আকাশে শকুন

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

তারপর সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয় দারুণ যুদ্ধ। মুনাফার খাতিরে যে-সভ্যতা তার পক্ষে পৃথিবীর বুকে এই রকম শকুনের উৎসব ডাকা ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না, কেন, তাই দেখো। 

পৃথিবীতে পেছিয়ে-পড়া দেশের তো একটা সীমা আছে। আর তাছাড়া, যে-সব দেশে ধনতত্ত্ব বেড়েছে সেই সব দেশের মধ্যে কোনো দেশে তা আগে দেখা দিয়েছে আর কোনো দেশে বা পরে দেখা দিয়েছে। তাই, যে-সব দেশে ধনতন্ত্র আগে 

দেখা দিয়েছে। সেই সব দেশের মালিকেরা পেছিয়ে-পড়া দেশগুলোর ওপর আগে ঝাপিয়ে পড়েছে। এইভাবে অনেকদিন আগেই পেছিয়ে-পড়া দেশগুলো নিয়ে একটা মোটামুটি ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তারপর? ধনতন্ত্র তো থেমে নেই। উৎপাদনের শক্তি দিনের পর দিন বেড়ে যায়, কলকারখানার উন্নতি হতে থাকে, তৈরি হতে থাকে আরো রাশি রাশি জিনিস। যে-সব দেশগুলোয় ধনতন্ত্র পরে দেখা দিয়েছে সেই সব দেশগুলোয় উৎপাদন যখন এইভাবে খুব বেশি বেড়ে যায়। তখন সে দেশের মালিকদের কী গতি হবে? পেছিয়ে-পড়া দেশ যা ছিলো তার তো প্ৰায় সবই অন্যেরা আগে থাকতে দখল করে নিয়েছে। তাছাড়া, যে-সব দেশে ধনতন্ত্র আগে দেখা দিয়েছে সেই সব দেশের মালিকদেরই বা কী গতি হবে? পেছিয়ে-পড়া দেশ আর কোথায়? 

তাই এই অবস্থায় পৌছে ধনতন্তরের দেশগুলো নিজেদের মধ্যে মারামারি-কাটাকাটি করা ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পায় না। পৃথিবী জুড়ে শুরু হয় দারুণ যুদ্ধ, আসলে বাজার জোগাড় করার যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধ তো করবে সাধারণ মানুষ। মালিকরা তো আর নিজে হাতে ঢাল-তরোয়াল বা বন্দুক-কামান নিয়ে লড়াই করতে বেরুবে না। কিন্তু সাধারণ লোক যদি বুঝতে পারে এই যুদ্ধের পেছনে আসল মতলব হলো মালিকদের মুনাফা-লোভ তাহলে তো তারা বেঁকে বসবে। কোন ব্যবসাদারের কী লাভ-লোকসান হচ্ছে তাই ভেবে আমি মরতে যাবো কেন? তাই মালিকদের তরফ থেকে অনেক সব মিথ্যে কথা রটাবার ব্যবস্থা। সেই সব মিথ্যে কথায় ভুলিয়ে সাধারণ মানুষকে লড়াইয়ের ফাঁদে ফেলবার কায়দা। বেশির ভাগ খবরের কাগজই তো মালিকদের সম্পত্তি, তাই মালিকরা যখন মুনাফার লোভে লড়াই লাগাবার মতলব করে তখন এই সব খবরের কাগজগুলোয় রাশি রাশি মিথ্যে কথা ছাপিয়ে দেয়। খবরের কাগজে যদি সত্যিকারের খবরই ছাপা হতো তাহলে লেখা থাকতো কোন কোন দেশের কোন কোন মালিক-দল মুনাফার নেশায় কী রকম অন্ধ হয়ে পৃথিবীর বুক থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ উজাড় করবার আয়োজন করছে! 

তা ছাড়া লড়াই লাগানোর ব্যাপারে মালিকদের তো আরো একটা মস্ত সুবিধে রয়েছে। তৈরি মাল বিরি করা নিয়েই তো সমস্যা। লড়াই করে অন্য দেশ জিতে সেই দেশে মাল চালান দেবার সুবিধে ছাড়াও লড়াইয়ের সময়ে লড়াইয়ের কাজে রাশি রাশি মাল বিরি করবার সুযোগও। বন্দুক, কামান আর হাওয়া-গাড়ি হাউই জাহাজ থেকে শুরু করে পলটনদের জামা-জুতো পর্যন্ত কতোই না! এতো সব জিনিসপত্র চড়া দরে বিক্রি করতে পারলে মালিকদের সমস্যার কী রকম সহজ সমাধান হয় তা তো বুঝতেই পারছো। দেখছিলাম, মার্কিন দেশের ব্যবসাদারদের একটা কাগজে বেশ খোলাখুলিভাবেই লিখেছে : কোরিয়ায় যুদ্ধ বেধে আমাদের ব্যবসার সমস্যা। এ-বছরকার মতো সমাধান হয়েছে! 

অবশ্য লড়াইতে বড্ড মানুষ মরে। কিন্তু তাতে কীই বা যায় আসে? ধনতন্তরের কাছে মানুষ তো আর আসল কথা নয়। আসল কথা হলো মালিকদের মুনাফা। লড়াই লাগাতে পারলে মালিকরা দেদার মুনাফা পায়। আর তাই আজকের দিনে পৃথিবীর বুক থেকে একটা মহাযুদ্ধের ক্ষত শুকোতে না শুকোতে আর একটা মহাযুদ্ধ বাধাবার সাংঘাতিক তোড়জোড়! 

সকল অধ্যায়

১. শূন্য নিয়ে ছেলেখেলা?
২. বুড়ি পৃথিবীর বয়েস কতো?
৩. সে এক তুমুল কান্ড
৪. প্ৰাণের জন্ম
৫. এই দুনিয়ার এমন মজা
৬. এক যে ছিল অবাক ছেলে
৭. কঙ্কালে কঙ্কালে ভাইভাই
৮. তোমার যখন লেজ
৯. পাহাড়ের বই
১০. খুদেদের রাজত্ব
১১. মাছ আর মাছখেকো মানুষ
১২. ডাঙায় ওঠার পালা
১৩. দুঃস্বপ্নের যুগ
১৪. ডিম নয় আর
১৫. চার পা ছেড়ে দু-পা
১৬. পরে বলবো
১৭. পৃথিবীকে জয় করা
১৮. বন্য থেকে সভ্য
১৯. মানুষ যখন ছেলেমানুষ ছিলো
২০. নাচ, ছবি আর ইন্দ্ৰজাল
২১. মানুষের শত্রু মানুষ
২২. সিপাই-শারী পাণ্ডা-পুরুত
২৩. মনের মতো কথা
২৪. নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন
২৫. পিরামিড আর মমির রহস্য
২৬. সিন্ধু আর গঙ্গার কিনারায়
২৭. গ্রীসের গৌরব
২৮. রোমের দম্ভ
২৯. রোমের পতন
৩০. পাথরের দুর্গ আর বীর পুরুষের বল্লম
৩১. চলো যাই শহরে
৩২. বোম্বেটেদের দল
৩৩. মানুষ চাই
৩৪. মেজাজ বদল
৩৫. এপিঠ-ওপিঠ
৩৬. মুনাফার জন্মকথা
৩৭. বিপদ! বিপদ!
৩৮. আকাশে শকুন
৩৯. বিজ্ঞান : কী ও কেন
৪০. পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী
৪১. মরিয়ার শেষ কামড়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন