আশাপূর্ণা দেবী
আজ আর বাপও জেগে নেই, পিসিও জেগে থাকতে পারেনি। সুখেন দেখলো দেয়ালের ধারে লোহার ঢাকা চাপা দেওয়া খাবার রয়েছে তার। লোহার ঢাকাটা একবার তুললো, দেখলো একটা কলাইকরা থালার পাশে খানিকটা কিসের যেন তরকারি, আর এক গোছা রুটি। আর কিছু না। এক চিলতে আচার পর্যন্ত নয়।
অপ্রবৃত্তি এলো, ঢাকাটা আবার যথাস্থানে রেখে দিলো!
সামান্য একটু শব্দ।
তবু পিসির সতর্ক কান। বলে ওঠে, ‘সুখেন এলি নাকি? এতো রাত পর্যন্ত কোথায় থাকিস?’
সুখেনের গা জ্বলে যায়।
সুখেন বলে, ‘যমের বাড়ি।’
ওই কালো শুঁটকো দাঁতফোকলা আর কটুভাষিণী বুড়িটি না থাকলে যে সুখেনের কী দশা হতো, সে কথা ভাবে না সুখেন, বাড়ি ঢুকেই ওই মূর্তিটি আর তার কর্কশ কণ্ঠের সম্ভাষণ, সর্বাঙ্গে যেন বিষ ছড়ায়।
রেলের কুলিগুলোরও ঘরে একটা বৌ আছে।
দাঁতে দাঁত পিষে এই কথাটা উচ্চারণ করে সুখেন। সুখেনের ধারণা ওই বাপটি আর পিসিটি মিলে ষড়যন্ত্র করে তার কিছু হতে দিল না। কেন, সুখেনের মত চাকরীতে যারা আছে, তারা বিয়ে টিয়ে করে ঘর—সংসার করছে না?
আচ্ছা! আমিও এবার দেখাচ্ছি, অস্ফুট ঘোষণায় বিদ্রোহী হয় সুখেন, ‘স্বভাব খারাপ করে ছাড়ছি।’ যেন ভয়ানক একটা বাহাদুরী করবে।
এটা অবশ্য হাসিরই কথা যে, ওই তুচ্ছ কাজটা করবার জন্যে সুখেনকে এমন তাল ঠুকে ঘোষণা করতে হয়! হাসির কথা, এ যাবৎ পেরে ওঠেনি ওটা! এই রেলস্টেশনের ধারে—কাছে কুলি মজুর বাবু ভদ্রলোক মাস্টার বেকার যেটা অবলীলায় করে ফেলে।
সুখেনের যেন কোথায় একটা অলক্ষ্য ভয়, একটা অদৃশ্য বন্ধন। স্বভাব—চরিত্র খারাপ করে বসলে কার কাছে যেন জবাবদিহি করতে হবে সুখেনকে। দোষণীয় কিছু করে বসলে সেখানে যেন মুখ দেখাতে পারবে না সুখেন।
কেন কে জানে ছোট থেকে সুখেনের কেমন যেন একটা বিশ্বাস ছিল, তুলসী সুখেনের সম্পত্তি। তুলসী ননীর দোকানে বিনি পয়সায় খেটেই আসুক, আর রেল কলোনীর কোয়ার্টারে কোয়ার্টারে চাকরীই করে বেড়াক, অথবা জগু রাজেনের সঙ্গে হি হি করে আড্ডাই দিক, আসল দাবি সুখেনের। সময়কালে সুখেন তার সেই দাবির হাতটি প্রসারিত করে, নিয়ে নেবে ওকে। শুধু সুখেনের বড় হওয়ার ওয়াস্তা, শুধু একটা চাকরী পাওয়ার ওয়াস্তা।
কিন্তু সুখেনের পোড়া কপালে সুখেন বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুলসীও বড় হয়ে গেল, আরো অনেক বড়। তুলসী যে কেমন করে ওই ট্রেনিংটায় ভর্তি হবার চিন্তা মাথায় আনলো, কেমন করেই বা অতো তাড়াতাড়ি ট্রেনিং সেরে চাকরী বাগিয়ে ফেলল! সুখেন দেখলো কোন ফাঁকে তুলসী তার হাতের বাইরে চলে গেছে।
কিন্তু এ অনুভূতি কি একা সুখেনেরই?
রাজেন আর জগাই?
তাদের নয়?
তারাও তো নিয়ত সঙ্গী ছিল সুখেনের। আর সকলেরই একটা আহ্লাদের জিনিস ছিল ওই তুলসী। গেরস্তবাড়ি কাজ করেও তুলসী দিব্যি সময় বার করে ফেলে খেলতে আসতো। একটা খেলা ছিল ওদের রেলগাড়ির খালি কামরায় গদিতে উঠে বসে পা দোলানো, আপার বার্থে চড়ে পড়া, মুখে আঙুল পুরে এঞ্জিনের সিটির অনুকরণে সিটি মেরে অচল গাড়িখানাকে সচলের ভূমিকায় রূপ দেওয়া।
আর একটা খেলা, ফাঁকা গাড়ির এদিকের দরজা থেকে উঠে, ও দরজা দিয়ে নামা।
তখন নেহাৎ বাচ্চা নয় কেউই, তবু ওদের তেমন নয়—তুলসীকেই বেমানান লাগতো এই সব খেলায়। চারটেতেই প্রায় সমবয়সী, বরং হয়তো তুলসীই বয়সে কিছু ছোট, কিন্তু মেয়ের বাড় আর ছেলের বাড়? মেয়ের বাড়কে গ্রামে ঘরে কলাগাছের বাড়ের সঙ্গে তুলনা করে।
স্বাস্থ্যবতী তুলসীর সর্বাঙ্গে যেন সেই বাড়ন্ত কলাগাছের লাবণ্য। ওর ওই টান টান করে পরা খাটো ফ্রক’ আঁটা স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ শরীরটার দিকে লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছে সবাই! অবশ্য যারা ওই দৃষ্টিতেই তাকায়।
যাদের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করতো তারা, তাকাতো ঈর্ষার দৃষ্টিতে। কী খেয়ে মেয়েটার অমন স্বাস্থ্য, অমন গতর! আমাদের ঘরে তো এতো যত্নে—আদরেও ছেলেমেয়েগুলো পাঁকাটি।
খেলার সময় তুলসী প্রায় প্রায়ই পক্ষ বদলাতো। কখনো সুখেনের কখনো জগুর কখনো রাজেনের পক্ষ হয়ে অনায়াসেই বলতো, ‘আয় ভাই আমরা আলাদা খেলি, ওদের সঙ্গে আড়ি।’
অতএব প্রত্যেকের পক্ষেই সুখস্বপ্ন দেখার বাধা ছিল না, ছিল না অধিকার বোধের অনুভূতিতে ডুবে যাওয়ার বাধা।
অবিশ্যি তুলসী হাসপাতালে চাকরী পেয়ে চলে যাবার পর প্রত্যেকেরই মনোভঙ্গ, তবু তুলসী যে তাদের ভোলেনি এটা ঠিক। এইটা দেখে খুশী। হঠাৎ হঠাৎ তুলসীর ওদের তাসের আড্ডায় চলে আসা দেখে বোঝা যায় টানটা যায়নি তুলসীর।
আর এখনো পর্যন্ত তো বিয়ে না করেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তাই তুলসীকে দেখলেই যেন সেই মুড়িয়ে যাওয়া আশাতরুতে হঠাৎ একটা নতুন পাতার শিহরণ জাগে। হয়তো বিয়ে—টিয়ে করে সংসারী হয়ে পড়তে পারলে এ মোহ কেটে যেত। তখন সহসা রাস্তায় দেখা হলে শুধু একটু সৌজন্যের হাসি হেসে বলতো, ‘কী তুলসী, কী খবর?’
হঠাৎ একটা সম্ভাবনায় যেন গায়ে আগুনের হাওয়া বহে গেল সুখেনের। জগু আর রাজেনটা পৌঁছে দিতে গিয়ে এখনো হয়তো ওর সেই দাওয়ায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। লোক ভয় তো নেই তুলসীর।
সুখেন হতভাগা মান দেখাতে গিয়ে—
সুখেন নিজের গালে ঠাস করে একটা চড় মারলো।
পিসি কোণ থেকে বললো, ‘মশা মারতে গালে চড় খাচ্ছিস সুখেন? কই মশা তো নেই তেমন? হ্যাঁ, মশা ছিল তোদের চাঁপতায়। ঘরের মানুষকে বাইরে টেনে নিয়ে যেত। তা দেশভুঁই আর দেখলি কবে? সেই যে রেলের চাকরী নিয়ে চলে এলো তোর বাবা আর তো ও—মুখো হল না। তোর মা—’
অসহ্য! অসহ্য!
সুখেন হঠাৎ ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে রাস্তায় পড়ে হন হন করে হাঁটতে শুরু করে।
রাজেন আর জগু ফেরার সময় বোধকরি ভয় কাটাতেই খোলা গলায় গল্প করতে করতে ফিরছিল।
ভূতের ভয় নয়, চোর—টোরের ভয়।
অথচ ভাল করে ভেবে দেখলে ও ভয় পাওয়ায় হেসেই উঠতে পারতো।
কী নেবে তাদের কাছ থেকে চোর?
একটা কানাকড়িও তো সঙ্গে নেই।
পরনের প্যাণ্ট শার্টটা ছাড়া কিছু বলতে কিছু না।
তবু ভয়।
ভয় জিনিসটা সহজাত। ভয়ের জন্যেই ভয়।
অথচ ওই তুলসী নামের মেয়েটার প্রাণে ভয় নেই। সেই কথাটাই বলতে বলতে আসে ওরা!
‘বুকের পাটাটা বটে। একা মেয়েছেলে, একটা আলাদা বাসা করে থাকে।’
‘আমি একবার বলেছিলাম হাসপাতালের আর কোন মেয়েছেলের সঙ্গে ভাব করে দুজনে একসঙ্গে থাকতে পারিস। তারও সুবিধে, তোরও সুবিধে—’ তা উত্তর দিয়েছিল—’তার সুবিধে হতে পারে, আমার সুবিধে ঘোড়ার ডিম, একত্রে থাকলেই একত্রে খাওয়া দাওয়া। আমি যা খাই—দাই তাতে তার পোষাবে না, তাই নিয়ে মনোমালিন্য হবে। তাছাড়া কার মনে কী আছে, কী কেলেঙ্কারি করে বসবে না বসবে, দরকার কী বাবা সুখে থাকতে ভূতের কিল খাবার?’
কিন্তু তুলসীকে ওরা যত নির্ভয় ভাবে, সত্যই কি আর এখন নির্ভয় আছে তুলসী? যুদ্ধ করতে করতে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে না কি?
রেল কলোনির এধারে নতুন কোয়ার্টারের সারি তৈরী হচ্ছে। সেই জুতোর দোকানের র্যাকে সাজানো জুতোর বাক্সর মত বোদা বোদা বাড়ির সারি। এত আছে তবু কুলোচ্ছে না, কুলোচ্ছে না।
পৃথিবীর বুকে যেখানে যত কুমারী ভূমি অনাহত অক্ষত হয়ে পড়ে থেকেছে এ—যাবৎ—কাল, সর্বত্র ঘা পড়েছে কোদাল—কুড়ুলের। গভীর গহ্বর কেটে কেটে ভিত খোঁড়া হচ্ছে। প্রাসাদ উঠছে আকাশ ফুঁড়ে, ছাদে উঠে নিচে তাকালে মাথা ঘোরে এমন অট্টালিকার মধ্যেও ঢুকে পড়ছে মানুষ। আবার এই জুতোর বাক্স, দেশলাই বাক্স, তাসের ঘরেও এসে নিচ্ছে আশ্রয়।
আশ্রয়টা চাই।
আর সেটা যতই বাড়িয়ে চলা হোক কুলোচ্ছে না। মানুষ নামক কীটটা মুহূর্তে বিস্তার করে চলেছে বংশ, রক্তবীজ হার মানছে, অতএব ইঁটের পর ইঁট সাজানোর বিরাম নেই।
সকালবেলা হাসপাতালে যাবার পথে কেন কে জানে এই দিকটা দিয়ে যাবার ইচ্ছে হল তুলসীর। যেখানে এই নতুন ব্লকগুলো তৈরী হচ্ছে।
তুলসীর মনটা কেমন যেন উদাস উদাস লাগছে। আবার গুচ্ছির মানুষ এসে ঢুকবে দেশটায়, রাস্তাঘাট দোকান—পশার কিলবিলিয়ে ছেয়ে যাবে নতুন পুরোনোর ভীড়ে।
তুলসী দেশটার কত পরিবর্তন দেখলো!
কতো ফাঁকা ছিল চারিদিক, কতো গাছগাছালি।
ওই নতুনগুলো যেখানে উঠছে, সেখানে বিরাট বিরাট ক’টা গাছ ছিল। তাতে ফলও ছিল না ফুলও ছিল না—শুধু ছায়া। তবু তার আকর্ষণেই চলে আসতো ওরা।
সুখেনই আগে—ভাগে টেনে আনত ওকে। বলতো, এই তুলসী, গাছে উঠতে যাবি?
হ্যাঁ, এইটাই তাদের স্পেশাল খেলা ছিল। গাছের ডালে উঠে পা দোলানো। তুলসীর অবশ্য ইস্কুলের বালাই ছিল না, কিন্তু ওদের তা ছিল। রেল কোম্পানীর বদান্যতার ফল বিনি মাইনের ইস্কুল। কিন্তু ক’দিন বা নিয়ম করে ইস্কুলে পড়তে যেতো ওই লক্ষ্মীছাড়া ছেলে তিনটে?
কিন্তু তিনটের মধ্যে এতো মিলের কারণ কি?
কারণটা হয়তো—প্রধান একটা জায়গায় একটা বিশেষ মিল ছিল বলে। তিনটেরই মা ছিল না। আর হয়তো ওই মিলের টানেই তুলসী নামের মেয়েটাও ওদের সঙ্গে জুটতে আসতো।
তুলসী ওই ইঁটের স্তূপ আর ভারার বাঁশগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেললো। কোথাও আর ফাঁকা জায়গা বলে কিছু থাকবে না।
আবার হঠাৎ মনে মনে হেসে উঠলো, থাকবে। শুধু মনের মধ্যেটায় থাকবে ফাঁকা। আর সেটা বেড়েই চলবে। বাইরে যত দম আটকে আসবে, ‘ফাঁকাটা’ আর কোথাও জায়গা না পেয়ে মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে পড়বে।
আচ্ছা, আজ আমি এদিক দিয়েই বা এলাম কেন? এটা তো ঘুর পথ, এটায় তো হাঁটতে হচ্ছে বেশী।
অসমাপ্ত ব্লকের পাশ কাটিয়ে চির—পুরানো বাড়ি গুলোর ধারের রাস্তায় পড়তেই কোনো একটা খুপরির সামনের দরজা থেকে একজন ডেকে উঠলো, ‘কী তুলসী? আজ এতো বেলায় যে?’
তুলসীকে অন্যমনস্কতা ত্যাগ করতে হলো। এগিয়ে গিয়ে হাস্যবদনে বলতে হলো, ‘এই একটু দেরি হয়ে গেছে বৌদি!’
‘এই শোনো, তোমার সঙ্গে একটা দরকারী কথা ছিল—’
‘বলুন।’
তারপর হঠাৎ চোখে—মুখে কৌতুক ফুটিয়ে গলা নামিয়ে বলে তুলসী ‘কী? আমাদের ওখানে ভর্তি হতে যাবেন নাকি?’
‘মরণ তোমার!’ বৌদি ঝলসে হেসে ওঠেন, ‘আবার মরতে যাবো আমি?’
‘মরতে কেন গো! বাঁচতে যাবেন।’
‘থাম বাপু! এই শোনো, আমার ননদ এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে, আজকালের মধ্যেই বোধহয় চালান দিতে হবে তাকে। তোমাকে যেন পাই সে সময়।’
‘এই সেরেছে! ডেটটা কী?’
‘সেই তো মুশকিল। একটু গোলমেলে আছে—’
‘তা হলে?’
‘ওসব জানি না বাবা! তোমাকে চাই। আমি ননদকে খুব আশ্বাস দিয়ে রেখেছি—বিশেষ করে রাত্তিরের জন্যে। সবাইয়ের নামেই তো বদনাম শুনি, ঘুমিয়ে পড়ে, পেসেণ্ট ডেকে সাড়া পায় না, নয় তো ঘুম ভাঙালে খিঁচোয়—’ গলা নামিয়ে বলে, ‘বাঙালীও তো তেমন নেই আর?’
‘আমার নামে বদনাম শোনেন না?’
‘তোমার নামে? ও বাবা! তোমার নামে তো জয় জয়কার।’
‘তাহলে তো তরেই গেলাম। আচ্ছা বৌদি যাই! দেখি আপনার ননদের দিনে—’
চলে যায় হনহনিয়ে।
প্রশংসায় মন প্রসন্ন হবারই কথা।
অথচ তুলসীর মনটা যেন বেজার হয়ে গেল। এই একটি মাত্র পরিচয় তুলসীর এই করণপুরে। ভাল আয়া!
প্রসূতিকে যত্ন করে, রাতে ঘুমিয়ে পড়ে না, মেজাজ ভাল, কথার গুণে চাঙ্গা করে তোলে পেসেণ্টকে।
না, আর কোনো পরিচয় নেই তুলসীর।
হাসপাতালে মুখোমুখি না হয়ে উপায় নেই। ঘাড়ে গর্দানে ডাক্তার ঘোষ। ঘাড়টা আরো গুঁজে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে প্যাসেজ পার হয়ে চলে যান। মাথার মাঝখানটা টাক, ঘাড়ে গুচ্ছির চুল। তাতে কাঁচার থেকে পাকার ভাগই বেশী।
গম গম করে হাসপাতাল কাঁপিয়ে রোগী দেখে বেড়ান উনি, সবাই যমের মত ভয় করে। বলে ‘বাঘ ডাক্তার।’
তুলসী ওঁর ওই তাড়াতাড়ি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে চলে যাওয়া দেখে মনে মনে হাসে। যমেরও যম আছে।
আশ্চর্য! মানুষ কী আজব জীব!
আর দিনের মানুষটার সঙ্গে রাতের মানুষটার কত তফাত!
* * *
রাজেন আর জগু গুম হয়ে বসেছিল।
সামনে সুখেন।
তলে তলে এই চালাচ্ছে তুলসী!
এটা যেন ওদের আশঙ্কার জগতে ছিল না। তুলসী বাচাল, তুলসী বেহায়া, তুলসী আড্ডা দেবার সময় মেয়ে—পুরুষে ভেদ করে না, তুলসী সাজে, তুলসী বিড়ি—সিগারেট খায়, তবু কোনখানে যেন অপরিসীম একটি বিশ্বাস ছিল তুলসীর উপর এই ছেলে তিনটের। সেই বিশ্বাসটির উপরই ওদের ভালবাসা ন্যস্ত ছিল।
কিন্তু সুখেন কাল রাত্রে যা দেখে এসেছে তার ওপর তো আর কথা চলে না। যাকে বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, তাই শুনিয়েছে সুখেন ওদের।
খোলাখুলিই স্বীকার করে যে ঈর্ষার জ্বালাতেই ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল সে। স্থিরনিশ্চয় করেছিল গিয়ে দেখবে রাজেন জগাই তখনো তুলসীর ওখানে আড্ডা মারছে, কিন্তু দূর থেকে দেখলো দাওয়া অন্ধকার।
পাপমনের চিন্তাও ব্যক্ত করেছে সুখেন তার আশৈশবের বন্ধুদের কাছে। জ্বালায় ছটফটিয়ে ভেবেছিল, ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢোকেনি তো ও দুটো?
আচ্ছা দেখে নেবে সুখেন। বন্ধুদের এই বেইমানীর শোধ নেবে।
কিন্তু আর একটু এগোতেই মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝিম মেরে গিয়েছিল সুখেনের।
ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে যে লোকটা তুলসীর বেড়ার দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে অন্ধকারে মিশে গেল, সে রাজেনও নয়, জগুও নয়।
সুখেন তাকে চেনে।
সুখেন দেখলো অন্ধকারে দাওয়ার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে তুলসী।
তার মানে দাঁড়িয়ে থেকে বিদায় দেওয়া হয়েছে।
ওরা গর্জন করে বলে উঠেছিল, ‘তুই কিছু বললি না? হাতে হাতে ধরে ফেললি যখন?’
যেন সুখেন তুলসীর গার্জেন। সুখেন কিন্তু সে কথা বলেনি।
সুখেন তখন একটু থেমেছিল।
সুখেন একটা গোপন কথা তার আশৈশবের বন্ধুদেরও বলতে পারেনি। বলতে পারেনি তুলসীকে ওই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেন কে জানে সুখেনের দু’চোখে হুশ করে জল এসে গিয়েছিল। সুখেন হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সটান উল্টোমুখ ধরে ফিরে এসেছিল।
সুখেন ওই গোপন কথাটা চাপা দিয়ে বলেছিল, ‘পিরবিত্তি হল না। তদ্দণ্ডেই ওকে ডেকে কথা কইতে পিরবিত্তি হল না।’
তারপর বসে আছে গুম হয়ে তিনজনে।
যেন যে ব্যাঙ্কটায় ওদের তিনজনেরই টাকা জমা ছিল, সেই ব্যাঙ্কটা ফেল হয়ে যাবার খবর এসেছে ওদের কাছে।
লেভেল ক্রশিংয়ের ওধারে যে একটা ইঁটের ঢিবি মতন আদি অন্তকাল পড়ে আছে, তার উপর বসে ছিল ওরা। যেন কথাবার্তা, সব ফুরিয়ে গেছে।
তাই নিঃশব্দে শুধু একটার পর একটা বিড়ি টেনে চলেছিল।
কিন্তু কে জানতো এমন অসময়ে এবং অনুপযুক্ত জায়গায় হঠাৎ স্বয়ং অভিযুক্ত আসামীই এসে হাজির হবে।
পরস্পরে তাকাতাকি করলো।
দিব্যি তো মটমট করে আসা হচ্ছে।
লজ্জার বালাই মাত্র নেই।
থাকবে কেন? বড় গাছে নৌকো বেঁধেছেন যে!
এই নতুন বেঁধেছে, কি কতকাল বেঁধেছে, কে জানে। কিন্তু এদিকেই বা আসছে কেন?
‘কেউ কথা কসনে।’
বলে ওরা ঊর্ধ্বমুখে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে।
‘তোরা এখানে? আর আমি তোদের খুঁজে খুঁজে—’
তুলসী ওদের ঠেলে দিয়ে একপাশে বসে পড়ে বলে, ‘রাজরাস্তা থেকে কোণে এসে বসে তিন শেয়ালে কী যুক্তি হচ্ছে?’
ওরা কেউ কোনো কথা বললো না। যা করছিল তাই করতে লাগলো। ব্যাপারটা অভিনব।
সুখেনের না হয় অভিমানের কারণ আছে, কাল রাত্রেই সেটা দেখিয়ে চলে গিয়েছিল গটগটিয়ে। আর দুটোর হঠাৎ কী হল? রাত দুপুর পর্যন্ত তো দেখা হয়েছে। গাল—গল্প করতে করতে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। সুখেনের অপমানে ওদের অপমান, এমন চিহ্ন তো প্রকাশ পায়নি।
তুলসী দু হাতের তালু উল্টে বলে, যা বাব্বা! একটার মুখে—ও কথা নেই যে! মুখ দেখে মনে হচ্ছে বৈরাগী হয়ে যাবি। তিন জনেই এক পথের পথিক হচ্ছিস তাহলে? কাপড়চোপড় গেরুয়ায় ছুপিয়ে—টুপিয়ে নিয়েছিস নাকি? হরে—কেষ্ট কাপড়ই বা কোথা? সবই তো পেণ্টুল। নাঃ। গোড়াতেই মৌনীবাবা! ছাড় দিকি, একটা বিড়ি ছাড়।’
আর চুপ করে থাকতে পারে না রাজেন।
বলে ওঠে, ‘কেন? ওসব ছোটলোকের জিনিসে তোর দরকার? তোর তো ওর গন্ধে মাথা ধরে।’
‘ধরতো! তা কী আর করা যাবে। ফুরিয়ে গেছে। নেই।’
অগত্যাই দেশলাইটা আর প্রার্থিত বস্তুটা এগিয়ে দিয়ে রাজেন বাঁকা গলায় বলে, ‘রাজরাণীর আবার অন্নের অভাব? এখন তো বড় গাছে নৌকো বেঁধেছিস, অভাব কিসের? ফুরোবার আগেই যোগান হবে।’
তুলসী ভুরু কুঁচকে ওদের বিদ্বেষ—বিষাক্ত মুখ তিনটে দেখে বলে, ‘কিসে নৌকো বেঁধেছি?’
‘কিসে বেঁধেছিস নিজেই ভাল জানিস। মনে করেছিলি ডুবে ডুবে জল খেলে শিবের বাবাও টের পায় না। তা হয় নারে! ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।’
তুলসী অনায়াসে ধোঁয়া উড়িয়ে বলে, ‘ধর্মের কল কোথায় নড়ে ধর্মই জানে, এখন আপাতত তোদের মাথায় কোনোখানে পোকা নড়েছে। কী যে আবোল—তাবোল বকছিস। এলাম তোদের কাছে একটা বিপদে পড়ে পরামর্শ করতে—’
‘বিপদ! ওঃ!’ সুখেন সন্দেহ—বিকৃত মুখে ভারী গলায় বলে, ‘তা বিপদটা কী শুনতে পাই না?’
‘শোনাবার জন্যেই তো এসেছি, তা তোরা দেখছি কেবল ব্যাঁকা কথাই কইছিস। ব্যাপারটা কী?’
‘ব্যাপার কিছু না। গরীব হতভাগাদের কথায় কান দেওয়ার দরকার নেই।’
‘এই সুখেনটা শুধু হতভাগাই নয়, ইল্লুতে ছোটলোক।’
তুলসী তীব্র গলায় বলে, ‘কী একটু বলেছি, তাতেই নুনের নৌকো ডুবে গেছে। বলি জগৎ—সংসারে যে বাঘ ভাল্লুক জন্তু—জানোয়ারই বেশী এটা তো মিথ্যে নয়? কে কখন জানোয়ার হয়ে ওঠে বলাও শক্ত। কাল রাত্তিরে তোরা দু’জনে আমায় পৌঁছে দিয়ে যেমনি পিছু ফিরেছিস, তেমনি দেখি সামনে এক কুকুর!’
‘কুকুর!’
জগাই বলে, ‘সে তো আমরা তাড়িয়ে দিয়ে এলাম।’
‘কাকে তাড়িয়ে দিয়ে এলি?’
‘কেন, সেই বীরভদ্দর কেলে কুকুরটাকে।’
‘ও, সেইটা? সেটা আর কী এমন? সে তো কুকুরের মতন দেখতে কুকুর—’
তুলসী হাতের বিড়িটা শেষ না হতেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সাপিনীর মত হিস হিস করে বলে, ‘মানুষের চামড়া ঢাকা কুকুরটাকে তো তাড়িয়ে দিয়ে আসিসনি? আঃ, আর একটু যদি এগিয়ে আসতিস! বেড়ার দোর থেকে ছেড়ে না দিয়ে দাওয়ায় তুলে দিতিস। দেখতে পেতিস মানুষের চামড়া মোড়া কুকুর আরো কত ভয়ঙ্কর!’
সুখেন ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘লোকটা কে?’
‘বলে আর কী হবে—’
তুলসীর গলায় ঔদাসীন্য, ‘সমাজের মাথা একজন কেষ্টবিষ্টু বেক্তি, এই আর কী?’
‘নাম বল তুলসী! সেই ‘মাথা’র মাথাটা দু’চির করে দিয়ে আসি।’
‘তাতে কেলেঙ্কারী বাড়বে বৈ কমবে না সুখেন!’
তুলসী গভীর গলায় বলে, ‘একটা ছোটলোক আয়ার ইজ্জতের থেকে ওসব মাথার দাম হাজার গুণ বেশী।’
‘তার মানে লোকটাকে তুই বাঁচাতে চাস?’
‘তা মিথ্যে বলবো না সুখেন, ওর মতন বিচক্ষণ ডাক্তার তো আর এ তল্লাটে নেই—’
‘ডাক্তার!’
‘এইরে বলে মলাম! যাক ওই পর্যন্তই। শুধু এই কথাই বলছি, ওর মাথাটা দুফাঁক হয়ে গেলে, রুগীগুলোর কপাল বেবাক ফাঁকা হয়ে যাবে।’
‘এই সব পাজী লোক একটা বিদ্যে শিখেছে বলে তাদের ইহ—পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে?’
‘তা এই তো এ জগতের নিয়ম রে জগাই! কত কেষ্ট—বিষ্টুর ফর্সা জামার নীচে কত কাদা। তবু তারা পৃথিবীর কাজে লাগছে বলে সমাজ—সংসারে মাথার মণি।’
রাজেন এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এখন ক্ষুব্ধ গলায় বলে ওঠে, ‘আর আমরা যারা পৃথিবীর কোন কাজে লাগি না, তারা সমাজ সংসারের জুতোর সুখতলা। এই তো?’
‘যা বলেছিস! কিন্তু তুই না বললেও সেই কুকুরটা যে কে আমি ধরতে পারছি, ওই বুড়ো বজ্জাতটা এর আগে অনেক কীর্তি করেছে। ওকে শেষ করলে একটা পুণ্যের কাজ হবে।’
তুলসী হতাশ গলায় বলে, ‘তোদের মাথায় শুধু ওই শেষ করাই ঘুরছে। ওতে আমি ভরসা পাবো না। ছারপোকার বংশ যত মারো ততই বাড়ে। একটা কুকুর মেরে আর কতটুকু আসান হবে? আমি তোদের কাছে অন্য কথা বলতে এসেছিলাম!’
বলতে এসেছিলাম!
তাই তো। তারা তো সেটা তেমন ভাবেনি। ভেবেছে এমনি এসে বসেছে।
‘কি বলতে এসেছিলি?’
তিনজনে একযোগে একই কথা বলে ওঠে।
তুলসী কাঁধের আঁচলটা টেনে বেশ চোস্ত হয়ে বসে।
কারুর মুখের দিকে না তাকিয়ে, সামনের রেলের ওই গুমটি ঘরের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে ‘বলছিলাম, বেড়ালের মুখ থেকে মাছ আগলাতে আগলাতে জীবন মহানিশা হয়ে গেল! অথচ বেড়াল—কুকুর নিধন করে এ সমিস্যের সমাধান হয় না বুঝলি? একমাত্তর সমাধান, মাছটাকে যেখানে সেখানে ফেলে না রেখে শিকেয় তুলে রাখা। তাই ঠিক করেছি নিজেকে আর এমন বেওয়ারিশ ফেলে না রেখে একটা ওয়ারিশানের হাতে তুলে দেব। যুদ্ধ করে করে আক্লান্ত হয়ে গেছি।’
তুলসী আঁচল তুলে ঘাড়ের ঘাম মোছে।
সুখেন, রাজেন, জগাই পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
তুলসীর কথায় এ যে এক অদ্ভুত নতুন সুর!
এই অদ্ভুত কথাটার যথার্থ মানে কী?
তাহলে কি তুলসী তলে তলে কিছু ব্যবস্থা করে ফেলেছে?
কিন্তু তুলসী যে বড় ‘আক্লান্ত’।
তুলসীর মুখটা দেখে মায়া আসছে। চিরদিনের সেই তেজে—মটমটে তুলসী যেন উদাস বিষণ্ণ!
কে কি বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বলেই বোধহয় তিনজনেই উসখুস করে, অথচ কিছুই বলতে পারে না।
তুলসী আবার বলে, ‘পোড়ারমুখো ভগবান, মেয়েজাতটাকে এমন অসহায় করেও গড়েছিল! দেহখানাকে সন্দেশ মণ্ডার মতন লোভের বস্তু করে রেখে দিয়েছে। এ শাস্তিটা ভগবান দিল কেন মেয়েমানুষকে তাই বল? এ পাপ না থাকলে মেয়ে পুরুষ সমান হয়েও পৃথিবীতে চলতে পারতো। তা হবে কেন? বিধাতা পুরুষ যে নিজে পুরুষ, তাই মেয়েজাতটার সুখ—দুঃখ বোঝেনি। মরুকগে—যা করেছে তার তো আর চারা নেই! মেয়েমানুষ জাতটাকে চিরটাকাল ফাঁসির আসামী হয়েই থাকতে হবে। যাক ওসব কথা—আসল কথাটাই বলি স্পষ্ট করে—ভেবে দেখলাম একটা বিয়ে করে ফেলাই হচ্ছে সমিস্যে সমাধানের উপায়।’
‘বিয়ে! মানে তোর?’
জগাই বলে ফেলে বোকার মত।
‘তোরও হতে পারে—’
তুলসী হেসে ওঠে, ‘বিয়ে করতে হলে তোদের মধ্যেই একজনকে করা ভাল। এই বয়সে আর একটা অচেনা অজানা নতুন লোকের সঙ্গে ভাব ভালবাসা জমানো পোষাবে না। তোদের সঙ্গে চিরকালের ভালবাসা! এখন বল কে রাজী আছিস?’
কে রাজী আছে!
তিন তিনটে সা—জোয়ান ছেলে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
এ আবার কেমন ধরনের প্রস্তাব।
তুলসীর যেন সবটাই অদ্ভুত!
তবু সুখেনই তাড়াতাড়ি প্রস্তাবটাকে হাতে তুলে নেয়। বলে ওঠে, ‘রাজী না থাকার কথা উঠছে কোথা থেকে?’
ইস!
সুখেনটা কী চালু! ফটকরে উত্তরটা দিয়ে বসলো!
রাজেন আর জগাই জিভ কামড়ায়।
এ কথাটা তো আমিও বলতে পারতাম!
তবে রাজেন পিঠোপিঠিই বলে, ‘সত্যি, রাজী হওয়া না হওয়ার কথাই নেই তুলসী, তুই যাকে পছন্দ করবি—’
”হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই কথাই তো ঠিক—’জগাইও নিজের কথাটা বলে নেয়, ‘তুলসীর যখন এতোদিনে বিয়ের ইচ্ছে, মানে বিয়ের মত হয়েছে—’
তুলসী গম্ভীর মুখে বলে,—ইচ্ছেও নয়, পছন্দও নয়, মত হওয়া—হয়িও নয়, স্রেফ দায়ে পড়ে তোদের কাছে এসে পড়েছি। বলতে পারিস, তোদের শরণ নিচ্ছি। নিজের ভার আর নিজে বইতে পারছি না। একজনের বিয়ে করা বৌ হয়ে গেলে পাঁচজনে আর মানুষটাকে পাবলিকের সম্পত্তি ভাবতে সাহস করবে না।’
তিনজনেই একসঙ্গে কিছু কথা বলে ওঠে।
ঠিক বোঝা যায় না, তাদের ব্যাকুলতা বোঝা যায়।
অকস্মাৎ এই প্রস্তাবের আঘাতে ওরা প্রায় বিমূঢ়।
আশ্চর্য! তুলসী যদি বললোই তো এই ভাবে বললো!
সুখেন মনে মনে কপালে করাঘাত করে।
তুলসী কি জানেনা সেই শৈশবকাল থেকে সুখেন তুলসী বলে মরে যায়? জানে না তুলসীকে সে কী চক্ষে দেখে? অথচ একটি বার একা সুখেনকে ডেকে বলতে পারলো না, ‘সুখেন, ভাবছি এবার বিয়েটা করে ফেলি।’ বাকি কথা সুখেনই বলতো।
ওর ইচ্ছেটুকু প্রকাশের পর আর কিছু করতে হত না তুলসীকে। …সুখেনও তো ঠিক করে ফেলেছিল, এবার একটা বিয়েই করে ফেলবে। সে বিয়ের কনে যদি তুলসী হয়, তার থেকে সুখের আর কী আছে।
কিন্তু তুলসী কিনা রাজরাস্তার মাঝখানে একসঙ্গে তিন তিনটে লোককে বলে বসলো, ‘আমায় কেউ বিয়ে করবি?’
ছি ছি, এতো বুদ্ধি ধয়ে তুলসী, আর এই বুদ্ধির পরিচয় দিল!
সুখেন গাঢ়স্বরে বললো, ‘তুই তো জানিস তুলসী, তোকে আমি চিরকাল কী চক্ষে দেখি—’
‘আহা সে তো জানিই।’
তুলসী অনায়াসেই বলে, ‘তোদের তিন জনকেই জানি। আমার কোন ‘সারপর’ নেই। তোদের মধ্যে যার সুবিধে হবে, যার অবস্থায় কুলোবে, তার সঙ্গেই বিয়েয় বসে যেতে রাজী। কিন্তু এই দণ্ডে জবাব চাইছি না, দুটো দিন সময় দিলাম, ভেবে—চিন্তে দেখ ঘরে গিয়ে। নিজের নিজের মনকে জিজ্ঞেস কর। আমার আর কী! এতো এতো দিনই যদি পারলাম আর ক’টা দিন চালিয়ে দেব। বুড়ো বদমাইসটা এখন দু’চারটে দিন বোধহয়—’ তুলসী উঠে দাঁড়ায়।
হাত বাড়িয়ে বলে, ‘দে আর একটা দে। চলি।…ভেবে—চিন্তে উত্তর দিবি আমায়। সুখেনের তো মস্ত একটা অসুবিধে, ওই পিসি! সে কি আর একটা সরকারী হাসপাতালের আয়াকে বৌ করে ঘরে তুলতে রাজী হবে?’
‘পিসিকে আমি থোড়াই কেয়ার করি।’
বীরবিক্রমে গর্জন—করে সুখেন, ‘আমার যে মেয়েকে ইচ্ছে তাকেই বিয়ে করবো।’
‘বাপও তো আছে তোর।’
‘বাবার কথাও বাদ দে। সাতেও নেই পাঁচেও নেই, দুটো বাড়াভাত পেলেই হলো।’
রাজেন মনে মনে নিশপিশ করে।
সব কথাগুলো সুখেনটাই বলে নিচ্ছে।
আচ্ছা দুটো দিন তো সময় দিয়েছে, তার মধ্যে রাজেনের নিজের যা বলার বলবে।
সুখেন যতই বলুক, ওর ওই পিসি বুড়ি ফ্যাচাং তুলবেই। সে দিক থেকে আমার বাবা বেপরোয়া।
আর জগাই মনে মনে হিসেব করতে থাকে, তিনজনের মধ্যে চাকরীটা কার সবচেয়ে ভালো, মাইনেটা কার আর দুজনের থেকে বেশী…জগাই তোদের মতন কথায় অতো চৌকস না হতে পারে, তাস খেলতে হেরে মরতে পারে, কিন্তু চাকরীটা তারই ভালো, মাইনেটা তারই বেশী।…তা ছাড়া তুলসীর নিজের আয়ও তো কম নয়। সংসার সুখেই চলবে।
ভাবে জগাই, যা বলবার পরে বলবো।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন