শূন্য নিয়ে ছেলেখেলা?

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

মানুষের গল্প বলতে বসার একটা মুশকিল আছে। মুশকিলটা হলো, মানুষের গল্প বলতে গেলে মানুষের কথা দিয়ে শুরু করা যায় না। কেননা, এককালে পৃথিবীর কোথাও মানুষের টিকিট খুঁজে পাবার জো ছিল না। আবার তারও আগে কোথাও পৃথিবী বলে কোনো কিছুর চিহ্ন ছিল না।

তাহলে? কোথা থেকে এলো এই পৃথিবী? মানুষের দলই বা এলো কোথা থেকে?

এই সব কথা থেকেই শুরু করতে হবে মানুষের গল্প। কিন্তু তাতেও খুব মুশকিল আছে। কেননা, এই সব কথা এতো ভয়ানক বেশিদিন আগেকার কথা যে তা শুনে ব্যাপারটা ঠিকমতো ঠাহর করতে পারা যায় না। যেমন ধরো, হিসেব করে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর জন্ম হয়েছে নিদেনপক্ষে সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে তো বটেই, তার চেয়েও বেশি বছর হতে পারে!

ভেবে দেখো ব্যাপারটা! সাড়ে চারুশো কোটি বছর! তার মানে, সাড়ে চারশোর পেছনে সাত সাতটা শূন্য! কিন্তু শূন্য নিয়ে তো সত্যিই ছেলেখেলা নয়। এক একটা শূন্যর চোটেই একেবারে আকাশ পাতাল তফাত হয়ে যায়। একের পিঠে একটা শূন্য বসাও, হয়ে যাবে দশ ৷ অথচ, দশ বছর আগেকার কোনো ব্যাপারই তুমি নিজের চোখে দেখো নি, আর না হয়তো এতো ছোট্ট ছিলে যে তখনকার কোনো কথা তোমার মনে নেই।

আর একটা শূন্য বাড়াও ৷ হয়ে যাবে একশো। একশো বছর, বাস্রে! তুমি তো তুমি, তখন তোমার দাদুই বলে জন্মান নি। হয়তো তোমার দাদুর বাবা সবে পাত্তাড়ি বগলে করে পাঠশালায় যেতে শিখছে। তখন এই কলকাতা বলে শহরটার চেহারাই কি এই রকম ছিল নাকি? তখনো ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়িরই চল হয় নি, আজকালকার ট্রামগাড়ি আর মোটরগাড়ির কথা তো কেউ ভাবতেই পারতো না। এই রকমঃ একটা শূন্যের চোটে একেবারে অন্য রকম। তারপর আর একটা শূন্য বাড়াও। একের পিঠে তিনটে শূন্য। একহাজার। এক হাজার বছর আগেকার কথা কিছু ভাবতে পারে? তখন, ইংরেজ তো দূরের কথা, আমাদের দেশে মোগল আসেনি, পাঠান আসেনি। কলকাতা শহর তো দূরের কথা এমন কি দিল্লির দরবারের চিহ্নটুকুও নেই! আরো একটা শূন্য বাড়াও, হয়ে যাবে দশ হাজার বছর। বাস্রে, সে কি কম কথা? রামায়ণ-মহাভারতেরও আগেকার কথা। তখন শুধু বনজঙ্গল। সভ্য মানুষের চিহ্ন কোথাও নেই। এখানে ওখানে অসভ্য মানুষের দল ফলমূল আর শিকার জোগাড় করবার আশায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারপর যদি আরো একটা শূন্য বাড়াও তাহলে হয়ে যাবে একের পিঠে পাঁচটা শূন্য। তার মানে এক লক্ষ বছর। তখন যে কী রকম ব্যাপার তা আন্দাজ করতেই পারা যায় না।

তাই বলছিলাম, শূন্য নিয়ে ছেলেখেলা নয়। এক একটা করে শূন্য বাড়িয়ে যাওয়া মানেই একেবারে দারুণ রকমের পেছিয়ে পেছিয়ে যাওয়া। পাঁচটা শূন্য-য় যখন পৌঁছলাম তখন এতোদূর পেছনের কথা ভাববার দরকার পড়লো যে মাথা প্রায় গোলমাল হয়ে যাবার জোগাড়। তাই সাড়ে চারশোর পেছনে সাত সাতটা শূন্য-র কথা ফস্ করে বলে দেওয়াটা যতো সহজ আসলে ব্যাপারটা মোটেই তেমন সহজ নয়।

তার মানে, ভয়ানক আর ভয়ানক রকমের থুরথুরে বুড়ি এই পৃথিবী। এতো থুরথুরে আর এমন বুড়ি যে ভালো করে ভাবতেই পারা যায় না। কিন্তু এর দিকে চেয়ে দেখো, অবাক হয়ে যাবে। বুড়ি কোথায়? সবুজ ঘাস, সোনালী ধান, রঙিন ফুলে ঝলমল। বুড়ি কোথায়? এ তো বরং নিত্যনতুনের মেলা! যে-পাখি আগে কখনো ডাকে নি আজকের ভোরে সেই পাখির ডাক, আগে যেখানে ছিল গভীর অরণ্য আজকের দিনে সেখানে গড়ে উঠেছে বিরাট বিরাট শহর। চিমনির চুড়োগুলো কী দারুণ উঁচু, বাস্রে! মনে হয়। আকাশটাকে বুঝি ফুটো করে দেবে। পঁচিশো বছর আগে এ-রকম উঁচু উঁচু চিমনির কথা কেউ ভাবতে পারতো?

চারদিকেই এই রকম। নিত্যনতুন। তাহলে বুড়ি কোথায়?

অথচ বুড়িই। কেননা, সাড়ে চারশো কোটি বছর বয়েসটা তো চারটিখনি কথা নয়। আর হিসেব করে দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর বয়েস নিদেন পক্ষে অতোগুলো বছর তো হবেই!

অধ্যায় ১ / ৪১

সকল অধ্যায়

১. শূন্য নিয়ে ছেলেখেলা?
২. বুড়ি পৃথিবীর বয়েস কতো?
৩. সে এক তুমুল কান্ড
৪. প্ৰাণের জন্ম
৫. এই দুনিয়ার এমন মজা
৬. এক যে ছিল অবাক ছেলে
৭. কঙ্কালে কঙ্কালে ভাইভাই
৮. তোমার যখন লেজ
৯. পাহাড়ের বই
১০. খুদেদের রাজত্ব
১১. মাছ আর মাছখেকো মানুষ
১২. ডাঙায় ওঠার পালা
১৩. দুঃস্বপ্নের যুগ
১৪. ডিম নয় আর
১৫. চার পা ছেড়ে দু-পা
১৬. পরে বলবো
১৭. পৃথিবীকে জয় করা
১৮. বন্য থেকে সভ্য
১৯. মানুষ যখন ছেলেমানুষ ছিলো
২০. নাচ, ছবি আর ইন্দ্ৰজাল
২১. মানুষের শত্রু মানুষ
২২. সিপাই-শারী পাণ্ডা-পুরুত
২৩. মনের মতো কথা
২৪. নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন
২৫. পিরামিড আর মমির রহস্য
২৬. সিন্ধু আর গঙ্গার কিনারায়
২৭. গ্রীসের গৌরব
২৮. রোমের দম্ভ
২৯. রোমের পতন
৩০. পাথরের দুর্গ আর বীর পুরুষের বল্লম
৩১. চলো যাই শহরে
৩২. বোম্বেটেদের দল
৩৩. মানুষ চাই
৩৪. মেজাজ বদল
৩৫. এপিঠ-ওপিঠ
৩৬. মুনাফার জন্মকথা
৩৭. বিপদ! বিপদ!
৩৮. আকাশে শকুন
৩৯. বিজ্ঞান : কী ও কেন
৪০. পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী
৪১. মরিয়ার শেষ কামড়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন