এক যে ছিল অবাক ছেলে

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

বাপ বললে, পদ্য লিখতে শেখো। কিন্তু পদ্যলেখায় ছেলের মন নেই। কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে যেটুকু বা লিখলে তা নেহাতই অচল, আজেবাজে পদ্য। 

বাপ বললো, তাহলে ডাক্তারি পড়ো। কিন্তু ডাক্তারি পড়ায় ছেলের মন নেই। তাই ডাক্তারি শেখাও হয়ে উঠলো না।

তাহলে পাদরি হবার চেষ্টা দেখো, বাপ বললে। পাদরিদের কাছে লেখাপড়া শিখে পাদরি হবার ব্যবস্থা। কিন্তু পাদরি হওয়ায়ও ছেলের মন নেই। তাই এ-বিদ্যেও বেশি দূর গড়ালো না। 

বাপ বললে, ওর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। দিদি বললে, ওর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। কিন্তু দেখা গেল ওর দ্বারাই হলো। আর এমন দারুণ ব্যাপার হলো যা পালে পার্বণেও হয় না। কেননা, বড় হয়ে এই ছেলেটি যে-সব কথা আবিষ্কার করলে তাই শুনে পৃথিবীর সমস্ত পণ্ডিতদের মাথা একেবারে ঘুরে গেল। 

ছোট্ট বয়েস থেকেই ছেলেটির দারুণ উৎসাহ পোকা-মাকড়, গাছপাতা আর পশুপাখির ব্যাপারে। পাখির ডিম খুঁজতে খুঁজতে সারাটা দিন কেটে যায়। ভোর বেলায় শিকারে বেরোবার কথা থাকলে মাথার কাছে জুতো জোড়া নিয়ে ঘুমোয়, রাত পোয়াতে না পোয়াতে জুতো পরে ফিটফট। আর নতুন ধরনের কোনো পোক-মাকড় দেখলে ছেলেটি আনন্দে যেন দিশেহারা হয়ে যায়। একবার হয়েছিল কি, ছেলেটি দেখলো একটা গাছের গুড়িতে তিনটে নতুন ধরনের পোকা। ছেলেটি দু-হাত দিয়ে খাপ খপ করে দুটো পোকা ধরে ফেললো। এদিকে তিন নম্বরের পোকাটা পালিয়ে যায় যায়! কিন্তু দুটো হাতই যে দুটো পোকায় জোড়া। তাহলে? ছেলেটি করলো কি, খপ করে ডান হাতের পোকাটা নিজের মুখের মধ্যে পুরে ফেললো আর ডান হাত দিয়ে চেপে ধরলো তিন নম্বরের পোকাটা। ছেলে-ধরার গল্প শুনেছে, কিন্তু এরকম পোকা-ধারা ছেলের গল্প কখনো শোনো নি নিশ্চয়ই। ছেলেটির নাম চার্লস ডারউইন। প্রায় শ-দেড়েক বছর আগে।—১৮০৯ খৃস্টাব্দে তার জন্ম। 

ডারউইনের তখন বছর একুশ বয়েস। খবর এলো, বিগল বলে একটা জাহাজ। পৃথিবী ঘুরতে বেরোচ্ছে। জলপথে দেশ-বিদেশে সওদাগরী জমাবার পথ বার করাই এর উদ্দেশ্য। কিন্তু জাহাজের ক্যাপ্টেন বলছেন, দেশবিদেশ ঘুরে বিজ্ঞানের খবর জোগাড় করতে কেউ যদি রাজি থাকে তাহলে তাকে এই জাহাজে নিয়ে ঘোরানো যেতে পারে। খবর পেয়ে ডারউইনের তো মহা উৎসাহ। অনেক রকম কাকুতি-মিনতি করে বাবাকে কোনো মতে রাজি করানো গেল। ডারউইন চললো ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু ডারউইনের থ্যাবড়া নাক দেখে ক্যাপ্টেন ভাবলো এর দ্বারা কিচ্ছু হবে না; একে নিয়ে গিয়ে লাভ কী? যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেনেরও মন গলিলো; রওনা হলো বিপুল। 

এ-দেশ থেকে ও-দেশ। এ-দ্বীপ থেকে ও-দ্বীপ। পুরো পাঁচ বছর ওই জাহাজে। আর ডারউইন প্ৰাণ ভরে নানান রকমের ব্যাপার দেখতে লাগলো : পোকা মাকড় আর গাছ-পালা আর পশু-পাখি আর পাহাড়-পর্বত সংক্রান্ত ব্যাপার। নজর করবার মতো যা দেখে খুঁটিয়ে লিখে রাখে। আর সব খুঁটিয়ে দেখে বলেই যা আর পাঁচজনের চোখে পড়ে না তা ডারউইনের চোখে পড়ে। 

তারপর বিগল জাহাজ দেশে ফিরে এলো। কিন্তু ডারউইনের কাজের কামাই নেই, দেখার কামাই নেই। আরো বিশ বছর ধরে জন্তুজানোয়ার আর পোকামাকড় আর পাহাড়পর্বত আর গাছপালার ব্যাপার দেখা। জরুরি ধরনের যা কিছু দেখছে তাই লিখে রাখছে, লিখতে লিখতে খাতার পর খাতা ভরে যায়। 

আর তারপর, এতো সব চোখে দেখা ব্যাপারের নজির নিয়ে বেরুলো ডারউইনের বই। সে-বই পড়ে পৃথিবীর সব পণ্ডিতদের মাথা একেবারে ঘুরে গেল। শুরু হলো দুনিয়া জোড়া হৈ-চৈ। এমন হৈ-চৈ আর কোনো বই নিয়ে পড়েছে কিনা সন্দেহ। 

কিন্তু এতো হৈ-চৈ কেন? কী লেখা আছে। ওই বইতে?

হৈ-চৈ তো হবেই। কেননা, এর আগে পর্যন্ত সবাই যে-কথা ভাবতো, যেকথা মানতো, ডারউইন প্রমাণ করে দিলেন সে-সব একদম ভুল কথা। এর আগে পর্যন্ত সবাই ভাবতো, পৃথিবীর বুকে এতো যে সব লক্ষ লক্ষ প্রাণী তা সবই ভগবানের সৃষ্টি। ভগবান সৃষ্টি করেছেন হাতি আর ঘোড়া, ব্যাঙ আর রাজহাঁস আর শুয়োপোকা আর নটে শাক – সব কিছুই আলাদা করে সৃষ্টি করা। তার মানে, মানুষের সঙ্গে শুয়োপোকার কিম্বা ব্যাঙের কোনো সম্পর্ক নেই। মানুষ হলো 

এক রকম আর ব্যাঙ হলো আর এক রকম। এক্কেবারে আলাদা। 

ডারউইনের বইতে প্ৰমাণ হয়ে গেল, মোটেই তা নয়। এখন এই যে এতো রকম জীবজন্তু আর গাছপালা—এগুলোকে ভগবান সৃষ্টি করেছেন, একথা বলবার কোনো মানে হয়না। কেননা, আসল ব্যাপারটা হলো একেবারে অন্য রকমের ব্যাপার। অনেক অনেক বছর ধরে আদিম প্রাণীরা নানান দিকে নানানভাবে বদলাতে বদলাতে আজকের দিনের এতো সব লক্ষ লক্ষ রকমের প্রাণী হয়ে গিয়েছে। তার মানে, আজকের দিনে এতো রকম সব প্রাণীর একই পুর্বপুরুষ।-

কিন্তু প্ৰমাণ কী? 

প্রমাণ আসলে অনেক রকমের। 

ডারউইনের বইতে অনেক রকম প্রমাণ আছে। 

তাছাড়া, ডারউইনের পর আরো অনেকে আরো অনেক রকম ব্যাপার দেখেশুনে আরো নানান রকম প্রমাণ জোগাড় করেছেন। 

সে-সব প্রমাণের কিছু কিছু নমুনা দেওয়া যাক। 

সকল অধ্যায়

১. শূন্য নিয়ে ছেলেখেলা?
২. বুড়ি পৃথিবীর বয়েস কতো?
৩. সে এক তুমুল কান্ড
৪. প্ৰাণের জন্ম
৫. এই দুনিয়ার এমন মজা
৬. এক যে ছিল অবাক ছেলে
৭. কঙ্কালে কঙ্কালে ভাইভাই
৮. তোমার যখন লেজ
৯. পাহাড়ের বই
১০. খুদেদের রাজত্ব
১১. মাছ আর মাছখেকো মানুষ
১২. ডাঙায় ওঠার পালা
১৩. দুঃস্বপ্নের যুগ
১৪. ডিম নয় আর
১৫. চার পা ছেড়ে দু-পা
১৬. পরে বলবো
১৭. পৃথিবীকে জয় করা
১৮. বন্য থেকে সভ্য
১৯. মানুষ যখন ছেলেমানুষ ছিলো
২০. নাচ, ছবি আর ইন্দ্ৰজাল
২১. মানুষের শত্রু মানুষ
২২. সিপাই-শারী পাণ্ডা-পুরুত
২৩. মনের মতো কথা
২৪. নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন
২৫. পিরামিড আর মমির রহস্য
২৬. সিন্ধু আর গঙ্গার কিনারায়
২৭. গ্রীসের গৌরব
২৮. রোমের দম্ভ
২৯. রোমের পতন
৩০. পাথরের দুর্গ আর বীর পুরুষের বল্লম
৩১. চলো যাই শহরে
৩২. বোম্বেটেদের দল
৩৩. মানুষ চাই
৩৪. মেজাজ বদল
৩৫. এপিঠ-ওপিঠ
৩৬. মুনাফার জন্মকথা
৩৭. বিপদ! বিপদ!
৩৮. আকাশে শকুন
৩৯. বিজ্ঞান : কী ও কেন
৪০. পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী
৪১. মরিয়ার শেষ কামড়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন