বন্য থেকে সভ্য

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

হাতিয়ার হাতে পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের লড়াই। মানুষের হাতিয়ার যতো ভালো হয়েছে মানুষ ততোই ভালো করে পৃথিবীকে চিনতে আর জয় করতে শিখেছে। তাই হাতিয়ারের উন্নতি মানুষকে কোথা থেকে কোথায় এগিয়ে নিয়ে গেলো তারই একটা হিসেব দেখা যাক। 

মানুষ যখন সবেমাত্র পশুর রাজ্য পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে তখনই কিন্তু তার সঙ্গে পশুর তফাত তেমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি। তখনো বনেজঙ্গলেই মানুষের বাস, বনজঙ্গল থেকে ফলমূল জোগাড় করেই পেট ভরাবার চেষ্টা। কেননা, মানুষের হাতিয়ার তখনো এমনই ভোঁতা। আর বাজে যে তাই দিয়ে ফলমূল জোগাড় করবার চেয়ে বড়ো একটা বেশি কাজ করা যায় না। মানুষের এই অবস্থোটাকে বলা হয় বন্য অবস্থার সাব-নিচু দশা। আর এই দশায় মানুষের যেটা সবচেয়ে বড়ো আবিষ্কার সেটা হলো তার কথা বলবার ভাষা। 

এইখানে কিন্তু গল্পটা বেশ একটু জটিল। সবটা খুঁটিয়ে বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হবে। কিন্তু সাঁটে বলবো, নইলে তোমার ঘুম পেয়ে যাবে। 

মানুষের পুর্বপুরুষদের শরীরের গড়ন বদলাতে বদলাতে যখন থেকে এক জোড়া হাত দেখা যাচ্ছে তখন থেকে-আর তারই ফলে মানুষের শরীরে আরো রকমারি অদল বদল শুরু হয়েছে। যেমন ধরো, যতোদিন হাত বলে কিছু নেই ততোদিন অনেক কাজ করতে হয় মুখের চোয়াল দিয়ে; গাছের ফলমূল ছেড়া থেকে রকমারি কাজ। কিন্তু হাতের কাজ শুরু হবার সময় থেকে চোয়াল জোড়ার দায় ঢের কমলো। তুলনায় অকেজো হবার ফলে চোয়াল জোড়ার মোপও সিটিয়ে আসতে লাগলো। তাই মাথার খুলির মধ্যে মগজ বলে যে-জিনিসটি আছে যার উপর নির্ভর করেই মানুষের সব রকম ভাবনা-চিন্তা করবার ক্ষমতা— সেই মগজটি যাতে বাড়তে পারে তার জন্যে খুলির মধ্যে জায়গা তৈরি হলো। বাড়লো মানুষের মগজ হাতের কাজের রকমারি দায়দায়িত্ব চোকাবার জন্যে নতুন ধরনের ভাবনা-চিন্তার তাগিদ মেটাবার পক্ষে ওই সুবিধাজনক মগজের গড়নটাও আরো জটিল আর উন্নত হতে লাগলো। মানুষের পূর্বপুরুষ বনমানুষেরা যা ভাবতে পারতো না, মানুষ তা ভাবতে শিখলো; তার মাথায় নতুন নতুন ধারণা আসতে শুরু করলো। ফলে কিন্তু হাতের কাজটাও উন্নত হতে লাগলোঃ নতুন করে ভাবতে শিখে নতুন ধরনের কাজ করবার ধারণা নিয়ে মানুষ নুতন রকমের কাজকর্ম করতে শুরু করলো। সোজা কথায়, মগজের উন্নতির ফলে হাতের–আর হাতের কাজেরও উন্নতি হতে লাগলো। 

হাতের উন্নতির সঙ্গে চিস্তাশক্তির উন্নতি-দুটোকে তাই আলাদা করা যায় না।

কিন্তু মানুষের মুখে ভাষা ফুটুলো কী করে? ভাষা বলতে অবশ্যই গলার স্বর; শরীরের যে-অংশর উপর নির্ভর করে জন্তু জানোয়ার থেকে মানুষ পর্যন্ত গলার যে-স্বর বের করতে পারে তাকে বলে স্বর্যযন্ত্র। ইংরেজীতে যাকে বলে ল্যারিঙস। কুকুর ঘেউঘেউ করে, বেড়াল মিউ মিউ করে, পাখির গলার স্বর আমাদের 

কাছে অনেক সময়ই সুরেলা লাগে। এদের সকলের শরীরেই স্বর্যন্ত আছে। মানুষের তুলনায় তা খুব একটা বাজে ধরনের নয়। তাঁরাও গলা দিয়ে রকমারি আওয়াজ বের করে। 

কিন্তু এরা কেউ কথা বলতে পারে না। তার মানে, এদের কারুর মুখেই ভাষা ফোটে নি। শুধু মানুষের মুখে ভাষা ফুটেছে, শুধু মানুষই কথা বলতে পারে। 

তাহলে ব্যাপারটা আসলে কী? স্বর্যযন্ত্র থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো জীবজন্তু কেন কথা বলতে পারে না? স্বর্যযন্ত্র ব্যবহার করেই মানুষ কিন্তু কথা বলতে পারে। তফাতটা কেন? 

কেননা, ভাষা বলতে শুধু গলার শব্দ বের করা নয়। মানুষের ভাষা শব্দ দিয়ে তৈরি; কিন্তু শব্দগুলোর মানে আছে। শব্দগুলোকে তাই বলে ধারণার বাহক। আমি একটা কথা বললাম; তুমি শুনলে আর শুনে বুঝতে পারলে আমি ঠিক কী বলতে চাই। তার মানে, আমার কথাটা তোমার কাছে আমার ধারণাটা পৌঁছে দিলো। তাহলে মগজের উন্নতির ফলে ধারণা বলে ব্যাপারটা সৃষ্টি না-হওয়া পর্যন্ত গলার স্বর নেহাতই অর্থহীন হয়ে থাকে। কিন্তু মগজের উন্নতির ফলে মানুষের মাথায় ধারণা সৃষ্টি হলো। একের ধারণা বাকি দশের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে মানুষের গলার স্বর আর নেহাতই অর্থহীন চীৎকার হয়ে রইলো না। ধারণার বাহক হয়ে গেলো। মগজের উন্নতি না হলে পুরো ঘটনাটাই ঘটতে পারতো না। 

এদিকে কিন্তু মানুষের মুখে ভাষা ফোটবার ফলে তার হাতের কাজও আরো উন্নত হতে লাগলো। কেননা, একের ধারণা বাকি দশের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে দশে মিলে কাজটা করা অনেক সহজ হয়। এদিক থেকে ভাবলে বুঝতে পারা যায়, মুখের ভাষার সঙ্গে-কথা বলতে শেখবার সঙ্গে আবার সেই মেহনতেরই সম্পর্ক, হাতের কাজের সম্পর্ক। দল বেঁধে কাজ করতে গেলে ভাষার কথা বলার-সম্পর্ক যে কতো কাছাকাছি তা তো হামেশাই দেখা যাচ্ছে। কোন দিকে বিপদ, কোন দিকে খাবারের যোগান—এই সব ব্যাপার একজনের পক্ষে দলের বাকি দশজনকে অনেক সহজে মানুষ বোঝাতে পারে। কেননা, তার মুখে কথা ফুটেছে। 

অবশ্য এই সব ব্যাপার নিয়ে আরো অনেক আলোচনা বাকি আছে। গলা দিয়ে কোন শব্দ বের করলে মানুষের ভাষা হিসেবে তা কোন ধারণার বাহক হবে তা নির্ভর করছে মানুষের দলের উপর। তাই এদেশে একটা শব্দের মানে এক, অপর দেশে সেই শব্দরই মানে আলাদা। “গান” বলতে আমরা যা বুঝি, ইংরেজরা তা বোঝে না। আর তাই শিশুকে ভাষা শেখাতে হয়; জন্ম থেকেই তো তার মুখে কথা ফোটে না। মা-বাবার কাছ থেকে তাকে ধীরে ধীরে ভাষা শিখতে হয়। তার মানে, তাকে শেখাতে হয়, নিজেদের দলের অপর দশজনের কাছে অমুখ-ধরনের গলার স্বর মানে অমুখ; তমুখ ধরনের গলার স্বর মানে তমুখ 

আমি যে গল্প শুরু করেছি। আর তা শুনতে শুনতে তোমার কাছে গল্পটা যে বেশ জমে উঠছে তার কারণ তোমার আর আমার ভাষা একই। গল্প বলতে বলতে আমার গলা শুকিয়ে এলে তোমায় যদি এক গেলাস জল এনে দিতে বলি তাহলে তুমি নিশ্চয়ই তা এনে দেবে। পশুর জগতে এমন ব্যাপার সম্ভবই নয়। 

কথাগুলো মনে রেখে আমাদের আসল গল্পটায় ফেরা যাক। 

পাথর নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মানুষ দুটো দারুণ জরুরী জিনিস আবিষ্কার করে ফেললো। এক হলো পাথরের হাতিয়ার, আর এক হলো আগুন। ধারালো আর ছুঁচোলো পাথরের টুকরোগুলো হাতিয়ার হিসেবে চমৎকার। তাই দিয়ে মাটি খোড়া যায়, শিকার করা যায়, এমনি কতো কি। আবার একরকম পাথরে পাথরে ঠোকা দিলে ঠিকরে বেরোয় আগুনের ফুলকি, সে-ফুলকি শুকনো পাতায় পড়লে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। মানুষ আবিষ্কার করলো আগুন। সেই আগুনে মাছ ঝলসে খাওয়া, শিকার ঝলসে খাওয়া, খাওয়া-দাওয়ায় কতোই না উন্নতি! 

ইতিমধ্যে শিকার জোগাড় করবার জন্যে মানুষ বর্ষা আর মুগুর তৈরি করতে শিখেছে। এতো সব আবিষ্কারের দরুন মানুষ অনেকখানি স্বাধীন হয়ে উঠলো। খাবারের আশায়, শীতের হাত থেকে বাঁচবার আশায়, জঙ্গলের একটা জায়গায় আর কুঁকড়ে পড়ে থাকবার দরকার নেই। তাই মানুষ শুরু করলো ঘুরে বেড়াতেঃ নদীর কিনারা ধরে ধরে এ-জঙ্গল পেরিয়ে ও-জঙ্গল, এ-দেশ পেরিয়ে ও-দেশ। অনেক হাজার বছর ধরে যাযাবর মানুষের দল পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়িয়েছে, ওদের পাথরের তৈরি হাতিয়ার সে-সময়ে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীময়। সে-সব হাতিয়ার আজও আমাদের চোখে পড়ে, বৈজ্ঞানিকেরা সেগুলির খোঁজ পেলে যত্ন করে জাদুঘরে জমিয়ে রাখেন। মানুষের এই যে-অবস্থা, এর নাম দেওয়া হয় বন্য অবস্থার মাঝামাঝি দশা। 

তারপর মানুষ আবিষ্কার করলো তীর-ধনুক। তীর-ধনুকই বন্য অবস্থার সবচেয়ে চূড়ান্ত হাতিয়ার। তাই তীর-ধনুক হাতে পেয়ে মানুষ উঠে এলো বন্য অবস্থার সব-ওপর স্তরে। তীর-ধনুক পেয়ে শিকার জোগাড় করা কতখানি সহজ হলো তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারোঃ খাবার জোগাড় করবার সমস্যা অনেকখানি চুকে গেলে, মানুষ যেন থিতিয়ে বসবার অবসর পেলো। দেখা গেলো, মানুষ গ্রাম গড়বার চেষ্টা করছে। অবশ্য তখনকার দিনের গ্রাম আজকালকার গ্রামের চেয়ে ঢের ঢের বাজে ব্যাপার। ইতিমধ্যে পাথরের হাতিয়ারগুলোর অনেক ধারালো, অনেক ভালো হয়ে উঠেছে, তাই নিয়ে মানুষ নানান রকম কাঠের জিনিস তৈরি করতে শুরু করেছে।—কাঠের ডিঙি, কাঠ কুরে কুরে কাঠের বাটি বা ঘট, এই রকম অনেক কিছু। 

তারপর মানুষ শিখলো মাটির ঘট বানাতে আর তখন থেকেই বন্য দশকে পেছনে ফেলে সভ্যতার স্তরে উঠে আসা। আর তারপর দুটো দারুণ আবিস্কারঃ পশুপালন আর চাষবাস। পশুপালন : শিকারের আশায় আর হন্যের মতো বনে বনে ঘুরতে হবে না, তার বদলে বনের জানোয়ারকে পোষ মানিয়ে ঘরে বেঁধে রাখা। এই সব জানোয়ারের কাছ থেকে দুধ পাওয়া যাবে, মাংস পাওয়া যাবে, পাওয়া যাবে চামড়া। পালন-করা পশু বলতে বেশির ভাগই গরু আর ভেড়া। আর চাষবাস বলতে আজকালিকার মতো ক্ষেতে লাঙল দিয়ে ফসল ফলানো বোঝায় না। তবু ফসল ফলানো, মাটির বুকে খাবার ফলানোর কাজটা নিজের কবলে, তাই ফলমূলের আশায় আর বনে বনে ঘোরা নয়। 

পশুপালন আর চাষবাস। প্রথম দিকে পাথরের খোস্ত দিয়ে মাটি খুঁড়ে বীজ পোতা; ক্রমশ লাঙ্গল দিয়ে চাষ। সবচেয়ে আদিম ধরনের লাঙল অবশ্য কাঠের তৈরি। কিন্তু মানুষ ক্রমশ শিখলো লোহা গলাতে; লোহা গলিয়ে লোহার হাতিয়ার তৈরি করতে। তৈরি হলো লোহার লাঙল। 

কোথা থেকে শুরু করে মানুষ কোনখানে এসে পৌঁছলো? হন্যের মতো বনে বনে ঘোরা, ভোতা হাতিয়ার দিয়ে কোনোমতে ফলমূল জোগাড় করে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা। ওইখান থেকে শুরু করেছিলো মানুষ। আর লোহা গলাতে শেখবার পর? তখন থেকে, মানুষের পোষা জানোয়ার মানুষের ক্ষেতে মানুষের তৈরি লোহার লাঙল টানছে। ফসল, অনেক অনেক ফসল। নিছক বেঁচে থাকবার জন্যে যতোখানি দরকার তার চেয়েও বেশি জিনিস পৃথিবীর কাছ থেকে আদায় করতে পারা। বাড়তি জিনিস তৈরি করতে পারা, যেজিনিসটাকে ঘরে জমিয়ে রাখা যায়। বেঁচে থাকবার সমস্যা অনেকখানি সহজ হলো, মানুষ মন দিতে পারলো আরো নানান রকম কাজে। মুখের ভাষাকে লেখার হরফ দিয়ে প্রকাশ করতে পারা; মানুষ আবিষ্কার করলো লেখার হরফ। আর এই লেখার হরফ আবিষ্কার হবার সময় থেকে মানুষ রীতিমতো সভ্য হয়ে উঠলো। তার মানে অসভ্য অবস্থাকে পেছনে ফেলে সভ্যতার আওতায় উঠে আসা! 

সভ্যতার কথায় পরে আসছি। সভ্যতা শুরু হবার আগে পর্যন্ত মানুষের যে কী অবস্থা তা আর একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। 

সকল অধ্যায়

১. শূন্য নিয়ে ছেলেখেলা?
২. বুড়ি পৃথিবীর বয়েস কতো?
৩. সে এক তুমুল কান্ড
৪. প্ৰাণের জন্ম
৫. এই দুনিয়ার এমন মজা
৬. এক যে ছিল অবাক ছেলে
৭. কঙ্কালে কঙ্কালে ভাইভাই
৮. তোমার যখন লেজ
৯. পাহাড়ের বই
১০. খুদেদের রাজত্ব
১১. মাছ আর মাছখেকো মানুষ
১২. ডাঙায় ওঠার পালা
১৩. দুঃস্বপ্নের যুগ
১৪. ডিম নয় আর
১৫. চার পা ছেড়ে দু-পা
১৬. পরে বলবো
১৭. পৃথিবীকে জয় করা
১৮. বন্য থেকে সভ্য
১৯. মানুষ যখন ছেলেমানুষ ছিলো
২০. নাচ, ছবি আর ইন্দ্ৰজাল
২১. মানুষের শত্রু মানুষ
২২. সিপাই-শারী পাণ্ডা-পুরুত
২৩. মনের মতো কথা
২৪. নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন
২৫. পিরামিড আর মমির রহস্য
২৬. সিন্ধু আর গঙ্গার কিনারায়
২৭. গ্রীসের গৌরব
২৮. রোমের দম্ভ
২৯. রোমের পতন
৩০. পাথরের দুর্গ আর বীর পুরুষের বল্লম
৩১. চলো যাই শহরে
৩২. বোম্বেটেদের দল
৩৩. মানুষ চাই
৩৪. মেজাজ বদল
৩৫. এপিঠ-ওপিঠ
৩৬. মুনাফার জন্মকথা
৩৭. বিপদ! বিপদ!
৩৮. আকাশে শকুন
৩৯. বিজ্ঞান : কী ও কেন
৪০. পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী
৪১. মরিয়ার শেষ কামড়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন