মানুষ চাই

দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

বিরাট বিরাট শহর। প্রকাণ্ড প্ৰকাণ্ড কারখানা। পৃথিবীর চেহারাটাই হুড়মুড় করে বদলে যেতে লাগলো! কী তেজ এই নতুন সভ্যতার, যার নাম দেওয়া হয়। ধনতন্ত! কল টিপলে গাড়ি চলে, কল টিপলে তাঁত চলে; চোখের নিমেষে মানুষ পার হয়ে যায় দশ-বিশ করোশ পথ, চোখের নিমেষে মানুষ বুনে ফেলে। দশ-বিশ জোড়া কাপড় 

অনেক টাকা লাগলো। অনেক পুঁজি জুটলো সওদাগরি করে, তেজারতি করে, ডাকাতি করে। কিন্তু শুধু টাকা হলেই তো হয় না। আরো একরকম জিনিস দরকার। সে-জিনিসের নাম হলো মানুষের মেহনত। কারখানা গড়তে গেলে মানুষ চাই, কারখানাকে চালাতে গেলে মানুষ চাই। কারখানা তো আর আপনি-আপনি গড়ে ওঠে না, কারখানা তো আর আপনি-আপনি চলতে থাকে না। তাই কারখানা ফাঁদতে গেলে নগদ টাকা দিয়ে শুধু ইট-পাথর আর লোহা-লক্কড় আর কাঁচামাল কিনলেই হবে না। আরো একটা জিনিস কিনতে হবে, সে-জিনিসটা হলো মানুষের গতর, কিংবা, আরো ভালো করে বললে বলা উচিত, গতর খাটাবার শক্তি। তার মানে, এমন মানুষ চাই যারা নগদ পয়সার বদলে গতির খাটাতে আসবে। এ-হেন মানুষের নাম দেওয়া হয় দিন-মজুর। 

কোথা থেকে পাওয়া যায় ওই দিন-মজুরের দল? যতো দিন সামন্ততন্ত্র ততোদিন দেশের বেশির ভাগ মানুষই যেন খেতের সঙ্গে শেকল দিয়ে বাঁধা : জমিদারের হুকুম ছাড়া জমি ছেড়ে এক-পা নড়বারও উপায় নেই। অবশ্য জমিদারি ব্যবস্থা যতো অচল হয়ে পড়তে লাগলো ততোই প্রজাদের মধ্যে নগদ খাজনায় জমি বিলি করে দেবার ব্যবস্থা দেখা দিতে লাগলো, কিন্তু তাতেও মনের মতো কাঁচা পয়সা মিলছে না দেখে জমিদাররা আবার জমিগুলো কেড়ে নিয়ে সেখানে ভেড়া চরাবার ব্যবস্থা চালু করতে লাগলো। ফলে, অনেক চাষী একেবারে সর্বহারা, একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়লো। খুশিতে ভরে উঠলো ব্যবসাদারদের মন। কেননা, ওই সর্বহারার দল শেষ পর্যন্ত পেটের দায়ে শহরের কারখানায় গতর খাটাতে না গিয়ে যাবে কোথায়? যতোদিন পর্যন্ত গায়ে ভিটেমাটি বজায় থাকবে ততোদিন তো তারা এই ভিটেমাটি আঁকড়েই পড়ে থাকতে চাইবে, কেন যাবে শহরে দিন-মজুর হতে? 

শহরের ব্যবসাদাররাও তাই রব তুললো : ভালো ভালো। জমিদারি ব্যবস্থা যতো উচ্ছন্নয় যায় ততোই মঙ্গল। মানুষের মুক্তি চাই। শিকল দিয়ে আর মানুষকে মাটির সঙ্গে বেঁধে রাখা চলবে না। মানুষের মুক্তি চাই। মানুষের মুক্তি চাই। 

কিন্তু এই যে মুক্তির জন্যে ডাক এ-ডাক মেহনতকারী মানুষকে সত্যিকারের মুক্তি দেবার জন্যে, সত্যিকারের স্বাধীন করবার জন্যে ডাক নয়; এ-ডাকের আসল মানে হলো তাদের পা থেকে এক রকমের শেকল খুলে আর এক রকম শেকল পরাবার জন্যে ডাক। মুক্তি। কিন্তু কিসের থেকে মুক্তি? নিজেদের ভিটেমাটিটুকু থেকে, নিজস্ব বলতে যা-কিছু তাই থেকেই। 

একদিকে অনেক টাকার পুঁজি আর একদিকে অনেক মানুষের যোগান। আর তার ফলে গড়ে উঠলো। ওই নতুন সভ্যতা, যার নাম ধনতন্ত্র, যার কীর্তি সত্যিই আশ্চর্য! 

সকল অধ্যায়

১. শূন্য নিয়ে ছেলেখেলা?
২. বুড়ি পৃথিবীর বয়েস কতো?
৩. সে এক তুমুল কান্ড
৪. প্ৰাণের জন্ম
৫. এই দুনিয়ার এমন মজা
৬. এক যে ছিল অবাক ছেলে
৭. কঙ্কালে কঙ্কালে ভাইভাই
৮. তোমার যখন লেজ
৯. পাহাড়ের বই
১০. খুদেদের রাজত্ব
১১. মাছ আর মাছখেকো মানুষ
১২. ডাঙায় ওঠার পালা
১৩. দুঃস্বপ্নের যুগ
১৪. ডিম নয় আর
১৫. চার পা ছেড়ে দু-পা
১৬. পরে বলবো
১৭. পৃথিবীকে জয় করা
১৮. বন্য থেকে সভ্য
১৯. মানুষ যখন ছেলেমানুষ ছিলো
২০. নাচ, ছবি আর ইন্দ্ৰজাল
২১. মানুষের শত্রু মানুষ
২২. সিপাই-শারী পাণ্ডা-পুরুত
২৩. মনের মতো কথা
২৪. নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন
২৫. পিরামিড আর মমির রহস্য
২৬. সিন্ধু আর গঙ্গার কিনারায়
২৭. গ্রীসের গৌরব
২৮. রোমের দম্ভ
২৯. রোমের পতন
৩০. পাথরের দুর্গ আর বীর পুরুষের বল্লম
৩১. চলো যাই শহরে
৩২. বোম্বেটেদের দল
৩৩. মানুষ চাই
৩৪. মেজাজ বদল
৩৫. এপিঠ-ওপিঠ
৩৬. মুনাফার জন্মকথা
৩৭. বিপদ! বিপদ!
৩৮. আকাশে শকুন
৩৯. বিজ্ঞান : কী ও কেন
৪০. পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী
৪১. মরিয়ার শেষ কামড়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন