাবুর মন্তব্যটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে মেমবউ বললেন, পড়ে পাওয়া সাতাশি পয়সা।

তার মানে? ডোডোবাবু অবাক হয়ে তাতাইবাবুর কাছে জানতে চাইলেন। তাতাইবাবু বললেন, সাতাশি পয়সা বুঝলেন না, সেই পুরনো চৌদ্দ আনা।

একটু ভেবে নিতেই বুদ্ধিমান ডোডোবাবু ব্যাপারটা বুঝলেন, বললেন, তার মানে পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। এবার এ কথার নিহিতার্থ ধরে ফেলতে তিনি রাগে ফুসতে লাগলেন। মেমসাহেবকে বললেন, তা হলে ব্যাপারটা হল, আপনার কলকাতায় শ্বশুরবাড়িতে আসা হল পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা। আপনি ভাবেন কী?

তাতাইবাবু মধ্যস্থতা করে বললেন, আপনার মেমবউদি বাংলা কিছু বোঝেন না। ওঁকে এসব কথা বলে কোনও লাভ নেই।

ডোডোবাবু উত্তেজিত হয়ে বললেন, তা হলে এই সব আপনি মুখস্থ করিয়েছেন মেমকে দিয়ে আর উনি কিছুই না বুঝে ঝরঝর করে বলে যাচ্ছেন।

বছর কুড়ি-পঁচিশ আগে হলে এতক্ষণে ডোডোবাবু আর তাতাইবাবুর মধ্যে হাতাহাতি হয়ে যেত।

এ বার অবশ্য তা হল না। ডোডোবাবুর কোথায় একটা কাজ ছিল, তিনি তাড়াতাড়ি চলে গেলেন, বলে গেলেন দুয়েকদিনের মধ্যেই আসছেন। বেরোনোর সময় সদর দরজা চৌকাঠের ওপরে তাতাইবাবু ডোডোবাবু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, মেমবউ ঠিক মধ্যিখানে এসে দাঁড়ালেন। তার পর দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে দুজনকে বার দুয়েক ভাল করে দেখে কোনও রকম দ্বিধা না করে মেমসাহেব ডোডোবাবুকে বললেন, তুমি যেমন বুনো তেঁতুল আর ইনি তেমনই বাঘা ওল, বলে তাতাইবাবুকে দেখালেন।

সকল অধ্যায়

১. পঞ্চতন্ত্রের শেষ গল্প
২. খেজুরে গুড়ের সন্দেশ
৩. রেলবাজার স্টেশন
৪. চলন্তিকা
৫. জারিনা বিবি
৬. আরম্ভ
৭. মূল কাহিনি
৮. ব্লটিং পেপার
৯. ছোটসাহেব
১০. হন্তদন্ত
১১. ভাল খবর, খারাপ খবর
১২. হাস্যকর
১৩. সর্বাঙ্গসুন্দরের কবিতা
১৪. চেয়ার
১৫. মার্জার পুরাণ
১৬. কাঁঠালহাটির গল্প
১৭. গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি
১৮. লালমোহনের বিপদ
১৯. পটললালের বিপদ
২০. চর্মন্তুদ অথবা জুতো ও পটললাল
২১. বিবাহঘটিত
২২. একদা প্রভাতকালে
২৩. ফুটবল
২৪. রাঁধি মাছ না ছুঁই তেল
২৫. ছত্র বর্ধন
২৬. বিপদ ও তারাপদ
২৭. পটললাল, চলচ্চিত্র ও লেখক
২৮. অদূরভাষ
২৯. ধর্মাধর্ম
৩০. চাষির মুখে হাসি
৩১. বেশ-বেশ
৩২. ২৫০%
৩৩. একটি গল্পের নবজন্ম
৩৪. এখনই
৩৫. বইমেলায় পটলবাবু
৩৬. একটি পুস্তক সমালোচনা
৩৭. লক্ষ্মীর প্রত্যাবর্তন
৩৮. জটিলেশ্বর
৩৯. ডবল পটললাল
৪০. রোশনচৌকি
৪১. সুধানাথবাবু মন্ত্রী হলেন
৪২. ভাগলপুরের পাঞ্জাবি
৪৩. শেষ অশ্বারোহী
৪৪. স্বর্গের চাবি
৪৫. আরশোলা এবং নিদারুণ বার্তা
৪৬. একটি অখাদ্য গল্প
৪৭. একটি আদ্যোপান্ত দুর্ঘটনা
৪৮. গোরুর গল্প
৪৯. ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের চিঠি
৫০. আবহাওয়া
৫১. ঘুঘু কাহিনি
৫২. সাক্ষাৎকার
৫৩. ভজহরি চাকলাদার
৫৪. জয়াবতী ও জয়গোপালের কাহিনি
৫৫. নিরুদ্দেশ জানলা
৫৬. খদ্দের
৫৭. ভ্রমণকাহিনি
৫৮. লাথ্যৌষধি
৫৯. বাণেশ্বরের রোগমুক্তি
৬০. জীবনবাবুর পায়রা
৬১. মনোজ সান্যালের গল্প
৬২. ভজগোবিন্দ ভোজনালয়
৬৩. নবারুণবাবু সুখে থাকুন
৬৪. কণ্টকাকীর্ণ
৬৫. বেঁচে আছি
৬৬. সঞ্চয়িতা
৬৭. পুরনো পল্টন
৬৮. রেটটা একটু কমান
৬৯. গেঞ্জি
৭০. ভিখারি বিষয়ে
৭১. বইমেলা
৭২. পাদুকার বদলে
৭৩. নামাবলী
৭৪. পাপি সুইমিং স্কুল
৭৫. টমাটো সস
৭৬. গয়া ১৯২৪
৭৭. টাইপ-রাইটার
৭৮. দুই মাতালের গল্প
৭৯. মহামহিম
৮০. জয়দেবের জীবনযাত্রা
৮১. একদিন রাত্রে
৮২. কালমেঘ
৮৩. চশমা
৮৪. সার্জন সাহেবের বাড়িতে
৮৫. কবিতা ও ফুটবল
৮৬. এন-আর-আই
৮৭. গুপ্তপ্রসঙ্গ
৮৮. দাঁত
৮৯. একশো টাকার ভাঙানি
৯০. সান্যাল স্লিমিং
৯১. হাতে খড়ি
৯২. অন্য এক মাতালের গল্প
৯৩. অবসরের দিনলিপি
৯৪. বিমান কাহিনি
৯৫. শালিক ও শ্যালিকা
৯৬. তরমুজের বীজ
৯৭. টালিগঞ্জে পটললাল
৯৮. পটললাল ও মধুবালা
৯৯. নীল আলো
১০০. পাঁচ-পাঁচ
১০১. বেগুন, মোচা এবং কাফকা
১০২. হৃদয় ঘটিত
১০৩. অবিচ্ছিন্ন
১০৪. চিকিৎসা
১০৫. কে মারা যাচ্ছে?
১০৬. পটললাল ও মিস জুলেখা
১০৭. নিজেকে জানো
১০৮. ভাল-খারাপ
১০৯. ব্যাঙ
১১০. বরাহমিহিরের উপাখ্যান
১১১. বিবি এগারো বারো
১১২. হুঁকো
১১৩. ফুঃ
১১৪. স্বর্গের গল্প
১১৫. হরিনাথ ও হরিমতী
১১৬. জীবনযাপন
১১৭. ফুলকুমারী
১১৮. জতুগৃহ
১১৯. বিষ
১২০. বাঁচার মতো বাঁচা
১২১. নস্যি
১২২. ডিম
১২৩. এক প্রধানের গল্প
১২৪. আবগারীশ্বরী
১২৫. কাণ্ড-কারখানা
১২৬. আধকপালে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন