পঞ্চতন্ত্রের শেষ গল্প

তারাপদ রায়

পঞ্চতন্ত্রের শেষ গল্প

অস্তি কস্মিংশ্চিৎ নগরে রাজারাম নামে এক রজক ছিল। এই নগর এক রাজ্যের রাজধানী, সেই রাজ্যের রাজার নামও রাম, অর্থাৎ কিনা রাজা রাম।

না। ইনি অযোধ্যার রাজা রাম নন। এসব গোলমালের মধ্যে জড়িয়ে পড়ার সাহস নেই আমার। আমার গল্পের এই রাজা পরবর্তীকালের অন্য এক রাজ্যের অধিপতি।

আসলে এ গল্প আমার নয়। এটা বিষ্ণু শর্মার পঞ্চতন্ত্রের শেষ গল্প।

সকলেই জানেন, পঞ্চতন্ত্র প্রণেতা বিষ্ণু শর্মা চার রাজপুত্রের শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ওই রাজপুত্রদের গল্পচ্ছলে নীতিকথা শোনাতেন। এই গল্পগুলিই পরে পঞ্চতন্ত্র এবং হিতোপদেশ, দুটি বিখ্যাত কালজয়ী গ্রন্থে সংকলিত হয়।

আজ আমরা যে গল্পটা নিয়ে পড়েছি, সে গল্পটা কিন্তু পঞ্চতন্ত্রে বা হিতোপদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিষ্ণু শর্মা রাজপুত্রের গল্পটা বলেছিলেন বটে, পরবর্তীকালে সংকলনকারীরা গল্পটিকে এড়িয়ে যান।

সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের বেরার অঞ্চলে বেড়াতে গিয়েছিলাম। জায়গাটার প্রাচীন নাম বিদর্ভ। পণ্ডিত বিষ্ণু শর্মা ওই অঞ্চলেরই লোক ছিলেন। এখানকারই এক রাজবাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে এই গল্পটা শুনলাম। বোকার মতো লিখে ফেলছি, কিন্তু গল্পের বিষয়বস্তু এমন যে, আমার কেমন ভয় ভয় করছে। হঠাৎ বিপদে পড়ব কিনা কী জানি!

অল্প বয়সে রজক-তনয় রাজারাম এবং রাজপুত্র রাম একই পাঠশালায় পড়াশুনো করেছে, একই গুরুর কাছে। যাকে বলে ক্লাসফ্রেন্ড তাই আর কী।

কালক্রমে রাজারাম পৈতৃক পেশা রজকের জীবিকা গ্রহণ করে এবং রাজপুত্র রাম রাজা হয়। রাজারাম ছিল রাজপ্রাসাদেরই খাস ধোবা। প্রতিদিন খুব ভোরবেলা রাজবাড়ির লোকেরা ঘুম থেকে ওঠার অনেক আগে রাজারাম তার গাধার পিঠে কাচা কাপড়ের বস্তা নিয়ে আসত। তারপর সেই কাপড় দিয়ে আবার বস্তা বেঁধে, সেদিনের ময়লা কাপড় নিয়ে যেত। ভোর ভোর অন্ধকারেই রাজারাম কাজ মিটিয়ে ফিরে যেত, কারণ সকালে উঠেই রাজবাড়ির লোকেরা যদি রজকের মুখ দেখে ফেলে তাতে নাকি তাদের খুব অমঙ্গল হবে।

রাজারাম এতে কিন্তু বিশেষ কিছু মনে করত না। তার কাজ সে স্বাভাবিক ভাবেই করে যেত।

কিন্তু একদিন একটা গোলমাল হল।

সেদিনও খুব সকাল সকাল গাধার পিঠে কাপড়ের বোঝা চাপিয়ে রাজারাম রাজবাড়িতে এসেছে। ঠিক তখনই তার সহপাঠী রাজা রাম রথে চড়ে বেরোচ্ছে।

রাজা মৃগয়ায় যাচ্ছেন। রাজজ্যোতিষী, তিনি আবার রাজসভার একজন বিশিষ্ট সচিব, পাঁজিপুঁথি দেখে, গ্রহ নক্ষত্র বিচার করে আজকের দিনটি নির্বাচন করেছেন মৃগয়ার উপযুক্ত দিন বলে। সূর্যোদয়ের আগেই সবচেয়ে শুভ লগ্ন। তাই রাজা এত সকালেই লোকলস্কর হাতি ঘোড়া নিয়ে রথে চড়ে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়ছেন। কয়েক ক্রোশ দূরে গভীর বন, সেই বনে যাবেন শিকার করতে, রাজারাজড়ার ভাষায় মৃগয়া করতে।

বেরোনোর মুখেই পুরনো সহপাঠী রজক রাজারামের সঙ্গে দেখা। রাজজ্যোতিষী চেষ্টা করেছিলেন রজক যাতে রাজার মুখোমুখি না পড়ে যায়। এই যাত্রার মুখে সে বড় অমঙ্গল।

কিন্তু রাজা বলেই বোধ হয় রামের মনে কোনও সংস্কার নেই। দূর থেকে গাধার পাশে রাজারামকে দেখে তাড়াতাড়ি রথ থামিয়ে রাজা নেমে পুরনো বন্ধুর কাছে এগিয়ে গেলেন। 

দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময় হল। দুয়েকটা পুরনো কথা হল। রাজারাম যে প্রতিদিনই রাজপ্রাসাদে আসে অথচ রাজার সঙ্গে দেখা হয় না, রাজা সেটা জানেন, রাজারামকে একদিন বিকেলের দিকে অবসরের সময় আসতে বললেন, তারপর বললেন, আমার আজকে একটু তাড়া আছে, যাই।

রাজারাম তখন জিজ্ঞাসা করল, এত লোকজন, হাতিঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছ, যুদ্ধ-টুদ্ধ নাকি?

রাজা বললেন, না, না। যুদ্ধ কীসের! মৃগয়ায় যাচ্ছি।

রাজারাম চিন্তিত মুখে বললেন, আজকের দিনে তুমি মৃগয়ায় যাচ্ছ?

রাজা বললেন, কেন দিনটা তো খারাপ নয়। রাজজ্যোতিষী অনেক বেছে দিনটা বার করেছেন। মৃগয়ার পক্ষে খুবই শুভ দিন।

ততক্ষণে রাজজ্যোতিষী এসে পড়েছেন। তিনি সামান্য রজকের সঙ্গে রাজার এই অন্তরঙ্গতা মোটেই পছন্দ করেন না, তিনি এসে আগ বাড়িয়ে বললেন, রাজামশায়, আর দেরি করবেন না, লগ্ন পার হয়ে যাচ্ছে। তারপর রাজারামকে বললেন, দিনটা খারাপ তোমাকে কে বলেছে?

 রাজারাম বলল, আজ মৃগয়ার পক্ষে খুব খারাপ দিন। আর একটু পরেই ভয়ংকর ঝড়, বৃষ্টি আসবে। আকাশ ভেঙে পড়বে।

তখন সকালবেলার সূর্যের আলোয় রাজবাড়ির ফুলের বাগান, সবুজ গাছপালা ঝলমল করছে। রাজজ্যোতিষী চারদিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন, বললেন, রাজারাম তোমার মাথা খারাপ হয়েছে! যা তা বকছ৷ তারপর রাজাকে নিয়ে দ্রুত পদে এগিয়ে গেলেন।

হাতি ঘোড়া লোকলস্কর সুদ্ধ রাজার রথ দ্রুতগতিতে ছুটে গেল জঙ্গলের দিকে।

কী এক কার্যকারণে সেদিন সকালে সাড়ে আটটা-নয়টার সময় আকাশ অন্ধকার করে ঘন কালো মেঘ ছুটে এল। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি আর প্রবল ঝোড়ো হাওয়া।

জঙ্গলে ঢোকার মুখেই এই ঘটনা ঘটল। রাজার মাথার মুকুট হাওয়ায় উড়ে গেল। জামাকাপড়, জুতো ভিজে গেল। বৃষ্টিতে নেয়ে ঠান্ডা বাতাসে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে রাজপ্রাসাদে ফিরে এসে রাজা প্রথমেই তার সেই বিশিষ্ট সচিব রাজজ্যোতিষীকে বরখাস্ত করলেন। তারপর এত্তেলা পাঠালেন রজক রাজারামকে।

রাজারাম আসতে রাজা তাকে বললেন, তুমি এত ভাল জ্যোতিষ জানো, এত ভাল দিন-গণনা। করতে পারো, এসব কবে শিখলে? আমি তোমাকে আজ থেকে আমার সচিব নিযুক্ত করলাম, তুমি হবে আমার জ্যোতিষী ও পরামর্শদাতা।

সব শুনে রাজারাম বলল, কিন্তু আমি সামান্য ধোপা। জ্যোতিষী তো আমি জানি না।

 রাজা তখন অবাক হয়ে বললেন, তা হলে তুমি কী করে ভোরবেলা বললে আজ এত ঝড়বৃষ্টি হবে?

 প্রশ্ন শুনে রাজারাম বলল, ও, ওই কথা! সে তো আমি আমার গাধার লেজ দেখে টের পাই। যত ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয় ততই আমার গাধার লেজটা শক্ত হয়ে খাড়া হয়ে উঠতে থাকে। আজকের সকালে ওটার লেজটা একেবারে টানটান খাড়া হয়ে উঠেছিল, তাই দেখে বুঝেছিলাম খুব ঝড়বৃষ্টি হবে।

তখন রাজা বললেন, তা হলে তোমার গাধাটাকেই নিয়ে এসো।

 গাধাটা নিয়ে আসার পর গাধাটাকে রাজা তার পরামর্শদাতা ও রাজজ্যোতিষী নিয়োগ করলেন।

এবং সেই শুরু। তারপর থেকে শুধু গাধারাই উচ্চ রাজপথে নিযুক্ত হয়ে আসছে।

অধ্যায় ১ / ১২৬

সকল অধ্যায়

১. পঞ্চতন্ত্রের শেষ গল্প
২. খেজুরে গুড়ের সন্দেশ
৩. রেলবাজার স্টেশন
৪. চলন্তিকা
৫. জারিনা বিবি
৬. আরম্ভ
৭. মূল কাহিনি
৮. ব্লটিং পেপার
৯. ছোটসাহেব
১০. হন্তদন্ত
১১. ভাল খবর, খারাপ খবর
১২. হাস্যকর
১৩. সর্বাঙ্গসুন্দরের কবিতা
১৪. চেয়ার
১৫. মার্জার পুরাণ
১৬. কাঁঠালহাটির গল্প
১৭. গয়া-গঙ্গা ভ্যারাইটি
১৮. লালমোহনের বিপদ
১৯. পটললালের বিপদ
২০. চর্মন্তুদ অথবা জুতো ও পটললাল
২১. বিবাহঘটিত
২২. একদা প্রভাতকালে
২৩. ফুটবল
২৪. রাঁধি মাছ না ছুঁই তেল
২৫. ছত্র বর্ধন
২৬. বিপদ ও তারাপদ
২৭. পটললাল, চলচ্চিত্র ও লেখক
২৮. অদূরভাষ
২৯. ধর্মাধর্ম
৩০. চাষির মুখে হাসি
৩১. বেশ-বেশ
৩২. ২৫০%
৩৩. একটি গল্পের নবজন্ম
৩৪. এখনই
৩৫. বইমেলায় পটলবাবু
৩৬. একটি পুস্তক সমালোচনা
৩৭. লক্ষ্মীর প্রত্যাবর্তন
৩৮. জটিলেশ্বর
৩৯. ডবল পটললাল
৪০. রোশনচৌকি
৪১. সুধানাথবাবু মন্ত্রী হলেন
৪২. ভাগলপুরের পাঞ্জাবি
৪৩. শেষ অশ্বারোহী
৪৪. স্বর্গের চাবি
৪৫. আরশোলা এবং নিদারুণ বার্তা
৪৬. একটি অখাদ্য গল্প
৪৭. একটি আদ্যোপান্ত দুর্ঘটনা
৪৮. গোরুর গল্প
৪৯. ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের চিঠি
৫০. আবহাওয়া
৫১. ঘুঘু কাহিনি
৫২. সাক্ষাৎকার
৫৩. ভজহরি চাকলাদার
৫৪. জয়াবতী ও জয়গোপালের কাহিনি
৫৫. নিরুদ্দেশ জানলা
৫৬. খদ্দের
৫৭. ভ্রমণকাহিনি
৫৮. লাথ্যৌষধি
৫৯. বাণেশ্বরের রোগমুক্তি
৬০. জীবনবাবুর পায়রা
৬১. মনোজ সান্যালের গল্প
৬২. ভজগোবিন্দ ভোজনালয়
৬৩. নবারুণবাবু সুখে থাকুন
৬৪. কণ্টকাকীর্ণ
৬৫. বেঁচে আছি
৬৬. সঞ্চয়িতা
৬৭. পুরনো পল্টন
৬৮. রেটটা একটু কমান
৬৯. গেঞ্জি
৭০. ভিখারি বিষয়ে
৭১. বইমেলা
৭২. পাদুকার বদলে
৭৩. নামাবলী
৭৪. পাপি সুইমিং স্কুল
৭৫. টমাটো সস
৭৬. গয়া ১৯২৪
৭৭. টাইপ-রাইটার
৭৮. দুই মাতালের গল্প
৭৯. মহামহিম
৮০. জয়দেবের জীবনযাত্রা
৮১. একদিন রাত্রে
৮২. কালমেঘ
৮৩. চশমা
৮৪. সার্জন সাহেবের বাড়িতে
৮৫. কবিতা ও ফুটবল
৮৬. এন-আর-আই
৮৭. গুপ্তপ্রসঙ্গ
৮৮. দাঁত
৮৯. একশো টাকার ভাঙানি
৯০. সান্যাল স্লিমিং
৯১. হাতে খড়ি
৯২. অন্য এক মাতালের গল্প
৯৩. অবসরের দিনলিপি
৯৪. বিমান কাহিনি
৯৫. শালিক ও শ্যালিকা
৯৬. তরমুজের বীজ
৯৭. টালিগঞ্জে পটললাল
৯৮. পটললাল ও মধুবালা
৯৯. নীল আলো
১০০. পাঁচ-পাঁচ
১০১. বেগুন, মোচা এবং কাফকা
১০২. হৃদয় ঘটিত
১০৩. অবিচ্ছিন্ন
১০৪. চিকিৎসা
১০৫. কে মারা যাচ্ছে?
১০৬. পটললাল ও মিস জুলেখা
১০৭. নিজেকে জানো
১০৮. ভাল-খারাপ
১০৯. ব্যাঙ
১১০. বরাহমিহিরের উপাখ্যান
১১১. বিবি এগারো বারো
১১২. হুঁকো
১১৩. ফুঃ
১১৪. স্বর্গের গল্প
১১৫. হরিনাথ ও হরিমতী
১১৬. জীবনযাপন
১১৭. ফুলকুমারী
১১৮. জতুগৃহ
১১৯. বিষ
১২০. বাঁচার মতো বাঁচা
১২১. নস্যি
১২২. ডিম
১২৩. এক প্রধানের গল্প
১২৪. আবগারীশ্বরী
১২৫. কাণ্ড-কারখানা
১২৬. আধকপালে

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন